মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
[বিশ্বনাথ দত্ত হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়]
ভ্রু তুলিয়া একটু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশ বলিল –“বিজ্ঞাপন পড় না? তবে পড় কি?”
“খবরের কাগজে সবাই যা পড়ে, তাই পড়ি—খবর।”
“অর্থাৎ মাঞ্চুরিয়ায় কার আঙুল কেটে গিয়ে রক্তপাত হয়েছে আর ব্রেজিলে কার একসঙ্গে তিনটে ছেলে হয়েছে, এই পড়। ওসব পড়ে লাভ কী? সত্যিকারের খাঁটি খবর যদি পেতে চাও, তাহলে বিজ্ঞাপন পড়।”
আমি খোঁচা দিবার লোভ সামলাইতে পারিলাম না, বলিলাম— “ও, তাই না কি? কিন্তু খবরের কাগজওয়ালারা তাহলে ভারি শয়তান, সমস্ত কাগজখানা বিজ্ঞাপনে ভরে না দিয়ে কতক গুলো বাজে খবর ছাপিয়ে পাতা নষ্ট করে।”
ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল— “তাদের দোষ নেই। তোমার মত লোকের চিত্তবিনোদন না করতে পারলে বেচারাদের কাগজ বিক্রি হয় না, তাই বাধ্য হয়ে ঐ সব খবর সৃষ্টি করতে হয়। আসল কাজের খবর থাকে কিন্তু বিজ্ঞাপনে। দেশের কোথায় কি হচ্ছে, কে কি ফিকির বার করে দিন-দুপুরে ডাকাতি করছে, কে চোরাই মাল পাচার করবার নতুন ফন্দি আঁটছে— এই সব দরকারী খবর যদি পেতে চাও তো বিজ্ঞাপন পড়তে হবে। রয়টারের টেলিগ্রামে ওসব পাওয়া যায় না।”
বড়তলা থানায় ফোনটা বেজেছিল কাকভোরে, পৌনে পাঁচটা নাগাদ।
—এখানে গণ্ডগোল হচ্ছে স্যার, প্রচুর লোক জমে গেছে। তাড়াতাড়ি আসুন।
—এখানে মানে?
—২সি, বিডন স্ট্রিট। খুন করে ফেলেছে স্যার।
—খুন?
ডিউটি অফিসার ফোন নামিয়ে রাখেন। সবে মিনিট পনেরো হল সকালের শিফটে বসেছেন। প্রথম ফোনটাতেই খুনের খবর? সাধে কি বলে, ‘মর্নিং শোজ় দ্য ডে!’ সকালই বুঝিয়ে দিচ্ছে, বাকি দিনটা কেমন যাবে?
বড়তলা থানা থেকে কতই বা দূরত্ব ঘটনাস্থলের? এক কিলোমিটার বড়জোর। পুলিশের জিপ যখন থামল ২সি বিডন স্ট্রিটের সামনে, অত ভোরেও অন্তত শ’তিনেক লোক। চিৎকার-চেঁচামেচিতে বোঝা দায়, ঠিক কী ঘটেছে। পুলিশের আবির্ভাবে সমবেত কোলাহল নিমেষে আরও উচ্চকিত, জানোয়ারটাকে আমরাই ফাঁসি দেব স্যার, আপনারা ফিরে যান!
২সি, বিডন স্ট্রিট
অপরাধের সুলুকসন্ধান পরে। পরিস্থিতি যা, এ তো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হতে যাচ্ছে। এমনিতেই জনবসতিপূর্ণ এলাকা, কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমাট বাঁধছে দ্রুত। অফিসার ওয়ারলেস সেট হাতে নিলেন, বার্তা পাঠালেন থানায়। থানা থেকে যা অবিলম্বে পৌঁছল লালবাজার কন্ট্রোলে, “Commotion at Beadon Street over suspected murder. Reinforcement required as early as possible. Please inform superiors.”
থানা জানাল ওসিকে, লালবাজার জানাল ডিসি নর্থ আর ডিসি ডিডিকে। ওসি সাততাড়াতাড়ি ছুটলেন, হোমিসাইড শাখার অফিসাররাও। পার্শ্ববর্তী থানাগুলি থেকে বাড়তি ফোর্স রওনা দিল বিডন স্ট্রিটের উদ্দেশে। কন্ট্রোল রুম ঘটনাস্থলে অফিসারদের জানিয়ে দিল, “DC North and DC DD on way. Situation report every five minutes please.”
বিশ্বনাথ দত্ত হত্যা মামলা। বড়তলা থানা, কেস নম্বর ৬২/৯৪। তারিখ ৬/৩/৯৪, ভারতীয়
দণ্ডবিধির ১২০ বি/৩০২/২০১ ধারায়। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুন এবং প্রমাণ লোপাট।
সূচনায় শরদিন্দুর ‘পথের কাঁটা’-র প্রারম্ভিক অংশের একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করেছি।
উপায়ান্তর ছিল না। আলোচ্য মামলার ঘটনাপ্রবাহে নির্ণায়ক ভূমিকা ছিল সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের, যেখানে ব্যোমকেশের ভাষায়, “আসল কাজের খবর” ছিল।
৩১ জানুয়ারি, ১৯৯৪, সোমবার। চন্দননগরের বাড়িতে বসে আনন্দবাজার পত্রিকার সারিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের পাতায় চোখ বুলোচ্ছিলেন অভিজিৎ। চাকরির সন্ধানে আছেন, কর্মখালির বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে পড়েন। লিখে রাখেন, কোথায় কোথায় আবেদনপত্র পাঠাবেন। দেখতে দেখতেই নজর পড়ল জমি/বাড়ি বিক্রয়-এর কলামে। এটা কী?
‘নোটিস
কলিকাতা মিউনিসিপ্যালের অন্তর্ভুক্ত/ ২/সি, বিডন স্ট্রীট, কলিকাতা-৬, বড়তলা থানার অধীন বাড়ী বিক্রয় হইবে। উক্ত ঠিকানার বাড়ীর দুই অংশিদার ছাড়া, যদি কোন অংশিদার বা দাবিদার থাকেন, তাহা হইলে উক্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ৭ দিনের মধ্যে এসে নিম্ন লিখিত ঠিকানায় যোগাযোগ করুন। বিকাশ পাল এডভোকেট স্মল কজেজ কোর্ট। ২/১, কিরণ শংকর রায় রোড, কলিকাতা-১’
একবার নয়, দু’বার পড়লেন অভিজিৎ। কাগজ হাতে নিয়েই সোজা পাশের ঘরে, ‘বাবা! এটা দেখেছ?’
সকাল সোয়া ন’টা তখন। প্রাতরাশ সেরে অফিসযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অমরনাথ। ছেলেকে বিচলিত দেখে একটু অবাকই হলেন। অভিজিৎ আশৈশব শান্ত প্রকৃতির, অকারণ উত্তেজনার প্রকাশ তার স্বভাববিরুদ্ধ। কাগজটা টেনে নিলেন ছেলের হাত থেকে।
‘কী হল? কী বেরিয়েছেটা কী? দেখি…’
অমরনাথ দেখলেন, এবং অফিসে হাজিরার ব্যস্ততা সাময়িক অগ্রাধিকার হারাল। বসার ঘরের ল্যান্ডলাইন থেকে তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন কলকাতার নম্বরে।
—সমর, আজকের আনন্দবাজার দেখেছিস? আটের পাতা, বিজ্ঞাপনের কলাম… জমিবাড়ি…
বিডন স্ট্রিটের তিনতলা বাড়িটি সাতের দশকের শেষাশেষি তৈরি করেছিলেন জগন্নাথ দত্ত। তিনি গত হলেন ’৯০-এর শুরুতে। স্ত্রী-ও প্রয়াত হলেন বছরতিনেকের মধ্যেই। উত্তরাধিকার সূত্রে বাড়ির মালিকানা পেলেন চার পুত্র, এক কন্যা।
বাড়ি বিক্রির নোটিস
বড় অমরনাথ ব্যাংকের আধিকারিক। সপরিবারে বাস চন্দননগরে। স্ত্রী সংসারধর্মে ব্রতী, পুত্র অভিজিৎ পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরিপ্রত্যাশী। মেজো সমরনাথ পৈতৃক বাড়িতে থাকেন না, তবে কলকাতারই বাসিন্দা, চাকুরিজীবী। পরের ভাই বিশ্বনাথ, অকৃতদার। ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার ধর্মতলা শাখার কর্মী। নির্বিরোধী মানুষ, নেশা বলতে দুটি, গান আর বিভিন্ন দেশের পুরনো মুদ্রা সংগ্রহ। রেকর্ড-ক্যাসেট কিনতেই ব্যয় হয়ে যায় বেতনের অর্ধাংশেরও বেশি। তিনতলায় দুটি ঘর নিয়ে অন্তর্মুখী জীবনযাপন।
পরের সন্তান অনুরাধা, বিবাহিতা। শ্বশুরবাড়ি কলকাতারই ফকির চক্রবর্তী লেনে।
সর্বকনিষ্ঠ অলোকনাথ কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল। স্ত্রী মমতা, এক শিশুপুত্র এবং দুই নাবালিকা কন্যাসহ থাকেন দোতলার দুটি ঘরে একটি আচ্ছাদিত বারান্দাসহ। অলোকনাথের ভায়রাভাই শিবশঙ্কর, ডাকনাম বাবু। কর্মহীন। ওই বারান্দাতেই তার নিশিযাপন।
একতলার ঘরগুলিতে ভাড়াটেরা থাকেন। মাসান্তে ভাড়ার সমবণ্টন হয় ভাইবোনদের মধ্যে। অমরনাথ-সমরনাথ-অনুরাধার ভাগের কয়েকটি ঘর খালিই পড়ে থাকে দু’তলা–তিনতলায়।
আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপন নজরে আসার পর কালক্ষেপের প্রশ্ন ছিল না। অমরনাথ যোগাযোগ করলেন সমরনাথ ও অনুরাধার সঙ্গে। বিডন স্ট্রিটের বাড়ির মালিকানার অংশীদার তাঁরাও এবং তাঁদের অনুমতি ব্যতিরেকে বাড়ি বিক্রি আইনসিদ্ধ নয়, উকিলকে জানিয়ে দিলেন যৌথ চিঠিতে। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে।
প্রশ্ন ওঠা সংগত, বিশ্বনাথ এবং অলোকনাথকে কিছু জানালেন না কেন, কেন কিছু জানতে চাইলেন না? উত্তরে ভাইবোনদের সম্পর্কের সমীকরণ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত জরুরি।
বিশ্বনাথ, পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন, নিজের জগতে থাকতে ভালবাসতেন। নিস্তরঙ্গ দিনাতিপাত, সামাজিক মেলামেশায় তীব্র বীতস্পৃহা। বৈষয়িক আলোচনায় বরাবরের অনাগ্রহী। অলোকনাথের মানসিক অবস্থান অবশ্য আমূল বিপ্রতীপে। ভোগবিলাসে আকর্ষণ মজ্জাগত, অনায়াস বিচরণ রেসের মাঠে, দিনান্তে মেজাজি মদ্যপান, নিষিদ্ধপল্লিতে পরিচিত মুখ নিয়মিত যাতায়াতের সৌজন্যে।
বিশ্বনাথ ভাইয়ের জীবনযাত্রায় হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতেন। কিন্তু সমরনাথ-অমরনাথ-অনুরাধার সঙ্গে অত্যন্ত তিক্ত সম্পর্ক ছিল অলোকনাথের। ছোটভাইয়ের উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবের তীব্র বিরোধী ছিলেন ওঁরা। পারস্পরিক বাক্যালাপ বন্ধই ছিল একরকম, বাবা-মা গত হওয়ার পর বিডন স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়িতেও আর পা-ই রাখেননি অন্যত্র বসবাসকারী ভাইবোনরা।
বিজ্ঞাপন দেখে ওঁরা ভাবলেন, আপনভোলা বিশ্বনাথকে ভুল বুঝিয়ে নিশ্চয়ই বাড়ি বিক্রির মতলব ফেঁদেছেন অলোকনাথ। উকিলকে তথ্যপ্রমাণসহ প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে আশ্বস্ত হলেন তিন ভাইবোন। যাক, বাড়ি বিক্রির সম্ভাব্য চক্রান্ত সমূলে বিনষ্ট করা গেল।
সমরনাথের কলকাতার বাইরে কাজ ছিল অফিসের, ফেরার কথা ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। অমরনাথ ঠিক করলেন, সমরনাথ ফিরলে মার্চের প্রথম সপ্তাহে দু’জনে মিলে বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে যাবেন। একটা হেস্তনেস্ত অলোকের সঙ্গে এবার না করলেই নয়। কী ভেবেছেটা কী? ‘ধাবু’কেও (বিশ্বনাথের ডাকনাম) বোঝানো দরকার। কাউকে কিছু না জানিয়ে রাজি হয়ে গেল অলোকের কথায়? টাকাপয়সার লোভ তো ধাবুর কোনওকালেই ছিল না, তা হলে?
‘তা হলে’-র উত্তর মিলল ৬ মার্চের ভোরে। আগের রাতেই অমরনাথ পুত্র অভিজিৎকে নিয়ে চন্দননগর থেকে পৌঁছলেন কলকাতায়। উঠলেন সমরনাথের বাড়িতে। ঠিক হল, তিনজনে রাত দুটো-আড়াইটে নাগাদ যাবেন বিডন স্ট্রিটে। অলোকের মর্নিং ডিউটি থাকলে ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে যাবে। দেখাই হবে না সকালে গেলে। আর দেখা হলেও ডিউটির অজুহাতে আলোচনাটা হতে দেবে না। বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরবেই না হয়তো দু’-তিনদিন। ধরতে হবে ঘুমনোর সময়।
ঘুমচোখে দরজা খুললেন অলোক, চমকে গেলেন দাদাদের ওই গভীর রাতে দেখে।
—তোমরা?
—অনেকদিন আসা হয়নি, খোঁজখবর নিতে এলাম। উপরে গিয়েছিলাম, ধাবুর ঘর দেখলাম ভিতর থেকে বন্ধ। ধাক্কা দিতে কেউ আওয়াজ দিল ভিতর থেকে, ‘বাদ মে আইয়েগা।’ ধাবু কই?
—ওহো, তোমাদের বলা হয়নি, ধাবুদা তো দিন পনেরো হল বারাসতে ঘরভাড়া নিয়ে চলে গেছে।
—মানে? হঠাৎ বারাসতে কেন?
—বলল, কিছুদিনের মধ্যেই ইউবিআই-এর বারাসত ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে যাবে। এখান থেকে যাতায়াতের অসুবিধে হবে। তাই আগে থেকেই ওখানে একটা আস্তানা…
মাঝপথে থামিয়ে দেন অমরনাথ।
—তোর গল্পটা দাঁড়াচ্ছে না। কী হয়েছে বল? আর আমাদের ঘরগুলোও ভিতর থেকে বন্ধ কেন? খোলাই তো থাকে সবসময়। ধাবু কোথায়?
—বললাম তো বারাসত! বিশ্বাস না হয় দেখে এসো। ১১/১ ঝাউতলা লেন, বারাসত চৌরাস্তার কাছে। শুধুশুধু চোটপাট করছ কেন?
—করছি কি আর সাধে! আমাদের ঘর বন্ধ কেন? ধাবুর ঘরেই বা কারা? এসব কী করেছিস তুই? আমরা বারাসত থেকে ঘুরে এসে তোর সঙ্গে বোঝাপড়া করছি।
ততক্ষণে তর্কাতর্কি আর চেঁচামেচিতে বেরিয়ে এসেছেন একতলার ভাড়াটেরা। দু’তলা–তিনতলার ভিতর থেকে বন্ধ ঘরগুলি থেকেও বেরিয়ে এসেছেন এক অবাঙালি পরিবারের সদস্যরা। সমরনাথ পরিচয় জানতে চাইলে এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, ‘মেরা নাম নন্দলাল সিং। অলোকবাবু আর বিশ্বনাথবাবু আপনা আপনা হিস্যা মুঝে বেচ দিয়া থোড়ে দিন পহেলে।’
—তার মানে? ওই ঘরগুলোর মালিক আমরা, কিনে নিয়েছেন মানে?
—আপ অলোকবাবুসে পুছিয়ে না! এগ্রিমেন্ট হ্যায় মেরে পাস। দেখ লিজিয়ে।
বাড়ি বিক্রির দলিল আনতে ঘরে ঢুকলেন নন্দলাল, আর সমরনাথ কলার চেপে ধরলেন ছোটভাইয়ের। অলোকনাথ তখন দৃশ্যতই কোণঠাসা, মুখে টুঁ শব্দটি নেই। মমতাও নিশ্চুপ, নতমস্তক। অমরনাথ নিরস্ত করলেন সমরনাথকে।
—আগে বারাসত যাই চল। ধাবুটার কী হল কে জানে! ফিরে এসে বাকি বোঝাপড়া করছি।
অমরনাথ–সমরনাথ-অভিজিৎ ট্যাক্সি করে রওনা দিলেন বারাসত, ফিরলেন রাত সোয়া চারটে নাগাদ। অলোক যে ঠিকানা বলেছিলেন, সেখানে অন্য পরিবার বাস করে। বিশ্বনাথের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে, ডাহা মিথ্যে বলেছেন অলোক।
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল দুই দাদার। চড়থাপ্পড়ের অকৃপণ বৃষ্টিপাত হল অলোকের উপর, ‘বল কী করেছিস? পিটিয়েই মেরে ফেলব না হলে!’ চেপে ধরলেন একতলার ভাড়াটেরাও।
মিনিটপাঁচেকের বেশি ওই ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে পারলেন না অলোক, স্বীকারোক্তি এল।
—ধাবুদাকে মেরে পুঁতে দিয়েছি।
—মানে?
‘মানে’ উদ্ধারে অবিলম্বে বড়তলা থানার নম্বর ডায়াল করলেন অভিজিৎ।
অতিরিক্ত পুলিশবাহিনী পৌঁছনোর পর ভিড় ঠেলে ঢোকা গেল ২সি বিডন স্ট্রিটের অন্দরমহলে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছেন অলোকনাথ দু’তলার বারান্দায়, এক কোণে প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে মমতা। একতলার ভাড়াটেদের অনেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বারান্দার এদিক-সেদিক। অমরনাথ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। সমরনাথ বিধ্বস্ত, চোখের জল মুছছেন। অভিজিৎ সামলাচ্ছেন শোককাতর কাকাকে। ওসিকে দেখে অমরনাথ এগিয়ে এলেন।
—আসুন বড়বাবু, আমার নাম অমরনাথ দত্ত।
—কী হয়েছে? শুনলাম খুন…
কাঁদতে কাঁদতে সমরনাথ ছুটে যান অলোকনাথের দিকে। কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে থাকেন ছোটভাইয়ের।
—স্যার, এ খুন করেছে, এ! ধাবুকে খুন করে পুঁতে দিয়েছে। নিজের দাদাকে খুন করে জাল দলিল বানিয়ে বাড়ি বিক্রি করেছে, কুলাঙ্গার একটা, ফাঁসি দিন স্যার…কিছুতেই বলছে না কোথায় পুঁতে রেখেছে আমাদের ধাবুকে…
অফিসাররা বুঝলেন, এভাবে কাজের কাজ কিছু হবে না। একান্তে জিজ্ঞাসাবাদ দরকার। ক্রোধোন্মত্ত জনতার ভিড় ঠেলে অলোকনাথকে কোনওমতে নিয়ে যাওয়া হল বড়তলা থানায়।
‘ঘটনাটা পুরোটা বলুন। আপনি কলকাতা পুলিশের কর্মী। পুলিশের কায়দাকানুন জানেন। সত্যিটা তাড়াতাড়ি বললে ভাল। যত দেরি করবেন, তত বেশি ক্ষতি, এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।’
অলোকনাথ বিস্তর মারধর খেয়েছেন দাদাদের হাতে একটু আগেই। ঠোঁট ফুলে গিয়েছে, চুল উস্কোখুস্কো, হাঁফাচ্ছেন। বলতে শুরু করলেন। রহস্য ক্রমে উন্মোচিত হল।
প্রায় পঁচিশ বছর আগে কতই-বা বেতন ছিল একজন কনস্টেবলের? স্ত্রী এবং তিন সন্তানের সংসার সামলে বেহিসাবি বিলাসব্যসন অসম্ভব। ইন্দ্রিয়ের তাড়নাকে সংযত রাখার ক্ষমতা অবশ্য কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল অলোকনাথের অনায়ত্ত ছিল। রেস-জুয়া-মদ-নারীসঙ্গের অভ্যাস ত্যাগ করার অক্ষমতা বাধ্য করেছিল ধারদেনায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়তে। পরিত্রাণের পথ খুঁজছিলেন মরিয়া অলোকনাথ।
পথের দিশা পেলেন একটাই, অনেক ভাবার পর। বাড়ির দু’তলা-তিনতলাটা যদি বেচে দেওয়া যায়, অর্থাগম হবে যথেষ্ট। কিন্তু বড়দা-মেজদা আর দিদি রাজি হবে? সম্ভাবনা শূন্য। ধাবুদা? বলে দেখা যেতে পারে একবার। বললেনও ’৯৩-এর নভেম্বরের শেষদিকে এবং হতাশ হয়ে পড়লেন বিশ্বনাথের প্রতিক্রিয়ায়।
—না না, বাড়ি বেচার প্রশ্ন আসছে কেন হঠাৎ? দিব্যি আছি তো।
বিশ্বনাথ ‘দিব্যি’ থাকতে পারেন, ধারদেনায় বিপর্যস্ত অলোকনাথ মোটেই স্বস্তিতে ছিলেন না। ভ্রাতৃহত্যার ষড়যন্ত্রের বীজ বপনে দেরি করলেন না বিশেষ। আশ্রিত ভায়রাভাই শিবশঙ্করকে শরিক করলেন পরিকল্পনার। চিত্রনাট্য রচনায় থাকল স্ত্রী মমতারও সক্রিয় অংশগ্রহণ। টাকার লোভে চক্রান্তে যুক্ত হলেন শিবশঙ্করের ভগ্নিপতি মৃণাল দত্ত। বাড়ি নিমতায়, পেশায় ব্যাংককর্মী। নিয়মিত যাতায়াত ছিল বিডন স্ট্রিটের বড়িতে।
জেরায় নাজেহাল অলোকনাথ মাঝেমাঝেই কেঁদে ফেলছেন, জবানবন্দিতে ছেদ টানছে স্বগতোক্তি, ‘এ আমি কী করলাম! ক্ষমা করে দিন স্যার!’
এসব কুম্ভীরাশ্রু অনেক দেখেছেন গোয়েন্দারা, বাকিটা বলতে বাধ্য করছেন নির্মোহ নৈপুণ্যে, তারপর কী হল?
—ব্রোকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। খদ্দেরও পেয়ে গেলাম কয়েকজন। মৃণাল আমার শালা, আমি আর মমতা মিলে বোঝালাম মৃণালকে, ধাবুদার নামে সই করতে হবে বেচাকেনার দলিলে, বিশ্বনাথ দত্ত সেজে। প্রথমে রাজি হচ্ছিল না, কিছু টাকা দিলাম। মৃণাল সামান্য চাকরি করত, রাজি হয়ে গেল।
—তারপর?
—নন্দলাল সিং নামে এক অবাঙালি খদ্দেরের সঙ্গে চুক্তি ফাইনাল হল। বাড়ি দেখতে এলেন নন্দলাল। ধাবুদা যখন অফিসে, তখন দেখালাম। মৃণালকে পরিচয় দিলাম বিশ্বনাথ দত্ত হিসেবে, আর মমতাকে নিজের দিদি অনুরাধা হিসেবে। দোতলা আর তিনতলার ঘরগুলো বেচার এগ্রিমেন্ট হল, সইসাবুদ জানুয়ারির মাঝামাঝি। মৃণাল-মমতা সই করল বিশ্বনাথ-অনুরাধা হিসেবে। অ্যাডভান্স হিসেবে ষাট হাজার মতো পেলাম।
নন্দলালদের তাড়া ছিল। তাগাদা দিচ্ছিলেন, কবে পজেশন পাবেন? দখল পাওয়ার এবং রেজিস্ট্রেশনের পর বাকি লাখদুয়েক দেওয়ার কথা হয়েছিল। ধাবুদা থাকলে কী করে পজেশন দেব? অ্যাডভান্স নিয়ে ফেলেছি, বাগুইআটির অশ্বিনীনগরে ফ্ল্যাট ভাড়াও হয়ে গেছে, যেখানে উঠে যাব ঠিক করেছিলাম বাড়ি বিক্রির পর।
—এর পর?
—ধাবুদাকে মেরে ফেলা ছাড়া তো আর উপায় ছিল না স্যার।
—তা কী উপায় করলেন?
—২২ জানুয়ারি রাতে ধাবুদা সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরল। বললাম বাড়িতে মিস্ত্রি লেগেছে, আমাদের বারান্দায় শুয়ে পড়ো। সরল মানুষ ছিল, বিশ্বাস করল। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ আমি-শিবশঙ্কর-মৃণাল মিলে কম্বল চাপা দিয়ে মেরে ফেললাম। পরের দিন বিকেলেই পজেশন দিলাম নন্দলালকে। ওঁরা চলে এলেন, দখল নিলেন ঘরগুলোর। আমি বললাম, আমার ঘরটা কয়েকদিন পরেই ছেড়ে দেব। জিনিসপত্র শিফট করতে একটু সময় দরকার। নন্দলাল রাজি হয়ে গেলেন।
—বডি কোথায়?
—পুঁতে দিয়েছি স্যার।
—সে তো বুঝলাম, কিন্তু কোথায়?
অলোক নিরুত্তর। কলার ধরে ঝাঁকুনি দিতে কথা বেরল অস্ফুটে।
—নিমতলা ঘাটের কাছে স্যার।
—জায়গা দেখাতে পারবেন?
—হ্যাঁ স্যার।
কালবিলম্ব না করে গাড়ি ছুটল নিমতলা ঘাটে। অলোক একবার এ-জায়গা দেখাচ্ছেন, একবার ও-জায়গা। যেন দিকভ্রান্ত, অকস্মাৎ স্মৃতিভ্রষ্ট।
অপরাধীর এহেন অকাল স্মৃতিভ্রংশের সঙ্গে পরিচিত গোয়েন্দারা। বুঝলেন, সহজে কবুল করবেন না অলোকনাথ। একে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া দরকার, থানায় হবে না। তবে তার আগে অলোকনাথের এবং বিশ্বনাথের ঘরটা সার্চ করা প্রয়োজন, সকালের তাড়াহুড়োয় আর হট্টগোলে করা যায়নি। স্থির হল, ঘরগুলো তল্লাশি করে seizure list তৈরি করে তারপর সোজা লালবাজার। অনেক সময় আছে, কতক্ষণ চেপে রাখবে সত্যিটা?
ফের বিডন স্ট্রিট। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা ততক্ষণে দখল নিয়ে ফেলেছেন বাড়ির।
বারান্দার এবং বাড়ির বাকি অংশের স্কেচম্যাপ তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। শিবশঙ্কর এবং মমতাকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। দু’জনেরই মুখে কুলুপ। মৃণালের নিমতার বাসস্থানের খোঁজে টিম বেরিয়ে গিয়েছে। কাদের কাদের জেরা করা আশু প্রয়োজন, তৈরি হচ্ছে তালিকা। তদারকিতে ডিসি ডিডি স্বয়ং, সহায়তায় ডিসি নর্থ।
হোমিসাইড বিভাগের টিমে ছিলেন অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন আটাশ বছরের তরুণ সাব-ইনস্পেকটর, অধুনা ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। অতনু ছিলেন অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের, সজাগ মস্তিষ্ক এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির সুবাদে প্রিয়পাত্র ঊর্ধ্বতন অফিসারদের।
তন্নতন্ন করে প্রতিটি ঘর খুঁজে যখন প্রস্তুতি চলছে seizure list-এর, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা খুঁজছেন বারান্দায় হাত বা পায়ের ছাপের নমুনা, অতনুও ঘুরে দেখছিলেন এঘর-ওঘর। হঠাৎই চোখ আটকে গেল নন্দলালের ঘরের দেওয়ালে। ঠাকুরের বেদি, যেমন আছে এবাড়ির অধিকাংশ ঘরে। কিন্তু এটার রং একটু অন্যরকম লাগছে না? একটু কাঁচা মনে হচ্ছে না চোখের দেখায়? বাকি দেওয়ালের রঙের সঙ্গে একটু তফাত যেন? ঘরের সমস্ত অংশ সাদা, এই বেদিটা একটু ক্রিমরঙা, সামান্য লালচেও না? বিদ্যুৎঝলক খেলে যায় অতনুর মাথায়।
—স্যার, একবার এদিকে আসবেন?
সিমেন্ট করা সেই বেদিটি, যার নীচে মৃতদেহ ছিল
তড়িঘড়ি এলেন ডিসি ডিডি সহ বাকিরা। আরে, সত্যিই তো! রং সামান্য আলাদা, আর কাঁচাও। অলোকনাথকে নিয়ে আসা হল বেদির সামনে। মিনিটদুয়েকের ধমকধামক এবং মৃদু চড়চাপড়ের পর ভেঙে পড়লেন দত্তবাড়ির কনিষ্ঠ পুত্র।
—ওখানেই ধাবুদাকে পুঁতে দিয়েছিলাম স্যার।
নিজেদেরই বাড়ির দেওয়ালে দাদাকে খুন করে পুঁতে দিয়ে বাড়ি বিক্রি, ‘পথের কাঁটা’-কে সরিয়ে দেওয়া? বাক্রুদ্ধ অভিজ্ঞ অফিসাররাও, সংবিৎ ফিরতে সময় লাগল কিছু। মিস্ত্রি ডাকা হল, বেদিতে কোদালের প্রথম কোপ পড়ার কিছু পরেই দুর্গন্ধ দখল নিল ঘরের। উদ্ধার হল দেহ, মৃত্যুর দেড় মাস পরে। ঘাড়ে-গলায়-বুকে সামান্য মাংস লেগে রয়েছে, শরীরের অবশিষ্ট প্রায় কঙ্কালে পর্যবসিত। জেরায় প্রকাশ্যে এল, কখন কীভাবে মৃত্যু এসেছিল তেতাল্লিশ বছরের বিশ্বনাথের, সহোদরের চক্রান্তে।
বিশ্বনাথ দত্ত-র কঙ্কাল
২২ জানুয়ারি, ১৯৯৪। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরলেন বিশ্বনাথ, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে ব্যাংকের একটি বিচিত্রানুষ্ঠান দেখে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবেন, মুখোমুখি অলোকনাথের সঙ্গে।
—ধাবুদা, আজ তুই আমাদের ঘরের লাগোয়া বারান্দাটায় শুয়ে পড়বি?
—কেন রে?
—না, ঘরগুলোর যা অবস্থা, মিস্ত্রি লাগিয়েছি একটু চুনকামের জন্য। তাড়াহুড়োয় বলা হয়নি আগে। আজ তিনতলাটা ধরেছে, কাল-পরশু দোতলাটা করবে।
বিশ্বনাথ দেখতেও পেলেন কয়েকটি সিমেন্টের বস্তা দু’তলা থেকে তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে। ভাইকে বিশ্বাস করলেন। খাওয়াদাওয়া সেরে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লেন দু’তলায় ভাইয়ের ঘরের লাগোয়া বারান্দায়। মৃণাল পূর্বপরিকল্পনা মাফিক সাড়ে ন’টার মধ্যেই এসে পৌঁছলেন, অপেক্ষা করলেন অলোকনাথের ঘরে। যেখানে তখন উপস্থিত শিবশঙ্করও। এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল অলোকের পুত্র-কন্যারা। ঘড়ির কাঁটা যখন পেরল সাড়ে বারোটা, অলোক বেরলেন ঘর থেকে। ফিরলেন মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই।
—দাদা ঘুমিয়ে পড়েছে। মমতা, কম্বলটা দাও।
কম্বল নিয়ে শিবশঙ্কর, মৃণাল আর অলোক এলেন বারান্দায়, যেখানে বিশ্বনাথ গভীর
নিদ্রাচ্ছন্ন। শিবশঙ্কর দুই পা চেপে ধরলেন বিশ্বনাথের, মৃণাল হাত দুটো। অলোক কম্বল চাপা দিলেন দাদার মুখে, সর্বশক্তি প্রয়োগে চেপে ধরে থাকলেন প্রায় মিনিটসাতেক। হাত-পায়ের নিষ্ফল ছটফটানি ক্রমে থেমে এল বিশ্বনাথের। কম্বল মুখ থেকে তুলে নাকের কাছে হাত নিয়ে পরীক্ষা করলেন অলোকনাথ। চোখের পাতা টেনে দেখলেন…
নাহ্, নিশ্বাস পড়ছে না আর, কাজ হয়ে গেছে।
কাজ আরও বাকি ছিল, সম্পূর্ণ করলেন চক্রী-চতুষ্টয়, অলোক-মমতা-মৃণাল-শিবশঙ্কর। মিস্ত্রিদের দিয়ে কিছুদিন আগেই অলোক দু’তলার একটি ঘরে নতুন করে ভিত করিয়ে রেখেছিলেন ঠাকুরের বেদির। যেমন বেদি দেয়ালের সঙ্গে ছিল বিডন স্ট্রিটের বাড়ির অধিকাংশ ঘরেই। মজুত ছিল পর্যাপ্ত সিমেন্ট-বালিও।
বিশ্বনাথের নিস্পন্দ দেহকে বেদির মধ্যে পা মুড়িয়ে ঢোকানো এবং অতঃপর গাঁথনি, প্রমাণ লোপাটে ভোর হয়ে গেল প্রায়। মৃণাল ফিরে গেলেন নিমতার বাড়িতে, শিবশঙ্কর রোজকার মতো শুয়ে পড়লেন বারান্দায়, যেখানে ঘণ্টাখানেক আগেই ঘুমোচ্ছিলেন বিশ্বনাথ। এবং পাশের ঘরের দেওয়ালে দাদার মৃতদেহ গেঁথে দেওয়ার পর অলোকনাথ-মমতা ঘরে ফিরে নিদ্রা গেলেন নির্বিকার।
অলোক-মমতা-শিবশঙ্কর গ্রেফতার হয়েছিলেন মৃতদেহ আবিষ্কারের দিনই। মৃণাল ধরা পড়লেন পরের দিন, নিমতার বাড়ি থেকে।
তদন্তের দায়িত্ব ন্যস্ত হল অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরই। পুলিশকর্মী নিজের দাদাকে হত্যা করে পুঁতে রেখেছিলেন বাড়ির দেওয়ালে, অশ্রুতপূর্ব এই ঘটনায় শহর জুড়ে তুমুল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিকই ছিল। যেমন স্বাভাবিক ছিল দ্রুত চার্জশিট পেশ করে শাস্তিবিধানের চাপ। অলোকনাথ যে প্রকৃতির মানুষ, পুলিশকে দেওয়া বয়ান সম্পূর্ণ অস্বীকার করবেন আদালতে, অনায়াসে অনুমেয়। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতেই দোষী সাব্যস্ত করতে হবে অভিযুক্তদের, স্পষ্ট ছিল গোড়া থেকেই।
তদন্ত হল ম্যারাথন। অভিযুক্তদের গ্রেফতারির অর্থ, বিয়াল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যে অতিক্রান্ত মাত্র দশ। বাকি বত্রিশে প্রমাণ সংগ্রহ, চার্জশিট পেশ এবং আদালতে বিচারান্তে শাস্তিপ্রাপ্তি। দৌড় শুরু করলেন অতনু। প্রমাণ একত্রিত করার জরুরি কাজটি সম্পন্ন করলেন নিখাদ নিষ্ঠায়, প্রত্যয়ী পরিশ্রমে।
বাগুইআটির অশ্বিনীনগরে অলোকনাথের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হল বিশ্বনাথের তিনটি ট্রাঙ্ক। যাতে ছিল পোশাকআশাক, প্রচুর পুরনো মুদ্রা আর গানের রেকর্ড-ক্যাসেট। অর্থলোভ কতটা অতলগামী করে ফেলে মানুষকে, তার প্রমাণ মিলল ২৪/এ, নিমতলা ঘাট স্ট্রিট-নিবাসী গোবিন্দ সর্দারের বাড়িতে। যাঁকে বিশ্বনাথের পাম্পসেট এবং কিছু আসবাবপত্র বেচে দিয়েছিলেন অলোকনাথ এবং কবুল করেছিলেন জেরায়।
বাড়ি বিক্রির দলিলে সই করেছিলেন অলোক-মৃণাল-মমতা। ত্রয়ীর হস্তাক্ষরের নমুনা (Specimen hand writing) সংগ্রহ করে পাঠানো হল ফরেনসিক পরীক্ষায়, প্রত্যাশিতভাবেই মিলে গেল হুবহু।
পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের অস্ত্রাগারে (Armoury) কর্মরত ছিলেন অলোকনাথ। হাজিরা খাতা খুলে দেখা গেল, ২৩ জানুয়ারি ডিউটিতে এসে কিছু পরেই মেয়ের অসুস্থতার অজুহাতে বেরিয়ে যান। ফের কাজে যোগ দেন সপ্তাহখানেক পর। খুনটা হয়েছিল ২২-র রাতে। পরের সাতদিন অলোক ব্যস্ত থেকেছিলেন নন্দলালদের মালিকানা দেওয়ায় এবং অন্য সম্ভাব্য প্রমাণ লোপাটে। পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কর্মক্ষেত্রে ওই ঘটনা-উত্তর অনুপস্থিতি।
সিমেন্ট-বালি অলোকনাথ কিনেছিলেন সৌমিত্র নায়ক নামের এক ইমারতি সামগ্রী বিক্রেতার থেকে, জানুয়ারির মাঝামাঝি। দোকান এবং দোকানের মালিক, দুই-ই চিহ্নিত হল। আদালতে রাখঢাকহীন বয়ান দিলেন সৌমিত্র, চিহ্নিত করলেন ক্রেতা অলোকনাথকে।
