সত্যাসত্য
প্রাচীন অথবা মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের একটা বড় পার্থক্য এই যে, সে যুগে পরিবর্তনের ধারা ছিল সাধারণত মন্থর; এ যুগে সব কিছু দ্রুত বদলে চলেছে। ফলে সত্য সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীও পালটে গেছে। সে যুগেও অবশ্য ইতিহাস নিশ্চল ছিল না। কিন্তু যাঁরা প্রাচীন ও অভিজ্ঞ তাঁদের দৃষ্টিতে প্রায়শ ইতিহাসের গতি ছিল চক্রবৎ, যার বৈশিষ্ট্য পুনরাবৃত্তি। একটির পর একটি পরিবর্তনের ধারা ধরে মানুষ এক প্রত্যাবর্তনহীন যাত্রায় চলেছে, এমন ধারণা মধ্যযুগীয় মানসে প্রাধান্য লাভ করেনি।
অতএব সে যুগে সনাতন ধর্মে বিশ্বাস সহজ ছিল। যে-সমাজব্যবস্থা এবং যেসব আচার শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে এসেছে তার স্রষ্টা নয় মরণশীল মানুষ। তার মূলে আছে কোনো অমর সত্য। সেই সত্যেরই ব্যাখ্যা মেলে শাস্ত্রে; ব্রাহ্মণ তার ব্যাখ্যাতা। ধর্ম অনুযায়ী প্রজাপালন ও দণ্ডবিধান রাজার কর্তব্য। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, সবাই সনাতন ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ। এই নিয়ে সমাজ।
এটা শুধু প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার কথাই নয়। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সমাজেও যাজকশ্রেণী ও রাজন্যবর্গের প্রাধান্য ছিল, আর শাস্ত্রের প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। সম্রাট ও ধর্মগুরুর ভিতর হয়তো মাঝে মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দিত। কিন্তু ইয়োরোপের চিন্তার জগতে সেদিন ধর্মের প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। আচার-বিচার, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছুর ওপরই এই প্রভাব পরিব্যাপ্ত ছিল।
ইয়োরোপে আধুনিক যুগের শুরু ও বাণিজ্যের প্রসার একই সঙ্গে দেখা দিল। এই যোগাযোগ কাকতালীয় নয়, বরং এর ভিতর একটা কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। মধ্যযুগের জগৎ ছিল ছোট ছোট গ্রামীণ সমাজে বিভক্ত। এইসব ক্ষুদ্র ও স্বয়ংভর সমাজের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগ ছিল নগণ্য। এই পরিবেশেই আঞ্চলিক আচার-বিচার। সনাতন নিয়মের মর্যাদা লাভ করে। বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের হাওয়া। দেশের ভিতর বইতে লাগল। পৃথিবী যে বিপুলা, তার বৈচিত্র্য যে অপার, এই বোধ চেতনাকে নাড়া দিতে লাগল। বণিক শ্রেণীর সেই ক্ষমতা ছিল, আর্থিক স্বাধীনতা ছিল, যাতে সে প্রাচীন সমাজব্যবস্থার বন্ধনের বাইরে এক নতুন জীবনধারার সূত্রপাত করতে পারে।
একই সঙ্গে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন দুয়েকটি সত্য আবিষ্কৃত হল যাতে প্রাচীন বিশ্বদর্শনকে আর রক্ষা করা গেল না। পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে নয়, সূর্য তাকে প্রদক্ষিণ করছে না, বরং এর বিপরীত কথাই সত্য, এই ধারণা আজ আমাদের স্তম্ভিত করে না। কিন্তু সেদিন এই আবিষ্কার বিল্পবাত্মক ছিল। কল্পনা করা কঠিন নয় যে, বিরাট বিশ্বের একটি পরিচিত নকশা যেদিন হঠাৎ ভুল প্রমাণিত হল সেদিন ইয়োরোপের বহু চিন্তাশীল মানুষ কত দিগ্ভ্রান্ত বোধ করেছিলেন।
ধীরে ধীরে সত্য সম্বন্ধে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গী আধুনিক চিন্তাধারার বৈশিষ্ট হয়ে উঠল। শেষ সত্য অথবা সমগ্র সত্য কোনো মানুষের কাছেই জ্ঞাত নয়। মানুষ সত্যকে শুধু আংশিকভাবে, অসম্পূর্ণভাবে জানে। অতএব গৃহীত সমস্ত ধ্যানধারণাকেই কিছুটা সংশয়ের সঙ্গে দেখা প্রয়োজন। এই সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপূরক হিসাবে আরও একটি ধারণা চিন্তাশীল মানুষের মনে ক্রমে প্রবেশ লাভ করে। কোনো মানুষই যখন পরম। জ্ঞানী নন, সত্যাসত্য নির্ধারণের শেষ দায়িত্ব যখন কোনো ব্যক্তিবিশেষের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যায় না, তখন বিচারকে মুক্ত করাই শ্রেয়। মতামতের দ্বন্দ্ব যথাসম্ভব নিবধ হোক, সময়ের হাতেই সত্য নির্ধারণের ভার ছেড়ে দেওয়া যাক। বেকন বললেন, “Truth is the daughter not of authority but of time.” সমালোচনার স্বাধীনতা সত্য সন্ধানের অঙ্গ বলে স্বীকৃত হল।
.
দুই
এই উদার চিন্তা ইয়োরোপের সর্বত্র স্বীকৃত হয়েছে, অথবা কোনো দেশে সম্পূর্ণভাবে গৃহীত হয়েছে, এমন কথা বললে অবশ্য ভুল হবে। রেনেসাঁসের ঢেউ সর্বত্র সমানভাবে গিয়ে ধাক্কা দিতে পারেনি। ধর্মীয় গোঁড়ামি চলেছে। পরমতঅসহিষ্ণুতা নব নব বেশে। দেখা দিয়েছে বর্তমান শতাব্দীতেও। এমন কি বৈজ্ঞানিকতার ছদ্মবেশেও তাকে দেখা গেছে। এ যুগের একজন নেতা বলেছেন, “সমালোচনার স্বাধীনতা, কথা খুব গালভরা বটে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তায় যাঁরা বিশ্বাসী, যাঁরা বিশ্বাস করেন যে চিন্তাকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাঁরা চাইবেন না নতুন ও পুরনো চিন্তার স্বাধীন সহাবস্থান, বরং চাইবেন পুরনো চিন্তার নির্বাসন।” দুটি ভিন্ন মত একই সঙ্গে সত্য হতে পারে না; যদি একটি হয়। সত্য, তবে অন্যটি মিথ্যা। মিথ্যাকে স্থান ছেড়ে দেওয়া যায় না; আর যেহেতু আমার মতটাই সত্য (এটা তো আমাকে ধরে নিতেই হবে!), অতএব পরমত দমনে দোষ নেই। এই হল অসহিষ্ণুতার সপক্ষে সরল যুক্তি। এর প্রভাব আজও দুর্বল নয়।
দুটি ভিন্নমত অবশ্য একই সঙ্গে সর্বাংশে সত্য হতে পারে না। তবে দুটি মত একই সঙ্গে আংশিকভাবে সত্য হতে পারে। সমালোচনার অধিকার আমার আছে; কিন্তু অপরের মত প্রকাশের সুযোগ কেড়ে নেবার অধিকার আমার নেই। যা মিথ্যা, আশা রাখতে হবে যে, সময়ে তা পরিত্যক্ত হবে। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, এ মত আইন করে বন্ধ করবার প্রয়োজন হয়নি; আপনিই পরিত্যক্ত হয়েছে। যদি দুটি মতেই কিছু সত্য থাকে, আশা রাখতে হবে যে সমালোচনার ভিতর দিয়ে দুয়েরই সত্যাংশ ক্রমে একটি মহত্তর সমন্বয়ে পৌঁছবে। মার্ক্সবাদ ও ফ্রয়েডীয় মতবাদের দ্বন্দ্বে এই রকম একটা সমন্বয়ের কথা কেউ কেউ আজ চিন্তা করছেন। আমরা যে যত বৈজ্ঞানিকই হই না কেন, আমাদের কারোই এমন শক্তি নেই যে সময়ের উর্ধ্বে উঠে সমন্বয়ের শেষ রূপরেখা আগে থেকে নির্ধারণ করে দিতে পারি।
তবু প্রশ্ন উঠবে, মতবাদ যখন স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা প্রণোদিত হয়, তখন? তখনও একই কথা। স্বার্থের দ্বন্দ্বের একটা দিক থাকে যাকে বলে শক্তির পরীক্ষা। আপাতত সেটা আমাদের আলোচনার বস্তু নয়। আমাদের আলোচনার বিষয় হল মতের দ্বন্দ্ব। অধিকাংশ মতামতের পিছনেই অল্পবেশী স্বাধবুদ্ধি থাকে, বিশেষত সমাজবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। তবু মনে রাখা ভালো যে, স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত মতবাদও আংশিকভাবে সত্য হতে পারে; আবার নিঃস্বার্থ মতামতেও ভুল থেকে যেতে পারে। প্ল্যাংটো অথবা মার্ক্স, গান্ধী অথবা লেনিন কি নিঃস্বার্থ ছিলেন? এ ধরনের প্রশ্ন বেশী না তোলাই ভালো। যদি এদের কারোও চিন্তায় কোনো ভুল থাকে তো যুক্তির সাহায্যেই সেই ভুল ধরিয়ে দেওয়া সম্ভব! সে চেষ্টাই করা উচিত। অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কিছু প্রমাণ করা যায় না, বরং তাতে সমালোচনার মান নেমে যায়। আমরা স্বভাবতই নিজেকে এবং স্বপক্ষের নেতাকে। অপেক্ষাকৃত নিঃস্বার্থ এবং অপরকে স্বাধান্বেষী মনে করে থাকি। কিন্তু এ নিয়ে বিবাদ করা বৃথা। মতবাদের আলোচনাকে যথাসম্ভব নৈর্ব্যক্তিক যুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত করতে পারলেই সত্য নির্ধারণ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
মতবাদের ঘাতপ্রতিঘাতের পাশে পাশে আন্দোলন এবং সাংগঠনিক কাজেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। প্রতিদিনের ঘটনায় শক্তির সংঘর্ষই সাধারণত বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু দীর্ঘকালীন দৃষ্টিতে এই মুহূর্তের অনেক বড় ঘটনাও ছোট হয়ে যায়, আর চিন্তার। প্রগতির ভূমিকা বড় হয়ে ওঠে।
মধ্যযুগীয় সমাজে আচার ছিল কঠিন নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে তর্কের অন্ত ছিল না। এদেশে প্রাচীন যুগে ভগবানের স্বরূপ নিয়ে কত সূক্ষ্ম বিচারই না। হয়েছে! এসব বিচার যে একেবারে নিরর্থক ছিল এমন নয়। কিন্তু আধুনিক যুগের শুরু থেকেই চিন্তার মোড় ঘুরল। বেকন বললেন, চিন্তাকে ‘ফলবান’ করতে হবে। যে চিন্তার প্রয়োগ নেই তা নিষ্ফল। চিন্তার ইতিহাসে এটা যুগান্তকারী কথা সন্দেহ নেই। মধ্যযুগে পণ্ডিতেরা সত্যাসত্য নির্ধারণ করতেন শাস্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে। আজও কেউ কেউ তাঁদের বক্তব্যের চারদিকে রাশি রাশি আপ্তবাক্যের দেয়াল গেঁথে নিরাপদ বোধ করেন। কিন্তু এটা আধুনিক মনের পরিচায়ক নয়।
চিন্তা কর্মের সহায়ক। অন্তত ঐহিক বিষয় নিয়ে আমাদের যে চিন্তা, কার্যকারিতার দ্বারাই তার সার্থক বিচার। এই রকম একটা কথা আমরা শুনেছি আধুনিক যুগের আদিপর্ব থেকে, বেকন প্রভৃতি চিন্তাশীল লোকদের মুখে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এটা সহায়ক হয়েছে। মধ্যযুগীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে এই মতবাদ একটি নতুন বিজয় পতাকার মতো উত্তোলিত হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে একটি নতুন বিপত্তিও ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠল।
মধ্যযুগীয় সমাজে উচ্চ-নীচ বিভিন্ন শ্রেণীর ভিতর একটা ভারসাম্য দীর্ঘদিন থেকে প্রতিষ্ঠিত ছিল, প্রাচীনত্বের গুণে যাকে সেদিন প্রশ্নাতীত বলে মনে হয়েছিল। বণিক শ্রেণীর অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভারসাম্য ভেঙ্গে পড়ল। শক্তির দ্বন্দ্বকে আর অভ্যস্ত আচার দিয়ে প্রচ্ছন্ন রাখা গেল না। সমাজের বিবর্তনে যে স্বার্থের ঘাতপ্রতিঘাতের একটা ভূমিকা আছে, এই বোধ ক্রমশ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। জাতিতে জাতিতে যুদ্ধের কথা অবশ্য প্রাচীন কাল থেকেই কাব্যে ও মহাকাব্যে কীর্তিত হয়েছে। আধুনিক যুগে আমরা বিভিন্ন শ্রেণীর ভিতর সংঘাতকে নতুন চোখে দেখতে শিখলাম। কেউ কেউ এমন কথাও বললেন যে, শ্রেণী সংগ্রামই ইতিহাসের মূল কথা।
মধ্যযুগের পণ্ডিতেরা ভগবানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রমাণ দাখিল করতে চেয়েছিলেন। আধুনিক যুগের কোনো কোনো পণ্ডিত বললেন যে, ভগবান সম্বন্ধে ধারণাটা কোন কাজে লাগে সেটাই দেখা দরকার; অবশেষে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ঐ ধারণাটা শোষণের কাজে সহায়ক বলেই শোষক শ্রেণীর কাছে আদরণীয়। একই কারণে শোষিত শ্রেণীর সংগ্রামে হাতিয়ার হিসেবে নাস্তিক্যই গ্রহণযোগ্য। যদি সত্যের বিচার হয় কার্যকারিতা দ্বারা, আর বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী অথবা শ্রেণীর ভিতর স্বার্থের দ্বন্দ্ব হয় মৌলিক, যদি এই দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে সমাজের কোনো বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ হিতের চিন্তা হয় অলীক, তবে খণ্ড ও বিরোধী তত্ত্বের উর্ধ্বে কোনো এক অদ্বিতীয় সত্যের চিন্তাকে ভ্রান্ত মনে করা ছাড়া উপায় থাকে না। সত্যের প্রকৃতি সম্বন্ধে এই মতবাদ যদি আমরা গ্রহণ করি তো সমালোচনার স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। পারস্পরিক সমালোচনার ভিতর দিয়ে কোনো বৃহত্তর সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়, কারণ বৃহত্তর সত্য বলে কিছু নেই। শাস্ত্রের বন্ধনের চেয়েও জোরালো এক নতুন অসহিষ্ণুতার বন্ধন এইভাবে চিন্তাকে আবদ্ধ করে ফেলে।
এই সংকট থেকে কি উদ্ধারের কোনো পথ নেই? স্বার্থের দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করা যায় না। স্বার্থের দ্বারা আমাদের মতামত প্রভাবিত হয় একথাও স্বীকার্য। কিন্তু বিরোধী স্বার্থ থেকে বিরোধী সত্যের জন্ম হয় এমন নয়; বরং লোভে, ভয়ে এবং দলীয় বুদ্ধির প্রভাবে সত্যের নানাবিধ বিকৃতির উদ্ভব হয়, একথাটাই মেনে নেওয়া ভালো। যা সত্য তার বিভিন্ন প্রকাশের ভিতর পার্থক্য এবং স্তরভেদ থাকলেও বৈপরীত্য থাকে না। বিরোধী মিথ্যার ভিতরই সমম্বয় অসম্ভব। অতএব ‘শ্রেণীসত্য’ অথবা দলীয় সত্য বলে কিছু মেনে নেওয়া যায় না। দলীয় অথবা শ্রেণী স্বার্থের প্রভাবে সত্যের বিকৃতি সম্ভব এইটুকুই স্বীকার্য। এই বিকারের সম্ভাবনাকে স্বীকার করে নিয়েই একে দূর করবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
যে সমাজে আত্মীয়তার বন্ধন প্রবল, সেখানে সত্যের ঐক্যমুখী ধারণাও সহজ ছিল। আধুনিক যুগে সমালোচনার মূল্য সম্বন্ধে আমরা সচেতন হয়েছি। এটাকে অগ্রগতি বলেই মেনে নিতে হবে। কিন্তু দ্বন্দ্ব-প্রবণতা যখন এমন একটা প্রত্যয়ের দিকে আমাদের ঠেলে নিয়ে যায়, যেখানে বিরোধের উর্ধ্বে সত্যের কোনো পরম প্রতিষ্ঠাভূমিকেই আমরা আর।
স্বীকার করতে চাই না, তখন সত্যানুসন্ধান ও সমালোচনার স্বাধীনতা দুই-ই বিপন্ন হয়। যে সৃষ্টিশীল বৈচিত্র্যগ্রাহিতা রেনেসাঁসের যুগের মহত্তর প্রবণতা ছিল, এইভাবে আমরা তার এক বিপরীত মেরুতে এসে উপস্থিত হই। ব্যক্তিগত ও দলীয় বিচ্ছিন্নতার উর্ধ্বে একটি সাধারণ সত্যের সম্ভাবনামাত্রকে অস্বীকার করবার পরিণতি এই; এর পর মতের দ্বন্দ্ব, এমন কি ভাব বিনিময়ের চেষ্টাকেও, নিরর্থক মনে করা ছাড়া উপায় থাকে না। সত্য সম্বন্ধে মধ্যযুগীয় মনোভাবের সঙ্গে আধুনিক নাগরিক সংশয়বাদিতার একটা নতুন সামঞ্জস্যের তাই প্রয়োজন আছে।
.
তিন
সত্যের প্রকাশ যে বিচিত্র, আর এই বৈচিত্র্যের পিছনেও যে এক পরম সত্যের অস্তিত্ব স্বীকার করা প্রয়োজন, একথা এদেশে এতই পুরাতন যে, এর পুনরাবৃত্তিতে আমাদের মনে আজ আর কোনো বিশেষ চিন্তা জাগ্রত হয় না। এদেশে বিপদ দেখা দিয়েছে বিপরীত পথে। তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশে আমাদের বাস। আমরা একই সঙ্গে সরস্বতী দেবীর আরাধনা করি, যিনি নাকি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আবার কুসংস্কারকে সযত্নে পোষণ করে ভয়ে ভয়ে মনসাদেবীর পূজাতেও চাঁদা দিই। এদেশে অহিংসার বাণী এবং পশুবলি, এমন কি নরবলিও, পাশাপাশি চলে আজও। আমাদের ব্রাহ্মণেরা নিরাকার ব্রহ্মের তত্ত্ব জানেন; জীবমাত্রে দেবদর্শন করেন; এবং কোটি কোটি মানুষের অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা নিষ্প্রয়োজন মনে করেন।
গান্ধী আমাদের শিখিয়েছিলেন যে, অহিংসার অর্থ অন্যায়ের অপ্রতিবাদ নয়; অহিংসাও যুদ্ধেরই এক ধরন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একমাত্র সভ্য পথ। মতের উদারতার অর্থও এই নয় যে, যাকে আমরা অযৌক্তিক মনে করি তার কঠিন সমালোচনা করব না। মনে রাখতে হবে যে, পরমতসহিষ্ণুতা ও সমালোচনার স্বাধীনতা পরস্পর পরিপূরক। বিজ্ঞান ও কুসংস্কারকে সব দেশেই অম্লাধিক পাশাপাশি পাওয়া যায়। এদেশে এদের দ্বন্দ্বহীন সহাবস্থানই নিয়ম। এই দ্বন্দ্বহীনতাকে আমরা সহিষ্ণুতা জ্ঞান করি। কিন্তু সহিষ্ণুতা সম্বন্ধে এই স্থবির ধারণা ভুল। যে-মতবাদকে আমরা ভ্রান্ত মনে করি তাকে গায়ের জোরে দমন করা যেমন সভ্যতার বিরোধী, তাকে বিনা প্রতিবাদে ক্রমাগত সহ্য করাও তেমনই প্রগতির পরিপন্থী। মতামতের স্বাধীন দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে যদি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না চলে তবে সমাজ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে। অবশেষে প্রকৃতির প্রতিশোধের মতো কোনো অন্ধ অসহিষ্ণু আন্দোলন একদিন দেশকে গ্রাস করে। মতামতের স্বাধীন দ্বন্দ্বকে ত্যাগ করে সহিষ্ণুতা গ্রহণীয় নয়; সেই সংগ্রাম পরিচালনার সভ্য নিয়ম হিসেবেই সহিষ্ণুতা শ্রদ্ধেয়। ব্ৰহ্মজ্ঞান ও অস্পৃশ্যতার দ্বন্দ্বহীন সহাবস্থানকে সহিষ্ণুতা বললে ঐ শব্দটিকে। বিদ্রূপ করা হয় মাত্র।
ভিন্ন মতবাদেও সত্যের অসম্পূর্ণ অংশ আছে। এ কথাটা একটা শুদ্ধ সম্ভাবনা হিসেবে জানাই যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন মতবাদের কোনটিতে কতটা সত্য আছে, সেটা নির্ধারণ করবার উপায় হিসেবে মতামতের অবিরত দ্বন্দ্ব প্রয়োজন। সব মতেই কিছুটা সত্য আছে, এ কথা তত্ত্ব হিসেবে মেনে নিয়ে বিচার থেকে ক্ষান্ত হওয়া সত্যের প্রতি অবহেলারই একটি বিশেষ রূপ। আমাদের দেশে আজও এরই প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ ব্যাপারে আমাদের জড়তা কাটবে এমন একটা সম্ভাবনা উনিশ শতকে দেখা দিয়েছিল। সেই সম্ভাবনাও আজ বিলীয়মান।
আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর দিকে তাকালেই ব্যাপারটা চোখে পড়ে। একই ব্যক্তি বিভিন্ন সভায় নিজেকে রামকৃষ্ণ, গান্ধী, মার্ক্স ও লেনিনের ভক্ত বলে বর্ণনা করেন; এতে কারও হাস্যোদ্রেক হয় না। আমরা সুবিধা অনুযায়ী পুনঃপুনঃ দল ও মত পরিবর্তন করি। সকল মতকে মনে মনে সমভাবে সত্য, অর্থাৎ সমান অকিঞ্চিৎ জেনে নিয়ে আমরা ক্ষমতাবানকে অক্লেশে সত্যের ওপর স্থাপন করেছি।
দার্শনিক তর্কের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য অবশ্য এ দেশে ছিল ন্তু সেই তর্ক ছিল বহু পরিমাণে শব্দনির্ভর। এগারো শতকে হিন্দুদের সম্বন্ধে তপ্রবর আলবেরুনী লিখেছিলেন, ভগবতত্ত্ব নিয়ে বিবাদ ওঁদের ভিতর বিশেষ দেখা যায় না; বড় জোর ওঁরা শব্দ নিয়ে কলহ করেন। (“On the whole, there is very little disputing about theological topics among themselves; at the utmost, they fight with words.”) জাতীয় তর্কের নিরর্থকতা থেকেই বোধ করি অনেকে এই বিশ্বাসে এসেছিলেন যে, তর্কে নয়, ভক্তিতেই সত্যলাভ হয়। যে ফলপ্রসূ সমালোচনার ইঙ্গিত আমরা বেকনের লেখাতে পাই, আমাদের এ যুগের ঐতিহ্যে তা জীবন্ত হয়ে ওঠেনি। এর পর এতে বিস্মিত হবার। কিছু নেই যে, সমালোচনার স্বাধীনতা নামক বস্তুটির মূল্য আমাদের কাছে প্রায় অজ্ঞাত। যদিও একে আমরা ভদ্র নমস্কার জানাতে অভ্যস্ত, তবু সেটা দুর্বল নমস্কার। আজ যদি কোনো ক্ষমতাবান নায়ক সমালোচনার স্বাধীনতাকে দেশ থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেন তবুও আমরা সম্ভবত একটি অক্ষম নমস্কার জানিয়েই কর্তব্য সমাপ্ত করব।
সত্যাসত্য সন্ধানের দুই মেরুতে দুই সংকট অহিষ্ণুতা ও অনীহা। যে-রূপে সত্য আমার কাছে উদ্ভাসিত তারই সপক্ষে আমাকে দাঁড়াতে হবে। তবু জানব যে, বৃহত্তর সত্যের একটি ভগ্নাংশ মাত্র আমার দৃষ্টির অধিগম্য। ভ্রান্তি দেখা দেয় দুই প্রান্ত থেকে। কোথাও দল অথবা গোষ্ঠীবিশেষ সমগ্র সত্যের অধিকার দাবী করে মতামতের দ্বন্দ্বকে আপত্তিকর, অতএব সংহারযোগ্য, বিবেচনা করেন। আবার কোথাও ভিন্ন, এমন কি বিরোধী, সমস্ত মতই সত্য হতে পারে এই অভ্যস্ত বিশ্বাসে আমরা মতামতের যুক্তিনিষ্ঠ বিচারকে নিষ্প্রয়োজন মনে করি। এ দুয়ের মাঝখানে পথ বেছে নেওয়া কঠিন। তাই সত্য যদি-বা সহজ, সত্যের সন্ধান সহজ নয়।
.
চার
যে জড় প্রকৃতিকে নিয়ে পদার্থবিদ্যা অথবা জ্যোতির্বিদ্যায় গবেষণা চলে, সেই প্রকৃতি যে ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছার বশবর্তী নয়, এইসব ইচ্ছাঅনিচ্ছার বাইরে যে তার একটা সত্য প্রতিষ্ঠা আছে একথা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন। এক্ষেত্রেও অবশ্য গবেষণা ও সত্যানুসন্ধান সামাজিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু পরমাণুতত্ত্ব অথবা চাঁদের রহস্য সম্বন্ধে জ্ঞানবিজ্ঞান দেশের সীমানা মেনে চলে না, যদিও পরমাণু শক্তির ব্যবহার এবং চাঁদে যাত্রা নিয়ে জাতিতে জাতিতে সীমাহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
সমাজবিদ্যার ক্ষেত্রে অবস্থা ভিন্ন। প্রশ্নটা আগেই একবার উঠেছিল; কিন্তু আরও খানিকটা আলোচনা প্রয়োজন। বর্তমান এমনকি অতীত সমাজ বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত আদর্শ সমাজ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা দিয়ে প্রভাবিত। কাজেই আদর্শ অথবা কল্পিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মতের সাম্য না থাকলে বর্তমান সম্বন্ধেও দৃষ্টিভঙ্গির ঐক্য হওয়া কঠিন। এই জটিলতা সমাজবিদ্যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অবশ্য আদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও সমাজবিজ্ঞানীদের ভিতর অম্লমধুর সহযোগিতা সম্ভব; এখানেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভাবের আদানপ্রদান চলছে।
আদর্শের পার্থক্য দুই ধরনের হয়। আমরা ভিন্ন মার্গে বিশ্বাসী হয়েও পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে পারি; যেমন শিল্পী ও বৈজ্ঞানিক পরস্পরকে শ্রদ্ধা করেন। আদর্শের এই পার্থক্য দ্বন্দ্বমূলক নয়। কিন্তু যদি কেউ যুদ্ধের ভক্ত হন, যেমন ছিলেন মুসোলিনী ও তাঁর দল, আর অন্য কেউ শান্তিকে আদর্শ বলে জানেন, তবে এ দুয়ের ভিতর বিরোধ মৌলিক। তেমনি মানবতাবাদ বর্ণবিদ্বেষকে শ্রদ্ধা করতে পারে না।
জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, জাতীয় আদর্শ ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠী ও শ্রেণীর দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে। বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয়তাবাদের বিশেষ ভূমিকা ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে স্বীকার্য। কিন্তু এই সংগ্রামী আদর্শে যতটা উচ্ছলতা থাকে, উন্মাদনা থাকে, নীতি ও আদর্শ সম্বন্ধে ততটা স্পষ্ট ধারণা থাকে না। আমাদের জাতীয় সংগ্রামে পরিচিত ও অপরিচিত বহু মানুষ অকাতরে জীবনদান করেছেন। তাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের অভিভূত করে।
“একলা চল রে” গানটি গান্ধীর প্রিয় ছিল। অগণিত মানুষের যৌথ প্রেরণা ও আত্মদানের সঙ্গে একক মানুষের সত্যানুভূতির একটা মৌল পার্থক্য আছে। যে সহস্র। মানুষ নির্ভয়ে বিদেশী শাসকের লাঠি ও বুলেটের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তাঁদের ভিতর সামান্য কয়েকজনই গান্ধীর মতো স্বজাতির ক্রুদ্ধ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সর্ববিষয়ে সহমত হতে পারেননি; প্রয়োজনবোধে তিনি জনগণমনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিনায়কের বিরুদ্ধেও সমালোচনা উচ্চারণ। করতে সাহসী হয়েছেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতামতের সত্যাসত্য বিচার করা এখানে নিষ্প্রয়োজন। যে সাহসে ব্যক্তি তাঁর সত্যানুভূতিকে আশ্রয় করে জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন, সেই অদ্বিতীয় নির্ভয়তার কথাই এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে। যৌথ উত্তেজনা যে-মেই আসুক না কেন, সে যদি ব্যক্তিকে পিষ্ট করে সমষ্টির সঙ্গে একাকার। করে দিতে চায়, তবে সেটা নিন্দার যোগ্য।
আমাদের যুগ গণতন্ত্রের যুগ। আমরা আভিজাত্যের স্পর্ধায় বিশ্বাসী নই। মনুষ্যত্বের স্বীকৃতি ও অধিকার সমস্ত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই আমরা আগ্রহী। কিন্তু সকল তন্ত্রের মতো গণতন্ত্রেরও বিকার আছে। সেই বিকারের বিরুদ্ধে তাকে রক্ষা করা কর্তব্য। গণতন্ত্রের যুগে যাঁর পক্ষে ভোট বেশী অথবা জনসমর্থন বেশী, তিনি শাসন করবেন এটাই স্বীকৃত বিধি। তার অর্থ এই নয় যে, জনমত অভ্রান্ত, অথবা জনমতের গুণে শাসক অভ্রান্ত। যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী, তিনিও ভ্রান্তির সম্ভাবনার উর্ধ্বে নন। অতএব সংখ্যায় যিনি আজ গৌরবের অধিকারী নন, তাঁরও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমানভাবে রক্ষার যোগ্য। এই স্বাধীনতা প্রকৃত গণতান্ত্রিকের কাছে পরম মূল্যবান। মনে রাখা আবশ্যক যে, নতুন সত্য সংখ্যালঘিষ্ঠের সত্য হিসেবেই প্রথম প্রবেশ লাভ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসন করবেন; সংখ্যালঘিষ্ঠের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে; এই দুই। ‘বিপরীতে’র সাযুজ্যেই গণতন্ত্র।
কোনো এক যুগে রাজার অহংকার ছিল যে, তিনি ঈশ্বরের প্রতিভূ। এ যুগে ঈশ্বরের স্থান অধিকার করেছে–জনতা। আজকের নেতা জনতার প্রতিনিধি। সে-যুগের। ইয়োরোপে ‘অবিশ্বাসী’র শাস্তি হতে, তিনি শয়তানের প্রভাবাধীন এই অভিযোগে। এ যুগে ভিন্ন মতাবলম্বীর বিরুদ্ধে দারুণতম অভিযোগ, তিনি জনতার শত্রু। জনতা অথবা জনগণের নেতা ঈশ্বরের মতোই অভ্রান্ত, শেষ সত্যের অধিকারী, এই মুটু ধারণা থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে না পারলে তার বিকৃতি অপ্রতিরোধ্য।
জাতীয়তাবাদীর ভাষায় জাতির অন্য নাম জনতা। সাম্যবাদীরা শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে জনতাকে সমার্থকভাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু মানবতাবাদীর পরিভাষাতে মানবজাতির অন্য নাম কখনও জনতা নয়। এর কারণ চিন্তার যোগ্য। জনতা বলতে মানুষের। যে-চেহারা সহজেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে তা বহু মানুষের ভিড়, প্রায়শ একটি ক্রুদ্ধ সংহতি। কিন্তু মানুষ বলতে আমরা সেই জীবটিকে বুঝি, যে অপরাপর জীব থেকে তার স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন; যে সংশয়ের ভিতর দিয়ে সত্যের দিকে অগ্রসর হতে চায়; যার শেষ পরিচয় কোনো ক্ষুদ্র যৌথ আনুগত্য দিয়ে পরিসমাপ্ত নয়। মানবতাবাদী এই মানুষকে জনতার চেয়ে বড় বলে জানে।
এ প্রসঙ্গে মার্ক্সবাদের একটি দিক নিয়েও সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে। মার্ক্সবাদীদের ভিতর অনেকে বিশ্বাস করেন যে, ধনিক ও শ্রমিক শ্রেণীর ভিতর আদর্শের একটা দ্বন্দ্বমূলক পার্থক্য আছে। ধনিক শ্রেণী শোষণের নীতিতে আস্থাবান। ‘শ্রেণীচ্যুত’ হয়ে তবেই ধনিকের পক্ষে শ্রমিকের সঙ্গে আদর্শগত ঐক্যে আবদ্ধ হওয়া সম্ভব।
এই ধারণাটাকে তথ্য এবং যুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা দরকার। বস্তুতপক্ষে শ্রমিক তাঁর আশা ভরসা অথবা জীবনের লক্ষ্য বিভিন্ন স্তরে স্থাপন করতে পারেন। প্রথমত তিনি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে তারই ভিতর শ্রমিক আন্দোলনের সাহায্যে নিজ অবস্থার উন্নতির জন্য চেষ্টা করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যান্য অনেক দেশেই শ্রমিক সংস্থাগুলির মূল প্রচেষ্টা এই। আবার তিনি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিতরে থেকেও চিন্তার। দ্বারা উচ্চতর একটি সমাজব্যবস্থার ধারণায় পৌঁছতে পারেন এবং সেই আদর্শের জন্য সংগ্রাম করতে পারেন। শ্রমিক তাঁর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার ফলে অনিবার্যভাবে ঐ আদর্শের অধিকারী হন একথা তথ্য হিসেবেও ঠিক নয়। এবিষয়ে অন্তত লেনিনের মনে কোনো ভ্রান্ত ধারণাও ছিল না। কথাটি অন্যভাবে বলা যেতে পারে। শ্রমিক তাঁর বিশুদ্ধ শ্রেণীগত চরিত্র থেকে মজুরী বাড়াবার জন্যই সংগ্রাম করে থাকেন; এর চেয়ে বড় কোনো উদ্দেশ্য তাঁর জীবনকে তখনও চালিত করে না। যে-মুহূর্তে তিনি সাম্যবাদী আদর্শকে কল্পনায় লাভ করেছেন, সে মুহূর্তে তিনি শ্রেণীগত চরিত্রের উর্ধ্বে উঠে একটি বৃহত্তর মানবিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
এই অর্থে কি-ধনিক, কি-শ্রমিক উভয়েই ‘শ্রেণীচ্যুত’ হয়েই, অর্থাৎ শ্রেণীর ঊর্ধ্বে উঠে তবেই সাম্যবাদী হন। কেউ হয়তো বা বলবেন যে, এই ‘শ্রেণীচ্যুতি’ শ্রমিকের স্বার্থে, ধনিকের স্বার্থের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই প্রসঙ্গেও দুটি কথা মনে রাখা ভালো। শোষক ও শোষিতের পারস্পরিক সম্পর্ক উভয়ের জন্যই পরিপূর্ণ মুক্তিলাভের পথে অন্তরায়। এইরকম একটা বোধ থেকেই সাম্যের আদর্শের উদ্ভব। সাম্যবাদী আন্দোলনের চিন্তাধারা ও নেতৃত্ব বহু পরিমাণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভিতর থেকেই এসেছে। শুধু শ্রেণীগত পরিচয়ে ধনিক অথবা শ্রমিক কোনো শ্রেণীই নমস্য নয়। মানুষ হিসাবে শ্রেণীর ঊর্ধ্বে উঠবার শক্তিতেই ব্যক্তিবিশেষ শ্রদ্ধেয়। অন্তত মানবতাবাদী একথাই বলবেন। সমাজকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে তার একটিকে দেবতা এবং অপরটিকে দানব কল্পনা করলে তার ফলে অসহিষ্ণুতার এক নতুন শাস্ত্র ও মন্ত্র রচিত হয়।
কিন্তু এসব তর্কও আজ অবস্থার পরিবর্তনে অনেক পরিমাণে অপ্রাসঙ্গিক। সাম্যবাদ ও জাতীয়তাবাদ একদিন বিরোধী তত্ত্ব ছিল। মার্ক্স ও বিসমার্কের ভিতর সেতুবন্ধন ছিল না। কিন্তু বিসমার্ক থেকে স্তালিনের দূরত্ব দুরতিক্রম্য নয়। সমাজে রাষ্ট্রের ভূমিকা গত অর্ধ শতাব্দীতেই ক্রমশই বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর কর্তৃত্বই আজ ক্ষমতার মূল উৎস। এই কর্তৃত্বলাভের জন্য প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে এবং জনতার সমর্থনে যে-লড়াই চলেছে, আজকের সাম্যবাদী আন্দোলন তারই অন্যতম রূপ। ক্ষমতালাভের পর ‘সাম্যবাদী রাষ্ট্রের পরিচালনায় ও শাসকদলের শাখা-প্রশাখায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী নব কলেবর ও নতুন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উচ্চাশা আজ পুরনো শ্রেণীস্বার্থ দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। শ্রেণীস্বার্থ ত্যাগের প্রশ্নও তাই পুরনো অর্থ বহন করে না। ইতিহাসের পথ জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে নতুন সম্ভাবনা আর নতুন মোহিনী ছলনা। সত্যাসত্য আবারও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দিয়ে খণ্ডিত। কিন্তু আজকের ছলনার ভাষা ভিন্ন।
জাতিভেদ ও শ্রেণীবিভাগের পুরনো চিহ্নগুলো অক্ষয় নয়। কিন্তু ক্ষমতার লড়াই দুর্মর। যেহেতু এই দ্বন্দ্বের ভিতর থেকে মানুষের সমস্যার শেষ সমাধান পাওয়া যাবে না, অতএব এর প্রকোপ থেকে সত্যকে কি করে বাঁচানো যায়, এর উর্ধ্বে সত্যের একটি। প্রতিষ্ঠা কি করে রক্ষা করা যায়, সে প্রশ্ন সমস্ত কল্যাণকামী মানুষের জন্য এ যুগের একটি প্রধান প্রশ্ন হয়ে আছে।
পল্লী ও নগর (১৯৭৩)