যামিনী জাগহি যোগী
পিতৃদেব অনেকক্ষণ কান খাড়া করে বসে আছেন। সামনে একটা মোটা বই আধাআধি জায়গায় খোলা। চাপা আলো সামনে ছড়িয়ে পড়েছে। মশারির মধ্যে শুয়ে শুয়ে দেখছি। ঘুম চটে গেছে। সহজে কি আর আসবে। হঠাৎ মশারির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ডাকছে বলো তো? মনে হচ্ছে দুটো কোলা ব্যাং মুখোমুখি বসে গলা সাধছে! এখন তো বর্ষাকাল নয়। ব্যাং আসবে কোথা থেকে?
আজ্ঞে ব্যাং নয়। মেসোমশাইয়ের নাক। দুটো ফুটো দু’রকম শব্দ ছাড়ছে। আর মাঝে মাঝে গলাটা আমতা আমতা করে উঠছে।
রাত বারোটার পর পিতৃদেব একটু নরম হয়ে যান। তখন একটু রসিকতা টসিকতা চলে। রোদ উঠলেই স্বভাবের জলাশয় উত্তপ্ত হতে থাকে। সূর্য যখন মধ্যগগনে মেজাজও তখন সপ্তমে। মেজাজেরও উদয় অস্ত আছে। আসলে এই ঘরে এই সময় তো মায়ের শোবার কথা। নীল শাড়ি, চুড়ির শব্দ। চুলে চিরুনি চালাবার গাঢ় ঘন শব্দ। যেন বটের পাতায় হাওয়া লেগেছে। আমার মা হলেও পিতার স্ত্রী তো! দু’জনের সঙ্গে দু’রকম সম্পর্ক। রিভারসিবল সোয়েটারের মতো। দু’জনের কাছে দুরকম রং! সেই জায়গায় কে শুয়ে আছে। তারই গর্ভজাত এক অষ্টাবক্র মুনি। দেহেও মর্কট, মনেও মর্কট। সন্ন্যাস নিলে, নিজেই নিজের নাম রাখব স্বামী মর্কটানন্দ।
এ নাক কি শুলেই ডাকবে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, দুপুরেও সমানে ডেকে গেছে।
তার মানে মিউজিক্যাল নোজ। আমাদের ফ্যামিলিতে কারুর কখনও নাক ডাকেনি। ডাকের বহর দেখে মনে হচ্ছে অ্যাফ্রিকান নোজ। মেয়েদুটো ঘুমোচ্ছে কী করে! এ যে ঘরের পাশে ঘোড়ার আস্তাবল।
পিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। সমস্যায় সলিলোকি। শেক্সপিয়ার চালু করে দিয়ে গেছেন। ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলেন, রিভলভারে যদি সাইলেন্সার ফিট করা যায়, নাকে কেন যাবে না! নিশ্চয়ই যাবে। ওটা যদি গোল হয়, এটা হবে তিনকোনা।
রাতে চারপাশ শান্ত বলেই ডাকের জোর দুপুরের চেয়ে অন্তত একশো গুণ বেশি মনে হচ্ছে। একেবারে ষাঁড়ের ডাক। ঘঘারতর আক্রোশ। দাতে দাঁত চেপে নাক শব্দ করছে গাঁ গাঁ। বিরাট লরির ইঞ্জিন খাড়াই বেয়ে ওঠার সময় এইরকম পরিত্রাহী শব্দ ছাড়ে। আর একটি উপসর্গ যোগ হয়েছে যা দুপুরে ছিল না। নিজের ডাকে নিজেই চমকে উঠে সাড়া দিচ্ছেন, কে কে? চারবার কে বলে আবার নিচু পরদা থেকে নাক ধাপে ধাপে ওপরে উঠছে। সত্যিই আতঙ্কের বিষয়।
পিতার সলিলোকি, নাক কেন ডাকে? নাক ডাকে, না গলা ডাকে? বর্ষাকালে ব্যাং ডাকে। সে হল পুরুষের ডাক। পুরুষ ডাকছে প্রকৃতিকে। সে তো নাক নয়, গলার খেলা। দেখি বুক অব নলেজ কী বলছে।
রাত দুটো। মানুষের ঘুম চলে গেলে মাথা কত দিকে খেলতে চায়। বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বুক অব নলেজ খুঁজছেন। হঠাৎ মাথাটা বাঁ পাশে হেলে গেল। যেন কোনও কিছুর ঝাঁপটা লাগল। চট করে বসে পড়লেন। গুঁড়িগুড়ি এগিয়ে গেলেন টেবিলের দিকে। হাত বাড়িয়ে আলো নেবালেন। বই বন্ধ করলেন ধপাস করে। একই কায়দায় ফিরে এলেন বিছানায়, মশারির ভেতরে। ফিসফিস করে বললেন, এসে গেছে।
ঘরে সুইশ সুইশ করে ডানার শব্দ হচ্ছে। সেই বিশাল চামচিকিটা। চক্কর দিয়ে উড়তেই থাকবে, উড়তেই থাকবে। পিতার মহামান্য অতিথি। আজ আমাদের বাড়ি-ভরতি অতিথি, মেঘের মতো নাসিকা গর্জন, তাই তেমন গা ছমছম করছে না। নয়তো এই মধ্যরাতে, অন্যান্য দিন, দুটি প্রাণীর চোখের সামনে ডানা-মেলা অন্ধকার যখন লাট খেতে থাকে তখন কেমন যেন মনে হয়। That hor rible black scaffold dressed. That stapled block God sink the rest!
রঙ্গমঞ্চে লাট-খাওয়া চামচিকির প্রবেশ, পিতার গুঁড়িগুড়ি বিছানায় এসে ঢোকা, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস বলা, এসেছে, এসেছে। ঘাড়ের কাছে গরম নিশ্বাস। অন্ধকারে অন্ধকারের তরঙ্গ তুলে পক্ষযুক্ত অন্ধকারের অন্ধকার রেখা টেনে চলা, জগতের গর্ভমোচন করে অতিজাগতিকের রহস্যমুক্তির মতো বিমূর্ত কোনও অনুভূতি। শরীর কেমন শিথিল হয়ে আসে। পিতা বলতে থাকেন, এ সোল, এ সোল। মহৎ কোনও আত্মা। আমাকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। কার আত্মা! আমাদের যত মৃত পূর্বপুরুষ! আত্মার তলে ঈশ্বরের চাকিতে তিনকোনা পরোটার আকৃতি ধারণ করে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে! শিক্ষিত মানুষের এমন বিশ্বাস আসে কী করে? পরপর তিন দিন না এলেই বুঝবে বিপদ আসছে। একটা হাত মাথার বালিশে রেখে কাত হয়ে পিতা ঘরের অন্ধকারের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বোধিবৃক্ষের তলায় উপবিষ্ট বুদ্ধকে শিষ্য পোত্থাপদ জিজ্ঞেস করলেন, প্রভু, এই জগৎ কি অনন্তকালের নয়? কোনও উত্তর নেই? প্রভু, জগৎ কি সসীম? বুদ্ধ নিরুত্তর। জগৎ কি তবে অসীম? এ প্রশ্নেরও কোনও জবাব নেই। প্রভু, আত্মা আর দেহ কি এক? এরও কোনও উত্তর নেই। তা হলে কি পৃথক? বুদ্ধ বললেন, এসব প্রশ্ন অর্থহীন। ধর্মের সঙ্গে কোনও যোগ নেই। এর উত্তর জানা-না-জানায় প্রশ্নকারীর কোনও লাভ নেই। মূল কথা হল, দুঃখ, সমুদয়, নিরোধ আর মার্গ। আত্মা চামচিকি, না চামচিকি আত্মা এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চিত্তবৃত্তির নিরোধ সাধন করে ঘুমিয়ে পড়ো। মেসোমশাই আচমকা কে কে করে উঠলেন।
পিতা বললেন, কানের পাশে এই তূর্যনাদ চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে। ঠেলে তুলতে হবে।
সেটা খুব অভদ্রতা হবে।
এই, এই হল বাঙালি মেন্টালিটি। নোলক-নাড়া বউদের স্বভাব। সঁতে দাঁত চেপে সহ্য করব আর পুকুরঘাটে গিয়ে চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করব। ইয়োররাপের রীতিটা কী জানো? সোজা মুখের ওপর বলা, ইউ আর এ নুইসেন্স। আমার একটা হাই উঠল। খুবই অনুচিত কাজ। তবে আবেগ তো! বেগ চাপা যায় না।
পিতা বললেন, ইউ আর এ নুইসেন্স বুঝলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এইটা হল ইয়োরোপিয়ান অ্যাপ্রোচ।
হাইটা চাপতে পারলাম না। চেষ্টা করেছিলুম। ছপ্পর ফুঁড়ে বেরিয়ে এল।
তোমাকে বলিনি। হাইয়ের পাংচুয়েশানে আগের কথার জের টানলুম। তোমাকে ডিরোজিওর জীবনের একটা গল্প বলি। জানো তো তিনি কে ছিলেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
হিন্দু কলেজে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। ডিরোজিও দেখছেন। হঠাৎ একটা ছেলে এসে সামনে আড়াল করে দাঁড়াল। যেমন তোমরা করো আর কী? ডিরোজিও বললেন, মাই বয়, ইউ আর নট ট্রানসপেরেন্ট। একেই বলে ইংলিশ অ্যাপ্রোচ। অভদ্র না হয়েও কাজের কথাটি বলে ফেলা।
কিন্তু যিনি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন তাঁকে আপনি কী বলবেন? না ট্র্যানসপেরেন্ট, না ওপেক, ডেড।
দেখবে তা হলে! ব্যাপারটাকে কতদূর ফানি করে তোলা যায়! দেখো তা হলে।
বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লেন। চামচিকি উড়ে চলে গেছে শেষ চক্কর মেরে। আলো জ্বলে উঠল। মেঝেতে শতরঞ্জি পড়ল। কিছুই বুঝতে পারছি না। ঘটনা কোন দিকে যাবে। কী করতে চলেছেন। নিচু হয়ে খাটের তলা থেকে বাঁয়া তবলা টেনে বের করলেন।
হাঁটুতে ধীরে ধীরে চাপড় মারলেন বারকতক। তাল বোঝার চেষ্টা করছেন। নাকের ডাকেরও তাল আছে! দেখি কোন তালে ভেড়ে! তবলায় চাটি পড়ল। নেহাত বাগানঘেরা ভুতুড়ে বাড়ি! তা না হলে প্রতিবেশীরা ডান্ডা নিয়ে তেড়ে আসত। তবলা বোল ভাঙছে। বাঃ নাক দেখছি ঝাঁপতালে চলেছে।
মিনিট দশেক হয়ে গেল, তবলা উদ্দাম বেজে চলেছে, ধা ধা, ধা, ধিনতা তা। ধাগে নাগে বাগে পেলে, ধিক্কার দিয়ে যা। ভুরুকুটি, মুকুটি, ভিরকুটি, ফেঁসে যা, ধসে যা, ধা, ধা, ধিনতা,কৎ। যেনাক ডাকে, সে কানে শুনতে পায় না। আর মেয়েরা একবার ঘুমোলে মৃত। বেহুলার কথা মনে নেই! লক্ষ্মীন্দর ঠ্যালা মারছে আর বলছে, উঠ উঠ বেহুলা/সায়াবেনের ঝি। তোরে খাইল কালনিদ্রা/ মোরে খাইল কী! আমাদের মেনিদা তো প্রায়ই সদর দরজার একটা পাল্লা কাঁধে করে রাতে গৃহপ্রবেশ করেন। শ্রীমতী মেনির এমনই ঘুম। দেয়ালে পাল্লা ঠেসিয়ে রেখে একটু দম নিয়ে স্ত্রীর নাক টিপে ধরেন। একটু হাঁসফাস করে চোখ মেলে তাকিয়ে শ্রীমতী বলেন, ভেঙেছ! একেই বলে, ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়। সবই মিস বড় মেনির কাছে শোনা। মাঝে মাঝে দুপুরে আসে পড়তে। এমন নিঃক্ষত্রীয় বঙ্গললনা সচরাচর চোখে পড়ে না। শব্দটা সুখেনের আবিষ্কার। যে-শরীরে যৌবন ফেঁড়ে ফেলার মতো ধার নেই সুখেনের ভাষায় তেমন শরীর হল নিঃক্ষত্রীয়। থিয়েটারে ছেলেরা মেয়ে সাজে। মেয়েরা যদি ছেলে সাজতে চায় সবার আগে মিস মেনির ডাক পড়বে। সব সমতল। ও তলে অতল নেই। সুখেনের কৃপায় জ্ঞানভাণ্ডার যেরকম সমৃদ্ধ হয়েছে, পরিচয় পেলে। পিতা হতভম্ব হয়ে যাবেন। এ যে পিতার পিতা, বৃদ্ধ পিতা।
তবলা থেমে গেল। সাবেক কালের লম্বা লম্বা গরাদ লাগানো খোলা খাড়া জানলায় রাতের আকাশ লেগে আছে। অন্ধকার যেন পাতলা চাঁদরের মতো থিরথির কাঁপছে। ফ্যাকাসে চাঁদ অভিসার শেষ করে ওই পথেই যেতে যেতে উঁকি মেরে দেখছে। ঘরের মেঝেতে লম্বা হয়ে তারাদের ছায়া পড়েছে, চার পাশ কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। মোহনিশা সব সো অনিহারা। দেখছি স্বপ্ন অনেক প্রকারা ॥ এহি জগ যামিনী জাগহি যোগী। পরমারথ পরপঞ্চ বিয়োগী। এই মোহরাত্রি। ভোগী জীব স্বপ্নে নিদ্রিত। কনক, মুকু, মেসোমশাই। আর এই যে আমরা পরমার্থনুসন্ধায়ী বিবেকী যোগী দু’জন সংসার নিশায় জেগে বসে আছি। রাতের রেলগাড়ি চলেছে, চাঁদের পাহাড়ের পাশ দিয়ে তারাদের যাত্রী নিয়ে। থ্যাঙ্কস ফাদার। আপনার জন্যেই এই নিশিযাপন। অসীমের রহস্য সন্ধান।
হাঁটুর ওপর হাত রেখে পিতা তাকিয়ে আছেন উন্মনা হয়ে। সারাশরীরে চাঁদের আলো। ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। না ফিরেই বললেন, ঘুমোলে নাকি?
আজ্ঞে না।
কী হবে ঘুমিয়ে! নেমে এসো। দেখি তুমি কেমন গান শিখেছ?
মিলিটারি ডিসপোজালে কেনা খাকি মশারির ঘেরাটোপ ছেড়ে নেমে এলুম। মেঝেতে রুপোর স্রোত বইছে। ভাণ্ডারে তালে গাইবার মত দুটো গানই আছে। তাই তোক। তুলসীদাসকে মনে পড়ছে। অযোধ্যার পাহাড়। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা। ধরে ফেলি তা হলে, রামনাম সুখদায়ী, সাচ্চা মনসে ভজ রাঘব তো, একদিন মুক্তি পাই। গান বেশ জমে উঠল। সুরের মায়াজাল তৈরি করবার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে। মাতুলের মতো কাজ অলংকার বসাতে না পারলেও চোখের সামনে রামচন্দ্রকে দেখতে পাচ্ছি। কাঁধে ধনুর্বাণ, নন্দলাল বসুর আঁকা টানাটানা চোখ। অযোধ্যার বিশাল প্রাসাদ। সিংহাসনে বৃদ্ধ দশরথ। চামর হাতে দু’পাশে দুই সুন্দরী। অযোধ্যার রাতের বাজার। মশালের আলো। দোকানে দোকানে ঝিলিক মারছে হিরে, চুনি, পান্নার হার। কী শান্তি! কী আনন্দ! রামনাম সুখদায়ী। রাম নাম হ্যাঁয় অমৃতধারা। রাম বিনা কোই নেহি হামারা। ভাবের ঘোরে হড়কে গিয়ে মাঝে মাঝে তাল কাটছে। উত্তেজনায় লয় বেড়ে যাচ্ছে। প্রবল বেগে তবলা বাজাতে বাজাতে পিতা থেকে থেকে হুঁ হুঁ করে উঠছেন। ফাঁক চলে গেছে সমে। সম চলে এসেছে ফাঁকে। মরিয়া, তেরিয়া, খেপে গেছি। সবে সাইকেল চালাতে শিখে রাস্তায় নামার মতো। বেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। লয় বাড়ছে, মাথা দুলছে। লাঠালাঠি ব্যাপার।
খুটুস করে কনকদের ঘরের দরজা খুলে গেল। রাম ভুলে চোখ চলে গেল ঘরের দিকে। কায়দা। করে তিন তেহাই মেরে কালোয়াতের কালোয়াতি শেষ হল। কনক অবাক হয়ে গেছে। রাতের এখন কোন প্রহর! চাঁদের আলো আরও ম্লান হয়ে এসেছে। বৃষ্টিভেজা প্রেয়সীর ওষ্ঠের মতো। পিতাপুত্র সেই আলোতে বসে আছি বিবর্ণ ছবির মতো।
কনক এগিয়ে এসে বললে, মেসোমশাই, কখন উঠলেন?
তিড়িং করে তবলায় চাটি মেরে বললেন, শুতেই যাইনি, তো ওঠা! নাও ধরো ধরো। মন্দ হচ্ছে না। ঘষামাজা করলে হতে পারে।
আমারও তর সইছে না। গলায় সুর এসেছে। সামনে কনক এসেছে। চার পাশে দুধ-গোলা অন্ধকার। মলিন উত্তরীয় জড়িয়ে পৃথিবী চেয়ে আছে পুবের দিকে। আর তো কিছু জানা নেই। ভয়রোই চলুক। জাগিয়ে রঘুনাথ কুবর। পঞ্ছি বন বোলে। আহা সুর যা লাগছে! আকাশের গায়ে সিঁদুরে রং ধরার মতো।
কনক পা মুড়ে বসে পড়েছে। মেসোমশাইয়ের নাসিকা গর্জন থেমে গেছে। এরকম ভীষণ উৎপাতে কে ঘুমোবে! পুরো পরিবার জেগে উঠেছে। ঝাঁপসা পাখি উড়ছে। কুমার রঘুনাথকে জাগাবার জন্যে গাইয়ের কী ব্যাকুলতা! রহস্যময়ী রাত চলে গেল। অচেনা পৃথিবী আবার চেনা হয়ে, উঠছে। স্পষ্ট প্রত্যক্ষ।
চোখদুটো জ্বালাজ্বালা করছে। কনক কাপড়জামা ছেড়ে প্রাইমাস স্টোভে চায়ের জল চাপিয়েছে। মেসোমশাই ঠাকুরঘরে ধ্যানস্থ। পিতা দাঁতে কড়া বুরুশ ঘষছেন। স্টোভের শব্দের সঙ্গে বুরুশের শব্দ মিশে বেশ একটা ঐকতান তৈরি হয়েছে। সকালের গায়ে যেন শিরিষ কাগজ ঘষা হচ্ছে।
মেসোমশাই ঘরের বাইরে এসে ধ্যান-ভাঙা চোখে জগৎসংসারের দিকে কিছুক্ষণ অপলকে তাকিয়ে থেকে বললেন, হরিদা, আপনাদের এখানে কোথাও খাঁটি দুধ পাওয়া যায় না। খাঁটি দুধ!
পিতা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, এ বাজারে খাঁটি কিছু আছে কি? খাটাল আছে, গোরু আছে, বাঁট থেকে সাদা জলও বেরোবে: তবে সে দুধে সরও পড়বে না, গোঁপে ঘিয়ের স্বাদও পাবেন না।
সেই ছেলেবেলা থেকেই সকালে দুধ খাওয়া অভ্যাস, যদি অনুমতি করেন একরার চেষ্টা করে। দেখি।
কটার সময় খাওয়া অভ্যাস?
এই আটটা নাগাদ।
তার আগেই পাবেন। বালতি হাতে রামখেলোয়ান এল বলে।
তা হলে এই এক মাসের জন্যে দুধ একটু বাড়িয়ে দেবার আজ্ঞা করুন।
করলুম। তবে চাদির চাকতি ছোঁড়া চলবে না।
ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গেলেন। সুটকেসে নোট গজগজ করছে, খরচ করার সুযোগ মিলছে না। কনক চায়ের কাপ হাতে পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললে, বাব্বাঃ, কখন দাঁত মাজতে বসেছেন মেসোমশাই! এবার উঠুন। চা এসে গেছে।
ব্রাশ হাতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পিতা বললেন, সকালের চা আমি যে গেলাসে খাই মা। ওইটুকু মধুপরি কাপে কি সানাবে?
খালি পেটে এক গেলাস চা?
ও বাপকো বেটি! লিভারাতঙ্কে ভুগছ! চা আমার লিভারকে কাবু করতে পারবে না। তুমি কিচ্ছু ভেবো না। মেসোমশাই এবার দ্বিতীয় ফাঁকড়া বের করলেন, আপনাদের সকালের বাজারটা একবার দেখে এলে হত না। গামছায় হাত মুছতে মুছতে পিতা বললেন, আপনি মশাই মহা ছটফটে লোক। শান্ত হয়ে একটু বসুন তো! বাজারে গিয়ে গোত্তা খেয়ে কী হবে? এ কি আপনি মধুপুরে চেঞ্জে এসেছেন? ড্যাঞ্চিবাবু হয়ে বাজারে ঘুরবেন? তিন দিনের বাজার বাড়িতে ঠাসা। আগে খেয়ে শেষ করুন।
আমি যে মাছ কিনতে বড় ভালবাসি।
সে সুযোগ রোববারে পাবেন।
পড়ার টেবিল থেকে মুকু ডাকল, বাবা।
পিতৃদেবের ভুরু ক্রমশই কুঁচকে উঠছে।
মেসোমশাই চলে গেলেন। পিতা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তুমি বাজার থেকে দেখেশুনে একটু মাছ আনতে পারবে?
কেন পারব না?
তা হলে নেমে পড়ো। তোমার মেকআপ টেকআপ নিয়ে নাও।
কথায় একটু হুল থাকবেই। বসরাই গোলাপেও কাটা থাকে। মাতুল একটি মুখে ঘষার ক্রিম উপহার দিয়েছিলেন। সেই বস্তুটি একদিন মাখতে দেখে, কী অট্টহাসি! ওহে লালিমা পাল পুং, বঙ্গের বীর সন্তান, চুলে পমেটম, গালে রংচং, পকেট ঢনটন, মুখে মিহিমিহি বুলি, চায়ের কাপে তুফান তুলি, বেড়াবি আর কতকাল। সেই দর্শনের দর্শনী আজও দিতে হচ্ছে।
হরি আছ? হরিশঙ্কর?
বেশ ভারী গলা। সিঁড়ি ভেঙে উঠছেন আর হক মারছেন। এত সকালে কার আগমন? বিধুজ্যাঠা। গায়ে আসাম সিল্কের পাঞ্জাবি। চওড়াপাড় দিশি ধুতি। কপালে লাল চন্দনের টিপ। তার মাঝে একটি চাল আটকে আছে। চুলে অ্যায়সা তেল ঢেলেছেন কপালের দুপাশে গড়াচ্ছে। মাতুল দেখলেই বলতেন, কলুর বলদ। সাতসকালে কারুর শুভাগমন কোনওকালেই তিনি ভাল চোখে দেখেন না।
বিধুজ্যাঠা আর একবার হাঁক পাড়লেন, হরি আছ? হরিশঙ্কর? আমাকে সামনে দেখে বললেন, ও তুমি! বাবা উঠেছেন?
কথায় আছে, তিন তিসি, লোটা গর্দান, দোনো হায় শয়তানকা নিশান। এই মানুষটি সেই লক্ষণাক্রান্ত। চোখে আবার ফ্যান্সি চশমা! আমার পেছনে দাঁড়িয়ে পিতা বললেন, আসুন। হঠাৎ এই সকালে!
এক সার বাঁধানো দাঁত মেলে বিধুজ্যাঠা বললেন, বাধ্য হলুম আসতে। তুমি যেরকম ন্যাজে খেলছ!
তার মানে?
তুমি যেন আকাশ থেকে পড়লে হে!
হ্যাঁ, আকাশ থেকেই পড়লুম। আপনার ন্যাজ আছে সে স্বীকারোক্তি এক ধরনের আত্মপ্রকাশ। মেনে নিতে রাজি আছি। তবে সে সোঁটা ন্যাজ নিয়ে আমি কোন দুঃখে খেলতে যাব।
রেগো না, রেগো না। ভেতরে চলল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা চলে না! ব্যাপারটা যখন দেনাপাওনার।
বিধুজ্যাঠা প্রায় ঠেলেঠুলেই ঘরে ঢুকে এলেন। একটা জ্বলন্ত উনুন যেন পাশ দিয়ে চলে গেল, এত উত্তাপ! চেয়ারে যেন নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন। নিজের ডান পা-টাকেই বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর এমনভাবে রাখলেন যেন বন্দুক ঘোরাচ্ছেন! পিতাও প্রায় সেইভাবেই চেয়ারে বসলেন। এঁদের শরীরে এখন খোঁচা মারলে রক্ত বেরোবে বলে মনে হয় না। রেলগাড়ির স্টিম বেরোবে ফাঁস করে।
পিতা বললেন, কীসের দেনাপাওনা! কীসের দেনাপাওনা! আমার কাছে কেউ এক কপর্দকও পায় না।
পায় পায়, হরিশঙ্কর। নেবার সময় লোকে খুব কাঁদুনি গায়, দেবার সময় তিড়িং তিড়িং লাফায়।
শুনুন, শুনুন, আমি আপনাকে হাড়েহাড়ে চিনি। জীবনে আপনার ত্রিসীমানা মাড়াইনি, মাড়াবার ইচ্ছেও নেই। না খেয়ে মরব সেও ভি আচ্ছা, তবু আপনার মতো এক দালালের কাছে কখনও টাকা ধার করতে যাব না, বুঝলেন? আর তা ছাড়া বাপমায়ের আশীর্বাদে আমি ভিখিরি নই। নিজের ম্যাও নিজেই সামলাতে পারি। তার জন্যে দালালের দরজায় যেতে হবে না।
হরিশঙ্কর, অহংকার ভাল, তবে কী জানো, তোমার মেজদা, যার মেরে তোমার এই বোলচাল, তার শেষের দিনে এই বিধুশৰ্মাই তো ম্যাও ধরেছিল। তোমার মেজবউদি যখন মরোমরো, তুমি তো তখন উড়ছ। বাড়িতে আসর বসাচ্ছ, রাজ এস্টেট থেকে ওস্তাদ আনাচ্ছ, বাড়িতে রেখে বিরিয়ানি ওড়াচ্ছ, আর ওদিকে তোমার মেজদা দু’বেলা আমার কাছে এসে হাত পাতছে।
গেট আউট, ইমিজিয়েটলি গেট আউট। লায়ার, শয়তান, রোগ।
পিতা ঘুষি পাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে সবেগে উঠতে গেলেন। গেঞ্জি গলে মোটা পইতে ঝুলে ছিল। উত্তেজনার অবসরে পইতে যথাস্থলে চেয়ারের কোনায় জড়িয়ে বসেছিল। পিতা উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার উঠল, পইতে ছিঁড়ে দু’টুকরো হল, চেয়ার টাল খেয়ে সশব্দে উলটে পড়ল বইয়ের র্যাকের ওপর, র্যাক থেকে দুদ্দাড় করে বই পড়ল, বইয়ের ধাক্কায় চায়ের গেলাস ছিটকে গেল কোনার দিকে। সব ঘটে গেল পরপর, অনেকটা জন্ম বিবাহ মৃত্যুর অর্ডারে।
মেসোমশাই, মুকু, কনক তিনজনেই ছুটে এসেছেন। পিতা পইতে ছিঁড়ে রণক্ষেত্রে দণ্ডায়মান। প্রতিপক্ষ চেয়ারেই বসে আছেন পায়ের ওপর পা তুলে। মৃদু মৃদু হাসছেন। আমার সেই শয়তানের গল্পটি মনে পড়ল। ঈশ্বর বললেন, শয়তান, লোকে বলে তুমি খারাপ ছাড়া ভাল কিছু কখনও করো না। কেন বলো তো? শয়তান বললে, প্রভু আমার ভাগ্য। দু’জনে ছদ্মবেশে এক মুদির দোকানে বসে কথা বলছিলেন। শয়তান গুড়ের নাগরি থেকে আঙুলে এক ফোঁটা গুড় নিয়ে দোকানের বাঁশের খোঁটায় একটি টিপ পরিয়ে দিয়ে বললে, প্রভু, এটা কি কোনও অপকর্ম? ভগবান বললেন, না, এ আর কী এমন অপকর্ম। তবে দেখুন! দু’জনেই স্থানত্যাগ করলেন। এদিকে সেই গুড়ের টানে সারি সারি পিঁপড়ে খোঁটা বেয়ে উঠতে লাগল। পিঁপড়ের লোভে তেড়ে এল গোদা টিকটিকি। টিকটিকি ধরতে এল বেড়াল। বেড়ালের ওপর ঝাঁপিয়ে এল রাস্তার কুকুর। নিমেষে লন্ডভন্ড, লঙ্কাকাণ্ড।
মেসোমশাই মেয়েদের এক এক টানে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে দুম করে ডান পা ফেলে ঘরে ঢুকলেন। ড্রয়ারের ওপর পাশাপাশি রাখা কাঁচের ফুলদানি চিন করে বেজে উঠল। চাপা হুংকারে বললেন, কী হয়েছে হরিদা?
নানা জিনিসের যুগপৎ পতনের শব্দে বিভ্রান্তিতে পিতা তৃষ্ণীষ্কৃত হয়েছিলেন। মেসোমশাইয়ের প্রশ্নে ঘোর কেটে গেল। বাজারের পাশে একটা লোক বসে বসে ভেলকি দেখাচ্ছিল, লাগ ভেলকি, লাগ ভেলকি। হঠাৎ টাগরায় জিভ জড়িয়ে লোকটির সমাধি হয়ে গেল। সবাই ধন্য ধন্য করছে। কিছুক্ষণ পরে সেই ভাবটি যেই কেটে গেল, লোকটি অমনি লাগ ভেলকি, লাগ ভেলকি বলে চিৎকার শুরু করে দিল। পিতা সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে উঠলেন, গেট আউট গেট আউট, ইউ স্কাউন্ড্রেল।
মেসোমশাই অগ্রপশ্চাৎ কিছুই শোনেননিঃ কিন্তু বীরভাবের একটা স্পর্শদোষ আছে। মালকোচা মারা ধুতিপরিহিত মেসোমশাই বিধুজ্যাঠার চোখের সামনে তিড়বিড় করে নাচতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, গেট আউট, গেট আউট, ইউ স্কাউড্রেল।
আমাদের তিনজনের এতক্ষণ কোনও ভূমিকা ছিল না। লম্ফঝম্প শুরু হওয়ায় আমরা তিনজনে সমস্বরে চিৎকার করতে লাগলুম, বাবা কাঁচ, মেসোমশাই কাঁচ। বাবাতে, মেসোমশাইতে এমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে, কে কার বাবা, কে কার মেসোমশাই! সাবধানবাণী কেউই গ্রাহ্য করছেন না। এদিকে মেঝেতে লেবুর কোয়ার মতো ফালাফালা কাঁচ পড়ে আছে। একবার পায়ে ফুটলে হয়! আমাদের সুখেন একবার বৃন্দাবনকে খুব ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল। বৃন্দাবনের বাবা বৃন্দাবনের মাসিকে দ্বিতীয় পক্ষ করে আনলেন। সুখেন বোকাসোকা বৃন্দাবনকে বুঝিয়ে দিলে, তোর বাবাকে আর ভুলেও বাবা বলে ডাকিনি। ভীষণ রেগে যাবেন। অপমান করা হবে। তিনবার ফেল করেছিস, এইবার তা হলে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। মেসোমশাই বলবি। মাসির বর মেসো হয় জানিস তো! পরের দিন সকালে দেখা গেল, বৃন্দাবন উদম হয়ে বাইরের রকে বসে আছে। কী হল রে বৃন্দাবন? কী বলব মাইরি, রাতে খাবারটাবার সব বাড়া হয়েছে, যেই ডাকলুম, মেসোমশাই, খাবেন আসুন, এতদিনের বাবা মাইরি জুতো হাতে তেড়ে এলেন। শরীরের অবস্থা দেখ, মেসোতে আর মাসিতে মিলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিয়েছে রে! সব কেড়ে নিয়ে। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। বাবা মাইরি সত্যিই মেসো হয়ে গেছে।
বিধুজ্যাঠা এমনভাবে বসে আছেন, যেন কুচিপুডি নৃত্য দেখছেন। প্রোগ্রাম শেষ হলে হাততালি দেবেন। কাঁচ পরিষ্কার করে নাচের নিরাপদ জমি তৈরি করার জন্যে কনক ঝাটা আনছিল। খেয়াল করেনি। সেই রাতের আরশোলা-পেটানো ঝাটা। একটা আধমরা প্যান্তাখাঁচা মাল কাঠির মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল। মেঝেতে নিচু হয়ে বোল কাটা জোড়া জোড়া পা বাঁচিয়ে যেই এক টান মেরেছে, আরশোলা ক্যাতরাতে ক্যাতরাতে হাত বেয়ে একেবারে সেই মোম আশ্রয়ে ঢুকে পড়ল যেখানে বিবাহের আগে কোনও পুরুষের হাতের প্রবেশ নিষেধ। কনক ঝাটা ফেলে মেঝেতে কুমড়ো গড়াগড়ি। ওদিকে কুচিপুডি, এদিকে হিন্দি সিনেমার সুঁই নাচ। শেম শেম বলতে ইচ্ছে করছে। বিধুজ্যাঠা ছাড়া সকলেরই অবস্থা মত্ত মৃদঙ্গের মতো। খ্যাচাখাই খ্যাচাখাই করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বেজেই চলেছে। গেট আউট বললেও কেউ যদি গেড়ে বসে থাকে, তা হলে তাকে চ্যাংদোলা করে বাইরে ফেলে দিয়ে আসতে হয়।
মেসোমশাইয়ের হঠাৎ বোধহয় আদালতের কথা মনে পড়ল, বাজখাই গলায় চেঁচাতে লাগলেন, পুলিশ পুলিশ। ওদিকে সাহসী মুকু বক্ষলগ্ন আরশোলা সমেত কনককে বাইরে টেনে নিয়ে গেছে, সেদিক থেকে নানা রকমের কাতর চিৎকার ভেসে আসছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমার ভীষণ সাহস। আরশোলা ফারশোলায় আর কোনও ভয় নেই। হাত ঢুকিয়ে খপাত করে ধরেই ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দোব। অসাধারণ বীরত্ব। সেভিয়ার অফ ম্যানকাইন্ড, উওম্যানকাইন্ড। আহা, মানিক আমার। একটা উটকো লোক এসে পিতাকে অপমান করছে, সন্তান হয়ে গায়ে লাগছে না, রুখে দাঁড়াবার সাহস হচ্ছে না, মজা দেখছ, এরই মধ্যে আবার আরশোলা উদ্ধারের শখ। এই শোন, রোজই তো কথামৃত পড়িস, তা হলে মন অত চুলবুল করছে কেন রে! সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। সন্ন্যাসীর পক্ষে স্ত্রীলোক, থুথু ফেলে থুথু খাওয়া। স্ত্রীলোকদের সঙ্গে সন্ন্যাসী বসে বসে কথা কবে না–হাজার ভক্ত হলেও জিতেন্দ্রিয় হলেও আলাপ করবে না।আরে সে তো পড়েছি। আরশোলা ঢুকেছে যে!
বিধুজ্যাঠা পায়ের ওপর থেকে পা নামিয়ে বললেন, সামান্য ক’টা টাকার জন্যে এত নাচানাচি, ভাঙাভাঙি!
যোলোকলা পূর্ণ হল। দরজার সামনে মাতামহ। কয়েকদিন অদর্শনের পর আজ উপস্থিত। বুকের কাছে দু’হাতে ধরা একটি বিশাল ঠোঙা। কাগজ ফুড়ে তেল ফুটে উঠেছে। তার মানে রসদ সহ অভিযানে বেরিয়ে পড়েছেন। মুড়ি আর তেলেভাজা। পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ চালাবার ইচ্ছে ছিল। ঘরের লন্ডভন্ড কাণ্ড অবস্থা দেখে বললেন, কী ব্যাপার! বেড়াল ঢুকেছে নাকি? বেড়ালও চোর, তবে তার জন্যে আবার পুলিশ কেন?
আজ্ঞে বেড়াল নয়, বিধুজ্যাঠা।
মাতামহ টর্পেডোর মতো সামনে ঝুঁকে পড়ে দেখলেন, তারপর দু’পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, আরে আরে, এটা যে দেখছি সেই সিন্ধুঘোটক জুট মার্চেন্টটা। আঁটকুড়োর ব্যাটা? তুই এখানে সাতসকালে কী করছিস! ফুটবল খেলছিস। ব্যাটার মুখ দেখলেও অযাত্রা।
ক্রোধে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠলেও পিতার শালীনতা জ্ঞান নষ্ট হয়নি। মাতামহকে বললেন, এ আপনি কী বলছেন? আঁটকুড়োর ব্যাটা? আরও অনেক ভাল ভাল গালাগাল আছে, যেমন পিগ, রাসকেল, সান অফ এ বিচ, হতচ্ছাড়া, জানোয়ার। সেসব ছেড়ে আপনি চলে গেলেন বস্তির ল্যাঙ্গোয়েজে। ওই আপনার দোষ। মুখের ফিল্টার নষ্ট হয়ে গেছে।
মাতামহ একগুঁয়ে ছাত্রর মতো বললেন, যা বলেছি, বেশ বলেছি। তুমি ওকে কতটা চেনেনা হরিশঙ্কর? ও একটা চিট। দ্যাটস রাইট। হি ইজ এ চিট। শুধু তাই নয়, ওই আগেরটাও। তুমি ওর জন্মবৃত্তান্ত জানো? ওর মা ছিল নন্দলালের রক্ষিতা। সমাজের যে শাসন নেই, তাই আজ সিল্ক চড়িয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। চুলে আবার পমেটম। তুই কোন সাহসে আমাদের সামনে চেয়ারে পা তুলে বসে আছিস? ওঠ। উঠে দাঁড়া। কান ধরে উঠে দাঁড়া।
মাতামহকে দেখে বিধুবাবু একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। এখন যেন জোকের মুখে নুনের ছিটে পড়ল। বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সামান্য ক’টা টাকার জন্যে তা হলে কোর্ট কাছারিই করতে হচ্ছে।
আবার টাকা! কীসের টাকা? কার টাকা? পিতা তেড়ে আসতে চাইছেন। হাতের মুঠো আবার পাকিয়ে উঠেছে। আমরা আবার কোরাসা ধরেছি, বাবা কাঁচ, মেসোমশাই কাঁচ।