1 of 2

১.০৪ এসেছিল সুবৰ্ণ সেই চিলেকোঠার ঘরে

হ্যাঁ, এসেছিল সুবৰ্ণ সেই চিলেকোঠার ঘরে। যখন সংসারের সব পাট চুকিয়ে মুক্তকেশী নিত্যনিয়মে দ্বিপ্রাহরিক পাড়া বেড়ানোয় বেরিয়েছেন, উমাশশী গেছে ছেলে ঘুম পাড়ানোর ছুতোয় একটু গা গড়িয়ে নিতে, খুদু আঁশ-নিরামিষ দু প্রস্থের বাসনের পাহাড় নিয়ে উঠোনে বসেছে গুছিয়ে, তখন এই নিরিবিলির অবসরে পা টিপে টিপে সিঁড়িতে এল সুবর্ণ, আরো পা টিপে টিপে সিঁড়ি উঠতে লাগল অভিসারের ভঙ্গিতে পায়ের মল খুলে রেখে।

কিন্তু পায়ের মল কি এক সুবৰ্ণই খুলেছিল? তা যেই খুলুক প্ৰবোধের সেটা জানার কথা নয়, প্ৰবোধ তাই প্রতি মুহূর্তে একটি মলের রুনুকুনুর অপেক্ষায় উৎকৰ্ণ হয়ে হয়ে ক্রমশ হতাশ হচ্ছে, ক্রুদ্ধ হচ্ছে, ক্ষিপ্ত হচ্ছে।

গরমে গলাগলিয়ে ঘাম ঝরছে, মশার কামড়ে আরো গা ফুলে উঠেছে, নিজের হাতের চড় খেয়ে খেয়ে গায়ে ব্যথা হবার যোগাড়! তবু বেরিয়ে পড়বার উপায় নেই। কারণ আশা ছলনাময়ী। তা ছাড়া বেরোবেই বা কোন লজ্জায়? ও যে আজ অফিস পালিয়েছে সেটা তো আর ঢাক পিটিয়ে লোক-জানাজানি করবার কথা নয়।

অফিস পালানো বলে পালানো, প্রায় ছেলেবেলায় স্কুল পালানোর মতই কাণ্ড করে বসেছে। দাদার সঙ্গে পাশাপাশি বসে ভাত খেয়ে, দাদার সঙ্গে একসঙ্গে বেরিয়ে, দাদার চোখে ধুলো দিয়ে ফিরে এসেছে। ধুলো দেওয়ার সুবিধেও আছে, প্ৰবোধ যায় ট্রামে, সুবোধ যায় শেয়ারের ঘোড়ার গাড়িতে। মোড়ের মাথায় ছাড়াছাড়ি হয়ই।

দাদাকে দেখিয়ে ট্রামে উঠে, একটু পরে টুপ করে নেমে আসে গুটি গুটি বাড়িপানে। এ সময় কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার ভয় কম, কারণ পাড়া ঝেটিয়েই তো সব পুরুষ জাতীয়েরা অফিস ইস্কুলে চলে গেছে। মেয়েমানুষরা তো আর রাস্তায় বেরোচ্ছে না যে দেখে ফেলবে?

তবু যদি কারো বাড়ির ঝি-চাকর কি স্বয়ং খুদুর সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়, কোন কথাটা বলে মান রক্ষা করবে, সেটা তৈরি করেই রেখেছে! বলবে, ওরে বাবারে, পেটের মধ্যেটা এমন মোচড় দিয়ে উঠল, মাঝপথে ফিরে আসতে হল।

না, এর থেকে সভ্য কোনো মিথ্যে কথা বানাতে পারে নি। সুবৰ্ণলতার স্বামী। কিন্তু বিধি তখনও পর্যন্ত তার প্রতি সদয়। তাই কোনো চেনা মুখের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হল না প্ৰবোধচন্দ্ৰকে। অবশ্যি সদর দোর দিয়েও ঢোকে নি সে। কি জানি দৈবদুর্বিপাকে যদি আজই মুক্তকেশী। এত বেলায়?ष्ठाङ्क्षाgনা याনা!

হ্যাঁ, নিত্য গঙ্গাস্নানের পুণ্য অর্জন করে চলেছেন মুক্তকেশী বিধবা হয়ে পর্যন্ত। বিরাজ তখনো নিতান্ত শিশু, তত্ৰাচ মুক্তকেশী বৈধব্য ঘটবার সঙ্গে সঙ্গেই বৈধব্যের সর্ববিধ শুচিতা এবং কঠোরতা পালন করে আসছেন। চুল কেটেছেন, হাত শুধু করেছেন, পান ছেড়েছেন রাত্রে আচমনী খাদ্য ছেড়েছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছেলেদের অফিস পাঠিয়ে মুক্তকেশী ঘটি-গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সে আন্দাজে বেরিয়ে গেছেন, কিন্তু কে বলতে পারে প্রবোধের ভাগ্যেই আজ–

পাশের ওই মেথর আসার গলি দিয়ে ঢুকে পড়লে আর কোনো ভয় নাই। মুক্তকেশী এর ধারেকাছেও উঁকি দেন না কোনোদিন। প্ৰবোধ? সে তো আড়াই পা বাড়ালেই শুদ্ধ। আড়াই পায়ের কসরৎ ছেলেবেলা থেকেই অভ্যাস করা আছে মুক্তকেশীর ছেলেদের।

অতএব প্ৰবোধ নিষ্কন্টকে বাড়ি ঢুকে এদিকে ওদিক তাকিয়ে ঝাঁপ করে ছাতের সিঁড়ি ধরেছে। ধরেছে মানেই মরেছে। সেই বোলা এগারটা থেকে এই বেলা আড়াইটে! চিলেকোঠার এই ঘরটাতেই কি জমাতে হয়। ছাই সংসারের যাবতীয় ওঁচা মাল?

পায়াভাঙা চৌকী, কলাভাঙা তোরঙ্গ, ড্রালাভাঙা হাতবাক্স, এসব ছাড়াও ছেঁড়া মশারি, পুরানো কাঁথা, বাতিল তোশক, ফুটো ঘড়া, কাচফাটা ছবির ফ্ৰেম-কী আছে আর কী নেই! ফেলবার নয়, ফেলবার নয়, এই সব বস্তুর আর গতিই বা কি?

অবশ্য ভবিষ্যতে ওদের আবার টেনেন্টুনে কাজে লাগাবার আশা আছেও কিছু কিছু। যেমন, সময় সুবিধে করে ধুনুরি ডেকে ছেঁড়া তোশক ধুনিয়ে, নতুন একটু খেরো কিনে তোশক বানিয়ে নেওয়া, কাঁথাগুলোর উপর আবার একপ্রস্থ করে কাপড় বসিয়ে গোটাকতক ফোঁড় চালিয়ে নিয়ে কাজ চালানো, বাসনওলা এলে ঘাড়াগুলো বদল দেওয়া, আর বাসনওয়ালী এলে ছেঁড়া মশারি বদলে দুএকখানা পাথরের খোরা, কি কাসার বাটি, নয়তো একটা পেতলের গামলা কি মোটা চিরুনি আর হাত-আয়না কিনে ফেলা!

ফাটা ছবির ফ্রেমেরও সদৃগতি হয় বৈকি! ভাঙা কাঁচেরও খদের আছে। ভরদুপুরে বেরোয় তারা কাচ ভাঙা-কাচ ভাঙা হাঁক পেড়ে। চোর সামলাতে পাঁচিলের মাথায় ভাঙা কাচ পুততে কেনা হয় ওগুলো।

মোটা কথা, গোরস্ত বাড়িতে চাটু করে কিছু ফেলে দেওয়ার কথা ওঠে না। ফেলাছড়ায় মা-লক্ষ্মী বিমুখ হন এ আর কোন গোরস্তর গিন্নী না জানে? অথচ ওই সব কুদর্শন বস্তুগুলো, সময়সাপেক্ষে যাদের সদগতি হবে, তাদের কিছু আর সর্বদা চোখের সামনে বিছিয়ে রাখা যায় না! তাদের জন্যেই চোরকুঠুরি, চিলেকোটা, চালি, সাঙ্গা!

মুক্তকেশী ও গোরস্তর পিানীর পদ্ধতিতেই চিলেকোঠাটাকে বোঝাই করে রেখেছেন। কোনো একদিনও এ ঘরে আর আদরে পুত্ররত্ব পেবো এসে বসে বসে মশার কামড় খাবে আর নিজের গাল নিজে চড়াবে, এ কথা মুক্তকেশীর স্বপ্নের অগোচর।

অথচ সেটাই ঘটছে।

পেবো মশার ছুতোয় নিজের গালে নিজে চড়াচ্ছে, নিজের কান নিজে মুলছে, এবং নেহাৎ মাটিতে শতবর্ষের ধুলো বলে নাক ঘষটে নাকে খৎ দিতে না পারায় মনে মনে সেটা দিচ্ছে শতবার!

ভরসা বলতে, আশ্রয় বলতে ভাঙা এই তক্তপোশটা। সেটাকে প্ৰবোধ ফুঁ দিয়ে দিয়ে আলতো করে কোঁচার আগার ঝাঁপটা মেরে বসবার যোগ্য করে নিয়েছে। সুবৰ্ণলতাকে নিয়ে যদি দুদণ্ড বসতে হয় এখানে বিরহজ্বালা মেটাতে, চৌকির ক্যাচার্ক্যোচ শব্দটা নিয়ে না মুশকিলে পড়তে হয়, এই ভাবনাতেই কাতর ছিল প্রথম দিকে, ক্রমশ সেটা চলে গেছে, এখন শুধু ভাবনা সুবর্ণ এলে কী কী কটু কথায় মনের ঝাল মেটাবে।

কী ভেবেছে সে নিজেকে?

মহারাণী?

তাই তীর্থের কাকের মতন, রাস্তার হ্যাংলা কুকুরের মতন হা-পিত্যেশ করে বসে আছে প্ৰবোধ, যে নাকি সুবর্ণর স্বামী! জগতের সেরা গুরুজন! জাপান থেকে চিরুনি আসে, তাতে পর্যন্ত লেখা থাকে পতি পরম গুরু। তার মানে তাদের দশের মেয়েরাও এ উপদেশ শিরোধাৰ্য করে। আর সুবর্ণ হিন্দুর মেয়ে হয়ে, বাঙালীর মেয়ে হয়ে এই কষ্টটা দিচ্ছে স্বামীকে?

প্ৰবোধ পারে না। অমন পরিবারকে ত্যাগ করে দিতে? একবার যদি মায়ের কাছে মুখের কথাটি খসায় প্ৰবোধ, যদি বলে, তোমার মেজবৌ তোমারই থাক মা, আমার দরকার নেই, আমার জন্যে চিমটে আছে, লোটা আছে, গেরিমাটি আছে— মা দূর দূর করে বিদেয় করে দেবে না। অমন অলক্ষ্মী বৌকে? আর ছেলেকে ঘরবাসী করতে নতুন করে মেয়ে দেখে বিয়ে দেবে না?

ভেবে দেখে না। এসব গরবিনী দেমাকী!

নাকি ভাবে প্ৰবোধের আর বৌ জুটবে না?

পুরুষ বেটা ছেলে, আস্ত চারখানা হাত-পা আছে, তার আবার বৌয়ের অভাব? ত্যাগ দিতেই বা ছুতোর অভাব কি? মস্ত ছুতো তো রয়েইছে।

মা!

মার নামে বদনাম তুললেই তো চুকে গেল।

এতদিন ত্যাগ করা হয় নি কেন? জানতাম না!

ভেতরের কথা জানতাম না। ব্যস!

অদৃশ্য সেই অপরাধিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাকে যথেষ্ট লাঞ্ছনা করতে থাকে প্ৰবোধ, যথেচ্ছ কটুকাটিব্য! করবে না কি করবে, মশার কামড়ে চাকা চাকা হয়ে গেল না। সর্বাঙ্গ? ঘামতে ঘামতে লোনা হয়ে গেল না দেহটা? এত জিনিস আছে। ঘরে, এত জঞ্জাল, একখানা ভাঙা হাতপাখা নেই! যেটা থাকলে নাকি প্ৰাণটা এমন ঠোঁটের আগায় আসত না, আর হয়তো মেজাজ এত সপ্তমে উঠিত না!

কিন্তু নেই।

একখানা ফাটা ছবির কাচ নিয়ে নেড়ে নেড়ে বাতাস খেতে গেল। হতভাগ্য বেচারা, ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল সেটা! লাভের মধ্যে কাচের টুকরোর বিভীষিকা ছড়িয়ে রইল চৌকির উপর।

লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষটা আসুক একবার, আগে এই কাচগুলোর ব্যবস্থা করিয়ে তবে অন্য কাজ।

রাগতে রাগতে হঠাৎ একসময় চোখে জলই এসে যায় প্ৰবোধের। শুধু কী ওই পাজী মেয়েমানুষটা?

নিজের মা তার শত্রু নয়?

গৰ্ভধারিণী মা!

আরো তিনটে ছেলেও তো রয়েছে তার? আর কাউকে কেন্দ্র করে স্বপ্ন দেখতে পারলেন না? এই হতভাগ্য পেবোই তার স্বপ্নে ঠাঁই পেতে গেল!

কেন?

কোন অপরাধে?

মা যদি ওই কিন্তুতকিমাকার স্বপ্নটি দেখে না বসতেন, আজ কি এই দুৰ্গতি ঘটতো প্ৰবোধের? পনের বিশ দিন উপোসী রাত কাটাতে কাটাতে তবেই না এমন মরীয়া হয়ে উঠেছে প্ৰবোধ? বিনিদ্র রজনীতে মা আসেন গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, পাখার বাতাস করতে! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে! সেই নুনের ছিটের জ্বালায় মার পায়ে মাথা খুঁড়ে বলতে ইচ্ছে হয়, মা, তোমার স্নেহ সংবরণ কর মা। মারার ওপর খাঁড়ার ঘা বসিও না।

তা সত্যিই তো বলা যায় না, তাই সব আক্রোশ জমা হয় গিয়ে সেই ঘোমটাধারিণীর ওপর। এদিকে তো ঘোমটার ভেতর খেমটা নাচ, শুধু স্বামীর বেলাতেই যত লজ্জা!

সুবৰ্ণ যদি চালাকি চাতুরী খেলিয়ে একটু অগ্রণী হতো, এক আধবার কি সুযোগ জুটতো না? তা নয়, মহারাণী যেই ঘরে ঢুকলেন, শব্দ করে খিল ঠুকলেন, ব্যস! হয়ে গেল রাত কাবার!

প্রথম যখন শোনা গেল সুবর্ণ একলা শুতে চেয়েছে, বলেছে তার অত ভয় নেই, প্ৰবোধ আশায় কম্পিত হয়েছিল, আহ্লাদে পুলকিত হয়েছিল।

বোঝা গেছে!

মানে বোঝা গেছে!

চালাকের দাড়ি তো!

খেয়াল হয়েছে। ঘরে রাজু-ফাজু থাকলে অসুবিধে, ধরা পড়ে যাবে চোরা অভিসার, তাই!

হায় কপাল, সে আশা মরীচিকা মাত্ৰ!

বসে বসে মজা দেখছে, স্বামীর ছটফটানি যন্ত্রণা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে! নরকেও ঠাঁই হবে এই পাপিষ্ঠার?

হবে না! নরকেও ঠাঁই জুটবে না। ওর!

রাগ বেড়েই চলে। কারণ তদুপরি পেটের মধ্যে অগ্নিদাহ। কোনকালে অফিসের ভাত খেয়ে বেরিয়েছে, কখন সে ভাত হজম হয়ে গেছে, তেষ্টায় ছাতি ফাটছে, এক ফোঁটা জলও পেটে পড়ে নি!

অফিসে থাকলে এতক্ষণে চার-ছখানা হিঙ্গের কচুরী, গোটা আষ্টেক আলুর দম, আধ-পোটাক বোঁদে সেঁটে, গেলাস দুই জল খেয়ে নেওয়া হয়ে যেত, সে জায়গায় এই! পেটের কলকজাগুলো পর্যন্ত বাপান্ত করছে!

আসবে না!

আসবে না পাপীয়সী!

বেরিয়েই পড়তে হবে এবার!

সত্যিই তো আর গুমখুন হতে পারে না প্ৰবোধ?

 

অবস্থা যখন এমনি চরমে, তখন হঠাৎ মৃদুমন্দ হাসির আওয়াজ যেন দরজার ওদিকে চিকমিকিয়ে ওঠে!

খি খি খি খি কৌতুকের হাসি!

তার মানে প্ৰবোধের অবস্থা অনুমান করে আমুদে হাসি হাসছে।

প্ৰবোধ কি দরজা খুলেই ওর গলাটা টিপে ধরবে? নাকি নিষ্ঠুর পাষাণী বলে দু হাতে সাপটে ধরে–

দরজায় টোকা পড়ল।

যেটা আগে থেকে ঠিক ছিল।

প্ৰবোধ খিল বন্ধ করে বসে থাকবে, সুবর্ণ এসে তিনটি টোকা দেবে। কারণ দৈবাৎ যদি অন্য কেউ এসে দোর ঠেলে! তার থেকে সাঙ্কেতিক ব্যবস্থা করে রাখাই ভাল!

টোকা পড়ল।

একবার, দুবার, তিনবার।

কোঁচার কাপড় তুলে মুখ মুছতে মুছতে দরজার খিলটা খুলে দিল প্ৰবোধ, আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে ঠিকরে ফের চৌকির ওপর গিয়ে পড়ল ভয়ঙ্কর একটা আ-আ শব্দে!

শব্দটা একবার ড়ুকরে উঠেই একেবারে পাক খেয়ে দুদ্দাড়িয়ে নিচে নেমে গেল সিঁড়িতে আর্য আ রেশ ছড়িয়ে!

বিরাজ!

বিরাজের ওই রোগ।

ভয় পেলেই আঁ আঁ করে চোখ কপালে তুলে কীর্তিকাণ্ড করে বসে! আর ভয় পায় ও ফি হাত! বিরাজকে ভয় দেখানো এ বাড়ির সকলের একটা পরিচিত খেলা!

প্ৰাণ গেলেও বিরাজ অন্ধকারে দোতলায় সিঁড়িটায় ওঠানামা করে না। ফস করে কারুর ঘরের পিলসুজ থেকে পিদিপটা তুলে নিয়ে এসে সিঁড়ি ওঠে নামে। এমন কি দিনদুপুরেও ভূতের ভয় বিরাজের।

তা বিরাজকে নিয়ে বাড়ির সেই পরিচিত খেলাটাই কি খেলতে বসেছিল সুবর্ণ? বিরাজকে ভয় দেখিয়ে কৌতুক পেতেই তাকে ভুলিয়েভালিয়ে ছাতে তুলেছিল?

নাকি রহস্য-কৌতুকের লক্ষ্যস্থল অন্য?

খেলার উল্লাস আর একজনকে নিয়ে?

তা কৌতুকপ্রিয় সুবর্ণর ভাবভঙ্গীতে কিছু বোঝা যায় নি। খুব নিরীহ গলায় চুপিচুপি বিরাজকে বলে রেখেছিল সে, মা বেরিয়ে গেলে চিলেকোঠায় গিয়ে বাঘবন্ধী খেলবে ছোটঠাকুরঝি?

বাঘবন্দী খেলাটা বিরাজেরই পরম প্রিয়, কারণ অক্ষর পরিচয়ের বালাই তার নেই, দুপুরের অবকাশকে সহনীয় করবার জন্য উপায় জানা নেই। উমাশশীর মত ঘুম মারতেও ওস্তাদ নয় সে।

তাই সুবৰ্ণ যখন দুপুরবেলা চুপিচুপি একখানি বই নিয়ে বসে, বিরাজ বাঘবন্দীর জন্যে পীড়াপীড়ি করে। না খেললে বই পড়ার কথা মাকে বলে দেব বলে শাসায়। সুবৰ্ণকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুঁটি কড়ি নিয়ে বসতে হয়। সে অনিচ্ছা বিরাজের চোখে ধরা পড়ে বৈকি!

কাজেই প্ৰস্তাবটা বিরাজের কাছে প্ৰায় অলৌকিকই লেগেছিল।

তাছাড়া চিলেকোঠার ঘরে।

যেখানে ভরদুপুরে গেলে গা ছমছম করে।

মা চলে গেলে আর চিলেকোঠায় কেন? বিরাজ অবাক হয়, দোতলার ঘরেই তো-

না, মুক্তকেশীর সামনে বৌ মানুষের আমন সময় অপচো করা খেলা চলে না! বৌ অবসর সময়ে সলতে পাকাবে, সুপুরি কাটবে, চালডালের কাঁকর বাছরে, নিদেনপক্ষে কাঁথা সেলাই করবে, এটাই বিধি। কচি ছেলের মা-দের যদি বা ঘুমের কিছুটা ছাড়পত্র থাকে, অন্যদের তো আদৌ না।

ওই সব কাজ না করে বৌ কড়ি ঘুটি চেলে খেলতে বসবে? মা-লক্ষ্মী টিকবেন তাহলে? চার হাত তুলে ধেই ধেই করে বেড়িয়ে যাবেন না?

মুক্তকেশীর অবশ্য গ্রাবুর আসরে বাঁধা বরাদ্দ আছে। শীত গ্ৰীষ্ম বর্ষা, রোদ বৃষ্টি বাজপাত, সব কিছু তুচ্ছ করে দ্বিপ্রাহরিক সেই তাসের আড্ডায় গিয়ে হাজির হন মুক্তকেশী! আবার সেখানে এক স্যাকরা-গিনীর সঙ্গে ছোঁয়াছুয়ি হয়ে যায় বলে এসে স্নানও করেন। কিন্তু মুক্তকেশীর সঙ্গে কার তুলনা?

বাঘের সঙ্গে হরিণের তুলনা সাজে?

সিংহের সঙ্গে খরগোসের?

মুক্তকেশীর সামনে তাই খেলা চলে না। মেয়ের জন্যে মনটা যদি বা একটু দোলে, তবু বৌ নষ্ট তো আর করতে পারেন না মেয়ের মায়ায় পড়ে?

মেয়েকে অনেক খোশামোদ করেন নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে কিন্তু যেতে চায় না বিরাজ। বলে, গিন্নীদের কাছে তো সেই মুখে তালাচাবি দিয়ে বসে থাকা। কথা কইলেই বকবে!

বকবো না তো কি? পরের ঘরে যেতে হবে না? বলে চলে যান মুক্তকেশী পেট-কাপড়ে তাসজোড়াটি বেঁধে নিয়ে। চুখিচুপি শিখিয়ে দিয়ে যান, দুপুরভোর যেন গাল-গল্প করে মেজবৌমার কাজ কামাই করিয়ে দিসনে।

খেলার আকর্ষণ তাই পুরোদমেই আছে। কিন্তু মুক্তকেশীর অসাক্ষাতে চিলেকোঠায় কেন?

সুবৰ্ণ বলে, আছে। মজা! গেলেই দেখতে পাবে।

বলই না ছাই! কুলের আচার সরিয়ে জমা করে রেখে এসেছ বুঝি?

উঁহুঁ!

তবে?

বলবো কেন? বলছি তো গেলেই দেখতে পাবে।

বলই না বাবা!

বললে মজা থাকবে না।

বুঝেছি ঝালমুড়ি মেখে রেখে এসেছি।

সুবৰ্ণ কৌতুকে ফেটে বলে, ধরে নাও তাই।

সুবৰ্ণর ওই কৌতুকে ফাটা মুখ দেখে ৰিরাজও স্পন্দিত হয়।

না জানি কি!

অবশ্য সেই থেকে আরো অনেকবার প্রশ্ন করে করে অস্থির করেছে বিরাজ, কিন্তু একা একবার ছুটে গিয়ে দেখে আসবে, সে সাহস হয় নি।

অথচ শত সাধ্যসাধনাতেও সুবর্ণ মজা ফাঁস করে নি।

নিচের সংসারের পাঠ যখন শেষ হল, সুবর্ণ বলে, চল এইবার! মল জোড়াটা খুলে পা টিপে টিপে চল।

ওমা কেন?

বিরাজ ভয়ে আতকে ওঠে, মল খুলবো কেন?

আছে। মজা! আমিও খুলছি।

আমার বাপু বড্ড ভয়-ভয় করছে!

ভয় আবার কি? বল না, ভূত আমার পুত শাঁকচুন্নি আমার ঝি, রামলক্ষ্মণ বুকে আছেন ভয়টা আমার কি?

অদ্ভুত কিছু একটা কৌতুকের আশায় অগত্যাই ওই মন্ত্রটা জপ করতে করতে সুবর্ণর সঙ্গে সঙ্গে ছাতে ওঠে বিরাজ।

তারপর?

তারপর সুবর্ণ বলে, আস্তে দরজায় তিনটে টোকা দে!

ও বাবা কেন?

দে না! দেখবি স্বপ্নে যা ভাবিস নি। তাই দেখতে পাবি!

তুমি আমায় ভূতে খাওয়াতে চাও নাকি, বল তো?

সুবৰ্ণ এবার উদার হয়, বেশ, সে সন্দ যদি হয়ে থাকে তোমার তো দিও না টোকা! এতদিন আমাকে দেখেশুনে এত অবিশ্বাস আমার ওপর?

বিরাজ লজ্জিত হয়।

স্বভাবদোষে আর শিক্ষার দোষে সব কথা মার কাছে লাগিয়ে দেওয়ার অভ্যাস থাকলেও মেজবৌদি তার কাছে আকর্ষণীয়। মেজবৌদির কাছে চুল বাধতে সুখ, মেজবৌদির কাছে সাজতে সুখ, মেজবৌদির সঙ্গে খেলতে, গল্প করতে সুখ। মেজবৌদির অভিমানে তাই নরম হয় সে।

বলে, বেশ বাবা বেশ, দিচ্ছি টোকা, বাঁচি বাঁচবো মারি মরবো!

সুবৰ্ণ হেসে ওঠে খি খি করে।

তারপর টোকা!

তারপর খিল খোলার শব্দ!

সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের অতীত সেই দৃশ্য!

যে মেজদা ভাত খেয়ে অফিস চলে গেছে, সেই মেজদা খিল খুলে দিল ছাতের দরজার।

কিন্তু সত্যিই কি মেজদা?

ওই কি মেজদার মুখ?

অমনি ভয়ঙ্কর?

আমন বীভৎস?

হ্যাঁ, প্রায় অজ্ঞান হয়েই পড়েছিল বিরাজ, আর এই কৌতুকের জন্যে তাই অনেক খেসারৎ দিতে হয়েছিল সুবৰ্ণকে।

মুক্তকেশীর মেয়েকে অজ্ঞান করার অপরাধে, মুক্তকেশীর ছেলেকে লাঞ্ছনা করার অপরাধে! আবার শুধু মৌখিক তিরস্কারই নয়, দৈহিক শাস্তিও পেতে হয়েছিল। লাঞ্ছিত অপমানিত স্বামীর কাছ হতে!

সুবৰ্ণর কৌতুকম্পৃহার অধ্যায়ে একটা বড় ছেদ পড়েছিল সেদিন থেকে।

তবু স্বভাব যায় না মলে! আবার একদিন ননদাইকে নিয়ে রঙ্গ করতে গিয়ে-তা সে তো পরে।

সুবৰ্ণদের দর্জিপাড়ার নিজেদের বাড়িতে।

যে বাড়িতে সিঁড়ির অভাবে ছাতে ওঠা যায় না। টাকার অভাবে সারা জীবন সিঁড়ি হল না। যার।

কিন্তু শুধু কি টাকার অভাবে?

প্ৰয়োজন বোধের অভাবেও কি নয়?

সুবৰ্ণ ছাড়া আর কেউ ছাতে উঠতে না পাওয়াটা মস্ত একটা লোকসান ভাবে নি। সে বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *