১.০৫ ঘুম হল না বিদিশার

[পাঁচ]

সারা রাত ভাল ঘুম হল না বিদিশার। তন্দ্রা আসছে, ছিঁড়ে যাচ্ছে, চমকে চমকে উঠে বসছে বিছানায়। পাশে অর্চিষ্মান গভীর নিদ্রায়, পানের মাত্রা আজ একটু বেশিই হয়ে গেছে তার, নীলাভ রাতবাতির আলোয় বিদিশা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তাকে। সন্ত্রস্ত চোখে। আজ নয় নিলামঘরের চুরি নিয়ে অর্চিষ্মান চিন্তিত ছিল, বিদিশাকে ভাল করে লক্ষই করেনি, এমনকি বিদিশার শরীর নিয়েও নাড়াঘাঁটা করল না, কিন্তু কাল কী হবে? কিংবা পরশু? বিদিশার মুখ দেখে কিছুই কি টের পাবে না অর্চিষ্মান? মনে কোনও সন্দেহ জাগবে না? ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তে বুকের চাপা উদ্বেগ লুকিয়ে রাখা বড় কঠিন।

টাকা চায় লোকটা! বিদিশা অত টাকা কোট্টত্থেকে পাবে? পঞ্চাশ হাজার! অর্চিষ্মানের অজান্তে অত টাকা দেওয়া কি বিদিশার পক্ষে সম্ভব? না দিলে কি ফোনের লোকটা সত্যি সত্যি সব জানিয়ে দেবে অর্চিষ্মানকে? শুনে অর্চিষ্মান কী করবে? তাড়িয়ে দেবে বিদিশাকে? তারপর? এই বিলাস, এই প্রাচুর্য, এই ঐশ্বর্য, গুমোট শ্রাবণ রাতে হিম হিম শীতল ঘরে শুয়ে থাকার এই সুখ, সব সব মিলিয়ে যাবে মহাশূন্যে।

আবার সেই মহিম হালদার লেনের বাড়ি। ওই কুৎসিত দীনহীন পরিবেশ। পাড়াপড়শিরা হাসাহাসি করবে, বন্ধুবান্ধব ব্যঙ্গ ছুড়বে, সামনে আড়ালে কানাকানি করবে আত্মীয়স্বজন—ঘুঁটেকুড়ুনির রাজরানি হওয়া কপালে সইল না তো। মাগো! বিদিশা ভাবতেই পাবে না।

আচ্ছা, বিদিশাই যদি অর্চিষ্মানকে সব খুলে বলে? কত জনের কথা বলবে? মিহির ভাস্কর অর্ক…।

মিহিরের সঙ্গে বিদিশার কলেজের রাস্তায় আলাপ। বছর চারেক আগে। চেহারাপত্র তেমন একটা আহামরি না হলেও চমৎকার কথা বলতে পারত মিহির, তিন দিন বিদিশার পিছনে ঘুরেই তাকে জপিয়ে ফেলেছিল। সাদামাটা চাকরি করত, সেলসে। হরেকরকম ঘরগেরস্থালির জিনিস ফিরি করার কাজ। সামান্য মাইনে থেকেই বিদিশার জন্য খরচ করত দু হাতে। এই রেস্টুরেন্টে ঢুকছে, এই পারফিউম কিনে দিচ্ছে…। মিহিরের সঙ্গে বার তিনেক ডায়মন্ডহারবারও গেছে বিদিশা। কলেজের নাম করে সকালে বেরিয়ে সন্ধেয় ফেরা। মাঝে সারাটা দুপুর হোটেলের নিভৃতে দু’জনে…। বেশ উদ্দামে কেটেছিল দিনগুলো। বছর খানেক মতো টিকেও ছিল সম্পর্কটা। আরও নিখুঁত ভাবে বলতে গেলে চোদ্দ মাস। বিদিশা তার মধ্যেই বুঝে গেল মিহির বাকপটু বটে, কিন্তু নেহাতই ফোঁপরা। সারাটা জীবন কাঁধে ব্যাগ বয়ে বেড়ানো ছাড়া তার আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এমন একটা চিড়িয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন কেন স্বেচ্ছায় কাটাবে বিদিশা?

ভাস্কর ছিল আরও ক্ষণস্থায়ী প্রেমিক। মিহিরেরও আগের। সেই যখন স্কুলে ইলেভেন টুয়েলভে পড়ত বিদিশা, সেই সময়ের। স্কুলগেটের উল্টোদিকে বাসস্টপের শেডের নীচে দাঁড়িয়ে থাকত ভাস্কর। কোনওদিন বা দলবল নিয়ে, বেশিরভাগ দিন একাই। নিত্যনতুন দামি দামি টি শার্ট পরত ভাস্কর, গলায় ঝুলত সোনার চেন, হাতে স্টিলের বালা। চেহারাও ছিল দারুণ ঝকমকে। টকটকে ফর্সা রং, টিকোলো নাক, ঈষৎ ঢুলুঢুলু চোখ, যেন স্বপ্নের রাজপুত্র। স্কুলফেরতা হাহা হিহি হাসির মাঝেই পরিচয়, তার পর স্কুল পালিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, গঙ্গার ঘাট, বোটানিকস। মাঝে দিন সাতেক ভাস্করের দর্শন না পেয়ে বিদিশার যখন বুক আনচান, তখনই খবর পেল ভাস্কর শ্রীঘরে ঢুকেছে। গাড়ি চুরির কেসে। এবং যেহেতু এই তার প্রথম শ্রীঘর বাস নয়, বেরোতে দেরি হবে। ভাস্করের সঙ্গে আর কস্মিনকালে দেখা হয়নি বিদিশার।

আরও একজন অবশ্য ছিল। আরও আগে। বিদিশা তখনও মাধ্যমিক দেয়নি। সেটা ঠিক প্রেম কিনা বিদিশা নিশ্চিত নয়। অরুণ নামের ছেলেটার কসমেটিকস আর ইমিটেশন গয়নার দোকান ছিল। যদুবাজারে। একটু হাসি, একটু কটাক্ষ, একটু হাত-ছোঁওয়া বাস, তাতেই মিলে যেত অনেক কিছু। লিপস্টিক নেলপালিশ চুড়ি দুল…। ভারী বোকাসোকা ছিল ছেলেটা, দোকানটা টিকিয়ে রাখতে পারেনি।

এ সব কাহিনী না বলে যদি শুধু অর্কর কথাই বলে বিদিশা? টেলিফোনের লোকটা অর্চিষ্মানকে সব কিছু শোনালেও বিদিশা তখন স্বচ্ছন্দে অনেকটাই হেসে উড়িয়ে দিতে পারবে। এ কথা তো ঠিক ভাস্কর মিহিরদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা ছিল শুধুই শারীরিক মোহ অথবা চাহিদা মেটানোর খেলা। একমাত্র অর্কর ওপরেই এক ধরনের মায়া পড়ে গিয়েছিল বিদিশার। অর্চিষ্মানের সঙ্গে বিয়েটা না হয়ে গেলে হয়তো অর্ককেই সে একদিন…

কিন্তু অর্ক এপিসোডই কি মেনে নিতে পারবে অর্চিষ্মান?

ভাবতে ভাবতেই রাত ভোর হয়ে গেল।

ঘুম থেকে উঠেই অর্চিষ্মান হুটোপুটি শুরু করে দিয়েছে। রবিবার তার সাপ্তাহিক নিলামের দিন, কোনও রকমে নাকে মুখে গুঁজে সাত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। তার পরও স্বস্তি নেই, চোরা আতঙ্কে কাঁটা হয়ে আছে বিদিশা। একতলায় নামতে সাহস হচ্ছে না, শ্বশুরমশায়ের ঘরে যেতেও পা সরে না, বাথরুমে গেলেও সঙ্গে হ্যান্ডসেট। টেলিফোন একটু ঝঙ্কার তুলল, তো ওমনি বুক হিম। এই বুঝি হানা দিল সেই ধাতব কণ্ঠস্বর।

দশটা নাগাদ পদ্মপাণির আবির্ভাব। ডাকছে,—বউদি, ও বউদি…বউদিমণি?

বিদিশা প্রথমটা শুনতে পায়নি। আয়নার সামনে বসে চুলের জট ছাড়াচ্ছিল। বার কয়েক ডাকার পর সাড়া দিল,—কী বলছ? …এসো, ভেতরে এসো।

পদ্মপাণি পর্দা সরিয়ে দরজায় দাঁড়াল,—তুমি সেদিন দুইমাছ রাঁধবে বলেছিলে না? ভাল কাতলা এনেছি আজ। মানদাকে বলেছি কাঁচা রেখে দিতে। তুমি কি একবার রান্নাঘরে আসবে?

—আজ? বিদিশা অন্যমনস্ক ভাবে বলল,—আজ থাক।

পদ্মপাণি সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল না। দাঁড়িয়েই আছে দরজায়।

বিদিশা ভুরু কুঁচকোল,—আর কিছু বলবে?

—না মানে…পদ্মপাণি আমতা আমতা করছে,—তুমি ঠিক আছ তো বউদি?

—মানে?

—না…বলছিলাম…সকালে তুমি কর্তাবাবুর সঙ্গে জলখাবার খেতে হলঘরে এলে না, সুমতি কফি নিয়ে এল, ভর্তি কাপ ঠাণ্ডা ফেরত নিয়ে চলে গেল…

বিদিশা সচকিত হল। বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা ছোটখাটো অনেক কিছু নজর করে না, কিন্তু কাজের লোকদের দৃষ্টি এড়ানো সহজ নয়। এবং এদের মনে কোনও কৌতূহল হতে দেওয়াটাও বিপজ্জনক।

মুখে হাসি টেনে বলল,—নাগো, ঠিকই আছি। এমনিই…। কাল নিলামঘরে একটা চুরি হয়ে গেল, তোমার দাদা অত দুশ্চিন্তা করছে…

—ওমা, ওই নিয়ে ভাবছ তুমি! পদ্মপাণি এক গাল হাসল,—ধন্যি বউ বাবা! ভগবান জোড়ও মিলিয়েছেন তোমাদের!

—বাহ্, তোমার দাদার টেনশান হলে আমি কী করে নিশ্চিন্ত থাকি?

—তা বটে।… তবে নিলামঘরের কর্মচারিদের অন্ন উঠে গেল। শুধু দারোয়ান নয়, দাদা সবাইকে তাড়াবে।

—সে কী কথা! কেন? অন্যরা কী দোষ করল?

—দাদা ওসব মানে না। বোঝে না। কে দোষ করল সেটা বড় কথা নয়, দুর্ঘটনাটা ঘটল এটাই আসল। সবাইকেই শাস্তি পেতে হবে। এটাই দাদার আইন।

বিদিশার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,—এ তো অন্যায় আইন। ভুল করলে এক আধবার তো ক্ষমা করে দেওয়াই যায়।

—ক্ষমা? ক্ষমা দাদা কাউকে করে না। সুমতির আগে যে মেয়েটা ছিল, সরস্বতী, সে আমাদের মালীর সঙ্গে খুব ফস্টিনস্টি করত। একদিনই দাদার চোখে পড়েছে, ব্যস সেদিনই চাকরি খতম। সরস্বতী পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিল। দাদার এক কথা, শাঁখাসিঁদুর পরে পরপুরুষের সঙ্গে মাখামাখি? এ বাড়িতে ও সব চলবে না। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

অজান্তেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল বিদিশার। পলকে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে দিঘা। ডায়াল এম ফর মার্ডারের গল্প শুনে কী রকম যেন শীতল হয়ে গিয়েছিল অর্চিষ্মান! ‘বিবাহিত নারীর প্রেমিক’—এই ব্যাপারটাই বুঝি অর্চিষ্মান সহ্য করতে পারে না। অর্ককে যদি সেদিন অর্চিষ্মান দেখে থাকে, আর তার পরে যদি বিদিশা অর্কর কথা তাকে যেচে বলে…

বিদিশা আরও সিঁটিয়ে গেল। সিঁটিয়েই রইল দিনভর। চাপা ত্রাস নিয়ে শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সারল, জোর করে হাসি ধরে রাখল মুখে। রাতে অর্চিষ্মান ফেরার পর অকারণে উচ্ছল হওয়ার চেষ্টা করল। ধুকপুক করছে বুক, অথচ ঠোঁটে গুনগুন গান, সে কী বিষম দশা!

দিনটা ইষ্টনাম জপ করতে করতে কেটে গেল।

পরদিন সকাল থেকে বিদিশার তথৈবচ দশা। কাল আসেনি ফোন, আজ যদি আসে? তবু দুরুদুরু বুকে বেরোল একবার, ড্রাইভার রবিকে নিয়ে। ব্যাঙ্কে চুড়িগুলো রেখে এল। গত দু দিন নিলামঘর নিয়ে অর্চিষ্মানের মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল দশা ছিল, ওই তুচ্ছ বিষয় মনে আসেনি, আজ যদি প্রসঙ্গ তোলে। অন্য দিন লকার খুলে গয়নাগুলো অনেকক্ষণ উলটে পালটে দেখে বিদিশা, দেখে দেখে প্রাণ যেন আর ভরে না, সোনা রুপো হিরে জহরতে শুধু হাত বোলানোতেই এত সুখ! আজ বিদিশা বন্ধ কক্ষে ঢুকল আর বেরোল। ফিরেই পদ্মপাণি মানদা সুমতির মুখের দিকে তাকাচ্ছে ঘন ঘন, কোনও ফোন এসেছিল কিনা এই নির্দোষ প্রশ্নটুকু করারও সাহস নেই। অথচ সে ভাল মতো জানে, দূরভাষের সেই কণ্ঠ আর কারুর সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হবে না।

তা সেই ফোন অবশ্য সেদিনও এল না। তার পরের দিন না। তার পরদিনও না।

একটু একটু করে ছন্দে ফিরছে বিদিশা। বৃহস্পতিবার ভোরে বেরিয়ে পড়েছে গাড়ি নিয়ে, নিয়ম মতো চক্কর দিল সল্টলেকে। অল্প অল্প উদ্বেগ নিয়ে দুপুরে ভাতঘুমও দিল একটা।

পর দিন আরও স্বাভাবিক। দিব্যি হাহা হিহি করছে শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে, মানদাকে হটিয়ে স্বহস্তে চিংড়ি মাছের মালাইকারি রান্না করল, দুপুরে ঝাঁ করে ঘুরে এল বিউটি পার্লার। ফিরে অলস মেজাজে গড়াচ্ছে বিছানায়। ধ্যুৎ, কোত্থেকে কে এক উটকো লোক উড়ো ফোন করল, মিছিমিছি তার ভয়ে কটা দিন গুটিয়ে সুটিয়ে রইল, কোনও মানে হয়! উফ, দুঃস্বপ্ন! নির্ঘাত কেউ তার সঙ্গে মজা করছিল। বলে কিনা সব খবর জানি তোমার! হাহ্, কী জানিস তুই? জানিসই যদি তো খুলে বললি না কেন? শুধু ভাসা ভাসা কথা! হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা… আরে যাহ্, তুই আমার কচু করবি।

কিন্তু অমন নিষ্ঠুর মজাটাই বা করল কে?

শূন্য ঘরে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আছে বিদিশা। ফাঁকা চোখে। এসি বন্ধ, জানলা হাট, মাথার ওপর পাখা ঘুরছে বনবন। নির্জন কক্ষে ঘুরন্ত পাখার শব্দময় নৈঃশব্দ্য। এমন নৈঃশ্বব্দ্যে কেমন যেন গা ছমছম করে। বাইরে এক মেঘলা আকাশ, মনের মেঘও যেন সরছে না।

কী ভেবে উঠল বিদিশা, ড্রয়ার খুলে একটা ছোট্ট ডায়েরি বার করল। উল্টোচ্ছে পাতা, থামল এক জায়গায়। আছে, নম্বরটা আছে।

কর্ডলেস ফোন হাতে তুলে বিদিশা পুট পুট বোতাম টিপল,—হ্যালো, মহুয়া আছে?

—বলছি। কে?

—আমি রে। বিদিশা।

মহুয়া কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর গলায় যথারীতি ব্যঙ্গ ফুটেছে,—তুই হঠাৎ! কী মনে করে?

—কেন, তোর খোঁজ নিতে নেই? মনে পড়ে, এর আগের বার আমিই ফোন করেছিলাম?

—সে তো এক যুগ আগে।

এক যুগ মানে সাড়ে পাঁচ মাস। বিদিশার বিয়ের ঠিক পর পর। মহুয়া আজকাল বিদিশার সঙ্গে এই ভাবেই কথা বলে।

ভার মুখে বিদিশা বলল,—নম্বর দিয়েছিলাম, আমাকেও তো একটু ফোন করতে পারতিস।

—পারতাম। তবে…

—কী তবে? থামলি কেন, বল।

—তোর এখন ব্যাপারই আলাদা রে ভাই। কত বড়লোকের বউ তুই, বন্ধুদের আর পাত্তা দিবি, কি দিবি না…হয়তো ডিসটার্বড হবি…

সেই পুরনো রাগ! না হিংসে?

বিদিশা মুখ বেঁকিয়ে হাসল,—ডায়ালগ ছাড়। আছিস কেমন বল।

—ভাল। ভালই।

—করছিস কী আজকাল?

—আমাদের যথা পূর্বং তথা পরং। চাকরির চেষ্টা চলছে, টাইপ শিখেছি, এখন কম্পিউটারের একটা কোর্স করছি…

—আর কোনও খবর নেই?

—আর কী খবর?

—তোর বিয়ের কদ্দূর?

—যে তিমিরে, সেই তিমিরে। মাঝে মাঝেই পাত্রপক্ষকে ইন্টারভিউ দিচ্ছি, তারা সব সিঙাড়া সন্দেশ খেয়ে পরে চিঠি লিখে জানাব বলে ভেগে যাচ্ছে…। মহুয়া একটু দম নিল,—আমি তো আর তোর মতো পটেশ্বরী নই যে শ্বশুর এসে কোলে করে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেবে!

বিদিশার পেট হাসিতে গুলগুল করে উঠল। হিংসের বহর দ্যাখো! সাধে কি বিধাতা তোকে কেলেকুষ্টি করে গড়েছিল।

হাসি চেপে বিদিশা বলল,—তুই দেখছি এখনও আমার ওপর চটে আছিস!

—আমি চটার কে? যা ভাল বুঝেছিস, করেছিস।

—বিশ্বাস কর, বিয়েটা এমন হঠাৎ ঘটে গেল, আমার কিছু করার ছিল না রে।

—থাক, বার বার এক কৈফিয়ত নয় নাই দিলি। সুখে আছিস, ভাল আছিস…

সময় মেপে নিশ্চুপ রইল বিদিশা। এত বেশিক্ষণ নয় যাতে মনে হয় ভেবে চিন্তে কথা বলছে, আবার এত কম সময়ও নয় যাতে অনুতপ্ত ভাবের ছলনাটা মহুয়ার কানে বাজে।

স্বরে একটা দুঃখী দুঃখী ভাব ফোটাল বিদিশা,—দূরের ঘাস সব সময়েই ঘন মনে হয় রে। কে দুঃখে আছে, কে সুখে আছে, অন্যে তার কী বোঝে?

প্রত্যাশা মতোই মহুয়ার স্বরে ঔৎসুক্য, এত পেয়েও তুই সুখী নোস?

যাক, টোপটা গিলেছে। আগের বার তো মহুয়া ভাল করে কথাই বলেনি। অবশ্য বিদিশাও সেবার একটু বেশি উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিল।

বিদিশা সতর্ক হল। এখন গলায় কণামাত্র বেফাঁস তারল্য এলে চলবে না। মহা নেকু মেয়ে মহুয়া। অর্কর সম্পর্কে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আহ্লাদ করে এক সময়ে ভাইফোঁটা দিত অর্ককে, রাখি পরাত।

দুঃখী ভাবটাকে আরও ঘন করল বিদিশা—আর সুখ? কোথায় অর্ক, আর কোথায় আমার এই আধবুড়ো বর।

—আধবুড়ো তো কী আছে? টাকার পাহাড়ে শুয়ে আছিস…

—টাকাই কি সব রে? সবাই কি অর্কর মতো ভালবাসতে জানে? বিদিশা স্বরে এবার দু চামচ হাহাকার মিশিয়ে দিল,—কী মোহে যে পড়েছিলাম।

মহুয়ার কোনও সাড়াশব্দ নেই। বিদিশা বেশ টের পেল ধন্দে পড়ে গেছে মহুয়া।

এবার রিসিভারে শব্দ করে শ্বাস ফেলল বিদিশা। গলা অস্বাভাবিক খাদে নামাল,— কেমন আছে রে অর্ক?

—এখন তা জেনে তোর লাভ? মহুয়া একটু মোলায়েম যেন।

—না, তুই বল। আমাকে ওর কথা একটু বল।

—কী বলব? তোর বিয়ের পর দুটো মাস তো ঘর থেকেই বেরোত না, কারুর সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলত না, তারপর আস্তে আস্তে…মাস দেড়েক আগে আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। এসপ্ল্যানেডে, ট্রাম গুমটির কাছে। তখনও কী অন্যমনস্ক। একটা দুটো কথা বলছে, উদাস হয়ে যাচ্ছে…কাজটা তুই ভাল করিসনি রে বিদিশা।

—বার বার বলিস না রে। নিজেকে এমন অপরাধী লাগে। বিদিশা ফোঁচ ফোঁচ নাক টানল। এখন সে অনেকটা নিশ্চিন্তও বটে, দিঘায় অর্কর সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা জানে না মহুয়া। গুটি গুটি এগোল বিদিশা,—অর্ক এখন আছে কোথায় রে? সেই মাসির বাড়িতেই?

—আপাতত।

—আপাতত কেন?

—শুনেছিলাম খুব শিগগিরই বোধহয় এখানকার পাট উঠিয়ে দেবে।

—কেন?

—রায়গঞ্জ ফিরে যাবে। বাবা মার কাছে। এখানে চাকরি বাকরি তো কিছু হল না, ওখানে গিয়ে এবার কী ব্যবসা ট্যাবসা করবে। ফুলদা বলছিল কোত্থেকে যেন মোটা টাকা পাবে অর্কদা…।

—টাকা? বিদিশার গলা কেঁপে গেল,—কীসের টাকা?

—তা বলতে পারব না। ফুলদা গত রোববার আমাদের বাড়ি এসেছিল, বলছিল শুনছিলাম। …অর্কদা নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে।

পঞ্চাশ হাজার। বিদিশার স্বর আটকে গেল।

টেলিফোন রেখে দিয়েও বিদিশার ঘোর কাটছিল না। অর্ক, তবে অর্কই! হতেও পারে। লোভ যে কখন মানুষকে কোন দিকে টানে। চিঠির কথা শুনে বিদিশা ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠেছিল, দেখেছিল অর্ক। হয়তো তার পরই মতলবটা মাথায় এসেছে। ভাবল কী করে গলা বদলে শাসালেই বিদিশা সুড়সুড় করে টাকা বার করে দেবে?

অন্য একটা বিদিশা পিনপিন করে উঠল বিদিশার বুকে। অর্কর মন কি এত ছোট? ভয় দেখিয়ে প্রেমিকার কাছ থেকে টাকা হাতাবে অর্ক? বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হয় না।

আরেক বিদিশা বলল, হয়তো টাকা নেওয়াটা উপলক্ষ! এতদিন পর হয়তো প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠেছে অর্কর! হতাশ মানুষ, বিফল মানুষ মরিয়া হয়ে গেলে কত নীচে নামতে পারে তার ঠিক কী?

কিন্তু একবার ফোন করে চেপে গেল কেন? দ্বিধায় পড়েছে? অপরাধবোধ এসেছে? নাকি নিষ্ঠুর ঠাট্টা করে বিদিশাকে বেতালা করে দিতে চায় অর্ক?

নাহ, ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।

[ছয়]

সকালে অর্চিষ্মান বেরিয়ে যেতেই বিদিশা সেজেগুজে তৈরি। সাজ মানে নিপুণ সাজহীন বেশ। সালোয়ার কামিজ নয়, ওয়াড্রোব ঘেঁটে সাধারণ একটা তাঁতের শাড়ি বার করে পরেছে। স্বর্ণাভরণ খুলে রাখল, হাতে শুধু শাঁখা আর লোহা। আঙুলের হিরের আংটিটা শুধু প্রাণে ধরে খুলতে পারল না। থাক গে, ওটা হিরে না কাচ অর্ক থোড়াই বুঝবে। আয়না ছেড়ে ওঠার আগে কী ভেবে সিঁথির সিঁদুরটা আরেকটু গাঢ় করে দিল বিদিশা। এখন সে এক পরিপূর্ণ সাধ্বী স্ত্রী।

পায়ে পায়ে বিদিশা শশুরের ঘরে এল,—বাবা, আমি একটু বেরোচ্ছি।

দিননাথ টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল দেখছিলেন। কত হরেক রকম প্রাণী কত বিচিত্র উপায়ে শিকার ধরে তারই জীবন্ত ছবি ফুটে উঠছে পর্দায়। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,—চললি কোথায়?

—এক বান্ধবীর বাড়ি।

—এখন? এই সকালে?

বিদিশা মুখটা করুণ করে বলল,—একটু আগে বন্ধুর ফোন এসেছিল। ওর মার অবস্থা খুব খারাপ।

—কী হয়েছে?

—স্ট্রোক মতো। কথা-টথা নাকি জড়িয়ে গেছে।

—হাসপাতালে দেয়নি?

—বলল তো বাড়িতেই রেখেছে। দেখি, একবার গিয়ে দেখে আসি।

—থাকে কোথায়?

—ওই হাতিবাগানে।

—যা, ঘুরে আয়।…সাবধানে গাড়ি চালাস।

—গাড়ি আমি নিচ্ছি না বাবা।

—কেন রে?

—অফিস টাইম, রাস্তায় বাসট্রামের ভিড়…সেদিন ভবানীপুর যেতে যা নার্ভাস লেগেছিল। এদিকটা তো আরও ক্লামজি।

—রবিকে নিয়ে যা তাহলে। রবি ডিউটিতে আসেনি?

—এসেছিল। ওকে তো তোমার ছেলে আজ অফিসে নিয়ে গেল। কোথায় যেন পাঠাবে দুপুরে।

—ও।…টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়েছিস তো?

—হ্যাঁ, বাবা।

—দেরি হলে ফোন করে দিস। নইলে আমি কিন্তু ওয়েট করব।

—আচ্ছা।

পথে বেরিয়ে বিদিশা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। পুত্রবধূ মিথ্যে বলল, এটা নিশ্চয়ই সন্দেহ করেননি শ্বশুরমশাই? তার সাদামাটা সাজ লক্ষ করেছেন কি? উঁহুঁ, তাহলে নির্ঘাত পরিহাস জুড়তেন। রুদ্রবাড়ির বউয়ের এমন যোগিনী বেশ কেন! মনে মনে হাসল বিদিশা। মেয়েদের পোশাক আশাকের ব্যাপারে বেশির ভাগ পুরুষের দৃষ্টিই তেমন সূক্ষ্ম নয়, এটা একটা মঙ্গলের কথা।

গোল চক্করের মুখে এসে ট্যাক্সি পেয়ে গেল বিদিশা। অর্কর বাড়ি হাতিবাগান ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে, প্রায় চিৎপুরের কাছাকাছি। পাড়াটা মোটেই তেমন সুবিধের নয়। কাছেই কলকাতার কুখ্যাততম নিষিদ্ধপল্লি, এ পাড়াতেও যত্রতত্র নষ্ট মেয়ের বাস। এক সময়ে বিদিশা প্রায় দিনই পাতাল বেয়ে ভবানীপুর থেকে এখানে অভিসারে আসত। দুপুরবেলা। ওই সব মেয়েরা তখন রাস্তার কলে স্নান করত, জল ভরত, হাসাহাসি করত নিজেদের মধ্যে, চোরা অস্বস্তিতে গা শিরশির করত বিদিশার।

আজ কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। বড় রাস্তাতেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়েছে, হাঁটতে হাঁটতে মাথায় আলগা ঘোমটা তুলে নিল। পুরনো আমলের পলেস্তারাহীন বাড়ির রংচটা দরজায় পৌঁছে থমকে রইল একটুক্ষণ। কড়া নাড়বে, কি নাড়বে না? সময় মেপেই এসেছে, সাড়ে দশটা বাজে, অর্কর মাসির এখন বাড়ি থাকার কথা নয়, কিন্তু…? পোস্ট অফিসে চাকরি করেন মহিলা, স্বামী মারা গেছেন, ছেলেপুলে নেই, সকাল দশটার আগেই বোনপোর জন্য রান্নাবান্না সেরে বেরিয়ে যান, তারপর সারাদিন বাড়ি একেবারে ফাঁকা। অন্তত সে সময়ে থাকত, মাস সাত আট আগে। এই কদিনে কি রুটিন বদলেছে কিছু? আজ শনিবার, কোনও সরকারি ছুটিছাটা নেই তো? বিদিশার কথা জানেন মাসি, অর্কই বলেছে। আজ বিদিশাকে বিয়ের পরও অর্কর কাছে আসতে দেখে মাসি কী ভাববেন?

যে যা খুশি ভাবুক। বিদিশা তো আজ অর্কর সঙ্গে প্রেম করতে আসেনি। দরকার হলে মাসির সামনেই বিদিশা জেরা করবে অর্ককে।

দোনামোনা করতে করতে দরজায় মৃদু করাঘাত করল বিদিশা। সঙ্গে সঙ্গেই দরজার পাশের জানালা খুলে গেছে। গরাদ বসানো জানালা, এ পারে তারজাল, ও পারে অর্কর মুখ।

দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেছে অর্কর,—তুমি! তুমি হঠাৎ?

—দরজা খোলো। কথা আছে।

মুহুর্তে উন্মুক্ত হয়েছে দ্বার। অর্কর গলায় বিস্মিত আহ্বান, এসো।

চৌকাঠ পেরিয়ে বিদিশা আরেক বার থমকাল। এই সেই পরিচিত ঘর। মাথায় ওপর মরচে ধার কড়িবরগা, দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় ভ্যাম্প, চার ব্লেডের পাখা। কিছুই বদলায়নি ঘরটার। আসবাবপত্র ঠাঁইনাড়া হয়নি এতটুকু। ওই কোণে টেবিল চেয়ার, একদিকে ফাটা কাচের আলমারি, দেওয়াল ঘেঁষে ইয়া বড় টিনের তোরঙ্গ, ও পাশের দুটো জানলা জোড়া তক্তপোষে অর্কর বিছানা, ফুলছাপ বেডকভারে ঢাকা। বাঁদিকের দরজা দিয়ে প্যাসেজে গেলে ভেতরে আর কী কী আছে তাও মনশ্চক্ষে নিখুঁত দেখতে পাচ্ছে বিদিশা। ছায়ামাখা স্যাঁতসেতে প্যাসেজের এক ধারে মাসির ঘর। অন্য ধারে বাথরুম, রান্নাঘর, খাবার জায়গা। পিছনে ছোট্ট উঠোনও আছে একটা, সেখানে টবে টবে নানান ফুলের গাছ। ছোটখাটো এই বাড়িটা বহুকাল আগে ভাড়া নিয়েছিলেন অর্কর মেলোমশাই। তাঁর অকালমৃত্যুর পর বাড়িটা এখন মাসির। তাঁর চাকরিটাও। বিদিশা জানে। আশ্চর্য, এত হতদরিদ্র পরিবেশের বাসিন্দা এই ছেলেটার প্রেমে কী করে সে হাবডুবু খেয়েছিল!

অর্ক ব্যস্ত মুখে ফুলছাপ বেডকভার টান টান করছে,—বোসো।

বসতে গিয়েও বসল না বিদিশা। ওই বিছানায় অনেক দুপুরের স্মৃতি লেগে আছে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েই সরাসরি অর্কর চোখে চোখ রাখল,—কেন এসেছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?

—না তো!

—অনুমানও করতে পারছ না?

—না, বিশ্বাস করো। অর্কর স্বরে অকৃত্রিম বিস্ময়,—তুমি আসবে আমার কাছে, এখন, এ সময়ে…এ আমার কল্পনাতেও ছিল না।

—ন্যাকামি কোরো না। বিদিশার স্বর কর্কশ হল, তুমি এত নীচে নেমে গেছে অর্ক?

—আমি! আ-আ-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না দিশা।

—বাহ্, অ্যাক্টিংটা তো ভালই শিখে গেছ! গলায় মডুলেশান তো রপ্ত করেছই, পাক্কা একজন ক্রিমিনাল হয়ে উঠতে তোমার আর বাকি নেই।

অর্কর মুখের আহত ভাব লহমায় বদলে গেল। ভারী গলায় বলল,—তুমি কি আমাকে অপমান করতে এসেছ?

—না, সাবধান করতে এসেছি। প্রচুর বাড়াবাড়ি হয়েছে, আর নয়। এবার পুলিশে খবর দেব, কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাবে।

—তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। অর্কও রীতিমত তেতে গেছে, আমারই বাড়ি চড়াও হয়ে আমায় যা নয় তাই বলে যাচ্ছ? ভেবেছ টাকা থাকলেই ধরাকে সরা জ্ঞান করা যায়?

বিদিশা দমল না। একই সুরে বলল, মেজাজ দেখাবে না, একদম মেজাজ দেখাবে না। ও সব মেজাজ তোমার ভালমানুষ মাসির ওপর ফলিয়ো। আমি জানতে চাই এ সব নোংরামির অর্থ কী?

অর্ক কয়েক সেকেন্ড স্থির। একদৃষ্টে দেখছে বিদিশাকে। বিড়বিড় করে বলল, কী নোংরামি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। উল্টোপাল্টা না বলে মোদ্দা কথাটা বলো না।

—ছি অর্ক, ছি। বিদিশা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল,—কটা মাত্র টাকার জন্য আমায় ব্ল্যাকমেল করা শুরু করলে? তুমি আমার কাছে ভিক্ষে চাইতে পারতে…

—দাঁড়াও দাঁড়াও। কিসের ব্ল্যাকমেল বলো তো? কিসের টাকা?

—এখনও অভিনয়? তুমি আমায় টাকার জন্য ফোন করোনি? ভেবেছ হেঁয়ালি করে কথা বললে তোমায় আমি চিনতে পারব না?

—আমি তোমায় টাকার জন্য ফোন করেছি? কবে? কখন?

প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল বিদিশা,—তোমার টাকার দরকার নেই?

—এই দুনিয়ায় কার টাকার দরকার নেই! আমারও আছে।

—পঞ্চাশ হাজার?

—হ্যাঁ, ওই রকমই…বলেই অর্ক হোঁচট খেল,—তুমি জানলে কীকরে?

—আমি অনেক কিছুই জানি। আমি এও জানি তোমার দৌড়বীর হওয়ার বাসনা চলে গেছে। তুমি আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন, মানে রায়গঞ্জে ফিরছ। টাকা দিয়ে তুমি এখন ব্যবসা ফাঁদতে চাও। এবং সেই টাকা আমার গলা মুচড়ে…। তুমি যখন দিঘায় চিঠিগুলোর কথা তুললে তখনই আমার আন্দাজ করা উচিত ছিল।

অর্কর মুখটা কেমন করুণ হয়ে গেল,—তুমি যা বলছ তার অনেকটাই ঠিক। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার অভিযোগের আমি বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছি না। টাকার আমার দরকার আছে। হ্যাঁ, পঞ্চাশ হাজারই। কিন্তু সে টাকা তো আমায় মাসি দিচ্ছে। মেসো মাসির নামে একটা এল আই সি করেছিল, এই জুনে সেটা ম্যাচিওর করেছে। স্পোর্টস কোটায় চাকরিটা তো শেষ পর্যন্ত হল না, আমার এমন বিদ্যের দৌড়ও নেই যে এই কলকাতা শহরে আমি…আমায় তো বাঁচতে হবে।…কিন্তু ফোন… আমি… তোমাকে…? আমি তো তোমার নাম্বারই জানি না।

—মিথ্যে কথা।

—আমি মিথ্যে বলি না দিশা। তুমি জানো। অর্কর স্বর অসম্ভব ঋজু। ওই স্বরকে অবিশ্বাস করতে চেয়েও পারছিল না বিদিশা। মিথ্যে কেন, অর্কর মধ্যে যে কোনও কপটতাও নেই, এ কথা বিদিশার থেকে বেশি আর কে জানে! ভাস্কর মিহির ছিল চালবাজ টাইপ। নিজেরা যা, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তার থেকে অনেক বেশি দেখানোর চেষ্টা করত নিজেদের। অর্ক একদম উল্টো। মহুয়ার বাড়িতে প্রথম আলাপের দিনই অবলীলায় নিজের অবস্থার কথা বলে দিয়েছিল। সে যে একজন অতি সাধারণ প্রাইমারি স্কুল টিচারের ছেলে, আরও পাঁচটা ভাই বোন আছে তার, বাড়িতে থাকতে ভাল করে খাওয়া জুটত না, কিন্তু দৌড়বীর হওয়ার নেশাটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, এই নিঃসন্তান মাসির আশ্রয়ে থেকে স্বপ্নটাকে সে সফল করতে চায়…। কিছু কখনও গোপন করেনি অর্ক, কিচ্ছু না, ফুল ছাড়া কক্ষনও তাকে সামান্যতম কিছু উপহার দেয়নি অর্ক। বিদিশা রসিকতা করলে সোজাসুজি বলেছে, আমার টাকা কই দিশা! দু চার পয়সা যদি জোটাতেও পারি, সে আমি হয় মাসিকে দেব, নয় দেশে পাঠাব! আমরা তো পরস্পরকে ভালবাসি, তবে আর এই কেতাবি ঠাট ঠমকের প্রয়োজন কী!

বিদিশা ধম করে বিছানাতেই বসে পড়ল। শুকনো মুখে বলল, —তুমি নও? তাহলে কে?

চেয়ার টেনে এনে সামনে বসল অর্ক,—কী হয়েছে আমাকে খুলে বলো দিকিনি?

অর্ক শুনল সব। গুম হয়ে। তারপর উঠে পায়চারি করছে ঘরে। মাথা ঝাঁকাচ্ছে মাঝে মাঝেই। স্বগতোক্তির মতো বলল,—তুমি ধরে নিলে, আমি? এত অবিশ্বাস আমাকে, এত?

বিদিশা অফুটে বলল,—কারণ ছিল বলেই না…

—ও! অর্ক এক মুহূর্ত জরিপ করল বিদিশাকে। আপাদমস্তক। ঠোঁটের কোণে বিচিত্র এক হাসি ফুটে উঠেছে। হঠাৎ ঝাঁ করে গিয়ে টিনের তোরঙ্গ খুলল। বার করছে একের পর এক পুরনো রানিং শু, ট্র্যাক স্যুট। একদম নীচ থেকে তুলে আনল একটা প্লাস্টিক প্যাকেট। দড়াম করে তোরঙ্গ বন্ধ করে প্যাকেটটা ছুড়ে দিল বিদিশার কোলে,—গুনে নাও, সাঁইত্রিশটাই আছে।

বিদিশা অবশ্য সত্যি সত্যি গুনল না। প্যাকেট ফাঁক করে আলগা চোখ বুলিয়ে চিঠিগুলো ব্যাগে রেখে দিচ্ছিল, অর্ক দ্রুত এসে ছোঁ মেরে কেড়ে নিল,—উহুঁ, এগুলো তো তোমার প্রাপ্য নয়, এগুলো আমার।

বিচলিত স্বরে বিদিশা বলল,—তুমিই রেখে দেবে?

—এসো। দ্যাখো কী করি।

অর্ক ভেতরে ঢুকে গেল। পিছন পিছন বিদিশা, যন্ত্রচালিত মানবীর মতো। রান্নাঘরে এসে অর্ক গ্যাস জ্বালাল, প্যাকেট থেকে একটা একটা করে চিঠি বার করে পোড়াচ্ছে। নীল শিখায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে নীল খাম, লাল আগুন হিসহিস নাচছে। উৎকট কাগজপোড়া গন্ধ ছড়িয়ে গেল গোটা বাড়িতে।

বহ্ন্যুৎসব শেষ করে থামল অর্ক,—শান্তি হয়েছে তো?

বিদিশা নতমুখে সরে এল। বুকের মধ্যে এক তোলপাড় করা অনুভূতি। সহসাই। এই সরল যুবককে সে ঠগ জোচ্চর ক্রিমিনাল ভেবেছিল, অথচ প্রকৃত প্রতারক সে নিজেই। একটি বারও তার দিকে আঙুল তুলল না অর্ক, শুধু তাকে আশ্বস্ত করার জন্যই সযত্নে রাখা চিঠিগুলো…! দিঘায় বলেছিল না, ওইটুকুই আমার সম্বল!

পিছনে অর্কর গলা, ভাবনা তো গেল, এবার একটু হাসো।

প্রাণপণে হাসার চেষ্টা করল বিদিশা। এ হাসি যেন কান্নার চেয়েও বিষণ্ণ। যেন শীতের আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে, মলিন সূর্য তাকে ভেদ করে উঁকি দিতে পারছে না।

ভেজা ভেজা গলায় বিদিশা প্রশ্ন করল,—কবে রায়গঞ্জ যাচ্ছ?

—দেখি। সবটাই একটা সুতোর ওপর ঝুলছে।

—কেন?

—একটা শেষ চেষ্টা করছি। কন্টাইতে স্টেট মিটে গিয়েছিলাম না, রানারস হয়েছি। দেখেছ নিশ্চয়ই কাগজে?

—না… মানে… তখন তো দিঘায়…। তুমিও তো কিছু বলোনি?

অদ্ভুত হাসল অর্ক। একটু থেমে থেকে বলল,—চ্যাম্পিয়ানের সঙ্গে মাত্র পয়েন্ট ওয়ান সেকেন্ডের মার্জিন ছিল। ন্যাশনাল মিটে আমরা দুজনেই স্টেটকে রিপ্রিজেন্ট করব। যদি সেখানে কিছু করতে পারি তো…

—নিশ্চয়ই পারবে। বিদিশা সহজ হওয়ার চেষ্টা করল।

—খুব টাফ। দিল্লি মহারাষ্ট্র তামিলনাড়ু—অন্তত জনা সাতেকের টাইম আমার থেকে বেটার। তবু এটাই আমি লাস্ট মোটিভেশান হিসেবে ধরে নিয়েছি। যদি হারি, তো চিরবিদায়।

—তুমি হারবে না। তোমার জেদ আছে, অ্যাম্বিশান আছে…

—শুধু কপালটাই নেই। লাক, যাকে বলে উইনারস লাক। না হলে কি তুমি আমার কাছ থেকে…! অর্ক মাঝপথেই কথা ঘুরিয়ে নিল, নেক্সট মানথে তোমাদের সল্টলেক স্টেডিয়ামে আমার ক্যাম্প শুরু হচ্ছে। যেটুকু মাজা ঘষা ওখানেই করতে হবে। তারপর যা হবে সব উপরওয়ালাকা খেল।

—হুঁ। বিদিশা আবার দূরমনস্ক, কিন্তু ফোনটা কে করেছিল বলো তো?

—আরে দূর, ওসব কোনও বখা ছেলেদের কাজ। কাগজে পড়োনি, কলকাতায় ইদানীং, একটা র‍্যাকেট গজিয়েছে, তারা ফোনে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে…

—কিন্তু আমার নাম জানবে কীকরে?

—হয়তো তোমাদের আশপাশের বাড়ির কোনও ছেলেই সে দলে আছে। তোমাদের সল্টলেক বড়লোকের জায়গা, ওই সব গুণধর ছেলেরাও পয়সাঅলা বাড়ির। কে কীভাবে তোমার নাম জেনে নিয়েছে তার ঠিক আছে!

—হতে পারে। বিদিশা আরও আনমনা,—আমার কিন্তু একজনকে সন্দেহ হচ্ছে।

—কে? চেনা পরিচিত কেউ?

—সে তো বটেই।

—প্রতিবেশী?

বিদিশা উত্তর দিল না। মনে মনে নামটা ভাঁজছিল।

[সাত]

পরদিনই বিদিশা বাপের বাড়ি ছুটল। অর্চিষ্মানের নতুন জেন টিউনিং-এর জন্য গ্যারেজে গেছে, স্বামী-স্ত্রী একই সঙ্গে মারুতিতে বেরিয়েছিল, পথে পার্ক স্ট্রিট নেমে গেল অর্চিষ্মান। আজ আবার নিলামের দিন, ডাক শুরু হবে ঠিক দশটায়, তার অন্তত আধ ঘণ্টা আগে দোকানে পৌঁছে যাওয়া অর্চিষ্মানের অভ্যাস। বিদিশাকে নামিয়েই রবি দোকানে ফিরে গেল, বিকেল সন্ধে নাগাদ এসে মালকিনকে তুলে নিয়ে যাবে। অনেক কাল পর আজ সারাটা দিন মহিম হালদার লেনে কাটাবে বিদিশা।

শখ করে নয়, বাবা-মার প্রতি ভালবাসার টানেও নয়, বিদিশার আজ অন্য উদ্দেশ্য আছে।

কাল অর্কর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিদিশার মনের ভার অনেক লঘু হয়েছে বটে, কিন্তু নতুন কাঁটাটা খচখচ করেই চলেছে বুকে। ফোনের বজ্জাতটা যখন অর্ক নয়, তখন দাদা ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে! পুরোপুরি চাপমুক্ত হতে গেলে দাদাকে একবার বাজিয়ে দেখা দরকার। তারপর নয় গোটা ব্যাপারটাকে নিছক ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে।

চিত্রভানু আর বিদিশার সম্পর্কটা কোনও দিনই খুব সরল নয়। ভাইবোনে বয়সের ফারাক মাত্র আড়াই বছরের। অর্থাৎ প্রায় পিঠোপিঠি। এত কম তফাতে ভাই বোনে একটু আধটু খুনসুটি হয় বটে, তবে পরস্পরের প্রতি তীব্র এক টানও থাকে। চিত্রভানু আর বিদিশার মধ্যে সেটা একদমই নেই। জন্মের পর খুব বেশি দিন বাবা মার অখণ্ড মনোযোগ পায়নি চিত্রভানু, হয়তো বা সেই জন্যই।

ছোটবেলা থেকেই বোনের ওপর চিত্রভানুর প্রবল হিংসে। কী আজব আজব কাণ্ডই না করত চিত্রভানু, ওই ঈর্ষা থেকেই! পুজোয় বোনের এক সেট বেশি জামাকাপড় হয়েছে, সবার অগোচরে বোনের সব ফ্রক কখন ব্লেড দিয়ে চিরে রেখেছে চিত্রভানু! পরীক্ষায় বিদিশা ভাল নম্বর পেল হয়ে, প্রভাকর খুশিতে ডগমগ হে মেয়েকে কলম কিনে দিলেন, পরদিনই নতুন কলম ভ্যানিশ! লন্ডন-ফেরত মামা চমৎকার এক টকিং ডল এনে দিয়েছিলেন বিদিশাকে, সাত দিনের মধ্যে সেই পুতুল মুণ্ড ছেঁড়া অবস্থায় ডাস্টবিনে পাওয়া গেল। প্রভাকর চোরের মার মেরেছেন চিত্রভানুকে, কিন্তু ছেলের স্বভাব বদলাতে পারেননি। উল্টে ছেলে আরও বিগড়েছে। ক্লাস ফাইভে উঠে নাচ শেখার ক্ষণস্থায়ী শখ হল বিদিশার, বেলতলার এক নাচের স্কুলে প্রভাকর মেয়েকে ভর্তি করে দিলেন, আহ্লাদ করে মেয়ের জন্য দামি ঘুঙুর কেনা হল—প্রতিদিন ঘুঙুরের একটা করে ঘণ্টি ছিঁড়ে রাখত চিত্রভানু। একজন বুড়ো মতো মাস্টারমশাই বাড়ি এসে পড়াতেন ভাইবোনকে, একদিন বুঝি তিনি বলেছিলেন চিত্রভানুর থেকে বিদিশার মাথা অনেক সাফ, ব্যস্ বুড়ো মানুষটার চপ্পলই আর খুঁজে পাওয়া গেল না। বোনকে হিংসে করতে করতেই চিত্রভানু বুঝি লেখাপড়ায় আরও তলিয়ে গেল। মাধ্যমিকে মেরেকেটে দু দাঁড়ি, হায়ার সেকেন্ডারি টায়েটুয়ে পাশ, কলেজের গণ্ডিটা তো আর উতরোলই না। চিরকালই যত রাজ্যের ওঁচা ছেলেদের সঙ্গে ভাব, এখনও তারাই চিত্রভানুর দুনিয়া বেহেশত দোজখ। এমন দাদাকে মনে মনে একেবারে ক্লিন চিট দেয় কী করে বিদিশা?

যে এক চাইতে পারে, সে দশও চাইতে পারে। যে দশ চাইতে পারে, পঞ্চাশ চাইতেই বা তার বাধা কোথায়! সঙ্গ গুণে হিংসুটে দাদার লোভের মাত্রা কোথায় পৌঁছেছে, বিদিশা কি তার পুরো হদিশ রাখে!

আজ অবশ্য বাপের বাড়ি আসার পিছনে বিদিশার অন্য এক গৃঢ় অভিপ্রায়ও আছে। সেটি ক্রমশ প্রকাশ্য।

যথারীতি হাট দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেই বিদিশা দেখল প্রভাকর চৌকিতে আধশোওয়া হয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট, লম্বা ছাই এই বুঝে খসে পড়ে। বয়স এখনও ষাট ছোঁয়নি প্রভাকরের, দেখে কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব বলে ভ্রম হয়। ক্ষয়াটে চেহারা, লম্বাটে মুখ, ফর্সা রং জ্বলে তামাটে, মাথার চুল সব প্রায় পাকা। এক সময়ে মোটামুটি রূপবান ছিলেন, এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই, একমাত্র খাড়া নাকটি ছাড়া।

মেয়েকে অসময়ে দেখে প্রভাকর ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেল, শুরু হয়ে গেল হইচই। নিজের হাতেই চাদর টান টান করছেন, চেয়ার ঝাড়ছেন, টুল সরাচ্ছেন…। ভারতীও ছুটে এলেন, মেয়ে গোটা দিন থাকবে শুনে তাঁরও মুখে হাসি ধরে না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চা বিস্কুট এসে গেল। চানাচুর চিড়েভাজাও।

বাবা-মার শশব্যস্ত আপ্যায়নে বেশ মজা লাগছিল বিদিশার। যেন সে এই ঘোষবাড়ির মেয়েই নয়, ছিলও না কোনও দিন, যেন রুদ্রবাড়ির মহিমান্বিত বউ হঠাৎ এসে ধন্য করে দিয়েছে মহিম হালদার লেনের এই পরিবারকে। আদর অভ্যর্থনায় পান থেকে চুন খসলে বুঝি বা এদের ফাঁসি দ্বীপান্তর হয়ে যাবে। এইটুকু দূরত্ব থাকা এখন বোধহয় ভাল। বেচারার দল!

বিদিশা ঘাড় ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,—দাদাকে দেখছি না? সে কোথায়?

প্রভাকর গম্ভীর হলেন,—নবাবপুত্ত্বর এখনও শয্যা ছাড়েননি।

ভারতী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন,—আহা, কাল শুতে অত রাত হল…

—কেন রাত হল? কেন রাত করে ফেরে?

—বারে বলল না, কোন এক বন্ধুর জ্যাঠা মারা গেছে।…শ্মশানে গেছিল…

—শাক দিয়ে মাছ ঢেকো না। অন্য দিন বুঝি সন্ধেবেলা ফেরে? প্রভাকর মেয়ের দিকে ফিরলেন,—তোর মা…এই তোর মা’ই যত নষ্টের মূল। লাই দিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে একেবারে গোল্লায় পাঠাল। আমাদের বংশে আর একটাও অমন লক্ষ্মীছাড়া জন্মায়নি।

—তুমি খালি ওর দোষই দ্যাখো। ভারতীর মুখ ভার।

—গুণও আছে বুঝি হারামজাদার? …কী গুণ, অ্যাঁ? মড়া বওয়া? কার পিসি হাসপাতালে খাবি খাচ্ছে তার জন্যে দৌড়ে বেড়ান?

—অন্যের উপকার করা দোষ?

—ওরকম ঘরেরটি খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াতে অনেকেই পারে। হারামজাদাকে বলে দিয়ো, প্রভাকর ঘোষ আর ওই দামড়ার নাদা ভরাতে পারবে না। সে যেন নিজের বন্দোবস্ত নিজে করে নেয়।

নিয়মমাফিক বাদবিতণ্ডা হল কিছুক্ষণ। থামলও এক সময়ে। কথা হচ্ছে টুকটাক। এলোমেলো। দিননাথ নিজে ধূমপায়ী না হয়েও বেয়াই-এর জন্য এক প্যাকেট দামি সিগারেট পাঠিয়েছেন, বিদিশার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে প্রভাকর উল্লসিত, উল্টেপাল্টে দেখছেন। ভারতী রান্নাঘরে চলে যেতেই প্যাকেট খুলে রাজা মাপের সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়েছেন প্রভাকর। ধরিয়ে তৃপ্তির ধোঁয়া ছাড়ছেন। হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল। বললেন,—হ্যাঁরে বুলু, তোদের দোকানের চুরিটার কিছু সমাধান হল?

বিদিশা আকাশ থেকে পড়ল,—তুমি কোত্থেকে জানলে?

—অর্চিষ্মানের কাছ থেকে! আমি তো পরশু দুপুরে তোদের নিলামঘরে গেছিলাম। অর্চিষ্মান বলেনি?

—না তো!

—তাহলে বোধহয় ভুলে গেছে। কাজেকম্মে থাকে…প্রভাকর যত্ন করে অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়লেন,—অফিসের এক কলিগকে নিয়ে গেছিলাম, বুঝলি? পুরনো শোকেস কিনতে চায়, বললাম আমার জামাই-এর দোকানে চলো…। তা গিয়ে দেখি এক পুলিশ অফিসার বসে আছে।…সে উঠে যেতেই কথায় কথায়…। অর্চিষ্মান খুব চাপা আছে, না রে? কিছু ভেঙে বলতে চায় না।

—হুম্। বিদিশা ঈষৎ আনমনা।

—টাকা পয়সা তো শুনলাম তেমন কিছু যায়নি! এত থানা পুলিশ করছে কেন? সেদিন যা সিরিয়াস মুখে দারোগাটার সঙ্গে কথা বলছিল…! অন্য আর দামি কিছু গেছে নাকি?

—জানি না তো।

ভারতী আবার দরজায়। কী যেন ইশারা করছেন প্রভাকরকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন প্রভাকর,—তুই একটু বোস, আমি চট করে ঘুরে আসছি।

—কোথায় যাচ্ছ?

—এইই, যাব আর আসব।

—বাজার যাচ্ছ?

ধরা পড়া মুখে হেসে ফেললেন প্রভাকর।

বিদিশা আলাগা ভাবে বলল,—থাক না বাবা। যা আছে তাই না হয়…

প্রভাকরের হাসি চওড়া হল—আরে দূর, তোর অনারে আমরাও আজ একটা স্পেশাল খাওয়াদাওয়া করব না? কীখাবি বল? ইলিশ, না চিংড়ি? মুরগি, না মাটন?

—সে তোমার যা ইচ্ছে।

ভেতরে চলে গেলেন প্রভাকর। চাপা স্বরে কী যেন কথা হচ্ছে ভারতীর সঙ্গে, ঠিক শুনতে পাচ্ছিল না বিদিশা। মিনিট কয়েকের মধ্যেই পাঞ্জাবি চড়িয়ে থলি হাতে প্রভাকর বেরিয়ে গেলেন।

ভারতী মশলা বাটতে বসে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আরও একটা দুটো কথা বলে চিত্রভানুর ঘরে এল বিদিশা।

চিত্রভানু জেগেই ছিল। বোনের আবির্ভাবেও কোনও হিলদোল নেই। শুয়ে শুয়েই আড়মোড়া ভাঙছে।

শুয়ে শুয়েই মন্তব্য ছুড়ল—আজ এখানে বডি ফেলে দিলি?

বিদিশা মুখ টিপে বলল,—বাপের বাড়ি আসাকে বডি ফেলা বলে বুঝি?

ছোট্ট হাই তুলল চিত্রভানু,—ভাল ভাল। আরও কিছু ধসিয়ে যা। মিস্টার প্রভাকর ঘোষ হার হাইনেসের বাপ হওয়ার ঠেলা বুঝুক।

—মানে?

—বাবা মার ডায়ালগটা শুনতে পাসনি? নাকি ওই সময়ে কানের পর্দা মোটা হয়ে যায়?

বিদিশার চোখ বড় বড়,—সত্যিই শুনতে পাইরে রে!

চিত্রভানু কথাটা বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। উঠে বসেছে তক্তপোষে। এ ঘর এক সময়ে বিদিশার দখলে ছিল। হাত বদল হওয়ার পরে এ ঘরের এখন আর সামান্যতম শ্রী সৌষ্ঠবও নেই। যত্র তত্র জামা প্যান্ট ছড়ানো, মেঝেয় পোড়া সিগারেটের টুকরো, ছোট টেবিলে ছেঁড়াখোঁড়া কাগজের জঙ্গল, তার ওপরে ফাটা একটা আয়না…। সদ্য খুঁট খোলা মশারি স্তূপ হয়ে আছে বিছানার কোণে, তারই মধ্যে থেকে হাতড়ে হাতড়ে একটা টিশার্ট বার করল চিত্রভানু।

খালি গায়ে টিশার্টটা চড়াতে চড়াতে বলল,—আজ মাসের কত তারিখ খেয়াল আছে? টোয়েন্টি নাইনথ। বাবার পকেট ঢুঁ ঢুঁ । এখন ধার করতে ছুটল। তোকে খাওয়াতে।

বিদিশা আজ কিছুতেই চটবে না পণ করে এসেছে। তবু আহত হল। গোমড়া মুখে বলল,—আমি কী করব? আমি কি বাবাকে জোর করে পাঠিয়েছি?

—তোর এরকম দুম করে হাজির হওয়াটাই তো জোর করা।

—আমি এসেই চলে গেলে তুই খুশি হতিস?

—তোর বাপের বাড়ি, তুই ইচ্ছে হলে আসবি, আসবি না…আমি খুশি অখুশি হওয়ার কে? আমি শুধু অন্য হিসেব কষছি।

—কী হিসেব?

—পঞ্চাশের সঙ্গে আরও কিছু প্লাস হল। এটা অবশ্য পাড়া থেকেই ম্যানেজ করবে। হয়তো বিনা সুদেই…।

বলতে বলতেই গলা তুলে চায়ের হুকুম ছুড়ল চিত্রভানু। বিদিশাকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে অলস পায়ে ছোট ঘরে এল। চোখের সামনে কাগজ মেলে চৌকিতে বসেছে।

বিদিশা প্রাণপণে মাথা ঠাণ্ডা রাখল। এসেছে পিছন পিছন,—তোকে একটা কথা বলব দাদা?

—বলে ফ্যাল।

—বাবার জন্য তোর যখন এত চিন্তা, নিজে কিছু একটা কর না।

—কী করব? চাকরি? বিদ্যেয় কুলোচ্ছে না। চিত্রভানু শব্দ করে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাল,—বল্লবগড়ের ঘোষবাড়ির ছেলে হয়ে তো আর কুলিগিরি করতে পারব না।

বিদিশা পাকা দাবাডুর মতো এগোতে চাইল। সন্তর্পণে একটা বোড়ে ঠেলে দিল,— চাকরি নয় না’ই করলি। ব্যবসা কর।

—টাকা কে দেবে? তোর শ্বশুর?

—ধর, শ্বশুরের বউমাই দিল।

ঝপাং করে কাগজ ভাঁজ করল চিত্রভানু। সরু চোখে তাকাল,—তুই! তুই দিবি?

—দিতেই পারি। বিদিশা ঠোঁট চেপে হাসল। কোনাকুনি গজ ঠেকল,—তুই সেদিন আমার কাছে টাকাটা চাইলি, আমি না বলে দিলাম…বাড়ি গিয়ে আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে রে! সত্যিই তো, আমি যখন একটা ভাল জায়গায় পৌঁছেছি, তখন আমরাও তো উচিত বাবা মা ভাইকে দেখা, নয় কি?

—তুই এসব কথা ভাবলি? চিত্রভানুর গলায় স্পষ্ট অবিশ্বাস।

—ভাবি রে, ভাবি। অহরহ ভাবি। আরেকটা বোড়েকে এক ঘর এগোল বিদিশা,— কিন্তু একটা ধন্দ আমার থেকেই যাচ্ছে। দশ হাজার ইনভেস্ট করে তুই কী এমন ব্যবসা করবি, যাতে লাইফে শাইন করা যায়?

—বললাম তো, আছে ব্যবসা। ক্যাপিটাল পেলে দেখিয়ে দেব।

—কী দেখাবি? অল্প পুঁজির ব্যবসায় খাটুনি খুব, অনেক দিন লেগে থাকতে হয়। ও তুই পারবি না। বিদিশা ঝটাং করে ঘোড়া বাড়িয়ে দিল। একটু প্যাঁচ কষে, আড়াই পাক। মধুর স্বরে বলল,—তুই একটু বড় কিছু ভাবছিস না কেন? ধর, তোকে আমি যদি পঞ্চাশ হাজার দিই?

আশ্চর্য, চিত্রভানুর মুখে কোনও প্রতিক্রিয়াই ফুটল না। ঠোঁটের কোণটা বেঁকে গেল সামান্য,—টিজ করছিস?

—নো। ইটস অ্যান অফার। ওই টাকাতে একটা তুই ক্যাসেট ম্যাসেটের দোকান দে। যদি লেগে যায়…পারলে টাকাটা আমায় ফেরত দিয়ে দিস। আর ডুবলে ধরে নেব টাকাটা গেল। বিদিশা ঝাঁ করে মন্ত্রী চার ঘর এগিয়ে দিল,—বাট মাইন্ড ইট, দিলে আমি পঞ্চাশ হাজারই দেব। শুনছিস? পঞ্চাশ হাজার।

—ধুস্‌, তোর কাছ থেকে টাকা আমি নেবই না। আমি কি তোকে চিনি না? সারা জীবন খোঁটা দিবি তার পর। দাদাটার কিচ্ছু হচ্ছিল না, আমি দাঁড় করিয়ে দিলাম! বলতে বলতে আবার কাগজ টেনে নিল চিত্রভানু,—কী ভাবিস আমাকে? তোর কাছ থেকে দু চার পয়সা খামচা মারি বলে আমি কি ভুখ্খার পার্টি নাকি?

বিদিশা হতাশ হয়ে গেল। কক্ষচ্যুত ঘুটিগুলোকে আবার রাখছে স্বস্থানে, হৃদয়ে দাবার বোর্ডটাকে মুড়ে ফেলল। বিচিত্র এক অনুভূতি হচ্ছে বুকে। হতাশার সঙ্গে সঙ্গে একটা মুক্তির শিহরনও যেন টের পাওয়া যায়। নাহ্, দাদা নয়, দাদা নয়। দূরভাষের সেই কণ্ঠ অলীক ঠাট্টাই। তার দাদা এখনও এত দুঁদে অপরাধী বনে যায়নি, যে বার বার পঞ্চাশ হাজার শব্দটা শুনেও সম্পূর্ণ অভিব্যক্তিহীন রাখতে পারবে নিজেকে।

আচম্বিতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল চিত্রভানু,—তুই এত টাকা দেব দেব করছিস কেন রে? বিদিশা হাসার চেষ্টা করল,—এমনিই। তোর কথা ভেবেই।

—কিন্তু টাকাটা তো তোর নয়। তুই তো একটা প্যারাসাইট। অর্চিষ্মান রুদ্রর রোকড়া দেখিয়ে তুই ফুটুনি মারছিস কেন? বরং আমার উপকার যদি করতে চাস, তো অন্য ভাবে করতে পারিস। তোর বরকে বলে ওর দোকানে বা বারে যেখানে হয় আমায় ফিট করে দে। সংসারটাও বাঁচে, তোর কাছেও আমার হাত পাততে হয় না।

বিদিশা এবার কুঁকড়ে গেল। অর্চিষ্মান কী প্রকৃতির মানুষ সে এখন মোটামুটি জেনে গেছে। পদ্মপাণি সেদিন যা বলল তার কণামাত্রও যদি সত্যি হয়, তাহলে অৰ্চিষ্মানের কাছে কোনও আত্মীয়স্বজনকে চাকরি করতে দেওয়া সুবিধের হবে না। তার এই দাদাটিকে তো নয়ই। এক তিল গড়বড় হলেই নির্দ্বিধায় চিত্রভানুকে গলাধাক্কা দেবে অর্চিষ্মান, এবং বিদিশার জীবনটাও বিষময় হয়ে উঠবে।

তবু সরাসরি না করল না বিদিশা। ইতস্তত মুখে বলল,—দেখি। বলব।

ভারতী ছেলের চা এনেছেন। প্লেটে চা ঢেলে সড়াৎ সড়াৎ চার চুমুকে কাপ খালি করল চিত্রভানু, একবার টেরিয়ে বিদিশাকে দেখে বাথরুমে চলে গেল।

ভারতী তখনই নড়লেন না। চাপা স্বরে প্রশ্ন করলেন,—ভানু কী বলছিল রে? কী সব ব্যবসা…টাকা…অর্চিষ্মান…?

—ও কিছু না। বিদিশা প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। পাল্টা প্রশ্ন করল,—মা, আমায় একটা সত্যি কথা বলবে?

—কী?

—দাদা সব সময়ে বলে আমার বিয়ের জন্য বাবা নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার নিয়েছে। কাবলিঅলার কাছ থেকে। সত্যি?

ভারতীর মুখ পাংশু হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বললেন,—উফ, ভানুকে নিয়ে আর পারি না।

—তার মানে দাদা ঠিকই বলে?

—হ্যাঁ, মানে…। ও নিয়ে তুই ভাবিস না বুলু। কত বড় একটা দায় উদ্ধার হয়ে গেছে আমাদের…। তাছাড়া টাকা শোধের বন্দোবস্ত হয়ে গেছে।

—কোত্থেকে হল?

—সে প্রায় আকাশ ফুঁড়েই বলতে পারিস। ভারতীর মুখে অনাবিল হাসি,— বল্লভগড়ে তোর বাবাদের অনেক জমিজমা ছিল না…সেইগুলো কিছু বিক্রি হচ্ছে। বেশ কয়েক লাখ টাকার জমি। জ্ঞাতিগুষ্টিতে ভাগ হয়েও তোর বাবার হাতে পঞ্চাশ হাজার মতো আসবে।

বিদিশার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না কথাটা, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছিল না। বল্লভগড়ে তাদের দেশ বটে, তবে বর্ধমানের সেই গঞ্জ অঞ্চলে সে বড় একটা যায়নি। আবছা আবছা মনে আছে প্রকাণ্ড একটা বড়ি, অজস্র শরিক চারদিকে, খোপে খাপে পাখির মতো বাস করে তারা। সেখানে কী এমন সম্পদ ছিল যার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জুটবে বাবার? এত ভূসম্পত্তির অংশীদার হয়েও কেনই বা বাবা এই হতদরিদ্র দশায় দিন কাটায়? বল্লভগড়ের সঙ্গে বাবার তো তেমন সম্পর্কও নেই! তার বিয়েতেও ওখান থেকে বিশেষ কেউ আসেনি। এক আইবুড়ো পিসি, এক কাকা, ব্যস।

চিন্তাটা বেশি দূর গড়াতে পারল না। প্রভাকর চিংড়িমাছ আর মুরগি সমেত হাজির। ভারতী পই পই করে নিষেধ করেছেন বলে কাবুলিঅলার প্রসঙ্গ বাবার সামনে আর তুলল না বিদিশা।

অনেক বেলা অবধি হইহই হল। খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে প্রায় আড়াইটে। মুখে চারটি গুজেই চিত্রভানু ধাঁ। প্রভাকরও একটু শুতে গেলেন।

মাকে কাটিয়ে কুটিয়ে বিদিশা দাদার ঘরে এল। একটা গড়ানোর বাহানা করে। এই বেলা আরও একটা কাজ সেরে ফেলতে হবে। আসল কাজ।

নিঃসাড়ে দরজায় ছিটকিনি তুলল বিদিশা। মেঝেয় বসে তক্তপোশের তলা থেকে টেনে বার করল একটা কালো ট্রাঙ্ক। বিদিশার নিজস্ব তোরঙ্গ। স্মৃতির ঝাঁপি।

ট্র্যাঙ্ক খুলেই বিদিশার বুক ধক করে উঠেছে। ভেতরে শুধুই গাদা গাদা পুরনো কাপড়। তার নিজস্ব ছোট্ট বাক্সটি কোথথাও নেই!

[আট]

দরজা খুলে বিদিশা চেঁচিয়ে ডাকল—মা? …মা?

সাড়া পেতে একটু বুঝি সময় লাগল। পাশের ঘর থেকে হাই তুলতে তুলতে এসেছেন ভারতী,—কী হল, তুই শুসনি?

বিদিশা উত্তর দিল না। অস্থির ভাবে মাথা ঝাঁকাল,—আমার সব জিনিসপত্রগুলো গেল কোথায়?

—কী জিনিস?

—আমার জিনিস। আমার ট্র্যাঙ্কে যা ছিল।

—ও, তোর পুরনো শালোয়ার কামিজ? ও তো আর তুই পারবি না। ভারতী এক গাল হাসলেন, ওগুলো সব আমি সাবিত্রীর মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি। পড়ে পড়ে নষ্ট হওয়ার থেকে গরিব মানুষ পরে বাঁচুক।

—আর আমার কাঠের বাক্সটা?

—ওতে তো শুধুই ঝুটো গয়না। ও আর তোর কী কাজে লাগবে?

—মানে? ওটাও দিয়ে দিয়েছ? বিদিশা এক সেকেন্ড থমকাল,—আমার অত সব শখের গয়না…

—নারে বাবা না। ওটা আছে। যত্ন করেই তোলা আছে।

—কোথায়?

—আলমারিতে।

—নিয়ে এসো তো বাক্সটা।… গয়নাগুলো একটু দেখব।

ভারতী যেন সমান বিস্মিত। কোটিপতি মেয়ে এখন সর্বাঙ্গ সোনামোড়া হয়ে থাকতে পারে, তবু ওই তুচ্ছ নকল গয়নার ওপর টান এখনও মরেনি, বুঝি এই কথা ভেবেই।

বাক্সটা আনতেই বিদিশা ছোঁ মেরে হাতে নিয়ে নিল। ওয়ালনাটের বাক্স, গায়ে সুন্দর কাশ্মীরি কারুকাজ, দৈর্ঘ্য প্রস্থে কোনও দিকেও ফুট খানেকের বেশি হবে না। অরুণ উপহার দিয়েছিল বাক্সটা, এসপ্ল্যানেডের ফুটপাথ থেকে কিনে। ভেতরে একটা ছোট্ট আয়নাও বসানো আছে। অসমতল আয়না।

বাক্স নিয়ে ঘরে ফিরল বিদিশা। পিছন পিছন ভারতীও। ডালা খুলেই বিদিশা সতর্ক হয়ে গেল। ছদ্মমনোযোগে ঘাঁটছে ছদ্ম অলংকার। রুপোর ওপর সোনার জল করা চুড়ি, রোলগোন্ডের কণ্ঠহার, অজস্র ছোট বড় মেকি সোনার দুল, বালা ব্রেসলেট…। কাচের চুড়িও আছে বেশ কয়েক ডজন। সবই উপহার, কোনওটা বা অরুণের, কোনওটা মিহিরের।

ভারতীও নড়ছেন না সামনে থেকে। তিনিও ঝুঁকে দেখছেন। ভেতরে ভেতরে অধৈর্য বোধ করছিল বিদিশা। ঝপ করে ডালাটা বন্ধ করে দিল,—এটা আমি নিয়ে যাব।

—কী করবি নিয়ে? ভারতী আরও অবাক।

—আমার জিনিস আমার কাছে থাকবে।

—সব নিয়ে যাবি?

—আপত্তি আছে? বিদিশা কায়দা করে হাসল।

—তা নয়। তবে… ভারতীর মুখ যেন সামান্য করুণ দেখাল,—ওখান থেকে আমি মাঝে মাঝে নিয়ে…। বুঝিসই তো, আমার আর কিছু নেই। এই ব্রোঞ্জের ক’গাছা চুড়ি, আর ওই ফঙফঙে এক জোড়া বালা।… কাজেকর্মের বাড়িতে গেলে গলা কান তো আর একেবারে ন্যাড়া করে যাওয়া যায় না…

বিদিশা ফাঁপরে পড়ে গেল। ভারতীর মলিন মুখ দেখে নয়, কাজটা কী করে সুষ্ঠু ভাবে সমাধা করা যায় সেই কথা চিন্তা করে। কটা ঠুনকো মাল, স্বচ্ছন্দে মাকে দিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তারপর বাক্সটা নিয়ে যাওয়া কেমন বেখাপ্পা দেখাবে না?

চটজলদি জবাবও এসে গেল মাথায়,—ঠিক আছে, তুমি এগুলো নিয়েই নিয়ো… আসলে এখানে বেশ কয়েকটা ভাল ডিজাইন আছে, ওগুলো দেখিয়ে দেখিয়ে আমি দু চারটে গয়না গড়াব।

—ও, তাই বল। ভারতীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল,—মনে করে দিয়ে যাস কিন্তু। আমি চাইতে পারব না।

—দেব বাবা, দেব। চৌকির সামনে পড়ে থাকা ট্রাঙ্ক তলায় ঠেলে ঢুকিয়ে দিল বিদিশা, বিছানায় লম্বা হল আবার। অলস মেজাজে বলল,—কটা বাজে? চা খাওয়ার সময় হয়নি?

—খাবি?

—করো। কখন আবার গাড়ি নিতে এসে যায়।

ভারতীর নিষ্ক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বিদিশা তড়াং করে উঠে বসল। বাক্সের ডালা খুলে গয়নাগুলো ঢালল বিছানায়। নীচের ভেলভেটের আস্তরণ টেনে টেনে ওঠাতেই বেরিয়ে পড়েছে এক গুপ্ত খোপ। আছে আছে, চিঠিগুলো আছে। নীল খাম অর্কর, গোলাপি খাম মিহিরের। অরুণেরও আছে একটা কচি কলাপাতা। ভাস্করই চিঠি ফিঠি লেখেনি কোনও দিন, ও সব তার ধাতেই ছিল না।

খাম খুলে খুলে কয়েকটা চিঠিতে পাখির চোখ বোলাল বিদিশা। অরুণেরটা একেবারে আবেগে থিকথিক, কবিতার লাইন টুকে টুকে পাতা ভরানো। কী স্তুতি রে বাপস! …হে উর্বশী, তুমি একবার যদি আমার ওপর পোসোন্ন হও, তালেই আমার জিবন ধন্ন হয়ে যাবে। …নিস্য আমি, রিক্ত আমি, কিছুই আমার নাই, আছে শুধু ভালবাসা, দিলেম তোমায় তাই… ! তোমার জন্য একটা দার্জিলিং এস্টোন্ বসানো দুল রেখে দিয়েছি, কবে তোমার দশ্শন পাব!… তুলনায় অর্ক যেন অনেক বেশি কাঠখোট্টা। …গতকাল রায়গঞ্জে পৌঁছেছি। ভেবেছিলাম সোমবার ফিরব, হয়ে উঠবে না। পাঁচিলটা ঝুরঝুরে হয়ে গেছে, মিস্ত্রি লাগাতে হবে। ভাইটা খুব ঘন ঘন জ্বরে ভুগছে, ওকে একবার ভাল করে ডাক্তার দেখানো দরকার…। ভালবাসার কথাও আছে, একদম শেষের লাইনে।…তোমাকে ছাড়া দিনগুলো এখানে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বিশেষত বিকেলবেলায়। তোমারও কি তখন আমার কথা মনে পড়ে দিশা!… মিহিরের চিঠির ছত্রে ছত্রে শুধু শরীর। কান ঠোঁট ঘাড় গাল গলা চুমু…। মিহিরের ভাষাটাই সবচেয়ে জবরদস্ত ছিল, পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। আশ্চর্য, আজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। ভাষা তো একই আছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অভিঘাত কত ক্ষীণ হয়ে গেল।

চিঠিগুলো স্বস্থানে রেখে ভেলভেটের ঢাকা আবার চেপে আটকাল বিদিশা। গয়নাগুলো ভরতে ভরতে এসে গেছেন ভারতী, টুকটাক কথা হচ্ছে এলোমেলো। প্রভাকরও উঠে পড়লেন, চা খেয়েই উশখুশ করতে লাগলেন তিনি, বেরোবেন। ঘড়ি দেখছেন ঘন ঘন।

এক সময়ে বলেই ফেললেন,—হ্যাঁ রে বুলু, তোর গাড়ি কখন আসবে রে?

—কেন?

—আমাকে তাহলে একটু হাজরায় নামিয়ে দিতিস।

বিদিশা হাসল,—ও আচ্ছা, আজ তো রবিবার! তোমার রিহার্সাল আছে বুঝি?

—আর বলিস কেন, নতুন নাটক নামছে…

ছোট্ট একটা শৌখিন নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রভাকর। বহুকাল। এটাই তাঁর নেশা, ব্যসনও বটে। তাঁদের দলের একটি দুটি প্রয়োজন এক সময়ে মোটামুটি নাম করেছিল, ইদানীং গ্রুপের অবস্থা তেমন ভাল নয়। পুরনো সদস্য হিসেবে দলের প্রতি প্রভাকরের প্রগাঢ় আনুগত্য, ঝড় জল বৃষ্টি বন্যা কোনও কিছুতেই তাঁকে রবিবার বিকেলে রুখে রাখা কঠিন।

বিদিশা চোখ নাচাল,—কী নাটক করছ এবার?

—ছেঁড়া শিকল।… দারুণ লিখেছে, বুঝলি? একটা খারাপ লোক ভাল হতে চায়, কিছুতেই পারছে না। কত ধরনের ফোর্স যে তাকে আবার জটিল আবর্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছে…

—বুঝেছি বুঝেছি। বাবার উৎসাহকে থামাল বিদিশা,—তোমার কী রোল?

—মেন রোল। হিরোর সেকেন্ড ভয়েস। অল্টার ইগোও বলতে পারিস। …অবশ্য আমাকে স্টেজে দেখা যাবে না…

—ওহ, বাবা আবার তোমার সেই বিহাইন্ড দা কার্টেন অভিনয়?

—ওটাই তো আসল রে। যাকে স্টেজে দেখা যায় না, সে যদি নিজের উপস্থিতিটা ঠিক ঠিক ফিল করাতে পারে…। প্রভাকরের খাড়া নাক আরও খাড়া হয়ে গেছে,— প্রভাকর ঘোষ উইল স্টিল দা শো, তুই দেখে নিস।…এই সেপ্টেম্বরেই তো ফাস্ট শো হবে।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। রবি। ঝটপট তৈরি হয়ে নিল বিদিশা। কাঠের বাক্সখানা প্লাস্টিকে মোড়াতে গিয়েও মোড়াল না, থাক গাড়িতেই তো থাকবে। বেশি মোড়ামুড়ি করলে অর্চিষ্মানের আবার কী কৌতূহল হবে ঠিক কী!

বিদিশা বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। চিত্রভানু মোড়ের চায়ের দোকানে গজল্লা করছে, টেরিয়ে টেরিয়ে দেখল বিদিশাকে, তবে প্রভাকর রয়েছেন বলেই বোধহয় কাছে ঘেঁষল না। মনে মনে হাসল বিদিশা, আজ লেডি ডায়না কম্যান্ডো পাহারায়।

ছুটির বিকেল, রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা। গাড়িঘোড়া চলছে বটে, তবে তাদেরও কেমন শিথিল মেজাজ। অনেক দিন পর দুঃখী মেঘেরাও আজ আকাশ থেকে ছুটি নিয়েছে, হলুদ রোদে ঝকঝক করছে বিকেল। বাতাসে যেন শরতের গন্ধ টের পাওয়া যায়।

প্রভাকরকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলেছে পার্ক স্ট্রিটের পথে। নিচু পর্দায় গান চালিয়ে দিল রবি, বিদিশারই নির্দেশে। চপল হিন্দি গান। সুরের দোলায় মাথা দোলাচ্ছে বিদিশা।

লঘু গলায় জিজ্ঞাসা করল,—তোমার দাদার নিলামঘরের হাতুড়ি ঠোকাঠুকি আজ এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল?

রবি বাড়ির পুরনো ড্রাইভার হলেও কথা বলে অত্যন্ত কম। সংক্ষেপে জবাব দিল,— আজ্ঞে, শেষ হয়নি তো।

—মানে এখনও নিলাম চলছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—খুব ভিড়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—তাহলে এত তাড়াতাড়ি গাড়ি পাঠাল কেন?

রবি নিরুত্তর।

বিদিশা মনে মনে একটু বিরক্তই হল। নিলামঘরের ভিড়ভাট্টায় যাওয়া তার একদমই পছন্দ নয়। মাস কয়েক আগে একবারই নিলামের দিন গিয়েছিল বিদিশা, নেহাতই কৌতুহলের বশে। মিনিট পাঁচ দশ থাকার পরেই এমন মাথা ধরে গেল! একুশশো একুশশো, তেইশশো তেইশশো, পঁচিশশো পঁচিশশো পঁচিশশো… অসহ্য। আজ হয়তো তেমনটা নাও হতে পারে। হয়তো আন্দাজ করেই গাড়ি পাঠিয়েছে অর্চিষ্মান, সে পৌঁছতে পৌঁছতেই ডাক শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরই কি সঙ্গে সঙ্গে অৰ্চিষ্মান উঠবে? নিজেই তো বলে, আফটার অকশন হাজারো বখেড়া থাকে। অর্থাৎ কিনা এখন গিয়ে ঘট হয়ে বসে থাকো কখন বাবু উঠবেন। আজ অবশ্য অর্চিষ্মান বারের কাজ দেখতে ঢুকবে না, জলদি জলদি ফিরবে, তাকে কথা দিয়েছে। তবু…। টুকিটাকি কিছু মার্কেটিং সেরে গেলে কেমন হয়? বুধবার অর্চিষ্মানের ভাগ্নির জন্মদিন, তার জন্য একটা কিছু তো কিনতেই হবে। নিজেরও গোটা কয়েক কসমেটিকস দরকার। তিন চারটে শেডের লিপস্টিক, একটা ব্লাশ অন…। বুধবার ননদের বাড়ির পার্টির জন্যে একটা ডিপ ব্লু আই শ্যাডো কিনলে কেমন হয়? বিদিশার যদিও আলাদা করে রূপটানের কোনও প্রয়োজন নেই, তবু নানা রকম প্রসাধনী ব্যবহার করতে বিদিশার মন্দ লাগে না।

যা ভাবা তাই কাজ। বিদিশা হুকুম ছুড়ল, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির অভিমুখ ঘুরে গেছে ক্যামাক স্ট্রিটের দিকে। আলো ঝলমল সুসজ্জিত এক মার্কেটিং কমপ্লেক্সের দরজায় এসে থামল গাড়ি।

দোকানে দোকানে ঘুরছে বিদিশা। মূল জিনিস কেনার আগে বেশ খানিকক্ষণ উইন্ডো শপিং সারল। এও সুখ, চোখের আরাম। দেখতে দেখতে একখানা দামি শিফন কিনে ফেলল। দু তিনটে দোকান ঘুরে ভাগ্নির জন্য দেড়হাজারি লংস্কার্ট কিনল একটা। সাজগোজের দোকানে ঢুকে লিপস্টিকের রং বাছছে।

তখনই হঠাৎ পিছনে রবি। বছর পঁয়তাল্লিশের ছোটখাট চেহারার লোকটা কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছে। চোখ বিস্ফারিত, গলায় স্বর ফুটছে না,—বউদি… বউদি… বউদি, আপনি ঠিক আছেন?

বিদিশা বেজায় চমকাল, —কেন, কী হয়েছে?

—আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন না?

—আমি? অজ্ঞান? না তো!

—তবে যে লোকটা বলল…

—কোন লোকটা?

—ওই যে… একটা ড্রাইভার! বলল, আপনি নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন… গাড়ির নম্বর দিয়ে আমাকে নাকি ডেকে আনতে বলেছেন… আমি সব দোকান খুঁজতে খুঁজতে আসছি…

—কে ড্রাইভার? কোথায়?

—ওই তো বাইরে। …শালা আমায় ঢপ মারল? রবি উত্তেজিত মুখে এগোল,— আসুন, দেখবেন আসুন। …হারামি কাঁহিকা…

হতচকিত বিদিশাও বাইরে এসেছে। রাস্তা টপকে গাড়ির কাছে গেল,—কোথায় সে? কই?

রবি উদ্‌ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিড়বিড় করে বলল,—এই তো এই মাত্র এখানে ছিল।… গলির মুখটায় গাড়ি পার্ক করে ভেতরে ঢুকল, হঠাৎ বেরিয়ে এসে…। গাড়িটাও তো নেই।… একদম আমাদের কালারের গাড়ি! মারুতি!

বিদিশার শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সহসা যেন চাবুক মেরেছে। লাফিয়ে গাড়ির জানলায় গেছে, ঝুঁকে দেখল ভেতরটা। পরক্ষণে আর্ত স্বর ঠিকরে এল,—আমার বাক্স?

অর্চিষ্মান হুঙ্কার দিয়ে উঠল,—তুই গাড়ি লক করে যাসনি?

রবি ভয়ে ঠকঠক কাঁপছে। ঢোঁক গিলে বলল—আজ্ঞে হ্যাঁ। …আজ্ঞে না। …মানে ঠিক মনে পড়ছে না।… লোকটা এমন ভাবে ছুটতে ছুটতে এসে ডাকল…

—করছিলি কী তখন?

—আজ্ঞে গান শুনছিলাম।

—তোমার গান শোনা আমি ছোটাচ্ছি। নম্বর দেখেছিস গাড়িটার?

—খেয়াল করিনি।

—ওয়ার্থলেস ওয়ার্থলেস। প্রায় শূন্য নিলামঘরে দাপাচ্ছে অর্চিষ্মান,—কে না কে এসে কী ভড়কি দিল, ওমনি বাবু গাড়ি খুলে রেখে…

বার-কাম-রেস্তোরাঁর ম্যানেজার অম্বরীশ পাকড়াশি পাশেই দাঁড়িয়ে। স্যুট বুট পরা তালসিড়িঙ্গে শরীরটা ঝুঁকিয়ে বলে উঠল—স্যার, একটা কথা বলব?

অর্চিষ্মান কটমট তাকাল।

—রবিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই স্যার। আজকাল কত ধরনের যে ছিঁচকে চোর গজিয়েছে, পুটপাট গাড়ির লক খুলে ফেলে। হয়তো ম্যাডামের বাক্সটাকে সিটে লক্ষ করেই লোকটা…। তাছাড়া স্যার, একটা মারুতির চাবি দিয়ে অন্য মারুতি গাড়ি তো ইজিলি খুলে ফেলা যায়।

—হুম, তা অবশ্য ঠিক।

বলতে বলতে বিদিশার সামনে এসে বসল অর্চিষ্মান। নিলামঘরের অফিসে বিদিশা এখনও মাথা ঝুঁকিয়ে বসে, তার দিকে ভুরু কুঁচকে দেখল একটুক্ষণ,—কী কী অর্নামেন্ট ছিল বাক্সতে?

চোখ তুলল না বিদিশা। নিরক্ত মুখে বলল—তেমন দামি কিছু না…

—তবু শুনি কী ছিল?

—চুড়ি হার দুল… সবই ইমিটেশান।

—ঠিক বলছ?

বিদিশা ঘাড় নাড়ল।

—যাক, জোর বেঁচে গেছ তাহলে। যে শালা নিয়েছে সে তোমার বাপ চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করছে। স্বভাববিরুদ্ধ ভঙ্গিতে হা হা হেসে উঠল অর্চিষ্মান,—আর মন খারাপ করে কী করবে? ওঠো।

বিদিশার পা সরছিল না। হাঁটু অবশ, গোড়ালি অসাড়, কোমর থেকে দেহের নীচের অংশটুকু বুঝি আর কোনও দিন নাড়ানো যাবে না। তবু টেনে টেনে তুলল নিজেকে। সত্যিই কি ছিঁচকে চোরের কাণ্ড এটা? নাকি এ কোনও গভীর ষড়যন্ত্র?

বিদিশা আর ভাবতে পারছিল না। তার মস্তিষ্ক পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে।

[নয়]

ফিরতি পথে গাড়িতে নিশ্চুপ ছিল বিদিশা। কোনও কিছুই আর সুস্থিত ভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা নেই অসাড় মস্তিষ্কের। ভাবনারা ধেয়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে, তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে বার বার। কেন এমন দশা হল তার? মাত্র ছটা মাসও কাটল না, এর মধ্যেই কেন অমানিশার ছায়া পড়ছে জীবনে? গরিব কেরানির মেয়ে হয়ে জন্মে, রূপ যৌবনকে পুঁজি করে সে যদি একটু আনন্দ খুঁজেই থাকে, তা কী এমন গভীর অপরাধ? বিয়ের আগে কত মেয়ের জীবনেই তো কত পরপুরুষ আসে, তাকে নিয়েই বা বিধাতা নিষ্ঠুর খেলা শুরু করলেন কেন?

নিষ্ঠুর খেলা, নাকি নিছকই কৌতুক? তার পাপমন কি অহেতুক বেশি বেশি ভয় পাচ্ছে? হয়তো ফোন আসাটা ঠাট্টাই। অর্ক তো বলছিল এমন নাকি আখছার ঘটছে আজকাল। হয়তো আজকের চুরিও নেহাতই কোনও ছিঁচকে চোরের কাণ্ড। কিংবা কোনও কেপমারি দলের। তারা তো এমন বিলাসবহুল বাজারের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, নিত্যনতুন উপায়ে ঠগবাজি করে, হয়তো বিদিশাকেই টার্গেট করেছিল আজ, মাঝখান থেকে বেচারা রবি…। তবু মন সান্ত্বনা পায় কই? ঈশ্বর জানেন, বিয়ের আগে যাই করে থাকুক, বিয়ের পর থেকে বিদিশা অর্চিষ্মান ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পুরুষের কথা ভাবেনি। তবে এই শাস্তি কেন? অহর্নিশি এই দহনের হাত থেকে কি বিদিশার মুক্তি নেই?

চিন্তার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি বিদিশা অর্চিষ্মানের গলা শুনতে পেল,—কী গো, এখনও শোকে মুহ্যমান?

—উঁ? বিদিশা আলগা ঘাড় নাড়ল,—নাহ্।

—বললেই হল? গুম মেরে বসে আছ, বাপের বাড়ির গপ্পো শোনাচ্ছ না…। বাক্সয় শুধু ঝুটো গয়নাই ছিল শুনে অর্চিষ্মানের উষ্মা চলে গেছে, সে এখন দিব্যি তামাশার মেজাজে। রঙ্গের সুরেই বলল,—তোমরা মেয়েরা পারোও বটে। কেয়ারলেসের মতো কাজ করবে, আর থপাস থপাস কপাল চাপড়াবে।

বিদিশা কষ্ট করে হাসল,—নাগো বিশ্বাস করো, গয়নার কথা ভাবছি না।

—তাহলে কী ভাবছ?

—ভাবছি…ভাবছি দুম করে কীরকম বোকা বনে গেলাম। পথেঘাটে হঠাৎ পিকপকেট হয়ে গেলে কেমন আপসেট লাগে না? কিংবা গলা থেকে যদি আচমকা একটা হার ছিনতাই হয়ে যায়…হোক না সে মেকি হার…

—বুঝলাম।

—কী বুঝলে?

—বোকা বনতে তোমার বেজায় আপত্তি। অর্চিষ্মান মৃদু হাসল,—কিন্তু ম্যাডাম, বোকা কারা বনে জানো?

—কারা?

—চালাকরা, অফকোর্স। বোকারা তো বোকা আছেই, তাদের বোকা বনার প্রশ্নই নেই। সুতরাং মনোকষ্টে না ভুগে গর্ব অনুভব করো। তুমি চালাক বলেই কেউ একজন তোমায় বোকা বানাতে পেরেছে।

অন্য সময় হলে অর্চিষ্মানের যুক্তি শুনে হাসত বিদিশা। এখন হাসল না বটে, তবে কিছুটা সহজ হল। বলল,—তাই হবে।

—অমন করে বোলো না। আটার ইট উইথ এ স্মাইল। অর্চিষ্মান হাত রাখল বিদিশার পিঠে,—তোমার রিকোয়েস্টে আজ সন্ধেটা ফ্রি করে ফেললাম, এখন তুমিই যদি মুখ গোমড়া করে থাকো…চলো, নাইট শোয়ে একটা সিনেমা যাবে?

—সিনেমা?

—হ্যাঁ, সিনেমা। ফিল্ম। ছায়াছবি। চলো, গাড়ি ঘুরিয়ে এসপ্ল্যানেডের দিকে যাই। একটু ঘুরে টুরে, খেয়ে দেয়ে হলে ঢুকে যাব।

—বাবাকে যে বলা নেই! বাবা যে আমাদের জন্য বসে থাকবেন, খাবেন না!

—ফোন করে দিচ্ছি।…চলো, লাইটহাউসে তোমার হিচককের একটা বই এসেছে, দেখে আসি।

এমনিতে অর্চিষ্মানের সঙ্গ পাওয়াই দুর্লভ। আজ অর্চিষ্মান বিদিশাকে নিয়ে বাইরে খাবে, সিনেমায় যাবে, এমন লোভনীয় প্রস্তাবে বিদিশার লাফিয়ে ওঠার কথা, কিন্তু বিদিশার কিছুতেই কিছু ভাল লাগছে না। আলগা ভাবে জিজ্ঞাসা করল—কী ছবি?

—দা ম্যান হু নিউ টুউ মাচ। কলেজ লাইফে বইটার খুব নাম শুনেছিলাম। ট্রাম্পেট না কী একটা বাজনার সঙ্গে একটা গুলি চালানোর ঘটনাকে মিশিয়ে দারুণ সাসপেন্স আছে।…তুমি কি আগে দেখেছ?

—না।

—চলো তাহলে। হিচককের বই-এর মজাই আলাদা। রহস্য সব সময়েই এক্সপোজড, কিন্তু সারাক্ষণ একটা চাপা টেনশানে ছটফট করতে হয়, ঠিক কি না? ক্রাইমটা হব হব করছে, অথচ হচ্ছে না। কিংবা ক্রিমিনাল সামনে ঘোরাফেরা করছে, ধরা পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। এটাই খুব ইন্টারেস্টিং, কি বলো?

পলকের জন্য অর্চিম্মানের চোখে যেন দিঘার ঝলক দেখতে পেল বিদিশা। অস্বস্তি মাখা গলায় বলল,—আজ থাক।

—কেন, থাকবে কেন?

—দিদি কাল ফোনে বলছিল আজ সন্ধেয় আসতে পারে।

—অ।

অর্চিষ্মানের উচ্ছ্বাস নিবে গেল। মুখ ঘুরিয়ে রাস্তা দেখছে। পার্ক সার্কাস ছাড়িয়ে বাইপাস অভিমুখে ছুটছে গাড়ি, এলোমেলো ভিড় ফাঁকা হয়ে আসছে ক্রমশ। পথের দু ধারে নাগরিক সন্ধ্যার আবছায়া।

বিদিশার নতুন অস্বস্তি শুরু হল। হু-হু হাওয়া ঢুকছে জানলা দিয়ে, তবু যেন গাড়ির মধ্যে গুমোট ভাব কাটছে না। নৈঃশব্দ্যও বুঝি অনেক সময়ে বাতাসকে শুষে নেয়।

অর্চিষ্মানের দিকে সরে এল বিদিশা। ঠাণ্ডা হাত রেখেছে স্বামীর হাতে,—এই রাগ করলে?

অর্চিষ্মান চুপ।

—দিদি সেই শালকিয়া থেকে উজিয়ে আসবে, আমাদের কারুর সঙ্গে দেখা হবে না…

—হুম্।

—কোনও দিনই তো তোমাকে পাওয়া যায় না, একটা দিন নয় সারা সন্ধে বাড়ি রইলেই।

—জো মর্জি। অর্চিষ্মান হাসল এতক্ষণে,—ওদিকে গেলে তোমারই লাভ হত। একটা নতুন জিনিস দেখাতাম। পছন্দ হলে আজই কিনে নেওয়া যেত।

—কী গো?

—আনসারিং মেশিন। টেলিফোনের। ফরেন মাল। আমার এক কাস্টমারের শোরুমে এসেছে। শুধু মেসেজ রেকর্ডই হয় না, কেউ রিং করলেই তার নাম্বার সঙ্গে সঙ্গে মেশিনে উঠে যায়। আর ভয়েস তো টেপ করাই যাবে।

—তাই?

চকিতে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠেছে বিদিশার মাথায়। যদি লোকটা আবার ফোন করে তার হদিশ তাহলে পাওয়া যাবে? গলাও তুলে রাখা যাবে টেপে? আর তো তাহলে লোকটা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না!

সঙ্গে সঙ্গে আরেক চিন্তা এসে হাড় হিম করে দিল বিদিশার। লোকটা যদি তার অনুপস্থিতিতে ফোন করে? তখনও তো নাম্বারটা উঠে থাকবে? যদি অর্চিষ্মানের চোখে পড়ে যায়…?

অর্চিষ্মান কাঁধ ঝাঁকাল,—কী, চাই নাকি?

বিদিশা ঢোক গিলল,—আমাদের ও মেশিনে কী দরকার? তোমার বিজনেস ফোন তো বেশি সেলুলারেই আসে। ক্বচিৎ কখনও হয়তো দু চারটে,…সেও তো হয় সক্কালে নয় রাতে। তখন তো তুমি বাড়িতেই থাকো।

—আমার জন্য বলছি না। তোমারই লাভ হত।

—আমার! কেন?

—কোনও উড়ো ফোন ধরে ফেলতে পারবে।

—আমার উড়ো ফোন আসবে কেন? বিদিশার তালু শুকিয়ে গেল।

—সে কী! দেশের ফোন-রোমিওরা কি মরে গেছে? অ্যাম আই টু বিলিভ, তোমার মতো সুন্দরীকে কেউ কক্ষনও ডিসটার্ব করে না?

অতি কষ্টে উত্তেজনা চাপল বিদিশা। স্বর স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে গলাটা ঘড়ঘডে হয়ে গেল,—উল্টোপাল্টা ফোন এলে আমার পাত্তা দিতে ভারী বয়ে গেছে।

—কেউ যদি বার বার জ্বালাতন করে তাও জানতে ইচ্ছে করবে না?

—আমার অত কৌতূহল নেই।

—তাহলে থাক, কিননা না।

কথায় কথায় বাইপাস বেয়ে লবণহ্রদ উপনগরীতে ঢুকে পড়েছে গাড়ি। বর্ষায় রাস্তায় প্রচুর খানাখন্দ। পথবাতিগুলো সব জ্বলছে না, কিছু কিছু আলো ঢাকা পড়ে আছে গাছের আড়ালে। রবি বেশ সামলে সুমলেই গাড়ি চালায়, তাও ঘটাং ঘটাং লাফাচ্ছে ইস্পাতনীল মারুতির লঘু তনু, অন্ধকার ঘন হচ্ছে অন্দরে।

নিজের ভেতর নিজেই সঙ্কুচিত বিদিশা বাড়ি ঢুকে দেখল অর্চনা আর পূষন এসে গেছে, দক্ষিণের বারান্দায় বসে কথা বলছে দিননাথের সঙ্গে। কী এক বীভৎস অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে হাওড়া ব্রিজে, একটা ট্যাক্সি কীভাবে থেঁতলে দিয়েছে এক যুবককে, তারই বিশদ বর্ণনা দিচ্ছে পূষন। সাড়ম্বরে।

বিদিশাকে দেখে পূষন আবার প্রথম থেকে শুরু করতে যাচ্ছিল, অর্চনা বলল—থাক, বাচ্চা মেয়েটার সামনে আর ওসব বলতে হবে না।

বিদিশা জিজ্ঞাসা করল—তোমরা চা খেয়েছ দিদি?

—তোর শ্বশুরমশাই খেতে দিল কই! আধঘণ্টা ধরে বসে আছি, খালি বলছে, একটু বোস এক্ষুনি আমার বেটি এসে পড়বে।

পূষন বলল—এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে। সুমতির সার্ভ করা চায়ে আমি টেস্ট পাই না। অন্তত বিদিশা আসার পর থেকে।

পূষনের সরস মন্তব্যে অর্চিষ্মান যেন তেমন প্রীত হল না। একটা দুটো নিয়ম রক্ষার কথা বলে চলে গেছে নিজের শিবিরে।

বিদিশা চা জলখাবার সাজিয়ে টেবিলে ডাকল সকলকে। বসতে বসতে অর্চনা জিজ্ঞাসা করল—তোরা তাহলে বুধবার কখন আসছিস?

স্মিত মুখে বিদিশা বলল—যখন তোমার ভায়ের সময় হবে।

—বুধবার তো নিলামঘর বন্ধ, দুপুরেই সবাই চলে যায় না। তোরা তো একদমই যাস না, তাও ভাগ্নির নাম করে নয় কটা ঘণ্টা বেশিই কাটিয়ে এলি।

—দেখি।

—উহুঁ, দেখি নয়। অবশ্যই যাবি। বাবলু পরে যায় যাক, তুই আর বাবা আগে চলে যাবি। মুন্নি না হলে খুব দুঃখ পাবে।

দিননাথ চায়ের কাপ টানতে টানতে বললেন,—আমাকে বাদ দে না খুকি। অদ্দূর ঠেঙিয়ে যাওয়া আমার আজকাল আর পোয় না রে।

—বাজে কথা বোলো না তো বাবা। গান শুনতে রোজ হিল্লি দিলি ছুটছ, মেয়ের বাড়ি যেতেই যত আলিস্যি!

পূষন ফুট কাটল,—আপনার একমাত্র নাতনি এবার পঞ্চদশী হচ্ছে। এই অকেশানটা মিস করবেন না বাবা। পার্টিটাও এবার খুব জম্পেশ দিচ্ছি। প্রায় শ দেড়েক ইনভাইটেড।

—দেড়-শো! জন্মদিনে?

—হ্যাঁ, তা তো হবেই। মুন্নির বন্ধুই আসছে জনা পঞ্চাশেক। স্কুল পাড়া নাচের ক্লাস…কিছু টিচারও আছে। তারপর ধরুন আমার ফ্যাক্টরির স্টাফরা, লোকাল সার্কল, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, আপনারা আছেন…

—এ কিন্তু অপচয়। দিননাথ গজগজ করছেন,—নিজেই বলো ব্যবসার হাল ভাল নয়…

—ব্যবসার ওঠা পড়ার জন্য আমোদ আহ্লাদ কি থেমে থাকবে বাবা?

পূষনের কথার মধ্যে যথারীতি কেয়ারফ্রি ভাব। বয়স বছর চল্লিশ, রীতিমত রূপবান, পোশাক আশাকেও দেখনদারি আছে। অর্চনার সঙ্গে একই কলেজে পড়ত পূষন, একই ক্লাসে। অর্চনার গোলগাল মোটাসোটা চেহারা গিন্নি গিন্নি হয়ে গেছে বটে, পূষন এখনও দিব্যি লক্কা পায়রা।

দিননাথের সঙ্গে মেয়ে জামাই-এর কথোপকথনের মাঝে ফিরে এসেছে অর্চিষ্মান। ধরাচূড়ো ছেড়ে, পাজামা পাঞ্জাবি শোভিত হয়ে। তাকে দেখা মাত্র পূষনের আলাপের বিষয় বদলে গেল। নতুন একটা ব্যবসার মতলব এসেছে পূষনের মাথায়, চাল রপ্তানি করবে বাংলাদেশে, তারই লাভ ক্ষতির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হল অর্চিষ্মানের সঙ্গে। নামেই আলোচনা, কথা বলছে পূষন একাই, অর্চিষ্মান শুধু ঘাড় নাড়ছে মাঝে মাঝে। ব্যাংক, ওভারড্রাফট, এল সি, প্যাকেজিং…আরও যে কত শব্দ ফুটছে পৃষনের মুখে।

বিদিশার ক্লান্ত লাগছিল। এক সময়ে টুক করে সরে এল নিজের ঘরে। শাড়ি বদলাল, মখ হাত ধুল, গালে কপালে অ্যাসট্রিনজেন্ট মাখল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে নিজেকে। হঠাৎ হঠাৎ ধক ধক করে উঠছে বুক। বেশ তো ছিল বাক্সটা, কেন যে মরতে আজ মার কাছ থেকে নিতে গেল! ও বাড়িতেও তো পুড়িয়ে দিতে পারত চিঠিগুলো, মাকে কিছু একটা ভুজুং ভাজুং দিয়ে নিলেই হত।

—কী ম্যাডাম, আপনাদের আজকাল নাকি খুব চুরিচামারি হচ্ছে?

হঠাৎই আয়নায় ছায়া। পূষন একেবারে ঘরে ঢুকে পড়েছে। রীতি সহবতের ধার ধারে না লোকটা, জিজ্ঞেস না করেই অবলীলায় বিদিশার ঘরে চলে আসে। ভাবটা এমন, যেন এ বাড়ির প্রতিটি ইট কাঠ দেওয়ালে তারও একটা অধিকার আছে।

বিরক্ত ভাবটা প্রকাশ করল না বিদিশা। আলগোছে হাসল একটু।

পূষন সোজা খাটে গিয়ে বসল। চোখ বিদিশার স্থির,—একটা কথা বলব ম্যাডাম? কনফিডেনশিয়াল।

—বলুন।

—দোকানের চুরিটা নয় রাত্তিরে হয়েছে, কর্মচারীরা নেগলিজেন্ট, কিন্তু গয়নার ব্যাপারে আপনি এত ক্যাজুয়াল হলেন কী করে? এ তো মেয়েদের স্বাভাবিক ধর্ম নয়?

বিদিশা ঠোঁট বেঁকাল,—অর্চিষ্মান বলেনি গয়নাগুলো ঝুটো ছিল?

—বলল, কিন্তু…। পূষন দম নিল একটু। তারপর চাপা স্বরে বলল,—ব্যাপারটা এরকম নয় তো, গয়নাগুলো হয়তো আসলই, বাবলুকে ভয় পেয়ে আপনি ইমিটেশান বলে চালাচ্ছেন?

—যাহ্, ও রকম কেউ বলে নাকি?

—মেয়েরা গয়নার ব্যাপারে স্বামীকে সহজে সত্যি কথা বলে না। এই যে আপনার ননদ ইয়া ইয়া নেকলেস পরে ঘুরত, আট বছর পরে আমি আবিষ্কার করেছি ওগুলো সব ইউনিক না ফিউনিক কীসের যেন। আসল মাল সব লকারে চালান করে রেখেছে।

বিদিশা মনে মনে বলল, বেশ করেছে। তোমার মতো লুঠেরার কাছে সত্যি কথা বলে সব খোয়ায় আর কি!

মুখে বলল,—আমার অর্চিষ্মানকে মিথ্যে বলার প্রয়োজন হয় না।

—রিয়েলি? সব সত্যি বলেন?

—হ্যাঁ।

—জীবনের কোনও কথাই বাবলুর কাছে গোপন করেননি?

—মানে?

—এই দেখুন আপনি ভয় পেয়ে গেলেন। পূষন খ্যাক খ্যাক হাসল,—শুনুন, প্রাইভেটলি একটা কথা বলি আপনাকে। বিটুইন ইউ অ্যান্ড মি। অর্চিষ্মান রুদ্র কিন্তু পূষন রায় নয়। ইউনিক আর সোনার পার্থক্যটা সে ঠিক বুঝে ফেলে।

বিদিশা আবার বলল,—মানে?

—বাবলু ইজ বেসিক্যালি সাসপিশিয়াস টাইপ। একবার যদি সন্দেহ হয় কেউ কিছু লুকোচ্ছে তো তার দফা রফা।

বিদিশার এবার বেশ রাগ হয়ে গেল। শালীনতার প্রলেপ রেখেই ঝাঁঝ ফোটাল গলায়,—আমি তার কাছে কিছু লুকোতে যাবই বা কেন?

—ভাল। তাহলেই মঙ্গল।

কথাটা শূন্যে ভাসিয়ে উঠে গেল পূষন। বিদিশা কাঠ। এ সব কী বলে গেল লোকটা? কেন বলল? পূষন রায়ের কথায় কিসের যেন প্রচ্ছন্ন ইশারা!

তুৎ, পূষনদা তো সব সময়েই এরকম রহস্য করে কথা বলে। খামোখা সে ভয় পাচ্ছেই বা কেন?

অর্চনা হলঘর থেকে চেঁচিয়ে বিদিশাকে ডাকছে। সাড়া দিতে স্বর ফুটছিল না বিদিশার। তবু তড়িঘড়ি ছুটল ও ঘরে, একা থাকলে ভাবনাটা তাকে পাগল করে দেবে।

একটা মাত্র টেলিফোনের এত শক্তি? এমন ভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে সব কিছু?

একটা নয়, টেলিফোনটা আবার এল। দ্বিতীয় বার। পর দিনই। দুপুরবেলা।

এবারের স্বর আরও শীতল। আরও ধাতব। আরও নির্মম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *