পারাপার – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
উৎসর্গ
আমার বাবা ও মা
শ্ৰীযুক্ত মণীন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায়
শ্ৰীযুক্তা গায়ত্রী মুখোপাধ্যায়
শ্রীচরণেষু
এক
হাসপাতাল থেকে ললিতকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাত্র দু’টি লোক এসেছিল। বাড়িওয়ালার ছেলে শম্ভু, আর বহুকালের অভিন্নহৃদয় সেই তুলসী। ইচ্ছে করেই আর কাউকে ছাড়া পাওয়ার তারিখটা জানায়নি ললিত, জানালে হয়তো আরও কেউ কেউ আসত। কিন্তু ললিত ভেবে দেখেছে, এ-সময়টায় খুব বেশি লোকের সঙ্গে দেখা হওয়া ভাল নয়। যদিও ডাক্তার তাকে কিছুই স্পষ্ট করে বলেনি, তবু সে জানে এটা ঠিক আরোগ্য নয়, খুবই সাময়িক এই ভাল হয়ে যাওয়া। এটা নিয়ে একটুও আনন্দ করার কিছু নেই।
পেটের ভিতরের পুরনো ব্যথাটা আর নেই, তবু বিছানা থেকে লিফট পর্যন্ত হেঁটে আসতে পেটের অপারেশনের কাটা জায়গাটায় টান লাগার একটা ব্যথা সে টের পাচ্ছিল। আসল ব্যথাটার তুলনায় এ-ব্যথাটা কিছুই নয়, তাই সে তুলসী কিংবা শম্ভুর কাঁধে ভর দিল না, আস্তে আস্তে একাই হেঁটে এল। লিফটে নেমে রাস্তা পর্যন্ত আসতে তার কষ্ট হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল পেটের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় একটা ছেঁড়া নাড়ি দোল খাচ্ছে, ওই নাড়িটায় বোধহয় তার শরীরের কোনও যন্ত্র ছিল, যেটা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সে অনেকদিন ধরে ভেবে এসেছে যে, বাইরে এলে লোকজনের চলাচল, ট্রাম-বাস আর খোলা আলো-বাতাসের মধ্যে হঠাৎ খুব ভাল লাগবে। তার শরীর আর মন জুড়ে পুরনো চেনা কলকাতা ঝমঝম করে বাজনার মতো বেজে উঠবে।
বস্তুত সে-রকম কিছুই ঘটল না। পড়ন্ত বেলার সূর্যের আলো তার চোখে এসে লাগল। ট্রাম-বাস লোকজনের ভিড় নিয়ে কলকাতা বয়ে যাচ্ছে ঠিকই, এবং ঝমঝম বাজনার মতোই শব্দ হচ্ছে চার দিকে। কিন্তু সে অনুভব করল তার শরীর নিস্তব্ধ, মনেও কোনও চঞ্চলতা নেই। হাতে চোখ আড়াল করে সে দেখল রাস্তার ও-পারে বড় কলেজ-বাড়িটার গায়ে লাল কালিতে লেখা পোস্টার, টেলিফোনের তারে কাক বসে আছে, সেই পুরনো ময়লা ঘিঞ্জি কলকাতা।
তুলসী একটু এগিয়ে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে ট্যাক্সির জন্য, সামান্য হাঁফ ধরে গিয়েছিল, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্টও হচ্ছিল বলে ললিত শম্ভুর কাঁধে একটু ভর দিয়ে হেলে দাঁড়াল। যদিও এখন শরৎকাল, তবু সে খুব ঘামছিল এখন। শম্ভু একটা হাত বাড়িয়ে পিঠের দিক দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। ললিতের মনেই হচ্ছিল না যে দু’ মাস সে ঘরে বন্দি ছিল, দু’ মাস সে এইসব রাস্তাঘাট দেখেনি; বরং তার মনে হচ্ছিল, আজ সকালেই সে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছে। এত চেনা সবকিছু, এত একঘেয়ে।
একমাত্র মায়ের জন্যই গত দু’ মাস যাবৎ একটা দুশ্চিন্তা ছিল ললিতের। দু’ মাসে মা মাত্র কয়েকবার দেখতে এসেছে তাকে। গত দু’ মাস সে তুলসী কিংবা শম্ভু আসামাত্রই মায়ের কথা জিজ্ঞেস করত। আজ ভুল হয়ে গেছে। আজকের দিনটা অন্য রকমের বলেই এই ভুল। তবু তুলসী যখন চলতি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে বলল, আয় রে ললিত, তখন হঠাৎ সে খেয়াল করে শম্ভুকে প্রশ্ন করল, মা কেমন আছে রে?
শম্ভু হাসল, ভালই।
ভালই! ললিত ‘ভালই’ কথাটা নিয়ে মনে মনে সামান্য নাড়াচাড়া করতে করতে ট্যাক্সিতে উঠল। না, মা ভাল নেই, ভাল থাকার কথাও নয়। লাম্বাগো আর বাতে পঙ্গু মা ভাল করে হাঁটাচলাও করতে পারে না, প্রায় সময়েই হামাগুড়ি দিয়ে কাজকর্ম করে। মাকে ভাল রাখার চেষ্টা কোনও দিন তেমন করে করেওনি ললিত। একা একা মা’র সারাদিন কাটে, ললিত বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। এখন ট্যাক্সির সিটে এলিয়ে পড়ে থেকে সে মনে মনে ভাবল এবার থেকে সে মায়ের কাছে কাছে বেশি করে থাকবে।
তুলসীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ললিত বলল, তোর কাছে সিগারেট নেই রে?
আছে। বলে তুলসী পকেটে হাত দিল। তারপর থেমে বলল, খাবি?
দে না।
একটু ভাবল তুলসী, তারপর সস্তা সিগারেটের প্যাকেটটা আর দেশলাই এগিয়ে দিয়ে বলল, খা, কী আর হবে! সেরে যখন গেছিস…
শেষ কথাটা অনাবশ্যক। তাকে শুনিয়ে বলা। সিগারেট ধরাতে গিয়ে মৃদু একটু হাসল ললিত। মুখে কিছু বলল না সে, কিন্তু মনে মনে বলল, ক্যানসার সারে না রে তুলসী, ক’মাস পর হয়তো তোকে আমার খাটে কাঁধ দিতে হবে।
সিগারেটের স্বাদ ভুল হয়ে গেছে। ধোঁয়াটা কর্কশ আর গন্ধটা বিদ্ঘুটে লাগছিল ললিতের। সে দেখল সামনের সিটে শম্ভু বসে সোজা রাস্তায় তাকিয়ে আছে, তুলসীর মুখও বাইরের দিকে ফেরানো। দু’জনেই খুব গম্ভীর, চিন্তিত। এই গুমোটটা ভেঙে দেওয়ার জন্যই ললিত শম্ভুকে ডেকে বলল, হ্যাঁরে শম্ভু, তুই জিমনাশিয়ামে এখনও যাচ্ছিস? শ্ৰী-ফ্রি একটা কিছু পেলি?
শম্ভু মুখ ফিরিয়ে একটু হাসল, কিছু বলল না।
একাই কথা বলছিল ললিত। তুলসীকে ডেকে বলল, দেখ তুলসী, এই গরিব দেশে শম্ভুটা একাই চারজনের খোরাকি টেনে নিচ্ছে। সরকারের উচিত জিমনাশিয়ামগুলি বন্ধ করে দেওয়া। শম্ভুটা ফ্যানভাত, পালং সেদ্ধ, লাল আটার রুটি কত কিছু বায়নাক্কা যে শুরু করে সকাল থেকে রাত অবধি যে, ওর স্বাস্থ্যের ধাক্কায় বাড়িসুদ্ধ লোক রোগা হয়ে গেল। ওরে শম্ভু, মাসিমা এখনও তোর খাওয়া নিয়ে খিটখিট করে?
শম্ভু হাসিমুখ ফিরিয়ে বলল, এখন আর করছে না কিছুদিন। আমি সার্জেন্টের চাকরিতে সিলেক্টেড হয়ে আছি ক’দিন হল। এখন খাওয়াচ্ছে খুব।
হাসল ললিত। শম্ভু বেশ বুদ্ধি করে উত্তর দিয়েছে। কথা টেনে নিয়ে ললিত বলল, সার্জেন্ট! সেই লাল মোটর সাইকেল আর কোমরে পিস্তল! দূর, ওটা একটা চাকরিই নয়।
কেন?
কলকাতার সার্জেন্টগুলো কেবল রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করে বেড়ায়, আর কোনও কাজ নেই।
খোলা গলায় শম্ভু হাসছিল। আর তখন তুলসী একটা হাত বাড়িয়ে ললিতের হাতে রেখে চাপ দিয়ে বলল, তুই এত কথা বলিস না ললিত।
কেন?
তুলসী চুপ করে রইল। ওর মুখের রসকষহীন চিন্তার ভাবটুকু আড়চোখে দেখল ললিত। ডাক্তার সম্ভবত ওকে কিছু বলেছে! কী বলেছে তা ললিত ওর মুখের ভাবটুকু থেকে সহজেই আন্দাজ করতে পারছিল। আজকালকার বাচ্চা ছেলেরাও এ-রোগের পরিণাম জানে। তুলসী তাই অত গম্ভীর। এমনই দুশ্চিন্তা ওর যে, এখন যে ললিতকে ভুলিয়ে রাখা দরকার সে-কথাও ওর খেয়াল নেই, নইলে নিজের মুখে অন্তত নকল একটা খুশির ভাব ওর ফুটিয়ে তোলা উচিত ছিল।
রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ের মোড়ে ট্রাফিকের লাল আলোয় তাদের ট্যাক্সি থামাল। সামনে-পিছনে দুটো ডবলডেকার আর পাশে একটা লরি এসে দাঁড়ানোয় হঠাৎ ট্যাক্সিটাকে খুব ছোট্ট আর অসহায় বলে মনে হচ্ছিল ললিতের। চারপাশের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে তাদের ট্যাক্সির ভিতরটাকে মুহূর্তের মধ্যে গুমোট করে দিল। ললিত মুখ বের করে ট্রাফিকের আলোর দিকে চেয়ে ছিল। বরাবর তার সবচেয়ে প্রিয় হল মাঝখানের ক্ষণস্থায়ী হলুদ বাতিটি, ঝলসে উঠলে নিজের শরীরের ভিতরে একটা গভীর অনুভূতি সে টের পায়। অনেকদিন সে বাতিটি দেখেনি ললিত।
শম্ভু পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালাকে বলছিল সে যেন সামনের ডবলডেকারটাকে পার হয়ে সোজা রাস্তা ধরে। ললিত হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে বলল, না রে শম্ভু, গাড়ি বাঁ দিকে ঘোরাতে বল।
কেন?
একটু ঘুরেফিরে যাই। অনেকদিন কলকাতা ভাল করে দেখা হয়নি। সর্দারজি, বাঁয়ে ঘোরে…
ট্যাক্সি বাঁ দিকে ঘুরল।
শম্ভু বলল, দূর। মিটার উঠবে।
তুলসী মুখ ফিরিয়ে বলল, উঠুক।
শম্ভুর দোষ নেই। শম্ভু বরাবর ট্যাক্সিকে সোজা পথেই নিয়ে যেতে শিখেছে। প্রয়োজনেই তাদের ট্যাক্সিতে চড়া, তাই চড়েও শান্তি থাকে না, উগ্র চোখে চেয়ে সতর্ক থাকতে হয় যাতে ড্রাইভার এতটুকু ঘুরপথে না নিয়ে যেতে পারে। তাই ললিত তুলসীর দিকে চেয়ে একটু হাসল।
তুলসী বুঝল কি না বলা যায় না। শুধু আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবি?
প্রশ্নটা ললিত শুনতেই পেল না। তুলসীর দিকে তাকিয়ে সে তুলসীর কথাই ভাবছিল। তার সন্দেহ হচ্ছিল যে তুলসী বোধহয় আর তার সমবয়স্ক বন্ধু নেই। গত দু’ মাসে সে হয়ে গেছে অন্য সম্পর্কের মানুষ। ললিতের বাপ-কাকার মতো কেউ যদি জীবিত থাকত তবে এখন এ-অবস্থায় তাদের মুখের ভাব বোধহয় অনেকটা তুলসীর মতোই হত। তার অজান্তে কখন যেন তুলসী তার অভিভাবক হয়ে গেছে, সন্দেহ হয়, পুরনো বন্ধুত্বের সহজ সম্পর্কটা আর কোনও দিন ফিরে আসবে কি না। তার ইচ্ছে হচ্ছিল সখেদে তুলসীকে ডেকে বলে, তুলসী, তোকে কী বলে ডাকব এখন বল তো! কাকু না জেঠু?
তুলসী কলকাতার বাইরে একটা স্কুলে চাকরি করে। রোজ যাতায়াত করতে হয়। তা ছাড়া ললিত হাসপাতালে থাকার সময়েই মাসখানেক আগে তুলসীর বিয়ে হয়ে গেল। এত সব ব্যস্ততা, বিয়ে, রোজ স্কুলে যাতায়াত সব সামলেও প্রায় রোজই তুলসী তার কাছে এসেছে। মাঝে মাঝে দেখাশোনা করেছে মায়ের। হাসপাতালে থাকার সময়ে তুলসীই ছিল তার সবচেয়ে বড় সহায়। সম্ভবত সেই সময়েই আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্কটা পালটে গেছে। বস্তুত এখন তুলসীর মূখ দেখে, ওকে একবার ‘শালা’ বলে ডাকতে, কিংবা ওর বউ নিয়ে একটু রসিকতা করতে ইচ্ছে থাকলেও লজ্জা করছিল ললিতের।
কোথায় যাবি? তুলসী আবার জিজ্ঞেস করে।
বেশি দূর না। গড়িয়াহাটা হয়ে লেকের ধার ঘেঁষে সাদার্ন অ্যাভেনিউ ধরে ফিরে যাব।
শম্ভু মুখ ফিরিয়ে বলল, মাসিমা বসে আছে কিন্তু আপনার জন্যে। যত তাড়াতাড়ি পারি নিয়ে আসব বলে তাঁকে দরজায় বসিয়ে রেখে এসেছি। আপনি না গেলে মাসিমা দরজা ছেড়ে নড়বেন না।
শম্ভুর ভাঙাচোরা চৌকো শক্ত শিরা-ওঠা তেলতেলে মুখটার দিকে অলস চোখে চেয়ে হঠাৎ ললিতের ইচ্ছে করছিল বলে, মা আমার জন্য চিরকাল বসে আছে অপেক্ষায়, আমার জন্মেরও আগে থেকে। এই দেরিটুকু মা’র সইবে।
কিন্তু কথাটা খুব দার্শনিক হয়ে যাবে, শম্ভু মোটেই বুঝতে পারবে না বলে ললিত বলল না। কেবল ম্লান হাসল একটু। তারপর চোখ বুজল। তার ইচ্ছেমতো ট্যাক্সি চলতে লাগল।
মাঝে মাঝে চোখ খুলে ললিত দেখছিল ভিড়ের গড়িয়াহাটা ছাড়িয়ে গেল তার গাড়ি, লেক পার হল হু হু হাওয়ায় উড়ে, তারপর বাঁক নিল বাঁয়ে, মাথার ওপর দিয়ে টালিগঞ্জের রেলপোল চলে গেল, আনোয়ার শা রোড হয়ে এসে থামল তাদের সরু গলির মধ্যে বাসার সামনে।
তুলসী নেমে দরজা খুলে ধরে রইল। সামান্য অস্বস্তি বোধ করে ললিত। শালা তুলসীটা তাকে বাদের খাতায় ধরে নিয়েছে। দৃষ্টিকটু রকমের ভদ্রতা করে যাচ্ছে ও। তাই মাটিতে পা দিয়ে ললিত ইচ্ছে করেই খুব জোরে ঝপাং শব্দে ট্যাক্সির দরজাটা বন্ধ করল।
উলটো দিকের বাড়ির বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে-থাকা রায়বাবু মুখের সামনে থেকে বইটা নামিয়ে ঝুঁকে বললেন, আরে, ললিত!
ললিত হাসল।
উনি বললেন, তুমি তো একদম ভাল হয়ে গেছ। স্বাস্থ্য ফিরে গেছে তোমার।
ললিত আবার হাসল।
রায়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, বাঃ! চমৎকার!
ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করার শব্দে সামনের ঘরের দরজা খুলে গিয়েছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদু একটু হাসলেন শম্ভুর মা, এলে ললিত?
ললিত হাসল। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল সামনের ঘরটায় অনেকজন মেয়ে-বউ। আর সেই ভিড়ের মধ্যে মায়ের চশমার ঘোলা কাচ দুটো ঝকমক করে উঠল। পাড়া-পড়শিরা মাকে ঘিরে বসে আছে।
এখন সামান্য একটু লজ্জা করছিল ললিতের। সামনের ঘরটা শম্ভুদের। তাদের ঘরটা পিছনের দিকে। এখন এই অন্যের ঘরে একগাদা চেনা আধচেনা মেয়ে-বউয়ের সামনে মা তাকে পেয়ে কী যে করবে ভেবে পাচ্ছিল না ললিত। হয়তো জড়িয়ে ধরে কাঁদবে, হয়তো বিলাপ করবে।
খুবই সংকোচের সঙ্গে সে দরজায় উঠে দাঁড়িয়ে রইল। শম্ভুর মা ডাকলেন, ভিতরে এসো ললিত।
ললিত ঢুকল না। ঘরের ভিতরে বাস্তবিক জায়গা নেই। সামনেই ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারে মা বসে আছে। তার চারধারে মেঝেতে এবং চৌকিতে পাঁচ-সাতজন মা’র বয়সিই প্রবীণ মহিলা। এঁরা কেউ কেউ সধবা। ললিত জানে এঁরাই মা’র অবসরের সঙ্গী, নিঃসঙ্গতার সহায়। সে যখন বাড়িতে থাকে না তখন এঁরাই আসেন যেচে। ললিত তাই নিশ্চিন্ত থাকে। আজও এঁরা এসেছেন তাকে দেখতে। সে কেমন ভাল হয়ে ফিরে এল।
ললিত মাকে দেখল। এক পলকেই বোঝা যায় মা’র চেহারা অনেক পালটে গেছে। এমন নয় যে, মা আরও রোগা কিংবা বুড়ো হয়ে গেছে। তা নয়। কিন্তু হঠাৎ মনে হয় যেন মা আরও বোকা হয়ে গেছে। মুখটা সামান্য খোলা, ভ্যাবলা একটা বোধবুদ্ধিহীন দৃষ্টি তার চোখে। নীচের ঠোঁটটা আবেগে সামান্য কাঁপছে। মা তার দিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইল। হঠাৎ ধক করে উঠল ললিতের বুক, মা কি কিছু বুঝতে পারছে!
রোগা দুটো হাতে চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে মা উঠবার জন্য চেষ্টা করছিল। একবার কোথাও বসলে মা আর সহজে দাঁড়াতে পারে না, কোমরে রস জমে যায়। শম্ভুর মা মা’র পাশে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললেন, দেখুন দিদি, ললিত কেমন সুন্দর চেহারা নিয়ে ফিরেছে!
সকলেই তাকে দেখছিল। ললিত অনুভব করে সকলের চোখেমুখেই একটা নিশ্চিন্ত ভাব। সন্দেহ হয় এরা কেউ ললিতের অসুখটার বিষয়ে ভাল করে কিছু জানে না। মাকেও জানানো হয়নি। জানালেও মা সঠিক বুঝতে পারত কি না কে জানে! মা শুধু জানে যে, তার গুরুতর একটা কোনও অসুখ করেছিল, এখন সেরে গেছে।
চশমা খুলে মা তার থানের আঁচল তুলে চোখের জল মুছছিল। দৃশ্যটা অনেকবার দেখা ললিতের। অনেক ছোটখাটো কারণেও মাকে অনেকবার কাঁদতে দেখেছে ললিত, কোনও দিনই সে মা’র কান্না দেখে খুব বিচলিত হয়নি। আজ কিন্তু সে তার বুকের মধ্যে গুরগুর শব্দে হৃৎপিণ্ডের ডেকে ওঠার শব্দ শুনল।
মায়ের কাছে যা ললিত। করুণাভরা গলায় এ-কথা বললেন মিতুর ঠাকুমা। মিতু— যার বিয়ে হয়ে গেছে বড় বাড়িতে, যাকে এক সময়ে ললিতের বড় পছন্দ ছিল। মিতুর ঠাকুমা থেকে আস্তে আস্তে চোখ ফিরিয়ে সবাইকে দেখছিল ললিত। এঁরা কেউ মিতুর ঠাকুমা, কেউ মুনুর পিসিমা, কেউ বীরুর মা। এ-সব সম্পর্কের ওপরেই এঁদের পরিচয় বেঁচে আছে, নাম ধরে ডাকার কেউ নেই। বেশির ভাগই বুড়ো অথর্ব অসহায়। এঁরা প্রাণভরে লোককে আশীর্বাদ করে, অভিশাপ দেয়। কোনওটাই শেষ পর্যন্ত ফলে না। এই অসহায়দের দলে মাকেই সবচেয়ে বেশি অসহায় বলে আজ মনে হচ্ছিল ললিতের। সে ছাড়া তার মায়ের আর কেউ নেই, তারও নেই মা ছাড়া আর কেউ। সে আজ মায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে মনে মনে সামান্য অস্থির হয়ে পড়ল।
ঘরের ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছে করছিল না ললিতের। ঘরের আবহাওয়াটা কেমন বুড়োটে, গুমোট হয়ে আছে। তা ছাড়া বাইরে তুলসী দাঁড়িয়ে আছে।
মায়ের কান্নাটা যে দুঃখের ছিল না এটা বুঝতে একটু সময় লাগল ললিতের। সুখে কখনও সে মাকে এর আগে কাঁদতে দেখেনি।
কষ্টেসৃষ্টে নড়বড়ে শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল মা, ফোকলা তোবড়ানো মুখে অদ্ভুত একটু হেসে সকলের দিকে চেয়ে অনুমতি ভিক্ষে করল, ললিতকে ঘরে নিয়ে যাই?
ললিত বুঝল ওই চাওয়াটুকুর মধ্য দিয়েই সকলের কাছ থেকে ললিতের জন্য আশীর্বাদ ভিক্ষে করে নিল। সকলেই সহৃদয়ভাবে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল মাকে। মিতুর ঠাকুমা মুখ বাড়িয়ে বলল, এবার ললিতের একটা বিয়ে দাও গো, ললিতের মা!
ললিত মায়ের কাঠের মতো শুকনো দুর্বল একখানা হাত ধরে সিঁড়িটা সাবধানে নামিয়ে আনল। নামতে নামতে মা মুখ ঘুরিয়ে মিতুর ঠাকুমাকে বলল, তোমরা আশীর্বাদ করো বাছা। ছেলেকে তো তোমরা জানোই, আমি বুড়ো অথর্ব হয়ে গেছি, চোখে ভাল দেখি না, তোমরাই বেছেগুছে পছন্দ করে দাও।
সকলেই সমস্বরে কথা বলে উঠল। হ্যাঁ, তারা ললিতকে জানে, হ্যাঁ এমন ছেলে! তারা দেখবে ললিতের জন্য একটি মেয়ে। কোনও চিন্তা নেই। মিতুর ঠাকুমা গলা বাড়িয়ে বলল, ললিতের পছন্দের কেউ আছে কি না খোঁজ নিয়ে গো ললিতের মা!
ললিতের মন বলল, ছিল। মিতু। তার তো বিয়ে হয়ে গেছে।
তুলসীর দিকে একখানা হাত বাড়াল মা, আঃ তুলসী, ললিতকে ফিরিয়ে এনেছিস।
শম্ভুদের বাড়ির পিছন দিকে তাদের ঘর, সরু একটা গলির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ঘরের তালা খুলতে খুলতে মা বলল, দেখ তুলসী, সারাদিন ঘর ছেড়ে নড়বার উপায় নেই আমার। ললিতটা বাইরে বাইরে ঘোরে, আর এই লক্ষ্মীছাড়া ঘর আগলে আমার থাকা। কত কিছু আছে কলকাতায়, কালীঘাট, রামকৃষ্ণের মঠ, ভাগবত রামায়ণ পাঠ। সবাই যায়, কেবল আমারই কিছু হয় না। বসে থাকতে থাকতে দেখ আমায় বাতে ধরেছে। তারা মেয়ে দেখ, আমি ললিতের বিয়ে দিই…
শরীরে এত কষ্ট মা’র তবু তাদের ছোট ঘরখানা ঝকমক করে, ললিতের তক্তপোশে ধবধবে চাদর পাতা।
ললিত সামান্য হাঁপাচ্ছিল। বিছানায় বসতে-না-বসতেই সে গড়িয়ে পড়ল। বলল, মা, এক গ্লাস জল দাও।
দিই বলে মা তবু তুলসীর সঙ্গে কথা বলে, তুই রোজ এসে ওকে বোঝাবি। কেন, মাস্টাররা কি বিয়ে করে না? তুই করিসনি?
খোলা জানালার ওপর সতেজ একটা পেয়ারার ডাল এসে পড়েছে। সিলিঙে ঘুরছে কোন আদ্যিকালের পুরনো ফ্যানটা। দেয়ালে সেই সূর্যাস্ত আর তিনটে ডিঙি নৌকোর ছবিওলা ক্যালেন্ডার। আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে রইল ললিত।
আর মাস কয়েক পরে এই ঘরের এই বিছানায় শুয়ে তার মৃত্যু হতে পারে।
মায়ের কথাগুলো আর বুঝতে পারছিল না ললিত। কেবল তার একঘেয়ে গলার স্বর তার কানে আসছিল। অনেক অনেকদিন পরে আজ তার হঠাৎ মনে হল এই স্বর তার বড় প্রিয়। এই রকম আরও কত কী প্রিয় ছিল ললিতের। তার কোনওটা হয়তো বা ওই জানালার ওপর হেলে-পড়া পেয়ারার ডাল, কিংবা ওই সূর্যাস্তের ছবিটির মতোই তুচ্ছ।
কাত হয়ে শুয়ে সে মায়ের মুখখানা দেখছিল। দাঁত-পড়া, তোবড়ানো একখানা মুখ। বুড়ি। মাঝে মাঝে আঁচলে নাক মুছে নেওয়ার মুদ্রাদোষ। এই তার মা।
জল চেয়েছিল ললিত, মা জল দিতে ভুলে গেল। আর-একবার চাইতে ইচ্ছে হল না তার। কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে সামান্য তন্দ্রা আর আচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে গেল সে।
মা তুলসীর সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিল। একটানা, একই রকম স্বরে। সে-সব কথা আর ললিতের কানে ঢুকছিল না। চোখের পাতা ভারী হয়ে পরস্পর মিতুর ঠোঁটের মতো লেগে রইল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সমস্ত চেতনাই সজাগ ছিল তার। সে ভেবে দেখছিল আর কয়েকটা দিন একতলার এই ছোট্ট ঘরে, বুড়ো পঙ্গু অক্ষম মায়ের সঙ্গে তার কেমন কাটবে। সম্ভবত খুবই একা লাগবে তার। মাঝে মাঝে প্রবীণ মুখশ্রী নিয়ে চিন্তিত তুলসী আসবে অভিভাবকের মতো, ললিতের ঠাট্টার উত্তরে মৃদু ম্লান হাসবে, আড্ডা জমবে না। মা তুলসীকে টেনে নিয়ে যাবে রান্নাঘরের চৌকাঠ অবধি, পিঁড়ি পেতে বসিয়ে দুঃখ আর আক্ষেপের কথা বলে যাবে। একা লাগবে ললিতের। হয়তো সে মাঝে মাঝে বেরোবে পাড়ায়, দু-একটা বাড়ি থেকে মায়ের প্রবীণ সঙ্গিনীরা ললিতকে ডাকবে, এসো, ললিত। ঘরে বসিয়ে তাকে শোনাবে তারই মায়ের দুঃখের কথা। বলবে, এত বড় ফাঁড়াটা কেটে গেল, এবার দেরি করে বিয়ে করো ললিত, জীবনের সব কাজগুলোই করণীয়। কোনওটাই ফেলনা নয়। এ-সবই ললিত জানে। কিংবা হয়তো সে গলির নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েক পলক দেখবে বাচ্চা মেয়েরা রাস্তায় ছক কেটে এক্কা-দোক্কা খেলছে। তাদের কারও বেণি ধরে একটু টেনে দিয়ে ললিত বলবে, কেমন আছিস রে টগর? কিংবা পাড়ার ঘরোয়া চায়ের দোকানটাতে যাওয়া যেতে পারে, যেখানে তার বয়সি পাড়ার কয়েকজন আড্ডা দেয়। তারা কেউই ললিতের বন্ধু নয়, পরিচিত। তবু তাদের সঙ্গেও একটু সময় কেটে যাবে। স্কুল থেকে ছুটি নেওয়া আছে, তবু আর-একটু ভাল বোধ করলে সে স্কুলের কাজও শুরু করতে পারে। হয়তো আগের মতোই বিশ্রী লাগবে তার, তবু সময় কেটে যাবে। সময় তো এখন আর খুব বেশি নয়!
সে মা আর তুলসীর অস্পষ্ট গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিল। চায়ের কাপে চামচ নাড়ার শব্দ। মা তুলসীকে চা করে খাওয়াচ্ছে। ললিত তাকাল না। তার চোখের দু’টি ভারী পাতা পরস্পরের সঙ্গে লেগে রইল। একথা ঠিক যে, দু’ মাস বাদে এই ফিরে আসার মধ্যে এতটুকু আনন্দ নেই। কিন্তু যদি মিতু তার বউ হত, তা হলে! ভাবতেই তার আনন্দের একটা স্রোত ললিতের শরীরকে নাড়া দিয়ে গেল। মিতু হলে— মিতু হলে— কিন্তু মিতু তো হল না ললিতের।
হওয়ার কথাও ছিল না। মিতুদের বড় বাড়ি, গেটের ওপর বোগেনভেলিয়ার ঝাড়, গ্যারেজে ছোট্ট একটা গাড়ি। বড় হতাশ লাগত ললিতের। মাঝে মাঝে মিতুর সঙ্গে দেখা হত স্কুলের রাস্তায়, আর ললিতের মনে হত সে এর জন্য সবকিছু করতে পারে। সবকিছু। দরকার হলে একটা-দুটো খুন, বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে এক-আধটা বাড়ি, হাজারটা মারমুখো লোকের মুখোমুখি পারে দাঁড়াতে। আশ্চর্য, কোনও দিনই মিতুর সঙ্গে তবু কথা বলা হয়নি। বড় ভাল ছেলে ছিল ললিত— ধীর, শান্ত, লাজুক আর ভিতু। মিতুর সঙ্গে কথা বলার মতো পাপ সে করেনি। কেবল মিতুকে দেখলে তার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠত, মুখের জল যেত শুকিয়ে, আর সারাটা অবসর সময় সে মনে মনে মিতুর সঙ্গ ধরত, ডাকত, বউ, আমার বউ।
মা তখনও মাঝে মাঝে তার বিয়ের কথা বলত, সেই বছর সাতেক আগেও। সে উত্তর দিত না, অন্যমনস্কর মতো মিতুর কথা ভাবত। মিতু হলে— মিতু হলে—
সম্ভবত মা কিছু টের পেয়েছিল। কীভাবে পেয়েছিল তা ললিত জানে না। হয়তো কেউ মাকে বলেছিল সকাল সাড়ে দশটায় স্কুলে যাওয়ার পথে ললিত হাঁ করে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিংবা এমনও হতে পারে যে, রাতে ঘুমের মধ্যে কোনও দিন সে মিতুর নাম ধরে ডেকেছিল, কিংবা বলেছিল যে, সে মিতুকে ভালবাসে। তখন জ্বরবিকারের মতো একটা অবস্থায় কী যে করেছিল ললিত কে জানে!
যেমন করেই হোক মা টের পেয়েছিল। মা ললিতকে কিছুই বলেনি। কিন্তু একদিন যখন ললিত ঘরে ছিল না তখন মা মিতুকে ডেকে এনেছিল ঘরে।
সেই ডেকে-আনার ফল ভাল হয়নি। যা ছিল তার মনের ব্যাপার, যা ছিল তার একার তা সমস্ত পাড়ায় বিশ্রীভাবে ছড়িয়ে গেল। মা মিতুকে কী বলেছিল, তা ললিত জানে না। শুধু এটুকু জানে যে, মিতু রাজি হয়নি।
বোধ হয় খুবই রেগে গিয়েছিল মিতু, মাকে অপমান করে বলেছিল, আমাকে এভাবে ডেকে আনা আপনার উচিত হয়নি। বাবা শুনলে খুব রেগে যাবে।
তার বোকা, ললিত-সর্বস্ব মা হয়তো বলেছিল, কিন্তু আমার ললিতকে দেখ, কেমন হয়ে যাচ্ছে আমার তরতাজা ছেলে। তুই রাজি হয়ে যা মিতু, আমি তোর বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলব।
শুনে মিতু হয়তো খুব রেগে গিয়েছিল। কেননা, ছেলেবেলা থেকেই সে জানে যে, সে বড় বাড়ির মেয়ে, বড় বাড়িতেই তার বিয়ে হবে। তার সেই নিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে এইভাবে তাকে চুরির চেষ্টা দেখে সে হয়তো মাটিতে পা ঠুকেছিল, এ আপনার অন্যায় মাসিমা, এটা খুব অন্যায়। আমার মা শুনলে ভয়ংকর বকবে যে, আপনি আমাকে বাড়িতে ডেকে এনে এইসব বিশ্রী কথা বলেছেন।
মা হয়তো তবু ভিখিরির মতো কাঙালপনা করেছিল, দেখিস মিতু, তোর সুখের সংসার হবে। ললিতের কুষ্ঠিতে আছে তিরিশের পর ওর ভোগসুখ, পয়সা হবে ওর দেখিস। তুই সুখে থাকবি, আমি তোদের সব দুঃখ টেনে নিয়ে চলে যাব। দেখিস, যাওয়ার সময় আমি একটুও দুঃখ রেখে যাব না। আমার আর বেশি দিন নেই রে!
কে জানে হয়তো এরপর মিতু কেঁদে ফেলেছিল। ডাইনি জটাইয়ের মতো এই বুড়িটা তাকে বশ করে ফেলছে এই ভয়ে হয়তো ককিয়ে উঠে বলেছিল, পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দিন মাসিমা! কিংবা তেজি ঘোড়ার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বলেছিল, আপনি আমাদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবেন না মাসিমা। বাবাকে বলে দিলে আপনি মুশকিলে পড়বেন। আর, ঠাকুমাকেও বলে দেব যেন আপনার কাছে আর না আসেন।
সেইদিন মিতু চলে যাওয়ার পর মা ভয় পেয়েছিল। ললিত যদি জানতে পারে! রাতে ঘরে ফিরে এসে ললিত দেখেছিল দারুণ গরমেও মা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
কী হয়েছে মা?
আমার জ্বর হয়েছে ললিত। রান্না করা আছে, তুই নিয়ে থুয়ে খা।
গায়ে হাত দিয়ে ললিত বলল, কোথায় জ্বর!
হয়েছে রে। শরীরের মধ্যে কেমন কাঁপুনি। দুপুর থেকে পড়ে আছি।
সে-রাতে অনেক এলোমেলো কথা বলছিল মা, যার স্পষ্ট অর্থ ললিত ধরতে পারেনি। ললিত বকবে, এই ভাবনায় ভয়ে ভয়ে সে-রাতে মা’র সত্যিই জ্বর এসেছিল।
তন্দ্রা ভেঙে ললিত দেখল ঘরে কেউ নেই। তুলসী চলে গেছে।
আস্তে আস্তে উঠল ললিত। এখন শরীরটা অনেক ঝরঝরে লাগছে। একটু খিদে টের পাচ্ছিল সে। উঠে ললিত ভিতরের দরজায় গিয়ে দেখল পেয়ারাতলার ছোট্ট খুপরি রান্নাঘরটায় মা নিশ্চল হয়ে বসে আছে। একটু কুঁজো হয়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো বসবার ভঙ্গি মা’র। যেন কোনও কিশোরীবেলার চিন্তায় বিভোর। আসলে এখন আর মাকে ললিতের পাকা মাথাওলা প্রবীণ মহিলা বলে মনে হয় না। সারাদিন কাটুকুড়ুনির মতো কুঁজো হয়ে হয়ে মা সারা ঘর ঘুরে বেড়ায়, খুঁজে খুঁজে ময়লা বের করে ঘর থেকে, বার বার সামান্য জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখে, বিছানার চাদর টান করে অকারণে, তারই ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ শূন্য হয়ে যায় চোখ, শিশুর মতো বোকা হয়ে যায় তোবড়ানো মুখ। যেন চারদিকের এই ঘরবাড়ি, ছোটখাটো জিনিসপত্র, এই ছোট এক ঘরের সংসার— এর কোনও কিছুর অর্থই মা বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে ঘুমন্ত অবস্থায়ও মাকে লক্ষ করেছে। হাঁটু মুড়ে ছোটখাটো হয়ে গিয়ে মা ঘুমোয়, নিঃসাড় সেই ঘুম, আর মাঝে মাঝে সেই মুখে একটু একটু হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়। তখন মনে হয় মা স্বপ্ন দেখছে— সেই কিশোরীবেলার স্বপ্ন। এক দূর গ কিংবা গাঁয়ের স্বপ্ন, যার সঙ্গে জেগে দেখা চারপাশের সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মাইলের তফাত।
মা’র মন ভুলো হয়ে গেল। বিকেলে জল চেয়েছিল ললিত, মা’র জল দিতে ভুল হয়ে গেল। আর মাসকয়েক পর যদি ললিত মরে যায়, তবে তার এই শিশু মা’কে কে দেখবে!
মাকে ডাকল না ললিত। আবার ঘরের মধ্যে ফিরে এল। একা লাগছে। বড় বেশি একা।
দুই
গলির মুখেই শম্ভু দাঁড়িয়ে ছিল। তুলসী বেরোতেই দেখা।
তুলসীদা, চললেন?
হুঁ।
তুলসী একটু লক্ষ করে দেখল, শম্ভুর ভোল পালটে গেছে। হাসপাতালে গিয়েছিল সাদামাটা একটা বুশ শার্ট আর সুতির প্যান্ট পরে। এখন চমৎকার একটা গাঢ় রঙের চাপা প্যান্ট তার পরনে, নীল রঙের টেরিলিনের শার্ট, হাতাদুটো অনেক দূর গোটানো— দুটো মাংসল হাত মুগুরের মতো ঝুলছে, বাঁ হাতের কবজিতে ঘড়িটাকে এতটুকু দেখাচ্ছে। মুখটা একটু ফরসা দেখাচ্ছিল শম্ভুর, সম্ভবত বিকেলে সাবান দিয়ে মুখ ধুয়েছে, একটু স্লো কিংবা পাউডারও দিয়ে থাকা সম্ভব। শম্ভুর মুখে একটা বোকা তৃপ্তির ভাব। চৌকো ভাঙাচোরা মুখ, আর মোটা দুটো ঠোঁটে একটা চাপা নৃশংসতা রয়েছে। সেটুকু তুলসীর ভুল দেখার দোষও হতে পারে। আসলে অতটা স্বাস্থ্যের জন্যই শম্ভুকে বোধহয় মাঝে মাঝে ভয়ংকর মনে হয়। শার্টের ওপর দিয়ে বুকের প্রকাণ্ড দুটো চৌকো পেশি ফুলে আছে, খুব সরু কোমর, ঘাড়টা মোষের ঘাড়ের মতো মোটা আর শক্ত। সেই তুলনায় মাথাটা ছোটই। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা বাবরি ধরনের চুল শম্ভুর, সামনের দিকে ফাঁপিয়ে তুলে আঁচড়ানো। সাজগোজ সত্ত্বেও শম্ভুকে যতটা সুন্দর দেখাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে ভয়ংকর।
আপনি তো ঢাকুরিয়ায় থাকেন, না?
তুলসী মাথা নাড়ল। শম্ভু তার সঙ্গ ধরে আস্তে আস্তে পাশাপাশি হাঁটছিল। বলল, কেমন বুঝলেন ললিতার অবস্থা?
ভালই তো। আপাতত চিন্তা নেই।
ডাক্তাররা কী বলছে?
ওই যা বলে। যদি রিলাপ্স করে তবে মাস কয়েকের মধ্যে করবে।
করবে বলে আপনার মনে হয়?
তুলসী অসহায়ের মতো বলল, কী জানি!
শম্ভু দাঁতে আর জিভে একটা চিরিক শব্দ করল, ললিতদা এই বয়সে মরে-ফরে গেলে বড় বিশ্রী।
তুলসী চুপ করে রইল। শম্ভুর পাশাপাশি হাঁটতে তার নিজেকে বড় বেমানান লাগছিল। সে রোগা, কালো আর ছোট। বিয়ের পর কয়েক দিনে সামান্য একটু চেহারা ফিরেছে তুলসীর, রংটা বোধ হয় আগের চেয়ে খানিকটা উজ্জ্বল। তবু অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান শম্ভুর কাছাকাছি হাঁটতে সে এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করছিল।
গোপালের মনোহারি দোকানে হ্যাজাক জ্বলছে, কয়েকজন ছেলে-ছোকরা দাঁড়িয়ে। তুলসী শম্ভুকে বলল, দাঁড়াও, একটু সিগারেট কিনে নিই।
শম্ভু ঘাড় নেড়ে ছোকরাদের দলটার মধ্যে ভিড়ে গেল।
সিগারেট কিনতে কিনতে হঠাৎ চোখ তুলে তুলসী দেখে পাঞ্জাবি পরা রোগাটে চেহারার একটা লোক তাকে দেখছে। লোকটার মুখে-চোখে একটা অসহায়, ভয় পাওয়া বুড়োটে ভাব। সে চমকে উঠল। পরমুহূর্তেই ভুল ভেঙে গেল তার। এরা এমন বিদঘুটে জায়গায় আয়না টাঙিয়ে রাখে।
ছোকরাদের দল থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে তুলসী জিজ্ঞেস করল, শম্ভু, তুমি যাবে নাকি?
শম্ভু ভীষণ ব্যস্ত এবং উত্তেজিতভাবে কথা বলছিল। দল থেকে মাথা উঁচু করে বলল, এক মিনিট, তুলসীদা।
সম্ভবত পাড়ার কোনও গণ্ডগোল। শম্ভু এইসব ছেলেদের দলের মাথা, এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তুলসী অস্বস্তির সঙ্গে একটা সিগারেট ধরাল। দাঁড়িয়ে রইল শম্ভুর জন্য।
ললিতকে ফিরিয়ে আনা গেছে, অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও, এটা ভাবতে তুলসীর ভাল লাগছিল। এরপর ললিতের ভাগ্য। যত দূর করার তুলসী করেছে। অবশ্য তুলসী না করলেও কেউ-না-কেউ করতই। না করলেও ক্ষতি ছিল না। চিকিৎসা হাসপাতাল থেকেই হচ্ছিল, সে শুধু যেত ললিতের মনের জোরটা বজায় রাখতে, যাতে সে ভেঙে না পড়ে। কিন্তু ক্রমে তুলসী বুঝতে পেরেছিল বাড়তি মনোবালের কোনও দরকার ললিতের নেই। সে একরকম করে তার অসুখের ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল। তাকে তাই খুব বেশি গম্ভীর বা বিষণ্ণ দেখাত না। বরং তুলসী গেলে ঠাট্টা করত ললিত, কী রে শালা, তোকে গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন? তোর ভাবী বউটা কি কুচ্ছিত? না কি, দাদা বের করে দিয়েছে তোকে বাড়ি থেকে বিয়ে দেবে না বলে? এ—কথা ঠিক যে, তুলসী কোনও দিনই খুব একটা হাসিখুশি হতে পারে না। তুলসী জানে যে, সে স্বভাবে গম্ভীর নয়। তার আসল অসুখ হল, সে বড় অল্পেই দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়। ছোটখাটো হাজারটা দুশ্চিন্তা তুলসীর, হাজারটা ভয়। তার মন কখনও দুশ্চিন্তা থেকে ছাড় পায় না। কোনও দিন স্কুল কামাই গেলে সারা দিন তার চিন্তা হয় পরদিন হেডমাস্টার তাকে ডেকে অপমানকর কিছু বলবে কি না। এই চিন্তা এমনই পেয়ে বসে তাকে যে, সারাটা দিন সে চাপা উত্তেজনায় কাটায়, একা হলেই হেডমাস্টারের সঙ্গে একটা কল্পিত সংলাপ তৈরি করতে থাকে: ‘কাল আসেননি তুলসীবাবু!’ ‘আজ্ঞে না।’ ‘কেন!’ চাপা রাগ দেখিয়ে তুলসী বলবে, ‘কাজ ছিল!’ ‘কাজ! কাজ থাকতে পারে, কিন্তু গত তিন মাসে আপনার সাতটা ক্যাজুয়েল লিভ গেল, এর পরও তো মশাই নয় মাস রয়েছে, তখন আপনার কাজ থাকবে না? আর দেখুন, আপনি তো জানেন কম স্টাফে আমার স্কুল চালাতে হয়, এক-দু’জন করে রোজ অ্যাবসেন্ট থাকলে ক্লাসগুলো কাকে দিয়ে আমি চালাব! স্মরজিৎবাবু এসে বললেন যে, কাল সময়মতো ওঁর ভাত রান্না হয়নি বলে আসতে পারেননি, আপনি এসে আরও ধোঁয়াটে যুক্তি দিলেন— কাজ ছিল। এ-সব ছেলেমানুষি যুক্তি ছাত্রদের মুখে মানায়, আপনাদের নয়।’ তুলসী হিংস্রভাবে বলবে, ‘আমার পাওনা ছুটি আমি নিচ্ছি। আর আমার কী রকম কাজ ছিল কিংবা কাজ ছিল কি না এ-সব ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনারও হাজারটা দোষ রয়েছে, সেগুলোকে কে দেখে?’ ‘কী রকম?’ বলে হেডমাস্টার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। তুলসী ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলবে, ‘আছে। গ্র্যান্টের টাকায় আপনি সায়েন্স ল্যাবরেটরি করলেন, কিন্তু আমরা সাত মাস টাকা পেলুম না, স্কুলে ছেলে নেই তবু আপনি তিনটে স্ট্রিমে স্কুল চালাচ্ছেন কারণ প্রতিটি স্ট্রিমের জন্য আপনি পঁচিশ টাকা করে অ্যালায়েন্স পান, তা ছাড়া স্কুলের শতকরা ষাট-সত্তরজন ছাত্র ডিফল্টার, তার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই, আপনি গার্জিয়ানদের খুশি রাখার জন্য কোনও স্টেপ নেন না…’ ইত্যাদি। বস্তুত এ-সব ভাবতে ভাবতে সে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে, সারাটা দিন তার তেতো হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হেডমাস্টার কোনও দিনই তাকে জিজ্ঞেস করে না যে কেন সে গতকাল স্কুলে আসেনি। বড় জোর হেডমাস্টার বলে, ‘আপনি কাল আসেননি, না?’ তুলসী ভীষণ সংকুচিত হয়ে বলে, ‘আজ্ঞে না।’ হেডমাস্টার খুব অবহেলার সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেয়, ‘ঠিক আছে।’
কিংবা কখনও তুলসী ভীষণ রকমের আজগুবি চিন্তার পাল্লায় পড়ে। একদিন সকালে দাদা-বউদির একটা ঝগড়া হয়ে গেল। দাদা গটমট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে অফিসে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঘর থেকে বউদি চেঁচিয়ে বলল, ‘ফিরে এসে দেখো আমি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছি।’ কথাটা আধোকান্নার বিকৃত গলায় এমনভাবে বলেছিল বউদি যে তুলসীর মাথায় কথাটা লেগে গিয়েছিল। সারা দিন আর ব্যাপারটা খেয়াল ছিল না তুলসীর। কিন্তু স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রেনে হঠাৎ মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হয়ে পড়ল তুলসী। এখন ফিরে গিয়ে যদি সত্যিই দেখে যে বউদি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে তা হলে সে কী করবে? এ-সব অবস্থায় লোকে কী করে? সে আকাশপাতাল ভেবে দেখল, তার মুখের জল শুকিয়ে গেল, এবং অল্প সময়েই সে টের পেল যে, দুশ্চিন্তায় তার গাল বসে যাচ্ছে। হয়তো গিয়ে সে দেখবে বউদির ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, ডাকাডাকিতে খুলছে না। তখন দরজা ভাঙার আগে তাকে পাড়া-প্রতিবেশীদের ডেকে লোক জড়ো করতে হবে। তারপর দরজা ভাঙা, দড়ি কেটে মড়া নামানো, কিংবা হয়তো মড়া নামানোর আগেই পুলিশ ডাক্তার অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেওয়ার ঝামেলা, দাদাকে ফোন করা। মরবার পর বউদির চেহারা কেমন হবে কে জানে, সেটা দেখাও তো একটা নরক-যন্ত্রণা। বাচ্চাগুলোকে বউদি নিশ্চয়ই পাশের ঘরে বন্ধ করে রাখবে। বের করার পর ওদের কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতে ভাবতে তুলসী শিউরে উঠল। এরপর পোস্টমর্টেম, ডেথ সার্টিফিকেট ইত্যাদি সব ঝামেলাই তাকে করতে হবে। মড়া উঠতে উঠতে বোধহয় পরদিন রাত হয়ে যাবে। এই শীতে মড়া পুড়িয়ে স্নান করা ইত্যাদিও ভীষণ ব্যাপার। তারপর সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে একা ঘরে শোয়া, অপঘাতে বউদির মৃত্যুর পর সেটাও একটা সমস্যা। এরপর বউ-অন্তু দাদা যদি সন্ন্যাসী হয়, কিংবা সব ছেড়েছুড়ে চলে যায় তা হলে তার গোটা তিনেক বাচ্চার ভারও সারা জীবনের জন্য পড়ল তুলসীর ঘাড়ে…। ভাবতে ভাবতে সমস্ত ব্যাপারটাকে চোখের সামনে এত সত্যের মতো দেখতে পাচ্ছিল তুলসী যে শীতেও তার ঘাম ছাড়তে লাগল। সে সেদিন অনেকক্ষণ আড্ডায় কাটাল, তারপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল, বাড়িতে ঢুকবার আগে অন্তত বার তিনেক বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করল। রাত বারোটায় চোরের মতো ঢুকে দেখল, ঘরে আলো জ্বেলে দাদা-বউদি আর দাদার বড় মেয়েটা শুকনো মুখে তুলসীর জন্য বসে আছে। তার দেরি দেখে সকলেই চিন্তিত।
বস্তুত তুলসী কখনওই সুখে থাকে না। নিশ্চিন্ত না থাকাটা তার নিয়তির মতো। হয়তো ট্রামে কিংবা বাসে জানালার ধারে প্রিয় সিটটিতে বসে সে যাচ্ছে, এমন সময় ধপ করে পাশে এসে বসল খুব কর্কশ চেহারার একটি লোক, কিংবা এমন কোনও লোক যার নাক কান চুলকোনোর মুদ্রাদোষ আছে, বা এমন কেউ যে বসেই তার পিঠের ওপর দিয়ে হাতটা সিটের পিছনে রেখে তার শরীরের দিকে হেলে বসল। সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তা কিংবা অস্বস্তি শুরু হয়ে যায় তুলসীর!—তার পাশে-বসা লোকটা কেমন! যদি এখন এ-লোকটার সঙ্গে তার কোনও কারণে লেগে যায়! যদি লোকটা তার পকেটে হাত দেয়, কিংবা যদি তার শরীরে আরও হেলান দিয়ে বসে? তা হলে কী করবে তুলসী? অমনি তার মন দু’ ভাগ হয়ে গিয়ে পাশে বসা লোকটার সঙ্গে কী রকম কথাবার্তা হতে পারে তার একটা খসড়া তৈরি করতে লেগে যায়।
এখন ললিতের কথা ভাবলেও নানা রকমের ভাবনা একটার সঙ্গে আর-একটা জড়িয়ে আসে। তুলসী ঠিক করে রেখেছে এখন থেকেই সে ললিতের মা’র জন্য একটা আশ্রমটাশ্রম খোঁজ করে রাখবে।
সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল। শম্ভু ভিড় ছেড়ে এগিয়ে এসে বলল, চলুন তুলসীদা, আপনাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।
চলো।
কয়েক পা হেঁটে হঠাৎ শম্ভু বললে, মা প্রথমটায় বিশ্বাসই করতে চায়নি যে রোগটা ছোঁয়াচে নয়। মা’র ধারণা এরপর আর ও-ঘরের ভাড়াটে জুটবে না।
তুলসী অর্থটা ধরতে পারল। চুপ করে রইল সে।
শম্ভু একা একাই হাসল, মা’দের যে কী সব বাজে ধারণা থাকে!
তুলসী জানে হয়তো মাস কয়েক পর ললিতদের ঘরটা খালি হয়ে যাবে। কম ভাড়াতেই ললিতরা আছে। মাত্র পঁচিশ টাকা, বছর দশেক আগেকার ভাড়া। এখন ও-ঘরের ভাড়া অনায়াসে ষাট-সত্তর টাকা হবে। বাথরুম-টাথরুম আলাদা, কলে প্রায় সারা দিন জল। তুলসীর একবার ইচ্ছে হল শম্ভুকে জিজ্ঞেস করে, এবার তারা কত ভাড়ায় ঘরটা দেবে।
তারপরই মনে মনে সে নিজেকে ইতর বলে গাল দিয়ে সামলে গেল। ভাগ্যিস মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যায়নি! তা হলে সম্ভবত শম্ভু একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলত, কেন ললিতা মরে গেলে আপনি নেবেন?
মনে মনে নিজের কাছেই একটা জবাবদিহি খাড়া করার চেষ্টায় খুব অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল তুলসী। এমন সময়ে তাকে চমকে দিয়ে শম্ভু বলল, বাসে অত ঘুরে যাবেন কেন তুলসীদা, আনোয়ার শা রোড ধরে রিকশায় চলে যান, দু’-চার আনা বেশি লাগবে।
আনোয়ার শা রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে তুলসী একটু ভাবল। রিকশায় বা বাসে যেতে তার ইচ্ছে করছিল না। যদিও শরীরটা ক্লান্ত, ট্রেন বাস ট্যাক্সিতে অনেকটা ঘুরেছে সে, এবং ঘরে মৃদুলা— তার বউ— তার অপেক্ষায় আছে, তবুও তার মনে হল নিজেকে একটু শাস্তি দেওয়া দরকার। ললিতদের ঘরটা শম্ভুরা এবার কতয় ভাড়া দেবে, এ-প্রশ্নটা তার মাথায় এল কেন? সে মুখে বলেনি ঠিকই, কিন্তু মনে কথাটা এসেছিল। মনের এই অসংযমটুকুর জন্য মাইল দুই হেঁটে যাওয়ার ছোট্ট একটু শাস্তি বোধহয় তার পক্ষে চমৎকার হবে।— না শম্ভু, আমি বরং এটুকু হেঁটেই চলে যাই।
শম্ভু হাসল, হাঁটবেন! সে তো ভালই, একটু এক্সারসাইজ হবে। শরীরটা তো বড় নাড়াচাড়া করেন না।।
তুমি কোন দিকে? তুলসী জিজ্ঞেস করে।
একটু সিনেমায়-টিনেমায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আর হবে না। পাড়ায় একটা গণ্ডগোল বেধে আছে, ফিরতে হবে।
কী গণ্ডগোল?
কেসটা ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোককে কাল রাতে কয়েকজন এসে খুব ঠেঙিয়ে গেছে। ভদ্রলোক একা থাকতেন, পাড়ার কারও সঙ্গে মিশতেন না, তবে মাঝেসাঝে একটা মেয়ে আসত বইখাতা হাতে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা মেয়ে-ঘটিত। একটু দেখতে হবে। বুঝতেই পারছেন পাড়ার ইজ্জত… বাইরের লোক এসে মেরে যাবে…বলে হাসল শম্ভু। আত্মপ্রত্যয়ের হাসি।
তুলসী বলল, তা হলে চলি।
ক’দিন আগে বর্ষা গেছে খুব। ভাঙাচোরা বিশ্রী রাস্তাটায় খোঁসপাঁচড়ার রসের মতো জল জমে আছে। দু’ধারে কাঁচা ড্রেন বর্ষার জল পেয়ে পচে ফুলে আছে। মুসলমানদের বস্তি, দু’-একটা মসজিদ এবং কবর। তুলসী সাবধানে পা ফেলছিল। সন্ধে হয়ে এসেছে। মৃদুলার জন্য আগ্রহ অনুভব করছিল তুলসী।
হাঁটতে হাঁটতে তুলসী ভাবছিল, এই হেঁটে যাওয়ার শাস্তিটুকু তার পাওয়া উচিত। মৃদুলার কাছে যেতেও একটু দেরি হবে। ভাল, এইটুকু দেরি হওয়া ভালই। ললিতদের ঘরটার ভাড়া এখন কত হবে এ-কথা মনে আনা তার উচিত হয়নি। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ও-রকম বিশ্রী চিন্তা ইচ্ছে করে তুলসী করেনি। চিন্তাটা এসে গেল। তার মনের আশ্চর্য গতির কথা তুলসী ভাবছিল। নিজের মনের ওপর তার এতটুকু হাত নেই, মাঝে মাঝে সে অসহায়ের মতো টের পায় তার মন ইচ্ছেমতো জঘন্য কুৎসিত নানা রকম চিন্তা তৈরি করে যাচ্ছে। সে তখন নিজেকে প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করে— শয়তান আহাম্মক, অন্য কথা ভাবো। কিন্তু কিছুই সে করতে পারে না। নিজের এই কুৎসিত মনটার জন্য তুলসী বড় ভয়ে ভয়ে থাকে। বুঝতে পারে তার ভিতরে এক শয়তান আহাম্মক অহংকারী আমি রয়েছে যাকে বের করে দেওয়া উচিত।
মৃদুলা একদিন তাকে বলেছিল, এত তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না, জানো?
তুলসী সামান্য অবাক হয়ে বলল, তা হলে হল কেন?
মৃদুলা হাসছিল। বলল, হয়ে গেল, কী আর করা যাবে!
বিছানায় শুয়ে ছিল তুলসী, উঠে বসল। বলল, এ-বিয়েতে তোমার ইচ্ছে ছিল না?
মৃদুলা হাসিমুখেই বলল, ইচ্ছে হয়তো ছিল না। কিন্তু হয়ে গিয়ে এখন ভাল লাগছে।
বলে মৃদুলা তাকে আদর করল অনেক। তুলসী গলে গেল, কিন্তু অস্বস্তিটা ছাড়ল না তাকে। পরের রাতে সে আবার কৌশলে কথাটা তুলল, তোমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমার বাবা বিয়ে দিলেন? জোর করে! অ্যাঁ!
মৃদুলা অবাক হয়ে বলল, জোর করে নয়তো! আমি কি সে কথা বলেছি।
তবে!
তবে কী? বাবার নিজেরও ইচ্ছে ছিল না এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার। গান শিখতুম, লেখাপড়া করতুম— আমার বিয়ের ব্যাপারে কেউ ভাবছিলই না। কিন্তু তবু দেখো দুম করে বিয়ে দিয়ে দিতে হল।
শুনে তুলসীর বুক ধড়ফড় করে উঠল। সে জিজ্ঞেস করল, কেন?
মৃদুলা বলল, সে অনেক ব্যাপার। শুনলে তুমি খুশি হবে না।
তবু শুনি।
না।
মৃদুলা, লক্ষ্মী মেয়ে, বলো। না বললে আমার খুব খারাপ লাগবে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোনও কিছু গোপন থাকা উচিত না, তাতে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়…
তুলসীর ব্যগ্রতা প্রকাশ হয়ে গেলে মৃদুলা হেসে বলল, তোমার ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়। নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।
তবু বলো, লক্ষ্মী, পায়ে পড়ি।
ছিঃ। বলে মৃদুলা একটুক্ষণ তাকে ভাল করে দেখল, হাসল, তারপর বলল, তুমি ভীষণ উইক।
অনেক কাকুতি-মিনতির পর মৃদুলা বলতে রাজি হয়েছিল।
আমার পেছনে কিছু লোক লেগেছিল। তারা ঘুরঘুর করত।
কেন? তুলসী জিজ্ঞেস করেছিল।
কেন আবার! বোঝো না! মেয়ের পিছনে ছেলেরা কেন ঘুরঘুর করে!
হ্যাঁ, তুলসী বোঝে। তবু তার মন থেকে প্রশ্নটা গেল না। কেন কিছু লোক মৃদুলার পিছনে ঘুরঘুর করত? কেন? অ্যাঁ! কী তাদের অধিকার একটা মেয়ের পিছনে ঘুরঘুর করার। ভয়ংকর অন্যায় এটা, ভীষণ অন্যায়।
তারা কারা?
পাড়ারই ছেলে সব। তাদের মধ্যে একজন ছিল বিভু। লেখাপড়া শেখেনি, বাপ দুধ বিক্রি করত, পয়সা ছিল অনেক। ছেলেটা প্রথম প্রথম আমাকে দেখে মাথা নিচু করত, অনেক দূর দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেত। কখনও সখনও একটা সাইকেলে সাঁ করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেত। কোনও দিন কথা বলার চেষ্টা করেনি। শুনেছিলুম ছেলেটা খুব ভাল সাইকেল চালায়, সাঁতার দেয়, ফুটবল খেলে। এ-সব কারণেই বোধ হয় লেখাপড়া হয়নি, শুনতুম এক নম্বরের বখা ছেলে। তাই আমাকে দেখে যখন পাশ কাটিয়ে যেত বা মাথা নিচু করত তখন আমার সন্দেহ হত যে, বোধ হয় এবার ছেলেটার মাথা ঘুরে গেছে। আর এ-সব ছেলে মেয়েদের ব্যাপারে সিরিয়াস হলে মুশকিল। তারপর শোনো, কলেজে যাতায়াতের পথে প্রায়ই দেখা হত, কোনও দিন বা বাস-স্টপে দাঁড়িয়ে থাকত, সকালসন্ধে অসংখ্যবার আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেত। তারপর বোধ হয় একা কিছু করা যাচ্ছে না দেখে বন্ধুবান্ধবদের জুটিয়ে আনল। দেখতুম বাস-স্টপে এক দঙ্গল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝখানে বিভু। আমাকে দেখলেই চাপা গলায় ওর বন্ধুরা বলত, বিভু, তোরটা, তোরটা। আর কী সাহস দেখো, একদিন বাসে উঠেছি, ওমা, বাস আর ছাড়ে না, ড্রাইভার চেঁচিয়ে কাকে যেন সরে যেতে বলছিল। উঁকি দিয়ে দেখি ওই দলের একটা ছেলে রাস্তার মাঝখানে নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছে, মুখে বদমাইশির হাসি। কোনও কোনও দিন তিন-চারজনকে নিয়ে বাসে উঠত বিভু, কলেজ পর্যন্ত ‘ফলো’ করত। আমি ভয় পেয়ে গিয়ে মাকে বললুম, মা বলল, কী আর করবি বল, ওদের দিকে কখনও তাকাসনি। বুঝলুম মাকে বলে লাভ নেই, বাবাকেও বলতে ইচ্ছে করত না, কেন না বাবা তোমার মতোই ভিতু ভালমানুষ, এ-সব শুনে হয়তো খুব নার্ভাস হয়ে পড়বেন, আর বলা যায় না, ভিতুদের যা স্বভাব, হয়তো বলে বসবেন, ওর সঙ্গেই তোর বিয়ে দিয়ে দিই মৃদুলা। আমি বাবাকে বললুম না, কিন্তু ওদের সাহস ক্রমে বাড়ছিল। সকালে সন্ধেবেলায় আমাদের বাসার সামনে আড্ডা দিত ভিড় করে দাঁড়িয়ে। আমার ছোট ভাই বাচ্চু রাস্তায় গেলে বলত, এই বিভুর শালা, কোথায় যাচ্ছিস? বাবা সন্ধেবেলায় বাইরের ঘরে বসে মক্কেলদের সঙ্গে কথা বলতেন, একদিন একটা ছেলে ঘরের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে বলল, মেসোমশাই, আগুনটা একটু দেবেন? এইভাবে আমাদের ভয় পাইয়ে আর ঘাবড়ে দিয়ে তারপর একদিন ওরা কয়েকজন মুরুব্বি ছেলেকে বাবার কাছে পাঠাল বিভুর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা পাড়তে। বাবা ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন, অবাক হয়ে বললেন, ওরা স্বজাতি নয়। ছেলেগুলো ফিরে গেল, কিন্তু তারপর একদিন বিভুর বন্ধুরা দল বেঁধে এল। বিশ্রী কালো কালো কর্কশ চেহারা, রংচঙে পোশাক, একজনও কথা বলতে জানে না। ওরা বলল, জাতফাত নিয়ে মাথা ঘামাবেন না মেসোমশাই, সব জাতই মানুষ। আর তা ছাড়া আপনি যে বামুন তার কোনও প্রমাণ আছে? পাকিস্তান থেকে এসে অনেকেই ও-রকম বামুন কপচায়। সব এফিডেভিড করা বামুন, আমরা জানি। আর শিক্ষিতা মেয়ে তো কী হয়েছে। বিভু স্পোর্টসম্যান, আজকাল স্পোর্টসম্যানদের লেখাপড়ার দরকার হয় না। তবু যদি বলেন তো বিভু আবার স্কুলে ভরতি হবে, তিন-চারটে মাস্টার রেখে ওকে আমরা পাশ করিয়ে দেব। এ-সব শুনে বাবা আর ভয়ে কথাই বলতে পারল না। পরদিনই আমাকে কলেজ-ফেরত ট্যাক্সিতে তুলে বাবা দমদমে পিসিমার বাড়িতে রেখে এল। কলেজে যাওয়া বন্ধ হল, বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করলেন। শুনতুম আমাদের বাড়িতে রাতে কিংবা দুপুরে ঢিল পড়ছে, আমাদের বাইরের ঘরের সিঁড়িতে গু ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে রাত্রিবেলা। এক মাসের মধ্যেই বাবা তোমার খবর আনলেন, বললেন, চমৎকার ছেলে, খুব সৎ আর নিষ্ঠাবান। ব্যস, বিয়ে হয়ে গেল।
মৃদুলার কাছ থেকে এ-গল্প শোনার পর তুলসী স্বস্তি পেল না। মৃদুলা দেখতে এমন কিছু সুন্দর নয়। তার গালে ব্রণর দাগ, ঠোঁট পুরু, তবে চোখ দুটো মৃদুলার সুন্দর। শ্যামবর্ণ মেয়েদের চোখ সুন্দর হলে ফরসা মেয়েদের চেয়ে তাদের আকর্ষণ বেশি হয়। সব সুন্দরই তো আর আকর্ষণ করার শক্তি রাখে না। মৃদুলা সুন্দর না হলেও সেই আকর্ষণশক্তি তার আছে বোধ হয়। তা ছাড়া মৃদুলার শরীরটাও রোগার ওপর বেশ মজবুত। উগ্র ধরনের সতেজ ভাব আছে তার শরীরে, আর মাথায় অনেক চুল। মৃদুলাকে ভাল করে লক্ষ করে বিষণ্ণভাবেই তুলসী বলেছিল, বুঝতে পারছি না তোমার পিছনে ছেলেটা এত ঘুরেছিল কেন!
সম্ভবত তুলসীর মনোভাব বুঝেই মৃদুলা উত্তর দিল, ও, আমার বুঝি কিছু নেই, না!
মৃদুলা হাসছিল। কিন্তু তুলসীর ভাল লাগেনি। সে কাঠ কাঠ গলায় বলল, সে-কথা বলছি না। তবে—
তবে কী তা তুলসী আজও জানে না। গত মাস দেড়েকে সে ভেবে বের করতে পারেনি যে, ঘটনাটুকুর মধ্যে এমন কী ছিল যাতে মাঝে মাঝে তার মৃদুলার ওপর রাগ হচ্ছে। তার এমন কথাও মনে হয়েছে যে, মৃদুলার আকর্ষণশক্তি না থাকলেই ভাল ছিল। মনে হয়েছে যে, মেয়েদের বেশি আকর্ষণশক্তি থাকা বা উগ্র সুন্দরী হওয়াটা এক ধরনের অন্যায়। এখন সেই ছেলেটা— সেই বিভু যদি মৃদুলার খোঁজ পায়, যদি তাদের ঠিকানা খুঁজে বের করে তা হলে কী হবে! এত অল্পে সে মৃদুলাকে ছেড়ে দেবে বা ভুলে যাবে এটা সম্ভব নয়। যদিও তাদের বাসা বিভুর পাড়ায় নয়, তবু বেপরোয়া এবং মরিয়া বিভু এ-পর্যন্ত হানা দিতেই পারে। দিলে, শুধু রাতে বা দুপুরে বাড়িতে ঢিল মেরে এবং সিঁড়িতে ও ঢেলেই কি বিভু নিশ্চিন্ত থাকবে! তুলসীই এখন তার সবচেয়ে বড় বাধা, কাজেই তুলসীকে সরিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা কি তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! কাগজে রোজ ব্যর্থ প্রেমের সঙ্গে অ্যাসিড বালব্ আর ছোরামারা ইত্যাদি ঘটনার কথা চোখে পড়ে তার।
তাই আজকাল তুলসী বাড়ির বাইরে একটু অস্বস্তি বোধ করে একা, আগে পিছনে ভাল করে নজর রাখে, এবং সতর্কভাবে লোকজনকে লক্ষ করে। বস্তুত সে টের পায় মৃদুলার জন্যই তার শান্তি অনেকটা নষ্ট হয়ে গেল। আবার যখন সে ভাবে যে মৃদুলার জন্য একজন পাগল হয়েছিল, তখন আবার তার মৃদুলার প্রতি এক ধরনের পাগলাটে ভয়ংকর ভালবাসাও জেগে ওঠে।
বাড়ি ফিরে তুলসী দেখল ঘরগুলোর বাতি নেভানো, দাদা-বউদি আর বাচ্চারা বোধ হয় কেউ বাড়িতে নেই। সামনের ঘরের দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। ঘরে ঢুকে সুইচ টিপেই সে ভয়ংকর চমকে গেল। মৃদুলা মেঝেতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
লাফিয়ে ওঠা হৃৎপিণ্ডকে সামলে তুলসী প্রশ্ন করল, কী হয়েছে, মৃদুলা?
স্খলিত গলায় মৃদুলা বলল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
তিন
সারা রাত ধরে ঝিরঝির বৃষ্টি হয়ে গেল কি? নাকি রান্নাঘরের টিনের চালের ওপর পেয়ারা গাছের ডালপালা নড়ার শব্দ! গাঢ় ঘুম হয়নি ললিতের— সারা রাত সে এক অবসন্ন আচ্ছন্নতার মধ্যে পড়ে ছিল। তার মধ্যে অস্বস্তিকর খ্যাপাটে সব স্বপ্ন দেখেছে সে।
রেলগাড়ির একটা কামরায় সে একা খুব দূরে কোথাও চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ টের পেল গাড়ি থেমে আসছ। বাইরে ধীরে গম্ভীর গলায় কেউ হেঁকে বলছে— যশিডিহ্…যশিডিহ্…। যেন তার জন্যই ওই ডাক, ওই নামোচ্চারণ। হঠাৎ খেয়াল হয় এইখানেই তার নামার কথা, এইখানেই তার যাত্রা শেষ, এই যশিডিতে। ত্বরিতে উঠল সে, লাফিয়ে নামল বাঙ্ক থেকে, সুটকেস টেনে নিয়ে অন্য হাতে দরজা খুলে সে দেখতে পেল গভীর অন্ধকার চরাচর, প্লাটফর্ম নেই, স্টেশনের বাতি নেই, লোকজন নেই। শুধু খুব লম্বা কালো পাথরের মতো চেহারার একটা দেহাতি লোক একটা মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার জন্যেই। যন্ত্রের মতো ধীর গম্ভীর গলায় সে বলে যাচ্ছে— যশিডিহ্… যশিডিহ্…। তার মশালের আলো তার শরীরের মন্ত ছায়াকে নিয়ে দুলছে। মশালের আলো পড়েছে ধান-কেটে-নেওয়া খেতে, আলের ওপর বর্ষার ব্যাঙ ডাকছে, সেই ডাক শূন্য মাঠগুলিকে আরও বেশি শূন্য করে দিচ্ছে। এই অদ্ভুত যশিডিতে তার জন্যেই থেমেছে রেলগাড়ি। তাকে নেমে যেতে হবে। দুঃখে বুক ভেঙে যাচ্ছিল ললিতের— গাড়ির কামরায় কামরায় ঘুমন্ত সুখী লোকেরা টেরও পেল না যে, ললিতকে অন্ধকার শূন্য একটা মাঠের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে রেলগাড়িটা চলে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক যশিডি নামিয়ে নিচ্ছে তাকে চিরকালের মতো…
শেষরাত্রির দিকে ললিত ঘুমের মধ্যে যশিডির ডাক শুনতে শুনতে চমকে উঠল। যশিডি, না ললিত? তার নাম ধরে কেউ ডাকছে না?
ঘোর অন্ধকারে চোখ খুলল সে। গায়ে ঘাম। ঘরে একটা বদ্ধ হাওয়ার ভ্যাপসা গন্ধ। জেগে সে শুনতে পেল মা ডাকছে, ললিত, ও ললিত।
উঁ।
পাশ ফিরে শো। তোকে বোবায় ধরেছে।
স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল ললিত। বিছানায় একটা ঘেমো ভেজা-ভেজা ভাব, শরীর রাখতে ইচ্ছে হয় না। আস্তে সে উঠে বসল ঘোরের মধ্যে। মাকে জিজ্ঞেস করল, সারা রাত খুব বৃষ্টি হয়েছে, না মা?
দুর! বৃষ্টি কোথায়, আমি তো শুয়ে থেকেই জেগে আছি।
আচ্ছন্নতার মধ্যে বসে থেকে একটু চিন্তা করল ললিত। মনে হল সারা রাত যে বৃষ্টির শব্দটা সে শুনেছে সেটা বোধহয় বৃষ্টি নয়। মশারি তুলে বাইরে যেতে গিয়েও সে অপেক্ষা করল। না, আর কোনও শব্দ নেই। ভুলই। বুকের মধ্যে দুরদুর করে দ্রুত শব্দ হচ্ছে হৃৎপিণ্ডের— ঘুম ভেঙে হঠাৎ উঠে বসলে এ-রকম হয়, আবার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু আর শুল না ললিত, বালিশের পাশ থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই হাতড়ে আনল। দেশলাই জ্বালার শব্দে মা আবার জেগে উঠে বলল, ললিত উঠলি!
হুঁ
শরীর কেমন লাগছে?
ভাল। তুমি ঘুমোও।
আমার আর ঘুম! মা বিড়বিড় করে কী একটু অস্পষ্ট কথা বলে পাশ ফিরল। মায়ের হাই তোলার শব্দ শুনল ললিত। ললিতের মনে হল মা এখন আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করবে। বুড়ো হয়ে গেলে মানুষের কথা বলার ঝোঁক বেড়ে যায়। তা ছাড়া এখন ললিতকে মায়ের অনেক কথা বলার আছে। সে-সব কথার অধিকাংশই আবোল-তাবোল, অর্থহীন, পুরনো দিনের কথা বলতে বলতে ভুল হয়ে যায়, এক কথা থেকে পারম্পর্যহীন আর-এক কথা এসে পড়ে, কখনও ললিতের বিয়ে এবং ভবিষ্যৎ, চাকরি কিংবা রোগা হয়ে যাওয়া চেহারার কথা বলতে বলতে সম্পূর্ণ অবাস্তব জগতে চলে যায় মা। বলে, একটা বাড়ি করবি ললিত, পুরো চোদ্দো কাঠা জমির ঘেরওলা ছ’টা আম, চারটে কাঁঠাল, একটা ডুমুর, সজনে, দশটা সুপুরি আর দশটা নারকোল গাছ লাগাবি, পিছনে থাকবে কলার ঝাড়। কুঞ্জলতা আমার বড় পছন্দ, বুঝলি! বেড়ার গায়ে গায়ে লতিয়ে দেব। তুই তো শিম খেতে ভালবাসিস— একটু শিমের মাচান করবি, গোয়ালঘরের চালের ওপর লকলকিয়ে উঠবে লাউডগা…। ললিত জানে কোন সুদূর ছেলেবেলায় দেখা পুরনো ছবিটাকে মা আবার টেনে এনে দূর ভবিষ্যতের গায়ে টাঙিয়ে রাখছে। এইভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে মা, ধীর পায়ে মৃত্যুর দিকে। দীর্ঘ সব ঘুমহীন রাত জেগে ভাবতে ভাবতে মা’র মনে সব অতীত ভবিষ্যৎ গুলিয়ে ওঠে, জট পাকায়। বুদ্বুদের মতোই তখন মা’র মুখে কথা ভেসে ওঠে। কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যায় মা’র মন, আর তখন এইসব একা থাকা দীর্ঘ দিনরাত্রিগুলোকে আর-একটু সহনীয় মনে হয় মা’র।
এখন মায়ের কথা শুনতে ইচ্ছে করছিল না ললিতের। মশারি-টশারি তুলে বেরিয়ে গিয়ে বাইরের বাতাসে একটু হাঁফ ছাড়তে ইচ্ছে করছিল তার। ঘুমহীনতার জন্য তার শরীরে জ্বর জ্বর ভাব, মুখের ভিতরে আঠালো লালা, চোখের পাতায় আঁশের মতো জড়িয়ে আছে ঘুম। অবসন্ন লাগছিল তার। বাঁ হাতের তেলোয় সিগারেটের ছাই ঝাড়ছিল ললিত। গরম ছাই কখনও ছ্যাঁকা দিচ্ছে হাতে। সেটুকু একরকম ভালই লাগছিল তার। ওই ছ্যাঁকাগুলো থেকেই বোঝা যায় যে, সে জেগে আছে, বেঁচে আছে। খুব সামান্যই এই অনুভূতিটুকু, নিতান্তই শারীরিক। তবু ললিত মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে হাতের পায়ের চামড়ার খুব কাছাকাছি আগুনটা ধরে রাখছিল, চামড়া তেতে গেলে সরিয়ে নিচ্ছিল আগুন। খেলার মতোই, অথচ ঠিক খেলাও নয়। কেননা তার এই ছোট্ট খেলাটুকুর মধ্যেই কোথাও জীবনমৃত্যুর একটা প্রশ্নও জড়িয়ে ছিল। সিগারেটে টান দিলে মশারির ভিতরটুকু আলো হয়ে যাচ্ছিল। সেই লাল আভার ভৌতিক আলোয় মশারির লম্বা সেলাইয়ের ধার ঘেঁষে ছোট্ট একটা ছারপোকাকে লক্ষ করল ললিত। তার বিছানায় বরাবরই ছারপোকা। মা চোখে দেখে না, তবু মাঝে মাঝে বিছানা বালিশ টেনে নিয়ে রোদে দেয়, গরম জলে ধুয়ে দেয় চৌকি। তবু ছারপোকাগুলো কখনও ঠিক নির্বংশ হয় না। কোথাও কোনও কোনায় ঘুপচিতে এক-আধটা থেকে যায়, সেই থেকেই আবার বংশ বিস্তার করে। চোখে পড়লে ললিত মারে। আজ সে সিগারেটের আগুন ছারপোকাটার কাছে নিয়ে গেল। তাপ পেয়ে পোকাটা দৌড় দেয়। ছেড়ে দিল ললিত! ওটা বেঁচে থাকলে ললিতের আর সামান্যই ক্ষতি হবে। বরং পোকাটার প্রাণ দিয়ে সে ভালই করল। কে জানে এর ফলে তার আয়ু কিছুটা বেড়ে যাবে কি না। সব কর্মেরই তো ফল আছে।
সিগারেটের শেষ অংশটুকু ফেলে দেওয়ার জন্য ললিত উঠল। মা আবার নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। যতদুর নিঃশব্দে সম্ভব দরজা খুলে বাইরে এসে ললিত মুগ্ধ হয়ে গেল। এত ভোর সে বোধ হয় তার জ্ঞানবয়সে দেখেনি। আকাশভরা তারা, আর পুব দিকে আকাশের রং ময়ূরের গলার মতো রঙিন। সামান্য হিম পড়েছে। সেই হিম ধুয়ে দিয়েছে বাতাসকে। বাতাস এখন বড় পবিত্র, বড় উদার। শূন্য অলিগলি রাস্তাঘাট নিয়ে কলকাতা এখন প্রকাণ্ড হয়ে আছে। সবাই জেগে উঠলে কলকাতা আবার ঘিঞ্জি আর ছোট হয়ে যাবে।
দরজার সিঁড়িতেই বসল ললিত। চৌকাঠে হেলিয়ে রাখল ক্লান্ত মাথা। আস্তে আস্তে ঘুমের ঢল নেমে আসছিল শরীরে। সামনের আকাশ, আকাশ-ভরতি তারা, না-ওঠা সূর্যের কাছে বিড় বিড় করে প্রার্থনা করল যেন তার মৃত্যু এই রকম সুন্দর একটি শেষরাত্রির সময়ে ঘটে। তারপর সে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল বেলায়, যখন গলির দেয়ালের ওপর দিয়ে রোদ তার মাথা ছুঁয়েছে তখন মা তাকে ডেকে জাগাল। জেগে দেখল সামনে শম্ভু দাঁড়িয়ে আছে, পায়জামার ওপর আধময়লা শার্ট, হাতে বাজারের থলি। কিছুদিন হল ললিতের অসুখের প্রায় শুরু থেকেই শম্ভু তাদের বাজার করে দিচ্ছে।
শম্ভু চৌকো সুখে সরল হাসি হাসল, শরীর কেমন?
ললিত দেখল শম্ভু গেঞ্জি পরেনি, পাতলা বুক-খোলা শার্টের ওপর দিয়ে ওর শরীরের চমৎকার পেশিগুলো জেগে আছে। কখনও শরীরের চর্চা করেনি ললিত, যদিও মাঝে মাঝেই তার মনে হয় গায়ের জোরওয়ালা পুরুষ হতে পারলে বেশ হত। তার ছাত্রদের মধ্যে যারা খেলোয়াড় তারা মাথায় মোটা হলেও ললিতের প্রিয়। শম্ভুর শান্ত মুখ। চোখ আর কণ্ঠায় একটু কোমল ফোলা ভাব দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় রাতে ও সুন্দর ঘুমিয়েছে, ঝকমকে দাঁত দেখলে বোঝা যায় ওর লিভারের দোষ নেই। তবে এ-কথা নিশ্চিত যে শম্ভুর চিন্তাশক্তি কম, বুদ্ধি প্রখর নয়। শম্ভর মুখোমুখি নিজেকে বেশ রুগ্ণ আর অসুস্থ বলে বোধ হচ্ছিল তার, হাই তুলে ললিত বলল, শেষ রাতে বাইরে এসে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছি।
শেষ রাতে তো আমি রোজ উঠি। শম্ভু বলল, আপনি উঠেছেন জানলে ডাক দিয়ে যেতাম।
তুই ভোরে উঠে করিস কী?
দৌড়োই।
হাসল ললিত, শরীর ছাড়া শম্ভুটা কিছু বোঝে না। বলল, রোজ দৌড়োস! কতটা?
আনোয়ার শা রোড এক চক্কর দিয়ে আসি।
ললিত আচমকা প্রশ্ন করল, তোর লজ্জা করে না?
বড় অবাক হল শম্ভু, কেন, লজ্জা কীসের!
তোর পরনে কী থাকে?
এবার শব্দ করে হাসল শম্ভু, আপনি না এক্কেবারে— তারপর বলল, পরনে থাকে শটস, গায়ে গেঞ্জি, গলায় মাফলার আর পায়ে কেডস। আপনি একটু ভাল হয়ে নিন, আপনাকে তুলে নিয়ে যাব। রোজ দৌড়ে দেখবেন শরীর খুব ফ্রি হয়ে যাবে।
দূর! ওই পোশাকে আমি বেরোতেই পারব না!
পোশাক আপনি যা খুশি পরুন না। দৌড়টাই আসল। দৌড়নো যায় এমন যে-কোনও পোশাক করবেন। বলতে বলতে শম্ভু গলির মধ্যেই উবু হয়ে বসল, আমি বলছি আপনি দৌড়ে দেখুন ললিতাদা।
মৃদু হাসল ললিত, তারপর কী হবে!
তারপর আমি আপনাকে আসন করা শেখাব। আমাদের জিমনাশিয়ামের ট্রেনারের কাছে নিয়ে যাব। দেখবেন আপনার সব অসুখ সেরে যাবে। যোগব্যায়ামে শরীরকে যা খুশি করা যায়। আপনার কিছু হয়নি, দেখবেন আমি গ্যারান্টি দিয়ে সারিয়ে দেব।
ঘরের ভিতর থেকে মা বলল, নিয়ে যাস তো শম্ভু, আমি ওকে রোজ রাত থাকতে তুলে দেব। জোয়ান বয়সের ছেলে দেখ, রাতে নাকি ঘুম হয় না, সকাল আটটার আগে উঠতে পারে না, একটু বেশি ভালমন্দ খেলে সইতে পারে না। তুই নিয়ে যাস তো। না যায় তোর বন্ধুদের দল বেঁধে এনে জোর করে নিবি। দে তো ওর সব অসুখ সারিয়ে।
শম্ভুর গায়ে জোর আছে, আর আছে বোকার মতো খানিকটা বিশ্বাস। অল্প বুদ্ধিতে শম্ভু যেটুকু বোঝে সেটুকুকেই গোঁয়ারের মতো অনুসরণ করে। যুক্তি-তর্ক সম্ভব-অসম্ভবের কোনও বিচার নেই তার। ললিত সবই বোঝে। তবু এখন তার হঠাৎ শম্ভুর কথাটার ওপর নির্ভর করতে ইচ্ছে করছিল। যোগব্যায়ামে সব সেরে যায়। একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি ললিত! যদি সারে, যদি সেরেই যায়, যখন এ-রকম ভরসা একজন যে-কেউ জোরের সঙ্গে দিচ্ছে— তখন আশা করতে, বিশ্বাস করতে দোষ কী? যোগব্যায়ামের কতটুকু জানে ললিত? কে জানে এই রহস্যময় সব পদ্ধতির ভিতরে কী রকম প্রাণশক্তির সন্ধান রয়েছে।
সে হেসে বলল, খুব শক্ত হলে কিন্তু পারব না রে! আমার ও-সব কোনওকালের অভ্যাস নেই।
শম্ভু তড়িৎগতিতে একটা হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরল, বিশ্বাস করুন ললিতা, একটুও শক্ত না। দম নেওয়া আর ছাড়া, খুব ধীরভাবে শরীরকে বাঁকানো— এটুকুই যা শক্ত। খুব সহজে অভ্যাস হয়ে যাবে দেখবেন। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কত রোগের রুগি আসে আমাদের জিমনাশিয়ামে— আরথ্রাইটিস, পোলিও, হার্টের অসুখ, আলসার…।
সব সেরে যাচ্ছে?
সব। কিন্তু জলদিবাজি করলে চলবে না। এ তো কেনাকাটার মতো সহজ ব্যাপার নয়। এ যোগ। করতে হবে ঠিকমতো, চলতে হবে ঠিকমতো, অনাচার করলে চলবে না। যেমন চলতে বলবে, তেমন চলবেন। চাল্না ঠিক হওয়া চাই। শম্ভুর চোখ বিশ্বাসে ভক্তিতে চকচক করে উঠছিল, সমস্ত শরীরে চাপা আবেগে পেশির ঝড় খেলা করছে। বোকা শম্ভুর মুখখানা দেখে হঠাৎ ললিতের বুক ভরে উঠছিল। শম্ভু অন্য জায়গায় যেমনই হোক, নিজের ক্ষেত্রকে সে কিন্তু ঠিকঠাক জানে। সম্ভবত সেখানে শম্ভুর ভুল হয় না। শম্ভুর কথার ওপর আত্মসমর্পণ করার একটা তীব্র ইচ্ছা বোধ করছিল ললিত।
ললিতের মনে তার হাসিঠাট্টার ভাব ছিল না। তবু মুখে একটু ঠাট্টার ভাব বজায় রেখে সে প্রশ্ন করে, চল্না মানে কী রে?
শম্ভু ললিতের নাড়ির গতি বুঝতে পারছিল। তাই তার চোখমুখে ঐকান্তিক নিষ্ঠার ভাব ফুটে উঠেছে, চলনা মানে চালচলন। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, অনিয়ম না করা, পরিষ্কার থাকা, সৎ চিন্তা এবং সৎ আচরণ করা— সব বলে দেওয়া হবে।
দুর! হতাশায় মুখ ফেরাল ললিত, ও-সব হবে না। আমি সিগারেট খাব না, রাত জাগব না, দুপুরে ঘুমোব না, আলসেমি করব না! ও-সব বিধবা আর সিদ্ধবাবারা পারে।
হাসল শম্ভু, পারবেন। পারতে হয়। বিপদে পড়লে মানুষ সব পারে।
কথাটা ধাক্কা দিল ললিতকে। সামান্য উত্তেজিত হল ললিত, বলল, আমি পারব না। এতকাল পারিনি। ধাতে সইবে না।
মা দরজার কাছে খুঁটি গেড়ে বসে সব শুনছিল। এবার বলল, এমন কী শক্ত! শম্ভ করছে না! ওর চেহারা দেখ, চোখ জুড়িয়ে যায়। আর তোর কেবল হাড্ডিগুড্ডি সার হচ্ছে। কত ফরসা ছিলি, আর কেমন রোদে-পোড়া চেহারা হয়েছে। খুব পারবি, আমি তোকে চালিয়ে নেব। তুই ওকে দলে নিয়ে নে শম্ভু।
শম্ভু ঘাড় নাড়ে। ললিতকে বলে, ঠিকমতো না চললে হয় না। আমার ক্রনিক ফ্যারিনজাইটিস সারছে না, দেখুন না গলায় মাফলার জড়িয়ে সকালে বেরোতে হয়। সর্দির অ্যালার্জি, চিংড়ি ইলিশ ডিম বারণ তবু খেয়ে ফেলি, অনেক সামলেও নানা রকম অনিয়ম হয়ে যায়। কিন্তু জানি রোগটা সারানো সহজ, ঠিক মতো চললেই সেরে যাবে। অসুখটা তেমন খারাপ নয় বলে গা করি না, কিন্তু আপনার তো তা নয়…
বেলা হয়ে যাচ্ছে বলে শম্ভু উঠল। বলে গেল কাল আসবে, এসে তার জিমনাশিয়ামে নিয়ে যাবে ললিতকে। ললিত রাজি হল না, অত ভিড়ের মধ্যে খালি গায়ে আমি পারব না। প্রথম প্রথম তুই দেখিয়ে দে, একটু একটু বাসায় করি, তারপর যাব তোর জিমনাশিয়ামে।
গলির মুখে যখন শম্ভু বেরিয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ ললিতের ইচ্ছে হল ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে, আমার এ-বয়সে একটু দেরি হয়ে যায়নি তো! এখনি কি কোনও ফল হবে? জিজ্ঞেস করল না লজ্জায়। কিন্তু ভাবতেই হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। যদি ফল না হয়!
বেলা দশটা নাগাদ ললিত নাক টিপে, জোর করে বমির ভাব আটকে রেখে এক গ্লাস দুধ খেল। খড়িগোলা জলের মতো বিস্বাদ। এখন তাকে এইসবই খেতে হচ্ছে— দুধ, ফলের রস, দুধভাত, সেদ্ধভাত! ঝাল-মশলা দেওয়া তীব্র স্বাদের খাবারই ললিতের প্রিয় ছিল। জলো স্বাদের খাবার তার ভাল লাগত না। এখন খেতে হচ্ছে। মনে মনে ভেবে রেখেছে ললিত এ-সব নিয়মকানুন ঝেড়ে ফেলে সে স্বাভাবিক বেপরোয়াই হয়ে যাবে আবার, এখন আর ভয় কী? শম্ভু শিঙি মাছ এনে দিয়ে গেছে বাজার থেকে, আর কাঁচা পেঁপে। দুই-ই তার অখাদ্য।
মায়ের দোক্তার কৌটো থেকে সে বেছে বেছে কয়েকটা ভাজা মৌরি ধনে মুখে দিল। তারপর ধোয়া পায়জামা পরল একটা, ধীরে ধীরে গায়ে চড়াল পাঞ্জাবি। মা রান্নার মশলা নিতে ঘরে এসে তাকে দেখে বলল, কোথায় যাচ্ছিস!
স্কুল থেকে একটু ঘুরে আসি।
কোনও দরকার নেই। সদ্য হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছ, মাথা ঘুরেটুরে রাস্তায় পড়ে গেলে…
ঘরে থাকা এখন অসম্ভব। বাইরে টলটল করছে শরৎকালের মিঠে রোদ, রাস্তায় চলেছে লোকজন। এখন একবার হাঁফ ছাড়ার জন্য বাইরে যেতেই হবে ললিতকে। অনেক দিন মৃত্যুর ছায়ার মধ্যে সে শুয়ে ছিল। তার শরীর দুর্বল, চলাফেরার উপযুক্ত নয়, কিন্তু তবু একবার সুস্থ মানুষের মতো ভিড়ের মধ্যে গিয়ে চলে ফিরে আসতে বড় ইচ্ছে করছে। মা বলছিল সে ভাল হয়ে গেছে। কিন্তু ললিত নিজের শরীরের চামড়ায় একটা বিবর্ণ হলদে ভাব লক্ষ করে— ছায়ায় বেড়ে ওঠা গাছের রং যেমন হয়। তার সমস্ত শরীর রোদ-জল-মাটির জন্য ছটফট করছে, আবার স্কুল, চায়ের দোকানের আড্ডা, চা-সিগারেট, মেয়ে দেখা, দুֹ’-একটা অশালীন শব্দ, সিনেমা-থিয়েটার, বিয়ের নিমন্ত্রণ, আরও কত কিছুর জন্য চনমন করছে মন। হঠাৎ মনে পড়ে কত তুচ্ছকেই সে কত ভালবেসেছিল। অসুখের আগে কখনও মনে হত না যে, সে বড় ভালভাবে বেঁচে আছে। কিন্তু এখন মনে হয় তখন সে কত ভালভাবে বেঁচে ছিল!
মায়ের কথার সহজ উত্তর দিল না ললিত। বলল, স্কুলে একটু টাকাপয়সার খোঁজ করা দরকার। ডি এ-টা বোধ হয় এসেছে। ট্যাক্সিতে চলে যাব। ক্লাস তো করছি না।
মা তবু গুনগুন করে কী সব বলছিল। কান দিল না ললিত। দরজার বাইরে এসে চেঁচিয়ে বলল, সদরটা বন্ধ করে দাও।
সহজভাবে হাঁটতে পারছিল ললিত। তবে একটু কুঁজো হয়ে, সোজা হলে পেটের কাটা জায়গায় টান পড়ে। পেটের মধ্যেকার সেই ভয়ংকর ব্যথাটা আর নেই, যে-ব্যথায় সে মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যেত। এক দিন ক্লাসঘরে, আরেক দিন ফুটপাথেও শুয়ে পড়তে হয়েছিল তাকে। কোনও কাণ্ডজ্ঞানই বজায় রাখা যেত না তখন। ও-রকম ব্যথা যে-কোনও লোকেরই শালীনতা-ভদ্রতাবোধ, বিচার এবং বুদ্ধির শক্তি, সমস্ত রকমের সংযম ও পৌরুষ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেই ব্যথার জায়গায় এখন তার পেটে একটা নাড়ি দোল খায় যেন, আর মনে হয় পেটের মধ্যে অনেকটা ফাঁপা শূন্য জায়গা। যেন খানিকটা আকাশ ঢুকে গেছে।
অনেককালের চেনা পাড়ার ভিতর দিয়ে হাঁটছিল ললিত। সে গলির মুখে ডাকবাক্সটা পেরিয়ে গেল, করপোরেশনের জলের কলের গা ঘেঁষে গোপালদার মনোহারি দোকান, ডান দিকে একটা গ্যারেজের মধ্যে ক্লাবঘর, এখন তালাবন্ধ— মাঝে মাঝে বৃষ্টি বা দুর্যোগের দিনে বেরোতে না পারলে ললিত এইখানে এসে পাড়ার একটু বয়স্ক যুবকদের সঙ্গে তাস বা দাবা খেলেছে কখনও সখনও। ক্লাবঘর ছাড়ালে চৌধুরীদের বাগানের টানা লম্বা দেয়াল অনেকটা পর্যন্ত গেছে। দেয়ালের ওপর দিয়ে উঁকি দেয় নারকেল সুপুরি আর জাম গাছের মাথা—এ-রকমই একটা বাগানওলা বাড়ির বড় শখ মা’র। ললিত যেন এ-রকম বাড়ি করে। মাত্র চোদ্দো-পনেরো কাঠা জমি— বেশি তো নয়! বাঁ দিকে একটা তালার কারখানা। অনেক চেনা মুখ চোখে পড়ছে- এই যে ললিত, ভাল তো? হেসে ঘাড় নাড়ে ললিত। এরা বেশির ভাগই তার অসুখের খবর রাখে না, গত দু মাস কেন দেখা হয়নি এই প্রশ্নও কারও মনে আসছে না। ভেবে দেখতে গেলে দু’মাস একটুও বেশি সময় নয়। তবু ললিতের মনে হচ্ছিল অনেক দিন বাদে, যেন প্রায় সেই ছেলেবেলার ছেড়ে যাওয়া কোনও জায়গায় সে আবার ফিরে এসেছে। তার মনে হচ্ছে চার দিকে বিপুল কোনও পরিবর্তন ঘটে গেছে, অথচ কিছুই চোখে পড়ছে না। হয়তো পরিবর্তনটাই খুব গভীর আর রহস্যময়, চোখে দেখা যায় না কিন্তু টের পাওয়া যায়। আজ সব কিছুই সে খুঁটিয়ে দেখছিল, আশ্চর্যের বিষয় যে এতকাল তার নজরে পড়েনি যে সান্যালদের ছাদের ওপর একটা পায়রার বাসা আছে, লক্ষ করেনি ধোপাদের বস্তির পিছনে ছোট্ট একটা শিবমন্দিরের ত্রিশূল রাস্তা থেকেই দেখা যায়। এ-রকম ছোটখাটো আবিষ্কার করতে করতে বড় রাস্তার কাছে পর্যন্ত পৌঁছে গেল ললিত। তারপর আর সে দাঁড়াতে পারছিল না। কিছুটা বা ব্যগ্রতায় সে প্রয়োজনের চেয়ে দ্রুত হেঁটেছে, অনভ্যাসে তার পদক্ষেপ একটু বেচাল হচ্ছিল, আর সামান্য টলমল করছিল মাথা। এখন তার পা কাঁপছিল, সমস্ত শরীরে ঘাম, মাথার মধ্যে ঝিঁঝি পোকার ডাক, আর বমির ভাব বুক জুড়ে।
অল্প দূরেই দেখা যাচ্ছে গলির পথটা আনোয়ার শা রোডে শেষ হয়েছে। তেরাস্তায় তিন-চারটে রিকশা দাঁড়িয়ে। ওই পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে একটা রিকশায় গা এলিয়ে দিতে পারত ললিত, পৌঁছে যেত ট্রাম-বাসের রাস্তায়। কিন্তু ললিত সে-চেষ্টা করল না। করলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তার শরীর ইতিমধ্যেই মাটির দিকে ঢলে পড়ছে। মুখের মধ্যে জলহীন শুকনো ভাব, জিভ চটচট করছে। শরীরে জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পরেকার মতো ঠান্ডা তাপহীনতা বোধ করছে সে, হাত পা দুর্বল হয়ে আসছে। চেনা একটা ছেলের মুখ নজরে পড়ল ললিতের। পাড়ার ছেলেই হবে, কিংবা হয়তো তার ছাত্রই। বখাটে চেহারা, হাতে সিগারেট। তাকেই হাতছানি দিয়ে ডাকল ললিত। সে কাছে আসতেই বলল, আমাকে একটা রিকশা ডেকে দেবে ভাই, আমি অসুস্থ, হাঁটতে পারছি না।
ছেলেটা সিগারেট লুকোয়নি, কিন্তু চটপটে পায়ে দৌড়ে গিয়ে তেরাস্তা থেকে গলির মধ্যে রিকশা নিয়ে এল। ললিতকে ধরে তুলে দিল রিকশায়। রিকশার ঢাকনা উঠিয়ে দিল। রিকশাওয়ালাকে বলে দিল, আস্তে চালিয়ে নিবি।
অতটুকু ছেলেকে ধন্যবাদ দিতে লজ্জা করছিল ললিতের। সে শুধু একটু কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল। রিকশা চলতেই ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগল চোখেমুখে। আস্তে আস্তে আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছিল সব। চোখ চাইল ললিত— বাঁ ধরে খুপরি দোকানের সারি, নোংরা বাজার আর বস্তি, গত বর্ষার জল উপচে পড়ছে কাঁচা ড্রেনে, ডান ধরে রেলিং ঘেরা একটা পুরনো পুকুর, তার পাশে মসজিদ। বড় রাস্তায় এসে রিকশা ছেড়ে দিল ললিত। দেখল অফিসের ভিড়-বোঝাই বাসে-ট্রামে ওঠা অসম্ভব। এ-সময়ে ট্যাক্সি পাওয়া ভাগ্যের কথা।
অসহায়ভাবে সে ট্রাম-স্টপে দাঁড়িয়ে রইল। এই অসম্ভব রোগগ্রস্ত শরীরটার জন্য বড় ঘেন্না হচ্ছিল ললিতের। শরীর— তবু শরীর ছাড়া অস্তিত্ব নেই।
একটা ট্রাম তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল ধীরগতিতে। সেকেন্ড ক্লাস থেকে কে যেন ডাকল, ললিতদা!
অত ভিড়ের মধ্যে কাউকে চিনবার উপায় নেই। ললিত ট্রামটার দিকে চেয়ে রইল শুধু। লক্ষ করল ট্রামটা তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলে দরজার ভিড় ঠেলে লাফিয়ে নামল একজন। দূর থেকেই তাকে দেখে হেসে হাত উঁচু করল, এগিয়ে এল তার দিকে। ভ্রূ কুঁচকে দেখছিল ললিত। লোকটার পরনে ঝকমকে টেরিলিনের প্যান্ট-শার্ট, হাতে ফোলিও ব্যাগ, গলায় টাইও ঝুলছে। কিন্তু এমনই গ্রাম্য তার হাবভাব, হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলার বিশ্রী ভঙ্গি যে, পোশাকটাই মার খেয়ে গেছে। চিনতে পারছিল না ললিত। লোকটা যখন খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাসল তখন তার পান-খাওয়া কালো দাঁত, ডান গালে পানের টিবি, আর কপালে ছোট্ট একটু রক্তচন্দনের ফোটা দেখে চিনতে পারল— এ লক্ষ্মীকান্ত । কোনও দিনই তার সম্বন্ধে আর পাঁচজনের মতামতকে পরোয়া করে না লক্ষ্মীকান্ত। সে যে এখনও পোশাক-আশাক পরে রাস্তায় বেরোয় এটাই রাস্তার লোকের বাবার ভাগ্য।
ফোলিও ব্যাগটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিয়ে বাড়িয়ে ললিতের হাত ধরে রামঝাঁকানি দেয় লক্ষ্মীকান্ত, ললিতদা, কী কথা ছিল?
যেন পরশুদিনই কথাটা হয়েছে এমনই জিজ্ঞাসার ভঙ্গি তার। ললিত হাসল, কেমন আছ লক্ষ্মীকান্ত?
ভাল। বলে হাত ছেড়ে দিয়ে লক্ষ্মীকান্ত কাজের কথায় আসে, ললিতদা, কী কথা ছিল? অ্যাঁ?
ঠিক কী যে করে লক্ষ্মীকান্ত তা জানে না ললিত। তাকে একনজর দেখেই মনে হয় যে লোকটি খুব বিষয়ী, দালাল কিংবা ফড়ে। বস্তুত লক্ষ্মীকান্ত তাই। মোটাসোটা কালোকালো চেহারা তার, মাথায় একটু টাক— সম্ভবত আসল বয়সের তুলনায় তাকে বেশি বয়সেরই দেখায়। তবে তার আসল বয়সটাও অবশ্যই ললিতের চেয়ে অন্তত বছর পাঁচেকের বেশি। তবু বরাবরই লক্ষ্মীকান্ত ললিতকে দাদা বলে ডেকে আসছে, আর ললিত— যে-কোনও লোকের সঙ্গেই যার ‘আপনি’থেকে ‘তুমি’তে নামতে অনেক সময় লাগে, সেও সেই প্রথম থেকেই লক্ষ্মীকান্তকে নাম ধরে ডেকে ‘তুমি’ বলে আসছে। এর জন্য লক্ষ্মীকান্তর স্বভাবটিই দায়ী— সকলের কাছে সবসময়েই সে বশংবদ, একনাগাড়ে নিজেকে উজাড় করে কথা বলে যায়, অন্যে বিরক্ত হচ্ছে কি না তা লক্ষও করে না। লক্ষ্মীকান্তর আত্মসচেতনতা নেই, বিষয়ী লোকের তা থাকলে চলেও না। কলকাতার বিস্তৃত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সে হচ্ছে খুঁটে-খাওয়া পাখি। বিশেষত তার অনেক রকমের দালালি, হাজারটা লোককে চরিয়ে খেতে হয়। তাই নিজেকে নিচু করে রাখা লক্ষ্মীকান্তর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। কুড়ির ওপর বয়সের যে-কোনও লোককেই সে দাদা বলে ডাকে— ব্যবসার সম্পর্ক থাক আর না থাক। তাকে দেখে মনে হয় সে সম্মান বা সমাদর খুব কমই পায়, এবং পায় না বলে তার কোনও ক্ষোভও নেই। যে-কোনও লোকের সঙ্গেই মিশ খেতে গেলে ও-রকম ক্ষোভ না থাকাই ভাল। কবে, কীভাবে যে ললিতের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল তা আজ আর ললিতের মনে নেই, তবে লক্ষ্মীকান্ত পায়ের তলায় সরষে নিয়ে সারা শহরে চরকিবাজি খায় বলে মাঝে মাঝেই তার সঙ্গে ললিতের দেখা হয়ে যায়, আর দেখা হলেই লক্ষ্মীকান্তর এক কথা, কী কথা ছিল দাদা! মনে নেই?
মনে আছে ললিতের। হাজার পাঁচেক টাকার একটা জীবনবিমা তাকে দিয়ে করাতে চাইছে সে। এবং চার বছর ধরে তার পিছনে লেগে আছে। জীবনবিমার উপকারিতা, বা না-করা যে সামাজিক অপরাধ— এ-সব নিয়ে খুব বেশি কিছু বলে না সে, তার আবেদন অন্য রকমের— যদি না করেন তবে আমার এজেন্সিটা চলে যাবে, খুব ঝামেলায় পড়ে যাব দাদা। তারপর নিজের সংসার, অপদার্থ ছেলেমেয়ে, নিষ্ঠুর ভাইরা এবং একচোখা বাবার কথা অকপটে বলতে থাকে সে। আর মাঝে মাঝে বলে যে, এবার গভর্নমেন্টের সঙ্গে তার একটা মামলা লেগে যাবে। বালিগঞ্জের ভাল একটি পাড়ায় অনেকটা বেওয়ারিশ জমি দখল করে আছে লক্ষ্মীকান্ত। ওখানে জমির দাম পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা। জমিটা কেনেনি সে, খাজনাও বোধ হয় দেয় না। সামনে তার একটা মুদির দোকান আছে, যেটার দেখাশোনা করে তার বারো বছর বয়সের ছেলে। দোকানের গা ঘেঁষেই মাটি দিয়ে গেঁথে কালীর মন্দির বানিয়েছে সে, নিত্যপূজা হয়, বাগান করে গাছ লাগিয়েছে, যাতে সহজে উচ্ছেদ হতে না হয়। লক্ষ্মীকান্তর বাড়ি বাঁকুড়ায়, তবু রিফিউজি কার্ড করিয়ে রেখেছে সে। তার ধারণা তাকে তোলা বড় সহজে হবে না। তার বিশ্বাস আরও বছর দশেক ওখানে টিকে যেতে পারলে জমিটা তার হয়ে যাবে। এ-সবই ললিতের লক্ষ্মীকান্তর কাছেই শোন। এত সব সত্ত্বেও লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গ খুব প্রিয় মনে হয় না ললিতের, দু’ দণ্ড তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে। সম্ভবত এই গুণটুকুর জন্যই টিকে আছে সে, টিকে যাবে।
ললিত প্রসন্ন মুখে হেসে বলল, ব্যবসা কেমন?
ভাল কোথায়? আপনি গা করছেন না, কিন্তু এই ভাল সময় চলে যাচ্ছে। দেরি করলেই দেরি। চার বছর আগে করে রাখলে আজ আপনি চার বছর এগিয়ে যেতেন ম্যাচুয়ারিটিতে। চিন্তা করে দেখুন বিশ-পঁচিশ বছর পর এক থোকে অত টাকা…
বিশ-পঁচিশ বছর সময় বড় অলীক বলে মনে হয়। তবু হাসল ললিত, বলল, বিশ-পঁচিশ বছর পর টাকার দাম অনেক কমে যাবে লক্ষ্মীকান্ত, আজকের দাম পাওয়া যাবে না। ঠকা হয়ে যাবে!
হতাশ হল লক্ষ্মীকান্ত, বলল, আপনাদের কেবল ওই এক কথা! বিশ বছর লম্বা সময়, ততদিনে দাম কমে-বেড়ে কী হবে তা কি বলা যায়! হয়তো দেখলেন পাঁচ হাজারের দাম পাঁচ লাখে দাঁড়িয়েছে…
তা কি বলা যায়! তা ছাড়া দেখো লক্ষ্মীকান্ত, পাঁচ হাজার টাকার জন্য বিশ বছর হাঁ করে বসে থাকাও বড় কষ্টের। আমার অত ধৈর্য নেই।
বেঁচে থাকাটাই ধৈর্যের ব্যাপার ললিতদা। দেখুন না, আমি চার বছর ধরে আপনার পিছনে ঘুরছি, আপনি ফিরিয়ে দিচ্ছেন….
ললিত হাসল, যদি ততদিন না বাঁচি লক্ষ্মীকান্ত, তবে আমার টাকাটা খাবে কে? বুড়ি মা ছাড়া আমার কে আছে?
লক্ষ্মীকান্ত জিব দিয়ে চকাস শব্দ করল, টাইয়ের ফ্ল্যাপ তুলে থুতনির কাছে একটু ঘাম মুছে নিল। তারপর সে কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই ললিত বুঝতে পারল লক্ষ্মীকান্ত কী বলবে। সে তার ভাবী বউ এবং বাচ্চাকাচ্চার কথা তুলবে এবার, বলবে, এই বেলা বিয়ে করে ফেলুন, আমি মেয়ে দেখে দিচ্ছি। চমৎকার মেয়ে আছে আমার হাতে। যতদূর শুনেছে ললিত, লক্ষ্মীকান্ত ঘটকালিরও একটা সাইড-বিজনেস করে, মেয়ের বাপের কাছ থেকে পয়সা নেয়। তাই ললিত তাড়াতাড়ি বলল, আমার শরীর ভাল নেই লক্ষ্মীকান্ত, সদ্য একটা অপারেশন হয়েছে আমার। তুমি আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দাও দেখি।
দেখছি। বলে বড় ব্যস্ত হয়ে পড়ল লক্ষ্মীকান্ত।
ট্যাক্সি পাওয়া খুব সহজ হল না। মোটা মানুষ লক্ষ্মীকান্ত তার থলথলে শরীর নিয়ে গাড়িঘোড়ার মধ্য দিয়ে কয়েকবার রাস্তার এপার-ওপার ছোটাছুটি করল, ভরতি ট্যাক্সিকেও হাত তুলে থামাবার চেষ্টা করল বারকয়েক। অনেক দূর হেঁটে গেল, একবার ডান পারে, একবার বাঁ ধারে। তার ব্যস্ততা এবং আগ্রহ দেখবার মতো। ললিত দেখছিল। সে ভেবে দেখল খুব স্বার্থেও সে নিজে কারও জন্য ট্যাক্সি ধরে দিতে এত ছোটাছুটি করত না। প্রাণ আছে লক্ষ্মীকান্তর, কিংবা কে জানে এটাও লক্ষ্মীকান্তর ব্যবসার অঙ্গ কি না। যে-কাউকে খুশি করতেই লক্ষ্মীকান্ত বড় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সবসময়ে যে তার প্রতিদান চায় তা নয় বোধ হয়। কেন না ললিতের দ্বারা যে তার খুব সুবিধে হবে না এটা লক্ষ্মীকান্ত নিশ্চিত বুঝে গেছে।
ট্যাক্সি পাওয়া গেল অবশেষে। লক্ষ্মীকান্তই ধরে আনল।
একই দিকে যাবে বলে লক্ষ্মীকান্তও উঠল ট্যাক্সিতে। পাশাপাশি বসে ললিতের দিকে তাকিয়ে হাসল সে, বে-খেয়ালে টাইয়ের ফ্ল্যাপ তুলে থুতনির ঘাম মুছল—বস্তুত ওই জায়গাটাই বোধ হয় বেশি ঘামে তার। ললিত ভেবে পেল না টাইটা আসলে লক্ষ্মীকান্তর পোশাকের অংশ, না কৌশলে থুতনির ঘাম মুছবার জন্যই ওটা বেঁধেছে সে!
লক্ষ্মীকান্ত আস্তে আস্তে কথা পাড়ছিল। সংসারও যে একটা ধর্ম এবং সেটা যে উপেক্ষা করার নয়— সেই পুরনো কথা।
ললিত বলল, তুমি কি আমাকে বিয়েটিয়ের কথা বলবে নাকি লক্ষ্মীকান্ত? বলে হাসল সে, তবে দেখো ইনশিওর করা কী ঝামেলার ব্যাপার! পাঁচ হাজার টাকার ওয়ারিসান খুঁজতে গিয়ে বিয়ে করা! তার চেয়ে এই বেশ আছি হে, শেষে ঢাকের দায়ে মনসা বিকোবে…
স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল ললিত। লক্ষ্মীকান্ত নেমে বলল, আর একদিন দেখা করব দাদা, এবার বাসায় যাব। ঠিকানা আমার কাছে আছে।
যেয়ো। ললিত হেসে বলল, কিন্তু আমার একটা শক্ত অসুখ করেছে, বোধহয় বেশি দিন বাঁচব না।
কী অসুখ? বলে সত্যিকারের উৎকণ্ঠা দেখাল লক্ষ্মীকান্ত।
ক্যানসার। বলে ললিত ভাল করে ওর মুখটা দেখছিল। আশ্চর্য হয়ে সে দেখল লক্ষ্মীকান্তর চোখে সত্যিকারের বিস্ময় ফুটল, ছোট হয়ে গেল মুখ।
দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ল সে, এত অল্প বয়সে, দাদা?
শুধু হাসল ললিত। কিছু বলার ছিল না।
আবার দেখা হবে লক্ষ্মীকান্ত। বলে পিছু ফিরল ললিত। দেখা হবে, না হলেও ক্ষতি নেই। ললিতের ইচ্ছে হল একবার লক্ষ্মীকান্তকে ডেকে বলে— তোমাকে আমি পছন্দ করতুম, লক্ষ্মীকান্ত। পরমুহূর্তে সে সামলে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল লক্ষ্মীকান্ত খুবই ধীরে পায়ে ট্রাম রাস্তার দিকে এগোচ্ছে। একবার সেও ঘাড় ফেরাল। চোখাচোখি হয়ে যাওয়ার ভয়ে ত্বরিতে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ললিত।
বড় রাস্তা থেকে গলির মধ্যে কয়েক পা এগোলেই তার স্কুল। পুরনো আমলের জমিদার বাড়ি, বাইরের দিকে বারান্দায় দুটো পাথর বসানো মোটা থাম আর কাজ করা রেলিং। বাড়িটার কাছাকাছি আসতে-না-আসতেই শ’খানেক ছেলে ছুটে এল চার দিক থেকে মৌমাছির মতো। ঘিরে ধরল তাকে। চিৎকারে কানে তালা লেগে গেল ললিতের; ‘স্যার…স্যার…স্যার’ অজস্র প্রশ্ন শুনতে পাচ্ছিল ললিত— কোথায় ছিলেন স্যার? কী হয়েছিল স্যার? কেমন আছেন স্যার?
এক পা-ও এগোনোর জো ছিল না আর। খোলা রাস্তার ওপরেই তার পায়ে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম শুরু হয়ে গেছে। পায়ের চামড়ায় কচি হাতগুলো খাবলে দিচ্ছে, ঘষা খাচ্ছে, কাড়াকাড়িতে নখের আঁচড় লাগছে। ধাক্কায় বেসামাল ললিত হাসিমুখেই দাঁড়িয়ে টাল খাচ্ছিল। মনের কোনও চিন্তাশক্তি ছিল না ললিতের। আবেগে সে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। চোখের পাতা বুজে আসছিল তার— দুর্বল শরীর যে-কোনও সময়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়তে পারে, তবু বড় ভাল লাগছিল ললিতের। যেন চার দিক থেকে প্রাণ আর জীবন তাকে চেপে ধরেছে, হঠাৎ কোথাও তার যাওয়ার উপায় নেই, আর কোনও বহুদূরে নয়। সে দেখছিল যেন হাজার হাজার ছেলে তাকে ঘিরে ধরেছে।
ললিত জানে ছেলেদের কাছে সে কত প্রিয় ছিল। ক্লাসে অনেক দিন ফাঁকি দিয়েছে সে, পড়া ফেলে রেখে গল্প করেছে, কিংবা অকারণ টাস্ক দিয়ে বসিয়ে রেখেছে ছাত্রদের, তারপর আর সে টাস্ক দেখে দেয়নি। তবু ললিত স্যার ছেলেদের বড় প্রিয়, সবচেয়ে প্রিয়। তাই ছেলেদের হল্লার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ অনুভব করল যে, সে বড় বেঁচে আছে। মনে মনে সে বলছিল, ধন্যবাদ, তোমাদের ধন্যবাদ।
তার অবস্থা দেখে মাস্টার মশাইরা অনেকেই বেরিয়ে এসেছিলেন। ললিত শুনল উদ্ধববাবু চিৎকার করছেন, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, স্যারের অসুখ, ভয়ংকর অসুখ। সরে যা। দম নিতে দে… পণ্ডিতমশাই ছেলেদের নড়া ধরে বেড়াল ছানার মতো সরিয়ে দিয়ে ধমকাচ্ছিলেন, আদরে মেরে ফেলবি রোগা মানুষটাকে! হট সব হট যা…
দু’পাশ থেকে তার হাত ধরে উদ্ধববাবু আর পণ্ডিতমশাই তাকে কমনরুমে নিয়ে এলেন। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে তাকে দেখে। মাথার ওপর ফ্যান চালিয়ে দেওয়া হল, বসতে দেওয়া হল জানালার কাছে সবচেয়ে সুন্দর জায়গার চেয়ারটিতে।
লোকের ভিড়ে নিজেকে আর অনুভব করতে পারছিল না ললিত। এত উত্তাপে আদরে উৎকণ্ঠায় সে গলে চার দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ক্রমান্বয়ে হাসা ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না, আর মাঝে মাঝে ‘এখন কেমন আছেন?’ এই সাধারণ প্রশ্নটির উত্তরে সে মাথা নেড়ে বলছিল, ভাল, বেশ ভাল। তাকে ঘিরে এসে দাঁড়িয়েছে সবাই। অজস্র কথার শব্দ হচ্ছে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, তবু সুবোধবাবু ভাঁজকরা একটা খবরের কাগজ তার মাথার ওপর পাখার মতো নাড়ছিলেন।
ললিত দেখল জানালা বেয়ে উঠেছে ছেলেরা। শিকের ও-পাশে তাদের ঘিঞ্জি মুখ, দরজার চৌকাঠের ও-পাশ থেকে শরীর ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভিতরে ঢোকা বারণ বলে। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা ভিড় সরাতে সরাতে চেঁচাচ্ছে। ললিত তার চেনা মুখগুলো দেখছিল…সাধন…অমিতাভ…নিশীথ দে… অরুণ বরুণ দুই ভাই… হাতকাটা পশুপতি… অনেকের নাম মনে নেই। সে দেখল কানু বেয়ারা ভিড় ঠেলে প্লেট ঢাকা এক গ্লাস জল নিয়ে তার দিকে আসছে, সেই কানু যে কোনও দিন ললিতের বশ মানেনি। সে সুনীল হালদারকে দেখতে পাচ্ছিল, যার কাছে গত দু’বছর ধরে তার পঁচিশটা টাকা পাওনা আছে। বেঁটেখাটো প্রতাপবাবুর হাসি-হাসি মুখটি ভিড় ঠেলে এগিয়ে আছে, কিছু দিন আগে তিনি ললিতের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন। সম্ভবত এখন বিয়েটা হয়নি বলে নিজের ভাগ্যকে তিনি ধন্যবাদ দিচ্ছেন। তবু সকলের প্রতিই একধরনের কৃতজ্ঞতা অনুভব করছিল ললিত।
তার মনে হচ্ছিল এ-রকমভাবে সকলেই যদি চায়, সকলেই যদি ভালবাসায় বেঁধে রাখে তাকে, তবে কে তাকে নিয়ে যাবে জীবন থেকে! কী করে মরবে ললিত!
পাঁচ মিনিটের ঘণ্টা বাজছিল। দশটা পঞ্চান্ন। জানালা থেকে টুপটাপ করে খসে পড়ছে কচি মুখগুলি, তার চারধারের চাপ ভিড় আলগা হয়ে যাচ্ছে। স্কুল বসবে। ঘণ্টা বাজছে।… স্কুলের ঘন্টা তার বড় চেনা। তবু হঠাৎ মনে পড়ে বিষাদময় সেই ঘণ্টার শব্দ— বড় স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার আগে যেমন বাজে। ভিড় আলগা হয়ে যাচ্ছে চারদিকে… ললিতের অস্তিত্ব থেকে খসে যাচ্ছে চেনা, প্রিয় মানুষেরা… ট্রেন ছাড়তে আর দেরি নেই।
চার
রাত্রিটা খুব ছোট ছিল। খুব ছোট। ভোরের ঘুমে সে স্বপ্ন দেখছিল, চন্দনের গন্ধওলা সাবানের ফেনার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে আছে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। চোখ খুলেই সে দেখতে পেল দুধের মতো সাদা সুন্দর বুকে দুটি স্তন, সরু একটি সোনার চেন স্তনের ওপর দিয়ে ঝুলে তার কপালে লেগে আছে। রিণি, তার বউ।
সঞ্জয় হাসল। এক হাতে আলতোভাবে তার মাথা বুকে চেপে রেখে অন্য হাতে মাথার চুলের মধ্যে বিলি কাটছে রিণি। রিণি— রিন্তি— রিন্তু— তার বউ— তার সোহাগি। সঞ্জয় চোখ বোজে আবার। পাতলা একটা চাদরের তুলায় দু’জনেরই খালি গা। শরীরের ওম ঘন হয়ে আছে রিণির। শরতের সকালের মৃদু হিম থেকে তাকে ঘিরে আছে। মাথাটা আরও ভাল করে রিণির বুকে তুলে দেয় সঞ্জয়, সারা রাতে মাথা-রাখা উষ্ণ বালিশের স্বাদ একঘেয়ে হয়ে গেছে। রাতে গায়ে পাউডার মেখেছে রিণি। চন্দনের গন্ধ।
মাথাটা আবার বালিশের ওপর ঠেলে দিল রিণি, ওঠো, উঠে পড়ো।
সঞ্জয় গুনগুন করে, রিন্তু মিন্তু সিন্তু নিন্তু!
সুগন্ধ চুলের গোছা তার মুখের ওপর ফেলে নিচু হয় রিণি, হয়ে বলে, আর বাকি রইল কী? কিন্তু কিন্তু? ওঠো, উঠে পড়ো।
কখন থেকে আদর করছ আমাকে?
অনেকক্ষণ।
জাগাওনি কেন?
ঠিক সময়ে জাগিয়েছি।
দুই বালিশের ফাঁকে রাখা সঞ্জয়ের হাতঘড়ি বের করে এনে দেখে রিণি, ছ’টা দশ।
ঠিক সময়! ঠিক সময়! সঞ্জয় কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হল, কী করে বুঝলে ঠিক সময়! কীসের ঠিক সময়! কেন ঠিক সময়!
আঃ! অত জানি না। ছ’টা এগারো-বারো হয়ে গেল।
ঠিক সময় ছ’টা দশ! বলতে বলতে সঞ্জয় আবার বালিশে মাথা রেখে গড়ায়, ঠিক সময় ছ’টা এগারো বারো তেরো। আদরের ঠিক সময়, বিছানা ছাড়ার ঠিক ঠিক সময়, চায়ের ঠিক সময়, কাগজের ঠিক সময়…
পাগল!
পাগলামির ঠিক সময়।
সারাদিন তুমি অত কাজের, কিন্তু সকালে ভীষণ কুঁড়ে।
কুঁড়েমির আজিকে সময়… সময়! না অবসর?
দেখো, পিকলুটার বোধ হয় জ্বর।
জ্বর?
মনে হচ্ছে। সারা রাত জ্বালিয়েছে। সকালে আবার ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। তোমার যা ঘুম, টেরও পাওনি।
রিণির ওধারে অয়েল ক্লথের ওপর পাতা পিকলুর বিছানা। তাদের ছেলে। বয়স সাত মাস। হাতের ভর দিয়ে উঠল সঞ্জয়, রিণির শরীরের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘুমন্ত পিকলুর গা দেখে বলল, দূর! জ্বর কোথায়! গা ঠান্ডা।
কী জানি। মনে তো হচ্ছে। রাতে কয়েকবার কেশেছিল তো!
সঞ্জয়ের হাত গায়ে লাগতে পিকলুর ঘুমন্ত ঠোঁট ফুলল, ফোঁপানির শব্দ হল একটু। সঞ্জয় হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, শ্রীমান ক্রন্দন। তারপর বাউল সুরে গুনগুন করল, আপনজনরে চিনলি না রে মন, বাঁচবি ক্যামোনে? বাউল সঞ্জয় বলে…
ও কী কথা! ধমক দেয় রিণি, বিশ্রী!
কেন! গান! সঞ্জয় বাউলের রচনা।
ছাই গান। রিণি পিকলুর বুকের ওপর আলতো হাত রেখে আস্তে করে বলল, ও বাঁচবে। বাঁচবার জন্যই এসেছে।
মেঝের ওপর খবরের কাগজ পড়ে ছিল। বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে কাগজটা তুলে আনল সঞ্জয়, রিণির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখো তো প্রথম পৃষ্ঠায় কী কী খবর আছে।
তুমি দেখো।
কাগজ না দেখে, চোখ বুজেই সঞ্জয় বলতে লাগল, প্রথম হেডিং একটা ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট, প্লেন ক্র্যাশ, খনিতে ধস, একটু ছোট হেডিং— হাঙ্গামায় চারজন খুন, বিস্ফোরণে কয়েকজন হতাহত, রাহাজানি, ডাকাতি, ভিয়েতনামে বোমার শিলাবৃষ্টি…
চুপ করো।
চোখ চেয়ে হাসল সঞ্জয়, এরপরও আশা হয় বাঁচবে?
আঃ।
বেশ শক্ত ব্যাপার। রিন্তু-মিন্তু, পিকলুর পক্ষে ব্যাপারটা বেশ শক্ত হবে। আরও খারাপ দিন আসছে।
তার কথায় কান দিল না রিণি। সে ঝুঁকে পড়ে পিকলুর কপালে নিজের গাল ঠেকিয়ে জ্বর বুঝবার চেষ্টা করছিল।
শ্ৰীমতী বাতিক। কাগজটা ফেলে দিয়ে সঞ্জয় বলল।
বলে বিছানা ছাড়ল সে। মেঝের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তার শরীর থেকে ঘুমের আর আলসেমির জড়তা ঝরে গেল। এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস— বিশ্রাম বা কুঁড়েমি থেকে চট করে আবার কাজের মধ্যে চলে আসা। বিছানা ছাড়ার পরও আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলে বা ঘুমের আমেজকে বজায় রাখতে গিয়ে সে সময় নষ্ট করে না। সে অনেকটাই ঘড়ির অনুশাসন মেনে-চলা মানুষ। কাজের লোক। সবসময়ে নিজেকে যে-কোনও কাজের জন্য তৈরি রাখা তার প্রিয় অভ্যাস। তাতে মানুষ অহংকারী না হয়েও নিজেকে গুরুত্ব দিতে শেখে। সে শিখেছে। অবশ্য এ-ব্যাপারে সে খুব কড়াকড়ি করে না— যতটা করলে দৃষ্টিকটু দেখায় বা অন্যে অস্বস্তি বোধ করে। কাজের সঙ্গে মজাও তার প্রিয়। মন হালকা না থাকলে সে কাজ করতে পারে না। মেঘলা আকাশ, গোমড়া মুখ, গভীর চিন্তা তার অপছন্দ।
চমৎকার দিন। ঝলমল করছে রোদ। শরৎকাল। পুজো-পুজো ভাব। আপন মনে হাসল সঞ্জয়। চমৎকার দিন… বেশ দিন… হালকা দিন… উড়ে যাব… উড়ে যাই…
বাথরুমের র্যাক থেকে টুথব্রাশ তুলে নিয়ে সঞ্জয় দেখল ব্রাশটা পুরনো হয় গেছে। বদলাবার সময়। সে ব্রাশটার সঙ্গে কথা বলছিল— সুপ্রভাত শ্ৰীযুক্ত ব্রাশ, আপনার শরীরটা তো ভাল দেখছি না। বুড়ো হয়ে গেছেন। এটাই বিশ্রামের ঠিক সময়। বিশ্রাম? সেও কি আপনার কপালে আছে? হয় আমার জুতোর র্যাকে, নয়তো রিণির গয়না পরিষ্কার করার কাজে আপনাকে লাগতে হবে। জীবনটা এ-রকমই মশাই, যতক্ষণ কাজ আদায় হয় কেউ ছেড়ে দেয় না।… শ্ৰীমতী পেস্ট, আপনি একেবারে যুবতী, তবু বুড়ো ব্রাশটার ঘর করতে হচ্ছে! চিন্তা নেই, শিগগিরই আসছেন নতুন বর— ঝকঝকে নতুন…
বাথরুমের আয়নায় তার ছায়া পড়েছিল। সেদিকে চেয়ে হাসল সঞ্জয়। পুরনো বন্ধু সঞ্জয়, আহা বড় দুঃখে ছিল লোকটা। কেবল ধৈর্য অধ্যবসায় আর দুশ্চিন্তাহীন মন ছিল বলে বেঁচে গেছে এ-যাত্রা। এখন মজায় আছে।
চোখ টিপল সঞ্জয়, ফিস ফিস করে বলল, কী টু-পাইস হচ্ছে?
হচ্ছে তো। বলে হাসল। তারপরই মেঘের ছায়ার মতো একটু ম্লানতা এসে গেল তার মুখে। তার মুখের দু’পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পেস্টের ফেনা। অমানুষের মতো দেখাচ্ছে তাকে। দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে সে একটু হাসল, অস্ফুট গলায় প্রশ্ন করল, ভাল আছ তো, সঞ্জয়?
বোধ হয় ভালই আছে সে। ভাল থাকা এক-এক রকমের। যদি অতীতের সঙ্গে তুলনা করা যায় তবে সে ভালই আছে। মন সে-কথা মানছে কি? না, মানছে না। তাতে কিছু আসে যায় না। যুক্তিশাস্ত্র অনুযায়ী তার ভাল থাকা উচিত। সততা, কর্মক্ষমতা আর নিষ্ঠা তিনটেই তার ছিল। যা মানুষকে সফলতা এনে দেয়। সফলতা, সুখের মৃদু উত্তাপ, নিরাপত্তা। ঝকঝকে সুন্দর বাথরুমটার নানা জায়গায় চোখ রাখল সে। আয়নার তাকের ওপর শ্যাম্পুর শিশি, ও-ডি কোলান, সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই, রুপোর মতো চকমকে র্যাকে পরিষ্কার তোয়ালে, দুধের মতো সাদা বেসিন, কমোড, চৌবাচ্চার পাশে তাকের ওপর রাখা শীতকালের জন্য জল গরম করার যন্ত্র। চমৎকার নয়! বছর দুয়েক আগে সে হিন্দুস্থান পার্কের এই আধুনিক ফ্ল্যাটখানা ভাড়া নিয়েছিল। দেড় ঘরের ফ্ল্যাট, তিনশো টাকা। খুব বেশি কি? বেশি না, মোটামুটি ভাল থাকার পক্ষে বেশি না মোটেই। যে কেউ স্বীকার করবে। আবার হাসল সঞ্জয়। প্রচুর ফেনায় তার ঠোঁট দুটোই ঢেকে গেছে, প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে তার হাঁ-মুখকে। অনেকটা বাঘের মতে, না? বাঘের মুখ কি এ-রকম হয়? হবেও বা। অনেক কাল বাঘ-টাঘ আর দেখেনি সঞ্জয়।
সততা, কর্মক্ষমতা আর নিষ্ঠা। তিনটেই ছিল তার। নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে সে বাঁ হাতের দুটো আঙুল তুলে দেখাল, অস্ফুট গলায় বলল, এখন দুটো আছে! শেষ দুটো! কিংবা কে জানে শেষটাও আছে কি না! তবে দুটোই বাদ দাও হে, ধরো একটাই আছে। কর্মক্ষমতা। শেষ পর্যন্ত যদি এটাও থাকে তবে ভাগ্য ভাল… হারাধনের দশটি ছেলের যা হয়েছিল… মনে নেই।
মুখ ধুয়ে সে গুনগুন করে গান গায়, সুখে আছি, সুখে আছি…
ঠিক সাড়ে আটটায় খাবার খায় সে। সাজিয়ে দেয় রিণি। মুড়মুড়ে টোস্ট আর মাখন, ডিমসেদ্ধ, কোকো মেশানো এক গ্লাস দুধ। ব্যস। দুপুরে অফিসেও শুকনো লাঞ্চ সারে সে— রুটি মাংস কিংবা টোস্ট ডিম-সবজিসেদ্ধ-কলা-কফি। দিনে ভাত খায় না সে। অনেককালের অভ্যাস, প্রায় সেই প্রথম যৌবনের কিংবা শেষ কৈশোরের। যখন সে বোস অ্যান্ড কোম্পানিকে নিজের হাতে তৈরি করছে। নানু বোসের সেই কোম্পানি।
খাওয়ার জায়গাটা ছোট্ট। একটা মাঝারি টেবিল পাতায় জায়গাটা জুড়ে গেছে। এক পাশে গ্রিল দেওয়া, গ্রিলের ও-পাশে বাগান। নীচের তলার ফ্ল্যাট বলে ঘর থেকে বাগানের কিছু গাছপালা দেখা যায়। গ্রিল ঘেঁষে একটি গন্ধরাজের গাছ। যতক্ষণ খায় সঞ্জয় ততক্ষণ বারবার গাছপালাগুলোর দিকে চেয়ে থাকে, রোদ বৃষ্টি কিংবা কুয়াশার খেলা দেখে। আজ চমৎকার রোদ, না-ঠান্ডা না-গরম একটি দিন। আজ উড়ে যাব…উড়ে যাই…
মনের মধ্যে আজকাল মাঝে মাঝে স্লান মেঘের ছায়া আনাগোনা করে। কখনও একটু ক্লান্তি। বয়স হয়ে যাচ্ছে? দুধের গ্লাস নামিয়ে রেখে সঞ্জয় বলল, বয়স হয়ে যাচ্ছে।
সে-কথার উত্তর না দিয়ে রিণি বলল, মনে করে একটা লিপস্টিক এনো তো! আর পিকলুর জন্য একটা বিলিতি ফিডার।
লিপস্টিক, কোন শেড?
রোজি ড্রিম।
রোজি ড্রিম! রোজি ড্রিম… গোলাপি স্বপ্ন… গো লা পি স্বপ্ন… স্ব প্না লি গোলাপ…
কী হচ্ছে আবার!
নামটা একদম খাপ খায় না।
খাপ খায় না কেন?
গোলাপি স্বপ্ন একদম মেলে না আমার সঙ্গে। বাজে নাম।
হোক বাজে। আমার পছন্দ।
আচ্ছা, শ্ৰীমতী জিদ, ইচ্ছে মতো সাজো। তোমারে সাজাবো যতনে…। তোমারে, না তোমাকে? আজকাল বড় ভুল হয়ে যায়, বুঝেছ! বয়স হয়ে যাচ্ছে।
বুঝেছি, দাদামশাই।
হাসল সঞ্জয়। পিকলুকে আদর করে বলল, বিলিতি ফিডার চাই! ব্যাটা নবাবপুওুর।
আজ উড়ে যাব। চমৎকার দিন, সুন্দর দিন আজ। রিণির লিপস্টিকটার কী যেন রং! গোলাপি স্বপ্ন! গোলাপি স্বপ্নের মতো দিন। সাজতে বড় ভালবাসে রিণি, এখনও। সব কিছুই তার বিলিতি হওয়া চাই। বিলেতের ছোট জামা, বিলেতের লিপস্টিক। শোওয়ার আগে রিণি দাঁত মাজে, গায়ে পাউডার দেয়। ভুল হয় না। বিকেল-বিকেল খোঁপা বাঁধে— নতুন নতুন সব খোঁপা— তাতে বিনুনি নেই, ফিতে নেই। চোখের পাতায় ম্যাস্কারা লাগায়, ভ্রূ-তে পেনসিল। কার জন্য এত সাজগোজ, রিণি? কারও প্রেমে পড়োনি তো? দেখো ডুবিয়ো না। রমেনটার তাই হয়েছিল। বেচারা! কোথায় যে চলে গেল তারপর ময়মনসিংহের সেই জমিদারের ছেলেটা! যাকগে। আজ চমৎকার দিন রিণি, সুন্দর দিন। এই বেলা সাজগোজ করে নাও। বয়স হয়ে যাওয়ার আগে, পিকলু বড় হওয়ার আগে, পিকলুর আর সব ভাইবোনেরা এসে পড়ার আগে, তারপর ওদের দিন, পিকলুদের আর তাদের প্রণয়িনী বা স্ত্রীদের, যদি অবশ্য পিকলুরা ততদিন বাঁচে, যদি যুদ্ধটুদ্ধ আর না হয়, যদি দেশটা আরও পচে না যায়। তোমাদের আমি সুখে রেখেছি তো! রাখিনি? আমার তিনটে জিনিস ছিল— সততা, কর্মক্ষমতা আর নিষ্ঠা। প্রথম আর শেষটা পকেটমার হয়ে গেছে মনে হচ্ছে, খুঁজে পাচ্ছি না। কর্মক্ষমতাটা আছে এখনও। কিন্তু সে আর ক’দিন? বয়স হচ্ছে, বয়স হলে মানুষের কিছু সদ্গুণ ঝরে যায়, বদলে অভিজ্ঞতা বাড়ে। তোমাদের জন্য আমি দুটো জিনিস দিয়ে দিয়েছি।
হ্যাঁ, অনেক দিন পর্যন্ত আমার তিনটি গুণই ছিল। ছেলেবেলা থেকে। যখন আমি চায়ের দোকানের বাচ্চা বয়, কিংবা মোটরসারাইয়ের শরখানার ছোকরা কারিগর, তারপর হন্যে হয়ে ঘোরা। না, তখনও চুরি করিনি, মিথ্যে কথা বলিনি— ভয় করত। ধর্মভয়? হবেও বা। নানু বোস আমাকে তুলে নিল একদিন। নিজে নিজে তখন অর্ডার সাপ্লাইয়ের চেষ্টা করছি, নানু বোস ছিল সরকারি পারচেজ-এ, দু’হাতে পয়সা মারছে। আমাকে দু’-একটা অর্ডার দিত পয়সা না নিয়ে, দয়া করেই। তারপর একদিন আমাকে ডেকে বলল, এভাবে পারবেন না। আপনি সৎ লোক, খাটিয়ে লোক আছেন। আমার সঙ্গে হাত মেলান। কোম্পানি করছি রঙ্গিনী বোসের নামে— আমার বউ। সরকারি চাকরি, বুঝতেই পারছেন। নিজের নামে করতে পারি না। সব আপনি দেখবেন, টাকা আমার। ভাববার কিছু নেই।
ভাববার কিছু ছিল না। নানু বোসের কোম্পানি খুললুম আমি। বোস অ্যান্ড কোম্পানি। প্রথম দেড় মাস একটিও অর্ডার নেই। সারা দিন শুধু ঘোরা আর ঘোরা। নানু বোসের নিজের দেওয়া সরকারি অর্ডারগুলো বাদ দিলে বিজনেস ছিল পুরো ঝুল। মাইনে নিতে আমার লজ্জা করত। মাস ছয়েক পুরোটাই ক্ষয়ক্ষতিতে গেল। চাঁদনিতে অফিসঘর। তার ভাড়া, বেয়ারার মাইনে, ভাগের টেলিফোনের বিল, তা ছাড়া থোক টাকা আটকে ছিল স্টিলের আলমারি, টাইপরাইটার টেবিল চেয়ার ইত্যাদিতে। ভয় করত, যদি না পারি! নানু বোস ভরসা দিল, মাছের চোকলার মতো টাকা আছে আমার। আপনি চিন্তা করবেন না, চালিয়ে যান। আঃ রিণি, কী যেন তোমার লিপস্টিকটার নাম। গোলাপি স্বপ্ন, না স্বপ্নলি গোলাপ! ঠিক আছে, মনে থাকবে। তোমার চেহারাটা ভাল। যদি চেহারাটা ভাল না হত তা হলে লিপস্টিক কতদূর কী করতে পারত। ব্যবসাতেও তাই। ব্যবসা টাকায় দাঁড়ায় না ততটা, যতটা দাঁড়ায় চরিত্রে। নানু বোসের কোম্পানি তাই দাঁড়াল। আমার তিনটে জিনিস ছিল— তিনটে জিনিস— মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি উপুড় করে কড়ির ঢল নেমে এল নানু বোসের ঘরে। সম্ভবত তার ইচ্ছে ছিল বউয়ের ব্যবসা দেখিয়ে কিছু কালো টাকা সাদা করবে, কিন্তু লাভ দেখে সে আশ্চর্য হয়ে গেল। তার মনে কৌতূহল এল, আর সন্দেহ। ইচ্ছে করলে আমি কি নানু বোসের লাল কোম্পানিকে সাদা করে দিতে পারতুম না? আজকের সুন্দর দিনটার নামে প্রতিজ্ঞা করে বলছি, মাস-মাইনে ছাড়া আমি কিছুই নিইনি। সেই আমার প্রথম যৌবনের সময়টায় আমি বোস অ্যান্ড কোম্পানির জন্য ঊর্ধ্বশ্বাস— মেয়েদের ভাল করে লক্ষ করিনি, আকাশ গাছপালা বা প্রকৃতিজগতের সৌন্দর্য দেখার জন্য দাঁড়াইনি, হাসি ঠাট্টাও কম করেছি। তাতে লাভ হয়নি। কোম্পানি বড় হয়েছে বলে নতুন কিছু লোক নিল নানু বোস, আর নতুন লোকেরা ছিল তারই আত্মীয়— একজন ভাইপো, অন্যজন শালা। তারপর ক্রমে ক্রমে…কিন্তু তাতেও খুব একটা ক্ষতি হয়নি, কী বলো রিন্তি-মিন্তি- সিন্তি-নিন্তি! বোস কোম্পানি থেকে আমাকে ছাড়িয়ে দিলেও আমার কিন্তু তিনটে জিনিস ঠিকই ছিল— তিনটে জিনিস আর হাসি-ঠাট্টা করার মতো মনের জোর। অফিস আর কোম্পানিগুলো চিনত আমাকে— এই সঞ্জয় সেন, সৎ নিষ্ঠাবান পরিশ্রমী। না, এ আমাদের কখনও ফাঁকি দেয়নি।… একটু কষ্ট হল কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে গেলুম। এবার চাকরিতে, ম্যাকগুইয়ের অ্যান্ড কোং। এক বছর পর পঞ্চাশ টাকা বেশি মাইনেয় জোহানসন অ্যান্ড দালাল— আমার এখনকার কোম্পানিতে। দু’ বছর সততা নিষ্ঠা আর উদ্যমে চাকরি করার পর আমাকে দেওয়া হল পারচেজ-এ, জুনিয়ার অফিসার। কোম্পানির জন্য মালপত্র কিনবার আংশিক ভার। অর্ডারে আমার সই থাকে। মাইনে বেশি না। কিন্তু পাকা কাঁঠালের মতো অবস্থা আমার, চারদিকে মাছি ভন ভন করে। কোম্পানি জানত পয়সা খেয়ে পারচেজের লোকেরা কোম্পানিকে বেচে দিচ্ছে। তাই আমার মতো একজন লোককে তাদের দরকার ছিল এখানে। তখনও আমার তিনটে জিনিস ঠিক ঠিক ছিল, আমি দু’ হাতে লোভ ঠেকাতে লাগলুম। আমার রিনরিন, রিন্তি-নিন্তি, এটা দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ জেতার চেয়ে কিছু কম শক্ত ছিল না। ভয় পেয়ে আমি ওপরওয়ালার কাছে দরবার করলুম— আমাকে আমার পুরনো সেকশন এস্টিমেশনে ফিরিয়ে নাও। ওপরওয়ালা প্রথমে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, তারপর হাসল, তোমার অসুবিধেটা আমরা জানি। তবু কাজ করে যাও। আর দেখো, কোম্পানির ক্ষতি না করে তুমি যদি পয়সাওয়ালা হতে চাও হও। তাতে ক্ষতি নেই, আমরা তবু তোমাকে সৎ, নিষ্ঠাবান আর কাজের লোক বলেই জানব। আমরা জানি যে আমরা তোমাকে মাত্র চার শ’, টাকা মাইনে দিই, যা এই বাজারে একেবারেই যথেষ্ট নয়। আমরা ইনকনসিডারেট নই। ভাগ্য ফেরাবার এটাই তো বয়স, ঠিক বয়স, তোমার।
আমার সেই দার্শনিক ওপরওয়ালা আসলে আমার ওপর ডাকাতি করতে চেয়েছিল। মূল্যবান তিনটে জিনিস ছিল আমার। আঁকড়ে ধরার মতে, জীবন দেওয়ার মতো। আসলে আমার সেই ওপরওয়ালা জ্ঞানী লোকটি জানত, পারচেজে সৎ লোকের থাকাটা সেই লোকের পক্ষে বিপজ্জনক। অন্যেরা তার সম্বন্ধে অস্বস্তি আর সন্দেহ পোষণ করতে থাকবে ক্রমান্বয়ে। সেটা অনেক দূর গড়াতে পারে।
আমি টিকে গেলুম পারচেজে। দু’ বছর আগে তুমি এলে। বড় মজার ব্যাপার হয়েছিল। তোমার বাবা অর্ডার নিতে এলেন— ফরসা রোগা মানুষ, চোখা নাক আর কৌতুকে মিটমিট করছে চোখ। দূরদর্শী লোক, তিনি কোম্পানিকে জানেন, আর আমার চাকরি আর পজিশনের গুরুত্ব বুঝলেন। হয়তো ভাবলেন, ছোকরার এক-আধটা গুণ কেড়ে নিলে ধাঁ করে উন্নতি করে ফেলবে। কিন্তু সেজন্য তিনি উপদেশ দিলেন না, ভিড়িয়ে দিলেন তাঁর সুন্দর মেয়েটিকে, বিয়েরও দেরি করলেন না। এবং সম্ভবত তারপর মনে মনে হাসলেন।
আমার রিণি, এ-কথা ঠিক যে আমার টাকার দরকার ছিল। বিয়ের জন্য, বাসার জন্য, নতুন ঘরকন্নার জন্য। আমার যে অপদার্থ দাদাটা ব্যাঙ্কে পিয়নের কাজ করত তার কাছে আশ্রিত ছিল আমার বিধবা মা আর অন্ধ একটা বোন। মাস-মাইনের অনেকটাই তাদের দিতে হত। ‘আমি থাকতুম মেসে। টাকা জমাইনি বলে হঠাৎ টাকার দরকারে একটু ঘাবড়ে গেলুম। ধার করা যেত। করেওছিলুম। ধার দিল মহাজনেরা, যারা কোম্পানিকে মাল বিক্রি করত। সেই ধার আর শোধ দেওয়া হল না।…রিণি, আমার রিন্তি, আমি কাকে দায়ী করব? যদি বলি তুমি দায়ী তা হলে দায় এড়ানো হল, যুদ্ধ জেতা হল না। আমি দায় এড়াতে চাই না। আসলে বয়স। বয়স হলে মানুষের দু’-একটা সদ্গুণ ঝরে যায়, বদলে অভিজ্ঞতা বাড়ে। ভেবো না যে ব্যাপারটা হঠাৎ হয়ে গেল। হঠাৎ হয় না এ-সব, হলে মানুষ সামলেও যায়। আমার মন তৈরি হয়েই ছিল, কেবল একটা অভ্যাসজনিত লজ্জা বাধা হচ্ছিল এত দিন। যখন আমি ভাবছিলুম যে আমার তিনটে জিনিসই ঠিকঠাক রয়ে গেছে, তখন বস্তুত আমার ছিল মাত্র দু’টি জিনিস, আমি তা ভাবতেও ভয় পেতুম বলে ভাবতুম না। হারাধনের তিনটি ছেলে… আঃ হা, রইল বাকি দুই! না? কী যেন তোমার লিপস্টিকের নামটা! গোলাপি স্বপ্ন, না? দেখো, ঠিক মনে রেখেছি। আনব, ঠিক আনব। ভুল হবে না। আর পিকলুর জন্য বিলিতি ফিডার। আমি সব আনব একে একে— যা যা চাই। যেমন এনেছি রেফ্রিজারেটার, রেডিয়োগ্রাম, স্টিলের আলমারি। কে বলবে যে এ-সব আমার দরকার নেই? কে বলবে যে ভালভাবে থাকা উচিত নয়? কে বলবে তোমার ছেলেকে দিশি ফিডার এনে দাও, বউকে বলো যেন লিপস্টিকের বদলে পান খায়?… যতদিন আমার অটুট তিনটে জিনিস ছিল ততদিন আমি কি খুব ভাল ছিলুম? আর এখন নেই বলে খারাপ? মনের ঐশ্বর্য একে একে ত্যাগ করছি বলে আমাকে যদি সন্ন্যাসী বলা যায় তা হলে কি তুমি হাসবে? অত বড় তিন-তিনটে গুণ ঐশ্বর্যের মতো ছিল আমার, সেগুলি ছেড়ে দেওয়া কি কিছু কম ত্যাগের ব্যাপার? চমৎকার দিন আজ, সুন্দর দিন, পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছে আমার ট্যাক্সি… উড়ে যাই। এখন চাকরি ছাড়াও আমার নিজের কোম্পানি আছে, আমার সেই অপদার্থ দাদা সেখানে আমার পার্টনার, সেই কোম্পানি থেকে অফিসার হয়ে আমি মাল কিনি…রিণি, মাঝে মাঝে বড় অবাক হতে হয় যে আমার বেচা জিনিস আমিই কিনছি। বোধ হয় জীবনের সর্বত্রই এ-রকম, না? কে জানে! সুন্দর একটি উজ্জ্বল দিনের মধ্য দিয়ে আমি উড়ে যাচ্ছি… উড়ে যাই…
অফিসে দুপুরের দিকে একটা টেলিফোন পেল সঞ্জয়। ফোন তুলে ‘হ্যালো’ বলে শুনল ও-পাশে মৃদু ভিতু ধরনের একটা গলা, বলছে, সঞ্জয়, তুই কি সঞ্জয়? আমি সঞ্জয় সেনকে চাইছি।
সঞ্জয় বলছি।
আমি ললিত।
ললিত! বলে স্তব্ধ হয়ে রইল সঞ্জয়।
হ্যাঁ। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছি।
সঞ্জয় সামান্য চমকে-ওঠার ভাবটা সামলে নিয়ে হাসল, উঁচু গলায় বলল, ললিত, ভাই, কেমন আছিস এখন? দ্যাখ, হাসপাতালে সেই যে একদিন তোকে দেখতে গিয়েছিলুম, তারপর আর যাওয়াই হয়নি, এমন বিশ্রী চাকরি। ইস ললিত, কবে বেৱোলি জানতেই পারলুম না, একটা খবর দিলি না কেন?
এই তো দিচ্ছি। আসল খবর হচ্ছে এখন গোনাগুনতি দিন হাতে আছে। সময় বেশি নেই। তোদার সঙ্গে একটু দেখা হওয়া ভাল।
ফালতু কথা ছাড়। কোথা থেকে ফোন করছিস?
স্কুল থেকে।
শোন, তুই স্কুলে থাক একটু, আমি অফিস থেকে কাট মারছি, ট্যাক্সি করে গিয়ে তোকে তুলে নেব।
তারপর?
তারপর হবে একটা কিছু। সেলিব্রেশন।
ললিত হাসল, তার দরকার নেই। তুই বরং বিকেলে আয়। তুলসীও আসবে। আমি বাসায় থাকব। শরীরটা খুব ভাল নেই রে।
আচ্ছা।
ফোন রেখে দিল সঞ্জয়। একটু বসে রইল চুপচাপ। হঠাৎ লক্ষ করল টেবিলের কাচের ওপর রাখা তার হাতের আঙুলগুলো সামান্য কাঁপছে।