গ্রেফতারির পর থেকেই মৃণাল দত্ত তদন্তকারীদের বলে আসছিলেন, যে পাপ করেছি, তার ক্ষমা নেই। অভিনয় নয়, বাস্তবিকই অনুতাপদগ্ধ ছিলেন মৃণাল, মনে হয়েছিল অতনুর। মৃণাল সম্মত হয়েছিলেন আদালতে বিচারপতির কাছে জবানবন্দি (judicial confession) দিতে। ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন পুঙ্খানুপুঙ্খ। যা চূড়ান্ত সহায়ক হয়েছিল শাস্তিবিধানে।
বয়ান নেওয়া হল আইনজীবী বিকাশ পালেরও, যিনি আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বিকাশকে নিয়োগ করেছিলেন নন্দলাল, সম্পত্তি বেচাকেনায় কোনও আইনি জটিলতা রয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে। বিক্রয়প্রক্রিয়া চলাকালীন অলোক আগাগোড়া বলে এসেছিলেন, তাঁরা দুই ভাই, এক বোন। বাড়ির দলিলপত্র পুরসভায় ‘সার্চ’ করে অন্য তথ্য পেয়েছিলেন বিকাশ। নথি বলেছিল, চার ভাই, এক বোন। প্রশ্ন করায় অস্বীকার করেছিলেন অলোক, এড়িয়ে গিয়েছিলেন উত্তর। অবধারিত সন্দেহের উদ্রেক হয়, কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিকাশ। যে বিজ্ঞাপন দেখা দিয়েছিল রহস্যভেদের প্রধান অনুঘটক রূপে। বিকাশও আদালতে চিহ্নিত করেছিলেন অলোক-মমতা-মৃণালকে।
মূল কাজটি অবশ্য তখনও অসমাপ্ত। প্রায় কঙ্কালে পরিণত দেহ যে বিশ্বনাথেরই, তার সন্দেহাতীত প্রমাণ।
ময়নাতদন্ত করেছিলেন অধ্যাপক ডা. অপূর্বকুমার নন্দী, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক অ্যান্ড স্টেট মেডিসিন বিভাগের তৎকালীন প্রধান। দীর্ঘ কর্মজীবনে কয়েক হাজার মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ডা. নন্দী রিপোর্টে লিখলেন, “Death in my opinion was caused by compression of neck, for example, throttling ante-mortem and homicidal in nature.” জানালেন, মৃতের বয়স আনুমানিক তেতাল্লিশ। বিশেষ তাৎপর্যের, অমরনাথ-সমরনাথ-অনুরাধা জানিয়েছিলেন, গজদাঁত ছিল বিশ্বনাথের। সেই গজদাঁতেরও উল্লেখ ছিল রিপোর্টে, যা চিহ্নিতকরণের পক্ষে অন্যতম পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয়েছিল বিচারপর্বে।
দেহ শনাক্তকরণে তর্কাতীত প্রমাণ অবশ্য মিলেছিল ‘photographic superimposition’ পদ্ধতিতে। তদন্তকারী অফিসারের আর্জিতে যার সফল প্রয়োগ করেছিলেন কলকাতার Central Forensic Science Laboratory (CFSL)-র তৎকালীন ডেপুটি ডিরেক্টর ড. ভি কে কশ্যপ। ১৯৬০ সালে পঞ্চম শুক্লা হত্যা মামলায় কলকাতা তথা ভারতে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ‘সুপারইমপোজ়িশন’ পদ্ধতি। বিশ্বনাথ দত্তের খুনের মামলায় যার প্রয়োগ কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে হয়েছিল দ্বিতীয়বার, চৌত্রিশ বছর পরে।
মৃতের করোটি। গজদাঁতের চিহ্নিতকরণের অন্যতম প্রমাণ
রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, “The super-imposition test suggests that the skull and the mandible belonged to a person whose photographs were forwarded to me for test.”
ঘটনার ‘কী-কেন-কখন-কীভাবে’ এত নিখুঁত উঠে এসেছিল অতনুবাবুর চার্জশিটে, অভিযুক্তদের আইনজীবী হালে পানি পাননি। অলোকনাথ-মমতা–শিবশঙ্কর-মৃণালকে ফাঁসির সাজা শোনান সেশন কোর্ট, ২০০০ সালে। যা বহাল রাখেন কলকাতা হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট অলোকের সাজা লঘু করে দণ্ডিত করেন যাবজ্জীবন কারাবাসে। বাকিদের, যাঁদের দীর্ঘ কারাবাস ততদিনে সম্পূর্ণ, মুক্তি দেওয়া হয়।
অলোকনাথ সম্প্রতি বহরমপুর জেলে পরলোকগত হয়েছেন। আপাতত ‘সর্বোচ্চ’ আদালতের বিচারাধীন হয়তো।
বিবরণীর সূচনা ‘পথের কাঁটা’-র উদ্ধৃতি দিয়ে। সমাপ্তিতেও নিই শরদিন্দুর শরণ। ব্যোমকেশের সেই বহুপঠিত কাহিনি মনে করুন, যাতে বৃদ্ধ করালীবাবুকে খুন করা হয়েছিল মেডালা আর ফার্স্ট সার্ভিকল ভার্টিব্রার সন্ধিস্থলে ছুঁচ ফুটিয়ে।
কল্পনার করালীবাবুর হত্যার সঙ্গে বাস্তবের বিশ্বনাথের খুনের বাহ্যত মিল নেই কোনও। তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, সত্যিই নেই? মোটিভের মোহনায় তো মিলেমিশে গেছেই দুই হত্যাকাণ্ডের কল্পনা আর বাস্তব।
অর্থমনর্থম!