১. সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত

প্রথম খণ্ড

সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত লোকেমুখে শুনেছি কেবল। আমার নিজের কিছু মনে নেই।

সকাল থেকেই পুরো আকাশ ধূসর করে তুষার ঝরছিল। লোক খুব বেশি বের হয়নি বাসা থেকে। যারা বের হয়েছে ছাতা মাথায় দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছুলেই যেন বাঁচে। তবে আমি যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেটায় মোটামুটি ভিড়ই বলা চলে।

সেই ভিড়ের মাঝে রাস্তার ওপর হাঁটুতে ভর দিয়ে তুষার হাতড়ে যাচ্ছি। মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে আমার মুখটা। কিছু একটা খুঁজছি। পাশেই পড়ে আছে আমার ছাতাটা।

আশপাশে অনেকে থাকলেও কেউই আমার দিকে একবারের বেশি দু’বার তাকাচ্ছে না। আসলে কেউই ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না।

তবে কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোকের বোধহয় আমার ওপর কিছুটা করুণা হলো। এক হাতে একটা ব্রিফকেস এবং আরেক হাতে ছাতা ধরে ছিল সে, অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল খুব সম্ভবত। তুমি কি কিছু খুঁজছো, মা? জানতে চায় সে।

আমি বোধহয় শুনতে পাইনি তার কথা। কোন জবাব দেইনি।

চোখের কনটাক্ট লেন্স হারিয়ে গেছে? আমি খুঁজতে সাহায্য করবো?

খুঁজতে খুঁজতেই কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম, লেন্স না, অন্য কিছু।

তখন লোকটা বুঝতে পারে যে আসলেও কোন সমস্যা হয়েছে আমার। হাতে কোন গ্লোভস না পরেই তুষার হাতড়ে যাচ্ছি। আঙুলগুলো অসাড় হয়ে পড়ছে ঠান্ডায়, কিন্তু আমার কোন প্রতিক্রিয়া নেই।

কতক্ষণ ধরে হাঁটু গেড়ে বসে আছি, জানি না। আমার পিঠেও তুষার জমতে শুরু করেছে। আশপাশের অবস্থা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথাই নেই, শুধু খুঁজে যাচ্ছি একমনে।

আমার কণ্ঠে ভয় আর উৎকণ্ঠা। কোথায় পড়লো?

এসময় লোকটার চোখে পড়লো আরেকটা ব্যাপার। আমার চারদিকের তুষার লাল হয়ে উঠেছে। রক্তের ফোঁটা সবখানে।

তুমি ঠিক আছো? আমাকে জিজ্ঞেস করে সে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে মুখ ফেরাই তখন।

খুঁজেই পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি। আমার বাম চোখটা এখানেই কোথাও পড়েছে…।

রক্ত ঝরছে আমার চোখের কোটর থেকে। সেই অবস্থাতেই জ্ঞান হারালাম।

যেখানে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, সেখান থেকে কিছুটা দূরে খুঁজে পাওয়া যায় আমার চোখটা। কাদা আর তুষারে মাখামাখি, পথচারীদের পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে সেটাকে আর চোখ বলে মনে হচ্ছিল না।

কয়েক দিন ধরেই ভারি তুষারপাতে বিপর্যস্ত ছিল জনজীবন। বাধ্য হয়েই ছাতা মাথায় বাইরে বের হতে হচ্ছিল সবাইকে। আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি, এমন সময় একজনের ছাতার চোখা অংশটা ঢুকে যায় আমার চোখে। অপটিক নার্ভ থেকে ছিঁড়ে আসে চোখটা। অক্ষিকোটর থেকে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। উভ্রান্তের মত উপুড় হয়ে সেটা খুঁজতে শুরু করি আমি।

এগুলো সবই পরে রিপোর্টগুলো পড়ে জেনেছি। সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। আমার ব্যাগে থাকা স্কুলের পরিচয় পত্র থেকে নাম জানতে পারে হাসপাতালের স্টাফ-নামি শিরাকি।

আর এভাবেই, জানুয়ারির এক সকালে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলি আমি।

*

চোখ খুলে প্রথমে ঝাপসা দেখছিলাম সবকিছু। সাদা সিলিঙ আর সাদা দেয়ালের একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে আছি আমি। গলা অবধি কম্বল টেনে দেয়া।

পাশেই এক ভদ্রমহিলা বসে পত্রিকা পড়ছেন। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তবে কিছু বললাম না।

খানিকবাদে পত্রিকার পাতা ওল্টানোর ফাঁকে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রমহিলা। সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, হাতের পত্রিকাটা পড়ে গেল মেঝেতে। “নার্স! কাউকে ডাকুন। নামির জ্ঞান ফিরেছে!”

একজন নার্সকে সাথে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলেন ডাক্তার। আমাকে কিছু প্রশ্ন করে গেলেন একটানা। ভদ্রমহিলা এখনও পাশে আছেন, শুনছেন সবকিছু।

|||||||||| “কি সমস্যা, নামি?” জিজ্ঞেস করলেন মহিলা। “আশপাশে না তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে ডাক্তার সাহেবের কথা শোনো।”

হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওগুলোয় ব্যান্ডেজ করা। আমার বাম চোখের ওপরেও একটা ব্যান্ডেজ। চেষ্টা করলাম ব্যান্ডেজটা তুলে ফেলার, কিন্তু ডাক্তার এবং নার্স দু’জনেই বাধা দিল এতে।

ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালেন মহিলা, “নামি?”

নামি যে একটা নাম সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু কার নাম তা জানি না। সেটাই বললাম ওনাদের উদ্দেশ্যে।

“তোমার নাম নামি,” ডাক্তার বললো। “ওনাকে চিনতে পারছো?” পাশের মহিলাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, এরপর মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।

“ইনি তোমার মা,” ডাক্তার বললো।

আবারও তাকালাম ভদ্রমহিলার দিকে। মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছেন তিনি এখন।

ডাক্তার ব্যাখ্যা করে বললো যে আমার বাম চোখে আঘাত পেয়েছি এবং প্রচণ্ড শকে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি।

*

একটা গাড়িতে ভোলা হলো আমাকে। পেছনের সিটে মার পাশে বসেছি। সামনে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে অচেনা একটা লোক। কিছুক্ষণ পর আমাকে তিনি বললেন যে তিনিই আমার বাবা।

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই নানা বিষয়ে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে মা, জবাবে কি বলি সেটা শোনার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু কোন জবাব বেরুলো না আমার মুখ দিয়ে, কারণ সে যেসব বিষয়ে কথা বলছে, সবগুলোই আমার অচেনা, অজানা। হতাশ মনে হলো তাকে।

“একদম চুপচাপ হয়ে গেছো তুমি,” বাবা বললো।

আমাদের বাড়ি দেখতে কেমন, সেটাও বেমালুম ভুলে গেছি। দরজায় নামফলকে বড় করে লেখা ‘শিরাকি। আমাদের পারিবারিক পদবি। জুতো খুলে ভেতরের করিডোরে রাখলাম, কিন্তু সেখান থেকে কোথায় যাবো জানি না।

মা হাত ধরে প্রথমে লিভিং রুমে, এরপর রান্নাঘরে নিয়ে গেল আমাকে। “এখানকার কথা তো মনে আছে তোমার?”

মাথা ঝকালাম আমি।

দোতলায় আরেকটা রুমে আমাকে নিয়ে গেল মা। একটা পিয়ানো রাখা আছে একপাশে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কোন মেয়ের রুম।

“এবার?” জিজ্ঞেস করলো মা।

রুমটা বেশ সুন্দর লাগছিল আমার কাছে, সেটাই বললাম। তখন মা বলল যে এটা আমার নিজের রুম। ছোটবেলা থেকে এখানেই থাকি।

খুব ক্লান্ত লাগছিল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে পারবো কিনা জিজ্ঞেস করলাম।

“তোমার নিজের ঘর,” বললো মা। “যা ইচ্ছে করো।”

এতক্ষণে খেয়াল হলো যে কাঁদছে সে।

কিছুক্ষণ পর ছবির কয়েকটা অ্যালবাম আর বেশ কয়েকটা ট্রফি হাতে রুমে প্রবেশ করলো বাবা। প্রতিটা ট্রফি কোন না কোন পিয়ানো

প্রতিযোগিতায় জেতা।

“তোমার কি কিছুই মনে নেই?” জিজ্ঞেস করে সে।

মাথা ঝাঁকালাম আবারো।

অ্যালবামের ছবিতে দেখলাম ছোট্ট একটা মেয়ে হাতে স্কুপ নিয়ে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। দু’চোখ ভর্তি পানি।

“আমাকে কি ছোটবেলায় অনেক খেপাতো বন্ধুরা?” জিজ্ঞেস করলাম।

“এই মেয়েটা তোমার বান্ধবী ছিল। তুমি হচ্ছো ওর পেছনের জন, এই যে এটা। হাসছো মুখে হাত চাপা দিয়ে।”

এরপর আমাকে আরো কয়েকটা ছবি দেখালো বাবা। কিন্তু ওগুলোর কোনটা সম্পর্কেই কোন স্মৃতি নেই আমার। আমার নিজের বানানো একটা ফুলদানি নিয়ে আসলো সে, তবুও কিছু মনে পড়লো না। নিজের প্রিয় টেডি বিয়ারটার নামও ভুলে গেছি, যেটা মা আমাকে দিয়েছিল। এমনকি নিজের পছন্দের সিনেমার নামটাও!

*

প্রথম প্রথম সাধারণ সব কাজ করতেও বাবা মাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হতো আমাকে। জিনিসপত্র কোথায় কোনটা রাখা, কিছুই মনে নেই আমার। সবকিছুতেই অনুমতি চাইতাম। কিন্তু বাবা এক পর্যায়ে বলে যে এটার কোন দরকার নেই।

কিছু করতে গেলেই বিভ্রান্তি আমার সঙ্গী হয়। এক রাতে ওপরতলার বাতি জ্বালাতে গিয়ে বুঝতে পারি যে সুইচবোর্ড কোথায় সেটাও জানি না। এরপর যখন সুইচবোর্ড খুঁজে পেলাম, কোন সুইচটা জ্বালবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতে যাই।

“এই যে এটা! কি জিজ্ঞেস করছো তুমি এসব!” চেঁচিয়ে ওঠে সে।

আমি দুঃখিত, মাথা নিচু করে বলি।

বাবার চাইতে মা-ই বেশি কষ্ট করছে আমার স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনার আগে আমি কেমন ছিলাম, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেন। বেশিরভাগ গল্পই তার আর আমার একসাথে কাটানো কোন সময়ের স্মৃতিচারণা।

“মনে আছে একবার খুব বেশি ঠান্ডা লেগেছিল তোমার? অনেকদিন বিছানাতেই থাকতে হয়েছিল?”

মনে নেই।

“মনে আছে কিভাবে তোমার যত্ন নিয়েছিলাম? আপেল কেটে দিয়েছিলাম?”

দুঃখিত মনে নেই।

“কেন মনে নেই?”

“আমি জানি না। সরি।”

“এত সরি সরি বলছো কেন? কত হাসিখুশি একটা মেয়ে ছিলে। নার্সারিতে পড়ার সময় আমার সাথে বাজারে যেতে তুমি। ফেরার পথে সবসময় রুটির ব্যাগটা আমার জন্যে বয়ে আনতে। মনে আছে?”

আবারো মাথা ঝাঁকাই। মনে নেই।

“কাঁদছো কেন? এসব নিয়ে কাদার তো কিছু নেই।”

যখনই আমি কিছু করতে ভুলে যাই বা কিছু একটা মনে করতে পারি না, মা বিড়বিড় করে বলে, “নামি তো এরকম করতো না। নামি তো কিছু ভুলতো না।”

লম্বা একটা সময় বাড়িতেই থাকি আমি। কিন্তু ধীরে ধীরে বাইরে যাওয়া আসাও শুরু করি। কখনো কখনো প্রতিবেশীরা আমার সাথে কথা বলে।

একদিন রাতের খাবারের সময় বাবা আমাকে বলে, “গতকাল মিঃ সাইতোউ তোমাকে হ্যালো বলেছিল। তুমি কিছু বলোনি কেন জবাবে?”

তার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলাম।

“লোকে তোমাকে নিয়ে নানারকম কথা বলা শুরু করেছে। তুমি নাকি কেবল তাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকো। অন্তত বাউ তো করতে পারো।”

“খুবই লজ্জাস্কর একটা ব্যাপার,” মা বললো অসন্তুষ্ট চিত্তে। “হ্যাঁ, সবাই জানে যে দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারিয়েছো তুমি, সেটাও বিবেচনায় রাখা উচিৎ তাদের। কিন্তু লোকে তোমার প্রতিটি চালচলন খেয়াল করে, সুতরাং তোমারও সেভাবেই চলাফেরা করা উচিৎ। আশা করি খুব দ্রুত স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবে। ততদিন অবধি পুরনো নামির মত ব্যবহারের চেষ্টাটুকু অন্তত করো।”

একদিন রাতে মা বাবাকে বলাবলা করতে শুনলামঃ

“একটু বেশিই কড়া ব্যবহার করছো তুমি ওর সাথে,” বাবা বলে মার উদ্দেশ্যে। “আমি আর নিতে পারছি না,” মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দেয়। “মাঝে মাঝে তো মনে হয়, ও আমাদের মেয়ে-ই না।”

*

আরেকদিন রাতের খাবার শেষে বাবা বলে, “তুমি তো পাবলিক স্কুলের ছাত্রী ছিলে। সহপাঠীদের চেহারা বোধহয় ভুলে গেছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

“তোমার টিচারদের সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার। চাইলে যে কোন সময় ক্লাসে ফিরে যেতে পারো।

বাবা সিদ্ধান্ত নিল যে দু’দিন পর, সোমবার থেকে স্কুলে যাবো। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আমি।

রুমে গিয়ে স্কুলের ইউনিফর্ম গায়ে চাপালাম। বই আর নোটবুকগুলো খুলে চোখ বুলালাম কিছুক্ষণ। সব ভুলে গেছি।

বইগুলোয় কয়েক পাতা পরপর ছোট ছোট চিরকুট সেঁটে রেখেছিলাম আমি। কিন্তু এখন বড় অপরিচিত লাগছে সেগুলো, মনে হচ্ছে অন্য কেউ করেছে কাজগুলো।

সোমবার চলে এলো দেখতে দেখতে।

রুমে যে সাদা টোট ব্যাগটা ছিল, সেটাই স্কুলের খাতাবইগুলো ঢোকালাম। বাইরে পা রাখবো এমন সময় মা পেছন থেকে বলে উঠলো, “নামি সবসময় ওর ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যায়। তুমিও তাই করো।” এমনভাবে কথাগুলো বললো সে যেন আমি আর নামি পৃথক কোন সত্তা।

একবার ক্ষমাপ্রার্থনা করে দ্রুত উপরে উঠে ব্যাগ পাল্টে নিলাম।

স্কুলের ঠিকানা ভুলে গেছি, তাই বাবা চললো আমার সাথে।

অনেক বড় একটা স্কুল। সরাসরি স্কুলের অফিস রুমে নিয়ে এলো আমাকে বাবা। টিচাররা সারাদিন বাচ্চাদের কি পড়াবেন, সেগুলো ঠিকঠাক করছিলেন। বাবার সাথে তাল মেলানোর জন্যে দ্রুত পা চালাতে হলো আমাকে।

অফিসে আমার ক্লাস টিচার, মিঃ ইওয়াতার সাথে দেখা হলো।

“তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে,” বললেন তিনি, এরপরেই চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণের জন্যে। “তোমার কাছে হয়তো স্কুলের প্রথম দিনের মত ঠেকছে,” যেন হঠাৎই মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললেন।

তার উদ্দেশ্যে একবার বাউ করে বের হয়ে গেল বাবা। অফিসের অন্যান্য সব টিচার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

“জানি এভাবে সবাই তাকিয়ে থাকায় অস্বস্তিবোধ করছো, আমার বাম চোখের ওপর যে ব্যান্ডেজটা আছে সেদিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন মিঃ ইওয়াতা।

“সবার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছে। দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে, এটা সকলেই জানে।”

কিরকম ছাত্রী ছিলাম আমি, জিজ্ঞেস করি।

“তুখোড়। পড়াশোনা, খেলাধুলা সবখানেই দুর্দান্ত। ক্লাসের মধ্যমণি ছিলে তুমি। সুতরাং এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। চলো তাহলে, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে।”

তাকে অনুসরণ করে অফিস থেকে হলওয়েতে বেরিয়ে এলাম। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে তার একদম পেছন পেছন হাঁটছি। একাদশ শ্রেণি, সেকশন ১ লেখা একটা ক্লাসরুমের বাইরে থামলেন তিনি। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ঠিক আছে তো?”

মাথা নাড়লাম জবাবে।

আমরা ভেতরে ঢোকার আগমুহূর্ত অবধি হইচই হচ্ছিল গোটা ক্লাসে। কিন্তু আমাকে দেখেই পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবার চোখ আমার ওপর। রুমের মাঝে খালি একটা ডেস্কের দিকে নির্দেশ করলেন মিঃ ইওয়াতা। সেটায় গিয়ে বসলাম আমি।

আমার অবস্থাটা ক্লাসের অন্য সবাইকে ব্যাখ্যা করলেন টিচার। দুর্ঘটনার কারণে কিরকম অসুবিধার মধ্যে পড়েছি সেটাও বললেন। কিন্তু সবাই যে ইতোমধ্যেই জানে তা বুঝতে অসুবিধে হলো না।

হোমরুম পিরিয়ড শেষ হবার পরপরই আমাকে ঘিরে ধরলো সহপাঠীরা। তাদের একজনের চেহারাও চিনতে পারছি না। কিন্তু আমার সাথে এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন অনেকদিনের চেনা। তাদের নামটাও জানি না, কিন্তু তারা আমার সম্পর্কে এমন সব কথা জানে যেগুলো আমি নিজেও শুনিনি কখনো।

“নামি!” একজন বললো। “তোমাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো আমাদের!”

“ঠিক আছে তো?” আরেকজন জিজ্ঞেস করে।

কি বলবো ভেবে উঠতে পারলাম না, তাই চুপ থাকলাম। তাদের উৎসাহ হতাশায় পর্যদুস্ত হতে খুব বেশি সময় লাগলো না।

“তুমি মজার মজার কথা বলছো না কেন? হাসছো না কেন, নামি?”

“চেহারা এত গোমড়া করে রেখেছো কেন?”

আমি দুঃখিত। সরি।

আমার সামনের ডেস্কে বসে থাকা মেয়েটা বললো, “তোমার কি আসলেও কিছু মনে নেই?”

না, কিছু মনে নেই।

“সমস্যা নেই, তোমাকে সব বলবো আমি। সবসময় তোমার হোমওয়ার্ক নকল করেছি, সেটার প্রতিদান বলতে পারো। কি হলো? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে?”

তোমার নাম তো জানি না।

“মানে? আমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড!”

সরি।

“আচ্ছা, বাদ দাও। আমি ইউরি কাতসুরা। মাথায় গেঁথে নাও, ঠিক আছে?”

ধন্যবাদ।

আমাকে আমার ব্যাপারে বললো সে। যে মেয়েটার কথা শুনলাম তাকে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন। ইউরি বললো যে চমৎকার একজন মেয়ে ছিলাম আমি। কথার ধরণ শুনেই বোঝা যাচ্ছিল যে আমার ভক্ত ইউরি।

“তুমি ছিলে সবকিছুর মধ্যমণি। যখন হাসতে, সবাই নির্ভার অনুভব করতো। মিঃ কামাতার কথা মনে আছে? ঐ হতচ্ছাড়া ইংরেজি টিচারটা?”

মাথা ঝাঁকালাম।

“ইংরেজিতে একটা তর্কে তাকে হারিয়ে দিয়েছিলে তুমি! সবাই খুব খুশি হয়েছিল লোকটাকে হেনস্তা হতে দেখে।”

সেদিন অন্যান্য ক্লাসগুলোও করলাম, কিন্তু বুঝলাম না কিছুই। আমার টিচাররা সবাই উজ্জ্বল দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছিল আমার দিকে। বলছিল কত ভালো ছাত্রী ছিলাম আমি। বেশ কয়েকটা প্রশ্নের সমাধান করতে দেয়া হলো, একটাও পারলাম না। তাদের বিড়বিড় করতে শুনলাম, “এটাও ভুলে গেছে।”

ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরলাম। সাথে করে আনা চিরকুটগুলো দেখে দেখে স্টেশন আর রাস্তা মিলিয়ে নিতে হচ্ছে। কিছুই মনে নেই যে।

*

আমার নানা বেঁচে আছেন। মার কাছে শুনেছি অবসর গ্রহণের আগে একটা বড় কোম্পানির মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই তাই বেশ জানাশোনা আছে।

আমাকে খুবই আদর করতেন নানা। দুর্ঘটনায় চোখ হারানোয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট তিনিই পেয়েছেন। একদিন বাবাকে নানার সাথে ফোনে কথা বলতে শুনলাম। আমাকে দেখে কর্ডলেসটা নামিয়ে বাবা বললো, “নামি, নানা বলেছে তোমার বাম চোখের জন্যে খুব তাড়াতাড়ি কিছু করবেন। জাতীয় চক্ষু সংস্থায় তার পরিচিত কয়েকজন আছে।”

বাম চোখ ফিরে পেলে আমার চেহারা আবার আগের মত হয়ে যাবে। বাবার মতে অপটিক নার্ভও সেরে উঠতে পারে। ফলে আবারো দেখতে পাবো হয়তো।

*

“নামি, তুমি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। আরো বেশি কথা বলা উচিৎ তোমার।”

স্কুলে সবাই আমাকে এই কথাটা বলে। যতই দিন যায়, আমার সাথে কথা বলার মত সহপাঠীর সংখ্যাও কমতে থাকে।

একজন আমাকে গতদিন দেখা কোন একটা টিভি শো’র ব্যাপারে বিস্তারিত বলা শুরু করলো। অন্য একটা মেয়ে এসে তার হাত ধরে দূরে টেনে নিয়ে ফিসফির করে কিছু বলার সাথে তার চেহারার অভিব্যক্তি বদলে গেল। ফিসফিস করে বললেও আমার শুনতে অসুবিধে হলো না যে কি বলছে মেয়েটা।

‘নামি এখন আর আগের নামি নেই।”

ইউরি বাদে এখন আর কেউ আমার সাথে কথা বলে না। তবে তার উৎসাহের কমতি নেই। একের পর এক অতীতের গল্প করেই চলে। সেই গল্পে যে শুধু আমিই থাকি, তা নয়। এমন অনেকের কথাই বলে, যাদের চিনি না। হয়তো একসময় চিনতাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে এখন সাধারণভাবে শ্বাস ফেললেই অবাক হয়ে যাই মাঝে মাঝে। আমার দিকে তাকিয়ে যে নামিকে দেখার চেষ্টা করে ইউরি, সে হারিয়ে গেছে।

শুধু ইউরি নয়, আমার টিচারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখনও পুরনো আমিকে খুঁজে বেড়ায় তারা। যখনই কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানাতে ব্যর্থ হই, মুখটা গোমড়া করে ফেলেন। চেহারা দেখেই বোঝা যায় যে ভীষণ হতাশ হয়েছেন।

“আগের নামি সবকিছু করতে পারতো,” একদিন ইউরি বলে। “সব।”

আসলেই?

“খুবই কিউট ছিল ও। মানে, তোমার চেহারাও একই। কিন্তু কি যেন একটা নেই। এমনকি তোমার সাথে কথা বলতেও আগের মত ভালো লাগে না। মনে হয় যেন বাতাসের সাথে কথা বলছি।”

আমি দুঃখিত।

*

সবাই বর্তমান নিভৃতচারী আমি আর আগের হাস্যোজ্বল, সব কাজে পারদর্শী নামিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চোখে দেখে।

দুর্ঘটনার পর চোখ খুলে মার চোখে যে উষ্ণতার ছায়া দেখেছিলাম, তা এই কয়দিনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বাবা বলে, আগে নাকি আমি আর মা সবসময় একসাথে থাকতাম। যেন দুই বোন।

আমি ঘরে বসে পড়ছিলাম এসময় বাবা আসে।

“তোমাকে এর আগে কখনো টেবিলে বসে পড়তে দেখিনি,” বলে সে। “তবুও পরীক্ষায় কোনদিন কম নম্বর পাওনি।”

আমি যদি খুব পড়াশোনা করে পরীক্ষায় আগের মতন নম্বর পাই, মা কি আবারো আমাকে ভালোবাসবে?

“সেটা পরে দেখা যাবে,” বাবা অনিশ্চিত কণ্ঠে বলে। “এখন চোখ মোছছা তো মা, তোমাকে কাঁদতে দেখতে অভ্যস্ত নই একদমই।”

*

আমার চোখের অস্ত্রোপচারের আগেরদিন নানা এলেন দেখা করতে।

“নামি,” আমাকে দেখেই ডেকে উঠলেন। “একবার আমার জন্যে পিয়ানো বাজাবে? তোমার স্মৃতিশক্তি চলে গেলেও, মাসল মেমোরি থেকে পিয়ানো বাজাতে পারার কথা।”

আমাকে পিয়ানোর সামনে বসিয়ে দিলেন তিনি। বাবা, মা, নানু, মামা আর মামাতো ভাইবোনেরা-সবাই গোল হয়ে ঘিরে আছে আমাকে। একদৃষ্টিতে দেখছে, অপেক্ষা করছে পিয়ানোর সুরের মূর্ঘনায় হারিয়ে যাবার।

কিন্তু পিয়ানোর কি’গুলোতে কেবল হাতড়েই গেলাম, কোন সুর বেরুলো না। খুব তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে মাথা নামিয়ে নিল সবাই।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নানার বুক চিড়ে।

লজ্জায় চেহারা লাল হয়ে গেছে আমার। কান ঝাঁঝাঁ করছে। মনে হচ্ছে। ছুটে পালাই।

আবারো পুরনো নামির গুণগান গাইতে শুরু করলো সবাই মিলে। সেই নামি কখনো হতাশ করেনি তাদের। আগে কেমন ছিলাম, এখন কিরকম আছি-ঘুরেফিরে এটা নিয়েই আলাপ হয়েছে সারাদিন। একটার পর একটা ভুল ধরে গেছে মা।

মাথা উঁচু করার শক্তিও যেন হারিয়েছি। অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। স্কুলে গেলেও একই অনুভূতি হয়। সবাই আগের নামির বন্ধু হতে চায়। এখনকার আমির কোন মূল্যই নেই কারো কাছে। এমনকি যারা করুণা করে এখনও কথা বলে আমার সাথে, তারাও আগের নামিকেই খুঁজে ফেরে।

পরদিন একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। এর আগে কখনো এই হাসপাতালটায় আসিনি। শহর থেকে কিছুটা দূরে জায়গাটা।

নানাকে জিজ্ঞেস করলাম যে কেন শহরের বড় হাসপাতালগুলোর একটায় নেয়া হয়নি আমাকে।

“তোমার নতুন চোখের বন্দোবস্ত করার জন্যে কিছু বিশেষ উপায় অবলম্বন করতে হয়েছে আমাকে। সেইজন্যেই এই ছোট হাসপাতালটায় আসতে হয়েছে। চিন্তা কোরো না, আসল ডাক্তারই দেখবে তোমাকে”

অস্ত্রোপচারের ঠিক আগে চোখটা দেখলাম একবার। একটা কাঁচের বয়ামের ভেতর থকথকে তরলে ভাসছে। মনে হচ্ছে যেন দেখছে আমাকে।

অ্যানেস্থেশিয়া দেয়া হলো আমাকে। অন্ধকারের গহীন নিরুদ্দেশে হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যে।

.

অন্য কারো চোখ প্রতিস্থাপিত হলো আমার বাম অক্ষিকোটরে। অপটিক নার্ভগুলোও ঠিকঠাক জোড়া লেগে গেল। অস্ত্রোপচারের পর তিনদিন বাম চোখের কাছে হাত নেয়াই নিষিদ্ধ। ব্যান্ডেজের ওপর দিয়ে হাত দেয়া যাবে না। ডাক্তার বারবার করে বলে দিয়েছেন সম্ভব হলে চোখের নাড়াচাড়াও যথাসম্ভব কম করতে হবে।

মাঝে মাঝে মনে হল যে আমার চেহারার বামপাশে কোন অনুভূতিই নেই। মাথাটা কিঞ্চিৎ হেলে আছে বামদিকে।

চারদিন পর চোখের ওপর থেকে ব্যান্ডেজ সরানো হলো। হাঁটাহাঁটি বা নড়াচড়া এখনও একদম নিষিদ্ধ। তবে অনুভূতি ফিরে আসতে শুরু করেছে বামপাশটায়। পঞ্চম দিনে পুরোপুরি অনুভব করতে পারলাম সবকিছু। বাম চোখে অদ্ভুত অনুভূতিটাও দূর হয়ে গেছে একদম।

“ব্যান্ডেজ খুলে ফেললেও, প্রথম প্রথম দেখতে হয়তো কিছুটা অসুবিধে হবে। নার্ভ ঠিকঠাক সাড়া দিতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে খুব শিঘ্রই তোমার শরীরের সাথে মানিয়ে নেবে প্রতিস্থাপিত চোখটা, তখন আশা রাখি দেখায় কোন সমস্যা থাকবে না। খবরদার! ভুলেও চোখ কচলাবে না।”

বাম চোখ খোলার পর মনে হলো যেন একটা ধূসর কাঁচের পেছন থেকে দেখছি আমি। সবকিছু বড্ড বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। এখনও বোধহয় এত আলোর সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি চোখটা।

আমার কেবিনের দেয়ালের একপাশে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। নিচের অর্ধেকে তারিখ আর ওপরের অর্ধেক জুড়ে একটা রঙিন ছবি। ছবিটায় খালি দোলনা দেখা যাচ্ছে।

ক্যালেন্ডারটা আমার বিছানার বিপরীত দিকে বলে সারাদিন মোটামুটি ওটার দিকেই তাকিয়ে থাকি। ব্যান্ডেজ খুলে ফেলার পর প্রথম কয়েকদিন অবশ্য পরিষ্কার দেখতে পেতাম না, সবকিছু ঝাপসা হয়ে যেত। কিন্তু দুদিন পর দোলনার শেকলগুলোও স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

এক সপ্তাহ পর বাসায় ফেরার সময় হলো। মা এসেছে আমাকে বাসায় নিয়ে যাবার জন্যে। অস্ত্রোপচারের পর এই প্রথম হাসপাতালে এসেছে সে। নানা একবার এসেছিলেন, কিন্তু খুব বেশিক্ষণ থাকেননি। আসলে কথা বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই একরকম বিরক্ত হয়েই চলে গেছেন।

“তুমি কি বাম চোখ দিয়ে দেখতে পাও?” মা জিজ্ঞেস করলো। “দুর্ঘটনার পর তোমার চেহারাটাই বদলে গেছিল। আমার নামিকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তোমার মধ্যে। এখন আবার আগের মত লাগছে। আশা করি আচার ব্যবহারেও পরিবর্তন আসবে।”

আয়নায় তাকানোর পর প্রথমবারের মতন খেয়াল করলাম যে আমার দু’চোখের রঙ মিলছে না। বাম চোখ পরিষ্কার বাদামি।

আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে একবার সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো মা! “দেখতে অন্তত পুরনো নামির সাথে মিল আছে তোমার। খুব সুন্দর, বলে বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে রাখলো সে। “এবার তাড়াতাড়ি স্মৃতি ফিরে আসুক ভোমার। মাঝে মাঝে তো মনে হয় তুমি বুঝি নামিই নও। এরকম হয়ে গেছ কেন, বলো তো? নিজের সন্তানকে চোখের সামনে স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে দেখার চেয়ে ভয়ানক আর কিছু নেই কোন মা’র জন্যে।”

হাসপাতালের রিলিজ ফর্মে সই করার জন্যে বাইরে বেরুলো মা।

বিছানায় উঠে বসে আবারো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে আমার মস্তিষ্ক আর বাম চোখের অপটিক নার্ভের সংযোগ ঠিকঠাকই হয়েছে। তবুও ক্যালেন্ডারটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। আসলে কাঁদছি আমি। পাশের টেবিল থেকে একটা টিস্যু তুলে নিয়ে খুব সাবধানে চোখ মুছলাম।

বুকে ভারি হয়ে চেপে বসে রাজ্যের সব কষ্ট। যেন দশ মণী একটা পাথর বাঁধা। মা আর আমার সহপাঠীদের বলা কথাগুলো অনবরত কানে বাজে। পুরনো আমিকে খুব ভালোবাসততা তারা। কিন্তু নতুন আমি তো কিছুই করতে পারে না ঠিকমতো। বেশিরভাগ সময়েই যখন আমার সাথে কেউ কথা বলতে আসে, খুঁজে পাই না যে কি বলবো।

জানি, যখন আমি আমতা আমতা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করি, তখন কল্পনায় পুরনো নামির ছবি ভাসে তাদের। সবসময় তুলনা করে। চাইলেও ব্যাপারটা খেয়াল না করে পারি না। এরপর মনে হয় যে সেখানে আমার জায়গায় পুরনো নামি থাকলে কতই না ভালো হতো।

ক্যালেন্ডারের দোলনাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এসব কথা ভাবতে লাগলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে দোলনায়।

সবকিছু গোছগাছ করে ফেলতে হবে মা ফিরে আসার আগে। সেই লক্ষ্যে ক্যালেন্ডারটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে গিয়ে থমকে গেলাম। প্রথম প্রথম বুঝতে পারলাম না যে কেন থমকে গিয়েছি, কিন্তু যখন বুঝলাম, ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ডের মাঝ বরাবর।

ক্যালেন্ডারের দোলনাটা তো খালি ছিল। কিন্তু এখন দেখছি একটা মেয়ে বসে আছে সেখানে।

গুঙিয়ে উঠে মুখের বাম দিকে হাত দিলাম। স্বাভাবিকের চেয়ে গরম ঠেকলো জায়গাটা। বাম চোখের ওপর দিকটা থেকে থেকে লাফাচ্ছে।

ক্যালেন্ডারের দোলনাটা নড়ে উঠলো এসময়। নিজেকে বোঝানোনার চেষ্টা করছি যে ব্যাপারটা অসম্ভব, এসময় আবারো নড়ে উঠলো ওটা।

বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, ভেবেছিলাম অন্ধকার নেমে আসবে চোখে। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। চোখ বন্ধ করার পরেও মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বলা যায় এখন আরো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। তবে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। শুধু আমার বাম চোখই দেখতে পাচ্ছে দৃশ্যটা। ডান চোখ বন্ধ করে শুধু বাম চোখটা খুললাম; হ্যাঁ, দোলনার মেয়েটা আছে।

নিজেকে প্রবোধ দিলাম যে এটা হয়তো দিবাস্বপ্ন। কিন্তু কিসের কি! ছবিটা আরো পরিষ্কার, প্রাণবন্ত হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা পার্কে।

হাত দিয়ে বিছানার চাদর চেপে ধরে নিশ্চিত হলাম যে এখনও হাসপাতালেই আছি। মেয়েটা ধীরে ধীরে নেমে পড়লো দোলনাটা থেকে। বয়স একদমই কম মেয়েটার, প্রাইমারি স্কুলেও পড়ার বয়স হয়নি বোধহয়। তবে চুলগুলো বেশ লম্বা।

দোলনাটা বেশ পুরনো। দুপাশের শেকলে মরিচা ধরতে শুরু করেছে। পার্কের পেছন দিকে বেশ ঘন একটা বন দেখা যাচ্ছে।

বাঁ চোখের স্বপ্নটা পাল্টে যেতে শুরু করলো এসময়, সেই সাথে স্বপ্নে আমার দেহাবয়বও পাল্টে গেল। যদিও আমি জানি যে সেটা সম্ভব না। হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে এল মেয়েটা।

এরপর ঢেউ যেভাবে একসময় মিলিয়ে যায় নদীতে, ঠিক সেভাবে স্বপ্নটাও মিলিয়ে গেল। এখন আবারো আগের মত দেখাচ্ছে ক্যালেন্ডারটা। ফাঁকা একটা দোলনা শোভা পাচ্ছে সেখানে।

বমি বমি লাগছে। কি ছিল এটা? স্বপ্ন? ভ্রম? নাকি অন্যকিছু? যখনই ভাবলাম যে দোলনাটা একবার নড়ে উঠেছে, অমনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো আমার বাঁ চোখ।

আবারো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকালাম। স্বপ্নে যা যা দেখেছি তার চেয়ে বেশ কিছু ফারাক চোখে পড়লো এবারের ক্যালেন্ডারে যে দোলনাটা আছে, সেটার শেকলে কোন মরিচা নেই। পেছনে সমুদ্র।

এসময় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো মা।

অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লাম আমি। একবার মনে হয়েছিল ক্যালেন্ডারটা সাথে করে বাসায় নিয়ে আসবো, কিন্তু কিছু বলার সাহস হয়নি।

স্বপ্নে দেখা মেয়েটার হাসি এখনও ভাসছে মানসপটে। ভীষণ আন্তরিক একটা হাসি। খুব প্রিয়জনদের মুখে এ ধরনের হাসি দেখা যায়। এক অচেনা উষ্ণতায় ভরে উঠলো বুকটা। স্মৃতি হারানোর পর থেকে এই প্রথম এরকম অনুভূত হলো।

হাসপাতাল থেকে বেরুনোর সময় আমার চোখে পানি দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেল মা। “কাঁদছো কেন?” সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না। ঐ অচেনা মেয়েটার হাসি আসলেও বেশ বড়সড় প্রভাব ফেলেছে আমার মনের পর। কিরকম খারাপ একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে।

*

হাসপাতাল থেকে ফিরে আবারো পুরনো রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। স্কুলে যাই, ক্লাস করি। কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তা হয়না। মোটামুটি একাই সময় কাটে।

দুর্ঘটনার পর প্রথমবার যখন জ্ঞান ফেরে, সবকিছু বড় বিভ্রান্তিকর ঠেকছিল আমার কাছে। আশপাশের সবার আলাপচারিতা শুনে যাচ্ছিলাম কেবল। কিছু না ভেবে বা না অনুভব করেই মাথা নাড়ছিলাম। কিন্তু অপারেশনের পর সেটা বন্ধ করেছি। এখন মোটামুটি পরিস্থিতি বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি।

ক্লাসে আমার ডেস্কে বসে পুরনো, আদর্শ নামির কথা জিজ্ঞেস করলাম। নতুন চোখ প্রতিস্থাপনের পরেও খুব একটা সুবিধে করতে পারছি না।

“পুরনো নামি সবার সাথে মজার মজার কথা বলতে, সবাইকে হাসাতো। তোমার মত মুখ গোমড়া করে বসে থাকতো না।”

আসলেও কি এরকমটা করতাম আমি?

“হ্যাঁ, তোমার থেকে পুরো অন্যরকম ছিল সে। অন্য সবকিছুতেও ভালো ছিল। তোমার জন্যে ভলিবল ম্যাচে হেরে গেছি আমরা। পুরনো নামি হলে চাপ দিয়ে প্রতিপক্ষ দলের বারোটা বাজিয়ে দিত।”

ভলিবল কোর্টে চারপাশে অন্যান্য মেয়েরা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে একা মনে হচ্ছিল। এতবার ভুল করি যে কেউ আমার হাতে বলই দিতে চাচ্ছিলো না। চোখে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিল বারবার। যেন আমি কোর্ট থেকে বের হয়ে গেলেই বাঁচে।

দুই ক্লাসের মাঝে বিরতি চলছে এখন। চারিদিকে হইচই। নিজের ডেস্কে চুপচাপ বসে পরবর্তী ক্লাসের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই বিরতিগুলোয় নিজেকে বড় বেশি একা লাগে। নিজের জন্যে নিজেরই করুণা হয়।

চোখ বন্ধ করে হাসপাতালের দেখা সেই মেয়েটার কথা কল্পনা করলাম। আমার উদ্দেশ্যে তার দেয়া উষ্ণ হাসিটা এখনও কিছুটা মানসিক শান্তি জোগায় মনে। তাকে যেন অনুভব করতে পারি। ওরকম অন্ধকার জগতে একদম একা, ভাবতেই বুকের বাঁ পাশটা মোচড় দিয়ে উঠলো। একাকী লাগলেই স্বপ্নটার কথা ভাবি, কিছুটা প্রশান্তি ভর করে চিত্তে।

মেয়েটা কে ছিল আসলে? আসলেও কি কোন স্বপ্ন দেখছিলাম। সেদিনের পর থেকে আজ অবধি আর কোন স্বপ্ন দেখিনি। যদি আমার ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলোর কিছুটা জড়ো হয়ে আমাকে স্বপ্নটা দেখায়, তাহলে বলতে হবে মেয়েটাকে আমি চিনি। নতুবা স্মৃতিতে সে আসবে কি করে?

মাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, লম্বা চুলের ছোট একটা মেয়ের ব্যাপারে কিছু জানো তুমি? বনের পাশে একটা পার্কে দোলনায় বসে থাকে।

“না,” মাখা ঝাঁকিয়ে বলে মা।

এই উত্তর আশা করিনি। স্মৃতিগুলো যদি আসলেও ফিরে আসতে শুরু করে তাহলে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবো। পুরনো নামি, যাকে সবাই ভালোবাসে, সে আবার ফিরে আসবে।

*

স্কুল থেকে বাসার ফেরার পথে ট্রেন স্টেশনে দ্বিতীয় দিবাস্বপ্নটা দেখলাম। আসলে এটাকে ঠিক দিবাস্বপ্ন বলা যাবে কিনা, নিশ্চিত নই। কারণ স্বপ্নটা দেখার সময় ঘুমোচ্ছিলাম না আমি, পুরোপুরি সজাগ ছিলাম।

প্লাটফর্মের ধারে হলুদ রঙের কিছুটা স্টিকার লাগানো থাকে। এই স্টিকারগুলোর অন্যপাশে যাওয়া নিষেধ। সেরকমই একটা স্টিকার জুতো দিয়ে খোটাচ্ছিলাম। আমার চারপাশে শত শত স্কুল ছাত্রী। প্রত্যেকেই বাড়ি ফেরার ট্রেনের অপেক্ষা করছে। হাইস্কুলের ছেলেমেয়েরা একসাথে জড়ো হয়ে আড্ডা দিচ্ছে, মাঝে মাঝে হেসে উঠছে উচ্চস্বরে। বারবার মনে হচ্ছে যেন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তারা।

ট্রেন আসতে এখনও কিছুটা সময় বাকি।

হঠাৎই খেয়াল করলাম আমার বাম চোখটা গরম হয়ে উঠছে। প্রথমে ভাবলাম মনের ভুল, কিন্তু না, আসলেও গরম হচ্ছে। চোখের শিরাগুলো রীতিমত দপদপ করছে, যেন হৃৎপিণ্ডটা কেউ চোখে বসিয়ে দিয়েছে আমার।

নিজেকে শান্ত করে যা দেখছি সেটার দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। এখনও রেললাইনের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে যে রেললাইনটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম সেটা ছিল চকচকে। কিন্তু এখন যেটা দেখছি, যেটা বাদামি মরিচায় জীর্ণ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করবো। চোখ বন্ধ করে নিলাম, হাসপাতালের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এতে আরো পরিষ্কার দেখতে পাবো স্বপ্নটা।

রেললাইনটা বেঁকে গেছে মনে হলো। যেন ঘাড় কাত করে নিয়েছি আমি। আমার চোখের সামনে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্লাটফর্ম এখন। আকাশ দেখে বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যা নামবে কিছুক্ষণের মধ্যে। একটা বনের মাঝে আমি, চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ।

নিচে সবুজ, ডানে সবুজ, বামে সবুজ, সামনে সবুজ, পেছনে সবুজ। ট্রেনের একটা জীর্ণ বগি নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে বনের মাঝে। দীর্ঘ সময় ধরে পরিত্যক্ত, এটা স্পষ্ট। একটা জানালাতেও কাঁচ নেই। ছাদে ঘাস জন্মেছে। ধীরে ধীরে বনটার অংশ হয়ে যাচ্ছে ট্রেনটা। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় চকচক করছে গাছের পাতাগুলো। গ্রীষ্মকাল বোধহয়।

দৃশ্যটা এত সুন্দর যে দম আটকে গেল এক মুহূর্তের জন্যে। এরকম গভীর কোন বনের স্মৃতি নেই আমার। সীমাহীন দিগন্তেরও কোন স্মৃতি নেই। গত সতের বছরে এরকম কিছু দেখেছি বলে মনে হয় না। সবকিছু একদম নতুন আমার জন্যে। মনের খালি পাতায় চিরদিনের জন্যে আঁকা হয়ে গেল গোটা দৃশ্যটা।

এই স্বপ্নটাও আগের স্বপ্নটার মতনই। আধ-স্বচ্ছ। কেবল বাম চোখ দেখতে পাচ্ছে। ডান চোখ এখনও আগের প্লাটফর্মটাই দেখছে। যেরকমটা ভেবেছিলাম, আমি বাদে আর কারো চোখে পড়ছে না পুরনো বগিটা। ডান চোখ দিয়ে দেখলাম এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক নিবিষ্ট মনে খবর কাগজে পড়ছেন।

বাম চোখের দৃষ্টির সাথে সাথে ট্রেনটাও নড়ছে। পরীক্ষার জন্যে ডানে বামে, উপরে তাকিয়ে দেখলাম। মনে হচ্ছে যেন আমার বাম চোখ এক জায়গায় আর ডান চোখ আরেক জায়গায়।

এসময় হঠাই বগিটার জানালায় কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ের মুখ দেখতে পেলাম। এরা কি বগিটা খেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করে? হাতে লাঠি নিয়ে বগিটার গায়ে সমানে বাড়ি দিচ্ছে তারা। তবে কোন শব্দ শুনতে পেলাম না আমি। শুধু দৃশ্যটুকুই। তবুও মনে হচ্ছে যেন আশপাশের বনের পাতার মর্মর ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, ঝিঁঝি পোকার ডাক কানে আসছে।

এসময় নড়ে উঠলো গোটা দৃশ্যটা। নিয়মিত তালে দুলতে লাগলো ট্রেনটা। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম যে আসলে স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে চলেছি বগিটার দিকে। বাস্তবে কিন্তু দাঁড়িয়েই আছি প্লাটফর্মের ওপর। সাবধান থাকতে হচ্ছে, নতুবা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবো নিচে।

ধীরে ধীরে বগিটা বড় হচ্ছে চোখের সামনে। বাচ্চাগুলো এখন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাটি থেকে আমার চোখের যে অবস্থান, স্বপ্নে আমার বয়সও নিশ্চয়ই অনেক কম। হয়তো বাচ্চাগুলোর সমান।

বগিটার কাছে এসে একটা জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলাম পা উঁচু করে। একটা বাচ্চার চোখে স্বাভাবিকভাবেই বিশাল ঠেকছে ট্রেনটা। মরিচার ফাঁক দিয়ে কিছু জায়গায় এখনও রঙ দেখা যাচ্ছে।

এসময় রাগী রাগী চেহারার একটা ছেলে চোখ বড় করে ভেতর থেকে তাকালো আমার দিকে। একটা ছোট্ট হাত উপরে উঠে এলো, আমার নিজের হাত। মানে স্বপ্নে যে বাচ্চাটা ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেছে তার হাত আর কি।

হাত বাড়িয়ে জানালাটা ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। অনেক বেশি উঁচুতে। জানালা দিয়ে যে ছেলেটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম, সে উধাও হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। যখন ফিরলো তার হাতে ছোট একটা পাথর। সজোরে সেটা ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। শব্দ করে চমকে উঠলাম আমি। আমার পাশে দাঁড়ানো লোকটাও চমকে গেল।

স্বপ্নে যে ছেলেটা একটা লাঠি দিয়ে ট্রেনটার গায়ে বাড়ি দিচ্ছিল, সে লাঠিটা ছুঁড়ে মারলো আমার দিকে। আপনা-আপনিই হাত উঠে এলো নিজেকে বাঁচানোর জন্যে।

প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম, বাস্তবেও হাত উঠিয়েছি আমি।

এসময় একটা ট্রেন এসে থামলো সামনে। স্বপ্ন দেখা শেষ। পুরোপুরি বাস্তবে ফিরে এসেছি আবার।

*

বাড়ি ফিরে একটা খালি পাতায় স্বপ্নে যা যা দেখেছি তার বিস্তারিত বর্ণনা লিখে ফেলাম। কয়েকটা ছবিও এঁকে রাখলাম। সেই সাথে স্বপ্নটা দেখার সময় এবং স্থান টুকে নিলাম একপাশে।

আমার সন্দেহ, সামনে এরকম স্বপ্ন আরো দেখতে হবে আমাকে।

প্রথমে দোলনায় ঐ মেয়েটাকে দেখলাম। দ্বিতীয় স্বপ্নে পরিত্যক্ত ট্রেনের বগিটা দেখলাম। পরেরবার কি দেখবো কে জানে। হয়তো এগুলো আমার স্মৃতিশক্তি হারাবার পূর্বের অভিজ্ঞতা। কিংবা আগে দেখা কোন সিনেমার দৃশ্যও হতে পারে।

তবে স্বপ্নগুলোর কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে। যেমন, দু’টো স্বপ্নই নির্দিষ্ট একটা দৃশ্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বাস্তবে রূপ নিয়েছে। দু’বারই আমার চোখের সামনে যা ছিল, স্বপ্নেও সেরকম একটা কিছু ছিল। যেমন প্রথম স্বপ্নে দোলনাটা আর দ্বিতীয় স্বপ্নে রেললাইন। স্বপ্ন আর বাস্তবের দৃশ্যের সমাপতন ঘটা মাত্র বাঁ চোখে চলতে শুরু করে স্মৃতিটা। যেন কেউ রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে সিনেমা চালিয়ে দিয়েছে।

শুধু বাঁ চোখেই স্বপ্নগুলো দেখি। চোখটাকে রীতিমত গুপ্তধনের বাক্সের মত মনে হতে থাকে আমার সোনাদানার পরিবর্তে এই বাক্স ভর্তি উষ্ণ, আন্তরিক সব স্মৃতি দিয়ে। বেশিরভাগ সময়েই অবশ্য বাক্সটা বন্ধ থাকে। ডান চোখের মতই স্বাভাবিক কাজ করে সেটা তখন। কিন্তু এমন কোন দৃশ্য যদি চোখে পড়ে যেটা চাবি হিসেবে কাজ করবে বাক্সটার জন্যে, অমনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

একটা বাইন্ডারে স্বপ্নগুলোর বিবরণ রাখতে শুরু করলাম।

যে স্বত্তার রূপ ধরে স্বপ্নগুলো দেখি, তার বয়স খুব কম। বগির ছেলেটা পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল তার দিকে। এই দৃশ্যের অর্থ বের করতে শার্লক হোমস হতে হবে না। অন্যেরা খেলায় নিতে চাচ্ছিল না বাচ্চাটাকে।

দৃশ্যটা প্রভাবিত করলো আমাকে। সচরাচর স্বপ্ন দেখার কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু এই স্বপ্নটা স্মৃতির মতো জমাট বেঁধে আছে আমার মস্তিষ্কের এক কোণে। স্বপ্নটার কথা ভাবলেই উদাস হয়ে যাই। বাস্তবে ঐ পরিত্যক্ত বগিটা কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। অবশ্য আমার নিজের যেহেতু কোন স্মৃতি নেই, সব কিছুই নতুন ঠেকে।

স্মৃতির অভাব বোধ করি সারাক্ষণ। দুর্ঘটনায় জেগে ওঠার পর থেকে খুব বেশি স্মৃতি জমা হয়নি মস্তিষ্কের কোষগুলোতে। নিউরনগুলো যেন শুষ্ক মরুভূমি, খাঁ খাঁ করছে। স্মৃতি এমন একটা জিনিস যেটা মানুষকে নিজের অবস্থান বারবার মনে করিয়ে দেয়। আর সেই স্মৃতিই যদি না থাকে তাহলে নিজেকে ছিন্নমূল প্রতীয়মান হয় বারে বারে।

কিন্তু এই অদ্ভুত স্বপ্নগুলো সেই বিরান প্রান্তর থেকে উদ্ধার করেছে আমাকে। হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে প্রশান্তির পরশ দিচ্ছে।

*

ট্রেন স্টেশনের স্বপ্নটা দেখেছি এক সপ্তাহ হতে চললো। আমার স্মৃতির জার্নাল ইতোমধ্যে বিশ পাতা ছাড়িয়ে গেছে। যেমনটা ধারণা করেছিলাম, আসলেও একটার পর একটা স্বপ্ন দেখে চলেছি।

বাক্স আর চাবির যে উপমাটা দিয়েছিলাম, সেটাও ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আমি যা দেখি সেগুলো থেকেই কোন কোন জিনিস চাবি হিসেবে কাজ করে। এমনকি টিভি বা খবরের কাগজের ছবিগুলো থেকেও স্বপ্ন দেখতে শুরু করি মাঝে মাঝে।

যে কোন কিছু বাঁ চোখের স্বপ্নের চাবি হতে পারে–একটা দুধের কার্টন কিংবা ছোট্ট কোন বিড়ালছানার চমকে যাওয়া মুখ। প্রতিবার যখন নির্দিষ্ট দৃশ্যটা দেখি, বাঁ চোখ গরম হতে শুরু করে। আমার নিজের ইচ্ছের ওপর কিছু নির্ভর করে না। যে কোন জায়গায়, যে কোন সময় শুরু হয়ে যেতে পারে। তবে দৃশ্যগুলো ছাড়া ছাড়া। একটায় হয়তো ভাঙা কাঁচের ওপর দাঁড়িয়ে আছি একা একা, অন্যটায় কোন কুকুর তাড়া করেছে আমাকে। আবার আরেক জায়গায় স্কুল মাঠে খেলছি। এরকম।

যতই দিন যাচ্ছে, স্বপ্নের সংখ্যাও বাড়ছে।

একদিন ক্লাসে আমার ডেস্কে বসে একমনে তাকিয়ে ছিলাম রাবারের দিকে। এ সময় গরম হতে শুরু করলো বাঁ চোখটা। আসন্ন স্বপ্নের উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করছে। হয়তো অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু স্বপ্নগুলোর দেখার অপেক্ষায় থাকি আমি। মনে হয় যেন পুরনো কোন পারিবারিক ছবির অ্যালবামের সন্ধান পেয়েছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বপ্নটা দেখা শুরু করলাম বাঁ চোখে। চোখ বন্ধ করে নিলাম, যাতে পরিষ্কার দেখতে পাই। স্বপ্নে একটা ক্লাসরুমে বসে আছি। আশপাশে যে বাচ্চারা বসে আছে তাদের দেখে আন্দাজ করলাম এই স্বপ্নে আমার বয়স বারো-তেরো। প্রতিটা স্বপ্নেই বিভিন্ন বয়সে আবিষ্কার করেছি নিজেকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীক্ষা শুরু। টিচার সবার ডেস্কে খাতা আর প্রশ্ন বিলি করছেন। স্বপ্নে একটা কাঠের পেন্সিল ধরে আছি আমি। একটা ছেলের হাত এটা, ইউনিফর্ম দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। নিজের নাম লিখলাম পরীক্ষার খাতায়। কাজুয়া ফুইয়ুতসুকি। এরপাশে হাইস্কুলের নাম।

পাশের বিশাল জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকালাম একবার। মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। তবে জানালার কাঁচে প্রতিফলিত ছেলেটার চেহারা মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। এর আগে কখনো এই চেহারাটা দেখিনি, তবে বুঝতে অসুবিধে হলো না যে স্বপ্নে আমি এই ছেলেটার বাম চোখ দিয়েই সবকিছু দেখি।

এরপরেই মিলিয়ে গেল স্বপ্নটা।

কাজুয়া। নামটা আমার নোটবুকে টুকে নিলাম যাতে না ভুলে যাই। পরীক্ষার খাতায় লেখা হাইস্কুলটার নাম আর আজকের তারিখও লিখলাম। কাগজটা বাইন্ডারে ঢুকিয়ে দিলাম অবশেষে।

সেই রাতে টিভি দেখতে দেখতে বাঁ চোখে স্বপ্নগুলোর কথা ভাবতে লাগলাম।

বাবা এখনও ফেরেনি অফিস থেকে। মার আর আমি একা বাসায়। আমাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা কমছে দিনদিন। মাঝে মাঝে এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় যেন অচেনা কাউকে দেখছে। কথা বলার সামনে নাম ধরেও ডাকে না। শুধু ‘তুমি-তুমি’ করে। সেদিক থেকেও আমাকে আগের নামির থেকে পৃথক করে রেখেছে সে।

রাতের খাবারের পর মনে হলো যে রুমে চলে চাই, কিন্তু মা’র সাথে লিভিং রুমে থেকে গেলাম। রাগ করতে পারে বেচারি। হয়তো আগের নামি’ হতে কখনোই পারবো না, কিন্তু তাকে সঙ্গ দিতে তো দোষ নেই।

টিভিতে হারানো ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। ডিসপ্লের নিচের দিকে ফ্লোটিং প্যানেলে একটা ফোন নম্বর ঘুরছে কিছুক্ষণ পরপর। কারো কাছে যদি কোন তথ্য থাকে, তাহলে সেই নম্বরে ফোন করে জানানো যাবে।

টেলিভিশন বা কোন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত আমার সব স্মৃতি হারিয়ে গেছে। কয়েক মাস হারিয়ে যাওয়া একটা ছেলের ছবি দেখানো হচ্ছে টিভিতে। ক্লাসরুমের স্বপ্নটায় দেখা আমার স্বপ্ন সত্তার ছবিটা ভেসে উঠলো মনের পর্দায়।

স্বপ্নে আমি কাজুয়া নামের একটা ছেলে। তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সবকিছু দেখি। কোন শব্দ শুনতে পাই না, কেবল ছবি। প্রতিটা স্বপ্নেই কাজুয়া যা দেখেছে বা করেছে, সেগুলো অনুভব করেছি। নির্দিষ্ট বিরতিতে অন্ধকার নেমে আসে দৃশ্যগুলোয়। অর্থাৎ চোখের পলক ফেলি তখন।

এমনটা কিন্তু নয় তৃতীয় কারো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরো ঘটনাটা দেখছি। ঘটনা ঘটার সময়ে সেখানে উপস্থিত থাকি।

হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। কয়েকটা স্বপ্নে আশপাশের লোকজনের সাথে কথা বলি আমি, কিন্তু কিছু শুনতে পাই না। সুতরাং তারা কি নামে ডাকে আমাকে, সেটাও বোঝা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন যেহেতু কাজুয়া নামটা জানি, স্বপ্নগুলো আরো বেশি বাস্তব মনে হয়।

“টেবিল পরিষ্কার করে ফেলি, তুমি আরো দেখবে?” মা উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো এ সময়।

না।

একটা মেয়ের ছবি দেখাচ্ছে এখন টিভিতে। গ্রেড স্কুল বা মিডল স্কুলের ছাত্রী হতে পারে সে। ছবিতে বেশ কয়েকজন মেয়ের সাথে রান্না করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। নিশ্চয়ই কোন সামার ক্যাম্পে। অন্যদের চেহারা অবশ্য ঝাপসা করে দেয়া হয়েছে।

হঠাই প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠলো আমার বাঁ চোখ। প্রতিবার স্বপ্ন দেখার আগে এরকমটা হয়। তবে এবার উত্তাপের পরিমাণ অনেক বেশ। দপদপ করছে চোখটা।

এতটাই হতচকিত হয়ে পড়লাম যে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। চোখ বন্ধও করতে পারছি না। স্থানুর মত তাকিয়ে রইলাম টিভির মেয়েটার দিকে। আমার বাঁ চোখের টিভিটা চালু হয়ে গেল এসময়। দরদর করে ঘাম ছুটছে সারা শরীরে। মনে হচ্ছে খুব অশুভ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। এবারে যা দেখবো, সেটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন নয়। দুঃস্বপ্ন।

হঠাৎই টিভি স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেল। মেয়েটার ছবিও নেই হয়ে গেল সেই সাথে। চোখ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরে এলো মুহূর্তে। কাঁপতে কাঁপতে মার দিকে তাকালাম। রিমোট কন্ট্রোল তার হাতে।

“টিভি চালু করে রাখবো?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।

.

সাওরি আর ক্যাফের মালিক কথা বলছে। আমি-মানে কাজুয়া কাউন্টারে

হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কাউন্টারের পাশে একটা ফুলদানিতে কয়েকটা সাদা ফুল। সাওরি আমার দিকে ঘোরার সময় তার হাত লেগে ফুলদানিটা উলটে গেল। ভেতরের পানিতে ভেসে যাচ্ছে কাউন্টার।

স্বপ্নটা এখানেই শেষ। চোখ খুলে হাতের পত্রিকাটা বন্ধ করে রাখলাম। ব্যাগ থেকে একটা নোটবুকের পাতা বের করে স্বপ্নটা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে শুরু করলাম।

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ১০

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : সাওরি, ক্যাফের মালিক।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু: নিজের ঘরে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। পত্রিকার একটা বিজ্ঞাপনের সাদা ফুলগুলো ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : সাওরি কথা বলছিল ক্যাফের মালিকের সাথে। কাজ করতে করতে তার হাতে পুঁতে লেগে একটা ফুলদানি উলটে যায়। ফুলগুলো মাটিতে পড়ে যায়, কাউন্টারে ছড়িয়ে পড়ে পানি। আমার কফির কাপের নিচেও পানি এসে জমা হয়।

*

স্বপ্নতে যে ক্যাফেটা দেখেছি সেটার নাম মেলানকলি গ্রোভ। কাগজটা আমার বাইন্ডারে ঢুকিয়ে রাখলাম। এই জার্নালটায় নিয়মিত লিখছি দুই সপ্তাহ হতে চললো। এই চৌদ্দ দিনে চক্রবৃদ্ধি হারে মোটা হয়েছে জার্নালটা।

সাওরি হচ্ছে কাজুয়ার বড় বোন। ক্যাফেতে খণ্ডকালীন চাকরি করে সে।

বেশ কয়েকটা স্বপ্নে ঘুরেফিরে একই মানুষদের দেখি। কিন্তু কোন শব্দ শুনতে পারি না বলে তাদের নাম জানার কোন উপায় নেই। সাওরির নাম জেনেছি তার ঘরের বাইরের নামফলক দেখে।

সাওরিকে প্রায়ই দেখি আমি। সে আর কাজুয়া যে ভাইবোন, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

কোন কোন স্বপ্নে তার বয়স একদম কম আবার কোনটায় রীতিমত পূর্ণবয়স্ক নারী। আমার দৃষ্টিকোণ ওপর নিচ হতে থাকে স্বপ্নের সাথে সাথে। কিন্তু আমাদের বয়স যা-ই হোক না কেন, প্রতিবার একই রকম আন্তরিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় সে। প্রথম স্বপ্নে দোলনায় যে মেয়েটাকে দেখেছিলাম, সে-ই সাওরি।

বয়সের সাথে তার চুলের দৈর্ঘ্য আর স্টাইলও পরিবর্তিত হয়। কখনো লম্বা, বেনি করা তো কখনো বব কাট। কিন্তু তার চেহারার একটা বৈশিষ্ট্য বলতে গেলে কখনোই বদলায় না। আজ অবধি যতবার তাকে দেখেছি প্রতিবারই বেচারার নাক একদম টকটকে লাল। সবসময় পানি ঝরে।

বাম চোখে প্রায় সময়েই নাক ঝরতে দেখি তাকে। পাশে টিস্যুর পাহাড় জমে যায় মাঝে মাঝে। শপিংয়ে যায় এক বাক্স টিস্যু নিয়ে। ক্যাফেতে খদ্দেরদের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে নাক ঝারে।

এই ব্যাপারটা বাদ দিলে তার চেহারা খুবই সুন্দর। কিন্তু দিনের বেশিরভাগ সময় নাক ঝরতে ঝারতে চলে যায় তার। অন্যরা তার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়?

স্বপ্নে প্রায়ই একসাথে হাঁটতে বের হই আমরা। একসাথে কার্ড খেলি। একবার স্বপ্নে দুই ভাইবোনকে ঝগড়া করতে দেখি। দু’জনের চোখ দিয়েই পানি ঝরছে। নাকের পানি চোখের পানি মিশে একাকার অবস্থা সাওরির।

বেশিরভাগ স্বপ্নেই সাওরি আমার চেয়ে লম্বা, কিন্তু একবার একটা স্বপ্নে কাজুয়াকে লম্বা মনে হয়। অর্থাৎ বড় হয়ে গেছে সে, বোনকে ছাড়িয়ে গেছে। আমার নিজের চেয়েও লম্বা কাজুয়া। এমন একটা উচ্চতা থেকে পৃথিবীটাকে দেখি সেটা আগে কখনো সম্ভব হয়নি।

স্বপ্নের ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে একই এলাকায় সংঘটিত হয়। আশপাশ দেখলেই বোঝা যায় সেটা। মনে হয় যেন কারো দৈনন্দিন জীবনের ভিডিও করে রাখা কিছু অংশ দেখছি। স্বপ্নগুলোকে আপন করে নেই আমি। এগুলো হচ্ছে স্মৃতি-অতীতের টুকরো অংশ। আমার নিজের যেহেতু কোন স্মৃতি নেই, এগুলোই সই।

*

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ১৩

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : সাওরি, আমাদের বাবা-মা।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু : বইয়ের শেলফের রাখা একটা কটন বাড।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : সাওরি আর আমি একে একে মার কোলে মাথা রাখছি (খুব সম্ভবত মিডল স্কুলে পড়ি দু’জনেই)। কটন বাড দিয়ে আমাদের কান পরিষ্কার করে দিচ্ছেন তিনি। সাওরির পালা আসলে একটু দূরে গিয়ে একটা ট্রাক দিয়ে খেলতে শুরু করি। সাওরি মাথা স্থির রাখতে পারছিল না কিছুতেই, বার বার হেসে মাথা সরিয়ে নিচ্ছিল। ওর সর্দিতে মা’র কোল ভিজে গেছে।

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ১৪

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : আমার (কাজুয়া’র) বাবা, তার সহকর্মী।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু : সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাক। স্বপ্নটা দেখতে শুরু করার কারণে রাস্তা পার হতে পারিনি আমি।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : হাতে মোটা গ্লোভস পড়ে একটা কাঠের মিলে কাজ করছিল বাবা। আমার দৃষ্টিকোণ বিবেচনায়, কাজুয়া তখন বেশ ছোট। বাবার পরনের কাপড়ে ছোপ ছোপ তেলের দাগ। ট্রাক ভর্তি মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি। পাশে তার যে তরুণ সহকর্মী দাঁড়িয়ে আছে, তার পরনেও একই পোশাক। বাবার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম আমি, কিন্তু হাত উঠিয়ে আমাকে থামিয়ে দিল সে। মুখ নড়ে উঠলো একবার। যেন বলছে ‘এখানে এসো না। খুব বেশি বিপজ্জনক।’

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ১৫

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : সাওরি, এক মাঝবয়সী দম্পতি।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু বাবার ফেলে দেয়া একটা সিগারেটের মাথা।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : স্বপ্নে অচেনা একটা লোকের বাসায় এসেছি আমি আর সাওরি। লোকটা মাতাল। মহিলার হাত থেকে ট্রেটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সে। বাটি আর গ্লাস উল্টে পড়লো মেঝেতে। সাওরি জড়সড় হয়ে বসে আছে।

*

সাওরি আর কাজুয়া ফুইয়ুতসুকির বসবাস এক পাহাড়ি এলাকায়। অনেকগুলো স্বপ্নেই পাহাড়ি রাস্তায় আবিষ্কার করি নিজেকে। পাশ দিয়ে নেমে গেছে গভীর খাদ।

বাবা-মা’কে নিয়ে চারজনের পরিবার সাওরির। একটা স্বপ্নেও তাদের দাদা-দাদি বা নানা-নানিকে দেখিনি। একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণে পৌঁছুনোর পর স্বপ্নে কাজুয়ার বাবা-মাকেও আর দেখা যায় না। হয়তো অন্য কোথাও চলে যায় তারা।

স্বপ্নে দেখা দৃশ্যগুলোর খুঁটিনাটি টুকে রাখি। ভালো লাগে কাজটা করতে।

প্রায়ই বাবা-মা’র কোলে নিজেকে আবিষ্কার করি। এত ভালো লাগে তখন! উষ্ণতায় মন ছেয়ে যায়। সেই সাথে একরকম অপরাধবোধও কাজ করে। আমার নিজের বাবা-মা’র জন্যে কখনো এই অনুভূতিগুলো খেলা করেনি। তাদের ছেড়ে অন্য একজনের বাবা-মা’র প্রতি এই আন্তরিকতার প্রদর্শনী বিবেকের কাছে ঠিক মনে হয় না।

স্কুলে বা বাসায়, সবসময় একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি কাজ করে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু স্বপ্নগুলো সেই অস্বস্তির হাত থেকে রেহাই দেয় আমাকে। যখন মনে হয় যে বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নের দুনিয়াটাই বেশি টানে আমাকে, এক অচেনা বেদনায় ভরে ওঠে মন।

যখনই মা বা আমার কোন বন্ধু পুরনো নামির ব্যাপারে কথা বলে, খুবই খারাপ লাগে ভেতরে ভেতরে। মিঃ ইওয়াতা বা পূর্ব পরিচিত কেউ আমার সাথে কথা বলতে আসলে তাদের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। তারাও যে আমার প্রতি হতাশ, এ কথা মনে হবার সাথে সাথে পা কাঁপতে শুরু করে। মনে হয় যেন ছুটে পালাই।

“নামি, আজকে ব্ল্যাকবোর্ড মোছার পালা তোমার।”

হ্যাঁ, মুছছি।

কোন সহপাঠীর সাথে এটুকু কথোপকথনেই হাঁপিয়ে উঠি। দিনের প্রতিটা মুহূর্ত কাটে ভয় আর উৎকণ্ঠায়। ঠিকমত কথা বলছি তো? হাসিটা ঠিক ছিল তো? ওদের অসন্তুষ্ট করার মত কিছু করিনি তো? যখনই পিয়ানোর দিকে তাকাই, পরিবারের অন্য সবার সামনে কিছুদিন আগের সেই ব্যর্থতার কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয় চিৎকার করে কাঁদি। ছোটখাটো যে কোন কাজে ভয় লাগে।

জানি, এমনটা ভাবা ঠিক যুক্তিসঙ্গত না। তবুও এরকম ভাবনা এসেই যায় মনে। ইচ্ছে করে চিরদিনের জন্যে কাজুয়ার জগতে চলে যেতে।

আমার পক্ষে আর আগের নামি হওয়া সম্ভব নয়। যতই চেষ্টা করি না কেন, পিয়ানো বাজাতে বা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারবো না। জোর করে টিচারদের পছন্দের পাত্রও হওয়া সম্ভব না।

একটা পর্যায়ে হালই ছেড়ে দিয়েছি।

শুধু এটাই না। দুর্ঘটনার পরে জ্ঞান ফিরে নিজেকে যে অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলাম, তার চাইতে এখনকার আমির অনেক তফাৎ। শূন্য স্মৃতি নিয়ে পুনরায় জীবন শুরু করা কারো পক্ষে এই অল্প ক’দিনে এতগুলো স্মৃতি বহন করা সম্ভব নয়। উপরন্তু স্মৃতিগুলো এমন একজনের যে কিনা বড় হয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলে। আর আমি যে এই শহরের বাইরে আগেও খুব একটা যাইনি এ কথা হলফ করে বলতে পারি।

কুকুর ভয় লাগে আমার। কামড় দেবে এই ভয়ে দূরে দূরে থাকি সবসময়। প্রথম প্রথম বুঝতাম না কেন এমনটা করি।

একদিন মা বলে, “আগে কুকুর কত পছন্দ করতে…”

কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম যে বাম চোখে দেখা একটা স্বপ্নের কারণে কুকুর ভয় পাই আমি। আমার বাইরে একটা স্বপ্নের বর্ণনা অনেকটা এরকমঃ

স্বপ্ন দেখার তারিখ : ফেব্রুয়ারি ২৬

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : একটা বড় কুকুর।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু : স্কুল থেকে আসার পথে দেখি একটা কুকুরকে হাটাতে বের হয়েছে তার মনিব।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : একটা বড় কুকুর ধাওয়া করে আমাকে। ওটা আমার পায়ে কামড় বসাতে যাবে, এমন সময় স্বপ্নটা মিলিয়ে যায়।

*

তখন থেকেই কুকুরভীতি কাজ করা শুরু করে আমার ভেতরে কাজুয়ার ঘটনাগুলো আমার জীবনকেও প্রভাবিত করতে শুরু করেছে।

ক্লাসের মাঝে ইউরি আমাকে বলে, “মনে হয় যেন একদম অন্য কাউকে দেখছি। তুমি আর তুমি নেই। স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করো দ্রুত, নাহলে সবার পেছনে পড়ে যাবে।”

মাথা নাড়ি আমি। আসলেও সবকিছুতে পিছিয়ে পড়ছি। প্রতিটা মুহূর্তে আগের নামির সাথে এমনভাবে তুলনা করা হয় যে মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমার পক্ষে তার প্রতিচ্ছবি হওয়া সম্ভব নয় কোনমতেই।

স্মৃতিশক্তি থাকাকালীন সময়ের একটা ভিডিও আমাকে দেখালো মা। অর্থাৎ পুরনো নামির একটা ভিডিও। তার ধারণা ছিল ভিডিওটা দেখে আমার ভেতরে সুপ্ত স্মৃতিগুলো জেগে উঠবে। বলা বাহুল্য, কাজ করেনি পদ্ধতিটা।

ভিডিওর শুরুতে খুব সুন্দর একটা ড্রেস পরে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে নামিকে। দর্শকদের উদ্দেশ্যে একবার বাউ করে পিয়ানোর সামনে নিপুণ ভঙ্গিতে বসে পড়লো সে। কিছুক্ষণের মধ্যে সুরের মূর্ঘনায় ভরে উঠলো গোটা অডিটোরিয়াম। খুবই সুন্দর একটা সুর। চোখ বন্ধ করে নিলাম। আমার কানের পর্দায় এসে সজোরে বাড়ি খাচ্ছে সুরের তরঙ্গগুলো। নামি আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে পিয়ানো বাজিয়েই চলেছে। অপূর্ব একটা দৃশ্য।

আরেকটা ভিডিওতে দেখা গেল নিজের জন্মদিনের পার্টিতে বন্ধুবান্ধব দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সে। পার্টিটা আমাদের লিভিং রুমে। অনবরত একে অপরের সাথে কথা বলেছে তারা। গত এক সপ্তাহে আমি যা বলেছি, দশ মিনিটের মধ্যে সে তার থেকে বেশি কথা বলে ফেললো। কথা বলে, গালে টোল ফেলে মুচকি মুচকি হাসে আর কিছুক্ষণ পরপর আশপাশের সবার উদ্দেশ্যে বাউ করে।

আনন্দের এক অদৃশ্য বলয় যেন ঘিরে রেখেছে তাকে। ভিডিওর মেয়েটার চেহারা অবিকল আমার মতন হতে পারে হয়তো, কিন্তু সে একদম ভিন্ন একজন মানুষ। নিজেকে নিকষ অন্ধকারে বন্দী মনে হলো আমার।

*

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ২১

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে। আমার বাবা মা। কাঠের মিলে কাজ করছে।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু : হার্ডওয়্যার স্টোরের একটা করাত।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বাবা-মা।

হার্ডওয়্যার স্টোরে স্কুলের জন্যে একটা কম্পাস কিনতে যাই আমি। বিশাল দোকানটার ভেতরে অফিস সাপ্লাই সেকশন খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে আবিষ্কার করি কনস্ট্রাকশন যন্ত্রপাতির সেকশনে।

সেখানেই একটা তাকে গোল একটা করাত রাখা। সেটা দেখা মাত্র আমার বাঁ চোখ গরম হতে শুরু করে। থেমে, করাতটার প্রতি মনোযোগ দেই আমি।

কারো স্পর্শ ব্যতিরেকেই ঘুরতে শুরু করে করাতটা। আমার ডান চোখে দেখা করাতটা আর বাম চোখে দেখা করাত দু’টোর সমাপতন ঘটায় এমনটা মনে হচ্ছে। স্বপ্নটা শুরু হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

স্বপ্নে দেখলাম করাতটার আঘাতে কাঠের গুঁড়ি ছিটছে চারদিকে। সুন্দর করে দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে বড় বড় হোয়াইট বোর্ড। বাবার সাথে কাঠের মিলে এসেছি আমি আবার।

বরাবরের মতনই এই স্বপ্নটাও কেবলই ছবি। কিন্তু ছবিগুলো এতটাই বাস্তব যে মনে হচ্ছে কান পাতলেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাবো। সদ্য কাটা কাঠের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল।

সাধারণত বৈদ্যুতিক করাতের সাহায্যে কাঠ কাটে মিলের কর্মীরা। একটা কুঁড়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখছি আমি। বড় বড় ট্রাকে করে বিশাল কাঠের গুঁড়িগুলো গাদাগাদি করে আনা হয়। ওগুলো নামানোর জন্যে আলাদা জায়গা আছে। আমার দৃষ্টিকোণের উচ্চতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কাজুয়ার বয়স বেশ কম এই স্বপ্নে।

কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমার বাবা-মা একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। মা প্রায়ই বাবার সাথে মিলে দেখা করার সময় আমাকে সাথে করে নিয়ে আসে।

একটা বড় ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বাবা-মা। ট্রাকটার পেছনে বিশাল বিশাল সব গুঁড়ি দড়ি দিয়ে বাঁধা। আমার উদ্দেশ্যে একবার হাত নাড়লো বাবা। তাদের দিকে হাঁটা শুরু করলাম আমি।

এমন সময় কোন প্রকার সতর্কবার্তা ছাড়াই একটা গাছের গুঁড়ি ট্রাক থেকে গড়িয়ে মা-বাবার ওপর পড়ে গেল।

হার্ডওয়্যার স্টোরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই চিৎকার করে উঠলাম। স্বপ্নটা থামিয়ে দিতে চাইছি, কিন্তু এগুলোর ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। চোখ কয়েকবার খুললাম আর বন্ধ করলাম। কিন্তু লাভ হলো না, আমার চোখের সামনেই মঞ্চায়িত হয়ে চলেছে দৃশ্যটা।

আমার স্বপ্ন সত্তা স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিলের এক কোণে। আশপাশ থেকে কয়েকজন মিল কর্মি এসে আমাকে পেছনে সরিয়ে নিল। বিশাল গুঁড়িটার নিচে আটকে পড়া বাবা-মাকে দেখতে পাচ্ছি তখনও। দ্রুত গুঁড়িটা সরিয়ে নেয়া হলো, কিন্তু তাদের কেউই নড়াচড়া করছে না। নিথর পড়ে আছে প্রাণহীন পুতুলের মতন। এজন্যেই কাজুয়ার তুলনামূলক বয়স্ক সত্তার চোখ দিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখি, সেখানে তাদের কোন অস্তিত্ব নেই।

বাবার মাথা থেকে রক্ত ঝড়ছে। পা দু’টো বেঁকে গেছে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে।

স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেল। আবারো স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে পেলাম বাঁ চোখে। হার্ডওয়্যার স্টোরটার মেঝেতে পড়ে আছি আমি। দোকানের এক কর্মী ছুটে আসছে আমার দিকে। চিৎকার শুনতে পেয়েছে সে।

*

মার্চের শেষদিকে ফলো-আপ টেস্টের জন্যে ছোট হাসপাতালটায় ফিরে এলাম আমি। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি কিন্তু মার্চ মাসে আজকেই প্রথম। আমি যেহেতু রাস্তাটা চিনে গিয়েছি তাই একা একাই বাসে চড়ে এসেছি। বাবা মা দুইজনই অবশ্য গাড়ি করে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল।

হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে একবার চারপাশে তাকালাম। শহরতলীর বাইরে ছোট্ট একটা হাসপাতাল। আগে কখনো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি, কিন্তু কি যেন একটা কিলো আমার কাছে। একে তো বাইরে কোন সাইনবোর্ড নেই। দ্বিতীয়ত, প্রবেশপথের কাছে ঘন গাছগাছালির কারণে গেইটটা দেখাই যায় না। কেউ যদি আগে থেকে না জানে যে এখানে একটা হাসপাতাল আছে, তাহলে চোখেই পড়বে না।

ভেতরে প্রবেশ করে জুতো বদলে হাসপাতালের সবুজ স্লিপার পরে নিলাম। ছিঁড়ে যায়নি বা গর্তবিহীন একটা জোড়া খুঁজলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু লাভ হলো না। সবগুলো একই। আমি বাদে ফলো-আপের জন্যে কেউ আসেনি। রিসিপশন ডেস্কে পাথরের মত মুখ করে বসে আছে এক নার্স। বয়স আন্দাজ করা সম্ভব না। শুধু ওয়েটিং রুমটাই না, পুরো হাসপাতালই নিভু নিভু আলোয় আলোকিত।

দোতলার কেবিনটায় থাকাকালীন সময়ে চোখে পড়েনি, কিন্তু এবারে সবকিছু অন্যরকম ঠেকছে। হয়তো আমার পরিবর্তনের ফলাফল এটা।

ডেস্কে বসে থাকা নার্স এক্সামিনেশন রুমে যাওয়ার ইশারা করলো আমাকে। একটা চেঞ্জিং স্ক্রিন, এক্সামিনেশন টেবিল, ডেস্ক আর চেয়ার রাখা রুমটায়।

গোঁফওয়ালা ডাক্তার ডেস্কের পেছনে বসে কিছু কাগজপত্র ঠিকঠাক করেছে। তার উদ্দেশ্যে বাউ করলাম একবার।

একবার আমাকে দেখে আবার হাতের কাগজটার দিকে দৃষ্টি ফিরে গেল তার।

“টেবিলটায় উঠে পড়ো,” বললো সে।

তার কথা অনুযায়ী টেবিলটায় শুয়ে পড়লাম। দৃষ্টি সিলিং বরাবর। ডান পাশে তাকাতেই দেয়ালে ঝোলানো একটা আয়না চোখে পড়লো। সেখানে আমার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।

অপারেশনের দিনের কথা ভাবলাম। এরকমই একটা টেবিলে শুয়ে ছিলাম আমি অপারেশন থিয়েটারে। সেখানেই প্রথম চোখটাকে দেখি, যেটা এখন শোভা পাচ্ছে আমার বাম অক্ষিকোটরে।

এর আগে সে জায়গায় একটা গর্ত ছিল কেবল। চোখটা প্রতিস্থাপনের পর আবারো পুরনো নামির চেহারা ফিরে পাই আমি। কিন্তু মিল বলতে ওটুকুই। আর কোন পরিবর্তন আসে না আমার ভেতরে। মা এখনো আগের মতনই হতাশ।

অপারেশনের পর সে বলেছিল, “এই তো আমার নামির আগের চেহারা।” একবার গালও টিপে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমত চমকে উঠি। খুশিও হই ভেতরে ভেতরে। মা’কে এরকম হাসিখুশিই তো দেখতে চাই সবসময়।

কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় আমাদের সম্পর্ক। যখনই কোন ভুল করে বসি, যেটা আগের নামি হলে করতো না, মা’র মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এখন যেহেতু আমার চেহারা পুরনো নামির মত, তার হতাশার মাত্রা আরো বেড়েছে।

হাতের কাজ শেষ করে কাগজগুলো একপাশে সুন্দরমত গুছিয়ে রাখলেন ডাক্তার। আমাকে পরীক্ষা করা শুরু করবেন শিঘ্রই।

আয়নার দিকে তাকাতেই আবারো গরম হতে শুরু করলো আমার বাম। চোখ, আসন্ন স্বপ্নের ইঙ্গিত। আয়নার প্রতিবিম্বটা স্বপ্নের বাক্সের চাবি হিসেবে কাজ করছে এক্ষেত্রে। অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু স্বপ্নের দেখা নেই। সাওরি বা কাজুয়ার সহপাঠীদের চেহারা ভেসে উঠলো না বামচোখে। এখনও সাদা সিলিংই দেখছি।

না! দ্রুত হয়ে উঠলো আমার স্পন্দন। কি যেন একটা ঠিক নেই। এরপরই বুঝলাম কিরকম অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখছি। আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলেও, আয়নায় আমার প্রতিবিম্বটা তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। নিজেকে আয়নায় এভাবে দেখার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করার মতন না।

আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়লো। বাঁ চোখের দৃষ্টিটা কিছুটা ঘোলাটে ঠেকছে। যেন পানির মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে আছি কোথাও।

হঠাৎই পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। আসলে এক্সামিনেশন রুম না, অপারেশন থিয়েটারটা দেখছি আমি বাম চোখে। আর ওটা অপারেশনের আগমুহূর্তে অপারেটিং টেবিলে শুয়ে থাকা আমি।

বিভ্রান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। এবারে আরো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি সবকিছু। এই দৃশ্যটা স্বপ্নের মত দেখছি কেন আমি? এটা তো কাজুয়ার দেখা কোন দৃশ্য নয়।

অপারেশনের আগের মুহূর্তে কি ঘটেছে তা মনে করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, আসলেই তো! একটা কাঁচের জারের ভেতরে তরলে ভাসছিল চোখটা। তরলের কারণেই ঘোলাটে দেখাচ্ছে সবকিছু।

এগুলো কোন স্বপ্ন নয়, এগুলো হচ্ছে চোখটার স্মৃতি। আমি আজ অবধি যে দৃশ্যগুলো দেখেছি সেগুলো কোন স্বপ্ন বা ভ্রম নয়। চোখটার স্মৃতি সবকিছু। রেটিনায় চিরদিনের জন্যে জমা হয়ে আছে স্মৃতিগুলো।

“তোমাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্যে দুঃখিত। শুরু করি তাহলে?”

আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার। মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে বসলাম আমি। বাঁ চোখে এখনও নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখছি অপারেটিং টেবিলে। এতক্ষণ চেহারার ডানপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম কেবল, এখন বামদিকটাও পরিষ্কার। আর বাম চোখের জায়গায় একটা গর্ত।

.

বাম চোখ দিয়ে এতদিন আসলে কি দেখছিলাম সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবার পর একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম যেন। ডাক্তার সাহেব বোধহয় কিছু প্রশ্ন করলেন আমাকে, কিন্তু কিভাবে সেগুলোর জবাব দিয়েছি জানি না। কিছুক্ষণ পর চেকআপ শেষে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম।

আসার পথে একটা বইয়ের দোকানে থেমে হাইস্কুল এন্ট্রান্স পরীক্ষার কয়েকটা বই খুঁজলাম। অবশেষে একটা বই পেলাম যেখানে দেশের সবগুলো স্কুলের নাম আছে। কাজুয়ার পরীক্ষার খাতায় লেখা স্কুলের নামটা খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়ে গেলাম যা খুঁজছি। কাজুয়ার স্কুলটার অস্তিত্ব আসলেও আছে।

বাম চোখে স্বপ্নটা দেখার আগে কখনো জানতাম না যে এই নামের কোন স্কুলের অস্তিত্ব আছে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে দৃশ্যগুলো সব কল্পনা, অন্য কোন জগতের স্বপ্ন কেবল। কিন্তু এই স্কুলটার অস্তিত্ব আসলেও আছে, আমার নিজের জগতেই।

আমার বাম চোখে দেখা সবগুলো দৃশ্য যদি কল্পনাই হয়ে থাকে, তাহলে এটার ব্যাখ্যা কি? কোথাও কি স্কুলটার নাম শুনেছিলাম, এরপর অবচেতন মনে সেটা নিয়ে ভাবার কারণে স্বপ্নেও দেখেছি? না, এটা বোধহয় সম্ভব না। বরং এতে আরো প্রমাণিত হয় যে বাম চোখে যা দেখেছি সেগুলো পুরোপুরি বাস্তব।

আমার বাম অক্ষিকোটরে প্রতিস্থাপিত হবার আগে চোখটা অন্য কারো ছিল। আমি যে দৃশ্যগুলো দেখেছি, সেগুলো আদতে কাজুয়ার নিজের অভিজ্ঞতা। “স্বপ্নের জার্নাল” নামটা আসলে ভুল দিয়েছি। বরং বাস্তব অভিজ্ঞতার জার্নাল’ নাম দিলেই বেশি মানাতো।

সত্যিটা জানার পর একইসাথে কয়েক ধরনের অনুভূতি কাজ করছে আমার ভেতরে। তবে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে বিভ্রান্তি।

আমি এতদিন ভেবে এসেছি স্বপ্নে দেখা জগতটার কোন অস্তিত্ব নেই। ভাবতাম স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করা মাত্র এক কাল্পনিক চরিত্রের রূপ নেই আমি-কাজুয়া ফুইয়ুতসুকি। স্বপ্নগুলোকে নিজের স্মৃতিতে যত্ন করে সংরক্ষণ করেছি। আর আমার স্মৃতির কুঠুরিগুলো একদম খালি হওয়াতে, এই স্মৃতিগুলোই আঁকড়ে ধরে রেখেছি প্রাণপণে। মনে হয় যেন সবগুলো আমার নিজের অভিজ্ঞতা। নিজেকে নামি কম কাজুয়া ভাবতাম বেশি।

কিন্তু কাজুয়া তো কাল্পনিক কেউ নয়। সাওরি কিংবা বাম চোখে দেখা অন্যান্য দৃশ্যগুলোরও বাস্তব অস্তিত্ব আছে নিশ্চয়ই। এ কারণেই বিভ্রান্তি জেঁকে বসেছে আমার চিত্তে। হঠাৎই ভীষণ ভয় লাগছে। যতক্ষণ এগুলোকে স্বপ্ন ভাবছিলাম, সাওরিকে সিনেমায় দেখা কোন চরিত্র মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এসব হচ্ছে অতীতে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা। বাম চোখটা সেই ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী।

তবে ভয় ছাড়াও আরেক ধরনের অনুভূতির অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। আকাঙ্ক্ষা। ভেতরে ভেতরে আসলে আমিও চাইছি যাতে দৃশ্যগুলো বাস্তব হয়।

এতদিন স্বপ্নে যাদের দেখে এসেছি, তারা পরোক্ষভাবে আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে। আমার নিজের যেহেতু কোন স্মৃতি ছিল না, হতাশার মুহূর্তগুলোতে এই স্মৃতিগুলোর আশ্রয় নিয়েছি।

কিছুটা উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে।

আমি যে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছি, সাওরিও সেই একই পৃথিবীতে চলাফেরা করে। অথচ এতদিন কাল্পনিক মনে হতো সবকিছু। আমার মাথার ওপরে যে আকাশ, সাওরিও মাথা উঁচু করলে সেই আকাশই দেখতে পায়। হয়তো এ মুহূর্তে আমি যেদিকটায় তাকিয়ে আছি, সে-ও একই দিকে তাকিয়ে আছে।

বাম চোখে আমি কাজুয়ার জীবনের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য দেখেছি। স্কুল, ট্রেন স্টেশন, কয়েক জায়গার নাম; আর স্বপ্নগুলোর যাবতীয় খুঁটিনাটি জার্নালে লিখে রেখেছি।

চেক-আপের পরদিন জার্নালটার সবকিছু আবারো মনোযোগ দিয়ে পড়লাম একে একে। কাজুয়া আর সাওরি দেশের কোন প্রান্তে থাকে, সেটা খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগলো না।

আমার শহর থেকে বুলেট ট্রেনে চেপে যেতে আধ দিন সময় লাগবে। একটা অ্যাটলাসে জায়গাটার নাম খুঁজতে লাগলাম। একদম ছোট অক্ষরে লেখা নামটা প্রথমে এড়িয়ে গেলেও, একসময় ঠিকই পেয়ে গেলাম। সমুদ্র থেকে অনেকটা ভেতরে, পাহাড়ি একটা অঞ্চল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম পাতাটার দিকে।

কাজুয়ার বাম চোখ ঐ হাসপাতালে কি করে এলো সেটা জানতে হবে আমাকে। একমাত্র নানার কাছেই আসে সে উত্তর।

কর্ডলেস ফোনটা আমার ঘরে নিয়ে এলাম। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও পুরো নম্বর ডায়াল করতে পারলাম না। সাহসে কুলোচ্ছে না আসলে। এর আগে কেবল একবার নানার সাথে একাকী কথা হয়েছে আমার। কি নিয়ে কথা বলেছিলাম, সেটাও ভুলে গেছি। তার প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো দিতে পারছিলাম না দেখে মনে মনে যে ভীষণ লজ্জিত বোধ করছিলাম-এটা মনে আছে শুধু।

অবশেষে সাহস করে ফোন দিয়েই দিলাম তাকে। কয়েকবার রিং হবার পর নানার কণ্ঠস্বর শোনা গেল অপর পাশ থেকে। আমার ফোন পেয়ে খুশিই মনে হলো তাকে। “তোমার চোখের কি অবস্থা? স্মৃতি ফিরে পেয়েছে নাকি?” তার প্রফুল্ল কণ্ঠস্বর কিছুটা শান্ত করলো আমাকে।

না, স্মৃতি ফিরে পাইনি। কিন্তু চোখ ঠিকঠাক।

কিছুক্ষণ এটাসেটা ব্যাপারে আলাপ করার পর আসলে প্রশ্নটা করলাম।

“চোখটা কোথা থেকে জোগাড় করেছি, সেটা জানতে চাও?” সাবধানী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। “নামি, এটা তোমার না জানলেও চলবে…”

নানা পরিষ্কার করে না বললেও এটা বুঝতে সমস্যা হলো না যে চোখটা ঠিক বৈধভাবে জোগাড় করা হয়নি।

মরণোত্তর চক্ষুদান কর্মসূচির আওতায় চক্ষুদাতা তার চোখ দুটো দান করে দেয়। একটা প্রতিষ্ঠান আছে যারা এসব চোখ সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করে।

আমার নানা তার প্রভাব খাঁটিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানের একজনের মাধ্যমে চোখটার ব্যবস্থা করেছেন। দুর্ঘটনায় চোখ হারানো ব্যক্তির তালিকা অনেক লম্বা। অনেক সময় কয়েক বছর লেগে যায়। উপরন্তু যারা দু’চোখই হারিয়েছে, তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়। নানা যদি বিশেষ ব্যবস্থা না নিতেন তাহলে এত তাড়াতাড়ি চোখটা পেতাম না আমি।

এই চোখটা আসলে অন্য একজনের জন্যে বরাদ্দ ছিল। ভীষণ অপরাধবোধ হলো আমার। মনে হচ্ছে যেন একজনের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছি।

“তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো?” নানাভাই জিজ্ঞেস করলেন।

নাহ… তবে এরকম একটা কাজ না করলেই ভালো হতো। চোখটার সাথে কাজুয়ার স্মৃতিগুলোেও পেয়েছি। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে আমি সৌভাগ্যবান। তবুও… এটা অন্যায়।

হঠাৎই একটা বুদ্ধি মাথায় এলো এসময়। কর্ডলেসটা কানে চেপে বললাম, “একটা অনুরোধ আছে আমার…”

“তোমার জন্যে দুনিয়া হাজির। বলো শুধু…”

আমার নিজের কাছে আইডিয়াটা ভালোই মনে হচ্ছে। কিন্তু নানাভাই করে দিতে পারেন।

“মারা যাবার পর আমি আমার চোখ জোড়া দান করে দিতে চাই।”

কয়েক সেকেন্ড কিছু বললেন না নানাভাই। নিজেরই আফসোস হচ্ছিল আমার কথাটা এভাবে বলে ফেলায়।

কিন্তু পরমুহূর্তেই তার হাসি শুনতে পেলাম ফোনের ওপাশ থেকে।

“নিশ্চয়ই! আমি ব্যবস্থা নেব।”

রক্তিম হয়ে উঠলো আমার দুই গাল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে।

ফোন রেখে দেয়ার পরেও আনন্দের অনুভূতিটা চলে গেল না। মনে মনে নানাভাইকে ধন্যবাদ দিতে লাগলাম বারবার।

*

কাজুয়া মারা গেছে। এটা শতভাগ সত্য কথা। নিশ্চয়ই মরণোত্তর চক্ষুদান ফর্মে সই করে গিয়েছিল সে। এজন্যেই তার মৃত্যুর পর চোখটা আমি পেয়েছি।

সেই চোখের মাধ্যমেই তার ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো দেখেছি। সুখস্মৃতি, দুঃস্মৃতি-সব। তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এমন ভাবে অনুভব করেছি যেন ওগুলো আমার নিজের অভিজ্ঞতা। এমনকি তার আবেগগুলোও মাঝে মাঝে ভর করেছে আমার ওপরে।

এটা ঠিক যে স্বপ্নগুলোয় কোন শব্দ থাকে না। শুধু ছবি। তবুও তার অনুভূতিগুলো ঠিকই আমার অংশ হয়ে গেছে। কাজুয়াকে ভীষণ পছন্দ আমার। তার চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখতে ভালো লাগে। তাই যখন বুঝতে পারলাম যে সে মারা গেছে, খুবই মন খারাপ হলো।

বাবা-মা আর ছোট ভাইকে হারিয়ে সাওরির এখন কি অবস্থা? অ্যাটলাসটা খুলে যে পাতাটায় চিহ্ন একে রেখেছিলাম সেটা দেখতে লাগলাম। এর আগেও এই একই কাজ করেছি বহুবার। আর প্রতিবারই সময়ের খেই হারিয়ে ফেলেছি।

তার সাথে দেখা করতে চাই আমি। জানি না যে দেখা হলে কি বলবো, কিন্তু সামনা সামনি তার চেহারাটা তো দেখতে পাবো। ভাবনাটা জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে রইলো আমার বুকের ওপর।

বাম চোখে যা দেখছি সেগুলো স্বপ্ন নয়, স্মৃতি-এটা জানার পরেও দৃশ্যগুলো নিয়মিত দেখতে থাকলাম বাম চোখে। একদিনে পাঁচটাও দেখেছি একবার। প্রতিবারই আমার বামচোখটা গরম হয়ে ওঠে আর সিনেমার চাকাটা ঘুরতে শুরু করে। একজনের সাধারণ মানুষের জীবনকাহিনি দেখতে থাকি আমি।

তবে একই দৃশ্য দু’বার কখনো দেখিনি। খুবই মনোযোগ দিতে হয় এজন্যে। নতুবা খুঁটিনাটি অনেক তথ্য দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে। সবকিছু যথাসম্ভব মগজে গেঁথে নেই।

স্বপ্নগুলো (এতদূর যখন স্বপ্ন বলেছি, তাই স্বপ্নই বলবো ওগুলোকে) কখনো ক্লান্ত করে না আমাকে। বরং তেষ্টা আরো বাড়িয়ে দেয়। যা যা সম্ভব জানার চেষ্টা করি ওগুলো থেকে। আর প্রতিটা স্বপ্নের সাথে কাজুয়া ও সাওরির প্রতি আমার ভালোলাগার মাত্রাটাও বাড়তে থাকে।

সেই সাথে বাবা-মা আর স্কুলের সহপাঠীদের সাথে দূরত্বটাও বেড়ে চলে প্রতিনিয়ত।

একদিন মা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “সমস্যা কি তোমার? স্কুল থেকে ফোন দিয়েছিল। তুমি নাকি গত কয়েকদিন ধরে অনুপস্থিত।”

এই সময়গুলোতে কফিশপে বসে বই পড়ি আমি। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকি। একদিন সারা বিকেল পার্কের পুকুরে হাঁসগুলোকে খাবার খাইয়ে কাটিয়েছি।

ভীষণ অপরাধবোধ হয় আমার। কিন্তু স্কুলে যেতে বড় বেশি ভয় কাজ করে। তা সত্ত্বেও স্কুলে চলে গিয়েছিলাম একদিন, কিন্তু গেটের কাছে যাওয়া মাত্র পা যেন একশো মণ ওজনের হয়ে যায়। এক পা-ও সামনে এগোতে পারি না।

আমি নিশ্চিত যে নামি কখনো এরকম কোন সমস্যাঁতেই পড়েনি। এক দৌড়ে ক্লাসরুমে ঢুকে গিয়ে সহপাঠীদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠতো সে। কিন্তু সেই ক্লাসরুমে আমার কোন জায়গা নেই। আমার কোনখানেই কোন জায়গা নেই।

“স্কুলে যাও না কেন তুমি?” মা জানতে চাইলো কড়া সুরে। “আগে না স্কুলে যেতে কত পছন্দ করতে?”

কথাগুলো শুনে ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়লাম। মনে হচ্ছে যেন তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, ব্যাপারটা পীড়া দিচ্ছে আমাকে।

মা নামিকে ভোলেনি। আমাকে সহ্যই হয় না তার। সে বোধহয় ভাবে যে বর্তমান আমিকে যদি আপন করে নেয়া হয়, তাহলে আগের নামির অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাবে।

“তোমার কি স্কুল ভালো লাগে না? আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দাও!”

মনে হচ্ছে কেউ যেন দু’হাতে চেপে ধরেছে আমার হৃদয়। তা সত্ত্বেও মনে সাহস জোগাড় করে মার চোখে চোখ রেখে বললাম, “আমি দুঃখিত যে স্কুলে না যাওয়ার ব্যাপারে আগে কিছু বলিনি।”

আমি ঠিকঠাকমতো পড়াশোনার চেষ্টা করেছি। পিয়ানো বাজানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনটাই আর আগের মতন পারি না। এমনকি হাসার চেষ্টাও করেছি। যা-ই করি না কেন, সবকিছুতেই মনে হয় যেন ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। জানি সবাই আমাকে নিয়ে হতাশ। নিজেকে অপদার্থ মনে হয় থেকে থেকে।

কিন্তু ঘরের কাজে তোমাকে যতটা সম্ভব সাহায্য করি। তোমাকে ভালোবাসি আমি, মা। আশা করি তুমিও আমাকে আবার ভালোবাসবে।

কথাগুলো শুনে শীতল চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মা। এরপর একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো খুঁচবার নয়।

*

পরদিন নিজের ঘরটা গোছালাম আমি। ভেতরের আসবাবপত্রগুলোর জায়গা বদলালাম। টিভি আর বিছানা জানালার পাশে নিয়ে আসলাম; এমনকি নতুন পর্দাও কিনেছি। দেয়ালে যে পোস্টারগুলো ঝোলানো ছিল, সব নামিয়ে ফেললাম। আগের নামির সব চিহ্ন মুছে গেল ধীরে ধীরে।

হুটোপুটির শব্দ শুনে ভেতরে উঁকি দিল বাবা। বইয়ের শেলফের একটা খালি জায়গা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ইয়োকিবোর কি হলো?”

ইয়োকিররা হচ্ছে একটা টেডি বিয়ার।

“ওটা আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখেছি।”

“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না! কখনো ভাবিনি যে এই দিন দেখতে হবে,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললো সে। “এসব ভালো লাগছে না আমার।”

একবার মনে হলো যে ভুল করে ফেলেছি। পুরনো নামির মত করে আবার ঘরটা গুছিয়ে দেব নাকি সে চিন্তাও করতে লাগলাম।

আমতা আমতা করে জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি এসময় বাবা আমার ডেস্ক থেকে বাইন্ডারটা উঠিয়ে নিল। পাতা উল্টিয়ে বললো, “এটা কি?”

ঐ বাইন্ডারটার ভেতরেই কাজুয়ার জীবনের বিস্তারিত লিখেছি আমি।

ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠলেও মুখটা স্বাভাবিক রেখে বললাম, “এটা হোমওয়ার্ক।”

সাথে সাথে আগ্রহ হারিয়ে বাইন্ডারটা আমাকে ফিরিয়ে দিল বাবা। ওটা হাতে পেয়ে কিছুটা সাহস পেলাম। স্মৃতিগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে মাথা উঁচু করে বললাম, “বাবা, এই ঘরটা আমি নতুন করে সাজাতে চাই। পুরনো নামির কোন জিনিসটা ভালো লাগতো, সেসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই।”

কিছুক্ষণ আমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবলো বাবা। এরপর মাথা নেড়ে বললো, “সেটাই ভালো হবে বোধহয়।”

*

সেদিন বিকেলে লাইব্রেরিতে গেলাম কাজুয়ার মৃত্যুর ব্যাপারে কোন খবরের কাগজে কিছু ছাপা হয়েছে কিনা সেটা দেখতে।

সে কিভাবে মারা গেছে তা জানি না। এটাও জানি না যে কবে মারা গেছে। তাই অন্ধের মত খবরের কাগজ উল্টে কিছুই পেলাম না।

সিটি লাইব্রেরিতে গত তিন বছরের খবরের কাগজ জমিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সেই পাতাগুলোয় ঠিক কি খুঁজবো তা তো জানি না। তাই বিশাল শেলফটার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কবে মারা গেছে কাজুয়া? ভাবতে লাগলাম।

কেউ যদি চক্ষুদান ফরমে সই করে যায়, তবে তার মৃত্যুর পরপরই মৃতদেহ থেকে চোখজোড়া তুলে নেয়া হয়। আর সেই চোখগুলোর নতুন মালিক পেতেও খুব বেশি সময় লাগে না। সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতিস্থাপিত করা হয়। তাই ঠিক করলাম যে আমার চোখের অপারেশনের আগের খবরের কাগজ থেকে দেখা শুরু করবো। কয়েক সপ্তাহ কিংবা কয়েক মাস আগের খবর দেখলেই হবে।

অপারেশন হয় ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে। তার আগের দিন থেকে সাবধানে পাতা উলটে দেখে যেতে লাগলাম।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের নাম এবং শোক সংবাদের কলামে যাদের নাম ছাপা হয়েছে ওগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। সবক্ষেত্রেই নামের পাশে একটা সংখ্যা দেয়া, মৃতের বয়স।

কাজুয়া যখন মারা যায় তখন তার বয়স কত হয়েছে তা ভাবার চেষ্টা করলাম। স্মৃতিগুলোতে সাওরির মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়তে দেখিনি কখনো, অর্থাৎ চোখটা তাকে বৃদ্ধ অবস্থায় দেখেনি। এমনকি সাওরিকে মাঝবয়সীও মনে হয়নি কোন স্মৃতিতে। এ থেকে ধারণা করা যায় তুলনামূলক কম বয়সেই মারা গেছে কাজুয়া।

স্মৃতিগুলোতে সাওরিকে সবচেয়ে বয়স্ক অবস্থায় যখন দেখেছি, তখনও তার বয়স খুব জোর পঁচিশের আশেপাশে হবে বলে মনে হয়েছে। আমার হিসেব ঠিক হলে কাজুয়া মারা গেছে বিশের কোঠায়।

দু’ঘণ্টা ধরে লাইব্রেরির খবরের কাগজগুলো ঘেটে চললাম। আমার চোখের ওপর চাপ পড়ছে একটানা ছোট ছোট লেখার কলামগুলো দেখার জন্যে। কিছুক্ষণের জন্যে বিরতি নিলাম একটু পর। একভাবে চিন্তা করলে আমি আমার বাম চোখটাকে নিজের মৃত্যুর খবর খুঁজতে বাধ্য করছি। আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ঠুর একটা কাজ।

পাতা উল্টেই চললাম একের পর এক। কিন্তু কাজুয়া ফুইয়ুতসুকির নাম খুঁজে পেলাম না। এমনটাও হতে পারে যে ইতোমধ্যে যে খবরের কাগজগুলো দেখে ফেলেছি সেগুলোর কোনটায় তার নাম আছে, তবে সে সম্ভাবনা নিতান্তই কম। কাজুয়ার বসবাস ভিন্ন অঞ্চলে, সুতরাং এখানকার স্থানীয় পত্রিকায় তার নাম হয়তো ছাপাই হয়নি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাল ছেড়ে দিলাম এক পর্যায়ে।

খবরের কাগজগুলো নিয়ে বুক শেলফে নির্ধারিত স্থানে গুছিয়ে রাখার জন্যে উঠলাম। একটা নির্দিষ্ট ক্রমানুযায়ী রাখা হয় ওগুলো, তাই জায়গাটা খুঁজে বের করতে হলে আগে।

এমন সময় চোখে পড়লো ছবিটা। শেলফে গাট্টি করে রাখা একটা খবরের কাগজের বান্ডিলে দৃষ্টি আটকে গেল। গত বছরের কাগজ এগুলো।

একটা হারানো বিজ্ঞপ্তি। পাশে নিখোঁজ মেয়েটার ছবি। প্রতিবেদনটা অবশ্য পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। নেহায়েত ভাগ্যের জোরে ছবিটা চোখে পড়েছে। খবরের কাগজটা বের করে আনলাম বান্ডিল থেকে বড় বড় অক্ষরে ‘চৌদ্দ বছরের কিশোরী নিখোঁজ’ লেখা। এর নিচে প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে- গতকাল, হিতোমি আইজাওয়া বান্ধবীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেনি…’

ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হচ্ছে স্কুল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। কোথায় যেন দেখেছি আগে।

হঠাৎই গরম হয়ে উঠলো আমার বাম চোখ। দপদপ করছে। যেন যে কোন মুহূর্তে ফেটে পড়বে।

কিছুদিন আগে মা’র সাথে টিভি দেখার সময়ে একই অনুভূতি হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানেও নিখোঁজ ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে কথা বলছিল সঞ্চালক।

আরে তাই তো! এই মেয়েটার ছবিই দেখেছিলাম টিভিতে। খবরের কাগজের ছবিটা থেকে চোখ সরাতে পারছি না কেন যেন।

বাম চোখের দপদপানি আরো বেড়েছে। মনে হচ্ছে যেন চোখের শিরার রক্তগুলো উল্টোদিকে প্রবাহিত হচ্ছে।

এই স্মৃতিটার সাথে ভয়ঙ্কর কোন কিছুর সম্পর্ক আছে। কি আবোল তাবোল ভাবছি। চোখ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না।

একদম বাচ্চা বাচ্চা একটা চেহারা।

চোখ দুটো নড়ে উঠলো এ সময়।

স্বপ্নটা শুরু হয়েছে। স্মৃতির বাক্স খুলে একটার পর একটা ছবি ভেসে উঠতে শুরু করেছে মনে। এক্ষেত্রে হিতমির ছবিটা ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে। সবসময়ের মতোই, পুরো দৃশ্যটা দেখতে হবে আমাকে।

চোখ বন্ধ করে নিলাম। কাজুয়ার দেখা দৃশ্যগুলো আরো পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠলো।

একটা মেয়ের চেহারা দেখা যাচ্ছে কাজুয়া থেকে কিছুটা দূরে। হিতেমি। জানালার অপর পাশে মেঝেতে শুয়ে আছে সে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একবার চোখের পলক পড়লো মেয়েটার।

আশপাশে একবার তাকালো কাজুয়া। ঘন বনের ভেতরে একটা বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। পশ্চিমা নকশার বাড়িটা নীল ইটে তৈরি। কাজুয়া হয় কোন এক পাশে অথবা বাড়িটার পেছন দিকে দাঁড়ানো।

আবারো হিতোমি আইজাওয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরালো সে। জানালাটা তার পায়ের কাছে, নিচের দিকে। নিশ্চয়ই কোন তলকুঠুরির জানালা। চারকোনা, ময়লা লেগে আছে চারপাশে। ঘরটা বেশ অন্ধকার হওয়াতে খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল বাইরের আলোতে মেয়েটার চেহারা কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে।

মনে অবিশ্বাস নিয়ে স্বপ্নটা দেখে চলেছি আমি। নিখোঁজ মেয়েটা এরকম একটা তলকুঠুরিতে কি করছে? কাজুয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন?

প্রথমে বুঝে উঠতে পারলাম না যে কি ঘটছে। তবে দ্রুত একটা ভাবনা ভর করলো মাথায়। হয়তো হিতোমিকে অপহরণ করে তলকুঠুরিতে আটকে রেখেছে কেউ। আর সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে কাজুয়া ভয়ংকর একটা ব্যাপারের প্রত্যক্ষদর্শী।

নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলাম লাইব্রেরিতে। নড়তেও পারছি না। এখন জানালার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আশপাশের ঝোপঝাড়ে নজর রাখছে। কাজুয়া। মনে হচ্ছে যেন ওর নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছি। সে নিশ্চয়ই ভয়ে ভয়ে আছে যে বাড়ির মালিকের চোখে পড়ে যাবে।

এই বাড়িটা যার, সে-ই কি হিতোমিকে বন্দী করে রেখেছে ভেতরে?

ঝোপগুলো থেকে বাড়ি অবধি সরু একটা নুড়ি বেছানো পথ। বাড়িটা দোতলা। চারদিকের গাছগুলোয় পাতার সমারোহ বেশ কম। অর্থাৎ শীতকাল।

কোন এক পর্যায়ে কাজুয়া পকেট থেকে একটা স্ক্রু ড্রাইভার বের করে এনেছে। হয়তো এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিল ওটা। হাঁটুগেড়ে বসে জানালার চৌকাঠ পরীক্ষা করতে শুরু করলো সে।

মেয়েটাকে এখান থেকে উদ্ধার করতে এসেছে সে।

কিন্তু জানালাটা একটা দেয়ালের সাথে শক্ত করে আটকানো। খোলার মত স্কু নেই। আরেকবার সাবধানী চোখে আশপাশে নজর বুলিয়ে জানালা আর দেয়ালের মাঝে যে সরু জায়গাটা আছে সেখানে ক্রু ড্রাইভারটা প্রবেশ করালো সে। মনে হচ্ছে চাপ প্রয়োগ করে খোলার চেষ্টা করবে।

হঠাই থমকে গেল সে। কিছু একটা নজরে এসেছে। এক সেকেন্ড পর আমিও খেয়াল করলাম ব্যাপারটা।

হিতোমি আইজাওয়া মেঝে থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তবে তার চেহারার এক পাশ দেখা যাচ্ছে এখন কেবল। অন্য পাশটা ঠেস দিয়ে আছে মেঝের সাথে। তার পোশাকগুলোও অদ্ভুত। আসলে সেটাকে পোশাক বললেও ভুল হবে, বরং বস্তা বলা ভালো। এমনভাবে একটা বস্তায় ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে যে শুধুমাত্র চেহারাটাই দেখা যাচ্ছে। গলার কাছটায় বস্তাটা একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা।

কিন্তু বস্তার আকৃতিটা কেমন যেন। হঠাই ভয়ঙ্কর একটা চিন্তা খেলে গেল আমার মাথায়। এতটাই ভয়ঙ্কর যে সেটা বাস্তব কিনা তা ভাবতেও আঁতকে উঠছি। অন্ধকারের কারণে প্রথম দিকে হিতোমির পুরো শরীর দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে বস্তাটায় একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে কোনভাবেই আটানো সম্ভব না। একবার মনে হলো পা দুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে চেপে রেখেছে সে, কিন্তু সেটাও অসম্ভব। কারণ তেমনটা হলে ফুলে থাকতো বস্তাটা। আমার বাঁ চোখ দিয়ে যে মেয়েটাকে দেখছি তার, কেবল শরীরের ঊর্ধ্বাংশটুকুই আছে। এটা কিভাবে সম্ভব? চিন্তাটা প্রচণ্ড অস্বস্তিদায়ক।

একমাত্র তার হাত পা কেটে ফেলা হলেই এভাবে বস্তায় ঢুকিয়ে রাখা সম্ভব। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম।

এসময় ভীষণভাবে নড়ে উঠলো কাজুয়ার দেহ। হঠাৎই জানালাটার কাছ থেকে দৌড়ে পালালো সে। বাড়িটার এক পাশে গিয়ে আত্মগোপন করলো। নীল দেয়ালের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে যেন। এসময় একটা ছায়া দেখতে পেলাম দেয়ালের অন্যপাশটায়। কেউ একজন আসছে।

নিঃশ্বাস নেয়ার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছি।

ধীরে ধীরে পেছনে এগোতে লাগলো কাজুয়া। হাতের ক্রু ড্রাইভারটা পকেটে ঢোকানোর জন্যে নিচের দিকে তাকাল একবার। এসময় দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হতে হলো তাকে। হাত থেকে ছুটে গেল জিনিসটা।

একটা কংক্রিটের তৈরি ড্রেনের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ড্রেনের ঢাকনাটা ভোলা, ভেতরে শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। ক্রু ড্রাইভারটা যদি পাতাগুলোর ওপর পড়তো তাহলে কোন শব্দ হতো না। কিন্তু ভেতরে পড়ার আগে ওপরে কংক্রিটে একবার তো খেল ধাতব অংশটা। স্বপ্নগুলোয় কোন শব্দ শুনতে পাই না, বলেছি আগেই। তবুও আমার মাথায় যেন তারস্বরে বেজে উঠলো সাইরেন।

এবার ঝেরে দৌড় লাগাল কাজুয়া। পেছনের গাছ গাছালির জঙ্গল ফেলে ঢাল বেয়ে নামতে লাগলো। চারিদিকে শুকনো পাতা পড়ে আছে। সেগুলো মাড়িয়ে শব্দের তোয়াক্কা না করেই ছুটে চলেছে সে।

একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখে নিল। এক ঝলকের সেই দৃষ্টিতে মনে হলো কেউ একজন পেছন পেছন ছুটছে। তার চেহারা বা উচ্চতা অবশ্য বোধগম্য হলো না। কিন্তু ধাওয়া করছে, সেটা নিশ্চিত।

শরীর রীতিমত কাঁপছে আমার এখন। শেলফটা ধরে ভারসাম্য রক্ষা করলাম।

গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে তীরবেগে ছুটছে কাজুয়া। মাটি থেকে বেরিয়ে থাকা শেকড়গুলো সাবধানে এড়িয়ে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যেও থামার জো নেই। বনটা যেন শেষই হচ্ছে না। একটা গাছ পেরুলেই, আরেকটা সামনে এসে পড়ছে। চিরকাল এরকমই চলবে মনে হলো।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগলো। ছোট পাতাহীন গাছের বদলে এখন লম্বা লম্বা চিরহরিৎ গাছ চোখে পড়ছে। সেগুলোর ফাঁক দিয়ে দৌড়ে চললো সে।

এ সময় হঠাৎই বাম চোখের দৃষ্টিটা একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল। খাড়া ঢালে নিশ্চয়ই পা হড়কে গেছে কাজুয়ার। গড়িয়ে নিচে পড়তে লাগলো সে। চারদিকে পাতা আর ধুলোর ঝড় উঠেছে রীতিমত। হঠাই বন থেকে খালি জায়গায় বেরিয়ে এলো গড়তে গড়তে। উঠে দাঁড়ালো হাচড়ে পাঁচড়ে। পায়ের নিচে পিচঢালা রাস্তা এখন। সামনে তাকাতেই জমে গেল একদম। একটা সাদা গাড়ি এগিয়ে আসছে ভয়ানক গতিতে। সরে যাবার সময় নেই।

লাইব্রেরিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। বাম চোখের দপদপানি বেড়ে গিয়েছে আবারো।

কাজুয়াকে ধাক্কা দিয়েছে গাড়িটা। কত জোরে ধাক্কা দিয়েছে, সেটা ছবিগুলো দেখে বলা সম্ভব না। কিন্তু এ মুহূর্তে নিথর ভঙ্গিতে রাস্তায় পড়ে আছে সে। একটুও নড়ছে না। দৃষ্টি আকাশের দিকে।

চোখের উত্তাপ কমে এলো এসময়। ধীরে ধীরে স্বপ্নটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু সংঘর্ষের ঠিক পরমুহূর্তে গাড়িটার পেছন দিকে গাছের আড়ালে কাউকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে কাজুয়া, এটা নিশ্চিত।

স্বপ্নটা শেষ হয়েছে অবশেষে। দু’চোখ দিয়ে পানি ঝরছে আমার। নিশ্চয়ই ধাক্কা লাগার পরমুহূর্তেই মারা যায় কাজুয়া। একটা গাড়ির সাথে সংঘর্ষে মৃত্য হয় তার। কিন্তু এটা সাধারণ কোন দুর্ঘটনা না।

হিতামিকে দেখেছিল কাজুয়া। আমার যদি ভুল না হয়, তাহলে হাত পা কেটে ফেলা হয়েছে মেয়েটার। কিন্তু টিভিতে যে ছবিটা দেখিয়েছে সেখানে একদম স্বাভাবিক ছিল সে।

কাজুয়া দেখেছে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে মেয়েটাকে। তাকে বাঁচানোর চেষ্টাও করে, কিন্তু অপহরণকারীর কাছে ধরা পড়ে যায়।

নিষ্ফল এক ক্রোধে ফুঁসতে লাগলাম আমি। যে লোকটা হিতোমিকে অপহরণ করেছে, সে-ই এক প্রকার খুন করেছে কাজুয়াকে। কিন্তু সবাই নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে সে। এই ভাবনাটা রীতিমত অসহ্য ঠেকছে আমার কাছে।

সাওরির কি অবস্থা হয়েছিল খবরটা শোনার পর? কতগুলো স্বপ্নের অকালমৃত্যু ঘটেছে কাজুয়ার মৃত্যুর সাথে?

স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। স্বপ্নটা শেষ হবার পর আমার বাঁ চোখের দৃষ্টি আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন আমার শরীরেরই একটা অংশ ওটা। মনে হচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগে চোখটার গরম হয়ে ওঠা আমার কল্পনা বৈ কিছু নয়।

আমাকে যেতেই হবে জায়গাটায়। হিতোমি আইজাওয়াকে যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে সেই বাড়িটা খুঁজে বের করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *