ওড়নাখানি খুলিয়া দেখিয়া করিমের মা বলিল, ” এ ওড়্না আমাদেরই তৈয়ারী; এ রকম ফুল-লতা-মোড়ের কাজ আর কোথাও হয় না| গোয়েন্দা বাবুর বৌ-এর জন্য এ রকম একখানি ওড়্না চাই না কি? তা’ ইহার অপেক্ষাও যাতে ভাল হয়, তা’ আমি ক’রে দিব| বৌ-এর হুকুমে বুঝি আজ তাড়াতাড়ি এখানে ছুটে এসেছ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না, সে রকম হুকুম আপাততঃ আমার উপরে পড়েনি; পড়্লেই তামিল করবার জন্য এখানে ছুটে আসতে হবে, সেজন্য বিশেষ চিন্তা নাই|”
করিমের মা বলিল, “তবে এ ওড়্না সঙ্গে কেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” কে তোমাকে এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করতে দিয়েছিল, বলিতে পার?”
করিমর মা হাসিয়া বলিল, ” কেন-তাকে আবার কেন? পাছে তোমার কাছে বেশি নিই, তাই কত খরচ পড়েছে, সেটা আগে তার কাছে খবর নিয়ে আস্বে -মনে করেছ? তাতে দরকার নাই, খুব কম খরচে ক’রে দিব, সে তোমার গায়েই লাগ্বে না| কি মুস্কিল ! তোমার কছে কি আমি বেশে নিতে যাব !”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না করিমের মা, তুমি যা’ মনে করেছ, সেটা ঠিক নয়| কার জন্য এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করেছিলে বল দেখি; কাজ আছে-বিশেষ দরকার|”
করিমের মা ওড়্নাখানি ভাঁজ করিতে করিতে বলিল, ” তাকি আর এখনও মনে আছে ! কত লোকের কত রকম ওড়্না ক’রে দিচ্ছি-সে কি আর মনে রাখা যায় ! এ বয়সে সব কথা আর মনে থাকে কি? দেখি, আমার মেয়ের যদি মনে থাকে-সে নিজের হাতেই এই ওড়্নায় রেশমের ফুল তুলেছে|”
এই বলিয়া করিমের মা মেয়েকে ডাকিল| মেয়ে ঘরের ভিতরে জানালার ধারে বসিয়া শিল্পকার্য্যে মনোনিবেশ করিয়াছিল; তখন উঠিয়া আসিল| মেয়ে সেই ওড়্না দেখিয়া তৎক্ষণাৎ চিনিতে পারিল, এবং সে নিজের হাতে সেই ফুল তুলিয়াছে, বলিল|
মেয়ের বয়স ত্রিশ বৎসরের কম নহে| তাহারও মহিমের মা কি জালিমের মা-এই রকমেরই একটা কিছু নাম হইবে| তাহার নামে আমাদিগের বিশেষ কোন প্রয়োজন নাই| করিমের মা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করিল, “এই ওড়্নাখানি কে তৈয়ারী করতে দিয়েছিল, মনে আছে কি?”
মেয়ে বলিল, ” সে আজকের কথা কি? প্রায় সাত-আট মাস হ’ল, একজন বাইজী এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করতে দিয়েছিল|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলের, ” কে সেই বাইজী, নাম কি?”
“লতিমন বাইজী|”
‘কোথায় থাকে?”
” বামুন-বস্তিতে| সেখানে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে আপনি সবই জানতে পারবেন| আমার ঠিক মনে পড়্ছে এ নিশ্চয় সেই লতিমন বাইজীর ওড়্না|”
“আর তার দেখা পাওয়া যাবে না; সে আর নাই|”
“নাই কি ! কোথায় গেল?”
“যেখানে সকলে যায়-সকলকে যেতে হবে| লতিমন মরিয়াছে|”
“সে কি ! কবে-কি হইয়াছিল?” বলিয়া করিমের মা চকিতে উঠিয়া দাঁড়াইল|
দেবেন্দ্রবিজয় সেই ওড়্খানি পুনরায় নিজের হাতে লইয়া কহিলেন, ” এই ওড়্না যদি লতিমনেরই হয়, তা’ হলে লতিমন আর এ জগতে নাই| তার মৃত্যু হয়েছে|”
“কি সর্ব্বনাশ|” বলিয়া করিমের মা আবার বসিয়া পড়িল|
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “মেহেদী-বাগানের একটা গলিপথে লতিমনকে কে খুন ক’রে গেছে|”
“কি সর্ব্বনাশ গো ! কে খুন করিল?”বলিয়া করিমের মা বিস্ময়স্থিরনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল|
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” যে খুন করেছে, সে এখনও ধরা পড়ে নাই| যাতে শীঘ্র সন্ধান ক’রে ধরতে পারি, সেইজন্য যে খুন হয়েছে, তার নাম জান্বার চেষ্টায় এখানে এসেছি; আমার সে চেষ্টাও প্রায় সফল হয়েছে, এখন আর একটু চেষ্টা করলেই খুনীকে ধরতে পারব|”
করিমের মা বলিল, “লতিমন বাই যে খুন হয়েছে-তার এখন ঠিক কি? লতিমন এই ওড়্না যদি আর কাকে দিয়ে থাকে-কি আর কারও জন্যে আমাদের এখানে তৈয়ারী করিয়ে থাকে?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এখন আমাকে সেটা সন্ধান ক’রে ঠিক করতে হবে| যখন একটা নাম পাওয়া গেছে, তখন সহজেই সব কাজই শেষ করতে পারব| এখন চল্লেম, দরকার হয় আবার দেখা করব|” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন|