এভাবেও মেরে ফেলা যায়!
[পাকুড় হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার এম এল রহমান]
উফফ, কী একটা ফুটিয়ে দিয়ে চলে গেল!
পাঞ্জাবির হাতা ততক্ষণে গুটিয়ে ফেলেছেন বছর কুড়ির যুবক। পরীক্ষা করছেন ডান হাতের উপরের দিকের ক্ষতচিহ্ন। পিন ফোটালে যেমন হয়। জ্বালা করছে বেশ।
সে বহুকাল আগের কথা। বেলা আড়াইটে তখন। হাওড়া স্টেশনের গড়পড়তা দুপুর দ্রুত রওনা দিচ্ছে বিকেলের দিকে। ভারী ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে। ভিড়ে হাঁসফাঁস স্টেশন-চত্বর। যাত্রীদের লটবহর কাঁধে কুলিদের ‘থোড়া সাইড দিজিয়েগা ভাইসাব!’ মন ভাল বা খারাপ করে দেওয়া কু-ঝিকঝিক রেলগাড়ির। ইঞ্জিন থেকে চলকে ওঠা ধোঁয়া পাক খেতে খেতে ঊর্ধ্বমুখী। অমুক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে তমুক ট্রেন একটু পরেই পাড়ি দেবে গন্তব্যে, ঘোষণা মিনিটে মিনিটে।
সন ১৯৩৩। তারিখ ২৬ নভেম্বর। স্টেশনের চলতিফিরতি ভিড়ের নজর কাড়ছে পাকুড়ের জমিদারবাড়ির কনিষ্ঠ পুত্র অমরেন্দ্রচন্দ্র পান্ডের ঘরে ফেরার আয়োজন। পাত্রমিত্র-অমাত্যের দঙ্গল এসেছে স্টেশনে। ছোটখাটো শোভাযাত্রাই বলা চলে। অমরেন্দ্রর সঙ্গে যাবেন সহোদরা বনবালা। বিশেষ ঘনিষ্ঠ কমলাপ্রসাদ পান্ডে, অশোক প্রকাশ মিত্র এবং আরও অনেকে এসেছেন বন্ধুকে ছাড়তে। বৈমাত্রেয় দাদা বিনয়েন্দ্রও উপস্থিত।
ট্রেন ছাড়ব-ছাড়ব করছে, অমরেন্দ্র-বনবালাকে ঘিরে জটলা। বিদায়-সম্ভাষণের পালা চলছে। হঠাৎই উলটো দিক থেকে একটি লোক, গায়ে খদ্দরের ময়লা চাদর, দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে অমরেন্দ্রকে হালকা ধাক্কা দিয়ে, কেউ কিছু বোঝার আগেই নিমেষে মিলিয়ে গেল ভিড়ে। আর অমরেন্দ্রর মুখ থেকে ছিটকে বেরল যন্ত্রণা, উফফ, কী একটা ফুটিয়ে দিয়ে চলে গেল!
আজ যে মামলার কথা, যখনকার কথা, পাঠক-পাঠিকাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্মই হয়নি, নিশ্চিত। প্রায় পঁচাশি বছর আগের ঘটনা এই মামলা বিরলতমের পর্যায়ভুক্ত। আজও আলোচিত হয় দেশ-বিদেশের অপরাধ-বিষয়ক লেখালেখিতে, গবেষণায়। বলা হয়, “One of the first cases of individual bioterrorism in modern world history.” কী বাংলা হয়? জীবাণু-অস্ত্রে ব্যক্তিহত্যা? জুতসই হল না মোটেই। না হোক, ঘটনার বিবরণে আসি, যা পড়লে মনে হতে বাধ্য, এভাবেও মেরে ফেলা যায়!
পাকুড় হত্যা মামলা। টালিগঞ্জ থানা, কেস নম্বর ৬৭। ধারা, ভারতীয় দণ্ডবিধির তারিখ ১৭/২/৩৪। ৩০২/১২০ বি। খুন এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। অনেকে শুনেছেন এই মামলার কথা, বিস্তর লেখাও হয়েছে এ নিয়ে। ইন্টারনেটেও পাবেন। তবে অধিকাংশ বিবরণেই নানা ভাষা-নানা মত-নানা অনুমান। বিভ্রান্তির অবকাশ অনেক। রইল প্রামাণ্য ঘটনাপ্রবাহ, কেস ডায়েরি থেকে, সযত্নে যা রক্ষিত আছে উত্তর কলকাতার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে আমাদের সংগ্রহশালায়।
পাকুড় মামলার চার্জশিটের প্রতিলিপি
পাকুড়ের অবস্থান ঝাড়খণ্ডের উত্তর-পূর্বে। সাঁওতাল পরগনায়। বহুদিন সাহেবগঞ্জ জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থল ছিল। স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা মিলেছে ’৯৪-এ। দেশের মানচিত্রে পাকুড় বিখ্যাত ব্ল্যাকস্টোনের জন্য। উত্তরে সাহেবগঞ্জ, দক্ষিণে দুমকা, পশ্চিমে গোদ্দা জেলা আর পূর্বে আমাদের মুর্শিদাবাদ-বীরভূম। প্রাক-স্বাধীনতা আমলে দেশের অন্যতম ধনাঢ্য জমিদারির মালিকানা ছিল পাকুড়ের পান্ডে পরিবারের। সমসময়ের বংশলতিকার যেটুকু প্রয়োজন কাহিনির স্বার্থে, বলে নিই।
কুমার প্রতাপেন্দ্রচন্দ্র পান্ডের দুই স্ত্রী ছিলেন। দু’জনেই পরলোকগতা। প্রথম পক্ষের পুত্র বিনয়েন্দ্র, কন্যা কাননবালা। এক পুত্র, এক কন্যা দ্বিতীয় পক্ষেও। অমরেন্দ্র আর বনবালা। প্রতাপেন্দ্রর দাদা গত হয়েছেন, যাঁর নিঃসন্তান স্ত্রী বর্তমান। রানি সূর্যবতীদেবী। অমরেন্দ্রর মাতৃবিয়োগ হয়েছিল জন্মের বছরদুয়েকের মধ্যেই। সন্তানহীনা সূর্যবতী মাতৃস্নেহে লালন করেছিলেন শিশু অমরেন্দ্রকে।
কুমার প্রতাপেন্দ্র আর রানি সূর্যবতীর মধ্যে সমান ভাগাভাগি হয়েছিল জমিদারির বিষয়সম্পত্তি। জমিদারির বার্ষিক আয় ছিল লাখখানেকের ঢের বেশি। সে-যুগের নিরিখে কুবেরের বিষয়-আশয় প্রায়।
প্রতাপেন্দ্র মারা গেলেন ১৯২৯-এ। অমরেন্দ্র ও বিনয়েন্দ্রর মধ্যে সম্পত্তির সমবণ্টন করে গিয়েছিলেন উইলে। অমরেন্দ্র তখনও নাবালক, বছর পনেরোর কিশোর। স্কুলের পাঠ শেষ করবেন কিছুদিনের মধ্যে। বিনয়েন্দ্রর বয়স তখন বাইশ, দায়িত্ব ছিল সম্পত্তির দেখাশোনার।
বিনয়েন্দ্র ছিলেন ইন্দ্রিয়সুখে আচ্ছন্ন মানুষ। জীবনদর্শন সহজ, “মেজাজটাই তো আসল রাজা, আমি রাজা নয়।” নানাবিধ দুর্লক্ষণ ছিল মেজাজের। দিনরাতের অধিকাংশ সময় ‘জলপথেই’ থাকতে পছন্দ করতেন। উদ্দাম নারীসঙ্গ স্বভাবগত, নিয়মিত নিশিযাপন বালিকাবালা এবং চঞ্চলা নামে দুই রক্ষিতার সাহচর্যে। প্রমোদবিলাসে মাঝেমধ্যে পাড়ি দিতেন বোম্বাই। রুপোলি পরদার রংবাহারে বরাবরের আকর্ষণ। সংযম এবং শৃঙ্খলা, দুইয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন কৈশোরেই।
অমরেন্দ্র ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। ভদ্র, নম্র, পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, নিয়মিত শরীরচর্চাও করেন। স্বভাবগুণে প্রবল জনপ্রিয় প্রজাকুলে। ‘ছোটবাবু’ বলতে অজ্ঞান পাকুড়ের আবালবৃদ্ধবনিতা।
স্কুলের পাট চুকিয়ে অমরেন্দ্র ভরতি হলেন পাটনা কলেজে। পড়াশুনোর খরচ নিয়মিত পাঠাতেও প্রায়ই গড়িমসি করতেন বিনয়েন্দ্র। অমরেন্দ্র আঠারোর চৌকাঠে পা দিলেন ফোর্থ ইয়ারে এবং সাবালকত্ব প্রাপ্তির পরই সম্পত্তির অংশের দায়িত্ব বুঝে নিতে চিঠি লিখলেন বিনয়েন্দ্রকে।
সেটা ১৯৩২ সাল। রানি সূর্যবতী থাকতেন দেওঘরে, সব খবরই পেতেন বিনয়েন্দ্রর টালমাটাল জীবনধারার। তিনিও পরামর্শ দিলেন অমরেন্দ্রকে, যথাসম্ভব দ্রুত বিষয়সম্পত্তি বুঝে নেওয়ার।
মাত্রাছাড়া ভোগবিলাসে অবধারিত টান পড়বে, তাই বৈমাত্রেয় ভাইকে তার প্রাপ্য অংশ দিয়ে দেওয়ায় বিনয়েন্দ্রর অনীহা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আইন তো আর অনীহার অনুগত নয়, অমরেন্দ্রকে বুঝিয়ে দিতে হল প্রাপ্য অর্ধাংশ। এবং হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় দুই ভাইয়ের মধ্যে যথেষ্ট তিক্ততা উৎপন্ন হল। বিস্তর চিঠিচাপাটি, তপ্ত বাক্যবিনিময়, সব।
পুজোর ছুটিতে অমরেন্দ্র বেড়াতে গেলেন দেওঘরে, রানি সূর্যবতীর কাছে। বিনয়েন্দ্রও এলেন কিছুদিন পরে। উঠলেন দেওঘরেরই অন্যত্র, বাড়ি ভাড়া করে। এক সন্ধেয় বিনয়েন্দ্র বললেন, চল বাবু (অমরেন্দ্রর ডাক নাম), একটু বেড়িয়ে আসি। বেরনো হল সান্ধ্যভ্রমণে। হঠাৎই বিনয়েন্দ্র বললেন, ‘তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি কলকাতা থেকে। এই দ্যাখ।’ বলেই পকেট থেকে বার করলেন শৌখিন নাকে-আঁটা চশমা (Pince-nez glasses)। একরকম জোর করেই পরিয়ে দিলেন ভাইকে। পরানোর সময় নাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই ব্যথা পেলেন অমরেন্দ্র। ছড়েও গেল একটু।
নাকে চাপটা কি একটু বেশিই দিয়েছিল দাদা? একটু খটকা যে লাগেনি অমরেন্দ্রর, এমনটা নয়। বন্ধুদের জানিয়েওছিলেন, বলেছিলেন সূর্যবতীকেও। সকলেই কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করেছিলেন শুনে। অস্বস্তি আশঙ্কায় পরিণত হল, যখন দিন তিনেক পরে মুখের একটি দিক ফুলে গিয়ে প্রায় অবশ হয়ে গেল অমরেন্দ্রর।
বিনয়েন্দ্র তার আগেই ফিরে এসেছেন কলকাতায়। পারিবারিক চিকিৎসককে খবর দেওয়া হল। তিনি দেখেশুনে বললেন, টিটেনাসের সংক্রমণ। Anti-tetanus প্রতিষেধক চালু হল প্রথামাফিক।
চিকিৎসা চলাকালীনই বিনয়েন্দ্র দেওঘরে পাঠালেন তাঁর পরিচিত এক তরুণ ডাক্তারকে। নাম তারানাথ ভট্টাচার্য, কথাবার্তায় চৌকস। এসেই প্রস্তাব দিলেন মরফিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার। ততদিনে দেওঘরের একাধিক চিকিৎসক দিনরাত পর্যবেক্ষণে রেখেছেন অসুস্থ অমরেন্দ্রকে। কেউই মানলেন না তারানাথের পরামর্শ।
বিনয়েন্দ্র ছিলেন গভীরতম জলের মাছ। নিজেই চলে এলেন দেওঘর, সঙ্গে তুলনায় অভিজ্ঞ এক চিকিৎসক, ডাক্তার দুর্গারতন ধর। যিনি চিকিৎসাবিদ্যার ব্যাপারে প্রভূত জ্ঞান বিতরণ করে চিকিৎসকদের রাজি করিয়ে ফেললেন একটি ইঞ্জেকশন দিতে। যেটি নিজেই সঙ্গে করে এনেছেন কলকাতা থেকে। দেওয়া হল ইঞ্জেকশন।
কলকাতায় রোগী দেখার জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে ডা. ধর আধঘণ্টা পরে কলকাতার ট্রেন ধরলেন। সঙ্গী বিনয়েন্দ্রও। এদিকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পরই আচমকা দ্রুত শারীরিক অবনতি হতে শুরু করল অমরেন্দ্রর। প্রায় অচৈতন্য, রক্তচাপ যখন-তখন অগ্রাহ্য করছে বিপদসীমা। ‘এই যায় সেই যায়’ অবস্থা। সে যাত্রা কোনওক্রমে সামাল দিলেন ডাক্তাররা।
কয়েকদিন পর বিনয়েন্দ্র ফের উদয় হলেন দেওঘরে, ভাই কেমন আছে দেখার অছিলায়। সঙ্গে এবারও সেই ডাক্তার ধর এবং আরও একজন। ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য। ঢের শিক্ষা হয়েছে ততদিনে অমরেন্দ্রর বন্ধুবান্ধব-শুভানুধ্যায়ীদের। সূর্যবতীও কড়া নির্দেশ জারি করেছেন বিনয়েন্দ্রকে দেওঘরের বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার। দেওয়া হলও না। নিষ্ফলা বাদানুবাদের পর বিনয়েন্দ্র দুই সঙ্গী-চিকিৎসক সহ ফিরে গেলেন কলকাতায়।
অমরেন্দ্রর শরীরস্বাস্থ্য চিন্তায় ফেলল সূর্যবতীকে। যে ছেলের ছোটবেলার অভ্যেস ভোর পাঁচটায় উঠে শরীরচর্চার, সে বেলা দশটার আগে এখন বিছানাই ছাড়তে পারে না দুর্বলতার জেরে। বছর ঘুরে তখন ১৯৩৩। অমরেন্দ্রকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল সুচিকিৎসার প্রয়োজনে। হরিশ মুখার্জি রোডের একটি বিশাল বাড়ি ভাড়া করা হল। খবর দেওয়া হল সেই কিংবদন্তি চিকিৎসককে, যাঁর নামে কলকাতার এনআরএস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডা. নীলরতন সরকার রোগী দেখে ওষুধপত্র দিলেন। সঙ্গে পরামর্শ, কিছুদিন কাজকর্মের চিন্তা সম্পূর্ণ দূরে রেখে বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসার।
অমরেন্দ্র ‘চেঞ্জে’ গেলেন ভুবনেশ্বরে, কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি হল না। মাথা ঘোরে, অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। খিদে কমে গিয়েছে। বই পড়তে ভালবাসতেন খুব, সে ইচ্ছেও যেতে বসেছে। বন্ধুরা নতুন বই পাঠালে দু’-চার পাতা উলটেই রেখে দেন। মাসকয়েক পর ভুবনেশ্বর থেকে ফিরে এলেন পাকুড়ে। ভগ্ন শরীরেই জমিদারির কাজকর্ম দেখাশোনা শুরু করলেন সাধ্যমতো।
বিনয়েন্দ্র এ সময়টা শান্তশিষ্ট দিনযাপন করছিলেন, ভাবার কারণ নেই কোনও। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না, ছকেরও না। চক্রান্তের শেষ অঙ্ক অভিনীত হল ’৩৩ -এর নভেম্বরে। ১৮ তারিখ পাকুড়ের বাড়িতে সূর্যবতীদেবীর টেলিগ্রাম এল অমরেন্দ্রর নামে, ‘কলকাতায় শীঘ্র আসিও। রাজস্ব-সংক্রান্ত আইনি আলোচনা রহিয়াছে।’
পত্রপাঠ কলকাতা রওনা দিলেন অমরেন্দ্র এবং গিয়ে আবিষ্কার করলেন, টেলিগ্রামটি ভুয়ো। সূর্যবতী আদৌ আসেননি কলকাতায়। তারবার্তাটি তাঁর নয়।
অমরেন্দ্র সব জানালেন সূর্যবতীকে। দু’জনেই সহমত হলেন, এ অপকর্ম বিনয়েন্দ্রর। জ্যাঠাইমা সূর্যবতী আদরের ‘বাবু’-কে সতর্ক করে দিলেন, ‘কাছেপিঠে ঘেঁষতে দিবি না দাদাকে।’ অমরেন্দ্র সরাসরি জানতে চাইলেন দাদার কাছে টেলিগ্রামের ব্যাপারে। বিনয়েন্দ্র অম্লানবদনে অস্বীকার করলেন। এরই মধ্যে বিনয়েন্দ্র একাধিকবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন দুই পুত্রের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে প্রতাপেন্দ্রর রেখে যাওয়া দু’লাখ টাকার সিংহভাগ অমরেন্দ্রর অজ্ঞাতে সই জাল করে তুলে নেওয়ার। সবই জানতে পেরেছিলেন অমরেন্দ্র পারিবারিক উকিলের মাধ্যমে। সে নিয়েও বচসা হল খানিক।
২৫ নভেম্বর, ১৯৩৩। পরের দিন অমরেন্দ্রর কলকাতা থেকে পাকুড়ে ফিরে যাওয়ার কথা দুপুরের ট্রেনে। সন্ধেবেলা অমরেন্দ্রর কলকাতার অস্থায়ী বাসস্থানে এসে হাজির বিনয়েন্দ্র। সব তিক্ততা ভুলে গিয়ে হঠাৎই যেন স্নেহশীল বড়দার ভূমিকায়। কথায় কথায় স্মৃতিচারণ করছেন শৈশব-কৈশোরের, কিঞ্চিৎ ঘনঘনই গলা বুজে আসছে কান্নায়, ‘তুই আমাকে ভুল বুঝিস না বাবু, শরীরের যত্ন নিস ভাই।’
অমরেন্দ্র দাদার চরিত্র জানতেন, কুম্ভীরাশ্রুতে বিচলিত হওয়ার কারণ দেখলেন না কোনও। বিনয়েন্দ্র যাওয়ার আগে কথায় কথায় জেনে নিলেন, পরদিন ভাইয়ের ট্রেন কখন।
২৬ নভেম্বর। স্টেশনে অমরেন্দ্র এবং আত্মীয়বান্ধবরা একটু অবাকই সহাস্য বিনয়েন্দ্রকে দেখে। কেউ কেউ বললেনও, এ আপদ এখানে কেন? অমরেন্দ্র নিরস্ত করলেন উত্তেজিত স্বজনদের। যতই কুচক্রী হোন, বৈমাত্রেয় হলেও দাদা তো! স্টেশনে এসেছেন, ও ভাবে বিদেয় করে দেওয়া যায়? এর কিছু পরে অতর্কিতে উলটোদিক থেকে খদ্দরের চাদরমুড়ি অপরিচিতের দ্রুত ধাক্কা দিয়ে অন্তর্ধান, গাড়ি ছাড়ার পূর্বমুহূর্তের সে ঘটনা বলেছি শুরুতে।
পাঞ্জাবির হাতা তুলে অমরেন্দ্র দেখালেন ক্ষতচিহ্ন। আপাতদৃষ্টিতে মারাত্মক কিছু নয়। কিছুটা তরল পদার্থ পিন ফোটানোর জায়গা থেকে চুঁইয়ে পড়েছে পাঞ্জাবিতে। ট্রেন ছাড়তে তখন বাকি মিনিট পাঁচেক। সহোদরা বনবালা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। অমরেন্দ্রর বন্ধু কমলাপ্রসাদ এবং অন্যরাও। বললেন, ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া যাক। দু’দিন পরই না হয় পাকুড় যাওয়া যাবে। বিনয়েন্দ্রও কপট উদ্বেগ দেখালেন প্রাথমিক, তারপর বললেন, ‘এ তো সামান্য ব্যাপার, পাকুড়ে গিয়েও তো ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া যায়।’ কমলাপ্রসাদ প্রতিবাদ করতে গেলে বিনয়েন্দ্র মেজাজ হারালেন, ‘আমরা পাকুড়ের জমিদারবাড়ির। এসব তুচ্ছ ব্যাপারে তোমরা সাধারণরা মাথা ঘামাতে পারো। আমরা নয়।’
অমরেন্দ্রর কিছু জরুরি কাজও ছিল পরের দু’দিনে। ভাবলেন, ডাক্তার দেখিয়ে নেব বাড়ি ফিরে। বনবালাকে নিয়ে উঠে বসলেন পাকুড়গামী ট্রেনে। এবং মারাত্মক ভুল করলেন।
ভাইবোন যখন ট্রেনে বিকেলের জলযোগ সারছেন, কথোপকথন হল এইরকম।
—দাদাভাই, আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না।
—কেন রে?
—না, ওই পিন ফোটানোর ব্যাপারটা । মনটা খচখচ করছে।
—ও কিছু না। পকেটমার-টার হবে। ছোট ক্ষুরটুর ছিল হয়তো হাতে।
—ক্ষুরে অমন দাগ হয়? আমি লোকটাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি, মনে করতে পারছি না কিছুতেই …
—যাহ্, কী যে বলিস। তুই আবার কোথায় দেখলি?
—না রে, দেখেছি কোথাও, একদম এক চেহারা।
—চেহারাটা তো আমিও দেখলাম। বেঁটে, মিশকালো, গায়ে খদ্দরের চাদর ছিল। পায়ে চপ্পল।
—দাদাভাই! মনে পড়েছে! আমরা গত সপ্তাহে যখন পূর্ণ থিয়েটারে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম, ওই লোকটা টিকিট কাউন্টারের সামনে ঘোরাঘুরি করছিল।
—আরে ধুর। তোর মনের ভুল। বেশি ভাবিস না তো।
বনবালার আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা বোঝা গেল পরের দিন থেকেই। প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়লেন অমরেন্দ্র। ২৮ তারিখ রাতে ফিরিয়ে আনা হল কলকাতায়। এবার উঠলেন রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের একটা ভাড়াবাড়িতে। ডাকা হল আর এক প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসককে। ডা. নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্ত। অবস্থা দেখে ডাক্তারবাবু ‘ব্লাড কালচার’ করতে বললেন অবিলম্বে। ডান দিকের বাহুমূল ততক্ষণে ফুলে উঠেছে অমরেন্দ্রর। জ্বর নামছেই না ১০৫ ডিগ্রির নীচে। কষ্ট পাচ্ছেন প্রচণ্ড। রক্তচাপ হোক বা হৃদ্স্পন্দন, প্রতি ঘণ্টায় একটু একটু করে চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অমরেন্দ্র জ্ঞান হারালেন, ৪ ডিসেম্বর সকালে প্রাণ। ‘ব্লাড কালচার’-এর রিপোর্ট এল পরদিন। যার সারাংশ পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ডাক্তাররা। মৃতের রক্তে ‘Pasteurella Pestis’ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। যা শরীরে ঢুকলে plague-এ আক্রান্ত হওয়া অনিবার্য। প্লেগের মারণছোবলেই প্রাণনাশ অমরেন্দ্রর, সংশয়ের অবকাশ নেই তিলমাত্র।
রোগভোগে আপাত-স্বাভাবিক মৃত্যু। ময়নাতদন্ত হল না, দাহ হল নিয়মমাফিক। মুখাগ্নি করলেন বিনয়েন্দ্র, কেঁদে ভাসালেন। ওই কুনাট্য সহ্য করতে হল অমরেন্দ্রর ঘনিষ্ঠদের। যাঁদের আগাগোড়াই সন্দেহ ছিল বিনয়েন্দ্রর উপর। পিন ফোটানোর ঘটনা নিশ্চয়ই বিনয়েন্দ্ররই মস্তিষ্কপ্রসূত, দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অমরেন্দ্রর বন্ধুদের। কিন্তু প্রমাণ কই? সন্দেহের বশে তো আর কাউকে ফাঁসিকাঠে চড়ানো যায় না।
স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করা এক যুবকের অকালমৃত্যু, তা-ও প্লেগে! চিন্তায় পড়ে গেলেন কলকাতার চিকিৎসকমহল। দিকপাল ডাক্তাররা শেষ সময়ে চিকিৎসা করেছিলেন, কথা বলেছিলেন অমরেন্দ্রর আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে, নথিবন্দি করেছিলেন দিনকয়েক আগের পিন ফোটার ঘটনা এবং পরবর্তী সমস্ত রোগলক্ষণ। গোলমাল আছে কিছু, চিকিৎসকদল আন্দাজ করেছিলেন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায়।
ডাক্তাররা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ১২ ফেব্রুয়ারি একঝাঁক প্রশ্ন পাঠালেন ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডিরেক্টরের কাছে। প্লেগের ‘bacilli’ কি হাইপোডারমিক নিডলের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো যায়? গেলে কত পরিমাণে? যতটা যায়, ততটা কি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট? এ ছাড়া আরও বেশ কিছু, টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি। বিস্তারিত উত্তর এল চার দিন পর, ১৬ তারিখ। বলা হল, এই মৃত্যু অস্বাভাবিক, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটানো হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে এ জিনিস ঘটেনি। অতএব, ‘homicidal death’— খুন! এবং যে ‘bacilli’-ঘটিত মৃত্যু, তা কলকাতায় পাওয়া যায় না। একমাত্র বোম্বাইতেই (সেসময়ের নামটাই রাখলাম বাণিজ্যনগরীর) মেলে Haffkine Institute-এ।
অমরেন্দ্রর বন্ধুরা কিন্তু হাল ছাড়েননি দাহকার্য সাঙ্গ হওয়ার পরও। ট্রপিক্যালের রিপোর্ট আসার একমাস আগেই ঘটনার সবিস্তার বিবরণ সমেত কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতরের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন পাকুড় জমিদারবাড়ির পারিবারিক উকিল। অভিযোগ দায়ের করার মতো নথিপত্র ছিল না হাতে। তাই কেস নথিবদ্ধ করা হয়নি তখনও, কিন্তু পুলিশের গোপন অনুসন্ধান এবং নজরদারি চালু হয়েছিল বিনয়েন্দ্র এবং তারানাথের গতিবিধির উপর। গোয়েন্দারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন প্রাক্-মৃত্যু চিকিৎসা যাঁরা করেছিলেন, সেই ডাক্তারদের সঙ্গে। অলিখিত তদন্ত একরকম শুরুই হয়ে গিয়েছিল।
ডা. এন আর সেনগুপ্তকে পাঠানো সাক্ষীদানের সমন
১৬ ফেব্রুয়ারি ট্রপিক্যাল মেডিসিনের রিপোর্ট আসামাত্রই কমলাপ্রসাদ টালিগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করলেন। পাঁচজন অভিযুক্ত। বিনয়েন্দ্রচন্দ্র পান্ডে, ডাক্তার তারানাথ ভট্টাচার্য, ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য, ডাক্তার দুর্গারতন ধর এবং সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি, যে স্টেশনে পিন ফুটিয়েছিল।
FIR হয়েছে খবর পাওয়ামাত্র পালালেন বিনয়েন্দ্র। পালিয়ে যাবেন কোথায়, নজরদারি তো ছিলই অষ্টপ্রহর। গ্রেফতার করা হল সে-রাতেই। আসানসোল স্টেশনে, ট্রেনের কামরা থেকে। ডা. ধর ধরা পড়লেন পরের দিন, তারানাথ আরও একদিন পরে। ১৮ ফেব্রুয়ারির সকালে। ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য মাসখানেক পর, ২৪ মার্চ।
কিন্তু যে লোকটি পিন ফুটিয়েছিল? বেঁটে, কালো, খদ্দরের চাদরমুড়ি দেওয়া অপরিচিত? বিনয়েন্দ্র স্বীকার করলেন, তিনিই লোকটাকে পূর্ণ থিয়েটারে পাঠিয়েছিলেন অমরেন্দ্রকে চিনে নিতে। কিন্তু লোকটির নাম-ঠিকানা এক-একবার এক-একরকম বলে চললেন, কোথাও খোঁজ মিলল না হাজার চেষ্টাতেও। ছবি-টবি আঁকিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার পরেও না।
দুটো সম্ভাবনা ছিল। এক, প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে আততায়ীকে চলে যেতে বলেছিলেন বিনয়েন্দ্র ভিনরাজ্যের কোনও প্রত্যন্ত এলাকায়, যেখান থেকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। দুই, ঘটনার পর বিনয়েন্দ্রই লোক লাগিয়ে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিয়েছিলেন আততায়ীকে। যাতে ভবিষ্যতে ব্ল্যাকমেলের আশঙ্কাও নির্মূল করে দেওয়া যায় চিরতরে। দ্বিতীয়টাই সম্ভবত ঘটেছিল, ধারণা হয়েছিল তদন্তকারীদের।
জিজ্ঞাসাবাদে অমরেন্দ্র-হত্যার পরিকল্পনা যা জানা গেল, তা ঘোর লজ্জায় ফেলে দেবে যে-কোনও রুদ্ধশ্বাস গোয়েন্দা কাহিনিকে। ভাবুন একবার, প্রায় এক শতক আগে স্থির মস্তিষ্কে এক বছর তিরিশের যুবক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটিয়ে ভাইকে খুনের প্ল্যান করছে! শরদিন্দুর উপন্যাসে সাইকেল থেকে নিক্ষিপ্ত গ্রামোফোন পিন বা শজারুর কাঁটা দিয়ে খুনের কাহিনি বহুপঠিত। বাস্তবের বিনয়েন্দ্রর কুকর্মের অভিনবত্ব তুলনায় ঢের বেশি কূটবুদ্ধির, সন্দেহ নেই কোনও।
সম্পত্তির ন্যায্য প্রাপ্য অমরেন্দ্র দাবি করার দিন থেকেই বিনয়েন্দ্র ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন ভাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার। নাকে আঁটা চশমার মাধ্যমে Tetanus সংক্রমণের চেষ্টা যখন ব্যর্থ হল, তখন আরও প্রাণঘাতী কিছুর সন্ধানে মনোযোগী হলেন বিনয়েন্দ্র। ষড়যন্ত্রের শরিক হলেন তারানাথ। যিনি আদপে ডাক্তারই নন (ভুয়ো ডাক্তার সে-যুগেও ছিল!)। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ‘Calcutta Medical Supply Concern’ নামে এক ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতেন। সেই সুবাদে অসুখবিসুখ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা হয়েছিল। তারানাথই বুদ্ধি দিলেন, ঘাতক হিসাবে প্লেগ অব্যর্থ।
কিন্তু ভাবলেই তো হল না, প্রয়োগের উপায়? তার চেয়েও জরুরি, প্লেগের bacilli পাওয়া যাবে কোথা থেকে? কে দেবে? বোম্বাইয়ের হফকিন ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত হল।
‘Haffkine Institute for Training, Research and Testing’ স্থাপিত হয়েছিল ১৮৯৯ সালে, বোম্বাইয়ের পারেল অঞ্চলে। প্রতিষ্ঠাতা Dr Waldemar Mordecal Haffkine শুরুতে নাম রেখেছিলেন ‘Plague Research Laboratory’। তারানাথ টেলিগ্রাম করে ইনস্টিটিউটে জানালেন, তাঁর ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ডিপ্লোমা রয়েছে। ব্যাকটেরিয়া-বাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন, plague bacilli প্রয়োজন। ইনস্টিটিউট উত্তরে জানাল, কলকাতার surgeon general –এর সুপারিশ পাঠালে বিবেচনা করে দেখা হবে আর্জি। কিন্তু কে দেবে অজ্ঞাতকুলশীল তারানাথকে ওই মহার্ঘ সুপারিশপত্র, আর কেনই বা দেবে?
তা হলে? ডা. শিবপদ ভট্টাচার্য ও ডা. দুর্গারতন ধরের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করলেন বিনয়েন্দ্র-তারানাথ। যথেষ্ট অর্থের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে দুই চিকিৎসকও যোগ দিলেন প্লেগ-পরিকল্পনায়। ডা. ভট্টাচার্য দীর্ঘ সুপারিশ পাঠালেন তারানাথের হয়ে। উত্তর এল নেতিবাচক।
বিনয়েন্দ্র তবু অদম্য, একাধিকবার বোম্বাই গেলেন। সরকারিভাবে সুবিধে করতে পারলেন না। মরিয়া চেষ্টায় ইনস্টিটিউটের দুই ডাক্তারকে বিপুল অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখালেন লাগাতার। বিলাসবহুল Sea View Hotel-এ ব্যবস্থা করলেন যথেচ্ছ বিনোদনের, দিনের পর দিন। দুই ডাক্তার প্রলোভনে নতিস্বীকার করলেন শেষমেশ, কিন্তু লিখিত প্রমাণ রাখলেন না। সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে বিনয়েন্দ্র-তারানাথের কাছে পৌঁছল ‘লাইভ প্লেগ কালচারের’ vial। সেটা ৭ জুলাই, ১৯৩৩। তারানাথকে সুযোগ করে দেওয়া হল বোম্বাইয়ের প্লেগ হসপিটালে ‘bacteriologist’ পরিচয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার। সাদা ইঁদুরের উপর ব্যাকটেরিয়া-বিষ প্রয়োগ করে নিশ্চিত হলেন তারানাথ।
এরপর যা ঘটেছিল, লিখেছি আগেই। কুড়ি বছরের যুবকের দেহে প্লেগ bacilli ঢুকিয়ে বিরলতম হত্যা। যা হইচই ফেলে দিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচলে।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতর, দাবিই করা যাক, অসামান্য তদন্ত করেছিল। যা মুক্তকণ্ঠে তারিফ করেছিলেন জজসাহেব তাঁর রায়ে। তদন্তকারী অফিসার শুরুর দিকে ছিলেন সাব ইনস্পেকটর শরৎচন্দ্র মিত্র, পরে ইনস্পেকটর এম এল রহমান। আততায়ীকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য। এমন অবস্থায় বাকি ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তিদান নিশ্চিত করতে ভরসা শুধু অকাট্য যুক্তিতে মোটিভকে প্রমাণ করা এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণের (circumstantial evidence) জালটি এমন ভাবে বোনা যাতে ঘটনাপরম্পরার গতিপথ (chain of events) দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। এ কাজ যে কী ভীষণ কষ্টসাধ্য, সে তদন্তকারী অফিসারই শুধু জানেন।
মোটিভের অংশটি অবশ্য সহজসাধ্যই ছিল। অমরেন্দ্রর মৃত্যুতে বিনয়েন্দ্র যে লাভবান হতেন, সেটা তো জলবৎ তরলং ছিল। পারিপার্শ্বিক প্রমাণ একত্রিত করার দুরূহ কাজটি সুসম্পন্ন করতে প্রাণপাত করেছিলেন কলকাতার গোয়েন্দারা। বিনয়েন্দ্রর বোম্বাইযাত্রার দিনপঞ্জি এবং হোটেলবাসের প্রতিটি নথি জোগাড়, রেজিস্টারের হস্তাক্ষরের সঙ্গে অভিযুক্তের হস্তাক্ষর মেলানো, হফকিন ইনস্টিটিউটে যাতায়াতের প্রমাণ সংগ্রহ, তারানাথের টেলিগ্রাম এবং ডা. ভট্টাচার্যের সুপারিশপত্র, যে দোকান থেকে ইঁদুর কেনা হয়েছিল সেটি খুঁজে বের করে মালিকের জবানবন্দি, যে ট্যাক্সিতে করে বোম্বাইয়ের প্লেগ হসপিটালে পৌঁছেছিলেন তারানাথ, সেটিকে খুঁজে বের করা, পুঙ্খানুপুঙ্খ এমন আরও যে কত, লিখলে তালিকা দীর্ঘতর হতে থাকবে। বোম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দরাজ সাহায্যের, নিয়মিত কলকাতার নগরপালের সঙ্গে আলোচনা করতেন তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে।
বিচারপর্বে অঢেল অর্থব্যয় করবেন বিনয়েন্দ্র, প্রত্যাশিতই ছিল | লাভ হয়নি যদিও। নিম্ন আদালত ফাঁসির আদেশ দেয় বিনয়েন্দ্র ও তারানাথকে। মুক্তি দেওয়া হয় ডা. ধর এবং ডা. ভট্টাচার্যকে। উচ্চ আদালতে আপিল পেশ হয় যথানিয়মে। ফাঁসির আদেশ কমে সাজা হয় ‘কালাপানির’, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। বিচারক লেখেন রায়ে, “probably unique in the annals of crime।”
মামলার নথিপত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে খুনের প্রস্তুতিপর্বে তারানাথকে ষড়যন্ত্রী আশ্বাস বিনয়েন্দ্রর, কেউ জানবে না, কে পিন ফুটিয়েছিল। খুনিই না পেলে পুলিশ কাঁচকলা করবে! সহজ হিসেব।
সহজ? সহজ আর থাকল কই? প্রেক্ষিত আলাদা, ব্যঞ্জনাও বহুমাত্রিক। তবু, এ কাহিনির উপসংহারে শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন ঝলকে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত—
“এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।”