তিনটে বছর গায়েব করেও বিরাজকে আর বারোর কোঠায় রাখা যাচ্ছিল না। দেখতে ছোটখাটো, বয়সের বাড়বাড়ন্ত নেই বলেই যে পাড়াপাড়শীর চোখে ধুলো দিয়ে চালানো যাবে, এ আশা একটু বেশি আশা।
সেদিন তো এক প্ৰিয়সঙ্গিনীর সঙ্গে বন্ধু-বিচ্ছেদই ঘটে গেল। মুক্তকেশী তার কাছে আক্ষেপ জানাচ্ছিলেন, ছেলেরা তো আপিস আর তাসপাশা নিয়েই মগ্ন, বোনটার বিয়ের কথা মনেও আনে না, আমারই হয়েছে জ্বালা। একটা পাত্তর-টাত্তরের সন্ধান দাও না ভাই, গলা দিয়ে ভাত নামছে না যে। বারো বছর পার হয় হয় মেয়ে-
হয়ে গেল উল্টো উৎপত্তি। বান্ধবী বলে বসলেন, এখনো বারো পার হয় হয়? মেয়ে কি তোমার উল্টো দিকে হাঁটছে সুবোধের মা? পাঁচ বছর আগে তো শুনেছি। রাজু দশে পা দিয়েছে—!
মুক্তকেশী প্রথমটা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন, তারপরই অবশ্য নিজমূর্তি ধরলেন। বান্ধবীকে বাবার বিয়ে-খুড়োর নাচন দেখিয়ে দিয়ে বন্ধুত্বের মূলে কুঠারাঘাত করে চলে এলেন। কিন্তু মনের মধ্যে তো আগুনের দাহ।
আবার একদিন মুক্তকেশীর এক জ্ঞাতি ননদ বেড়াতে এসে বলে বসলেন, কোলের মেয়ে বলে বুঝি কাছছাড়া করবি না। নবৌ, মেয়েকে বীজ রাখবি? বলি রাজি যে পাড় হয়ে উঠল!
রসনার ধার সম্পর্কে মহিলাটির খ্যাতি আছে। মুক্তকেশীকে তিনি হেলায় জয় করতে পারবেন এ কথা মুক্তকেশীর অজানা নয়। তাই এক্ষেত্রে মুক্তকেশী অন্য পথ ধরলেন। অভিমানের গলায় বললেন, তা তোমরা পিসিরা থাকতে যদি মেয়ের বিয়ে না হয়, আমি আর কি করবো ঠাকুরঝি? চোদ্দপুরুষ নরকস্থ হলে তোমার গিয়ে বাপ-ঠাকুর্দার বংশই হবে, আমার নয়। তোমরাই বোঝ।
অতএব কলহ এগোল না, ননদ মুক্তকেশীর ছেলেদের নিন্দাবাদ করে বিদায় নিলেন।
কিন্তু তারপর ঝড় উঠল। অবিচ্ছিন্ন ঝড়।
মুক্তকেশীর সংসারে সেই ঝড়ের ধাক্কায় তোলপাড় হতে থাকলো। বিরাজ তো মার সামনে বেরোনোই ছেড়ে দিল, কারণ তাকে মাঝে রেখেই তো মার যত বাক্যি-বুলি!
প্ৰবোধ-সুবোধও মার সর্ববিধ কটুক্তি নীরবে গলাধঃকরণ করে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে, উমাশশী সর্বদাই তটস্থ, এমন কি মুখরা সুবৰ্ণও মার মনপ্ৰাণ ভাল নেই ভেবে চুপচাপ আছে।
এহেন পরিস্থিতিতে সহসা আগুনে জল পড়ল। বড় মেয়ে সুশীলা এসে হাজির এক সম্বন্ধ নিয়ে। বিদ্বান ছেলে, রূপে কাৰ্তিক, অবস্থা ভাল, তারা এই সালেই বিয়ে দিতে চায়, কারণ সামনে অকাল পড়ছে। তবে হ্যাঁ, একটু খাই আছে। ফুলশয্যার তত্ত্ব, দানসামগ্ৰী, বরাভরণ, নমস্কারী, ননদঝাঁপি, কনের গা-সাজানো গহনা ইত্যাদি সর্ববিধ সৌষ্ঠবের ওপর আবার তিনশো টাকা নগদ।
নগদের সংখ্যাটা শুনেই আঁতকে উঠলেন মুক্তকেশী।
তিন-তিনশো টাকা নগদ বার করা কি সোজা?
ঘরখরচা, বরযাত্রী-কনেযাত্রী খাওয়ানো, এসবও তো আছে?
মেয়ের ওপর বিরূপ হলেন মুক্তকেশী। বেজায় গলায় বললেন, খুব যা হোক সম্বন্ধ আনলি! তোর ভাইদের বুঝি রাজা-রাজড়া ভেবেছিস? এখনো বলে বাড়ির দেনাই শোধ হয় নি!
সুশীলা এর জন্য প্ৰস্তৃত ছিল।
সুশীলার ভাঁড়ারে তাই যুক্তি মজুত ছিল।
ধার-দেনা আবার কোন গোরস্তটাকে করতে না হয়? কন্যেদায় উদ্ধার করতে ধার-দেনা করা তো চিরাচরিত বিধি। এমন সোনার পাত্ৰ হাতছাড়া করলে, এরপর মাটির পাত্রে মেয়ে সপতে হবে। আর তার মানেই চিরটাকাল মেয়েকে টানা।
এই যে তিন তিনটে মেয়েকে পার করেছেন মুক্তকেশী, ভাল ঘরে বরে দিয়েছেন বলেই না। নিশ্চিন্দি আছেন—ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ যুক্তির জালে বন্দী করতে চায় সুশীলা মাকে।
তা মুক্তকেশীরই কি আর মন ঝোঁকে না সোনার পাত্রের দিকে? তবু আরও বোজার গলায় বলেন, বুলে দেখে ড়োমার ভাইদের। আমার কোঁচড়ে তো আর টাকার কঁড়ি জুমানো নেই, যে বুকের পাটা করে হ্যা করবো? মেয়ে তো তালগাছ হয়ে উঠছে, দেখি আর ক্যাপি!
তা ভাইদের বলে দেখে সুশীলা।
বুদ্ধিমতী মেয়ে বেশ মোক্ষম সময়েই কথাটা পাড়ে। চার ভাই যখন সারি দিয়ে খেতে বসেছ বড় বড় কাঠালিকাঠের পিঁড়ি পেতে, সামনে মা বসেছেন। পাখা হাতে করে, বৌমা ধারে কাছে ঘুরছে। নুনটুকু লাগবে কি না জানতে, তখন মায়ের হাত থেকে পাখ্যাখানা নিয়ে নাড়তে নাড়তে সুশীলা বলে ওঠে, হ্যাঁ রে, তা রাজুর বিয়ের কী করছিস তোরা?
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সে প্রসঙ্গের ধুয়ো তুলে ঢালে খাঁড়ায় হয়ে আছেন মুক্তকেশী, দিদির মুখেও কি না সেই প্রসঙ্গ!
সন্দেহ কি যে মারই শিক্ষা!
কিন্তু সে সন্দেহ তো ব্যক্ত করা যায় না। সুবোধ থালায় আঁক কাটতে কাটতে বলে, খুঁজছি। তো। তেমন মনের মতন পাচ্ছি। কাই! যা তা ধরে তো আর-
আহা-হা, তাই বা দিবি কেন? ভাল পাত্তর আমার হাতে আছে। তবে খাই একটু বেশি।
হ্যাঁ, একঝোঁকে বলে ফেলাই ভাল। বিরুক্তি বা বাদ প্রতিবাদের পথ থাকে না।
শব্দটা কী ভয়াবহ!
যেন হাঁ করে খেতে আসছে।
সুবোধের মুখ শুকিয়ে যায়, খাঁই মানে? কত খাঁই?
কত সেকথা শুনে সুবোধের মুখ আরো শুকোয়। গলা ঝাড়া বলে, অত খাঁই হলে— মানে, আমাদের তো এখন হাতে কিছু নেই—
বোনের বিয়ে তাহলে শিকেয় তোলা থাক—, মুক্তকেশী ঠাণ্ডা পাথুরে গলায় বলেন, হাতে যখন টাকা নেই তোমাদের, বলবার কিছু নেই। তবে শাস্তরে ভগ্নীদায় আর কন্যাদায়কে সমানই বলেছে।
কোন শাস্তরে বলেছে। এ কথা, সে প্রশ্ন তোলে না মুক্তকেশীর ছেলেরা। এ কথাও তোলে না, না বুঝে সুঝে বুড়ো বয়স অবধি সংসার বাড়াতে তোমায় বলেছিল কে বাপু? তোমার নির্বুদ্ধিতার দায় আমাদের পোহাতে হবে এমন কি বাধ্যবাধকতা?
না, তোলে না। এসব কথা, শুধু অক্ষুটে বলে, না, মানে গহনাটাও গা সাজানো চাইছে কিনা। এদিককারও সব আছে, তার ওপরে নগদ-
হঠাৎ রান্নাঘরে শেকলটা নড়ে ওঠে।
সাঙ্কেতিক ঘণ্টা!
সুশীলাই পাখ্যাখানা নামিয়ে উঠে যায়, আর পরীক্ষণেই হাস্যবিদনে এসে বলে, ওই শোনো, হয়ে গেল সমিস্যের সমাধান! মেজ বৌ বলছে, গহনার জন্যে ভাবতে হবে না তোমাদের!
ভাবতে হবে না!
চার ভাই-ই একটু সচকিত হয়। যেন ঠিক অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু মুক্তকেশী পারেন, সঙ্গে সঙ্গে একগাল হেসে বলে ওঠেন, বুঝেছি। নির্বুদ্ধির ঢেঁকি নিজের গয়নাগুলো খয়রাৎ করবে। বোকা হবো হলে কি হয়, মনটা ওর বরাবরই উঁচু।
এই সেদিনই ভিখিরিকে একখানা পুরনো কাপড় দিয়ে ফেলার অপরাধে যে ওই বৌয়ের দরাজ মেজাজের খোঁটা তুলে, নাকের জলে চোখের জলে করেছিলেন তাকে, তা অবশ্য মনে পড়ে না।
মেজ বৌয়ের উঁচু মনের পরিচয়ে ছোট দুই ভাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাতের চুড়োয় গর্ত করে ডাল ঢেলে সাপটিাতে থাকে, বড় ভাই মাথাটা নিচু করে ভাতটা নাড়াচাড়া করতে থাকে এবং মেজ ভাই প্ৰচণ্ড রাগকে সংহত করতে বড় বড় গ্রাস তুলতে থাকে মুখের মধ্যে তার ওপর।
অসহ্য!
অসহ্য এই সর্দারী!
স্বামীর অনুমতি নেওয়া দূরে থাক, স্বামীর সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নেবারও দরকার বোধ করল না! ভেবেছে কি ও?
প্ৰশংসা কুড়োবেন?
প্ৰশংসা কুড়িয়ে পেট ভরবে?
ঐদিকে তো আচার-আচরণের দোষে নিন্দেয় গগন ফাটিছে! কই তার বেলায় তো ইচ্ছে হয় না, বড় বৌয়ের মতন শান্তশিষ্ট হয়ে সুখ্যাতি কিনি!
ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবেন!
চাদির ছুঁচ দিয়ে লোকের মুখ সেলাই করে দেবেন!
রাগে হাত-পা কাঁপতে থাকে প্ৰবোধের। সুশীলার অবশ্য এ ভাবান্তর চোখ এড়ায় না, তবে সুশীলা সে কথা তুলে আর ব্যাপারটাকে উদঘাটন করতে চায় না। তাড়াতাড়ি ভাইদের পাতের কাছে দুধের বাটিগুলো এগিয়ে দিয়ে গুড়ের বাটিটা নিয়ে আসে।
প্ৰবোধ একটা সুযোগ পায়, প্ৰবোধ এই ছুতোয় মনের উত্তাপ প্রকাশ করে বসে। দুধের বাটিটা বঁ হাতে ঠেলে দিয়ে বলে, লাগবে না, সরিয়ে নাও।
ওমা সে কী, কেন? পেট ভাল নেই?
পেট খারাপ শত্রুর হোক- প্ৰবোধ থমথমে গলায় বলে, এসব বাবুয়ানা ছাড়তে হবে এবার!
সুশীলা বুঝেও না বোঝার ভান করে, ফিকে গলায় বলে, হঠাৎ বাবুয়ানা কি দোষ করল!
প্ৰবোধ গুজগুঁজে গলায় বলে, যাদের এক পয়সার সংস্থান নেই, এক কথায় মেয়েদের গায়ের গহনায় হাত পড়ে, তাদের এমন দুধ ক্ষীর খাওয়া মানায় না।
বলে ফেলেই অবশ্য ঘাড়টা গুঁজে যায় প্ৰবোধের, কারণ ঠিক এমন স্পষ্টাস্পষ্টি কিছু বলে ফেলার ইচ্ছে তার ছিল না, চোরা গোপ্তা একটু ইশারা দিতে চেয়েছিল, হল না।
মায়ের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় বুকটা হিম হয়ে গেল তার। এরপর আর কি ও গহনা ছোঁবেন মুক্তকেশী?
কিন্তু মুক্তকেশী কি সুবৰ্ণলতা?
তাই অভিমানভারে সুবিধে-সুযোগ পণ্ড করবেন? না, সুবৰ্ণলতার মত বোকা নয় মুক্তকেশী। মুক্তকেশী। তাই তেতো গলায় বলে ওঠেন, তা ওই দুধ টুকু সরালেই সব সমিস্যের মীমাংসা হবে? না ওই বাঁচানো দুধ টুকু পুনরায় গরুর বাঁটে উঠে গিয়ে আবার পয়সা ফিরিয়ে আনবে? বাড়িতে কন্যেদায় উপস্থিত হলে, ঝি-বৌয়ের গহনায় হাত পড়ে না। এমন রাজার সংসার কাটা দেখেছিস তুই? মেজ বৌমা নিজে মুখ ফুটে বলেছে, সেইটুকুই আহ্লাদের, নইলে দরকারের সময় ছলে বলে কৌশলে নিতেই তো হতো! দিতে চেয়ে খুব একটা মহত্তর কিছু করে নি মেজ বৌমা। বড় বৌমারও থাকলে দিত।
অর্থাৎ প্ৰবোধের ঠেস দেওয়া কথার ফল হলো এই। সুবৰ্ণলতার মহত্ত্ব, উদারতা সব কিছুই এখন তৃতীয় বিভাগে পড়ে গেল, সুবৰ্ণলতার উঁচু মনের পরিচয়টা ধামাচাপা পড়ে গেল, সুবৰ্ণলতার সুখ্যাতিটা মাঠে মারা গেল।
মুক্তকেশী অতঃপর বসে বসে ফিরিস্তি দিতে লাগলেন এহেন ঘটনা আর কবে কোথায় দেখেছেন এবং কী রকম সোনাহেন মুখ করে সেই সব বৌরা গা থেকে গহনা খুলে দিয়েছে ননদের বিয়েতে, ভাশুরবির বিয়েতে।
তবে?
সবৰ্ণলতা কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নি সুবৰ্ণলতা এত কিছু বাহাদুরি দেখায় নি। সুবৰ্ণলতার মনটাকে যে উঁচু মন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন মুক্তকেশী, সে কেবল মুক্তকেশীর নিজের মন উঁচু বলে।
কিন্তু সুবৰ্ণলতার সেই মনের স্বীকৃতি কি রইল? বিরাজের গায়ে-হলুদের দিন যখন মুক্তকেশী মেজ বৌমার গহনার বাক্সটি তোরঙ্গ থেকে বার করলেন মেয়েকে সালঙ্কারা করবার জন্যে, তখন কি দর্জিপাড়ার ওই বাড়িটায় একটা বজ্রাপাত ঘটে গেল না?
দোয়াত আছে, কালি নেই।
বাক্স আছে, গহনা নেই।
মুক্তকেশীর ঘরে তোরঙ্গ, মুক্তকেশীর কোমরের ঘুনসীতে চাবি, অথচ মুক্তকেশীর অজানতে সে গহনা হাওয়া!
এ হেন ঘটনায় বিয়েবাড়িতে যতদূর হুলস্থূল হবার তো হয়েছিল বৈকি। বেশি বৈ কম হয় নি, কারণ বিয়েতে মুক্তকেশীর তিন বিবাহিতা মেয়ে এসেছে সপরিবারে, এসেছেন মুক্তকেশীর ভাজ, বোন, মাসতুতো বোন হেমাঙ্গিনী।
সকলে গালে হাত দিয়ে থ!
ভূত না চোর!
চোর যদি তো বাক্সটাসুদ্ধই নেবে, বাক্স খুলে আংটি মাকড়ি মল ইত্যাদি কুচকানো গহনা রেখে দিয়ে, বালা বাজুবন্ধ, চিক, সীতাহার, শাঁখা অনন্ত, পালিশ পাতের চুড়ি ইত্যাদি করে বড় বড় গহনাগুলি বেছে নিয়ে যাবে? এত সময় হবে চোরের?
তা হলে! হুঁ!
রাত-বিরেতে সিঁড়ির ছায়ায় কি উঠোনের ছাঁচতলায় ভূতের দেখা মেলে বলেই যে লোকে গহনা-চোর ভূতে বিশ্বাসী হবে এমন হয় না।
শেষ অবধি। তবে ঘরের মানুষ!
কে সেই মানুষটি?
কোন ঘরের?
মুখ মুখে কথা ফেরে, কথা কানে ইটে। অনেক কান ঘুরে সুবৰ্ণলতার কানে এসে পৌঁছয় উত্তরটা।
আর কে?
যার জিনিস সে।
হ্যাঁ, সে নিজেই। তা ছাড়া আর কি! সুখ্যাতি কিনতে লোক দেখিয়ে দানপত্তরে সই করে বসে হাত-পা কামড়ে মরছিল, অতএব তলে তলে পাচার। বাপের বাড়ি যাওয়া-আসা নেই! তাতে কি, এ বাড়িরই আনাচেকানাচে কোথাও সরিয়ে রেখেছে, পরে তাক বুঝে ব্যবস্থা করবে। দিয়ে ফেললে তো হাতছাড়া গোত্তরছাড়া!
সরিয়েছে কখন?
মৃত্যুর আবার ভাবনা কি, গঙ্গায়ানে যান না মুক্তকেশী। তাসের আড্ডায়?
চাবি?
সে অমন পাঁচটা চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ফেলা যায়। ভাঁড়ারের বাসনের সিন্দুকের মরচেধরা তালাটা খুলে দেয় নি সেদিন সুবৰ্ণলতা?
খুলে দিয়ে বাহাদুরী নেয় নি?
পান সাজিছিল সুবৰ্ণলতা, কাছে এসে কানে ঢেলে দিল। একজন কথাটা।
সুবৰ্ণলতা দাঁড়িয়ে উঠল।
বলল, কি বললে?
ও বাবা, এ যে নাগিনীর মত ফোঁস কর ওঠে গো! আমি বলি নি বাবা, বলেছে তোমারই শাশুড়ী।
কোথায় তিনি?
আরক্ত মুখ আগুনের মত গানগনিয়ে ওঠে, সামনে এসে মুখোমুখি বলবার সাহস হল না বুঝি?
জানি না। বাবা, তোমাদের কথা তোমরা জানো বলে জ্ঞাতি ননন্দ পালায়। ভেবেছিল কথাটা নিয়ে জ্ঞাতি জেঠির একটু নিন্দেবাদ করবে, ব্যাপার দেখে থেমে গেল, সরে পড়ল।
কিন্তু সুবৰ্ণলতা কি থেমে থাকবে?
সুবৰ্ণলতা কি তার মা সত্যবতীর রক্তে-মাংসে তৈরি নয়? যে সত্যবতী কখনো মিথ্যার সঙ্গে আপোস করে চলতে পারে নি, কখনো অন্যায় দেখে চুপ করে থাকে নি?
সুবৰ্ণলতা সেই একবাড়ি লোকের সামনে মুক্তকেশীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। বলল, গহনা হারানোর কথায় কী বলেছেন??
মুক্তকেশী তাঁর মেজবৌমার অনেক মূর্তি দেখেছেন, কিন্তু ঠিক এ মূর্তিটি বোধ হয় দেখেন নি, তাই ফিসে গলায় বলেন, কী আবার বলবো?
বলেন নি, আমি সরিয়ে ফেলেছি?
মুক্তকেশী গালে হাত দেন, ওমা শোনো কথা! তোমার জিনিস, তুমি বলে কত আহ্লাদ করে ছোট ননদকে দেবে বললে, তোমায় ও কথা বলতে যাব কেন? ছিছি, আমি পাগল না। ভূত!
নিজের অভিনয়-ক্ষমতায় নিজেই প্রীত হন মুক্তকেশী।
সুবৰ্ণলতা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে, তবে যে রঞ্জা ঠাকুরঝি বলল?
মুক্তকেশী কথাটা লুফে নেন।
উদাস গলায় বলেন, তা তো বলবেই, জ্ঞাতি শতুর যে! জ্ঞাতির মুখেই এমন কথা শোভা পায়!
তবে আপনি কাকে সন্দেহ কর্চ্ছেন?
সন্দেহ আর কাকে করবো বাছা, করি আমার আদেষ্টকে! গহনার জন্যে এখন শ্বশুরবাড়িতে কত খোয়ার হয় দেখা মেয়েটার!
হবে বললেই তো হয় না— সুবৰ্ণলতা তীব্ৰস্বরে বলে, বার করতে হবে গহনা!
ওমা, বার করবো কোথা থেকে? হদিস জানি?
মুক্তকেশী হদিস জানেন না, কিন্তু মুক্তকেশীর বৌ সে হদিস বার করে ছাড়বে! মুক্তকেশীর ঘোমটা দেওয়া বৌ ঘোমটা মুখে সকলের সামনে মুখ তুলে চেঁচিয়ে ওঠে, আপনার ছেলে কই, মেজ ছেলে?
ওমা কী সর্বনেশে কথা, তাকে কী দরকার?
আছে দরকার।
তা এই একবাড়ি লোকের সামনে ডেকে কথা কইবে নাকি তুমি তার সঙ্গে?
কইব। কইতেই হবে। খুদু ডেকে আনো তো তোমাদের মেজদাদাবাবুকে।
চটি জুতোর শব্দ করতে করতে বাইরের ঘর থেকে ভিতরে এল প্ৰবোধ। অলস আদুরে গলায় শুধোলো, মা, ডেকেছ কেন গো?
মা নয়, আমি!
দর্জিপাড়ার গলির ওই বাড়িটায়। আর একটা বাজ পড়ল।
বুঝিবা এ কাজটা আরো ভয়ঙ্কর, আরো সাংঘাতিক।
মুক্তকেশীর পাশ কাটিয়ে, মুক্তকেশীর সামনে, একবাড়ি লোকের সামনে মুখের ঘোমটা কমিয়ে বরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৌ তীব্ৰ গলায় উচ্চারণ করল, মা নয়, আমি!
প্ৰবোধের মুখটা হঠাৎ অমন পাংশু হয়ে গেল কেন? প্ৰবোধ হুঙ্কার দিয়ে বৌকে থামিয়ে দিতে পারল না কেন? আমন বোকার মত শিথিল গলায় প্রশ্ন করল কেন, তার মানে?
সুবৰ্ণলতা কি সত্যই পাগল হয়ে গেছে? সুবৰ্ণলতা কি ভুলে গেছে সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কাদের সামনে? তা নইলে কি করে সুবৰ্ণলতা তেমনি স্বরেই বলতে পারে, মানে বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছে? গহনাগুলো কোথায় সরিয়েছ?
গহনা? আমি? কিসের গহনা? মানে—ইয়ে সেই গহনা? আমি কি জানি? বাঃ!
প্ৰবোধের জিভ তোৎলার অভিনয় শুরু করে।
কিন্তু মুক্তকেশী কি দাঁড়িয়ে ছেলের এই অপমান সহ্য করবেন?
তা তো আর হয় না।
মুক্তকেশী কনুইয়ের ধাক্কায় বৌকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেন, বাড়তে বাড়তে একেবারে যে আকাশে পা তুলছে মেজবৌমা। কাকে কি বলছো জ্ঞান নেই?
আছে। জ্ঞান ঠিকই আছে।–ধাক্কা খেয়েও নিবৃত্ত হয় না সুবৰ্ণলতা। বলে, খুব তো মাতৃভক্ত ছেলে আপনার, মায়ের পা ছুঁয়ে দিব্যি গালুক না, ও জানে কি না গহনা কোথায় আছে!
বেশ তাই করছি—, প্ৰবোধ মায়ের পা থেকে হাত চারের দূরে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছেড়ে, পা ছয়েই দিব্যি গালছি। ডরাই নাকি? ঐ্যা, এত বড় আস্পর্ধার কথা! আমি চোর, আমি গহনা চুরি করেছি!
চুরি করবে। কেন, সাবধান করেছ-, সুবৰ্ণলতা আরো তীক্ষ্ণ গলায় বলে, পাছে পরের ঘরে দামী জিনিসগুলো চলে যায়। তাই বাধা দিয়েছ। তোমায় চিনি না। আমি? দেব বলেছি বলে যাচ্ছেতাই কর নি তুমি আমায়? ধরে ঠেঙাও নি?
হ্যাঁ, এই চরমতম অপমানের কথা ব্যক্ত করে বসলো সুবৰ্ণলতা। পাছে লোক-জানাজানি হয়ে যায় বলে মার খেয়ে যে টু শব্দটি করে না, তার এই বলে বসাটা আশ্চর্য বৈকি!
এমনই ধৈৰ্যচ্যুতি ঘটলো সুবৰ্ণলতার যে, তার জীবনের এই লজ্জাকর গোপনীয় খবরটা এমন করে উদঘাটিত করে বসলো!
তা সুবৰ্ণলতার চরিত্রে হয়তো ওইটাই ছিল পরমতম ত্রুটি। সুবৰ্ণলতা যখন-তখনই ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে বসতো। সেই অতিক্রম করে বসায় যে নিজেই সে হাস্যাম্পদ হতো, হেয় হতো, সমালোচনার বিষয়বস্তু হতো, তা মনে রাখতে পারত না! সুবৰ্ণলতা যে তার ননদের গায়ে-হলুদের দিন গলায় আঁচল পাকিয়ে মরতে গিয়ে একটা কীর্তি করে বসেছিল, এতে কেউ সুবৰ্ণলতাকে মমতা করেছিল? না কি প্ৰবোধকে নিন্দে দিয়ে সত্যপথে স্থির তার বৌকে বাহবা দিয়েছিল?
মোটেই না। সুবৰ্ণলতাকে শুধু ছি-ছিক্কার করেছে। সবাই। কারণ সুবৰ্ণলতার জন্যে ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল সেদিন।
কী লজা! কী লজা!
মুক্তকেশীই কেন গলায় দড়ি দেন নি সেদিন, এই আশ্চর্য!
আচ্ছা বিরাজের বিয়েটা কি তবে বন্ধ হয়ে গেল?
ইস! পাগল নাকি?
মেয়ের বিয়ে বন্ধ হয়?
মা মরলে তাকে ঘরে শেকল তুলে রেখে দিয়ে লোকে কন্যাসম্প্রদানটা করে নেয়! এ তো তুচ্ছ একটা বৌ বাড়ির!
তা ছাড়া মরেও নি তো!
শুধু কেলেঙ্কারী করেছিল!
একবেলা শুয়ে পড়ে থেকেই তো সেরে গেল তার দুর্বলতা। আবার তো পরদিন উঠে কাজ-কর্ম করতে লাগলো বিয়েবাড়িতে। সবাইয়ের সঙ্গে খেতে বসতেও দেখা গেল মাছ লুচি নিয়ে। শুধু একটু বেশী শান্ত, একটু বেশী স্তব্ধ।
কিন্তু লজ্জিত কি?
আশ্চর্য, লজ্জিত হতে দেখা যায় নি কখনো সুবৰ্ণলতাকে! অথচ জীবনে কম কেলেঙ্কারী তো করে নি। সে! বারে বারে করেছে, যখন—তখন।
বিরাজের বিয়ে হয়ে গেল তা হলে? তবে বুঝি নিরলঙ্কার দেহে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দাঁড়াতে অনেক গঞ্জনা খেতে হয়েছিল বেচারাকে?
না না, গহনাগুলো যে পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত!
অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে পাওয়া গেল। মুক্তকেশীর সেই তেরঙ্গের মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল কাপড়াচোপরের খাজে।
হয়তো গহনার বাক্সটায় চাবি দেওয়া হয় নি! হয়তো অসাবধানে কোনো সময় উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল বাক্সটা।
ঠিক ঠিক সবই পাওয়া গেল।
স্বাস্থ্যবতী সুবৰ্ণলতার দরুণ গায়ে বড় জরির কলকা বসানো মখমলের জামা আর বেগুনী ড়ুরে ভারী জরিদার বেনারসী পরে, সর্বাঙ্গে ঢলঢলে গহনা ঝলমলিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল বিরাজ, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে।
যাবার আগে গোপনে সুবৰ্ণলতার হাত ধরে কেঁদে বলেছিল, এতদিন তোমায় চিনতে পারি নি মেজবৌ, কত লাঞ্ছনার কারণ হয়েছি! তুমি দেবী।
সুবৰ্ণর চোখেও জল ছিল বৈকি। চোখে জল আর মুখ হাসি নিয়ে বলেছিল, যাক, একজন তবু চিনলে আমায়! তবু মনে জানবো ভূ-ভারতে এসে একটু সার্থক হলাম। তা মনে কি আর রাখবে মেজবৌকে? যা সোন্দর বর হল! পৃথিবীই ভুলে যাবে!