[দশ]
—সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ এসে গেছি দিদি।
—উঁ?
—এবার কোন দিকে যাব?
—উঁ?
—বলছি, যাবেন কোথায় এবার? বাঁয়ে, না ডাইনে?
তৃতীয় বার প্রশ্নের পর হুঁশ ফিরল বিদিশার, ধড়মড়িয়ে তাকাল এদিক ওদিক। ট্যাক্সি গ্রে স্ট্রিটের ট্রাম লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে, ও ফুটপাথে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন। অর্থাৎ বিদিশা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে।
পিছনে অটো রিকশার পাল। গঁ গঁ করছে। মিটারে কত উঠেছে না দেখেই ব্যাগ হাতড়ে ঝটিতি একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট ড্রাইভারের হাতে গুজে দিল বিদিশা, খুচরো ফেরতের অপেক্ষা না করে ট্যাক্সির দরজা খুলে নেমে পড়ল। এগোচ্ছে দক্ষিণমুখো, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে…বিডন স্ট্রিটের দিকে। পড়ন্ত দুপুরে এখনও চড়া রোদের ঝাঁজ, চিড়বিড় করছে গা, ঘাম ঝরছে দরদর। বিদিশা হাঁটছে না, প্রায় ছুটছে, তবু পথ যেন ফুরোয় না। মাত্র তো শ দেড় দুই গজ গিয়ে রাস্তা পেরোবে, এইটুকু পথকেই কী অসীম মনে হচ্ছে এখন! অথচ এই পথে পরশুও…
অর্কদের গলির মুখে এসে বিদিশা পলকের জন্য থমকাল। নোংরা আবর্জনার স্তূপ বিশ্রি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নাকে আঁচল চাপতে গিয়েও চাপল না বিদিশা, এই গন্ধই যেন তার প্রাপ্য এখন। ওদিকে এক বাড়ির দরজায় দুটো মেয়ে উগ্র সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে, তাদের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বিদিশা চোখ নামিয়ে নিল। অন্য দিনের মতো অস্বস্তিতে নয়, বরি বা আত্মধিক্কারে। সে কি ওই মেয়ে দুটোর চেয়েও হীন জীবনযাপন করে না? শ্রমহীন, পরগাছার জীবন? সেই পরভৃৎ জীবনের আয়েশটুকু টিকিয়ে রাখতেই না আজ তার এই কুল ছোটাছুটি? কেন যে সে নিজেকে অন্যভাবে গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারল না কোনও দিন? সমুদ্রে অর্চিষ্মান বলেছিল, তোমার পায়ের নীচ থেকে যদি কখনও মাটি সরে যায়…!
অসম্ভব। বিদিশা কিছুতেই তার সুখ হাতছাড়া করতে পারবে না। তার জন্য যে মূল্যই দিতে হোক না কেন, বিদিশা প্রস্তুত।
ক্ষণিকের সন্তাপ ক্ষণিকে উধাও। অর্কর দরজায় কড়া নাড়ছে বিদিশা। অধৈর্য হাতে।
অর্ক নয়, সামনে অর্কর মাসি। সুপ্রভা।
বিদিশাকে দেখেই সুপ্রভার কপালে ভাঁজ,—তুমি! কী ব্যাপার?
সুপ্রভা এ সময়ে ঘরে থাকবেন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি বিদিশা। ঝাঁকুনিটা সামলে নিয়ে অতি কষ্টে হাসল। ঈষৎ অপ্রতিভ স্বরে বলল,—অর্ক আছে মাসিমা?
—কেন? তাকে আর কী দরকার?
—দরকার নেই। এমনিই…। বিদিশা ঢোক গিলল,—অনেক দিন খোঁজ নেওয়া হয় না…কাছেই এসেছিলাম…
—তুমি তো পরশুও এসেছিল।
— হ্যাঁ…মানে…। বিদিশা আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। একটু একটু রাগও হচ্ছিল অর্কর ওপর। কী বেআক্কেলে ছেলে রে বাবা! পেয়ারের মাসিকে ব্যাক ব্যাক করে সব কথা না বললে কি ঘুম হয় না!
সুপ্রভার চোয়াল কঠিন হয়েছে,—আবার কেন অর্কর কাছে আসছো বলো তো? তোমার নাকি বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে…! আমার ভালমানুষ বোনপোটাকে তো অনেক কষ্ট দিয়েছ, আর কেন?
বিদিশা কাচুমাচু মুখে বলল,—বিশ্বাস করুন, বিয়েতে আমার কোনও হাত ছিল না। বাবা মা জোর করে…। আমি অর্কর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।
—তাতেই বুঝি সব চুকে বুকে গেল? সুপ্রভা খরখর করে উঠলেন,—জানো, আবার এসে ছেলেটার কী দশা করে গেছ? পরশু সারা দিন ছেলেটা দাঁতে কুটোটি কাটেনি, সারা রাত ঘুমোয়নি…
বিদিশা এবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কান্নার সবটা বোধহয় অভিনয়ও নয়, ভেতরের জমাট উত্তেজনাও অশ্রু হয়ে গলে গলে বেরিয়ে আসছে।
সুপ্রভা সামান্য নরম হলেন। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়েছেন,—এসো, ভেতরে বোসো।
—আছে অর্ক? বিদিশার চোখ জ্বলে উঠল।
—এ ঘরের পাখাটা চলছে না, ভেতরের ঘরে ঘুমোচ্ছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অর্ক এল ঘরে। বিদিশার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল একটুক্ষণ, বুঝি বা কিছু আন্দাজও করল।
প্যাসেজের দরজায় অটল সুপ্রভাকে বলল,—মাসি, দু কাপ চা করে দেবে?
সুপ্রভা সরতেই বিদিশা খপ করে চেপে ধরেছে অর্কর হাত। চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠল,—অর্ক প্লিজ আমায় বাঁচাও।
এক মুহূর্ত বুঝি বিদিশার স্পর্শ অনুভব করল অর্ক। পরমুহূর্তে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। মৃদু স্বরে বলল,—মাসি যখনই বলল তুমি আবার এসেছ, তখনই বুঝেছি…
—আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাকে মনে হয় আত্মহত্যা করতে হবে।
—আবার কী হল?
—সেই ফোনটা আবার এসেছিল। আজ। দুপুরবেলা।
—কী বলেছে?
—ওই সেই। টাকা চাই। পঞ্চাশ হাজার। বিদিশার গলা থরথর কাঁপছে,—এবার আর আমার নিস্তার নেই।
—কেন?
দরজায় সুপ্রভার ছায়া পড়ছে, সেদিকে চোখের ইশারা করল বিদিশা। ফিসফিস করে বলল,—সে অনেক কথা। এখানে কি বলা যাবে?
ইঙ্গিত বুঝল অর্ক। দেওয়ালের ব্র্যাকেট থেকে পাঞ্জাবি নিয়ে গলিয়েছে গায়ে। গলা উঠিয়ে বলল,—মাসি, চা করতে হবে না, থাক।
সুপ্রভার মুখ উঁকি দিল,—কেন রে?
—বিদিশার ফেরার তাড়া আছে, ওকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।
—দেরি করিস না কিন্তু।
পথে নেমে বিদিশা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল সুপ্রভা সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। কটমট চোখে দেখছেন বিদিশাকে।
মাথা নীচু করে হাঁটতে হাঁটতে বিদিশা বলল, —তোমার মাসি আজ অফিস যাননি?
—না। গা ম্যাজম্যাজ করছে বলছিল। আজকাল মাঝে মাঝেই কামাই করে। বয়স হচ্ছে তো, রোজ রোজ অফিস বোধহয় আর পেরে ওঠে না।
—মেজাজটাও আজ মাসির খারাপ মনে হল।
অর্ক যেন কথাটা শুনেও শুনল না। কেজো স্বরে বলল,—হ্যাঁ শুনি, কেন টাকা না দিলে তোমার নিস্তার নেই?
উত্তরটা মোটামুটি সাজিয়েই রেখেছিল বিদিশা। চিঠির বাক্স চুরির কাহিনীটা বলল, তবে সেই বাক্সে যে মিহির অরুণের চিঠিও ছিল সে কথাটুকু সচেতনভাবে চেপে গেল।
অর্ক একটু ভেবে নিয়ে বলল,—টেলিফোনের সঙ্গে তুমি চুরিটাকে মেলাচ্ছ কীভাবে? ওটা তো কাকতালীয়ও হতে পারে।
—মোটেই না। লোকটা টেলিফোনে তোমার চিঠির লাইন পড়ে পড়ে শোনাচ্ছিল। ওর কাছে নাকি আমাদের ছবিও আছে।
—ছবি?
—হ্যাঁ, তাই তো বলল। প্র্যাকটিসের পর তুমি আমার সঙ্গে অনেক দিন রেড রোড ধরে ফিরতে না, সেই সময়কার। …তোমার হাত নাকি আমার কাঁধে, আমার হাত নাকি তোমার কোমরে বেড় দিয়ে আছে…
—অসম্ভব। এরকম ছবি থাকতেই পারে না।
—আমিও তো জানি অসম্ভব। কিন্তু যদি সত্যি হয়? যদি কেউ শয়তানি করে আড়াল থেকে তুলে থাকে?
—কে হতে পারে? কে আমাদের এমন শত্রু ছিল? বলেই অর্ক হো হো হেসে উঠেছে,—সে জানলই বা কী করে তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা সত্যিই ঘটবে না?
—তুমি হাসছ?
—হাসব না? যে ছবি তুলেছে সে কি আগে ভাগেই জানত নাকি তোমার একটা বড়লোক বর হবে? আর তারপর সে তোমাকে ওই ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করবে?
—আমি জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। বিদিশা প্রকাশ্য রাস্তাতেই প্রায় ককিয়ে উঠল,—লোকটার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমার কী হবে সেটা একটু ভাবো। চিঠিগুলো যে তার হাতে আছে এতে তো কোনও সন্দেহ নেই।
—হুঁ, তা অবশ্য ঠিক। অর্কর মুখ থেকে হাসি সরল,—লোকটা কি সত্যি সত্যি আমার চিঠি পড়ে শুনিয়েছে?
—না তো কি আমি বানিয়ে বলছি?
—তা নয়।..আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম।
—কী কথা?
—লোকটা তার মানে জানত তুমি বাপের বাড়ি থেকে চিঠির বাক্স নিয়ে আসছিলে! আই মিন, তুমি যে ওই বাক্সতেই চিঠি রাখতে সেটাও লোকটার অজানা ছিল না।
—কী বলতে চাইছ?
—আমার মনে হয় লোকটা আননোন কেউ নয়। তোমারই ক্লোজ কেউ। এবং সে দেখেছে তুমি বাক্সটা নিয়ে চলে আসছ।
—তারপর সে আমায় ফলো করেছে?
—সোজা হিসেব তো তাই বলে। অর্ক চোখ সরু করল,—বাক্সটা নেওয়ার সময়ে তোমায় কে কে দেখেছে?
—মা ছিল।
—আর?
—বাবা।
—আর কেউ? …ডোন্ট মাইন্ড, তুমি এক সময়ে তোমার দাদার নামে অনেক কিছু বলতে। বাই এনি চান্স…
—না, দাদা নয়। আমি শিয়োর। দাদা তার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল। তাছাড়া এই ব্ল্যাকমেলিং… পঞ্চাশ হাজার… না, এ কাজটা দাদার দ্বারা হবে না।
—কী করে শিওর হচ্ছ?
—আমি দাদাকে বাজিয়ে দেখেছি।
কথাটা যেন বুলেটের মতো বেরোল বিদিশার মুখ থেকে। অর্ক অবাক চোখে দেখল বিদিশাকে। তারপর ধীরে ধীরে এক বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠছে তার ঠোঁটে,—যেমন পরশু তুমি আমায় বাজিয়ে দেখছিলে?
বিদিশা চোখ নামিয়ে নিল।
অর্ক ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল,—তুমি বড় নিষ্ঠুর দিশা। প্রায় ওই ব্ল্যাকমেলটার মতোই।
—আমি প্র্যাকটিকাল। বিদিশা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল,—তুমি আমায় সাহায্য করবে কিনা বলো? নয়তো।…
—নয়তো কী?
—আগেই তো বলেছি। সুইসাইড করব।
—প্র্যাকটিক্যাল মেয়েরা সুইসাইড করে না।
বিদিশা তর্কে গেল না। অর্কও নীরব। হাঁটছে পাশাপাশি। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ-এর চওড়া ফুটপাথ ধরে। প্রায় নিঃশব্দেই রাস্তা পার হল দুজনে, ছোট্ট একটা পার্কে ঢুকল। কোণের এক বেঞ্চে বসেছে। এই বেঞ্চ তাদের পরিচিত, এখানেও তাদের অনেক সঘন মুহূর্ত জমা আছে।
বিদিশার অবশ্য অত মনে টনে পড়ার সময় নেই। বসেই সে অর্কর মুখের দিকে তাকিয়েছে,—কী ভাবছ? কিছু সলিউশন পেলে?
অর্ক দু দিকে মাথা নাড়ল।
—তাহলে আমি এখন কী করব?
—বলব? বললে শুনবে?
—কী?
—ব্ল্যাকমেলিংটা খুব খারাপ চক্কর। এতে একবার যে গেঁথে যায় তার পক্ষে মুক্তি পাওয়া কঠিন। অর্ক গলা ঝাড়ল। ঘনায়মান প্রসন্ন বিকেলের দিকে তাকিয়ে উদাস স্বরে বলল,—তুমি বরকে সব কথা খুলে বলো। নিজের অতীত ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চেয়ে নাও। তোমার স্বামী তো খুব ভাল লোক, তুমিই বলেছ। একটা বোগাস বেকার ভ্যাগাবন্ডের সঙ্গে তোমার প্রেম হয়েছিল, এবং তাকে তুমি কীভাবে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছ, কেন দিয়েছ, সব খুলে বললে তিনি কি আর তোমার ওপর রাগ করতে পারবেন?
বিদিশার বুকটা ধকধক করে উঠল। মনে মনে বলল, তুমি যদি একা হতে তাহলে আমি নয় চেষ্টা করে দেখতাম। কিন্তু ভাস্কর আছে, মিহির আছে, অরুণ আছে…কত জনের কথা বলব আমি? ব্ল্যাকমেলার কি শুধু অর্কর কথাই বলেছে?
মুখে বলল,—ওটা হয় না। হলে তো আমি তোমার কাছে আসতাম না।
—কেন হয় না দিশা? যদি বলো তো আমি নিজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি। তাঁকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারি। সত্যের একটা নিজস্ব জোর আছে, মহা পাষণ্ডও তাকে অবহেলা করতে পারে না। কী, যাব আমি?… আমি স্পোর্টসম্যান, নিজের পরাজয়ের কথা বলতে আমার লজ্জা হবে না।
নীল আকাশ যেন পাঁশুটে হয়ে গেল হঠাৎ। বিদিশা সভয়ে বলল,— না না না। এমনটি কক্ষনও কোরো না। অর্চিষ্মান ভীষণ সেন্সেটিভ। পজেসিভ। ছেলেমানুষ ধরনের। বউ-এর কোনও প্রেমিক ছিল এ সে সহ্যই করতে পারবে না।
ছোট্ট ন্যাড়া মাঠে বাচ্চা ছেলের ফুটবল পেটাচ্ছে। চর্মগোলক উড়ে আসছিল বিদিশার দিকে, অর্ক হাত বাড়িয়ে থামাল। বলটাকে ফের ছুড়ে দিল মাঠে। চোখ কুঁচকে বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলল,—তাহলে টাকাটা দিয়েই দাও।
—বলছ?
—বলছি। আর কী বলতে পারি? তুমি তো আমার অন্য পরামর্শ শুনবে না। ব্ল্যাকমেলার তোমাকে কব্জা করে ফেলেছে।
কথাটা অমোঘ সত্যের মতো শোনাল। অর্ক যে শেষ পর্যন্ত এই কথাই বলবে, এও যেন জানত বিদিশা। ঠিকই তো, আর তো কোনও সমাধান নেইই। তবু কেন সে ছুটে এসেছে অর্কর কাছে? অর্কই একমাত্র টেলিফোনে ভয় দেখানোর কথাটা জানে, অর্ককে বলেই একমাত্র নিজেকে হালকা করা যায়, এই ভেবে? নাকি অর্ক কোনও মিরাকল ঘটিয়ে ফেলবে, এ রকম একটা দুরাশা ছিল বিদিশার?
অর্ক আবার বলল,—কবে যেন দিতে হবে টাকাটা?
—শনিবার। সামনের শনিবার।
—কীভাবে দিতে হবে কিছু বলেছে?
—বলেছে। বিদিশা একটু থেমে নিষ্ঠুর কণ্ঠটাকে স্মরণ করে নিল। ভার গলায় বলল,—ঢাকুরিয়া লেকের ধারে। সাঁতার ক্লাঁবে ঢোকার রাস্তাটায় একটা অ্যাম্বাসাডর দাঁড়িয়ে থাকবে। ডিকি খোলা। গাড়ির তলায় একটা লোক শুয়ে কাজ করবে। টাকাটা প্ল্যাস্টিক ব্যাগে ভরে ডিকিতে রেখে ডিকিটাকে বন্ধ করে দিতে হবে। নোটগুলো হতে হবে পঞ্চাশ টাকার। এবং পুরনো। টাকা গাড়িতে রেখে যে পথে এসেছি সে পথেই ফিরে যেতে হবে।
—বাহ, তোফা বন্দোবস্ত! অর্ক হাত ওল্টালো,—যা বলেছে সে রকমই করো তাহলে। যদি চাও, আমিও তোমার সঙ্গে থাকতে পারি। অবশ্য তার একটা প্র্যাকটিকাল অসুবিধে আছে। তোমার বাবা মা ভাই তো নিশ্চয়ই তোমার সন্দেহের তালিকায় পড়ে না! তাহলে ব্ল্যাকমেলার এমন একজন লোক যে তোমায় আগাগোড়া ফলো করেছিল। চিঠিসুদ্ধ বাক্সটা সে বাই লাক পেয়ে গেছে!… এমনও হতে পারে সে হয়তো আজও ফলো করছে। হয়তো সেদিনও তোমায় কড়া ওয়াচে রাখবে। হয়তো কেন, রাখবেই। আমি সঙ্গে থাকলে…। অবশ্য আমি খুব সিক্রেটলিও থাকতে পারি। আলাদা ভাবে দূর থেকে ওয়াচ করতে পারি। যদি বলো…
বিদিশা সব কথা শুনছিল না। খানিকটা আত্মগত ভাবেই সে বলে উঠল,—কিন্তু টাকাটা আমি পাব কোত্থেকে।
[এগারো]
বুধবার বিকেল। বিদিশার বেরনোর প্রস্তুতি পর্ব শেষ হল প্রায় সাড়ে চারটেয়। সে আজ পরেছে রানি রং ঢাকাই জামদানি, শাড়ির সর্বাঙ্গে জরির কারুকাজ। দু হাতে চওড়া ব্রেসলেট, কানে ঝুমকো, গলায় সাতনরি হার। নাকে একটা ছোট্ট নাকছাবিও লাগিয়ে নিয়েছে, হিরে বসানো। পার্লার থেকে বেঁধে আসা ঢেউ-ঢেউ খোঁপায় গুঁজে দিয়েছে সাগরসেঁচা মুক্তোর ফুল। তীব্র এক গন্ধ বিচ্ছুরিত হচ্ছে রূপসী বিদিশার শরীর থেকে। মৃগনাভির ফরাসি সুবাস।
রুপো বাঁধানো ছড়ি হাতে বাগানে পায়চারি করছিলেন দিননাথ। একটু বুঝি অসহিষ্ণু ভাবে। পূর্ণ সজ্জায় উদ্ভাসিত বিদিশাকে দেখে তাঁর মুখের ভাব বদলে গেল। চোখে যেন আর পলক পড়ে না।
বিমোহিত স্বরে বলে উঠলেন,—করেছিস কী রে বেটি? আমার নাতনিটার দিকে কেউ যে আজ আর তাকাবেই না!
প্রশস্তি বাক্যে বিদিশার দারুণ খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু ঠিক তেমনটা হল না। তবু লজ্জা-লজ্জা গলায় বলল,—হারটা আমায় মানিয়েছে বাবা?
—মানিয়েছে কী রে? দেখে তো মনে হচ্ছে ওই হার তোরই গলার জন্য তৈরি হয়েছিল।
—ঠাট্টা কোরো না, সিরিয়াসলি বলো মানিয়েছে কি না। এত ভারী হার…তোমার ছেলে তো আবার ভারী গয়না পরা পছন্দ করে না।
—ও ব্যাটা সৌন্দর্য আভিজাত্যের কী বোঝে? রুদ্রবাড়ির বউ ফঙফঙে হার পরে পার্টিতে যাবে? ছ্যা ছ্যা।
রবি গ্যারেজ থেকে অনেকক্ষণ গাড়ি বার করে অপেক্ষা করছে। শ্বশুর পুত্রবধূ ইস্পাতনীল মারুতিতে পাশাপাশি বসল। বিদিশা একবার দেখে নিল উপহারের প্যাকেটটা নেওয়া হয়েছে কি না। হয়েছে। পদ্মপাণি আগেই রেখে গেছে গাড়িতে। খুঁটিনাটি কাজে পদ্মপাণির কখনও ভুল হয় না।
কদিন পর আজ আবার বেশ মেঘ করেছে। খানিক আগে দু-এক পশলা ঝরেছিল, ভেজা ভেজা আছে রাস্তাঘাট। বাতাসে কিছুটা জোলো ভাব। মনে হয় বর্ষা এখনও শরৎকে জায়গা ছাড়তে রাজি নয়।
চলছে মারুতি। স্বচ্ছন্দ গতিতে। লবণহ্রদের এদিকটায় প্রচুর গাছপালা। দিননাথের চোখ জানলার বাইরে, সবুজ দেখছেন।
হঠাৎই বললেন,—এই হারটা কার ছিল জানিস?
বিদিশাও সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,—জানি। এ হার মা পরতেন।
—হুম। আমার শাশুড়িঠাকরুন তাঁর মেয়েকে দিয়েছিলেন। বিয়ের সময়। তিনি আবার পেয়েছিলেন তাঁর মার কাছ থেকে।
—তা হলে তো এ হার দিদিরই প্রাপ্য ছিল।
—ছিলই তো। খুকি মুখ ফুটে চেয়েছিল।
—দাওনি কেন?
—তার বিয়েটা যখন আমার ইচ্ছেয় স্থির হয়নি, তখন এ বাড়ির সেরা গয়নাগুলো সে পাবে কেন? তা ছাড়া আমি তখনই ঠিক করে ফেলেছিলাম বাবলুর জন্য আমি নিজে বউ খুঁজে আনব, তার গলাতেই শোভা পাবে এই হার।
বিদিশার মনে পড়ে গেল বউভাতের দিন অর্চনাই তাকে সাজিয়েছিল, অলঙ্কারে প্রায় মুড়ে দিয়েছিল বিদিশাকে, হিরে, জড়োয়া, সোনা…। এই হারটাই শুধু পরায়নি সেদিন। কেন পরায়নি? ঈর্ষায়? তাই হবে। অন্তত শ্বশুরমশাই যা বললেন, তার থেকে সে রকমই তো মনে হয়। সেই দিদিরই বাড়িতে আজ এই হার পরে যাওয়া কি শোভন হচ্ছে? মুখে কিছু না বললেও হয়তো মনে মনে আহত হবে অর্চনা!
কিন্তু উপায়ই বা কী? ভাগ্নির জন্মদিন বলেই না হারটা লকার থেকে বার করা অনেক সহজ হয়েছে, অর্চিষ্মানের মনেও সন্দেহ জাগার সুযোগ আসেনি! পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় করার একটাই তো রাস্তা এখন। কালই এই পনেরো ভরির সাতনরি কণ্ঠহার অর্কর হাতে তুলে দিয়ে আসবে বিদিশা। অর্কদের পাড়ায় প্রচুর স্যাকরার দোকান, বেচলেই করকরে নোট এসে যাবে হাতে। তার পর আর কী, শয়তান ব্ল্যাকমেলারটার মুখে টাকাটা ছুড়ে মারো, ব্যস নিশ্চিন্ত। অর্ক যাই বলুক, বিদিশা এই ভাবনাটাকে কক্ষনও প্রশ্রয় দিতে রাজি নয়, যে ব্ল্যাকমেলার তাকে আবার উত্ত্যক্ত করবে। শয়তানটা তাকে কথা দিয়েছে, ওই টাকাটা পেলেই সে চিরকালের তো চুপ হয়ে যাবে। চোর ডাকাতদেরও কথার দাম থাকে, বিদিশা জানে। শনিবারের মধ্যেই একটা অভিন্নদর্শন সোনার জল করা সাতনরি ঢুকে যাবে বিদিশার লকারে—অর্চিষ্মানের হিসেবও নিখুঁত রইল! ভাগ্যিস সে দিন পূষন ঝুটো গয়না আসল গয়না নিয়ে ঠাট্টা তামাশা জুড়ল, নইলে কি আর এই সাদাসাপটা অথচ নিশ্ছিদ্র প্ল্যানটা বিদিশার মগজে আসত!
আলগোছে সাতলহরীর গায়ে একবার হাত বুলিয়ে নিল বিদিশা। এত সুন্দর সমাধান পেয়ে গেছে সে, তবু যে কেন বুকটা চিনচিন করে? বহুমূল্য গয়না হারাতে হবে, এই শোকে? নাকি কোনও সূক্ষ্ম অপরাধবোধ জাগছে প্রাণে?
সল্টলেক পেরিয়ে উল্টোডাঙায় পড়তেই গাড়ি যানজটের কবলে। ঠেলাগাড়ির মতো চলছে। মানিকতলায় জ্যাম, পোস্তায় জ্যাম, হাওড়া ব্রিজে জ্যাম…ফোঁটা ফোঁটা ঘামের মতো সর্বত্র জমে আছে গাড়িঘোড়া, ট্রামেরা যেন মৃতপ্রায় সরীসৃপ। শালকিয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিদিশাদের সন্ধে নেমে গেল।
সাবেকি আমলের বাড়িটার সামনে গাড়ি থামতেই ছুট্টে বেরিয়ে এসেছে অর্চনা আর মুন্নি। পলকের জন্য অর্চনার চোখ আটকেছে বিদিশার সাতনরিতে, অজান্তেই গায়ে আঁচল জড়িয়ে নিয়েছে বিদিশা, পরক্ষণেই সব স্বাভাবিক।
বিদিশার হাত ধরে অর্চনা ঠোঁট ফোলাল,—সেই তোরা এত দেরি করে এলি।
মুন্নি কলকল করে উঠল,—দাদু, তুমি মামাকে ধরে আনতে পারলে না?
দিননাথ সহাস্যে বললেন,—তোর মামিকে ছেড়ে মামা যদি তার সতিনে মজে থাকে, তার আমি কী করব বল?
বিদিশা অবাক হয়ে দেখল, কথাটা শুনে হঠাৎই যেন চোখ জ্বলে উঠল অর্চনার। নিমেষেই অবশ্য হাসি ফুটিয়েছে মুখে। হাসতে হাসতেই বলল,—যা বলেছ। বাইরের বউ-এর ওপর টান ঘরের বউ-এর থেকে একটু বেশিই হয়।… তা সে আসবে কখন কিছু বলেছে?
বিদিশা বলল,—বলেছে তো আটটার মধ্যে…। এই মুন্নি, তুমি তোমার মামাকে একটা ফোন করো না।
—আমার ভারী হয়ে গেছে। বলতে বলতে মুন্নি হিড়হিড় করে বিদিশাকে টেনে নিয়ে চলল,—তুমিই এসো, আমার বন্ধুরা সবাই তোমায় দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ওদের বলেছি, আমার মামি একেবারে ডিটো মাধুরী দীখসিৎ।
বিশাল হলঘর খুব জমকালো করে সাজানো হয়েছে আজ। রঙিন কাগজের শিকল ঝুলছে, দেওয়ালে জরির চুমকি, বেলুন, সিলিং-এ সুন্দর এক ঝাড়বাতি। দেওয়াল ঘেঁষে পাতা হয়েছে লম্বা লম্বা সোফা, মাঝখানে শ্বেতপাথরের টেবিলে প্রকাণ্ড এক কেক। জাহাজকেক। টাইটানিক। বয়স্ক অতিথিরা কেউ তেমন আসেনি এখনও, হলময় কিশোর কিশোরীদের ভিড়। হইহল্লা চলছে জোর, গান বাজছে, হঠাৎ হঠাৎ অকারণ উচ্ছ্বাস ভেঙে পড়ছে হাসিতে। অনেকের হাতেই পানীয়র প্লাস। শীতল নরম পানীয়।
বিদিশার আবির্ভাবে ছেলেমেয়েদের কলরব থেমে গেল সহসা। মুন্নি এদিক ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে বিদিশাকে, একে একে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। সাময়িক আড়ষ্টতা কাটিয়ে বিদিশা ধীরে ধীরে ভিড়ে মিশে গেল। সিনেমার নায়িকাদের মতো স্তাবকপরিবৃত হয়ে ঘুরছে হলে, মেয়েরা তার গয়না দেখছে, শাড়ি দেখছে, ছেলেরা মুগ্ধ দৃষ্টি উপহার দিচ্ছে তাকে। এমন পরিবেশ আসন্ন বিপদকেও বুঝি ভুলিয়ে দেয়। বিদিশা স্বচ্ছন্দ বোধ করছিল, উপভোগ করছিল।
একটু ফাঁক পেয়ে মুন্নিকে জিজ্ঞাসা করল,—তোমার বাবা কোথায়? তাকে দেখছি না যে বড়?
—কে জানে কোথায়! মুন্নি ঠোঁট ওল্টাল,—এই তো তখন কেটারারদের সঙ্গে কথা বলছিল, হয়তো ছাদেই আছে। ডাকব?।
—না থাক। …তুমি কেক কাটবে কখন?
—ঠিক সাড়ে সাতটায়।
—সাড়ে সাতটায় কেন? তোমার বন্ধুবান্ধবরা তো সব এসে গেছে।
মুন্নি লাজুক মুখে বলল,—আমি নাকি ঠিক ওই সময়টাতেই জন্মেছিলাম। প্রতি বছর তাই ওই সময়েই কেক কাটি।
বিদিশা হেসে ফেলল। কত রকম যে খেয়াল থাকে মানুষের! বিদিশা নাকি জন্মেছিল রাত সাড়ে তিনটেয়, অর্চিষ্মানকে ওই সময়ে পার্টি দিতে বললে কেমন হয়? আগে কখনও সেভাবে জন্মদিনই হয়নি বিদিশার। নভেম্বরের কুড়ি তারিখটায় মা হয়তো একটু পায়েস করল, বাবা হয়তো একটু মিষ্টি আনল, ব্যস। এবার নিশ্চয়ই ছবিটা বদলে যাবে। অর্চিষ্মান না করলেও দিননাথ নিশ্চয়ই ঘটা করে করবেন তাঁর বেটির জন্মদিন। কাকে কাকে সেদিন ডাকবে বিদিশা? অর্ককে বললে হয়, ছেলেটা খুব নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করছে বিদিশাকে। উহুঁ, যদি অর্চিষ্মান দিঘায় অর্ককে দেখে থাকে…।
এলোমেলো ভাবনার মাঝে টুক করে একবার দোতলায় উঠে গেল বিদিশা, পূষনের মার সঙ্গে দেখা করে এল। করতে হয়। কর্তব্য। পূষনের মা আর্থারাইটিসের রোগী, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারেন না, দিননাথ তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছেন, একটুখানি সেখানে বসে বিদিশা আবার পায়ে পায়ে নীচে। কোরারের কর্মচারীর ট্রে থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাস তুলে নিয়ে বসেছে সোফায়, একটু একটু চুমুক দিচ্ছে। লোকজন আসতে শুরু করেছে এক এক করে, অৰ্চনা আর মুন্নি অভ্যর্থনা জানাচ্ছে তাদের। পূষনেরও দর্শন মিলল, ব্যস্ততার মাঝেও বিদিশার সঙ্গে নিয়মমাফিক ফষ্টিনষ্টি করে গেল পৃষন।
কেক কাটা হবে এবার। মুন্নিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তার বন্ধুবান্ধব, বাবা মা, অতিথি অভ্যাগত, বিদিশা দিননাথ। সব আলো নিবিয়ে দেওয়া হল, হলঘর জুড়ে পনেরোটা মোমবাতির আবছায়া, মৃদু লয়ে ইংরেজি বাজনা বাজছে। সুর উচ্চকিত হল ক্রমশ, কেকে ছুরি বসিয়ে এক ফুঁয়ে মোমবাতি নেবাল মুন্নি। পলকের জন্য দমকা অন্ধকারে ঘুটঘুট চারদিক, পর মুহূর্তেই আলোর রোশনাই, হাততালিতে ফেটে পড়ছে ঘর।
আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে বিদিশার শিরদাঁড়া বেয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল। পূষনের পাশে কে এসে দাঁড়িয়েছে? ভাস্কর না? কখন এল? কোত্থেকে এল?
বিদিশার ননদের বাড়িতে ভাস্কর কেন?
ভাস্করেরও দৃষ্টি বিদিশায় স্থির। মুখের হাসি চওড়া হচ্ছে ভাস্করের। গলা নামিয়ে পূষনকে কী যেন বলল। পূষনও তাকাচ্ছে বিদিশার দিকে।
বিদিশার মুখ পাংশু। বনবন ঘুরছে গোটা পাঁচেক পাখা, তবু যেন ঘর সহসা বাতাসহীন।
ভিড় কাটিয়ে ভাস্করকে নিয়ে এগিয়ে এল পূষন,—ম্যাডাম, মিট মাই ফ্রেন্ড। ভাস্কর চ্যাটার্জি। দারুণ ডায়নামিক ছেলে। আমার ছোট ভাইও বলতে পারেন। …আর ইনি হলেন মিসেস বিদিশা রুদ্র। আমার একমাত্র শ্যালকের একমাত্র ওয়াইফ।
খাঁটি গ্রিক পুরুষের মতো দেহকাণ্ড ঈষৎ নেওয়াল ভাস্কর। কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে বলল,—আপনাকে যেন আগে কোথায় দেখেছি?
পূষন হো হো হেসে উঠল,—পুরনো কায়দা ছাড়ো। বিদিশা ম্যাডামকে যে দেখে তারই এরকমটা মনে হয়।
—তাই কি? ভাস্করের ঘুম ঘুম চোখ আরও ঢুলুঢুলু—আপনিই বলুন তো ম্যাডাম, আগে আমাদের কোথায় দেখা হয়েছে?
গত কয়েকটা দিন বিদিশাকে অনেক শক্তপোক্ত করে দিয়েছে। কয়েক মুহূর্তেই সামলে নিল নিজেকে। মুখে একটা ইলাস্টিক হাসি টেনে যথাসম্ভব নীরস স্বরে বলল,— সরি। আই কান্ট রিমেমবার।
—তা হলে হয়তো আমিই ভুল করছি। ভাস্করের হাসি বাঁকা হয়ে ঝুলছে,—স্মৃতি মাঝে মাঝে বড় বিট্রে করে ম্যাডাম। চেনা লোককে অচেনা লাগে, অচেনা মানুষকে চেনা মনে হয়…
ভাস্করের কথা শেষ হল না। মুন্নি ঘুরে ঘুরে কেক বিলি করছে, বিদিশার মুখে টাইটানিকের টুকরো গুজে দিয়ে গেল, সুযোগ বুঝে বিদিশাও সরে গেছে সামনে থেকে।
পার্টি জমে উঠেছে। হিন্দি গান চালিয়ে কোমর দোলাচ্ছে ছেলে মেয়েরা, বয়স্ক জনেরা তালি দিয়ে দিয়ে তাদের উৎসাহিত করছে। নব্য সংস্কৃতি। দিননাথ সোফায় একটু বিরক্ত মুখে বসে, ওই সব গান তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। বিদিশা সেঁটে গেল শ্বশুরমশায়ের পাশে। দিননাথই এখন তার আত্মরক্ষার বর্ম।
আটটা নাগাদ খাবার সার্ভ করা হল। বুফে সিস্টেম। পাশের ঘরে সাজানো রয়েছে টেবিল, প্লেট হাতে পছন্দসই আইটেম তুলে আনছে নিমন্ত্রিতরা, রকমারি সুখাদ্যের ঘ্রাণে হলঘর ম ম।
অর্চনা ঘুরে ঘুরে তদারকি করছিল। বিদিশাকে ডেকে বলল,—এই, বাবাকে খাবার এনে দে না। মিছিমিছি বসে বসে বোর হচ্ছে!
বিদিশাও এই কথাই ভাবছিল। অর্চিষ্মানের সময়জ্ঞান অত্যন্ত কম, তার অপেক্ষায় থাকতে গেলে শ্বশুরমশায়ের অনিয়ম হয়ে যাবে।
খাবার ঘরের দিকে এগোতে গিয়েও বিদিশা দাঁড়িয়ে পড়ল। ওফ, ভাস্করটা দাঁড়িয়ে আছে! ওখানেই!
নিচু গলায় অর্চনাকে জিজ্ঞেস করল,—ওই ভাস্কর চ্যাটার্জি লোকটা তোমাদের এখানে ভিড়ল কী করে দিদি?
—তুই চিনিস ওকে?
—পূ্যনদা আলাপ করিয়ে দিল। লোকটা খুব চালিয়াৎ টাইপ, তাই না?
—কামাচ্ছে দু হাত্তা, চাল তো একটু মারবেই।
—করেটা কী?
—কিছুই করে না। আবার অনেক কিছুই করে।
—বুঝলাম না।
অর্চনা চোখ টিপল। চাপা স্বরে বলল,—পলিটিকাল টাউট।
—মানে?
—রাজনীতির চাঁইরা তো সব সাধুবাবারও বাড়া, টাকাপয়সা স্পর্শ করলে তাদের হাতে ফোসকা পড়ে। তাই এদের হাত দিয়েই সব লেনদেন হয়। অর্চনা গলা আরও খাদে নামাল,—আগে নাকি হাজরা মোড়ে ফ্যা ফ্যা করে বেড়াত। এখন খুব সোর্স। তোর পূষনদা এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যবসা করবে বলছে না, ওই ভাস্করই তো খুঁটি। ওই নাকি সব বন্দোবস্ত করে দেবে। ব্যাঙ্ক লোন ট্যাঙ্ক লোন সব। কমিশনও নেবে…
—পূষনদার সঙ্গে পরিচয়টা হল কী করে?
—বিজনেসের লাইন, কোথায় কার সঙ্গে কখন পরিচয় হয় তার কোনও ঠিক আছে?… যা যা, তুই বাবার খাবারটা নিয়ে আয়।
চোখ কান বুজে ভাস্করকে পার হয়ে গেল বিদিশা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। প্লেটে ফিশফ্রাই তুলছে, পিছনে ভাস্কর।
ফিসফিস করছে,—মানুষ খুব তাড়াতাড়ি পাস্ট ভুলে যায়, তাই না?
বিদিশার হাত থেমে গেল। মুখ ফেরাল না, দাঁতে ঠোঁট চেপে বলল,—মনে রাখারও তো কোনও কারণ দেখি না।
—একেবারে অর্চিষ্মান রুদ্রর সতীসাধ্বী বউ বনে গেছ, অ্যাঁ?
বিদিশার হাতের প্লেট থরথর কেঁপে উঠল,—অর্চিষ্মানকে তুমি চেনো নাকি?
—অনেককেই আমায় চিনতে হয় ম্যাডাম। এটাই আমার পেশা।
ভাস্করের স্বরে এমন কিছু ছিল, বিদিশা ঘাড় ঘোরাতে বাধ্য হল। দেখল, ভাস্করের মুখে হাসির চিহ্নমাত্র নেই, ঘোলাটে চোখের কোণে অচেনা ধূর্ততা খেলা করছে।
একেবারেই অচেনা? নাকি চেনা চেনা?
[বারো]
বিদিশা ক্রমশ অস্থির হয়ে পড়ছিল। সেই কখন থেকে বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়ে আছে, এখনও অর্ক আসে না কেন? অর্কর কোনও বিপদ হল না তো?
অদেখা শয়তানটার সব শর্তই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে বিদিশা। ঠিক সময়ে ছায়ামাখা রাস্তাটায় পৌঁছেছিল, প্লাস্টিকে মোড়া টাকার বাণ্ডিল যথাস্থানে রেখে নিশ্চল অ্যাম্বাসাডারের ডিকি বন্ধ করে দিয়েছে, একটি বারের জন্যেও পিছু ফিরে তাকায়নি, সোজা চলে এসেছে এই গোলপার্কে। অর্ক তখন ছিল অনেকটা দূরে, তাকে মোটেই কারুর লক্ষ করার কথা নয়।
লোকটা কি আরও ধড়িবাজ? অর্ককে দেখে ফেলেছিল? যদি লোকটা অর্ককে…?
না, বিদিশা আর ভাবতে পারছে না। একটু আগে পর্যন্ত একটা হিমেল ভয় ময়াল সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ছিল বিদিশাকে, সাপটা এখন আর নেই, তবু তার শীতল স্পর্শ বিদিশা এখনও বেশ অনুভব করতে পারছে। কেন যে আজ মিছিমিছি জেদ করে সঙ্গে এল অর্ক? বিদিশাকে সাহস জোগাতে এসে নতুন কোনও সমস্যা ডেকে আনল না তো? একবার কি গিয়ে দেখবে বিদিশা?
চিন্তায় চিন্তায় বিদিশা যখন পাগলপ্রায়, অর্ককে দেখা গেল। ফুটপাথ ধরে হনহনিয়ে আসছে।
ছুট্টে এগিয়ে গেল বিদিশা,—কী করছিলে এতক্ষণ? কোথায় ছিলে?
অর্ক হাঁপাচ্ছে,—শালাকে ধরে ফেলেছিলাম প্রায়। ইশ, একটুখানির জন্যে…
—সেকি! তুমি লোকটাকে ধরতে গেছিলে?
—পারলাম না। তুমি চলে আসার পরেও শালা গাড়ির তলায় শুয়েছিল অনেকক্ষণ। প্রায় আধ ঘণ্টা। আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম। যেই না ব্যাটা বেরিয়েছে, দিয়েছি এক ডাইভ। পৌঁছতে পৌঁছতেই স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে গাড়িতে। তাও লাস্ট মোমেন্টে হাত বাড়িয়ে কলার চেপে ধরেছিলাম ব্যাটার, পিছলে বেরিয়ে গেল। শুধু এই বোতামটা মুঠোয় রয়ে গেছে।
বিদিশা হাতে নিয়ে দেখল বোতামটা। মামুলি প্লাস্টিকের বোতাম। হলদেটে। কী ভেবে বোতামটা পুরে রাখল ব্যাগে।
ভার ভার গলায় বলল,—কী দরকার ছিল বীরত্ব দেখানোর? লোকটার কাছে যদি আর্মস থাকত?
—থাকলে থাকত। আমি পরোয়া করি না। অর্ক গলা ঝাড়ল,—যতই কালিঝুলি মেখে থাকুক, ও শালার মুখ আমি দেখে নিয়েছি।
—লোকটাও তো তোমায় দেখল। আবার যদি ফোনে থ্রেট করে?
অর্ক গোমড়া হয়ে গেল,—দ্যাখো দিশা, আমি তোমায় অনেক বার বলেছি, আমি স্ট্রেট গেমে বিশ্বাসী। কে না কে উল্টো পাল্টা ভুজুং ভাজুং দিয়ে তোমার কাছ থেকে টাকা কেড়ে নিয়ে যাবে, আর আমি সেটা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব? আমায় যদি তুমি আদৌ কিছু না জানাতে তাও একটা কথা ছিল। আর থ্রেট করার কথা বলছ? কাকে থ্রেট করবে?
—আমাকে। আর কাকে?
—কী বলবে? সঙ্গে লোক নিয়ে গেছিলে, খেসারত স্বরূপ এই টাকা দাও? হাহ্। তোমাকে তো বলেইছি, ব্ল্যাকমেলাররা একবার টাকার গন্ধ পেলে জোঁকের মতো সেঁটে যায়। আমি আজ এখানে না এলেও সে তোমাকে ছাড়ত না। দেখো, এবার লোকটা আরও বেশি চাইবে।
শঙ্কাটা যত মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায় বিদিশা, অর্ক তত বুঝি স্মরণ করিয়ে দেবেই। তেতো গলায় বিদিশা বলল,—তুমি দেখছি ব্ল্যাকমেলারটার মনের নাড়িনক্ষত্র জেনে ফেলেছ?
অর্ক চুপ হয়ে গেল। অন্ধকার নামছে। স্ট্রিট লাইট জ্বলে উঠল একে একে। গোলপার্কের মোড় এখন জনারণ্য। বাস মিনিবাস ট্যাক্সি গাড়ির শব্দে কান পাতা দায়। বাতাসে পোড়া পেট্রল ডিজেলের কটু গন্ধ। ভিড়ের মধ্যেই নির্জনতা খুঁজে নিবিষ্ট ভঙ্গিতে গল্প করছে দুই তরুণ তরুণী। এই কেজো নাগরিক সন্ধ্যায় কোন স্বপ্নের কথা বলে ওরা?
অর্ক কপোতকপোতীকে দেখছিল। নিঃশব্দে। কোনও দীর্ঘশ্বাস পড়ল কি অর্কর?
নিষ্প্রাণ স্বরে কথা শুরু করল আবার,—তুমি এখন ফিরবে তো?
বিদিশা বুঝতে পারছিল অর্ক আহত হয়েছে। খারাপ লাগছিল বিদিশার। বিপদের ঝুঁকি নিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছে, তার জন্য অমন বাঁকা সুরে কথা না বললেই হত।
ঘড়ি দেখে বলল,—আর একটু থাকতে পারি। বাড়িতে বলে এসেছি ফিরতে দেরি হবে।
—মিছিমিছি দেরি করবে কেন? কাজ তো তোমার হয়ে গেল।
—রাগ করেছ? বিদিশা আলগা ছুঁল অর্ককে,—আমি কিন্তু কিছু ভেবে বলিনি। মাথার ঠিক নেই, কখন কী কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়…
—তোমার ওপর রাগ করার আমার তো কোনও অধিকার নেই দিশা।
—এটাও তো রাগের কথা। …বড্ড গলা শুকিয়ে গেছে, একটু চা খাওয়াবে?
—আমি ফুটপাথের চা খাই। সে কি তোমার মুখে রুচবে?
—এবার কিন্তু তুমি আমায় কথা শোনাচ্ছ। বিদিশা হাসার চেষ্টা করল,—বড়লোকের বাড়ি বিয়ে হয়েছে বলে কি আমার সব অভ্যেস বদলে গেছে?
—চলো তাহলে।
পেট্রল পাম্পের উলটো দিকে খুপরি চা-দোকান। বাইরে মলিন বেঞ্চি। বসল দুজনে। ধূমায়িত চায়ের গ্লাস এসে গেল।
বিদিশা এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। একটু আড়ষ্ট ভাবে। অর্ক জিজ্ঞাসা করল—কী দেখছ?
—না, মানে…লোকটা আশেপাশে নেই তো?
—সে আর থোড়াই এ তল্লাটে আছে! যে ভাবে চোঁ চা রাসবিহারীর দিকে চম্পট দিল…
—কেমন দেখতে লোকটা?
—লম্বাও নয়, আবার বেঁটেও নয়।…মাঝারি হাইট। গায়ের রং ফর্সার দিকেই। মুখে অবশ্য প্রচুর কালি মেখে ছিল।
—হ্যাঁ, মোটামুটি ফর্সা। আমি এক ঝলক পা দুটো দেখেছিলাম।
—চেহারাটাও তেমন কিছু ষণ্ডাগণ্ডা নয়। তবে গায়ে বেশে জোর আছে। ফেসটা স্কোয়্যার মতো…না না, একটু বুঝি লম্বাটে।
হঠাৎই কী যেন মনে পড়ে গেল বিদিশার উদ্ভাসিত চোখে বলল, —ও হ্যাঁ, আমি আরেকটা জিনিস দেখেছি। গাড়িটার নাম্বার। ডব্লু এম ডি, সেভেন নাইন ওয়ান জিরো।
—ফুঃ, ওটা কি আসল নাম্বার নাকি?
—নয়?
—কক্ষনও না। আসল নেমপ্লেট ঝুলিয়ে টাকা নিতে আসবে, ব্ল্যাকমেলার কি রামছাগল নাকি?
বিদিশা মেনেও মানতে পারল না। তর্ক জুড়ল,—অপরাধীরা তো অনেক সময় ভুলও করে। সিলি মিসটেক। তার জন্যই তো তারা কত সময় ধরা পড়ে যায়।
—তা ঠিক। অর্ক মাথা দোলাল। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে গ্লাস রেখে দিল পাশে। ভুরু কুঁচকে বলল,—কিন্তু এ লোকটা এত সামান্য ভুল করবে বলে মনে হয় না।…তোমাকে যে ভাবে বুদ্ধু বানিয়ে বাক্সটা হাতিয়েছে।
—তাহলে তো লোকটাকে আর ট্রেস করার কোনও উপায়ই নেই!
—আছে, আছে। বললাম না, লোকটার মুখ আমি দেখে নিয়েছি? ওই মুখ আমি ভুলব না। দিনে হোক, রাতে হোক, হাজার লোকের ভিড়ের মধ্যে হোক, ট্রেনে বাসে ট্রামে যেখানে দেখি না কেন, আমি ওকে আইডেন্টিফাই করতে পারবই। এই শহর আমি চষে বেড়াই, আজ হোক, কি ছ মাস পরেই হোক…। অর্ক এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তারপর বলল,—শুধু একটা ব্যাপার আমার খুব স্ট্রেঞ্জ লাগছে, জানো?
—কী?
—টাকা ডিকিতে রাখার সঙ্গে সঙ্গে তো লোকটার চলে যাওয়া উচিত ছিল। তা না করে আধঘণ্টা ওয়েট করল কেন?
—ভেবেছিল হয়তো আমি কাছেপিঠে দাঁড়িয়ে ওকে ওয়াচ করছি!
—তা কী করে হয়? তুমি তো সঙ্গে পুলিশ নিয়েও আসতে পারতে!… লোকটা নিশ্চিন্ত মনে গাড়ির তলায় শুয়ে রইল… ফিশি, ভেরি ফিশি। ইনফ্যাক্ট গাড়িতে ওঠার সময়েও ওর তেমন তাড়াহুড়ো ছিল না। তাই না আমি অতটা পথ কভার করে রিচ করতে পেরেছিলাম। প্রায় সত্তর আশি গজ। আমার কী মনে হচ্ছে জানো? আমার প্রিভিয়াস অনুমানটা কারেক্ট। দি পারসন, মানে দি ব্ল্যাকমেলার তোমার পরিচিত। সে তোমার স্বভাবের হাড়হদ্দ জানে।
—কী করে বলছ? বিদিশার মুখ সাদা হয়ে গেল।
—কারণ লোকটা অ্যাবসোলিউটলি সিওর ছিল, তুমি পুলিশে খবর দাওনি। সে মনের জোরও তোমার নেই। শুধুমাত্র, তোমার মুখোমুখি হতে চায় না সে, ব্যস।
বিদিশার হৃৎপিণ্ডের গতি আবার বেড়ে গেল। নিশ্বাসে আবার চাপা কষ্ট। বুধবার রাত থেকে যার দিকে সন্দেহের তির ছুটছে, সেই ভাস্করই কি তবে পর্দার আড়ালের খলনায়ক? সেদিন কথার ছলে বাজাচ্ছিল, বিদিশা তার কথা অর্চিষ্মানকে বলেছে কিনা। হঠাৎ তাকে দেখে বিদিশার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে কেন…রিয়েল রিচ ম্যানস ওয়াইফ হয়ে অগাধ টাকা নাড়াচাড়া করতে কেমন লাগে…! অর্চিষ্মান আসার পর ইচ্ছে করে অর্চিষ্মানের সঙ্গে গিয়ে গল্প জুড়ল, কিন্তু একটি বারের জন্যও বিদিশার ওপর থেকে চোখ সরায়নি। কী বিশ্রী চাহনি, এখনও যেন কাদার মতো লেগে আছে গায়ে। প্রথম ফোনটায় হয়তো এমনি এমনি ভয় দেখিয়েছিল ভাস্কর, বাক্স হাতানোর পর মিহির অর্কর কথা জেনে গিয়ে আরও জোর পেয়ে গেছে। হয়তো অনেকদিন ধরেই বিদিশাকে ফলো করছিল, সেদিনও যখন বিদিশা বাপের বাড়ি থেকে ফিরছে…!
অর্ককে কী বলে ফেলবে ভাস্করের কথা? উঁহু, বলা যায় না। বিদিশার দিকে দ্বিধাহীন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অর্ক, যথেষ্ট ছোটাছুটি করছে, হার বেচা, ডিজাইন মিলিয়ে নতুন হার গড়ানো, এও বেশ ঝঞ্ঝাটের কাজ, আজ একটু আগে অমন একটা বিপদের ঝুঁকি নিল কেন? অর্কর বুকে নিশ্চয়ই একটাই বিশ্বাস ধ্রুবতারার মতো জ্বলছে। অর্চিষ্মান বিদিশার স্বামী হতে পারে, কিন্তু এই পৃথিবীতে সেই বিদিশার একমাত্র প্রেমিক। কে না জানে, স্বামীর চেয়ে প্রেমিক এক কনা হলেও বেশি জায়গা দখল করে থাকে হৃদয়ে। এমন প্রেমিক বিদিশার প্রায় গণ্ডাখানেক ছিল, এই তথ্য জানার পর অর্ক কি তাকে অৰ্চিষ্মানের চেয়েও বেশি ঘৃণা করবে না? স্বামীকে প্রেমিক সহ্য করলেও করতে পারে, কিন্তু অন্য প্রেমিককে নয়।
বিদিশা উঠে দাঁড়াল। দূরমনস্ক ভাবে বলল,—কী জানি, আমার কিছু মাথায় ঢুকছে না। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
অর্কর চোখে মায়া ঘনাল। চায়ের দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল,—আর ভেবো না। হয়তো তোমার ধারণাই ঠিক লোকটা আর জ্বালাতন করবে না। …তাছাড়া আমি তো আছি। কিছু হলে আমায় সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ো। বাই দা বাই, আমি কিন্তু বড় জোর সামনের হপ্তাটা বাড়ি আছি, তারপর থেকে আমার ক্যাম্প শুরু হয়ে যাবে।
—তাহলে যোগাযোগ করব কী করে?
—তোমার তো আরও সুবিধে হল। আমি তো সল্টলেক স্টেডিয়ামে থাকব। তোমার অনেক কাছাকাছি। পারসোনালিও দেখা করতে পারো, যদি বলো আমি তোমাকে ফোনও করতে পারি।
—ফোন?
—হ্যাঁ, ক্যাম্প থেকে।…কখন করলে তোমার সুবিধে?
—দুপুরে। আড়াইটে থেকে তিনটে।
নম্বরটা টুকে নিল অর্ক। ট্যাক্সি ডেকে তুলে দিল বিদিশাকে।
ফিরছে বিদিশা। জানলার বাইরে চোখ, অথচ দেখছে না কিছুই। না চাইতেও তালবেতাল ভাবনা আসছে মনে। দিদি সেদিন চলে আসার সময় বলছিল, হারটা খুব যত্ন করে রাখিস বিদিশা, এতে আমার মার স্মৃতি লেগে আছে। বলার সময় দিদির চোখের কোল চিকচিক করছিল। হারটা বেমালুম বেচে দেওয়া কি পাপ কাজ হল? দূর, তা কেন, এ হার তো এখন বিদিশারই, নিজের গয়না নিয়ে সে যা খুশি তাই করতে পারে।… ভাস্করের সঙ্গে পূষনদার অত খাতির কেন? পূষনদা ভাস্করের সঙ্গে যুক্ত নেই তো? হতে পারে, হতেই পারে। যতই মুন্নির জন্মদিনে পার্টি থ্রো করে শোম্যানশিপ দেখাক, টাকাপয়সার হাল পূষনদার মোটেই ভাল নয়। নতুন ব্যবসার ধান্ধা করছে, শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু মিলবে না জানে, হয়তো তাই…! অর্ক যা চেহারার বর্ণনা দিল, তা অবশ্য পূষনদা বা ভাস্করের সঙ্গে মেলে না। অর্থাৎ ওরা কাউকে কাজে লাগিয়েছে, কে লোকটা? কোনও পেশাদার অপরাধী? পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে তাকে নিশ্চয়ই কিছু দিতে হবে…! উহুঁ, পূষনদাকে ব্ল্যাকমেলার ভাবা যায় না। যতই তেড়াবেঁকা কথা বলুক, পূষনদা ঠিক অমরীশ পুরী টাইপ নয়। তাহলে? তাহলে?
ভাবতে ভাবতে সল্টলেক এসে গেল। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মেটাচ্ছে বিদিশা, সামনে পদ্মপাণি। দোকান টোকান কোথাও যাচ্ছে।
বিদিশাকে দেখে এগিয়ে এল,—ও বউদিমণি, তোমার জন্য একটা লোক কখন থেকে বসে আছে গো।
বিদিশা বেশ চমকাল,—আমার জন্য? কে?
—চিনি না। বলছে, দাদা পাঠিয়েছে। তোমার সঙ্গে কী কাজ আছে।
চিন্তিত মুখে বৈঠকখানায় এসে বিদিশা দেখল, একজন বছর ষাটেকের লোক সোফায় বসে ঢুলছে।
বিদিশার পায়ের আওয়াজ পেয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল লোকটা। হাত জোড় করে বলল,—নমস্কার ম্যাডাম। আমার নাম সবিতাবরণ বাপুলি। আপনাকে একটা ফর্ম সই করানোর জন্য অনেকক্ষণ বসে আছি।
—কীসের ফর্ম?
—প্রোপোজাল ফর্ম। এল আই সির।
—কে এল আই সি করবে?
—আজ্ঞে, আপনার নামে হবে। মিস্টার রুদ্র তো তাই বললেন। বলতে বলতে ব্রিফকেস খুলে একটা ছাপানো কাগজ বাড়িয়ে দিল লোকটা,—মোটামুটি সব ফিল আপ করাই আছে। মিস্টার রুদ্রই করে দিয়েছেন। আপনি শুধু জন্ম তারিখটারিখগুলো একটু চেক করে দিন। আর সইটা…
—এখনই করতে হবে?
—করলে ভাল হয় ম্যাডাম। মিস্টার রুদ্র চেকটা দিয়ে রেখেছেন, কাল তাহলে ফার্স্ট আওয়ারে অফিসে জমা করে দিতে পারব।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদিশা দেখল কাগজটা। এবং চমকাল।
তার নামে দশ লাখ টাকার পলিসি! তিরিশ বছরের মেয়াদ! নমিনি অর্চিষ্মান!
লোকটা হাত কচলাচ্ছে—কাইন্ডলি সইটা করে দিন ম্যাডাম। আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। গড়িয়া ছাড়িয়ে। সেই বোড়াল।
থতমত মুখেই সইটা করে দিল বিদিশা। লোকটাকে বিদায় করে অবসন্ন পায়ে সিঁড়ি ভাঙছে। শরীর চলছে না আর, একটু শোবে এখন। দোতলা থেকে বাজনার সুর ভেসে আসছে। সেতার। দিননাথ রেকর্ড চালিয়েছেন।
শ্বশুরমশায়ের মহলের সামনে এসে বিদিশা দাঁড়াল একটুক্ষণ। ঘর অন্ধকার, একা মানুষটা আরও একা হয়ে ডুবে আছেন সুরের নির্জনতায়।
কী রাগ শুনছেন শ্বশুরমশাই? বিদিশা রাগ রাগিণী চেনে না কোনও, তবু সুরের মূৰ্ছনা তার বুকে গিয়ে বিঁধছিল। মাগোঃ, সুর কেন এত করুণ হয়!
বিদিশার কান্না পেয়ে গেল।
[তেরো]
অর্চিষ্মান ফিরল নটা নাগাদ। ঘর অন্ধকার করে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়েছিল বিদিশা। আলো জ্বলতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
অর্চিষ্মানের চোখে বিস্ময়,—অসময়ে শুয়ে আছ যে?
বিদিশার ঝিমঝিম করছে মাথা, তবু দ্রুত ধাতস্থ করে নিল নিজেকে। বলল,—এমনি।
—উহুঁ, কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। নইলে এখন তো তোমার বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে টিভি দেখার কথা! অর্চিষ্মান ভুরু কুঁচকোল,—শরীর খারাপ?
মানুষের মন কী বিচিত্র! অর্চিষ্মান যে লক্ষই করেনি বিদিশা কদিন ধরে টিভি চালাচ্ছে না, এতে তো বিদিশার স্বস্তি পাওয়ার কথা, কিন্তু হঠাৎই যেন বিদিশার বুকে সূক্ষ্ম অভিমানের ধোঁয়াশা! কেন সারাক্ষণ শুধু কাজের চিন্তায় ডুবে থাকবে অর্চিষ্মান? বিদিশা যে এত কষ্ট পাচ্ছে, দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, হোক না তা তার নিজেরই কর্মফল, অর্চিষ্মান একবার ভুলেও নজর করবে না? প্রশ্নের উত্তরে হয়তো মিথ্যে বলবে বিদিশা, হয়তো এড়িয়ে যাবে স্বামীকে, তবু তো মনে হবে মানুষটা তার পাশে আছে, তার কথা ভাবে! মাত্র ক’ মাসে বিদিশা স্বামীর কাছে এত পুরনো হয়ে গেল!
ম্লান হেসে বিদিশা বলল,—তেমন কিছু না, একটু মাথা টিপটিপ করছে।
—ওষুধ খেয়েছ কিছু?
—নাহ্। দেখছি… এমনিই কমে যাবে।
—দেখো বাবা, আবার জ্বর টর বাধিয়ে বোসো না। সিজন চেঞ্জের সময়…
হালকা শিস দিতে দিতে অ্যান্টিরুমে ঢুকে গেল অর্চিষ্মান। জুতো খুলছে, পোশাক বদলাচ্ছে। এই সময়টায় অর্চিষ্মানের পায়ে পায়ে থাকে বিদিশা, হাতের সামনে সব কিছু জুগিয়ে দেয়, বাথরুমে তোয়ালে রেখে আসে, বাইরে থেকে এলে অল্প গরম জলে হাত মুখ ধোওয়ার বাতিক আছে অর্চিষ্মানের, অন করে দেয় গিজার, এবং অবশ্যই গ্লাস বোতলও সাজায়। আজ কিছুই ইচ্ছে করছে না, সত্যিই যেন মাথাটা জমাট পাথর।
অর্চিষ্মান অবশ্য পরনির্ভর মানুষ নয়। নিজেই টুকটাক সারছে সব। একটু নিশ্চিন্ত হয়েই বিদিশা শুয়ে পড়ল আবার। শুয়ে শুয়েই কানে এল অর্চিষ্মান হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে বাথরুমে। দিঘার সেই গান! মনে করো শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর…! উফ, ওই বিদঘুটে গানটাই কেন যে এত পছন্দ অর্চিষ্মানের!
সুমতি দরজায় এসেছে,—বাবু খেতে বসে গেছেন। আপনি যাবেন না বউদি?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠল বিদিশা। না গেলে ঝঞ্ঝাট হবে, এক্ষুনি হয়তো ছুটে আসবেন শ্বশুরমশাই, সামান্য মাথার যন্ত্রণার জন্য হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে বসবেন। বিয়ের মাসখানেকের মাথায় একদিন তলপেটে ব্যথা হচ্ছিল বিদিশার, মামুলি মেয়েলি ব্যথা, রাত্রে দিননাথের খাবার টেবিলে গিয়ে দাঁড়ায়নি—ব্যস, তক্ষুনি শ্বশুরমশাই ডাক্তারকে কল দেন আর কি। শেষে অর্চিষ্মানই ধমকে ধামকে নিরস্ত্র করেছিল বাবাকে। আজ সিন ক্রিয়েট করার কোনও মানেই হয় না, যত কষ্টই হোক।
দিননাথের নৈশাহারটি বেশ সংক্ষিপ্ত। তিনটে রুটি, দুটি সবজি দিয়ে, একটি দুধে ভিজিয়ে।
রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে দিননাথ বললেন, —বুঝলি বেটি, আজ লাহিড়িকে জব্বর টাইট দিয়েছি।
বিদিশা জোর করে কৌতূহল দেখাল,—তাই বুঝি?
—হ্যাঁ রে, পর পর দুটো গেমেই লাহিড়ি মাত। রোজ রোজ আমায় হারিয়ে দেবে, তা কি হয়? দিন আমারও আসে।
—ও, সেই আনন্দেই বুঝি সেতার শুনছিল?
—তোর বুঝি কানে গেছে? দিননাথ মুখ তুললেন,—সেতারের সুরে সব সময় সুখ থাকে না রে পাগলি, কষ্টও থাকে।
—তোমার আবার কীসের কষ্ট?
—ওই যে, লাহিড়িটা রোজ রোজ জেতে, আজ হেরে গেল। বেচারার মুখটা যদি তখন দেখতিস। দিননাথ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন,—জিতেও সব সময়ে আনন্দ হয় না রে। হারার কষ্ট কী তা তো আমি বুঝি!
বিদিশা হেসে ফেলল। মানুষটা সত্যিই বড় সরল। প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতেও চান, আবার হারিয়েও মনখারাপ হয়, এমনটা বোধ হয় একমাত্র শ্বশুরমশায়ের মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব।
হাসি হাসি মুখেই বিদিশা বলল,—তাহলে কেন বড় মুখ করে বললে লাহিড়িকে টাইট দিয়েছ?
—ওটা তো আমার নিজের আনন্দ। তা বলে অন্য কারুর দুঃখে খারাপ লাগবে না?
—থাক, আর শোক আহ্লাদ করে কাজ নেই। কাল আবার হেরে এসো, সব কাটাকুটি হয়ে যাবে।
শ্বশুরমশায়ের কাছে আরও একটুক্ষণ থেকে ঘরে ফিরল বিদিশা। স্নান সেরে ফিটফাট হয়ে গেছে অর্চিষ্মান, ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি চড়িয়েছে, কোলন ছড়িয়েছে গায়ে, গ্লাস বোতল নিয়ে সে এখন সোফায়। দিননাথের সঙ্গে কথা বলে বিদিশার মাথাটা সামান্য হালকা হয়েছিল, কোলন আর সুরার মিশ্র গন্ধে ব্যথাটা আবার চড়াং করে উঠল।
ড্রয়ার খুলে ওষুধ খুঁজছিল বিদিশা, অর্চিষ্মান বলে উঠল,—তোমার দাদা তো দিন দিন খুব ফান্টুস হচ্ছে গো।
বিদিশা ঘুরে তাকাল,—কেন?
—খুব বারে ঢুকে ফুর্তি চালাচ্ছে আজকাল।
—তোমার বারে?
—না, রয়াল ড্রাগনে। এক কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছি, হঠাৎ দেখি দলবল নিয়ে টঙ হয়ে বেরোচ্ছে। অর্চিষ্মান গ্লাসে চুমুক দিল,—দু পয়সা রোজগার নেই, অথচ ওড়ানোর শখ আছে বাবুর!
দাদার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে অর্চিষ্মান, বিদিশাই বলেছে। তবু এই মুহূর্তে মন্তব্যটা বিঁধল বিদিশাকে। যতই হোক নিজেরই দাদা তো।
খানিকটা কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল,—ওই সাঙ্গোপাঙ্গোগুলোই যত নষ্টের মূল। তারাই আরও বেশি বখাচ্ছে দাদাকে।
—কেউ কাউকে বখায় না বিদিশা। বখার এলিমেন্টগুলো মানুষের নিজের মধ্যেই থাকে। বন্ধুরা বড় জোর ক্যাটালিস্ট হতে পারে।
প্রতিবাদ করল না বিদিশা। ইচ্ছেও নেই, শরীরে ক্ষমতাও নেই। ট্যাবলেট মুখে ফেলে ঢকঢক খানিকটা জল গিলল, বসল গিয়ে বিছানায়।
কথা ঘোরানোর জন্যই বলল,—তোমার কে এক ইনসিওরেন্সের লোক এসেছিল, সইসাবুদ সব করে দিয়েছি।
—সবিতাবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে? গুড। পলকের জন্য কী যেন ভাবল অর্চিষ্মান,— তুমি বিকেলবেলা গিয়েছিলে কোথায় বলো তো?
বিদিশা ঢোক গিলল,—তুমি ফোন করেছিলে, না?
—একবার নয়, তিন বার। তিনটের সময় করলাম, সুমতি বলল, এই মাত্র বেরিয়েছে। চারটের সময় করলাম, কেউ ধরল না, বেজে গেল। সাড়ে ছটার সময়ে পদ্মপাণি বলল, তুমি নাকি বলে গেছ ফিরতে রাত হবে। …এতক্ষণ ধরে কোথায় ছিলে? বাপের বাড়ি?
হ্যাঁ বললেই ল্যাটা চুকে যেত, তবু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,—না, বন্ধুর বাড়ি। হাতিবাগান।
—গাড়ি নিয়ে যাওনি যে?
বিদিশা ফাপরে পড়ে গেল। ওষুধে কাজ হচ্ছে না, মাথার টনটন ভাব বেড়ে গেছে হঠাৎ। শ্বশুরমশাইকে যা খুশি বলে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু অর্চিষ্মান কঠিন ঠাঁই। গাড়ি চাড়া বিদিশার বেরোনোর যদি অন্য কোনও মানে করে বসে!
মুখভাব যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে গলা নরম করল বিদিশা,—আমার বন্ধুদের তো সবার গাড়ি নেই!…ভাবলাম, যদি কিছু মনে করে… যদি ভাবে চাল দেখাচ্ছি…
—ভাবুক যা খুশি। অর্চিষ্মান রুদ্রর বউ গাড়ি ছাড়া ট্যাঙোশ ট্যাঙোশ করে ঘুরবে, দিস ইজ সিম্পলি আনবেয়ারেবল্। অর্চিষ্মানের গলায় হালকা ঠাট্টার সুর। ঠোঁট কুঁচকে হাসছে,—যদি আমার বউটাকে কেউ চুরি করে নেয়, তখন কী হবে?
বিদিশাও হাসল। কষ্ট করে। আবার কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল,—চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়েই বুঝি অত টাকার ইনসিওরেন্স করলে?
—হা হা, ভাল আইডিয়া দিয়েছ তো! তোমাকে প্রোটেক্ট করার জন্য একটা বার্গলারি ইনসিওরেন্স করে ফেলা যায়, কী বলো? বউটা কোন অ্যাসেটের মধ্যে পড়বে? মুভেবল, না ইমমুভেবল?
হায় রে, আজ বিদিশার মনমেজাজ চূড়ান্ত খারাপ, আর আজই কিনা খুশির জোয়ার এসেছে অর্চিষ্মানের প্রাণে!
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বিদিশা বলল,—তার মানে আমি তোমার কাছে অ্যাসেট?
—নও? স্ত্রীই তো স্বামীর সব থেকে বড় সম্পদ।
—দশ লাখ টাকা দামের?
—আরে দূর, ওটা তো তুমি মরে গেলে পাব। কথায় বলে না, মরা হাতি লাখ টাকা? আমার তেমন মরা বিদিশা দশ লাখ।
—তুমি চাও আমি মরে যাই?
—বউ তো মরে ভাগ্যবানের। আমার কপাল অত ভাল নয়।
নিছকই লঘু রসিকতা, তবু বিদিশার বুকটা চিনচিন করে উঠল। অকারণে জল এসে গেছে চোখে।
অর্চিষ্মান অত শত খেয়াল করল না। তার বরাদ্দ দু পেগ শেষ, বোতল তুলে রাখল কাচের আলমারিতে। কাকে যেন মোবাইলে ফোন করছে।
বোতাম টিপতে টিপতে পুট করে বলল,—কোন বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলে গো? বয়ফ্রেন্ড, না গার্লফ্রেন্ড?
বিদিশা কেঁপে গেল আবার। কাঁপুনিটা ছড়িয়ে যাচ্ছে শরীরে, হঠাৎ খুব শীত করে উঠল।
অস্ফুটে বলল,—মহুয়া। …তুমি চেনো না।
—বিয়েতে এসেছিল? বলেই হঠাৎ বিদিশার দিকে চোখ পড়েছে অর্চিষ্মানের। ফোন ফেলে দৌড়ে এল,—কী হয়েছে তোমার? কাঁপছ কেন?
বিদিশা আরও কুঁকড়ে গেল।
বিদিশার গায়ে হাত ছুঁইয়েই চমকে উঠেছে অর্চিষ্মান,—এ কী, গা যে পুড়ে যাচ্ছে!
এইটুকু স্পর্শ, এইটুকু সহানুভূতিরই বুঝি প্রয়োজন ছিল এই মুহূর্তে। বিদিশা প্রায় খামচে ধরেছে অর্চিষ্মানের হাত, চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। ক্রমশ শিথিল হয়ে এল শরীর।
ঘোর থেকে আরও ঘোরে ডুবে যেতে যেতে বিদিশা শুধু বলল,—মরে যাচ্ছি… আমি মরে যাচ্ছি…
টানা তিন দিন জ্বরে বেহুঁশ হয়ে রইল বিদিশা।
জ্বরটা একটু অদ্ভুত ধরনের। সারাদিন একশো এক একশো দুই-এর ভেতর ঘোরাফেরা করে, বিকেল হলেই বাড়তে থাকে, রাত্তির আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ একশো চারে পৌঁছে যায়। একটা দিন মোটামুটি সুস্থির ছিলেন দিননাথ, পরদিন থেকেই পাগলের মতো ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন। এই ডাক্তার ডাকছেন, এই স্পেশালিস্ট কল করছেন, দশ মিনিট পর পর খবর নিয়ে যাচ্ছেন বিদিশার। একই দিনে তিন তিনটে ল্যাবরেটরিতে ব্লাড টেস্ট হল। ম্যালেরিয়া ডেঙ্গু এনসেফেলাইটিস কোনও কিছুই নেই, টাইফয়েডও না। কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যাচ্ছে ডাক্তার, খেয়ে সারাদিন আচ্ছন্নের মতো শুয়ে আছে বিদিশা। কে ঢুকছে কে বেরোচ্ছে খেয়াল নেই, গোটা পৃথিবীটাই যেন আবছা পর্দার ওপারে, মানুষগুলো নড়াচড়া করে ভূতের মতো, ঘরের আলো বড় নিষ্প্রভ ঠেকে, জাগতিক সব ধ্বনি বড় ক্ষীণ মনে হয়। এরই মধ্যেই টের পেল বাবা এসেছে, কথা বলছে শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে, তার মাথায় হাত রাখল বাবা…।
চতুর্থ দিন থেকে একটু একটু করে কমতে শুরু করল জ্বর। সাত দিনের মাথায় পুরোপুরি ছাড়ল।
অসম্ভব দুর্বল হয়ে গেছে বিদিশা। হেঁটে বাথরুম অবধি যাবে সে ক্ষমতাও নেই, পা টলে যায়, সুমতিকে ধরতে হয় বার বার। মুখ ঘোরতর বিস্বাদ, কোনও খাদ্যই গলা দিয়ে নামতে চায় না। মানদা যত্ন করে স্টু বানিয়ে দেয়, জিভে দিয়েই থু থু করে ফেলে দেয় বিদিশা, জোর করে গিলতে গেলে বমি উঠে আসে। শরীর শুকিয়ে কাঠি, দুধে আলতা রঙে ব্যাধির মলিন ছোপ। মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে থাকে সারাক্ষণ। কখনও যা করেনি বিদিশা, তাই করছে, কাজের লোকদের মুখ করছে কারণে অকারণে, খিঁচিয়ে খিঁচিয়ে উঠছে।
দিননাথের মুখের হাসি উবে গেছে, অর্চিষ্মানের কপালে ভাঁজ। পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে বিদিশার প্রায় দশ এগারো দিন লেগে গেল।
এখন আবার স্বচ্ছ ভাবে চিন্তা করতে পারছে বিদিশা। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় টাকা দেওয়ার দিনটার কথা, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তবে সেই সাংঘাতিক আতঙ্কটা অনেক মরে এসেছে। কেমন যেন মনে হয় ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। মন থেকে দুঃস্বপ্নটা ঝেড়ে ফেলতে চায় বিদিশা, তবু কোথাও একটা চিন্তাটা বুঝি রয়েই যায়। আটকে থাকা কাঁটার মতো। বিশ্রী আঁশটে গন্ধের মতো। অর্ক কি ফোন করেছিল এর মধ্যে? কিছু কি জানতে পেরেছে? খুঁজে পেল লোকটাকে?
অসুখ হয়ে একটা লাভ অবশ্য হয়েছে বিদিশার। নতুন করে অর্চিষ্মানকে যেন চিনল সে। কাজপাগল মানুষ দোকানে গিয়েও ঘড়ি ঘড়ি খবর নিয়েছে বিদিশার, সন্ধে না হতেই বাড়ি তারপর সারাক্ষণ লেপটে আছে বিদিশার গায়ে! ছায়ার মতো! দু পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর হাত ছোঁয়াচ্ছে কপালে, নাড়ি টিপছে, রাতে বিদিশা একটু উ আ করলেই জেগে উঠছে অর্চিষ্মান! মানুষটার আপাত কঠোর খোলসের মধ্যে যে এমন এক কোমলহৃদয় স্বামী লুকিয়ে ছিল, অসুখটা না হলে কি বিদিশা জানতে পারত!
আজ বিকেলেও অর্চিষ্মানের কথাই ভাবছিল বিদিশা। বারান্দার দোলনায় বসে। পাশেই টুলে বেদানার রস, গ্লাস তুলে চুমুক দিচ্ছে মাঝে মাঝে। আজ নিলামঘর বন্ধ, জলদি জলদি ফিরবে অর্চিষ্মান, ভারী সুন্দর কাটবে সন্ধেটা। নীচের লনে বেড়াবে দুজনে, কিংবা একটু রাস্তায়, তারপর ফিরে এসে একসঙ্গে টিভি দেখবে…
আকাশে এখন গাঢ় শরৎ। ঝকঝকে নীল চাঁদোয়ার নীচে উড়ে বেড়াচ্ছে শিমুল তুলো। ভাদ্র এখনও যায়নি, তবু গুমোটটা প্রায় নেই, হাওয়া বইছে ঝিরঝির। খানিক দূরের মাঠে উঁকি দিয়েছে কাশফুল, শরতের খুশি মেখে দুলছে।
রসটুকু শেষ করে বিদিশা ঘরে এল। বসেছে ড্রেসিংটেবিলের সামনে। কী শাঁকচুন্নির মতো চেহারা হয়েছে, দেখলে কান্না পায়! মহার্ঘ ভেষজ লোশন মুখে ঘষল বিদিশা, হাত বুলিয়ে বুলিয়ে মুছতে চাইল মুখের মালিন্য। সরু করে আইলাইনার টানল চোখে, উজ্জ্বল হয়ে উঠল আঁখি। ছোট্ট লাল টিপ লাগাল কপালে, লিপস্টিকে আলতো রাঙিয়ে নিল ঠোঁট। চুলটাকে নিয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বিনুনি বাঁধবে, না খোঁপা? বিনুনিই ঝুলিয়ে দিল পিঠে। নাইটি হাউসকোট ছেড়ে শাড়ি পরেছে, অর্চিষ্মান এসে গেল।
আজ অর্চিষ্মান নীচে হাঁটতে রাজি নয়। বিদিশাকে নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে বেরিয়ে পড়ল। পক্ষীরাজের মতো উড়ে চলেছে গাড়ি, অনেক দিন পর মুক্ত পৃথিবীর হাওয়া লাগছে বিদিশার গায়ে, চোখ বুঝি শুষে নিচ্ছে বাতাস।
অস্ফুটে একবার বলল,—আঃ, এই তো সুখ।
অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করল,—কিছু বলছ?
স্বামীর কাঁধে মাথা রাখল বিদিশা। হাসল আপন মনে,—কই, বলিনি তো কিছু!
অর্চিষ্মানও হাসছে,—তুমি কিন্তু একটু পাগল আছ।
বিদিশা এবার খিলখিল হাসল,—আছিই তো। তুমি এতদিনে টের পেলে?
—জ্বরের সময় যা করছিলে, বাপস! বাইপাসে গাড়ির গতি বাড়াল অর্চিষ্মান,—কী ডিলেরিয়াম বকতে গো?…
—আমি? ডিলেরিয়াম?
—হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি। হঠাৎ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠছ….ধরো ধরো, ওই অ্যাম্বাসাডরটাকে ধরো! আবার কখনও কখনও বিড়বিড় করছ…শয়তান, তুই আমার সঙ্গে বজ্জাতি করে পার পাবি ভেবেছিস!… কে শয়তান? কোথাকার কোন অ্যাম্বাসাডার? কেউ তোমায় পথেঘাটে কখনও ভয় দেখিয়েছিল বুঝি?
বিদিশার শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। কণ্ঠ তালু শুকিয়ে কাঠ।
খরখরে জিভ ঠোঁটে বুলিয়ে বলল,—জানি না তো কিছু! আ-আ-আর কী বলতাম?
—ওই সবই। … না না না, আর একটা কথাও বলতে…ফোনটা ভেঙে ফ্যালো, ফোনটা ভেঙে ফ্যালো! অর্চিষ্মান শব্দ করে হেসে উঠল,—হঠাৎ ফোনটার ওপর তোমার রাগ হল কেন, অ্যাঁ?
বিদিশার স্বর ফুটছিল না। আর কী কী প্রলাপ বকেছে সে? আর কতটুকু কী জানতে পেরেছে, অর্চিষ্মান? অর্ক ভাস্করের কথাও কি…?
তরল আঁধারে ভরে যাচ্ছে চরাচর। সন্ধে নামছে। অন্ধকারটা বিদিশার বুকেও নেমে আসছিল।
[চোদ্দ]
অন্ধকার যখন নামে, অন্ধকারই নামে। ঠুনকো বাতি জ্বালিয়ে অন্ধকারকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয় বটে, কিন্তু তাতে অন্ধকারের অস্তিত্ব মিথ্যে হয়ে যায় না। ক্ষণস্থায়ী আলোটুকু চলে গেলেই আরও প্রকট হয় আঁধার।
বিদিশার কদিনের অসুস্থতা, অসুখের সূত্রে স্বামীকে একটু নিবিড় করে পাওয়া, কয়েকটা সুখী উজ্জ্বল মুহূর্ত বড় তাড়াতাড়ি নিবে গেল। সে প্রলাপের ঘোরে কী বকেছে, কী বকেনি ঠিক নেই, হয়তো অর্চিষ্মান তাকে আদৌ সন্দেহ করেনি, নিছকই কৌতূহলের বশে প্রশ্ন করেছিল দু একটা, তবু বিদিশা নিশ্চিন্ত হতে পারছে কই! স্বামীর প্রতিটি কার্যকলাপেই, হাঁটা চলা তাকানো প্রেম হাসি বিরক্তি রাগ, সবেতেই অস্বাভাবিকতার ছায়া দেখতে পাচ্ছে বিদিশা। কারণে অকারণে হৃৎকম্প হচ্ছে। সে রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে টের পেল অর্চিষ্মান পাশে নেই, ধড়মড়িয়ে উঠে আবিষ্কার করল অর্চিষ্মান পায়চারি করছে বারান্দায়, ব্যস ওমনি বুক ধড়াস ধড়াস। দুটো দিন অর্চিষ্মান বেশি রাতে বাড়ি ফিরল, ফিরেই বিনা বাক্যব্যয়ে বোতল নিয়ে বসেছে, বিদিশাকে আদর করতে করতে দুম করে অর্চিষ্মান বলল, আজ পুষনরা দোকানে এসেছিল, পলকে শিথিল হয়ে গেল বিদিশার শরীর। অর্চিষ্মান কী বুঝল কে জানে, সঙ্গে সঙ্গে সরে গেছে, বলল, তুমি ঘুমোও এখন। ঘুম কি এল বিদিশার?
মনে পাপ থাকলে বুঝি এমনটাই হয়। অহর্নিশি মেঘ ডাকে বুকে। সেই শয়তানটা যে আর ফোন করছে না, তাতেও যেন এতটুকু স্বস্তি নেই। বিদিশার কেবলই মনে হয় ওই নীরব থাকাটা ছলনা, বুঝি বা প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের আগে নিথর হয়ে আছে সমুদ্র।
ঝড় ঠিক উঠল না, তবে চেনা বাতাস এল। দুপুরে কেব্লে একটা হিন্দি ফিল্ম দেখছিল বিদিশা, নাচগানের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়েছিল সামান্য, তখনই হ্যান্ডসেটে পিক পিক।
—কে, দিশা? আমি অর্ক।
বিদিশা হ্যান্ডসেটটা খামচে ধরল,—ও, তুমি!
—আছ কেমন এখন? অর্কর স্বর সহজ,—শুনলাম খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে?
—কে বলল?
—ফোন করেছিলাম তো। এক মহিলা ধরেছিল, বোধহয় তোমাদের কোনও কাজের লোক টোক হবে। সেই বলল, খুব বাড়াবাড়ি, তুমি নাকি বিছানা থেকে উঠতেই পারছ না..! কী হয়েছিল দিশা?
শেষ বাক্যটা কানেই গেল না বিদিশার, মস্তিষ্কে টোকা পড়েছে। কে ধরেছিল ফোন? সুমতি? আশ্চর্য, একবারও বলেনি তো!
স্নায়ু টানটান হল বিদিশার,—এক বারই করেছিলে?
—হ্যাঁ। খেটেখুটে একটা খবর মিলেছিল, সেটাই জানাতে…তুমি এখন ঠিক আছ তো দিশা?
এবারও শেষ বাক্যটা কানে গেল না বিদিশার। অস্ফুটে বলল—কী খবর?
—আমার অনুমানই ঠিক, বুঝলে? অর্ক হাসল,—গাড়ির নম্বরটা বোগাস।
—কী করে জানলে?
—ইজি প্রসেস। মোটর ভেহিকলসে গিয়ে খোঁজ করলাম। ওখানে আমার একটা চেনা লোক আছে, ওই ফাইল টাইল ঘেঁটে বার করে দিল। ডব্লু এম ডি সেভেন নাইন ওয়ান জিরো গাড়ির মালিক একজন ক্রিকেটার। এয়ারলাইনসে কাজ করে। ঠিকানা-ফিকানা নিয়ে তার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম আমি তাকে ভালভাবেই চিনি। ক্রিকেট মাঠেই আলাপ হয়েছে। জেনুইন জেন্টলম্যান। ও কালপ্রিট হতেই পারে না।
—ও।
—আরও আছে। আমি ওখানেই থামিনি। নিজের চোখে গাড়িটাও দেখে এসেছি। এবং সেটা মোটেই সাদা নয়, নেভি ব্লু। ওই ক্রিকেটার গাড়িটা কিনেছিল সাম মুখার্জির কাছ থেকে। প্রায় পাঁচ বছর আগে। সে ভদ্রলোক এখন থাকেন বিদেশে। কানাডায়।
—ও। বিদিশা চুপসে গেল,—তার মানে লোকটাকে ট্রেস করার আর কোনও উপায়ই নেই?
—তা কেন, উপায় তো আছেই। লোকটা নিজেই তো ট্রেসেবল। অর্ক ঝুপ করে গলা নামাল,—লোকটাকে বোধহয় আমি পেয়েও গেছি।
—কোথায় পেলে? বিদিশা হকচকিয়ে গেল,—কী করে পেলে?
—সে অনেক কথা। লোকটাকে সাডেনলি দেখতে পেয়ে আমি ফলো করেছিলাম।…আমার চোখের ভুল করার কথা নয়…যাই হোক, বাড়িটা দেখে এসেছি। পাড়া থেকে ইনফরমেশানও কালেক্ট করেছি কিছু।
—কী ইনফরমেশান?
—এক্ষুনি বলা যাবে না। আর একটু সময় দাও, অন্তত আজকের দিনটা। অর্ক একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল,—তুমি আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারবে?
অজান্তেই ঘামতে শুরু করেছে বিদিশা। জড়ানো গলায় বলল,—কবে? কোথায়?
—আমি তো এখন সল্টলেকেই আছি। ক্যাম্পে। কাল আসতে পারবে?
—কখন?
—সন্ধেবেলা? কাল আমার সকালে প্র্যাকটিস আছে, দুপুরে ক্লাস, বিকেলে একটা ট্রায়াল কম্পিটিশন..
—কোথায় আসব?
—স্টেডিয়ামের ইস্ট গেটে। এই ধরো সাতটায়?
—ঠিক আছে।
—এসো কিন্তু। আমি অপেক্ষা করব।
—আচ্ছা।
টেলিফোনটা রেখে দিয়েই বিদিশার মনে হল, অর্ক কোনখানে লোকটাকে দেখেছে জানা হল না তো? কবে দেখেছে? কোথায় বাড়ি লোকটার? খবর জোগাড় করেছে বলল, কী খবর? লোকটাকে কে লাগিয়েছিল জানতে পেরেছে কি? কী করে জানবে?
ভাবতে ভাবতে ভাবনারা তালগোল পাকিয়ে গেল। ঝিমঝিম করছে মাথা। টিভিতে ভয়ঙ্কর মারপিটের দৃশ্য চলছে। পাহাড়কিনারে মরণ-ঝাপটাঝাপটি করছে হিরো আর ভিলেন। উফ, কী আওয়াজ! বিদিশা রিমোট টিপে পর্দা ধূসর করে দিল। টলমল পায়ে বাথরুমে ঢুকেছে, জল ছেটাচ্ছে মুখে। হঠাৎ চোখ তুলতেই শিরদাঁড়ায় কারেন্ট। এক মুহূর্ত পরেই ভুল ভেঙেছে। আয়নায় নিজেরই মুখ দেখে এত ভয়!
স্খলিত পায়েই ঘরে ফিরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল বিদিশা। অশান্ত নিশ্বাস স্বাভাবিক হচ্ছে ক্রমশ। চোখ ঘুরছে কড়িকাঠে, মাখন রং দেওয়ালে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের জানালা সব বন্ধ, দরজাও ভেজানো, শীতল আবহে এখন শুধুই আবছায়া। বাইরে সূর্য হেলে গেছে পশ্চিমে, ভেন্টিলেটার ফুঁড়ে তার এক কুচি আলো এসে পড়েছে দেওয়ালে, সরু সরু গ্রিলের ছায়াকে জেলের গরাদ বলে ভ্রম হয়। অসহায় বন্দিনীর মতো গভীর নৈরাশ্যে ছেয়ে যাচ্ছিল বিদিশার বুক। লোকটাকে ধরে মূল অপরাধীর সন্ধান যদি পাওয়াও যায়, কী লাভ হবে বিদিশার? ব্ল্যাকমেলারটার সে কী করতে পারে? পুলিশে দেবে? সে বুকের পাটা বিদিশার আছে? তাহলে অর্কর কাছে গিয়েই বা কী লাভ? কিল খেয়ে কিল হজম করাই তো তার ভবিতব্য। শুধু যদি লোকটা বিদিশাকে আর উত্ত্যক্ত না করে, মুক্তি দিয়ে দেয়…
সুমতি দরজায় টোকা দিচ্ছে,—বউদি, চা খাবেন না?
আচ্ছন্ন ভাব ছিঁড়ে গেল বিদিশার। দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেল। চারটে পঁয়ত্রিশ। এত তাড়াতাড়ি বয়ে গেল সময়?
গলা তুলে বলল,—টেবিলে দাও, আমি যাচ্ছি।
হলঘরে গিয়ে একটু অবাকই হল বিদিশা, শ্বশুরমশাই এখনও আসেননি। জিজ্ঞাসা করল,—বাবা কোথায়?
—বাবু এখন চা খাবেন না বললেন। শরীরটা নাকি ভাল নেই।
—সে কী! কী হয়েছে বাবার?
—তা বলেননি। বারান্দায় বসে আছেন চুপ করে।
চিন্তিত মুখে দক্ষিণের বারান্দায় এল বিদিশা। ইজিচেয়ারে আধশোওয়া দিননাথ, আড়াআড়ি হাতে দু’ চোখ ঢাকা।
বিদিশা গলা খাঁকারি দিল,—কী হয়েছে তোমার?
দিননাথ চোখ থেকে হাত সরালেন না। যেন জানতেনই বিদিশা তাঁর খোঁজ নিতে আসবে। বললেন,—কিচ্ছু হয়নি রে। এমনিই গাটা একটু গুলোচ্ছে।
—অম্বল হয়েছে?
—ওই রকমই।
—ওষুধ খেয়েছ?
—আমি কি কথায় কথায় ওষুধ খাই?
তা অবশ্য ঠিক। ওষুধ খাওয়াতে যে দিননাথের অনীহা আছে, দেখেছে বিদিশা। অল্প হেসে বলল,—এবার থেকে একটা কাজ করতে হবে। রান্নাবান্নায় মশলা কমিয়ে দিতে বলব। সরষে শুকনো লঙ্কা সব বাদ। বয়স তো হল, এবার একটু সেদ্ধটেদ্ধ খাওয়া অভ্যেস করো।
দিননাথ সোজা হলেন খানিকটা। ঘুরে তাকালেন বিদিশার দিকে। স্নেহময় দৃষ্টি ঘন হল,—তুই আমার জন্য খুব ভাবিস, না রে?
—আমি না ভাবলে কে ভাববে? তুমিও তো আমার জন্য ভাবো।
—তুই তো দেখছি তোর শাশুড়ির মতো করে কথা বলছিস। দিননাথের হাসিটা বড় দুঃখী দুঃখী দেখাল।
বিদিশার চোখে প্রায় জল এসে গেল। তাকে এত ভালবাসেন মানুষটা, কত আদরে যত্নে এ বাড়ির কর্ত্রীর আসনে বসিয়েছেন, প্রতিটি কথায় সেই কবে মারা-যাওয়া শাশুড়ির সঙ্গে মিল খুঁজে পান, বিনিময়ে প্রতারণা ছাড়া সে কী দিয়েছে এই পরিবারকে? শাশুড়ির হারটা পর্যন্ত বেচে দিয়ে এল নিজের দুষ্কর্ম ঢাকতে… ছিঃ।
মোড়া টেনে বিদিশা বসল শ্বশুরমশায়ের সামনে। মাথা নামিয়ে বলল,—তাঁর সঙ্গে আমার তুলনা কোরো না বাবা। আমি তাঁর মতো হব, সে যোগ্যতা আমার কই!
—কেন, তুই বা কম কীসে? দিননাথ বিদিশার মাথায় হাত রাখলেন,—আমি কি তোকে এমনি এমনি এ বাড়িতে এনেছি? এ সংসারটা তোকেই মাথায় করে রাখতে হবে রে বেটি। সব দায় বইতে হবে তোকেই। আমি মরে গেলে আমার ছেলেটাও তো তোরই জিম্মায় থাকবে।
—এসব আবার কী অলুক্ষণে কথা? হঠাৎ মরে যাওয়ার কথা আসছে কেন?
—ঠিকই তো বলছি। জীবন তো অনিত্য, কবে আছি, কবে নেই…
—বললেই হল? তোমায় মরতে দিচ্ছে কে?
—ওরে পাগলি, সময় হলে সবাইকেই যেতে হবে। এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে আটকে রাখতে পারে না রে।
—থামো তো। সামান্য একটু অম্বলেই আবোল তাবোল শুরু করে দিলে? দিননাথকে লুকিয়ে টুক করে চোখের জল মুছে নিল বিদিশা,—যাও, উল্টোপাল্টা কথা বলে একটু হেঁটে এসো তো।
—হুঁ, যাই।
শ্বশুরমশাইকে রওনা করিয়ে দিয়ে বিদিশা নিজের মইলে এল। দুঃখী মানুষের সান্নিধ্যে থাকার একটা মহৎ গুণ আছে, তারা আরও দুঃখী মানুষের মনোকষ্ট কিছুটা লাঘব করে দেয়। বিদিশারও একটু হালকা লাগছিল নিজেকে। দু পাঁচ মিনিট টিভি দেখল, ধুৎতেরি বলে উঠে গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ব্যালকনিতে, আবার ঘরে ফিরে বৈকালিক প্রসাধন সেরে নেমে এল একতলায়, মানদা সুমতির ওপর একটু খবরদারি করল, পদ্মপাণিকে ডেকে ঝাড়পোঁছ করাল বৈঠকখানাটা, তারপর একা একা অনেকক্ষণ পায়চারি করল লনে। বাতাসে শরতের গন্ধ, বেশ লাগছিল। পুজোর যদিও এখনও মাসখানেক বাকি, তবু এবার পুজোয় কার জন্য কী কিনবে, তা নিয়ে পরিকল্পনা করল মনে মনে।
বিকেলটা কেটে গেল। রাতটাও।
পরদিন অর্চিষ্মান বেরিয়ে যেতেই আবার বিদিশার শুরু হয়েছে চোরা টেনশান। যাবে কি আজ অর্কর কাছে? না গেলে কী হয়? অর্ক সত্যিই কি জানতে পেরেছে কিছু? ফোনেই তো বলতে পারত, ডেকে পাঠাল কেন? এই শহরে কোটিখানেক লোকের মাঝে ওই লোকটাকেই দেখতে পেয়ে গেছে অর্ক—কীরকম আষাঢ়ে গল্পের মতো শোনাচ্ছে না? রহস্যের অত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও স্বরে তো তেমন উত্তেজনা ছিল না অর্কর? বরং যেন বিদিশার সঙ্গে দেখা করার জন্যই বেশি ব্যগ্র মনে হচ্ছিল! অর্ক কি তবে তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য উৎসুক? সবই সম্ভব, শেষ ক’টা দিন সে বোধহয় অর্ককে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে। অর্ক বিদিশার জন্য খেটেছে, প্রতিদানে বিদিশার কাছ থেকে আবেগমাখা নরম ব্যবহার তার প্রাপ্য ছিল, ব্যস, এখানেই লেনাদেনা শেষ—অর্ক বোধহয় জীবনের এই সরল হিসেবটা মানতে রাজি নয়। নতুন করে সম্পর্ক গড়ে ওঠা মানে নতুনতর জটিলতার সম্ভাবনা। হুঁহ্, গাড়িটার হদিশ করতে পারল না, মানুষটাকে পেয়ে গেল! অত সোজা!
যুক্তিবুদ্ধি মানুষকে এক দিকে ঠেলে, নিয়তি টানে অন্য দিকে। দুপুরের পর থেকে মন বদলে গেল বিদিশার। এক অদম্য কৌতূহলে ছটফট করছে। অর্ক আজ পর্যন্ত তার সঙ্গে অসৎ আচরণ করেনি, মিথ্যে বলাও অর্কর স্বভাববিরুদ্ধ, হয়তো অর্ক সত্যিই কিছু জানতে পেরেছে। লোকটা তাকে আর জ্বালাতন করুক আর নাই করুক, মেঘের আড়ালে মেঘনাদটা কে জানবে না বিদিশা?
সাতটার একটু আগে বিদিশা বেরিয়েই পড়ল। কপাল ভাল, রবি আজ তাড়াতাড়ি চলে গেছে, গাড়িটা বার করে নিল গ্যারাজ থেকে। পথ খুব বেশি নয়, ফাঁকা ফাঁকা অন্ধকার মাড়িয়ে অচিরেই পৌঁছে গেছে স্টেডিয়াম।
পুব দিকের গেটটায় কীসের যেন ভিড়! রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে বেশ কিছু মানুষ জটলা করে আছে! একটু তফাতে গাড়ি থামাল বিদিশা। চোখ চালাচ্ছে এদিক ওদিক, অর্কর সন্ধানে।
এক উগ্র চেহারার যুবক গাড়ির দিকে এগিয়ে এল। কর্কশ স্বরে বলল,—গাড়ি এখান দিয়ে যাবে না, ঘুরিয়ে নিন।
বিদিশা ভুরু কুঁচকোল,—কেন?
—কেন কী! দেখছেন না অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে!
—কী অ্যাক্সিডেন্ট?
উত্তর না দিয়ে ছেলেটা ফিরে গেল জটলায়। সহসা বিদিশার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কী এক সিগনাল পাঠাল মস্তিষ্কে, মোহাবিষ্টের মতো নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। পায়ে পায়ে ভিড়টার দিকে যাচ্ছে। জটলার ফাঁক দিয়ে দৃশ্যটা চোখে পড়তেই টলে গেল মাথা।
দু হাত ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কে?…রক্তে ভাসছে…অর্ক না? অর্কই তো!
প্রায় চৈতন্যরহিত দশাতেও টুকরো টুকরো মন্তব্য কানে আসছিল বিদিশার।
—শালা। বড়লোকগুলো নিজেদের কী ভাবে মাইরি! তরতাজা ছেলেটাকে বেমালুম পিষে দিয়ে বেরিয়ে গেল…!
—গাড়িটাকে দেখেছেন দাদা? নাম্বার নোট করেছেন?
—আর নাম্বার! রাস্তার অর্ধেক আলো জ্বলে না…
—কাল্টু বলছিল অ্যাম্বাসাড়ার…
—দূর মশাই, ও জেনে কী হবে? বডিটা ওঠান আগে, হাসপাতালে নিয়ে চলুন…ওই তো ওই মারুতিটা আছে…
—কাকে ওঠাবেন দাদা? ছেলেটা তো অলরেডি ডেড।
—ইশ, ঘিলু একেবারে ছেতরে দিয়েছে গো!
বিদিশার পায়ের নীচে কি ভূমিকম্প হচ্ছে? দুলছে গোটা পৃথিবী? বিস্ফারিত-চোখ বিদিশা কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল। তারপর হঠাৎই ছুট লাগিয়েছে। স্টিয়ারিং-এর ওপর থরথর কাঁপছে হাত, অ্যাক্সিলারেটারে উল্টোপাল্টা চাপ দিচ্ছে পা, মাতালের মতো দৌড়চ্ছে গাড়ি।
বাড়ি ফিরে গাড়ি গ্যারাজে ঢোকানোর কথাও মাথায় এল না বিদিশার। উদভ্রান্তের মতো ঘরে পৌঁছে গেল। কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে পাঁজরে গজাল ঠকছে কেউ। ঠং ঠং…
ঠিক তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠল। হ্যান্ডসেট বিছানায় পড়ে, ঝাঁপিয়ে সেটাকে তুলে নিল বিদিশা।
আর্তনাদ করে উঠেছে,—কে? কে?
অনেক দিন পর আবার সেই পুরনো ধাতব স্বর,—কেমন লাগছে এখন, বিদিশা?