ব্যক্তি ও গণসমাজ
শিল্প বিপ্লবের প্রথম যুগে সামাজিক ভাঙ্গাগড়ার মাঝখানে যে-সব আদর্শ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তারই একটিকে নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করব। আমরা ভাবতে ভালবাসি যে, ভবিষ্যতের আদর্শ সমাজ হবে একটি ছোট সুখী পরিবারের বর্ধিত সংস্করণ। পরিবারে যেমন সহানুভূতির একটি সহজ ঐক্যে সবাই যুক্ত হয় বৃহত্তর সমাজেও তেমনই একসূত্রে আবদ্ধ হবে সহস্রটি প্রাণ। পরিবারে আমরা ভাইয়ে-ভাইয়ে কলহ চাই না; আদর্শ সমাজেও তেমনি সবাই হবে একমন, একাত্ম। পারস্পরিক দাবিদাওয়ার নিষ্পত্তি হবে প্রীতির ভিত্তিতে, অন্ত হবে ক্ষুদ্র স্বার্থের আর ভুল বোঝাবুঝির।
এই আদর্শে এমন একটি আদিম ও মৌল সত্য আছে যে একে শ্রদ্ধা করতে হয়। তবু এর আপাত সরলতা মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতে সমাজকে দারুণ আশাভঙ্গের সংকটে টেনে নামাতে পারে। তাই এর সম্বন্ধে সাবধান হওয়াও প্রয়োজন।
সব মানুষ এক মন এবং প্রাণ, এমন কখনও ছিল কি না জানি না। যদি থেকেও থাকে সে সমাজ আমরা পিছনে ফেলে এসেছি এবং তাতে প্রত্যাবর্তন আর সম্ভব নয়। মতের অনৈক্য আধুনিক সমাজে অনিবার্য। এ কথাটাই আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে। যে-সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত পরিবর্তন চলছে সেখানে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সমস্ত শাস্ত্রের প্রতি অল্পবেশী অবিশ্বাস নিয়ে যুক্তিবাদী মানুষ তাঁর নিজের চিন্তা শুরু করবেন এটাই স্বাভাবিক। আর সন্দেহ থেকে যেখানে চিন্তা শুরু সেখানে পরিপূর্ণ মতৈক্যে পৌঁছানোটা আশ্চর্য। এই আশ্চর্য যোগাযোগ তবু আমরা নিয়তই আকাঙ্ক্ষা করি। যুক্তি যদি সত্যে উপনীত হবারই পথ হয় তো যুক্তিবাদী মানুষমাত্রই অবশেষে একমতে পৌঁছবেন কারণ সত্য এক–এমন একটা সরল আশার কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়। কিন্তু এই আশাটা অবাস্তব। শেষ সত্যে যখন সমাজ পৌঁছবে তখন সমস্ত পরিবর্তনেরও অন্ত ঘটবে। সেই পরিবর্তনহীন সমাজ তো সৃষ্টির শেষ অঙ্ক; তার কথা আজ আর চিন্তাও করা যায় না। যে সমাজে আমরা আছি ও থাকব তাতে পরিবর্তন অপ্রতিরোধ্য; অতএব মতের অনৈক্যও অনিবার্য।
একথা শুধু আধুনিক মানুষের বুদ্ধিগ্রাহ্য চিন্তার ক্ষেত্রেই সত্য নয়, তার সমগ্র উপলব্ধি সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। আধুনিক মনের অনেকখানি যন্ত্রণার শুরু এখানেই। ভালো ও মন্দ সম্বন্ধে আমরা যেখানে একমত নই সেখানে পরস্পরকে ভালোবাসাও কঠিন হয়ে ওঠে। যে জগৎকে আমি ভালোবেসে কাছে টানতে পারছি না সে আমার ভালোবাসার ব্যর্থতার সাক্ষী হিসাবে তার কঠিন অস্তিত্ব নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে, এটা সহ্য করা সহজ নয়। এই অসহ্য অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয় সেই নাস্তিবাদী পাগলামি যা সব কিছুকে ধ্বংস করতে চায়।
অথবা আমরা সমস্যা সমাধানের কোনো সহজ উপায় খুঁজি। আমাদের সঞ্চিত বিক্ষোভ চালিত করি কোনো স্থূল শত্রুর বিরুদ্ধে। এরই এক উদাহরণ কুদ্ধ জাতীয়তাবোধ। হিটলারের দেশ একদিন চেয়েছিল, এমনই একটা সামষ্টিক ক্রোধে দেশের আভ্যন্তরীণ বাদ-বিসংবাদকে ডুবিয়ে দিতে। শুধু জাতি নয়, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আশ্রয় করেও অসহিষ্ণু সংহতিবোধ জেগে ওঠে মাঝে মাঝে। সেই হিংস্র সংহতির উত্তেজনায় সাময়িকভাবে মনে হতে পারে যে, ভাঙ্গা পরিবার তার হারানো ঐক্য বুঝি আবার খুঁজে পেল। নেশার মতই ক্ষণস্থায়ী এই ঐক্য, আর হিংসার মত ধ্বংসাত্মক।
অথবা আমরা মুক্তি খুঁজি নতুন কোনো মোহে। বিশ্বাস করতে ভালোবাসি যে শ্রেণীদ্বন্দ্বের অবসানে সমাজ আবার মনে-প্রাণে এক হবে; বহু মানুষের এই বৃহৎ সমাজ আবার সহজ পারিবারিক প্রীতিতে আবদ্ধ হবে। এই সরল বিশ্বাসকে আশ্রয় করে আমরা আজকের সমাজকে প্রাণপণে ঘৃণা করি। বিশুদ্ধ নাস্তিবাদীর চিন্তায় একটা অসহ্য আশাহীনতা আছে; তার চেয়ে ভালো শ্রেণী সংগ্রামের প্রবক্তা যিনি ধর্মযোদ্ধার মতই একটি দূরের আশায় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।
কিন্তু সেই দূরের আশাও দুরাশা। রুশ বিপ্লবের পর পঞ্চাশ বৎসর পূর্ণ হতে চলেছে। নতুন করে সোভিয়েত সমাজের তরুণেরা জিজ্ঞাসা করেছেন, কেন বাঁচব? আবারও তাঁরা আবিষ্কার করছেন একের মনের অন্তরতম যন্ত্রণা অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া কত কঠিন। আবারও পিতা ও পুত্রের ভিতর সহোপলব্ধির সেতু ভেঙ্গে যাচ্ছে। নেশা ও নাস্তিবাদের আকর্ষণ আবারও সেখানে প্রবল। চীনের বৈপ্লবিক উচ্ছ্বাস যখন ক্লান্ত হয়ে আসবে তখন একই প্রশ্ন একই সমস্যা সেখানে কি দেখা দেবে না? আর্থিক ব্যবস্থার বিচার এখানে করছি না; মানুষের আত্মার যোগের কথাই বলছি। ধনোৎপাদনের যন্ত্র রাষ্ট্রায়ত্ত হলেই সমাজ সুখী পরিবারে রূপান্তরিত হয় না, মানুষের মনের গভীরতম সমস্যারও কোনো সরল সমাধান দেখা দেয় না। এ কথাটা যাঁরা বোঝেননি তাঁরা এ ব্যাপারে এখনও বুদ্ধিতে বালক।
নাস্তিবাদ (nihilism) অবশ্য অর্থহীন। নাস্তিবাদীও সমাজের শ্রমে উৎপন্ন অন্ন গ্রহণ করছেন, বহু মানুষের সাধনায় সৃষ্ট সাহিত্য থেকে বচন উদ্ধার করে নিজের মত অথবা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। নিজের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা না থাকলে এসব নঙর্ধক কার্যেরও কিছুই অর্থ হয় না। সমাজের বাইরে কোনো অর্থহীন একাকিতে নিজেকে সংহার করাই তাহলে কর্তব্য। এমনতর একটি মতকে আমরা নৈরাশ্যের অন্ধতম মুহূর্তের আতধ্বনি হিসাবে সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে পারি। কিন্তু যিনি বাঁচতে চান তাঁকে জীবনের প্রতি, অর্থাৎ নিজের ও অপরের প্রতি, শ্রদ্ধার একটি ভিত্তি খুঁজে বের করতে হবে।
পরিবর্তনশীল জটিল বৃহৎ সমাজে অপর ব্যক্তি আমার কাছে চিরকালের মতোই অংশত অজ্ঞেয় থাকবে, মানুষে মানুষে মতান্তর কখনও দূর হবে না। এরই ভিতর কি করে দুয়ে এবং মতান্তরিত অপরের প্রতি খানিকটা প্রীতি ও সহিষ্ণুতা রক্ষা করা যায় এটাই আধুনিক সমাজের একটা মূল সমস্যা। সহজ ভ্রাতৃত্বের আদর্শ এ-অবস্থায় আপদ ঘটাতে পারে, কারণ ভাইয়ের কাছেও আজ নির্বিরোধ ঐক্য দাবি করলে গোড়াতেই দ্বন্দ্বের আশংকা আর ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধের মত তিক্ত বিরোধ বুঝি নেই। অথবা বলা যায় যে, ভ্রাতৃত্বের আদর্শকে বাঁচাতে হলে আজ তার রূপান্তর প্রয়োজন। এই রূপান্তরিত আদর্শের। জোরেই আমরা বলি আপনার মত মানি না, কিন্তু আপনার মত প্রকাশ করবার স্বাধীনতাকে আমি শ্রদ্ধা করি যেন সে আমারই স্বাধীনতা! গণতান্ত্রিকের কাছে এই মৌল শ্রদ্ধার অভাবই একমাত্র অশ্রদ্ধেয়।
আরও গোড়ার কথাটা সম্ভবত এই। তোমাকে আমার কখনও সম্পূর্ণ জানা হবে না; কিন্তু নিজেকেই কি জানা হবে! না জানার বেদনা থাকবে; তবু এই দুয়ে তোমাকেই দুর্ভেয় আমার দোসর জানব। এমন করে আমরা পরস্পরকে স্বতন্ত্র জেনেও সম্প্রীতির সূত্রে আবদ্ধ হই এবং সমপ্রয়োজনের ভিত্তিতে যতদূর সম্ভব সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে। তুলি। সহজ কাজ নয়। তার চেয়ে সহজ ক্রোধে অথবা মোহে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা। পরকালে আস্থা স্থাপন করা; অথবা বিপ্লবের ওপারে দেহ ও আত্মার ক্ষুধার অন্ন আছে বিশ্বাসটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরা। কিন্তু এই মোহও সাময়িক। এই আত্মপ্রবঞ্চনাকে অতিক্রম করেই পরিণত বুদ্ধির মানুষকে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।
ব্যক্তি-স্বাধীনতার সপক্ষে অনেক সহজ যুক্তি আছে। মধ্যযুগীয় ছোট ছোট সম্প্রদায়ের প্রাচীর ভেঙ্গে বৃহত্তর সমাজ গড়ার সময় যখন আসে তখন ব্যক্তিকে সেই সচল সমাজে নিজ স্থান খুঁজে নেবার অধিকার দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে ওঠে। খণ্ডিত সত্যের দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই বৃহত্তর সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব, তাই ব্যক্তির আংশিক সত্যবোধও সমাজের পক্ষে মূল্যবান। এসব যুক্তির পরও একটি কথা অবশিষ্ট থাকে। সেটা অন্তরের কথা; সেটাই এখানে বলতে চেয়েছি। আজকের আত্মসচেতন ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা যাবে, কিন্তু গায়ের জোরে তাকে চিরকালের মতো গণসমাজের সঙ্গে একাকার করে দেওয়া যাবে না। সে তার স্বাতষ্মের গর্ব ও একাকিত্বের যন্ত্রণা নিয়ে নানা বিপরীত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সমাজ ও বিশ্বের সঙ্গে যোগসাধনের নিজের বিশেষ পথটি নিজেই খুঁজে নেবে। এই মৌল অধিকারই ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্তিম ভিত্তি।
গণযুগ ও গণতন্ত্র (১৯৬৭)