১.০৬-১০ পাথুরে গির্জা

১.০৬ পাথুরে গির্জা

গির্জাটি মাত্র বছর কয়েক আগে তৈরি হয়েছে, এখনও সব ঝকঝক তকতক করছে, চারদিক ঘিরে ফুলের বাগান।

কেরী ও টমাস গিয়ে গির্জের কাছে নতজানু হয়ে বসল আর প্রার্থনা শুরু করল, পাশে দাঁড়িয়ে রইল রামরাম বসু। মিসেস কেরীর সঙ্গে চলছিল পার্বতী ব্রাহ্মণ। মিসেস কেরী সমস্ত ব্যাপারটার উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, মুখে চোখে তার ফুটে উঠেছে বিরক্তি। বিনা ভাষায় কিভাবে কেরী-পত্নীর মনোভাব সমর্থন করা যায় তারই চেষ্টা করছিল পার্বতী। কেরী-পত্নী থামে তো পার্বতী থামে, কেরী-পত্নী চলে তো পার্বতী চলে; কেরী পত্নী বিরক্তিসূচক ‘ইস’ বললে পার্বতী অনুরূপ ‘ইস’ বলে, কেরী-পত্নী আকাশের দিকে তাকালে পার্বতীও একবার আকাশের দিকে তাকায়।

ওদিকে ইতিমধ্যে কেরী ও টমাস উঠে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণে তাদের খেয়াল হয়েছে যে দ্বিতীয় গাড়ি এসে পৌঁছয় নি। কেরী শুধাল—ওরা গেল কোথায়?

রাম বসু বললে, যাদের বয়স কুড়ির কোঠায়, গির্জা আর গোরস্থান দেখার আগ্রহ তাদের হবার কথা নয়।

কথাটা টমাসের বড় লাগসই লাগল, সে বলল, মুন্সী, তোমার কথা খুব সত্যি। কুড়ির কোঠায় আমি তো আধখানা শয়তান ছিলাম।

রাম বসু মনে মনে বলল, এখন পুরো শয়তান হয়েছ, জুয়োর আচ্ছা তোমার গিঞ্জে, মদের বোতলে তোমার জর্ডানের দীক্ষাবারি। দাঁড়াও না, একদিন টুশকির বাড়ি নিয়ে যাই, তখন পরীক্ষা হবে তোমার খ্রীষ্ট-ভক্তির।

কেরী গির্জার চুড়ার দিকে তাকিয়ে রাম বসুকে বলল, মিঃ মুন্সী, অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর সব জাতের আশ্রয় হবে প্রভু খ্রীষ্টের এই গির্জা, সব ধর্মের লোক এসে এখানে হাত মেলাবে।

রাম বসু বলল, ডাঃ কেরী, আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য, কিন্তু তার জন্যে ভবিষ্যতের আশায় বসে থাকতে হবে না।

রাম বসুর কথায় কেরীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ব্যস্তভাবে শুধাল, কি রকম?

তবে এ গির্জা তৈরির ইতিহাস শুনুন, বুঝতে পারবেন কত জাত আর কত ধর্মের সমবায়ে এ গির্জা গঠিত।

এই বলে রাম বসু সেন্ট জন গির্জা তৈরির ইতিহাস বলতে শুরু করল

একজন হিন্দু রাজার দত্তা জমিতে এর ভিত্তিপত্তন, আর গির্জার পাথর আনা হয়েছে রাজমহল বলে একটা জায়গার নবাবী প্রাসাদ ভেঙে। সেই সুবাদে দেশীয় লোকেরা এটাকে বলে ‘পাথুরে গির্জা’। কাজেই দেখতে পাচ্ছেন যে, হিন্দু-মুসলমান ও খ্রীষ্টানের মিলন ইতিমধ্যেই ঘটেছে গির্জা গঠনে!

এখন, কেরী ও টমাস ধর্মবাতিকগ্রস্ত না হয়ে সাধারণ মানুষ হলে রাম বসুর কথা কি ভাবে গ্রহণ করতে হবে বুঝতে পারত, কিন্তু ওরা পারে না, ওরা ভাবে রাম বসু মস্ত একটা ভাবের কথা বলেছে, মুন্সীর প্রতি তাদের ভক্তি বাড়ে। ভক্তি জিনিসটারই ঐ প্রকৃতি প্রেম যদি অন্ধ হয়, ভক্তি অবুঝ।

কেরী বলল, শুধু তাই নয়, এমন সময় একদিন আসবে, যখন জগতে যুদ্ধবিগ্রহ থাকবে না, অস্ত্রাগারের উপর গড়ে উঠবে গির্জা।

রাম বসু বলল, পাদ্রী সাহেব, আপনার দিব্যদৃষ্টি না থেকে যায় না। অস্ত্রাগারের উপরেই গড়ে উঠেছে গির্জাটি, তবে ঠিক অস্ত্রাগার নয়, বারুদখানা। এই জায়গায় এক সময়ে কোম্পানির বারুদখানা ছিল।

কেরী সোৎসাহে বলল, মুন্সী, অদ্ভুত তোমার ব্যাখ্যা করবার শক্তি। তোমার মত ব্যাখ্যাতা পেলে এদেশে প্রভুর করুণা বিতরণ করতে বেশি সময় লাগবে না।

বসুজা মনে মনে বললে, প্রভুর করুণার জন্যে আমার বা আমার দেশের লোকের মাথাব্যথা নেই। আগে প্রভুর চেলাদের করুণার বহর বুঝি। কিন্তু ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে মুঠো খুব শক্ত, মাসিক কুড়ি টাকার বেশি করুণা আদায় করতে পারলাম না।

কেরী বলল, মুন্সী, তুমি কি ভাবছ? বসুজার উত্তর না পেয়ে কেরী বলল, আগামী কালে জগতের শুশ্রূষার স্থান হবে গির্জা।

বসুজা অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করে টমাসের উদ্দেশে বলল, ডাঃ টমাস, আজ ডাঃ কেরীর মুখে যে একেবারে ভবিষ্যদ্ভাষণের খই ফুটছে।

টমাস কিছু বুঝল না, তবু এমন কথায় সন্দেহ প্রকাশ অভদ্রতা জ্ঞানে বলল, নিশ্চয়, নিশ্চয়।

এই দেখ না কেন, আর কয়েক গজ উত্তরদিকে এক সময়ে ছিল কোম্পানির আমলের হাসপাতাল–শুশ্রূষার অভাব হচ্ছিল বলেই বোধ করি প্রভুর আদেশে পাশে গড়ে উঠল গির্জা।

টমাস বলে উঠল–চমৎকার।

রাম বসু বলল, কিন্তু চমকারের সবটা এখনও বুঝতে পার নি। প্রভু খ্রীষ্টের চেয়ে খ্রীষ্টানদের দূরদৃষ্টিও কিছু কম নয়। দেখ কেমন ব্যবস্থা কেল্লা, হাসপাতাল আর গোরস্থান কেমন পাশাপাশি তৈরি করেছিল—এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে বেশি সময় লাগত না।

কেরী জিজ্ঞাসা করল, কেল্লা তো কাছেই শুনেছি, কিন্তু গোরস্থান?

রাম বসু ও টমাস দুজনে একযোগে বলল—এই জায়গাতেই ছিল খ্রীষ্টানদের প্রাচীনতম গোরস্থান।

বল কি।

টমাস বলল, একটা হিসাবে দেখেছিলাম যে, নৃতন বেরিয়াল গ্রাউণ্ড খোলবার আগে এখানে বারো হাজার লোকের সমাধি দেওয়া হয়েছিল।

এইটুকু জায়গায়? তার মানে, একজনের উপরে আর একজনকে সমাধিস্থ করা হয়েছে?

তা হয়েছে বই কি।

রাম বসু বলল, শেষ বিচারের হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে, উপরের জন না উঠলে নীচের জনের ওঠবার উপায় থাকবে না।

ঐ সমাধি-স্তম্ভটা কার?

জব চার্নকের। তাকেই বলা যেতে পারে কোম্পানির কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা।

চল দেখে আসি।

যখন তারা তিনজন সমাধি-স্তম্ভ দেখবার জন্যে অগ্রসর হল, সেই অবসরে মিসেস কেরী এসে উঠে বসল গাড়িতে, অগত্যা পার্বতীকেও উঠে বসতে হল।

কেরী-পত্নী গায়ের শালখানা খুলে পাশে রাখল। এহেন অবস্থায় কি কর্তব্য স্থির করতে না পেরে বেশ শীত অনুভূত হওয়া সত্ত্বেও পার্বতী বলল, আজ বেশ গরম!

কেরী-পত্নী তার সমর্থন বা প্রতিবাদ কিছুই না করে চুপ করে বসে রইল।

ওদিকে জব চার্নকের সমাধির কাছে গিয়ে আনুপূর্বিক ইতিহাস শুনে সধিক্কারে সবিস্ময়ে কেরী শুধাল—তুমি কি বলতে চাও একজন হিদেন রমণীকে নিয়ে কলকাতায় প্রতিষ্ঠাতা বাস করত? খ্রীষ্টান সমাজ স্বীকার করেছিল এ বিবাহ?

ছেলেমেয়ে হল, খ্রীষ্টান সমাজে তাদের বিয়ে হল, জামাই সরকারী বড় কাজ পেল, এক জামাই গড়ে দিল এই স্মৃতিস্তম্ভ। স্বীকার করা আর কাকে বলে?

কি সর্বনাশ! চল, চল।

বহুকাল পূর্বে মৃত জব চার্নকের অখ্রীষ্টানোচিত কাজের প্রতিবাদেই যেন কেরী দ্রুত স্থানত্যাগ করল।

টমাস বলল, কাছেই আরও দুটো দর্শনীয় বস্তু আছে—পুরাতন কেল্লা আর ট্যাঙ্ক স্কোয়ার।

কেরী বলল, তবে এটুকুর জন্যে আর গাড়ি চড়ে কাজ নেই, চল হেঁটেই যাওয়া যাক।

তার পর স্ত্রীর উদ্দেশে বলল, ডরোথি, এস না, নাম, একটু হাঁটা যাক।

পত্নী বিরক্তির চরম সুরে বলল, আমি নামতেও রাজি নই, হাঁটতেও রাজী নই, কিছু দেখতেও রাজী নই।

তখন টমাস কোচম্যানকে বলল, তুমি গাড়ি নিয়ে গিয়ে লালবাজারে রোপওয়াকের কাছে অপেক্ষা কর আমরা এখুনি আসছি।

গাড়ি ডরোথিকে নিয়ে রওনা হল, সঙ্গে রইল পার্বতী ব্রাহ্মণ।

এদিকে কেরী, টমাস ও রাম বসু পদব্রজে পুরাতন কোর দিকে এগিয়ে চলল।

.

১.০৭ ওল্ড ফোর্ট

আস্ত দুটো সাহেব দেখে দারোয়ান সেলাম করে গেট খুলে দিল। না খুললেও ক্ষতি ছিল না, প্রাচীর জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়ে চতুষ্পদ ও দ্বিপদের জন্য স্বাভাবিক দরজা সৃষ্টি করে রেখেছে। তবু যখন কেল্লা, হক পুরাতন আর অব্যবহৃত, একটা গেট আছে। আর গেট যখন আছে, অবশ্যই একজন গেটকীপার বা দারোয়ানও আছে।

ভিতরে প্রবেশ করে কেরী, টমাস ও রাম বসু দেখল জনশূন্য ভগ্নপ্রায় বাড়িগুলো নিরর্থক পড়ে আছে, দরজা-জানলার অধিকাংশই ভাঙা।

রাম বসু ও টমাস আগেও দু একবার এর ভিতরে ঢুকেছে। এবার কেরীকে দেখাবার জন্যেই প্রবেশ, নইলে তাদের কোন আগ্রহ ছিল না।

স্বদেশে থাকতেই ‘ব্ল্যাক হোল ট্রাজেডি’ বা ‘অন্ধকূপ হত্যা’র সংবাদ কেরীর কানে পৌঁছেছিল, তাই সে ঘরটা দেখবার আগ্রহ প্রকাশ করল।

রাম বসু বলল, সেদিকে যাওয়া যাক।

কেরী বলল, ততক্ষণ পুরনো কেল্লার ইতিহাস বল, সব কথাই তোমার জানা থাকবার কথা, মিঃ মুন্সী!

মুন্সী অর্থাৎ রাম বসু বলল, তা আপনি নেহাৎ মিথ্যা বলেন নি। কলকাতা শহরেই আমার বাস, এখানেই আমার জন্ম, আর জন্মসালটাও নাকি ১৭৫৭, যে বছর পলাশীর যুদ্ধে কোম্পানির ফৌজ নবাবকে হারিয়ে দেয়।

তাহলে তুমি নিশ্চয় লর্ড ক্লাইভকে দেখেছ?

লর্ড ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস, সার ফিলিপ ফ্রান্সিসকাকে দেখি নি! একদিন সকালবেলায় এদিকে এসেছিলাম চীনাবাজারে। দেখলাম একজন সাহেব ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন, সঙ্গে কয়েকজন ফৌজী ঘোড়সওয়ার। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম—জঙ্গী লাট ক্লাইভ। সত্য কথা বলতে কি, দেখে বীরপুরুষ বলে মনে হল না। আরও শুনলাম, গোবিন্দপুরে যে নতুন কেল্লা তৈরী হচ্ছে তাই দেখতে চলেছেন।

টমাস বলল, আরে বীরপুরুষ কি অষ্টপ্রহরই বীরপুরুষ! তা নয়। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে বীর, অন্য ক্ষেত্রে আমাদের মতই মানুষ।

আর ওয়ারেন হেস্টিংসকে দেখেছিলাম, ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রীটের মোড়ের বাড়িটায়, এখন যার পাশে মিসেস ফে নামে এক ইংরেজ রমণী কাপড়ের দোকান খুলেছে। হঠাৎ তাকে দেখে কোন ইংরেজ কেরানী বলে মনে করেছিলাম। পরিচয় জেনে পালিয়ে বাঁচি।

কেরী কৌতূহল বোধ করল, শুধাল, হঠাৎ পালাতে গেলে কেন? লোকটা কি রূঢ় ব্যবহার করত?

না না, এদেশী লোকের সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বদা মিষ্ট ব্যবহার করত। কিন্তু কি জানেন ডাঃ কেরী, বৃদ্ধ চাণক্য রাজপুরুষ থেকে শত হস্ত দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। কোন রাজপুরুষ যদি আজ বলে বসে, বসু, তোমার মুখটি বেশ সুন্দর, তখনই ঘরে গিয়ে মাথা নেড়া করে মুখটা যথাসাধ্য বীভৎস করে তোলবার চেষ্টা করব।

তার কথায় কেরী ও টমাস দুজনে হেসে উঠল। হাসলে কেরীর উপরের পাটিতে দুটি অধভগ্ন দাঁত দেখা যায়।

আর সার ফিলিপকে? জিজ্ঞাসা করে কেরী।

আদালতে বিচারের সময়ে তাকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম।

তিনি কি ছিলেন, জজ না কৌঁসুলী?

ও দুয়ের কোনটাই নয়। আসামী।

আসামী! অত বড়লোক! বিস্ময় প্রকাশ করে কেরী। কি অপরাধ?

সেসব কথা আপনার মত ধর্মপ্রাণ লোকের শুনে কাজ নেই।

টমাস সব কথাই জানত, সে মুচকে হাসল।

এই যে অন্ধকূপের কাছে এসে পড়েছি—রাম বসু কেরীব মনোযোগ সেদিকে আকর্ষণ করল।

ইতিহাস-কুখ্যাত অন্ধকূপ গৃহ এখন পরিত্যক্ত ও জীর্ণ। দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ তিনজনের নাকে গেল—তার পরেই গোটা দুই বাদুড় পাখা ফড়ফড় করে উড়ে চলে গেল মাথার উপর দিয়ে বাইরের দিকে। চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে এলে তিনজনে দেখল এক কোণে পাকারে পড়ে রয়েছে চুন-সুরকি, কতকগুলো ভাঙা লোহা-লক্কড়।

টমাস বলল, ঘরটা এখন গুদামে পরিণত হয়েছে। ঐ গরাদে-দেওয়া উঁচু জানলা দিয়ে নবাবের সেপাই বন্দীদের জল দিয়েছিল।

এই বলে জানলাটার দিকে তাকিয়েই রাম বসু বলল-ইস, সর্বনাশ! আসুন, বাইরে আসুন।

এই বলে কেরীকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এল-সঙ্গে সঙ্গে টমাসও বাইরে এল।

কি হল?

