সারমন অন দি মাউন্ট
আমাদের নোনা-ধরা দেয়ালের যে-জায়গাটায় দক্ষিণ আমেরিকার মানচিত্র তৈরি হয়েছে সেখানে একটা আদ্যিকালের বদমেজাজি ঘড়ি ঝুলছে। পেন্ডুলামের চেহারাটা হেডমাস্টারের মতো। গুরুগম্ভীর মুখে দুলছে তো দুলছেই। ছন্দটা এইরকম: নো, নো, আই ওন্ট টলারেট। বাজনার সুর রসকষহীন। দুপুর রোদে হাঁকছে যেন, শিল কাটাও। বাজা-র এক মিনিট আগে জানান দেয়, খাড়াক।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিতাঠাকুর চুলে টাকপড়া বুরুশ চালাতে চালাতে বললেন, ক্লক স্ট্রাইকস টেন। যাও, রসগোল্লা।
ক্লক স্ট্রাইকস বললে কেমন একটা রহস্যের দরজা খুলে যায়। মধ্যরাতে ঘড়ি বাজে, কবর খুলে বাদুড় ওড়ে। চশমার খাপ থেকে দশটা টাকা বের করে আমার হাতে দিলেন। স্নান সেরেছেন। বেশ তাজা দেখাচ্ছে। ছাদের ঘরে ব্যায়াম হয়েছে। ঠাকুরঘরে বসা হয়েছে। ধর্মের জন্যে নয়, একাগ্রতার জন্য। সব কাজ সারা। এইবার রাত বাড়বে, পড়া চলবে, পাতার পর পাতা। টেবিলের একধারে বইয়ের পাহাড়। কী নেই। উপন্যাস, দর্শন, গণিত, ভূবিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা, কৃষিবিজ্ঞান। স্বল্পং স্তথা আয়ু বহবশ্চ বিঘ্ন। শিশির ভাদুড়ীর মতো হাত পা নেড়ে বলেন, জ্ঞান অর্জন করে যাও, জ্ঞান অর্জন। করে যাও। এক জীবনে সব হবে না। যতটা পারা যায়, যতটা পারা যায়।
টাকাটি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, কড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। একটি একটি করে হাঁড়িতে তুলবে যখন, দেখবে। চোখ বুজিয়ে থেকো না। চোখ বুজিয়ে ঈশ্বরদর্শন হয়, জগৎদর্শন হয় না। টাটকা আর বাসি মিশিয়ে ছেড়ে দেবে। এ বড় শক্ত ঠাই, গুরু শিষ্যে দেখা নাই।
বিশাল উনুনে ঢাউস কড়ায় রস ফুটছে। রসে টাবুরটুবুর করছে রাশি রাশি রসগোল্লা। শর্করার গন্ধমাখা ফিনফিনে ধোঁয়া উঠছে বাঁশের বাতার দিকে। কড়ার সামনে নৌকোর হালের মতো কাঠের হাতা নিয়ে টুলে বসে আছেন পরেশদা। চোখের চেহারা দেখেই মালুম হচ্ছে দু’-চার ছিলিম চেপে গেছে। যমরাজ বসে আছেন গাট হয়ে। তপ্ত কটাহে জীবজগৎ হাবুডুবু। ভিয়েন দেখলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। রসে ডু ডুবিয়ে তুলে দেখে ময়রা। এক সুতো। দু’সুতো। পাঁচ সুতায় পাকা পাক। পঞ্চেন্দ্রিয় চুর হলে জীব মুক্তি পায়। সর্বং খন্বিদং ব্রহ্ম।
পরেশদা, এক সের বড় রসগোল্লা।
অপেক্ষা করো, হয়ে এসেছে।
বাঁশের খোটায় হুক লাগানো। সেই হুকে সোনপাপড়ির সুতো লাগিয়ে আর এক ভীমভবানী টানাটানি চালিয়েছে। এও আর এক খেলা। যত টানবে তত খাস্তা হবে। ততই মজবে ভাল। মাঞ্জামারা সোনপাপড়ি। রসের চাঁচর সঁতে কাটবে নাগর। নাগর শব্দটা তেমন ভাল নয়। এসব কথা কেন মনে আসছে! বালযোগী সাবধান। ক্ষুরস্যধারা।
পরেশদা হাঁক মারলেন, নিতাই, নিতাই।
ইজের-পরা নিতাই দোকানের গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে এল। একসেরি হাঁড়ি আন একটা।
ভিজে হাঁড়ি জল শুষছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় ফিসফিস শব্দ ছেড়ে গেল, বড় তৃষ্ণা, বড় তৃষ্ণা। ওজন টোজনের প্রয়োজন হল না। বড় রসগোল্লা ক’টায় এক সের হয় পরেশদার জানা।
ছোট্ট বিড়ের ওপর হাঁড়ি। মুখে শালপাতার আবরণ। পাটের দড়ি দিয়ে কায়দা করে বাঁধা। হাঁড়ি ঝুলছে ডান হাতে। ফাউ চাইলে একটা মুগের নাড়ু মিলত। লোভ জয় করে ফেলেছি। চরিত্রের কী শক্তি! ওদিকে সারি সারি পাঁচপো মাপের হাঁড়ি লাইন দিয়ে বসেছে। দুধে টইটম্বুর, সাজা দিয়ে ফেলে রেখেছে। কাল সকালে জমে দই হবে।
রাতের রাস্তায় নোক চলাচল কমে এসেছে। মধুবাবুর সাইকেল মেরামতের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। রকে একটা কালো কুকুর শুয়ে শুয়ে গা চাটছে। বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারা। কুকুরটা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, একটা ডন মেরে রাস্তায় নেমে এল। ভয়ের কিছু নেই। কে চোর, কে সাধু, চেনার ক্ষমতা কুকুরের মতো আর কোনও প্রাণীর নেই। সাধে কুকুর পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের পথের সঙ্গী হয়েছিল?
আমি চলেছি। পেছন পেছন কুকুর চলেছে ফোঁস ফোঁস করতে করতে। চলতেই হবে, আমি যে ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। মহাপ্রস্থান করার সময় তোকে নিয়ে যাব রে ভুলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে একটু সন্দেহ হল। ভুলো আমার সাত্ত্বিক চরিত্রকে অনুসরণ করে আসছে বলে মনে হচ্ছে না তো! ডান হাতে ঝোলানো হাঁড়িটা শুঁকতে শুঁকতে আসছে।
এতে রসগোল্লা আছে মানু। মাংস নেই। গরম রসগোল্লা।
ভুলো রাসকেলের এই মতলব ছিল কে জানত! সামনের দু’পা তুলে মারল টান। হাত ছেড়ে হাঁড়ি পড়ল রাস্তায়। ভটাস করে একটা শব্দ। ঘটাকাশ আর চিদাকাশ এক হয়ে বন্ধনমুক্ত জীবের মতো সাদা সাদা রসগোল্লা। আমরা চললুম পিন্টু, ভুলোর মুখ দিয়েই স্বর্গদ্বারে পৌঁছোব, তোমার পিতৃদেবকে বলে দিয়ো। উপবাসী শয়তান কাবাব জ্ঞানেই রসগোল্লা খেতে লাগল। ন্যাজটি কিন্তু নাড়তে ভোলেনি। শয়তান হলেও কুকুর তো! অন্ধকার রাস্তা। দোকানপাট সব বন্ধ। নর্দমার ধার থেকে আর একটি ছায়ামূর্তি প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল। এইবার প্রেতের হাসি। খিলখিলে শব্দ। এ সেই মণিপাগলি। কুকুরটা একটা চাপা গর্জন ছাড়ল। আনন্দমঠের দুর্ভিক্ষের দৃশ্য। পাগলি উবু হয়ে বসে রসগোল্লা খাচ্ছে। প্রায় উলঙ্গ।
মণি কত বড় বাড়ির মেয়ে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে কীভাবে পাগল হয়ে গেল! একসময় কী সুন্দর চেহারা ছিল। ভাল ফুল তো ফোঁটার উপায় নেই। মানুষ এসে ছিড়বেই৷ মণিকে যারা শেষ করে গেল, তারা এখন কোন ফুলে গিয়ে বসেছে কে জানে। ডাসা ডাসা ভোমরা উড়ছে। যৌবনের পরাগ ঝরে ঝরে পড়ছে। ভাগ্যিস মেয়েছেলে হইনি। ভাদ্র মাসে ভুলোরা শেষ করে দিত। হে ভারত ভুলিয়ো না তোমার নারীজাতির আদর্শ।
মণিপাগলিকে দেখে মনের জোর বেড়ে গেল। রসগোল্লার বদলে বকুনি খাবার জন্যে আমি এখন প্রস্তুত। প্রমাণ সহ পিতার সামনে উপস্থিত হতে হবে। প্রমাণ ছাড়া তিনি কিছু বিশ্বাস করেন না। ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যায় না, সুতরাং তিনি নাস্তি। মাটির হাঁড়ির একটা টুকরো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিলুম। ভুলোর একটা টুকরো নিতে পারলে ভাল হত।
মণি গান ধরেছে, হরে কৃষ্ণ, হরে রাম, পেটের ছেলের বড় দাম।
শূন্য হাতে ফিরতে দেখে পিতা বললেন, কী এখনও নামেনি নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ নেমেছে। আনতে আনতে কুকুরে ছিনিয়ে নিলে। এই যে ভাঙা হাঁড়ির টুকরো। ভুলো আর মণিপাগলি ভাগাভাগি করে খেয়েছে। নির্ভীক স্বীকারোক্তি। বুক ফুলিয়ে সত্যভাষণ। জর্জ ওয়াশিংটন তো তাই করেছিলেন। পিতার শখের গাছ তলোয়ারের এক কোপে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পিতা, এই অপকর্ম আমি করিয়াছি।
মেসোমশাই মেয়েকে পড়াচ্ছিলেন। মুখ তুলে বললেন, ভগবানের ইচ্ছে নেই হরিদা। আপনি চেষ্টা করলে হবে কী?
ভগবান ফগবান আমি মানি না বিনয়দা। যখন যেমন, মানুষের ইচ্ছে ভগবানের ইচ্ছে বলে চালানো হয়। আমি পুরুষকারে বিশ্বাস করি। ট্রাই অ্যান্ড ট্রাই! গরম রসগোল্লা আমি খাওয়াবই আর ওকে দিয়েই আনাব।
আপনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না? কী আশ্চর্য! তার ইচ্ছেতেই তো জগৎ চলছে। জীব আসছে যাচ্ছে। গাছের পাতা নড়ছে। ফুল ফুটছে। পাখি ডাকছে। যেখানে যা দরকার তাই দিয়ে পৃথিবী সাজিয়েছেন। এ এক অনন্ত লীলা! আপনার আমার বোঝার ক্ষমতা নেই। মওঃ শরতরং নান্য কিঞ্চি অস্তি ধনঞ্জয়! ময়ি সর্ব ইদং পোতং সূত্রে মণি-গণা ইব।
মেয়ের বই দেখে আমাকে আর সংস্কৃট আওড়াবেন না। আমি সার বুঝেছি, ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ প্রমাণাভাবাৎ ঈশ্বর আমার সামনে এসে দাঁড়ালেও আমি আগে আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চাইব। যাচাই করে নেব ইমপোস্টার কি না? আমি মনুর সন্তান মানুষ। আমার সেই পিতার পিতা তস্য। পিতা, প্রি-ইনফাইনাইট পিতা বলে গেছেন, যৎ কর্ম কুর্বতোহস্য স্যাৎ পরিতোমোহন্তরাত্মনঃ। তৎ প্রযত্নেন কুর্বিত বিপরীতন্তু বর্জয়েৎ। যে কাজ করলে অন্তরাত্মার তৃপ্তি হয় আমি সেই কাজই করব। ওসব গড উইশ ফুইশ আমি বুঝি না।
আগে তো আপনি এইরকম ঘোরতর নাস্তিক ছিলেন না। কী করে এরকম হয়ে গেলেন?
ঈশ্বর হলেন ধনীর বিলাসিতা, দরিদ্রদের দুর্বলতা। এই সংসারে একের পর এক যখন মৃত্যু নামছে, একটা করে প্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন মাঝরাতে, নির্জন ছাতে, তারাভরা। আকাশের দিকে তাকিয়ে, জলভরা চোখে দিনের পর দিন বলেছি, প্রভু, আর না, আর না, এনাফ। অফ ইট, এবার ক্ষান্ত হও। একেবারে শ্মশান করে দিয়ো না। আপনার ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব ঈশ্বর উল্কায় জ্বলেছেন, তারায় মিটমিট করেছেন, অ্যান্ড নাথিং মোর। ভীরুর কল্পনায় তার মন্দির। ওয়ান্ট, ডেস্ট্রাকশন, ডেস্টিচিউশন, মিউটিলেশন, রেপ, র্যামপেজ, ডিভাস্টেশন, আপনার ঈশ্বরের পৃথিবীর নিত্য ঘটনা। হার্ড লিকার। চিনি দিলেও মিষ্টি হবে না। এই নাও দশটা টাকা। এইবার মাথায় করে আনবে। দেখি এইবার ঈশ্বরের কেমন ক্ষমতা! দ্যাট নন-এগজিস্ট্যান্ট অলমাইটি লর্ড, আই চ্যালেঞ্জ ইয়োর অথরিটি।
পরেশদার ভিয়েন নেমে গেছে। দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছেন। বাচ্চা ছেলেটা ঘ্যাসর ঘ্যাসর করে পিঠের ঘামাচি চুলকে দিচ্ছে। ছেলেটাকে দেখে বড় কষ্ট হয়। কে যে কী করার জন্যে জন্মায়! কীভাবে বিকিয়ে যায়! এই ভবের হাটে অনবরত চলছে বেচা-কেনা। কে কোন রাতে নিজের তাগিদে জন্ম দিয়ে সরে পড়েছে। এখন তুমি ভুগে মরো। নির্মলদা ঠিকই বলেন, তোমার আনন্দ আর একজনের দুঃখ। প্রাণ রাখিতে সদাই যে প্রাণান্ত। জন্মিতে কে চাইত যদি আগে সেটা জানত। ভোরে উঠেই ঘুমটি নষ্ট, তার পরেতে যে সব কষ্ট, বর্ণিতে অক্ষম আমি সে সব বৃত্তান্ত।
আয়েশে পরেশদার চোখ বুজে এসেছে। ছেলেটি তার গ্রাম্য ভাষায় বললে, খদ্দের এসেছে গো।
আসুক গে তুই শালা চুলকো।
আমার গলা না শুনলে আয়েশ কাটবে না। পরেশদা, এক সের গরম রসগোল্লা।
পরেশদা ঘাড় তুলে চিনলেন, আরে সেই ঘোড়াটা আবার এসেছে। কী হল? এই তো নিয়ে গেলে।
ছোঁড়া শব্দটা শুনে পা থেকে মাথা অবদি জ্বলে গেল। ব্যাটার পয়সা হয়েছে। পয়সা হলে কী হবে কালচার নেই। না, রাগলে চলবে না। গীতা বলছেন, বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ। গীতাকে তো আবার ব্যঙ্গ করেছেন ডি এল রায়। গীতার জোরে সচ্ছে ঘুষি, সচ্ছে কানুটিটে, গীতার জোরে পেটে না খাই, সয়ে যাচ্ছে পিঠে। নানা ভাবের ধাক্কায় পৃথিবীর পথ খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন হয়ে পড়ছে।
বেশ ঝরঝরে গলায় বলতে হল, দেরি হবে নাকি!
বাবা, তুমি যে দেখছি ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছ?
হ্যাঁ, তাড়া আছে। আমার কাজ আছে।
ব্যাজার মুখে পরেশদা দোকানে ঢুকলেন। বিচিত্র স্বভাবের মানুষ। আগেও দেখেছি দোকানে কোনও নিম্নশ্রেণির মহিলা এলে, অন্য খদ্দের ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রসালাপ করবেন। স্বামীজি কেমন করে বললেন, মানুষই ঈশ্বর। বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর। কী দৃষ্টি লাভ করলে পরেশকে ঈশ্বর ভাবা যায়! পরেশ ঈশ্বর, মণিপাগলি ঈশ্বর। আমিও ঈশ্বর। ঈশ্বরে ঈশ্বরে ছয়লাপ। পৃথিবী গিজগিজ করছে রে বাবা!
এবার আর কোনও ঝুঁকি নেওয়া চলবে না। মাথায় না চাপালেও, প্রায় বুকের কাছে গরম হুঁড়ি চেপে ধরে গুটিগুটি এগোতে থাকি। কৃষ্ণকোলে নন্দলালা যমুনা পার হচ্ছেন। আর কোনওদিন রাস্তার কুকুরকে সোহাগ করে বলতে যাব না, মানু আমার, মাংস নয়, রসগোল্লা। অন্ধকারে ভোস করে একটা শব্দ হল। ইনি আবার কে? আমাদের পাড়ার সেই বিখ্যাত ষাঁড়টি। যার আতঙ্কে যুবতী গোরুরা রাস্তা হাঁটে ভয়ে ভয়ে। যে থানার বড় দারোগাকে শিঙে ঝুলিয়ে রেখে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। খ্যাতিমান পুরুষ এখন প্রাণায়াম করছেন। কুলকুণ্ডলিনী ধ্যানস্থ। ইড়া পিঙ্গলায় মহেশ্বরের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে। চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাবার মতো গাভী সুন্দরীরা এখন গোয়ালে জাবর কাটছে। প্রকৃতিতে বড় কামপ্রভাব। পজেটিভ আর নেগেটিভ এক হবার জন্যে সদাই ছটফটর করছে। তাতে তোর কী রে শালা। এ যে রামকৃষ্ণের গলা। তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।
আমাদের বাড়িতে মধ্যরাতে সন্ধ্যা নামে। সব নিদ্ৰাজয়ী মহাযোগী। কোন বাড়িতে রাত বারোটার সময় কর্তা হাঁকেন, চা চাপাও তো! পিতৃদেব গর্ব করে বলেন, আমি হলুম নকটারন্যাল বার্ড। কালপ্যাচা। কেন এমন হয়েছে জানেন, একের পর এক রুগির পাশে বসে রাতের পর রাত জেগে জেগে আমার বায়োলজিক্যাল ক্লক ঘুরে গেছে। পৃথিবী যখন ঘুমোয় আমি তখন জাগি। সেন্টিন্যাল অফ দি নাইট। নাইটজার। পিতার স্টকে কত যে ভাল ভাল শব্দ আছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে সারাজীবন এমন পিতার পাশে থেকে সেবা করে যেতুম।
হাতে হাঁড়ি দেখে পিতা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন, এসেছে এসেছে। পেরেছে পেরেছে। আপনার ঈশ্বর পরাজিত হয়েছেন বিনয়দা। মেসোমশাই মুখ তুলে তাকালেন। সহজে হারতে চান না। মৃদু হেসে বললেন, বিচার হবে শেষের সে দিনে, যেদিন আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি হব। মৃত্যু একটা ন্যাচারাল প্রসেস। ওখানে ঈশ্বর নেই। আছে কাল। ইজ থেকে ওয়াজ।
Under the wide and starry sky,
Dig the grave and let me lie.
Glad did I live and gladly die,
And I laid me down with a will.
জলের বিম্ব জলেতে মিলায় অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত মরতে মরতে একেবারে মরণটারে মারত ॥
ব্যস! মেসোমশাই কুপোকাত। ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত সব একেবারে পাঞ্চ করে ছেড়েছেন। ভোলাময়রা আর হরুঠাকুরের ধুন্ধুমার লড়াই। ভুরভুরে ঘিয়ের গন্ধ নাকে আসছে। মুকু চেয়ারে নেই। রান্নাঘরে গেছে দিদিকে সাহায্য করতে। হঠাৎ মাতামহকে মনে পড়ল। এই মুহূর্তে কী করছেন কে জানে? বাগানের একপাশে নারকেল গাছের তলায় ছোট্ট একানে ঘর। বিশাল এক সিন্দুক। একটু পরেই আমরা লুচি খাব। তিনি কী খেলেন? মাতুলের সংসারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। অভিমানে দূরে সরে আছেন। কিছু প্রশ্ন করলেই হা হা হাসি, গৃহীভুত্বা বনী ভবেৎ, বার্ধক্যে মুনিবৃত্তীনাম।
মুকু গোটাকতক আসন হাতে বড়ঘরে ঢুকল। হলঘরই বলা চলে। শুনেছি একসময় এই ঘরে বড় বড় আসর বসত। রাত ভোর হয়ে যেত গানে গানে। বড় বড় সব ওস্তাদ আসতেন। মাতুল তখন কিশোর। সেই কিশোর বয়সেই তাক লাগিয়ে দিতেন। মুকু হাতের ইশারায় ডাকল।
সেই সন্ধে থেকে এক নাগাড়ে পড়ে পড়ে চোখদুটো ফুলে উঠেছে। কোন দিকে মুখ করে খেতে বসতে হয় জানো?
দক্ষিণ ছাড়া, যে-কোনও দিকেই মুখ করে বসা যায়। দাও আমি পেতে দিচ্ছি। মুকু তিনটে আসন এনেছে। দুটো আসন পেতে দিলুম।
তোমারটা পাতলে না?
আমি পরে তোমাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসব।
খেতে বসে পিতৃদেব নানা ফ্যাচাং বের করেন। কনক সামলাতে পারবে না। তা ছাড়া অপরিচিত মেসোমশাইয়ের সামনে বসে তারই মেয়ের ভেজে ভেজে দেওয়া ফুলকো লুচি খেতে লজ্জায় মরে যাব। রান্নাঘরে উনুনের আগুনের আভায় কনককে একেবারে বউমার মতো দেখাচ্ছে। ওবেলা একটু আড়ষ্ট ছিল। এবেলা সব পুরোমাত্রায় দখলে এসে গেছে। মাঝে মাঝে ডিক্টেটারের মতো মুকুকে হুকুম চালাচ্ছে।
একটা নকল কাশি দূর থেকে এগিয়ে আসছে। পিতা আসছেন। কনকের একেবারে পেছনে পঁড়িয়ে সিঁথি দেখছিলুম। কেন দেখছিলুম তা বলতে পারব না। ভাল লাগছিল। সম্মানজনক দূরত্বে সরে গেলুম। যতই শিশুর মতো নিষ্পাপ মুখ করি না কেন, পিতার চক্ষুবীক্ষণে মনের ফেঁসো ধরা পড়বেই। মন রে তুই শোয়াপোকা।
তালতলার চটি পটাস পটাস শব্দ করছে। কনকের কিছু দূরে এসে শব্দ থেমে গেল। পিড়েতে পেছন ঠেকিয়ে কনক বসে আছে উবু হয়ে। ইয়া এক খোঁপা ঘাড়ের কাছে লটকে আছে। সামনে অ্যালুমিনিয়ামের কড়ায় আধা-ঘিয়ে লুচি ফুলছে ফোঁস করে।
পিতা তারিফ করলেন, বাঃ বেশ ফুলছে। একেবারে নিখুঁত, নিটোল হয়ে। আচ্ছা এবার তুমি ওঠো। তোমার কাজ শেষ। এবার আমাদের শুরু।
কনক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, তার মানে?
তার মানে, তোমরা এইবার খেতে বসবে, আমরা পিতাপুত্রে পরিবেশন করব।
এ আবার কোন দেশি নিয়ম!
তোমরা অতিথি। অতিথিসেবার পর গৃহস্থ আহারে বসবে, এই হল নিয়ম।
নিয়ম শাস্ত্রেই থাক। আপনারা খেতে বসুন। মেয়েলি শাস্ত্র আলাদা।
কনক কথা বলছে আর লুচি ভেজে চলেছে। মেসোমশাইকে বেশ কায়দায় ফেলে দিয়েছে। মেয়েরা কেমন সহজেই শাসক হতে পারে! ভয়ডর কিছুই নেই। সাধে পরের বাড়ি গিয়ে সহজে আঁকিয়ে বসে? ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোয়।
পিতা বললেন, কথা তা হলে শুনবে না!
না, মেসোমশাইয়ের বাড়িতে এসেছি। অতিথিফতিতি আবার কী? যদ্দিন আছি, এ মহলে আপনার প্রবেশ নিষেধ।
ঠ্যাং করে কড়াতে ঝুঁজরিতে একটা শব্দ হল। পিতার চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি। বহু দূর থেকে যেন তাকিয়ে আছেন। দীর্ঘ জলযাত্রার পর নাবিক যে-দৃষ্টিতে তমাল তটরেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। স্থির অচঞ্চল। চটির শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল। এ কি জয়? এ কি পরাজয়? পরাজয় মাঝে মাঝে ভাল।
কনক এবার আমার দিকে তাকাল। একটা চোখ আধ-বোজা। কড়ার ভাপ এসে লাগছে। এ এক মারাত্মক চাহুনি। একে আমার একটু কবিকবি ভাব। থেকে থেকে আকাশে কালিদাসকে দেখি। ছাদে উঠে ডানা মেলে উড়ে যেতে চাই। বিরহী যক্ষের মতো জানলা দিয়ে উত্তরের শ্যামবৃক্ষরাজির দিকে তাকিয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার দিকে এমন ধারালো মুখ যদি আধ-বোজা চোখে তাকায়, তা হলে কী হয়? নাও ভেসে যায় নদীর জলে।
কনক বললে, তুমি বসছ না কেন?
আমার কি লুচি চলবে?
ওমা সেকী কথা!
দেখলে না, সকালের খাদ্য।
তোমার তো পেট সেরে গেছে।
অত্যাচারে যদি বেড়ে যায়?
ঘোড়ার ডিম হবে। গরম লুচিতে পেট ভাল হয়।
তা হলে, তোমাদের সঙ্গে বসব।
রাত হয়েছে বেশ। তোমার খিদে পায়নি?
না না, খিদে পাবে কেন?
খিদে পেয়ে পেয়ে মরে মরে এখন আর খিদে কাকে বলে ভুলেই গেছি। কনক তো আর জীবনের সব ঘটনা জানে না। মরা গাছে ফল শুকিয়ে পাকে। রং থাকে স্বাদ থাকে না।
মুকু পরিবেশন করছে। শাড়ির আঁচল ঝুলে ঝুলে পড়ছিল। মেসোমশাই বললেন, কতদিন বলেছি, আঁচল কোমরে জড়াবে।
মুকু বাঁ হাতে কোনওরকমে আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিল। মুকুর চুল বেশ কেঁকড়ানো কোকড়ানো। দু’জনের আহার বেশ জোরকদমে চলেছে। অম্বুলের রুগি হলে কী হবে, মেসোমশাই বেশ ভালই টানছেন। এক এক গ্রাসে, এক একখানা লুচি উড়ে যাচ্ছে।
দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছি। দু’বোন আমাকে কোনও কাজই করতে দেবে না। পিতা পাত থেকে মুখ তুলে বললেন, কী বুঝলে তা হলে?
বোকার মতো তাকিয়ে রইলুম ঘুমঘুম চোখে। কোন বোঝার কথা বলছেন?
একটি নধর পটল আঙুল দিয়ে ফুটো করতে করতে বললেন, সেই ছাগলের ঘটনা মনে আছে। নিশ্চয়ই।
ওরে বাবা, খুব মনে আছে। অনেকটা এই ভুলোর মতোই ব্যাপার। পিতাপুত্রে বাজার সেরে ফেরা হচ্ছে। আমার হাতে বিশাল দুটো কপি। চারপাশে লতাপাতা ঝুলছে। পথের পাশে একটা ছাগল শুয়ে ছিল। হঠাৎ মনে হল কপির পাতা তো কাজে লাগবে না। আহা কৃষ্ণের জীব খাইয়ে যাই। কপিসমেত পাতা মুখের সামনে ধরলুম। নে, খা, পাতা খা। ছাগলটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। আচমকা এক টান মেরে কপিদুটো হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মার দৌড়। দু’জনেই ছুটছি ছাগলের পেছনে। হইহই রইরই ব্যাপার। ছাগল এক খানা টপকাবার জন্যে মারলে লাফ। কপি ছিঁড়ে পড়ল নর্দমায়। পাতা-মুখে ছাগল পালাল ওপারে। রাস্তার লোকের সে কী আনন্দ! মানুষ বোকা বনে গেলে তার চেয়ে আনন্দের আর কী আছে! পিতার চোখমুখ রাগে লাল। বাড়ি ফিরে বললেন, ছাগলটাকে চিনতে পারলে? ভালমানুষের মতো বললুম, আজ্ঞে না।
আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও। দেখতে পাবে।
সামান্য দুটি কথা; কিন্তু কী অসম্ভব জ্বালা। শুনেছি, শয়তানের মুখ নাকি ছাগলের মতোই।
মুগের ডালের তারিফ করতে করতে পিতা বললেন, তোমার জন্যে আমি এক সেট ‘সারমন অন দি মাউন্ট’ তৈরি করে দিয়ে যাব। প্রথম সারমন হল, সবসময় ভাববে আমি মানুষ নই, একটা গাধা। পৃথিবীর অন্য সমস্ত জীবজন্তুর বুদ্ধি আমার চেয়ে ঢের বেশি।
মেসোমশাই ভরাট মুখে বললেন, সেই লেটারবক্সের ঘটনার পর আমিও নিজেকে তাই মনে করি।
পিতা কুচুরমুচুর করে লুচি খেতে খেতে বললেন, গ্রেট গাধাজ থিঙ্ক অ্যালাইক। হ্যাঁ, আপনার কী হয়েছিল?
সেই লেটারবক্স। তখন তো বলা হল না। কোর্টে যাবার পথে একদিন একটা চিঠি পোস্ট করার ছিল। এই অবদি শুনেই কনক কুঁক কুঁক করে হেসে উঠল। মেসোমশাই মেয়েকে সমর্থন করলেন, হাসিরই কথা। ভাবলে আমার নিজেরই এখনও হাসি পায়। চিরকাল শুনে আসছি চিঠি ঠিকভাবে না ফেললে লেটারবক্সের টাগরায় আটকে থাকে। তাই হাঁটু ভেঙে ডান পাশে কাত হয়ে হাতটাকে যতদূর পারা যায় ততদূর ঠেলে দিলাম ভেতরে। প্রায় কাধ পর্যন্ত ঢুকে গেল। চিঠিটা টুক করে ছেড়ে দিলুম। এইবার যত হাত টানি, হাত আর বেরোয় না। লেটারবক্সের জিভ আছে। আপনি কি তা জানেন হরিদা?
খুব জানি। লেটারবক্সও প্রাণী। সে থিয়োরি আমি আপনাকে পরে বলব।
যতবার হাত টানি মুখের সেই ফ্যালফ্যাল ফ্ল্যাপে কোটের ওপর হাতটা আটকে যায়। হাত আর বেরোয় না। তেমন জোরে টানতেও সাহস হচ্ছে না। কোট তো ছিড়বেই। সেই সঙ্গে একখানা। মাংসও যাবে। ইতিমধ্যে দু’-একজন এসে গেছেন চিঠি ফেলতে। তারা কেবলই জিজ্ঞেস করেন, কী। হল আপনার? আপনি কি নিজেকে পোস্ট করতে চাইছেন? তা হলে চিঠির বাক্সে নয়, পার্সেলের বাক্সে গিয়ে পড়ুন, হয়তো ধরে যাবে। লজ্জায় বলতেও পারছি না, আটকে গেছি। শেষে বলতেই হল, দাদা হাত টেনে ধরেছে। হইহই ব্যাপার। ঠিকুর রোদে বেলা বারোটা পর্যন্ত সেইভাবে ঝুলে রইলুম। মজা দেখার জন্যে শহরের ছেলেবুড়ো সব ভেঙে পড়ল। এজলাসে মামলা মুলতুবি রইল। জায়গাটার নামই হয়ে গেল, উকিলমারি। সেই থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি, ডাকবাক্সে আর কখনও হাত ঢোকাব না।
চিঠিটা নিশ্চয়ই একটু ক্ষতিকারক ছিল!
তা একটু ছিল। উকিলের চিঠি তো! কারুর সর্বনাশ, কারুর পোষ মাস।
সেই কারণেই লেটারবক্স হাত কামড়ে ধরেছিল। মরামাছ প্রতিশোধ নেয় জানেন কি?
কীরকম?
এই তো কয়েকদিন আগে সঁাত আর মাড়ির ফাঁকে আড়াআড়ি ঢুকে গেল কাটা। কিছুতেই বেরোয় না। আঙুলে ধরা যায় না। কাঠি দিয়ে খোঁচানো যায় না। জিভ দিয়ে ঠেলা যায় না। মাড়িতে পুঁতে গেল। ধারালো একটি খোঁচা বেরিয়ে রইল। সারাদিন কসরত। শেষে ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে ফেঁড়ে বার করতে হল। মানুষ অপঘাতে মরলে ভূত হয়। মাছও তাই। মরে মেরে গেল।
ওটা জাস্ট একটা দুর্ঘটনা।
তা হলে শুনুন, দেয়াল কীভাবে প্রতিশোধ নেয়। পেরেক পুঁতছেন। ইয়া গজাল। হাতুড়ি পড়ছে টাই উঁই। কে বলেছে দেয়ালের প্রাণ নেই! যার কান আছে, তার প্রাণও আছে। হাতুড়ির সঙ্গে ইশারায় কথা হয়ে গেল। ব্যস, পরের ঘায়ে বুড়ো আঙুলের মাথাটা ছেতরে গেল। পৃথিবী কি সহজ জায়গা মশাই! এখানে কী আছে আর কী নেই! কী হয় আর কী হয় না, বলা ভারী শক্ত।
একটি রসগোল্লা মুখে পুরলেন। এ হেঃ প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছে। গরম রসগোল্লা দোকানের সামনে উবু হয়ে বসে খেতে হয়। নিন নিন, টপাটপ মুখে পুরুন। তা হলে তোমার দর্দ বাড়বে। হিন্দিতে দর্দ মানে যন্ত্রণা।
ঘড়ি খাড়াড়াক করে উঠল। সাড়ে এগারোটা বাজবে। তিনমাথার মোড়ে কুকুর মড়াকান্না শুরু করেছে। মাঝরাত এগিয়ে আসছে। এইবার ভূত বেরোবে। আমাদের চিলের ছাতে পাচা ডাকবে চা চাঁ করে।
রান্নাঘরে তিনজন পাশাপাশি খেতে বসেছি। মেয়েদের খেতে বসার ধরনটাই আলাদা। একটা হাঁটু খাড়া থাকবে, আর একটা পাতা থাকবে জমিতে। তার ওপর থাকবে একটা হাত। ঠোঁটদুটো অল্প ফাঁক। খাবার ঢুকবে একটু একটু করে। খাচ্ছে কি খাচ্ছে না বোঝার উপায় থাকবে না। যে গতিতে খাওয়া চলেছে, শেষ হতে রাত দুটো বাজবে। কনক নিজের পাত থেকে একটা পটল আমার পাতে তুলে দিল। তুলে দিয়েই খেয়াল হল, এ মা তোমার পাতটা এঁটো করে দিলুম যে।
আনন্দে সারাশরীর শিরশির করে উঠল। কত কাছাকাছি চলে এসেছি। দুটো মহাদেশ যেন এক হচ্ছে। আমার একটা সেই মাছি-মার্কা হাসি আছে। দাঁত বের করা, গালে টোল ধরানো। সেই সাপের হাসি যে বেদেয় চেনে। মুখটাকে গাটাপার্চারের মতো করে বললুম, তাতে কী হয়েছে! তুমি খেলে না কেন?
নতুন পটল। সুন্দর খেতে। তুমি একটা বেশি খাও। রান্না কেমন হয়েছে?
উঃ। ওয়ান্ডারফুল। কার কাছে শিখলে এমন রান্না।
মায়ের কাছে।
সব শেষ হতে বারোটা বেজে গেল। উত্তর মহলের আলো নিবে গেল। কনক বললে, মুকু, তুই কি এখন আবার পড়তে বসবি?
আর শরীর বইছে না।
আজ তা হলে শুয়ে পড়।
ছাতে ধুপধাপ আওয়াজ হচ্ছে। পিতৃদেব পদচারণা করছেন। হজমের জন্যে যা অবশ্য করণীয়। বৃষ্টি পড়লে ছাতা মাথায় দিয়েও করতে হবে। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও সূর্য পূর্ব দিকে ঠিকই ওঠে। কোনও নড়চড় নেই।