প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.০৬ বাড়ির ভেতরে এসে

বাড়ির ভেতরে এসে দেখা গেল, সাড়া পড়ে গেছে। একেবারে প্রথম যে ঘরখানা সেটা দক্ষিণ দুয়ারী, সেখানে ঢালা ফরাস পাতা। চারখানা হেরিকেন চারদিকে বসানো। ঘরখানা আলোয় ভরে গেছে। একধারে সারি সারি ফরসি সাজানো, জল বদলে এখন তামাক সাজছে যুগল। তার সামনে নারকেল ছোবড়া, তামাকের ডিবে, দেশলাই, কুপি–নানাবিধ সরঞ্জাম।

হেমনাথ সঙ্গীদের নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মাঝি দু’জন মুখ-বাঁধা হাঁড়িগুলো আর মাছটা নামিয়ে তলায় যুগলের কাছে ঘন হয়ে বসল। প্রৌঢ় দু’জন বসল ফরাসের ওপর। বিনু এখনও ছাড়া পায় নি, সেই প্রৌঢ়টির কোলের ভেতর বসে থাকতে হয়েছে তাকে।

হেমনাথ বসলেন না। বললেন, তোরা তামাক টামাক খা মজিদ, আমি জামাইদের খবর দিই।

বিনু দেখতে পেল, যে প্রৌঢ়টি তাকে কোলে নিয়ে বসে আছে সে-ই উত্তর দিল, ঠিক আছে ঠাউরভাই।

এই তা হলে মজিদ মিঞা। কেতুগঞ্জে এঁর বাড়িতেই দাদু ও বেলা গিয়েছিলেন।

হেমনাথ আর কিছু বললেন না, ভেতর-বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

খানিক পর অবনীমোহন সুরমা সুধা সুনীতি–সবাইকে নিয়ে ফিরে এলেন হেমনাথ। স্নেহলতা আর শিবানী আসেন নি, রান্নাঘরে নানা কাজে তারা ব্যস্ত।

সবার সঙ্গে আগন্তুকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। মজিদ মিঞা ছাড়া আরেকজন যে প্রৌঢ় এসেছে তার নাম হাসেম আলি-মজিদ মিঞার বোনাই সে।

অবনীমোহনদের দেখে কী করবে যেন ভেবে পেল না মজিদ মিঞা। মুঠোয় বুঝি আকাশের চাঁদই পেয়ে গেছে। অবনীমোহনের একখানা হাত ধরে উচ্ছ্বসিত স্বরে সে বলতে লাগল, আপনেরা আইছেন, আমাগো কি যে সৈভাগ্যি!

অবনীমোহন বললেন, ছি ছি, ও কথা বলবেন না। সৌভাগ্য আমারও কম না। আপনাদের মতো মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল–

মজিদ মিঞা বলল, আমরা আবার মানুষ! দোজখের আন্ধারে (পাতালের অন্ধকারে) পইড়া আছি।

হেমনাথ মাঝখান থেকে বলে উঠলেন, তোমরা এসেছ শুনে মজিদ ছুটে চলে এল। আর এমন পাগল–ওই দেখ তিন হাঁড়ি বোঝাই করে তোমাদের জন্যে মিষ্টি আর মাছ নিয়ে এসেছে।

অবনীমোহন লজ্জিত হলেন, সুরমাও। দু’জনে প্রায় একসঙ্গে বললেন, আবার শুধু শুধু ও সব আনতে গেলেন কেন?

মজিদ মিঞা বলল, ঠাউরভাইয়ের নাতি-নাতনী ভাগনী-ভাগনীজামাই আমারও নাতি-নাতনী ভাগনী-ভাগনীজামাই। তাগো কিছু খাওয়াইতে বুঝিন সাধ হয় না?

এর ওপর আর কথা চলে না, অবনীমোহনরা অভিভূতের মতো তাকিয়ে রইলেন।

হেমনাথ যুগলকে বললেন, মাছ-মিষ্টিগুলো ভেতরে দিয়ে আয়।

যুগল হাঁড়িটাড়ি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। একটু পর ফিরে এসে জানালো, স্নেহলতা মজিদ মিঞাদের রাতে খেয়ে যেতে বলেছেন।

মজিদ মিঞা হাসল, খাইয়া তো যামুই। আমার ঘেটিতে (ঘাড়) কয়টা মাথা যে এই বাড়িত আইসা ভাবীর হাতের ভাত ব্যান্নন (রান্না তরকারি) না খাইয়া যাই! যা যুগইলা, হাকিমেরে কইয়া আয়, তেনার হুকুম অমাইন্য করার সাইদ্য আমার নাই।

বোঝা গেল, এ বাড়িতে আরও অনেক বার এসেছে মজিদ মিঞা এবং যুগলকে খুব ভাল করেই চেনে। আরও টের পাওয়া গেল, এ সংসারের সবার হৃদয়ের একেবারে মাঝখানটিতে তার আসন পাতা।

হঠাৎ অবনীমোহনের কী মনে পড়ে গেল। আস্তে করে হেমনাথকে ডাকলেন, মামাবাবু—

 হেমনাথ মুখ ফিরিয়ে তাকালেন, কী বলছ?

কী একটা দাঙ্গার মীমাংসা করে দিতে না গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

সেটা মিটেছে?

হাসতে হাসতে হেমনাথ বললেন, মজিদকে জিজ্ঞেস করে দেখ না–

মজিদ মিঞা শুনছিল। জিজ্ঞেস করার আগেই বলে উঠল, নবু গাজীর লগে আমার চাইর বচ্ছরের কাইজা এক কথায় মিটাইয়া দিছেন ঠাউরভাই। অ্যামন মীমাংসা করছেন যে কুনোকালে আর কাইজা হইব না।

অবনীমোহনের কৌতূহল শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল। শুধোলেন, কিরকম?

আমার মাইয়ার লগে নবু গজীর পোলার বিয়া ঠিক কইরা দিছেন ঠাউরভাই। মাঘ মাসে ধান কাটার পর বিয়া হইব। নবু শালায় আমার মাইয়ার হউর (মেয়ের শ্বশুর) হইব। আপনেই কন, তার লগে চর লইয়া মারামারি আর মানায়? একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, ঠাউরভাই অ্যামন। ব্যবোস্তা কইরা দিলেন যে মুখ চিরটা কালের লেইগা বন্ধ। নাইলে শালারে কি ছাড়তাম? সড়কি দিয়া এফোড় ওফোড় কইরা ফালাইতাম।

ভাবী বেয়াই সম্বন্ধে এ জাতীয় সদিচ্ছায় অবনীমোহনরা হেসে ফেললেন।

মজিদ মিঞা আবার বলল, হে যাউক, মাইয়ার বিয়ার সোময় আপনেগো কিন্তুক যাইতে হইব। আপনেরা হইবেন মাইয়াপক্ষের কত্তা। নবু শালায় তো বরযাত্ৰ আনব কতগুলান চউরা চাষা (চরের চাষা)। শালারে দেখাইয়া দিমু, আমার আপনজনেরা কী দরের মানুষ, আর তার জ্ঞাতগুষ্টিই বা ক্যামন!

অবনীমোহন বললেন, কিন্তু–

কী?

আপনার মেয়ের বিয়ে তো সেই মাঘ মাসে, ধানকাটার পর। ততদিন আমরা এখানে থাকব না।

থাকবেন না? বেশ নিরাশ হয়ে পড়ল মজিদ মিঞা। তারপর হাতের ভেতর মুশকিল আসানটা যেন পেয়ে গেছে, এমন সুরে বলল, হেইতে কি, কইলকাতায় একখান টেলি কইরা দিমু, চইলা আইবেন। আইতেই হইব।

অবনীমোহন আগেই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। মজিদ মিঞার আন্তরিকতা তার প্রাণে তরঙ্গ তুলে গেল। বলল, আসব, নিশ্চয়ই আসব। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি উৎসব লাগলে না এসে পারা যায়?

কোল থেকে বিনুকে নামিয়ে অবনীমোহনের কাছে আরও নিবিড় হয়ে এল মজিদ মিঞা। একরকম তাকে জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগের সুরে বলল, এই একখান কথার লাখান (মতো) কথা কইছেন আত্মীয়স্বজন।

আবেগটা এ ঘরের অন্য সবাইকেও স্পর্শ করেছিল। সমস্বরে সকলে সায় দিল, এ একটা কথার মতো কথা বটে।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর মজিদ মিঞা বলল, আমার একখান সাধ আছে।

অবনীমোহন জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।

মজিদ মিঞা বলল, চরের দুই কানি জমিন লইয়া নবু গাজীর লগে চাইর বচ্ছর আমার কাইজা। আপনেরাও আইলেন, আর আইজই কাইজটা মিটা গেল। আমার সাধ আপনের লগে মিতা পাতাই।

অবনীমোহন সবটা বুঝতে পারেন নি, অনুমানে ভর করে বললেন, বন্ধুত্ব করতে চাইছেন?

হ। করুণ মিনতিপূর্ণ চোখে এমনভাবে মজিদ মিঞা তাকাল যাতে মনে হয়, অবনীমোহনের বন্ধুত্ব না পেলে তার জীবন নিষ্ফল হয়ে যাবে। অবনীমোহনের একটা আঁ’ বা না’র ওপর তার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।

প্রৌঢ় মানুষটির শিশুর মতো আচরণ, সরলতা, বন্ধুত্বের জন্য কাঙালপনা, সব একাকার হয়ে অবনীমোহনকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। বললেন, আপনি বন্ধু হতে চাইছেন, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।

মিতা হইবেন, কথা দিলেন কিলাম (কিন্তু)—

হ্যাঁ।

পাকা কথা।

পাকা কথা বৈকি। অবনীমোহন হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন।

এইর লেইগাই কিন্তুক কেতুগুঞ্জ থিকা অ্যাতখানি পথ এই রাইতে আইছি।

শুধুমাত্র তার বন্ধুত্বের আকাঙ্ক্ষায় একটি মানুষ এত রাতে এতটা পথ চলে এসেছে, যত বার ভাবলেন তত বারই অবাক হয়ে গেলেন অবনীমোহন।

যাই হোক, তারপর শুরু হল গল্প। সুধার সঙ্গে, সুনীতির সঙ্গে, সুরমার সঙ্গে কত কথা যে বলতে লাগল মজিদ মিঞা। কথায় কথায় রাত ঘন হতে লাগল।

একসময় ভেতর থেকে স্নেহলতা খবর পাঠালেন, রান্না শেষ।

এই ঘরেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হল। হাসেম আলি, মজিদ মিঞা এবং মাঝি দু’জনের জন্য আসন পাতা হয়েছে। হেমনাথ হঠাৎ বললেন, আমাকেও এখানে ওদের সঙ্গে দিয়ে দাও, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে।

অবনীমোহন বিস্মিত, চমকৃত। উনিশ শ’ চল্লিশে ব্রাহ্মণ-শূদ্র-বৈশ্য-হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি ইত্যাদি নানা ভাগে, অগণিত ছোট ছোট স্পর্শকাতর কুঠুরিতে বসুন্ধরা যখন খণ্ড খণ্ড হয়ে আছে তখন মজিদ মিঞা হাসেম আলির গা ঘেঁষে খেতে বসা দুঃসাহস বৈকি।

হেমনাথ বললেন, অবনীমোহনও বসে যাও না। মিতাই তো হলে মজিদের, একসঙ্গে খেতে বসে বন্ধুত্বতা পাকা করে নাও।

ঘোরের ভেতর থেকে অবনীমোহন বললেন, বেশ তো–

অতএব আরও তিনখানা আসন এল। হেমনাথ বসলেন, অবনীমোহন বসলেন, বিনুও বসল। মেয়েরা অবশ্য কেউ বসল না।

খাওয়াদাওয়ার পর মাঝরাত্তিরে পুকুর পেরিয়ে ধানখেতের ওপর দিয়ে কেতুগঞ্জ চলে গেল মজিদ মিঞা।

বিকেলবেলা ভবতোষ গাঢ় বিষাদের ছায়া নিয়ে এসেছিলেন। মেঘের পর রৌদ্রঝলকের মতো মজিদ মিঞা এ বাড়িটাকে আবার আলোকিত করে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *