পুলিশ বন্দীদের হাজির করার পর সাব-ইন্সপেক্টর তাঁদের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তখন তাঁর কামরায় ছিলেন। তিনি কাপড় পারছিলেন। হেড কনস্টেবল পুলিশের তত্ত্বাবধানে বন্দীদের রেখে বাংলোয় এলো।
সাধারণ ঐ লোকটি কে যাকে তুমি ধরে এনেছ? কিছুটা চিন্তান্বিত হয়ে সাবইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনার আদেশে আমি তাকে গ্রেফতার করেছি। সে একজন আগভুক। শিখ মন্দিরে সে অবস্থান করছিল।
এই উত্তরে সাব-ইন্সপেক্টর বিরক্ত হলেন। তোমার মাথায় বুদ্ধি নেই একথা বিশ্বাস করা ঠিক নয়। সামান্য একটা কাজ আমি তোমার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি গিয়ে এমন কাজ করেছ যা তোমার নিবুদ্ধিতার পরিচায়ক। গ্রেফতার করার আগে তুমি তাকে একবার দেখেছি। গতকাল যে লোকটি আমাদের সাথে ট্রেন থেকে নামে সে কি একই ব্যক্তি নয়?
ট্রেন?? নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে হেড কনস্টেবল বলল, আমি তাকে ট্রেনে দেখি নি। স্যার। আমি শুধু আপনার আদেশ পালন করেছি। সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে ঐ আগন্তুককে গ্রামে ঘোরাফেরা করতে দেখে আমি গ্রেফতার করেছি।
সাব-ইন্সপেক্টর ক্রোধান্বিত হলেন।।
গাধা।
হেড কনষ্টেবল তার অফিসারের মন্তব্য না শোনার ভান করল।
তুমি কোন এলাকার গাধা, সাব-ইন্সপেক্টর একই কথার প্রতিধ্বনি করে বললেন, তোমার মাথায় কি কোন বুদ্ধি নেই?
স্যার, আমি কি অন্যায় …
চুপ কর।
হেড কনষ্টেবল তার নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সাব-ইন্সপেক্টর তার মেজাজ ঠাণ্ডা করলেন। তাঁকে হুকুম চাঁদ-এর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি তাঁর ওপর ভরসা করেছিলেন। তিনি তাঁকে বিব্রত করবেন। এটা হুকুম চাঁদ আশা করেন নি নিশ্চয়ই। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সাব-ইন্সপেক্টর তারের জাল দেয়া দরজায় উঁকি দিলেন।
ভিতরে আসতে পারি, স্যার?
আসুন, আসুন ইন্সপেক্টর সাহেব, হুকুম চাঁদ বললেন। আনুষ্ঠানিকতার জন্য অপেক্ষা করবেন না।
সাব-ইন্সপেক্টর ভিতরে গিয়ে তাঁকে স্যালুট করলেন।
বলুন, কাজ কতদূর হলো? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন। সদ্য শেভ করা চোয়ালে তিনি ক্রম ঘষছিলেন। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা মগের তলদেশে সাদা ট্যাবলেটের মতো একটা বস্তু বুদবুদ ছড়াচ্ছিল। তার ঢেউ ওপরে ভেসে উঠছিল।
স্যার, আজ সকালে আমরা দুজন লোককে গ্রেফতার করেছি। একজন জুগ্গা বদমায়েশী। ডাকাতির রাতে সে বাড়ির বাইরে ছিল। তার কাছ থেকে আমরা অবশ্যই কিছু তথ্য পাব। অন্য লোকটি একজন আগন্তুক। গ্রামের সরদার তার সম্পর্কে আমাদের কাছে রিপোর্ট করেছিল। আপনি তাকে গ্রেফতার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
হুকুম চাঁদ চিবুকে ক্রম ঘসা বন্ধ করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, দ্বিতীয় লোকটির গ্রেফতার করার দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করার চেষ্টা হচ্ছে।
লোকটি কে?
সাব-ইন্সপেক্টর বাইরে অপেক্ষারত হেড কনস্টেবলকে লক্ষ্য করে বললেন, শিখ মন্দির থেকে যাকে গ্রেফতার করেছ, তার নাম কি?
ইকবাল।
ইকবাল কি? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বেশ জোরে জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি এখনই জিজ্ঞাসা করে আসছি। স্যার। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব তাকে কিছু বলার আগেই হেড কনস্টেবল সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের দিকে দৌড়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ধৈৰ্যচ্যুতি ঘটতে শুরু করল। টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে তিনি এক চুমুক হুইস্কি গলাধঃকরণ করলেন। সাব-ইন্সপেক্টর অস্বস্তির মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে রইলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হেড কনস্টেবল ফিরে এসে কাশি দিয়ে তার উপস্থিতির কথা জানাল।
স্যার। সে আবার কাশলো। স্যার, সে লিখতে পড়তে পারে। সে শিক্ষিত।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বেশ ক্রুদ্ধ হয়ে দরজার দিকে ফিরলেন।
তার কি মা-বাবা আছে? কোন ধর্ম আছে কি নেই? শিক্ষিত!
স্যার। হেড কনস্টেবল তো তো করে বলল, সে আমাদের কাছে তার পিতার নাম বলতে অস্বীকার করেছে। সে বলেছে যে, তার কোন ধর্ম নেই। সে আপনার সাথে কথা চলতে চায়।
তাকে ধরে নিয়ে এসো, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব রাগে গর গর করতে লাগলেন। উত্তর না দেয়া পর্যন্ত তার পাছায় বেত মার। যাও, … না, দাঁড়াও। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব এটা দেখবেন।
হুকুম চাঁদের ক্ৰোধ তখনও প্রশমিত হয়নি। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে তিনি তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছলেন। কিছুটা আরাম বোধ হলো তাঁর। রাগও কিছুটা কমল।
আপনি আর পুলিশরা আচ্ছা লোক দেখেছি। নাম, পিতার নাম বা কোন জাতির লোক তা না জেনেই আপনার লোক গ্রেফতার করে। সাদা গ্রেফতারী পরোয়ানায় আপনারা আমার সই করিয়ে নিয়েছেন। একদিন হয়ত আপনারা গভর্নরকে গ্রেফতার করে বলবেন, হুকুম চাঁদ আপনাকে ঐ কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছে। আপনারাই আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করাবেন।
স্যার, আমি এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। লোকটা গতকাল মানো মাজরায় আসে। আমি তার পিতৃ-পরিচয় ও পেশা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি।
হ্যাঁ যান। খোঁজ নিন। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় কাটাবেন না। হুকুম চাঁদ চিৎকার করে উঠলেন। মেজাজ খারাপ করা বা কৰ্কশ ব্যবহার করা হুকুম চাঁদের অভ্যাস নয়। সাব-ইন্সপেক্টর চলে গেলে তিনি আয়নায় নিজের জিহবা পরীক্ষা করে। দেখলেন এবং পানি ভর্তি মাগে আর একটা ট্যাবলেট ছেড়ে দিলেন।
সাব-ইন্সপেক্টর ঘরের বাইরে গিয়ে বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। প্ৰাণ ভরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলেন। কয়েকবার। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ক্ৰোধ তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করল। তাঁকে শক্ত পথেই এগুতে হবে এবং সঙ্কল্পহীনতা কাটাতে হবে। তিনি সোজা সার্ভেন্ট কোয়াটারে গেলেন। জুগাত্ সিং-এর দল থেকে একটু দূরে ইকবাল ও তার নিরাপত্তারক্ষীরা দাঁড়িয়ে ছিল। যুবক লোকটি নিজেকে অপমানিত বোধ করছেন বলে সাব-ইন্সপেক্টরের ধারণা হলো। ঐ লোকটির সাথে কথা না বলাই উত্তম বলে তাঁর মনে হলো।
এ লোকটার কাপড়-চোপড় তল্লাশি কর। তাকে একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্ৰ করি। আমি সব কিছু নিজে পরীক্ষা করব।
ইকবালের পরিকল্পিত বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হলো না। একজন কনস্টেবল তাঁকে প্রায় টেনে হেঁচড়ে একটা কামরার মধ্যে নিয়ে গেল। তাঁর বাধা দান কোন কাজেই এলো না। তিনি তাঁর জামা খুলে পুলিশের কাছে দিলেন। সাব-ইন্সপেক্টর কামরায় ঢুকে জামা পরীক্ষার আগ্রহ না দেখিয়ে নির্দেশ দিলেন,
আপনার পাজামা খুলুন। ইকবাল নিজেকে অপমানিত বোধ করলেন। তাঁর প্রতিরোধ ক্ষমতার আর কিছুই রইল না।
পাজামার মধ্যে কোন পকেট নেই। ফলে এর মধ্যে কিছু লুকিয়ে রাখার উপায় নেই।
পাজামা খুলুন, তর্ক করবেন না। সাব-ইন্সপেক্টর তার হাতের লাঠি দিয়ে নিজের খাকি জামার ওপর আঘাত করলেন কয়েকবার। তার আদেশ ইকবালকে মানতে হবে, এটাই তিনি তাকে বোঝাতে চাইলেন।
ইকবাল তাঁর পাজামার দড়ি ঢিলা করলেন। তার পায়ের গোড়ালির চারপাশে চিলা পাজামা খসে পড়ল। হাতে হাতকড়া ছাড়া তাঁর পরিধানে আর কিছুই রইল না। তিনি পাজামার গণ্ডি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার উপক্রম করলেন, যেন সাব-ইন্সপেক্টর তা পরীক্ষা করতে পারে। না, কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সাবইন্সপেক্টর নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন,
আমার যা দেখার তা দেখে নিয়েছি। আপনি কাপড় পরতে পারেন। আপনি বলেছেন, আপনি একজন সমাজকর্মী। মানো মাজরায় আপনার কাজ কি?
আমার পার্টি আমাকে এখানে পাঠিয়েছে, ইকবাল তাঁর পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে বললেন।
কোন পার্টি?
পিপলস পার্টি অব ইন্ডিয়া।
ইন্সপেক্টর সাহেব ইকবালের দিকে তাকিয়ে বিদ্বেষের হাসি হাসলেন। দি পিপলস পার্টি অব ইন্ডিয়া। তিনি কথা কয়টি আস্তে আস্তে বললেন। সব কটি শব্দ উচ্চারণ করলেন পৃথকভাবে। আপনি কি নিশ্চিত যে, ওটা মুসলিম লীগ নয়?
এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য ইকবাল ধরতে পারলেন না।
না, আমি কেন মুসলিম লীগের সদস্য হতে যাব? আমি…
ইকবাল তাঁর কথা শেষ করার আগেই ইন্সপেক্টর সাহেব কামরার বাইরে চলে গেলেন। বন্দীকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি কনস্টেবলকে নির্দেশ দিলেন। তিনি তার আবিষ্কার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে জানাবার জন্যে বাংলোয় গেলেন। তার ঠোঁটে লেগে রইল আত্মতৃপ্তির হাসি।
স্যার, সব ঠিক আছে। সে বলছে যে, তাকে পিপলস পার্টি পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, সে মুসলিম লীগের সদস্য। দু’টো পার্টি একই রকম। সীমান্তের কাছে কোন অসৎ উদ্দেশ্যে সে এসেছে। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা অন্যায় হয়নি। তার বিরুদ্ধে আমরা যে কোন অভিযোগ আনতে পারি।
আপনি কিভাবে বুঝলেন সে মুসলিম লীগের সদস্য।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব, আস্থার সাথে মৃদু হাসলেন। আমি তাকে বিবস্ত্ৰ করেছি।
ট্যাবলেটের গুড়ো নিচে জমে ছিল। তা গুলিয়ে দেয়ার জন্য হুকুম চাঁদ গ্লাসটা ঝাঁকিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি তা এক ঢেকে সব গিলে ফেললেন। খালি গ্লাসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, গ্রেফতারী পরোয়ানা ঠিক করে পূরণ করে নিন। নাম মোহাম্মদ ইকবাল, পিতার নাম মোহাম্মদ … কিছু একটা বা পিতার নাম-জানা যায়নি, জাতি মুসলমান, পেশা-মুসলিম লীগ সদস্য।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেল নাটকীয়ভাবে স্যালুট করলেন।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। আধা কাজ করে শেষ করবেন না। আপনার পুলিশ ডায়রিতে লিখুন যে, রামলালের হত্যকারীদের এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু সে সম্পর্কিত তথ্য শীঘ্রই পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এ ব্যাপারে জুয়ার কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে বলে আপনি মনে করেন?
হ্যাঁ স্যার। ডাকাতরা চলে যাওয়ার সময় তার বাড়ির আঙ্গিনায় কাচের চুড়ি নিক্ষেপ করে। জুগ্গা তাদের সাথে এই ডাকাতিতে অংশ নিতে অস্বীকার করে বলে দৃশ্যত মনে হয়।
ভাল কথা। তার কাছ থেকে শীঘ্ৰ নামগুলো জেনে নিন। প্রয়োজন হলে তাকে প্রহার করবেন।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব হাসলেন। তাকে প্রহার না করেই তার কাছ থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি ডাকাতদের নাম সংগ্ৰহ করব।
ঠিক আছে, আপনি যেভাবে পারেন নামগুলো সংগ্ৰহ করুন। অধৈৰ্যভাবে হুকুম চাঁদ বললেন। আজকের দুজন গ্রেফতারের देिश्चच। 9ानाः ডায়রিতে দফাওয়ারীভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন। কোন কাজ আনাড়ির মতো করবেন না।
ইন্সপেক্টর সাহেব। আবার স্যালুট করলেন।
সব বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখে কাজ করব স্যার।