প্রকাণ্ড মৌচাক। আমাদের সাড়া পেয়ে গুনগুন শুরু করেছে—তাড়া করলে আর রক্ষা নেই, দ্বিতীয় অন্ধকূপ হত্যা ঘটিয়ে ছাড়বে।

রাম বসু বলল, তার চেয়ে আসুন বাইরে যেতে যেতে পুরনো কেল্লার ইতিহাস যতটুকু জানি বলি।

এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই কেল্লার পত্তন হয়। সমস্তটাই ইটের তৈরী। একদিকে ঐ দিঘি, আর একদিকে গঙ্গা-যদিচ এখন গঙ্গাকে ঠেলে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়ে সে জায়গায় রাস্তাঘাট আর বাড়ি তৈরি হয়েছে। তখনকার দিনে কোম্পানির যাবতীয় অফিস, গুদাম, ফ্যাক্টরি আর কেরানীদের থাকবার জায়গা এর মধ্যেই ছিল। আর খোদ গভর্নর সাহেবও এখানে থাকতেন, যদিচ নামে মাত্র।

কেন, নামে মাত্র কেন?

কার্যত তিনি কেল্লার বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বড় বাড়িটায় থাকতেন, এখন সেখানে কাস্টম বিভাগের আপিস।

সে আবার শুরু করল—ডাঃ কেরী, ঐ যে বড় হলঘরটা দেখছেন, সেন্ট জন চার্চ তৈরি হওয়ার আগে ওটা প্রেয়ার-হল রূপে ব্যবহৃত হত।

টমাস বলল, ওখানে মেয়েদের পালকি থেকে নামতে বড় অসুবিধা হত। একদিন সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল—গভর্নরের পত্নী এলেন পালকিতে। তিনি নামতে যাবেন, কখন স্কার্ট বেধে গিয়েছে একটা কাঁটায়—সবসুদ্ধ সে এক লজ্জাকর বীভৎস ব্যাপার। সেই দিনই স্থির হল—না, এমন করে চলে না, শহরের যোগ্যতা মাফিক গির্জা গড়তে হবে। উপাসনার শেষেই চাঁদার আবেদন জানানো হল।

কথা বলতে বলতে তিনজন কেল্লার বাইরে এসে পৌঁছল—আর রাস্তাটুকু পার হয়ে ট্যাঙ্ক স্কোয়ারে ঢুকল।

.

১.০৮ ট্যাঙ্ক স্কোয়ার বা লালদিঘি

রামরাম বসু বলল, ডাঃ টমাস, একবার ছেলেবেলায় এখানে কমলালেবু চুরি করতে এসে বারওয়েল সাহেবের চাপরাসীর তাড়া খেয়েছিলাম। ধরা পড়ি আর কি! আমি তো ছুটে পালালাম। কিন্তু পার্বতী ভায়ার দুরবস্থার একশেষ। সে বরাবরই একটু মোটা পালাবার অন্য উপায় না দেখে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ঐদিকে উঠে পালাল।

কেরী বিস্ময়ের সঙ্গে শুধাল, এখানে কমলালেবু গাছ ছিল নাকি?

ছিল বই কি। সিলেট থেকে কমলালেবুর চারা এনে পুঁতেছিল। আরও কত ফলের ও ফুলের গাছ ছিল।

কেরী শুধায়, তবে এখন এমন লক্ষ্মীছাড়া দশা কেন?

তখন অর্থাৎ কোম্পানির রাজত্বের প্রথম আমলে এই ট্যাঙ্ক স্কোয়ারটাই ছিল সাহেব মেমদের হাওয়া খাওয়ার একমাত্র স্থান-তাই জায়গাটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের পরে সাহেব-সুবোরা শহরের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, চাঁদপাল ঘাটের কাছে যেখানে জলা আর জঙ্গল ছিল, সেখানে সুন্দর এপ্ল্যানেড গড়ে তুলেছে। তাই এ জায়গাটার উপর আর তেমন লক্ষ্য নেই।

টমাস বলল—শুধু হাওয়া খাওয়ার একমাত্র জায়গা ছিল না, জল পানেরও একমাত্র পুকুর ছিল।

কিন্তু তা এখনও আছে।

কেরী শুধাল, এই কি পানীয় জল?

পানীয় জল বই কি। সাহেবপাড়ার সমস্ত পানীয় জল এখানে থেকে সরবরাহ হয়।

কেরী বলে—বল কি! ঐ তো দেখছি দুটো কুকুর নেমেছে জলে।

শুধু কুকুর? সুযোগ পেলে লালবাজারের কোচম্যানের দল এখানে ঘোড়া এনে স্নান করিয়ে নেয়। ঐ দেখুন ভিত্তি করে জল নিয়ে যাচ্ছে সাহেববাড়ির জন্যে।

তিনজনে দেখল, পুবদিকের ঘাটে নরনারী স্নান করছে, ভিস্তিওয়ালা ভিস্তি ভরছে। তারা সুরকি-ঢালা পথ ধরে লালদিঘির উত্তরদিক দিয়ে পুবমুখে চলল।

কেরী বলল, শুনেছি এটার নাম লালদিঘি, রেড ট্যাঙ্ক। নামটার অর্থ কি?

টমাস বলল—ঠিক অর্থ কেউ জানে না, নানা লোকের নানা অনুমান। কেউ কেউ বলে, এক সময় পুরনো কেল্লার প্রাচীরের লাল রঙ দিঘির জলে প্রতিফলিত হয় তাই নাম হয়েছিল লালদিঘি।

কেরী জিজ্ঞাসা করে, উত্তরদিকের ঐ লম্বা বাড়িটা কি?

ওটার নাম রাইটার্স বিল্ডিং। নীচের তলায় কোম্পানির আপিস। দোতলায় নবাগন্তুক রাইটারদের বাসস্থান। আর ঐ পুবদিকে দেখা যাচ্ছে—ওন্ড মিশন চার্চ।

ওটাই কি শহরের সবচেয়ে পুরনো গির্জা?

সবচেয়ে পুরনো গির্জাটা মুগীহাটা নামে এক জায়গায়। সেটাকে বলে আর্মেনিয়ান গীর্জা। আর একটা পুরনো গির্জা ছিল রাইটার্স বিল্ডিঙের ঐ পশ্চিম-উত্তর কোণে। নাম ছিল সেন্ট অ্যানস চার্চ। এ পাড়ায় ওটাই ছিল একমাত্র গির্জা—কেল্লার ঠিক সামনেই।

সেটা গেল কোথায়?

সিরাজদ্দৌল্লা যখন কলকাতা আক্রমণ করে তখন কামানের গোলায় ভেঙে যায়, অনেককাল ভাঙা অবস্থায় পড়ে ছিল, তার পর সরিয়ে ফেলে জায়গাটা পরিষ্কার করা হয়েছে।

আর ওটা?

ওটা সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ, এই গত বছর মাত্র তৈরি শেষ হয়েছে।

তার আগে ওখানে কি ছিল?

ওখানে ছিল মেয়রের আপিস আর আদালত, ঐ আদালতেই মহারাজা নন্দকুমারের বিচার হয়েছিল।

কেরী বলল, দেখ টমাস, প্রভু খৃষ্টের কি মহিমা, আদালতের উপরে উঠল গির্জার চুড়া।

টমাস বলল, রাইটার্স বিল্ডিঙের উত্তরে একটা বড় বাড়িতে থাকত লর্ড ক্লাইভ, সেটা এখনও খালি পড়ে আছে। তারই কাছে ছিল পুরনো থিয়েটার আর সার ফিলিপ ফ্রান্সিসের প্রথম বাসস্থান। যাবে ওদিকে?

কেরী বলল, আজ আর যাব না, চল ফেরা যাক—মিসেস কেরী অনেকক্ষণ একলা আছে।

তখন তিনজনে ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট পেরিয়ে এসে রোপওয়াকের মোড়ে গাড়িখানা দেখতে পেল। গাড়িতে উঠলে মিসেস কেরী স্বামীকে বলল-তবু ভাল যে ফিরেছ। এত কি দেখবার ছিল?

প্রভুর মহিমা দেখছিলাম, চারদিকে গির্জা উঠছে।

প্রভুর মহিমা গাড়িতে বসেও দেখতে পারতে। ভবিষ্যতে যখন প্রভুর মহিমা দেখতে বেরুবে আমাকে বাড়িতে রেখে বেরিও।

গাড়ি চলল।

টমাস বলল-ডানদিকে ছিল পুরনো জেলখানা, এখন উঠে গিয়েছে টালির নালার কাছে।

কেরী শুধাল, এ রাস্তাটার নাম কি?

এটা দি অ্যাভিনিউ, সবচেয়ে পুরনো রাস্তা। কেল্লার গেট থেকে বেরিয়ে বরাবর সিধে চলে গিয়েছে বৈঠকখানার বড় বটগাছটা পর্যন্ত, তার নীচেই বিখ্যাত মারহাট্টা ডিচ। তার পরেই আরম্ভ হল-বাদা—মানে—মার্শল্যান্ড।

বাঁয়ে চিৎপুর রোড, ডাইনে কসাইটোলা রেখে গাড়ি চলে দি অ্যাভিনিউ ধরে।

.

১.০৯ বিয়ার বোতলের লড়াই

জন স্মিথদের গাড়ি গঙ্গার ধার দিয়ে ঘুরে নৃতন কেল্লা ও এপ্ল্যানেড হয়ে যখন সেন্ট জন গির্জার কাছে পৌঁছল তখন তারা দেখল যে, সেখানে কেরীদের গাড়ি নেই। জন ভেবেছিল এখানে কেরীদের পাবে, আর একসঙ্গে ফিরবে। তখন দু-একজন লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানল যে, একখানা গাড়ি অনেকক্ষণ আগে এসেছিল বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ হল চলে গিয়েছে। শুনে জন কোচম্যানকে হুকুম করল পুরনো কেল্লা হয়ে অ্যাভিনিউ-র দিকে চলতে।

গাড়িখানা যখন লালদিঘির উত্তরদিকে এসে পৌঁছেছে তখন গাড়ির আরোহীরা দেখতে পেল, রাইটার্স বিল্ডিঙের দোতলায় কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ যুবক রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পথের লোকচলাচল দেখছে।

জন কেটির উদ্দেশে বলল, এরা সব বাচ্চা নবাব।

কেটি বলল, তার মানে?

কোম্পানির রাইটার, সবে ইংল্যান্ড থেকে এসে পৌঁছেছে। এখনও এদের নবাবীর ট্রেনিং সম্পূর্ণ হয় নি, হলেই পুরোদস্তুর নবাব হয়ে দেশ শাসন শুরু করে দেবে।

তার পর নিজের মনেই যেন আক্ষেপ করে বলল, এদের আচরণের ফলে এ দেশে ইংল্যান্ডের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।

কেটি শুধাল—এরা এখানে কেন?

দোতলায় এদের বাসস্থান, নীচের তলায় অফিস।

কেটি বলল, এখনও রাত-পোশাক ছাড়ে নি দেখছি।

তা না হলে আর নবাব বলছি কেন! ওরা এই পোশাকেই আপিসে যাবে, পোশাক বদলাবে ডিনারের আগে। ওদের কাছে ওটাই হচ্ছে গিয়ে দিবসের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য।

ইতিমধ্যে শ্বেতাঙ্গ যুবকগণ গাড়ির আরোহীদের দেখতে পেল। প্রথমে এ ওকে ইশারায় গাড়িখানা দেখাল, তার পর সকলে একযোগে উল্লাসের হল্লা করে উঠল। সে রকম হল্লা কুড়ির নীচে ও পঁচিশের উপর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাদের উল্লাসের যথেষ্ট কারণ ছিল। শ্বেতাঙ্গিনী দুর্ভিক্ষের বাজারে একসঙ্গে দুটি শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরীর অকস্মাৎ একবারে বাড়ির দরজায় আবির্ভাবে খুশি হয়ে না ওঠে এমন যুবকের অস্তিত্ব ইংলিশ চ্যানেলের পশ্চিমদিককার দ্বীপটিতে সম্ভব নয়। সতীর্থদের হল্লায় আরও জনকয়েক ঘর থেকে বেরিয়ে এল—এবারে সংখ্যা হল পনেরোর কাছাকাছি। কেটি ও লিজার উদ্দেশে চীকার করে উঠল ‘সুইটি’, কেউ চীৎকার করে বলল ‘ডারলিং’।

কেটি ও লিজা মনে মনে কৌতুক ও কৌতূহল অনুভব করল—জনেরও মন্দ লাগছিল।

কেটি ভাবছিল, তারা দুটি যুবতী পাশাপাশি থাকলেও যুবকমন সৌন্দর্যের অর্ঘ্য নিবেদন করে তারই উদ্দেশে। অবশ্য লিজাও নীরবে ঠিক ঐ কথাই ভাবছিল-ভাবছিল, কেটি নিতান্তই উপলক্ষ্য, আসল লক্ষ্য সে নিজে।

এমন সময় একটি যুবক ইশারা ও হাসির আশ্রয় ছেড়ে কবিতার আশ্রয় গ্রহণ করল, সে গেয়ে উঠল

“There’s no lady in the land
Half so sweet as Sally;
She is the darling of my heart,
And she lives in our alley.”

বন্ধুরা বিপুল হাস্যে তাকে সমর্থন জানাল, তখন সে আবার গাইল–

“But when my seven long years are out,
O then I’ll marry Sally.
O then we’ll wed, and then we’ll bed,
But not in our alley.”

গানের তাৎপর্যের সঙ্গে তাদের শিক্ষানবিশী জীবনের তাৎপর্য মিলে গেল দেখে বন্ধুরা মহা কলরবে হেসে উঠল।

কিন্তু গানের তাৎপর্য দিল জনকে চটিযে, সে পা-দানির উপর দাঁড়িয়ে উঠে যুবকদের ইঙ্গিতে শাসাল। এতে ফল হল ঠিক বিপরীত। তাদের গান তো থামলই না, বরঞ্চ ভিন্নতর খাতে প্রবাহিত হল, যার এক কূলে ব্যঙ্গ, অন্য কূলে প্রচ্ছন্ন লালসা।

একজন যুবক যথোচিত ভঙ্গী ও মুদ্রা করে শুরু করল–

“O lovely Sue,
How sweet art thou,  
Than sugar thou art sweeter,
Thou dost as far
Excel sugar
As sugar does saltpetre.”…

এই অপ্রত্যাশিত ও সময়োচিত কাব্যফুর্তিতে বড় হাসির হররা পড়ে গেল সকলে সমস্বরে গেয়ে উঠল–As sugar does salpetre!’

তখন জন আস্ত জনবুল-মূর্তি ধারণ করে ইঙ্গিতে কিল ঘুষি ছুঁড়তে লাগল। আর ওদিক থেকে অপরপক্ষ ইশারায় চুম্বন ছুঁড়ে দেওয়া শুরু করল—সঙ্গে সঙ্গে,

“One for the master. one for the dame,
One for the lame man who lives by the lane.”

কেটি ও লিজা অপ্রস্তৃত হয়ে গিয়েছিল, তারা নিতান্ত অপরাধীর মত চুপ করে বসে রইল। কিন্তু মনটা চুপ করে ছিল না। কেটি ও লিজা দুজনেই মনে মনে যাবতীয় দায়িত্ব পরস্পরের ও জনের ঘাড়ে চাপাচ্ছিল, যুবকদের কেউ একবারের জন্যেও দায়ী করল না। এরকম না হলে আর রমণীকে বিশ্বাসহন্ত্রী ইভের বংশধারিণী বলেছে কেন?

ইশারায় চুম্বনবৃষ্টি কমাবার উদ্দেশ্যে জন এক পাটি জুতো খুলে নিয়ে দোতলা লক্ষ্য করে ছুঁড়ল—আর তার প্রত্যুত্তরে গোটা দুই বিয়ারের বোতল এসে পড়ল গাড়ির আশেপাশে। তখন কোচম্যান সমাধানের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারল। গাড়ি জোরে ছুটল। অপস্রিয়মাণ গাড়ির আরোহীদের কানে যুবকদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর প্রবেশ করল–

“Return again fair Lesley.
Return to Loll Digie!
That we may brag wc hae a ass,
There’s none again sae bonnie.”

রাগে অপমানে জন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, সে বসে বসে গজরাতে লাগল। বালক ফেলিক্সের কাছে সবটাই একটা মস্ত তামাসা বলে মনে হল। কেটি ও লিজাও ক্ষুব্ধ, জনের প্রতি সমবেদনাপরায়ণ ও কৃতজ্ঞ। কিন্তু…..কিন্তু তৎসত্ত্বেও অস্তিত্বের গভীরতম কেন্দ্রে কেমন একটুখানি তীব্র সুখের মতন অভিজ্ঞতা তারা অনুভব করছিল। যুবকদের আচরণ অবশ্যই অভদ্র, কিন্তু তার মূলে তাদের দীর্ঘ উপবাসজনিত বুভুক্ষা; বুভুক্ষুর আর্তনাদে বিরক্ত হলে চলবে কেন, তাদের ক্ষুধার মূল্য দাও। কিসের ক্ষুধা? নারীর। কে সে নারী?

কেটি ভাবছিল, আর যেই হক, ভিজা নয়। লিজাও ঠিক ঐ কথাই ভাবছিল, আর যেই হক, কেটি নয়।

নারীসমাজে নারী নির্বান্ধব, কারণ সংসারের যাবতীয় নারী তার প্রতিদ্বন্দিনী-হক সে কন্যা, হক সে মাতা, হক সে শ্বশু! পুরুষসমাজেও সে নির্বান্ধব, কারণ সে কখনও পুরুষকে বন্ধুরূপে অর্থাৎ সমানে সমানে পাওয়ার কল্পনায় তৃপ্তি পায় না। আলিঙ্গনাবদ্ধ নাকে পুরুষ জিজ্ঞাসা করে-‘তুমি আমার?’ নারীজীবনের গভীরতম অভিজ্ঞতার প্রেরণায় সে বলে-‘আমি তোমার।‘

এতক্ষণ একদল ছোকরা ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে সাহেবদের কান্ড দেখছিল। এবারে পলায়নপর গাড়িখানা খানিকটা দূরে যেতেই তারা উচ্চৈঃস্বরে ছড়াকাটা শুরু করল।

হাতীপর হাওদা, ঘোড়াপর জিন,
জলদি যাও জলদি যাও, ওয়ারেন আস্তিন।

গাড়িখানা কসাইটোলা-চিৎপুরের মোড়ে পৌঁছতেই লিজা বলল, জন, এবার ফেরা যাক।

জন কোচম্যানকে সেইরকম হুকুম করলে গাড়ি কসাইটোলা ধরে চলল চৌরঙ্গীর দিকে। গাড়ি Davies Daintie দোকানের কাছে আসতেই লিজা বলল—কোচম্যান, রোখো।

গাড়ি থামলে সে বলল, কিছু কেকের অর্ডার দিয়ে যেতে হবে। নাম না মিস প্ল্যাকেট, দোকানটা দেখে যাও, পরে কাজে লাগবে।

তখন কেটি ও ফেলিক্স লিজাকে অনুসরণ করে নেমে দোকানে ঢুকল।

অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও জন নামল না, সে যেমন বসে ছিল তেমনি চুপ করে বসে রইল।

.

১.১০ দি অ্যাভিনিউ

কেরীর গাড়ি কসাইটোলার মোডে পৌঁছতেই কেরী বিস্ময়ে বলে উঠল–এ কি!

টমাস বলল, পরশুদিন দুজন ফিরিঙ্গির ফাঁসি হয়েছিল, তাদেরই দেহ ঝুলছে।

এমনভাবে কদিন থাকবে?

আরও চার-পাঁচ দিন থাকবে, তার পর পচতে শুরু করে দুর্গন্ধ ছাড়তে শুরু করলেই সরিয়ে ফেলা হবে।

কেরী অনেকটা যেন আপন মনেই বলল, এভাবে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া মানবোচিত কার্য নয়।

অপ্রত্যাশিত উম্মায় মিসেস কেরী চীৎকার করে বলল—কি এমন অন্যায়টা হয়েছে? তারা খুন জখম করবে প্রকাশ্যে, আর তাদের ফাঁসি দেওয়া হবে গোপনে! তাহলে লোকশিক্ষা হবে কি উপায়ে?

কেরী বলল,—দু পক্ষেই অনেক কিছু বলবার আছে সত্য, কিন্তু এ খ্রীষ্টানোচিত নয়।

রাখ তোমার ধর্মোপদেশ! ডাঃ টমাস, এ খুব স্বাস্থ্যকর প্রথা। এর পর ফাঁসি হবে খবর শুনলে আমাকে জানিও, আমি অবশ্য দেখতে আসব।

গাড়ি অ্যাভিনিউ সড়ক ধরে চলেছে। দুদিকে বড় বড় বাড়ি, অধিকাংশই দোতলা, একতলার সংখ্যাও কম নয়। অধিকাংশ বাড়িই শ্বেতাঙ্গগণের।

কেরী বলল, রাস্তাটাকে ফ্যাশনেবল পাড়া বলে মনে হয়।

টমাস বলল—হাঁ, চৌরঙ্গীর পরে এটা শৌখিন পাড়া। অবশ্য গার্ডেনরীচ ও আলিপুরের কথা আলাদা। ও দুটো হচ্ছে কাঞ্চন-কৌলীন্যের স্বর্গ।

কেরীরা দেখতে পেল তখনও অত বেলাতেও দোতলার অধিবাসীরা রাত-পোশাক ছাড়ে নি, অনেকে বারান্দায় দ্রুত পায়চারি করে ঘুমের জের কাটাবার চেষ্টা করছে।

রাস্তার দু-পাশেই যে টানা বাড়ির শ্রেণী এমন নয়, মাঝে মাঝে জলা ও আগাছার জঙ্গল আর পতিত জমি। ডানদিকে এমনি একখণ্ড স্থান দেখে কেরী বলে উঠল—এখানে দিব্য একটি গিজা গড়া যেতে পারে।

মিসেস কেরী বলল, আগে আমাকে বাসায় পৌঁছে দাও, তার পর বসে বসে যত খুশি গির্জা গড়িও।

কেরী বলল, বাসাতেই তো ফিরছি।

গাড়ি যতই পুবদিকে চলতে লাগল ততই বাড়ির সংখ্যা কমে পতিত জমির আয়তন বাড়তে লাগল।

এমন সময়ে একটা শেয়াল পথটা অতিক্রম করে অন্যদিকে চলে গেল।

মিসেস কেরী বলে উঠল-দেখ দেখ, একটা নেকড়ে বাঘ!

কেরী বলল-না ডিয়ার, এটা একটা শেয়াল।

নিশ্চয়ই শেয়াল নয়, নেকড়ে; তুমি আমাকে বৃথা আশ্বাস দিচ্ছ।

তখন টমাস, রাম বসু ও পার্বতী একযোগে সাক্ষ্য দিল, বলল, না, ওটা শেয়াল ছাড়া কিছু নয়।

কিন্তু এত সহজে সমস্যার সমাধান হল না; মিসেস কেরী বলে উঠল, তবে তো এখনই বাঘ বেরুবে, কারণ আমি বই-এ পড়েছি শেয়াল হচ্ছে বাঘের অগ্রদৃত। এই কোচম্যান, গাড়ি জোরে হাঁকাও।

অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়ি মারহাট্টা ডিচের প্রান্তে এসে পড়ল—সেই বৃহৎ বটগাছটার তলায়।

টমাস বলল, ডাঃ কেরী, এই সেই বিখ্যাত মারহাট্টা ডিচ।

মারহাট্টাদের ভয়ে খনন করা হয়েছিল বুঝি?

হাঁ, ঠিক তাই।

এ খাল কি কলকাতাকে পরিবেষ্টিত করেছে?

সেইরকমই কথা ছিল, কিন্তু এর মধ্যে মারহাট্টা হাঙ্গামা থেমে গেল–তাই খালটাও জানবাজার রোড পর্যন্ত এসে থেমে গেল।

আর এই রাস্তাটা?

টমাস বলল-খালের পশ্চিমদিক বরাবর চলেছে, খালের মাটি তুলে তৈরি। সকালে বিকালে হাওয়াখখারের দল এখানে ভিড় করে।

বাপ রে, কি প্রকাণ্ড গাছ! বলে কেরী।

এ হচ্ছে গিয়ে ভারতের বিখ্যাত বেনিয়ান ট্রি। কলকাতা অভিযানের সময়ে এই গাছটার তলাতে বসে নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কেল্লা আক্রমণ দেখেছিল—ঐ দেখ, কেল্লার ফটক দেখা যাচ্ছে।

সকলেই দেখল—হাঁ, দি অ্যাভিনিউ বরাবর কেল্লার ফটক দেখা যাচ্ছে বটে। বটগাছটা ও কেল্লার ফটক সমসূত্রে স্থাপিত।

টমাস বলল, ডাঃ কেরী, এবারে ফেরা যাক, মিসেস কেরী বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

 কেরী বলল, আমি তাই বলব ভাবছিলাম, এখন ফিরে যাওয়াই ভাল।

 তখন গাড়ি আর একটু দক্ষিণে গিয়ে জানবাজার রোড দিয়ে চৌরঙ্গীর মুখে ফিরল।

কিন্তু আমি ভাবছি, জনদের গাড়ি গেল কোথায়?

মিসেস কেরী বলল, তারা তো খ্রীষ্টীয় প্রচারক নয়, এতক্ষণ নিশ্চয় বাড়ি ফিরে গিয়েছে।

সকলেই বুঝল—যে কারণেই হক, মিসেস কেরীর মেজাজ আজ ভাল নেই, তাই কেউ আর আলাপের কোন প্রসঙ্গ তুলল না। গাড়ি জানবাজার রোড ধরে, গোপী বসুর বাজারের পাশ দিয়ে যখন চৌরঙ্গী রোডে পড়ল তখন সবাই দেখল—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *