1 of 2

১.০৭ গণতন্ত্র ও সমাজবিবর্তন

গণতন্ত্র ও সমাজবিবর্তন

এক

সমাজবিবর্তনের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে গত অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে শিক্ষণীয় বস্তু আছে। এ-বিষয়ে পরস্পর বিরোধী নানা তত্ত্ব বা থিওরী এই অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সত্যনির্ধারণে সুবিধা হবে, একথা সন্দেহাতীত।

এই অর্ধশতাব্দীতে পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে নানা পরিবর্তন ঘটেছে! পঞ্চাশ। বৎসর আগের ব্রিটেন বা আমেরিকা বা সুইডেনের সঙ্গে আজকের। ব্রিটেন-আমেরিকা-সুইডেনের পার্থক্য সামান্য নয়। পঞ্চাশ বৎসর আগে আমেরিকায় শ্রমিক আন্দোলনের শক্তি ছিল নগণ্য, আজ মার্কিন শ্রমিকের সাংগঠনিক শক্তি অসামান্য।

শ্রমিক আন্দোলনের সংঘবদ্ধ শক্তিকে গণনার মধ্যে না-নিয়ে যাঁরা মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে বিচার করতে বসেন তাঁরা আজকের মার্কিন সমাজকে চেনেন না। সংঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠছে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ব্রিটেন সুইডেনের দেশব্যাপী সমবায় সংগঠন এই বৃহৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই বিশেষ। অঙ্গ হিসাবে স্বীকৃত। শ্রমিকদের শিক্ষার জন্য বহু বিচিত্র আয়োজনও এই আন্দোলনের আর একটি দিক। সাধারণ মানুষকে দেশের সমস্যা সম্বন্ধে পরিচিত করবার ও সাধারণ মানুষের প্রয়োজন সাধনে সরকারী নীতিকে প্রয়োগ করবার প্রয়াস ক্রমশই এগিয়ে চলেছে।

সামাজিক সাম্য এসব দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একথা এখনও বলা চলে না। বহুক্ষেত্রে অসাম্য প্রকট। মার্কিন দেশে নিগ্রোদের সমস্যা সুবিদিত। আর শ্রমিক-দলের শাসন। সত্ত্বেও ব্রিটেনে সম্পত্তির বণ্টনে অসাম্য প্রবল। কিন্তু এসব দেশে গত অর্ধশতাব্দীতে সামাজিক সাম্যের দিকে অগ্রগতি অনস্বীকার্য। সম্পত্তির বণ্টনে গভীর অসাম্য আছে বটে; কিন্তু সম্পত্তি থেকে আয়লাভের পথ সঙ্কুচিত হয়েছে। পারিবারিক আয় বণ্টনের এক হিসাবে প্রকাশ যে, ব্রিটেনের শতকরা যে পাঁচভাগ পরিবারের আয় সর্বোচ্চ, দেশের মোট পারিবারিক আয়ে তাদের অংশ ছিল ১৯১৩ সালে শতকরা ৪৩ ভাগ, আর ১৯৪৭ সালে শতকরা ২৪ ভাগ। আয়কর বাবদ দেয় অংশ আয় থেকে বিয়োগ না করেই এই হিসাব। [১] অর্ধশতাব্দী আগে ব্রিটেন-আমেরিকায় উচ্চবিত্তদের আয়ের উপর যে-হারে কর ধার্য হতো নিম্ন-মধ্যবিত্তদের আয়ের উপরও প্রায় সেই হারই ধার্য ছিল। আজ ক্রমে সর্বোচ্চ আয়ের উপর করের হার শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ পর্যন্ত পৌচেছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা এবং ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে; বেকার ভাতা এবং অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্রমশ উন্নতি ঘটেছে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের সমস্ত দাবী পূর্ণ না-হলেও দাবী পূরণের পথ ক্রমশই প্রশস্ত হচ্ছে।

জনসাধারণের সংঘবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া এই অগ্রগতি সম্ভব হতো না। কিন্তু ব্রিটেন-আমেরিকা-সুইডেনে গণতন্ত্রের এই অগ্রগতি বিপ্লবের পথে ঘটেনি, বরং সমাজ-ব্যবস্থার ক্রমবিবর্তনের পথেই ঘটেছে। [২]

শাস্ত্রশাসিত ও পরিবর্তন অসহিষ্ণু সমাজে নৃতন চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ক্রমপরিবর্তন সম্ভব হয় না এ-দুয়ের ভিতর বিরোধ ক্রমশ প্রবল। হয়ে উঠে বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। অপরপক্ষে গণতান্ত্রিক সমাজে নূতন চিন্তা ও সমস্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ক্রমাম্বিত সংস্কার ঘটে ফলে পূঞ্জীভূত অসামঞ্জস্যের শোধনের জন্য বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না।

বিপ্লববাদী তর্ক তুলবেন যে, ধনতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে, আর এই ভিত্তির আমূল পরিবর্তন যে-দিন প্রয়োজন হবে সে-দিন কি সংস্কারের পথ পরিত্যাগ করে বিপ্লবের পথ অনিবার্য হবে না। কিন্তু অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যেমন ক্রমপরিবর্তন সম্ভব, সম্পত্তি সম্পর্কিত অধিকারেরও তেমনিই। সম্পত্তির উপর কর, বা সম্পত্তির একাংশে মৃত্যুর পর সরকারী অধিকার প্রবর্তন, আজ সংস্কারপন্থী কার্যক্রমের অঙ্গবিশেষ অথচ উনিশ শতকী দৃষ্টিতে এধরনের কার্যক্রম ব্যক্তিগত সম্পত্তির মৌল অধিকারে অসহ্য হস্তক্ষেপ। সম্পত্তির অধিকার বলতে আমরা বুঝি, ব্যক্তিগত বিচার অনুযায়ী সুচিহ্নিত কোনো সম্পদের নিয়োগ অথবা ব্যবহারের অধিকার। এই অধিকারকে অন্যান্য বহু অধিকারের মতোই সামাজিক নানা শর্ত ও দায়িত্ব দিয়ে বেষ্টন করা যায়। প্রয়োজন। অনুযায়ী ব্যক্তির অধিকারকে খর্ব করে সমাজের অধিকারকে সম্পত্তির পরিচালনায় প্রতিষ্ঠিত করা সংস্কারপন্থিতার বিরোধী নয়। শিল্প থেকে অংশীদারদের লভ্য আয় সীমায়িত করে দেওয়া কোনো সংস্কারবাদী সরকার নিজের অধিকারবহির্ভূত মনে করেন না; বিশেষ কোনো শিল্প নিজের হাতে তুলে নিয়ে সরকার পূর্বতন অংশীদারদের একটা বার্ষিক বরাদ্দের ব্যবস্থা করে দিলে, অবস্থার কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে না আর বর্তমান অংশীদারদের মৃত্যুর পর এই বার্ষিক বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া, অথবা মৃত্যুকালীন শুল্ক হিসাবে সম্পত্তির একটা বড় অংশ সরকারী তহবিলে হস্তান্তরিত করা, কিছু বৈপ্লবিক ব্যাপার নয়। সমাজ বিবর্তনের ধারায় বৈপ্লবিক পদ্ধতি ছাড়াও ধাপে ধাপে ব্যাপক পরিবর্তন সম্ভব।

.

দুই

অপরপক্ষে যে-সব দেশ এক ধাক্কায় আমূল পরিবর্তন আনতে চেয়েছে তাদের বৈপ্লবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এর উদাহরণও অর্ধশতাব্দীতে কম নেই।

অক্টোবর বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯২১ সালের আরম্ভ পর্যন্ত সোভিয়েত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাবার এক বৈপ্লবিক সাধনা চলেছিল। পুঁজিপতিদের সমাজে অর্থনৈতিক কাজকারবার চলে বাজারে লেনদেনের সাহায্যে, টাকার মাধ্যমে। নূতন কম্যুনিস্ট অর্থনীতিতে এসব কিছুই থাকবে না, টাকার ব্যবহার উঠিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক সমিতির তত্ত্বাবধানে মালমশলা ও উৎপাদন-দ্রব্যের গতি নির্ধারিত হবে, এমন একটা ভাবনা বৈপ্লবিক উৎসাহের সঙ্গে কার্যে পরিণত করবার প্রয়াস চলছিল। কিন্তু এ ব্যবস্থা চালানো সম্ভব হলো না। তৎকালীন অর্থনৈতিক দুর্গতি অংশত গৃহযুদ্ধের অনিবার্য ফল, আর অংশত এই বৈপ্লবিক অসাধ্যসাধনের ব্যর্থ প্রয়াসের পরিণতি। অল্পকালের ভিতর মোট উৎপন্নের পরিমাণ ভয়ঙ্করভাবে কমে গেল। সেই সঙ্গে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের আবিভাব, যাতে নাকি পঞ্চাশ লক্ষেরও অধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। দেশময় সাধারণ মানুষের বিরোধিতার ফলে এই বৈপ্লবিক সাম্যবাদী ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে হলো। [৩]

১৯২১ সালে নূতন অর্থনৈতিক নীতি গৃহীত হলো। টাকার প্রচলন, বাজারে লেনদেন, কাজকারবারের পরিচালনায় কারবারী হিসাব-নিকাশ ইত্যাদির প্রবর্তনের ফলে সোভিয়েত অর্থনৈতিক পুনরভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো। বৈপ্লবিক কল্পনাবিলাস পরিহার করে আজ হয়তো স্বীকার করা সহজ যে, বিভিন্ন দেশে টাকার প্রবর্তন এবং বাজারে লেনদেনের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে শুধু কয়েকজন পুঁজিপুতির স্বার্থে নয়। বরং সমাজের প্রয়োজনে, অর্থাৎ, সামাজিক সম্পদের বিনিয়োগে হিসাব রেখে ও কার্যের সঙ্গে সরঞ্জামের সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলবার প্রয়োজনে। বাজারে কোনো দ্রব্যের মূল্য। কখনও ন্যায্যতার সীমা ছাড়িয়ে যায় কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য হলেও কোনো জটিল সমাজে লেনদেনের যন্ত্র হিসাবে বাজারের উপযোগিতা সাধারণভাবে স্বীকার্য। সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা বা শিল্পের জাতীয়করণের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রয়োজন লুপ্ত হয় না। সোভিয়েত দেশে অবশ্য স্ট্যালিনী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার যুগে টাকার ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও দ্রব্যমূল্য ও উৎপাদন পরিকল্পনা বাজারের মাধ্যমে, অর্থাৎ, চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে, নির্ণয় করবার ব্যবস্থা অব্যাহত থাকেনি। কিন্তু পোল্যাণ্ড, যুগোশ্লাভিয়া ইত্যাদি দেশে আজ শিল্পের জাতীয়করণ সত্ত্বেও বাজারের ভিত্তিতে। অর্থনীতি চালু করবার ব্যবস্থা বহুদূর অগ্রসর; এবং সোভিয়েত দেশেও ভবিষ্যতে সেদিকে ঝোঁক দেখা দেওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। [৪]

বাজারের অর্থনীতি থেকে একটি মূল শিক্ষা গ্রহণীয়। সামাজিক বিবর্তনের ধারায় বহু শতাব্দীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে যে-প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে ওঠে, নূতন যুগে, অর্থাৎ পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, তাদের ত্রুটি চোখে পড়ে। যেসব প্রয়োজন ঐ প্রতিষ্ঠানগুলি তখনও বিনা আড়ম্বরে সিদ্ধ করে চলে সাময়িকভাবে সেসব প্রয়োজন থেকে দৃষ্টি ভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। যেদিকে ত্রুটি সে দিকটাই হয়তো সমগ্র চেতনাকে অধিকার করে বসে। এ অবস্থায় মাত্রাজ্ঞান বজায় রেখে প্রতিষ্ঠানগুলির প্রয়োজনীয় পরিবর্তনই সংস্কারপন্থিতা। রক্ষণশীলতা এখানে নিরর্থক, কারণ পরিবর্তন আবশ্যক ও অবশ্যম্ভাবী। বিপ্লববাদও প্রায়শ নিরর্থক; কারণ অহেতুক ক্ষয়ের পথে, নানা আতিশয্য অতিক্রম করে বিপ্লবী প্রয়াসও সেখানেই ফিরে আসে–সার্থক সংস্কারপন্থিতার ঝোঁক যেদিকে।

সোভিয়েত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উল্লেখ করে কেউ হয়তো বলবেন যে, আতিশয্য অতিক্রম করেও ঐ ব্যবস্থা যেখানে পৌঁচেছে, বা পৌঁছবার চেষ্টা করছে, তার সঙ্গে সংস্কারপন্থী সমাজবাদীদের সাধনার মৌলিক প্রভেদ আছে। সোভিয়েত দেশে কৃষির ক্ষেত্রে যৌথ চাষপ্রথা ও শিল্পের ক্ষেত্রে সামগ্রিক জাতীয়করণ পাশ্চাত্ত্য সমাজবাদীদের কার্যক্রমে স্থান পায়নি।

কিন্তু সোভিয়েত যৌথ চাষপ্রথা এবং শিল্পের সামগ্রিক জাতীয়করণ সমাজবাদী আদর্শের দিক থেকে প্রয়োজন অথবা বাঞ্ছনীয় কি না, এটাও বিচার্য। পূর্ব ইয়োরোপের যে-দেশেই যৌথ খামার থেকে চাষীদের বেরিয়ে আসবার অধিকার দেওয়া হয়েছে সেখানেই চাষীরা দলে দলে বেরিয়ে এসেছে। কম্যুনিস্ট যৌথ চাষপ্রথা শুধু-যে জোরজুলুমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তাই নয়, বাধ্যতার ভিত্তিতেই সাধারণত এ-ব্যবস্থা চালু রাখা যায়। বাধ্যতামূলক যৌথ চাষপ্রথায় উৎপাদনবৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছে একথাও আজ যুগোশ্লাভিয়া, পোল্যাণ্ড ইত্যাদি দেশের কম্যুনিস্ট নেতারা খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করছেন। চাষের ক্ষেত্রে সমবায় প্রতিষ্ঠানের স্থান আছে নিঃসন্দেহে; কিন্তু সমবায় প্রতিষ্ঠান ও পারিবারিক চাষের যে-সমন্বয়ের কথা যুগোশ্লাভিয়ার নেতা টিটো কিছুদিন আগে বলেছেন সেই বাঞ্ছিত সমন্বয়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ মিলবে সোভিয়েত দেশে নয়, বরং সংস্কারপন্থী হল্যাণ্ড-ডেনমার্ক।

শিল্পের ক্ষেত্রেও অনেকটা অনুরূপ কথাই বলা চলে। স্ট্যালিনী ব্যবস্থায় শিল্প-পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়করণ অতিরিক্তভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, একথা অনেকেই আজ স্বীকার করছেন! এ-প্রসঙ্গে পূর্ব ইয়োরোপের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ভিতর থেকে যে নৃতন চিন্তাধারা সরকারী দমনরীতি সত্ত্বেও আশান্বিতভাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। এই নূতন চিন্তাধারার প্রধান প্রস্তাব এই যে মূল শিল্পগুলিতে রাষ্ট্রের অব্যাহত কর্তৃত্ব থাকবে কৃষির ক্ষেত্রে যৌথ চাষপ্রথার অবসান ঘটবে; ছোট শিল্পে ব্যক্তিগত পরিচালনা গ্রাহ্য হবে; শিল্পের পরিচালনায় শ্রমিকদের, এবং রাষ্ট্রের উপর জনসাধারণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে; আর দেশময় চিন্তার দ্বন্দ্ব এবং স্বাধীনতা স্বীকৃত হবে। রাষ্ট্রীয় পরিচালনার সাধারণ কাঠামোর ভিতর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সমবায় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের ভিত্তিতে ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে নৃতন সমাজব্যবস্থা গঠনের এই আদর্শ আজ কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ভিতর যতই মৌলিক সমর্থন লাভ করবে ততই এই আন্দোলনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক ও সংস্কারপন্থী সাম্যবাদীদের সহযোগিতা ও ঐক্যের ভিত্তি প্রশস্ত হবে। পাশ্চাত্ত্য সাম্যবাদী ও পূর্ব ইয়োরোপের কম্যুনিস্ট আন্দোলন বিভিন্ন পথে হয়তো অনুরূপ আদর্শের দিকেই ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে।

.

তিন

ঘটনার পর প্রায় যে-কোনো ঐতিহাসিক তত্ত্বের সঙ্গেই উক্ত ঘটনার সামঞ্জস্য দেখানো কৌশলী তত্ত্বজ্ঞের পক্ষে কঠিন নয়। কিন্তু ঘটনার পূর্বে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তত্ত্বজ্ঞের যে-প্রত্যাশা তার সঙ্গে পরবর্তী তথ্যের তুলনাতেই ঐতিহাসিক তত্ত্বের যথার্থ পরীক্ষা; এবং এই পরীক্ষায় যদি কোনো অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে তা হলে তদনুযায়ী আদিতত্ত্বের সংশোধন বিবেচক বুদ্ধিজীবী সত্যান্বেষীর কর্তব্য।

ধনতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সম্ভাবনামাত্র নেই, মার্ক্সের আদি চিন্তায় এই ধারণা একটি মৌলিক সিদ্ধান্ত স্বরূপ। গণতন্ত্রের অভাবে সাম্যবাদী আন্দোলন বিপ্লবমুখী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ধনতন্ত্রের যে-যুগে মার্ক্সীয় বিশ্বদর্শনের উৎপত্তি, সে-যুগ, অন্তত মার্ক্সের জন্মভূমিতে, গণতন্ত্রের যুগ নয়। মার্ক্সের চিন্তায় বিপ্লববাদের প্রতিষ্ঠা তাই তৎকালীন সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আশ্চর্য নয়।

কিন্তু তত্ত্বকে পিছনে ফেলেই জীবন এগিয়ে চলে। মার্ক্সের যৌবনের ইয়োরোপের সঙ্গে তাঁর বার্ধক্যের ইয়োরোপের পার্থক্য বিস্তর। আর এই প্রভেদের মূলে আছে। তৎকালীন পশ্চিম ইয়োরোপীয় সমাজে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার বিস্তার।

১৮৪৮ সালের বিখ্যাত ইস্তাহারে মার্ক্স লিখেছিলেন।

“The Communists disdain to conceal their views and aims. They openly declare that their ends can be attained only by the forcible overthrow of all existing social relations.”

অর্থাৎ, কম্যুনিস্ট আন্দোলনের লক্ষ্য সিদ্ধ হতে পারে একমাত্র হিংসাত্মক বিপ্লবের পথে এবং প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার সামগ্রিক উচ্ছেদের ফলে। অথচ ১৮৭২ সালে আমস্টারডামে এক বক্তৃতায় মার্ক্সকে বলতে হলো।

“We must take account of the institutions, customs and traditions of various countries, such as the United States and Great Britain and if I knew your institutions better I should perhaps add Holland where the workers will be able to achieve their aims by peaceful means. But this will not be the case in all countries.”

অর্থাৎ, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, আমেরিকায় শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণ পথেই তাঁদের লক্ষ্যে পৌঁছতে। পারবেন। আরও প্রায় বিশ বৎসর পর এঙ্গেলস্ লিখেছিলেন

“With (the) successful utilisation of universal suffrage, an entirely new method of proletarian struggle came into operation.” (The Class Struggles in France, 1848-50, ভূমিকা)।

অর্থাৎ, গণভোটের প্রবর্তনের ফলে সর্বহারা মজুর শ্রেণীর সংগ্রামের একটি সম্পূর্ণ নূতন পথ খুলে গেছে।

উনিশ শতকের শেষভাগে শুধু গণভোটের অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয়নি; এ-যুগেই ইয়োরোপীয় শ্রমিক আন্দোলন সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকে শৈশব অতিক্রম করে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে বলা চলে। পরবর্তী যুগের ক্রমবর্ধমান সমাজ-সংস্কারের দিকনিদের্শও পাওয়া যায় প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বেই। উদাহরণত, ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯১৩ সালের ভিতর জামানী ও ব্রিটেনে সামাজিক বীমা বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রবর্তনে রাষ্ট্রের তৎপরতা লক্ষণীয়।

গত অর্ধশতাব্দীতে সংস্কারপন্থী আন্দোলন পশ্চিম ইয়োরোপে যে-আকৃতি ধারণ করেছে উনিশ শতকের শেষভাগে বা বর্তমান শতকের গোড়াতেই তার মূল লক্ষণগুলি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে-সাংগঠনিক শক্তির ফলে এই আন্দোলন তার লক্ষ্যের দিকে এগুতে পেরেছে তার ভিত্তিও এ-যুগেই স্থাপিত হয়েছে। একথা কখনও কখনও শোনা যায় যে, পাশ্চাত্ত্য দেশগুলিতে আধুনিক সংস্কারপন্থী প্রগতি সম্ভব হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায়। কিন্তু। সংস্কারপন্থিতার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক ক্ষীণ, বহুক্ষেত্রে কাল্পনিক। আমেরিকায় অর্থনৈতিক সংস্কারের স্মরণীয় যুগ রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের শাসনকাল। রুজভেল্টের আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদী বলা চলে না। নরওয়ে-সুইডেন-নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সংস্কারপন্থী নীতি উল্লেখযোগ্য; এসব দেশে সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুপস্থিত। এমন কি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও সমাজ সংস্কারে বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী এটলীর নেতৃত্বে, অর্থাৎ, সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের যুগে নয়, বরং সংকোচনের যুগে। আমেরিকা-ব্রিটেন-নরওয়ে-সুইডেন-নিউজিল্যাণ্ড-অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি সকল দেশেই সংস্কারপন্থী নীতির মূলে যদি কোনো একটি শক্তি কার্যকরী হয়ে থাকে তবে তা ক্রমবর্ধমান। গণতান্ত্রিক আন্দোলন।

গণতান্ত্রিক পথে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে স্বীকার করে সংস্কারপন্থী একটি নতুন যুগের আবিভাবকেই মার্ক্স পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছিলেন। তবু একথা বললে সম্ভবত ভুলই করা হবে যে, মার্ক্স জীবনের শেষ অধ্যায়ে বিপ্লববাদ ত্যাগ করেছিলেন। মার্ক্সীয় দ্বান্দ্বিক দর্শনের সঙ্গে বিপ্লববাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। যে-নূতন যুগের আবির্ভাব মার্ক্সের শেষবয়সের উক্তিবিশেষে প্রচ্ছন্ন সেই যুগের বৈশিষ্ট্য তাঁর চেতনাকে স্পর্শ করলেও দর্শনচিন্তার ভিত্তিতে স্থান পায়নি। মার্ক্সীয় দর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্বের ভিত্তি ধনতন্ত্রের আদিপর্বের বিশেষ অভিজ্ঞতা দ্বারা সীমায়িত। মজুরশ্রেণীর জীবনযাত্রার মানের ক্রম অবনতি, বিপ্লবের অবশ্যম্ভাবিতা, ধনতন্ত্রের আশু বিনাশ ইত্যাদি মার্ক্সীয় ভবিষ্যদ্বাণী ধনতন্ত্রের প্রথম যুগের পরিপ্রেক্ষিতেই বোধগম্য। একই কারণে হিংসাত্মক বিপ্লবের নানা বিচিত্র প্রস্তাব ও পরিকল্পনা মার্ক্সীয় দর্শনের ভূমি থেকে বার বার উদ্ভূত হয়েছে। এবং এই সব প্রস্তাবের তুলনায় “শোধনবাদীদের বক্তব্য মার্ক্সবাদের মূলভাবের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে। অপেক্ষাকৃত উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে এই জাতীয় বৈপ্লবিক প্রত্যাশা অবশ্য বার বারই ব্যর্থ হয়েছে এবং মার্ক্সবাদীদের যুক্তিচাতুর্য নিয়োগ করতে হয়েছে বিরোধী ঘটনার সঙ্গে থিওরীর সামঞ্জস্য প্রদর্শনের ব চেষ্টায়।

শুধু পাশ্চাত্ত্য ধনতান্ত্রিক দেশগুলির ক্ষেত্রে মার্ক্সীয় প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়নি; বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ব্যবস্থার বিবর্তনের সঙ্গেও মার্ক্সীয় প্রত্যাশার সঙ্গতি নেই। সোভিয়েত ব্যবস্থার যে স্বৈরাচারী অধঃপতন আজ ক্রুশ্চেভের প্রচারগুণে কম্যুনিস্ট মহলেও স্বীকৃত সে-অধঃপতন কি মার্ক্সবাদীরা আশা করেছিলেন? ধনতন্ত্র সম্বন্ধে “বুর্জোয়া” থিওরীর অলস প্রত্যয় যেমন ঘটনাদ্বারা খণ্ডিত হয়েছে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্বন্ধেও মার্ক্সবাদী প্রত্যাশা কি তেমনই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়নি। এ বিষয়েও তত্ত্বের সঙ্গে তথ্যের অসামঞ্জস্য চিন্তনীয়, এবং আদি তত্ত্বের সংশোধন প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে মার্ক্সীয় তত্ত্বের একটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। মার্ক্সীয় চিন্তায় শ্রেণীর সংজ্ঞা সম্পত্তির মালিকানা দ্বারা নির্ধারিত : সম্পত্তিবানের সঙ্গে সম্পত্তিহীনের সংগ্রামই শ্রেণী সংগ্রাম। অপরপক্ষে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনসাধারণের সঙ্গে আমলাতন্ত্র (bureaucracy) অথবা অত্যাচারপরায়ণ অন্য কোনো গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব শ্রেণীসংগ্রামের পযায়ভুক্ত নয়, কারণ আমলাগগোষ্ঠীর ক্ষমতা মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এখানে কয়েকটি কথা ভেবে দেখবার আছে। আগেই বলা হয়েছে যে, মালিকানা বলতে সম্পত্তি সংক্রান্ত কতকগুলি অধিকারের সমষ্টি বোঝায়, এবং এই অধিকারগুলি প্রয়োজনমতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মাধ্যমে সঙ্কুচিত করা যায় বা নানা শর্ত দ্বারা বেষ্টিত করা যায়। আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাও শাসন সংক্রান্ত কতকগুলি বিশেষ অধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমলাতন্ত্র যেখানে জনসাধারণের উপর অত্যাচারের একটি যন্ত্রবিশেষে পরিণত হয়েছে সেখানে প্রয়োজন জনসাধারণের স্বার্থে আমলাগোষ্ঠীর বিশেষ অধিকারগুলিকে গণস্বার্থরক্ষী শর্ত দ্বারা কার্যকরীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার লোপ পেলে আমলাতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার আর কোনো বাস্তব” ভিত্তি থাকে না, সোভিয়েত দেশের অভিজ্ঞতার পর এ-ধরনের অলীক থিওরীতে বিশ্বাস স্থাপন করতে আশা করি অনেকেই আজ ইতস্তত করবেন। যে-কথাটা এখনও পরিষ্কারভাবে বলা প্রয়োজন তা হলো এই যে, সম্পত্তির অধিকার নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে আমলাগোষ্ঠীর বিশেষ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা সহজসাধ্য এমন কোনো সাধারণ তত্ত্বও গ্রহণযোগ্য নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে দুই-ই সাধ্যায়ত্ত এবং শান্তিপূর্ণ সংস্কারের পথে সাধনীয় যে-সমাজে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও সংগঠন দুর্বল, সেখানে দুই-ই দুঃসাধ্য এবং বিপ্লবের আশঙ্কা বাস্তব।

চীনদেশের কম্যুনিস্ট নেতা মাও সে-তুং-এর একটি সাম্প্রতিক বিবৃতি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মাও বলেছেন যে, সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব (contradictions) থেকে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক কোনো ব্যবস্থাই মুক্ত নয় তবে ধনতান্ত্রিক সমাজের। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বৈরিতামূলক (antagonistic)–অর্থাৎ ধনতন্ত্রের বিলোপ ছাড়া এই দ্বন্দ্বের অবসান নেই–আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বৈরিতাহীন (non-antagonistic)–অর্থাৎ, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামোর ভিতরই শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাদ-প্রতিবাদের সমন্বয় সাধন সম্ভব, যদি-না প্রতিপক্ষ প্রতি-বিপ্লবী’ হন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের উদাহরণ হিসাবে মাও গণতন্ত্রের সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রিকতার (centralism) এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারী আমলাগোষ্ঠীর বিরোধিতার উল্লেখ করেন। মার্ক্স বলেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ইতিহাসে বৈরিতাভিত্তিক উৎপাদনপ্রথার অন্তিম পর্যায়।  [৫] অথচ সোভিয়েত ও অন্যান্য কম্যুনিস্টদেশে নেতৃস্থানীয়দের ভিতরে বৈরভাব এবং আমলাতন্ত্রের সঙ্গে জনগণের বিরোধ সন্দেহাতীতভাবে প্রকট। মার্ক্সীয় আদি তত্ত্বের সঙ্গে এইসব তথ্যের সামঞ্জস্য প্রদর্শনের চেষ্টা মাও সে-তুং-এর বিবৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। [৬]

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে, বা পূর্ববর্তী কোনো সমাজব্যবস্থায় অনুরূপ দ্বন্দ্ব ছিল, একথা তথ্য হিসাবে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা সম্ভব; কিন্তু ইতিহাসে ধনতন্ত্রই অন্তর্বিরোধসম্পন্ন সমাজব্যবস্থার শেষ উদাহরণ, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বা ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো তথ্যগত বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, থাকা সম্ভবও নয়। এক প্রকার শূন্যগর্ভ বাক্যের মারপ্যাঁচে মার্ক্সীয়তার্কিক এই বাঞ্ছিত সিদ্ধান্তে উপনীত হন এবং একে “বিজ্ঞানসম্মত বলে। ঘোষণা করন। কিন্তু এ ধরনের চিন্তায় ভবিষ্যৎ সমাজের গঠন ও সমস্যা সম্বন্ধে জ্ঞান বাড়ে না, মোহই বাড়ে। অতীতের মতো ভবিষ্যৎ সমাজেও অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং পরিবর্তন দুই-ই থাকবে। সমাজতন্ত্র বলতে যদি আমরা কোনো রূপরেখাহীন নিরাকার আদর্শ না বুঝে বাস্তব একটি সমাজব্যবস্থাই বুঝি ভরে এই নুতন সমাজব্যবস্থাও একদিন পরিবর্তনের স্রোতে অন্তর্হিত হবে। কি ধনতান্ত্রিক কি সমাজতান্ত্রিক-কোনো সমাজব্যবস্থাতেই গণতন্ত্রের অভাবে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করা যায় না। “সাম্যবাদী” সমাজে নেতৃস্থানীয়দের অন্তর্দ্বন্দ্ব, অথবা জনসাধারণের সঙ্গে আমলাগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব, গণতন্ত্রের অভাবে “বৈরিতামূলক” আকার ধারণ করাই স্বাভাবিক। ১৯৫৬ সালে “সমাজতান্ত্রিক” হাঙ্গেরীতে জনসাধারণ ও শাসকগোষ্ঠীর ভিতর দ্বন্দ্ব হিংসাত্মক আকার ধারণ করবার প্রধান কারণ এই যে, গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পথ সেখানে খোলা ছিল না–আজও নেই। অন্যান্য কম্যুনিস্ট দেশ সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য।

সমাজতান্ত্রিক দেশেও গণতন্ত্রের প্রয়োজন আছে, অর্থাৎ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনমত প্রকাশ ও সংগঠনের শান্তিপূর্ণ অধিকার প্রয়োজন; এবং এই অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও অত্যাচারের যন্ত্রে পরিণত হয়। বর্তমান ইতিহাসের এই সাক্ষ্য।

প্রগতির পথ (১৯৬৮)

.

উল্লেখপঞ্জী

১। Simon Kuznets “Economic Growth and Income Inequality”, American
২। Economic Review, March, 1955. ২। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কাঠামোর ভিতর গণতন্ত্র অসম্ভব একথা আধা সত্য মাত্র।
৩ ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না; কিন্তু ধনতান্ত্রিক সমাজের ভিতর থেকেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হওয়া সম্ভব এবং ধনতন্ত্রের ক্রমাম্বিত সংস্কারের ভিতর দিয়ে এই আন্দোলন ধাপে ধাপে পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হতে পারে।
৩। প্রত্যাহারের পর লেনিন ইত্যাদিরা অবশ্য বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, এ-অবস্থা ওঁরা বৈপ্লবিক নীতির দিক দিয়ে গ্রহণ করেননি, গৃহযুদ্ধের অবস্থার বিপাকে সাময়িকভাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মাত্র। অথচ গৃহযুদ্ধ যখন প্রায় অবসিত সেই অবস্থাতেও এই ব্যবস্থাকে আরও ব্যাপক করবার উদ্দেশ্যে অন্ততঃ দুটি নূতন ডিক্রী জারি করা হয়েছিল; আর যতদিন গৃহযুদ্ধ চলছিল ততদিন বহু কম্যুনিস্ট নেতার বিবৃতিতে এ-কথাই বারবার শোনা গেছে যে, এই ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে কম্যুনিস্ট বৈপ্লবিক আদর্শ দিনে দিনে মূর্তিমান হয়ে উঠছে! এবিষয়ে পোলানীর “The Logic of Liberty’ পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত আলোচনা অবশ্যপাঠ্য।
৪। এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। এর বক্তব্যের সঙ্গে পরবর্তী অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখার জন্য এই তারিখটি স্মরণ রাখা প্রয়োজন।!
৫ “The bourgeois relations of production are the last antagonistic form of the social process of production (Critique of Political Economy).
৬। এই প্রবন্ধ যখন লিখিত হয় তখনও চীনের বর্তমান নেতাদের “বৈরবিহীন” দ্বন্দ্ব রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *