ইকবাল ও জুয়াকে টাঙ্গায় করে চন্দননগর থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ইকবালকে বেশ সম্মানই দেয়া হলো। তাকে সামনের সিটের মাঝখানে বসানো হলো। কোচোয়ান তার নিজের সিট ছেড়ে ঘোড়ার পাশে কাঠের ওপর বসল। জুগ্গাত্ব সিং বসিল পিছনের সিটে, দুই পুলিশের মাঝখানে। রেল রাস্তার ধার দিয়ে দীর্ঘ এই রাস্তাটি ছিল কাঁচা। এই ভ্ৰমণে একমাত্র জুগারই কোন কষ্ট হচ্ছিল না। সে পুলিশদের চেনে, পুলিশরাও তাকে চেনে। তাছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতি তার কাছে নতুন নয়।
থানায় বোধ হয় এখন অনেক বন্দী আছে? জুগ্গা কথা শুরু করল।
না, একজনও নেই, একজন কনষ্ট্রেবল উত্তর দিল। আমরা দাঙ্গাকারীদের গ্রেফতার করি না। তাদেরকে আমরা কেবল ছত্রভঙ্গ করি। অন্যান্য অপরাধ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমাদের নেই। গত সাত দিনে এই প্রথম আমরা দুজন লোককে গ্রেফতার করলাম। থানার দু’টো কামরাই খালি। পুরো একটা কামরায় তোমরা একজন থাকতে পারবে।
বাবুজীর এ ব্যবস্থা পছন্দ হবে। তাই না বাবুজী? জুগ্গা জিজ্ঞাসা করল।
ইকবাল এ কথার কোন জবাব দিল না। জবাব না পাওয়ায় জুগ্গা কিছুটা আহত হলো। তবু সে হতোদাম হলো না। সে আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করল।
হিন্দুস্তান-পাকিস্তান নিয়ে যা চলছে তা নিয়ে তোমাদের অনেক কাজ করতে হচ্ছে, তাই না? একজন কনষ্টেবলের দিকে তাকিয়ে সে বলল।
হ্যাঁ, সব দিকে কেবল খুন। আবার পুলিশ বাহিনীর সদস্যও কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে।
কেন, তারা কি পাকিস্তানে যোগ দিয়েছে?
তারা ওপারে যোগ দিয়েছে কি না। আমরা জানি না। তারা শুধু প্রতিবাদ করছে যে, তারা ওপারে যেতেই চায় না। স্বাধীনতার দিন সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেব সব মুসলমান পুলিশকে অস্ত্ৰহীন করেন। এরপর তারা পালিয়ে গেছে। তাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল। মুসলমানদের কাজই এ রকম। তাদের বিশ্বাস করা কঠিন।
হ্যাঁ, অন্য কনষ্টেবলটি এ কথার সমর্থন জানিয়ে বলল, মুসলমান পুলিশরা এক পক্ষ সমর্থন করায় দাঙ্গার চেহারা বদলে গেছে। লাহোরের হিন্দু ছেলেরা মুসলমানদের নাজেহাল করতে পারত। কিন্তু পুলিশের জন্য পারেনি। তারা অনেক অত্যাচার করেছে।
তাদের সেনাবাহিনীও ঐ রকম। যে সব এলাকায় শিখ বা গুর্খা সেনাদলের ছাউনিতে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ নেই, সেসব এলাকায় বেলুচ সৈন্যরা লোককে গুলি করে মারছে।
তারা খোদার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। খোদার হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারে না, জুগ্গা বেশ আস্থার সাথেই বলল। সবাই যেন একটু অবাক হলো। এমন কি ইকবালও মাথা ঘুরিয়ে পরখ করে নিল যে, ঐ কথা জুগ্গার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে।
তাই না বাবুজী? আপনি চালাক মানুষ। আপনিই বলুন। খোদার গজব থেকে কেউ পালিয়ে যেতে পারে?
ইকবাল কিছুই বললেন না।
না, কেউ পারে না, জুগ্গা নিজেই উত্তর দিল। মিত সিং আমাকে যা বলেছিল, তার কিছু আপনাকে বলছি। খুব মূল্যবান কথা বাবুজী। ষোলো আনা খাঁটি কথা।
জুগ্গার কথায় ইকবাল কোন আগ্রহ দেখাল না।
জুগ্গা কিন্তু থামল না। ভাইজী আমাকে বলেন : এক ট্রাক ভর্তি বেলুচ সৈন্য অমৃতসর থেকে লাহোর যাচ্ছিল। পাকিস্তান সীমান্তের কাছে এসে তারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া শিখদের ওপর বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে। কোন সাইকেল আরোহী বা পায়ে হাটা লোককে দেখলে গাড়ির ড্রাইভার গতি কমিয়ে দেয়। আর দরজার কাছে দাঁড়ানো সৈন্যরা তাদের পিছন দিক থেকে ছুরিকাঘাত করে। এরপর ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। এভাবে তারা বহু লোককে মারে। তারা যতই পাকিস্তানের নিকটবর্তী হচ্ছিল ততই তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠছিল। তারা সীমান্তের এক মাইলের মধ্যে এসে জোরে গাড়ী চালাচ্ছিল। তারপর তাদের কি হলো কেউ চিন্তা করতে পার?
কি হলো? একজন কনস্টেবল জিজ্ঞাসা করল। ইকবাল ছাড়া সবাই তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এমন কি কোচোয়ানও ঘোড়াকে চাবুক মারা থামিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে রইল।
শুনুন বাবুজী, খুবই দামী কথা। একটা পথের কুকুর রাস্তা পার হওয়ার জন্য দৌড় দিল। যে ড্রাইভারটি এতগুলো লোকের খুনের সাথে জড়িত সেই ড্রাইভারই কুকুরটাকে বাঁচাবার জন্য গাড়ির স্টিয়ারিং ডানদিকে কাটাল। গাড়িটি ধাক্কা খেল একটা গাছের সাথে। ড্রাইভার আর দুজন সৈন্য নিহত হলো সেখানেই। মারাত্মকভাবে জখম হলো অন্য সবাই। এ ঘটনার ব্যাপারে তোমরা কি বলবো?
পুলিশরা গুঞ্জন করে তাদের মতামত জানাল। ইকবাল বিরক্ত হলেন।
এই দুৰ্ঘটনা কে ঘটাল, কুকুর না খোদা? বেশ উত্তেজিত হয়েই সে জিজ্ঞাসা করল।
নিশ্চয়ই খোদা, একজন পুলিশ উত্তর দিল। যে ড্রাইভার মানুষ মারতে আনন্দ পেয়েছে সে কেন একটা রাস্তার কুকুরকে গাড়ির তলায় চাপা দিতে পারল না?
তোমরাই বল, ইকবাল ঠাণ্ডা মেজাজে বললেন। জুগ্গা ছাড়া সবাইকে লক্ষ্য করে তিনি ঐ কথা বললেন। জুগ্গা যে অদম্য তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। জুগ্গা টাঙ্গার কোচোয়ানের দিকে তাকাল। কোচোয়ান ঘোড়ার পিঠে আবার চাবুক মারতে শুরু করল।
ভোলা, তোমার কি খোদার ভয় নেই, ঘোড়াটাকে এমন নির্দয়ভাবে মারছ?
ভোলা চাবুক মারা বন্ধ করল। কিন্তু তার চোখে-মুখে বিরক্তির ভাব প্রকাশ পেল। যেন সে প্রকাশ করতে চাইল, এটা তার ঘোড়া-এটা নিয়ে সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।
ভোলিয়া, ব্যবসা কেমন চলছে এখন? জুগ্গা জিজ্ঞাসা করল। তার মনের চাপা ক্ষোভ কিছুটা মিটানোর জন্য।
খোদা দয়ালু, কোচোয়ান তার চাবুক আকাশের দিকে উঁচু করে বলল। তারপর সে যোগ করল, ইন্সপেক্টর সাহেবও খুব দয়ালু। আমরা বেঁচে আছি। কোন রকমে খাবার যোগাড় করছি।
যে সব লোক পাকিস্তান যেতে চাচ্ছে তাদের কাছ থেকে তুমি টাকা কামোচ্ছ না? টাকার জন্য কি জান দেব? ভোলা রাগ করেই জবাব দিল। না, তোমাকে ধন্যবাদ ভাই। তুমি যে পরামর্শ দিলে তা তুমি নিজের জন্যই রাখ। উন্মত্ত লোকগুলো যখন আক্রমণ করে তখন তারা কে হিন্দু আর কে মুসলমান দেখে না। তারা শুধু হত্যা করে। এই তো সেদিন চারজন শিখ সরদার জীপ গাড়িতে চড়ে একদল মুসলমান উদ্বাস্তুকে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সতর্ক না করেই তারা তাদের স্টেনগান থেকে গুলি ছুঁড়ল। চারটে স্টেন গান। একমাত্র খোদাই জানে তারা কয় জনকে হত্যা করেছে। আমার টাঙ্গায় যদি মুসলমান থাকত। আর উন্মত্ত জনতা যদি আক্রমণ চালাত, তাহলে কি হতো? তারা প্রথমে আমাকে খুন করত এবং পরে অন্যদের দেখত।
জীপের তলায় একটা কুকুর গিয়ে তা উল্টে দিল না কেন? ইকবাল রসিকতা করে জিজ্ঞাসা করল।
সবাই হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। খিটখিটে স্বভাবের এই বাবুকে কি বলবে তা কেউ বুঝতে পারল না। জুগ্গা সহজভাবে বলল,
বাবুজি, আপনি কি বিশ্বাস করেন না, খারাপ কাজের ফল খারাপ হয়? এটা কর্মের ফল। একথা ভাইজি প্রায়ই বলতেন। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে গুরু একই কথা বলেছেন।
হ্যাঁ, ষোল আনা ঠিক কথা, ইকবাল উপহাস করে বললেন।
ঠিক আছে। আপনি যে রকম মনে করেন, হাসতে হাসতে জুগ্গা বলল, আপনি সাধারণ লোকের সাথে একমত হবেন না। সে কোচোয়ানের দিকে লক্ষ্য করে বলল, আমি শুনেছি, অনেক মহিলাকে ধরে নিয়ে সস্তায় বিক্রি করা হচ্ছে। তুমি নিজের জন্য একটা বউ যোগাড় করে নিতে পারতে।
কেন সর্দার, তুমি তো বিনা পয়সায় একটা মুসলমান মেয়েকে পেয়েছ। আমি কেমন মরদ যে, একটা লুঠের মেয়েকে গ্ৰহণ করব? ভোলা জবাব দিল।
জুগ্গা অবাক হলো। তার রাগ বেড়ে চলল। ভোলার কথায় পুলিশরা চাপা হাসি হাসলেও জুগ্গাত্ সিং-এর দিকে তাকিয়ে তারা ঘাবড়ে গেল। ভোলা তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইল।
কেন জুগিয়া, সে স্বাভাবিকভাবে বলল। তুমি অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা করছি, অথচ কেউ তার জবাব দিলে তুমি রাগ করছ।
আমার হাতে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি না থাকলে তোমার শরীরের সব হাড় টুকরা টুকরা করে দিতাম, জুগ্গা বলল ক্রুদ্ধভাবে। তোমার কপাল ভালো যে, আমার হাত থেকে রেহাই পেলে। কিন্তু একথা তোমার মুখ থেকে দ্বিতীয়বার শুনলে আমি তোমার মুখ থেকে জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলব। জুগ্গা শব্দ করে থুথু নিক্ষেপ করল।
ভোলা রীতিমত ভয় পেল। রাগ করো না। আমি কি …
বেজন্মা কোথাকার!
আলোচনার সমাপ্তি ঘটল। এখানেই। টাঙ্গায় সবাই নীরবে বসে রইল। ঘোড়াকে উদ্দেশ করে ভোলা যে সব কথা বলছিল, তা-ই কেবল নিস্তব্ধ নীরবতাকে ভেদ করে বেরিয়ে আসছিল। জুগ্গা ডুবে ছিল ক্রুদ্ধ চিন্তায়। সে অবাক হলো যে, তার গোপন অভিসার সাধারণ লোকের অগোচরে নেই। কেউ হয়ত তাকে দেখে ফেলেছে অথবা নূরান হয়ত এ নিয়ে কারও সাথে আলাপ করেছে। গুজবের সূত্রপাত হয়ত ওটাই। চন্দননগরের টাঙ্গা চালক যা জানে, মানো মাজরার সব লোক তা না জানার কোন কারণ নেই। যাদের নিয়ে এই গুজব, তারাই এ সম্পর্কে কিছু জানে না। সম্ভবত গ্রামে একমাত্র ইমাম বখশ ও তার মেয়ে নূরান এই গুজব সম্পর্কে কিছুই জানে না।
চন্দননগরে ঐ দলটি পৌঁছাল দুপুরের পরে। থানা চত্বরের বাইরে টাঙ্গা থামল। শহর থেকে কয়েক ফার্লং দূরে থানার অবস্থান। একটা গেটের নিচে দিয়ে রক্ষীরা বন্দীদের নিয়ে গেল। ঐ গেটের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা-স্বাগতম। তাদের প্রথম নিয়ে যাওয়া হলো রিপোর্টিং রুমে। হেড কনস্টেবল একটা মোটা রেজিস্ট্রার খুলে বিভিন্ন পৃষ্ঠায় ঐ দিনের ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করলেন। টেবিলের সামান্য ওপরে দেওয়ালে টাঙ্গানো সম্রাট জর্জ (ষষ্ঠ)-এর ছবি। তার নিচে উরদুতে লেখা ঘুষ গ্রহণ অপরাধ। অন্য দেওয়ালে গান্ধীর একটা রঙিন ছবি, ক্যালেন্ডার থেকে কেটে নেয়া। এর নীচে লেখা একটি আদর্শের কথা সততাই উত্তম নীতি। দেওয়ালে আরও অনেকের ছবি আছে। এরা হলো পলাতক অসৎ চরিত্রের লোক এবং নিখোঁজ ব্যক্তি।
দৈনন্দিন ডায়েরিতে সব কিছু লিপিবদ্ধ করার পর বন্দীদের আঙ্গিনা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো সেল-এর কাছে। ঐ থানায় মাত্র দু’টো সেল। এই সেলের আঙ্গিনা পুলিশ ব্যারাকের দিকে।
জুগ্গার উপস্থিতিতে থানায় যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল! ও জুগ্গা, তুমি আবার এলে। তুমি কি মনে কর, এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি? ব্যারাক থেকে একজন কনস্টেবল বলল।
হ্যাঁ, তাই। পুলিশের কন্যা সন্তানের সংখ্যা দেখে এটা ঠিক করেছি, জুগ্গাত্ সিং চিৎকার করে জবাব দিল।
বদমায়েশ কোথাকার! তুমি তোমার বদমায়েশি ছাড়লে না। আসুক ইনন্সপেক্টর সাহেব। তিনি তোমার এ কথা শুনলে তোমার পাছায় শুকনা ঝালের গুড়া ঢেলে দেবেন।
জামাইয়ের সাথে তোমরা এ কাজ করতে পারবে না।
ইকবালের ব্যাপারে ঘটনা অন্য রকম। ক্ষমা চেয়ে তার হাতকড়া খুলে নেয়া হলো। তাঁর সেলে একটা চেয়ার, একটা টেবিল ও একটা খাটিয়া দেয়া হলো। হেড কনস্ট্রেবল উর্দু ও ইংরেজী সব সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন যোগাড় করে ইকবালের সেলে পাঠিয়ে দিলেন। পিতলের থালায় ইকবালের খাবার দেয়া হলো। একটা কলসি ও একটা গ্লাস দেয়া হলো তাঁর সেলে। জুল্লার সেলে কোন আসবাব দেয়া হলো না। সত্যি কথা বলতে কি, তার খাবার ছুড়ে দেয়া হলো। রুটি সে হাতে নিয়েই খেল। লোহার বেষ্টনীর মধ্য থেকে সে হাত বাড়িয়ে দিলে একজন কনস্টেবল তাতে পানি ঢেলে দিল। সেই পানি খেয়ে সে তৃঞ্চ মেটাল। জুল্লার বিছানা হলো সিমেন্টের শক্ত মেঝে।
দু’জনের ক্ষেত্রে আচরণের এই বিভিন্নতায় ইকবাল বিস্মিত হলো না। যে দেশ কয়েক শতাব্দী ধরে জাতিভেদ প্রথা গ্ৰহণ করে নিয়েছে, সে দেশে সাম্যহীনতা একটা জন্মগত ধারণা। জাতিভেদ প্রথা আইন করে তুলে দেয়া হলেও শ্রেণী বৈষম্যের আবরণে ঐ প্রথা চালু থাকবে। পশ্চিমা ভাবধারায় সৃষ্ট দিল্লীর সেক্রেটারিয়েটে সরকারী কর্মকর্তাদের গাড়ি রাখার জায়গাও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে করা হয়। অনেক অফিসে প্রবেশ পথ শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকতাঁর জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়। প্রক্ষালণ কক্ষও তেমনিভাবে সিনিয়ার অফিসার, জুনিয়ার অফিসার, ক্লার্ক, স্টেনোগ্রাফার বা অন্যান্য পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত। শ্ৰেণীভিত্তিক এই মানসিক প্রস্তুতির কারণে একই অপরাধে অপরাধী বা দোষী সাব্যস্তদের মর্যাদা দান বেখাপ্পা মনে হয় না। ইকবালকে দেয়া হলো প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা। আর জুগ্গাকে দেয়া হলো সবচেয়ে নিচের তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদা।
দুপুরের খাবারের পর ইকবাল চারপায়ের ওপর শুয়ে পড়লেন। জুগ্গার সেল থেকে নাক ডাকার শব্দ পেলেন। কিন্তু তিনি নিজে ঘুমাতে পারলেন না। তাঁর মনে বিক্ষোভের ঝড় বইতে লাগল। তাঁর মনটা যেন কোন ঘড়ির সূক্ষ্ম ম্পিং-এর মতো, যা একবার স্পর্শ করলে কয়েক ঘণ্টা ধরে কম্পিত হতে থাকে। তিনি উঠে বসলেন। হেড কনস্টেবল যে সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন রেখে গেছেন তা নাড়াচাড়া করলেন। সব পত্রিকাই যেন একই রকম। একই সংবাদ, একই বিবৃতি, একই সম্পাদকীয়। কেবল শিরোনামের শব্দের বিভিন্নতা ছাড়া সব কিছুই যেন একই লোকের লেখা বলে মনে হয়, এমন কি ছবিগুলোও একই রকম। হতাশ হয়ে তিনি পাত্রপাস্ত্রীর বিজ্ঞাপন দেখতে শুরু করলেন। এতে অনেক সময় চিত্তবিনোদনকারী কিছু থাকে। কিন্তু পাঞ্জাবের যুবকরাও যেন সংবাদপত্রের সংবাদের মতো একঘেয়েমিপূর্ণ। তারা ভাবী স্ত্রীর যে গুণ কামনা করে তা বৈচিত্র্যহীন। সবাই চায় কুমারী মেয়ে। যারা একটু উদার, তাদের অবশ্য বিধবাকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। তবে শর্ত হলো, নিঃসন্তান হতে হবে। প্রত্যেকে এমন মেয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দেয় যে হবে লম্বা ও আকর্ষণীয় অথবা গৃহকৰ্মে নিপুণ। যারা একটু আধুনিক ও উদার, তাদের অবশ্য
জাতি বা যৌতুক কোন প্রতিবন্ধক নয়। ভাবী স্ত্রীর ফটো অনেকে চায় না। সৌন্দৰ্য বলতে তারা ফর্সা দেহকেই বোঝায়। অনেকে আবার ঠিকুজিসহ যোগাযোগ করতে বলে। জ্যোতিষী সামঞ্জস্য দেখে সুখ-শান্তি নিশ্চিত করে। ইকবাল পত্রিকাগুলো ছুড়ে ফেললেন। সংবাদপত্রের মতো খারাপ আর কিছু নেই। অজন্তা গুহার প্রাচীর চিত্র নিয়ে একটা নিবন্ধ অবশ্যই থাকতে হবে। ইন্ডিয়ান ব্যালো নিয়ে কিছু একটা লেখা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একটা কিছু থাকা দরকার। প্রেম চাঁদের গল্প নিয়ে একটা নিবন্ধ। সিনেমা তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একাধিক লেখা। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ইকবাল আবার শুয়ে পড়লেন। সব কিছুতে তিনি হতাশা বোধ করলেন। তিন দিন তিনি ভালমতো ঘুমাতে পারেন নি। এটাকে আত্মত্যাগ বলে অভিহিত করা যায় কি না ভাবলেন। এমন চিন্তা অবাস্তব কিছু নয়। পাটিকে খবর পাঠানোর একটা উপায় তিনি অবশ্যই বের করবেন। তারপর সম্ভবত… তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন তাঁর গ্রেফতারের খবর ব্যানার হেড লাইনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মুক্তির খবরও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি যে একজন বিজয়ী নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন-একথাও ঐ রিপোটে লেখা হয়েছে।