অবনীমোহনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আগে আগে হাঁটছিলেন হেমনাথ। ডাকটা কানে আসতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর এদিক সেদিক তাকাতেই তাঁর চোখে পড়ে গেল। বিনুরাও দেখতে পেল।
সামনের দিক থেকে একটা লোক লম্বা লম্বা পা ফেলে ব্যস্তভাবে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতে টের পাওয়া গেল, তার বয়স অনেক দিন আগেই পঞ্চাশ পেরিয়েছে। এখন ষাট ছুঁই ছুঁই। বেশির ভাগ চুলই রুপোর তার। অবশ্য কাঁচা চুলেরা একেবারে দখল ছাড়েনি, এখানে ওখানে ছড়িয়ে থেকে যতখানি পেরেছে যৌবনের পতাকা তুলে রাখতে চেষ্ট করছে। মুখখানা পরিষ্কার কামাননা। পরনে বাড়িতেকাঁচা হাফহাতা পাঞ্জাবি, স্কুল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। তুলনায় ধুতিটা অস্বাভাবিক খাটো, খালি পা। গলায় তিন লহর তুলসীর মালা।
এতখানি বয়স হয়েছে, কিন্তু শরীর মেদশূন্য, স্বাস্থ্যের ভিত বেশ মজবুত। মাঝারি মাপের শক্ত সবল এই মানুষটিকে ঘিরে কোথায় যেন খানিকটা দৃঢ়তা ফুটে আছে।
হেমনাথ বললেন, আরে অধর যে। কেমন আছ?
লোকটা অর্থাৎ অধর বলল, ভালই। আপনের শরীল গতিক?
ওই একরকম চলছে। হেমনাথ হাসলেন, তারপর এই দুপুরবেলা সেজেগুঁজে গিয়েছিলে কোথায়?
বিনুর হাসি পেল। পরেছে তো একটা বেঢপ পাঞ্জাবি আর খাটো ধুতি, তাতে আবার পায়ে জুতো নেই। একে নাকি সাজা বলে!
অধর বলল, আপনের বাড়ি গেছিলাম। গিয়া শুনলাম, আমাগো এইদিকে আছেন। বৌ-ঠাইরেন বইতে কইছিল, আমি আর বসি নাই। লৌড়াইতে লৌড়াইতে ফিরা আইছি, যদি আপনেরে এইখানে ধরতে পারি। শ্যাষম্যাষ পারছি।
আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে কেন?
বড় দরকার– বলতে বলতে বিনুদের সম্বন্ধে সচেতন হয়ে অধর শুধলো, এয়ারা? এগো তো আগে দেখি নাই।
হেমনাথ আলাপ করিয়ে দিলেন। অধরের পরিচয়টাও এবার পাওয়া গেল। পুরো নাম অধর সাহা। রাজদিয়া থেকে কয়েক মাইল উজানে কমলাঘাটের মস্ত গঞ্জ, অধর সেখানে বড় পাইকারি ব্যবসাদার। অনেকগুলো ধান-চালের আড়ত আছে তার। টাকাপয়সা যে কত তার লেখাজোখা নেই।
পরিচয় টরিচয় হল বটে, বিনুদের সম্বন্ধে কিন্তু তেমন আগ্রহ নেই অধরের। সে হেমনাথকে বলতে লাগল, এইদিকে যহন আইসাই পড়ছেন আর দেখাটাও হইয়া গ্যাছে তহন আমার বাড়ি একবার পায়ের ধূলা দিতে হইব।
হেমনাথ বললেন, আজ আর তোমার ওখানে যেতে বলো না অধর। তাকিয়ে দেখ কত বেলা হয়েছে। রামকেশবটা রাস্তা থেকে ওর বাড়ি ধরে নিয়ে গিয়েছিল। বড় দেরি করিয়ে দিয়েছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমাদের বেলা হেলে যাবে।
রামক্যাশবের বাড়ি যাইতে পারেন আর আমার বাড়ির কাছে আইসা যাইবেন না, হেয়া (তো) কিছুতেই হইব না। নাছোড় পেয়াদার মতো জেদ ধরল অধর, আসেন
হেমনাথ বোঝাতে চাইলেন, পরে একদিন আসব’খন। এখন তোমার ওখানে গেলে আরও দেরি হয়ে যাবে। ছেলেমেয়েগুলোর এখনও স্নান-খাওয়া হয়নি।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। অধর বলতে লাগল, দুই দন্ডও না বড়কত্তা, হের (তার) আগেই আপনেরে ছাইড়া দিমু। এটু কষ্ট কইরা একবার খালি আহেন। জবর দরকার–
হেমনাথ বললেন, তোমার দরকারের কথাটা এখানেই বলে ফেল না।
এইখানে কইলে হইব না, বাড়িতে নিয়া কয়টা জিনিস আপনেরে দেখামু।
ছাড়বে না যখন কী আর করা। চল– অধরের জেদ আর মিনতির কাছে নিজেকে সঁপে দিলেন হেমনাথ।
এই সময় অবনীমোহন বলে উঠলেন, আপনি ঘুরে আসুন মামাবাবু, আমরা বরং রাস্তায় দাঁড়াই। হেমনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, রাস্তায় কি দাঁড়িয়ে থাকবে, এস—এস—
অধরও সায় দিল, হ হ, আসেন—
বিনুরা যেদিক থেকে এসেছিল, আবার সেদিকে খানিকটা পিছিয়ে যেতে হল। তারপর রাস্তা থেকে ডান ধারে দু’পা গিয়ে সরু খালের ওপর বাঁশের সাঁকো, সাঁকো পেরিয়ে অধরের পিছু পিছু যেখানে এসে তারা পৌঁছল সেটা ফুলফলের বাগান। আশ্বিনের এই দুপুরবেলায় গাছগাছালির ঘন ছায়া এখানে নিবিড় হয়ে আছে। ছায়াচ্ছন্ন বাগানটার পর টিনের চমৎকার একখানা তিনতলা বাড়ি।
কলকাতায় সাততলা আটতলা কত বাড়ি দেখেছে বিন, তাদের ছাদগুলো যেন আকাশের মেঘেদের ছুঁয়ে আছে। কিন্তু টিনের তেতলা এই প্রথম দেখল। অবাক চোখে চারদিকে তাকাতে লাগল সে।
অধর সাহার বাড়িটার মাথায় প্যাগোডার মতো নকশা করা টিনের চাল। তার দু’ধারে দুটো টিনের ময়ূর পেখম মেলে আছে। দেওয়ালগুলো অবশ্য কাঠের।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে অধর বলল, চলেন, দোতালায় যাই।
হেমনাথ বললেন, আবার টঙে ওঠাবে?
উপুরে না গ্যালে তো জিনিসগুলান দেখাইতে পারুম না।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আগে আগে ওপরে উঠতে লাগল অধর। হেমনাথরা তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন।
একটা ব্যাপার বিনু লক্ষ করল, বাড়িটা আশ্চর্য রকমের নির্জন আর স্তব্ধ। অধর সাহা ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। শিশু-বৃদ্ধ-যুবক বা যুবতীর কণ্ঠস্বর কোনও দিক থেকেই ভেসে আসছে না। রূপকথার যক্ষপুরীর মতো এখানে জীবনের কোনও অস্তিত্ব বুঝি নেই।
খানিক আগে বিনুরা রামকেশবের বাড়িতে ছিল। অনেক মানুষ, অজস্র হইচই বা ফেনায়িত কোলাহল–সব মিলিয়ে যেন একটা সজীব রঙিন মেলার ভেতর অনেকখানি সময় কাটিয়ে এসেছে। তুলনায় এ বাড়ির নির্জনতা, নৈঃশব্দ চোখে কানে বিধতে লাগল।
একটু পর অধরের পিছু পিছু মস্ত একখানা ঘরের মধ্যে চলে এল বিনুরা। ঘরটার একধারে চেলা কাঠের পাহাড়। খুব সম্ভব দুতিনটে বড় বড় গাছ কেটে ওভাবে রাখা হয়েছে। আরেক পাশে সারি সারি সাজানো অনেকগুলো পেতলের নতুন কলসি, কাঁসার থালা-বাটি-গেলাস, আর নতুন নতুন খাট। তা ছাড়া, আরও অসংখ্য জিনিস।
এক পলকে সব দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে অধরের দিকে তাকালেন হেমনাথ।
মুখ কাচুমাচু করে অধর বলল, আপনের লগে পরামশ্য না কইরাই এইসব কিনাকাটা সারছি বড়কত্তা। একটু থেমে আবার বলল, দ্যাখেন জিনিসগুলান–একেবারে বাছা বাছা, পছন্দসই। কোনও শালায় কইতে পারব না অধর সা’ দানে খারাপ জিনিস দিছে।
হেমনাথ বিমূঢ় মুখে বললেন, কিন্তু ব্যাপারটা কী?
হেমনাথের চোখে চোখ রেখে অধর শুধলো, বুঝতে পারেন নাই?
না। ধীরে ধীরে হেমনাথ মাথা নাড়লেন।
একটু চুপ করে থেকে অধর বলল, দানসাগর ছাদ্দ করুম।
শ্রাদ্ধ!
হ।
কার?
কার আবার, আমার। নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে অধর সাহা ফিসফিস করে বলল।
আর হেমনাথ যেন কথা বলতে ভুলে গিয়ে একেবারে বোবা হয়ে গেলেন। তার চোখমুখ দেখে মনে হল, এমন আজগুবি কথা চৌষট্টি পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে আর কখনও শোনেন নি।
একটু কি ভেবে নিয়ে অধর আবার বলল, উই যে লাকড়ি (চেলা কাঠ) দেখতে আছেন, এগুলান দিয়া আমি মরলে আমারে পোড়ান হইব। আর এই নূতন খাটপালং থাল-ঘটি-গেলাস-বাটি-হগল দানের জিনিস। ছাদ্দের সোময় বামনগো দিমু। বুঝলেন নি বড়কত্তা, মরার আগেই নিজের ব্যবোস্তা নিজেই কইরা রাখলাম। অ্যামন কি আগামী বচ্ছর গয়ায় গিয়া নিজের পিন্ডটাও দিয়া আসুম।
নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন হেমনাথ। এতক্ষণে কথা বললেন, হঠাৎ তোমার ঘাড়ে এ পাগলামি চাপল কেন?
ঠিক এভাবে হেমনাথ বলবেন তা যেন আশা করে নি অধর। আহত সুরে বলল, এরে আপনে পাগলামি কন!
তা ছাড়া কী?
হেমনাথের কথার উত্তর না দিয়ে অধর বলল, আপনে তো হগলই জানেন বড়কত্তা—
হেমনাথ বললেন, কী জানি?
আমার পোলা দুইখান ক্যামন। অধর সাহা বলতে লাগল, দশ বচ্ছর তারা আমার লগে সম্পর্ক রাখে নাই। তাগো ভরসা করি না। কিন্তুক–
হেমনাথ প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কী?
হিন্দু হইয়া জন্মাইছি। মরার পর কে ছাদ্দ করব, কে পিন্ডি দিব তার তো ঠিক নাই। ওইটুকের লেইগা আত্মার সদগতি হইব না! পরকাল বইলা তো একখান কথা আছে।
তোমার ভালমন্দ কিছু হলে ছেলেরা আসবে না, এমন কথা আগে থেকেই ভবছ কেন? তা ছাড়া বলতে নেই, তোমার স্বাস্থ্য বেশ ভালই। বয়েসেও আমার চাইতে ঢের ছোট। এর ভেতর মরার চিন্তা তোমার মাথায় চুল কী করে?
দার্শনিকের মতো মুখ করে অধর বলল, বড়কত্তা, মাইনষের জীবন বড় তাজ্জবের বস্তু। এই আছে, এই ফা। কার কখন ওপারের ডাক আইব, কেউ জানে না। রাবণের সিঁড়ির লাখান ছাদ্দশান্তি আমি ফেলাইয়া রাখুম না।
হেমনাথ উত্তর দিলেন না।
বিনুর এইসব কথাবার্তা ভাল লাগছিল না। টিনের তেতলা দেখার বিস্ময়টাও ধীরে ধীরে কখন ফিকে হয়ে গেছে। সে উসখুস করতে লাগল। এদিকে অবনীমোহন সুধা আর সুনীতি চুপচাপ। তাদের মুখচোখ দেখে প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না।
অধর আবার বলল, ভাবতে আছি পূজার পরেই এট্টা ভালা দিন দেইখা ছাদ্দটা চুকাইয়া ফেলুম। একশ’জন ভাল বামন ভোজন করামু। আইচ্ছা বড়কত্তা, কারে কারে ডাকা যায় কন তো?
হেমনাথ বললেন, এখনও তো দেরি আছে। পরে এ নিয়ে ভাবা যাবে। আজ চলি।
অহনই যাইবেন?
হ্যাঁ। আজ আর দেরি করতে পারব না। বিনুদের নিয়ে হেমনাথ ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন। সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে একতলায়। তারপর ঝুপসি বাগান পেরিয়ে সোজা দক্ষিণগামী বড় রাস্তায়।
অধরও সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। সে বলল, দুই চাইর দিন পর আমি কিন্তুক আপনের বাড়িত যামু।
হেমনাথ বললেন, এস।
ছাদ্দশান্তির ব্যাপারে আপনের লগে মেলা (অনেক) পরামশ্য আছে।
আচ্ছা, আচ্ছা–
অধর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। হেমনাথ বললেন, কথা তো হয়ে গেল। এই রোদের ভেতর কষ্ট করে আর তোমাকে যেতে হবে না।
অধর দাঁড়িয়ে পড়ল। হেমনাথরা এগিয়ে গেলেন।
দাদুর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অধর সাহার কথা কিন্তু ভাবছিল না বিনু। বার বার ঝিনুকের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। এ পাড়ায় আসা হল। সেই সকাল থেকে এতখানি বেলা পর্যন্ত রামকেশব আর অধর এই দুটো লোক তাদের আটকে রাখল অথচ ঝিনুকদের বাড়িতেই শুধু যাওয়া হল না। বার বছরের বিনুর ছোট্ট, উষ্ণ, কোমল মনটা সেজন্য ভারাক্রান্ত হয়ে আছে।
খানিক যাবার পর অবনীমোহন শুধোলেন, লোকটা অদ্ভুত তো—
বিনু বুঝল, অধরের কথা বলছেন অবনীমোহন। সে জানে মানুষ মরে টরে গেলে অন্যেরা তার শ্রাদ্ধ করে। কিন্তু একটা লোক জীবিত অবস্থায় নিজের শ্রাদ্ধ নিজেই করতে যাচ্ছে দেখেও বিনু খুব অবাক হল না, তেমন কৌতূহলও বোধ করল না। ঝিনুক যেন চারদিকের সব কিছু থেকে তাকে অন্যমনস্ক করে রেখেছে।
হেমনাথ মৃদু হাসলেন, তা একটু—
অবনীমোহন বললেন, এমন লোক আগে আর কখনও দেখি নি।
উত্তর না দিয়ে হেমনাথ হাসতে লাগলেন।
অবনীমোহন বললেন, ছেলেদের ওপর খুব রাগ দেখলাম। কারণটা কী?
সে অনেক ব্যাপার। পরে বলব।
আর কেউ নেই ওঁর?
না। স্ত্রীকে ঢের আগেই খেয়ে বসেছে।
অবনীমোহন আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, হেমনাথ তার আগেই বলে উঠলেন, যাই, আড়ত থেকে মাছগুলো নিয়ে আসি। আয় দাদাভাই’ বলেই বিনুকে নিয়ে ডানদিকে নদীর ঢালে নেমে গেলেন।
কথায় কথায় কখন তারা নৌকোঘাটে এসে গিয়েছিলেন, অবনীমোহনের খেয়াল ছিল না। হঠাৎ তার মনে পড়ল, যাবার সময় মাছের জন্য আড়তে পয়সা দিয়ে গিয়েছিলেন হেমনাথ।
নৌকোঘাটটা রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা নিচে। নদীর জল জায়গাটা ছুঁয়ে আছে। তার গা ঘেঁষে সারি সারি মাছের আড়ত।
যাবার সময় আড়তগুলোর গায়ে যত জেলেডিঙি বিনুরা দেখে গিয়েছিল, এখন তার দশ গুণ জমা হয়েছে। নদীর দূর দূরান্ত থেকে চিত্রবিচিত্র পাল তুলে আরও অগণিত নৌকো এদিকে ছুটে আসছে। ইলিশ মাছের ভারী আঁশটে গন্ধ এখানে বুঝি বার মাস অনড়। নদীর এলোমেলো দুরন্ত বাতাসও তা উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারছে না।
আড়তে যেতেই সেই লোকটাকে দেখতে পেল বিনু। হেমনাথ এর হাতেই মাছের পয়সা দিয়ে গিয়েছিলেন।
লোকটা মাঝবয়সী। থলথলে মাংসল চেহারা, গায়ের রং কালো। সব সময় জলের কাছে থাকার জন্যই বোধহয় চামড়া রুক্ষ, খসখসে। গ্রীষ্ম বর্ষা হাজার নখে তারা গা চিরে চিরে দিয়েছে। পরনে আধময়লা ধুতি ছাড়া আর কিছুই নেই। হাতে চৌকো সোনার তাবিজ, গলায় সরু হার, মোটা মোটা গাঁটওলা আঙুলে পলা আর গোমেদের আংটি।
কোলের কাছে টিনের ক্যাশ-বাক্স আর লাল হিসেবের খাতা নিয়ে একটা তক্তপোশে বসে ছিল লোকটা। বিনুদের দেখেই লাফ দিয়ে নেমে এল। আপ্যায়নের সুরে ব্যস্তভাবে বলল, আসেন– আসেন। বসেন বড়কত্তা–
হেমনাথ বললেন, এখন আর বসব না নকুল। তাড়াতাড়ি মাছ দাও—
হেয়া (তাই) কখনও হয়। আড়তে আপনের পায়ের ধূলা পড়ল, একদণ্ড বইসা না গেলে শান্তি পামু ক্যান? বলতে বলতে নকুলের কী যেন মনে পড়ে গেল। বিনুকে দেখিয়ে বলল, নাতিরেই খালি আনছেন, জামাই আর নাতিনরা কই?
রাস্তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে হেমনাথ বললেন, ওখানে।
পথে খাড়া করাইয়া আইছেন! ক্যান, আমার এইহানে বসনের জাগা আছিল না? নকুলকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ দেখাল।
হেমনাথ বোঝাতে চেষ্টা করলেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে, তাই আর আনি নি। আনলে আরও দেরি হয়ে যাবে।
এট্টু দেরি হইব বইলা আনবেন না! পেরথম দিন আমার আড়তের দুয়ারে ওনারা আইলেন, দুইটা মিঠাই না খাওয়াইয়া ছাড়তে পারি! আপনের নাতি-নাতিন-জামাইর উপুর আমার জোর নাই? যাই ওনাগো ডাইকা আনি।
নকুল রাস্তার দিকে ছুটতে যাচ্ছিল, তার আগেই খপ করে তার একখানা হাত ধরে ফেললেন হেমনাথ, আজ থাক নকুল। একদিন তোমার বাড়িতে ওদের নিয়ে যাব। তখন যত পার খাইও–
একটু ভেবে নকুল বলল, ঠিক তো?
ঠিক।
কথা দিলেন কিলাম।
হ্যাঁ–হ্যাঁ, কথার খেলাপ হবে না। তুমি মাছ দাও—
বিনু অবাক হয়ে দেখছিল। আড়তদার এই লোকটাকে তার খুব ভাল লাগছে। তার মধুর ব্যবহার, তার আন্তরিকতা বুঝিয়ে দিচ্ছে দাদুকে কতখানি ভালবাসে সে, কতখানি শ্রদ্ধা করে। শুধু কি এই লোকটাই, হিরণ, মজিদ মিঞা, মজিদের বোনাই হাসেম আলি, রামকেশব-সারা রাজদিয়াই হয়তো হেমনাথের জন্য হৃদয় পেতে রেখেছে। বিনু টের পেল তাদের যে এত খাতির, এত মর্যাদা-সব, সব দাদুর জন্য।
নকুল ডাকল, আহেন, মাছ বাইছা লন (নিন)–
আড়তটার সামনের দিকে রাস্তা, পেছনে নদী। দু’টো দিকই খোলা। নকুলের সঙ্গে যেতে যেতে বিনু লক্ষ করল, পেছন দিকে ইলিশের পাহাড় জমে আছে–পূর্ব বাংলার চকচকে লোভনীয় রুপোলি ফসল।
আড়তের তলায় সারি সারি জেলে ডিঙি। আট দশটা লোক ডিঙিগুলো থেকে মাছ গুনে গুনে ইলিশের পাহাড়টার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। মাছির ভনভনানির মতো শোনা যাচ্ছে, রামে রাম, রামে দুই, রামে তিন–
আরেক দল তোক কাঠের প্যাকিং বাক্সে পরত পরত বরফের তলায় মাছ সাজাচ্ছে। বিনু জানে ওই বাক্সগুলো কলকাতায় চালান যাবে।
একসময় রুপোর পাহাড়টার কাছে এসে পড়ল বিনুরা। একসঙ্গে এত মাছ, এমন ঝকঝকে জীবন্ত জলের ফসল আগে আর কখনও দেখে নি সে।
নকুল বিনুকে বলল, পাঁচখান মাছ বাইছা লও ছোটকত্তা—
বিনু লজ্জা পেয়ে গেল। মাছ তো বাছলই না, দাদুর আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
হেমনাথ বললেন, পাঁচটা মাছ কেন? তিনটের দাম তো তোমায় দিয়ে গেছি।
নকুল বলল, আইজ জবর মাছ উঠতে আছে বড়কত্তা। দরও ঝপর ঝপর লামতে আছে। অহন ট্যাকায় দশটা বিকাইতে আছে, রাইতের দিকে বিশটা কইরা বেচতে হইব।
হেমনাথ কিছু বললেন না।
নকুল এবার বিনুকে নিয়ে পড়ল, কই, মাছ বাছলা না?
বিনু একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
বিনুর মনোভাব বুঝতে পেরে নিজেই সেরা ছ’টা মাছ বেছে বেঁধে দিল নকুল।
হেমনাথ বললেন, আবার ছ’টা কেন?
হেসে নকুল বলল, ছোটকত্তা পয়লা দিন আমার আড়তে আইল। হের (তার) সোম্মান নাই? এট্টা মাছ তারে খাইতে দিলাম।
মাছ নিয়ে রাস্তায় আসতে সুধা বলল, এত দেরি করলে কেন দাদু?
হেমনাথ বললেন, আর বলিস না ভাই। ওই আড়তদার মানে আমাদের নকুলটা কিছুতেই ছাড়ে। তোদের আড়তে নিয়ে মিষ্টি খাওয়াবার বাই তুলেছিল। কত কষ্টে যে ঠেকিয়েছি! তবে কড়ার করিয়ে নিয়েছে, একদিন ওর বাড়ি তোদের নিয়ে যেতে হবে।
অবনীমোহন ওধার থেকে বললেন, এখানকার মানুষজন বড় ভাল।
আবেগময় সুরে হেমনাথ উত্তর দিলেন, সত্যিই ভাল অবনীমোহন–
এরপর ইলিশ মাছ নিয়ে কিছুক্ষণ উচ্ছ্বসিত আলোচনা চলল। আট আনায় পাঁচটা বড় বড় ইলিশ, তার ওপর একটা ফাউ। অবনীমোহন ভাবলেন, এ যেন এক স্বপ্নের দেশ।
.
একসময় স্টিমারঘাট, সারি সারি সেই মিষ্টির দোকান, খোয়া বাঁধানো পথ আর নদীটা পেছনে ফেলে সেই কাঠের পুলটার কাছে এসে পড়ল বিনুরা। ঠিক সেই সময় শোনা গেল, হেম—হেম– পেছন থেকে কে যেন খুব চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করছে।
হেম নিশ্চয়ই হেমনাথ। তাঁকে যিনি নাম ধরে ডাকতে পারেন, হয় তিনি বন্ধুস্থানীয়, নতুবা গুরুজন টুরুজন হবেন।
সবাই একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল। আর ঘুরতেই বিনু দেখতে পেল, দূরে পথের বাঁকে কালকের সেই জারাজীর্ণ দুর্বল ঘোড়াটা তার চাইতেও পুরনো ভাঙাচোরা গাড়িটাকে টেনে নিয়ে আসছে। কালকের সেই কোচোয়ানটাকে দেখা যাচ্ছে না, চালকের জায়গায় ধবধবে সাদা একটি মানুষ বসে আছেন।
নিশ্চয়ই লালমোহন, অর্থাৎ ডেভিড লারমোর। তিনি ছাড়া রাজদিয়ায় সাহেব আর কে আছে? কাল এঁর কথা অনেক শুনেছে বিনু। যৌবনের মধ্যদিনে সুদূর আয়ার্ল্যান্ড থেকে পূর্ব বাংলার এই প্রান্তে এসেছিলেন, তারপর কয়েক যুগ কেটে গেছে। তাকে সামনাসামনি দেখবার জন্য বিনুর ছোট্ট হৃৎপিন্ড যেন লাফাতে লাগল।
কিছুক্ষণের ভেতর ফিটনটা কাছে এসে থামল। কোচায়ানের সিট থেকে একরকম লাফ দিয়েই নেমে এলেন লারমোর।
হেমনাথ বললেন, বয়স কত হল হে?
লারমোর হেসে বললেন, তোমার চাইতে গুনে গুনে চার বছরের বড়।
কিন্তু যেভাবে নামলে তাতে তিরিশ বছরের ছোট বলে মনে হচ্ছে। বুড়ো হাড়ে একবার চোট লাগলে দেখতে হবে না। ছ’মাসের জন্যে বিছানা নিতে হবে।
তাচ্ছিল্যভরে লারমোর বললেন, কিচ্ছু হবে না।
দু’চোখে অসীম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল বিনু। লালমোহনের চুল, ঘন জোড়া ভুরু, গায়ের রং, ঋষিদের মতো লম্বা দাড়ি সব কিছু দুধের মতো সাদা। ভুরুর তলায় স্বচ্ছ জলে আলোর নাচনের মতো দু’টি স্নিগ্ধ চোখ। পিঠ সামনের দিকে একটু নুয়ে পড়েছে। গা-ময় এত কুঞ্চন যাতে চামড়া সোনার জালি জালি মনে হয়। পরনে ধুতি আর কামিজ, পায়ে লাল কাপড়ের জুতো। গলায় কালো কারে রুপোর ক্রশ ঝুলছে।
বড়দিনে কলকাতার সাহেবপাড়ায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে প্রচুর আলো টালো দিয়ে ‘ক্রিসমাস ট্রি’ সাজায়। তার সঙ্গে ধবধবে দাড়িওলা এক বুড়োও থাকে। বিনু বুড়োর নামটা মনে করতে পারল সান্টা ক্লজ। পোশাকটুকু বাদ দিলে লারমোর যেন অবিকল সান্টা ক্লজ।
হেমনাথ বললেন, এস, পরিচয় করিয়ে দিই–
লারমোর বললেন, তোমার আর কষ্ট করতে হবে না, ওটা আমিই পারব। বলে অবনীমোহনের দিকে ফিরলেন, তুমি নিশ্চয়ই আমাদের জামাই। সুধা-সুনীতি-বিনুকে বললেন, আর তোমরা অবশ্যই দাদাভাই দিদিভাই। তোমাদের নাম তো জানি না। নামগুলো বল–
অবনীমোহনের হঠাৎ কী হয়ে গেল, ঋষির মতো দেখতে এই বয়স্ক বিদেশি মানুষটির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। দেখাদেখি সুধা-সুনীতি-বিনুও প্রণাম করল। তারপর একে একে সবাই নিজের নিজের নাম বলল।
সবাইকে আশীর্বাদ করে লারমোর অবনীমোহনের উদ্দেশে বললেন, কাল স্টিমারঘাটে তোমাদের আনতে যেতে পারি নি। বিশেষ দরকারে হাটে গিয়েছিলাম–
অবনীমোহন বললেন, মামাবাবু সে কথা বলেছেন।
কাল হাট থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে উঠেই চলে আসব ভেবেছিলাম। তখনও কতকগুলো ঝঞ্জাট এসে জুটল। সব মিটিয়ে বেরুতে বেরুতে দুপুর হয়ে গেল। ভাল কথা, রমু কোথায়? তাকে তো দেখছি না।
হেমনাথ বললেন, সে বাড়িতে আছে।
লারমোর শুধোলেন, তোমরা গিয়েছিলে কোথায়?
রাজদিয়া শহরটা ওদের একটু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম।
লারমোর এবার অবনীমোহনকে সাক্ষী মানলেন, শোন তোমার মামাশ্বশুরের কথা। আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমেছি বলে তো খুব উপদেশ ঝাড়া হল। আর উনি যে বুড়ো হাড়ে মাইল মাইল হেঁটে এলেন, তার বেলা?
সবাই হাসতে লাগল। লারমোর আর হেমনাথের ভেতর বন্ধুত্বটা যে কতখানি নির্মল, স্বচ্ছ আর প্রীতিপূর্ণ তা যেন অনায়াসে টের পাওয়া যাচ্ছে।
বিব্রত মুখে হেমনাথ বললেন, লাফানো আর হাঁটা–কিসে আর কিসে! সে যাক গে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর একটা কথাও নয়।
লারমোর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই হেমনাথের হাতে ইলিশ মাছগুলো দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সারা মুখে হাসির ছটা ঝলমলিয়ে উঠল। উচ্ছ্বসিত খুশির গলায় তিনি বললেন, নজর পড়েছে তা হলে–
ঢের আগেই পড়া উচিত ছিল। পেটিগুলো সর্ষে দিয়ে ভাতে দিলে যা হয় না–একেবারে হেভেন। চোখ বুজে বুঝিবা স্বর্গসুখটা কল্পনা করতে লাগলেন লারমোর।
ভুরু কুঁচকে হেমনাথ বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বোধহয় পেটিগুলো ভাতে দেওয়া যাবে। সেজন্যে বাড়ি যাওয়া দরকার।
লারমোর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সবাই গাড়িতে ওঠ। বলে নিজেই ফিটনের দরজা খুলে দিলেন।
অবনীমোহন হেমনাথ সুধা আর সুনীতি উঠতেই দেখা গেল, গাড়িতে আর জায়গা নেই। লারমোর বললেন, বিনুদাদা কোচোয়ানের সিটে আমার পাশে বসে যাবে।
পাশাপাশি যেতে যেতে বার বার মুখ তুলে লারমোরকে দেখতে লাগল বিনু। চোখাচোখি হলে অবশ্য মুখটা সরিয়ে নিচ্ছে।
এই মুহূর্তে বিনুর মন থেকে রামকেশব, রুমা ঝুমা, অধর সাহা, নকুল, রুপোর পাহাড়ের মতো ইলিশের স্থূপ, মনোরম নদীতীর, এমনকি ঝিনুক পর্যন্ত মুঝে গেছে। তার বারো বছরের অপরিণত অস্তিত্বের পুরোটাই দখল করে নিয়েছেন এই বিস্ময়কর চমকপ্রদ মানুষটি, যার নাম ডেভিড লারমোর।
বারকয়েক চোখাচোখির পর বিনু ধরা পড়ে গেল। সমেহ হেসে লারমোর শুধালেন, কী দেখছ?
লজ্জা পেয়ে বিনু তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিল, উত্তর দিল না।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর আবার তাকাতে লাগল বিনু। তার মনের কথাটা বোধহয় পড়তে পারলেন লারমোর। বিনুর দিকে খানিক ঝুঁকে বললেন, আমায় কিছু বলবে?
এই মানুষটি সম্বন্ধে এই মুহূর্তে বিনুর মনে অনেক জিজ্ঞাসা, অসীম কৌতূহল। ঘাড় ঈষৎ হেলিয়ে সে জানালো-বলবে।
লারমোর বললেন, বল না—
এতক্ষণে গলায় স্বর ফুটল বিনুর। ফিসফিসিয়ে বলল, পরে।
পরে কেন, এখনই বলে ফেল।
বিনু চুপ।
একটু ভেবে হাসতে হাসতে লারমোর বললেন, আচ্ছা, পরেই বলো।
একসময় ফিটনটা বাড়ি পৌঁছে গেল।