১.০৯ ডাক্তার নিয়ে গল্প

কোনো একটা পত্রিকায় যেন এই রসিকতাটা পড়েছিলাম। খুব সম্ভব সাপ্তাহিক দেশ। একজন ডাক্তার নিয়ে গল্প।

রোগী এসেছে ডাক্তারের কাছে। তার বললেন, আপনার সমস্যাটা কী? রোগী বল, সমস্যার তো কোনো কুলকিনারা নাই। শরীরে বাত; সকাল সন্ধ্যা জ্বর, কাশি আছে, হাঁপানি আছে। পেটের ট্রাবল দীর্ঘদিন ধরে। ইদানীং আমাশা হয়েছে। যুবক বয়সে যমা হয়েছিল। ছোটবেলায় হয়েছিল হুপিং কফ। এখন চোখেও কম দেখি। আর এই দেখুন-গায়ে কী যেন চাকা চাকা বের হয়েছে।

ডাক্তার সাহেব বললেন, এক কাজ করুন, ঝড়বৃষ্টির সময় সাত ফুট লম্বা একটা লোহার ডাণ্ড নিয়ে মাঠে হাঁটাহাঁটি করুন।

কেন?

আপনার তো সবই হয়েছে, শুধু বজ্রপাতটা বাকি। এইটাই বা বাদ থাকবে কেন? বজ্রপাতও হয়ে যাক।

রসিকতাটা আপনাদের কেমন লাগল জানি না, আমার নিজের বিশেষ ভালো লাগেনি। নির্মম রসিকতা। হাসি আসার বদলে ডাক্তারের উপর খানিকটা রাগই হয়। এইরকম একজন ডাক্তারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। নাম খবিরুদ্দিন। এলএমএফ ডাক্তার। বিশেষজ্ঞ নন বলেই ডাক্তারি কিছু জানেন। ওষুধ খেলে রোগ সারে। তবে নৈবেদ্যের উপর সন্দেশের মতো প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে কিছু কঠিন কথাবার্তা বলেন। রোগীরা তা সহ্য করে নেয়। গ্রাম্য প্রবচন আছে না–যে গরু দুধ দেয়…।

ডাক্তার খবিরুদ্দিনের কাছেই আমি প্রথম শুনলাম যে, বদহজমে যে সমস্ত লক্ষণ দেখা যায় অবিকল একই লক্ষণ প্রকাশ পায় প্রেমে পড়লে। বুক জ্বালা, অস্বস্তি, মাথা ঘোরা, রক্তচাপ বৃদ্ধি, পিপাসাবোধ এবং অনিদ্রা। তার মতে প্রেম এবং বদহজম এ দুটি আসলে একই জিনিস। এক বৃন্তে দুটি ফুল। এবং তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। বদহজমের ওষুধ দিয়ে প্রেমরোগ সারানো যায়।

আমি বললাম, আপনি প্রেমকে তাহলে রোগ হিসেবে দেখছেন? ডাক্তার খবিরুদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, রোগকে রোগ হিসেবে দেখব না? প্রেম হচ্ছে একটা ভাইরাস গঠিত ব্যাধি। সায়েন্স আরও ডেভেলপ করলে প্রেমের ভাইরাস আবিষ্কার হবে। হতেই হবে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করতে পারি না। যা করি তা হচ্ছে সিমটোমেটিক চিকিত্সা। প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই। সিমটোমেটিক চিকিৎসা করবেন, রোগ সারবে।

রোগের দৃষ্টিকোণ থেকে ডাক্তার খবিরুদ্দিন প্রেমকে এইভাবে দেখেন।

১। বারো বছর থেকে নব্বই বছর পর্যন্ত যে-কোনো সময়ে এই রোগের সংক্রমণ। হতে পারে। বৃদ্ধ বয়সে এই রোগ সাধারণত জটিল আকার ধারণ করে।

২। বয়োসন্ধিকাল এই রোগের প্রকৃষ্ট সময়। বয়োসন্ধিকালে রোগের বেশ কয়েকটি সংক্রমণ হতে পারে। তবে আশার কথা রোগ কখনো গুরুতর আকার ধারণ করে না।

৩। এই রোগ পুরুষদের যতটা কাবু করে মেয়েদের ততটা কাবু করতে পারে না। মেয়েরা এই রোগে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে রোগ লক্ষণ কদাচ প্রকাশ পায়।

৪। বিবাহ নামক সামাজিক প্রথা এই রোগে ভ্যাকসিনের কাজ করে। বিবাহিত নর-নারীর খুব অল্প সংখ্যকই এই রোগে আক্রান্ত হন, তবে আক্রান্ত রোগ অতি দ্রুত জটিল আকার ধারণ করে।

ডাক্তার খবিরুদ্দিন প্রেমকে শুধু রোগ হিসেবেই দেখেছেন তা-ই না। প্রেমের দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র মানবজাতিকে চার শ্রেণীতে ভাগ করেছেন এবং এই চার শ্রেণীর জন্যে পৃথক পৃথক চিকিৎসার বিধানও দিয়েছেন। শ্রেণী ও বিধান পুরুষের জন্যে প্রযোজ্য।

ক শ্রেণী বা বিশ্বপ্রেমিক শ্রেণী

এই শ্রেণীর পুরুষ মহিলা দেখামাত্র প্রেমে পড়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ কঠিন ডিসপেপসিয়ার সমুদয় লক্ষণ প্রকাশ পাবে। ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধি পাবে, রক্তে শর্করার পরিমাণ নিম্নগামী হবে। শ্বাসকষ্ট হবে। কবিতা রচনা করলে রোগের কিঞ্চিৎ আরাম হবে। প্রেমিকার কাছে দীর্ঘ পত্র রচনা করলেও ব্যাধির প্রকোপ খানিকটা কমে।

প্রেমিকার একগুচ্ছ চুল সঙ্গে রাখলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। রক্তচাপ কমাবার ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে।

খ শ্রেণী বা অনুকরণ শ্রেণী

শরৎচন্দ্রের দেবদাসের সঙ্গে এই শ্রেণীর বড় রকমের মিল দেখা যায়। মিলের মূল কারণ অনুকরণ প্রবণতা। এদের মধ্যে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেলেই উপন্যাস অথবা সিনেমার প্রেমিক চরিত্রের অনুকরণে সচেষ্ট হয়। ছাত্র হলে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। কেউ কেউ লম্বা চুল-দাড়ি রাখে। এদের কিছু অংশ পরবর্তী সময়ে গাঁজা ও পেথিড্রিন জাতীয় নেশায় আসক্ত হয়। এই রোগে সিমটোমেটিক চিকিৎসা খুব ফলদায়ী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্যি প্রহার খুব চমৎকার কাজ করে।

গ শ্রেণী বা বিপরীত শ্রেণী

প্রেমে পড়লে এই শ্রেণীর মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের স্বভাব প্রকাশ পায়। পুরুষ মহিলাদের মতো আচরণ করে। লজ্জা-ব্রীড়া এইসব দেখা যায়। এই শ্রেণীর মধ্যে প্রেমে পড়া মাত্র কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্ত লক্ষণ প্রকাশিত হয়। মিল্ক অব মেগনেশিয়া এদের জন্যে খুব উপযোগী। বিবাহ নামক সামাজিক প্রথা এদের জন্যে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। বিবাহিত পুরুষ কখনো এই রোগের কবলে পড়ে না।

ঘ শ্রেণী বা বেকুব শ্রেণী

এরা নিজেরা কারও প্রেমে পড়ে না, তবে অন্যরা তাদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বলে ধারণা পোষণ করে। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। বিবাহের পরে এই রোগের প্রকোপ আরও বৃদ্ধি পায়।

ডাক্তার খবিরুদ্দিনের প্রেম-বিষয়ক থিসিসের যৌন অশও আছে। এই বিষয় নিয়ে লেখালেখিতে আমার নিজের খানিকটা ইনহিবিসন আছে বলে লিখলাম না। পাঠক পাঠিকারা চাইলে পরবর্তীকালে উন্মাদএ ডাক্তার খবিরুদ্দিনের ঠিকানা দিয়ে দিতে চেষ্টা করব। তবে আগেভাগেই বলে রাখি, ডাক্তার খবিরুদ্দিন ঘ বা বেকুব শ্রেণীর। এবং আমি নিজে হচ্ছি… না থাক বলে কাজ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *