হেমনাথের নৌকো ধানবনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলে স্নেহলতা বললেন, ঘরে এস মানিকেরা– বলে পা বাড়িয়ে দিলেন।
স্নেহলতার পিছু পিছু সবাই সামনের পুবদুয়ারী বড় ঘরখানায় এল। ঘাড় ফিরিয়ে বিনু একবার দেখে নিল, হিরণ যুগল আর করিম ফিটন থেকে মালপত্র নামিয়ে ওদিকের একটা ঘরে নিয়ে রাখছে।
স্নেহলতার গলা আবার শোনা গেল, এখন আর কোনও কথা না, উঠোনে জল দেওয়া আছে। হাত-পা ধুয়ে আগে কিছু খেয়ে নাও। ধনেদের মুখ খিদেয় একবারে শুকিয়ে গেছে।
খানিক আগে আরেক বার ধন’ বলেছিলেন স্নেহলতা, এবারও বললেন। কথায় কথায় ওই শব্দটা বলা বোধহয় তার অভ্যাস। ফিক করে এবারও বিনু হেসে ফেলল।
হাসিটা কানে গিয়েছিল। স্নেহলতা শুধোলেন, হাসলি যে দাদা?
বিনু লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
সুরমা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, তুমি ধন’ বলেছ মামী, সেই জন্যে।
স্নেহলতা সস্নেহে হাসলেন। বললেন, শুধু ধন নাকি, আরও কত কি বলি দেখ না। তখন কত হাসতে পার, দেখব।
একটু পর হাত মুখ ধুয়ে এসে সবাই খেতে বসল। অবনীমোহন সুধা সুনীতি বিনু এবং সেই পুতুল পুতুল মেয়েটা–ঝিনুক। ফিটন থেকে বাক্স-টাক্স নামানো হয়ে গিয়েছিল। হিরণকে ডেকে এনে বসিয়ে দিলেন স্নেহলতা। সুরমা অবশ্য বসলেন না।
অবনীমোহন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সকাল থেকে কিছুই তো খাওনি, তুমিও বসে পড়।
কলকাতায় স্বামী এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেতে বসে যান সুরমা। খাবার দাবার মাঝখানে সাজানো থাকে। দরকারমতো সবাই চামচে করে তুলে নেয়। কলকাতার রীতি আলাদা। কিন্তু এখানে কেউ কিছু ভাবতে পারে। কলকাতা থেকে অনেক দূরে এই ছোট্ট রক্ষণশীল জগতে স্বামীর সঙ্গে খেতে বসা নিন্দনীয়।
অবনীমোহন যে এভাবে ডেকে বসবেন, সুরমার পক্ষে তা ছিল অভাবনীয়। তিনি লজ্জা পেয়ে গেলেন।
স্নেহলতাও বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই বসে পড়।
মৃদু স্বরে সুরমা বললেন, আমি পরে খাব’খন।
অবনীমোহন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, পরে টরে না। অসুস্থ শরীর, ডাক্তার না তোমায় বলে দিয়েছে। সকালবেলা সাতটার ভেতর খেয়ে নিতে। অনিয়ম করলে–
বিব্রত সুরমা চাপা গলায় ধমক দিলেন, আমার জন্যে ভাবতে হবে না। তুমি খেয়ে নাও তো।
অবনীমোহন আর কিছু বললেন না।
স্নেহলতা এবং শিবানী ফুলকাটা কঁসার থালায় পাতলা চিঁড়ে কদমা গুড় আর পাতক্ষীর সাজিয়ে সবাইকে দিতে লাগলেন। বড় বড় জামবাটি ভর্তি করে ঘন আঠালো দুধও দিলেন।
খেতে খেতে হঠাৎ হিরণ বলল, কি ঠাকুমা, ঠকাবার মতলব নাকি?
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন স্নেহলতা, ঠকাব!
হুঁ– হিরণ ঘাড় কাত করল, গাড়ি থেকে রসগোল্লার হাঁড়ি আর কলার কাদি নামিয়ে তোমার হাতে দিলাম না? সে সব কোথায়?
তাই তো– তাড়াতাড়ি জিভ কেটে স্নেহলতা উঠে পড়লেন। ছুটে গিয়ে ওধারের কোনও একটা ঘর থেকে রসগোল্লা আর কলা নিয়ে এসে সবার পাতে পাতে দিতে লাগলেন।
বড়দের চারটে করে রসগোল্লা আর দু’টো করে কলা দিয়েছেন স্নেহলতা। বিনুকে দিয়েছেন দুটো রসগোল্লা আর একটা কলা, ঝিনুকের ভাগে পড়েছে আরও কম–কলা আধখানা, রসগোল্লা একটা।
বিনুর ঠিক পাশেই ঝিনুক খেতে বসেছিল। আড়ে আড়ে একবার বিনুর পাতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল সে, আমি আধখানা কলা খাব না, একটা রসগোল্লা খাব না।
স্নেহলতা শুধোলেন, ক’টা খাবি?
গোটা কলা খাব, দুটো রসগোল্লা খাব–
তোর পেট ভাল না ঝিনুক, সহ্য করতে পারবি না। নিজেও কষ্ট পাবি, আমাকেও জ্বালিয়ে মারবি।
হাত-পা ছোঁড়া থামায় নি ঝিনুক। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলতে লাগল, ওকে কেন দিলে তা হলে? কেন দিলে ওকে?
স্নেহলতা অবাক, কাকে রে, কাকে?
আঙুল দিয়ে বিনুকে দেখিয়ে দিল ঝিনুক, ওকে।
পেট ভর্তি তোমার বিষ, ছেলেটা বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই হিংসে আরম্ভ করে দিয়েছ!
সুরমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, দাও মামী, ঝিনুক যা চাইছে দাও–
স্নেহলতা বললেন, তুই কি ওকে মেরে ফেলতে বলিস রমু?
তার মানে!
পরশু দিন ওর বাপ এখানে দিয়ে গেছে। আসা থেকে খালি খাচ্ছেই, খাচ্ছেই। কাল সারারাত পেটের ব্যথায় ঘুমোতে পারে নি, আমাদেরও ঘুমোতে দেয় নি। খাওয়ায় একটু টান না দিলে বুঝলি না, পরের দায়িত্ব
স্নেহের সুরে সুরমা বললেন, ছেলেমানুষ, বায়না করছে। এখন তো দাও, পরে না হয় দিও না।
কী আর করা, ঝিনুকের দাবি অনুযায়ী রসগোল্লা আর কলা তার পাতে তুলে দিতে হল।
একটু নীরবতা।
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যেতে সুরমা বললেন, আচ্ছা মামী—
কী বলছিস? মুখ ফিরিয়ে স্নেহলতা সাড়া দিলেন।
ঝিনুকের বাবা ওকে তোমার কাছে দিয়ে গেছে, বললে না?
হ্যাঁ।
কেন?
ওর মা’কে নিয়ে ওর বাপ ঢাকায় গেছে।
ঢাকায় কী?
ঝিনুকের মামাবাড়ি।
সুরমা অবাক। বিস্ময়ের সুরে বললেন, মামাবাড়িতে গেল, মেয়েটাকে নিয়ে গেল না?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন স্নেহলতা। বিষণ্ণ সুরে বললেন, না।
কেন?
কী যেন ভর করে বসল স্নেহলতার ওপর। নিজের অজ্ঞাতসারেই বুঝিবা ফিসফিসিয়ে বললেন, ওর বাপ চিরকালের মতো ওর মাকে রেখে আসতে গেছে।
সে কী!
যা, বড় অশান্তি হচ্ছিল বাড়িতে। তার চাইতে এই ভাল হয়েছে–
অবনীমোহন সুধা সুনীতি সবাই চকিত হয়ে ঝিনুকের দিকে তাকাল। যে মেয়ে খাওয়া নিয়ে এত বায়না করছিল, এখন আর সে খাচ্ছে না। ঝিনুকের চোখের তারা স্থির, টসটস করছে। পলকহীন সে স্নেহলতার দিকে তাকিয়ে আছে। লাল টুকটুকে পাতলা ঠোঁট দুটো থরথর করছে তার।
সুরমা বললেন, তোমার কাছে তো রেখে গেছে। ওদের বাড়িতে আর কেউ নেই?
না। কাকা জ্যাঠা ঠাকুমা ঠাকুরদা, কেউ না থাকার ভেতর বাপ-মা আর ওই একটা মাত্র মেয়ে। তাও–
এই সময় হিরণ ডেকে উঠল, ঠাকুমা—
হিরণের স্বরে এমন কিছু ছিল, স্নেহলতা চমকে উঠলেন।
খুব চাপা গলায় হিরণ আবার বলল, ঝিনুকের সামনে এ সব কথা বল কেন? বুঝবার মতো বয়েস ওর হয়েছে। মুখচোখের চেহারা দেখছ মেয়েটার?
চকিতে একবার ঝিনুককে দেখে নিয়ে স্নেহলতা বললেন, আমারই অন্যায় হয়ে গেছে। থাক, ওসব কথা থাক–
সবার চোখ ঝিনুকের দিকে। বিনুও তাকে দেখছিল। দেখতে দেখতে দাদুর কথাগুলো মনে পড়েছিল। স্টিমারঘাটে দাদু বলেছিলেন, ঝিনুক খুব দুঃখী।
এরপর আর কোনও কথা হল না। একসময় নিঃশব্দে খাওয়ার পালা চুকল।
.
পুবদুয়ারী সেই প্রকান্ড ঘরখানার একধারে তক্তপোশ পাতা। ইতস্তত দু’চারখানা চেয়ারও ছড়িয়ে আছে। খাওয়াদাওয়ার পর অবনীমোহন সুধা আর হিরণ এখানেই আসর বসালেন। সুনীতি আর সুরমা স্নেহলতা শিবানীর সঙ্গে ভেতর দিকে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ঝিনুকও তাদের সঙ্গে গেল। সুরমা এখনও খান নি। রান্নাঘরে মামী আর মাসির সঙ্গে কথা বলতে বলতে খাবেন। বিনু হিরণদের কাছেই থেকে গেল।
অবনীমোহন সুধা আর হিরণ গল্প জুড়ে দিল। নিমেষে মশগুলও হয়ে গেল। অবনীমোহন আর সুধা পূর্ব বাংলার এই ভূখণ্ডটি সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন করছে। বিপুল উৎসাহে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে হিরণ।
কিছুক্ষণ বসে বসে তাদের কথা শুনল বিনু, তারপর দূরমনস্কের মতো জানালার বাইরে তাকাল। এখান থেকে আদিগন্ত সেই ধানবন চোখে পড়ছে, আর দেখা যাচ্ছে আশ্বিনের টলোমলো, অথৈ, অগাধ জল। আকাশের একটা টুকরোও দৃষ্টিতে ধরা দিয়েছে। সারা বর্ষা বৃষ্টিতে ধুয়ে ধুয়ে আকাশ এখন আশ্চর্য নীল। সেখানে কেউ ভারহীন সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে রেখেছে। দূর আকাশ, অফুরন্ত জল আর শরতের মেঘদল যেন অবিরাম হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে।
আড়ে আড়ে একবার হিরণদের আসরটা দেখে নিল বিনু, সবাই বিভোর হয়ে আছে। সুযোগটা হাতছাড়া কারা সমীচীন নয়। পায়ে পায়ে সুধাদের অলক্ষ্যে বেরিয়ে পড়ল সে।
শালিকের মতো চঞ্চল পায়ে কিছুক্ষণ উঠোনে ঘুরল বিনু। দোলমঞ্চ দেখল, রাসমঞ্চ দেখল, পালা-সাজানো খড়ের স্থূপ দেখল। আর দেখল সারি সারি ধানের ডোল (গোলা)। ফিটন দুটো এখন আর নেই, তারা বোধহয় চলে গেছে। একটু পর কিসের একটা স্রোত তাকে একটানে বাইরের বাগানটার দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
খানিক আগে এখান দিয়েই এসেছিল বিনু। জায়গাটা তার চেনা। চারদিকে আমগাছ জামগাছ লিচুগাছ কামরাঙা গাছ-সব এক পায়ে দাঁড়িয়ে। বাগানটা ছায়াচ্ছন্ন। মাটি নরম, ভিজে ভিজে। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে পাখিদের চেঁচামেচি আর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ। ভিজে মাটির গন্ধ, দূর ধানখেতের গন্ধ, ফুলের গন্ধ–সমস্ত একাকার হয়ে যেন ঘুম ঘনিয়ে আনে।
গাছপালার পাশ দিয়ে, লতাপাতার ধার দিয়ে, ঝোঁপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে নেশাগ্রস্তের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল বিনু। কতক্ষণ ঘুরেছিল, মনে নেই। একসময় কার ডাক কানে ভেসে এল।
চমকে সামনের দিকে তাকাল বিনু, কাউকে দেখতে পেল না।
আবার ডাকটা শোনা গেল, ছুটোবাবু—ছুটোবাবু—
এদিকে সেদিকে তাকাতে তাকাতে এবার বিনুর চোখে পড়ল। পচা পাটের স্তূপের ভেতর সেই লোকটা বসে আছে। তোক না বলে তাকে ছোকরা বলাই উচিত।
ফিটনে করে আসার সময় ওইখানেই দু’জনকে কী করতে দেখেছিল বিনু, পরে টানাটানি করে তাদের মালপত্র নামাতে দেখেছে, নামও জেনেছে। একজনের নাম যুগল, অন্য জনের নাম করিম। তবে কে যুগল কে করিম, জানা যায় নি।
যুগল হোক করিম হোক, এখন একজনই বসে বসে পচা পাটের গা থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছে। আরেকজনকে দেখা গেল না।
চোখাচোখি হতেই সে হাতছানি দিল। পায়ে পায়ে বিনু কাছে এগিয়ে এল। বলল, ডাকছ কেন?
ছোকরার বয়স কুড়ি একুশের মধ্যে। চওড়া হাড়, মোটা মোটা আঙুল, প্রকাণ্ড বুক, সরু কোমর সবই তার বলশালিতার প্রতীক। গায়ের রং রোদে পুড়ে পুড়ে তামাটে। চুলগুলো খাড়া খাড়া, দুর্বিনীত। তেলে-জলে অথবা চিরুনিতে কোনওদিন তাদের বশ মানানো যাবে, তা যেন নেহাতই দূরাশা। পরনে ভিজে সপসপে এক টুকরো টেনি, কোমরের কাছটায় কোনওরকমে জড়ানো। এছাড়া আর কিছুই নেই। বড় বড় ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ সরলতায় মাখা।
দু’পাটির সবগুলো দাঁত মেলে দিয়ে হাসল ছোকরা। বলল, আপনেরা কইলকাতা থিকা (থেকে) আইলেন?
স্টিমারে আসতে আসতে বাংলাদেশের এ প্রান্তের আঞ্চলিক ভাষা শুনেছে বিনু, বিচিত্র উচ্চারণগুলি লক্ষ করেছে। যা শুনেছে তার সিকিও বোঝে নি। তবে সব মিলিয়ে তার খুব মজা লেগেছে, ভালও লেগেছে। সেটা খুব সম্ভব নতুনত্বের জন্য, বৈচিত্রের জন্য।
ছোকরা যা বলল, প্রথমটা বুঝতে পারল না বিনু। অনেকটা অনুমানের ওপর ভরসা করে বলল, কলকাতার কথা বলছ?
হ। ছোকরা মাথা নাড়ল, কইলকাতা মেলা (অনেক) দুরে, না?
এবার বুঝতে পারল বিনু। বলল, হ্যাঁ।
কয়দিন লাগে যাইতে?
মনে মনে হিসেব করে বিনু বলল, দেড় দিনের মতো।
যাইতে হইলে ইস্টিমারে চড়ন লাগে?
হ্যাঁ।
রেলগাড়িতে?
হ্যাঁ। ছোকরার চোখ চকচক করতে লাগল, জানেন আমি কুনোদিন রেলগাড়ি দেখি নাই।
করুণাই হল বিনুর। বলল, রেলগাড়ি দেখ নি! কেন, তোমাদের এখানে রেলগাড়ি নেই?
না। আছে হেই ঢাকার শহরে। অমি কুনোদিন ঢাকায় যাই নাই।
একটু চুপচাপ। তারপর ছোকরা আবার শুরু করল, আইচ্ছা ছুটোবাবু—
কী বলছ?
কইলকাতা তো পেল্লায় শহর, না?
এবারও আন্দাজে বুঝে নিল বিনু। বলল, হ্যাঁ।
কত বড় কন দেখি। ছোকরা সাগ্রহে শুধলো, আমাগো রাইজদা আপনে দেখছেন?
রাইজদা অর্থাৎ রাজদিয়া। বিনু বলল, সবটা দেখি নি। আসতে আসতে যেটুকু চোখে পড়েছে, দেখেছি।
ছোকরা বলল, এই ধারে আর কতটুক! উইধারে এইর ডাবল, তিন ডাবল। আইচ্ছা, কয়খান রাইজদা একলগে করলে একখান কইলকাতা হয়?
নাক কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সুরে বিনু বলল, হাজার হাজার।
চোখ দুটো গোল হয়ে গেল ছোকরার। অবাক বিস্ময়ে বলল, ক’ন কী!
ছোকরা আপনি’ আপনি’ করছে। এত মর্যাদা দিয়ে আগে আর কেউ তার সঙ্গে কথা বলে নি। মনে মনে নিজেকে রীতিমতো বিশিষ্ট আর সম্মানিত মনে হচ্ছে। বিনু বলল, একবার গিয়ে দেখে এস না।
কইলকাতা যাওনের সাইদ্য কি আমাগো আছে? মুখখানা ভারি বিমর্ষ হয়ে গেল ছোকরার।
বিনু এবার কিছু বলল না।
ছোকরা আবার বলে, কইলকাতায় মেলা গাড়ি ঘুড়া না?
বিনু বলল, অনেক।
মেলা মানুষ। শুনছি মাইনষের মাথা মাইনষে খায়। রাস্তাগুলান নিকি দিনরাইত ঘইষা মাইজা ঝকঝইকা কইরা রাখে। এতটুক ধুলা কুনোখানে পইড়া নাই। রাইতগুলি নিকি বাত্তিতে বাক্তিতে (আলোয় আলোয়) দিন হইয়া যায়। সত্য ছুটোবাবু?
পূর্ব বাংলার সুদূর অভ্যন্তরে এই রাজদিয়াতে একটি গ্রাম্য যুবকের কল্পলোকে কলকাতা স্বর্গ হয়ে আছে। তার কল্পনা কতদূর আর পৌঁছুতে পারে! সগর্বে বিনু তার চাইতে হাজার গুণ চমকপ্রদ আর বিস্ময়কর এক কলকাতার এমন বর্ণনা দিল যাতে ছোকরা একেবারে হাঁ হয়ে গেল।
বিস্ময়ের ঘোর কিছুটা কমে এলে ছোকরা বলল, আহা রে, অ্যামন দ্যাশ চৌখে দেখতে পাইলাম না! মনিষ্য জনমই ব্রেথা।
হঠাৎ বিনুর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, তখন তোমরা দুজন এখানে কাজ করছিলে না?
হ। আমি আর করিমা।
করিমা অর্থে করিম। বিনু বলল, তোমার নাম তা হলে যুগল?
ছোকরা অবাক হয়ে বলল, আমার নাম ক্যামনে জানলেন ছুটোবাবু?
তখন ঘোড়ার গাড়ি থেকে তোমরা বাক্স-টাক্স নামাচ্ছিলে, কে যেন তোমাদের নাম ধরে ডাকছিল। তাই শুনে জেনেছি।
যুগল বলল, অ।
বিনু শুধলো, করিমকে তো দেখছি না।
অগো (ওদের) বাড়িত্ গ্যাছে। দুফারে আইব।
একটু ভেবে বিনু কী বলতে যাবে, সেই সময় হঠাৎ ঘুরে পুকুরের দিকে তাকাল যুগল। দেখেই বোঝা যায়, তার চোখমুখ এবং স্নায়ুমণ্ডলী প্রখর হয়ে উঠেছে। স্থির দৃষ্টিতে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকল যুগল। তারপর আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে উধ্বশ্বাসে সেদিকে ছুটল।
বিনু জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? অমন করে ছুটছ কেন?
যুগলের উত্তর দেবার সময় নেই, সে ফিরেও তাকাল না। ছুটতে ছুটতে ঝপাং করে পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছু পিছু বিনুও ছুটে এসেছিল, ঘাটের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
ফিটনে আসতে আসতে মনে হয়েছিল পুকুরের ওপারে শুধু ধানবন। কাছাকাছি আসতে বিনু দেখতে পেল, তার তিন দিকেই ধানের খেত। প্রকাণ্ড মাছের মতো জল কেটে কেটে কোনাকুনি পুকুর পাড়ি দিয়ে নিমেষে ওপারে চলে গেল যুগল। তারপর ধানখেতের ভেতর ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ কোথায় অদৃশ্য হয়ে রইল।
ভয়ে বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল বিনুর। যুগল ডুবে গেল নাকি? যদি আর সে জলের তলা থেকে না ওঠে আসে! বিনু একবার ভাবল, ধানখেতে গিয়ে যুগলকে খুঁজে বার করে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল, সে সাঁতার জানে না। সঙ্গে সঙ্গে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
ত্রাসে আর উদ্বেগে কতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ হয়ে ছিল, মনে নেই। একসময় ধানখেতের ফাঁকে যুগলের মাথা ভেসে উঠল। তাকে দেখতে পেয়ে আস্তে আস্তে ভয়টা কাটল বিনুর। না, ডুবে যায় নি। অনেকক্ষণ পর জোরে জোরে বুকের ভেতর শ্বাস টানতে লাগল সে।
বিনু একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। দেখতে পেল, ধানখেত থেকে কী একটা যেন বুকের কাছে আটকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে যুগল। একটু পর পুকুর পেরিয়ে পাড়ে এসে উঠল সে, তারপর জল থেকে মস্ত বড় গোলাকার খাঁচার মতো একটা জিনিস তুলে আনল। সরু সরু কাঠি ফাঁক ফাঁক করে তার দিয়ে বেঁধে খাঁচাটা তৈরি। এমন জিনিস আগে আর কখনও দেখে নি বিনু। সে জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
যুগল বলল, চাই।
কী হয় এটা দিয়ে?
ভিতরে তাকাইয়া দ্যাখেন ছুটোবাবু।
প্রথমটা লক্ষ করে নি বিনু। যুগলের কথামতো তাকাতেই খুশিতে তার চোখ চকচকিয়ে উঠল। ‘চাই’-য়ের ভেতরটা মাছে বোঝাই, বোদ লেগে রুপোলি আঁশগুলো ঝলকে উঠছে।
বিনু প্রায় লাফ দিয়েই উঠল, ইস, কত মাছ!
এই মাছ দেইখ্যাই কন কত মাছ! আইতেন বষাকালে, দেখতেন মাছ কারে কয়! বলতে বলতে কী এক কৌশলে চাই’-য়ের পেছন দিকটা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে মাছগুলো ঝুপ ঝুপ করে মাটিতে পড়ে লাফাতে লাগল। নানা রকমের মাছ। বেশির ভাগই বিনুর চেনা। রুই, কালবোস, বড় বড় সরপুঁটি, গোলসা ট্যাংরা আর বেলে–এগুলো চিনতে পারল সে। বাদ বাকি অচেনা।
মাছ বার করা হয়ে গিয়েছিল। যুগল বলল, ছুটোবাবু আপনে ইট্ট (একটু) মাছগুলার কাছে। খাড়ন, দেইখেন চিলে আর কাউয়ায় (কাকে) আবার তুইলা নিয়া না যায়।
বিনু জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যাবে?
ধানখ্যাতে, চাইটা আবার পাইতা রাইখা আসি। মাছধরা ফাঁদের পেছন দিকটা তাড়াতাড়ি আটকে দিয়ে জলে গিয়ে নামল যুগল। নিমেষে ধানবনে সেটা রেখে ফিরে এল। তারপর যেখানে পচা পাট স্থূপাকার হয়ে আছে সেখান থেকে একটা বড় গামছা এনে মাছগুলো বেঁধে উঠে দাঁড়াল। বলল, চলেন ছুটোবাবু–
কোথায়?
মাছগুলা ভিরে দিয়া আসি।
দু’জনে বাড়ির দিকে চলতে লাগল।
বিনু মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, ইত্যাদি কর্মকুশলতায় যুগল তাকে জয় করে নিয়েছে।
পাশ থেকে যুগলকে একবার দেখে নিয়ে বিনু বলল, তুমি তো খুব সাঁতার কাটতে পার!
হ– মাথাটা অনেকখানি হেলিয়ে যুগল বলল, তা পারি। আমারে পুকৈর পার হইতে দেখলেন তো?
হ্যাঁ।
এইরকম তিনটা পুকৈর আমি এক ডুবে পার হইয়া যাইতে পারি। ইস্টিমারে কইরা যে গাং দিয়া আইলেন
হ্যাঁ—
সাতইরা (সাঁতরে) উই গাংটা যে কতবার এপার-ওপার করছি, হিসাব নাই ছুটোবাবু।
আগে মুগ্ধ হয়েছিল, এবার একেবারে ভক্তই হয়ে পড়ল বিনু। তোষামোদের সুরে বলল, আমাকে একটু সাঁতার শিখিয়ে দেবে?
চলতে চলতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল যুগল। বিস্ময়ে তার চোখ গোলকার হয়ে গেছে। সাঁতার জানে না, এমন মানুষ জীবনে এই বোধহয় প্রথম দেখল সে। বলল, আপনে সাতর জানেন না ছুটোবাবু!
চোখ নামিয়ে বিনু খুব আস্তে করে বলল, না। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিল না সে।
কলকাতায় থাকে বলে বিনুর খুব গর্ব। তার ধারণা, পৃথিবীর সব কিছু জেনে বসে আছে। কিন্তু একটি পেঁয়ো যুবকের কাছে যে পরাজয় মানতে হবে তা কে জানতো?
আবার হাঁটতে শুরু করল যুগল। আমাগো এইহানে কুলের (কোলের) পুলাটাও (ছেলেটাও) সাতর দিতে পারে। ডর নাই, দুই চাইর দিনের ভিতর সাতর শিখাইয়া, মাছ ধরা শিখাইয়া আপনেরে চালাক কইরা দিমু।
বিনু গম্ভীর হয়ে গেল। যুগলের কাছ থেকে চালাক হবার পাঠ নিতে হবে, এতখানি মেনে নিতে সে রাজি না। বলল, আমি বোকা না।
যুগল বলল, হে তো জানিই ছুটোবাবু–
একটু পর তারা ভেতর-বাড়িতে এসে পড়ল। যুগল ডাকল, ঠাউরমা, ইট্টু বাইরে আসেন দেখি—
রান্নাঘর থেকে স্নেহলতা বেরিয়ে এলেন। তার পিছু পিছু শিবানী সুরমা সুনীতি আর ঝিনুকও এল।
ততক্ষণে গামছা খুলে মাছগুলো ঢেলে ফেলেছে যুগল। সুনীতি সবিস্ময়ে বলল, এত মাছ কোথায় পেলে!
সবগুলো দাঁত বার করে হাসল যুগল, ধরলাম।
বিপুল উৎসাহে হাত-পা নেড়ে যুগলের মাছ ধরার পদ্ধতি বর্ণনা করতে লাগল বিনু।
স্নেহলতা সস্নেহ ভৎর্সনার সুরে বললেন, একেবারে মেছো রাশি। দিনরাত খালি মাছই ধরছে। আর ধরতেও পারে। মাছ যেন ওর গায়ে লেগে উঠে আসে।
মাছ দেখে সুরমা খুব খুশি। বললেন, ছেলেটা কে গো মামী?
স্নেহলতা সংক্ষেপে পরিচয় দিলেন। এখান থেকে মাইল বিশেক দূরে পাকসি বলে ভূঁইমালীদের একটা গ্রাম আছে। যুগলদের বাড়ি সেইখানে। তবে বাড়ির সঙ্গে, বাপ-মা ভাই-বোনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই হয়। দশ বছর বয়সে হেমনাথ তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে যুগল এ বাড়িরই ছেলে, কৃচিৎ কখনও নিজেদের বাড়ি যায়। এবেলা যায় তো, ওবেলা ফিরে আসে। এখানে থেকে থেকে বাপ-মা’র কাছে গিয়ে ওর মনই বসে না।
উঠোনে মাছগুলো লাফালাফি করছে। ওঘর থেকে সুধা দেখতে পেয়েছিল, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল। চোখ বড় করে বলল, কত মাছ রে!
একটু পর অবনীমোহন আর হিরণও এল। মাছ দেখে সবাই বেজায় খুশি। জল-বাংলার রুপোলি ফসল সকলকে উচ্ছ্বসিত করে তুলেছে।
স্নেহলতা যুগলের দিকে ফিরে বললেন, দিনরাত তো মাছরাঙার মতো মাছের পেছনে লেগে রয়েছ। পাট তোলা হয়েছে?
যুগল একগাল হেসে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, না।
উনি কেতুগঞ্জ থেকে এসে যদি দেখেন পাটের মনে পাট পড়ে আছে, মাছ খাওয়াবে’খন।
ঠাউরদা আসনের আগেই পাট তুইলা ফেলামু। বলেই দৌড় লাগাল যুগল। উঠোনের আধাআধি গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বিনুকে ডাকল, আসবেন নিকি ছুটোবাবু?
যুগলের সঙ্গ মোটামুটি ভালই লাগছিল। বিনু এগিয়ে গেল।
অবনীমোহন বললেন, দু’জনের বেশ ভাব হয়ে গেছে দেখছি।
সুরমা হাসলেন, তাই তো মনে হচ্ছে। মাছ ধরার কায়দা দেখিয়ে যুগল বিনুকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
বার-বাড়ির সেই বাগানে এসে পচা পাটের স্তূপের ভেতর বসে পড়ল যুগল। একটু দূরে একটা গাছের মোটা শিকড়ের ওপর বসল বিনু।
হাতের কৌশলে অতি দ্রুত পচা পাট থেকে আঁশ আর শোলা বার করে দু’ধারে রাখতে লাগল যুগল। সেই সঙ্গে চলল গল্প।
জাদুকর যেমন ঋপির ভেতর থেকে একের পর এক অচেনা বিস্ময় তুলে এনে চমকে দেয়, তেমনি কথায় কথায় নিজের তাবৎ গুণ জাহির করতে লাগল যুগল। বিনা পালে শুধু একখানা বৈঠার ভরসায় নৌকো নিয়ে বর্ষার নদী পেরিয়ে যেতে পারে, রাতের পর রাত কৃষ্ণলীলা আর রয়ানির আসরে গান গেয়েও তার গলা ভাঙে না। ইত্যাদি।
যত শুনছিল ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিল বিনু। গানের কথায় বিস্ময়টা তার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছল। বলল, তুমি গাইতেও পার!
না পারি কী? হগলই পারি। যুগল বলতে লাগল, আমার গীত শুনলে মাইনষে মোহিত হইয়া যায়।
তাই নাকি?
আশ্বাসের সুরে যুগল বলল, শুনামু ছুটোবাবু, আপনেরে একদিন আমার গীত শুনাইয়া দিমু। তহন বুঝবেন, যুগইলা মিছা কয় নাই।
শরতের বাতাস এলোমেলো বয়ে চলেছে। কখনও ঝড়ের মতো সাঁই সাঁই ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে, কখনও ঝিরঝিরে সুখস্পর্শে ঘুম এসে যায়। স্টিমারে আসতে আসতে মনে হয়েছিল, আকাশময় কে এক অদৃশ্য ধুনুরি পেঁজা তুলো ছড়িয়ে রেখেছে। কখন যে রং বদলে মেঘগুলো কালো হয়ে গেছে, বিনুরা লক্ষ কর নি। ধীরে ধীরে বাতি নিবে এলে যেমন হয় সেইরকম রোদটা কখন যেন দীপ্তি হারিয়ে, উজ্জ্বলতা হারিয়ে মলিন হয়ে গেছে।
গল্প করতে করতে পুকুরের ওপারে তাকাল বিনু। ধানবনে ঢেউ তুলে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। দু’চারটে নৌকোও চোখে পড়ছে। ধানখেত সিঁথির মতো চিরে তারা কোথায় পাড়ি জমিয়েছে, কে জানে।
হঠাৎ বিনু বলল, আচ্ছা, ওই দিকটায় ধানখেত আর জল ছাড়া কি কিছুই নেই?
যুগল বলল, আছে তো।
কী?
যুগল এবার যা বলল, তা এইরকম। ধুধু এই জলরাশি আর ধানের অরণ্যের ভেতর দ্বীপের মতো অনেকগুলো কৃষাণ গ্রাম মাথা তুলে আছে। আরও জানালো, সেই আষাঢ় মাস থেকে কার্তিকের শেষাশেষি পর্যন্ত গ্রামগুলো একখানা সমুদ্রের ওপর যেন ভাসতে থাকে। তারপর মাঠের জল সরে গেলে কয়েকটা মাস নিশ্চিন্ত।
বিনু শুধলো, ওই জল কি নেমে যাবে?
যাইব বৈকি। এইর মদ্যেই টান ধরছে– যুগল বলতে লাগল, আশ্বিনের শ্যাষাশেষি দেখবেন, জল কত কইমা গ্যাছে। অঘ্রাণ মাসে চাইর দিক শুকনা খটখইটা (খটখটে) হইয়া যাইব।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যেতে বিনু তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, চারদিক তো জলে ডুবে আছে। ওখানে লোক যায় কী করে?
নায়ে কইরা। যুগল বলতে লাগল, দুই চাইর দিন থাকেন, বুঝতে পারবেন নাই এইখানকার মাইনষের হাত-পাও। নাও ছাড়া এই জলের দ্যাশে কুনোখানে যাওনের উপায় নাই।
একটু ভেবে বিনু বলল, ওই সব গ্রাম ছাড়া ওধারে আর কী আছে?
বড় বড় গুঞ্জ (গঞ্জ)।
গুঞ্জ কী?
বাজার আর কি, যেইহানে মাল বিকিকিনি হয়। কী একেকখান গুঞ্জ ছুটোবাবু–দিনরাইত মাইনষের চিল্লাচিল্লিতে গমগম করে। দেলভোগ মোহনগুঞ্জ মীরপুর সুজনগুঞ্জ–যেহানেই যান, এক অবোস্তা।
সুজনগঞ্জ নামটা বিনুর চেনা চেনা লাগল। কিন্তু কোথায় কার কাছে শুনেছে, এই মুহূর্তে কিছুতেই মনে করতে পারল না।
যুগল থামে নি, পূজা আসতে আছে ছুটোবাবু। সুজনগুঞ্জে মীরপুরে দেলভভাগে রাইতের পর রাইত যাত্রাগান হইব। অ্যামনেই মাইনষের ভিড়ে পাও ফেলান যায় না, তহন পুরা রাজি একেবারে ভাইঙ্গা পড়ব।
বিনু বলল, জানো, অমি কখনও যাত্রা দেখি নি।
বরদানের ভঙ্গিতে যুগল বলল, তার লেইগা কি, অমি আপনেরে দেখাইয়া আনুম। কয়টা আর দিন, পূজা তো আইসাই পড়ছে।
বিনু বলল, কথা দিলে। নিয়ে যেতে হবে কিন্তু–
যামু—যামু—যামু—
বিনু আর কিছু বলল না। স্বপ্নলোকের রহস্যময় সংকেতের মতো দিগন্তের ওপার থেকে দেলভোগ সুজনগঞ্জ-মীরপুর-ইনামগঞ্জ, এই বিচিত্র নামগুলো আর যাত্রাগানের আসর তাকে বার বার যেন হাতছানি দিতে লাগল।