1 of 2

১.০১. প্রথম পরিচ্ছেদ – আলোকে

প্রথম খণ্ড

নিয়তি – লীলাক্ষেত্র

Cas. Vengeance, lie still, thy cravings shall be stated
Death roams at large, the furies are unchain’d,
and murder plays her mighty master-piece.
Nathaniel Lee-Alexander-The Great, Act. V. Scene II.

প্রথম পরিচ্ছেদ

আলোকে

রাত দুইটা বাজিয়া গিয়াছে । এখনও প্রসিদ্ধ ধনী রাজাব-আলীর বহির্ব্বাটীর বিস্তৃত প্রাঙ্গন সহস্র দীপালোকে উজ্জ্বল । সেই আলোকোজ্জ্বল সুসজ্জিত প্রাঙ্গনে নানালঙ্কারে সুসজ্জিতা, সুবেশা, সুস্বরা নর্ত্তকী গায়িতেছে – নাচিতেছে – ঘুরিতেছে – ফিরিতেছে – উঠিতেছে – বসিতেছে, উপস্থিত সহস্র ব্যক্তির মন মোহিতেছে । তাহার উন্নত বঙ্কিম গ্রীবার কত রকম ভঙ্গি, নয়নের কত রকম ভঙ্গি, মুখের কত রকম ভঙ্গি, হাত নাড়িবার কত রকম ভঙ্গি, পা ফেলিবারই বা কত রকম ভঙ্গি ! তন্ময় হৃদয়ে সকলে তাহার দিকে চাহিয়া আছে আর শুনিতেছে –

“সেইঞা যাও যাও যাও, নেহি বোল জবান্ ।
ইতনী বাত মোরি মান্ ।
ভোর ভেইয়া রে, যাওয়ে যাঁহু রহে;
তেরা পাঁও পড়ি, মেরি জান্ ।”

বীণানিক্কণবৎ কণ্ঠ কি মধুর ! সেই মধুর কণ্ঠে কি মধুরতর তান ধরিয়াছে – বেহাগের সুমিষ্ট আলাপ ! মীড়, গমকে, মুর্চ্ছণায়, গিট্কারীতে, উদারা মুদারা তারা তিনগ্রামে, প্রক্ষেপে ও বিক্ষেপে ষড়জ রেখাব, গান্ধার পঞ্চম, ধৈবত প্রভৃতি সপ্তস্বরে সেই মধুর কণ্ঠ কি অনাস্বাদিত্পূর্ব্ব পীযূষধারা বর্ষণ করিতেছে !

প্রাঙ্গন সুন্দররূপে সজ্জিত । ঊর্ধ্বে বহু শাখাবিশিষ্ট ঝাড় ঝুলিতেছে তাহাতে অগন্য দীপমালা । লাল, নীল, পীত, শ্বেত – বর্ণবিচিত্র পতাকাশ্রেণী । নিম্নে বহুমূল্য গালিচা বিস্তৃত, রজত-নির্ম্মিত আতরদান গোলাপপাশ, আল্বোলা, শট্কা এবং তাম্বুল-এলাচপূর্ণ রজত্পাত্রের ছড়াছড়ি । চারিপার্শে গৃহ-প্রাচীরে দেয়ালগিরি, তাহাতে অসংখ্য দীপ জ্বলিতেছে । অলিন্দে অলিন্দে – লাল, নীল, সবুজ, জরদ বিবিধ বর্ণের স্ফটিক-গোলক্মালা দুলিতেছে, তন্মধ্যস্থিত দীপশিখা বিবিধ বর্ণে আলোক বিকীর্ণ করিতেছে । স্তম্ভে স্তম্ভে দেবদারুপত্র, চিত্র, পতাকা ও পুষ্পমাল্য শোভা পাইতেছে । আলোকে-পুলোকে সকলেই উজ্জ্বলতর দেখাইতেছে । উর্দ্ধে, নিম্নে, মধ্যে, পার্শ্বে সহস্র দীপ জ্বলিতেছে । সেই উজ্জ্বল আলোকে বাইজীর সল্মার্ কাজ করা ওড়্না এক-একবার ঝক্মক্ করিয়া জ্বলিতেছে । ঈষন্মুক্ত বাতায়নগুলির পার্শ্বে সুন্দরীদিগের অসংখ্য উজ্জ্বল কৃষ্ণচক্ষুঃ তদধিক জ্বলিতেছে । কেহ কেহ বা সেই উজ্জ্বল চক্ষুঃ বারেক দৃষ্টি করিয়া অন্তরে তদধিক জ্বলিতেছে ।

আসরে নর্ত্তকী গায়িতেছে । নর্ত্তকীর নাম গুলজার-মহল । গুলজার-মহল কলিকাতার প্রসিদ্ধ বাইজী । তাহার গান শুনিতে চৌধুরী সাহেবের বাড়ীতে লোক ধরে না – শ্রোতৃবর্গে প্রাঙ্গণ ভরিয়া গিয়াছে । পুষ্প, পুষ্পস্তবক ও পুষ্পমাল্যে আসর ভরিয়া গিয়াছে । আতর গোলাপজল ও ফুলের গন্ধে আসর ভরিয়া গিয়াছে । সুবাসিত অম্বুরী তামাকের ধূমে ও গন্ধে আসর ভরিয়া গিয়াছে । সুরঙ্গম বাদ্যে আসর ভরিয়া গিয়াছে । আর নর্ত্তকীর সেই দীর্ঘায়ত কজ্জ্বলরেখাঙ্কিত নেত্রের বিদ্যুচ্চকিত কটাক্ষে, রত্নাভরাণোজ্জ্বল লাবণ্যবিকসিত দেহের ললিত কোমল ভঙ্গিতে প্রাঙ্গণবর্ত্তী শ্রোতৃমাত্রেরই হৃদয় ভরিয়া গিয়াছে । রাজাব-আলীর সেই আলোকিত, গীতবাদ্যবিক্ষুব্দ্ধ প্রমোদমদিরোচ্ছ্বসিত জমাট্ আসর ত্যাগ করিয়া কেহ উঠিতেছে না, কেহ উঠিব উঠিব মনে করিয়াও উঠিতে পারিতেছে না, কাহারও না-উঠিলে নয় – তথাপি উঠিতে পারিতেছে না ।
কেবল একজন যুবক বড় অন্যমনষ্ক; কিছুতেই তার মন স্থির হইতে চাহিতেছে না । যুবক আসর ত্যাগ করিয়া উঠিল । তাহাকে উঠিতে দেখিয়া রাজব-আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুজাত-আলি গিয়া তাহার হাত ধরিল, কহিল, “এখনই উঠিলে যে ?”
যুবকের নাম মোবারক-উদ্দীন । মোবারক-উদ্দীন কহিল, “রাত দুইটা বাজিয়া গিয়াছে ।”
সুজাত-আলি হাসিয়া বলিল, “তাহা হইলেও আরও দুই-একটা গান শুনিবার সময় আছে । অমৃতে অরুচি কেন ? গান ভাল লাগিতেছে না ?”
p;    মোবারক হাসিয়া বলিল, “না,বেশ গায়িতেছে ।”
উভয়ে বহিদ্বারে গিয়া দাঁড়াইল ।
সুজাত বলিল, “বেশ গায়িলে আর উঠিতে চাও ? গুলজার-মহল বাইজীর গান বুঝি তোমার ভাল লাগে না ?”
মোবারক কহিল, “এমন লোক দেখিনা গুলজার-মহল বাইজীর গান যাহার ভাল না লাগে । বিশেষতঃ আজ গুলজার-মহল আসর একেবারে গুল্জার করিয়া তুলিয়াছে । আসরে অনেক বড় লোক আসিয়া বসিয়াছে, নাচগানে গুলজার মহলের আজ নিজের উৎসাহও খুব দেখিতেছি ।”
সুজাত কহিল, “উৎসাহের আরও অনেক কারণ আছে । আমাদিগের সঙ্গে পাঁচ শত টাকা চুক্তি হইয়াছে । তা ছাড়া মুন্সী জোহিরুদ্দীন মল্লিকের স্ত্রী নিমন্ত্রণে আসিয়াছিলেন ; তাঁহার সঙ্গে নাজিব-উদ্দীন চৌধুরীর কন্যা জোহেরাও আসিয়াছিল । তাঁহারা দুইজনে গান শুনিয়া বাইজীকে দুইটী হীরার আংটি বখশিস্ দিয়া গিয়াছে ।”
কিছু বিস্মিত হইয়া মোবারক কহিল, “মুন্সী জোহিরুদ্দীন বুড়া বয়সে আবার বিবাহ করিয়াছেন না কি ?”
সুজাত কহিল, “টেক্কা রকমের বিবাহ করিয়াছেন ! স্ত্রীটি খুব সুন্দরী-যেমন গায়ের রং, তেমনি সুন্দর মুখ-ভাসা ভাস চোখ-যেন পরী । কিন্তু স্বভাবের কিছু দোষ আছে-গর্ব্বিতা ।”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “কাহার মেয়ে ?”
সুজাত কহিল, “তা ঠিক বলিতে পারি না । কোন গরীবের ঘরের মেয়ে হইবে । সন্ধান করিয়া করিয়া এতদিনের পর সহসা মুন্সী সাহেব কোথা হইতে এ রত্ন কুড়াইয়া আনিয়াছেন কেহ জানে না । জোহিরুদ্দীন সুন্দরী স্ত্রীর একান্ত বশীভূত হইয়া পড়িয়াছেন ; একবারও স্ত্রীকে চোখের অন্তরাল করেন না । কোন কাজে আজ তিনি কলিকাতায় গিয়াছেন ; নতুবা আজ গুলজার-মহলের আংটি লাভে সন্দেহ ছিল ।”
মোবারক বলিল, ” তাহা হইলে উভয়ের মধ্যে প্রণয়ও খুব জমিয়াছে ।”
সুজাত হাসিয়া কহিল, ” একদিকে খুব জমিয়াছে ; কিন্তু বৃদ্ধের নবীনা স্ত্রী বিবাহে সচরাচর যাহা ঘটিয়া থাকে, তাহাই ঘটিয়াছে । সৃজান বিবির স্বভাবের কিছু দোষ আছে । ইহারই মধ্যে তাহার একটা নিন্দাপবাদও বাহির হইতে আরম্ভ হইয়াছে । শুনিয়াছি, স্বভাবটা ভাল নহে – মনিরুদ্দীনের উপরেই নাকি তাহার নজরটা পড়িয়াছে ।”
মোবারক বিস্মিত হইয়া কহিল, “মনিরুদ্দীন ইহার ভিতরে আছে ? জোহেরার সহিত তাহার বিবাহ হইবার কথা ছিল না ? জোহেরা ইহা শুনে নাই ?”
সুজাত কহিল, “আমার শুনিয়াছি, আর জোহেরা শুনে নাই ? জোহেরার তাহাতে বড় কিছু আসে যায় না । জোহেরা ভাল রকম লেখাপড়া শিখিয়াছে, জ্ঞান-বুদ্ধি বেশ হইয়াছে, সে কি বড়লোকের ছেলে বলিয়া মদ্যপ দুশ্চরিত্র মনিরুদ্দীনকে বিবাহ করিবে ? জোহেরা বরং মনিরুদ্দীনকে ঘৃণার চোখেই দেখিয়া থাকে । আর জোহেরার অর্থের অভাবই বা কি ? তাহার বিস্তৃত জমিদারীর মাসিক পঁচিশ হাজার টাকা আয় । দুই বৎসর পরে সাবালিকা হইলে সে তাহার অতুল বিষয়ৈশ্বর্য্যের অধিকার পাইবে ; তখন নায়েব জোহেরুদ্দীনকে তাহার সমুদয় বিষয় বুঝাইয়া দিতে হইবে । জোহেরার ইচ্ছা, মজিদের সহিত তাহার বিবাহ হয় ; কিন্তু অভিভাবক জোহিরুদ্দীনের সেরূপ ইচ্ছা নহে ; তিনি মোনিরুদ্দীনের সহিত জোহেরার বিবাহ দিতে চাহেন । জোহিরুদ্দীনের ইচ্ছা কার্যে পরিণত হইবার কোন সম্ভাবনা দেখিনা – আর দুই বৎসর পরে জোহেরাকে জোহিরুদ্দীনের মুখ চাহিয়া থাকিতে হইবে না ; তখন সে নিজের মতে চলিতে পারিবে । জোহেরা-রত্নলাভ মজিদের কপালেই আছে । আর আমরা যতটা জানি, মজিদ নিজে লোকটা ভাল । স্বভাব-চরিত্রে কোন দোষ নাই – বিশেষতঃ খুব পরোপকারী ; ঈশ্বর অবশ্যই মজিদের কপাল সুপ্রসন্ন করিবেন ।”
তখন ভিতরে গুলজার-মহল গায়িতেছে; –
“পিয়ালা মুজে ভ’রে দে
আবনু আবত মাতোয়ারা, তু তো লেয়েলি – ”
মোবারক কহিল, ” আমি মজিদকে খুব জানি । তাহার সহিত আমার খুব আলাপ আছে । লোকটা লেখাপড়াও বেশ শিখিয়াছে ; কিন্তু কিছুতেই অদ্যাপি অবস্থার উন্নতি করিতে পারিল না ”
সুজাত কহিল, “উপার্জ্জনটা অদৃষ্টক্রমেই হইয়া থাকে । যাহা-হউক, মজিদের অদৃষ্টে যদি জোহেরা-লাভ ঘটে, তখন আর তাহার উপার্জ্জনের কিছুমাত্র আবশ্যকতা থাকিবে না । জোহেরার অগাধ বিষয়-অগাধ আয় । হয়ত আবার মোনিরুদ্দীনের বিষয়টাও তাহার হাতে আসিতে পারে । মোনিরুদ্দীনের পিতা মজিদকে বাল্যকাল হইতে প্রতিপালন করেন ; নিজের যত্নে তাহাকে লেখাপড়া শিখান্ । তিনি মজিদকে নিজের পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন । যাহার মন ভাল, ঈশ্বর তাহার ভাল করেন – তা’ মানুষ । মজিদের মন ভাল, ঈশ্বর অবশ্যই তাহার ভাল করিবেন । মনিরুদ্দীনের পিতা মৃত্যুপূর্ব্বে উইল করিয়া গিয়াছেন যে, মোনিরুদ্দীনের অবর্ত্তমানে যদি তাঁহার পুত্রাদি কেহ উত্তরাধিকারী না থাকে, তাঁহার সমস্ত বিষয় মজিদই পাইবে । এখনও মজিদ মোনিরুদ্দীনের নিকট হইতে পঞ্চাশ টাকা মাসহারা পাইয়া থাকে । যত্দিন জীবিত থাকিবে, ততদিন এই মাসহারা পাইবে, উইলে এরূপ বন্দোবস্ত আছে ।”
মোবরক কহিল, “মোনিরুদ্দীন এখন বিবাহই করে নাই – ইহার পর বিবাহ করিবে – পুত্রাদি হইবে – সে অনেক দূরের কথা । অল্প বয়সে অগাধ বিষয় হাতে পাইয়া মোনিরুদ্দীন যেরূপ মাতাল হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে তাহাকে বোধ হয়, ততদূর অগ্রসর হইতে হইবে না । কোন্দিন বেজায় মদ খাইয়া, হ্ঠাৎ দম আট্কাইয়া মরিয়া থাকিবে । মনিরুদ্দীনের বিষয়ও বড় অল্প নহে ; পরে মজিদেরই ভোগে আসিবে, দেখিতেছি ।”
অনন্তর অন্যান্য দুই-একটি কথার পর মোবারক, সুজাত-আলির নিকটে বিদায় লইয়া তথা হইতে বাহির হইয়া পড়িল ।
মোবারক-উদ্দীন সুজাত-আলির বাল্যবন্ধু । শৈশবে উভয়ে একসঙ্গে খেলা করিয়াছে ; পঠদ্দশায় উভয়ে একসঙ্গে এক বিদ্যালয়ে পাঠ করিয়াছে । মোবারক এখন অর্থোপার্জ্জনের জন্য বিদেশে বাস করে ; কোন কাজে এক সপ্তাহমাত্র কলিকাতায় আসিয়াছে ; সংবাদ পাইয়া সুজাত তাহাকে অদ্য নিমন্ত্রণ করিয়াছিল ।

 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *