১.০৫ সাহিত্য বাসর

আমাদের পাড়ায় সাহিত্য বাসর নামে চ্যাংড়া ছেলেপুলেদের কী যেন একটা সংগঠন আছে। এদের কাজ হচ্ছে দুদিন পর পর মাইক লাগিয়ে পাড়ার সবাইকে বিরক্ত করা। গল্পপাঠের আসর, কবিতা সন্ধ্যা, ছড়া বিকেল, বৃন্দ আবৃত্তি–একটা-না-একটা লেগেই আছে। এসব ঝামেলা ঘরে বসে সেরে ফেললেই হয়, তা করবে না। প্যান্ডেল খাটাবে, মাইক ফিট সুবে–বিরাট জলসা। পয়সা কোত্থেকে পায় কে জানে। দেশ যখন বন্যার পানিতে ডুবে গেল তখন সাহিত্য বাসর-এর অনুষ্ঠানের ধুম পড়ে গেল। বন্যার্তদের সাহায্যার্থে কমিক অনুষ্ঠান, বিচিত্রা অনুষ্ঠান, আনন্দ মেলা।

এই পর্যায়ের শেষ অনুষ্ঠানটি হলো আপনার কি আছে?

আগে ব্যাপারটি সম্পর্কে আপনাদের একটু বলে নেই। তারপর মূল ঘটনায় যাব।

ছুটির দিন সকালবেলায় আরাম করে দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছি, সাহিত্য বাসরের দলবল উপস্থিত। সবার মুখেই হাসি। হাসি দেখেই আঁতকে উঠতে হয়। কাম এরা সহজে হাসে না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কী ব্যাপার?

আমরা মারাত্মক একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি স্যার। নাম হচ্ছে আপনাদের কি আছে? বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যে।

বাহ, খুব ভালো।

একটা ইউনিক আইডিয়া। গানবাজনা কিছু না। ফাঁকা স্টেজ। স্টেজের মাঝখানে একজন ভিখারি বসে থাকবে, গায়ে কোনো কাপড় নেই। শুধু কলাপাতা দিয়ে লজ্জাটা ঢাকা। তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে মাইকে বলা হবে—আপনার অনেক আছে, এর কিছুই নেই। একে কিছু দিন। তখন দর্শকের মাঝখান থেকে একজন উঠে আসবে। সে তার মানিব্যাগ-শার্ট-গেঞ্জি এসব খুলে দেবে। প্রচণ্ড হাততালি। ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক–;ওই মহামানব আসে। আইডিয়া কেমন স্যার?

খুব ভালো, তোমাদের ধারণা লোকজন সব স্টেজে এসে সব খুলে দিয়ে চলে যাবে?

শুরুতে যাবে না। তবে প্রথম কয়েকজন যখন সাহস করে যাবে তখন ফ্লো এসে যাবে। আপনি তো জানেন স্যার, বাঙালি হচ্ছে হুজুগে জাতি। ফ্লোর ওপর চলে।

তা ঠিক।

এখন আপনি হচ্ছেন আমাদের ভগরসা।

আমি মনের উদ্বেগ বহুকষ্টে চাপা দিয়ে বললাম, আমি রসা মানে?

প্রথম যে মানুষটি যাবে সে হচ্ছে আপনি। এপাড়ায় আপনার একটা ইজ্জত আছে। প্রফেসর মানুষ, প্রথম আপনি গেলে অন্যরকম এফেক্ট হবে। একটু হাইড্রামা, স্যার করতেই হবে–উপায় নেই।

কী রকম হাইড্রামা?

সব কাপড়চোপড় আপনাকে খুলে ফেলতে হবে। তারপর আমরা আপনাকে ঠিক ভিখিরির মতো একটা কলাপাতা দিয়ে জড়িয়ে দেব। আপনি কিন্তু না বলতে পারবেন না। রিকোয়েস্ট।

উন্মাদ-এর পাঠক-পাঠিকা, আমি কী করে সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম সেই দীর্ঘ কাহিনী বলতে চাই না। তবে অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত কী রকম হলো সেটা বলছি।

অনুষ্ঠান শুরু হলো সন্ধ্যায়। প্রধান অতিথি চলে এলেন। তার নাম বলছি না। কারণ তিনি একজন পেশাদার প্রধান অতিথি। সবাই একে চেনেন। ঢাকা শহরের শতকরা আশি ভাগ অনুষ্ঠানে তিনি হয় প্রধান অতিথি, কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন। চমৎকার একটি বক্তৃতা দেন। যে ফুলের মালাটি তাকে দেওয়া হয় সেটি তিনি একটি শিশুর গলায় পরিয়ে অত্যন্ত নাটকীয় কায়দায় শিশুটির কপালে চুমু খান। তখন বিক্ষিপ্তভাবে হাততালি পড়ে। যাই হোক, এই প্রধান অতিথি ভদ্রলোক সম্ভবত অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগে কিছু জানতেন না। যখন দেখলেন স্টেজে কলাপাতা গায়ে এক নেংটো ভিখারি বসে আছে তখন স্বভাবতই ঘাবড়ে গেলেন।

তারপর যখন মাইকে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয় তখন প্রধান অতিথি শুকনো গলায় বললেন, এসব এরা কী বলছে? হোয়াট ডু দে মিন।

আমি তাকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ততক্ষণে মাইকে উদাত্ত গলায় বলা হচ্ছে এবার আমাদের এই অনুষ্ঠানে প্রথম যিনি তার সর্বস্ব দিয়ে এক অনুপম আদর্শের সূচনা করবেন তিনি হচ্ছেন আমাদের অতি আদরের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সাহিত্যবোদ্ধা অনলবর্ষী বক্তা, সমাজের বন্ধু, অভাজনের চোখের মণি…। প্রধান অতিথি কাঁপাগলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় বোধহয় নেই। আমি কোনো উত্তর দিলাম না। সাহিত্য বাসরের কর্মীরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঠেলাঠেলি। করে স্টেজে উঠিয়ে দিল। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান হতে লাগল ওই মহামানব… ও… আসে। যেরকম আশা করা হয়েছিল সেরকম হলো না। বাঙাল হুজুগে জাতি হলেও এই হুজুগে তারা মাতলো না, দ্রুত মাঠ খালি হয়ে গেল। শুধু প্রধান অতিথি একটি কলাপাতায় লজ্জা নিবারণ করে ত্রিভ মুরারী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন গলায় ফুলের মালা, সামনে পিরিচে ঢাকা পানির গ্লাস নিয়ে যিনি শান্ত সমাহিত ভঙ্গিতে বসে থাকেন তাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অন্য শ্রোতাদের মতো তিনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন না। অসুবিধা জায়গায় চুলকানি শুরু হলে চুলকাতে পারেন না। হাসিমুখে বসে থাকতে হয় এবং ভান করতে হয় বিমলানন্দ উপভোগ করছেন। প্রফেশনালরা এই কাজটা ভালোই করেন। অসুবিধা হয় যারা প্রফেশনাল না তাদের। আমার নিজের দেখা একটি দৃশ্য বলছি। বাংলাদেশ পুষ্পপ্রেমীদের একটি অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি হচ্ছে হাজী আসমত আলী বেপারী। ইনি কিছুদিন হলো শুকনো মরিচের ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা করেছেন। তাকে প্রধান অতিথি করার একটিই উদ্দেশ্য, কিছু পয়সাকড়ি পাওয়া।

হাজী আসমত আলী বেপারী চোখ বড় করে দুঘণ্টার মতো সময় মূর্তির মতো কাটালেন। তারপরই সম্ভব-অসম্ভব জায়গায় চুলকাতে শুরু করলেন। প্রধান অতিথিকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো এবং কানে কানে বলা হলো ফুলের ওপর দুএকটা কথা বলবেন। বেশি কিছু বলার দরকার নেই।

হাজি সাহেব রু করলেন গোলাপ দিয়ে। গোলাপের বর্ণ গন্ধ এইসব নিয়ে প্রচুর উচ্ছাস করে বললেন, গোলাপ হচ্ছে আমাদের জাতীয় ফুল।

তাকে কানে কানে বলা হলো, গোলাপ নয়, জাতীয় ফুল হচ্ছে শাপলা। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, কোন শালায় বলে শাপলা জাতীয় ফুল? কোথায় গোলাপ আর কোথায় শাপলা? কোথায় আইয়ুব খান আর কোথায় খিলি পান! ভাইসব, আপনারা বলেন, শাপলা কি একটা ফুল? শাপলা হচ্ছে একটা তরকারি।

বুঝতেই পারছেন প্রফেশনাল নন এসব লোকদের প্রধান অতিথি করা খুব রিস্কি ব্যাপার।

আবার প্রফেশনালদের নিয়েও কিছু সমস্যা আছে। এরা এই কাজ করতে করতে একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। যা নাকি মাঝে মাঝে জটিলতার সৃষ্টি করে। আমি এরকম একজনকে চিনি। তিনি সভাতে এসেই খোঁজ নেন সভা কতক্ষণ চলবে। সময় জেনে নিয়ে চট করে ঘুমিয়ে পড়েন। দর্শকরা কেউ তা বুঝতে পারে না। সবাই ভাবে চোখ বন্ধ করে গভীর মনোযোগে তিনি শুনছেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আধঘন্টা আগে জেগে ওঠেন এবং যথাসময়ে একটি চমত্তার বক্তৃতা দেন। একবার গণ্ডগোল হয়ে গেল। উদ্যোক্তারা বলছে অনুষ্ঠান তিন ঘণ্টার মতো চলবে। সেই হিসেবে তিনি গতার এ অভিভূত হলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান দুঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে গেল। তাকে জাগানো তার ভাবভঙ্গি দিশাহারার মতো। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একজন কানে কানে। বলল, স্যার কিছু বলুন। তিনি হুঙ্কার দিলেন, কেন?

আপনি স্যার প্রধান অতিথি।

তিনি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। দর্শকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল এবং এক সময় সবাইকে হতভম্ব করে তিনি বললেন, যুথির মা, আমাকে আধাকাপ চা দাও।

প্রধান অতিথি প্রসঙ্গে আমার নিজের একটি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা আছে। বেশ অনেকদিন আগের কথা। একদল ছেলে এসে আমাকে ধরল প্রধান অতিথি হতে হবে। আমি এককথায় রাজি। ওদের বলে দিলাম নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আমি উপস্থিত থাকব। চারটার সময় যাওয়ার কথা। আমি অবশ্যি চারটার সময় গেলাম না। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি এদের একটু দেরিতে উপস্থিত হতে হয় এটাই নিয়ম। আমি কুড়ি মিনিটের মতো দেরি করলাম। অনুষ্ঠান তখনো শুরু হয়নি। কিন্তু কী সর্বনাশ! ডায়াসে প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি দুজনই উপস্থিত। এ-কী কাণ্ড! আমি কী করব ভাবছি। উদ্যোক্তাদের একজন এগিয়ে এসে নিচুগলায় বলল, আপনি হচ্ছেন স্যার স্ট্যান্ডবাই প্রধান অতিথি। আসল জন না এলে আপনাকে বসিয়ে দিতাম।

বলো কী তুমি?

কী করব স্যার বলেন, কেউ কথা রাখে না। বলে আসবে কিন্তু আসে না। এইজন্যে স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়। আসেন স্যার, এক কাপ চা খান। চা না খেলে বুঝব আপনি রাগ করেছেন।

গেলাম চায়ের দোকানে। সেখানে আরেকজন স্ট্যান্ডবাই বিশেষ অতিথি বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। আমাকে দেখে মুখ কালো করে বললেন, আমি একা এলে একটা কথা হতো। স্ত্রী এবং ছোট শালীকে নিয়ে এসেছি, এদের কাছে কী বলি? আপনি বলুন তো ভাই!

আমি উনাকে কী বলব! আমি নিজেও আমার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি। জীবনের প্রথম প্রধান অতিথি আর স্ত্রী সেটা দেখবে না, তা কি হয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *