কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
কোমরের কাছ থেকে ছোট্ট একটুকরো কাপড় বের করে পিতৃদেব চোখ মুছলেন। আড়চোখে আমাকে একবার দেখে নিলেন। উঃ, পিতা হবার কী জ্বালা! আমার মতো সৌভাগ্যবান ক’জন আছে। জন্মেই মরুভূমি। ধরে বেঁধে রাখার মতো কেউ কোথাও নেই। পরিস্থিতি লম্বা আঙুল তুলে দিকনির্দেশ করছে, পিন্টু, লোটাকম্বল। কৌপীনবন্তং খলু ভাগ্যবন্তং। জয় শিবশঙ্কু, উখার দে মকান, লাগা দে তম্ভ। চিতপাত হয়ে শুয়ে আছে, আর এক গৌতমবুদ্ধ। মানুষের কী কষ্ট। রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি। মানুষ জেরবার হয়ে গেল। এ থাকে তো ও যায়, ও থাকে তো এ যায়। কী যে কেলোর কীর্তি চারদিকে। প্রবীণরা এসে মাঝে মাঝেই শুনিয়ে যান, হরিশঙ্কর, তোমরা শুনলে না তখন, এই ভূতের বাড়িতে এসে ঢুকলে! অত বড় সংসার, একে একে সবাই চলে গেল। এখন বংশে বাতি দেবার মতো কেউ থাকে কি না দেখো! হরিশঙ্কর তখন বুক ফুলিয়ে বলেন, কেউ না থাকে আমি থাকব। সেই ছাত্রজীবনে বাংলার শিক্ষক আমাদের চাঁদসদাগর পড়াতেন, হাতে লাঠি নিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছেন সদাগর, সব গেছে তবু নতি স্বীকার করব না।
মাতামহ অনেকটা টর্পেডোর ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে পড়ে জামাইয়ের দিকে এগিয়ে এলেন। ধরাধরা গলায় বললেন, হরিশঙ্কর, আমার এই জিভ, আমার এই নোলায় একটু হেঁকা দিতে পারো! সামনে জিভ ঝুলছে লকলক করে।
পিতা বললেন, ওটাকে আপনি ভেতরে গুটিয়ে রাখুন। হেঁকা দেবার ব্যবস্থা আমি করছি। তার আগে হিসেবটা লিখে নিই।
দাদু চেয়ারে বসে গান ধরলেন, এখনও কি ব্রহ্মময়ী, হয়নি মা তোর মনের মতো।
পিতা ক্যাশবাক্স খুলে সেই বিখ্যাত হিসেবের খাতাটি খুললেন। যার পাতায় পাতায় প্রতিদিনের হিসেব লেখা। পাইপয়সার এদিক-ওদিক হবার উপায় নেই। প্রতিদিনের হিসেব মেলাতে গিয়ে একটি কথা লিখতেই হবে, শর্ট, এত পয়সা। পাশে একটি জিজ্ঞাসার চিহ্ন। বড়ই সন্দেহ। কেন শর্ট? কে মেরেছে? আমি নয় তো! মিথ্যে বলব না, দু-এক দিন মেরেছি। বেশ নরম করে ভাজা বোকাদার দোকানের ডিমের ওমলেট বড়ই সুস্বাদু! মনের ওপর এখনও যে তেমন সংযম আসেনি। একটু-আধটু এদিকে-সেদিকে পা ফেলে। কিন্তু সে তো মাঝেমধ্যে। তা হলে রোজ শর্ট হয় কী করে! কে জানে? এদিকে শুনি হিসেবের কড়ি বাঘে খায় না।
ডাক্তারবাবুকে দু’টাকা ভিজিট দিয়েছেন। সকালে নর্দমা সাফ করার লোক এসেছিল, তাকে এক সিকি। ভিখিরি এসেছিল, দু’পয়সা। ওয়েস্ট নট ওয়ান্ট নট। চুলচেরা ব্যাপার। আমি যদি সত্যি বুদ্ধদেব হতুম, তা হলে কবে বোধিবৃক্ষের তলায় গিয়ে বসতুম। রোজ এইসব ছোটখাটো অপমান। বাজার থেকে পয়সা মেরেছি। অসুখে পড়ে ডাক্তার খরচ করিয়েছি। অহংকারে লাগে। আবার মহাপুরুষরা বলছেন, অহংকার কী রে ব্যাটা!
পাঁড়ে
ন করসী বাদ-বিবাদঁ। যা দেহী বিন সবদ না স্বাদঁ
অণ্ড ব্রহ্মাণ্ড খণ্ড ভি মাটি। মাটি নবনিধি কায়া।
আরে পাঁড়েজি তর্কাতর্কি মাত করো। এই দেহে শব্দ নেই, স্বাদ নেই, স্রেফ মাটি রে ভাই। অণ্ড, ব্ৰহ্মাণ্ড, খণ্ড সবই মাটি। ওই যে আমার পিতৃদেব টাকা টাকা করছেন, ওঁর কানের কাছে আমি যদি নাকি সুরে দু’কলি গেয়ে উঠি;
মন রে রতন কাগজ কা পুতলা।
লাগে ঝুঁদ বিনসি জাই ছিল মৈ গরব করৈ ক্যা ইতনা ॥
মন রে, ধনরত্ন সব কাগজের খেলনা। বুদবুদ এই উঠছে এই মিলিয়ে যাচ্ছে। এত গর্ব কীসের!
আর কিছু না পারি বেশ দু-চারটে শ্লোক, দোহা টোহা মুখস্থ করে, পিপুল-পাকা অবস্থায় পৌঁছে গেছি। নাকে রসকলি করে সামনে পুঁথি খুলে কথকতায় বসলেই হয়। গলায় গাঁদাফুলের মালা, সামনে মরা, আধমরা, বড়ি খোঁপা, পানদোক্তা-খাওয়া হরেক মেজাজের একপাল বিধবা।
মাতামহ বেশ তারিফের গলায় বললেন, বড় ভাল অভ্যাস হরিশঙ্কর! মরো আর বাঁচো রোজ হিসেবটি লিখে যাবে। নিজেকে সংযত রাখার এর চেয়ে ভাল রাস্তা আর কিছুই নেই। ওড়ার আগেই ডানাটি কেটে ফেলল। খাতার দিকে তাকাও আর শামুকের মতো গুটিয়ে যাও। মহাত্মা গান্ধী শুনেছি। রোজ হিসেব লিখতেন। সাধে স্বাধীনতা আনতে পেরেছিলেন! ইংরেজ বললে, বাবা, বড় সাংঘাতিক লোক। কাপড় হাঁটুর উপর তুলেছে। আরও ওপরে তোলার আগেই সরে পড়ো।
আপনার সব ভাল, মাঝেমধ্যে এই যে একটু গ্রাম্য হয়ে পড়েন, তখনই পিত্তি চটে যায়। হচ্ছে হিসেবের কথা, চলে গেলেন মহাত্মা গান্ধীতে। উত্তর পশ্চিম জ্ঞানের বড়ই অভাব।
তুমি ঠিক বলেছ হরিশঙ্কর। আমার মুখটা একটু আলগা। এক-একটা কথা ফস করে মুখ দিয়ে যেই বেরোয়, চমকে চমকে উঠি। রিভলভারের গুলির মত বেরোবার সময় ধাক্কা দিয়ে যায়। তখন নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করি, ওরে তোর মুখ না পেছন? অ্যাই, অ্যাই দেখো, যেই বললুম অমনি ধাক্কা খেলুম। উপমাটা তেমন সুবিধের হল না। মুখকে যার সঙ্গে তুলনা করলুম, সে জায়গাটা খুব সভ্য নয়।
কে আপনাকে ব্যাখ্যা করতে বলেছে?
কেউ বলেনি। তোমাকে দেখালুম আমি একেবারে গবেট নই। বোধবুদ্ধি আছে, কেবল অভ্যাসটা নেই। ঢলকো ছিপির মতো! কী, রাগ করছ নাকি? রেগে গেলে তোমার আবার জ্ঞান থাকে না। ভুলেই যাবে, আমি তোমার শ্বশুরমশাই। এখুনি বলবে, আপনি তা হলে আসুন। আমার লুচি-হালুয়া বন্ধ হয়ে যাবে। বেটির সামনে আসনে মন আর কিছুতেই স্থির হবে না। হরু পাগলের মতো গাইতে হবে,
থেকে থেকে যেন মাগো লুচির গন্ধ পাই
কোথা তোর রাঙা চরণ, ভাসছে
চোখে মণ্ডামেঠাই।
থেকে থেকে যেন মাগো লুচির
গন্ধ পাই।
খাতা ক্যাশবাক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চাবিটি লাগাতে ভুল হল না। দাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আহারাদি তা হলে আজ এখানেই হোক।
গান থেমে গেল। লাজুক লাজুক মুখে বললেন, স্বপাকে ভাতেভাত খাই, এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। ওরে কাঙাল ভাত খাবি? না, হাত ধুয়ে বসে আছি। তা, কী কী পদ হবে হরিশঙ্কর?
ধরুন খুব সরু চালের ভাত। তার ওপর পরিমাণ মতো গব্য ঘৃত।
আহা, আহা!
পালং শাক পোস্ত দিয়ে ভাজা।
বড়ি আর মুলো পড়বে?
পড়বে।
তোফা তোফা।
সোনামুগের ডাল।
বলো কী?
পাকা রুইমাছের কালিয়া।
কেয়া বাত কেয়া বাত।
একটু চাটনি আর দই।
সর্বাঙ্গসুন্দর।
কিন্তু কে করবে?
কে করবে? হ্যাঁ তাও তো বটে, কে করবে? এ তো শ্মশানভূমি। চারদিক হাহা করছে, খাঁখাঁ। তা হলে বললে কেন?
স্বপ্ন দেখালুম মুকুজ্যেমশাই। দিবা স্বপ্ন।
তা হলে কী হবে?
জগাখিচুড়ি। চালে, ডালে, লাউ উঁটায়, আলুতে, পটলে এক মহা সম্মেলন। কী, দুঃখ হচ্ছে?
কিছুমাত্র না। দুঃখু কীসের? মূলং তরোঃ কেবলমাশয়ন্তঃ, পানিদ্বয়ং ভোমামন্ত্রয়ন্ত কামিব শ্রীমপি কুৎসয়ন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্ত। বুঝলে হরিশঙ্কর।
হ্যাঁ, বুঝলুম বই কী। হীনবল ভারতীয়ের ভাগ্যের সঙ্গে সহজ রফা। পুরুষকারের অভাব। ওর সঙ্গে যোগ করুন তৃণাদপি সুনীচেন, তরুরোহপি সহিষ্ণুনা, নেংটি পরে লটকে বেড়াই, মুখে কেবল কথার বড়াই। যা বলেছি তাই হবে। নো ট্রাকস্টার অ্যান্ড হাকস্টার উইথ ফেট।
তুমি কথায় কথায় বড় ইংরেজি বলো সায়েববাচ্চার মতো। ওই ভাষাটা আমি আবার তেমন বুঝি না।
এ হল তাদের ভাষা যারা কর্মযোগে বিশ্বাস করে। যারা লেংচে চলে না। মার্চ করে।
সবই বুঝলুম হরিশঙ্কর, তবে কি নাতিটার পেট ভাল নেই, এতগুলো পদ রাঁধবে, আর আমরা খেলিয়ে খেলিয়ে খাব, সেটা কি ঠিক হবে?
ওর জন্যে আমি বেলের মোরব্বা তৈরি করব।
আহা বড় ভাল জিনিস! আমাকেও দিয়ো কিঞ্চিৎ, না কোরো বঞ্চিত। তা হলে এখন একটু চা হোক। চিনির বদলে আমাকে গুড় দিলেও চলবে।
কেন, চিনির অভাব আছে নাকি? আপনার মেয়ে নেই, ঠিক আছে। নেই তো নেই, আমি তো আছি!
অ্যাঁ, তুমি এত বড় কথা বললে? আমার পুত্র-পুত্রবধূ যে কখনও এমন কথা বলতে পারলে না। পায়ের নীচে এখনও তা হলে জমি আছে! হরিশঙ্কর, জমি তা হলে আছে?
আলবাত আছে। আপনার মেয়েকে আমি শ্রদ্ধা করি। আজ নেই বলে বলছি না, থাকলেও বলতুম। সে ছিল দেবী। আপনি তার কিসুই জানেন না। আনইয়ুজুয়াল ডটার অফ নট সো ওয়ার্দি এ ফাদার।
একটু বাংলা করে বলো হরিশঙ্কর। শুনতে বড় ভাল লাগছে। চোখে জল এসে যাচ্ছে।
বাংলা করলে শুনতে আর তেমন ভাল লাগবে না।
তা হলে ইংরিজিই থাক।
হ্যাঁ, সেই ভাল, হোয়ার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস দেয়ার।
উঃ, সব ভাল ভাল কথাই তুমি ম্লেচ্ছ ভাষায় বলছ, আচ্ছা তোমার সংস্কৃত আসে না?
আসে, তবে ইংরিজির মতো নয়। ইংরিজিতে বেশ মোলায়েম করে গালাগাল দেওয়া যায়।
তুমি কি তা হলে এতক্ষণ গালাগাল দিচ্ছিলে?
কুচো নিমকি আর চা দিয়ে স্টার্ট করা যাক। কী বলেন?
ওঃ ফাসক্লাস! কালোজিরে দেওয়া?
হ্যাঁ পূর্ণাঙ্গ জিনিস।
নাতিটা ডালবড়া।
পিতৃদেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। দাদু আমার দিকে তাকিয়ে ছেলেমানুষের মতো হেসে বললেন, কী বুঝছ পাস্তুরানি?
বেশ জমেছে।
এরকম জামাই তুমি ভূ-ভারতে পাবে না। আনন্দ, আনন্দ। আজ যেন আনন্দের হিল্লোল বইছে! বেটি কোন দিন যে কী করে দেয়! এই কাদাচ্ছে, এই হাসাচ্ছে! এই রাজবেশ, এই কৌপীন। এই মহাভোজ, এই উপবাস।
তবে সেই সে পরমানন্দ
যে জন পরমানন্দময়ীরে
জানে
সে জন না যায় তীর্থ পর্যটনে।
খুব জোর গান ধরেছিলেন। বিভোর ভাব। গায়ে হাফহাতা পাঞ্জাবি। পইতেটি সামান্য বেরিয়ে আছে।
দরজায় পিতৃদেবের মুখ দেখা গেল, স্টপ স্টপ, পরমানন্দময়ী হরিমটর ছাড়া আর কিছুর ব্যবস্থা রাখেন না, উঠে পড়ুন। এখন আর মিউজিক নয়, মাসলসের খেলা চলবে। বাটনা বাটতে পারেন?
ভাবজগৎ থেকে দমাস করে বাস্তবজগতে আছাড় খেয়ে মাতামহ কেমন যেন হয়ে গেলেন। তবু হাসি-হাসি মুখে বললেন, ওই শিলে ফেলে নোড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে তারপর গড়াগড়ি করে। মাখামাখির ব্যাপার তো! জীবজগতে অহরহ যা চলছে? আহা, জাতা ঘুরতে দেখে কবীর দাস একদিন কেঁদে ফেলেছিলেন। তার দুটো ফাটার মধ্যে পড়লে কেউ কি অক্ষত থাকবে রে ভাই,
চলতি চক্তি দেখিকে দিয়া
কবীরা রোয়
দুই পট ভিতর আয়কে সবিত গয়ান
কোয়।
এ আপনার জাঁতাকলে জীবজগত নয়। হলুদের কথা হচ্ছে। চলে আসুন। চা ছাকতে পারেন?
তা আর পারব না! কিন্তু তুমি যে বললে সেই কালোজিরে দেওয়া কুচো নিমকির কথা! ভুলে গেলে নাকি?
আপনার ওই পরমানন্দময়ীর জগৎ ছেড়ে বেরোতে পারলেই সর্বপ্রকার জীবানন্দ পাবেন।
তুমি বড় নাস্তিক হে হরিশঙ্কর, কিছুতেই তোমার বিশ্বাস আসে না!
আমি কালাপাহাড়; বলে পিতাঠাকুর অদৃশ্য হলেন। মাতামহ গেলেন চা ছাঁকতে।
সেই কুচো নিমকি আছে আলমারিতে। আংটায় ঝুলছে সাত লিভারের থান্ডার লক। বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিনি। পিতার অফিসের বন্ধুর স্ত্রী এক জার আমের মোরব্বা করে পাঠিয়েছিলেন। ফিনকি ফিনকি করে কাটা, কিসমিস টিসমিস দেওয়া বড় সুস্বাদু বস্তু। রাতে একটু চাখার পর স্বভাবটা কেমন যেন বেড়ালের মতো হয়ে গেল। হেঁক ছোঁক করে মরি। কোনও কাজেই মন বসে না। ঘুরি ফিরি আমের মোরব্বা। সেই কথামৃতের কথা: ঘুরছে ফিরছে, রান্না করছে, চুল বাঁধছে, মন পড়ে আছে উপপতির দিকে। দুপুরের দিকে একবারই একটু নিয়েছিলুম। বেশি না, চামচে দু’-এক। ধরা পড়লুম রাতে। মোরব্বার ওপর তখন বিদিগিচ্ছিরি রুটি আর কুমড়োর ছক্কা চেপে বসেছে। মোরব্বার জারে কোথায় একটা কী চিহ্নফিহ্ন করা ছিল। খুলতেই তিনি স্থানচ্যুত হবেন। জাগতিক দিক থেকে ব্যাপারটা খুবই সামান্য; কিন্তু নৈতিক দিক থেকে অসামান্য।
তুমি নিয়েছ?
যথারীতি উত্তর, আজ্ঞে না তো।
আজ্ঞে না-তো-ও-ও!
আজ্ঞে হ্যাঁ। একটুখানি। এই এতটুকু।
মুখ যতদূর সম্ভব কাচুমাচু। সামনে আয়না থাকলে ছিঁচকে চোরের মতোই দেখাত। মাথায় বাবরি, অথচ চোর। সেই পাড়ার প্রসন্নদার মতো। গগলস পরে অফিসের টাইপরাইটার চুরি করেছিল। সুট আর ঝকঝকে জুতো, চোখে রঙিন চশমা, এদিকে কোমরে কাছি বাঁধা। শ্রীঘরে চলেছে বড় রাস্তা দিয়ে। সামনে পেছনে দুই সেপাই চলেছে হেলেদুলে, খইনি মলতে মলতে। একই তো ব্যাপার। বললে, কাঁপতেন চুরি করে মরেছে। পিতৃদেব বলবেন, ব্যাটার মাথায় চাচরঅ চিকুরঅ এদিকে মোরব্বা চুরি করে মরেছে। কদমছাট কি ন্যাড়া চোরে সহ্য হয়। ননিচোরা কৃষ্ণকে দেবতা বলে রেসপেক্ট করা চলে, বস্ত্রহরণ, বাঁশি বাজন, রাধাভিসার, ক্ষমণীয় অপরাধ কারণ তিনি এক গীতাতেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে চিতপাত করে দিয়েছেন। তুমি বাছা কী করেছ! কিন্তু কেমন করে। ধরলেন?
কী করে ধরলুম! আমি শার্লক হোমসের বাবা। ঢাকনাটা শেষ প্যাঁচে এনেও আমি আরও একটু চাপ দিয়ে মোক্ষম বাঁধনে বেঁধেছিলুম। যাতে খোলার সময় বেশ একটু বেগ পেতে হয়। লক্ষ করেছিলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশ কোস্তাকুস্তি করেই খুলতে হয়েছিল।
হোমস বলছেন, অপরাধী অপরাধের জায়গায় সূত্র রেখে যাবেই। তুমি কী করলে, ঢাকনাটা লাগালে তোমার ক্ষীণজীবী শরীরের দুর্বল হাতে। পার্ফেক্ট ক্রিমিন্যাল পৃথিবীতে আজও জন্মায়নি। পিন্টু। পার্ফেক্ট সাধু কিন্তু জন্মেছেন; কারণ সতের পথ সোজা। ঈশ্বরের দিকে যেতে চাইলে তিনি হাত ধরে টেনে নেন। স্বর্গে জায়গা পাওয়া সহজ, নরক গুলজার, সেখানে লাইন দিতে হয়। তা হলে! সেই লোভ, যে-লোভ তোমাকে ভ্রষ্ট করেছে, সেই লোভের কাছে এই আহুতি।
যজ্ঞে আহুতি দেবার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে পিতৃদেব পুত্রের সামনে নতজানু। সময় মধ্যরাত। বাইরে বসন্তের উতলা বাতাস। সিংহমশাইয়ের চায়ের দোকানের সামনে কাঁচি দিয়ে ভুলোর ন্যাজ ছাটা হচ্ছে। আর্ত চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ। আর্য ঋষির মতো তিনি বলছেন, পিন্টুর লোভ প্রজ্জ্বলিত হও, মোরব্বাকে দহন করে চিরকালের জন্যে প্রশমিত হও।
সামনে থেকে সরে যাবার উপায় নেই। পায়ের গোছ চেপে ধরে আছেন। খেতে হবে, পুরোটাই তোমাকে খেতে হবে। খেয়ে অসুস্থ হলে আমি বিধান রায়কে ডেকে আনব। হেলা চরিত্র চাই না, চাই খাড়া, স্ট্রেট লাইক পাইন নিড়ল।
সে স্মৃতি কি ভোলা যায়! ওয়াটার্লর যুদ্ধের মতো। মাতালের অত্যাচারে ভুলো শেষ। তবু এখনও কুকুর কঁদলে মোরব্বার কথা মনে পড়ে। চরিত্রও পালটেছে। লোভ আছে, অভিমানে চাপা। খেতে হলে নিজের রোজগারে, নয়তো আকাশবৃত্তি। মাতামহ বলেন, অজগরবৃত্তি। হা করে পড়ে থাকবি। মুখের সামনে এলে গিলে খাবি, আবার চোখ উলটে পড়ে থাকবি।
ঠ্যান করে কী একটা পড়ল ওপাশে। পিতাঠাকুরের কিঞ্চিৎ উত্তেজিত গলা শোনা গেল, যাঃ, সব ফেললেন তো। নিন সরুন। খুব হয়েছে। এত কম সাধারণ বুদ্ধি নিয়ে বেঁচে থাকা যায়! পৃথিবীর সব ধেড়ে ধেড়ে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী লোপাট হয়ে গেল। ধূর্ত শৃগাল কিন্তু ঠিক আছে।
মাতামহের অসহায় গলা, কেটলির ঢাকনাটা যে ফট করে খুলে যাবে, বুঝতে পারিনি হরিশঙ্কর!
ধীরে ধীরে উঠে গেলুম। তখন থেকে বড়ই অপদস্থ হচ্ছেন। যে-মানুষটির পাল্লায় পড়েছেন তাকে চেনা অত সহজ নয়। চা-পাতা সমেত একগাদা লিকার মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে। কেটলি থেকে চা কার অভ্যাস না থাকলে ঢাকনা এইভাবেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
আমি একটু সাহায্য করতে পারি?
চায়ের কাপে চিনি গুলতে গুলতে পিতা বললেন, তুমি? তুমি যে উঠে এত দূর আসতে পেরেছ, এই তো যথেষ্ট। ব্র্যাভো ব্র্যাভো বলে হাততালি দেওয়া উচিত। তুমি তো সামান্যেই কাতর!
একটু আগের তিরস্কার ভুলে মাতামহ আমার পক্ষ নিলেন, পেটের অসুখে মানুষ বড় দুর্বল হয়ে পড়ে হরিশঙ্কর। তা ছাড়া ও তো এমনিই একটু কাহিল।
তবে শুনবেন? চায়ের কাপ ঠেলে দিয়ে পিতা চললেন অন্যের বীরত্বের কাহিনিতে। বীরের সংখ্যা তত কম নয়। কৃতি পুরুষেরও ছড়াছড়ি। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রচণ্ড যড়যন্ত্র চলেছে আমাকে আরও আরও হেয় করার জন্যে। কেউ ট্রাইপস পাচ্ছে, কেউ র্যাংলার হচ্ছে, কেউ ছ’টা লেটার পেয়ে আজীবন স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে নিচ্ছে, কেউ এফ আর সি এস হয়ে এসে ক্যাচক্যাচ মানুষ কাটছে, বড়দিদার মতো গুনছুঁচ দিয়ে পেট সেলাই করছে, কেউ এভারেস্টের মাথায় উঠে পতাকা জাপটে ধরে স্টাইলে ছবি তুলছে।
দাদু ফড়ড় করে চায়ে চুমুক দিতেই পিতৃদেবের ভুরু কুঁচকে গেল। পদার্থবিদ্যায় পড়েছিলুম, এভরি অ্যাকশন হ্যাঁজ ইকোয়াল, অ্যান্ড অপোসিট রিঅ্যাকশন। ফড়ড় মানেই এক ধরনের গ্রাম্যতা। চিনের চা, পরিবেশন করতে হবে জাপানি কায়দায়, খেতে হবে বিলিতি প্রথায়। এতটুকু শব্দ হবে না। চুক করে টেনে নিয়ে, সুড়ত করে গিলে ফেলা। গলকম্বল উঠল আর নামল। ইতিমধ্যে মাতামহ আর একটি দুর্ধর্ষ চুমুক মেরেছেন, ফড়ফড় ফড়াক করে। ভুরুতে এবার একাধিক ভাজ। মাতামহের চোখে পড়েছে। ধরতে পারলেন না ব্যাপারটা কী! অতি সরল প্রশ্ন, কী, মাথা ধবছে হবিশঙ্কর?
আজ্ঞে না, মাথা আমার ধরে না, অম্বল আমার হয় না। আমি শুধু ভাবছি, মানুষ কীরকম খাল কেটে কুমির আনে, ঝাড় কেটে বাঁশ আনে।
তা যা বলেছ? খাল বেয়ে অবশ্য মাছও আসে, রুই, কাতলা, মৃগেল। তোমার কুমির কোন দিক দিয়ে এল হরিশঙ্কর?
এবার বেশ খেলানো চুমকি। একতলা, তিনতলা।
পিতৃদেব বললেন, সামনের দরজা দিয়েই এল।
সে কুমির এখন কোথায়? মাতামহ নিমকি চিবোতে চিবোত প্রশ্ন করলেন।
আমার সামনে।
কী জানি বাবা, আমাকে বলছ না তো!
হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। চা খাচ্ছেন বেনারসের বিধবাদের মতো। চা খেতে অত শব্দ করেন– কেন?
মাতামহ হাঁ হয়ে গেলেন। হাতের নিমকি হাতে, চায়ের কাপ প্লেটে। ছেলেমানুষ বকুনি খেলে যেরকম মুখ হয় ঠিক সেই মুখে তাকিয়ে আছেন। ভয়ে কাপের দিকে আর হাত বাড়াচ্ছেন না। খেতে গেলে আবার যদি শব্দ হয়।
এই দেখুন আমার চুমুক। এক চুমুক চা টেনে নিলেন। কোনও শব্দ হল?
মাতামহ ঘাড় নাড়লেন নিঃশব্দে।
নিন, কাপ ওঠান, চেষ্টা করুন। এমন কিছু শক্ত নয়।
মাতামহ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। হাত আর কাপের দিকে এগোবার সাহস পাচ্ছে না।
কী হল? চেষ্টা করুন। যা দশে শেখেননি, তা ষাটে শিখুন।
আমি আর চা খেতে চাই না হরিশঙ্কর।
চোখের কোণদুটো ছলছলে। আলগা মুঠো থেকে মেঝেতে নিমকি খসে পড়ল। এতক্ষণ নিমকি নিমকি করে লাফাচ্ছিলেন। সেই নিমকির ওপরও আর তেমন টান নেই। সব ছেড়ে উঠে পড়লেন। প্লেটে নিমকি, আধ কাপ চা।
পিতা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় চললেন?
যাই, কোথাও তো যেতে হবে। বেলা বেড়ে যাচ্ছে।
বসুন। বেশ আদেশের সুর।
কখন কী অসভ্যতা করে ফেলি হরিশঙ্কর! তোমার মতো লেখাপড়া শিখিনি, তেমন সহবতও জানি না। রেলের মাল গুদামের বড়বাবু ছিলুম এককালে, পয়সাও অনেক কামিয়েছি; কিন্তু তোমার সামনে বসার মতো সভ্যতা তো আমাকে কেউ শেখায়নি হরিশঙ্কর। ছেলে বলে, ওল্ড ফুল, তুমিও
তো আমার আর এক ছেলে, তোমার মুখেও সেই এক কথা,
যাবদ্বিত্তোপার্জন শক্ত-স্তাবন্নিজপরিবারো রক্তঃ।
পশ্চাদ্ধাবতি জর্জরদেহে, বার্তাং পৃচ্ছতি কোছপি ন গেহে ॥
যতদিন রোজগার ছিল, বোলবোলা ছিল, ততদিন রাজনারায়ণের খুব খাতির ছিল হে। এখন গতায়ু বৃদ্ধ, জরা এসে চেপে ধরেছে, এখন কে কার! ভুলেও কেউ একবার জিজ্ঞেস করে না, বুড়ো কেমন আছ?
অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডং দশনবিহীনং জাতং তুণ্ডম
বৃদ্ধা যাতি গৃহীত্বা দণ্ডং
বৃদ্ধ না কুত্র যাতি। পিতা হাত ধরে চেপে বসালেন। বসুন। অত অভিমান কীসের? সংসারে আপনার অভিমানের কে তোয়াক্কা করে! শঙ্করাচার্য পড়ে ঠোঁট ফোলাচ্ছেন? সাধনমার্গের দুটো পথ, জানেন তো? নেতি নেতি। ইতি ইতি। চায়ে চুমুক দিলে শব্দ হয়, অতএব চায়ে চুমুক দেব না, নেতির পথ। এমনভাবে চুমুক দেব শব্দ হবে না, এ হল ইতির পথ। নিন, স্টার্ট চুমুক, ওয়ান, টু, থ্রি।
মাতামহ উবু হয়ে বসে ছোট্ট একটু চুমুক ছাড়লেন ভয়ে ভয়ে। কী হরিশঙ্কর, কী বুঝলে?
পারফেক্ট। যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
মাঝারি ধরনের আর একটি চুমুক মেরে বললেন, এইবার?
শাবাশ!
নিমকির দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে টেনে নিলেন। মুখে নিমকি পড়লে যে একটু মুচমুচ শব্দ হবে।
মুচমুচ অ্যালাউ করা যায়, কারণ ওটা বস্তুর ধর্ম, কিন্তু তারপর যদি চ্যাকোর চ্যাকোর শব্দ হয় তখনই হবে অভ্যাস দোষ।
তা হলে থাক বাবা। দরকার নেই খেয়ে।
না না, ইতিবাচক সাধনা। খেয়ে প্রমাণ করতে হবে সিদ্ধপুরুষ।
মাতামহের ট্রেনিংপর্ব চলেছে। আমাকে উপলক্ষ করে সেই বীরত্বের কাহিনি ধামাচাপা রইল। সরে পড়াই ভাল। পিতার চোখ পড়ল এতক্ষণে, তুমি তা হলে কীভাবে সাহায্য করবে?
যেভাবে বলবেন!
যেভাবে বলব? বেশ, তা হলে একটা কর্মতালিকা তৈরি করা যাক। মুখুজ্যেমশাই হলুদ আর সরষে বাটার চেষ্টা করবেন আর যে-কোনও একটা পদ রাঁধবেন।
রান্না কি আমার আসবে হরিশঙ্কর?
বেঁধে প্রমাণ করতে হবে আপনি মহিলা নন, পুরুষ।
সে আবার কী কথা?
পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় রাঁধিয়েই হল পুরুষ, গঞ্জালেস, আবু বকর, স্টুয়ার্টলয়েড, আমাদের হালুইকর বিচিত্রবীর্য। সব পুরুষ। রান্নার জগতে মেয়েছেলের স্থান নেই। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি বাছবে চাল। তোমার ওই রমণীমোহন চাচর চিকুরে ওই মেয়েলি কর্মটিই ভাল মানাবে।
আহা, তুমি আবার ওকে নিয়ে পড়লে।
পড়ব না! চুল ছাড়া ওর আর আছে কী? ভেবেছে চুল দিয়ে নারীচিত্ত জয় করবে! কৃষ্ণের হাতে শুধু বাঁশি ছিল না, সুদর্শন চক্রও ছিল। বুকের পাটা চাই। হাতের গুলি চাই। এই দেখো, তোমার সামনে তোমার পিতা, তোমার মাতামহ। সব ছেচল্লিশ ইঞ্চি।
সব ভুলে পিতার পাশে দাঁড়িয়ে সিমুলিয়ার ব্যায়ামবীরের মতো মাতামহ হাতের গুলি দেখাতে লাগলেন।