উন্মাদ পত্রিকায় একেকটি এলেবেলে প্রকাশিত হয়–আর আমি বেশ কিছু চিঠিপত্র পাই। সেইসব চিঠির ভাষা, ভঙ্গি ও মন্তব্য এমনই যে, প্রতিবারই ইচ্ছা করে লেখালেখি ছেড়ে পুরোপুরি সংসারী হয়ে যাই। এরকম একটি চিঠির নমুনা আপনাদের কাছে পেশ করছি। নারায়ণগঞ্জ থেকে জনৈক মোবারক হোসেন খাঁ লিখেছেন–
আপনি না জানিয়া মুধের মতো এলেবেলে নামক রচনা কেন লিখেন? পয়সার জন্যে আপনার এত লাল কেন? আপনি একবার লিখিলেন–বিবাহের ভোজসভায় তিন নম্বর চেয়ারে। বসিতে হয়। কারণ রেজালার বাটি রাখা হয় তিন নম্বর চেয়ারের সামনে। আপনারা লেখকরা যা মনে আসে তা-ই লেখেন এবং পাঠকদের বিভ্রান্ত করেন। এই অধিকার আপনাদের কে দিল?
মোবারক হোসেন বা সাহেব চিঠিতে আমাকে পরামর্শও দিলেন যার একটি হচ্ছে দূর্বাঘাস ভক্ষণ। চিঠি পড়ে আমি যত রাগই করি না কেন একটি জিনিস স্বীকার করতেই হয়, তা হচ্ছে লেখকরা পাঠকদের সত্যি সত্যি বিভ্রান্ত করেন। ছাপার অক্ষরে যা পড়ি তা বিশ্বাস করার প্রবণতা আমাদের আছে। যার জন্যে পরবর্তী সময়ে বিভ্রান্ত হতে হয়।
লেখা পড়ে আমি একবার মোবারক হোসেন সাহেবের মতোই বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। শৈশবের ঘটনা। পড়ি ক্লাস ফোরে। সেই সময় এক বৃন্তে দুটি ফুল নামের একটি বই পড়ে প্রথম জানতে পারি যে, প্রেম একটি স্বর্গীয়, মহৎ এবং অতি উঁচুস্তরের ব্যাপার।
আমি আমার সদ্যলব্ধ জ্ঞান সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগালাম। আমাদের পাশের বাসার পরী নামের এক বালিকাকে ডেকে কাঁঠাল গাছের নিচে গেলাম। ফিসফিস করে বললাম, পরী, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
পরী চোখ বড়বড় করে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুই অসভ্য।
মেয়েরা পেটে কথা রাখতে পারে না। কাজেই পাঠক-পাঠিকারা আমার অবস্থা সহজেই অনুমান করতে পারেন। গল্পের বইও (সে-সময় এদের বলা হতো আউট বই) আমার জন্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। যে প্রাইভেট মাস্টার আমাদের তিন ভাইবোনকে পড়াতেন আমি কোনো পড়া না পারলে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে বলতেন, প্রেমসাগর! লাইলী-মজনু করে সময় পাস না পড়বি কখন!
আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, একজন মহিলা সমস্ত ব্যাপারটাকে খুব সহজভাবে নিলেন। তিনি হচ্ছেন পরীর মা। আমাকে দেখলেই তিনি হাসতে হাসতে ভেঙে পড়তেন এবং বলতেন, এই যে জামাই। কেমন আছ?
তিনি আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে মাকে বলতেন, জামাইয়ের টানে এসেছি। বেচারা এই বয়েসেই আমার মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছে। আমি কিন্তু আপা এদের বিয়ে দিয়ে দিব। আপনাদের কোনো কথা শুনব না। এরকম প্রেমিক জামাই পাওয়া ভাগ্যের কথা। হি হি হি।
শৈশবের এই ঘটনার কারণেই পরবর্তী জীবনে কোনো তরুণীকে আমি তোমাকে ভালোবাসি এই কথা বলা হয়নি। এরচেয়ে বড় ট্রাজেডি একজন যুবকের আর কী হতে পারে?
বই পড়ে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়েছেন এরকম আরেকজনের কথা বলি। পুরানা পল্টনে থাকার সময় ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয়। এজি অফিসে কাজ করেন। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। রোগা নার্ভাস ধরনের একজন মানুষ। আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন। এক ছুটির দিনে আমার কাছে এলেন। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ বললেন, আচ্ছা ভাই, অনেকদিন থেকেই তো আপনি আমাকে দেখছেন। কখনো কি অদ্ভুত কিছু লক্ষ করেছেন?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, না তো।
আমি মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাই।
সে-কী!
বুঝতে পারছি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, কিন্তু ঘটনা সত্যি।
আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি অদৃশ্য হয়ে যান।
জি। পুরোপুরি অদৃশ্য–কেউ আমাকে দেখে না। ঘটনাটা কীভাবে হয় আপনাকে বাল। ক্লাস এইটে যখন পড়ি তখন সোলায়মনি যাদু নামের একটি বই আমার হাতে আসে। অনেক রকম যাদুবিদ্যা আছে এই বইটিতে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে অদৃশ্য হওয়ার জাদু। অনেক কিছু আগে সেই যাদুতে। যেমন শ্মশানের ভাঙা কলসির মুখ, কুমারী মেয়ের মাথার চুল, সাত নদীর পানি এইসব। তখন বয়স কম ছিল উৎসাহ ছিল বেশি। সব যোগাড় করে মন্ত্রটা পড়ি।
তারপর থেকেই আপনি অদৃশ্য।
জি-না। সবসময় না। মাঝে মাঝে আমি অদৃশ্য হয়ে যাই। কেউ আমাকে দেখতে পায় না।
বলেন কী?
সত্যি কথাই বলছি ভাই। মনে করেন কোনো রেস্টুরেন্টে আমি চা খেতে গেলাম। দোকানে ঢোকা মাত্র আমি অদৃশ্য হয়ে যাব। দোকানের কোনো বয় আমার ডাকে আসবে না। আমি যে টেবিলে বসব সেই টেবিলে আরও কতজন আসবে, চা খাবে আবার চলেও যাবে আমি কিন্তু বসেই থাকব। একটু পরপর বলব, এই যে ভাই। শুনুন, এক কাপ চা দিতে পারবেন। হ্যালো, ভাই একটু এদিকে। কোনোই লাভ হবে না।
ভদ্রলোক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
ভদ্রলোক বললেন, চায়ের দোকানের বয়দের দোষ দিয়ে লাভ নেই–আপনার কথাই ধরুন। প্রায়ই আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সিড়ি দিয়ে উঠবার সময় দেখা, নামবার সময় দেবা। কখনো আপনি আমার সঙ্গে একটা কথা বলেন না। আপনারই দোষ কী? সে বলবেন? আপনি তো আর আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। আমি অদৃশ্য। যখন কোনো পার্টি-টাটিতে যাই সেখানেও এই অবস্থা। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। চুপচাপ এক কোনায় একা বসে থাকি। কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না বলেই কাছে আসছে না, ওদের তো দোষ নেই। আমার নিজের স্ত্রীর বেলায়ও তাই। বেশির ভাগ সময়ই তার কাছে আমি অদৃশ্য। পাশাপাশি থাকি অথচ একটা কথা বলে না। ওর দোষ। কী বলুন। অদৃশ্য কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়?
তা তো বটেই।
বড় যন্ত্রণায় পড়েছি ভাই। আপনার কাছে কি জাদু কাটানোর কোনো বইপত্র আছে?
তবে বইপত্র না পড়েও কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়। যেমন আমাদের পাড়ার রিটায়ার্ড এসপি আব্দুল মজিদ সাহেব। তিনি বিভ্রান্ত হন গান শুনে। কারণ ইদানীং তার হাতে কোনো কাজকর্ম না থাকায় প্রচুর গান শোনেন এবং গানের কথাগুলি তাকে বিভ্রান্ত করে। যেমন একদিন আমাকে এসে বললেন, প্রেমের মরা জলে ডুবে না, এর মানে কা বলুন তো? জলে কেন ডুবে না। পুলিশে চাকরি করেছি, ডেডবডি নিয়ে আমাদের কারবার। যে-কোনো মরা তা সে প্রেমেরই হোক কিংবা প্লেইন এন্ড সিম্পল মার্ডার কেইসহ হে পানিতে ছাড়লেই ডুবে যাবে। কয়েকদিন পর ডেডবডির ভেতরে যখন গ্যাস হবে ৩২ ভেসে উঠবে। কি বলেন, ঠিক না?
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।
তাহলে এইসব উল্টাপাল্টা কথা কেন লেখে বলেন তো। আপনাদের রবি ঠাকুরেরও এই অবস্থা।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। উনার একটা গান আছে–ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। চাবি ভাঙলে ঘর খুলবে কী করে? ঠিক না।
খুবই ঠিক।
কী করা যায় বলুন তো প্রফেসর সাহেব?
মজিদ সাহেবকে কিছু বলতে পারলাম না। কারণ চাবি ভাঙার ব্যাপারটা আমাকেও ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে বিভ্রান্ত। কীভাবে এই বিভ্রান্তি কাটবে কে জানে।