হিমুর বাবার নাম কি?
আমি কি হিমু বিষয়ক কোন বইয়ে তাঁর নাম বলেছি?
মনে করতে পারছি না। ভদ্রলোক দেখতে কেমন তাও বলতে পারছি না। তার চেহারার বর্ণনা কি কোথাও করেছি? মনে হয় না। চরিত্রের চেহারা বর্ণনা সাধারণত আমি করি না। দায়িত্ব পাঠকের উপর ছেড়ে দেই, তাদেরকেই চেহারা কল্পনা করে নিতে দেই। আমার উপন্যাসের চরিত্ররা দেখতে কেমন তা জোর করে পাঠকের উপর চাপিয়ে দেই না।
এই পৃথিবীর মহান লেখকদের একজন দস্তয়ভস্কি তার তৈরি চরিত্রগুলির ডিটেল বর্ণনা এমনভাবে দেন যে পাঠক চোখের সামনে চরিত্র দেখতে পান। ঔপন্যাসিক চালর্স ডিকেন্স এই কাজটি ভাল করেন। তার চরিত্র বর্ণনা—
লোকটির মুখ লম্বাটে। জোড়া ভুরু। কানে প্রচুর লোম। নাকের ঠিক নিচেই পেনি আকৃতির একটি লাল আঁচিল। আঁচিলে বড় বড় কয়েকটা কালো চুল আছে। এর মধ্যে একটার রঙ বাদামি। সেই চুল ঠোটের উপর ঝুলে থাকে। মুখের চামড়া কুঁচকানো। কালো তিলে ভর্তি। দাঁত নোংরা। একটি দাঁত সামান্য বড় বলে বের হয়ে থাকে। চোখ ব্রাউন। একটি চোখ অন্যটির চেয়ে সামান্য বড়। তিনি যখন কথা বলেন না তখনো অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ তার মুখ থেকে বের হয়।
চরিত্র বর্ণনায় লেখক কোন টেকনিক ব্যবহার করবেন সেটা তার ব্যাপার। আমার টেকনিকের কারণ কি এই যে আমি চেহারা কেমন তা নিয়ে মাথা ঘামাই না? চরিত্রের মানসিকতাই প্রধান হয়ে দাড়ায়? হতে পারে। রূপবতী মেয়েদের রূপ বর্ণনা এক কথায় সেরে ফেলি— মেয়েটি অসাধারণ রূপবতী। অসাধারণ কোন অর্থে তা ব্যাখ্যা করা হয় না। রূপ বর্ণনা ব্যাখ্যা না করা বা ব্যাখ্যা করতে না পারা কি একটি বড় ধরনের ত্রুটি না?
নায়িকাদের রূপ বর্ণনার নির্ধারিত নিয়ম (Set rules) আছে। যেমন, পটলচেরা চোখ, বাঁশির মত নাক ইত্যাদি। আমি পটল চিরে তাকিয়ে দেখে ধাক্কার মত খেয়েছি। কেন চোখের বর্ণনায় এই সবজি চলে এসেছে আল্লাহপাকই জানেন।
হরিণের মত চোখের কথাও উপমায় ব্যবহার হয়। নুহাশ পল্লীতে এক সময় প্রচুর হরিণ ছিল। তাদের চোখের শেষ অংশ বড়শির মত বাঁকানো। সেখানে কোনো সৌন্দর্য নেই। গরুর বড় বড় চোখে তাও কিছুটা সৌন্দর্য আছে। তবে মেয়েদের চোখের তুলনা মেয়েদের চোখের সঙ্গেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ! ঐ যে সুনীলের কবিতা—
একটি গোলাপ ফুটেছিল
গোলাপের
মত।
প্রস্তাবনা বন্ধ থাকুক, হিমুর বাবার কাছে ফিরে যাই। পাঠক আসুন আমরা সবাই মিলে তার অবয়ব দাঁড়া করাই। প্রসেস অফ এলিমিনেশনের মাধ্যমে চেহারা দাঁড় করানো। অনেক না অতিক্রমের পর হ্যাঁ তে পৌছনো।
ভদ্রলোকটি কি বেঁটে?
অবশ্যই না।
ভদ্রলোক কি থলথলে মোটা?
অবশ্যই না।
ভদ্রলোকের মাথায় কি টাক?
অবশ্যই না।
কুৎসিত দর্শন?
না।
গায়ের রঙ কুচকুচে কালো।
না।
পান খাওয়ার কারণে দাত কি লাল হয়ে থাকে?
না।
তাহলে চেহারা কি দাঁড়াচ্ছে? লম্বা ফর্সা একজন মানুষ। রোগা। মাথা ভর্তি চুল।
এই ভদ্রলোকের চেহারা কল্পনায় হিমুর প্রতি আমাদের যে মমতা, সেই মমতা কাজ করেছে। ভদ্রলোক পাগল ধরনের একজন মানুষ। এই পাগল কিন্তু নেংটো হয়ে ট্রাফিক কনট্রোল করা পাগল না। মমতার পাগল। সে পাগলের স্বপ্ন ছেলেকে মহাপুরুষ বানানো। তার যুক্তি ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্যে যদি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থাকতে পারে, ডাক্তার বানানোর জন্যে মেডিকেল কলেজ থাকতে পারে তাহলে মহাপুরুষ বানানোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন থাকতে পারে না।
কাজেই তিনি নিজেই একটা স্কুল খুললেন। সেই স্কুলের একজনই ছাত্র। তার পুত্র হিমু এবং তিনিই একমাত্র শিক্ষক।
ভদ্রলোকের চিন্তা ভাবনা কি খুবই হাস্যকর?
না, খুব হাস্যকর না। কারণ সাধু সন্ত বানানোর স্কুল কলেজ কিন্তু আছে। মনটাসিয়ারি, মঠ, আশ্রম। হিমালয়ের গুহায় বাস করা সন্ন্যাসী। ঈশ্বরের আরাধনা শেখানোই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য না। শুদ্ধ মানুষ হবার প্রক্রিয়া শেখানোও তাদের ট্রেনিং-এর অংশ। মহাপুরুষতে শুদ্ধ মানুষ ছাড়া আর কিছু না।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে মহাপুরুষ হবার ট্রেনিং-এ কিছু কাল ছিলেন তা-কি পাঠকরা জানেন? সাধনার জন্যে তিনি গিয়েছিলেন হিমালয়ের গুহায় সন্ন্যাসীদের কাছে। এই সাধনায় তিনি আধ্যাত্মিক সিদ্ধি লাভ করেছিলেন এমন মনে হয় না। তার শিক্ষক প্রফেসর ওটেনকে তিনি নিজে কলেজ কম্পাউন্ডে প্রহার করেছিলেন। তারচে আশ্চর্য ব্যাপার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রহার সমর্থন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন–বিদেশি অধ্যাপকের কাছ থেকে দেশ, জাতি ও ধর্মের অপমানের কথা শুনলে ছাত্ররা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করবেই। না করলেই বরঞ্চ লজ্জা ও দুঃখের কথা।
সুভাষ বসুর আত্মজীবনীতে কিন্তু ওটেন সাহেব দেশ জাতি ও ধর্মের অবমাননা করেছেন এমন কথা লেখা নেই। ছাত্রদের সঙ্গে তার ধারাবাহিক দুর্ব্যবহারের কথা বলা আছে।
অধ্যাপক ওটেন সুভাষ বসুর উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখেছিলেন, তাতে তিনি লিখেন সুভাষ তাঁর প্রতি সুবিচার করেন নি। তিনি ছাত্রদের দেশপ্রেমকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন (অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অনুকরণীয়। ঈদ সংখ্যা ২০০৮, সাপ্তাহিক)।
গুরুগম্ভীর এই অংশে আমি আসলে কি বলতে চাচ্ছি? বলতে চাচ্ছি মহাপুরুষ আমাদের মধ্যে নেই। নেই বলেই মহাপুরুষদের প্রতি আমাদের দুর্নিবার আকর্ষণ। ভিন্নভাবে বলতে গেলে দুর্বলতা মানবজাতি ঘেন্না করে কারণ দুর্বলতা আছে তার মধ্যেই। Mankind abhors timidity, because he is timid.
মহাপুরুষ বিষয়ে আমার প্রবল আগ্রহের কারণ সম্ভবত একটাই আমার মধ্যে মহাপুরুষ বিষয়ক কিছু নেই। আমি নিতান্তই আমজনতার একজন। ভুলে যাবার আগে বলে রাখি আমার লেখা প্রথম মঞ্চ নাটকের নাম— মহাপুরুষ।
মহাপুরুষ গড়ার কারিগর হিমুর বাবার পোশাক কি হবে? হিমু হলুদ পাঞ্জাবী পরে। তিনি কি পরবেন? পোশাক খুব তুচ্ছ করে দেখার বিষয় না। স্বয়ং শেক্সপিয়ার বলেছেন, মানুষের প্রথম পরিচয় তার পোশাকে। বাংলা প্রবচনেও আছে—
পহেলা দর্শনধারি
তারপরে
গুণবিচারি।
দর্শনধারি হতে হলে সে রকম পোষাক লাগবে। গামছা পরে দর্শনধারি হওয়া যাবে না।
পরিধেয় বস্ত্র নিয়ে শেখ সাদীর বিখ্যাত শায়েরও আছে। পোশাক যথাযথ না হওয়ায় রাজসভাতে শেষের দিকে তাকে বসতে দেয়া হয়েছিল। কবি অভিমান থেকে লিখলেন–
রাজসভাতে এসেছিলেম
বসতে
দিলে পিছে
সাগর জলে সুক্তো ভাসে
মুক্তো থাকে নীচে।