এবারের এলেবেলে লেখা আমার ভাগ্নিকে নিয়ে। ওর ডাকনাম লীনা। ভালো নাম হানিফা খাতুন, আমার নানাজানের রাখা। মুরুব্বি মানুষের রাখা নাম, কাজেই হজম করতে হচ্ছে। যদিও বান্ধবীরা তাকে হানিফ সংকেত বলে ডাকা শুরু করেছে। বান্ধবীদেরও দোষ নেই। হানিফ সংকেতের সঙ্গে লীনার চেহারার কিছুটা মিল আছে।
লীনা এবার মেট্রিক পাস করেছে। যে বিষয়টি সে সবচেয়ে কম জানে (সাধারণ গণিত) তাতেই লেটার পেয়ে যাওয়ায় ঘাবড়ে গিয়েছিল। এখন সামলে উঠেছে।
মেট্রিক (থুক্ক, এখন তো আবার এসএসসি বলা নিয়ম) পাশ হওয়ার পরপরই সব মেয়ে খানিকটা আহ্লাদী হয়ে পড়ে। লীনার মধ্যে তা দেখা গেল। সে কথা বলতে লাগল টেনে টেনে এবং খানিকটা নাকি সুরে। আমি কড়া গলায় বললাম, কিরে, এমন টেনে টেনে কথা বলছিস কেন?
লীনা চোখ বড় বড় করে বলল, কখন টে-নে টেনে কথা বললাম?
এই তো বলছিস। ঠিকমতো কথা বল, নয়তো চড় খাবি।
দাও চড় দা-ও।
শোন লীনা, নাক দিয়ে কথা বলছিস ব্যাপারটা কী? নাক নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্যে। কথা বলার জন্যে না। সর্দি লাগলে কী করবি? তখন তো কথা বলা বন্ধ হয়ে যাবে। মুখে কথা বলার অভ্যাসটা বজায় রাখ।
লীনা খানিকক্ষণ মূর্তির মতো বসে রইল, তারপর হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। ঘটনাটি সকালবেলার। সারা দিনে বাড়িতে কী ঘটেছে আমি জানি না। একটা কাজে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম। রাত আটটায় বাড়ি ফিরেই শুনলাম লীনা এক বোতল ডেটল খেয়ে ফেলেছে। তাকে নেওয়া হয়েছে হাসপাতালে। ডাক্তাররা স্টমাক ওয়াস করাচ্ছেন। এত খাওয়ার জিনিস থাকতে সে এক বোতল ডেটল কেন খেল জিজ্ঞেস করায় সে বলেছে–বড়মামা আমাকে ইনসাল্ট করেছে, এইজন্যে খেয়েছি। আমি বাঁচতে চাই না। মরতে চাই।
এই হচ্ছে এ যুগের সুপার সেনসিটিভ বালিকাদের একটি নমুনা। আমাদের পাশের ফ্লাটের স্বাতীর কথা বলি। বংশীবাজার কলেজে পড়ে। মাথাভর্তি চুল। খোঁপা খুলে দিলে চুলের গোছা হাঁটু ছেড়ে নিচে নেমে যায়। একদিন তার মা বললেন, কিরে তুই সবসময় চুল এমন এলোমেলো করে রাখিস, খেপা করে রাখতে পারিস না?
স্বাতী গনগনে মুখে বলল, লম্বা চুল অসহ্য। ভাল্লাগে না।
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, এত অসহ্য হলে কেটে ছোট কর, কিন্তু পাগলির মতো থাকিস না।
স্বাতী তৎক্ষণাৎ নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে তার বাবার শেভিং রেজার দিয়ে মাথা কামিয়ে ফেলল। তারপর আয়নায় নিজের মূর্তি দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে বাঁ হাতের হাড় ভেঙে ফেলল।
স্বাতীর চুল এখন খানিকটা বড় হয়েছে। ছোট ছোট চুলেও তাকে ভালোই দেখায়, কিন্তু আমাদের পাড়ার সমস্ত বালক-বালিকা তাকে ডাকে কোজাক আপা। এই নাম তার কোনোদিন ঘুচবে, এমন মনে হয় না।
আমার বন্ধু মিসির আলী সাহেবের গল্পটা বলি। মিসির আলী সাহেব থাকেন নিউ এ্যালিফেন্ট রোডে। গত শীতের ঘটনা। তিনি ঘরে বসে টিভিতে নবীন শিল্পীদের গানের অনুষ্ঠান দেখছেন। এমন সময় দরজার কড়া নড়ল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, পনেরো-ষোল বছরের ম্যাক্সিপরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, কাকে চাও মা?
মেয়েটি সরু গলায় বলল, আপনাদের কি কোনো কাজের লোক লাগবে?
তোমার কথা বুঝতে পারছি না। কিসের কাজের লোক।
আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি। এখন আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাব। আমাকে রাখবেন?
বাড়িতে ঝগড়া হয়েছে?
হ্যাঁ, ড্যাডি আমাকে বকা দিয়েছে।
এসো, ভিতরে এসে বসো। দেখি কী করা যায়।
মেয়েটি খুব সহজেই ভেতরে এসে বসল। নিজেই ফ্রিজ খুলে কোকের বোতল বের করল। সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সোফায় পা তুলে টিভি দেখতে লাগল। মিসির আলী সাহেবের স্ত্রী নিউমার্কেট থেকে রাত আটটায় বাড়ি ফিরে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন। ষোল বছরের একটি অপরিচিত মেয়ে সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে। তার দৃষ্টি টিভিতে নিবদ্ধ। মাঝে মাঝে কোকের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। মিসির আলী পাগলের মতো একের পর এক টেলিফোন করে যাচ্ছেন। মেয়েটি কোত্থেকে এসেছে, কী, কোনোই হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ে নির্বিকার। দিব্যি পা নাচাচ্ছে। মিসির আলী সাহেবের স্ত্রীকে এক ফাঁকে শুধু বলল, আন্টি, ডিনারে কী রান্না হয়েছে? আমি কিন্তু ঝাল কম খাই।
দিনকাল পাল্টে গেছে–এ কথাটি সবার মুখেই শোনা যায়, কিন্তু কী পরিমাণ পাল্টেছে তা বলতে পারেন টিনএজদের বাবা-মা। আমার মামাতো বোন বিনুর কথাটা বলি। টিনএজ বলা ঠিক হবে না, অনার্স ফাইনাল দিয়েছে। একদিন দেরি করে বাসায় ফিরল। মেয়ের মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন–দুই কানেই নানা জায়গায় ফুটো করা হয়েছে। কান দুটি দেখাচ্ছে মুরব্বার মতো। তিনচার জায়গায় ফুটো করে গয়না পরাই নাকি এখনকার স্টাইল।
গত রমজানের ঈদে তার সঙ্গে আমার দেখা। কানের বিভিন্ন জায়গা থেকে গয়না ঝুলছে। (দুল না বলে গয়না বলছি, কারণ যেসব জিনিস ঝুলছে তার কোনোটাকেই দুলের মতো লাগছে না। একটি দেখতে ঘণ্টার মতো, তার ভেতর থেকে কালো সূতা বের হয়ে এসেছে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে বিনু বলল, এরকম করে তাকিয়ো না ভাইয়া, চারটা করে ফুটো করা এখনকার স্টাইল; আমি মোটে তিনটে করিয়েছি।
আমি বিস্ময় গোপন করে বললাম, স্টাইল যখন উঠে যাবে তখন তুই কী করবি? ফুটো বন্ধ করবি কীভাবে?
বিন বড়ই বিরক্ত হলো। কিন্তু সে জানে না বাংলাদেশে চোখধাঁধানো স্টাইল কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এটিও হবে না। বাড়তি ফুটো নিয়ে মেয়েগুলি বড়ই অশান্তিতে পড়বে। কিংবা কে জানে হয়তো এখনি পড়েছে। মাথার চুল দিয়ে কান ঢেকে রাখতে হচ্ছে।
লেখা শেষ করার আগে আবার আমার ভাগ্নির কাছে ফিরে যাচ্ছি। তার ডেটল ভক্ষণের পর থেকে সবার আচার-আচরণে একটা পরিবর্তন হলো। সে যা বলে সবাই তা-ই শোনে। সেনসেটিভ মেয়ে, আবার যদি কোনো কাণ্ডটাও করে বসে। তার এবং তার মায়ের কথাবার্তার কিছু নমুনা দিচ্ছি।
মেয়ে : আজ আমি কলেজে যাব না।
মা : ঠিক আছে মা, যেতে হবে না।
মেয়ে : আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে? আমি এখন থেকে সাইকেলে করে কলেজে যাব।
মা : বিকেলে নিউমার্কেটে গিয়ে কিনে নিস। তোর বাবাকে বলে দেব।
বাসার অবস্থাটা বোঝানোর জন্যে এই ডায়ালগ কটিই যথেষ্ট। গত বুধবারে গিয়েছি, ওদের ওখানে দেখি এক বখা ছেলে ড্রইংরুমে বসে আছে। ছোকরার গেঞ্জিতে লেখা পুশ মি। তার হাতে সিগারেট। সে সিগারেট টানছে দম দেওয়ার ভঙ্গিতে। ঘর ধোয়ায় অন্ধকার।
আমি আপাকে বললাম, ওই চিজটা কে?
আপা গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ও লীনার একজন চেনা ছেলে। তুই লীনাকে কিছু বলিস না। সেনসেটিভ মেয়ে কী করতে কী করে বসবে। আমি ভয়ে ভয়ে থাকি।
আমি কিছুই বললাম না। গুম হয়ে বারান্দায় বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরই উজ্জ্বল চোখে লীনা ঢুকল। হাতটাত নেড়ে বলল, মামা, কী কাণ্ড হয়েছে দেখে যাও। সবুজ একটা চিরুনি দিয়ে তার দাড়িতে আঁচড় দিতেই তেরটা উকুন পড়েছে। এদের মধ্যে চারটা লাল রঙের। প্লিজ মামা, দেখে যাও।
আমি কঠিন মুখে বসে রইলাম। আপা মৃদুস্বরে বলল, যা দেখে আয়। এত করে বলছে। সেনসেটিভ মেয়ে।
আমি দেখতে গেলাম। টেবিলের ওপর একটা সাদা কাগজ। সেখানে সত্যি সত্যি তেরটা মিডিয়াম সাইজের উকুন। কয়েকটির পেট লালাভ।
সবুজ আমাকে দেখে দাঁত বের করে বলল, মামার কাছে সিগ্রেট আছে? আই এ্যাম রানিং শর্ট।