এবারের এলেবেলে ডাক্তারদের নিয়ে। কাজেই ভয়ে ভয়ে লিখছি। ডাক্তাররা রাজনীতিবিদদের মতোই সেনসেটিভ। কেউ হা করলেই মনে করে গাল দিচ্ছে। রসিকতা একেবারেই ধরতে পারে না। রসিকতার কারণেই আমার দীর্ঘদিনের ডেনটিস্ট বন্ধু এ, করিমের সঙ্গে আমার কথাবার্তা বন্ধ। এক সন্ধ্যাবেলা তার চেম্বারে দাঁত দেখাতে গিয়ে ডেনটিস্টদের নিয়ে একটা গল্প বললাম। এই গল্প হলো আমার কাল। বন্ধু রেগে অস্থির। গল্পটা এরকম :
এক দাঁতের ডাক্তার খুব সহজেই একটা দাঁত টেনে তুললেন। এত সহজে দাঁত উঠ আসবে তিনি ভাবেননি। রোগীকে বললেন, ব্যথা পেয়েছেন? রোগী বলল, জি-না স্যার।
দাঁত তোলার ব্যাপারটা কত সহজ দেখলেন তো। শুধু শুধু আপনারা ভয় পান।
রোগী টাকাপয়সা দিয়ে চলে গেল। ডাক্তার চিমটা খুলে অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, দাঁত নয় তিনি হ্যাচকা টানে রোগীর আলজিব তুলে নিয়ে এনেছেন!
উন্মাদের পাঠকমাত্রই বুঝতে পারছেন অতি নির্দোষ গল্প। কিন্তু আমার বন্ধু এ করিম সেটা বুঝল না। চোখ-মুখ লাল করে বলল, এটা একটা কথা হলো? কোথায় আলজিবের পজিশন আর কোথায় দাঁতের পজিশন। তাছাড়া আলজিব টেনে তুললেও তো ব্যথা লাগবে। সেখানে তো লোকাল অ্যানসথেসিয়া করা হয়নি।
আমি বললাম, তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন! এটা একটা গল্প। একটা রসিকতা।
রসিকতা মানে? রসিকতার কোন মা-বাপ থাকবে না? যা ব্যাটা, তোর দাঁত আমি তুলব না।
আমি দাঁতের ব্যথায় কো কো করতে করতে ঘরে ফিরলাম এবং প্রতিজ্ঞা করলাম, এই জীবনে দাঁতের ডাক্তারদের নিয়ে কোনো রস করার চেষ্টা করব না। রস করা মানেই হাসানো। হাসানো মানেই দাঁত বের করা। ডেনটিস্টরা এই দাঁত জিনিসটাই সহ্য করতে পারেন না। দাঁত দেখামাত্রই তাদের টেনে তুলে ফেলতে ইচ্ছা করে। সেই তোলা ব্যাপারটাও তারা এক দফায় করেন না। প্রথম দফায় দাঁত ক্লিনিং। দ্বিতীয় দফায় টেম্পোরারি ফিলিং। তৃতীয় দফায় পার্মানেন্ট ফিলিং। চতুর্থ দফায় দন্ত উৎপাটন। পঞ্চম দফায় পাশের দাতে টেম্পোরারি ফিলিং…
পুনঃপৌনিক অংকের মতো ব্যাপার। চলতেই থাকবে যতদিন না মুখ দন্তশূন্য হয়।
বছরখানিক আগে আমার ছোট চাচিকে নিয়ে গিয়েছি এক ডেনটিষ্টের কাছে। চাচি নকল দাঁত নেবেন। ডাক্তার পরীক্ষা-টরীক্ষা করে বলল, সাতটা দাঁত আপনার ভালো। এদের তুলে ফেলে দিলে নকল দাঁত বসানোর খুব সুবিধা হবে। চাচি রাজি নন। হারাধনের সাত সন্তান ধরে রাখতে চান। ডেনটিও ছাড়বে না, সে তুলবেই। হেনতেন কত কথা। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার বললেন, আপনি মুরুব্বি মানুষ। আপনাকে হাফ ফিতে তুলে দেব!
এতে কাজ হলো। অর্ধেক দামে হয়ে যাচ্ছে এই লোভ সামলানো মুশকিল। চাচি তার সাতখানা দাঁত রেখে ফোকলা মুখে ঘরে ফিরলেন।
পাক ডেনটিষ্টের কথা। রেগুলার ডাক্তারদের কথা কিছু বলি। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে করি। একবার এক কিন স্পেশালিস্টের কাছে যেতে হলো। গিয়ে দেখি হুলস্থুল ব্যাপার ইস্কুল খুইলাছেরে মওলা ইস্কুল খুইলাছে। গোটা পঞ্চাশেক রোগী বসে আছে। আমার নম্বর হলো একান্ন। বসে আছি তো বসেই আছি। একটু লজ্জা লজ্জাও লাগছে। কারণ ডাক্তারের বিশাল সাইন বোর্ডে লেখা–চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ। আমার কেবলই মনে হচ্ছে সবাই বোধহয় আমাকে শেষের রোগের রোগী বলেই ভাবছে।
আপনারা সবাই জানেন স্পেশালিস্টের কাছে কেউ একা যায় না। এমন একজনকে নিয়ে যায় যে স্পেশালিস্ট বিশেষজ্ঞ। অর্থাৎ ঢাকা শহরে কোথায় কোন স্পেশালি আহে তা এরা জানেন। কে ভালো কে মন্দ কার কী স্বভাব এসব তাদের নখদর্পণে। আমি যাকে সন্ত নিয়ে গেছি তিনি সম্পর্কে আমার মামা। অত্যন্ত কারিকশা ব্যক্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুরে এসে বললেন, দশ টাকা ঘুষ দিলেই কার্যোদ্ধার হবে। আমি চমকে উঠে বললাম, কাকে ঘুষ দেব, ডাক্তারকে?
আরে না। তার অ্যাসিসটেন্টকে। দশটা টাকা খাওয়ালেই সে তোর একান্ন নম্বর টিকিটকে পনেরো বানিয়ে দেবে। যা তুই দশটা টাকা দিয়ে আয়। আমি মুরব্বি মানুষ, আমার দেওয়া ঠিক হবে না।
ঘুষ কী করে দিতে হয় সেই কায়দা জানা না থাকায় দেওয়া গেল না। ঘুষ নিশ্চয়ই প্রকাশ্যে দেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু যে টাকা নেবে সে বহুলোকের মাঝখানে বসে আছে। গোপনে তাকে টাকা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জুয়েল আইচ সাহেব পারলেও পারতে পারেন।
যাই হোক, একসময় উপস্থিত হতে পারলাম। রোগের লক্ষণ বলা কু করার আগেই ডাক্তার ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিলেন। হাতের চামড়ার যে সাদা দাগের চিকিৎসার জন্যে এসেছি তা দেখাতে গেলাম, তার আগেই দেখি প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ। আমি বললাম, আমার অসুখটা কী? ডাক্তার সাহেব ভারী গলায় বললেন, একশ।
প্রথমে ভাবলাম এটাই বুঝি অসুখের নাম। আমার মামা পেটে খোঁচা দিয়ে বললেন, একশ টাকা দিতে বলছে।
দিলাম একশ টাকা। ডাক্তার একটি চিমটি দিয়ে টাকা নিলেন। হাত দিয়ে ছুঁলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, টাকায় অনেক ময়লা থাকে তো, নানানরকম মাইক্রোঅরগেনিজম, এইজন্যে হাতে দুই না। আপনি আবার অন্য কিছু ভাববেন না।
বেরিয়ে এসে মামাকে বললাম, ব্যাটা তো কিছু দেখলই না। এর ওষুধে কাজ হবে।
মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, কাজ না হলে শখানেক লোক বসে থাকে। গাধার মতো কথা বলিস না তো।
রোগ সম্পর্কে কিছু না জেনেও যে রোগের চিকিৎসা বেশ ভালোভাবেই করা যায় এটা বোধহয় সত্যি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা বলি। আমার রুমমেট জুর, ডায়রিয়া এবং মাথাব্যথায় কাতর। ইউনিভার্সিটির ডাক্তারকে খবর দেওয়া হলো। ডাক্তার এলেন। রুমমেট তখন বাথরুমে (সেই সময় এটাই তার স্থায়ী ঠিকানা)। ডাক্তার সাহেব আমাকেই রোগী ভাবলেন। হা করতে বললেন। আমি তার ভুল ভাঙালাম না। কী দরকার ভদ্রলোককে লজ্জা দিয়ে। অদ্ভুত কাণ্ড, সেই প্রেসক্রিপশন মোতাবেক ওষুধ খেয়ে আমার রুমমেট ভালো হয়ে গেল। ডাক্তারি শাস্ত্রটার প্রতি সেই থেকেই আমরা খুব ভক্তি শ্রদ্ধা। বড়ই রহস্যময় শাস্ত্র।
শুধু চিকিৎসা নয়, চিকিৎসা-সংক্রান্ত সব ব্যাপারই আমার কাছে খুব রহস্যময় মনে হয়। আমার বড় মেয়েটির জন্ডিসের মতো হয়েছে। ডাক্তার বললেন, বিলরুবিন টেস্ট করানো দরকার। এক জায়গায় না করিয়ে দুজায়গায় করাবেন। করলাম দুজায়গায়। এক জায়গায় বলল, জন্ডিস নেই। অন্য জায়গায় বিলরুবিন নাইন পয়েন্ট ফাইভ। যার মানে রোগের কঠিন অবস্থা। ডাক্তার বললেন, থার্ড এক পার্টিকে দিন। দেখি ওরা কী বলে?
আমি থার্ড পার্টিকে দিলাম না। কী দরকার? জন্ডিসের এক মালা এনে গলায় পরিয়ে দিলাম–এই মালা গা বেয়ে নামলেই রোগ সেরে যাবে বলে জতি। দেশের যে অবস্থা তাতে মনে হয় মালা, চাল পড়া, পানি পড়া এইসব আধ্যাত্মিক ওষুধ খুব খারাপ না।
ডাক্তার প্রসঙ্গে চীনদেশীয় একটি গল্প শুনুন। জনৈক চীনের তরুণকে বলা হলো, তোমার এখানে খুব ভালো ডাক্তার কেউ আছেন? চীনাম্যান হাসিমুখে বললেন, যা আছেন। তার নাম ইং চুন!
খুব ভালো ডাক্তার।
জি হ্যাঁ। উনি একবার আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।
কী রকম বলো দেখি।
আমার একবার খুব অসুখ হয়। তখন আমি যাই ডাক্তার লী মাইয়ের কাছে। তিনি আমাকে কী কী সব ওষুধ দেন। সেসব খেয়ে আমি প্রায় মরমর। তখন গেলাম অন্য ডাক্তারের কাছে। তার ওষুধ খেয়ে আরও খারাপ। শেষ পর্যন্ত ইং চুন-এর কাছে।
তিনি তোমাকে নতুন ওষুধ দেন।
জি-না। ডাক্তার ইং চুন তখন দেশে ছিলেন না। কাজেই ওষুধ দিতে পারেননি। এই কারণেই আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি। কাজেই আমি ইং চুনকে খুব বড় ডাক্তার বলি।
বানানো গল্প বাদ দিয়ে একটি সত্যি গল্প বলি। খোদ আমেরিকার হাসপাতালের ডাক্তাররা একবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে স্ট্রাইক করেছিল। হাসপাতাল অচল। রোগীর চিকিৎসা হয় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিসাব করে দেখা গেল স্বাভাবিক অবস্থায় যত রোগী মারা যায়, স্ট্রাইক চলাকালীন অবস্থায় রোগী মারা গেছে অনেক কম। যার মোদ্দাকথা হচ্ছে খোদ আমেরিকাতে চিকিৎসা করেই রোগী বেশি মরে। না করলে মরত না।
এলেবেলে শেষ করার আগে আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাটা বলে নেই। ভদ্রলোক তার স্ত্রীর ইউরিন ডাক্তারের কাছে দিয়ে এসেছেন প্রেগনেন্সি টেস্ট করানোর জন্যে। ডাক্তার টেস্ট করে বললেন, পজিটিভ রেজাল্ট। কনগ্রাচুলেশন, আপনার স্ত্রী গর্ভবতী।
আমার বন্ধু ডাক্তারকে এই মারে তো সেই মারে। কারণ বোতলে করে টিউবওয়েলের পানি নিয়ে গিয়েছিল। তার উদ্দেশ্য এই ক্লিনিকের টেস্টগুলি কেমন তা আগেভাগে যাচাই করে নেওয়া। আমার বন্ধু রাগে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আপনি বলতে চান আমার টিউবওয়েল গর্ভবতী? ডাক্তার দার্শনিকের ভঙ্গিতে বললেন, যা তাই। আমাদের টেস্ট মিথ্যা হতে পারে না। তবে ওই জিনিস কী করে গর্ভবতী হলো তা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমি বলতে পারব না।