প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.০৫ স্নেহলতা ঝিনুকের পিছু পিছু

স্নেহলতা ঝিনুকের পিছু পিছু বড় বড় পা ফেলে ফিটনটার কাছে চলে এলেন। বিনু সুধা হিরণ ছুটে এসেছে। শিবানীও এসেছেন। সুনীতি ফিটন পর্যন্ত আসে নি, ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে নেমেই থেমে গেছে। অবনীমোহন এবং সুরমা ঘর থেকে বেরোন নি, দরজার কাছাকাছি এসে দ্বিধান্বিতের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সবার দৃষ্টি আগন্তুকের দিকে।

বিনু একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। এই তবে ঝিনুকের বাবা!

বয়স কত হবে ভবতোষের? চল্লিশোর্ধ্বে, তবে পঞ্চাশের অনেক নিচে। চুল অযত্নে আর অবহেলায় এলোমেলো, কত কাল যে চিরুনি পড়ে নি! সমস্ত মুখ সাদা-কালো অজস্র অঙ্কুরে ছেয়ে আছে। চোখের কোলে ঘন শ্যাওলার মতো কালচে দাগ, কালো মণির চারধারে যে শ্বেত জমি এখন সেখানে লাল রক্ত যেন জমাট বেঁধে আছে। দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, এই মাত্র শ্মশান থেকে ফিরলেন। তাঁকে ঘিরে দুর্বহ এক শোক রেখায়িত হয়ে রয়েছে।

ঘুম, বিশ্রাম, নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রা–এসবের সঙ্গে বুঝিবা কয়েক যুগ সম্পর্ক নেই ভবতোষের। কেমন এক বিহ্বলতা তাঁকে ঘিরে আছে।

ঝিনুক ছুটে গিয়ে বাবার কোলে উঠেছিল। কলকল করে একসঙ্গে অনেক কথা বলে গেল সে। তার কতক বোঝা গেল, বেশির ভাগ দুর্বোধ্য। তবে বলার সুরে অভিমান আর রাগ যে জড়ানো, সেটুকু অনায়াসে টের পাওয়া গেল।

যেটুকু বোঝা গেছে তা এইরকম। ঝিনুক বলেছে, তুমি বললে মা’কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ঢাকায় যাচ্ছ। যাবে আর আসবে। এক মাস দুমাস হয়ে গেল, তুমি আর আসো না।

ভবতোষ মলিন হেসেছেন, এক মাস দু’মাস কি রে, গেলাম তো পরশু বিকেলবেলা।

মা কোথায়?

ঝাঁপসা, ভারী স্বরে ভবতোষ বললেন, হাসপাতালে রেখে এসেছি।

কবে আসবে?

চার পাঁচ দিন পরে নিয়ে আসব।

ঝিনুকের সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকই দিয়ে গেছেন ভবতোষ, তবে কেমন যেন শ্বাসরুদ্ধের মতো। গলার কাছের মোটা মোটা রক্তবাহী শিরাগুলো অস্বাভাবিক স্ফীত হয়ে উঠেছে। চোখ ফেটে হয়তো। বা ফিনকি দিয়ে রক্তই ছুটবে।

বাতাসে কদম ফুলের রেণুর মত যে ফিনফিনে ইলশেগুঁড়ি উড়ছিল, এখন আর তা নেই। তার বদলে শরতের ঝিরঝিরে বৃষ্টি আবার শুরু হয়ে গেছে।

স্নেহলতা বললেন, ঘরে চল ভব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজে নেয়ে যাবে।

আবার ঘরে যাব? আমি বরং ঝিনুককে নিয়ে এখন যাই। পরে আসব’খন।

ঝিনুককে নেবার জন্যেই ছুটে এসেছ নাকি?

হ্যাঁ, মানে–

সেজন্যে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। স্নেহলতা বলতে লাগলেন, তুমি ঘরে এস তো। উঠোন পর্যন্ত এলে, ঘরে গিয়ে না বসলে আমাদের খুব খারাপ লাগবে।

মৃদু স্বরে ভবতোষ বললেন, আচ্ছা, চলুন–

এমনভাবে কথাগুলো বললেন ভবতোষ, যাতে মনে হয়, নিজের ইচ্ছায় তিনি চলেন না। হয়তো নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা তার ওপর ক্রিয়া করে না। অন্যের খুশিতে তাঁর চলাফেরা, ওঠাবসা। সমস্ত কিছুই অন্যের তাড়ায়, অন্যের নির্দেশে।

অবনীমোহনরা যেখানে আছেন সেই ঘরটার দিকে পা বাড়ালেন স্নেহলতা। অন্য সবাই তাকে অনুসরণ করল।

যেতে যেতে স্নেহলতা শুধোলেন, ঢাকা থেকে কখন ফিরলে ভব?

ভবতোষ বললেন, খানিক আগে। বাড়ি ফিরেই আপনাদের এখানে চলে এসেছি।

নারায়ণগঞ্জ থেকে কখন স্টিমার ধরেছ?

দশটা নাগাদ।

চান-খাওয়া নিশ্চয়ই হয় নি?

স্টিমারে মিষ্টি টিষ্টি খেয়েছিলাম।

মিষ্টি খেলে কখনও চলে? তোমার বাড়িতে তো রান্নাবান্না হয়নি। রাঁধবেই বা কে?

ভবতোষ চুপ করে রইলেন। স্নেহলতা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, একটু জিরিয়ে নাও, তারপর খেয়ে দেয়ে বাড়ি ফিরবে।

অন্যমনস্কের মতো ভবতোষ বললেন, আচ্ছা।

একটুক্ষণ নীরবতা। তারপর ভবতোষ ডাকলেন, খুড়িমা–

কী বলছ? চলতে চলতে পেছন ফিরে একবার তাকিয়ে নিলেন স্নেহলতা।

হেমকাকা আমার কাছে সেদিন ফিটনটা চেয়েছিলেন। কাদের আসবার কথা ছিল না?

হ্যাঁ।

তাঁরা এসেছেন?

হ্যাঁ। ভেতরে এস, আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।

ঘরে এসে অবনীমোহনদের সঙ্গে ভবতোষের পরিচয় করিয়ে দিলেন স্নেহলতা। তারপর বললেন, এখন কিছু খাবে ভব?

না। তবে—

বলে ফেল না—

একটা জিনিস পেলে মন্দ হত না, কিন্তু আপনাদের এখানে তার প্রবেশ তো নিষিদ্ধ।

স্নেহলতা হাসলেন, চা নিশ্চয়ই?

ভবতোষ মাথা নাড়লেন।

স্নেহলতা বললেন এ বাড়িতে চা ঢুকে পড়েছে।

মলিন বিষণ্ণতার মধ্যেও ভবতাষের চোখে বিস্ময়ের ছায়া পড়ল। বললেন, কাকাবাবু চা ঢুকতে দিলেন!

না দিয়ে উপায় কী। স্নেহলতা হাসতে হাসতে বললেন, আমার মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনীদের আবার ওই জিনিসটি না হলে চলে না।

ভবতোষ বললেন, যাক, এ বাড়ি নিয়ে রাজদিয়ার সাত বাড়িতে তা হলে চা ঢোকার ছাড়পত্র পেল। এবার থেকে চায়ের লোভেও মাঝে মাঝে আসতে হবে।

অবনীমোহন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, এ বাড়ি বাদ দিলে থাকে ছ’বাড়ি। ওই ছ’বাড়ি ছাড়া রাজদিয়ায় চায়ের চল নেই নাকি?

ভবতোষ মৃদু হাসলেন, না। হেমকাকা নিজে পি. সি. রায়ের শিষ্য, রাজদিয়াকেও তাই করে ছেড়েছেন। শুধু আমরা ক’জন পাষন্ড তাকে অমান্য করে চলেছি।

অবনীমোহনও হেসে ফেললেন।

একটু পরে চা এল। স্নেহলতা বা শিবানীর চা তৈরির অভ্যাস নেই, সুনীতিই করে এনে দিল।

চা খেতে খেতে ভবতোষ স্নেহলতার দিকে ফিরে বললেন, ঝিনুক কান্নাকাটি করে নি?

না।

আমার কথা বলেছিল?

মোটেও না। তবে–

কী?

বিনুর দিকে আঙুল বাড়িয়ে স্নেহলতা এবার বললেন, ওই দাদাভাইটা আসার পর খুব হিংসে হয়েছে। জেদ করে, বায়না ধরে ওর সমান সমান ভাগ আদায় করেছে। বলে তিনি হাসলেন।

ঘরের অন্য সবাইও হাসল। আর বিনু নেহাত অকারণেই হঠাৎ খুব লজ্জা পেয়ে গেল।

চা খাওয়া হলে তাড়া দিয়ে ভবতোষকে চান করতে পাঠালেন স্নেহলতা। পুকুরঘাট থেকে ফিরে এলে এ ঘরেই আসন পেতে খেতে বসিয়ে দিলেন।

বিশাল ঘরের এক ধারে দুটো তক্তপোশ জোড়া দেওয়া। তার ওপর অবনীমোহনরা বসে আছেন। তাদের দৃষ্টি ভবতোষের ওপরেই স্থির হয়ে রয়েছে। এই মানুষটি সম্বন্ধে হেমনাথ এবং স্নেহলতা দু’জনে গাঢ় বিষাদময় কিছু ভূমিকা করে রেখেছিলেন। অবনীমোহনদের চোখ দেখে মনে হয়, সাগ্রহে কিসের যেন প্রতীক্ষা করছেন।

প্রায় নিঃশব্দেই খেয়ে যাচ্ছিলেন ভবতোষ। আধাআধি খাওয়া হয়েছে, এমন সময় স্নেহলতা ডাকলেন, ভব–

পাত থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ভবতোষ।

তক্ষুনি কিছু বললেন না স্নেহলতা। বলবেন কি বলবেন না, তাই নিয়ে মনে মনে খুব সম্ভব বোঝাঁপড়া করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পর দ্বিধান্বিত সুরে জিজ্ঞেস করলেন, কাল তোমার ফেরার কথা ছিল না?

হ্যাঁ।

এলে না যে?

ভবতোষ উত্তর দিলেন না। ঝোলমাখা ভাতের ভেতর তার হাত থেমে গেছে, কণ্ঠার কাছটা থর থর কাঁপছে।

স্নেহলতা আবার প্রশ্ন করলেন, এই দু’দিন কি বৌমাদের বাড়িতেই ছিলে?

আস্তে মাথা নাড়লেন ভবতোষ, না।

খানিক আগে চায়ের ব্যাপার নিয়ে লঘু কৌতুকের চিকচিকে একটু আভা ফুটেছিল সবার চোখেমুখে। সমস্ত আবহাওয়া আবার অত্যন্ত ভারী, কষ্টকর আর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠল।

স্নেহলতা বললেন, কোথায় ছিলে তবে?

আমার এক বন্ধুর বাড়ি টিকাটুলিতে। তার কাছে ছিলাম। ভবতোষ বললেন।

বৌমা কি সত্যিসত্যিই ওখানে থেকে যাবে?

হ্যাঁ।

তোমার শ্বশুরমশায় কী বললেন?

এই ঘর বুঝি বায়ুশূন্য। শ্বাস টানতেও ভবতোষের কষ্ট হচ্ছে। অবরুদ্ধ গলায় বললেন, তার কিছু বলবার নেই, মেয়েকে যথেষ্ট বকাবকি করেছেন। বকাই সার।

শাশুড়ি?

তিনিও মেয়েকে প্রশ্রয় দেননি। আমার সঙ্গেই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এনে কী করব বলুন?

বিমর্ষ সুরে স্নেহলতা বললেন, সে তো ঠিকই।

ভবতোষ বলতে লাগলেন, আমার বন্ধুটি যার কাছে দু’দিন কাটিয়ে এলাম সে জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক। একসঙ্গে ঢাকায় ইউনিভাসিটিতে পড়তাম। তাকে পাঠিয়েছিলাম বোঝাবার জন্যে। কিন্তু–

কী? ঝিনুকের মা’র এক কথা, আমার সঙ্গে ঘর করবে না। রাজদিয়াতেও আর কখনও ফিরবে না।

কেউ লক্ষ করে নি, একদৃষ্টে ভবতোষের দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনে যাচ্ছিল ঝিনুক। হঠাৎ জোরে জোরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

সবাই চমকে ঝিনুকের দিকে ফিরল। ভবতোষ আর স্নেহলতা প্রায় একসঙ্গেই বলে উঠলেন, কাঁদছিস কেন ঝিনুক?

ফোঁপানি থামে নি, ক্রমশ সেটা উচ্ছ্বলিত হয়ে উঠতে লাগল। এদিকে লাফ দিয়ে তক্তপোশ থেকে নেমে হিরণ ঝিনুককে কোলে তুলে নিল। মাথায় কপালে হাত বুলোতে বুলোতে, আদর করতে করতে বলতে লাগল, কাঁদে না। তুমি লক্ষ্মী মেয়ে, সোনা মেয়ে। ভাল মেয়ে

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলতে থাকে ঝিনুক। জড়ানো জড়ানো, আধফোঁটা, আধভাঙা গলায় বলতে লাগল, মা আর আসবে না। মা আর আসবে না।

ভর্ৎসনার সুরে ভবতোষের দিকে তাকিয়ে হিরণ বলল, কেন যে তোমরা মেয়েটার সামনে এসব নিয়ে আলোচনা কর। এর আগেও একবার এ ব্যাপারে স্নেহলতাকে বকেছে সে। হিরণ দাঁড়াল না, ঝিনুককে নিয়ে বৃষ্টির ভেতরেই উঠোন পেরিয়ে ওধারের একটা ঘরে চলে গেল। আর এ ঘরে সময় যেন গতি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। ঝিনুকের সামনে এ প্রসঙ্গ তোলা যে খুবই অন্যায় হয়েছে, নীরবে সবাই তা অনুভব করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর পাতের ভাতগুলো নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লেন ভবতোষ।

স্নেহলতা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও কি, কিছুই তো প্রায় খেলে না। সব পড়ে রইল।

বিস্বাদ সুরে ভবতোষ বললেন, আমার আর খেতে ইচ্ছা করছে না খুড়িমা—

স্নেহলতা পীড়াপীড়ি করলেন না।

আঁচিয়ে এসে ভবতোষ বললেন, হেমকাকাকে তো দেখছি না।

উনি কেতুগঞ্জ গেছেন। স্নেহলতা বললেন।

কখন ফিরবেন?

স্নেহলতা বললেন, সে কথা জিজ্ঞেস করো না বাপু। আজও ফিরতে পারেন, কালও পারেন, পরশুও পারেন। তোমার কাকাটিকে তো চেনোই। আমি একটা সময় বলি, উনি হয়তো তখন এলেন না। মাঝখান থেকে আমি মিথ্যেবাদী সাজতে পারব না। হেমনাথ সম্পর্কে প্রায় এরকম কথাই খানিক আগে অবনীমোহনকেও বলেছিলেন তিনি।

ভবতোষ মৃদু হাসলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমি তা হলে এখন যাই। খুড়িমা–

এখুনি যাবে?

হা। সন্ধে হয়ে এল। মেয়েটাকে নিয়ে আবার অনেকটা রাস্তা যেতে হবে।

ঝিনুককে সত্যিই নিয়ে যেতে চাইছ?

হ্যাঁ।

কেন?

আপনাদের কাছে দু’দিন তো রইল। ভয়ানক দুষ্ট। তার ওপর এঁরা সব এসেছেন–

ভবতোষের ইঙ্গিত বুঝতে পারলেন স্নেহলতা নিজের দায়িত্বভার অকারণে অন্যের ওপর দিয়ে রাখতে তিনি কুণ্ঠিত হচ্ছেন।

স্নেহলতা বললেন, আমার কাছে মাঝে মাঝে তো দিয়ে যাও। এখানে থাকার অভ্যেস ওর আছে, বেশ ভালই থাকে। দুষ্টুমির কথা বলছ? ওটুকু দুষ্ট সব ছেলেমেয়েই। আর ওরা এসেছে তো কী হয়েছে। ওদের সঙ্গে হইচই করে বেশ থাকবে, মায়ের কথা মনে পড়বে না। বরং–

বরং কী?

একটু ইতস্তত করে স্নেহলতা বললেন, তোমার বাড়িতে তুমি একা। দিনরাত লেখাপড়া নিয়েই থাকো। ঝিনুকটা না পাবে একটা খেলার সঙ্গী, না পাবে কারোর সঙ্গে কথা বলতে। ও এখানেই থাক।

ভবতোষ আস্তে আস্তে বললেন, আমার মনটা ভাল নেই খুড়িমা, আজ ও চলুক। দু’একদিন পর না হয় দিয়ে যাব।

চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল আসার মতো অদৃশ্য গোপন পথে অনেকখানি দুঃখ এই ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্নেহলতা বুঝতে পারলেন, আজকের দিনটা অন্তত ঝিনুককে কাছে পাওয়া দরকার ভবতোষের। মেয়ের সঙ্গ তাকে খানিক সান্ত্বনা দিতে পারে। গাঢ় সহানুভূতির সুরে তিনি বললেন, আচ্ছা, নিয়েই যাও।

ভবতোষ বললেন, রাগ করলেন না তো খুড়িমা?

পাগল ছেলে। তোমার ওপর কি রাগ করতে পারি!

একটু চুপ করে থেকে ভবতোষ বললেন, এখন থেকে ঝিনুকের সব দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। আমার কলেজ খুললে ওকে কে দেখবে? আপনি ছাড়া মেয়েটাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। নির্ঘাত ও মরে যাবে।

ওসব আজ বাজে কথা বলতে নেই।

তা হলে এখন যাই?

এস।

দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে অবনীমোহনের কথা মনে পড়ে গেল ভবতোষের। ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাদের বাড়ি একদিন বেড়াতে যাবেন।

অবনীমোহন বললেন, আপনিও আসবেন।

আসব।

শরতের বৃষ্টি, এই আছে এই নেই। একটু আগেই স্বল্পায়ু শৌখিন বর্ষণ থেমে গেছে। ভবতোষ ঘর থেকে বাইরে এলেন, অন্য সবাইও সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে এল।

ডাকাডাকি করে ও ঘর থেকে ঝিনুক আর হিরণকে বার করলেন স্নেহলতা। কী একটা মজার কথা হচ্ছিল দু’জনের। খুব হাসতে হাসতে ওরা এল। এর মধ্যেই ঝিনুককে ভুলিয়ে ভালিয়ে অন্যমনস্ক করে ফেলেছে হিরণ।

ফিটনটা উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। স্নেহলতা বললেন, ঝিনুককে গাড়িতে তুলে দে হিরণ।

হিরণ বলল, ও কি এখন চলে যাবে?

হ্যাঁ।

ভবতোষ ইতিমধ্যে ফিটনে উঠে বসেছেন। ঝিনুককে তার পাশে বসিয়ে দিতে দিতে হিরণ বলল, সারাদিন তো রইলাম, ভবদা’র গাড়িতে আমি বরং চলেই যাই ঠাকুমা।

উঁহু–

কেন, আর কোনও কাজ আছে?

কাজ নেই। তবে তোমার যাবার হুকুমও নেই।

দাদু না এলে ছাড়া পাব না?

না।

অগত্যা।

ফিটন চলতে শুরু করল। দেখতে দেখতে উঠোন বাগান পেরিয়ে ঝিনুকরা রাস্তায় গিয়ে উঠল। আর অবনীমোহনরা ধীরে ধীরে ফিরে এলেন।

ঘরে এসে স্নেহলতা বললেন, ভবতোষের বৌর মতো মেয়েছেলে জীবনে আর দেখিনি। সংসারটা একবারে ছারখার করে দিলে।

সুরমা বললেন, কী এমন হয়েছে যে, স্বামীর সঙ্গে ঘর করবে না!

সন্ধে হয়ে এল, এসময় ওই অলক্ষ্মীর কথা থাক।

ভবতোষরা চলে গেছেন, এ বাড়ির ওপর গাঢ় বিষাদ এখনও অনড় হয়ে আছে। বিনু কাতোর কথা শুনছিল না, জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সেই সকাল থেকে দাদুর ভাগ নিয়ে, মাছের ভাগ নিয়ে, কলা আর রসগোল্লার ভাগ নিয়ে সমানে হিংসা করেছে ঝিনুক। তবু হিংসুটি মেয়েটার জন্য বিনুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল।

একটু পর সন্ধে নেমে এল।

মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে এক-আধ পশলা বৃষ্টি ছাড়া শরতের দিনটা ছিল বেশ নির্মল। তার গায়ে ছিল নরম সোনালি আভা মাখানো। দেখতে দেখতে জলে কালি গুলে দেবার মতো হাওয়ায় হাওয়ায়। কেউ বুঝি কালচে রং মিশিয়ে দিতে লাগল। এই রং মেশানোর খেলাটা চলল অনেকক্ষণ। তারপর অন্ধকার গাঢ় হয়ে ঝপ করে একসময় রাত্রি নেমে গেল।

কলকাতার ফেনায়িত কলরব থেকে এত দূরে বিজলি আলোর দাক্ষিণ্য এসে পৌঁছয়নি। জানালার বাইরে যতদূর চোখ যায়, গাছপালা ঝাঁপসা দেখাচ্ছে। তৃতীয় ঋতুর এলোমেলো বাতাসে সুপারি বন অল্প অল্প দোল খাচ্ছে, আম বাগানটাকে কেমন ভুতুড়ে মনে হয়। পুকুরটাকে আর চেনাই যায়। না। তার ওপারে ধানখেতে মিটমিটিয়ে জোনাকি জ্বলছে আর নিবছে, নিবছে আর জ্বলছে। দিগন্ত পর্যন্ত ধানের মাঠটা যেন একখানা জামদানি শাড়ি, জোনাকিরা তার গায়ে আলোর চুমকি।

স্নেহলতা ইতিমধ্যে ঘরে ঘরে হেরিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। তা ছাড়া কাঠের তিনতলা পিলসুজে রেড়ির তেলের আলোও জ্বলছে। তবু ঘরগুলো পুরোপুরি আলোকিত নয়, এ কোণে ও কোণে অন্ধকার যেন জুজুবুড়ি হয়ে বসে আছে।

সেই পুবদুয়ারী ঘরখানায় অবনীমোহন সুধা সুনীতি আর বিনু এখনও বসে আছে। স্নেহলতা শিবানী রান্নাঘরে, রাতের জন্য আনাজ টানাজ কুটছেন। সুরমা কাছাকাছি বসে এ গল্প সে গল্প করছেন। এতকাল পর মামী মাসিকে পেয়ে কথা আর তার ফুরোচ্ছে না।

জানালার বাইরে চোখ মেলেই ছিল বিনু। ধানখেতে জোনাকির নাচানাচি ওড়াওড়ি ছাড়াও মাঝে মাঝে আরও কিছু আলো ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল। ওগুলো কিসের আলো বুঝতে পারছিল না সে।

জোনাকি আর মাঝে মাঝে ধানখেতে আলোর ওই বিন্দু ক’টি ছাড়া চারধারে শুধু অন্ধকার গাঢ়, অথৈ, অতল আঁধার।

পূর্ব বাংলার এই সুদূর প্রান্তে এত অন্ধকার জমা হয়ে থাকবে আর সন্ধে নামতে না নামতেই ঝুপ ঝুপ করে চারদিক থেকে ঘিরে ধরবে, কে ভাবতে পেরেছিল। কলকাতায় রাত্রি টেরই পাওয়া যায় না। সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গে আলোর ফোয়ারা ছুটে যায়। আলোকিত নিশীথের যে স্বপ্নময়তা–চিরদিন তাতেই অভ্যস্ত বিনু। কিন্তু এখানকার রাত্রি প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে আছে। সে আছে আকাশ বাতাস জল স্থল, সব কিছুর ওপর ব্যাপ্ত হয়ে। শুধু অচেতন জড় পৃথিবীর ওপর নয়, বুঝিবা জীব জগতের অস্তিত্বের ভেতর, তার গভীর মর্মমূল পর্যন্ত এই রাত্রি ছাড়িয়ে আছে। পূর্ব বাংলার অন্ধকার কোনওদিন ফুরোবে না। আজকের রাত শেষ হয়ে দিনের আলো আবার দেখা দেবে, এমন ভরসা মনের কোথাও খুঁজে পেল না বিনু।

খুব কাছ থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে ডাকল, ছুটোবাবু—

বিনু চমকে উঠল। ভয়ও পেয়ে গেল খুব। চেঁচিয়েই উঠত, তার আগেই দেখতে পেল, জানালার ঠিক ওধারে একটু কোণের দিকে ভূতের মতো যে দাঁড়িয়ে আছে সে যুগল।

চোখাচোখি হতেই যুগল আগের সুরেই বলল, আসেন—

কোথায় যাব?

আসেন না—

বাইরে বড় অন্ধকার।

আন্ধারে ডর লাগে নিকি? কেমন করে যেন হাসল যুগল।

ভয়ের কথায় পৌরুষে খোঁচা লাগল। গম্ভীর গলায় বিনু বলল, মোটেও না।

তয় আইসা পড়েন।

অবনীমোহনরা কথা বলছিলেন। ওবেলার মতো চুপিসারে বেরিয়ে যাচ্ছিল বিনু, হঠাৎ সুধার চোখে পড়ে গেল।

সুধা বলল, এই কোথায় যাচ্ছিস রে?

বিনু বলল, বাইরে।

অবনীমোহন হিরণের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মুখ ফেরালেন, বাইরে কী?

একটু চুপ করে থেকে বিনু বলল, যুগল ডাকছে।

যুগলের সঙ্গে খুব খাতির দেখছি। আচ্ছা যা—

বিনু ছুট লাগাতে যাচ্ছিল, সুধা বাধা দিল, না, যেতে হবে না। ওই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে গিয়ে এক কান্ড করে বসো, আর আমরা তোমাকে নিয়ে পাগল হয়ে যাই–

বাধা পেয়ে বিনু খেপে গেল। চোখ দিয়ে আগুনের হলকা ছুটতে লাগল যেন। স্টিমারঘাটে পারে নি, এখন তার পুরোপুরি শোধটুকু তুলে নিল। জিভ ভেংচে টেনে টেনে বলল, পাগল হয়ে যা-ই! চুপ কর বাঁদরী। তোর বেশি ওস্তাদি করত হবে না।

সুধা আর বিনুর মধ্যে সম্পর্কটা নিয়ত শত্রুতার, চোখাচোখি হলেই তাদের যুদ্ধ। মাঝে মাঝে সন্ধি অবশ্য হয়, কিন্তু তা সাময়িক। দু’চার ঘন্টার বেশি তার আয়ু নয়। তারপরেই সব চুক্তি, সব শর্ত ছুঁড়ে দিয়ে তারা পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বারুদ সব সময় কামানে পোরাই আছে, যে কোনও কারণে যে কোনও সময় যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে যেতে পারে।

এই অজানা ভুবনে, অচেনা মানুষের ভিড়ে প্রায় গোটা একটা দিন কেটে গেল, দুই ভাইবোনের লড়াই এখনও জমে নি। নতুন পরিবেশটা একটু সইয়ে নেবার শুধু অপেক্ষা।

সুধার চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছিল। নেহাত হিরণ রয়েছে, নইলে এতক্ষণে তার নখে বিনুর গালের ছাল উড়ে যেত। সে-ও অবশ্য অক্ষত থাকত না, এক খামচা চুলের স্বত্ব তাকেও ছাড়তে হত।

চকিতে হিরণকে একবার দেখে নিল সুধা। হিরণের শক্তবদ্ধ চাপা ঠোঁটের ফাঁকে যা আবছাভাব ফুটে আছে তার নাম হাসি কিনা, বুঝতে পারা গেল না। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, দেখছ বাবা, দেখছ–কিরকম অসভ্য হয়ে উঠেছে বিনুটা।

অবনীমোহন হাসতে লাগলেন।

সুধা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, তুমি হাসছ বাবা!

অবনীমোহন বললেন, হাসব না তো কী করব?

সুধা গলার স্বর আরেক পর্দা তুলল, আদর দিয়ে দিয়ে তুমি ওটাকে একটা আস্ত বাঁদর করে তুলছ।

আদর তো আমি তোকেও দিই। বিনু বাঁদর হলে তুই কী?

সুধা চেঁচিয়ে উঠল, বাবা!

ছেলেমেয়েদের পেছনে লাগার স্বভাব অবনীমোহনের। তিনি সমানে হাসতে লাগলেন। হিরণের ঠোঁটদুটো আরও শক্ত হয়ে গেছে, ভেতরে কিছু একটা চলছিল। বুদবুদের মতো ফুটি ফুটি করেও বেরিয়ে আসতে পারছে না।

বিনু আর দাঁড়াল না, পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগুতে লাগল। সুধা বলল, ওকে তুমি বারণ কর বাবা, কিছুতেই বাইরে যেতে পারবে না। সুধার যেন জেদই চেপে গেছে। সে-ও যে বিনুর। অভিভাবক, তার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে বিনুর কোথাও যাবার সে উপায় নেই, হিরণের সামনে সেটাই প্রমাণ করতে চাইছিল সুধা।

অবনীমোহন হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বোঝাতে লাগলেন, এখানে আমাদের মাঝখানে বেচারি মুখ বুজে বসে ছিল। যাক না যুগলের সঙ্গে

অবনীমোহন শেষ করতে পারলেন না, সুধা হঠাৎ প্রবল বেগে হাত-পা এবং মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল। তবে সে আর কিছু বলার আগেই লাফ দিয়ে বিনু বাইরে বেরিয়ে গেল।

বারান্দায় এসে কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না। তবে কি যুগল চলে গেছে? আস্তে আস্তে বিনু ডাকল, যুগল–যুগল–

ঘরের ভেতর ঝড়ের আভাস পেয়ে উঠোনে নেমে গিয়েছিল যুগল। অন্ধকার কুঁড়ে সে কাছে এসে দাঁড়াল, এই যে ছুটোবাবু–

ওখানে কী করছিলে?

উত্তর না দিয়ে হি হি করে হাসতে লাগল যুগল। হাসতে হাসতেই বলল, ঘরের ভিতরে যা হইতে আছিল, উইখানে খাড়ইয়া থাকতে সাহস হয় নাই। ছুটোদিদি বুঝিন আপনেরে আসতে দিতে চায় না?

হুঁ, আমাকে ও আটকাবে! বীরের মতো ভঙ্গি করে বিনু বলল, কী জন্যে ডাকছিলে বল–

আসেন আমার লগে (সঙ্গে)।

কোথায়?

গ্যালেই দেখতে পাইবেন।

নিঃশব্দে অন্ধের মতো যুগলকে অনুসরণ করতে লাগল বিনু। উঠোন পেরিয়ে তারা প্রথমে এল রান্নাঘরে। দরজার বাইরে থেকে যুগল ডাকল, ঠাউরমা–

স্নেহলতা সাড়া দিলেন, কে, যুগল?

হ।

কিছু বলবি?

আপনের কাছে হেইদিন যে বড় বরিটা (বড়শি) দিছিলাম, হেইটা দ্যান। পুকৈরে শৌল আর বোয়াল যা ঘাই মারতে আছে–

বরি’ কী, বুঝতে পারল না বিনু।

স্নেহলতা শুধোলেন, আবার বুঝি মাছের পেছন লাগতে যাচ্ছিস?

যুগল ঘাড় চুলকোতে লাগল।

স্নেহলতা আবার জিজ্ঞেস করলেন, পাট তোলা হয়ে গেছে?

হ।

হাতের ভর দিয়ে উঠে পড়লেন স্নেহলতা। তারপর সামনের দেয়ালের উঁচু তাক থেকে প্রকান্ড একটা বড়শি বার করে বললেন, এই নে–

রান্নাঘরের ভেতর থেকে হেরিকেনের আলো বাইরে এসে পড়ছিল। বড়শি দিতে গিয়ে বিনুকে দেখতে পেলেন স্নেহলতা। বললেন, একি, দাদাভাইকেও জুটিয়ে নিয়েছিস দেখছি!

এক ফাঁড়া কাটিয়ে এসেছে, আবার যদি বাধা পড়ে সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি বিনু বলে উঠল, বাবাকে বলে এসেছি।

সুরমা ভেতর থেকে বললেন, ওর সঙ্গে ঘুরছ, ঘোরো। অন্ধকারে বেশি হুটোপুটি করো না।

বিনু তক্ষুনি ঘাড় কাত করল, আচ্ছা।

খানিক পর বিনুকে সঙ্গে নিয়ে উঠোন বাগান পেরিয়ে পুকুরের কাছে চলে এল যুগল। অন্ধকারে বিনুর ভয় ভয় করছিল, কিন্তু সে কথা তো আর যুগলকে বলা যায় না।

ঘরে বসে দেখতে পাওয়া যায় নি, পুকুরপাড়ে এসে বিনু দেখতে পেল, শরতের উজ্জ্বল নীলাকাশে সরু একফালি চাঁদ। চঞ্চল ভারহীন মেঘ তার মুখে বার বার পর্দা টেনে পরক্ষণেই নিরুদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে।

চাঁদ আছে ঠিকই, কিন্তু আলো নেই। আলো বলতে দূরের ধানখেতে রাশি রাশি জোনাকি। আলোর ছুঁচের মতো অন্ধকারকে তারা অবিরাম বিধে যাচ্ছে।

সঙ্গে করে একটা লম্বা দড়ি নিয়ে এসেছিল যুগল। অন্ধকারেই দড়ির একটা মাথায় বড়শিটা পরিয়ে একটা জ্যান্ত টাকি মাছ গেঁথে দিয়ে বলল, ছুটোবাবু, আমি উই গাছটায় উইঠা বরি’টা। বাইন্ধা দিমু। তলে একা একা খাড়ইয়া থাকতে ডর লাগব না তো?

শুনেই বুকের ভেতরটা গুরু গুরু করে উঠল। এখানে একলা দাঁড়িয়ে থাকতে হলে নির্ঘাত দম আটকেই সে মরে যাবে। কিন্তু তা বলা গেল না। তার বদলে বীরত্ব ফলাতে হল, একটুও ভয় লাগবে না। বলল বটে, স্বরটা কিন্তু কেমন কাঁপা কাঁপা শোনাল।

পুকুরের গা ঘেঁষেই একটা ঝুপসি আমগাছ। তার গোটা দুই ডাল জলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। চোখের পলকে তর তর করে উঠে গিয়ে টাকি মাছের টোপসুদ্ধ বড়শিটা জলে নামিয়ে দিল যুগল, তারপর দড়ির অন্য প্রান্তটা ডালে বেঁধে দিয়ে তক্ষুনি নেমে এল।

যতক্ষণ যুগল গাছে ছিল, দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে বিনু। যুগল নেমে এলে ধীরে ধীরে বুকের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস বার করে দিল সে।

পুকুর তোলপাড় করে মাছেরা লাফালাফি করছিল। যুগল বলল, শুনতে আছেন ছুটোবাবু?

বিনু যুগলের কাছে আরেকটু ঘন হয়ে এল। ক্ষীণ সুরে বলল, কিসের আওয়াজ?

বিনুর স্বরটা খেয়াল করে নি, যুগলের ধ্যান-জ্ঞান তখন পুকুরের দিকে। লোভী, ফিসফিস গলায় যে বলল, মাছ ছুটোবাবু, মাছ। মনে লয়, সাই (প্রকান্ড) বোয়াল কি কাতল (কাতলা)। দুইটাই রাইক্ষইসা মাছ। ইট্র খাড়ন। অহনই শালারা বরি গিলা ফেলাইব।

চারদিক নিঝুম, জনহীন। অবশ্য ঝোঁপঝাড়ে আর নিবিড় বনানীর ফাঁকে ঝিঁঝিদের জলসা বসেছে। একটানা ঝিল্লিস্বর শুনতে শুনতে দু’জনে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে রইল।

যুগল আবার কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় দেখা গেল দূরের ধানখেত চিরে আলোর ক’টি বিন্দু দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে।

বিনু জিজ্ঞেস করল, ওগুলো কিসের আলো যুগল?

যুগল একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, নাও মনে লয় (হয়)।

যুগলের অনুমানই ঠিক। আরেকটু কাছাকাছি আসতে টের পাওয়া গেল, নৌকোই। বৈঠা টানার ছপছপ আওয়াজ আসতে লাগল।

হঠাৎ দুটো হাত চোঙার মতো মুখের কাছে ধরে যুগল চেঁচিয়ে উঠল, কুন গেরামের নাও? স্বরটা শরতের বাতাসে দোল খেতে খেতে দিগন্তে মিলিয়ে গেল।

একটু পর দূর থেকে সাড়া এল, কেতুগুঞ্জের নাও—

নাও যায় কই?

হ্যামকত্তার বাড়ি।

যুগল ব্যস্ত হয়ে উঠল। বিনুকে বলল, বড়কত্তা ফিরা আইল বুঝিন।

বিনু বুঝতে পেরেছিল। তবু বলল, দাদু?

হ।

দেখতে দেখতে ছইওলা বড় একখানা নৌকো ঘাটে এসে লগি পুঁতল। ছইয়ের তলায় দুটো হেরিকেন জ্বলছিল। আলো নিয়ে প্রথমে দু’জন মাঝি নামল। তাদের পিছু পিছু হেমনাথ, হেমনাথের পেছনে আলো হাতে আরও দু’টো মাঝি। হেরিকেন ছাড়াও হাতে কলাপাতা দিয়ে মুখ-বাঁধা বড় বড় গোটা তিনেক হাঁড়ি আর প্রকাণ্ড এক রুই মাছ ঝুলছে।

ঘাট থেকে ওপরে উঠতেই সামনের মাঝি দুটোকে চিনতে পারল বিনু। ও বেলা এরাই এসে হেমনাথকে কেতুগঞ্জে নিয়ে গিয়েছিল। পেছনের দু’জন অবশ্য অচেনা। খুব সাধারণ মাঝি বা চাষী শ্রেণীর লোক বলে তাদের মনে হল না। দু’জনেই প্রৌঢ়, মুসলমান। পরনে পাজামা আর ফুল শার্ট। মচমচ আওয়াজে টের পাওয়া যাচ্ছে তাদের পায়ে কাঁচা চামড়ার নাগরা। হেরিকেনের আলোয় তাদের সোনার বোম আর আংটি ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে, মাথায় সাদা টুপি, গালে চাপদাড়ি। দূর থেকেও আতরের ভুরভুর উগ্র গন্ধ ভেসে আসছে। গ্রাম্য হলেও দুজনের চেহারায় বেশ সম্ভ্রান্ত ছাপ আছে।

কাছাকাছি আসার আগেই যুগল ফিসফিসিয়ে বলল, আমি যাই। বড়কারা আইছে। ঠাউরমারে খবরটা দেই গিয়া— বলে আর দাঁড়াল না, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে চলে গেল।

একটু পর হেমনাথরা কাছে এসে পড়লেন। বিনুকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি অবাক। থমকে দাঁড়িয়ে বলেন, এ কি দাদাভাই, এই রাত্রিবেলা একা একা তুমি পুকুরপাড়ে এসেছ?

বিনু বলল, একা আসি নি, যুগল আমাকে নিয়ে এসেছে।

হেমনাথ রেগে গেলেন, কোথায় সেই হারামজাদা? তোমাকে একলা ফেলে গেল কোন চুলোয়?

তুমি এসেছ। দিদাকে সেই খবরটা দেবার জন্যে এই মাত্তর বাড়ি গেল।

হেমনাথ আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন, পেছন থেকে সেই বয়স্ক মুসলমান দু’জন সামনে এগিয়ে এল। একজন শুধলো, এ ক্যাঠা ঠাউরভাই (ঠাকুর ভাই অর্থাৎ দাদা)?

হেমনাথ বললেন, নাতি। ওরাই আজ সকালে কলকাতা থেকে এসেছে।

প্রায় ছুটেই বিনুর সামনে চলে এল প্রৌঢ়টি বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে নিমেষে তাকে বুকের ভেতর তুলে নিল। বাড়ি পর্যন্ত তার বুকের ভেতর বন্দি হয়েই আসতে হল বিনুকে।

বিনু অবশ্য উসখুস করেছে, হাত ছাড়িয়ে নামবার চেষ্টা করেছে। প্রৌঢ় ছাড়ে নি, ঠোঁট টিপে টিপে দুষ্টুমির হাসি হাসছে আর বলছে, ছাড়ুম না, কিছুতেই ছাড়ুম না। বক্ষের পিঞ্জরে ধইরা রাখুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *