১ সেপ্টেম্বর, বুধবার ১৯৭১
বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার এক অবিশ্বাস্য, অমানবিক কাহিনী গতকাল শুনলাম শরীফ, জামী ও মাসুমের মুখ থেকে। শরীফ বরাবরই কম কথা বলে, সে তাদের দুদিন-দুরাত বন্দিদশার একটা সংক্ষিপ্তসার দিল নিজের মত করে। খুঁটিয়ে সমস্ত বিবরণ শুনলাম জামী আর মাসুমের মুখ থেকে।
সেদিন রাতে বাড়ির গেট থেকে রুমী-জামীদের হটিয়ে নিয়ে খানসেনারা মেইন রোডে গিয়ে দাঁড়ায়। শরীফরা দেখে রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটা জীপ আর লরিদাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি ঘেরাও করে যেসব মিলিটারি পুলিশ ছড়িয়ে ছিল, তারা আমাদের গলি আর কাসেম সাহেবদের গলি থেকে বেরিয়ে মেইন রোডে এসে জমা হয়। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম শরীফদের পাচজনকে রাস্তার পাশে লাইন ধরে দাঁড় করায়। তারপর উল্টোদিকের কােলা হোটেল বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে একটা জীপ এগিয়ে এসে ওদের সামনে থেমে হেডলাইট জ্বালে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম জীপের কাছে গিয়ে জীপে বসা কারো সঙ্গে মৃদুস্বরে কি যেন কথা বলে। তারপর শরীকদের সামনে এসে রুমীর বাহু চেপে ধরে বলে, তুমি আমার সঙ্গে এসো। রুমীকে নিয়ে ওই জীপটাতে তোলে। জামী, মাসুম ও হাফিজকে শরীফের গাড়িতে উঠতে বলে তাদের জীপটাকে ফলো করতে বলে। কয়েকজন মিলিটারিও শরীফদের গাড়িতে গাদাগাদি করে ওঠে। রুমী ও ক্যাপ্টেন কাইয়ুমসহ জীপটা প্রথমে, তারপর শরীফদের গাড়ি, তার পেছনে পেছনে বাকি সব জীপ ও লরি। ক্রমে ওরা গিয়ে থামে এম.পি.এ, হোস্টেলের সামনে। ওখানে যাওয়ার পর রুমীদের পাঁচজনকে নামিয়ে আবার লাইন বেধে দাঁড় করানো হয়, আবার তাদের মুখে গাড়ির হেডলাইট ফেলা হয়। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় এক আর্মি অফিসার, বলে ওঠে হু ইজ রুমী? রুমীকে সনাক্ত করার পর সবাইকে বারান্দায় উঠিয়ে দাঁড় করায় এক পাশে। মাত্র কয়েক মিনিট ঐ একসঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানোর সময় রুমী ফিসফিস করে বলে, তোমরা কেউ কিছু স্বীকার করবে না। তোমরা কেউ কিছু জান না। আমি তোমাদের কিছু বলি নি।
একটু পরেই কয়েকজন সেপাই এসে রুমীকে আলাদা করে ভেতরে নিয়ে যায়। তারপর আরো কয়েকজন সেপাই এসে শরীফদেরকে একটা মাঝারি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে সোফাসেট ছিল, তবু ওদেরকে মেঝেয় বসতে বলা হয়।
তারপরই শুরু হয়ে যায় নারকীয় কাণ্ডকারখানা। খানিক পরপর কয়েকজন করে খানসেনা আসে, শরীফ, জামী, মাসুম, হাফিজকে প্রশ্ন করে অস্ত্র কোথায় রেখেছ, কোথায় ট্রেনিং নিয়েছ? কয়টা আর্মি মেরেছ?–এই উত্তরগুলো স্বভাবতই না-সূচক হয় আর অমনি শুরু হয় ওদের মার। সে কি মার! বুকে ঘুষি, পেটে লাথি, হঠাৎ করে আচমকা পেছন থেকে ঘাড়ে রদ্দা–সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে গেল, রাইফেলের বাট দিয়ে বুকে-পিঠে গুঁতো, বেত, লাঠি, বেল্ট দিয়ে মুখে, মাথায়, পিঠে, শরীরের সবখানে মার, উপুড় করে শুইয়ে বুটসুদ্ধ পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাড়ানো, বিশেষ করে কনুই, কবজি, হাঁটুর গিটগুলো থেঁতলানো। আশপাশের ঘরগুলোতেও একই ব্যাপার চলছে, বন্দী বাঙালিদের চিৎকার, গোঙানি, খানসেনাদের উল্লাস, ব্যঙ্গ বিদ্রপ কানে আসছে। বন্দীরা যেন ওদের খেলার সামগ্রী, এতগুলো খেলার জিনিস। পেয়ে ওদের মধ্যে মহোৎসব পড়ে গেছে। একদল আসছে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, মারধর করে চলে যাচ্ছে। কয়েক মিনিটের বিরতি। এর মধ্যে কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে তার গায়ে। পানি ছিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আরেক দল এসে আবার সেই সর্বনেশে খেলা শুরু করছে।
একটা ব্যাপারে খানসেনারা বেশ হুঁশিয়ার। ওরা কেউ এমনভাবে মারে না যাতে বন্দী হঠাৎ মরে যায়। এমনভাবে মারে যাতে বন্দী অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে। নাকমুখ। দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোয়, হাত-পা, আঙুলের হাড় ভাঙে অথচ মরে না। অজ্ঞান হলে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে, একটু বিশ্রাম করতে দেয় যাতে খানিক পরে আবার নতুন করে মার সহ্য করার মতো চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
এরি মাঝে একজন করে ডেকে নিয়ে যায় অন্য একটা ঘরে–সেখানে এক কর্নেল বসে আছে–কর্নেল হেজাজী। সে এদেরকে এক এক করে নানা কথা জিগ্যেস করে। শরীফকে নিয়ে যাবার পর প্রথমে তাকে চেয়ারে বসতে বলে, জিগ্যেস করে শরীফ কি করে, কয়টা ছেলেমেয়ে, বাড়িতে কে কে আছে, রুমীর বয়স কত, কি পড়ে–এসব। শরীফ সব কথার উত্তর দেয়, হাফিজ সম্বন্ধে বলে, সে আজকেই মাত্র চাটগাঁ থেকে ঢাকা এসেছে, সে বেচারী ঢাকার কোনো হালহকিকতই জানে না। তাছাড়া ওর চাচা ঢাকার ডি.সি.।
তারপর কর্নেল হেজাজী জিগ্যেস করে রুমী কবে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, কোথায় ট্রেনিং নিয়েছে। শরীফ বলে সে এ সম্বন্ধে কিছু জানে না। এতক্ষণ বেশ দ্রভাবেই কথাবার্তা চলছিল, এবার হেজাজী একটু গরম হয়ে বলে, তুমি জান না তোমার ছেলে কি ধরনের বাজে ছেলেদের সঙ্গে মেশে, বাজে কাজ করে? শরীফ বলে আমার ছেলে বড় হয়েছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, সে কাদের সঙ্গে মেশে, কি করে–তার খবর রাখা আমার পক্ষে কি সম্ভব? হেজাজী বিদ্রুপ করে বলে, তাহলে তো দেখছি তুমি একজন আনফিট ফাদার। ছেলেকে সৎ পথে গাইড করার কর্তব্য করতে পার নি। শরীফ রেগে গিয়ে বলে, তুমিই কি ঠিক করে বলতে পার তোমার ছেলে কাদের সঙ্গে মেশে, কোথায়। কোথায় ঘোরে?
শরীফকে ফেরত আনার পর হাফিজকে নিয়ে যায়। অফিজের পাঞ্জাবির পকেটে ওর চাটগাঁ থেকে ঢাকা আসার প্লেন-টিকিটের মুড়িটা রয়ে গেছিল; ও সেইটা দেখিয়ে প্রমাণ করতে পারে যে সে সত্যিই ঐ দিনই ঢাকা এসেছে। তারপর একে একে জামী, মাসুম। এরা একেকজন করে যাচ্ছে। বাকিরা মার খাচ্ছে। যারা যাচ্ছে, তারা ফিরে এসে আবার মার খাচ্ছে। এমনি করে করে ভোর হল।
এরপর কয়েকজন সেপাই শরীফদেরকে নিয়ে যায় আরেকটা ঘরে, সেখানে শরীফদের জন্য অপেক্ষা করছিল এক বিরাট চমক! ছোট্ট একটা ঘর, ছয় ফুট বাই আট ফুট হবে। ঢুকে দেখে চারপাশের দেয়াল ঘেষে, সারা মেঝে জুড়ে এক দঙ্গল লোক বসে আছে–তার মধ্যে বদি আর চুলুকে দেখে শরীফরা চমকে যায়। শরীফরা বাকিদের
চিনলেও খানিকক্ষণের মধ্যে সবার পরিচয় পেয়ে যায়। খানসেনারা একটু পরে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে শেকল তুলে দেয়। অমনি সবাই ফিসফিস করে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় বিনিময় করতে শুরু করে। আলতাফ মাহমুদ, তার চার শালা নুহেল, খনু, দীনু ও লীনু বিল্লাহ, আর্টিস্ট আলভী, শরীফের ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু মান্নানের দুই শালা রসুল ও নাসের, আজাদ, জুয়েল, ঢাকা টি.ভির মিউজিশিয়ান হাফিজ, মর্নিং নিউজের রিপোর্টার বাশার, নিয়ন সাইনের মালিক সামাদ এবং আরো অনেকে। আলতাফ মাহমুদের গেঞ্জি বুকের কাছে রক্তে ভেজা, তার নাকমুখে তখনো রক্ত লেগে রয়েছে, চোখ, ঠোট সব ফুলে গেছে, বাশারের বাঁ হাতের কবজি ও কনুইয়ের মাঝামাঝি দুটো হাড়ই ভেঙেছে। ভেঙে নড়বড় করছে, একটা রুমাল দিয়ে কোনমতে পেঁচিয়ে রেখেছে, সেই অবস্থাতে হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। হাফিজের নাকে মুখে রক্ত, মারের চোটে একটা চোখ গলে বেরিয়ে এসে গালের ওপর ঝুলছে। জুয়েলের এক মাস আগের জখম হওয়া আঙুল দুটো মিলিটারিরা ধরে পাটকাঠির মত মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে।
একটু পরেই দরজা খোলার শব্দ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে সবাই চুপ করে যায় কারণ কথা বলা নিষেধ। কথা বলতে শুনলেই খানসেনারা মারবে। দরজা খুলে খানসেনারা রুমী এবং আরো কয়েকটা ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। একজন কেউ বলে। সেপাইজী, বহোত পিয়াস লাগা। যারা পানি পিলাইয়ে। সেপাইরা জবাবে হাতের বেল্ট ও তারের পাকানো দড়ি দিয়ে খানিক এলোপাতাড়ি মেরে আবার বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। একজন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, জল্লাদ। জল্লাদ। পানি পর্যন্ত দেবে না? পানি চাইলে আরো মার?
খানিক পরে দেয়াল ঘেঁষে বসা একজন নড়েচড়ে বসতেই সামনে থেকে আরেকজন বলে ওঠে, আরে! ওই তো একটা পানির কলা দেখা যাচ্ছে। সবাই চমকে দেখে দেয়ালের গায়ে একটা পানির ট্যাপ। এত লোক ঘেঁষাঘেঁষি গাদাগাদি করে বসার দরুন ট্যাপটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তখন সবাই ট্যাপের কাছে গিয়ে হাত পেতে পানি খায়। বাশারকে অন্য একটি ছেলে হাতের তালুতে পানি নিয়ে খাওয়ায়।
আবার ফিসফিস্ করে কথাবার্তা শুরু হয়। জানা যায় কারা কখন কিভাবে ধরা পড়েছে। বদি ধরা পড়ে ২৯ আগস্ট দুপুর বারোটার সময়। ঐদিন সকালে সে রুমীদের সঙ্গে ২৮ নম্বর রোডের বাড়িতে মিটিং করে। তারপর রুমী যায় চুলুর বাসায় গান শুনতে। বদি যায় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফরিদের বাসায় গল্প করতে। সেই বাসা থেকে মিলিটারি তাকে ধরে। সামাদকে ধরে বিকেল চারটেয়। আজাদের বাসায় মিলিটারি যায় রাত বারোটায়। ও বাসায় সেদিন ছিল জুয়েল, কাজী, বাশার, আজাদের খালাতো ভাই, দুলাভাই, আরো কয়েকজন। জুয়েল, বাশার, আজাদসহ খালাতো বোনের স্বামী এবং অন্য দুজন অতিথিকেও মিলিটারিরা ধরে এনেছে, কেবল কাজী হঠাৎ আচমকা ক্যাপ্টেনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাতের স্টেন ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে। ব্যাপারটা এতই আকস্মিক আর অচিন্তনীয় ছিল যে, মিলিটারিরা হকচকিয়ে ঘরের মধ্যেই এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। সেই ফাঁকে কাজী পালিয়ে যায়।
আজাদদের বড় মগবাজারের বাসা থেকে আলমদের বাসা কাছেই। দিলু রোডে আলমদের বাসা, আর্মি যায় রাত দুটোর দিকে। ও বাসা থেকে ধরেছে আলমের ফুপা আবদুর রাজ্জাক আর তার ছেলে মিজানুর রহমানকে। রাত দেড়টার সময় ও বাসায় কাজী যায় একেবারে দিগম্বর অবস্থায়। বলে, একটু আগে আজাদদের বাড়িতে আর্মি গিয়ে রেইড করেছে। আমি ওরি মধ্যে ধস্তাধস্তি করে কোনমতে পালিয়ে এসেছি। আমাকে একটা লুঙ্গি দিন, আর একটা স্টেন দিন। আর্মি নিশ্চয় একটু পরে এ বাড়িতেও আসবে। আমি ওদের ঠেকাব। আলমের মা তাকে লুঙ্গি দিয়ে বলেন, বাবা, তুমি এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাও। আমাদের ব্যবস্থা আমরা দেখব।কাজী বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আলমের মা এবং চার বোন আলমের বাবাকে পেছনদিকের নিচু বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর দিয়ে ওপাশে পার করে দেয়। এবং তার পরপরই আর্মি এসে বাসা ঘেরাও করে ফেলে। আলমদের রান্নাঘরের মেঝের নিচে পাকা হাউজের মতো বানিয়ে সেখানে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা ছিল। আর্মি এসে প্রথমেই জিগ্যেস করে রান্নাঘর কোনদিকে? তখন বাড়ির সবাই বুঝে যায় যে ওরা আর্মস অ্যামুনিশান ডাম্পয়ের কথা আগেই জেনে গেছে। খানসেনারা রান্নাঘরে গিয়ে রান্নাঘরের মেঝে থেকে লাকড়ি সরিয়ে শাবল দিয়ে ভেঙে কংক্রিটের স্ল্যাব তুলে সব অস্ত্র, গোলাবারুদ তুলে নিয়ে গেছে। বাড়িতে যেহেতু পুরুষ মানুষ ছিল আলমের ফুপা আর ফুপাত ভাই, আর্মি ওই দুজনকেই ধরে নিয়ে এসেছে। বেচারীরা কয়েকদিন আগেই খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছে। কিছু না জেনে এবং কিছু না করেই ওরা বাপ বেটা মার খেয়ে মরছে। ওরা বুঝেও পাচ্ছে না কেন ওদের এরকম এলোপাতাড়ি মারধর করছে।
হাটখোলায় শাহাদতদের বাসায় রাত তিনটের দিকে মিলিটারি গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কাউকে না পেয়ে শাহাদতের সেজো দুলাইভাই বেলায়েত চৌধুরীকেই ধরে এনেছে। সে বেচারা পি.আই.এ.তে চাকরি করে, দুমাসের ছুটিতে করাচি থেকে দেশে বেড়াতে এসে আর ফিরে যায় নি। গ্রামের বাড়িতেই ছিল, কপালে দুর্দৈব–মাত্র দশ-বারোদিন আগে ঢাকায় এসেছিল। বেচারা সাতেও ছিল না, পাঁচে ছিল না, মুক্তিযোদ্ধা শ্যালকদের বদৌলতে এখন খানসেনার হাতে পিটুনি খাচ্ছে।
চুলুদের বাড়িতে মিলিটারি যায় রাত বারোটা-সাড়ে বারোটার সময়। চুল্লুর ভাই এম, সাদেক সি.এস.পি, এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তার সরকারি বাসভবন এলিফ্যান্ট রোডের এক নম্বর টেনামেন্ট হাউস থেকে চুল্লকে ধরেছে।
স্বপনদের বাসায় আর্মি যায় রাত দেড়টা-দুটোর দিকে। এলিফ্যান্ট রোড থেকে চুলুকে চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে সেই জীপ স্বপনদের বাড়িতে যায়। চোখ বাধা বলে চুলু প্রথমে বুঝতে পারে না কোথায় এসেছে, কিন্তু কানে আসে এক খানসেনার কথা স্বপন ভাগ গিয়া। স্বপনের বাবার গলা শুনতে পায় চুলু। মেয়েদের কান্না শোনে। অনুমান করে স্বপনের বোন মহুয়া, কেয়া, সঙ্গীতার কান্না। স্বপনের বাবা শামসুল হক সাহেবকেও ধরে এনেছে খানসেনারা।
আলতাফ মাহমুদের বাসায় আর্মি যায় ভোর পাঁচটার দিকে। ওদের বাসাটা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টোদিকে আউটার সার্কুলার রোডে। শরীফের বন্ধু মান্নানের পাশের বাসাটা ভাড়া নিয়ে থাকতো ওরা। ওটা মান্নানের বড় ভাই বাকি সাহেবের বাড়ি। কয়েকদিন আগে নিয়ন সাইনের সামাদ গুলি ও বিস্ফোরক ভর্তি একটা বিরাট ট্রাঙ্ক আলতাফ মাহমুদের কাছে রাখতে আনে। মান্নানদের বাড়ির পেছনের উঠানে ওটা পুঁতে রাখা হয়। আর্মি এসেই প্রথমে আলতাফ মাহমুদের বুকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ জোরে মারে, সঙ্গে সঙ্গে তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসে। তারপর তাকে আর সামাদকে নিয়ে উঠান খুঁড়িয়ে সেই ট্রাঙ্ক তোলায়। আর্মি সামাদকে সঙ্গে নিয়েই ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। তারপর আলতাফের শালাদের দিয়ে সেই ট্রাঙ্ক গাড়িতে তোলায়। আলভী ওই সময় ওদের বাড়িতে ছিল। খানসেনারা আলভী কৌন হ্যায় বলে খোঁজ করছিল। কিন্তু আলভীর কপাল জোর, ঐ সময়ের মধ্যেই আলতাফ একফাঁকে আলভীকে বলে তোমার নাম আবুল বারাক। তুমি আমার ভাগনে। দেশের বাড়ি থেকে এসেছ। তাই আবুল বারাক নাম বলে আলভী বেঁচে যায়। অবশ্য দলের অন্যান্যের সঙ্গে তাকেও ধরে নিয়ে যায় খানসেনারা।
মান্নানের দুই শালা রসুল ও নাসের তাদের মার সঙ্গে বোনের বাড়ির দোতলাটা ভাড়া নিয়ে থাকত। যেহেতু দুটো বাড়িই গায়ে গায়ে লাগানো, ট্রাঙ্কটাও বেরিয়েছে মান্নানদের পেছনের উঠান থেকে, অতএব রসুল, নাসেরকেও ধরে নিয়ে যায় খানসেনারা। ভাগ্য ভালো, মান্নান এ সময় চাটগাঁয়ে, তাই সে বেঁচে গেছে। আলতাফদের দোতলায় ভাড়া থাকেন এক ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, তাঁকে, তাঁর ছেলেকে, তার এক ভাগ্নেকেও ধরে নিয়ে গেছে খানসেনারা।
রুমীকে ওই ছোট ঘরটায় আনার পর রুমী শরীফকে বলে, আব্ব এরা আমাকে ধরবার আগেই জেনে গেছে ২৫ তারিখে আমরা ১৮ আর ৫ নম্বর রোডে কি অ্যাকশান করেছি, কে কে গাড়িতে ছিলাম, কে কখন কোথায় গুলি চালিয়েছি, কতজন মেরেছি, সব, স-ব আগে থেকেই জেনে গেছে। সুতরাং আমার স্বীকার করা না করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তোমরা চারজনে কিছুতেই কিছু স্বীকার করবে না। তোমরা কিছু জান না, এই কথাটাই সব সময় বলবে। তোমাদের প্রত্যেককে হয়ত আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তোমরা কিন্তু সবাই সব সময় এক কথাই বলবে। আমি কি করে বেড়াই, তোমরা কোনদিন কিছু টের পাও নি। দেখো, একটুও যেন হেরফের না হয়।
আলতাফ মাহমুদও তার চার শালাকে, আলভীকে, রসুল, নাসেরকে একই কথা বলে, তোমরা সবাই একই কথা বলবে, তোমরা কেউ কিছু জান না। যা কিছু করেছি, সব আমি। যা স্বীকার করার আমি করব।
এমনিভাবে সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। একবার করে খানসেনারা ঘরে ঢোকে এলোপাতাড়ি খানিক পেটায়, গালিগালাজ করে, আবার বেরিয়ে যায়। তখন এরা। ফিসফিস করে কথা বলে। খানিকক্ষণ পর কয়েকজন খানসেনা রুমী, বদি আর চুলুকে বের করে নিয়ে যায়। পরে এক সময় আলতাফ মাহমুদ আর তার সঙ্গের সবাইকে নিয়ে যায়। আরেক সময় শরীফ-জামীদের নিয়ে যায়। এরই মধ্যে সকাল নটার দিকে হাফিজকে ছেড়ে দেয়া হয়, তাও ওরা জানে না। স্থান-কালের কোনো হুঁশ কারো ছিল না। কাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কখন নিয়ে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে কেউ কিছু এখন আর সঠিক করে বলতে পারছে না। ওদের শুধু তীক্ষভাবে মনে গেথে আছে খানিক পরপর ওদের ওপর কি রকম টর্চার করা হয়েছে। ওরা দেখেছে স্বপনের বাবা শামসুল হককে দুই হাত বেঁধে ফ্যানের হুকে ঝুলিয়ে তারপর মোটা লাঠি দিয়ে, পাকানো তারের দড়ি দিয়ে পিটিয়েছে। অজ্ঞান হয়ে গেলে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে পানির ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছে। তার ওপর খানসেনাদের বেশি রাগ–তার এক ছেলে স্বপন ওদের হাতের মুঠো ফসকে পালিয়ে গেছে। আরেক ছেলে ডালিম আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে।
মেলাঘরের আরেক গেরিলা উলফাতের খোঁজে তাদের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে ধরে এনেছে তার বাবা আজিজুস সামাদকেও। একে আমি নামে চিনি। এর স্ত্রী সাদেকা সামাদ আনন্দময়ী গার্লস স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। সাদেকা আপার সঙ্গে অনেক আগে থেকেই আমার পরিচয়। ঢাকার কয়েকটা দুঃসাহসিক অ্যাকশানে উলফাতের অবদান আছে। ছেলেকে পায় নি, বাপকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করছে।
এইদিন সন্ধ্যার পর আমি ফোনে সুবেদার গুল আর জামীর সঙ্গে কথা বলি। জামী। এখন বলল, মা, তোমার ফোন পাবার পর গুল আমাদেরই কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিছু রুটি কাবাব কিনে এনে আমাদের খেতে দেয়।
রাত এগারোটার দিকে এদের সবাইকে অর্থাৎ ২৯ মধ্যরাত থেকে ৩০ সকাল পর্যন্ত যতজনকে ধরেছিল, তাদের সবাইকে–কেবল রুমী বাদে–জীপে উঠিয়ে রমনা থানায় নিয়ে যায়। সেখানে সবার নাম এনট্রি করিয়ে একটা ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। এরা যখন রমনা থানায় আসে, তখন চারদিকটা একদম চুপচাপ ছিল। ঘরে ঢোকানোর পর দেখে মেঝেয় অনেক বন্দী শুয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। এদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা তালাবদ্ধ করে খানসেনারা যখন জীপে করে চলে গেল, তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সূচনা হয়। মেঝেয় মরার মতো ঘুমোনো লোকগুলো হঠাৎ সবাই একসঙ্গে উঠে বসে, হৈহৈ করে নতুন বন্দীদের নাম, কুশল জিজ্ঞাসা করে সেবা-যত্ন করা শুরু করে দেয়। কার কোথায় ভেঙেছে, কোথায় রক্ত পড়ছে, কোথায় ব্যথা–খোঁজ নিয়ে কাউকে ব্যান্ডেজ করে, কাউকে ম্যাসাজ করে, কাউকে নোভালজিন খাওয়ায়। প্রথম চোটে সবাইকে পানি খাওয়ায়। যারা সিগারেট খায় তাদের সিগারেট দেয়। তারপর কিছু ভাত-তরকারি আসে,দুচামচ করে ভাত আর একটুখানি নিরামিষ তরকারি। যারা পান খায়, তাদের জন্য পানও যোগাড় হয়ে যায়। এই বন্দীগুলোও দেশপ্রেমিক বাঙালি, এরাও কিছুদিন আগে মিলিটারির হাতে ধরা পড়েছে। এদেরও এম.পি.এ. হোস্টেল পর্ব শেষ করে আসতে হয়েছে। এরা নবাগত বন্দীদের বলে, কাল ভোরে আবার আপনাদের এম.পি.এ, হোস্টেলে নিয়ে যাবে। আরো টর্চার করবে। একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিই। প্রথমে দুএক ঘা মারার পরেই অজ্ঞান হয়ে যাবার ভান করবেন, চোখ মটকে নিশ্বাস বন্ধ করে থাকবেন। তখন ওরা পানি ঢেলে খানিকক্ষণ ফেলে রেখে যাবে। এতে পিটুনিটা কম খাবেন।
পরদিন সকালে আবার গাড়ির শব্দ পাওয়া যায় সাতটায়। এবার একটা বিরাট বাস। সবাইকে উঠিয়ে বাসের সবগুলো জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়। আবার এম.পি.এ. হোস্টেল। হোস্টেলে খানিকক্ষণ রাখার পর এদেরকে পেছনের আরেকটা বাড়িতে নিয়ে যায়। গেট দিয়ে বেরিয়ে গলি রাস্তা দিয়ে খানিক গিয়ে এম.পি.এ. হোস্টেলের পেছনের দিকে এই বাড়িটা। শোনা গেল এখানে সবাইকে স্টেটমেন্ট দিতে হবে। এ বাড়িতে যাওয়ার পর আরেক নারকীয় ঘটনার অবতারণা হয়।
স্টেটমেন্ট দেওয়া মানে এক এক করে একজন আর্মি অফিসার বন্দীর বক্তব্য শুনবে, তাকে প্রশ্ন করবে, তার জবাব শুনবে এবং সেগুলো কাগজে লিখে নেবে। এই স্টেটমেন্ট দেওয়া ও নেয়ার সময় বন্দীদের ওপর যে পরিমাণ নির্যাতন করা হয়, তা গত দুদিনের নির্যাতনকে ছাড়িয়ে যায়। অফিসার বন্দীকে প্রশ্ন করে, উত্তর যদি হয় না সূচক, অমনি শুরু হয় তার ওপর দমাদম লাঠির বাড়ি, লাথি, রাইফেলের বাটের গুঁতো। পরপর ক্রমাগত না-সূচক উত্তর হতে থাকলে স্টেটমেন্ট গ্রহণকারী অফিসারের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, সে খানিকক্ষণের জন্য বিরতি দেয়, তখন খানসেনারা ঐ বন্দীকে সিলিংয়ের হুকে ঝুলিয়ে পাকানো দড়ি দিয়ে সপাসপ পেটায়। কাউকে উপুড় করে শুইয়ে দুই হাত পেছনে টেনে পা উল্টোদিকে মুড়ে তার সঙ্গে বেঁধে দেয়–দেহটা হয়ে যায় নৌকার মত। লোকটার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, চিৎকারও দিতে পারে না। বেশি। ত্যাড়া কোন বন্দীর পা দুটো সিলিংয়ের ফ্যানে ঝুলিয়ে জোরে পাখা ছেড়ে দেয়। নিচের দিকে মাথা ঝোলানো লোকটা ফ্যানের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে নাকে-মুখে-চোখে রক্ত তুলে অজ্ঞান হয়ে যায়।
এই রকম নারকীয় কাণ্ডকারখানার ভেতর দিয়ে স্টেটমেন্ট নিতে নিতে বারোটা একটা বেজে যায়। দেড়টার দিকে শরীফদের তিনজনকে আবার এম.পি.এ. হোস্টেলে কর্নেলের রুমে আনা হয়। কর্নেল বলে তোমরা এখন বাড়ি যেতে পার। শরীফ জিগ্যেস করে রুমীর কথা। কর্নেল বলে রুমীকে একদিন পরে ছাড়া হবে। ওর স্টেটমেন্ট নেয়া এখনো শেষ হয় নি।