লতিমনের বাটী ত্যাগ করিয়া বাহির হইবামাত্র একটী মুসলমান বালক ছুটিয়া আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে একখানি পত্র দিল। বলিল, “বাবু, আপনার পত্র।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, পত্রের খামে তাঁহারই নাম লিখিত রহিয়াছে। বালককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ পত্র তুই কোথায় পাইলি?”
বালক কহিল, “একজন বাবুলোক দিয়ে গেছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় তখনই খাম ছিঁড়িয়া, পত্রখানি বাহির করিয়া পড়িতে লগিলেন;-
“দেবেন্দ্রবিজয়!
বৃথা চেষ্টা-তুমি আমাকে কখনও ধরিতে পারিবে না-তোমার ন্যায় নির্ব্বোধ গোয়েন্দার এ কর্ম্ম নহে। আমি তোমাকে গ্রাহ্যই করি না। তোমার মত বিশ-পঁচিশটা গোয়েন্দাকে আমি কেনা-বেচা করিতে পারি-সে ক্ষমতা আমার খুব আছে। যাহা হোউক, এখনই এমন কাজে ইস্তফা দাও নতুবা প্রাণে মরিবে। তোমার মত শতটা অকর্ম্মা গোয়েন্দা আমার কিছুই করিতে পারিবে না। তোমাকে আমি এখন হইতে সাবধান করিয়া দিতেছি, আমাকে বিরক্ত করিতে চেষ্টা করিয়ো না। এ পত্র পাইয়াও যদি তুমি বাহাদুরী দেখাইতে যাও-তাহা হইলে যদি কিছু বিষয়-সম্পত্তি থাকে, তাহা উইল করিয়া কাজে হাত দিবে। আমার ত মনে খুব বিশ্বাস, তোমার মত গোয়েন্দার হাতে আমি কখনও ধরা পড়িব না-যদি তেমন কোন সম্ভবনা দেখি-যদি ফাঁসীর দড়ীতে একান্তই ঝুলিতে হয়, তোমাকে খুন করিয়া ফাঁসী যাইব। তুমি যখন যেখানে যাইতেছ, যখন যাহা করিতেছ, আমি সকল খবরই রাখি। আমি সর্ব্বদা তোমার পিছু পিছু ফিরিতেছি। তাহাতে বুঝিতে পারিয়াছি-তুমি এখনও ঘোর অন্ধকারে আছ-অন্ধকারে অন্ধের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তুমি একটা আস্ত বোকা, সেইজন্য তোমাকে আমি একতিল ভয় করি না।
সেই
মেহেদী-বাগানের খুনী।”
পত্রখানি পাঠ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত চিন্তিত হইলেন। বুঝিলেন, তিনি যাহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, সে বড় সহজ লোক নহে। দেবেন্দ্রবিজয় পত্র হইতে দৃষ্টি নামাইয়া সম্মুখস্থ বালকের মুখের দিকে চাহিবামাত্র, সেই বালক তাঁহার খুব উপকার করিয়াছে মনে করিয়া বলিল, “বাবু বখা্শিশ দিনা্। যে বাবু আমার হাতে পত্র দিয়া গেল, সে বাবুর কছে একেবারে একটাকা বখা্শিশ পেয়েছি, এই দেখুন।” বলিয়া বালক বামহস্তের মুষ্টিমধ্যে হইতে চাকচিক্যময় একটি টাকা বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখাইল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তুই সে বাবুকে চিনিস? আর কখনও দেখিয়াছিসা্?”
বালক কহিল, “না বাবু।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” সেই বাবুর চেহারা কি রকম?”
বালক সেই পত্রদাতার যেরূপ বর্ণনা করিল, তাহাতে পত্রগ্রহীতার কিছুমাত্র উপকার দর্শিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” এ পত্র যে আমাকে দিতে হইবে, তুই তা’ কি ক’রে জানা্লি?”
বালক বলিল, ” সেই বাবু আমার হাতে এই পত্রখানা দিয়ে ব’লে গেল এই বাড়ী থেকে এখনই যে একজন বাঙ্গালী বাবু বেরুবে, তার হাতে এই পত্রখানা দিবি।”
দে। সে কতক্ষণের কথা?
বা। এই খানিক আগে।
দে। সে বাবু কোনা্ দিকে গেল।
বা। এইদিক দিয়ে বরাবর সোজা চ’লে গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এখন তাহার অনুসরণ করা বৃথা-এতক্ষণ সে কোথায়-কোনা্পথে চলিয়া গিয়াছে, ঠিক করা কঠিন।
দেবেন্দ্রবিজয়কে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বালক পুনরপি বলিল, “হজুর, আমার বখা্শিশ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” সেই বাবুকে যদি তুই কোন রকমে চিনাইয়া দিতে পারিস, কি তার বাড়ী কোথায় আমাকে ব’লে দিতে পারিসা্ তোকে আমি দশ টাকা বখা্শিশ দিব।”
বালক বলিল, ” আমি দিন-রাত ঘুরে ঘুরে চেষ্টা ক’রে দেখব, যদি তাকে আমি দেখতে পাই, ঠিক আপনাকে খবর দেব। কোথায় আপনার দেখা পাব?”
দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে নিজের ঠিকানা বলিয়া দিলেন; কিন্তু মনে মনে বুঝিলেন, এই বালক দ্বারা তাহার বিশেষ কোন কাজ হইবে না; পত্রলেখক লোকটি যেরূপ চতুর দেখিতেছি, তাহাতে অবশ্যই সে ছদ্মবেশে আসিয়া থাকিবে। তিনি বালককে পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, ” সে বাবুর দাড়ী গোঁফ ছিল?”
বালক কহিল, “হাঁ, খুব মস্ত মস্ত দাড়ী গোঁফ, মস্ত মস্ত চুল-চোখে নীল রঙের চশমা।”
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার অনুমান ঠিক-লোকটি ছদ্মবেশেই আসিয়াছিল। বালককে বলিলেন, ” তবে আর তুই সে লোককে দেখিতে পাইবি না-তোর অদৃষ্টে আর বখা্শিশের টাকাগুলো নাই দেখা্ছি।”
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় বালককে বিদায় করিয়া দিলেন এবং নিজে মনিরুদ্দীনের বাটী অভিমুখে চলিলেন।