1 of 2

১.০৯ সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ

সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ

পূর্বতন সাম্যবাদীদের মার্ক্স স্বপ্নবিলাসী আখ্যা দিয়েছিলেন। ওঁদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল এই যে, ওঁরা আদর্শ সমাজের চিত্তাকর্ষক ছবি এঁকে গেছেন, কিন্তু সে-সমাজে পৌঁর পথ দেখাননি। মার্ক্স চেয়েছিলেন ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের সাহায্যে পথের সন্ধান দিতে। মার্ক্সের পর দেখা দিলেন লেনিন। বিপ্লবের পথে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবার কলাকৌশল তিনি ব্যাখ্যা করলেন আশ্চর্য প্রতিভার সঙ্গে। রুশ বিপ্লবের অর্ধ শতাব্দী পরে খানিকটা অচঞ্চল মনে আজ তার লাভক্ষতির হিসাব করা সম্ভব।

উনিশ শতকের শেষ ভাগেই রুশ দেশে দ্রুত শিল্পোন্নয়ন শুরু হয়ে গিয়েছিল। বলা প্রয়োজন যে, প্রাক্-বিপ্লব রাশিয়া ছিল ব্রিটিশ আমলের ভারতের সমান দরিদ্র দেশ, এই বহুকথিত ধারণাটা তথ্যগতভাবে ভুল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, স্বাধীনতালাভের সময় ভারতে মাথাপিছু শস্যোৎপাদন যত ছিল ১৯১৩ সালের রুশ দেশে তার তিন গুণেরও বেশী ইস্পাতের উৎপাদনেও তারতম্যটা একই ধরনের। পাশ্চাত্য অনেক দেশের তুলনায় রুশ দেশ অবশ্য সেদিন পিছিয়ে তবে প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্ববর্তী তিরিশ বছরে তার শিল্পোন্নতির তাল ছিল প্রতিবেশী দেশ জামানীর মতোই দ্রুত। যুদ্ধের পর জার্মানী এগিয়ে চলেছে এক পথে, আর রুশ দেশে বিপ্লবের ফলে উদঘাটিত হয়েছে। উন্নতির একটা ভিন্ন পথ।

গত অর্ধশতাব্দীর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কম্যুনিজম বলতে আজ আমরা কার্যত দুটি স্বতন্ত্র বস্তু বুঝি। একদিকে কম্যুনিজম অনুন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবার একটা বৈপ্লবিক পথ। অন্যদিকে উপস্থিত শিল্পোন্নয়নের একটা বিকল্প পদ্ধতি। অর্থনীতিজ্ঞের চোখে এই দ্বিতীয় কথাটাই প্রধান।

সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমার সহানুভূতি আছে। কিন্তু আর্থিক উন্নয়নের ধনতান্ত্রিক পথের তুলনায় সাম্যবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবার জন্য যে সব যুক্তি সচরাচর ব্যবহৃত হয় সেগুলি প্রায়ই অভ্রান্ত নয়। এ-শতাব্দীতে দ্রুত আর্থিক উন্নতির নানা উদাহরণই চোখে পড়ে; যেমন জামানী, জাপান, সুইডেন, কানাডা, মেক্সিকো ও সোভিয়েত দেশের আর্থিক উন্নতি হয়েছে বিভিন্নভাবে। এই বিভিন্ন পথের তুলনামূলক বিচার থেকে আমাদের শিক্ষালাভ করতে হবে। একটা গোড়ার কথা দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত মুনাফা ও স্বার্থবুদ্ধিতে পরিচালিত হয়, অতএব ওটা মন্দ; সমাজতন্ত্রী নেতারা সমাজের হিত চান, অতএব সাম্যবাদ ভালো–এই নীতিসর্বস্ব চিন্তার উপর একান্তভাবে নির্ভর করে কোনো আর্থিক ব্যবস্থারই যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা বেশিদূর সম্ভব নয়। আদর্শ চিন্তা ভালো; কিন্তু আর্থিক জীবনে স্বার্থবুদ্ধির গুরুত্ব অস্বীকার করা ভুল। আদর্শবোধে রঞ্জিত কয়েকটি বিরল ও অবিস্মরণীয় মুহূর্তে জীবনকে আমরা সার্থকজ্ঞান করি। কিন্তু বৈষয়িক বিত্ত উৎপন্ন হয় তিলে তিলে প্রাত্যহিকতার স্পর্শে স্নান কর্মময় সাধারণ দিনে। অতএব মানুষের মহত্তম আদর্শনিষ্ঠাকে নয় বরং দৈনন্দিন জীবনের প্রবলতম প্রবৃত্তিকে, অর্থাৎ স্বার্থবোধকে, ধনোৎপাদনের কাজে কিভাবে নিযুক্ত করা যায় সেটা আর্থিক উন্নতির আলোচনায় বিশেষভাবে বিবেচ্য। এই সমস্যার প্রতি দৃষ্টি রেখে সাম্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা আবশ্যক। এই বাস্তববাদী আলোচনায় ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ভিতর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য একই সঙ্গে চোখে পড়ে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিকল্পিত অর্থনীতির বিশেষ সুবিধাগুলি স্পষ্ট; যেমন বেকার সমস্যার সমাধানে। প্রাগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে অবশ্য এ সমস্যাটা এখন আর আগের মতো তীব্র নেই। আংশিক পরিকল্পনার সাহায্যে ওঁরা ব্যবসায়ের পতন-উত্থানের চক্রটাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত করেছেন। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলিতে অবস্থা জটিল। এর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভিতর বেকার সমস্যার প্রাদুভাবের এক প্রধান কারণ শিক্ষার অব্যবস্থা। সমাজতন্ত্র আমরা গ্রহণ করি বা না-করি, শিক্ষার সংস্কার আবশ্যক। জাপান, জামানী, মার্কিন ও সোভিয়েত দেশে যদিও বিভিন্ন পথে শিল্পোন্নতি ঘটেছে তবু এ কথাটা বিশেষভাবে স্মরণীয় যে, শিক্ষার সংস্কার ও প্রসার সব দেশেরই আর্থিক উন্নতির ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শিক্ষার অব্যবস্থা ছাড়াও শিল্পোন্নয়নের গোড়ার যুগে বেকার সমস্যা জটিল হয়ে ওঠে আরও একটা বিশেষ কারণে। এ সময়ে গ্রাম ভেঙে দলে দলে লোক শহরে আসে; বেকারের সংখ্যা তাতে বৃদ্ধি পায়। এর বিহিত করা কোনো ব্যবস্থাতেই সহজ নয়। গণতান্ত্রিক দেশে তো বিশেষভাবেই কঠিন বাধ্যতামূলক উপায় ছাড়া এ সমস্যার সমাধানে বিলম্ব ঘটা স্বাভাবিক।

আর্থিক উন্নতির জন্য কিন্তু শুধু চাকুরীর সংখ্যা বাড়িয়ে যাওয়াই প্রয়োজন নয়; সেই সঙ্গে শ্রমিককে নতুন নিয়মানুবর্তিতায় অভ্যস্ত ও কলাকৌশলে শিক্ষিত করে তোলাও শিল্পোন্নয়নে প্রথম যুগের একটা আবশ্যিক কাজ। এ কাজটা ধনতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী কোনো দেশেই সহজে সাধিত হয় না। কিছুদিন আগে পূর্ব ইয়োরোপের একজন বিশিষ্ট সাম্যবাদী অর্থনীতি এ দেশে এসেছিলেন কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘আপনাদের দেশের মতোই রুশ দেশের লোকেরা ছিল অলস আর শৃঙ্খলায় অনভ্যস্ত। স্তালিন মারধোর করে ওদের কাজ শেখান।’ কথাটা অসত্য নয়। কাজে শৃঙ্খলা আনবার জন্য যে সব বিশেষ নিয়ম স্তালিন যুগে প্রবর্তিত হয় তা থেকেই ব্যাপারটা খানিকটা আঁচ করা যাবে। ১৯২২ সালে ওদেশে নিয়ম ছিল যে, কোনো শ্রমিক উপযুক্ত কারণ ছাড়া পরপর তিনদিন অথবা মাসে ছ’দিন অনুপস্থিত থাকলে তাঁকে বরখাস্ত করা চলবে। তারপর নিয়মটাকে ক্রমশ কঠিন করে তোলা হয়। ১৯৩২-এর শেষে নিয়ম দাঁড়াল যে, ভালো কারণ ছাড়া এক দিনের অনুপস্থিতিই চাকুরী থেকে বিতাড়নের পক্ষে যথেষ্ট। পরে আরও ব্যাখ্যা করা হল যে, কোনো শ্রমিক বিশ মিনিটের বেশী দেরি করে কাজে এলে তাঁকে অনুপস্থিত বলে ধরতে হবে।

কম্যুনিস্ট প্রচারে অনেক সময় মনে হতে পারে যে, সাম্যবাদী দেশের সমস্ত সম্পদ মজুর শ্ৰেণীরই সম্পত্তি এই জানার আনন্দে দেশের শ্রমিক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন। তাই যদি হত তো সোভিয়েত দেশে স্তালিনী আমলে শ্রমিকদের জন্য এমন কঠিন আইন প্রণয়ন প্রয়োজন হত না। আর আইনভঙ্গের শান্তিও এমন ক্রমশ কঠোর করে তুলতে হত না। সকল শিল্পপ্রধান দেশেই শ্রমিকেরা কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত; আর এই অভ্যাস আয়ত্ত করবার প্রাথমিক পর্বটা সাম্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক সব দেশেই কষ্টের ভিতর দিয়ে কেটেছে। শুধু বাধ্যবাধকতায় অবশ্য কোনো দেশেই ভালো কাজ হয় না। উন্নতিশীল দেশমাত্রেই কাজের নিয়ম এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হয় যে, নিজের স্বার্থের মুখ চেয়েই শ্রমিক কাজে দক্ষতা অর্জন করতে আগ্রহী হন। এদিক থেকে সোভিয়েত ও মার্কিনী ব্যবস্থার ভিতর একটা মৌলিক মিল আছে। পক্ষপাতমুক্ত দৃষ্টি নিয়ে যাঁরা বিষয়টি অনুধাবন করেছেন তাঁরাই এই মিলটাও লক্ষ করেছেন।

মূলধন নিয়োগের ব্যাপারে অবশ্য বিভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থার ভিতর যথেষ্ট তারতম্য লক্ষ করা যায়। ধনতান্ত্রিক দেশে মূলধন কখনও কখনও এমনভাবে নিযুক্ত হয় যাতে ব্যক্তির লাভ হলেও দেশের তাতে ক্ষতি। সাধারণ অবস্থাতেও এটা দেখা যায়; আর অনুন্নত দেশগুলিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সময়ে সমস্যাটা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। অবশ্য হিসাবের অন্য দিকটাও এই সঙ্গে একটু লক্ষ করা ভালো। শিল্পপরিচালনার পিছনে সূ না থাকলে কাজে অনেক সময় শৈথিল্য আসে। আমাদের দেশে সরকার প্রতি নগুলির ভিতর এর উদাহরণের অভাব নেই।

আরও একটা কথা এখানে যোগ করা দরকার। সমাজতন্ত্রী দেশে শিল্পের মালিকানা জাতির অথবা রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, শিল্পপরিচালকেরা সাধ্যমত সরকারের নীতি ও নির্দেশ মান্য করে চলেন অথ, জাতির স্বার্থের সঙ্গে শিল্পবিশেষের স্বার্থের দ্বন্দ্বটা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থারই বৈশিষ্ট্য। এই অনুমানটা কিন্তু নির্ভুল নয়। সমাজতান্ত্রিক দেশেও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিজের স্বার্থের খাতিরে দশের স্বার্থ উপেক্ষা করেন। এর উদাহরণের অভাব নেই। যে সমস্যাটা সোভিয়েত আর্থিক ব্যবস্থার নিয়ন্তাদের ইদানীং বিশেষ চিন্তিত করে তুলেছে তা হল এই। জাতীয় পরিকল্পনার কতারা ভিন্ন ভিন্ন শিল্পে কতটা উৎপাদন করতে হবে তার একটা লক্ষ্য স্থির করে দেন। আর শিল্পের পরিচালক ও শ্রমিকেরা পরিমাণে বেশী উৎপাদন দেখিয়ে বিশেষ পুরস্কার দাবি করেন; কিন্তু জাতে জিনিসটাকে করেন নিকৃষ্ট। দ্রব্যের পরিমাণ নির্ধারণ যতটা সহজ, গুণ নিয়ন্ত্রণ মোটেই ততটা সহজ নয়।

ধনতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী উভয় ব্যবস্থাতেই দোষত্রুটি আছে। উভয় ব্যবস্থাতেই ভিতর থেকে সংশোধনের ফলে এইসব দোষত্রুটি দূর করবার চেষ্টাও চলেছে। সাম্যবাদী দেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে খরচ কমাবার দিকে মনোযোগ দিতে বলা হচ্ছে এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন নির্ধারণ করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে। পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থায় উৎপাদন সাধারণত বাজারের চাহিদা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়; এটাই এই ব্যবস্থার প্রধান গুণ ও দোষ। এটার অসুবিধার দিকটা একটু চিন্তা করলেই মোটামুটি বোঝা যায়। অনুন্নত অর্থনীতির পঙ্গু অবস্থায় চাহিদা-না-বাড়লে উৎপাদন বাড়বে না এই নিয়ম মেনে চললে অনেক সময় পঙ্গুত্ব স্থায়ী হবার সম্ভাবনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাময়িক ক্ষতি স্বীকার করেও ভবিষ্যতের মুখ চেয়ে চাহিদার আগেই উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন। ক্ষুদ্র সীমার ভিতর ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিও হয়তো এটা কখনও কখনও করেন কিন্তু এ ব্যাপারে বাজারের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেওয়া নিরাপদ নয়। অতএব আর্থিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। আর্থিক পরিকল্পনাও কিন্তু আজ আর সাম্যবাদী ব্যবস্থার একান্ত সংরক্ষিত বৈশিষ্ট্য নয়। উদাহরণ হিসাবে ফরাসী দেশের কথা ধরা যাক। ফরাসী আর্থিক ব্যবস্থাকে ধনতান্ত্রিক বললে অন্যায় হয় না। তবু ওদেশের আর্থিক উন্নতিতে জাতীয় পরিকল্পনার প্রভাব স্পষ্ট। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিকল্পনাহীন ‘আর্থিক অরাজকতার উপর প্রতিষ্ঠিত এই অভিযোগকে পিছনে ফেলেই জগৎ আজ এগিয়ে চলেছে। ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের তুলনায় এ কথাটা উপেক্ষা করা। ঠিক নয়।

ধনতান্ত্রিক দেশে অবশ্য মূলধনের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এখনও অব্যাহত। সম্পত্তির বণ্টনে ঐসব দেশে এখনও বিরাট অসাম্য। এই অসাম্যের দাপটে মানুষে-মানুষে একটা সহজ ঐক্যবোধ অহরহ ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের বিবেককে এটা পীড়া দেয়; এই পীড়াবোধেই আমাদের মনুষ্যত্বের প্রমাণ। তবু এই প্রসঙ্গে আলোচনায় খানিকটা মাত্রাজ্ঞানও রক্ষা করা ভালো। এ দেশে যাঁরা সাম্যের কথা বলেন তাঁরা প্রায়ই নিজেকে ‘মধ্যবিত্ত ধরে নিয়ে উপরের সবার আয় হ্রাসের চিন্তা করেন। যেমন মাসিক আয় যাঁর এক হাজার টাকা তিনি সাম্য বলতে বোঝেন যে, কারও আয় যেন দেড় হাজারের বেশী না হয়; আবার যাঁর আয় পাঁচ শ’ তিনি হয়তো চান সকলের আয় হাজারে সীমাবদ্ধ রাখতে। কিন্তু এ দেশে যাঁদের মাথাপিছু মাসিক আয় পাঁচ শ’ টাকার কম নয় তাঁরা জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগও হবেন না। আমরা মধ্যবিত্তে’রা সবাই এ দেশের শতকরা নব্বই ভাগ লোকের তুলনায় উচ্চবিত্ত। যে দেশে অধিকাংশ পরিবারে মাথাপিছু আয় দৈনিক এক টাকারও কম সেখানে জনগণের দৃষ্টিতে যাকে সাম্য বলা যেতে পারে সেই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রগতির কথা ভাববার ও বলবার মত লোক বড় অবশিষ্ট থাকবেন না। অতএব জাতীয় আয় আরও অনেকটা বৃদ্ধি পেলে তবেই সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্যের কথা বলা সঙ্গত। ইতিমধ্যে বিত্তবানেরা যদি বিত্তের বড়াইটা কমান তো ভালো হয়। আরও প্রয়োজন যথাসম্ভব শীঘ্র, যথাসম্ভব বেশী লোকের জন্য খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ন্যূনতম ব্যবস্থা করা। এর বেশী সাম্যের চেষ্টায় আপাতত সুফল আশা করা যায় না; মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে দারিদ্র্যে টেনে নামাবার চেষ্টায় দেশে আত্মনিপীড়নে ও পরপীড়নে অভ্যস্ত এক ধরনের অসহিষ্ণু নেতৃত্ব সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে।

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতেও অসাম্য দূর হয়নি। সেই অসাম্য শুধু আর্থিক নয়। ক্ষমতার অসাম্যও যে কত দুঃসহ হতে পারে, এর ফলে মানুষের কাছে মানুষ কত। বিষমভাবে বাঁধা পড়তে পারে, আজকে আমলাতন্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে তাকালে তা বুঝতে দেরী হয় না। সাম্যবাদী দেশে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে জনসাধারণের দ্বন্দ্বটা সোভিয়েত নেতাদের চেয়েও স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন চীনের নেতা মাও। তিনি অবশ্য তাঁর ১৯৫৭ সালের ভাষ্যে এটাকে “বৈরবিহীন” দ্বন্দ্ব (non-antagonistic contradiction) আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এই বৈরবিহীন দ্বন্দ্ব ইদানীং চীনে যে প্রচণ্ড বৈরিতার সৃষ্টি করেছে তাতে সমস্যাটাকে আর শব্দের মারপ্যাঁচে খাটো করা যাচ্ছে না। যুগোস্লাভ নেতা জিলাসের স্পষ্টোক্তি এখানে স্মরণীয়।

চীনা-সমালোচকেরা বলছেন যে, সোভিয়েত দেশ সাম্যবাদী আদর্শকে ছেড়ে ‘ধনতান্ত্রিক’ পথ গ্রহণ করেছে। মার্ক্সীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী সোভিয়েত ব্যবস্থাকে ধনতান্ত্রিক আখ্যা দেবার কোনো কারণ আজও দেখা দেয়নি। তবু স্বীকার করে নেওয়াই ভালো যে, সোভিয়েত দেশে রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক পরিচালনার ক্ষমতা বহু পরিমাণে একটি আমলাগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। মাওপন্থীরা আরও বলেছেন যে, চীন দেশেও এই ধরনের একটা ঝোঁক দলীয় নেতৃত্বের একাংশের ভিতর দেখা দিয়েছে। এইসব অভিযোগ থেকে একটা কথা স্পষ্ট কলকারখানায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদ করলেই অসাম্য লোপ পায় না।

আরও একটা কথা এই সঙ্গে পরিষ্কার করা আবশ্যক। সমাজতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের কারণ খুঁজতে গিয়ে কয়েকজন মন্দ লোকের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করা অথবা। পুরনো ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উপর দোষ চাপানো বাস্তববিরোধী, ভ্রান্ত বিশ্লেষণ। মার্ক্সবাদীরা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যার আলোচনায় উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থার উপর জোর দিয়ে থাকেন; এটাই মার্ক্সীয় “জড়বাদী” ব্যাখ্যার ভিত্তি। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বের আলোচনায় কিন্তু ওঁরা ইতিহাসের এই বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। ত্যাগ করে চতুর্দিকে ব্যক্তিবিশেষের বিশ্বাসঘাতকতা আর দলীয় শত্রুর ষড়যন্ত্র খুঁজতে শুরু করেন। মার্ক্সবাদের প্রতি একান্ত আনুগত্য যেমন ভুল তেমনই ইতিহাসের মাঝপথে মার্ক্সবাদকে ওভাবে সম্পূর্ণ ত্যাগ করাও অবৈজ্ঞানিক। ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় ব্যবস্থাতেই ক্ষমতার অসাম্যের কারণ খুঁজতে হবে সমাজের অন্তঃপ্রকৃতিতে, উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থার বিন্যাসে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ ভূমিকায়। বিষয়টা আরও একটু তলিয়ে বিচার করা প্রয়োজন।

একালে সমাজ যতই বৃহৎ ও জটিল হয়ে উঠছে রাষ্ট্রের ভূমিকাও ততোই সম্প্রসারিত হচ্ছে। মধ্যযুগের সমাজে নিয়মতন্ত্রটা বড় কথা ছিল না। রাজার শাসনে বা কাজীর বিচারে শাস্ত্রের বিধানের একটা প্রশ্ন ছিল বটে; কিন্তু ক্ষমতাবানের ব্যক্তিগত মর্জিটাই তবু নানাভাবে বড় হয়ে উঠত। আধুনিক রাষ্ট্রের ঝোঁক নিয়মতন্ত্রের দিকে। যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির শাসনের স্থানে নিয়মের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও চলেছে। এটা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিশুদ্ধ অর্থে আধুনিক আমলাতন্ত্রের ভিত্তিও এখানেই। নিয়মশাসিত জটিল ও বৃহৎ রাষ্ট্রযন্ত্রে আমলাতন্ত্র অনিবার্য। শুধু সরকারী শাসনে নয়, আধুনিক সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই ধরনের একটা ঝোঁক অল্পবেশী চোখে পড়ে। মধ্যযুগের। কুটিরশিল্পে শিল্পসামগ্রী সৃষ্টি হত চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী। এই ঐতিহ্যটা শিল্পীর বাইরের বস্তু মনে হত না। আধুনিক বড় কলকারখানায় শ্রমিককে পদে পদে নিয়ম অনুযায়ী কাজ করতে হয়। সে নিয়মটা যান্ত্রিক, সেটার সঙ্গে শ্রমিকের অন্তরের যোগ অসম্পূর্ণ। কর্মটা এমনি করে কর্মীর উপর একটা বাইরের বন্ধন হয়ে ওঠে। এটা আধুনিক জটিল শিল্পপ্রধান সমাজমাত্রেরই সমস্যা। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন রচনায়। শ্রমিক সংগঠনকে অংশগ্রহণ করতে ডাকা সম্ভব; কিন্তু তাতেও এই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয় না। বহু মানুষ মিলে যেখানে একটা যান্ত্রিক ব্যাপারকে চালু রাখতে হয় সেখানে নিয়মগুলি হয়ে ওঠে ‘রুটিন’ ব্যক্তি মানুষকে তার দাসত্ব স্বীকার করেই কাজ করতে হয় আরও একটা কথা আছে। আধুনিক শিল্পসমাজের জটিল কর্মকাণ্ডে এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশ নানাভাবে জড়িত। অফিসে বা কারখানায় যিনি কর্মে নিযুক্ত তাঁকে কাজের নিয়ম নির্ধারণ করবার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া যায় না, কারণ কাজের শেষ লক্ষের সঙ্গে তাঁর নিজেরই পরিচয় অস্পষ্ট। মূলধনের স্বত্ব সংক্রান্ত আইন বদলে এ সমস্যা সমাধান হয় না। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালক গোষ্ঠী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভক্ত এদের ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঐক্যবন্ধন দুই-ই অসম্পূর্ণ। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকে ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ পেলে এই বিভক্ত পরিচালক গোষ্ঠীর পরিবর্তে সর্বত্র একটা অপেক্ষাকৃত ঐক্যবদ্ধ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

আধুনিক সমাজ সংগঠনের এই মূল সমস্যাটি গত দু’শো বছরে বহু চিন্তাশীল ব্যক্তির লেখায় নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তির ক্রমবিকাশ ঘটে। কিন্তু আধুনিক সমাজ সংগঠন যদি সম্পূর্ণ যুক্তিভিত্তিক হত তবুও ব্যক্তিমানুষ ঐ নৈর্ব্যক্তিক নিয়মের রাজত্বে নিজেকে প্রবাসী বোধ করত। বাস্তবক্ষেত্রে অবস্থাটা অবশ্য আরও জটিল হয়ে ওঠে। নিয়ম ও প্রশাসন চালু রাখবার জন্য যে-আমলাতন্ত্রের সৃষ্টি হয় তার ক্ষমতা ও জটিলতা বাড়বার দিকেই একটা দুর্নিবার ঝোঁক দেখা দেয়। পশ্চাৎপদ ধনতান্ত্রিক দেশে হিংসাত্মক বিপ্লবের পথে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অধিকার করবার উপায় লেনিন ও মাওবাদীরা উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু কম্যুনিস্ট দলের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলেই মূল সমস্যার অবসান হয় না। মূলধনে ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ করা যত সহজ আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটানো মোটেই তেমন সহজ নয়। হিংসাত্মক বিপ্লবের অনিবার্য ফলস্বরূপ বিপ্লবের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একটি নতুন শাসকগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং আমলাতন্ত্রের প্রভাব আবারও বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে আর্থিক ক্ষমতার সম্পর্কটাও এই সূত্রে বিচার্য। ধনতান্ত্রিক সমাজে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিপতিদের একটা পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মার্ক্সীয় বিচারে একথা বলা হয়েছে। কথাটা ভুল নয়। কিন্তু শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হবার পর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান জুড়ে বিশাল আমলাতন্ত্রের আধিপত্য আরও বিপুল ও সংহত আকার ধারণ করে। এই বিপুল ক্ষমতা আসলে শ্রমিক শ্রেণীর বা সর্বসাধারণের ক্ষমতারই কেন্দ্রগত সাংগঠনিক প্রকাশ, এই কল্পনাবিলাসী থিওরীর সঙ্গে বাস্তব ঘটনার বিরোধ ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সমস্যাটা কম্যুনিস্ট দেশে সবচেয়ে গুরুতর আকারে দেখা গেছে কৃষির ক্ষেত্রে। এ যাবৎ শিল্পে অনুন্নত যেসব দেশে ক্যুনিস্ট বিপ্লব ঘটেছে সর্বত্রই বিপ্লবের আগে কৃষকদের ভিতর ভূমির স্বত্ব নিয়ে প্রবল অশান্তি ও বিক্ষোভ ব্যাপ্ত ছিল। এ অবস্থায় কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। জমি বণ্টনের যে সব দাবী নিয়ে কম্যুনিস্টরা প্রথমে এগিয়ে আসেন সে-সব দাবী বহু ক্ষেত্রেই ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু কম্যুনিস্ট দল ক্ষমতা দখল করবার পর জমিতে কৃষকের ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ পায়। তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় বৃহদাকার যৌথ ক্ষেতখামার; আর তারই পরিচালনাসূত্রে এক অভূতপূর্ব আমলাতন্ত্রের শাসন চেপে বসে গ্রামে গ্রামে। যুগোস্লাভিয়ার মতো যে দুয়েকটি কম্যুনিস্ট দেশে কৃষককে এ ব্যাপারে স্বাধীন সিদ্ধান্তের অধিকার দেওয়া হয়েছে সেখানে অধিকাংশ কৃষক এই বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু যুগোস্লাভিয়া এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম।

সোভিয়েত দেশের নেতারা বলেন যে, ধনতন্ত্রের পুনরভ্যুত্থানের ভয়ে ওঁরা দেশে বিরোধী দল গঠনের অধিকার দিতে পারেন না। কিন্তু ওদেশ থেকে ধনিক শ্রেণী বিদায় নিয়েছেন বহু বৎসর আগে। ধনিকদের বিরুদ্ধে নয়, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধেই আজ গণমনে ব্যাপক অসন্তোষ। কম্যুনিস্ট দেশের মূল সমস্যা বুঝতে হলে এই কথাটাই প্রথমে মোহমুক্ত মন নিয়ে বোঝা দরকার। আমলাতন্ত্র বিরোধীদলকে ভয় করে; বিরোধী প্রতিষ্ঠানের অভাবে আমলাতন্ত্রের আধিপত্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।

.

আঠার উনিশ শতকে ধনতন্ত্রের প্রবক্তারা সাম্য-স্বাধীনতার বাণী কণ্ঠে নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সেই ইস্তাহারে কিছুটা ছিল সত্য, কিছুটা ভণ্ডামি! নতুন সমাজ ব্যবস্থায় আইনের চোখে নাগরিকের সাম্য স্বীকৃত হল, ব্যক্তিস্বাধীনতার আরও নানা শর্ত গৃহীত হল; কৃষক মজুরও ধীরে ধীরে সঙ্ঘবদ্ধ হবার অধিকার লাভ করলেন। তবু স্বাধীনতার ঐ সব শর্ত সত্ত্বেও অগণিত দরিদ্র মানুষকে পদে পদে নানা অন্যায় সহ্য করতে হয়েছে। ধনতন্ত্রের বিবর্তনে যাঁরা পুরোভাগে ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সোচ্চার। হয়েছে। এটাই অনিবার্য ছিল। কম্যুনিস্ট দেশে আর্থিক উন্নতির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্র তথা কম্যুনিস্ট দল। এখানেও অন্যায় কম ঘটেনি। কম্যুনিস্ট দল সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী উচ্চারণ করেছেন আত্মসমর্থনে। এই নতুন ইস্তাহারেও আছে খানিকটা সত্য আর খানিকটা সত্যের অপলাপ।

মনে রাখা ভালো যে, কোনো ব্যবস্থাই নির্দোষ নয় আর বিশেষ কোনো একটা পথই সব দেশের পক্ষে সমান উপযোগী নয়। সাম্য ও স্বাধীনতার দিকে এগোবার উপায় ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। এদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবার জন্য যেসব শর্ত আজ পালন করা প্রয়োজন তার একটি হল, সুপরিকল্পিত কৃষি সংস্কার। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের বুনিয়াদী সংস্থাগুলিকে গ্রামে ও শহরে ক্রমশ সুদৃঢ় করা আবশ্যক। এই সংস্থাগুলির কাজ হবে দ্বিবিধ গঠনমূলক ও প্রতিরোধাত্মক। এদেশের মানুষের ভিতর আত্মনির্ভরতা দুর্বল। দুর্ভাগ্যের কথা সমাজতন্ত্রের নামে আমরা আরও বেশী করে সরকারের উপর সব ব্যাপারে নির্ভরশীল হতে শিখেছি। পরিণামে আমলাতন্ত্রকেই এতে জোরালো করা হয়। স্বাধীন সমাজ গড়বার পক্ষে এটা সহায়ক নয়। বরং প্রয়োজন পরিপার্শ্বকে বাসযোগ্য করে তুলবার ব্যাপারে আরও বেশী ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ এবং গোষ্ঠীগতভাবে গঠনমূলক চিন্তা ও কর্মের প্রতি ঝোঁক। একই সঙ্গে চাই অন্যায়ের প্রতিকারে গণতান্ত্রিক অথচ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। এদেশে সমাজে যাঁরা ছোট বড় হর্তাকর্ত তাঁদের নানা ব্যাপারে ঔদাসীন্য এমনই অনড়, কোনো কথা তাঁদের কানে তোলা অথবা কোনো প্রশ্নের উত্তর আদায় করা এতই কঠিন যে, মাঝে মাঝে খানিকটা ঘা দিয়ে তাঁদের চৈতন্যোদয়ের চেষ্টাকে এক কথায় অন্যায় বলা যায় না। কিন্তু যুক্তিবিচার ও সহিষ্ণু প্রতিবাদকেই তবু অগ্রাধিকার দিতে হবে; কারণ আঘাত দেওয়াটাই অভ্যাসে পরিণত হলে তাতে অন্যায়ের অবসান ঘটে না, বরং সেই নির্বিচার হিংসা থেকে আরও কঠিন অন্যায়ের সৃষ্টি হয়। স্বাধীন সমাজে সম্পত্তির স্থান নিয়ে বিতর্ক চলবেই। ফরাসী দার্শনিক পু সম্পত্তিকে চৌর্যের সমান বলেও অবশেষে ব্যক্তিগত সম্পত্তি তুলে দিতে চাননি, পাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা শ্বাসরোধকারী হয়ে ওঠে এই ভয়ে। যাঁরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি তাঁরা রাষ্ট্রের অধীনে আনতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই চেষ্টাও হওয়া প্রয়োজন গণতান্ত্রিক উপায়ে। হিংসাত্মক বিপ্লবের পথে যে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে মানুষ এমন কোনো অতুলনীয় আনন্দের অধিকারী হয় না যাতে গৃহযুদ্ধের অপরিসীম ক্ষয় ও তিক্ততা পূরণ হয়ে যায়। বরং পারস্পরিক সন্দেহের ভিতর দিয়ে অত্যাচারের এক অতিকায় যন্ত্র সমাজের বুক জুড়ে চেপে বসে। গণতন্ত্রের পথ যতদিন খোলা আছে ততদিন সেই পথই শ্রেয়।

জীবনে এমন কিছু কাম্যবস্তু আছে যা অপরকে যত বেশী করে দেওয়া যায় ততোই আমরা নিজে বেশী করে পাই; যেমন প্রেম অথবা জ্ঞান। ধন অথবা ক্ষমতা সে জাতীয় বস্তু নয়। এইসব সীমাবদ্ধ কাম্যবস্তু নিয়ে দ্বন্দ্বকত্সহ ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় ব্যবস্থাতেই আছে, যদিও দ্বন্দ্বের রূপটা অবস্থা অনুসারে খানিকটা বদলায়। একথা মনে মনে জেনে রাখাই ভালো যে, ধনতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী কোনো উপায়েই সমাজ অনিন্দ্যসুন্দর হবে না। স্বর্গের কল্পনা কল্পনা হিসাবেই ভালো। বিজ্ঞান আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন; কিন্তু কোনো “বৈজ্ঞানিক পন্থাতেই পৃথিবীতে স্বর্গ স্থাপনা করা যাবে না। এই জেনে তারপর আমরা মানুষের দুঃখ যদি খানিকটা কমাতে পারি তবেই মঙ্গল।

গত পঞ্চাশ বৎসরের ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে যে, লেনিন ও মাও সে-তুং-এর প্রদর্শিত পথে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সম্ভব, অন্তত কখনও কখনও। প্রমাণিত হয়নি যে, ঐ পথে আদর্শ সমাজে পৌঁছানো কখনও সম্ভব। অথচ আদর্শ সমাজে পৌঁছাবার পথের নির্দেশই মার্ক্স দিতে চেয়েছিলেন। ক্ষমতাই যাঁদের আদর্শ, ক্ষমতা ও আদর্শের ভিতর ভেদ উপলব্ধি করবার বোধও যাঁদের লুপ্ত, গত পঞ্চাশ বৎসরের ইতিহাসকে তাঁরাই বিনাদ্বিধায় মার্ক্সবাদের সপক্ষে দ্ব্যর্থহীন সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করবেন। এ কথা শুনে মার্ক্সবাদী কি কষ্ট হবেন? তা হলে বলি, দোহাই আপনাদের, মার্ক্সের একটি কথা অন্ততঃ রাখুন, ওঁকে ভগবান বানাবেন না। এ আশা কি দুরাশা যে, এদেশের সাম্যবাদীরা মার্ক্স অথবা গান্ধী কাউকেই সত্যের একমাত্র অধিকারী বলে দাবী করবেন না? উভয়ই অবশ্য শ্রদ্ধেয়।

গণযুগ ও গণতন্ত্র (১৯৬৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *