১.০৬-১০ পুলিস এলো

১.০৬

পুলিস এলো একমাস পরে অপ্রত্যাশিতভাবে। দুপুর রাত, নিকোলাই, এণ্ড্রি, পেভেল গল্প করছে…মা অর্ধ-নিদ্রিতা।

এণ্ড্রি, কি কাজে রান্নাঘরে গিয়েই হঠাৎ ফিরে এলো ব্যতিব্যস্ত হয়ে, পুলিসের সাড়া পাচ্ছি।

মা বিছানা থেকে উঠে পড়লেন কাঁপতে কাঁপতে। পেভেল মাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, শুয়ে থাকে, মা, তুমি অসুস্থ।

স্থানীয় চৌকিদার ফেদিয়াকিনকে সঙ্গে করে পুলিসের এক কর্তা এসে ঢুকলেন। মাকে দেখিয়ে পেছেলের দিকে চেয়ে ফেদিয়াকিন বললো, এই হুজুর ওর মা—আর ঐ হ’ল পেভেল।

কর্তা গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলেন, তুমি পেভেল ভ্লাশভ?

হাঁ।

তোমার বাড়ি খানাতল্লাশ করব। এই বুড়ি, ওঠ…

হঠাৎ কি একটা শব্দে সন্দিগ্ধ হয়ে কর্তা পাশের ঘরে ছুটে গিয়ে চীৎকার করে বললেন, কে তুমি? নাম কি তোমার?…

তারপর খানাতল্লাশী চললো…জিনিসপত্রগুলো তছনছ করে…বইগুলো খুশিমত এদিক-ওদিক ছুঁড়ে ফেলে। এ অন্যায় অত্যাচার আর সইতে না পেরে নিকোলাই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো, বইগুলো মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলার কি দরকার?

মা নিকোলাহর সাহস দেখে বিস্মিত, তার পরিণাম ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। কর্তা রক্তচোখে নিকোলাইর দিকে চাইতে লাগলেন। মা পেভেলকে বললেন, নিকোলাই চুপ থাকুক না কেন?

কর্তা ধমক দিয়ে বললেন, কি কথা হচ্ছে! চুপ…এ বাইবেল পড়ে কে?

পেভেস বললো, আমি।

এসব বই কার?

আমার।

কর্তা তখন নিকোলাইর দিকে ফিরে বললেন, তুমিই বুঝি এণ্ড্রি?

হাঁ।

পরক্ষণেই এণ্ড্রি তাকে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে এসে বললো, ও নয়, আমি এণ্ড্রি।

কর্তা নিকোলাইর দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, হুঁশিয়ার! তারপর পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে ঘেঁটে এণ্ড্রি কে বললেন, এণ্ড্রি, রাজনৈতিক অপরাধে এর আগেও তোমার খানাতল্লাশ হয়েছিল?

হাঁ, রস্টোভ এবং সারাটোভে। তবে সেখানকার পুলিসেব ভদ্রতা-জ্ঞান ছিল। আমার নামের আগে মিস্টার যোগ দিতে অবহেলা করেনি!

কর্তা ডান চোখ কুঁচকে, রগড়ে, চকচকে সাদা দাঁতগুলি বের করে বললেন, তা মিস্টার এণ্ড্রি, তুমি কি জানো কোন্ বদমাশরা এই বে-আইনী ইস্তাহার আর বই বিলি করে বেড়ায়?

এণ্ড্রি জবাব দিবার আগেই নিকোলাই বলে উঠলো, বদমাশ আমরা প্রথম দেখছি এখানে।

কর্তা হুকুম করলেন, শুয়োরকে নিয়ে যাও এখান থেকে।

দু’জন সৈনিক নিকোলাইকে বের করে নিয়ে গেলো। খানাতল্লাশ শেষ হলে কর্তা বললেন, মিস্টার এণ্ড্রি নাখোদ্‌কা, আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করলুম।

কি অপরাধে?

পরে বলবো। তারপর মার দিকে চেয়ে বললেন, লিখতে পড়তে জানো, বুড়ি?

জবাব দিল পেভেল, না।

কর্তা ধমক দিয়ে বললেন, তোমায় কে জিগ্যেস করেছে! বুড়ি বলবে।

মার মনে, রি-রি করে উঠলো একটা অপরিসীম ঘৃণা। কর্তার মুখের সামনে হাত নাচিয়ে বললেন, চেঁচিওনা, এখনো তুমি বড় হওনি। জানো না, কী দুঃখ, কী বেদনা…

পেভেল বললো, স্থির হও মা!

এণ্ড্রি বললো, বুকের ব্যথা দাঁত দিয়ে চেপে থাকা ছাড়া তো কোনো উপায় নেই, মা।

মা সে কথা কানে তুললেন না, চেঁচিয়ে উঠলেন, কেন তোমরা এমন করে মানুষকে ছিনিয়ে নিয়ে যাও?

কতাও চড়া সুরে জবাব দিলেন, সে জবাব তুমি চাইতে পারোনা। চুপ কর…

মা ক্রুদ্ধা ফণিনীর মতো ফুলতে লাগলেন।

কর্তা তখন হুকুম দিলেন, নিকোলাইকে হাজির কর।

সৈন্যেরা, দু’জনে দু’হাত ধরে নিকোলাহকে নিয়ে এলো। নিকোলাইর মাথায় টুপি…কি একটা দলিল পড়তে পড়তে কর্তার সেটা খেয়াল হল। পড়া বন্ধ করে তিনি গর্জে উঠলেন, টুপি নাবাও…

নিকোলাই একটু রসিকতা করে বললো, আজ্ঞে হুজুর, আমার তো একখানা তৃতীয় হাত নেই যে আপনার হুকুম তামিল করব। দেখছেন, দু’জনে দু’হাত ধরে।

কর্তা একটু অপ্রস্তুত হলেন। তারপর নিকোলাই এবং এণ্ড্রিকে ধরে নিয়ে চলে গেলেন।

পেভেল বন্ধুদের হাসিমুখে বিদায় দিলো, আবেগে বলে উঠলো, আণ্ড্রে, নিকোলে ভাই!

তার কেবলই মনে হতে লাগলো, পুলিস দু’জনকে ধরে তাকে যে ছুঁলোওনা, এ তাকে অপমান করা ছাড়া আর কিছুই না। তাকে কেন এই সঙ্গে ধরে নিয়ে গেলোনা!

মা সান্ত্বনার সুরে বললেন, নেবে বাবা, নেবে—দু’দিন সবুর কর।

পেভেল বললো, সত্যিই নেবে, মা।

মা ব্যথিত হয়ে বললেন, তুই কি নিষ্ঠুর, পেভেল! একবারও যদি প্রবোধ দিস! আমি একটা আশঙ্কার কথা বললে, তুই বলিস তার চাইতেও ভয়ংকর-কিছু।

পেভেল মার দিকে চাইলো, তার কাছটিতে এগিয়ে এলো, তারপর ধীরে ধীরে বললো, আমি যে পারি না, মা, তোমায় মিথ্যে প্রবোধ দিতে পারি না…তোমার যে সব সইতে হবে, সব শিখতে হবে, মা!

.

১.০৭

পরদিন জানা গেলো, বুনি, শ্যামোয়লোভ, শেমোত এবং আরো, পাঁচজন ধরা পড়েছে। ফেদিয়া মেজিন এসে সগর্বে খবর দিয়ে গেলো, তার বাড়িও খানাতল্লাশ হয়েছে, তবে তাকে ধরেনি।

মিনিট কয়েক পরে প্রতিবেশী রাইবিন এলেন। রাইবিন বৃদ্ধ, বহুদশী এবং তথাকথিত ধর্ম-পদ্ধতির ওপর হাড়ে হাড়ে চটা। পেভেলের সঙ্গে অল্পক্ষণের মধ্যেই তার আলাপ জমে উঠলো। বললেন, তোমরা মদ খাওনা, খারাপ কিছু করনা, তাই সবাই তোদর সন্দেহ করে। এই-ই দুনিয়ার হল! কর্তারা বলেন, তোমরা নাস্তিক, গিজায় যাওনা, যদিও আমিও তথৈবচ। তারপর…ঐ বে-আইনী ইস্তাহারগুলি, ওগুলোও তো তোমরা ছড়াও, নয়?

হাঁ।

মা ভয়ে ভয়ে তা ঢাকতে চান। তারা কেবল হাসে।

রাইবিন বলে, বেশ সুচিন্তিত লেখা, লোককে মাতিয়ে তোলে। সবসুদ্ধ বারোটা বেরিয়েছে, নয়?

হাঁ।

সবগুলিই আমি পড়েছি।

তারপর কথা প্রসঙ্গে পেভেল অগ্নিগর্ভ ভাষায় ব্যক্ত করে যেতে লাগলো, ধর্ম, রাজা, রাষ্ট্র-শাসন, কারখানা, দেশ-বিদেশের মজুর জীবন সম্বন্ধে তার অভিমত। রাইবিন হেসে বললেন, তরুণ তুমি, লোকচরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা তোমার খুবই কম।

পেভেল বললো, কে তরুণ, কে বৃদ্ধ, সে কথা ছেড়ে দিন; কার চিন্তার ধারা সত্য, তাই দেখুন।

অর্থাৎ তুমি বলতে চাও, আমরা ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রতারিত হয়েছি, এইতো? তা আমারও মত তাই। আমিও বলি, আমাদের ধর্ম মিথ্যা, ধর্ম আমাদের ক্ষতি করেছে।

মা এই নাস্তিক্যবাদে শিউরে উঠে বলেন, ঈশ্বরের কথা যখন ওঠে একটু সতর্ক হয়ে কথা কয়ো।…যে কাজ তোমরা করছ, তাই তোমাদের জীবনে সান্ত্বনা জোগায়, কিন্তু আমার ঈশ্বর ছাড়া যে কিছুই নেই। তাকে কেড়ে নিলে আমি দুঃখে কষ্টে কার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াব।

পেভেল বললো, তুমি আমাদের কথা বুঝলে না, মা। যে মঙ্গলময় দয়াল ঈশ্বর তোমার উপাস্য, আমি তার কথা বলিনি; আমি বলেছি, সেই ঈশ্বরের কথা, যাকে দিয়ে পুরুতের দল আমাদের শাসিয়ে রাখে, যার দোহাই দিয়ে মুষ্টিমেয়ের অন্যায় ইচ্ছার সম্মুখে আমাদের মাথা নোয়াতে বাধ্য করে।

রাইবিন টেবিল চাপড়ে বলেন, ঠিক বলেছ। ওরা আমাদের ঈশ্বরকে ভেঙে চুরে ওদের কার্যোপযোগী করে নিয়েছে। ওদের হাতে যা-কিছু সব আমাদের বিরুদ্ধে। গির্জায় ঈশ্বরের আমদানি শুধু আমাদের ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখার জন্য এ ঈশ্বরকে বদলে ফেলতে হবে, মা,–

মা ব্যথিত হয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে।

রাইবিন পেভেলকে বলেন, দেখছো, এর আর কোথায়? মাথায় নয়, হৃদয়ে। আর হৃদয় এমন স্থান যে, ও ছাড়া আর কিছু জন্মায় না তাতে।

পেভেল দৃঢ়কণ্ঠে বললো, যুক্তি–একমাত্র যুক্তিই মানুষকে মুক্তি এনে দেবে।

রাইবিন বললেন, কিন্তু যুক্তি তো শক্তি দিতে পারে না–শক্তির একমাত্র উৎস–হৃদয়।

পেভেল রাইবিনে এমনি করে অনেক কথা কাটাকাটি চললো।

শেষটা রাইবিন বললেন, আমাদের কইতে হবে শুধু বর্তমানের কথা…ভবিষ্যতে কি হবে তা আমাদের অজ্ঞাত। মানুষকে মুক্ত করে দাও, তারপর সে নিজেই বেছে নেবে, তার পক্ষে কোটা ভালো। তাদের মগজে ঢের বিদ্যা আমরা ঢুঁসে দিয়েছি, এবার এর অবসান হক,—মানুষকে তার নিজের পথ নিজেকে খুঁজে নিতে দাও। হয়তো তারা চাইবে সমস্ত কিছু বর্জন করতে সমস্ত জীবন, সমস্ত জ্ঞান;–হয়তো তারা দেখবে সকল বন্দোবস্তই তাদের বিরুদ্ধে। তুমি শুধু তাদের হাতে বইগুলি দিয়ে দাও, তারপর নিশ্চিন্ত থাকতে পারো; সব প্রশ্নের উত্তর তারা নিজেরাই দেখে নিতে পারবে। তাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দাও যে, ঘোড়ার লাগাম যত কষানো হয়, তত সে ছোটে কম।

মা ক্রমে ক্রমে এ সব শুনতে অভ্যস্ত হন।

.

১.০৮

পেভেলের বাড়িটা মজুরদের মস্ত বড় একটা ভরসাস্থল হয়ে পড়লো। কোন অবিচার অত্যাচার হলেই মজুররা পেভেলের কাছে বুকি নিতে আসে। পেভেলকে সবাই শ্রদ্ধা করে, বিশেষত সেই ‘কাদামাখা পেনি’র গল্পটা বের হবার পর।

কারখানার পেছনে একটা জলাভূমি ছিল…বুনো গাছে ভর্তি… পচা জল…গরমের দিনে তা পচে দুর্গন্ধ হয়, মশা জন্মায়; ফলে, চারদিকে জ্বরের ধুম লেগে যায়। জায়গাটা অবশ্য কারখানার সম্পত্তি; নতুন ম্যানেজার এসে দেখলেন, জলাটা খুঁড়লে বেশ মোটা টাকার পিট মিলবে, কিন্তু খুড়তে বড় কম খরচ হবে না। অনেক ভেবে তিনি বিনা খরচায় কাজ হাসিল করার একটা চমৎকার মতলব ঠাওরালেন।

পল্লির স্বাস্থ্যরক্ষাকল্পেই যখন জলাটা সাফ করা আবশ্যক তখন পল্লিবাসী মজুররাই ন্যায়ত তার খরচ বহন করতে বাধ্য; অতএব তাদের মজুরি থেকে রুবেলে এক কোপেক করে এই বাবদ কেটে নেওয়া হবে। মজুররা তো একথা শুনেই ক্ষেপে উঠলো, বিশেষ করে যখন দেখলো কর্তার পেয়ারের কেরানীবাবুরা এ ট্যাক্স থেকে রেহাই পেয়েছে।

যেদিন এ হুকুম হয়, পেভেল সেদিন অসুস্থতার দরুণ কারখানায় অনুপস্থিত; কাজেই সে কিছুই জানতে পারলো না। পরদিন শিজভ, এবং মাখোটিন বলে দু’জন মজুর তার কাছে এসে হাজির হ’ল, বললো, সবাই আমাদের তোমার কাছে পাঠিয়ে দিলো এই কথাটা জানতে যে, সত্যিই কি এমন কোনো আইন আছে যাতে ম্যানেজার কারখানার মশা তাড়াবার খরচা মজুরদের কাছ থেকে জুলুম করে নিতে পারে। আছে এমন কোনো আইন? তিন বছরের কথা। সেবারও স্নানাগার তৈরি করার নাম করে জোচ্চোররা এমনিভাবে ট্যাক্স বসিয়ে তিন হাজার আটশো রুবেল ঠকিয়ে নিয়েছিল। কোথায় এখন সে রুবেল, কোথায়-বা সে স্নানাগার!…

পেভেল তাদের বেশ করে বুঝিয়ে দিলো যে, এ আইন নয়, অত্যাচার। এতে শুধু পকেট ভারি হবে কারখানার মালিকের।

মজুর দু’জন মুখ ভারি করে চলে গেলো।

তারা চলে যেতে মা হাসিমুখে বললেন, বুড়োরাও তোর কাছে বুদ্ধি নিতে আসা শুরু করেছে, পেভেল।

পেভেল নিরুত্তরে কাগজ নিয়ে কি লিখতে বসলো। লেখা শেষ হ’লে মাকে বললো, এক্ষুণি শহরে গিয়ে এটা দিয়ে এসো।

বিপদ আছে কিছু? মা প্রশ্ন করলেন।

পেভেল বললো, হাঁ। শহরে আমাদের দলের যে কাগজ ছাপা হয় তার পরবর্তী সংখ্যায় এ ‘কাদা-মাখা পেনি’ গল্পটা বেরোনো চাই।

যাচ্ছি এক্ষুণি, বলে মা গায়ের কাপড়টা ঠিক করে নিলেন। তার যেন আনন্দ আর ধরে না। ছেলে এই প্রথম তাকে বিশ্বাস করে তাঁর ওপর জরুরী একটা কাজের ভার দিয়েছে। ছেলের কাজে তিনি লাগলেন এতদিনে।

শহরে গিয়ে তিনি কার্যসিদ্ধি করে ফিরে এলেন।

তার পরের সোমবার–মাথা ধরেছে বলে পেভেল কারখানায় যায়নি। খেতে বসেছে, এমন সময় ফেদিয়া মেজিন ছুটে এলো রুদ্ধশ্বাসে-তার মুখে উত্তেজনা এবং আনন্দ। বললো, এসো, কারখানা সুদ্ধ মজুর জেগে উঠেছে। তোমাকে ডাকতে পাঠালে তারা। শিজভ, মাখোটিন বলে, তোমার মতো করে আর কেউ বোঝাতে পারবে না। বাব্বা, কী কাণ্ড!

পেভেল নীরবে পোশাক পরতে লাগলো।

মেজিন বলতে লাগলো, মেয়েরা জড়ো হয়ে কী রকম চেঁচাচ্ছে দেখো।

মা বললেন, তুই অসুস্থ, ওরা কি করছে কে জানে। চল, আমিও যাচ্ছি।

পেভেল সংক্ষেপে বললো, চলো।

নীরবে দ্রুতপদে তারা কারখানায় এসে উপস্থিত হ’ল। দুয়ারের কাছে মেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠে আলোচনা চালিয়েছে। তাদের ঠেলে তিনজন কারখানার উঠানের ভেতরে এসে ঢুকলো। চারদিকে উত্তেজিত জনতার চীৎকার এবং আস্ফালন। শিভজ মাখোটিন, ভিয়ালত এবং আরো পাঁচ ছ’জন পাণ্ডা একটা পুরানো লৌহস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে হাত দুলিয়ে জনতাকে উত্তেজিত করছে;– সবার চোখ তাদের দিকে। হঠাৎ কে একজন চেঁচিয়ে উঠলো, পেভেল এসেছে।

পেভেল? নিয়ে এসো।

তৎক্ষণাৎ পেভেলকে ধরে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হল। মা একা পেছনে পড়ে রইলেন।

চারদিকে কেবল শব্দ হতে লাগলো, চুপ, চুপ! অদুরে রাইবিনের গলা শোনা গেলো, আমরা দাঁড়াব কোপকের জন্য নয়–ন্যায়ের জন্য। কোপেকের গায়ে যে অজচ্ছল রক্ত মাখানো, তার জন্য…

জনতার কানে বেশ জোরে গিয়ে এ কথাটা পড়লো—সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠলো উত্তেজনাপূর্ণ চীৎকার, সাবাস রাইবিন, ঠিক বলেছ।

আঃ, চুপ করনা।

পেভেল এসেছে।

সবগুলি কণ্ঠ একত্র মিলে সৃষ্টি হ’ল একটা তুমুল কোলাহল, কলের শব্দ, বাষ্পের ফোসফোসানি, চামড়ার বেল্টের আওয়াজ, সব তাতে ডুবে গেলো। চারদিক থেকে লোক ছুটে আসছে, হাত দোলাচ্ছে, তর্কাতর্কি করছে,তিক্ত তীক্ষ্ণ ভাষায় পরস্পরকে ক্ষেপিয়ে তুলছে। যে বেদনা এতদিন বের হবার কোন পথ পায়নি, শান্ত বুকে চাপা রয়েছে, আজ তা জেগে উঠেছে, বের হতে চাচ্ছে, মুখ থেকে ফেটে পড়ছে বাক্যবাণে। আকাশে উঠছে বিরাট এক পাখীর মতো বিচিত্র পাখা দুলিয়ে, জনতাকে নখে জড়িয়ে টেনে-হিঁচড়ে, পরস্পর ঠোকাঠুকি করে;–রোষ-রক্তিম অগ্নিশিখার মতো জীবন নিয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে। জনতার মাথার উপর ধুলি এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলী সবার মুখে আগুন জ্বলছে, গাল বেয়ে পড়ছে ঘাম, কালো কালো ফোটায়–কালো মুখের মধ্য দিয়ে চোখ জ্বলছে, দাঁত চকচক করছে।

শিজভ, মাখোটিন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে উঠে দাঁড়ালো পেভেল, তার কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হ’ল, কমরেড :

কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে পেভেলের মধ্যে জাগলো একটা অদম্য আত্মপ্রত্যয়, সংগ্রামেচ্ছা, জনতার কাছে হৃদয় খুলে ধরার আগ্রহ।

‘কমরেড’—কথাটা তাকে আনন্দে, শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে তুললো। ‘আমরা মজুররা গির্জা এবং কারখানা গড়ে তুলি, শৃঙ্খল বানাই, মুদ্রা তৈরি করি, পুতুল গড়ি, কলকব্জা নির্মাণ করি…আমরা সেই জীবন্ত শক্তি, যা আদি থেকে অস্ত পর্যন্ত দুনিয়াকে বাঁচিয়ে রাখে—আহার এবং আনন্দ জুগিয়ে। সর্বকালে, সর্বস্থানে, কাজ করার বেলায় আমরাই সবার প্রথমে কিন্তু জীবনের অধিকারে সেই আমরাই সর্বপশ্চাতে। কে কেয়ার করে আমাদের? কে আমাদের ভালো করতে চায়? কে আমাদের মানুষ বলে স্বীকার করে?—কেউ না।

জনতাও প্রতিধ্বনি করে উঠলো, কেউ না।

শান্ত, সংযত, গম্ভীর, সরল ভাষায় পেভেল বক্তৃতা দিতে লাগলো। জনতা ধীরে ধীরে তার কাছে ঘিষে এক কালো ঘন সহস্র-শির বপুর মতো হয়ে দাঁড়ালো, তাদের শত শত উৎসুক চোখ পেভেলের দিকে নিবদ্ধ। পেভেলের কথাগুলো যেন তারা নির্বাক আগ্রহে গিলছে। পেভেল বলতে লাগলো, শ্রেষ্ঠতর জীবন আমরা কিছুতেই লাভ করতে পারব না ততদিন—যতদিন না আমরা উপলব্ধি করি, আমরা কমরেড, আমরা বন্ধু, এক অভিন্ন সংকল্পে পরস্পরে বাঁধা—সে সংকল্প কি জানো?—আমাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম।

মার কাছ থেকে কে একজন বলে উঠলো, কাজের কথা বলো।

অমনি সঙ্গে সঙ্গে রব হ’ল, গোলমাল করো না, চুপ কর।

একজন মন্তব্য করলো, সোশিয়ালিস্ট, কিন্তু বোকা নয়।

আর একজন বললো, বেশ জোর গলায় বলছে কিন্তু।

তারপর আবার পেভেলের গলা,–বন্ধুগণ, আজ দিন এসেছে, আমাদের শ্রমভোজী ঐ যে লোভী লক্ষপতির দল, ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে, আমাদের আত্মরক্ষা করতে হবে, বুঝতে হবে, আমাদের রক্ষা করতে পারব একমাত্র আমরা, অপর কেউ নয়। শত্রুকে যদি ধ্বংস করতে হয় তবে একমাত্র নীতি গ্রহণ করতে হবে আমাদের প্রত্যেকের জন্য সকলে, সকলের জন্য প্রত্যেকে।

মাখোটিন চীৎকার করে উঠলো, সাচ্চা কথা বলছে। শোন ভাইসব, সত্য কথা শোনো।

পেভেল বললো, এক্ষুণি ম্যানেজারকে ডাকবো আমরা, ডেকে জিগ্যেস করব।

পলকে যেন ঘুর্ণিবাত্যায় আহত হয়ে জনতা দুলে উঠলো, অজস্র কণ্ঠে চীৎকার হ’ল, ম্যনেজার! ম্যানেজার! সে এসে জবাব দিক।

প্রতিনিধি পাঠাও।…তাকে এখানে হাজির কর।

বহু বাদ-বিতর্কের পর প্রতিনিধি নির্বাচিত হ’ল শিজভ, রাইবিন এবং পেভেল। তারা যাত্রা করবে, হঠাৎ জনতার মধ্যে জেগে উঠলো একটা অনুচ্চ ধ্বনি, ম্যানেজার নিজেই আসছে।

জনতা দুফাঁক হয়ে পথ করে দিলো, তার মধ্য দিয়ে ম্যানেজার ঢুকলেন। হাত ঈষৎ দুলিয়ে, লোক সরিয়ে পথ করে নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু কাউকে স্পর্শ করছেন না। লম্বা-চওড়া শরীর, কুঞ্চিত চোখ, শাসনকর্তাসুলভ তীক্ষ্ণ-সন্ধানী দৃষ্টি বিস্তার করে তিনি মজুরদের মুখ দেখে নিচ্ছেন। মজুররা সসম্ভ্রমে টুপি খুলে হাতে নিচ্ছে, তিনি তাদের অভিবাদন যেন অগ্রাহ্য করে চলে যাচ্ছেন। তার উপস্থিতিতে জনতা চুপ করে গেলো, ঘাবড়ে গেলো। সবার মুখে উদ্বেগের হাসি, কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি,–শিশু যেন তার ছেলেমির জন্য অনুতপ্ত। ম্যানেজার সেই লৌহস্তূপের ওপর পেভেল, শিজভের সামনে দাঁড়িয়ে নিস্তব্ধ জনতার দিকে চেয়ে বললেন, এসব হল্লার মানে কি? কাজ ফেলে এসেছ কেন?

সব চুপ-চাপ। কয়েক সেকেণ্ড গেলো, কোন জবাব নেই। শিজভ, মাথা নীচু করে দাঁড়ালো।

ম্যানেজার বললে, যা জিগ্যেস করছি তার জবাব দাও।

পেভেল তার সামনে এগিয়ে গিয়ে শিজভ, রাইবিনকে দেখিয়ে বললো, আমরা এই তিন জন শ্রমিক-বন্ধুদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছি, আপনাকে সেই কোপেক-ট্যাক্সটা রদ করতে বলার জন্য।

কেন? পেভেলের দিকে না চেয়ে ম্যানেজার প্রশ্ন করলো।

পেভেল বেশ জোরের সঙ্গেই বললো, এরকম ট্যাক্স আমরা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করিনা।

ওঃ, তাহলে আমার জল সাফ করবার প্রস্তাবটায় তুমি দেখতে পাচ্ছ শুধুই মজুরদের শোষণ করবার ফন্দি, তাদের মঙ্গলেচ্ছা নয়। এই তো?

হাঁ।

আর, তুমি?–ম্যানেজার রাইবিনকে জিগ্যেস করলেন।

আমারো ঐ একই কথা!

শিজভকে প্রশ্ন করতে সেও ঐ জবাব দিলো।

ম্যানেজার ধীরে ধীরে জনতার দিকে চেয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পেভেলকে বিদ্ধ করে বললেন, তোমাকে দেখে বেশ চোখা লোক মালুম হচ্ছে। তুমি কি প্লানটার উপকারিতা বুঝতে পাচ্ছ না?

পেভেল জোর গলায় বললো, আমরা বুঝতুম, কারখানার নিজের খরচে যদি জলা সাফ করা হত।

ম্যানেজার রুক্ষ জবাবে বলে, কারখানাটা দাতব্যাদার নয়। আমার হুকুম, এক্ষুণি-এই মুহূর্তে কাজে যাও। এই বলে কারও দিকে দৃকপাত না করে ম্যানেজার নীচে নাবতে গেলেন।-জনতার মধ্য থেকে একটা অসন্তুষ্টির চাপা গুঞ্জন শুনে হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, কী!

সব চুপ চাপ। দূর থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো, তুমি নিজে কাজ করগে।

ম্যানেজার স্পষ্ট ভাষায় বেশ একটু কড়া সুরে বললো, পনেরো মিনিটের মধ্যে যদি কাজ শুরু না কর তাহলে তোমাদের প্রত্যেককে বরখাস্ত করা হবে। এই বলে তিনি ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেলেন। তার। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সোরগোল উঠলো।

ওঁকে বলোনা।

ন্যায়বিচার চাইতে গিয়ে এই পেলুম…এতো দেখছি ফ্যাসাদ আরও বাড়লো।

পেভেলের দিকে চেয়ে একজন চেঁচিয়ে বললো, কি হে মাতব্বর উকিল, এখন কি হবে? খুব তত বক্তৃতার পর বক্তৃতা দিচ্ছিলে, কিন্তু যেই ম্যানেজার এলো, অমনি সব ফাঁক্কা।

তাইতো, কি করা যায় এখন?

গোলমাল এমনি করে বেড়ে উঠতে পেভেল হাত তুলে বললো, বন্ধুগণ, আমি প্রস্তাব করি যে, কোপেক-ট্যাক্স বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আমরা ধর্মঘট করে থাকি।

জবাবে শোনা গেল উত্তেজিত কণ্ঠ কোলাহল, আমাদের বোক। পেয়েছ আর কি!

আমাদের এই করা উচিত।

ধর্মঘট?

এক কোপেকের জন্য?

না কেন? কেন ধর্মঘট করব না?

আমাদের দল সুদ্ধুর কাজ যাবে!

তাহলে কাজ করবে কে?

নতুন লোকের অভাব কি।

কারা? যুডাসেরা?

ফি বছর মছা তাড়াবার জন্যে আমাদের ত তিন রুবেল ষাট কোপেক খরচ করতেই হয়।

সবাইকেই তা দিতে হবে।

পেভেল নেবে গিয়ে মার পাশটিতে দাঁড়ালো। রাইবিন তার কাছে এসে বললো, ওদের দিয়ে ধর্মঘট করাতে পারবে না। একটা পেনির ওপরও ওদের লোভ দুরন্ত, অত্যন্ত ভীতু ওরা; বড় জোর তিন’শকে তুমি দলে টানতে পারে, আর নয়। একগাদা গোবর কি একটা শলা দিয়ে তোলা যায়?

পেভেল চুপ করে রইলো, মজুররা সব পেভেলের বাগ্মীতার প্রশংসা করলো কিন্তু ধর্মঘটের সাফল্যে সন্দেহ প্রকাশ করে কাজে গিয়ে যোগ দিলো। পেভেল মনমরা হয়ে পড়লো, তার মাথা ঘুরছে…আত্মশক্তিতে আর তার বিশ্বাস নেই। ভাবতে ভাবতে সে বাড়ি ফিরে এলো।

সেইদিন রাত্রেই পেভেল গ্রেপ্তার হ’ল।

.

১.০৯

ছেলেকে হারিয়ে মা বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন, তার প্রাণ কেবলই হাহা করে বলতে লাগলো, আমায়ও কেন পেভেলের সঙ্গে ধরে নিয়ে গেলো না। রাইবিন এসে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, আমার বাড়িতেও তারা হানা দিয়েছিল, কিন্তু ধরলো না-ধরলো পেভেলকে। ওদের এই-ই হাল। ম্যানেজার চোখ ইশারা করলো, পুলিস বল্লো, যো হুকুম… আর দেখতে দেখতে একটা লোক অদৃশ্য হ’ল। চোরে চোরে মাসতুতে ভাই। একজন পকেট মারে, আর একজন পরাণে মারে।

মা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের উচিত পেভলের পক্ষ হয়ে লড়া—তোমাদের সকলের জন্যই সে আজ জেলে গেছে।

কার উচিত?

তোমাদের সবার।

রাইবিন কেমন এক শ্লেষের হাসি হেসে বললো, তোমার যে অতিরিক্ত দাবি, মা। কেউ ওর কিছুই করবে না। কর্তারা হাজার হাজার বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করেছেন। আমাদের কজের মধ্যে তারা বহুত পেরেক ঠুকে রেখেছেন…আমাদের মধ্যে ব্যবধানের বিরাট দেয়াল। আমরা ইচ্ছে করলেই এক্ষুণি তা সরিয়ে মিলতে পারিনে…এইগুলো বাধা দিচ্ছে…এগুলোকে আগে দুর করা চাই।

রাইবিন চলে গেলো।

রাত্রে শোময়লোভ এবং য়েগর আইভানোভিচ এসে হাজির হল। আইভানোভিচ বললো, নিকোলাই জেল থেকে বেরিয়েছে, জানো দিদিমা?

তাই নাকি? ক’মাস জেলে ছিল সে?

পাঁচ মাস এগারো দিন। এণ্ড্রি আর পেভেলের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। এণ্ড্রি, তোমায় প্রণাম জানিয়েছে আর পেভেল বলে পাঠিয়েছে, ভয় নেই। জেল তো যাত্রাপথের সরাই—যা প্রতিষ্ঠা এবং তদ্বির করেছেন কর্তারা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে।…এখন কাজের কথা হক, দিদিমা। কাল ক’জন গ্রেপ্তার হয়েছে জানো?

না। আর কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে নাকি?

হাঁ, চল্লিশ জন এবং আরো দশজনের হবার সম্ভাবনা। তার মধ্যে একজন ইনি—শোময়লোভ।

মা যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন, পেভেল–পেভেল তাহলে একা নেই। বললেন, এতগুলি লোক যখন ধরেছে তখন বেশিদিন রাখতে পারবে না।

আইভানোভিচ বললো, সে কথা ঠিক, দিদিমা। আর আমরা যদি ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে পারি, তাহলে ওরা আরো নাকাল হয়। কথাটা কি জানো, দিদিমা, ওরা গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ ইস্তাহারগুলোও যদি কারখানায় আর না ঢোকে তবে কর্তারা নির্ঘাত বুঝবেন এসবের পাণ্ডা কারা। পেভেল আর তার সঙ্গীদের তখন জেলে শক্ত করে চেপে ধরবে। কাজেই যেমন ব্রতের খাতিরে তেমনি পেভেলদের জন্য আমাদের কারখানার ভেতরে ইস্তাহার বিলির কাজ ঠিক আগের মতোই চালানো চাই। খুব ভালো ইস্তাহারও হাতে আছে, কিন্তু সমস্যা, তা কারখানায় ঢোকানো যায় কি করে? কারখানার গেটে আজকাল প্রত্যেকের শরীর তল্লাশী করা হয়।

মা বুঝলেন, তাকে দিয়ে একটা কিছু কাজ করাতে চায় ওরা। ছেলের মঙ্গলের জন্য কোন কিছুই করতে তাঁর আপত্তি নেই; কাজেই বললেন, তা’ কি করতে হবে আমাকে?

ফেরিওয়ালী মেরি নিলোভনাকে দিয়ে ইস্তাহারগুলো ঢোকাতে পারো না?

মা বলে উঠলেন, ওকে দিয়ে? সর্বনাশ, তা হলে দুনিয়ার কারো জানতে আর বাকি থাকবে না।

তারপর একটু ভেবে বললেন, আমার কাছে রেখে যেয়ো, আমি নিজেই ব্যবস্থা করব। মেরির সাহায্যকারিণী সেজে কারখানায় খাবার নিয়ে যাবো, তখন…ধরা পড়ব না…সবাই দেখবে পেভেল জেলে গেছে বটে, কিন্তু জেল থেকেও তার হাত কাজ করে যাচ্ছে।

তিনজনের মুখই আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। আইভানোভিচ বলে উঠলো, চমৎকার! শোময়লোভ বললো, এ যদি হয় তো জেল হবে আমার কাছে আরামকেদারা! মা ভাবলেন, ইস্তাহার বেরোলে কর্তারা একথা কবুল করতে বাধ্য হবেন, ইস্তাহার বিলির জন্য পেভেল দোষী নয়। সাফল্যের আশায় এবং আনন্দে মা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলেন, বললেন পেভেলকে বোলো, তার জন্য আমি না করতে পারি হেন কাজ নেই।

আইভানোভিচ মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, তুমি পেভেলের জন্য মিছে ভেবোনা, মা। জেল আমাদের কাছে বিশ্রাম এবং পাঠের স্থান—মুক্ত অবস্থায় যার ফুরসুৎ আমাদের মেলেনা। যাক, তাহলে ইস্তাহারগুলো পাঠাবো। কাল থেকে আবার যুগান্ত-সঞ্চিত অন্ধকার-নাশী চাকা আগের মতো ঘুরতে আরম্ভ করবে। দীর্ঘজীবী হ’ক আমাদের স্বাধীনতা, আর দীর্ঘজীবী হ’ক এই মাতৃ-হৃদয়।

.

তারপর তারা বিদায় নিয়ে চলে গেলো! মা একান্ত মনে ভগবানকে ডাকেন আর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা করেন। তাঁর মানসপটে পেভেলের সঙ্গে আর সকলকার ছবি ফুটে ওঠে।

মা মেরির কাছে গিয়ে তার সাহায্যকারিণীর কাজ নিলেন।

.

১.১০

পরদিন মজুররা অবাক হয়ে দেখলো, কারখানায় নতুন এক খাবারওয়ালী–পেভেলের মা।

মেরি নিজে বাজারে গিয়ে মাকে কারখানায় পাঠিয়েছে।

মজুররা দলে দলে মার কাছে এসে দাঁড়ায়। কেউ দেয় আশা, কেউ সান্ত্বনা, কেউ বা সহানুভূতি, কেউ-বা ম্যানেজার এবং পুলিসকে দেয় গাল। কেউ আবার বলে, আমি হলে তোমার ছেলের ফাঁসি দিতুম, লোকগুলোকে যাতে সে আর বিগড়াতে না পারে।

মা শিউরে উঠেন।

কারখানায় সে কী উত্তেজনা! স্থানে স্থানে মজুরদের ছোট ছোট দল, সবাই ঘোঁট পাকায়। চাপা গলায় অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে। মাঝে মাঝে ফোরম্যানরা মাথা গলিয়ে দেখে যায়, তারা চলে যেতেই ওঠে ক্রুদ্ধ গালাগালি, হাসির হররা।

মার পাশ দিয়ে শোময়লোভকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় দুটো পুলিস। পিছু-পিছু শ’খানেক মজুরের হল্লা। পুলিসদের উদ্দেশ্যে বিদ্রূপ এবং কটূক্তি বর্ষণ করতে করতে তারা চলেছে। একজন বললো, বা কমরেড, বেড়াতে বেরিয়েছ বুঝি!

আর একজন বলে উঠলো, নয়তো কি! আমাদের ওরা কম সম্মান করে চলে?

তৃতীয় একজন বললো, হাঁ, বেড়াতে বেরোলেই সঙ্গে সঙ্গে বডিগার্ড চাইতো!

তীব্র তিক্ত স্বরে এক চক্ষু জনৈক মজুর বললো, কি করবে! চোর-ডাকাত ধরে তো আর মজুরি পোষায় না, তাই নিরীহ লোকদের নিয়ে টানাটানি।

পেছন থেকে আর একজন বলে উঠলো, তাও আবার রাত্তিরে নয়, একবারে খোলা-মেলা দিনে-দুপুরে। লজ্জাও নেই হতভাগাদের। পুলিসেরা এই কটূক্তি এড়াতেই যেন দ্রুত পা চালিয়ে দেয় মজুরদের কথা যে কানে যাচ্ছে এমনই মনে হয়না।

শোময়লোভ হাসি-মুখে জেলে গেল। মার মনে হল, যেন তার আর একটি ছেলেকে কে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। এই যে হাসিমুখে জেলে যাওয়া, এর মাঝেও পেভেলেরই প্রভাব।

সমস্ত দিন পরে মা বাড়ি ফিরে এলেন। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলো। মা উদগ্রীব হয়ে রইলেন, আইভানোভিচ কখন আসে ইস্তাহার নিয়ে।

হঠাৎ একসময়ে দ্বারে মৃদু করাঘাত হ’ল। মা দ্রুতগতিতে দোর খুলে দিয়ে দেখেন শশেংকা,–দেখেই মার মনে হল, শশেংকা যেন অস্বাভাবিক রকমের মোটা হয়ে পড়েছে। বললেন, এতোদিন এদিক মাড়াওনি যে, ব্যাপার কি?

শশেংকা হেসে বললো, জেলে ছিলুম যে, মা…পোশাকটা বদলাতে হবে আইভানোভিচ আসার আগে।

তাইতো, একেবারে নেয়ে উঠেছ যে।

ইস্তাহারগুলো এনেছি।

দাও, আমার কাছে দাও,–মা অধীর আগ্রহে বলে উঠলেন।

দিচ্ছি—বলে শশেংকা গায়ের চাদরটা খুলে ঝাড়া দিলো, আর মায়ের সামনে পাতা-ঝরার মতো পড়তে লাগলো ভূঁয়ে একরাশি পাতলা কাগজের পার্শেল। মা হেসে তা কুড়িয়ে নিলেন, বললেন, তাইতো অবাক হচ্ছিলুম, এতো মোটা হলে কি করে? বড় কম তো আনোনি? এসেছ কি করে—হেঁটে?

হাঁ।

মা চেয়ে দেখলেন, সেই অস্বাভাবিক মোটা মেয়েটি আবার আগের মতো অসামান্য সুন্দরী হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার চোখের নীচে কালি। বললেন, এতদিন জেলে ছিলে মা, এবার কোথায় তুমি একটু বিশ্রাম নেবে, না, সাত মাইল এই মোট বয়ে নিয়ে এসেছে।

এ তো করতেই হবে, মা।

সে যাক—পেভেলের কথা বল। সে ঠিক আছে তো? ভয় খায়নি তো?

না, মা! সে বিগড়াবে না, এটা ধ্রুব সত্য বলে ধরে নিতে পারো।

শশেংকা ধীরে ধীরে বললো, কী শক্তিমান পুরুষ এই পেভেল!

মা বললেন, সে ঠিক। অসুস্থ সে কখনো হয়নি।…কিন্তু তুমি যে শীতে কাঁপছ, দাঁড়াও, চা আর জ্যাম এনে দিচ্ছি।

মৃদুহাশ্যে শশেংকা বললো, তোফা কিন্তু মা এত রাতে তোমার কিছু করবার দরকার নেই, আমি নিজ হাতেই করছি।

হাঁ, তা বৈকি। এই রোগ ক্লান্ত শরীর নিয়ে—নয়? তিরস্কারের সুরে এই কথা বলে মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। শশেংকাও গেলো তার পিছু পিছু। মা চা করছেন, আর সে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ে বললো, হাঁ, মা, সত্যিই আমি বড়ো ক্লান্ত। জেলখানা মানুষকে নির্জীব করে দেয়। এই বাধ্যতামুলক কর্মহীনতাই হচ্ছে সেখানকার সব চেয়ে ভয়ের কথা। এর চেয়ে পীড়াদায়ক আর কিছু নেই। এক হপ্তা থাকি, পাঁচ হপ্তা থাকি–বাইরে কতো কাজ করার আছে তাতো জানি। জানি যে, মানুষ আজও জ্ঞানের জন্য বুভুক্ষিত—আমরা তাদের অভাব পূর্ণ করতে সক্ষম কিন্তু কি করব, পশুর মতো বন্দী আমরা। এইটেই অসহ্য বোধ হয়—প্রাণ যেন শুকিয়ে যায়।

মা বললেন, কিন্তু এর জন্য কে তোমাদের পুরস্কৃত করবে?… তারপর ধীরে ধীরে দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে তিনিই তার জবাব দিলেন, ভগবান। কিন্তু তাকে তো তোমরা বিশ্বাস করনা।

না–শশেংকা সংক্ষেপে মাথা নেড়ে বললো।

নিজের ধর্মবিশ্বাসের মর্ম বুঝলে না তোমরা! ভগবানকে হারিয়ে জীবনের এপথে কেমন করে চলবে তোমরা?…

বাইরে জোর পায়ের শব্দ এবং কণ্ঠস্বর শোনা গেল। মা চমকে উঠলেন। শশংকা উঠে দাঁড়ালো। ফিফা করে বললো, দোর খুলো না। পুলিস যদি হয় বলবে আমাকে চেনোনা—আমি ভুলে এ বাড়িতে এসে পড়েছি। হঠাৎ মূর্ছা গেছি…তুমি পোশাক ছাড়াতে গিয়ে দেখেছ ইস্তাহার…বুঝলে?

কেন? কিসের জন্য?

চুপ। এতো পুলিস নয়, মনে হচ্ছে, আইভানোভিচ।

সত্যই আইভানোভিচ এসে ঘরে ঢুকলো। শশেংকাকে দেখে বললো, এরি মধ্যে এসে গেছ তুমি!

মার দিকে ফিরে বললো, তোমার এ মেয়েটি দিদিমা পুলিসের গায়ের কাঁটা। জেল-পরিদর্শক কি এতটা অপমান করায় পণ করে বসলো, ক্ষমা না চাইলে অনশন করে মরবে। আটদিন পর্যন্ত কিছু খেলল না,–মরে আর কি!

মা অবাক হয়ে বললেন, বলো কি! পারলে পরপর আটদিন না খেয়ে থাকতে?

শশেংকা তাচ্ছিল্যভরে ঘাড় দুলিয়ে বললো, কি করব। তাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়াতে হবে তো!

যদি মারা যেতে?

যেতুম—গত্যন্তর ছিল না কিন্তু শেষটা সে বাধ্য হয়েছিল ক্ষমা চাইতে। অপমান কখনো ক্ষমা করতে নেই, মা!

মা ধীরে ধীরে বললেন, হাঁ, অথচ আমরা স্ত্রীলোকেরা জীবনভোর, অপমান সয়ে আসছি।…

চা পান করে শশেংকা শহরে যাবে বলে উঠে পড়লো। এত রাত্তিরে একা কি করে যাবে ভেবে শঙ্কিত হয়ে মা তাকে থাকতে বললেন; কিন্তু সে শুনলো না। শহরে তাকে ফিরতেই হবে। আইভানোভিচের কাজ আছে বলে সেও সঙ্গে যেতে পারলো না। মা শশেংকার জন্য দুঃখ করতে লাগলেন। আইভানোভিচ, বললো, জমিদারের আদুরে মেয়ে…ওর সইবে কেন? জেলে গিয়ে ওর দেহ ভেঙে পড়েছে।…জানো দিদিমা, ওরা দু’টিতে বিয়ে করতে চায়।

কারা?

ও আর পেভেল। কিন্তু এতোদিন ও পেরে উঠেনি। ইনি যখন জেলে উনি তখন বাইরে। উনি যখন জেলে ইনি তখন বাইরে।

মা বললেন, জানিনে তো! কেমন করে জানবো? পেভেল আমার কাছে তো কিছু বলে নি।

শশেংকার জন্য মার বুকটা যেন আরো দরদে ভরে উঠলো।

আইভানোভিচ, বললো, তুমি শশেংকার জন্য দুঃখ করছ দিদিমা, কিন্তু করে কি হবে? আমাদের বিদ্রোহীদের সবার জন্য যদি তোমার চোখের জল ফেলতে হয় তো চোখের জলও তো অতো পাবে না—অশ্রুউৎস শুকিয়ে যাবে তোমার। স্বীকার করি জীবন আমাদের কাছে, মোটেই সহজ নয়। আমার এক বন্ধুর কথাই বলি—এই দিনকয়েক আগে তিনি নির্বাসন থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি যখন নোভোগারদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তখন স্ত্রী স্মোলেনস্কে তার প্রতীক্ষা করছেন। তিনি যখন স্মোলেস্কে পৌঁছলেন তখন তাঁর স্ত্রী মস্কোর কারাগারে। এবার স্ত্রীর সাইবেরিয়া যাওয়ার পালা। বিদ্রোহ এবং বিবাহ—এদুটো পরস্পরবিরোধী এবং অসুবিধাজনক জিনিস-স্বামীর পক্ষেও অসুবিধা, স্ত্রীর পক্ষেও অসুবিধা, কাজের পক্ষেও অসুবিধা। আমারও একজন স্ত্রী ছিল, দিদিমা, কিন্তু এমনিধারা জীবন পাঁচ বছরের মধ্যেই তাকে কবরশায়ী করেছে…

এক চুমুকে চায়ের কাপ নিঃশেষ করে সে তার দীর্ঘ কারা-জীবন এবং নির্বাসনকাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা করে গেলো।

মা নিঃশব্দে সব শুনলেন। তারপর ন্যস্ত কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *