১. সৌপ্তিক – শ্রীরাধিকার এসএমএস

. সৌপ্তিক – শ্রীরাধিকার এসএমএস

যে-দেশে একটি ব্রহ্মাস্ত্রের দ্বারা অপর ব্রহ্মাস্ত্রকে প্রশমিত করা হয়, সেই দেশ জুড়ে কোথাও আগামী দ্বাদশ বর্ষ পর্যন্ত বৃষ্টি হবে না। সৌপ্তিকপর্বের শেষে মহর্ষি ব্যাসদেব অশ্বত্থামাকে এই কথাটুকু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।

শিবিরের মশালগুলি এখনও প্রজ্বলিত। নিকষ অন্ধকারের তীব্রতা কাটিয়ে ভোর হবে একটু পরেই। মহাভারতের যুদ্ধের পরের ছত্রিশতম বছর আগত। কৃষ্ণের মনে পড়েছে পুত্রশোকে সন্তপ্ত গান্ধারীর অভিশাপের কথা। তিনি যদুবংশীয়দের তীর্থযাত্রার আদেশ দিয়েছেন। দ্বারকা নগরী জনশূন্য, প্রজাহীন। প্রাণভয়ে আতঙ্কিত যাদবেরা সকলেই দলে দলে নগর ত্যাগ করেছে। কৃষ্ণ বৃদ্ধ হয়েছেন। দর্পণের প্রতিবিম্বে তাঁর পক্ককেশ প্রতিভাত হচ্ছে। যৌবন থেকে তিনি এখন বহু দূরে। সৌপ্তিক পর্বের অন্তিমে কোনো একটি বসন্তকালীন অপরাহ্ন বেলায় তিনি একটি এসএমএস পেয়েছিলেন। শোকাতুরা রমণীরা এমনকী শতপুত্রহারা সাধ্বী নারী গান্ধারীও যখন বিলাপে আকুল, কৃষ্ণ শোকক্ষেত্র থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মেসেজ বক্স খুলে দেখে নিয়েছিলেন বার্তা, ‘তুমি কেমন আছ? আমাকে কি ভুলে গেছ?’ বার্তা প্রেরণকারিণী একদা প্রেমিকা রাধিকা। যার স্তনদ্বয়ের নিন্মতল কৃষ্ণের বড় প্রিয়সুখের ছিল। অভিমানবশত প্রেমিকার কোনো ঠিকানার উল্লেখ ছিল না। বিচলিত হয়ে উঠেছিল চিরপ্রেমিক কৃষ্ণের হৃদয়। তিনি এখনও রমণীমোহন। বহু গোপিনীর সঙ্গসুখ তখনও তাঁর স্মৃতি থেকে অপসৃত হয়নি। মহাভারতের যুদ্ধের মহাক্ষয়, ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের করাল ছায়া, রাজনীতি সম্পর্কিত রাষ্ট্রচিন্তা, সব কিছু থেকেই তিনি মুহূর্তের জন্য দূরে সরে গিয়েছিলেন। বিষয়টি অনেকের অলক্ষে থেকে গেলেও গান্ধারীর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল কৃষ্ণের দিকে। তিনি অভিশাপ বর্ষণ করেছিলেন যদুবংশের সমূহ ধ্বংসের।

প্রকৃতিতে প্রচুর অলক্ষণ এখন। প্রায়ই ঝড় ওঠে, সঙ্গে তুষারপাত। অথচ বসন্তকাল সমাগত। পক্ষীকুলের দেখা নেই। কেকার নেই। কোকিল-জাতীয় পাখি যাদের কুহুরবে মথুরা, দ্বারকা, বৃন্দাবনের গৈরিক পথ উন্মুখ হয়ে উঠত, বিলীন হয়ে গেছে তারা। সেদিনের উদ্ভিন্নযৌবনা গোপিনীরা প্রৌঢ়া হয়েছেন। তাঁদেরও পলিতকেশ; গাত্রচর্ম আলগা হয়ে গেছে; মুখগহ্বর গতি হারাচ্ছে। অনেক বেলা পর্যন্ত চরাচর জুড়ে কুয়াশা ব্যাপ্ত থাকে। আকাশ থেকে সন্ধ্যাকালে উল্কাবর্ষণ হচ্ছে। সূর্যমন্ডল ধুলোয় আচ্ছন্ন। সূর্যোদয়ের সময় রবিকিরণে তেজ নেই এবং তার মণ্ডলেও কবন্ধের ছায়া। ভয়ংকর সব বলয় ঘিরে রাখছে চাঁদকে, তাই চন্দ্রিমাও রাহুগ্রস্ত। ব্ৰহ্মদন্ডের প্রভাবে বৃষ্ণি বংশের বিনাশ সমাগত।

নাগরিকদের জন্য কিছু সতর্কবাণী কৃষ্ণ উগ্রসেনের মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন যেমন–এক গৃহে কোনো প্রকারের সোমরস যেন তৈরি না করা হয়; দুই এমনকী অন্য রাজ্য থেকে আমদানি করে নিজস্ব মুদ্রা। ব্যয়ে সেবন অপরাধের। তবুও নগরে ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল, শোনা যায় বৃষ্ণি ও অন্ধকদের গৃহে শ্বেতবর্ণ ও রক্তনখর যুক্ত পায়রারা রাত্রিকালে গৃহস্থের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটায়। গাভীর গর্ভে গর্দভ, কুকুরের উদরে মার্জার এবং নেউলের পেটে ইঁদুরের জন্মকাহিনিও শোনা যাচ্ছে। কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খধ্বনিও গাধার ভীষণ ডাকে অশ্রাব্য থেকে যাচ্ছে।

কালের বিপরীত গতি দেখে কৃষ্ণ নিজেও নিশ্চিত যে, যাদবদের বিনাশ এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তিনিও যেন সেই নারীকে প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করেছেন যাঁর নাম মৃত্যু। তাঁর কেষ্ঠীতে রয়েছে, ভূমিতে যখন তিনি শয়ন করবেন, তখন জরা নামক এক ব্যাধ তাঁকে বাণে বিদ্ধ করবে। ঈশান কোণের দিকে যাত্রা করতে ইচ্ছে হয় তাঁর। সেখানেই তো বঙ্গদেশ– রাধার। দেশ। দীর্ঘাঙ্গী, আয়তনয়না রাধা। নিতম্ব কিঞ্চিৎ ভারী হলেও অসাধারণ বক্ষদেশ। সুলভিত বঙ্গভাষা। কোকিলের ধ্বনির মতোই মিষ্টতা। সেই দেশের মেয়েদের ভঙ্গি অসাধারণ। রন্ধন-কুশলাও তারা। মৎস্য, মাংস অতি উত্তম রান্না করে তারা। আজীবন নিরামিষ আহার গ্রহণকারী বাসুদেব গোপন অভিসার কালে সেই সুস্বাদু আমিষ আহারও গ্রহণ করেছেন। খুব শ্যামলিমা সেখানকার প্রান্তরে। বায়ু সুখদায়ক, ভূমিও নদীমাতৃক । সৌপ্তিকপর্বের অন্তিমে রাধার এসএমএস সত্যিই তাঁকে আন্দোলিত করেছিল, তিনি উদবেল হয়ে উঠেছিলেন। মহাভারতের মহাক্ষয়ে তিনিও নিমিত্তমাত্র। গান্ধারী বিশ্বাস করেননি তাঁর এই কপটতা। যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার অভিলাষ কৃষ্ণের ছিল। তিনি আত্মগর্বী হনন-উন্মুখ দুই প্রধান গোষ্ঠীকে সত্যিকারের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেননি। সকল জনমানসে তিনি ভাবগ্রাহী জনার্দন কিন্তু নিজের মনের লক্ষ্যদেশ তাঁর নিয়ন্ত্রণের অধীনে নেই। অন্ত্যজ প্রজাদের প্রতিনিধি তিনি, তাই প্রকৃত পাকল। প্রেমিক যাবতীয় ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে নির্বাচন করেছিলেন ব্যক্তিগত উত্থান। সেই। উচ্চাভিলাষ রাষ্ট্রকে বিপন্ন করেছে। তিনিও আর যাদবকুলের নয়নের মণি নন। অনুগত সংশপ্তক বাহিনীর সংহারও তাঁর প্ররোচনায় হয়েছে। রাজ্য পুরুষশূন্য। তিনিও বর্তমানে যৌনমিলনে অপারঙ্গম। স্নানাদি সমাপন করে কৃষ্ণ রাজবেশ পরিধান করলেন। ব্রাহ্মণেরা তাঁকে স্বস্তিবচনে সম্বোধিত করলে তিনিও প্রণাম জানালেন। দধি-ফলার সহযোগে তাঁদের অর্ঘ্য নিবেদন করলেন। এরপর কৃষ্ণ এলেন তাঁর স্বর্ণনির্মিত গরুড় চিহ্নিত রথে। ধ্বজা, গদা, চক্র, তলোয়ার, শঙ্খ, ধনুক ইত্যাদি আয়ুধ দিয়ে সুসজ্জিত রথ। শৈব, সুগ্রীব প্রভৃতি অশ্বরা কৃষ্ণের পুনরাগমনে চঞ্চল হয়ে উঠল। তিনি সারথি দারুককে অবরোহণ করতে বলে শকটের গতি বাড়িয়ে দিলেন।

লক্ষ্যপথের মতোই চির অচেনা ভবিষ্যৎ কাল। আজ তাঁর দিনির্ণয়ে ভুল হয়ে গিয়েছে। তিনি পুব দিকের পরিবর্তে যেন প্রত্যাবর্তন করেছেন সেই চিরচেনা প্রান্তরে। রমণীরা বিলাপ করছে। গণচিতার প্রজ্বলন এখনও অনির্বাণ।

একমাত্র স্থির জলেই মানুষ নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। ইন্দ্রিয় শুদ্ধ ও স্থির হলে দুর্বিঞ্জেয় আত্মাকেও দেখা যায়। যে-আত্মা মানুষ নেত্র দ্বারা দর্শন করতে পারে না বা কর্ণের দ্বারা শ্রবণ করতে পারে না, কৃষ্ণ তাঁর শুদ্ধ, স্বচ্ছ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সেই আত্মাদের দর্শন করতে থাকলেন। দুঃখ হলেও তিনি শোকে কাতর হলেন না। সমস্ত রাষ্ট্রের যে দুঃখ, তাঁর একা শোক করে কী লাভ? বুদ্ধিকে তিনি গুণের দিকে নিবৃত্ত করলেন। গুণময় পদার্থ থেকে তিনি চেষ্টা করলেন নিগুণ তত্ত্বের সমীপে পৌঁছোতে।

আবার এল রাধার এসএমএস: ‘কেমন আছ? ফিরে এসো তোমার রাধার কাছে। ধ্যানে নিমগ্ন মনটা বিনষ্ট হল। জনহীন কুরুক্ষেত্র প্রান্তর যেন জেগে উঠল। গান্ধারীর শতপুত্র রণভূমিতে রক্তাপ্লুত পড়ে রয়েছে। একাদশ অক্ষৌহিণী সেনানায়ক দুর্যোধন কর্তিত কদলি বৃক্ষের মতো পড়ে রয়েছেন। পড়ে রয়েছেন কুশলী ধনুর্ধর মহাবলী কর্ণ। শায়িত দুঃশাসন। ভীম তার বক্ষ চিরে রেখেছে। সেখানে এখনও শকুনের দল চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতুল তেজস্বী অভিমন্যুর মস্তক ক্রোড়ে নিয়ে ক্রন্দন করছে উত্তরা।

সমগ্র ভারতবর্ষ বীরোচিত শয্যায় শায়িত। গান্ধারীর শব্দবাণ হাওয়ায় ভাসছে। এই যুদ্ধের যাবতীয় সংহারের একমাত্র দায়বদ্ধতা কৃষ্ণের। তিনি উপেক্ষা করেছেন বিবদমান কৌরব এবং পান্ডবদের মধ্যে আনীত সন্ধির প্রস্তাবকে। বহু অনুচর ও সৈন্য তাঁর ছিল। কালকে তিনিই ঠেলে দিয়েছেন অনিবার্য যুদ্ধের দিকে। তাঁরই কারণে আজ ভরত বংশে নারীরা বিলাপ করছে। সৌপ্তিকপর্বে ব্যাপ্ত হাহাকারে দাঁড়িয়ে তিনি গান্ধারীর দিব্যদৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেননি। অভিশাপের করাল ছায়া এখন তাঁর দেহ ও মনে। যদুবংশ নিজেদের মধ্যে কলহ করে বিনাশপ্রাপ্ত হবে। অনাথের ন্যায় মৃত্যুবরণ করবেন তিনি–স্বয়ং রাধাস্বামী। মোবাইল স্ক্রিনে অর্নিবাণ অগ্নিশিখা। কবি, দার্শনিক মহাত্মা ব্যাসদেবকে বড়ো প্রয়োজন তাঁর, তিনি আর্ত। প্রেমহীন মৃত্যু-প্রতীক্ষায় উদ্‌বেল কৃষ্ণ।

.

২. যুধিষ্ঠিরের প্রাথমিক পাপবোধ

রাজপথে নাগরিকেরা বিজয়ী পাণ্ডবদের সংবর্ধিত করেছিল। সেই বিজয় বাহিনীরও অগ্রদূত সারথি ছিলেন কৃষ্ণ। তাঁর তুল্য দক্ষ অশ্বারোহী ছিলেন একমাত্র শল্য, যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্ণের সারথি। পরশুরামের গাভীবও ছিল কর্ণের কাছে। কলবুক খুলে কৃষ্ণের নম্বরে ছোঁয়ার আগে পিছলে গেল কর্ণ। দানবীর কর্ণ শত্রুকেও বিমুখ করতেন না, নিজেই যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিলেন। কখনো ডায়াল করা হয়নি। কুরুক্ষেত্রের কমেন্ট্রি বক্স থেকে সঞ্জয় বার বার ধরছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। তিনি তখন সবে কর্ণের বাণের তোড় থেকে রক্ষা পেয়েছেন। শ্রুতকীর্তীর রথে চড়ে কর্ণের পরাক্রম দেখছিলেন। সঞ্জয়কেও মিথ্যা বলেননি। আসলে মিথ্যে তো ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। আর যুদ্ধ এবং ক্ষত্রিয়ধর্ম পালনে তিনি কখনোই একনিষ্ঠ ছিলেন। না। তিনি চিরকালই স্বাধ্যায় ও যাগযঞ্জে ব্যাপৃত থেকেছেন। অর্জুন এবং সখা কৃষ্ণের উপর নির্ভর করে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে। নিদ্রা তাঁর বড়ো প্রিয়, সুখাসনে বসে তিনি নানাবিধ কল্পনাও করতে ভালোবাসেন। এখনও যেমন ভাবছেন পদব্রজেই স্বর্গে আরোহণ করবেন। বাকি ভ্রাতারা এবং দ্রৌপদী বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁকে অনুসরণ করবে। দুর্মর, গহন পথ, বনাঞ্চলে কীটপতঙ্গের খেলা, প্রস্রবণ কতদিন উপভোগ করেননি। রাজনীতিতে তাঁর স্বাভাবিক। অলসতা রয়েছে। কিছুটা আত্মধিক্কারেও তিনি জর্জরিত। বরাঙ্গনাদের পেলব নৃত্যকলা, পদ্যরচনা, গীতবাদন তাঁকে এখনও আকর্ষণ করে। জীবনকে তিনি সবচেয়ে উপভোগ করেন দূতক্রীড়ায়। সেই ভয়ংকর আত্মবিনাশকারী খেলা মহাভারতের যুদ্ধের অন্যতম হেতু। চতুর কেশবই একমাত্র যুধিষ্ঠিরকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ধ্যান ও যোগশিক্ষা তো কেশবের কাছেই।

কৃষ্ণের নম্বর ডায়াল করলেই টি-টি আওয়াজ আসছে। যাদবকুলের ধ্বংস কি অনিবার্য হয়ে উঠেছে? সেই জ্যোতির্বিদ এখনও কারাগারের নিরন্ধ্র অন্ধকারে বন্দি। দুর্যোধনের অত্যন্ত প্রিয় সেই বৃদ্ধ। প্রবাদপ্রবচন মানেন না, সংস্কার-শাস্ত্র কিছুই মানেন না। সর্বোপরি অস্বীকার করেন। ‘কৃষ্ণের ঈশ্বরতত্ত্ব’। চার্বাক মুনির আশ্রমেও যেতেন দুর্যোধন। ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতাঃ।’ ফিরে আসা নেই, জন্মান্তর নেই। স্বর্গ, নরক কিছুই নেই। এই দেহ মৃত্যুর পর মিশে যাবে মৃত্তিকায়। মাতুল শকুনির সাহচর্যে দুর্যোধনের পরিচয় হয়েছিল চার্বাকের সঙ্গে। নব্য যুবকদের কাছেও ইনি প্রিয় হয়ে উঠেছেন। বন্দি বৃদ্ধের নাম অর্কজ্যোতি। চার্বাক গুরুকুলের একজন প্রধান অধ্যাপক। কৃষ্ণকে অমান্য করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের জন্য গান্ধারীর মতো ইনিও প্রত্যক্ষ দায়ী করেছেন কেশবকে। এই মহাযুদ্ধে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্যাপক বিক্রিবাটা হয়েছিল। যাদবেরা নিজেদের কর্ম থেকে চ্যুত হয়ে অস্ত্র ব্যাবসায় নিযুক্ত হয়েছিল। কৃষ্ণ তাঁরই সংশপ্তক বাহিনী দুর্যোধনকে অর্পণ করে ব্যক্তিগত প্রাপ্তিলাভ করেছিলেন প্রচুর। তিনি একদিকে গীতার সৃষ্টিকর্তা, আর অন্যদিকে স্বার্থ ব্যতীত কিছুই করেন না তিনি এমন অপশ্রুতি রয়েছে। যুধিষ্ঠির কেশবের নিন্দা কখনো শ্রবণ করেন না। কলি যুগের প্রারম্ভে নাকি এসবই ঘটবে। ঈশ্বরের অস্তিত্বে আসবে সংশয়। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণেরও মৃত্যু ঘটবে নিষাদের হাতে। তিনি গো-হত্যা, প্রাণীনিধন নিষেধ করেছেন। প্রজাদের নিরামিষ আহার বাধ্যতামূলক হয়েছে। সমগ্র উত্তর ভারত তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছে। ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইতিহাসে তিনিই একমাত্র স্মর্তব্য। কিন্তু শিকার নিষিদ্ধ হওয়ায় ব্যাধশ্রেণি ওঁর উপর ক্ষুদ্ধ। গোদুদ্ধ এদের অপ্রিয়। এ ছাড়া সবুজ সবজি এবং দুগ্ধও অগ্নিমূল্য। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। যুদ্ধের প্রভাবে উৎপাদন নিন্মগতি। জমি উর্বরতা হারিয়েছে। বৃষ্টি নেই। ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ভঙ্গুর অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। হস্তিনাপুরের অদূরের প্রান্তিক রাজ্যগুলিতে বিদ্রোহের আশঙ্কা। দেখা দিয়েছে। দ্বারকা, মথুরায় সাধারণ প্রজারা কৃষ্ণের উপর অসম্ভব ক্ষুদ্ধ। তিনি নাকি ভুলপথে চালিত করেছেন রাজ্যকে। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধের এর অব্যবহিত পরেই রাজকোষ প্রায় শূন্য। উন্নয়ন খাতে ব্যয় বলতে কিছুই করেননি কৃষ্ণ। উগ্রসেন কৃষ্ণের নিযুক্ত কাষ্ঠপুত্তলিকা ব্যতীত কিছুই নয়।

দুর্বল যুধিষ্ঠির এসব পাপচিন্তাকে আর প্রশ্রয় দিলেন না। তিনি নরকগামী হতে চান না।

যুধিষ্ঠির উচ্চারণ করলেন, তিনি অর্থাৎ কৃষ্ণই সত্য, পরম পবিত্র, মঙ্গলময়। তিনি অবিনাশী, অবিচল, অখণ্ড জ্ঞান স্বরূপ পরমব্রহ্ম। তিনি সৎ অসৎ দুই-ই। জগতের সমস্ত কাজ তাঁর শক্তিতেই সংঘটিত হয়।

.

. নাস্তিক্যদর্শন

কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে পার হয়ে শ্রীকৃষ্ণের রথ এখন হস্তিনাপুর অভিমুখে চলেছে। তিনি সেই বৃদ্ধ বন্দির সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চান। নক্ষত্রেরও নাকি জন্ম-মৃত্যু রয়েছে। ওদেরও পরিবর্তন হয়। চিরদিন উজ্জ্বল নয়। সূর্য দেবতা নন, মাঝারি একটি নক্ষত্র মাত্র। বিবাহের পূর্বে কুন্তী সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন নিজের চরিত্রের সাময়িক স্খলনের কারণে। সূর্যরশ্মি থেকে কোনো যৌনমিলন সম্ভব নয়। এ সবই ব্যাসদেবের বন্ধুর কল্পনা।

তপস্যা ও ব্রহ্মচর্যের দ্বারা ব্যাসদেব মহাভারত নামক এক মহাগ্রন্থ রচনা করে চলেছেন। অনুলিখনের দায়িত্বে রয়েছেন শ্রীগণেশ। বৈদিক, লৌকিক সমস্ত বিষয় এই গ্রন্থে রয়েছে। এই গ্রন্থে রয়েছে বেদাঙ্গ-সহ উপনিষদ, দেবাদির ক্রিয়াকলাপ, ইতিহাস, পুরাণ, পৃথিবী-চন্দ্র-সূর্যগ্রহ নক্ষত্রাদির বর্ণনা। ঋক্‌-সাম-যজু-অথর্ববেদ, অধ্যাত্ম, ন্যায়, শিক্ষা, অনুশাসন, বিবিধ জাতি, লোক ব্যবহার, সঞ্জয়-কৃত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাত্যহিক ধারাবিবরণী এবং শ্রীকৃষ্ণের অনির্বচনীয় মহিমাকীর্তন। ব্রহ্মা ব্যাসদেবকে যতই তত্ত্বঞ্জানসম্পন্ন মহাখ্যাতি বলুন-না কেন, এই মহতী কাব্যও এতটা জনশ্রুতি পেত না যদি-না সেখানে কেশবের মাহাত্ম্য অনুপস্থিত থাকত। তিনিই স্বীকৃতি দিয়েছেন এখনও বহমান নিত্যদিনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ মহাভারকে পঞ্চম বেদ হিসেবে। ব্যাস চেয়েছিলেন, এটি পাঠ করবেন শূদ্র ও নারীরা। কৃষ্ণই তো ভারতবর্ষের নিন্মবর্গের অগণিত মানুষের প্রতিনিধি। ফলে তিনি স্বীকৃতি দেওয়ায় এই মহাগ্রন্থ পাঠে প্রকৃত পুণ্য লাভ হয়। ব্যাসদেবের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতাকেও সূর্যের মতোই নস্যাৎ করতে চেয়েছিলেন কারাগারের বন্দি। নাস্তিক্যদর্শনের প্রবক্তা ইনি। মহাভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে চান কারণ কালের গতিপ্রকৃতি নাকি চার্বাকের নিয়ন্ত্রণে। ব্যাসদেবও সাক্ষাৎ করেছিলেন। আজ কৃষ্ণ এসেছেন কারাগারে।

.

৪. শ্রীরাধিকার অনুরাগ স্মৃতি

শ্রীরাধা রতিক্রিয়ার হৃদয়ে যে-আনন্দের রেশ উৎপন্ন হয় সেখান থেকে বললেন, ‘হে যদুনন্ধন! চন্দনাপেক্ষাও সুশীতল তোমার করদ্বারা মদনের মঙ্গলকাসতুল্য আমার এই পয়োধরে মৃগনাভি পত্রলেখা অঙ্কিত করো।’ স্বাধীনভর্তৃকা রাধা। তিনি সব দূরত্ব আড়াল করে কৃষ্ণের কোলে এসে বসেছেন। যমুনায় নৌকাবিহার চলেছে। মাঝি ক্রুদ্ধ, সে তো আর যদুনন্দনকে চেনে না। বইঠা হাতে নিয়ে সে অন্য দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চুম্বনে চুম্বনে রাধার চোখের কাজল মুছে গেছে। ভ্রমরসাদৃশ অবস্থা চূর্ণকুন্তলের। এবার সরস সুন্দর জঙ্ঘাদেশে কৃষ্ণের হাত খেলা করছে। রতি উন্মুখ রাধার জঙ্ঘাদেশে যে ঘর্ম রয়েছে তা তিনি জিহ্বা দিয়ে লেহন করছেন। আরও আরও শিউরে উঠেছে রাধা। একসময় মনে হয়েছিল, কথিত সময় তো অতিক্রান্ত হল, কই তিনি তো এলেন না। সখিগণ বোধ হয় বঞ্চনাই করেছে। কৃষ্ণের কাছে কোনো সংবাদই পৌঁছোয়নি। আসলে তখন তো চলভাষ ছিল না। ক্ষণে ক্ষণে তাঁর অদর্শনে মনে হত ‘মম বিফলমিদমমলমপি রুপযৌবনম’। সখী কলহান্তরিতা এসে বলেছিল, ‘রাতিসুখসারেগতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্’। হে সখী, তোমার হৃদয়েশ্বর মদনমনোহর বেশে রতিসুখসারভূত অভিসারে গমন করেছেন। নিতম্বিনী তুমি গমনে বিলম্ব কোরো না। পীনপায়োধর-পরিসর মর্দন চঞ্চল করযুগশালী। তোমার পীনপয়োধর পরিসর মর্দনের জন্য তাঁর করযুগল চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সখী খন্ডিতা যোগ করল আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ‘ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।’ ধীর সমীর সেবিত যমুনাতীরে সেই বনমালী বনান্তে অপেক্ষা করছে। রাধার তখনই মনে হয়েছিল তোমার অভিসারে যাব অগম পারে। তাঁর হাড়-মজ্জার ভেতর দিয়ে বাজতে থাকত সেই আহ্বান। আহ্বানের বাঁশি আকুল করে তুলত। জীবন আচ্ছন্ন করা সেই বাঁশি। ঝড় বৃষ্টি বিদ্যুৎচমক উপেক্ষা করে, আয়ান ঘোষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও রাধা গেছে। ও’ই যে বাজিল বাঁশি, বলো কী করি?’

কয়েক ঘণ্টা হয়ে গেছে এসএমএস-এর কোনো উত্তর এল না।

হায় পুরুষ! ধিকৃত ওর জন্য যাবতীয় অভিসার।

আকাশের তারাদের মতোই এখন অধরা সে।

.

৫. কৃষ্ণের ব্যাসদেবের কাছে গমন

খুব ভোরে প্রতিটি বারাঙ্গনা পল্লিতেই এক ধরনের পবিত্র আলো এসে পড়ে। কৃষ্ণের প্রতিনায়িকার নাম চন্দ্রাবলী। গোপনে তার কুঞ্জে বহু রাত অতিক্রান্ত করেছেন কৃষ্ণ। রাধার উদবিগ্ন এসএমএস-এর কারণে একটা পালটা উদ্‌বেগ কৃষ্ণের মন জুড়ে রয়েছে। চন্দ্রাবলী ছিল খন্ডিত। ওর গৃহে রাত্রি যাপন করেন বলে রাধার প্রবল অভিমান হত। কৃষ্ণেরও গত রজনির জাগরণের কারণে লোহিত চক্ষু আলস্যে নিমীলিত থাকত। সেইসব পূর্বকথা।

ধুলোয় আকীর্ণ পথ। পল্লির গৃহগুলিও ধুলোয় আচ্ছন্ন। অপ্রশস্ত পথ। এই অঞ্চলের পথের মার্জনার কোনো দায় নেই নগরপালের। যদিও রাত্রির প্রহর যতই বাড়ে রথের ঘর্ষণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এই প্রান্তর। দিবাবসান হতেই চুলে, কানে, গলায়, বাহুতে মালা জড়িয়ে শরীরের বস্ত্র শিথিল করে দিয়ে নাগরিকদের জন্য অপেক্ষা করে বারাঙ্গনারা। কালের হিসেবে সবচেয়ে প্রাচীন এই পল্লি। পল্লির সীমান্তে দু-একটি বৃক্ষ রয়েছে। তাদের তলদেশে সস্তায় মাধ্বী সেবনের আয়োজন থাকে। এই পথ দিয়ে পদাতিক বণিকেরাও আসে এখানে। আসে রাজন্যবর্গের রথ। সাধারণ পথচারীকে কোণঠাসা করে ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলে ঘোড়সওয়ার। স্তম্ভিত দেহবিলাসিনীরা কাতর অপেক্ষা করে থাকে রাজপুরুষদের আগমনের।

অচিরেই ধ্বংস হবে নগর। এই পল্লিরও মৃত্যু অনিবার্য, ধ্বংসবীজ শরীরে ধারণ করেই যৌবনে উপনীত হয়েছিল সে। উত্তরদায়ী কে?এই। ধ্বংসের অভিশাপের বার্তাবাহকই-বা কে? বহু বছর পর এই পথ দিয়ে গোপনে অভিগমন করছেন কৃষ্ণ। নগর স্থাপনের সময়েই নাকি অভিশাপ। ছিল ধ্বংসের। গান্ধারী নিয়তির বার্তাবাহী মাত্র। চন্দ্রাবলীর কথাই-বা মনে পড়বে না কেন? অর্ধনিমীলিত নয়নে আরক্তিমা নিয়ে কৃষ্ণের তার জন্যেও তো অপেক্ষা ছিল। কিন্তু বিত্ত মানুষকে এক অলৌকিক বিভা দেয়। কৃষ্ণেরও তাই হয়েছে। তিনি বিস্মৃত হয়েছেন রাধা, চন্দ্রাবলী এবং তাঁর গোপিনীদের। রাজনীতি ও অর্থনীতির দ্বন্দ্বে তিনি বিভ্রান্ত। শরীরের সেই শ্যামবর্ণ উজ্জ্বল কান্তিও নেই। রুপসি ও প্রেমময়ীদের প্রতি যৌন-উচ্ছ্বাসও প্রায় অন্তর্হিত। তিনি সত্তরতম বর্ষে পদার্পণ করেছেন। চলনে এখন তাঁর মধ্যমভাব। তাও তিনি কৃষ্ণ বলেই এটুকু সম্ভব। যমুনার কৃষ্ণজলে জলক্রীড়া আর তাঁকে মানায় না। তাঁর একদা প্রিয়, কান্তিবান পুত্র শাম্ব ব্যাধিগ্রস্ত। তিনিই উচ্চারণ করেছেন অভিশাপ।

এখন তিনি চলেছেন কারাগৃহের গর্ভ অন্ধকারে। বৃদ্ধ জ্যোতির্বিদকে তিনি দেখতে চান। প্রবল অত্যাচারের পরও যিনি তাঁর নাস্তিক্যদর্শন থেকে এতটুকু সরে আসেননি। নক্ষত্রের, মহামন্ডলের ভাষা অর্জুনকে দিগদর্শন দেখানোর পরও কি তাঁর অগম্য থেকে গেছে। তিনি কি তবে বাস্তবরহিতও? কেশব স্বয়ং প্রশ্নতুর, মৃত্যুদীর্ণ।

সেই মৃত্যুদীর্ণ গহন অন্ধকারের স্তর থেকে কৃষ্ণের চিন্তায় আবার উঠে আসছেন শ্রীরাধিকা। প্রথম মিলনে যথেষ্ট ভীত ও সন্ত্রস্ত ছিল সে। কৃষ্ণ তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করলেন। হয়তো তিনি স্বয়ং অবলোকন করলেন সৃষ্টির রহস্যের পরিপূর্ণতাকে। রাধিকার গায়ের রং ছিল তাম্রাভ, একটু কালোর দিকেই। শরীর সর্বদাই উত্তপ্ত থাকত। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সৌন্দর্যচর্চায় তার কখনো কোনো রকমের অলসতা ছিল না। রাতের পর রাত আয়ান। ঘোষের পুরুষাঙ্গটির শিথিলতা না কাটলেও রাধিকা যৌনাঙ্গের কেশগুলি সযত্নে কর্তন করে রাখত। মাথার কেশরাশিতে দীর্ঘদিনের সুগন্ধিতেলের ব্যাবহারে কিঞ্চিৎ কুঞ্চন ও বাহার এসেছিল। স্তন দুটি ভরন্ত এবং নিতম্ব অত্যন্ত আকর্ষণের। ওর শরীরের সবচেয়ে কামার্ত অংশ ছিল পা দুটো। চোখের পাতা দুটো ঘন কৃষ্ণবর্ণের, আয়তনয়না এবং নাসিকা দীর্ঘ। ঠোঁট অপেক্ষাকৃত ভুল, এটি শরীরের একমাত্র অনুজ্জ্বল অংশ যদিও রক্তিম। দন্তরাশি উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণের, রতিক্রিয়ায় অসম্ভব পারঙ্গমা। অপাঙ্গ দৃষ্টিতে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, আবেগের অভিনয় নিখুঁত। অক্ষিদ্বয় থেকে নির্গত অশ্রুবারি স্ফটিকের মতোই স্বচ্ছ এবং বিশ্বাসযোগ্য। নীলাম্বরি শাড়িই ছিল শ্রীরাধিকার প্রিয়। দু-পায়ে রাঙিয়ে থাকত আলতা।

বৈষ্ণব কবি বলছেন, ‘রাধার অন্তরে হইল ব্যথা।’ আসলে রতিরণোচিত বেশে সজ্জিতা কোনো গুণশালিনীর প্রেমবিলাসে মেতেছেন কৃষ্ণ। কেশপাশ শিথিল এবং চূর্ণ ফুলদলে আরক্তা সেই নারীকে রাধা দেখেছেন। তিনি নিজেই তখন খণ্ডিতা। কৃষ্ণ যেন পদশব্দ শুনতে পাচ্ছেন যমুনাতীরে রাধা আসছে। কারাগারের অন্ধকার কক্ষে আসার আগে কৃষ্ণ যাবেন ব্যাসদেবের কাছে। সেই ব্যাসদেব, যাঁর কাছে লোকহিতার্থে স্বয়ং ব্রহ্মা এসেছিলেন। বিস্মিত ব্যাসদেব ব্রহ্মাকে প্রণাম করে বলেছিলেন, ‘ভগবান! আমি এক অতি সুন্দর কাব্য রচনা করেছি, বৈদিক এবং লৌকিক সমস্ত বিষয় এতে আছে। এতে বেদাঙ্গ উপনিষদ, বেদাদির ক্রিয়াকলাপ, ইতিহাস পুরাণ, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, জরা-ব্যাধি-মৃত্যু, আশ্রম-বর্ণাদির ধর্ম, পুরাণের সার, তপস্যা-ব্রহ্মচর্য, পৃথিবী-সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ নক্ষত্র এবং যুগের বর্ণনা, চতুর্বেদ, অধ্যাত্ম, ন্যায়, মিথ্যাপূর্বক, যুদ্ধকৌশল, বিভিন্ন ভাষা, জাতি, লোকব্যবহার, ব্যাপ্তস্বরূপ পরমাত্মার প্রকাশ সবই রয়েছে। তবে এই গ্রন্থের উপযুক্ত লিপিকার আমি পাচ্ছি না। ভগবান ব্ৰহ্মা প্রত্যুত্তরে শ্রীগণেশের কথা বলেছিলেন। তারপর থেকেই শ্রীগণেশ লিখে চলেছেন মহাভারতের অপূর্ব ভাষ্য। মহাভারত হল জ্ঞানরূপ অঞ্জনশলাকা। ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ –এই চার পুরুষার্থের সংক্ষিপ্ত ও বাস্তব বিবরণ মানুষের অভ্যন্তরের অন্ধকার দূর করবে। মহাভারতের প্রতিটি শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের অনির্বচনীয় মহিমা প্রকটিত হয়েছে। আসলে এই কল্পবৃক্ষ সকলেরই আশ্রয়স্থল। তাই বন্দিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগে কৃষ্ণ দেখা করবেন মহাকবি ব্যাসদেবের সঙ্গে। পঞ্চভৌতিক, আধ্যাত্মিক এবং প্রকৃতির মূল স্বরূপ কিছু অন্বেষণ তাঁর বড় প্রয়োজন। তিনি সনাতন পুরুষ হয়েও কবির কাছে যাবেন, কারণ ব্যাসদেবের মধ্যে সৎ-অসৎ দুটোই প্রকটিত। তিনিই নীতিভিত্তিক চরিত্রের স্তর থেকে নিজেকে উন্নীত করেছেন। মহাভারত শুধু ব্রাহ্মণের নয়, শূদ্রেরও। এমনকী নারীও এই পঞ্চম বেদ পাঠের মনোনীতা।

ব্যাসদেব এখন রয়েছেন লৌহিত্য নদের তীরে। এই নদের বৃত্তান্ত রয়েছে কালিকাপুরাণে। ব্রহ্মা একবার পৃথিবী প্রদক্ষিণে বেরিয়ে মহর্ষি শান্তনুর আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। শান্তনুর স্ত্রী ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। ওকে দেখে একেবারে মোহিত হয়ে গেলেন ব্রহ্ম। শান্তনু অনুপস্থিত জেনে এমন নির্জন পরিবেশে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। কামনা করে বসলেন অমোঘাকে। স্বাভাবিকভাবেই এই অশালীন আচরণে অসন্তুষ্ট হলেন অমোঘা। ওঁর রুদ্রমূর্তি দেখে ব্রহ্মা আর কাছে যাওয়ার সাহস পেলেন না। তবে যাওয়ার আগে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে স্খলন করে গেলেন তার বীর্য দ্বারপ্রান্তে। শান্তনু ফিরে এসে সবটা জানতে পেরে অসন্তুষ্ট হলেন। ব্রহ্মাকে তৃপ্ত করাই ছিল সনাতন ধর্ম। অমোঘা তখন ব্রহ্মার বীর্য ধারণ করে গর্ভবতী হলেন। জলপিণ্ডবৎ এক পুত্রের জন্ম হল। তখন মহতী শান্তনু কৈলাস, গন্ধমাদন, জারুধি ও সংবর্তক এই চারটি পর্বত দিয়ে ঘিরে সেই জলরাশি ব্ৰহ্মকুণ্ডে আটকে রাখলেন। এদিকে জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম পিতার আদেশে মাতাকে হত্যা করে পাপমুক্ত হওয়ার জন্য এই ব্ৰহ্মকুণ্ডে এসে স্নান করে কুণ্ডের জল। পান করেন। তিনিই সকল মানুষের পাপমুক্তির কথা চিন্তা করে আবদ্ধ জলরাশিকে লৌহিত্য সরাবেরের মধ্যে দিয়ে মুক্ত করার কারণে প্রবাহপথ তৈরি করে দেন। সেখান থেকেই সৃষ্টি এই লৌহিত্য নদ বা ব্রহ্মপুত্রের। আর সেই নদের তীরে রয়েছেন ব্যাসদেব অহম রাজ্য, জ্যোতিষচর্চার কেন্দ্রের কারণে এর আরেক নাম প্রাগজ্যোতিষপুর।

যদিও তখন এই রাজ্য অহম বা জ্যোতিষপুর হিসেবে পরিচিত ছিল না। তবে নদ-নদীর নাম তো অপরিবর্তিত থাকে। ফলে বিষ্ণুপুরাণের শোণিতপুরের অদূরে লৌহিত্য নদের তীরে ব্যাসদেব জ্যোতির্বিদ্যাচর্চায় মগ্ন–কৃষ্ণ অনুমান করলেন। তাঁর পত্নী রুক্মিণীর দেশ। দুর্যোধনপত্নী ভানুমতীও ছিলেন এই দেশের মেয়ে আর অর্জুনের স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা ও ভীমের জায়া হিড়িম্বাও কিছু সময় এই রাজ্যে ছিলেন। প্রাগজ্যোতিষপুরের নারীরা অতি সুন্দরী হয়। রুক্মিণীকে হরণের কারণে কৃষ্ণ একযোগে বহু রাজাকে পরাজিত করেছিলেন এবং দ্বারকায় ফিরে গিয়ে শিশুপালকে। হত্যা করেন। শেষ এসেছিলেন অনিরুদ্ধের কারণে। বানাসুরের কন্যা উষাকে বিবাহ করেছিল সে। গান্ধবর্মতে বিবাহ সম্পূর্ণ করার পর অনিরুদ্ধকে বন্দি করা হয়েছিল। সেও এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, অবশেষে অনিরুদ্ধকে মুক্ত করেন তিনি।

তবে ব্যাসদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল না। বৃদ্ধ বন্দিটির সঙ্গে একাই দেখা করতে হবে কৃষ্ণকে। তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। সময়ের করাল ছায়া তাঁকেও যেন রাহুগ্রস্ত করেছে। সময়ের জটিল আবর্তে তিনিও কি নিন্দনীয় হয়ে উঠবেন? এইসব কূটতর্কে প্রবেশের আগে খুব মনে পড়ছে অভিসারিকা রাধার কথা। সে যদি বিগতযৌবনাও হয় তবুও তার সৌন্দর্যের আকর্ষণ অলঙ্ঘনীয়। যুদ্ধক্ষেত্রে লিপ্ত না থেকে তিনিও তো পারতেন বাঁশরি বাদক ও প্রেমিক বাসুদেব হিসেবেই অক্ষয় থাকতে। পরক্ষণেই সংবিৎ ফিরে পেলেন। অলমতি চিন্তার পঙ্কিলতা আচ্ছন্ন করছে তাকে। যোগবলে মুক্ত হলেন ব্যাসদেব সন্দর্শনে।

.

. কারাগৃহে কৃষ্ণ

কয়েকটি ঋতু অতিক্রান্ত হয়েছে বৃদ্ধ জ্যোতির্বিদ অর্কজ্যোতি এখানে এসেছেন। কারাগৃহের আধিকারিকরা এসেছিলেন। ওঁকে ধৌত করা। হয়েছে। শরীরে আশ্রয় পাওয়া চাম-উকুনগুলি যতদূর সম্ভব দূর করা। হয়েছে। নিম্নাঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অত্যাচারপর্ব নিম্নাঙ্গ লক্ষ করেই করা হয়। এই কারাগৃহের অভ্যন্তরে সারা রাত চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। কৌরবপক্ষের শতাধিক সেনা এই কারাগৃহে রয়েছে। তাদের উপর অত্যাচার অবর্ণনীয়। ব্যাসদেবের মহাভারতে সেই। নিপীড়নের কাহিনি অংশভুক্ত হওয়ার কথা নয়। যাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশে এই অত্যাচারপৰ্ব সংঘটিত হয় দিনের পর দিন, তিনি রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির নন, তিনি কৃষ্ণ। জনশ্রুতি রয়েছে তিনিই স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। দুষ্টের নাশক। ধর্মরক্ষার জন্য যদুবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই অনাদি অনন্ত। বক্ষস্থলে স্ত্রীবৎসচিহ্নিত এবং সুন্দর পীতবাস ধারণ করেন। অর্জুনকেও সর্বাগ্রে রক্ষা করেছেন তিনি। তিনি কখনো শত্রুকে দুর্বল ভাবেন না। ব্যক্তিগত জীবনে ক্ষমাকে প্রশ্রয় দেন না। নাস্তিক্যবাদ তিনি প্রবলভাবে ঘৃণা করেন। চার্বাক মুনির আশ্রম তিনিই ধ্বংস করেছিলেন। সেই কৃষ্ণ আসছেন কারাগারে, আস্তিক্যদর্শনের প্রবক্তাও তিনি। উপবীত পরিধান করলেন বৃদ্ধ। বন্দিরা জয়ধ্বনি করছে, ‘কৃষ্ণ ভগবান! ওদের মধ্যে কৃষ্ণের আগমনে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছে। বধ্যভূমিতে দু-জনকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আজকের দিনের জন্য রদ করা হয়েছে। তাঁর আগমনের এতটা প্রচার তিনি চাননি। কিন্তু এই আর্যাবর্তে, এই দশকে তাঁর তুল্য পুরুষ কোথায়! তিনিই তো পুরুষোত্তম। ‘প্রকাশং চ প্রবৃত্তিং চ মোহমেব চ পাণ্ডব। /ন দ্বেষ্টি সংপ্রবৃত্তানি ন নিবৃত্তানি কাঙ্ক্ষতি।’ তিনি প্রকাশ প্রবৃত্তি ও মোহ আবির্ভূত হলেও দ্বেষ করেন না। সেই প্রাবক্তিক পুরুষ এসেছেন কারাগারে। কারাধ্যক্ষকে চেনার উপায় নেই। ওর রক্তচক্ষুদ্বয়ে আজ যেন মায়াঞ্জন মাখা রয়েছে। বন্দিরা তাঁর সন্দর্শনে ধন্য হচ্ছে এবং এইভাবে নন্দিত হতে হতে তিনি অবশেষে এলেন। বৃদ্ধের গোপন কারাগারে। উপবীত ধারণকারী ব্রাহ্মণটির পদদ্বয়ে তখনও শৃঙ্খলযুক্ত। কৃষ্ণের নির্দেশে বন্ধনমুক্ত হল শৃঙ্খলের। তিনি এবার নিরীক্ষণ করছেন বৃদ্ধকে। পক্ককেশ, লোলিতচর্ম, তবে অতি তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয়।

যতটা অসভ্যতা কৃষ্ণ বন্দির কাছ থেকে আশা করেছিলেন, বন্দিটি ততখানি দুর্বিনীত নয়। যাদব কৃষ্ণকে তিনি প্রণাম করলেন। কৃষ্ণও প্ৰতিনমস্কার করলেন। এবার বৃদ্ধটি একটু বিদ্রুপের গলায় বলে উঠলেন, ‘কৃষ্ণস্তু ভগব।’ প্রত্যুত্তরে কৃষ্ণ বললেন, ‘জ্ঞানং, জ্ঞেয়ং, পরিজ্ঞতা’ এই। তিনটিই কর্মের প্রেরণা। আপনি নতুন কী কথা বলেন?

–আমার আচার্য ছিলেন বোধিশ্রেষ্ঠ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর মেঘের গর্ভে জল থাকবে না। বনানীর চিহ্ন থাকবে না। বন্যপশু ও মানুষ মরতে শুরু করবে। এইসব কি আপনারও জানা ছিল না?

–কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের উত্তরদায়িত্ব একা আমার নয়।

–কথাটা সত্য, কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে না। মহাপ্রকৃতি তবে কি আমাদের কাছে দুয়ে?

–এর স্বীকারোক্তি আমি আগেই করেছি।

–অথচ আপনিই অর্জুনকে বলেছেন, ‘তপাম্যহমহং বর্য নিগৃহ্না মৎস্হামি চ।/অমৃতং চৈব মৃত্যুশ্চ সদসচ্চাহমর্জুন।’ অর্থাৎ আপনিই তাপ প্রদান করেন এবং আপনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং আকর্ষণ করেন। জড় ও চেতনা উভয় বস্তুই আপনার মধ্যে রয়েছে।

–অনেকাংশে সত্য।

–তবে মহাপ্রকৃতি এর বাহ্য কিছু?

–শৌনক মুনির নেতৃত্বে ঋষিরা আমার সম্পর্কেই বলেছেন, ‘কৃতবান্ কিল কর্মাণি সহ রামেশ কেশবঃ।/অতিমানি ভগবান্ গূঢ় কপটমানুষঃ।।’ ওঁরাই বলেছেন আমি স্বরূপ গোপন করে মনুষ্য রূপে লীলাবিলাস করছি।

–সেটা তো আমিও বলতে পারি, ‘অহং সর্বেষু ভূতেষু।’

–তুমি মোহাচ্ছন্ন বোধ থেকেই এটা বলছ।

–আপনাকে কিন্তু খুব বিচলিত এবং অন্যমন দেখাচ্ছে?

–আমিই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা এবং পিতামহ। আমি জ্ঞেয় বস্তু, শোধনকারী ও ওঙ্কার।

–অর্জুনকে বলেছেন এইসব। কিন্তু এখনও কি সে এইসব বিশ্বাস করে!

–আমার ভক্তরা করে।

–অসীম এবং সসীমের উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ কি সম্পূর্ণ? ভেবে উত্তর দিন।

–হ্যাঁ, অবশ্যই।

–রাধাকে আমি দেখেছি।

–কোন রাধা?

–আপনার শ্রীরাধিকা।

–কী করে দেখলে?

–সে আমাকেও এসএমএস করেছে। আপনি প্রতারক। জগৎ ও রাধার সঙ্গে আপনি প্রতারণা করেছেন।

–আমি তোমায় ক্ষমা করছি।

–ধর্মশীল রাজা রামচন্দ্রও সীতার পবিত্রতায় বিশ্বাস রাখতে পারেননি, আর আপনি আয়ান ঘোষের একদা পত্নী রাধাকে নষ্ট করলেন।

কৃষ্ণ এবার একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

–রাধা এখন কোথায় আছেন, ভদ্রে আপনার জানা আছে?

এবার একটু মূল্য দিলেন কৃষ্ণ কারাগারের বন্দিকে।

–আপনি কি মনে করেন সেই কুসুমকোমলা নারী সমাজে খুব নন্দিত হয়েই অবস্থান করছে?

–বঙ্গদেশই তো রাধার আবাসস্থল ছিল।

–স্বামী পরিত্যক্তা রমণী পিতার গৃহেও আর সম্মানজনক অবস্থান পায় না। তার উপায় একমাত্র ছিল গণিকালয়ের অন্ধকার গৃহ।

স্ত–ব্ধ হও তুমি। বন্দি, তুমি সীমা উল্লঙ্ঘন কোরো না।

–বাঁশি, তম্বুরা, মন্দিরা, মৃদঙ্গের সেই দিনগুলি আপনি ভুলে গেলেন ক্ষতি নেই। কিন্তু যে-গৃহবধূ নারীকে আপনি স্বৈরিণী করে তুললেন, এক বারও তার ভবিষ্যতের কথা ভাবলেন না! এরপরেও মানুষ আপনাকে ভাবগ্রাহী জনার্দন বলবে!

কৃষ্ণ স্তম্ভিত হলেন। বাতাসও নিস্তব্ধ। ভূমিও যেন পিচ্ছিল। সংসারত্যক্তা অসহায় স্ত্রীলোকটির বেদনাতুর মুখটি তিনি স্মরণ করলেন…

…রাধা রয়েছে বৃদ্ধাবাসে। সে এখন প্ৰবীণা। স্তন, নিতম্ব কোনো কিছুই ওর আর আকর্ষণীয় নয়। হয়তো রাধাকে দেখতে শ্মশানপ্রান্তের কোনো ডাকিনীর মতোই হয়েছে…

–আমি ওকে এক বার দেখতে চাই, জীবিতা কি না জানেন?

–এসএমএস যখন করেছে…

–হয়তো আত্মহননের প্রাক্‌মুহূর্তের আর্তি।

শয্যায় সেদিন ছিল শুক্লপক্ষের চাঁদের আলো। রাধার আয়তপক্ষ্ম নিমীলিত। চোখের তলায় কালি। অনাবৃত বাহুতে চোখের জলই বোধ হয় লেগেছিল। কৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন শ্রীরাধিকাকে বিবাহ করা তাঁর সম্ভব নয়। আয়ান ঘোষ তো নপুংসক ছিলেন। ওর বীর্য সন্তানক্ষম ছিল। কিন্তু কৃষ্ণের বীর্যে রাধার গর্ভে সন্তান আসা তো স্বাভাবিক। কী পরিচয় হবে ওর? এইরকমই সংশয়ে দীর্ণ ছিল রাধা। এই প্রাণের জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজন হলে দক্ষ বৈদ্যকে ডেকে আনতে হবে। গর্ভপাত ঘটাতে হবে রাধার। কৃষ্ণ অবশ্য রাধাকে আশ্বস্ত করেছেন, এই অবৈধ। প্রেমই শাশ্বত হবে। আহত হবে কাল। রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা জগতে অক্ষয় হয়ে থাকবে এই তাঁর অভীপ্সা। সুচতুর ক্ষমতাবান কৃষ্ণ যা খুশি করতে পারেন। মুহূর্তে আত্মস্বার্থে হত্যা করতেও তিনি নিবৃত্ত হবেন না। অবশেষে চোখের জলে সম্মত হয়েছিলেন রাধা। সেই অশ্রুজলের দাগ বাহুতে লেগে ছিল।

–অর্বাচীন, তুমি আমায় পথ চেনাতে পারবে?

–কোন পথ? বৃক্ষহীন, ধুলায় আকীর্ণ, অনন্ত রোদে ক্লিষ্ট পথ? যুদ্ধের পর আপনি প্রত্যক্ষ করেননি– দয়া নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। মাটিও সিক্ত নয় দীর্ঘকাল? ফলে বৃক্ষ নিষ্পত্র। কালান্তক ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুরা। কেশব, আপনি কি জানেন পুরুষেরা অধিকাংশ নিবীর্য? আপনার সখা পার্থ, সেও এই রোগের শিকার। রতিক্রিয়ায় পারঙ্গমা নারীরা উদ্দীপ্ত পুরুষের অপেক্ষা করতে করতে এখন উন্মাদিনী। দম্পতিদের রাত্রির শয্যা শান্ত। সঙ্গমে অশক্ত পুরুষ কেবলমাত্র ভর্ৎসনা করে নারীকে। সন্দেহ আর ভর্ৎসনা থেকেও এক ধরনের সুখ জন্মায়। গৃহে গৃহে এখন। সেই করুণাহীন সুখ।

কৃষ্ণ বললেন, ‘আমি জাগ্রত করতে পারি ভূমিকে। আমিই পরমব্রহ্ম । সৃষ্টির পালককর্তাও আমি।’

–সেই ধ্যান, প্রজ্ঞা আপনার আর নেই, প্রভু। প্রেমহীন জ্ঞান নিরর্থক।

–স্তব্ধ হও, বাঁচাল! আমি পারি। লৌকিক থেকেই অলৌকিকে আমার যাত্রা। এখন তুমি বলো আমাকে কি পথ দেখাতে পারবে?

–কোন পথ?

–তুমি উত্তমরূপেই জান আমি কোন পথের কথা বলছি। রাধার সন্নিকটে যাওয়ার পথ।

–আমার জানা নেই।

–আমি তোমায় মৃত্যুদণ্ড দেব।

–আপনি স্বয়ং মৃত্যুর উপান্তে চলে এসেছেন। কাল তার প্রদক্ষিণ আপনার ক্ষেত্রে সমাপ্ত করতে চলেছে। যাদবকুল অচিরেই ধ্বংস হবে। মৃত্যু ব্যতীত জীবনের, প্রাণের সন্নিকটে আপনিও কখনো কি আর আসতে পারবেন?

এই সময় রৌদ্রদগ্ধ রাজপথে অশ্বখুরধ্বনি শোনা গেল। কারাগারের প্রাচীর ছাপিয়ে সেই শব্দ কৃষ্ণের কর্ণে প্রবেশ করল। তিনি একটু উন্মুখ।

–হ্যাঁ, কৃষ্ণ, বাইরের ওই একমাত্র অশ্বারোহী আপনাকে রাধার পথের সন্ধান দিতে পারে।

–কীভাবে?

–একমাত্র ওদের গৃহেই সঙ্গম হয়। নারী অপেক্ষা করে পুরুষের। রাত্রির মিলন হয় দীর্ঘ। তবে যুদ্ধের কারণে যুবকও প্রবাসী ছিল দীর্ঘদিন। এখন প্রত্যাগমন করছে।

–তুমি বলছ এখনই নয়?

–হ্যাঁ। |||||||||| –আমি আবার আসব।

–আপনাকে যে আসতেই হবে, কৃষ্ণ।

কূট হাসি ছড়িয়ে গেল বৃদ্ধ বন্দির মুখে।

মুক্তি হল না বৃদ্ধ বন্দির। তবে কৃষ্ণ কারাধ্যক্ষকে বলে গেলেন কোনোরকম শারীরিক পীড়ন যেন এই বন্দির উপর না হয়। নজরদারি আরও যেন তীব্র করা হয়। অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে এর ব্যাপক প্রভেদের বার্তাটা কৃষ্ণ রেখে গেলেন।

বেলা দ্বিপ্রহর। অনাবৃষ্টিতে রোদ আরও তীব্র হয়েছে। সুদক্ষ সারথি কৃষ্ণেরও অশ্বারোহণে বেশ ক্লেশ হচ্ছে। সেই যুবককে দেখার অপার কৌতূহল হচ্ছে। তবে কোথাও তার সামনের পথরেখা খুঁজে পেলেন না। কৃষ্ণ। এক ধরনের সংকোচও হচ্ছে। অগণিত নর-নারী তাঁর অনুগামী। এখনও বৃন্দাবনের কত গোপিনী তাঁর সঙ্গলিপ্সায় উন্মুখ। তাঁর কি সত্যিই নারীর অভাব? প্রেমের অভাব? সৃষ্টির রহস্য তার করায়ত্ত। সপ্তর্ষি, অরুন্ধতী, বশিষ্ঠ, বিশাখার মতো নক্ষত্ররাজির সঙ্গে প্রতি রাতে একান্তে কথা হয় তার। নিষাদের বাণে যেদিন তার মৃত্যু হবে সেও তো এই বিস্ময়ের জীবনের পরিসমাপ্তি নয়। অনাদিকাল থেকে প্রকৃতির পক্ষে বিপক্ষে তার জন্মের প্রবাহ চলছেই। স্মৃতিবাহী চেতনায় তিনি যেকোনো কালে অনুগমন করতে পারেন। কল্প অতিক্রম করে কল্পান্তর আসবে। প্রসারণের পর সংকোচন শুরু হবে। যুধিষ্ঠির তার পঞ্চভ্রাতা ও দ্রৌপদী সহ যখনই স্বর্গের উদ্দেশে যাত্রা করবে, সেই মহাক্ষণ থেকে পৃথিবীর সংকোচন শুরু হবে। কোটি কোটি বৎসর ব্যাপী চলবে সেই সংকোচন। নদী, সমুদ্র ভূমির অভ্যন্তরে, বায়ুতে, রৌদ্রের দীপ্তিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষিত হবে। মৃত্যু হবে সবুজ উদ্ভিদের। সভ্যতা বিনাশের দিকেই ধাবমান হবে। প্রতিদিনই চূর্ণ হবে মানুষ। এটুকু তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। মৌষলপর্বে পৌঁছে যাদবকুল ধ্বংস হবে। যুধিষ্ঠিরের স্বর্গর্যাত্রা সে তো আর কিছুই নয়, তার মায়ার প্রকাশমাত্র। রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির নিজেকে পরমধার্মিক মনে করেন। তিনি কেশবের একান্ত অনুগামী। তার হৃদয় অস্থির। এই রাজ্য যা কিনা স্বজনহীন– তিনি মেনে নিতে পারছেন না। অস্থির মনের ঔষধ ভ্রমণ। তাই পঞ্চভ্রাতা, দ্রৌপদী-সহ যুধিষ্ঠির দীর্ঘ ভ্রমণেই যাবেন। সেই পথে অলকানন্দা রয়েছে। পুণ্যতোয়া এই নদী যুধিষ্ঠিরকে সঙ্গ দেবে। যুধিষ্ঠির তার মনের নির্যাসে অন্যান্য ভ্রাতা ও দ্রৌপদীর চেয়ে আরও বহু ক্রোশ অতিক্রমণ করবেন। সেই প্রদেশে তিনি বৃষ্টির দেখা পাবেন, রৌদ্রের পরিবর্তে বায়ুর শীতলতা উপভোগ করবেন। যে-সুখ তিনি প্রজাদের জন্য অন্বেষণ করেছেন সেই সুখের সাক্ষাৎ সেখানেই ঘটবে। আকাশের সাতটি তারার খুব নিকটবর্তী হবেন যুধিষ্ঠির। ব্রহ্মাণ্ডের সংকোচনের কারণে সেই অজানা বৃষ্টিভূমিই তিনি স্বর্গ হিসেবে ভ্রম করবেন। তাঁর অন্যান্য ভ্রাতাদের এবং দ্রৌপদীর যথাক্রমে অনিদ্রা ক্ষুধায় মৃত্যু ঘটবে। ন্যূতক্রীড়ায় অংশ নিয়ে যে-অন্যায় তিনি করেছিলেন তারই পরিসমাপ্তি ঘটবে মৃত্যুতে। যুধিষ্ঠিরের এই ভ্রমাত্মক পরিকল্পনা কৃষ্ণেরই রচনা। ব্যাসদেবও অনুসরণ করছেন কৃষ্ণকেই। যাবতীয় কাহিনি উপকাহিনির জন্মদাতা তিনি, কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি কি সত্যিই প্রেমহীন! রুক্মিণী, সত্যভামাদের সঙ্গে মিলনে সুখ নেই। অভ্যাসবশত সঙ্গম। সত্যিই প্রেমহীন তিনি। উদ্দীপ্ত হন না আর।

.

৭. মৌষল পর্ব

দ্বারকা নগরীতে রাজা উগ্রসেন ঘোষণা করলেন, কেউ যেন গৃহে মদিরা তৈরি না করে। এই নগরে সেবনের মাত্রা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এ ছাড়াও শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্ব মহর্ষি নারদের অভিশাপে এক ভয়ংকর মুষল প্রসব করেছেন। কোনো একসময়ের কথা। মহর্ষি বিশ্বামিত্র, কম্ব, নারদ প্রভৃতি ঋষিগণ দ্বারকায় এসেছিলেন। কৃষ্ণ স্বয়ং ঋষিদের অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু ঋষিদের আগমনেও নাগরিকদের প্রাত্যহিক চটুলতা কমল। কৃষ্ণও যেন উদাসীন ছিলেন পরিবর্তিত এই সময়ের প্রবহমাণতায়। বিশেষ করে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পাচ্ছিল কৃষ্ণপুত্র শাম্বের মধ্যে। তিনি রূপবান। ছিলেন এবং দিবসের অধিকাংশ সময়ে নারীদের সঙ্গে বিবিধ আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত থাকতেন। মাতৃস্থানীয় কৃষ্ণের প্রিয় গোপিনীরাও তার বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতপূর্ণ সম্ভাষণ থেকে রক্ষা পেত না। মহর্ষি নারদের আগমনেও তাঁর এই হীন রুচির সাময়িক পরিবর্তন ঘটল না। বরং একদিন তার সাথিদের প্ররোচনায় নারীর বেশ ধারণ করে ঋষিদের সমীপে গিয়ে উপস্থিত হলেন। হতবুদ্ধি ঋষিদের পরিহাসমূলক প্রতারণা করার জন্য। তাকে দেখিয়ে জনৈক সতীর্থ দেবর্ষি নারদকে বললেন, ‘দেবর্ষি! এই প্রমীলা মহাতেজস্বী বর স্ত্রী। বজ্র পুত্র লাভার্থে লালায়িত। একে তাই। উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করে বলুন, এর গর্ভে কী জন্মগ্রহণ করবে?’ অচিরেই নারদ শাম্বকে চিনতে পারলেন। তিনি এবং অন্যান্য ঋষিগণ ক্রোধান্বিত হয়ে অভিশাপ দিলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণপুত্র শাম্ব বৃষি ও অন্ধক বংশ বিনাশ করার কারণে এক ভয়ংকর মুষল প্রসব করবে। এই অভিশাপ বর্ষণের পর ঋষিগণ এলেন কৃষ্ণের কাছে।

সবে অশ্বারোহণে দীর্ঘপথ পেরিয়ে কৃষ্ণ এসেছেন নগরে। মুনিদের আতিথ্যের কোনো ত্রুটি তিনি করে যাননি। অথচ নগরে প্রবেশের সঙ্গে। সঙ্গে তিনি শুনতে পেলেন গর্ভদের ভয়ংকর আর্তনাদ। রক্তবর্ণ পায়রার দল মণ্ডলাকারে তাঁর মস্তকের উপর উড়তে থাকল। তিনি এটাও প্রত্যক্ষ করলেন– বিভিন্ন পয়ঃপ্রণালীতেও মূষিকের দল সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে ইতস্তত ছুটে বেড়াচ্ছে। এ ধরনের দৃশ্যাবলি মন্বন্তরের ইঙ্গিত। রাজ্যে বারাঙ্গনাপল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে গৃহে যেমন সঙ্গমের আকর্ষণ নেই তেমনি বিপ্রতীপভাবেই রতিক্রিয়া পারঙ্গমাদের পণ্যগৃহে অপুষ্ট অসফল বীর্যপাতে প্রেমের বদলে শারীরিক ক্ষুধা নিবৃত্তির ব্যাপক আয়োজন বৃদ্ধি পেয়েছে। যুবকদের মধ্যে শ্রদ্ধার বর্ষণ নেই। এ যেন বৃঞি, অন্ধক ও ভোজবংশীয়দের সমূহ সংহারকাল উপস্থিত। তিনি শুধুমাত্র দর্শক।

পুত্র শাম্বের প্রাথমিক অভিশাপ কাহিনি শুনলেন। শাম্বের লোলুপ দৃষ্টি থেকে মাতৃস্থানীয়রাও অব্যাহতি পায় না। এই কথা তিনি বহুদিন ধরে শুনে আসছেন। এবার তিনি–কৃষ্ণ স্বয়ং সেই অভিশাপ সম্পূর্ণ করলেন। কালব্যাধি কুষ্ঠ গ্রাস করল শাম্বকে। পুত্রের যৌবন সংহার করলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। বৃদ্ধ বন্দির কথাগুলি মনে পড়ল, ‘তাঁর জ্ঞান এখন অথর্ব ক্রিয়াশূন্য, কারণ সেই প্রজ্ঞায় প্রেম নেই। কৃতাঞ্জলিপুটে অবনতমস্তকে পুত্র শাম্ব কৃষ্ণের কাছে এসেছেন। অমন রূপবান যুবক আর চেনা যায় না। চর্মে কুঞ্চন, স্মার্ত লাল গড়িয়ে পড়ছে। বীভৎস কদাকার মুখ নিয়ে সে পিতার কাছে বিদায় চাইছে। শাম্বের অপরূপা স্ত্রী ধৈর্য হারিয়ে কৃষ্ণকে অভিশাপ দিচ্ছেন। সত্যভামাও ক্রন্দনরতা। আর কৃষ্ণ যেন পুত্রের কদাকার চেহারার প্রতিবিম্বে নিজেরই প্রেমহীন অজ্ঞানতা প্রত্যক্ষ করছেন। শুধু সংশয় আর অবিশ্বাস তাঁকে এই অভিশাপ বর্ষণে প্রলুব্ধ করল। শাম্বের রমণীমোহন রূপ তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল। তিনি অন্তর থেকে চাইছিলেন শাম্বের প্রস্থান এই রাজ্য থেকে, নগর থেকে।

রাত্রিকালে বহুকাল পর সত্যভামা নগ্ন করলেন নিজেকে। ওঁর পৃষ্ঠপ্রদেশে কৃষ্ণ যখন আদরপূর্বক জিহ্বা লেহন করছেন, কামতাপিত সত্যভামা হঠাৎ উন্মত্তা ব্যাঘ্রীর মতোই কৃষ্ণকে আক্রমণ করলেন বাক্যবাণে।

–কী হয়েছে তোমার, স্বামী? নিজের পুত্রকেও ভয় পেলে?

–শাম্ব সীমা অতিক্রম করেছিল।

-কীসের সীমা?

–শালীনতার।

–গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করে তুমি একদা এর চেয়েও গুরুতর অশ্লীলতায় অভিযুক্ত ছিলে।

–গোপিনীরা সকলেই আমার ভক্ত। তারা ত্রিসন্ধ্যা আমার নাম জপ করতেন।

–তাই তুমি ওদের বিবস্ত্র করেছিলে, এ কি কোনো ঈশ্বরের কর্ম?

–আমারই প্রেমলীলার রূপ।

–আর রাধা? চমকে উঠলেন কৃষ্ণ। আবার প্রশ্ন করলেন সত্যভামা, তোমার অমর প্রেমকাহিনির সঙ্গিনী?

–তার সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই।

–আমি রুক্মিণী দুজনেই এ সম্পর্কে জ্ঞাত আছি। তাই তুমি অন্যমন। সামান্য কারণে শাম্ব অভিশাপগ্রস্ত, যাদবকুল ধ্বংসের মুখে। মন্বন্তরের করালগ্রাসে রাজ্য আক্রান্ত।

–রাজ্য এবং প্রজাদের জন্য রাজা উগ্রসেন রয়েছেন।

–উগ্রসেন তো তোমার আজ্ঞাবহ মাত্র। সমগ্র আর্যাবর্তের নিয়তির নির্ধারক তুমি। কুরুক্ষেত্রে তোমার স্বজনবর্গ অন্যায়পক্ষ নিয়েছিল। কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় সব কিছুর নির্ধারক তুমি! আর কেউ নয়! কেশব, তোমার কি কোনো পাপ হয় না? তুমিই কি একমাত্র শুদ্ধপুরুষ?

–নিশ্চয় নয়। সত্যভামা, আমার আয়ুও ফুরিয়ে আসছে। জরা নামে এক ব্যাধের হাতেই আমার মৃত্যু। হয়তো পুত্র শাম্বের সঙ্গে আমার। আর সাক্ষাৎ হবে না। আসলে আমার অভিশাপ থেকে শাম্বের কোনো রোগলক্ষণ ফুটে ওঠেনি। বাতাসে বইছে সেই বিষরোগের জীবাণু। মুষল

প্রসবও সেই কারণে। নারীরাও নিশ্চল পাথরের মতো রতিক্রিয়াকালে। পুরুষ তো নির্বীর্য বটেই। মহাকাল গৃহে গৃহে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোনো ধনুর্ধরের সাধ্য নেই ওকে রোধ করার।

সত্যভামা বললেন, ‘আমার পরিণতি কী, প্রভু?’

–সর্বজ্ঞ আমিও নই, সত্যভামা। তবে এই দেশের স্ত্রীরা বহুবল্লভা হবে। আর্যাবর্তে বিদেশিদের আগমন ঘটবে।

–তুমি কি আমাকেও দ্বিচারিণী হওয়ার শাপ দিচ্ছ?

–এই গহন অন্ধকারে তোমায় বলি, সত্যভামা, আমার জ্ঞান এখন প্রেমশূন্য; তার প্রয়োগ আর হবে না। আমাকে অযথা ভয় পেয়ো না।

সত্যভামা তবুও যেন কৃষ্ণের বাহুবন্ধনে আবিষ্ট হলেন না। তিনিও আচরণ করলেন নিষ্ফল পাথরের মতোই। রাত্রি মধ্যমে কৃষ্ণ অট্টালিকার আচ্ছাদন কক্ষে উঠে এলেন। এই কক্ষে দুটি বাতায়ন। একটি দিয়ে দ্বারকার নগরজীবন লক্ষ করা যায়। আর দক্ষিণমুখী বাতায়নটি দিয়ে। অদূরের একটি কদম্ব গাছ দেখা যায় এটি অনেকটা ছায়াতরুর মতো। সেই ছায়াতরুর ফাঁক দিয়ে কৃষ্ণ দেখলেন সাদা মেঘের মতো দূরের নক্ষত্রপুঞ্জ। তাঁর চেনা ছায়াপথ। বাতিল, বর্জ্য আসবাবের মধ্যে চাপা পড়ে ছিল তার বাঁশরি। তিনি সংগোপনে বের করে আনলেন। নগর বিশ্রান্ত। আকাশের গায়ে ঘন লাল রং লেগে রয়েছে। তার মানে বৃষ্টিশূন্য আকাশ। ব্যাসদেব অশ্বত্থামাকে বলেছিলেন, ব্ৰহ্মাস্ত্র প্রয়োগের ফলে দ্বাদশ বর্ষ বৃষ্টিপাত হবে না। ফলে এই খরা কৃষ্ণের আয়ুষ্কাল জুড়েই থাকবে। তবুও তিনি রাত্রির স্পন্দন স্নায়ুর কম্পনাঙ্কে তুলে নিলেন আর অনেক দিন পর বাঁশরিতে ধুন আনলেন ছায়ানটের। সেই সুর দ্বারকা নগরী ছাড়িয়ে ব্রহ্মলোকেও যেন পৌঁছে গেল। ছায়াতরু কদম্ব বৃক্ষের তলদেশে এক অশরীরী নারীর ছায়ামূর্তি তিনি যেন অবলোকন করলেন। সেই নারী, যিনি কিনা তাঁর শাশ্বত প্রেমিকা। অচিরেই পৃথিবী চন্দ্রালোকে ভরে গেল। বায়ু অস্থির হয়ে উঠল। বাতাসে বৃষ্টির শুভ্র কুঁচি ছড়িয়ে গেল। কিন্তু এই সামান্য বৃষ্টিতে দাবদাহের আগুনের চুল্লির নির্বাপণ ঘটল না। অলৌকিক বৃষ্টিপাত হল না। সেই অশরীরী নারীরও প্রকাশ ঘটল না। ছায়ানটের সমাপ্তিতে কৃষ্ণ অবসাদ নিয়ে কয়েক পল বসে রইলেন। আর পিছু ফেরার নেই। তিনিও পারেন না অনেক কিছুই। কাল তাঁকেও গ্রাস করেছে।

শাম্বের মাতা জাম্ববতীর মুখোমুখি এখনও হননি কৃষ্ণ। শাম্বের স্ত্রী লক্ষ্মণাও নিশ্চয় তাঁকেই শাপশাপান্ত করছে। অভিশাপ অমোঘ। প্রেমের মতো তার থেকেও মুক্তি নেই মানুষের। হায় পুত্র শাম্ব, কৃষ্ণের চিন্তা আবার ধাবিত হল সেই দিকে। জাম্ববতী, সত্যভামা ও রুক্মিণী ব্যতিরেকে তার অগণিত রক্ষিতারাও সেইদিন ভৎসিত হয়েছিল। রমণীদের তিনি জলক্রীড়ায় আমোদিত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সহবাসের ক্ষমতা তো তিনি প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। শাম্বের অনিন্দ্যসুন্দর রূপ তাদের অনেকের মধ্যেই গোপন অভিসার আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছিল। অতি প্রেমোচ্ছ্বাস প্রকাশের কারণে ওদেরও শাস্তি দিয়েছেন তিনি। ষোলো সহস্র রমণীকে উপভোগ করার অপারগতা তাঁকে অভ্যন্তরে যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট করে তুলেছে।

ছায়ানটের বিস্তারে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সুরও বিদায় নিয়েছে তাঁর জীবন থেকে। পল্লবিত সবুজ তৃণে ভোরের রোদের আলো পড়তেই কৃষ্ণ সংবিত ফিরে পেলেন। প্রাসাদে প্রত্যাগমন তাঁর এখন জরুরি। অচিরেই দ্বারকার নগরজীবন জেগে উঠবে। পাখিরা নানা স্বরে রব শুরু করে দিয়েছে। নিজের জীবনেরও এক বেদনার্ত পরিণতি তিনি অনুভব করছেন। তার মৃত্যুর পর রক্ষিতারা বাজারের পণ্যাঙ্গনাদের মতোই ধর্ষিতা হবে তস্করের দ্বারা। এটা কোনো অভিশাপ নয়, কৃষ্ণের দূরদর্শিতা। তিনি জানেন প্রদ্যুম্ন, শাম্ব প্রভৃতি বীরেরা দ্বারকা নগরীকে বার বার রক্ষা করেছে। রাষ্ট্র, সমাজ, সুনীতিজ্ঞানের যে-শিক্ষা তিনি পুত্রদের দিয়েছিলেন তার ব্যতিক্রম বারংবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেই ঘটেছে। উত্তরাধিকারীরা তাঁর অবর্তমানে আবার দ্বারকা নগরী দখল করবে। ভয়াবহ সেই ভবিষ্যৎ। তবে আপাতত তিনি রাষ্ট্রচিন্তা, রাজনীতিকে দূরে সংস্থাপন করে অন্বেষণ করতে চান সেই অশ্বারোহীকে– যার গৃহে পুষ্ট ও সার্থক সঙ্গম হয় প্রতি রাতে।

.

৮. সৌপ্তিক ২

যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বলেছিলেন, পিতামহ, আপনার বক্তব্যের মধ্যে স্ববিরোধিতা দেখতে পাচ্ছি, কারণ আপনি আদর্শরূপে বলছেন অহিংসা পরমধর্ম। আবার পশুহত্যা না করে কী প্রকারে মাংস যজ্ঞে নিবেদন করা যায়?

ভীষ্ম বললেন, ‘যুধিষ্ঠির, যিনি সংযত হয়ে প্রতি মাসে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন, তিনি মদ ও মাংস পরিত্যাগ করবেন। জ্ঞানী সপ্তর্ষিগণ, বালখিল্য মুনিগণ ও মরিচপায়ী ঋষিগণ মাংস ভক্ষণ না করার পক্ষে। আবার স্বয়ম্ভব। মনু বলেছেন, যিনি মাংস ভক্ষণ ও পশুহত্যা করেন না কিংবা করান না, তিনি সমস্ত প্রাণীরই মিত্র।‘

সৌপ্তিকপর্বে ব্যাসদেব বলেছিলেন অশ্বত্থামাকে, ‘প্রজাহিতার্থে অর্জুন। তোমার ব্রহ্মাস্ত্র নষ্ট করেনি। তাই তুমি দিব্যাস্ত্র ফিরিয়ে নাও।‘

অশ্বত্থামা কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘আমি যদি দিব্যাস্ত্র ফিরিয়েও নিই, অনাবৃষ্টির প্রকোপেই পড়বে সমগ্র আর্যাবর্ত। এর উত্তরদায়ী বাসুদেব আমাকেই করবেন, সখা অর্জুনের জয়গান স্বয়ং ব্যাসদেব তো লিপিবদ্ধ করছেন। কৃষ্ণ বললেন, তোমার তবে অভিপ্রায় কী?’

–আমার এই নিক্ষিপ্ত দিব্যাস্ত্র ব্যর্থ হতে পারে না। তা ছাড়া একে প্রয়োগ করে ফেরানোর সামর্থ্যও আমার নেই।

ব্যাসদেব তখন স্মরণ করলেন সেই আপ্তবাক্য, অহিংসা পরমধর্ম। অশ্বত্থামা, পাণ্ডবদের প্রতি তোমার ক্রোধ সংবরণ করো।

–মহাঋষি ব্যাস, আমি কখনো আপনার কোনো আদেশ লঙ্ঘন করি না। কিন্তু কী করব, এটি আমার হাতে নেই। লক্ষ্যের অভিমুখ পরিবর্তন সম্ভব কিন্তু দিব্যাস্ত্র ফেরানোর কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই।

–অভিমুখ পরিবর্তন করার উদ্দেশ্য অস্পষ্ট কিছু নয়।

–হ্যাঁ, উত্তরার গর্ভ।

–এর পূর্বে তুমি দ্রৌপদী এবং পাণ্ডবদের পাঁচ মহাবলী পুত্রকে হত্যা করেছ। অস্ত্রবিশারদ ধ্রুপদপুত্রকেও হত্যা করেছ বিনা প্ররোচনায়।

–যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছিল বিনা প্ররোচনায়। অন্তত কৌরবপক্ষে। তেমন কোনো প্ররোচনা ছিল না। এই যুদ্ধের এবং এই মহাক্ষয়ের। পশ্চাতে মাত্র একজন নারী। তিনি দ্রৌপদী। পাণ্ডবরাও তাদের সাময়িক অপমান বিস্মৃত হয়ে সন্ধি চেয়েছিলেন। তখন এই পাঞ্চালীই কৃষ্ণকে বলেছিলেন, তার পিতা নেই, পুত্র নেই, ভ্রাতা নেই, এমনকী সখাও নেই। তাই কৃষ্ণের সন্ধির প্রস্তাবে কোনো আন্তরিকতা ছিল না। আজ রাজা দুর্যোধন অন্যায়যুদ্ধে নিহত। মৃতপ্রায় দুঃশাসনের রক্তপান করতে বৃকোদরের কোনোরকম কুণ্ঠা হয়নি, কারণ দ্রৌপদী। আমারও একই কারণে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে নিহত করতে কুণ্ঠা হয়নি।

ব্যাসদেব তখন বললেন, ‘কিন্তু উত্তরার গর্ভ তোমার লক্ষ্য কেন?’

–কারণ এই দিব্যাস্ত্রের আঘাত অমোঘ।

কৃষ্ণ বললেন, ‘তুমি কি আমার কথা বিস্মৃত হলে? বিরাটকন্যা উত্তরা যখন উপপ্লব্য নগরীতে ছিলেন, এক তপস্বী ব্রাহ্মণ তাকে বলেছিলেন, গর্ভে এক পুত্র জন্মাবে। সেই পুত্র পরীক্ষিৎই পাণ্ডবদের বংশধারক হবে।‘

অশ্বত্থামা তখন চিৎকার করে বললেন, ‘কেশব, তুমি নীচ, ও কাপুরুষ।‘

–অশ্বত্থামা তুমি উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানকে হত্যা করলে আমি তাঁকে জীবন দেব। রাজা পরীক্ষিৎ দীর্ঘায়ু লাভ করবেন। আচার্য কৃপ থেকে সর্বপ্রকার অস্ত্রজ্ঞান প্রাপ্ত হবেন। দীর্ঘায়ু লাভ করে তিনি দেবব্রতও ধারণ করবেন।

অপার ক্ষমতাশালী কৃষ্ণের সমীপে কৃতাঞ্জলিপুটে ক্ষমাভিক্ষা করলেন অশ্বত্থামা।

পূতিগন্ধময় শরীর থেকে রস নিঃসৃত হচ্ছিল।

তবে অশ্বত্থামাকে ক্ষমা করেননি কৃষ্ণ। আসলে অশ্বত্থামার দিব্যাস্ত্রের প্রভাবে আর্যাবর্তের অসংখ্য নারী মৃত পুত্র প্রসব করে। কৃষ্ণ একমাত্র রক্ষা করেছিলেন পরীক্ষিৎকে।

.

৯. প্রোষিতভর্তৃকা

প্রোষিতভর্তৃকা অপালা সারা দিনমান তাঁর অপেক্ষায় থাকত। সে-পথের শব্দ তিনি চিনতেন। তাই অপালা নূপুর পায়ে এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরে বেড়াত। তিনি তার গায়ের গন্ধ চেনেন। নিত্য চন্দনচর্চিত হয় ত্বকে। চন্দনের সুবাস থাকে হাওয়ায়। তিনি আশ্লেষ চুম্বন করতেন। প্রেমের কথা বলতে পারতেন। উদ্দীপনা দিতে পারতেন। জীবনটা যে কত মধুর ওর সঙ্গ ছাড়া বোঝা যায় না। বাইরে রোদের তেজ বাড়ছে। মেঘে ঢাকা সূর্য এখন প্রকাশিত হয়েছে। মেয়েমানুষ তো প্রকৃত পুরুষের বশ্য হয়ে থাকতে চায়। একসময় এই প্রদেশে গন্ধর্বপ্রতিম পুরুষেরা বাস করত আর নারীরা ছিল অপ্সরা। সেই দেশে এখন পুরুষেরা যৌবন হারিয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বিশাখজ্যোতি। আকাশের রামধনুর মতো তাঁর বুকের রং। প্রশস্ত প্রান্তর যেন তার বক্ষদেশ, অপালা সেখানে ক্ষুদ্র পাখির মতো আশ্রয় নিতে ভালোবাসে।

বীট নিয়ে এল একটি গৃহে। মাটির প্রদীপ জ্বলছে। এখানকার প্রতিটি গৃহই অপ্রশস্ত। অঞ্চলটিও জনপদ থেকে বহুদূরে। গৃহগুলিতে প্রদীপশিখার রং থাকে সামান্য লালাভ। নারীটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। স্বাস্থ্য মধ্যম। আলুলায়িত কেশ। অশ্বারোহী যুবা বীটকে কয়েকটি রৌপ্যমুদ্রা হাতে দিয়ে চলে যেতে বলল। বীট চলে গেলে গৃহের একমাত্র ক্ষুদ্র বাতায়নটি বন্ধ করা হল। ইতিমধ্যে নারীটি ফুলের গয়নায় সেজে এসেছে। অনাবৃত স্তন, উরু থেকে পুষ্পগন্ধ উঠে আসছে। সে কাছে এসে যুবাপুরুষটিকে কঠিন আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। অদ্ভুতভাবে গণিকাটির আঁখিতারায় নিমীলিতভাব এবং ওষ্ঠাধর রসসিক্ত হয়ে উঠল ও দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে স্তনদ্বয়ের পেষণে সে বেশ সুখানুভূতি প্রকাশ করল।

সচরাচর ক্রেতাদের রতিক্রিয়ার পর বেশ শীত করে। দীর্ঘকেশ রাখতে হয় যাতে খদ্দের আকর্ষণ করে সামান্য প্রহার করতে করতে শয্যায় নিয়ে ফেলে। এখানে শৃঙ্গার আসলে ধর্ষণেরই নামান্তর। কিন্তু আজ এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হল। যিনি এসেছিলেন তিনি যেন নিজে তৃপ্ত হতে আসেননি, সামান্য গণিকাকে তৃপ্ত করতেই আসা। রাজপুরুষ তো হবেনই যত ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকুন-না কেন। কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রাও রেখে গেছেন। একটি কথাও বলেননি। বৃন্দাবনের গোপিনীদের মতোই নিজেকে মনে হচ্ছে। যাবতীয় পাপের মুক্তি ঘটল যেন আজ।

এদিকে স্বামী-পুত্র ভরা সংসারে সত্যিই গর্ববোধ করে অপালা। সে সুন্দরী এবং গুণবতীও বটে। তাম্বুলরসে ঠোঁট দুটিকে রাঙা করেছে। দীর্ঘকেশ সুগন্ধি তেলে রসবতী করে মাথায় খোঁপা করেছে। খোঁপা আবৃত করেছে সুগন্ধি বেলিফুলের মালায়। সমস্ত ঘরগুলি পরিচারিকার পরিবর্তে নিজের হাতে ধৌত করেছে। রন্ধনেও অপালার ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। স্বামী বিশাখজ্যোতির বড়ো প্রিয় দুগ্ধজাত দ্রব্য। সেই কারণে অপালা মিষ্টান্ন তৈরি করে রেখেছে। বহুদিন পর কোমরে জড়িয়েছে। চন্দ্রহার। গলায় পরে রয়েছে বহুমূল্য পাথরখচিত কণ্ঠহার। এইসব মাগধী বণিকদের কাছ থেকে বিশাখজ্যোতিরই ক্রয় করা। প্রতিটি যুদ্ধে যাওয়ার প্রাকমুহূর্তে তিনি অপালাকে এইসব বহুমূল্য উপহার দিয়ে যান। অবশ্য তিনি প্রবাসে থাকলে অপালা আভরণহীন থাকে। ত্বক বা কেশের ন্যূনতম মার্জনার ইচ্ছেও তখন থাকে না। বহু দিবস পর তিনি প্রত্যাগমন করছেন। সেনাধ্যক্ষ তিনি। নগরে প্রবেশ করতেই নাগরিকেরাও অধীর হয়ে উঠবে তাকে সম্ভাষণ করার কারণে। অপালা অট্টালিকার ছাদে দণ্ডায়মান থেকে তাঁর আগমন প্রত্যক্ষ করবে। রতিক্রিয়ার কৌশল নিয়ে রাত্রিকালে তার অলক্তকরঞ্জিত পদযুগল বুকে তুলে নেবেন বিশাখজ্যোতি।