1 of 2

১.১০ মুক্তকেশীর সংসারের অন্নজল

কিন্তু মুক্তকেশীর সংসারের অন্নজল কতদিনের জন্যে উঠেছিল সুবৰ্ণলতার?

সে ইতিহাস জানতে হলে টাইট-বঁধুনি তো দূরের কথা, একেবারে অবাঁধা। বুরো ঝুরো পাতাগুলো তার এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে, উড়ে বেড়িয়েছে।

তবু সেই বিদেয় করে দেওয়ার অধ্যায়টা খুঁজে পেতে দেখে এইটুকু দেখা যায়, বাড়ির দরজায় ঘোড়ার গাড়ির শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সুবৰ্ণলতার বাবা নবকুমার বাঁড়িয্যে। ফর্সা ধবধবে রঙ, নিটোল গড়ন, চুল কাঁচা-পাকা। হয়তো বা কাঁচার থেকে পাকার সংখ্যাই বেশি।

পরনে ফতুয়া, পায়ে বিদ্যাসাগর চটি। একদা সরকারী কোনো এক অফিসের বড়বাবু ছিলেন, রিটায়ার্ড। ঘরকুনো মানুষ, বাইরে বেরোন কমই। সারাদিন বাড়ি বসে ছেলের বেঁকে টিকটিক করেন। আর নাতি নিয়ে সোহাগ করেন।

বেরোনোর মধ্যে সৌদামিনী দেবীর বাড়িতে একটু বেড়াতে যাওয়া। বৃদ্ধা বিধবা, নবকুমারের দূর সম্পর্কের দিদি। বহু দুঃখ-কষ্ট পার হয়ে আর বহু কৰ্মক্ষয় করে শেষ জীবনে পেয়েছিলেন কিঞ্চিৎ সুখের স্বাদ, কিন্তু সাইল না।

বুড়োটি গত হলেন।

অবিশ্যি সৌদামিনীর যা বয়েস তাতে বৈধব্যটাই স্বাভাবিক, তবে বহু কষ্ট পেয়ে সবেই তো স্বামী পেয়েছিলেন। তার সতীনই সর্বস্ত দখল করে রেখেছিল।

স্বামী গেছেন, সতীন গেছে, এখন একা সতীনের ছেলে।পুলে বৌ জামাই সব নিয়ে সংসার করছেন।

এই সংসারটাই দেখে পরিতৃপ্ত হন নবকুমার। তাই ছুটে ছুটে আসেন। এ সংসারে পুরনোর ছাপ বিদ্যমান, কারণ সৌদামিনীর হাতেই তো গড়া। যে সৌদামিনী নবকুমারের দিদি।

নবকুমারের মনের সঙ্গে খাপ খায় না। সে পছন্দ, সে রুচি!

কিন্তু বৌয়ের বা দোষ কি? শ্বশুর মনের মত রুচি-পছন্দ সে পাবে কোথায়? শাশুড়ীকে কি চক্ষে দেখেছে?

বিয়ের কনের থেকেই গিন্নী হতে হয়েছে তাকে। সংসারত্যাগিনী শাশুড়ীর পরিত্যক্ত সংসারটাকে কুড়িয়ে তুলে নিতে হয়েছে ছোট দুটি হাতে।

সংসারও অবিশ্যি ছোট, শ্বশুর দ্যাওর স্বামী। কিন্তু ছোট বলেই যে হাল্কা তা তো নয়। পাষাণবার। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই যে উত্তরাধিকার সেটা সহজ, সেটা কোমল, কিন্তু এ তো তা নয়।

স্বেচ্ছায় সংসারটাকে ত্যাগ করে চলে গেছে সংসারের গিন্নীটা! ছেলের বিয়ে সব ঠিকঠাক, তখনই অকস্মাৎ মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে এই কাণ্ড।

যথানির্দিষ্ট দিনে ছেলেটার বিয়ে হয় নি বটে, তবু বিয়েটা হলো। কারণ শাশুড়ী সত্যবতী নাকি এ সম্বন্ধ স্থির করে গিয়েছিলেন।

শ্বশুর সেই ইচ্ছেকে প্ৰাধান্য দিয়েছিলেন।

বৌ সুধীরবালা।

মানুষ খারাপ নয়, তবু নবকুমার যেন তাকে তেমন মেহের চোখে দেখেন না, পয়-অপয় কথাটা বিশ্বাস করেন। তিনি।

হাঁচি টিকটিকি মঙ্গলবার সব কিছুতেই পরম বিশ্বাস নবকুমারের। আজও পঞ্জিকাখানা হাতে নিয়ে উল্টে দেখছিলেন, কটা থেকে বেলা কটা পর্যন্ত মূলো খেতে নেই।

হঠাৎ এই ঘোড়ার গাড়ির শব্দ! এই বাড়ির দরজাতেই থামালো!

নবকুমার পঞ্জিকাখানা তাকের উপর রেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসেন, আর হাঁ করে দেখেন ভয়ঙ্কর অপরিচিত। আর বেশি পরিচিত এক নারীমূর্তি নেমে আসছে গাড়ি থেকে।

কে!

কে ও!

নবকুমার যেন আর্তনাদ করে ওঠেন। এত বাৰ্ধক্য এসেছে তাঁর, তাই এত দৃষ্টিবিভ্রম! না, না!

নবকুমার তাই আৰ্তনাদ করে ওঠেন।

কিন্তু এই বিচলিত ভাবটা মুহূর্তমাত্র স্থায়ী হলো, পরীক্ষণেই সে ভাব বদলে গেল। বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখলেন নবকুমার, ভাড়াটে এই গাড়িটা, যাকে নাকি ছ্যাকরা গাড়ি বলা হয়, সেটা ওই নারী আরোহিণীকে নামিয়ে দিয়েই উল্টো মোচড় দিয়ে গড়গড় করে চলে গেল।

তার মানে যে পৌঁছুতে এসেছিল, সে নামল না। সে পত্রপাঠ বিদায় নিল।

অর্থাৎ মানুষটাকে নির্বাসন দিয়ে গেল।

এর মানে কি?

পরমাকাজ্যিক্ষত মূর্তির এ কী অনাকাঙ্ক্ষিত রূপে প্ৰকাশ!

ও এসে পায়ের ধুলো নিচ্ছে!

নবকুমার কি সেই নতমুখ নতদৃষ্টি কন্যাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরবেন? হাহাকার করে বলে উঠবেন, সুবৰ্ণ রে—এতদিন পরে এলি তুই? যখন তোর বাপের সব গেল!

না, পারলেন না।

সেই সহজ স্নেহ-উচ্ছাসের মুখে পাথর চাপিয়ে দিয়ে চলে গেছে সুবর্ণর পারের কাণ্ডারী।

এই চলে যাওয়ার চেহারার মধ্যেই বুঝি সুবৰ্ণলতার দুর্ভাগ্যের ছায়া।

তাই নবকুমার কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আগে প্রশ্ন করেন, কে? সুবৰ্ণ? কী ব্যাপার? মানে—

এখানে থাকতে চাই!

প্ৰণাম-নিবেদনকারিণী এবারে নবকুমারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্থির স্বরে বলে, আর কিছু চাই না। বাবা, শুধু এইখানে থাকতে চাই!

এইখানে থাকতে চাই!

এ আবার কী গোলমেলে প্রার্থনা! বিয়ে হয়ে পর্যন্ত এই এতগুলো বছর যার দর্শনমাত্র মেলে নি, যাঁর জন্যে কত দিন কত রাত শুধু প্ৰাণের মধ্যে হাহাকার করেছে, এবং ইদানীং যার দর্শন পাওয়া সম্পর্কে একেবারে আশা ছেড়ে দিয়েছেন, বলতে গেলে যাকে প্রায় ভুলেই বসে আছেন, সেই মেয়ে কিনা অকস্মাৎ এসে পায়ে আছড়ে পড়ে বলে, আমায় আশ্ৰয় দাও!

বলে, আমি থাকতে চাই!

অথচ শাখা-সিঁদুর-সোনায় জ্বলজ্বলাটি মূর্তি। এমন নয় যে ভাগ্যান্তর ঘটেছে!

বিহ্বল নবকুমার স্থলিত স্বরে বলেন, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। সুবর্ণ!

বুঝতে পারবে না। বাবা! সুবৰ্ণ তেমনি স্থির স্বরে বলে, পরে সব বুঝতে পারবে বাবা! এখুনি সব কিছু বুঝতে চেষ্টা করো না। পরে সব বলছি।

বলেছিল সুবর্ণ হাঁপাতে হাঁপাতে।

কিন্তু নবকুমার তো বলতে পারতেন, থাক মা, বলতে তোকে হবে না কিছু। তুই যে এসেছিস এই আমাদের ঢের। কতকাল তোর চাদমুখটি দেখি নি, হয়তো কোনদিন মরেই যেতাম, ভগবান বোধ করি। দয়া করেই তোকে এনে দিলেন।

বলতে পারতেন।

মেয়েকে সুস্থির হবার সময় দিতে পারতেন। কাছে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তৃষিত পিতৃহৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশ করতে পারতেন, কিন্তু নবকুমার তা করলেন না। নবকুমার কেমন যেন ভয় পেলেন।

আর সেই ভয়ের তাড়নাতেই চির অভ্যাসমত ছুটলেন দিদিকে ডেকে আনতে।

দিদি সৌদামিনী দেবী নবকুমারের নিজের দিদি অবশ্য নয়, পিসতুতো বোন, কিন্তু স্বামী থাকতেও বেধবা হয়ে দীর্ঘকাল তিনি মাতুলালয়ে বাস করেছেন, সেই সূত্রে নবকুমারের দিদিঅন্ত প্রাণ!

যখন রর বয়েস কম ছিল, এবং তারও প্রায় জামাইয়ের মতই স্ত্রী নিয়ে সমস্যার অন্ত ছিল না, ওই বল-বুদ্ধি-ভরসা হয়ে রক্ষা করেছেন।

তবে শেষরক্ষা করতে পারেন নি সৌদামিনী। সুবৰ্ণর বিয়ে উপলক্ষ করে সত্যবতী যখন এক অপরিসীম ধিক্কারে সংসার ত্যাগ করলেন, তখন তো শেষ পর্যন্ত সৌদামিনীই সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন, তথাপি ফিরিয়ে আনতে পারেন নি।

কিন্তু ফিরিয়ে আনবার চেষ্টাই কি করেছিলেন?

সে প্রশ্ন করেছিলেন নবকুমার দিদির কাছে হাহাকার করে, পারলে না সদুদি? তুমি পারলে না? তোমার চেষ্টাও বিফল হল?

সৌদামিনী ক্ষুদ্ধ হাসি হেসে বলেছিলেন, ও কথা বললে মিথ্যে কথা বলা হয় নবু। সত্যি বললে বলতে হয় চেষ্টা আমি করি নি।

চেষ্টা কর নি!

নাঃ। তার মুখ দেখে বুঝেছিলাম যে, কোনো চেষ্টাই সফল হবে না। বিশ্বাসঘাতক স্বামীর ঘর আর করবে না সে। বললে তুই দুঃখু পাবি, তুই ওর যুগ্যি ছিল না কোনদিনই। তবু স্বামী বলে ভালবাসতো, ভক্তিছেদা করতে চেষ্টা করতো, সে ছেদা তুই খোয়ালি। বৌ তোকে অসার অমনিষ্যি যাই ভেবে আসুক, একথা কোনোদিন ভাবে নি তুই ওকে ঠকাবি! সেই কাজ করলি তুই, আমি আবার কোন দুঃখে চেষ্টা করতে যাব বল!

বলেছিলেন সৌদামিনী এসব কথা। তত্ৰাচ নবকুমার দিদির শরণ ত্যাগ করেন নি। সদুদিকে আঁকড়েই আবার হালভাঙা নৌকোটোকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে এসেছিলেন তীরে। এখন আর ভাইয়ের সংসারটা দেখতে হয় না সৌদামিনীকে, ছেলের বৌ দেখে, তবে কারুর একটু মাথা ধরলে ছুটে আসতে হয়।

তাছাড়া এদের লক্ষ্মী, যষ্ঠী, মনসা, মাকাল, ইতু, মঙ্গলচণ্ডী ইত্যাদি করে গোরস্তঘরের যা কিছু নিয়ম-লক্ষণ, পাল-পার্বণ, তার দায় এখনো পোহান সৌদামিনী।

বলতে গেলে এখনো এ সংসারে অভিভাবিকার পোস্টটা সৌদামিনীরই।

অতএব আকস্মিক কন্যার এই আবির্ভাবে ভীত-ত্ৰস্ত-আতঙ্কিত নবকুমার সদুদিকেই ডাকতে ছুটলেন, মেয়েকে ভাল করে বসতে পর্যন্ত না বলে।

বসতে বললো সাধনের বৌ সুধীরবালা। কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, এসো ঠাকুরঝি, হাত-মুখ ধোও।

বৌ সপ্ৰতিভ আত্মস্থ। শ্বশুরের মত ভয় পেল না সে।

বুঝলো একটা ঝগড়াঝাঁটির ব্যাপার। বিয়ে হয়ে এসে পর্যন্ত ননদকে চক্ষে না দেখলেও ননদের কথা শুনেছে বৈকি, অনেকই শুনেছে। ননদের ভাইদের কাছে, পিসশাশুড়ির কাছে, কদাচিৎ শ্বশুরের কাছে। শ্বশুরের কাছে—বেশির ভাগই তার মেয়ে অন্নর সঙ্গে তুলনায় ব্যাপারে।

উঠতে বসতে অনুর দোষ দেখতে পান নবকুমার আর বলেন, তোর পিসি তো এমন ছিল না রে!

নাতিটি নবকুমারের নয়নমণি, নাতনীটি নয়। নাতনীটার মধ্যে থেকে বুঝি কেবলই অনেক দিন আগের একটা বালিকাকে খুঁজে পেতে চান নবকুমার, একদা এই বাড়িরই সর্বত্র যে ছড়িয়ে ছিল মুলুরু কণিকার মত। গোলগাল বেঁটেখাটো শ্যামলা রঙ অন্নর মধ্যে তার আভাস কোথায়? তাই বিরক্ত হন।

আগে এই বাসাটার ভাড়াটে ছিলেন নবকুমার, তার পর বাড়িওয়ালাকে বলে-কয়ে বাড়িটা কিনে নিয়েছেন।

কেন?

কে জানে কী রহস্য!

সাধনের আদৌ ইচ্ছে ছিল না পয়সা খরচ করে এই পচা বাড়িটাই কেনা হয়। বাড়ির অভাব আছে নাকি? ভাত ছড়ালে কাকের অভাব থাকে?

চলছিল বাপের সঙ্গে সামান্য কথান্তর, সদুই রক্ষা করলেন। আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বললেন, বুঝতে পারছিস না বাবা, এই বাড়িখানাতেই তো তোর মা থেকেছে, সংসার করেছে, বলতে গেলে এর সর্বত্রই তোর মা বিদ্যমান। এ বাড়ি ছাড়লে সে একেবারে মুছে যাবে! তাই বোধ করি নবু প্ৰাণ ধরে–

সাধন চিরদিনই শান্ত গম্ভীর, গম্ভীর হয়েই বলেছিল সে, মার প্রতি খুব একটা ইয়েও তো দেখি না। মার নাম উঠলেই তো বাবা তেলে-বুগুনে জ্বলে ওঠেন। আর রাতদিন গাল পাড়েন!

সৌদামিনী হেসেছিলেন।

বলেছিলেন, ছেলেমানুষ তুই, তোকে আর কি বোঝাব! তবে বিয়ে তো করছিস, আপনিই বুঝতে পারবি পরোক্ষে। বেশিদূর যেতে হবে না, আমার জীবনটাই দেখ না কেন! তা সৌদামিনীর জীবনটা এ হিসেবে দ্রষ্টব্য বৈকি। দীর্ঘকাল পতিপরিত্যক্তা হয়ে মামা-মামীর সংসারে হাড়ে দুর্বো গজিয়েছে, স্বামী দ্বিতীয় পক্ষ নিয়ে সুখে সংসার করেছেন। হঠাৎ একদিন চাকা ঘুরলো, স্বামীর সংসারে আবার প্রতিষ্ঠিত হলেন সৌদামিনী রুগ্ন সতীনের কন্না করতে আর তার ষষ্ঠীর সংসারের খবরদারি করতে। তার পর স্বামী বড়গিনীতেই তদগত হয়েছেন, বড়গিনীতেই চক্ষে-হারা হয়েছেন। বলেছেন, প্রথম বলেছেন, ভালবাসা জিনিসটাই আলাদা বড়গিনী!

সমস্ত তো সাধনের চোখের সামনে।

তাই নিজের জীবনের দৃষ্টান্ত দেখান সৌদামিনী; বলেন, তোর বাপের মর্মকথা আমি বুঝি।

নবকুমারও তা জানেন, তাই মর্মকথার ভার নিয়ে ছোটেন দিদির কাছে। আজও ছুটলেন। অতএব সুধীরবালা এসে হাত ধরতে এল সুবর্ণর।

সুবৰ্ণ অবশ্য সে হাতে হাত রাখল না, এমনিই ঝেড়ে-পুড়ে উঠল। বলল, তুমিই বুঝি বৌ?

সুধীরবালা ঘাড় কাত করলো।

বিহ্বল সুবর্ণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সেই তার বাল্যের লীলাভূমিকে। হাত বদল হয়ে জিনিসপত্রগুলো জায়গা বদল করেছে, কিন্তু ইট-কাটগুলো তো আঁচল আছে। ওই জানলাটার নিচে বসে বই পড়তো সুবর্ণর মা, ওই কোণটায় বসে কুটনো কুটতো।

আর দোতলার সেই ছোট্ট ঘরখানা?

যেখানায় সুবৰ্ণ আর তার মা শোবে বলে চৌকি পাতা হয়েছিল?

সাধনের বিয়ে হলে বৌ নিয়ে সাধন ভাল ঘরটায় শোবে, পাশের সরু ঘরটায় সুবৰ্ণকে নিয়ে তার মা সত্যবতী, আর হতভাগ্য নবকুমার অতএব ছোট ছেলেকে নিয়ে নিচেরতলায়।

এই ব্যবস্থার মাঝখানে হঠাৎ এল ঝড়, তছনছ হয়ে গেল। সংসার, ছেলের বৌকে নিয়ে সংসার করা হলো না। সত্যবতীর।

সেই ঝড়ের পরের সংসারটাকে তো আর দেখে নি সুবর্ণ!

সুবৰ্ণ তাই বিহ্বল দৃষ্টি মেলে হারানো দিনকে খুঁজছিল …ওই ওই সেই কুলুঙ্গটা যার মধ্যে সুবৰ্ণর বই-শেলেট থাকতো। এখনো তাই রয়েছে! ধ্বক করে উঠেছিল বুকটা, তার পর বুঝলো ওসব নতুন অধিকারীর ব্যাপার!

সুবৰ্ণ কি আবার এ বাড়ির একটা কুলুঙ্গী খুঁজে নেবে তার বই-খাতা রাখতে? বহুদিনের ধুলো ঝেড়ে হাতে তুলে নেবে সেগুলো? আর সেই পরম বস্তুটি হাতে নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? বলবে, মা, তুমি যা চেয়েছিলে তোমার সুবর্ণ তাই হয়েছে। তবে প্ৰায় তোমার মতই জীবন তার, শুধু তফাৎ এই তুমি সংসারকে ত্যাগ করেছ, আর সংসার সুবৰ্ণকে ত্যাগ করেছে।

চকিত দৃষ্টিপাতের মধ্যে এতগুলো কথা ভাবা হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণর। শুধু যখন সহসা চাঁপা আর ভানু কানুর কাছে এসে ঠেক খেয়েছে, তখন সুধীরবালা বললো, এসো ঠাকুরবি!

সুবৰ্ণ ঝেড়ে উঠলো, বললো—তুমিই বুঝি বৌ?

তারপর বললে, বাবা তাড়াতাড়ি কোথায় চলে গেলেন?

সুধীরবালার বুঝতে আটকায় নি কোথায় গেছেন শ্বশুর। তবু ঘাড় নেড়ে বললো, জানি না।

সুবৰ্ণ অবাক হয়ে ভাবলো, বাবা কি মেয়ে এসেছে বলে তাড়াতাড়ি বাজারে ছুটলেন মিষ্টি আনতে।

অদ্ভুত তো! ভাল করে তো দেখলেনও না সুবৰ্ণকে!

এখন এই পরের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মনের অবস্থা তার অনুকুল নয়। এই অপরিচিত দুটো চোখের সামনে আপন দৈন্য নিয়ে–

বৌ আমার মিনতি করলো, হাত মুখ ধুয়ে নাও ঠাকুরঝি।

সুবৰ্ণ সে কথায় কান দিল না।

বলল, দাদা কোথায়?

বৌ একটু হাসলো।

বললো, কোথায় আর? কাছারিতে!

দাদা উকিল হয়েছে?

হ্যাঁ।

ছোড়দা?

ঠাকুরপো? বৌ হেসে হেসে থেমে থেমে বলে, তিনি তো সাহেব। রেলআপিসে মেজাসাহেব। বাঙালী নামে চলে না, নাম নিয়েছেন এস কে ব্যানার্জী।

সুবৰ্ণর বুকটা হঠাৎ যেন হাহাকার করে ওঠে।

কেন কে জানে?

সুবৰ্ণ কি এ বাড়ির ওই ছেলেটাকে হিংসে করছে? নাকি ওর সঙ্গে সুবর্ণর ব্যবধানের দূরত্ব মনে পড়ে বুকটা খা খা করে উঠল?

একটু থেমে বললো, তা সাহেব আসেন। কখন?

ও মা! তিনি এখানে থাকেন নাকি? তার তো মোগলসরাইয়ে কাজ। আগে ছিল বক্সার-

শেষ কথাটায় কান দেয় না সুবর্ণ।

ওর মাথার মধ্যে ধাক্কা দিতে থাকে মোগলসরাই! মোগলসরাই! যেটা নাকি কাশীর নিতান্ত নিকট। তার মানে ছোড়দা মার নিতান্ত নিকটজন হয়ে আছে এখন। নিশ্চয়। ছোড়দাকে মা ফেলতে পারবে না।

এই মেয়েটার সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। বলল, আমি ছাতে যাচ্ছি।

ছাতে!

ঝুমুৱাই অবাক হল। বললো, ছাতে কেন?

এমনি।

তা হলে চলো-এই যে এদিকে সিঁড়ি–

জানি। সুবর্ণ তীব্ৰস্বরে বলে উঠল, জানি। চলে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

সুধীরবালা অপ্রতিভা মুখে দাঁড়িয়ে থাকলো, আর গেল না। সঙ্গে। রাগও হলো। দিব্যি চলছিলো, হঠাৎ আবার এ কী বিপদ? এ বিপদকে ঠিক সাময়িকও মনে হচ্ছে না যেন। কে জানে কী ঘাড়ে পড়তে চলেছে!

মুখটা বেজার করে দাঁড়িয়ে থাকে সে বরের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। সময় হয়ে এসেছে।

 

গায়ে লম্বা কালো চাপিকান, গলায় পাকানো চাদর, পরনে ধুতি, পায়ে জুতো মোজা, যথারীতি উকিলবাবুর সাজে বাড়ি ফিরলো সাধন শেয়ারের ঘোড়ার গাড়ি করে। মোড়ের মাথায় নামে, গাড়ি অন্যদিকে ঘুরে চলে যায়।

নিত্য অভ্যাসমতই নেমে পড়েই বাড়ির দিকে তাকিয়ে নিল একবার, আর তাকিয়ে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভুরুটা কুঁচকে এল। তার।

ছাতে দাঁড়িয়ে কে??

আলসে থেকে অনেকটা উঁচু তে মুখ, ঘোমটা খোলা মাথা মনে হচ্ছে, এলো চুল!

সুধীরবালা?

সুধীরবালা কি অতটা লম্বা, অতটা ফর্সা?

তা ছাড়া সুধীরবালা এ সময় হাওয়া খেতে যাবে?

কেউ বেড়াতে এসেছে তা হলো!

কিন্তু কে?

বেজার মুখে বসে আছে।

অবাক হল সুবর্ণর দাদা সাধন।

কেউ যদি বেড়াতে আসবে, সুধীরবালা কেন এখানে এমন প্যাচামুখে?

বললো, ছাতে কে? আলসে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মনে হলো, মাথার ঘোমটা খোলা, চুল খোলা–

ঘোমটা খোলা!

চুল খোলা!

সুধীরবালার বুকটা কেঁপে ওঠে।

এ কী কথা!

পাগল নয় তো? নাকি হঠাৎ পাগল হয়ে গেছে? তাই! তাই হয়তো শ্বশুরবাড়ির লোক ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে। কী হবে!

সাধন আর একবার প্রশ্ন করলো, বল, কি? কে এসেছে?

সুধীরবালা নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু গলায় বলে, কে এসেছে পরে শুনো।

পরে শুনবো? তার মানে?

পরে শুনোটা তো ছিল! খবরটা স্বামীর কর্ণগোচর করবার জন্যে তো মরছিল! তবে লজ্জা?

তাই যেন না বললে নয়, এইভাবে বলে সুধীরবালা, এসেছে তোমাদের বোন।

বোন! বোন মানে? কোন বোন?

সাধন গলা থেকে চাদরটা নামিয়ে আলনায় রাখতে ভুলে গিয়ে হাতে করে ধরেই বলে, কোন বোন?

সাধনের কণ্ঠস্বর থেকে বিস্ময় যেন ঝরে ঝরে পড়ে—।

সুধীরবালাও চালাক মেয়ে, রয়ে-বসে পরিবেশন করে। বলে, বোন আর তোমাদের কটা আছে? একটাই তো বোন! সেই বোন।

সেই বোন! মানে সুবৰ্ণ?

হুঁ।

সাধনও বহুদিন অদেখা সেই বোনের আগমন-সংবাদে আনন্দিত না হয়ে ভীতই হয়। শঙ্কিত গলায় বলে, হঠাৎ এভাবে আসার কারণ?

কারণ! সুধীরবালা গলা খাটো করে বলে, কারণ কী করে জানবো? এসেই তো ঠরঠরিয়ে ছাতে উঠেছে!

বাবা নেই?

আছেন। মানে মেয়েকে দেখে তবে গেছেন!

দেখে তবে গেছেন? কোথায় গেছেন?

জানি না। বোধ হয় পিসিমার বাড়ি। দেখামাত্ৰই তো ছুটলেন।

সাধন বিরক্ত হলো।

বললো, বাবার তো কেবল ওই!

সাধন চিন্তিত হলো।

বললো, এলো কার সঙ্গে?

জানি না। চক্ষে দেখলাম না। তাকে। দরজা থেকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।

হুঁ, গণ্ডগোল একটি বাধিয়েছেন আর কি! তা এসেই ছাতে উঠল যে?

ভগবান জানেন। সাতবার বলছি হাত-মুখ ধোও, তা নয়, ছাতে যাব!

অন্ন কোথায়? ডেকে আনতে বল—

অন্নও তো পিছু পিছু ছাতে উঠেছে। বললাম। কিনা, পিসি হয়।

ডাকো ডাকো! কি জানি মাথার দোষ হয়েছে কিনা!

কে ডাকবে?

তুমি চেঁচাও, আমি আর সিঁড়ি ভাঙতে পারব না।

পিসি! পিসির সঙ্গে কী এত কথা!

অপছন্দ ভাব দেখায় সাধন।

 

কিন্তু সাধনের মেয়ে হঠাৎ ভারি পছন্দ করে ফেললো পিসিকে।

আস্তে আস্তে গায়ে হাত দিয়ে বলেছে, তুমি পিসি?

তারপর কেমন করে না-জানি ভোব উঠেছে জমে। সুবৰ্ণকে সে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে আর সুবর্ণ উত্তর দিচ্ছে।

হয়তো এমনিই একটা কিছু চাইছিল সুবর্ণ। বলতে চাইছিল নিজের কথাগুলো।

এই শিশুচিত্তের কৌতূহলের সামনে সেই বক্তব্য সহজ হলো।

অন্ন বলছে, এই বাড়িতে যদি জনেছ তুমি তো এখানে থাক না কেন?

এরা তাড়িয়ে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।

আবার তবে এলে কেন?

আবার শ্বশুরবাড়িরাও তাড়িয়ে দিল।

তোমায় কেবল সবাই তাড়িয়ে দিল।

তাই তো দিচ্ছে।

কেন? তুমি তো খুব সুন্দর!

তাতে কি! সুন্দরের ওপরই তো পৃথিবীর রাগ!

য্যাঃ!

দেখিস বড় হয়ে!

অন্ন নিজের হাতটা পিসির হাতের উপর রেখে বলে, আমি কালো!

না না, তুমি ভালো।

ঠাকুরদা বলে, তুই বিচ্ছিরি, বোকা। তোর পিসি ছিল বুদ্ধির রাজা!

কে বলে এ কথা? কে বলে?

অন্ন পিসির এই আকস্মিক উত্তেজনায় থতমত খেয়ে বলে, ঠাকুরদা! তোমার বাবা!

তোর ঠাকুরদা আমার বাবা হয়, জানিস এ কথা?

ওমা— অন্ন গিন্নীর মত বলে, তা জানবো না! ও বাড়ির ঠাকুমা বলে দেয় নি বুঝি! আচ্ছা, তোমার বর নেই?

বর! আছে বৈকি—

নীচের তলায় তখন পিতাপুত্র গুপ্ত পরামর্শ চলছে।

না, সৌদামিনী তৎক্ষণাৎ আসতে পারেন নি, তার হঠাৎ বাত চেগেছে। কোমর নিয়ে উঠতে দেরি। বলেছেন, তুই যা আমি যাচ্ছি।

সাধন অবশ্য পিসির জন্যে অপেক্ষা করছিল না, অপেক্ষা করছিল বাপের জন্যে। বলল, তুমি কিছু জিজ্ঞেস না করেই চলে গেলে ওবাড়ি!

নবকুমার নিজেকে সমর্থন করেন, জিজ্ঞেস করবার আর কী আছে? বুঝতেই তো পারলাম ভুঞ্জ এসেছেন একটা কিছু। ঝাড়ের বাঁশের গুণ যাবে কোথায়? হয়ে উঠেছেন একখানি অনুমান করছি!

সুবৰ্ণ এ বাড়িতে দুর্লভ ছিল, সুবর্ণ যেন একটু বিষণ্ণতার আধারে ভরা একখণ্ড পরম মূল্যবান রত্ব ছিল, কিন্তু সহসা সুবৰ্ণর দাম কমে গেল।

বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিতে এসে সুবৰ্ণ সব মূল্য হারালো।

সুবৰ্ণ বিপদের মূর্তি হলো।

সুবৰ্ণকে ছাত থেকে ডেকে পাঠিয়ে নবকুমার প্রশ্ন করলেন, হঠাৎ এরকম চলে এলি যে?

সুবৰ্ণ মুখ তুলে বাপের দিকে একবার তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো, চলে তো আসি নি, ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে!

সাধন বিরক্তকণ্ঠে বলে, তাড়িয়ে আমনি দিলেই হলো?

সুবৰ্ণলতা স্থিরভাবে বলে, হলো তো দেখলাম। সহজেই হলো। বললো-ছেলেরা আমাদের বংশধর, ওরা আমাদের কাছে থাক, তুমি তোমার মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকো গে। আমি বললাম, সবাই থাক। মেয়েও তোমাদেরই।

তারপর?

তারপর আর কি! গাড়ি ডাকলো, তোরঙ্গটা নিয়ে গাড়ির মাথায় তুলে দিলো, গাড়িতে উঠলো, দরজায় নামিয়ে দিয়ে গেল, আমি ঢুকে এলাম।

নবকুমার ধৈর্য ধরে সবটা শোনার শেষে ক্ষোভ আর ক্রোধের সংমিশ্রণে গড়া একটি প্রশ্ন করেন, ব্যস! ঢুকে এলাম! বুঝতে পারলি না এটা ত্যাগ করা?

বুঝতে পারব না কেন? ওরা তো বলে-কয়ে—

তবে? কেঁদে পড়ে বলতে পারলি না, ছেলেদের ছেড়ে আমি থাকবো কি করে?

সুবৰ্ণও ব্যঙ্গ আর ক্ষোভে গড়া একটি প্রশ্ন করে, ছেড়ে থাকতে পারবো না, এ কথার কোনো মানে হয়? ওটা তো একটা হাসির কথা!

নবকুমার মুহূর্তের জন্য মাথাটা হেঁট করেন। তারপর বলেন, তা ভবিষ্যৎটা তো ভাবতে হবে?

ভেবে কি সত্যিই কেউ কিছু করতে পারে–? বাবা শব্দটা মুখে এসেও আসে না, অনভ্যাসে মুখের মধ্যেই যেন আটকে যায়, কত মেয়ে তো হঠাৎ বিধবাও হয়!

হরি হরি! নবকুমার ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলেন, যা মুখে এলো বললেই হলো! আশ্চর্য! কোথায় রইল মা, কোথায় রইল মেয়ে, প্রকৃতিটি হয়েছে দেখছি এক ছাঁচে ঢালা। মুখ দিয়ে বার করলি কি করে এ কথা!

সত্যি কথা বলতে বাধবে কেন?

এবার বোধ করি জোর করেই বাবা শব্দটা উচ্চারণ করে সুবর্ণ। বলে, তুমি কি আমায় থাকতে দিতে হবে ভেবে ভয় পাচ্ছ, বাবা?

নবকুমার হঠাৎ বিচলিত হন।

নবকুমারের চোখ দিয়ে একঝলক জল এসে পড়ে। সেই অবসরে সাধন, দ্বলে ওঠে, ভয় পাওয়ার কথা হচ্ছে না। তবে আশ্চর্য হচ্ছি বৈকি। যারা এই এত বছরের মধ্যে কক্ষণো পাঠাল না, তারা হঠাৎ ইচ্ছে করে–

এই সময়ে অন্ন কথা বলে ওঠে। বাবার হাঁটুর নীচে থেকে, পিসির শাশুড়ীর টাকা কমে গিয়েছিল বলে শাশুড়ীটা বলেছিল, বৌরা কিছুদিন বাপের বাড়ি থাক। আমার বেশি খরচ হবে না—, তা পিসি বলেছিল, কোন যাব? যাব না—তাই ওরা রেগেটেগে বলেছে, তবে চলে যাও। থাকতে হবে না। আমাদের বাড়িতে।

তা সে প্রস্তাবে রাজী হলে ক্ষতিটা কি ছিল? সাধন বলে, সেটা তো খারাপ কিছু ছিল না। কিছুদিন বেড়িয়ে যেতে!

নবকুমার বলে ওঠেন, সেটা তো ভালোই হতো। আহ্লাদ করে চলে এলেই পারতে। ফাঁকতালে দুদিন থাকা হয়ে যেত!

ফাঁকতালে পেয়ে যাওয়া কোনো জিনিসে আমার লোভ নেই বাবা!

নবকুমার যেন একটু চমকে ওঠেন। কথাটা কেমন নতুন লাগে তাঁর কাছে।

কিংবা নতুনও নয়, শুধু ভুলে যাওয়াটা একটা সুরের মত। সুবৰ্ণর মা সত্যবতীও যেন এইরকম সুরেই কথা বলতো না?

কিন্তু এখন সময়টা সঙ্গীন।

হারানো সুর নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নয়। যে মেয়ে তাঁর কাছে প্রায় মৃত, অথবা সম্পূর্ণ অপরিচিত, হঠাৎ সেই মেয়েকে ঠিক আছে, তুই চিরকাল আমার ঘর ভরে আমার বুক ভরে থাক। বলা শক্ত বৈকি।

কে জানে মেয়ের কী প্রকৃতি, কী রীতি, কেন তারা এমন করে বিদায় করে দিয়েছে, কিছুই তো জানা নেই! তা ছাড়া তিনি বাপ, মেয়ের হিতাহিত দেখতে হবে! মেয়ে যদি তেজ করে স্বামীর ঘর ত্যাগ করে–

নবকুমার বিচলিত গলায় বললেন, আর সব বৌরা কী বলেছিল?

আর সব বৌরা! সুবর্ণ বিদ্রুপের গলায় বলে, আর সব বৌরা তো বাপের বাড়ি যেতে পেলেই নাচে! মানমর্যাদা বোধ থাকলে তো!

হুঁ! যত মান-মৰ্যাদা তোমার, কেমন? হবেই তো। মানী মায়ের মানী মেয়ে! মা একটা সংসার ধ্বংস করে বসে আছেন, মেয়েও–

নবকুমার হঠাৎ চুপ করে যান।

হঠাৎ পিছন ফেরেন। হয়তো চোখ দুটো আড়াল করতেই।

সাধন এই সব ভাবপ্রবণতা পছন্দ করে না। সাধন বলে ওঠে, ওসব কথা থাক বাবা। কথা হচ্ছে। এ ব্যাপারের একটা বিহিত দরকার। কিনা—

কিনা মানে? নবকুমার উদ্দীপ্ত গলায় বলেন, করতেই হবে। তারা বললো ত্যাগ করলাম, অমনি ত্যাগ হয়ে গেল, এ কথাটা কথা নাকি? তাদের কাছে গিয়ে নাকে খৎ দিয়ে মাপ চাইতে হবে!

নাকে খৎ দিয়ে মাপ চাইতে হবে!

একটা ধাতুপাত্ৰ যেন কথা কয়ে ওঠে।

এ কী স্বর! কী ভয়ানক!

এ স্বর যে বড্ড পরিচিত নবকুমারের।

আশ্চর্য!

মায়ের মতনই হয়ে বসে আছে মেয়েটা? কেন, ভাইদের মত হতে পারত না? কিন্তু এর ভার বইবার শক্তি নেই নবকুমারের। তাই নবকুমার তরল হবার চেষ্টা করেন, তা হবেই তো। শ্বশুরবাড়ি বলে কথা! মায়ের মত খুব নাটক নভেল পড়বার অভ্যোস হয়েছে বুঝি? তাই এত মান-মর্যাদার জ্ঞান! ওসব বুদ্ধিকে প্রশ্রয় দিতে নেই। দু-চারটে দিন যাক, আমি নিজে সঙ্গে করে গিয়ে শাশুড়ীম্যাগীকে তোয়াজ করে আসবো—

আমি তো আর কখনো ওখানে যাব না। বাবা-

শান্ত স্বর সুবর্ণর।

মেয়ের কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ অনুভব করেন নবকুমার, যা হোক করে বুঝিয়ে বাগে আনা যাবে বলে মনে হয় না। দেখা যাক, ভুলিয়ে ভালিয়ে আনা যায়। কিনা!

বলেন, শোনো ক্ষ্যাপা মেয়ের কথা! একেবারে কাটান-ছেড়ান করলে চলে? যাবো, বুঝিয়েসুঝিয়ে পাঁজি দেখিয়ে বরং আনবো একবার দু মাসের জন্যে। এ একটা ভাল হলো, শাপে বর হলো। আসা-যাওয়া ছিল না, আসা-যাওয়ার পথ খুললো—

সুবৰ্ণ ছাত থেকে নেমে এসে বসেছিল সিঁড়ির ধাপে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুমিও তাহলে আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছি। বাবা?

তাড়িয়ে! ছি:। ছি, এ কী কথা!

নবকুমার বলেন, সাধন শুনছিস তো বোনের কথা?

শুনছি। বৈকি। সাধন বলে, তবে মনে হচ্ছে মায়া-মমতার প্রশ্ন এখন নয়। মেয়েদের যেটা আসল আশ্রয়-

আসল আশ্রয়!

সুবৰ্ণ হেসে উঠে বলে, আসল আশ্রয়ের দাম তো ধরা পড়ে গেল দাদা! এক নিমেষের এদিকওদিক, বলে দিল বিদেয় হও। তবু সেই আশ্রয়কেই আসল আশ্রয় বলে আঁকড়ে থাকতে হবে?

সাধনের বৌ সুধীরবালা এইসব কথাবাতাঁর মধ্যেই তাড়াতাড়ি জলখাবারের আয়োজন করে ফেলেছিল। গৃহ প্রত্যাগত স্বামীর জন্যও বটে, আগন্তুক ননদের জন্যেও বটে।

দুখানি ধবধবে কাসার রেকবি করে ধরে এনে দেয় সে দুটো মানুষের সামনে। আগে আসন আনে। আনে। জলের গ্ৰাস।

শ্বশুর এ সময় খান না, অতএব তার জন্যে প্রয়োজন নেই।

সুবৰ্ণ সেই রেকবির দিকে তাকায়।

বড় বড় দুটি রসগোল্লা, দুখানা করে অমৃতি, আর দুখানা করে নিমকি।

সহসা হেসে ওঠে সুবর্ণ।

জোরে জোরে হেসে বলে, কী বৌ? বিদেয়ের ইশারা নাকি? বাঃ! তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী!

নবকুমার বৌয়ের মুখের দিকে তাকান।

গৃহিণীহীন গৃহের গৃহিণী।

তাই তাড়াতাড়ি বলেন, ও কি কথা সুবৰ্ণ? কতদিন পরে এসেছিস তুই, একটু মিষ্টিমুখ করবি না?

সুবৰ্ণ তিক্ত হাসি হেসে বলে, করলাম তো অনেক, রসগোল্লাটা আর সইবে না বাবা। তার চেয়ে তুমি বরং একটা গাড়ি ডাকো।

গাড়ি ডাকো!

নবকুমার ব্যস্ত গলায় বলেন, এখুনি গাড়ি ডাকবো মানে? আজই আমি ছাড়ছি কিনা! এক্ষুনি সদুদি এসে যাবেন, তোর সেই পিসি রে! মনে আছে তো? নাকি ভুলে গেছিস? বেতো মানুষ, মালিশ করাচ্ছে, বললো, যাচ্ছি। এখুনি। আজ আর নয়, বললাম তো দুটো দিন যাক, তারপর সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সাত হাত নাকেখৎ দিয়ে দু মাস নিয়ে আসবার জন্যে অনুমতি চেয়ে আনবো।

কিন্তু সুবর্ণ কি হঠাৎ কালা হয়ে গেল? সুবৰ্ণ শুনতে পেল না। এসব কথা? তাই সেই আগের মত ধাতব কণ্ঠে উচ্চারণ করে উঠল, দাদা, একটা গাড়ি ডাকো-

সাধন এবার বোধ করি ঈষৎ সঙ্কুচিত হয়। বলে, আজই এই দণ্ডে যাবার কী দরকার? বরং আজ একবার আমি ওদের ওখানে গিয়ে-

সাধনের কথা শেষ হয় না, একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ন বলে ওঠে, কেন খালি খালি বলছে বাবা? পিসি মরে গেলেও আর শ্বশুরবাড়ি যাবে না-

বটে? বটে? রাগে আগুন সাধন মেয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলে, যাবে না! বলেছে তোমার কানে ধরে! পাজী ডেপো মেয়ে! হচ্ছেন তৈরি। আর একখানি!

আহা থাক থাক, কচি মেয়েটাকে কেন শুধু শুধু—, নবকুমার বলেন, কূটকচালে কথা রাখ দিকি, নে খা দাদার সঙ্গে বসে খেয়ে নে। সেই তোর ননীর দোকানের রসগোল্লা। ছোটবেলায় যার জন্যে জিভে জল পড়তো তোর। ননী বুড়ো এখনো-

ননীর নামে নরম হতে পারতো সুবর্ণ। ছেলেবেলার উল্লেখে কোমল।

কিন্তু কিসে থেকে যে কি হয়! হঠাৎ সুবৰ্ণলতা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে।

আচমকা বসে পড়ে নিজের কপালটা ঠাঁই ঠাঁই করে দেওয়ালে ঠুকতে ঠুকতে বলে, কেন? কেন তোমরা সবাই মিলে আমাকে অপমান করবে? কেন? কেন?

ভিতরের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করবার আর কোনো ভাষা খুঁজে পায় না বলেই সুবৰ্ণলতা ওর এই এতদিনকার বিবাহিত জীবনের পুঞ্জীভূত সমস্ত প্রশ্নকে এই একটি শব্দের দ্বারা ব্যক্ত করতে চায়।

হয়তো বা শুধু তাও নয়, সমস্ত অবরুদ্ধ নারীসমাজের নিরুদ্ধ প্ৰশ্নকে মুক্তি দেবার দুর্দমনীয় বাসনা এটা, যা সত্যকার কোনো পথ না পেয়ে এমন উন্মত্ত চেষ্টায় মাথা কুটে মরে!

হয়তো বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধেও সভ্যতা আর প্রগতির চোখ-কালসানো আলোর সামনে সাজিয়ে রাখা রঙচঙে পুতুল মেয়েদের পিছনের অন্ধকারে আজও কোটি কোটি মেয়ে এমনিভাবে মাথা কুটে কুটে প্রশ্ন করছে—কেন? কেন?

সুবৰ্ণলতার যুগ কি শেষ হয়ে গেছে?

কোনো যুগই কি কোনোদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে শেষ হয়ে যায়?

হয়তো যায় না!

হয়তো বৃদ্ধা পৃথিবীর শীর্ণ পাঁজরের খাঁজে খাঁজে কোথাও কোনোখানে আটকে থাকে ফুরিয়ে যাওয়া যুগের অবশিষ্টাংশ, এখানে ওখানে উঁকি দিলে তার সন্ধান মেলে।

যেখানে মাথাকোটার প্রতিকার নেই। যেখানে লক্ষ লক্ষ কেন ছুটোছুটি করে মরছে।

তবে দৃশ্যমান মাথাকোটার প্রতিকার হয়। ও কি ও কি বলে ধরে ফেলেন নবকুমার। সাধন জল এনে কপালে ছিটোয়। সুধীরবালা ঘোমটা দিয়ে বাতাস করে।

আর ঠিক এই সময় সৌদামিনী এসে দাঁড়ান ভাঙা কোমর নিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *