বণিকবাড়ির অন্তরমহলে
[দেবযানী বণিক হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার সুজিত সান্যাল]
—থানা থেকে আসছি। দরজাটা খুলুন প্লিজ়!
রাত সোয়া দশটা তখন। কোলাপসিবল গেট পাঁচতলার ফ্ল্যাটের বাইরে। তালা দেওয়া। গেটের পিছনে কাঠের দরজা। যা খোলাই ছিল প্রায় অর্ধেক, পুলিশের ডাকাডাকিতে বন্ধ হয়ে গেল দড়াম।
লোক আছে ভিতরে, একাধিক, বোঝার জন্য বুদ্ধি খাটানোর দরকার হয় না কোনও। নারীকণ্ঠ-পুরুষকণ্ঠ, ফিসফিসানি দিব্যি শোনা যাচ্ছে বাইরে থেকেও। ফের ডাক দেওয়া হল, ‘গড়িয়াহাট থানার ওসি হীরেন্দ্রলাল মজুমদার বলছি, দরজাটা খুলুন একবার।’
ভিতরে যাঁরা ছিলেন, নিরুত্তর। ফিসফিস কথাও শোনা যাচ্ছে না আর। উলটে ওসি-র আওয়াজে নিভে গেল ভিতরের আলো, যেটা জ্বলছিল এতক্ষণ। ডাকাডাকি, দরজায় ধাক্কাধাক্কি আরও বেশ কিছুক্ষণ। ধৈর্যের সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওসি চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি দিলেন, ‘শেষ বারের মতো বলছি। যে বা যাঁরা ভিতরে আছেন, দরজা খুলুন। না হলে ভেঙে ঢুকতে বাধ্য হব, খুলুন!’
তবু কোনও সাড়াশব্দ নেই। ওসি খবর দিলেন দমকলে। অনুরোধ করলেন গেট এবং দরজা ভাঙার জন্য যা যা দরকার, সব নিয়ে দ্রুত চলে আসতে। ২৬, গড়িয়াহাট রোডের পাঁচতলায়। খুব বেশি হলে মিনিটদশেক। যন্ত্রপাতি নিয়ে পৌঁছলেন দমকলকর্মীরা।
লোহার মজবুত কোলাপসিবল গেট। কাঠের দরজাটিও নেহাত পলকা নয়। ভাঙতে সময় লাগল কিছু। ঢুকলেন ওসি-সহ থানার অফিসাররা, দমকলের আধিকারিকরা এবং সাক্ষী হিসাবে চার স্থানীয় বাসিন্দা। যাঁরা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে।
এমনিতেই গড়িয়াহাট চত্বর রাতভর আলোঝলমল। ফুটপাথ এখানে বদল হয় না মধ্যরাতে। দোকানপাটের অধিকাংশ সাড়ে ন’টা–দশটার মধ্যে বন্ধ হয়ে গেলেও অন্তত মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকেই টুকটাক পান-সিগারেটের ঠেক। দক্ষিণে গোলপার্ক-ঢাকুরিয়া, উত্তরে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি-পার্ক সার্কাস। পুবে বিজন সেতু-বালিগঞ্জ স্টেশন, পশ্চিমে রাসবিহারী-চেতলা। মানুষজনের যাতায়াত চলতেই থাকে বেশি রাত পর্যন্ত। গাড়িঘোড়ার স্রোতও তলানিতে ঠেকতে ঠেকতে গড়িয়ে যায় মাঝরাত্তির।
এহেন গড়িয়াহাট মোড় থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বের বহুতলের সামনে পুলিশের গাড়ি, দমকলের সাইরেন সাড়ে দশটা নাগাদ। মাত্রাছাড়া নয়, কিন্তু কৌতূহলী ভিড়-জটলা একটা তৈরি হলই। বাড়তি ফোর্স পাঠানো হল লালবাজার কন্ট্রোল রুম থেকে।
ফ্ল্যাটের ভিতরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বিশাল হলঘরে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল তিন মহিলাকে, দাঁড়িয়ে আছেন জড়সড়। চোখেমুখে টেনশন আর আতঙ্কের জ্যামিতি। ওসি-র পুলিশি ধমকে আরও কুঁকড়ে গেলেন ওঁরা, ‘কী ব্যাপারটা কী? দরজা খুলছিলেন না কেন? রাতদুপুরে কি আমরা গল্পগুজব করতে এসেছি এখানে?’
গড়িয়াহাট থানা, কেস নম্বর ৪৯, তারিখ ৩০/০১/৮৩। ধারা ১২০বি/৩০২/২০১/৩৪ আইপিসি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুন, প্রমাণ লোপাট এবং একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের যৌথ পরিকল্পনা।
সেই তুমুল চাঞ্চল্যকর মামলার বিবরণ। সবে কুড়ির কোঠায় পা দেওয়া এক গৃহবধূর নৃশংস খুন শ্বশুরবাড়িতে। দেবযানী বণিক হত্যা মামলা।
আমাদের কন্ট্রোল রুমে ফোনটা এসেছিল দশটা নাগাদ। আজও অজানা, কে করেছিলেন। বর্তমান সময় হলে বোঝা যেত সহজেই। কন্ট্রোল রুমের সব ফোনেই এখন সিএলআই লাগানো রয়েছে। তখনকার সময়ে ছিল না। ফোনে পুরুষকণ্ঠ জানিয়েছিল, গড়িয়াহাটের বণিকবাড়িতে লোক পাঠান তাড়াতাড়ি। ওদের বড়বউকে সবাই মিলে খুন করেছে। দেরি করলে বডি সরিয়ে দেবে।
থানা থেকে হেঁটে গেলে খুব বেশি হলে তিন মিনিটের পথ, গাড়িতে তার অর্ধেক। কন্ট্রোল রুম জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই ছুটেছিল পুলিশ।
নামেই ফ্ল্যাট, আয়তনের বিচারে প্রায় ফুটবল মাঠ। ঢুকেই প্রশস্ত করিডর, দৈর্ঘ্যে প্রায় একশো মিটার। প্রস্থেও নেহাত কম নয়। করিডরের দু’ধারে সার দিয়ে অনেকগুলি ঘর। যার অধিকাংশেই লাগোয়া বারান্দা। এক কোণে একটি মন্দিরও রয়েছে কাচ দিয়ে ঘেরা। পাঁচতলা থেকে ছ’তলায় সরাসরি যাওয়ার দরজা রয়েছে। আর ছ’তলা থেকে সাততলায় পৌঁছনোরও। চালু হল ঘরগুলির তল্লাশি। ছ’তলা-সাততলা তালাবন্ধ। পাঁচতলার ফ্ল্যাটের একটি ঘরে তিনটি বাচ্চা ঘুমোচ্ছে অঘোরে। অন্য একটিতে এক বৃদ্ধা মহিলা, তিনিও ঘুমন্ত। একটিতে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মহিলা, দৃশ্যতই অসুস্থ। শুয়ে আছেন চোখ বুজে। আর একটি ঘরে বারো বছরের এক ঘুমন্ত কিশোর। রান্নাঘরে তালাচাবি।
করিডরে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তিন মহিলাকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘বাইরে থেকে তো আওয়াজ পাচ্ছিলাম পুরুষকণ্ঠের, ওঁরা কোথায় গেলেন?’ তিনজনই নিরুত্তর, ঠোঁটে যেন কেউ সাইলেন্সার লাগিয়ে রেখেছে। পরের প্রশ্ন, এ বাড়ির বড়বউয়ের নাম কি দেবযানী বণিক? কোথায় উনি? ডাকুন। মুখে এখনও কুলুপ মহিলাত্রয়ীর। ততক্ষণে দুর্গন্ধ পেতে শুরু করেছেন অফিসাররা। পেশার প্রয়োজনে যে গন্ধ ডাক্তার বা পুলিশের অতি পরিচিত। পচতে থাকা মৃতদেহের।
উত্তর-পূর্ব কোণের ঘরটিতে ঢুকতেই গন্ধ তীব্রতর ঠেকল, নাকে রুমাল উঠে এল সবার। শূন্য ঘর, পরিপাটি বিছানা। লাগোয়া বারান্দা। যেখানে ঢোকার মুখেই বাচ্চাদের একটি বড় লোহার দোলনা আড়াআড়ি ভাবে ফেলা রয়েছে। বেশ ভারী, সরানো হল ধরাধরি করে। বারান্দায় একটি ফোল্ডিং খাট। তার উপর স্তূপাকার
লেপ-কম্বল-তোশক ডাঁই করা। সরানো হল।
খাটের নীচেও প্রচুর জামাকাপড়ের জঙ্গল। একদম ঠাসাঠাসি। যা টেনে বার করা হল একে একে এবং ভিতর থেকে বেরোল এক তরুণীর মৃতদেহ। শাড়ি-ব্লাউজ শরীরে। ফুলে উঠেছে দেহ, শুরু হয়েছে পচন। ‘Rigor Mortis’ (মৃত্যুর কিছু ঘণ্টা পর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের শক্ত হয়ে যাওয়া) বাসা বেঁধেছে দেহে। নাকমুখ থেকে রক্তের স্রোত বয়ে শুকনো দাগের চেহারা নিয়েছে শাড়িতে। গলায় ফাঁসের দাগ।
হলঘরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা তিন মহিলাকে ডাকা হল। চেনেন এঁকে? সমস্বরে উত্তর, না! ঘুম থেকে তোলা হল বছর বারোর কিশোরকে, চেনো এঁকে? ছেলেটি কেঁদে ফেলল নিমেষে, অস্ফুটে বেরোল একটাই শব্দ— বউদি!
—কী নাম বউদির?
—দেবযানী। দেবযানী বণিক।
খবর পেয়ে গভীর রাতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন পুলিশকর্তারা। ডিসি হেডকোয়ার্টার, ডিসি ডিডি, ডিসি সাউথ, হোমিসাইড শাখার প্রায় সবাই। তদন্তের চাকা ঘুরতে শুরু করল। তদন্তভার নিলেন হোমিসাইড তৎকালীন শাখার সাব-ইনস্পেকটর সুজিত সান্যাল।
গৃহবধূ-হত্যার খবর জানাজানি হতেই প্রবল প্রতিক্রিয়া শুধু কলকাতায় নয়, রাজ্যজুড়ে। এমন চর্চিত মামলা কমই হয়েছে কলকাতা পুলিশের শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসে। তখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আনন্দবাজার-যুগান্তরের প্রথম পাতায় আলোচিত হয়েছে দেবযানী-নিধনের রোজনামচা। যা অব্যাহত থেকেছে তীব্র টানাপোড়েনের বিচারপর্বেও। ঘৃণ্য অপরাধের দিকচিহ্ন হিসেবে আজও রয়ে গিয়েছে ওই অভিশপ্ত বহুতল, যাকে স্থানীয় মানুষ চিনতেন ‘বণিকবাড়ি’ নামে। গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে, এলাকার ভূগোল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, এমন কাউকে এখনও পরিচিতজন দেখিয়ে দেন ওই এগারোতলার মাল্টিস্টোরিড, ‘এটাই সেই বণিকবাড়ি!’
খবরের কাগজের সংবাদ
ওই তিন মহিলার পরিচয় কী, গ্রেফতার হওয়ার পর কী বললেন, বাড়ির পুরুষরাই বা কীভাবে পালালেন, আর ধরা পড়লেন কোথায় কখন, সে বিবরণে পরে আসছি।
তা ছাড়া, এটি তো ‘whodunnit’ নয় যে খুনি কে, জানার কৌতূহল থাকবে। সকলেরই মনে থাকবে, স্বামী-শ্বশুর-দেবর-ননদরা যুক্ত ছিলেন খুনে। চন্দ্রনাথ-চন্দন, এই দুটি নাম অনেকের মনেও আছে নিশ্চিত। তবে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ঘরসংসারে আদ্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ এক নেহাতই সহজসরল গৃহবধূকে, কতটা নির্মমতার সাক্ষী ছিল মৃত্যুর আগের ও পরের ঘটনাপ্রবাহ, সে কাহিনিও কম নাটকীয় নয়। বস্তুত, নারীনির্যাতনের এক কলঙ্কময় দলিল। সবিস্তার লিখতে গেলে অণু-উপন্যাসের আকার নেবে, যথাসাধ্য সংক্ষেপে পেশ করলাম দেবযানী-হত্যার ইতিবৃত্ত।
বণিকবাড়ি
শুধু বিত্তবান বললে কম বলা হয়, প্রভূত সম্পদশালী ছিল গড়িয়াহাটের বণিক-পরিবার। ব্যবসা মূলত চা-বাগানের। এ ছাড়াও বহুমুখী ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে ক্রমশ ফুলেফেঁপে ওঠা। গড়িয়াহাটের এগারোতলা ‘বণিকবাড়ি’ তৈরি করেছিলেন চন্দ্রনাথ বণিক।
একতলা থেকে চারতলার ফ্ল্যাটগুলি ভাড়া দিয়েছিলেন বা বিক্রি করেছিলেন। কোনওটা আবাসিকদের, কোনওটা সরকারি–বেসরকারি সংস্থাকে। নিজে থাকতেন সপরিবারে পাঁচতলায়, প্রায় দশ হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। ছ’তলা এবং সাততলার ফ্ল্যাট নিজের অধিকারে রেখেছিলেন। আট থেকে এগারো, উপরের চারটি তলা ছিল নির্মীয়মান অবস্থায়।
বণিক পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। চন্দ্রনাথ মধ্যপঞ্চাশ পেরিয়ে ষাট-ছুঁইছুঁই। স্ত্রী কিছুকাল হল অসুস্থ। মা বেঁচে আছেন। তিনিও শয্যাশায়ীই বলা চলে, ওষুধবিষুধ-পরিবৃত জীবন। নয় সন্তানের জনক চন্দ্রনাথ। পাঁচ কন্যা, চার পুত্র। বড়মেয়ে কল্যাণী বিবাহিতা, কসবায় শ্বশুরবাড়ি। তার পরের দু’জন, জয়ন্তী আর চিত্রার বিয়ে হয়েছে যথাক্রমে শিলিগুড়ি আর শ্রীরামপুরে। সুমিত্রা এবং বিত্রা অবিবাহিতা এখনও, থাকেন বাবা-মায়ের সঙ্গে। বড়ছেলে চন্দন বণিক, ১৯৭৫–এর অগস্টে সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে বর্ধমানের নতুনগঞ্জ নিবাসী ব্যবসায়ী ধনপতি দত্তের একমাত্র মেয়ে দেবযানীর সঙ্গে। তিন সন্তান চন্দন-দেবযানীর। দুই ছেলে বাবু আর টাবু, মেয়ে মামণি। খুবই ছোট এখনও, শৈশবের চৌকাঠ পেরতে ঢের দেরি। মেজোছেলে আশীষ বিবাহিত, স্ত্রীর নাম রূপা। একটি মেয়ে আছে ওঁদের, সে-ও দুধের শিশুই প্রায়। সেজো অসীম অবিবাহিত। সবচেয়ে ছোট বারো বছরের নন্দন, ক্লাস সেভেন।
বাড়িতে কাজের লোক বলতে জনাপাঁচেক। মাঝবয়সি চৈতন্য, দীর্ঘদিন রান্নাবান্না করেন বণিকবাড়িতে। চারতলার ল্যান্ডিং-এর পাশে একটি ছোট ঘরে থাকেন। যদু নামের যুবক, থাকেন তিনতলায় সিঁড়ির পাশের ঘরে। কাজ বলতে চন্দ্রনাথের সঙ্গে সকালে বাজার যাওয়া, বাসনপত্র ধোওয়া, টুকটাক হাজারো ফাইফরমাশ খাটা। ঊর্মিলা, সকাল-বিকেল ঠিকের কাজ করেন। ঘর মোছা, কাপড় কাচা, রান্নায় সাহায্য ইত্যাদি। পুষ্পা, বয়স কুড়ির এদিক-ওদিক, দেখাশোনা করেন চন্দন-দেবযানীর বাচ্চাদের। আর শান্তি, বারো বছরের কিশোরী। দেখভাল করার দায়িত্ব আশীষ-রূপার একমাত্র মেয়ের।
বর্ধমানের দত্ত পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও প্রয়োজন এখানে। খুবই বর্ধিষ্ণু এঁরা। ধনপতি দত্তের রাইস মিল আছে, আছে পেট্রল পাম্পও। অনেকগুলি বসতবাড়ি আছে বর্ধমানে, জমিজমাও যথেষ্ট। আছে মাছের ভেড়িও। স্ত্রী সুধারানী বর্তমান। তিন ছেলে, দেবদাস, বিপ্রদাস এবং রামদাস। এক মেয়ে, দেবযানী। সবার ছোট, বাড়ির সকলে চোখে হারায়। দাদারা ডাকে ‘বোনু’ বলে, মা-বাবার আদরের ডাক ‘বুড়ি’।
আগে লিখেছি, তবু মনে করিয়ে দিই, বণিক আর দত্ত পরিবারের পারস্পরিক আলাপ-দেখাশোনার পর দেবযানীর বিয়ে হয়েছিল চন্দনের সঙ্গে। ৭৫-এর অগস্টে। বাল্যবিবাহই বলা চলে, দেবযানী তখন সবে চোদ্দো। চন্দন সবে কুড়ি পেরিয়েছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে, যৌতুকে কার্পণ্য করেননি ধনপতি। বণিক পরিবারের এ নিয়ে অভিযোগের রাস্তা ছিল না কোনও।
দেবযানী বণিক
বিয়ের প্রথম তিন বছর কোনও সমস্যা ছিল না। সুখী দম্পতির জীবন কাটালেন চন্দন–দেবযানী। ‘বড়বউদি’-র সঙ্গে দেবর-ননদদের সম্পর্কে টাল খায়নি কোথাও। ‘বড়বউমা’-ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি শ্বশুর–শাশুড়ির।
তাল কাটতে শুরু করল ’৭৮-এর জুলাইয়ের শেষাশেষি। ধনপতি এসেছেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। চন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী প্রস্তাব দিলেন, ‘আমাদের সেজো মেয়ে চিত্রার বিয়ে দেব এবার। আপনার বড়ছেলে দেবদাসের সঙ্গেই বিয়েটা হোক, আমাদের একান্ত ইচ্ছে।’ ধনপতি সবিনয়ে জানালেন, ‘এই প্রস্তাব আর কিছু দিন আগে দিলে সম্মত হওয়া যেত। কিন্তু এখন তো আর সম্ভব নয়। আপনারা তো জানেন দেবদাসের বিয়ের পাকা কথা হয়ে গিয়েছে গত মাসে আসানসোলের হরিসাধন ঘাঁটির কন্যা কুমকুমের সঙ্গে। অগস্টে বিয়ে। কথার খেলাপ এখন আর করা চলে না।’ বণিক দম্পতি শুনলেন, গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং আর বাক্যব্যয় না করে ভিতরে চলে গেলেন। ধনপতি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, মেয়ের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে এলেন বর্ধমানে।
টানাপোড়েনের পরের ধাপও দেবদাসের বিয়ের সূত্রেই। ধনপতি সপরিবারে এসেছেন ছেলের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। ততদিনে দুই পরিবারেরই একে অন্যের আত্মীয়পরিজনের ব্যাপারে সম্যক ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই, কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই চন্দ্রনাথ বললেন ‘আচ্ছা, ড. মৃণালকান্তি বিষ্ণু আপনাদের আত্মীয় না?’ ধনপতি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার ভাইয়ের স্ত্রীর একটিই বোন আছে। ড. বিষ্ণু তাঁর স্বামী। খুবই ঘনিষ্ঠ আমাদের।’ চন্দ্রনাথ শর্ত দিলেন, ড. বিষ্ণুকে বিয়েতে ডাকলে বণিকরা যাবেন না বিয়েতে। ধনপতি জানতে চাইলেন, কেন? জানা গেল, দেবযানীর সঙ্গে বিয়ের আগে, চন্দনের বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল ড. বিষ্ণুর ভাগনির সঙ্গে। যেদিন মেয়েকে দেখতে আসার কথা, নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ছ’-সাত ঘণ্টা পর চন্দ্রনাথ গিয়ে জানিয়ে দেন, এ সম্বন্ধ এগোতে আর ইচ্ছুক নন। মেয়েকে না দেখেই। ড. বিষ্ণু বলেন, বিয়ে দেওয়া না-দেওয়া চন্দ্রনাথের ইচ্ছে। কিন্তু এই হেনস্থাটা না করলেই পারতেন। তর্কবিতর্ক-বাদানুবাদ হয়। সেই থেকেই ড. বিষ্ণুর উপর রাগ। ধনপতি শুনলেন সব, কিছু বললেন না।
বিয়ের দিন চন্দ্রনাথ সপরিবারে গিয়ে দেখলেন, ড. বিষ্ণুও আমন্ত্রিত। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ধনপতিকে বললেন, ইচ্ছে করে অপমান করলেন বাড়িতে ডেকে। আর কখনও আপনার মেয়ে বাপের বাড়ি আসবে না। ধনপতি বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে না ডাকলে খুবই খারাপ দেখাত। চন্দ্রনাথ কর্ণপাত করলেন না। চলে এলেন বিয়েবাড়ি থেকে।
সংঘাতের তৃতীয় পর্ব বর্ধমানে একটি পুকুর কেনা নিয়ে। ধনপতি পুকুরটি কিনেছিলেন বড় অঙ্কের টাকায়। জানতে পেরে হঠাৎই চন্দ্রনাথ জানান, ওই পুকুরটির জন্য তিনিও বায়না করেছিলেন। তাঁকে দিয়ে দিতে হবে ওই জলাশয়। ধনপতি বললেন, বেশ তো, বায়নানামা দেখান। চন্দ্রনাথ দেখাতে পারলেন না, হালকা বাদানুবাদ হল। দুই পরিবারের মনকষাকষি বাড়ল। যার প্রভাব উত্তরোত্তর পড়তে লাগল দেবযানীর উপর।
দ্রুত পালটে যেতে থাকল শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদদের ব্যবহার। স্বামী চন্দনেরও। শুরু হল কথায় কথায় কটাক্ষ, দুর্ব্যবহার। মাঝেমাঝেই স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে শুরু করলেন চন্দন। দেবযানী বাপের বাড়ি যেতেন প্রতি দু’মাস অন্তর, সেটা কমে দাঁড়াল ন’মাসে- ছ’মাসে একবার। তা-ও বহু কাকুতি-মিনতির পর। মা-বাবাকে চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে গেল বণিকবাড়ির বড়বউয়ের। দেবযানী সহ্য করছিলেন, যেমন করে থাকেন আর পাঁচজন নেহাতই সাদাসিধে, অল্পশিক্ষিতা এবং আর্থিকভাবে স্বামীনির্ভর গৃহবধূ।
পরিস্থিতি জটিলতর হল ’৮২ -র মাঝামাঝি থেকে। বর্ধমানে একটি বিশাল কোল্ড স্টোরেজ কিনলেন চন্দ্রনাথ, ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক কোটি টাকা ধার করে। অন্যান্য ব্যবসায় তখন তুলনামূলক মন্দা চলছে বণিকদের। কোল্ড স্টোরেজটি ঠিকমতো চালু হতেও সময় লাগছিল কিছু। জমছিল না তেমন। এদিকে ব্যাঙ্ক থেকে নিয়মিত তাগাদা আসতে শুরু করল ধারের কিস্তি শোধের, বণিকবাড়িতে পৌঁছল ‘ডিমান্ড নোটিস’। চন্দ্রনাথ চাপ দিতে শুরু করলেন ধনপতির উপর, বকেয়া ধারের ২৫ শতাংশ বহন করতে। ওই পঁচিশ শতাংশ মানে সেই তখনকার দিনেও প্রায় পৌনে এক কোটি। ধনপতি জানালেন, তিনি অপারগ। খুব বেশি হলে দশ লাখ। কোিট খানেক মতো দিয়ে ওঠা তাঁর সাধাতীত। উত্তরে চন্দ্রনাথ ফের মুখ খারাপ করলেন যথেচ্ছ। দুই পরিবারের সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকটি প্রায় পোঁতাই হয়ে গেল।
দেবযানীর জীবন ক্রমে আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠল। বাড়ল চন্দনের মারধরের মাত্রা। শাশুড়ি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তখন। স্বামী-শ্বশুর-দেবর-ননদরা ‘অলক্ষ্মী’ বলে প্রকাশ্যেই ডাকা শুরু করলেন বাড়ির বড়বউকে। ঘুম থেকে উঠলেই রোজ শুনতে হত, এই অলক্ষ্মীটার মুখ দেখতে হল আবার, সারা দিনটা খারাপ যাবে। এর জন্যই কোল্ড স্টোরেজ চালু হল না। বিস্তর কটাক্ষ, গালিগালাজ। বাড়ির পুরনো রাঁধুনি চৈতন্য খুব স্নেহ করতেন দেবযানীকে। তাঁর হাত দিয়ে গোপনে পাঠানো কয়েকটি চিঠিতে ধরা আছে দেবযানীর নিত্যদিনের যন্ত্রণার কাহিনি।
একটি চিঠির অংশবিশেষ—
শ্রীচরণকমলেষু মা, আমি পাঁচ বছর ধরে সহ্য করছি এদের অত্যাচার। আর পারছি না। আমি এখানে থাকব না আর। তুমি বাবাকে বলো আমাকে নিয়ে যেতে। ওখানে একমাস থাকলে মনটা ভাল হবে। এই চিঠি খুব সাবধানে লিখছি। চৈতন্যদা নিয়ে যাবে। বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বললেও এরা পাশে দাঁড়িয়ে শোনে সব। আমার খুব কান্না পায়। তোমার জামাইও ভাল লোক নয়। খারাপ কথা বলে সব সময়, গায়ে হাত তোলে সবার সামনেই। এভাবে থাকা যায় না। বাবাকে আবার বলো, আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
প্রণাম নিয়ো।
তোমাদের বুড়ি।
দেবযানীর সঙ্গে যখন দেখা করতে আসতেন ধনপতি, বসার ঘরে অপেক্ষা করতে হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মিনিটখানেকের দেখা হত পিতা-পুত্রীর, সাক্ষাতের এবং কথোপকথনের সাক্ষী থাকতেন ননদরা।
লিখতে লিখতে রবীন্দ্রনাথের ‘দেনা পাওনা’ মনে পড়ে অবধারিত— “রামসুন্দর যখন বেহাইবাড়ির অনুমতিক্রমে ক্ষণকালের জন্য কন্যার সাক্ষাৎলাভ করিতেন তখন বাপের বুক যে কেমন করিয়া ফাটে তাহা তাঁহার হাসি দেখিলেই টের পাওয়া যাইতো।”
বাহ্যিক বিচারে দেবযানীর সঙ্গে ‘দেনা পাওনা’-র নিরুপমার মিলের থেকে অমিলই বেশি। নিরুপমার জন্ম অর্থবান পরিবারে নয়। বাবা প্রাণপাত করেছিলেন বকেয়া তিন হাজার জোগাড়ে। নিরুপমার ক্ষয়িষ্ণু মৃত্যু এসেছিল নিজের প্রতি অযত্নে, নিয়ত মানসিক আঘাতে দীর্ণ হতে হতে। দেবযানী বিত্তশালী পরিবারের। খুন হয়েছিলেন। ধনবান পিতাও পারেননি কন্যার শ্বশুরবাড়ির চাহিদা পূরণ করতে।
আপাতভিন্ন প্রেক্ষিত। তবু সার্বিক বিচারে মনে হয়, একটি জায়গায় অক্লেশে মিলেমিশে যান ছাপোষা রামসুন্দর এবং সম্পন্ন ধনপতি। পিতৃহৃদয়ের স্নেহের দোলাচলে। একমাত্র কন্যার মানসিক বা শারীরিক যন্ত্রণালাঘবের ব্যর্থ অসহায়তায়। আর্থিক সামর্থ্য যেখানে তুচ্ছাতিতুচ্ছ।
গল্পের নিরুপমার মৃত্যুর পর “এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়”-এর উপায় ছিল রায়বাহাদুরের। বাস্তবের দেবযানীকে হত্যার পর চন্দ্রনাথদের সে-রাস্তা ছিল না। ঘানি টানতে হয়েছিল জেলের। সান্ত্বনা এটুকুই।
ঘটনায় ফিরি। বিরাশির দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার দিন কুড়ি আগের কথা। মেজোছেলে বিপ্রদাসের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শিয়ালদার এক আত্মীয়ার বাড়িতে এসে উঠেছেন দত্ত-পরিবারের অনেকে। ধনপতি ব্যবসার কাজে রয়েছেন বর্ধমানেই। বিকেলের দিকে রাইস মিলের ল্যান্ড লাইনে ফোন পেলেন দেবযানীর, ‘বাবা, তোমার জামাই আজ প্রচণ্ড মেরেছে আমায়।’ বলেই কান্না অনর্গল।
ধনপতি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন শিয়ালদায় আত্মীয়ার বাড়ি। স্ত্রীকে বললেন, এক্ষুনি যাও বুড়ির বাড়ি। ছুটলেন দত্ত পরিবারের সদস্যরা। বণিকবাড়ির বসার ঘরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পর দেবযানী এলেন। সঙ্গে ননদরা। একান্তে কথা প্রায় বলতেই দেওয়া হল না বাড়ির লোকের সঙ্গে। সুধারানী লক্ষ করলেন মেয়ের ডানহাতের কনুই ফুলে গিয়েছে। কালশিটের দাগ স্পষ্ট। অনুরোধ করলেন চন্দ্রনাথকে, বুড়িকে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
প্রথমে প্রত্যাখ্যাত হল আর্জি, শেষে বহু অনুনয়-বিনয়ের পর চন্দ্রনাথ বললেন, ‘কয়েকদিন পর ব্যবসার কাজে ত্রিপুরা যাবে চন্দন। তখন নিয়ে যাবেন।’
দেবযানীকে কয়েকদিন পর বর্ধমানে নিয়ে গেলেন ভাই রামদাস। মা-বাবাকে মেয়ে জানাল অত্যাচারিত হওয়ার বিস্তারিত কাহিনি। তখনকার দিনে তো বটেই, আজকের দিনেও এদেশের অধিকাংশ মা-বাবারা যা করে থাকেন এই পরিস্থিতিতে, তা-ই করলেন ধনপতি-সুধারানী। বোঝালেন, আমরা কথা বলব চন্দনের সঙ্গে। সব ঠিক হয়ে যাবে, তুই একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর বুড়ি।
দেবযানী মা-বাবাকে জানালেন, চন্দ্রনাথ-চন্দন বলেই দিয়েছেন আসার আগে, ধনপতি ওই বকেয়া ধারের ২৫ শতাংশ না দিলে আর কোনও দিন বর্ধমানে আসতেই দেবেন না। ধনপতি বোঝালেন, একসঙ্গে অত টাকা দেওয়া অসম্ভব। দশ লাখ দেবেন বলেছেন তো। পরে আরও চেষ্টা করবেন।
চন্দন এলেন বর্ধমানে দেবযানীকে নিয়ে যেতে। ধনপতি–সুধারানী আপ্রাণ বোঝালেন চন্দনকে, মেয়েকে অত্যাচার না করতে এভাবে। চন্দন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন অভিযোগ শুনে। গালিগালাজ করলেন দেবযানীকে, বললেন আর কখনও বর্ধমানে আসতে দেবেন না। ধনপতি-সুধারানী ভাবলেন, রাগের কথা। সত্যিই যে এটাই এ-বাড়িতে তাঁদের আদরের ‘বুড়ি’র শেষ আসা হতে যাচ্ছে, ভাবেননি দুঃস্বপ্নেও। বেরনোর আগে যখন প্রণাম করছেন দেবযানী, মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ধনপতি, তখনও দূরতম কল্পনাতেও ভাবেননি, মেয়ের সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাৎ হবে মাসকয়েক পরে, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
মহালয়ার দিনকয়েক আগে দত্তবাড়ি থেকে পুজোর জামাকাপড় নিয়ে বণিকবাড়ি এলেন দেবদাস। যা তাচ্ছিল্যে ফিরিয়ে দিলেন চন্দ্রনাথ। ফিরে এলেন অপমানিত দেবদাস। ধনপতি বুঝলেন, পুজোটা ভাল কাটবে না বুড়ির।
কাটলও না। অত্যাচার আরও বাড়ল, দেবযানী সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়লেন শ্বশুরবাড়িতে। মাঝ-ডিসেম্বরে কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসার কিছু কাগজপত্র বর্ধমানের কোর্টে জমা দিতে গিয়েছিলেন চন্দ্রনাথ-চন্দন। আদালতেই দেখা ধনপতিবাবুর বিশ্বস্ত কর্মচারী হৃষিকেশ ঘোষের সঙ্গে। হৃষিকেশকে ডাকলেন চন্দন। নিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে, যার মধ্যে বসে আছেন চন্দ্রনাথ। বাকিটা পড়ুন হৃষিকেশের বয়ানে: ‘চন্দ্রনাথবাবু বললেন, তোমার বাবুকে বলবে, আমি প্রতিশোধ নেব। এমন শোধ নেব যে সারা জীবন জ্বলবে। আমি বললাম, আমাকে বলছেন কেন? যা বলার, বাবুকে সরাসরি বলবেন।’
প্রতিশোধ নেওয়াও হল জানুয়ারির শেষাশেষি। ২৮ জানুয়ারি, ১৯৮৩। বণিকবাড়িতে সেদিন আয়োজন হয়েছে সত্যনারায়ণ পুজোর। বাড়িতে প্রচুর আত্মীয়স্বজন। মেজোছেলে আশীষ দিন কয়েক হল সস্ত্রীক শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে। এ ছাড়া সবাই উপস্থিত। দেবযানীর দেবর-ননদ, তাঁদের ছেলেপুলে, সব। কাজের লোকের মধ্যে সকালে উপস্থিত যদু, ঊর্মিলা আর শান্তি। চৈতন্য বাড়ি গিয়েছে দিনতিনেক আগে, পুষ্পাও কয়েক দিনের ছুটিতে সুন্দরবনের বাড়িতে।
সকাল ৮-০৫। চন্দনের সঙ্গে হলঘরে কথা-কাটাকাটি হল দেবযানীর। সবার সামনেই চন্দন হিড়হিড় করে টানতে টানতে দেবযানীকে নিয়ে গেলেন বেডরুমে। বেধড়ক মারলেন। কান্না আর আর্তনাদ ছিটকে এল বাইরে। শুনলেন বাড়ির বাকিরা। কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না কেউ, কানে তালা দিয়ে পুজোর সিন্নি নিয়ে আলোচনায় ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সকাল ৮-৩০। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে একরকম জোর করেই হলঘরে বেরিয়ে এলেন দেবযানী। ফোন করলেন বর্ধমানের বাড়িতে। তুললেন দেবদাস, বড়ভাই। সেদিন দত্তবাড়ির পুরুষরা সকাল থেকে খুবই ব্যস্ত একটি জমিজমাসংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে; একটু পরেই কোর্ট-কাছারিতে ছোটাছুটি আছে। দূরভাষে দেবযানী বললেন, ‘এরা আমাকে মেরে ফেলবে! দাদা, তোরা আজই এসে আমাকে নিয়ে যা।’
দেবদাসের মুখচোখ দেখে ফোন নিলেন ধনপতি। ততক্ষণে দেবযানীর থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছেন চন্দ্রনাথ, গালিগালাজ করছেন অকথ্য। ফোন বাবার থেকে আবার নিলেন দেবদাস, বললেন, ‘বোনুকে কিছু করবেন না। আমরা বিকেলের মধ্যে রওনা দিচ্ছি। নিয়ে আসব ওকে। কাকাবাবু, দোহাই আপনার, মারবেন না আর।’ কোনও উত্তর না দিয়ে সপাটে ফোন রেখে দিলেন চন্দ্রনাথ। ঠিক হল, দ্রুত কাজ সেরে সন্ধের আগেই কলকাতায় যাবেন ধনপতি আর দেবদাস। দেবযানীকে নিয়ে আসবেন বাড়িতে। কে জানত, তখনই না বেরিয়ে পড়ে বিকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পরিণতি কী ভীষণ মর্মান্তিক হতে যাচ্ছে!
পুজো শেষ হল। সবাই প্রসাদ খেলেন পাত পেড়ে। দেবযানী অভুক্ত থাকলেন, খেতে দেওয়া হল না। পুজোর জায়গার কাছাকাছি আসতেই দেওয়া হল না ‘অলক্ষ্মী’ অপবাদে। অতিথিরা চলে গেলেন দুপুর দুপুর। কল্যাণী আর চিত্রা, বণিকদের বড় আর সেজো মেয়ে, ফিরে গেলেন।
দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল, বণিকবাড়িতে উপস্থিত চন্দ্রনাথ, ছেলেদের মধ্যে চন্দন-অসীম-নন্দন। মেয়েদের মধ্যে জয়ন্তী, সুমিত্রা আর বিত্রা। দেবযানী নিজের ঘরে। চন্দ্রনাথের স্ত্রী আর মা নিজেদের ঘরে বিশ্রামে। বাচ্চারা আছে নিজেদের ঘরে, নিজেদের মতো। কাজের লোকদের মধ্যে রয়েছে যদু আর শান্তি। ঊর্মিলা দুপুরের কাজ সেরে নীচে গিয়েছেন। আবার আসার কথা সন্ধেবেলায়।
বিকেল ৪-০৫। দেবযানীর ঘরে ঢুকলেন চন্দ্রনাথ-চন্দন। কিছু পরেই দেবযানীর পরিত্রাহি চিৎকার ভেসে এল ঘর থেকে। যদু এবং শান্তি, দু’জনেরই খুব প্রিয় ছিল বড়বউদি। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ছুটল দেবযানীর ঘরের দিকে। হলঘরে আটকে দিলেন সুমিত্রা, ‘তোদের কী দরকার এখানে? যা, কাজে যা!’
দেবযানীর আর্তনাদ স্তিমিত হয়ে এল একটু পরে। সাড়ে চারটে নাগাদ রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে যদু দেখল, ওই ঘরে ঢুকছেন অসীম-জয়ন্তী-সুমিত্রা-বিত্রা। কৌতূহল সামলাতে না পেরে ফের যদু আর শান্তি চলে এল ঘরের কাছাকাছি। আবার ধমক সুমিত্রার, ‘তোদের বললাম না নিজের কাজ করতে! যা এখান থেকে।’ যদু আর শান্তি ফিরল রান্নাঘরে। তার আগে অবশ্য দেখা হয়ে গিয়েছে, বড়বউদি ঝুলছে ঘরের সিলিং ফ্যানে। গলায় ফাঁস শাড়ির।
তখন পৌনে পাঁচটা। ধনপতি-দেবদাস কলকাতা রওনা হওয়ার তোড়জোড় করছেন। ফোন বাজল নতুনগঞ্জের বাড়িতে। দেবদাস তুললেন। অন্যপ্রান্তে চন্দ্রনাথ, সকালের রুদ্রমূর্তি বদলে গিয়ে অস্বাভাবিক অমায়িক এখন।
—তোমরা কি রওনা হয়ে গিয়েছ?
—না কাকাবাবু, এই বেরব।
—শোনো, তোমরা আজ এসো না। আমি কাল বর্ধমান যাচ্ছি কাজে। তোমাদের দুর্গাপুরের পেট্রল পাম্পে দেখা করে নেব।
—বোনুকে একবার দেবেন, একটু কথা বলতাম।
—বউমা তো বেরিয়ে গেল একটু আগে চন্দনের সঙ্গে, সিনেমা দেখতে। তোমরা চিন্তা কোরো না, ও ভাল আছে।
ফোন রেখে দেওয়ার পরও খচখচানি একটা থেকেই গেল ধনপতি আর দেবদাসের। ব্যবহারে হঠাৎ এমন ভোলবদল? তারপর ভাবলেন, হতে পারে সকালের মারধরের পর অনুতাপ হয়েছে ওঁদের। মিটমাট হয়েছে সাময়িক। তা ছাড়া কাল তো চন্দ্রনাথ আসছেনই, মুখোমুখি কথা বলে নেওয়া যাবে। অনেক হয়েছে, ঘরের মেয়েকে ফিরিয়ে আনবেন ঘরে।
সন্ধে নেমেছে। বণিকবাড়িতে তখন প্রমাণ লোপাটের ব্যস্ততা। কিন্তু মাথা কাজ করছে না কারও। শান্তি তো রোজ রাত্রে এ বাড়িতে থাকেই, যদুও কখনও কখনও থেকে যায়। শুয়ে পড়ে রান্নাঘরে। দু’জনকেই বলা হল রাত্রে বাইরে শুতে। শান্তি গেল ঊর্মিলার ঘরে, যদু তিনতলায় সিঁড়ির পাশে নিজের রোজকার আস্তানায়। জয়ন্তী ভয় দেখালেন যাওয়ার আগে, ‘কাউকে কিছু বললে কাজ ছাড়িয়ে দেব চুরির বদনাম দিয়ে। না খেতে পেয়ে মরবি।’ ঊর্মিলা সন্ধেবেলা কাজে এসে দেখলেন, কোলাপসিবল গেট বন্ধ। বেল বাজালেন। ভিতর থেকে চন্দ্রনাথ বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কাল আসবি। আজ আর দরকার নেই।’
কিল-চড়-লাথি-ঘুসি তো ছিলই যেমন খুশি, লাঠি দিয়েও সজোরে দেবযানীর মাথায় মেরেছিলেন চন্দন। সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন দেবযানী। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু তৎক্ষণাৎ। খুনকে আত্মহত্যার চেহারা দিতে এর পর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল সিলিং ফ্যানে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দেবযানীর ঘর। বাচ্চাদের বলা হয়েছিল, মায়ের শরীর খারাপ, ঘুমোচ্ছে। তোমরা অন্য ঘরে থাকো। কতই বা বড় ওরা তখন, বাবার কথা মেনে নিয়েছিল নিষ্পাপ বিশ্বাসে।
রাত গভীর হলে চন্দ্রনাথরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, আত্মহত্যার গল্পটা না-ও দাঁড়াতে পারে। আপাতত দেহ লুকিয়ে ফেলা যাক। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় ফোল্ডিং খাটের ভেতর দেবযানীর দেহ পুরে দেওয়া হল। কীভাবে, শুরুতে লিখেছি বিস্তারিত।
পরদিন সকাল। ২৯/১/৮৩। একটি সুটকেস নিয়ে দশটা নাগাদ চন্দ্রনাথ-চন্দন বেরলেন। গোলপার্কের ইন্ডিয়ান ওভারসিজ় ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা তুললেন। এবং সোজা পৌঁছলেন পারিবারিক চিকিৎসক অজিতকুমার ব্যানার্জির চেম্বারে। বললেন, ‘এক মহিলা গৃহকর্মী মারা গিয়েছেন। একটা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে।’ ডাক্তারবাবু বললেন, ‘মৃতদেহ না দেখে সেটা কী করে সম্ভব?’ চন্দ্রনাথ সুটকেস খুললেন, যাতে সদ্য ব্যাংক থেকে তোলা এক লাখ। বললেন, ‘কত লাগবে আপনার?’
টাকার গরমের এই এক মুশকিল, সব কিছুই ক্রয়যোগ্য ভাবায় কখনও কখনও। ডাক্তারবাবু শুনে হাসলেন। সুটকেস বন্ধ করে দিয়ে বললেন, যতই দিন, এ জিনিস আমার দ্বারা হবে না। আসুন আপনারা।
বেরনোর আগে শেষ প্রশ্ন করলেন চন্দ্রনাথ, ‘ময়নাতদন্তে কি বোঝা যায়, খুন, না আত্মহত্যা?’ ডাক্তার ব্যানার্জি বললেন, ‘সে তো যায়ই। খুব সহজ। কিন্তু এ প্রশ্ন করছেন হঠাৎ?’ চন্দ্রনাথ-চন্দন আর দাঁড়ালেন না, ফিরলেন বাড়ির পথে। কন্ট্রোল রুমে সে রাতের ফোনটা কি ডাক্তারবাবুই করেছিলেন? কে জানে!
এদিকে নিয়মমতো ২৯ তারিখ সকালে কাজে এলেন ঊর্মিলা আর যদু। শান্তিও এল, পুষ্পাও ফিরে এসেছে বাড়ি থেকে। ভয় দেখিয়ে কি আর মুখ বন্ধ করা যায় সব সময়? যদু আর শান্তি খুলে বলল ঊর্মিলাকে, আগের দিন বিকেলে যা যা ঘটেছিল, যা যা দেখেছিল, সব। ঊর্মিলা সাহস করে জানতে চাইলেন চন্দনের কাছে, বড়বউদিকে দেখছি না। কোথায়? উত্তর এল, বাপের বাড়ি গিয়েছে গত রাতে। ভাইরা এসে নিয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা দেখল, মায়ের ঘর এখনও বন্ধ। চন্দন বোঝালেন, মা বর্ধমান গিয়েছে, কয়েকদিন পরই ফিরবে।
রাত বাড়ল। প্রায় দশটা। ঊর্মিলা কাজ সেরে ফিরে গিয়েছেন। যদুও বেরনোর তোড়জোড় করছে। পুষ্পা আর শান্তি রয়েছে। বেল বাজল ফ্ল্যাটের, থানা থেকে আসছি, দরজা খুলুন প্লিজ়। আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। পাঁচতলা থেকে ছ’তলায় ওঠার দরজা দিয়ে উপরে উঠে গেলেন চন্দ্রনাথ-চন্দন-অসীম। সাফাইকর্মীদের ব্যবহারের জন্য ছিল ঘোরানো সিঁড়ি। নেমে গেলেন নীচে, পালালেন নিঃশব্দে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দিকের গেট দিয়ে। যদু-শান্তি-পুষ্পাকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দিলেন সুমিত্রারা। শাসালেন, ‘কিচ্ছু বলবি না পুলিশকে। মারলেও মুখ খুলবি না কেউ।’
পুলিশ ঢুকল দরজা ভেঙে। যা হল এর পর, লিখেছি। কথায় বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। সেখানে কে চন্দ্রনাথ, কে-ই বা চন্দন-অসীম? আর কে-ই বা সুমিত্রা-জয়ন্তী-বিত্রা?
চন্দ্রনাথরা পালালেন কোথায়? প্রথমে মহাত্মা গাঁধী রোডের ‘Hoteliers Associates’-এ আগরতলার রমেশ দত্ত পরিচয়ে ঘর নিলেন চন্দ্রনাথ। হোটেলের রেজিস্টারে ছেলেদের নাম লিখলেন সুশীল দত্ত আর অশোক দত্ত। একদিন পরে সেখান থেকে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের শিয়ালদা লজ়। এবার গৌর সাহা নামে রেজিস্টারের ফর্ম ভরতি করলেন চন্দ্রনাথ।
দেবযানী বণিক-এর শ্বশুর চন্দ্রনাথ বণিক
হইচই পড়ে গিয়েছে শহরে ততক্ষণে দেবযানী-হত্যা নিয়ে। পুলিশ সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে পলাতকদের ধরতে। চন্দ্রনাথ-চন্দন-অসীমদের ছবি নিয়ে শহর চষে ফেলছে একাধিক সোর্স। চন্দ্রনাথরা বুঝলেন, বেশিদিন এভাবে পালিয়ে থাকা অসম্ভব। হোটেল থেকে ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখ দুই ছেলেকে নিয়ে বেরলেন হাজরার উদ্দেশে, পরিচিত উকিলের বাড়ি। পুলিশ খবর পেল সোর্স মারফত, রাসবিহারী মোড়ের কাছে ৪ ফেব্রুয়ারির দুপুরে আটকানো হল একটি ট্যাক্সি। ভিতরে চন্দ্রনাথ-চন্দন-অসীম। সোজা নিয়ে যাওয়া হল বণিকবাড়ি। যে লাঠি দিয়ে মারা হয়েছিল দেবযানীর মাথায়, উদ্ধার হল ছ’তলার অফিসঘর থেকে। ফাঁস দিতে ব্যবহৃত শাড়ি বেরোল সাততলা থেকে।
পুলিশের কাজই তো অপরাধ-দমন, কিনারা করা ঘটে যাওয়া অপরাধের। তারপর চার্জশিট, বিচারপর্বে সাক্ষ্যদান এবং আরও ‘তারিখ পে তারিখ।’ এবং অনন্ত অপেক্ষা আদালতের আদেশের। রায় পক্ষে গেলে অভিযুক্তের আবেদন উচ্চ থেকে উচ্চতর আদালতে, পুলিশি তদন্তের কাটাছেঁড়া নিয়মমাফিক। এটা করেননি কেন, ওঁর জবানবন্দি নেওয়া হয়নি কেন, সিজ়ার লিস্টে অমুকের নাম নেই কেন, তমুক তখন কোথায় ছিলেন, দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সামনে পড়তে হয় কেস ডায়েরিকে। সামান্যতম খুঁত পেলেই তিরস্কার বরাদ্দ।
সংগতই, তদন্ত তো নিশ্ছিদ্রই হওয়া উচিত। ভুলত্রুটি তো নিষিদ্ধই, মামলা যখন খুনের মতো গুরুতর অপরাধের, প্রশ্ন যখন ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাবাসের। মাননীয় আদালত অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পরই রায় দেন। যা মেনে নিতে হয় নতমস্তকে।
কিছু মামলা আসে কদাচিৎ, যখন স্রেফ রোজকার পেশাগত দায়বদ্ধতার সীমানার বাইরেও তৈরি হয় দোষীকে শাস্তিদানের বাড়তি মানবিক তাগিদ। দেবযানী মামলাও ছিল এমনই ব্যতিক্রমী। মিডিয়ার ঢক্কানিনাদের জন্য শুধু নয়। ঊর্ধ্বতনের চাপে শুধু নয়। এক নির্দোষ গৃহবধূর নির্মম হত্যাকাণ্ডে যাতে সাজা হয় দোষীদের, নিশ্চিত করতে পেশাগত প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে দলগতভাবে ঝাঁপিয়েছিল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতর। তদন্তকারী অফিসার সুজিত সান্যালের সুযোগ্য নেতৃত্বে। কোনও কোনও বিরল মামলায় অভিযুক্তের অপরাধ সম্পর্কে যখন নিশ্চিত হই আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ-তথ্যতালাশের পর, তখন মনে হয় আমাদের, যা হওয়ার হোক। শেষ পর্যন্ত যাব। শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলে। চলতেই থাকে।
দুরন্ত লড়েছিলেন তদন্তকারী অফিসার সুজিত সান্যাল। সুজিতের বৈশিষ্ট্য ছিল, এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যেতেন ঘটনার সঙ্গে, নাওয়াখাওয়াও ত্যাগ করতেন কখনও কখনও। তদন্ত শুধু পেশা ছিল না, নেশাও। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে তাঁর অধীনে যাঁরা কাজ করেছেন কোনও না কোনও সময়, তাঁরা আজও শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ান সুজিতবাবুর প্রসঙ্গ উঠলে। গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন পদে সুনামের সঙ্গে কাজ করার পর অবসর নিয়েছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে।
বিচার শুরু হল। বিত্রার বিচার শুধু জুভেনাইল কোর্টে, যেহেতু তখনও নাবালিকা। বণিক পরিবার জলের মতো টাকা খরচ করলেন উকিলদের পিছনে। দাবি করা হল, চন্দ্রনাথ-চন্দন-অসীম ঘটনার সময় ছিলেনই না বাড়িতে। ধৃত মহিলারাও নির্দোষ, আর কীসের খুন? দেবযানী তো আত্মহত্যা করেছেন। দীর্ঘ সওয়াল-জবাবে ধোপে টেকার কথা ছিল না এই মিথ্যাচারের। টেকেওনি। যদু-শান্তির সাক্ষ্য তো ছিলই। যে লাঠি দিয়ে মারা হয়েছিল দেবযানীর মাথায়, তাতে হাতের ছাপ ছিল চন্দনের। যে হোটেল দুটিতে ঘটনার পর ঠাঁই নিয়েছিলেন চন্দ্রনাথরা, তার রেজিস্টারের লেখার সঙ্গে চন্দ্রনাথের হাতের লেখা মিলে গিয়েছিল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। সর্বোপরি দেবযানীর লেখা চিঠিগুলি তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করেছিল ধারাবাহিক নির্যাতন।
আদালতে চত্বরে চন্দ্রনাথ বণিক
আর আত্মহত্যার তত্ত্ব? খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ড. রবীন বসুর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে। দেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল, প্রতিটির খুঁটিনাটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিল সেই রিপোর্ট। পরিষ্কার বলা হয়েছিল, মাথার আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল, চিড় ধরে গিয়েছিল দেবযানীর খুলিতে। এলোপাথাড়ি যত্রতত্র আঘাতের তীব্রতাতেই মৃত্যু, “fissured fracture on the vault of her scull and several other injuries, all ante-mortem and homicidal in nature.” আর গলায় ফাঁসের দাগ, পুলিশি পরিভাষায় ‘ligature mark’? রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা ছিল, “post-mortem hanging”। অর্থাৎ, মৃত্যুর পর দেহ ঝোলানো হয়েছিল।
’৮৫-র এপ্রিলে রায় দিলেন আলিপুর কোর্ট। জয়ন্তী, সুমিত্রা আর অসীমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। চন্দ্রনাথ-চন্দনের ফাঁসির আদেশ। জজসাহেব লিখলেন, “But the part played by accused Chandranath irrespective of his age and that of accused Chandan deserve the severest punishment enjoined by the law and no leniency need be shown to them having regard to the facts and circumstances of the case.”
হাইকোর্টে গেলেন বণিকরা। রায় আংশিক বদলাল। চন্দ্রনাথ-চন্দনের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকল। সুমিত্রার যাবজ্জীবনেরও। অসীম আর জয়ন্তীর শাস্তি কমে দাঁড়াল দু’বছরের সশ্রম কারাবাসে।
বল যথারীতি গড়াল সুপ্রিম কোর্টে। যেখানে চন্দ্রনাথ-চন্দনের ফাঁসির আদেশ রদ করে রায় দেওয়া হল যাবজ্জীবন কারাবাসের। ১৪ বছর পর মুক্তি পেলেন চন্দ্রনাথ-চন্দন-সুমিত্রা। চন্দ্রনাথ গত হয়েছেন। বাকিরা বর্তমান। জুভেনাইল কোর্টে বিচারপর্বে দোষী সাব্যস্ত বিত্রাও। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মামলা থেকে মুক্তি পান ঘটনার বছরতিনেক পর।
পড়লেন তো। কী-ই বা বলার আর? বাংলা শব্দকোষকে বড় নিঃস্ব দেখায় বিশেষণ খুঁজতে বসলে। করুণ? হৃদয়বিদারক? না কি মর্মান্তিক? বৃথা চেষ্টা, সব অনুভূতিকে কি আর শব্দের পোশাক পরানো যায়?
ঘটনা যতটা বেদনার, স্থাপনাও ততটাই বেদনাদায়ক ছিল, পরিশেষে স্বীকার করি নির্দ্বিধায়।