১. সূর্যোদয় দেখবে বলে

তীর্থযাত্ৰী – উপন্যাস – সমরেশ মজুমদার

সূর্যোদয় দেখবে বলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের তিনজন মানুষ একটি পর্বতচূড়ায় জড়ো হয়েছিল। তাদের ভাষা আলাদা, গায়ের রঙ আলাদা, কিন্তু লক্ষ্য এক দেবদর্শন। সেখানকার ভোরের সূর্য দেখা ঈশ্বর দেখার সমান। এই তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হল একটি মেয়ে। যে জীবনকে দেখেছে নিষ্ঠুর হতে, জীবনের কাঠিন্য যাকে করেছে নির্লিপ্ত। সেও ঈশ্বর দর্শনে এসেছে।

সমুদ্র থেকে অনেক উপরে সেই নির্জনে তিনটে মানুষ তাদের উদ্দেশ্য ভুলে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি শুরু করল মেয়েটিকে নিয়ে। প্রবৃত্তি তাদের নেকড়ে করল।

গোটা পৃথিবীটা তিনটে রঙের দাপটে তটস্থ। সাদা, তামাটে এবং কালো রঙের থাবা চাইছে পৃথিবী দখল নিতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পৃথিবীতে সুন্দর বেঁচে থাকে, থাকবে। এই উপন্যাস তারই প্রতিবিম্ব।

.

এতক্ষণ ঠাণ্ডা হাওয়ায় জিপটা চলছিল স্বচ্ছন্দে। লাট্টুর গায়ে পেঁচানো লেত্তির মতো রাস্তা ধরে তিন হাজার থেকে সাত হাজার ফুট উঠতে কোনো অসুবিধেই হয়নি। সুতরাং খুশ মেজাজে একটু একটু করে আকাশের গায়ে উঠে আসছিল পার্থ।

এই মুহূর্তে মিহি রোদের মশারি চারপাশে টাঙানো। নিচের পাহাড়গুলো পৃথুলা রমণীর মতো গায়ে গা এলিয়ে পড়ে নীলচে ছায়া মেখে। আর আকাশ, স্ত্রৈণ পুরুষের মতো আকাশ ওই পাহাড়ের গায়ে মাথা ঝুঁকিয়েছে যেখানে অসাড়ে গলে যাওয়া যৌবন ঝিরঝিরিয়ে নেমে যাচ্ছে ঝরনা হয়ে। এসব অনেক নিচে রেখে পার্থ উঠে যাচ্ছিল তার জিপে বসে। আর মাঝে মাঝেই তার গলা সুরেলা হবার চেষ্টায় ছিল, এই আকাশে আমার মুক্তি…।

সদ্য তৈরি রাস্তা শেষ হয়েছে রিনটেকে। রাস্তা না বলে যদিও উপায় নেই কিন্তু সাত হাজার ফুট ছাড়াতেই স্টিয়ারিং থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। ছোট ছোট বোল্ডার সাজিয়েছে যারা তারা এর বেশি পারেনি। এখনও পথের গায়ে কিলোমিটারের থাম বসেনি। কিন্তু যেতে হবে চৌদ্দ হাজার সাতশ ফুট উঁচুতে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সানরাইজ স্পট হিসেবে রিনটেক ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়ে গেছে বলা যায়। জিপের পথ তৈরি হলেও এখনও যাতায়াত শুরু হয়নি। পাথুয়া থেকে পায়ে হেঁটে ট্রেকাররা যায় ওখানে। পথে কোনো আশ্রয় নেই, সঙ্গে খাবার নিয়ে হাঁটতে হয়। রিনটেকেও কোনো খাবারের দোকান নেই। কারণ মানুষের বসবাস শুরু হয়নি সেখানে। পি, ডবলু, ডি-এর বাংলো এবং ইয়ুথ হোস্টেল ছাড়া মাথা গোঁজার কোনো ব্যবস্থা নেই।

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়–ব্রেকে চাপ দিতে ককিয়ে থেমে গেল জিপ। ভগবান! একি দেখছে সে? ওর নাম রাস্তা? অসম্ভব। এতক্ষণ যদি ছিল লেত্তির মতো লাট্টুকে জড়ানো, এখন তুবড়ির মতো ফোড়মে উঠে যাওয়া। এই খাড়াই পথে গাড়ি উঠবে? পার্থ পেছন ফিরে তাকাল। না, ফেরার কোনো প্রশ্নই নেই। তাছাড়া জিপের জন্যে যখন পথটা তৈরি হয়েছে তখন নিশ্চয়ই কোনোমতে রিনটেক পৌঁছানো যাবে।

আর তখন থেকেই গোঙানিটা শুরু হলো। নতুন ইঞ্জিন প্রবল প্রতিবাদ করতে করতে জিপটাকে টেনে তুলছে। এই বোল্ডারে সাজানো পথ জিপের চাকা ছাড়িয়ে বড়জোর এক হাত বাড়তি। বাঁক নেওয়ার সময় শরীর এবং মনে যে ঝড় ওঠে তার বিনিময়ে কর্ণের চেয়ে বড় দানবীর হওয়া যায়। প্রতিটি মুহূর্তে নার্ভের ওপর সমানে দুরমুশ চলছে, চারটে চাকা কখনই সমান জায়গায় দাঁড়াবার সুযোগ পাচ্ছে না। এই তিন-চার ডিগ্রিতেও পার্থর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠোঁট দাঁতের তলায়। আর তখনই রোদ নিভল, নিচের খাদ থেকে ঘন নীল কুয়াশাগুলো নেকড়ের মতো জিভ লকলকিয়ে ছুটে এল। পরের বাঁকটা ঘুরতে যেতেই খাদের হা-নিঃশ্বাস থেকে ছিটকে এপাশের পাহাড়ে ঘষটানি খেল জিপ। হঠাৎ পার্থর মনে হলো তার কিছু করার নেই, শেষমুহূর্ত আগত এবং তখনই হাত পনের সমতল পেয়ে কোনোরকমে ইঞ্জিন বন্ধ করে দুই হাতে মুখ ঢাকল স্টিয়ারিং-এর ওপরে। সমস্ত শরীরে এখনও মৃত্যুর ছোঁয়া যেন মরে নি। সমস্ত দেহে কাঁটা জমে আছে, থর-থর করে কাঁপছে হৃদপিণ্ড। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে ছিল নিজের দিকে; যেখানে অন্ধকুয়াশা ছাড়া আর কিছু দেখার নেই।

এমন জানলে কোন্ শালা আসত। একটু ধাত ফিরে পেলে পার্থ চেঁচিয়ে ওই কথাগুলো বলল। খাদের বুক থেকে উঠে আসা পপলার গাছ ছাড়া সেকথা শোনার কেউ নেই এখানে, তবু বলল। কোথাও যে অনেক সময় সঙ্গী, চমৎকার টের পেল না। ওরা বলেছিল রাস্তা খারাপ তবে অসুবিধে হবে না। অসুবিধে না হবার এই নমুনা? মরার আগেই মরে যেতে হয়। এখন আর ফিরে যাওয়ার পথও নেই, গাড়ি ব্যাক করা মানে চিতায় উঠে বসা। এখানে সেটাও জুটবে কি না সন্দেহ। ভাগ্যিস এখনও গাড়ির যাতায়াত শুরু হয়নি নইলে ওপর থেকে একটা এলে। ভাবতে চাইল না পার্থ।

কিছুক্ষণ প্রতিরোধ করেও পারল না সে। এখন নার্ভের যা অবস্থা এটুকু না হলে তার পক্ষে আর স্টিয়ারিং ধরা অসম্ভব। যদিও পাহাড়ে জিপ চালাবার সময় মদ্যপান অবশ্যই নিষিদ্ধ, তবু ঝুঁকি নিতেই হবে। বাস্কেট থেকে পিটার স্কট বের করে দু’ঢোঁক কাঁচা ঢেলে নিল গলায়। আঃ। মুহূর্তেই শরীর গরম। উলেন প্যান্ট এবং উইন্ড চিটারে মোড়া শরীর নিজেই যে ঠাণ্ডা তৈরি করছিল তার দাঁত ভাঙল।

দুই যখন চার হয়েছে তখন পার্থ সতর্ক হলো। তিরতিরে নেশা হয়ে গেছে। এখন জিপ চালানো তার কর্ম নয়। চারপাশ কুয়াশায় আটকানো, সামান্য দূরের জিনিস চোখে ঠেকে না। আপসোসে জিপের গায়ে হেলান দিয়ে সে নিজেকে গালাগাল দিল। কি দরকার ছিল এই পাকামো করার। সেরেফ নায়ক হবার ধান্দার জের এবার টানো। একটা মেয়েছেলে কী বলেছিল, কী ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের চিড়িয়া ঝটপটিয়ে ডানা নাড়ল, কোনো মানে হয়? আচ্ছা, জিপটাকে এখানে ফেলে যদি সে হেঁটে ফিরে যায়! নামবার সময়ে তো কোনো কষ্ট নেই। পরে যে কোনো ভাবে জিপটকে উদ্ধার করা যাবে না হয়। অসম্ভব। হিসেবটা ওকে আরও শীতল করল। পাথুয়া পৌঁছাতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে। আর এই খোলা আকাশের নিচে বিষাক্ত ঠাণ্ডায় চুপচাপ মরে যেতে হবে পৌঁছনোর আগেই।

গত সপ্তাহে ক্লাবে গিয়ে রিনটেকের সঠিক খবর প্রথম জানতে পারে পার্থ। আগে ভাসা ভাসা শুনেছিল কিন্তু খেয়াল করেনি। অসম্ভব ভালো জায়গা, সূর্য নাকি বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে উঠে আসে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এত কাছে যে মনে হয় হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে নিই। বনবিভাগের লোকজন পায়ে হেঁটে কিংবা ঘোড়ায় চেপে বছরে একবার যেত ওখানে। সম্প্রতি একটু নজর দেওয়া হচ্ছে বিদেশিদের উৎসাহ দেখে। কিন্তু ওই চৌদ্দ হাজার ফুট ওপরে পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে ক্লাবের সবাই নারাজ। বোস বলেছিল, সূর্য! হুঁ! আমার বাগানে দাঁড়ালে বিশাল সূর্য দেখা যায়। ওইতো একই জিনিস!

ভার্মা হেসেছিল, ইজ ইট? মিসেস বোসের প্রোটেস্ট করা উচিত।

চল্লিশ বছরের খুকি চোখ নাচিয়েছিল, শ্যুড আই-ই-ই?

ভার্মা খ্যাক খ্যাক করে হেসেছিল, সব সূর্য সমান? একজন লেডির সঙ্গে আর একজন লেডির কোনো তফাত নেই? তাহলে তো বেঁচে থাকাই যায় না।

ওয়েল সেইড! ওয়েল সেইড! চিৎকার উঠেছিল ঘরে উদ্দাম হাসির মিশেল হয়ে। হাত নেড়েছিল বোস, স্ত্রীলোকেদের সঙ্গে সূর্যের তুলনা–।

সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকিয়েছিলেন মিসেস বোস, ডোন্ট বি সিলি। স্ত্রীলোক বলছ কেন? যতসব ছোটলোকি শব্দ, গা ঘিন ঘিন করে ওঠে!

হিয়ার! হিয়ার। উল্লসিত সবাই।

আর তখনই মিসেস মুখার্জির মুখটা নজরে এল পার্থর। অবজ্ঞার হাসিটা চোখে এবং ঠোঁটের কোণে বোলানো। দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায় পার্থর। অথচ এই ভদ্রমহিলার মতো সুন্দরী সচরাচর চোখে পড়ে না। বৃদ্ধ স্বামীটিকে চেনে বেঁধে সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। পার্থর মনে আছে পরিচয়ের তৃতীয় দিনে দেখা হতেই বলেছিলেন, ও পার্থ! কাল সারারাত ঘুমুতে পারিনি। মুখ চোখ কাঁদো কাঁদো।

সে কি! কেন? পার্থ বিচলিত হয়েছিল।

 ড্রিমি! স্বপ্ন! একটা স্বপ্ন আমার ঘুম কেড়ে নিল। ঘোরে কথা বলার ভঙ্গি।

মে আই হেল্প য়ু? খুব আন্তরিক গলায় কথাটা বলেছিল পার্থ। আড়চোখে সে দেখে নিয়েছে বুড়ো ভাম মুখার্জি তখন মিসেস বোসকে ইন্ডিয়ান ফিলজফি বোঝাচ্ছে।

আপনি আবার হেল্প করবেন কি! ঠোঁট মুচড়ে হেসেছিলেন সুন্দরী, যত নষ্টের মূলে তো আপনি!

আমি! আচমকা খাবি খেয়েছিল পার্থ। সেই কৈশোর থেকে যে প্রতিরোধ তা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। তিরটা সব বাধা সরিয়ে মাছের চোখে বিঁধছে।

ইয়েস! খুব সিরিয়াস ভঙ্গি মিসেস মুখার্জির, দেখলাম বিশাল নদীতে আমি একা নৌকোয় বসে আছি। আপনি এসে আমাকে পার করে দিতে চাইলেন। কিন্তু মাঝনদীতে যাওয়া মাত্র ঝড় উঠল, নৌকো ডুবল। আর আপনি খাবি খেতে খেতে চিৎকার করলেন, আমি সাঁতার জানি না। তিন হাজার ঝরনা জড়াজড়ি করে ছুটে গেল ওঁর গলা থেকে। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলেছিলেন, ওফ। হরিবল।

তারপর থেকেই গুটিয়ে গিয়েছিল পার্থ। দেখা হলে ওই হাসি দ্বিতীয়বার চাঁদ হয়ে যায়। নিজেকে বুঝিয়েছিলেন পার্থ, ঝুট ঝামেলায় যেও না। তার জীবনে অ্যাদ্দিন কোনো মহিলা ছায়া ফেলেনি। মহিলা না বলে ও কৈশোর থেকে মেয়েছেলে বলেই এসেছে। এই সমাজে স্ত্রীলোক বললেই যদি ছোটলোকামি হয় তাহলে মেয়েছেলেতে কী দশা হবে কে জানে! ধাপে ধাপে ওঠার সময় একটি বাক্য সে মন্ত্রের মতো জপ করে এসেছে, নারী নরকের দ্বার। ছোটবেলায় কিছু কথা, শব্দ বা গন্ধ আমৃত্যু ভেতরে ভেতরে বেঁচে থাকে। এটাও ছিল। কিন্তু মিসেস মুখার্জিকে দেখার পর ব্রতচ্যুতি ঘটতে যাচ্ছিল। দুদিনেই জেনেছিল ওই বৃদ্ধ ভামটির দুবার স্ট্রোক হয়েছে, ব্লাড-প্রেসারের অবস্থা নড়বড়ে, সুগার ভালোরকমের খারাপ। এইসব সুন্দর গুণ থাকলে কতদিনে পৃথিবীকে ভারমুক্ত করা যায় তার সরল হিসেব করেছিল পার্থ। কিন্তু ওই ঘটনাটির পর সে নিজের আবর্তে ফিরে গেল। জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিল না তবু পেয়ে গেল। মেয়েছেলে-চিন্তা থাকলে কি আর তা পাওয়া যেত?

কলকাতার নিম্ন মধ্যবিত্ত (কথাটা এখন চমৎকার স্ল্যাং) পরিবার থেকে অনেক মেহনত করে সে এখানে উঠে এসেছে। মজার কথা হলো হাজার টাকার চাকরিতে উঠে মনে হয়েছিল আমাদের বংশে আর কেউ এত মাইনে পায় নি। দু-দিন বাদেই দেড় হাজারিদের দেখে বুক জ্বলে গেল। পরিশ্রম আর কপাল যখন তাকে ওই ধাপে নিয়ে এল তখন দুহাজারেরা চোখের সামনে লকলক করছে। এখন তিন হাজারে এসেও অবিরত অশান্তি। সামনে চার, পাঁচ, ছয়, দশ হাজার রাজত্ব করছে। উঠতেই হবে ওই চূড়োয়, কিন্তু চূড়োটা কোথায় তা কেউ জানে না। এই করে করে বড় কোম্পানির দায়িত্ব নিয়ে সে এসেছে পাহাড়তলি শহরে। বিশাল বাংলো, গাড়ি এবং কিঞ্চিত ক্ষমতা সত্ত্বেও মিসেস মুখার্জি ঘুরিয়ে বলে গেলেন সে অপদার্থ। শালা! ওই বুড়ো ভাম কোন্ বীর! তবু জ্বলুনি উপেক্ষা করে নিরাসক্ত হয়েছিল পার্থ।

সেদিন ক্লাবে গিয়ে সে দুবার ডজ খেল। পিছনে যাচ্ছে চোখ, ঠোঁট দুটোয় শব্দহীন ঢেউ এর মোচড়। সেই মোচড়-এর অনেকটাই অর্থ, তুমি একটি ইঁদুর। এসব দেখবে না ঠিক করাও বেঠিক হলো। রিনটেকের প্রসঙ্গ শেষ হওয়ার আগেই সে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করল, ব্যাপারটা এমন কিছুই নয়, আমিই তো যাচ্ছি।

সঙ্গে সঙ্গে সবকটি চোখ সার্চলাইট। বোস বললো, আপনি পাগল হয়েছেন? কি ডেঞ্জারাস রাস্তা, ট্রেকিং-এর অভ্যেস না থাকলে–।

পার্থ সম্রাটের গলায় বলল, আমি জিপে যাব।

তৎক্ষণাৎ চমকানির শব্দ ছড়াল। ভার্মা উঠে এল, ওঃ গড! ডু ইউ ওয়ান্ট টু কিল ইওরসেলফ? ও পথে এখনও জিপ ওঠেনি এবং খুব এক্সপার্ট ড্রাইভার ছাড়া ড্রাইভ করা অসম্ভব। রাস্তার কন্ডিশন জানা যাচ্ছে না জিপ না গেলে। একটা বোল্ডার লুজ থাকলে আর দেখতে হবে না।

মিসেস বোস চোখ ঘোরাল, না না, আমরা আপনাকে হারাতে চাই না।

পার্থ হাসল, আমি তো একা। কিছু হলে কাঁদবার লোক নেই। তাছাড়া ওখানকার ভার্জিন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আমি ছাড়া আর কে দেখবে? কথাটা শেষ করে যার দিকে তাকিয়েছিল তার মুখ ভাঁটার সমুদ্র, দুটো চোখ চড়ায় আটকে থাকা নৌকো। সমস্ত হৃদয় তৃপ্ত হয়েছিল তাই দেখে।

কিন্তু এখন এই প্রায় বিকেলে নিজেকে কুরুক্ষেত্রের শেষ সন্ধেবেলায় একা দাঁড়ানো যুধিষ্ঠিরের মতো মনে হচ্ছিল। সেদিন ওরকম জেদ যদি মনে না আসত! এখন কী দাম যে দিতে হবে ঈশ্বর জানেন।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে নেশাটা সামান্য জুড়লো। পার্থ স্টিয়ারিং-এ বসে ঘড়ি দেখল। দিনের আলো থাকতে থাকতে যে করেই হোক পৌঁছতে হবে। অ্যালকোহলের প্রতিক্রিয়ায় মনে জোর এল, হয়তো সে পারবে। ইঞ্জিন চালু করে জিপটাকে তুলে নিল ওপরে। গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। চাকাগুলো নেহাত নতুন তাই পিছলে যাচ্ছে না। চারপাশে এখন জমাট ফগ তবে একটাই সুবিধে, যত সে এগোয় তত ওরা সরে দাঁড়ায়। সব কটা আলো এই দুপুরেই জ্বেলে নিয়েছে পার্থ। ক্রমশ একটা বেপরোয়া ভাব এল মনে, দুর্ঘটনা হয় হোক কিন্তু সে থামবে না। একটা খাড়াই বাঁক নিতে গিয়ে চাকার তলা থেকে ছোট বোল্ডার ছিটকে চলে গেল খাদের বুকে। প্রচণ্ড দুলুনি খেয়ে জিপের চাকা কামড়ে ধরল রাস্তা। একই জায়গায় পেছনের চাকা পাক খেয়ে উঠে এল ওপরে। পার্থ এখন এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছে না। হয় রিনটেকে পৌঁছাব, নয় খাদে গড়াব। এর মাঝামাঝি যখন কিছু নেই তখন তা নিয়ে ভেবে কী লাভ; মোটামুটি এই মেজাজে চলছিল সে।

কত হাজার উঠেছে হিসেবে নেই, কতটা পথ বাকি তাও জানে না। চলতে চলতে যে ক্লান্তি আসে সেটাও যেন ভোঁতা এতক্ষণে। একটা বাঁক নিতে গিয়ে মনে হলো পাহাড়ের গায়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে কেউ যেন হাত নেড়ে তাকে থামতে বলছে। সামনের পথ ছাড়া অন্য কোনো দিকে নজর দেবার সময় নেই, পার্থ তাকাল না, গাড়ি থামাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি এখানে দানছত্র খুলতে আসি নি যে হাত দেখালেই থামতে হবে।

হঠাৎ ওর মনে হলো নাক এবং হাতের আঙুলগুলো নিঃসাড় হয়ে যাচ্ছে। অথচ জিপের ইঞ্জিনের যে তাত সেটাও তো কিছু কম ছিল না এতক্ষণ। ব্যাগে মাঙ্কি ক্যাপ এবং গ্লাভস রয়েছে। ও দুটো বের করতে গেলে গাড়ি থামাতে হবে, যেটা এই মুহূর্তে কিছুতেই সম্ভব নয়। ক্রমশ মনে হল সে ঠান্ডায় জমে যাবে। জিপ দুর্ঘটনা নয়, এইভাবে চললে আপসেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে।

এই বাঁকটাই যে শেষ বাঁক তা কে জানত। জিপ মুখ ঘোরাতেই পার্থর মনে হলো এ যাত্রায় সে বেঁচে গেছে। মাথার ওপরে আর পাহাড় নেই। এতক্ষণ যাকে পাক দিয়ে উঠতে হয়েছিল তার চূড়োয় জিপ গড়িয়ে চলছে। দুটো ফুটবল মাঠ-এর চেয়ে বেশি নয় যে জায়গা তার নাম রিনটেক। বেশ সমান রাস্তা ঘোড়ার নালের মতো পাক খেয়ে একটু ওপরের কাঠের বাংলোর গায়ে শেষ হয়েছে। জিপ থামিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকল পার্থ। সুন্দর। ছোট্ট হলুদরঙা বাংলোটার চারপাশে নীল ফগ। ডানদিকে আর একটা ঘর যার গায়ে লেখা ইয়ুথ হোস্টেল। পার্থ দেখল, হোস্টেলের দরজা নেই, জানলা নেই, কেমন খাঁ খাঁ করছে। তারপরেই খেয়াল হলো এই যদি রিনটেক হয় তাহলে এখানে কোনো মানুষ নেই। সামান্য প্রাণের অস্ত্বিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাগ খুলে মাঙ্কি ক্যাপ আর গ্লাভস বের করে গলিয়ে নিতে সামান্য আরাম লাগল। হঠাৎ এক ধরনের বুক-উপচানো আনন্দ এল, অনেক উঁচুতে উঠে এসেছে, প্রচুর ধাপ ভেঙে, এবং আপাতত সামনে কোনো পাহাড়ের প্রতিবন্ধক নেই। আঃ কি আরাম! অথচ শেষ সিকি মাইল–! পার্থ চোখ বন্ধ করল। তারপর পিটার স্কটের বোতল থেকে খানিক গলায় ঢালল। শালারা রাস্তাই তৈরি করেনি। দুটো চাকার মাপে পর পর বোল্ডার সাজিয়ে রেখেছে শুধু। কিভাবে চালিয়ে এসেছে তা এখনও মাথায় ঢুকছে না। ওই সময় কোনোরকম বোধশক্তি ছিল না তার। থাকলে আর উঠে আসতে হতো না। কোনোদিকে না তাকিয়ে একরোখা চালিয়ে এসেছে সার্কাসের জিপওয়ালাদের মতো।

ধীরে ধীরে বাংলোর নিচে জিপটাকে নিয়ে এল পার্থ। দরজা খুলে বের হতেই মনে হলো সপাং করে কেউ যেন তাকে চাবুক মারল। আরেব্বাস, পার্থ নিজের দাঁতের বাজনা শুনল, একি ঠাণ্ডা! এক দৌড়ে বাংলোর দরজায় পৌঁছে চিৎকার করলো সে, চৌকিদার!

মুখ থেকে ধোঁয়ার মতো কিছু বের হলো, শব্দটাকে খুব ছেলেমানুষ শোনাল নিজের কানেই। এই খোলা আকাশের তলায় স্থির হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। পা দুটো নাচিয়ে শরীর সচল করার চেষ্টা করে আর একবার চিৎকার পার্থ, চৌকিদার!

এবারও কোনো উত্তর নেই। প্রাণপণে দরজায় আঘাত করতে লাগল সে। এবং তখনি খেয়াল হলো কড়ায় তালা ঝুলছে। হিম চোখে দৃশ্যটা দেখল সে। বাংলোটাকে বন্ধ করে চৌকিদার হাওয়া হয়ে গিয়েছে। অথচ ওরা বলেছিল এখানে লোকটা আঠাশ দিন থাকে। মাইনে এবং খাবার নিতে দুদিনের জন্যে নাকি নিচে নামে। সেই দুদিনের একদিন যদি আজ তাহলে ওরা বলত। কেউ আসে না বলে কেটে পড়েছে লোকটা, সরকারি অর্থ হজম করে কাজে ফাঁকি দেবার চূড়ান্ত উদাহরণ।

কিন্তু তা তো হলো, এখন কী করা যায়! পার্থ ফিরে তাকাল। দূরে ইয়ুথ হোস্টেল এখন আবছা। কিন্তু ওখানে রাতকাটানো অসম্ভব ব্যাপার। আর মিনিট দশেকের মধ্যেই বোধহয় আলো মরে যাবে। যা করার এখনই এই মুহূর্তে করতে হবে। অসহায় চোখে বাংলোটার দিকে তাকাল সে। দরজার পাশের কাচের দেওয়ালে এর মধ্যেই হিম জমেছে। তবু ভেতরের চেয়ার টেবিল দেখা যাচ্ছে। আরামের গন্ধ পেয়ে মুহূর্তেই বুদ্ধি খেলে গেল। তার পকেটে এই বাংলোর রিজার্ভেশন স্লিপ রয়েছে। অর্থাৎ আইনসম্মত অধিকারে আছে এখানে রাত্রিবাসের। কোনো দায়িত্বহীন চৌকিদার কর্তব্যে অবহেলার কারণে সে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে না।

এক দৌড়ে সে জিপের কাছে ফিরে এল। তারপর দরজা খুলে হ্যান্ডেল বের করে নিয়ে এসে সামান্য মোচড় দিতেই খুলে গেল তালাটা। প্রায় লাফ দিয়েই ভেতরে ঢুকে প্রথমে দরজা বন্ধ করলো পার্থ। আর, কী আরাম। চমৎকার গরম হয়ে আছে ঘর। দরজার দিকে তাকাল সে। হয়তো বেআইনি হলো তালা ভাঙা, কিন্তু তা নিয়ে যথেষ্ট তর্ক করা যেতে পারে। একটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো চাপা গলায় অনেকে কথা বলেছে। এখানে আবার মানুষ এল কোত্থেকে? রিনটেকে থাকার মধ্যে তো ওই চৌকিদার। চট করে মুখ তুলে পেছনের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল দরজাটা বন্ধ। তারপরেই ভুলটা ধরা পড়ল। বাইরে কি হাওয়া বইছে? পপলার গাছের পাতার ঘষটানি কি মানুষের চাপা গলার মতো শোনায়! সে সামনে তাকাল। ঘরটার তিনটে দেওয়ালের চারফুট বাদ দিয়ে কাচে ঘেরা। এরমধ্যে ফগেরা উধাও হয়ে গেছে। একধরনের মরে যাওয়া আলোর ছায়া সমস্ত রিনটেকে জড়ানো। কিন্তু তার বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ছ্যাঁত করে উঠল পার্থর। কুমিরের মতো কুচকুচে কালো মেঘ আকাশের এককোণে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। ক্রমশ তার চেহারা জলহস্তীর আকার নিল। পেছনে ধাওয়া করে আসছে বিশাল চেহারার জন্তুরা। পার্থ দেখল রিনটেকের বাইরে কোনো পৃথিবী নেই, কোনো পাহাড়ের বরফচূড়ো দেখতে পাওয়া দূরের কথা আলোর ছায়াটাও সরে যেতে লাগল। ডানদিকের আকাশে গর্জন করে উঠল চাপা মেঘের দল। পৃথিবীর সব আকাশ থেকে যেন মেঘেদের তুলে এনে এখানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আসন্ন যুদ্ধের জন্যে। আর তারপরেই সমস্ত চরাচর ঘন অন্ধকারে মুড়ে গেল।

ঘরের ভেতরেও একফোঁটা আলো নেই। একটা হ্যারিকেন কিংবা মোমবাতি জ্বালা দরকার। পার্থর মনে পড়ল গাড়িতে সবকিছু রয়ে গেছে। বৃষ্টি ফিস্টি শুরু হবার আগেই ওগুলো নিয়ে আসা দরকার। বাইরের দরজাটা খুলতেই বাংলোটা ঝনঝনিয়ে উঠল। হাওয়া এখন উথাল পাথাল করছে, স্পর্শ লাগা মাত্র মনে হলো বরফের নখে কেউ খামছে নিচ্ছে শরীর। কিন্তু ব্যাগটা দরকার। পার্থ অন্ধের মতো পা বাড়াল সামনে। হাওয়ার ঝটকায় একপাশে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিতে চাইল। চোখের সামনে পৃথিবীটা অন্ধ। এত গরম জামাকাপড় তবু শরীরের কোথাও উত্তাপ নেই। অনেকবার হোঁচট খেতে খেতে সে একসময় জিপের কাছে পৌঁছল। দরজা খুলতেই মনে হলো জিপ গড়িয়ে যাবে হাওয়ার টানে। কোনরকমে ব্যাগ আর পিটার স্কটের বোতলটা দুহাতে ধরে হাঁটু দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে জিপের আড়ালে দাঁড়াল। ঘণ্টায় কত মাইল বেগে হাওয়া ছুটছে কে জানে! তবে আর একটু বাড়লে জিপটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর তখনই হুড়মুড় করে কিছু পড়ল বলে মনে হলো তার। সে চকিতে বাংলোর দিকে তাকাল। অন্ধকারে যদিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তবু মনে হলো শব্দটা বাংলোর দিক থেকে আসে নি। এমনও তো হতে পারে ওই পাহাড়ের গা থেকে বাংলোটাকেই উপড়ে নিয়ে গেল হাওয়া! দূর! অ্যাদ্দিন যখন হয়নি তখন আজকের রাত্রেই সেটা ঘটবে কেন? এইসময় টুপ করে একফোঁটা জল মাঙ্কি ক্যাপের ওপর পড়তেই জিপের আড়াল ছেড়ে সে দৌড় শুরু করল। এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে পিটার স্কটের বোতল নিয়ে অন্ধের মতো টলতে টলতে সে যখন বাংলোর খোলা দরজায় পা রাখল ঠিক সেই মুহূর্তেই বৃষ্টি নামল। কোনোরকমে দরজা বন্ধ করে সে মুখ ঢাকল দুই হাতে। ওঃ ভগবান!

কিছুক্ষণ পরে ব্যাগ খুলে হাতড়ে টর্চ খুঁজে পেল পার্থ। বোতাম টিপতেই অন্ধকার কেটে আলোর ফিনকি আছড়ে পড়ল ওপাশের দেওয়ালে। টর্চটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে ঘরের চেহারা দেখে নিল। শুধু টেবিল চেয়ার আর পায়ের নিচে কাঠের মেঝের ওপর দড়ির গালচে ছাড়া অন্য কোনো আসবাব নেই। না, পেছনের একমাত্র কাঠের দেওয়ালে একটা ছবি খুলে গিয়ে কোনোরকমে ঝুলছে। বরফের চূড়ার একটা ঝকঝকে বাঁধানো ফটোগ্রাফ। নিশ্চয়ই দরজা খুলে রাখার সময় হাওয়ার দাপটে ওটা খুলেছে। কিন্তু বাংলোটাকে এবার ভালো করে দেখা দরকার। টর্চের আলো যতই তীব্র হোক পেছনে অন্ধকার থাকে। ব্যাগ থেকে মোটা মোমবাতি বের করতে গিয়ে ঠকঠকিয়ে কেঁপে উঠল পার্থ। এখানে হাওয়া নেই তবু এত শীত করছে কেন? দেশলাই ঠুকে মোমবাতি ধরাতেই সমস্ত ঘরে আলো কাঁপতে লাগল। এক হাতে টর্চ অন্যহাতে মোমবাতি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে চারপাশে তাকাল। ভেতরে যাওয়ার দরজা দুটো। দুটোই বন্ধ তবে ছিটকিনি টানা। মাঝখানের দরজাটা খুললো সে।

ফাইন! শরীরের কাঁপুনি ছাপিয়ে এতক্ষণে খুশি এল। একটা দশ বাই বারো ঘর। পায়ের তলায় কার্পেট। নিভাঁজ বিছানার ওপর চারটে লাল কম্বল, দামী। বালিশের চেহারাটা সুন্দর। দুটো চেয়ার আর একটা স্টিলের টেবিল। পেছনে ড্রেসিং টেবিলের গা ঘেঁষে ওয়ার্ডরোব। বিছানার উল্টো দিকে ফায়ার প্লেস।

মোমবাতিটাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখতে ঘরটা আলোয় ভরে গেল। পার্থর ইচ্ছে হচ্ছিল বিছানায় শরীর এলিয়ে কম্বলগুলো টেনে নেয়। অনেক কষ্টে লোভ সামলালো সে। সারারাত তো সামনে পড়ে, এখনই ঠান্ডার কাছে আত্মসমর্পণ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বিছানায় বসে মনে হলো ওটা কনকন করছে। ঠান্ডায় ভিজে রয়েছে যেন। আর তখনই সে দেখতে পেল ফায়ার প্লেসের ওপরে একটা বড় বোতলে কেরোসিন রয়েছে। তার মানে যদি কাঠ জোগাড় করা যায় তাহলে ফায়ারপ্লেসটাকে চালু করতে অসুবিধে হবে না। ঘরের অন্য দরজাটি খুলে টর্চ হাতে উঁকি মারতেই একটা প্যাসেজ দেখতে পেল সে। টর্চের আলো ফেলে বোঝা গেল অনেকদিন মানুষ বাস করেনি এখানে। চৌকিদারটা থাকলে এসব হ্যাপা পোয়াতে হতো না। ফিরে গিয়ে এমন কমপ্লেন করতে হবে যাতে এরপর থেকে ব্যাটা ফাঁকি দিতে পারবে না।

প্যাসেজের শেষে ছোট্ট দুটো ঘর। একটা টয়লেট, শুকনো। অন্যটা স্টোর। উঁকি মারতেই খুশি হলো পার্থ। একগাদা কাঠ সাজানো রয়েছে। ওপরের তাকে সবরকমের ইউটেনসিলস। পাঁজা করে কিছু কাঠ তুলে ঘরে ফিরে এল পার্থ। টর্চ বগলে চেপে রাখায় অদ্ভুত আলো ছিটকাচ্ছিল দেওয়ালে। কয়েকটা কাঠের টুকরো ফায়ার প্লেসে ঢুকিয়ে সামান্য কেরোসিন ছড়িয়ে দেশলাই জ্বালল সে। দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। খুব দ্রুত লকলকিয়ে উঠল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘরের ঠান্ডা কমল না এক ফোঁটাও। দুটো হাত গ্লাভসশুদ্ধ প্রায় আগুনের ওপরে রাখল পার্থ। কিন্তু তেল পুড়ে শেষ হওয়া মাত্রই শরীরে কিছু ফুলকি রেখে নিভে গেল আগুন। জীবনে কখনও উনুন ধরায়নি, ফায়ারপ্লেস তো দূরের কথা। অসহায় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পার্থ। তারপরেই ব্লোয়ারটা চোখে পড়ল। পাম্প করলেই হাওয়া বের হচ্ছে। আবার কেরাসিন ঢেলে ব্লোয়ার চালাতে আগুনটা কাঠের গায়ে ছড়িয়ে পড়ল। মিনিট পাঁচেকের চেষ্টা সাফল্য এনে দিল পার্থকে। বাঃ, গুড। দাউ দাউ করে জ্বলছে ফায়ার প্লেস। উত্তাপে ভরে যাচ্ছে ঘর। ধোঁয়াগুলো ওপরের গর্ত দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে সেখান দিয়েও হাওয়ার ধমক আসছিল।

আর এ সময় গোঙানিটা শুরু হলো। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আগুন যে আকাশে ঝলসাচ্ছে তা জানলার পর্দার ফাঁক দিয়েও বোঝা যাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে তবে খুব জোরে নয় চোদ্দো হাজার সাতশ পঁচিশ ফুট উঁচুতে এসবের আলাদা মেজাজ আছে। ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে পার্থ পা নাচাল। এখন এই বাংলো তার। আজকের রাতটাকে কীভাবে উপভোগ করা যায়? কম্বল মুড়ি দিয়ে বাইরে বসবে নাকি? ওই ডিমঘরে? মাথা খারাপ! এই ফায়ার প্লেসের মেজাজ ছেড়ে কেউ নড়ে। বাইরের ঘরটা যখন ডিমের মতন তখন চমৎকার নামকরণ করা গেল, ডিমঘর!

এখন একটু মদ্যপান করা যাক। তারপর হট-বক্স থেকে খাবার বের করে পেটে পুরে শুয়ে পড়তে হবে। ভোর সাড়ে তিনটেতে উঠতেই হবে। না হলে এত কষ্ট করার কোনো মানে থাকবে না। সাড়ে তিনটে থেকেই নাকি অন্ধকারের চেহারা পালটায়। পাঁচটার একটু বাদেই সূর্য ওঠার সময়। তার পাঁচ মিনিট আগেই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়োয় আলো পড়ে। পার্থ শুনেছে প্রচণ্ড বৃষ্টি যদি প্রথম রাতে হয়ে যায় তাহলে ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা হাতের তেলের মতো পরিষ্কার। ফায়ার প্লেস যখন জ্বলছে, তখন যত ইচ্ছে বৃষ্টি হোক মাঝরাত পর্যন্ত। এসব ব্যবস্থা তার সূর্য দেখার লগ্নটিকে পাকা করার জন্যে, তাছাড়া কী!

কিন্তু পিটার স্কটের বোতল আনতে ওই ডিমঘরে যেতেই হবে। ব্যাগটাও পড়ে রয়েছে ওখানে। এঘরের উত্তাপ ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু উপায় নেই। দরজা খুলতেই কাঁপুনিটা ফিরে এল। ডিমঘরের কাচে কালো রঙ যেন মোটা করে বোলানো। দৌড়ে বোতল আর ব্যাগ তুলে সে ফিরে এল ভেতরে, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আর ওই ঘরে এরাতের মতো ঢুকছে না সে। বোতলটা খুলতেই খেয়াল হলো জল নেই। গ্লাসে ঢেলে চুক চুক করে খাওয়ার সময় এখন। গ্লাস? মনে পড়ল স্টোর রুমে বাসনকোসনের মধ্যে কয়েকটা গ্লাস দেখেছিল যেন। কিন্তু জল পাবে কোথায়? চৌকিদারকে মনে মনে শাপান্ত করলো পার্থ। শালার চাকরি খেতেই হবে।

বিছানাটা ফায়ারপ্লেসের কাছে টেনে এনে সেখানে আরও কয়েকটা কাঠ ফেলে দিয়ে কম্বলের তলায় ঢুকল পার্থ। তারপর বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোঁক গলায় নিতেই সে সিঁটিয়ে গেল। সর্বনাশ! খাবারের হটবক্স জিপে পড়ে আছে। রোস্ট চিকেন আর পরোটা। খুব যত্ন করে করিয়ে নিয়েছিল সে। কিন্তু এই ঠান্ডায় বৃষ্টিতে ভিজে কে ওই গাড়ির কাছে যাবে? অসম্ভব। নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করেছিল তার। সারাটা রাত না খেয়ে থাকতে হবে। অথচ খাবার আছে তিন মিনিটের দূরত্বে। সে জানলার পর্দার দিকে তাকাল। হাওয়া এবং বৃষ্টি যেন বেড়েই চলেছে। পার্থ তবু আর একবার চিন্তা করল, জিপের কাছে ছুটে যাবে কি না! হটবক্স পেছনের সিটেই আছে। কোনোরকমে দরজা খুলে নিয়ে আসা। গোটা চারেক কম্বলও ছিল সঙ্গে। অবশ্য সেগুলোর এখন প্রয়োজন নেই। পার্থ উঠে দাঁড়াল। ফায়ার প্লেসের আগুনে ঘরটা যতই তেতে থাক কম্বলের বাইরে আসামাত্র শরীর সিরসিরিয়ে উঠল। একটা ওয়াটার প্রুফ সঙ্গে আনা উচিত ছিল! এইসময় দরজার পাশে দেওয়ালের গায়ে নিজের ছায়াকে কাঁপতে দেখল সে।

দূর! দরজা খুলে খোলা আকাশের নিচে যাওয়া মানে যেচে হাড়িকাঠে গলা বাড়ানো। একটা রাত না খেয়ে থাকলে কী হয়! পৃথিবীর কত মানুষ তো দিনের পর দিন না খেয়ে কাটাচ্ছে। অত কথা কি, মা-মাসীমারা তো মাঝেমাঝেই নির্জলা উপোস করেন। এইসব ভাবনা-চিন্তা তার খিদেটাকে একটু একটু করে ভোঁতা করছিল। বিছানায় ফিরে এল সে। আর কাঁচা হুইস্কি খেতে ইচ্ছে করছে না। শুয়ে পড়া যাক। ঘড়ি দেখল পার্থ। ছটা বাজতে পাঁচ! তার মানে এখনও বিকেল চলছে। কে বিশ্বাস করবে?

কম্বলের তলায় শরীর রেখে ও ফায়ার প্লেসের দিকে তাকাল। এত ক্লান্তির পরও ঘুম আসছে না কেন? হঠাৎ তার মনে হলো মিসেস মুখার্জি না থাকলে এখানে তার কখনই আসা হতো না। একটি সুন্দর বাংলোর মালিক সে, কাউকে ভাগ দেবার নেই। আগামীকালের সূর্য কেমন হবে? পাহাড়কে যাঁরা ভালবাসেন তারা বলেন কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় যখন সূর্যের প্রথম কিরণ স্পর্শ করে তখন ঈশ্বর দর্শন হয়। পৃথিবীর যে-কোন মন্দিরের চেয়ে সেটা অনেক বেশি লাভজনক। হঠাৎ পার্থর মন প্রশান্ত হলো। আগামীকালের ভোর তার জন্যে অনুপম নৈবেদ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। এই পৃথিবীর একমাত্র সৌভাগ্যবান হিসেবে সে আগামী ভোরে সূর্যের সামনে দাঁড়াবে। মোমবাতিটা যদি জ্বলে জ্বলে নিভে না যায় তাহলে অগ্নিকাণ্ড হবে। ফায়ার প্লেসের আগুনেই ঘর যখন আলোকিত তখন ওটাকে নিভিয়ে ফেলা যাক। কাজকর্ম সেরে পার্থ বিছানায় ফিরে এল। এখন ঘুম চাই। কম্বলে সমস্ত শরীর ঢেকে সে চোখ বন্ধ করতেই আওয়াজটা শুনতে পেল। ঝড় উঠেছে। এতক্ষণ যা ছিল জোরালো হাওয়া তা ঝড় হয়ে গেল। কিন্তু শব্দটা এখন অন্যরকম হয়ে কানে বাজছে! একটু বেসুরো। এতক্ষণের প্রাকৃতিক আওয়াজগুলোর সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। হঠাৎ পার্থর মনে হলো কেউ নিশ্চয়ই দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে! বিরক্তিতে তার কপালে ভাঁজ পড়ল। এই বাংলোয় কারো আসার কথা নেই। আজ রাত্রের একমাত্র আইনসম্মত মালিক সে। অতএব অন্য কেউ এখানে আসতে পারে না। তার মনে হলো সে ভুল শুনেছে। ওটা হাওয়ারই শব্দ। দরজায় যদি একটু ফাঁক থাকে তাহলে ওরকম শব্দ হবেই। কিন্তু পরের মুহূর্তে সে উঠে বসল। এবার আর সন্দেহ নেই, কেউ দরজা ধাক্কা দিচ্ছে! দূর! এই পাহাড়ে ও আড্ডা মারবে কোথায়? কিন্তু চৌকিদার ছাড়া আর কেউ এখন আসতে পারে না। হঠাৎ বেশ আরাম লাগল পার্থর। লোকটাকে দিয়ে হট-বক্স এবং জল আনিয়ে নিতে হবে।

বিছানা থেকে কম্বলটা টেনে নিয়ে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে টর্চটা তুলে নিল পার্থ। দরজার এসে দাঁড়াতেই আর সন্দেহ রইল না। হাওয়া নয়, মানুষই, হঠাৎ বুকের ভেতর কাঁপুনি উঠলো। ডাকাত নয়তো? এই নির্জন পাহাড়ে কেউ গাড়ি নিয়ে এসেছে দেখে লুঠ করার লোভেও তো আসতে পারে। পরক্ষণেই হেসে ফেলল সে। মিডলক্লাস মেন্টালিটি! ধারে কাছে যখন লোকালয় নেই, হেঁটে আসাও কষ্টকর তখন ডাকাত আসবে কোত্থেকে? এসময় পার্থর নজরে গাড়ির হ্যান্ডেলটা এল। তালা ভাঙার সময় ওটা কাজে লেগেছিল। নিচু হয়ে সেটাকে তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর রাখল সে। প্রয়োজনে এটাকে ব্যবহার করা যাবে। ডিমঘরের দরজায় তখনও শব্দ হচ্ছে। সেই সঙ্গে একটা স্বর, যেন চিৎকার, কিন্তু হাওয়ার দাপটে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

কাঠের দরজার পাশেই কাচের দেওয়াল। ঠান্ডায় ঝাপসা হয়ে রয়েছে। চট করে মুছে নিয়ে উঁকি মারল পার্থ। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে বৃষ্টি খুব জোরে নয়, বড় বড় ফোঁটায় ঝরছে বোঝা গেল। আর তখনই বিদ্যুতের আলোয় রিনটেক ঝলসে উঠল। চকিতে একটা কালো পোশাকপরা মানুষকে দেখতে পেল সে। এবং স্পষ্ট গলার স্বর শুনতে পেল, ওপেন দি ডোর।

একটু ইতস্তত করে দরজা খুললো পার্থ। সঙ্গে সঙ্গে হিম করাত টুকরো টুকরো করে ফেললো তাকে। আর হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো যে তার শরীর থেকে জল ঝরছে। কোনোরকমে দরজা বন্ধ করেই ঘুরে দাঁড়াল পার্থ।

হা-ই সমস্ত শরীরের থরথরানি কাঁপুনি, তবু মেয়েটি হাসবার চেষ্টা করল।

পার্থর দুচোখ বিস্ফারিত। কয়েক মুহূর্ত যেন মুখে বাক্য এল না। এই প্রচণ্ড ঠান্ডাজড়ানো বৃষ্টির সন্ধেতে একটি রক্তমাংসের মেয়ে সশরীর চোদ্দো হাজার ফুট উঁচুতে!

মেয়েটি ততক্ষণে উইন্ডচিটারের ঘোমটা খোলার চেষ্টা করছে, পিঠ থেকে রুকস্যাক নামিয়ে রেখেছে মেঝেয়। চোখাচোখি হতেই বললো, আই ওয়ান্ট শেল্টার, মে আই?

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর যেন একত্রে সাড়া দিল, ও, ইয়েস। সিওর।

মেয়েটি ভেজা উইন্ডচিটারটা এক হাতে ঝুলিয়ে বললো, ইটস টেরিবল! এরকম ব্যাড ওয়েদার আমি কখনও দেখিনি। তুমি নিশ্চয়ই আমার ডাক শুনতে পাওনি? কথাগুলো বলার সময়ে মেয়েটি যেন শিউরে উঠেছিল, ওর দাঁত শব্দ করছে, মুখ সাদা।

দ্রুত ঘাড় নাড়ল পার্থ, না। আমি ভেবেছিলাম হাওয়া।

মেয়েটি মাথা নামাল, থ্যাঙ্কস! দরজাটা খোলার জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু আমার খুব শীত করছে! এখানে কি আগুন নেই? ভেজা চুলগুলো মুঠোয় নিংড়ালো মেয়েটি।

এক হাতে টর্চ জ্বেলে ঘরটায় আলো রাখছিল পার্থ। ঘটনার আকস্মিকতায় তার সব চেতনা যেন অসাড় হয়েছিল, এবার তৎপর হলো, তুমি এসো, এই ঘরে এসো। এখানে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে।

দ্রুত পাশ কাটিয়ে সে শোওয়ার ঘরের দরজাটা পুরো খুলে দিতেই মেয়েটি চলে এল, আঃ। হাউ নাইস! তারপর ছুটে ফায়ার প্লেসের গায়ে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাঁটু গেড়ে বসে দুটো হাত পারলে আগুনের গায়ে ঢুকিয়ে দেয়। পার্থ একটা চেয়ার এগিয়ে দিল ওর পাশে, তুমি নিজেকে পুড়িয়ে ফেলবে।

এবার ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটি হাসল, নো। আমার আরাম লাগছে। আর কিছুক্ষণ বাইরে থাকলেই আমি মরে যেতাম। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ! থ্যাঙ্কস!

পার্থ অগত্যা খাটে গিয়ে বসলো। মেয়েটি হাত পা মুখ সেঁকতে সেঁকতে একটু একটু করে সহজ হচ্ছে। কিন্তু ওর প্যান্টের অনেকটা ভিজে গেছে, চুলেও জল। পার্থ অনুমান করলো ওর বয়স অবশ্যই বাইশের বেশি হবে না। আমেরিকান? ব্রিটিশও হতে পারে। আগুনের আঁচ লাগছে মুখে, টকটকে লাল দেখাচ্ছে গায়ের চামড়া। মাথায় একরাশ সোনালী চুল নেতিয়ে আছে, ভিজে। যখন ঘরে ঢুকছিল তখন পার্থ লক্ষ্য করেছে মেয়েটি মাথায় ওর চেয়ে অন্তত ইঞ্চি চারেক নিচে।

হঠাৎ ঘাড় বেঁকিয়ে মেয়েটি বললো, ইজ দেয়ার এনিবডি হিয়ার?

কাঁধ নাচাল পার্থ, নো।

আই সি! কেয়ার টেকার নেই!

এসে অবধি আমি ওকে দেখিনি। অথচ আমি যখন শহরে এই বাংলো বুক করি তখন ওরা বলেছিল লোকটা এখানে থাকবে। পার্থ বিশদ হলো।

তুমি এই বাংলোটা বুক করেছ?

হ্যাঁ।

বুকিং ছাড়া এখানে থাকা যায় না?

না।

দেন, তোমাকে আর একবার ধন্যবাদ, কারণ তুমি আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছ।

পার্থ চুপ করে থাকল। যেন ধন্যবাদটা সে যুক্তিযুক্ত কারণেই গ্রহণ করল।

মেয়েটি বোধহয় এতক্ষণে পর্যাপ্ত উত্তাপ গ্রহণ করেছে, তাই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল, নাউ আই অ্যাম ইন ওয়ান। ওঃ, আমার জুতোটার অবস্থা দ্যাখো! উবু হয়ে বসে চুপসে যাওয়া কেডস এর ফিতে চটপট খুলে ফেলে সেই দুটোকে ফায়ার প্লেসের ওপর রাখল সে। তারপর দুটো পা পর্যায়ক্রমে আগুনের ওপর তুলে সেঁকতে সেঁকতে বললো, তুমি কি আজই এখানে এসেছ?

হ্যাঁ। পার্থ লক্ষ্য করছিল মেয়েটির পাদুটো শঙ্খের চেয়ে সাদা এবং নিটোল। ওরকম ভিজলে সে কি এত দ্রুত নিজেকে ফিরে পেত? অসম্ভব!

এবার চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে মেয়েটি আগুনে পিঠ দিয়ে পার্থর মুখোমুখি বসলো, আই অ্যাম অ্যানিটা, অ্যানিটা পারলেন। সুন্দর হাসল সে।

আর সেই হাসির রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই পার্থর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল। হাসির সঙ্গে সঙ্গে গালে যে টোল, চোখে যে রঙ খেলে গেল তা যেন এক ধাক্কায় পার্থকে বিরাট খাদের কিনারায় এনে দিল। ওর জিভ শুকিয়ে আসছিল। কোনোরকমে সে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি ব্রিটিশ?

নো! টোকা দিয়ে উচ্চারণ করলো অ্যানিটা, আমেরিকান। তুমি কখন এখানে এসেছ?

বিকেলে।

বিকেলে? কখন রওনা হয়েছিলে? আমি তোমাকে রাস্তায় দেখিনি! আমি অবশ্য শর্টকাট রাস্তায় এসেছি কিন্তু আমার আগে তুমি কি করে পৌঁছবে?

মেয়েটির চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল।

আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি!

ওঃ গড! তাই বলো। ইউ আর নট ট্রেকার!

না।

তাহলে নিশ্চয়ই তুমি খুব বড়লোক!

 এবার মাথা নাড়ল পার্থ, না। আমি একটা ভালো চাকরি করি।

মেয়েটি চোখের তলা দিয়ে দেখলো, তোমার মধ্যে হঠাৎ কিছু চেঞ্জ হয়েছে!

চেঞ্জ! পার্থ চমকে উঠে প্রাণপণে সহজ হতে চাইল, কই না তো।

তোমার মুখ বলছে। আমি আসায় তুমি কি ডিস্টার্বড বোধ করছ?

নো, নেভার।

কিন্তু দরজা খোলার পর তুমি এখনকার তুমির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য। আমার মনে হচ্ছে তুমি খুশি হওনি। কিন্তু আমি হেল্পলেস, ওরা আমাকে সত্যি কথা বলেনি। অ্যানিটা কাঁধ নাচাল। এখন ওর শরীরে পুরো হাতা পুলওভার, গলায় মাফলারের মতো জড়ানো কিছু। সেটা বোধহয় ভিজে অনুভব করে অ্যানিটা খুলে ফেললো, আমার সোয়েটারেও বোধহয় জল লেগেছে।

পার্থ সহজ গলায় বললো, তুমি আসায় আমি খুশি হয়েছি। একা থাকতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। কথা না বলে কতক্ষণ থাকা যায়!

আবার হাসিতে উজ্জ্বল হলো অ্যানিটা তাহলে এখনও নাম বলোনি কেন?

পার্থ সহজ হলো, পার্থ।

পাতর।

 নো। পা-র থো।

পার তো।

ওয়েল, অনেকটা কাছাকাছি।

আর একবার উচ্চারণ করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে হাত বাড়াল অ্যানিটা, গ্ল্যাড টু মিট ইউ। কল মি অ্যান।

করমর্দনের সময় পার্থর রক্তচলাচলের গতি বেড়ে গেল। প্রাণপণ নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করছিল সে। কিছু একটা বোকার মতো করে ফেললে পরে আফসোস করতে হবে।

এবার অ্যান অনেক সহজ হয়ে বললে, এগুলো চেঞ্জ করা দরকার। ভিজে প্যান্টে আর থাকা যাচ্ছে না। হোয়ার ইজ মাই ব্যাগ, ওহো, ওটা বাইরে আছে, না? অ্যান তরতরে পায়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিল কিন্তু পার্থ হাত বাড়িয়ে বাধা দিল, তুমি যেও না, আমি এনে দিচ্ছি।

কপট অভিব্যক্তি অ্যানের মুখে, কেন?

তোমার গায়ে গরম জামাকাপড় নেই। ওখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা! কম্বল শরীরে জড়িয়ে পার্থ ডিমঘরে ঢুকলো। জোর বৃষ্টি হচ্ছে, কাচের গায়ে সপাং সপাং শব্দ, দরজাটা হাওয়ার দাপটে কাঁপছে। মেঝে থেকে রুকস্যাক তুলে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এল পার্থ। তারপর সেটাকে মাটিতে রেখে বললো, এত ওজন কাঁধে নিয়ে হাঁটলে কী করে?

অ্যান হাসল, ঝুঁকে ব্যাগের চেন খুলে জিনিসপত্র বের করলো, মাই গড। এগুলো তো অলরেডি ভিজে গিয়েছে। ওরা বলেছিল ওয়াটার প্রুফ, তার নমুনা দ্যাখো! ওঃ, আমি এখন কী করি! পাগলের মতো সবকটা জিনিস মেঝের ওপর উপুড় করা হয়ে গেলে দেখা গেল একটা নীল স্লিপিং গাউন ছাড়া কেউ জলের ছোঁওয়া থেকে বাঁচে নি। পার্থ দেখলো জামাকাপড় বেশি নেই ওখানে। তবে আন্ডার গার্মেন্টস্-এর সংখ্যাই বেশি। সেগুলোর দিকে তাকাতে সংকোচ হচ্ছিল ওর। পূর্ণ যুবতীর ব্রেসিয়ার ভাঁজ করা অবস্থাতেও বড় উদ্ধত! সে চোখ সরিয়ে ফায়ার প্লেসের ওদিকে তাকাল। আগুনের শরীর ছোট হয়ে আসছে। উঠে দুটো কাঠ তুলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল পার্থ। এর মধ্যে বয়লারের মতো তেতে গেছে ফায়ার প্লেসটা। অধিক উত্তাপ কখনও যে এত আরামদায়ক হয়–এর আগে জানা ছিল না।

ভেজা জামাকাপড়গুলো ফায়ার প্লেসের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে অ্যান দুহাতে টেনে মাথার ওপর দিয়ে পুলওভারটাকে খুলে নিল। চকিতে তাকাল পার্থ, জিন্সের শার্ট পুলওভারের নিচে। সে উঠে দাঁড়াল, তুমি চেঞ্জ করে নাও আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।

হোয়াট ফর? সবিস্ময়ে তাকাল অ্যান।

তুমি তো পোশাক পাল্টাবে?

হ্যাঁ, কিন্তু তার জন্যে তোমাকে ওই ঠাণ্ডায় কাঁপতে হবে কেন?

পার্থ হাসল, আমাদের দেশে মেয়েরা পোশাক ছাড়া সময় ছেলেরা থাকে না।

খুব ভালো প্রথা। অ্যান মাথার চুল থেকে ক্লিপগুলো খুলছিল, কিন্তু যে মেয়ে একা একা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় তাকে কতগুলো কায়দাকানুন জানতে হয়।

সোনালি চুল ঝরনার মত পিঠময় ছড়িয়ে গেল। ছোট্ট তোয়ালে তুলে সেগুলো থেকে জল শুষে নিচ্ছিল অ্যান।

পার্থ আবার বিছানায় বসে পড়ল। অ্যানের যদি লজ্জা না আসে তাহলে সে কেন সংকোচ করবে! চুল শুকিয়ে নিয়ে অ্যান বলল, একথা মানতেই হবে ভারতবর্ষের মানুষ মেয়েদের সম্মান করতে জানে। আমি এদেশে একমাস এসেছি, কখনও কোনো বিপদে পড়িনি। এমনকি কেউ টিজ পর্যন্ত করেনি কথা বলতে বলতে শার্টের বোতাম খুলে ফেলল সে। তারপর অবলীলায় একটা হাত খুলে নিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল। পার্থ চোখ সরাতে চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত হেরে গেল। দুতিন সেকেন্ডের জন্যে শঙ্খের চেয়েও সাদা পিঠে হালকা নীল স্ট্রাপ টলটল করে উঠতেই ওর নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল। সমস্ত ইন্দ্রিয় একত্রিত হয়ে শরীরকে উত্তেজিত করছিল অ্যানের কাছে ছুটে যেতে। এবং ততক্ষণে স্লিপিং গাউনের আড়াল নেমে এসেছে শরীরে। সেই আড়ালে অভ্যস্ত হাতে প্যান্ট খুলে ফেলল অ্যান। খুলে বলল, আঃ। নাউ আই অ্যাম হ্যাপি। তারপর পার্থর দিকে তাকিয়ে বললো, কত অল্পে আমরা সুখী হই না? কিংবা সুখী হবার ভান করি! তুমি অমন করে তাকিয়ে আছ কেন?

কি করে?

তোমার মুখে রক্ত জমেছে।

পার্থ হাসবার চেষ্টা করলো, এবং এই হাসির কী অর্থ তা সে নিজেই জানে না।

ফায়ার প্লেসের সামনে লাগোয়া চেয়ার সরিয়ে এনে দুটো পা সামনে ছড়িয়ে বসলো অ্যান। পার্থ বুঝতে পারছিল না সে কী করবে। এখন তার একটুও ঠান্ডা লাগছিল না। সেটা যত না ফায়ার প্লেসের কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি শরীরের নিজস্ব উত্তাপে। বলা যায় পার্থ নিজেই ফায়ার প্লেস হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার আগুন না দেখানোর চেষ্টাই প্রকট, এটুকু পার্থক্য।

তুমি কোথায় থাকো? দুটো কনুই খাটে, তাতে শরীরের কিছুটা ভার।

কোলকাতায়। ইচ্ছে করে অর্ধেক সত্যি বলল পার্থ। কিন্তু তার চোখ ততক্ষণে অ্যানের স্লিপিং গাউনে। বাঁ দিকের থাই-এর কাছে থেকে গাউনটা কাটা, ফলে চকচকে পুরুষ্টু থাই চলকে উঠেছে। আগুনের ছায়া পড়েছে সেখানে, মনে হচ্ছে লাল মাখন স্থির।

ক্যালকাটা! ওঃ হরিবল। আমি একদিন ছিলাম ওখানে। হোটেল থেকে বেরিয়ে দম আটকে গিয়েছিল। অ্যান্ড দ্যাট টেরিবল লোডশেডিং। তোমরা ওরকম জায়গায় কীভাবে থাকো বুঝতে পারি না। এই দেশে এত সুন্দর জায়গা যখন খালি পড়ে আছে তখন ওরকম–। বিরক্তিতে ঘাড় নাড়ল অ্যান।

পার্থ বললো, তবু শহরটাকে আমরা পছন্দ করি।

কাঁধ নাচাল অ্যান, কখনও কখনও মানুষের আচরণ খুব ক্রেজি হয়ে যায়। তুমি অত দূরে বসে আছ কেন? আগুন পাচ্ছ? সরে এস।

ফায়ার প্লেসের ভেতরে ফুটফাট করে কাঠ ফাটছিল। পার্থ উত্তপ্ত শরীরটাকে অ্যানের কাছে নিয়ে এল। এখন সামান্য বেঁকলেই স্পর্শ পাবে। কিন্তু না, নিজেকে বোঝাল পার্থ, সারাটা রাত সামনে পড়ে আছে। এই নির্জন পাহাড়ে অমন সুন্দরী মেয়ে আর সে। তাড়াহুড়ো করে কোনো লাভ হবে না। রাতটাকে চুটিয়ে উপভোগ করার অনেক সময় পড়ে আছে। আজকের রাতের জন্যে এই বাংলো তার এবং হ্যাঁ, ওই রমণীও। আরও প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি পড়ুক, বাতাস বয়ে যাক, কোনো ক্ষতি নেই। সে জিজ্ঞাসা করলো, এ জায়গাটার কথা কোথায় শুনলে?

হ্যারল্ড বলেছিল। দিল্লিতে ওকে মিট করি আমি। আমরা দুজনে রাজস্থানটা ঘুরেছিলাম। কোলকাতায় এসে ও চলে গেল কাঠমান্ডু। আমি সোজা এখানে।

তোমার সঙ্গে বিছানাপত্র নেই?

দ্যাটস এ সিলি মিসটেক। আমার স্লিপিং ব্যাগ হোটেলে ফেলে এসেছি। ওরা বলেছিল এখানে এভরিথিং পাওয়া যাবে। তুমি যদি না থাকতে তাহলে মরে যেতাম।

পার্থ হাসল, কোনো অসুবিধে হবে না। এখানে চারটে কম্বল আছে। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে কি না টের পেল না পার্থ। কিন্তু দৃশ্যটা কল্পনা করে সে বুঁদ হয়ে গেল।

হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল অ্যান, তোমার কোনো গার্ল ফ্রেন্ড নেই?

নো। পার্থ হকচকিয়ে গেল।

ইউ আর নট ম্যারেড, আই সাপোজ! চোখ ছোট করল অ্যান।

নো।

দেন আই অ্যাম রাইট। তোমার তাকানো দেখেই বুঝতে পারছি।

কী করে?

তখন থেকে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছ তুমি। আমার শরীরটা কি শুধু পা-সর্বস্ব? আমি চুরি করা পছন্দ করি না। যেন ঠান্ডা জল ছুড়ে মারল মুখে, পার্থ ব্লাশ করল। তারপর ব্যাপারটা তুচ্ছ বোঝাতে বললে, তুমি অনেক কিছু অনুমান করে নিচ্ছ। এই নির্জন পাহাড়ে আমি একা বাংলো রিজার্ভ করে রয়েছি এই সময় তুমি এলে। প্রচণ্ড ঝড়জলের মধ্যে একজন সুন্দরীকে দেখে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটতেই পারে, আমি ঈশ্বর নই।

আর ইউ সিওর যে তুমি ঈশ্বর নও?

এইবার হতভম্ব হলো পার্থ, একি হেঁয়ালি!

ঈশ্বরই, কারণ তুমি যদি এই রাত্রে দরজা না খুলতে তাহলে আমি মরে যেতাম!

দূর! সে তো আমার ছাড়তে হলে কি দরজা খুলতাম।

অ্যান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর কাঁধ নাচিয়ে বললো, হবে হয়তো। কিন্তু এখন আমার খুব খিদে পেয়েছে হাত বাড়িয়ে রুকস্যাক থেকে বের করে রাখা একটা প্যাকেট তুলে নিল সে। তারপর মোড়ক খুলতে গিয়ে বললো, হায়রে, এটাও নষ্ট হয়েছে।

পার্থ দেখল কতকগুলো বিস্কুট এবং চিজ আর রুটি এখন প্রায় থকথকে কাদায় পরিণত হতে চলেছে। প্যাকেটটাকে আবার নামিয়ে রাখল অ্যান, তোমার কাছে খাবার আছে?

মাথা নাড়ল পার্থ, এখানে নেই। আমার মালপত্র গাড়িতে পড়ে আছে। ওখানে বৃষ্টি না থামলে যাওয়া অসম্ভব।

অ্যান উঠে জানালার পর্দা সারাল। কাচের গায়ে জলকণা থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নিজের মনেই যেন সে বলল, পৃথিবীতে আর কোনো প্রাণী নেই। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, আমার খুব তেষ্টা লাগছে।

পার্থ মাথা নাড়ল, না, জলও নেই। তোমরা কি বাইরের জল খাও?

কাঁধ নাচাল অ্যান। এবং এই সময় সে পিটার স্কটের বোতলটাকে দেখতে পেল, হা- ই! ইটস ইওরস?

মাথা নাড়ল পার্থ, হ্যাঁ।

নো গ্লাস?

পার্থ উঠল। কম্বলে শরীর মুড়ে ভেতরের দরজা খুলে টর্চ হাতে স্টোর রুমে চলে এল। দুটো কাচের গ্লাস তুলে নিয়ে প্রায় দৌড়ে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করল সে। এখন প্যাসেজেও আর হাঁটা যাচ্ছে না, ঠাণ্ডায় মাথার ঘিলু অবধি জমে যাবে।

জল নেই, অতএব র হুইস্কি নিয়ে ওরা দুজনে আগুনের সামনে বসলো। বসে পার্থ বলল, তোমার কথা বলো।

ঠোঁট টিপে হাসল অ্যান, তারপর ছোট্ট চুমুক দিয়ে বললো, কী কথা?

তুমি কী করো?

ওয়েল, এই মুহূর্তে আমি বেড়াচ্ছি। আমি দুবছর চাকরি করে যা জমিয়েছিলাম তাই নিয়ে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছি।

ভারতবর্ষে এলে কেন?

সেতার শুনে। য়ু নো রবিশংকর? ওঁর বাজনা শোনার পর মনে হয়েছিল, আই মাস্ট সি দি ক্যান্ট্রি! ইটস বিউটিফুল, তোমাদের এই দেশ সত্যিই সুন্দর!

কিন্তু তোমার চাকরি?

যেটা করতাম সেটা গেছে। ফিরে গিয়ে আবার জুটিয়ে নেব।

তোমার বাবা বা?

 তারা আছেন, নো প্রব্লেম।

এইভাবে একা বেরিয়ে আসতে তোমার ভয় করেনি?

ভয়? হোয়াই?

তুমি বাজে লোকের হাতে পড়তে পার।

সেটা আমি ন্যুয়র্কেও পড়তে পারি। আমি শুনেছি এখানে প্রথম সূর্যের আলো যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে পড়ে তখন, বিউটিফুল। ন্যুয়র্কে থাকলে কি আমি সেটা দেখতে পেতাম? নো নেভার! গ্লাসটা শেষ করলো অ্যান। তারপর বোতল থেকে খানিকটা ঢেলে নিয়ে বলল, ইটস গুড।

অ্যালকোহল ধীরে ধীরে থাবা বাড়াচ্ছে। পার্থ বুঝতে পারছিল তার নার্ভগুলো এখন স্বাভাবিক নয়। এক হাতে গ্লাস নিয়ে অ্যান ঝুঁকে কাঠ খুঁচিয়ে দিচ্ছে অন্য হাতে, পার্থ দেখলো স্লিপিং গাউনের ওপরের অংশ দুলে উঠল ঢেউ-এর মতো এখন ওরা এমন পাশপাশি যে স্পর্শ এড়ানো যাচ্ছে না। অ্যান যখন সোজা হয়ে বসলো তখন ওর কাঁধে তার কাঁধ। শীত দুটো মানুষকে হয়তো কাছাকাছি নিয়ে আসে। এবার অ্যান বললো, খুব ক্লান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছে।

এখনই শোবে? পার্থ চঞ্চল হলো।

শোওয়া যেতে পারে।

তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?

প্রচুর, কেন?

আমার সঙ্গে শুতে তোমার আপত্তি হবে না তো?

ইট ডিপেন্ডস। আমি ডিভোর্সি।

সেকী! তোমার বয়স কত?

ডোন্ট আস্ক দিস সিলি কোয়েশ্চেন। আমি সতেরতে বিয়ে করেছি, উনিশে আলাদা। আমার ঘুম পাচ্ছে। হাই তুলল অ্যান।

পার্থ উঠল। তারপর দ্রুত হাতে কম্বলের ভাঁজ খুলে বিছানায় ছড়িয়ে দিল। ওর সমস্ত শরীর অস্থির হয়ে উঠেছিল। গ্লাস নামিয়ে রেখে অ্যান বলল, তুমি খুব টিমিড টাইপের, না?

টিমিড।

মোটেই অ্যাগ্রেসিভ নও। একটা আমেরিকান ছেলে তোমার জায়গায় থাকলে আমাকে এত তোয়াজ কখনই করত না। আমি শুনেছি ভারতীয়রা সবসময় হাত পেতে নেয়, জোর ফলাতে জানে না। অ্যান উঠে বিছানায় বসল।

জোর করে তো কিছুই পাওয়া যায় না। পার্থ এবার কী করবে বুঝতে পারছিল না।

ইন্ডিয়ান ফিলজফার। অ্যান শব্দ করে হাসল, তুমি এরা আগে কোনো মেয়ের সঙ্গে শুয়েছ?

 দ্রুত মাথা নাড়ল পার্থ, ওর মুখ বেশ তেতেছে, না।

সত্যি? অ্যানের চোখ বিস্ফারিত! এত বড় হয়েছ অথচ কোনো মেয়েকে আবিষ্কার করোনি?

 পার্থ বিছানার এক কোণে বসল, আমাদের দেশে সেটা নিয়ম নয়।

তাই নাকি? এইসব ছেঁদো কথা আমায় শুনিও না। আমি অনেক ভারতীয়ের সঙ্গে মিশেছি। শিক্ষিত সমাজে পৃথিবীর সব জায়গায় এখন একই ছাঁদে গড়া। তুমি নিশ্চয়ই অশিক্ষিত গ্রাম্য যুবক নও? অ্যান শূন্য গ্লাস ফায়ার প্লেসের ওপরে নামিয়ে রাখল। তারপর গলা পালটে বলল, তুমি কখন শোবে?

মানে? পার্থ হকচকিয়ে তাকাল। এতক্ষণ যে ভঙ্গিতে কথা বলছিল অ্যান, এই জিজ্ঞাসা সেই ঘরানায় নয়। অ্যান একটু ঝুঁকে ফায়ার প্লেসের কাছে মাথাটা নিয়ে গিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো, আমরা রাতটাকে ভাগাভাগি করে নিই। দুজনের একসঙ্গে ঘুমানোর কোনো দরকার নেই। শেষ রাত্রে যে জেগে থাকবে সে আর একজনকে ডেকে দেবে যাতে ভোরের সূর্যটাকে আমরা না হারিয়ে ফেলি। কী বলো?

ভোরের সূর্য? বিড়বিড় করলো পার্থ। ভোর তো অনেক দেরি, এখন তো রাতও আসে নি।

হ্যাঁ। আমরা তো সানরাইজ দেখব বলে এত কষ্ট করে এসেছি, তাই না?

কথা বলতে বলতে অ্যান কয়েক পা হেঁটে পার্থর পাশে এসে বসল, যদি দুজনেই ঘুমিয়ে থাকি আর সেই ফাঁকে সূর্যটা টুপ করে উঠে যায় তাহলে এত কষ্ট করার কোনো মানে থাকবে না। বরং প্রথম রাতটা আমি জেগে থাকি দ্বিতীয় রাতটায় তুমি–ঠিক আছে?

পার্থ আড়চোখে অ্যানের বুকের দিকে তাকাল। ওর সমস্ত শরীরে এখন গ্রীষ্মের পোড়া হাওয়া পাক খাচ্ছে। গলার স্বরে প্রাণপণে স্বাভাবিকতা রেখে সে বললো, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমার ভোরে ওঠার অভ্যেস আছে। তাছাড়া এই সন্ধেবেলায় শুলে রাত একটার সময় আপনি ঘুম ভেঙে যাবে, ওসব নিয়ে চিন্তা কোরো না।

কিন্তু আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।

ওফ! তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন আমি কষ্ট করে সূর্য দেখতে আসিনি! তুমি সূর্য দেখবে আমি ঘুমুবো তাই বা ভাবছ কী করে! তাছাড়া–। কথাটা বলবে কি না বুঝতে পারছিল না পার্থ। ওর মনে একটু একটু করে যে বোধ জন্মাচ্ছিল তা হলো মেয়েটি নির্ঘাৎ খেলাচ্ছে।

পার্থর গলা একটু উঁচুতে ওঠায় অ্যান সকৌতুকে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। দ্বিধায় পার্থ চুপ করতেই সে জুড়ে দিল, তাছাড়া? সে চোখের তলা দিয়ে তাকাল যা পার্থর কাছে বিদ্রুপের মতো দেখাল, তাছাড়া? ওই ইয়ুথ হোস্টেলে থাকলে তোমাকে আগামী কালের ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না। সূর্য দেখা বেরিয়ে যেত, তাই না?

অ্যান স্পষ্টত বিস্ময়ে মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে পারছি না।

পার্থ খপ করে অ্যানের হাত ধরল, এটা না বোঝার কী আছে? এই বাংলো আমি রিজার্ভ করেছি। আমি যদি তোমাকে এই বাংলোতে ঢুকতে না দিতাম তাহলে তোমার কি অবস্থা হতো তা ভেবে দেখেছ? কাল সকালের সূর্যটাকে দেখতে পেতে? পেতে না তো? বেশ, তাহলে এখন যে বলছ তুমি কোনো রিস্ক নিতে চাও না, আমি জায়গা না দিলে তা বলতে পারতে? আমি এভাবে বলতে চাইনি কিন্তু তুমি আমাকে বলতে বাধ্য করলে।

অ্যান যেন নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করল মাথা নেড়ে। তারপর বলল, তুমি কি আমার কাছে এই আশ্রয়ের মূল্য চাইছ? এই সহজ কথাটা বলতে এত অসুবিধে হচ্ছে কেন?

পার্থর মনে সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হলো। নিজেকে মাছের কারবারি মনে করার কোনো কারণ নেই। সে ব্যবসা করতে বসেনি। বাইরে বৃষ্টি এবং ঝোড়ো বাতাস, মাইনাসে চলে গেছে পৃথিবীর উত্তাপ। এই হিম-নির্জন পাহাড়ের চূড়োয় নরম উত্তাপে একটি পুরুষ এবং ও একটি নারী কেন দায়বদ্ধ হিসেব নিকেশে জর্জরিত থাকবে? কেন স্বতস্ফূর্ত হবে না তাদের শরীরের প্রয়োজন? সে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল, না। এই পরিবর্তন নিশ্চয়ই অ্যানের চোখে পড়েছিল। সে স্থির চোখে পার্থকে দেখতে লাগল, তুমি ছেলেমানুষ! কী চাইছ তা জানো না।

আমি কী চাইছি তা আমি জানি না? পার্থ যেন সংলাপটাকেই আবৃত্তি করল। তারপর দুহাতে অ্যানের কাঁধ আঁকড়ে বললো, আমি তোমাকে চাইছি। কোনো কিছুর মূল্য হিসেবে নয়, কোনো দরদাম করেও নয়।

পার্থর নিঃশ্বাস ঘন, বুকের ভেতর অতল সমুদ্রের চাপ।

অ্যান একটুও বিস্মিত হয়নি এই আচরণে কারণ সে সামান্য নড়ল না বরং ওর ঠোঁটে চিলতে হাসি এল, কীভাবে চাইছ?

একরম একটা জায়গায় একটি পুরুষ এবং নারী যে ভাবে পরস্পরকে চাইতে পারে সেইভাবে। পার্থর মুখ নেমে আসছিল লক্ষ্যহীন হয়ে কিন্তু অ্যান বলল, দাঁড়াও। তার পর নিজের কাঁধ থেকে পার্থর মুঠো ছাড়িয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় উচ্চারণ করল, পরস্পরের চাওয়ার কথা বললে না?

পার্থ অ্যানের মুখের দিকে তাকাল, তোমার শরীরে এই মুহূর্তে কোনো চাহিদা নেই?

অ্যান দ্রুত মাথা নাড়ল, না নেই।

পার্থ সবিস্ময়ে অ্যানের শরীরের দিকে তাকাল। ওর লোভনীয় বুক এবং তার ভাঁজ হাঁটুর কাছে সরে যাওয়া গাউনের কল্যাণে বেরিয়ে আসা সিল্কি উরুর চামড়া অন্যকথা বলছে। সে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত উরুতে পাঁচ আঙুল ছড়াল, তুমি আমার সঙ্গে খেলা করছ অ্যান, খেলা করছ!

খেলা? তোমার সঙ্গে আমার কয়েক মিনিটের পরিচয়, খেলা করার সুযোগ হলো কখন।

তাহলে? তাহলে এই রাতটাকে উপভোগ করতে তোমার ইচ্ছে হচ্ছে না কেন? আমি যদি জোর করি? এখন চিৎকার করলেও তো কেউ তোমাকে সাহায্য করতে ছুটে আসবে না।

ওই ভুলটা করো না। অ্যানের গলা স্থির এবং ধ্বনিতে সতর্কীকরণ।

কেন? আমি আমার কামনা মিটিয়ে নেব, এতে ভুল কোথায়? তুমি বাধা দেবে?

না। কিন্তু তুমি তৃপ্তি পাবে না। তুমি বলেছ এখনও কোনো নারীকে তুমি পাওনি, প্রথম পাওয়াটাকে এমন মাথা গরম করে নষ্ট করো না। জীবনে ওই মুহূর্তটা আর কখনও ফিরে আসবে না।

অ্যান শেষ করতেই পার্থ ঠোঁট বেঁকাল, তুমি পাদরীদের মতো জ্ঞান দিচ্ছ। এসব কথা আমি শুনতে চাই না। তুমি এমন ভাব করছ যেন তোমার মতো সতী আর কেউ নেই। অথচ একটু আগেই বললে তুমি ডিভোর্সি, অচেনা লোকের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছ! তারা কি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে? আমি জানি আমেরিকান মেয়েরা খুব সেক্সি হয়, তুমি ধাপ্পা দিচ্ছ আমাকে।

কী বললে? আমেরিকান মেয়েরা সেক্সি হয়?

হ্যাঁ, বই-এ পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি, গল্প শুনেছি।

অবাক কান্ড! যৌবন এসেছে অথচ সেক্স চায় না এমন মেয়ে পৃথিবীর কোন্ দেশে আছে বলো দেখি! অ্যাবনর্মালদের কথা বলছি না।

তাহলে, তাহলে তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ কেন?

বাধা দিই নি। আপত্তি করেছি। কারণ আমি সূর্য দেখতে এসেছি। শুনেছি, কাঞ্জনজঙ্ঘার ওপর প্রথম সূর্যের আলো যখন এসে পড়ে তখন ঈশ্বরদর্শন হয়। তোমরা কি ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার মুহূর্তে শরীরে নোংরা মেখে যাও?

নোংরা? এটাকে তুমি নোংরামি বলছ? আর এক চাতুরী সন্দেহ করে হেসে উঠলো পার্থ।

হ্যাঁ, নোংরামি। দুটো শরীর যদি সামান্য ভালবাসা না নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয় তাহলে সেটা নোংরামি। চিরকাল সেই নোংরা পাঁক মেয়েরা শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াবে আর পুরুষ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে। একটি পুরুষ কোনো রমণীকে নির্জনে পেলেই নিজের পাঁক চালান করে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না? অ্যান উঠল। ফায়ার প্লেসের আগুন নিভে আসছিল, নতুন কাঠের টুকরো গুঁজে দিল তাতে। দিয়ে বললো, এ আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি।

কী রকম? পার্থ এতক্ষণে গোলকধাঁধায় কিভাবে এগোনো যায় বুঝে উঠছিল না।

অ্যান ফিরে এল। শরীরটাকে ধীরে ধীরে এলিয়ে দিল বিছানায়। তারপর হাত বাড়িয়ে পিটার স্কটের বোতলটা খুলে এক ঢোঁক গলায় সেটাকে আগের জায়গায় রেখে দিয়ে চোখ বন্ধ করলে। এখন ওর শরীর টানটান বিছানায় পায়ের গোছ পার্থর শরীর স্পর্শ করছে। অ্যান খুব ক্লান্ত গলায় বললো, তুমি আমার পাশে শুতে পারো।

পার্থর বুকে আবার ঢেউ। সে শুনেছে অনেক রকম খেলা আছে নারী-পুরুষের। চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছবার আগে আগে আঘাত দেওয়া অথবা আহত করাও কি সেরকম একটা খেলা। তার পরিণতিতে যখন এই ডাক তখন আর তাড়াহুড়ো করার কি দরকার। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতো ধীরগতিতে এগোনো যাক। ঝালায় যখন পৌঁছবে তখন তো আর কোনো বাধা শোনার অবকাশ থাকবে না। সে পোষা বেড়ালের মতো বিছানায় উঠে এল। দুটো কম্বল ছড়িয়ে দিলো অ্যানের শরীরে, দুটো টেনে নিল নিজে।এখন ইঞ্চি চারেকের ব্যবধান দুজনের। যদিও ওপরে আলাদা কম্বল কিন্তু তলার বিছানা যখন এক তখন? স্বচ্ছন্দে পিছলে মিশে যাওয়া যায়। কিন্তু পার্থ নিজেকে সতর্ক করলো, না, একটুও তাড়াহুড়ো করবে না। খুব ধীরে ধীরে এগোতে হবে।

অ্যান বললো, বৃষ্টি এখনও খুব জোরে নামেনি, না?

 অ্যানের শরীরের গন্ধ এখন পার্থর রন্ধ্রে খেলে বেড়াচ্ছে, সেই নেশায় ডুবে যেতে যেতে সে কোনোরকমে বললো, হ্যাঁ। খুব ঝড় উঠেছে।

সেদিনও উঠেছিল! অ্যানের শরীর কি কাঁপল? পার্থর মনে হলো খেলাটা যেন আচমকা বন্ধ হয়ে গেল, নেশাটা থমকে দাঁড়ালো, সেদিন মানে?

যেদিন আমাকে ভোগ করা হয়। এমন কিছু নতুনত্ব নেই। এখন মনে হয় এই সেক্স ব্যাপারটার মধ্যেই কোনো অভিনবত্ব নেই। পৃথিবীর যে কোনো অংশে লক্ষ লক্ষ লোক প্রতি মুহূর্তে একই ভঙ্গীতে যৌন আনন্দ উপভোগ করে, তাই না? চোখ বন্ধ করলো অ্যান।

আবার সেই মেঘটা নেমে আসছে ছাদ হয়ে, নাকি দেওয়াল? পার্থ দ্রুত বলে উঠলো, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এই মুহূর্তে একই ভঙ্গিতে ভালবাসার কথাও বলে থাকে।

মাথা নাড়ল অ্যান, ঠিকই। কিন্তু ভালবাসে কজন? যারা বাসে তারা আলাদা।

পার্থ নড়ে চড়ে উঠল। কনুই-এ শরীরে ভর রেখে আধশোয়া হয়ে বললো, তোমার কথা শুনি, ওই যে ঝড়ের কথা বলেছিলে সেটা কী?

কী হবে শুনে? একটা মেয়ের গোপন লজ্জার কথা শুনে কি সুখ পাবে?

জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে বুঝতে চাই।

চকিতে অ্যান ওর মুখের দিকে তাকাল, আমাকে বুঝতে চাও?

হ্যাঁ। পার্থ যেন ছোঁয়া বাঁচিয়ে রাখতে চাইল।

এত অল্প সময়ে?

সময়? সময়টাকে তো আমরাই তৈরি করে নিই।

হাসবার চেষ্টা করল অ্যান, কী জানি! তবে আজ অবধি কেউ আমায় বলেনি যে সে আমায় বুঝতে চায়। কত বন্ধুর সঙ্গে দিনরাত কাটিয়েছি তবু পরে মনে হয়েছে আমাদের ভালো করে চেনাজানাই হয়নি। মানুষের সঙ্গে মানুষের বোধহয় আলাপের মধ্যেই সম্পর্কটা আটকে থাকে। কিন্তু তুমি বললে আমাকে বুঝতে চাও। অবাক কান্ড! অবাক কান্ড! ঠিক আছে, আমি তোমাকে বলছি।

আর তখনই বাতাস যেন আছড়ে পড়ল বন্ধ জানলায়। শব্দটা এত ভারী যে ভেতরের পর্দায় কাঁপন এড়ালো না। পার্থ সচকিতে তাকাল। বাংলোটা উড়ে যাবে না তো! হঠাৎ অ্যান উঠে বসল। ওর মুখচোখ একাগ্র, যেন কান পেতে কিছু শুনছে, চাপা গলায় বললো, কেউ যেন চিৎকার করছে?

পার্থ শোনার চেষ্টা করলো। শুধু বাতাসের গোঙানি ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। সে হেসে মাথা নাড়লো, দূর! এখানে কে চেঁচাতে যাবে! ওটা ঝোড়ো বাতাস। বলে সে হাত বাড়িয়ে অ্যানের কোমর স্পর্শ করে শোওয়ার ইঙ্গিত করল।

অ্যান তখনও সন্দেহে দুলছে, কিন্তু আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম গলার একটা আওয়াজ। বাইরের দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে না?

পার্থ বলল, ওটা তোমার শোনার ভুল। এখানকার হাওয়া খুব শক্তিশালী, দরজাটা বাধা দিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু কথা শেষ করা মাত্র পার্থ সিটিয়ে গেল। হ্যাঁ সত্যিই মানুষের গলার স্বর। ঝড়ের দাপট ছড়িয়ে চিৎকারটা এসে ঘরে ঢুকছে। অ্যান বললো, হ্যাঁ, আমিই ঠিক, তুমি শুনতে পেয়েছ?

নিঃশব্দে মাথানাড়া ছাড়া আর কী করতে পারে পার্থ! কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা ক্রোধ জন্মেই তীব্রতর হলো। এই সন্ধ্যের অন্ধকারে ঝড়ো আবহাওয়ায় কোন্ হারামজাদা এসেছে। তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি এই মুহূর্তে সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত। চৌকিদারটা ফিরতে পারে। সে এলে অবশ্য অনেক তোয়াজ অনেক আরামের ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু এখন আর তার কি দরকার আছে! পার্থর চোয়াল শক্ত হলো, ওটা চৌকিদারের কণ্ঠস্বর না হয়ে যদি অন্য কোনো মানুষের হয় যে এই মেয়েটার মতো সূর্য দেখতে এসেছে! সে অ্যানকে এবার সজোর টানলে, আঃ, শুয়ে পড়ো, তোমার গল্পটা শুনতে চাই।

আর তখন স্পষ্ট হলো চিৎকার, হেল্প, হেল্প!

অ্যান অবাক হয়ে গেল, কী বলছ তুমি? একটা মানুষ এই আবহাওয়ায় সাহায্য চাইছে। আর–না, না, তুমি দরজা খুলে দাও। লোকটা মরে যেতে পারে।

পার্থ মাথা নাড়ল, কিন্তু আমরা জানি না লোকটা কে! কোনোরকম ঝুঁকি নেওয়া এক্ষেত্রে বোকামি।

অ্যান তাকিয়ে আছে দেখে পার্থ বোঝাল, ওরা ডাকাত হতে পারে, পারে না?

ডাকাত? এত উঁচুতে ওরা কী ডাকাতি করবে? তাছাড়া মাইলের পর মাইল আমি কোনো মানুষ দেখতে পাইনি, ডাকাতরা আসবে কোত্থেকে। তুমি ভুল করছ! লোকটাকে বাঁচাতেই হবে।

পার্থ বুঝতে পারছিল তার প্রতিরোধ নরম হয়ে আসছে। সে শেষ চেষ্টা করল, কিন্তু এই বাংলো আমি রিজার্ভ করেছি। তাই এর দরজা খোলা না খোলা সেটা আমার ইচ্ছে।

এবার অ্যান পার্থর হাত জড়িয়ে ধরলো, এভাবে জেদ করে বসে থেকো না। আমি তোমার কাছ প্রার্থনা করছি লোকটার প্রাণ বাঁচাও। আমি জানি বাইরে কিরকম ঠাণ্ডা। তুমি তো আমাকে জায়গা দিয়েছ।

তুমি মেয়ে তাই, ছেলে হলে দিতাম না। পার্থ বলতে বলতে মুখ ফেরাল, তুমি কি আমার সঙ্গে একা থাকতে ভয় পাচ্ছ? তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসল।

আর তখন অ্যান কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নামবার চেষ্টা করল, তুমি পাগল, একটা আস্ত পাগল। নাহলে এই অবস্থায় এসব কথা মাথায় আসত না। ঠিক আছে, আমিই দরজা খুলে দিচ্ছি। লোকটা বাইরের ঠাণ্ডায় মরে পড়ে থাকবে আর আমি ঘরে আরাম ভোগ করতে পারব না।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল পার্থ, থামো। আমার বাংলোর দরজা খুলে দেবার কোনো অধিকার তোমার নেই। চুপ করে বসো এখানে। পরোপকার করতে চাও? বেশ। সেটা আমিই করছি। বিছানা থেকে উঠে অ্যানের কাঁধ ধরে পার্থ আবার বিছানায় বসিয়ে দিল। তারপর উত্তপ্ত গলায় বলল, কিন্তু একটা শর্ত আছে, এটা তোমাকে মানতেই হবে।

বলো অ্যানের গলা এবার শান্ত।

আমি না বলা পর্যন্ত তুমি এই ঘর থেকে বের হতে পারবে না। যে-ই আসুক, আমি তাকে জানতে দিতে চাই না যে তুমি এখানে আছ। এটা তোমার নিরাপত্তার জন্যেই বলছি।

নিরাপত্তা! হাসল অ্যান, ঠিক আছে, তাই হবে। কিন্তু তুমি আর দেরি কোরো না। দুটো কম্বল টেনে নিয়ে অ্যান আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাকি দুটো শরীরে জড়িয়ে নিল পার্থ। তারপর টর্চ আর মোমবাতি হাতে দিয়ে ডিমঘরের দরজাটা খুলল। ডিমঘরে দরজাটা ভালো করে ভেজিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই মনে হলো বাইরের দরজাটা ভেঙে পড়বে। পার্থ চিৎকার করে উঠলো, কে, কে ওখানে? কিন্তু বাইরে এই প্রশ্নের কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটলো না। মোমবাতিটাকে টেবিলের ওপর রেখে সে হ্যান্ডেলটাকে তুলে নিল। ঠাণ্ডা লোহা যেন হাতে ছ্যাঁক করে উঠল।

পার্থ দরজার পাশের কাচে চোখ রাখতে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। যা জল এখানে জমেছে তা ভেতর থেকে হাজারবার মুছলেও কিছু দেখা যাবে না। খুব সাবধানে দরজাটা খুলল সে। এবং খোলামাত্র প্রচণ্ডশব্দে দুটো পাল্লা ধাক্কা খেল দু-পাশে। পার্থ একপাশে সরে দাঁড়িয়ে থরথরিয়ে কেঁপে উঠল কারণ ঘরের ভেতর তখন ভিজে হাওয়া ক্রমাগত ছোবল মারছে। আর তখনই হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল বিশাল শরীরটা, ঢুকে লম্বা দুই হাতে কোনোরকমে দরজাটা বন্ধ করে লাল দাঁত দেখিয়ে হাসল, থ্যাঙ্কু, থ্যাঙ্কু, ভেরি মাচ। যদিও হাসছে তবু লোকটার সঙ্গে প্রায় ভেজা এবং কাঁপুনিটা ওর শরীর থেকে ছিটকে উঠছে। পার্থ বিস্ফারিত চোখে লোকটাকে দেখছিল। কমসে কম সাড়ে ছয়ফুট লম্বা এবং পার্থর দ্বিগুণ চওড়া ওর দেহ। পিঠে বাঁধা সেই বিদেশি রুকস্যাক। গায়ে ট্রেকারদের পোশাকের ওপর বাড়তি ওয়াটার প্রুফ। লোকটা ঈষৎ ঝুঁকে কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপ সরিয়ে রুকস্যাকটাকে নামিয়ে ওয়াটার প্রুফের বোতামে হাত দিল। বস্তুটি থেকে তখন টুপটাপ জলের ফোঁটা পড়ছে। মাথার টুপিটাকে সরাতে লোকটাকে আরও বীভৎস দেখাল। কপাল চওড়া হয়ে ঠিক মাথার মাঝখান দিয়ে একদম ওপ্রান্তে চলে গেছে। দুদিকের স্প্রিং-এর মতো চুলগুলো যেন সেই টাকটাকে পাহারা দিচ্ছে। লোকটা এবার হাসল এবং হাসতেই বাঁ দিকের একটা দাঁত চিকচিকিয়ে উঠলো। নিশ্চয়ই পেতল কিংবা সোনার বাঁধানো। লোকটা সামান্য ঝুঁকে আবার বলল, থ্যাঙ্কু ভেরি মাচ। না হলে আমি মরে যেতাম। তারপরই হঠাৎ বিশাল শরীরটা নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জগিং করতে লাগল। পার্থ-এর আগে অনেক নিগ্রো দেখেছে। সিনেমায় তো বটেই, কলকাতায় কিংবা ওদের শহরে মাঝে মাঝে এক আধজনকে যে দ্যাখেনি তা নয় কিন্তু এত বিশাল চেহারার কাউকে এই প্রথম দেখল। পার্থ জানে না কেন হঠাৎ একধরনের ভয় তাকে আচ্ছন্ন করতে চাইল। এবং সেই ভয়টাকে তাড়াবার জন্যে সে রেগে গেল, কেন এসেছ এখানে?

প্রশ্নটায় যে বিতৃষ্ণা আছে তা বোধহয় টের পায়নি লোকটা। গালচের ওপর ততক্ষণে বসে পড়ে জুতোর ফিতেয় হাত দিয়েছে সে, সানরাইজ দেখতে। আমি শুনেছি এখানকার সানরাইজ নাকি দারুণ ব্যাপার। কেউ কেউ বলে এখানকার সানরাইজ আর ঈশ্বরকে দেখা একই ব্যাপার। তুমি দেখেছ?

শেষ প্রশ্নটার জবাব দিল না পার্থ, তুমি কোথায় থাকবে?

ভেজা জুতোটাকে পা থেকে মুক্ত করতে করতে লোকটা বলল ওরা আমাকে বলেছিল এখানে ইয়ুথ হোস্টেল আছে। কিন্তু ওটা যে ভাঙাচোরা, জলেভর্তি তা তো বলেনি। তখন তোমার এই বাংলোটাকে দেখতে পেলাম। এটা তোমার বাংলো? লোকটা অন্য জুতোয় হাত দিল।

না। কিন্তু আমি এটাকে রিজার্ভ করেছি। আমি ছাড়া অন্য কেউ এখানে থাকতে পারবে না।

অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমার নাম চার্লি, তুমি?

পার্থ লক্ষ্য করছিল লোকটা তার দিকে না তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। এই যে ধন্যবাদ দেওয়া এবং নিজের নাম বলার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পায়ের চেহারাটা দেখা।

তুমি আফ্রিকান?

নো। হয়তো কখনো, কিন্তু এখন নয়। মানে কয়েকপুরুষ ধরে আমি আমেরিকান। পৃথিবীর অন্যতম গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া দেশ যেখানে কোনো কালা আদমি আজ অবধি প্রেসিডেন্ট হয়নি। কিন্তু তোমার নামটা আমার জানা হয় নি বন্ধু। এইরকম উপকার যে করল তাকে মনে রাখতে হলে একটা নাম দরকার। জুতোজোড়াকে বেশ যত্নে লোকটা উঁচু করে ধরলো যাতে জল বেরিয়ে যায়। মোজা দুটো ভিজেছে।

আমার নাম পার্থ। লোকটার কথাগুলো খারাপ নয়, কিন্তু– দ্বিধায় দুলছিল পার্থ।

পারতো? এইসব ইন্ডিয়ান নামগুলো অদ্ভুত। শুনেছি প্রত্যেকটার নাকি একটা করে মানে থাকে। তাই কি? একটা লোক বেশ অর্থবান নাম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কি সুন্দর। তোমার এখানে আগুন জ্বালোনি? একটু আগুন হবে?

সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল শক্ত হলো পার্থর, না আগুন-ফাগুন এখানে নেই। শোনো, তোমাকে আমি এখানে থাকতে দিয়েছি এটাই অনেক কথা, তাই না?

লোকটা এবার রুকস্যাক খুলছিল, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। ইন্ডিয়ানরা খুব অতিথিবৎসল।

চুপ করো। থামিয়ে দিলো পার্থ, এসব বস্তাপচা কথা আমাকে শোনাতে এস না। বাইরে থাকলে তুমি মরে যাবে তাই তোমাকে ঢুকতে দিয়েছি। এই ঘরে তুমি রাতটা কাটিয়ে ভোরে সূর্য দেখতে চলে যেও। আমি চাই না আজকের রাত্রে আর তুমি আমাকে বিরক্ত করো। কেটে কেটে শব্দগুলো উচ্চারণ করল পার্থ।

এতক্ষণে নিজের ওপর বেশ আস্থা ফিরে এসেছে। নিগ্রোটার চেহারা যতই বিশাল হোক কেন সে নিজে হুকুম করার মতো জায়গায় আছে। তাছাড়া লোকটাকে মোটামুটি ভদ্র-টাইপের বলেই মনে হচ্ছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ওপাশের ঘরে আগুন আছে তা জানতে দেওয়া ঠিক হবে না।

ধীরে ধীরে লোকটা উঠে দাঁড়াল, তোমাকে আমি বিরক্ত করতে যাব কেন? কিন্তু একটু আগুন পেলে ভালো হতো। আমার হাত পা অসাড় হয়ে আছে। এখানে কিচেন নেই?

বসতে দিলে শুতে চায়। কিচেনের খোঁজ করছে এরপর খাটের করবে। পার্থ আর কথা বাড়াতে চাইছিল না, না। নেই। তারপর মোমবাতিটা তুলতে গিয়ে বলল, তোমার কি এটার দরকার?

হ্যাঁ, একটুখানি। কিন্তু তুমি শোবে কোথায়?

আমার কথা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি এখানেই শুয়ে পড়ো।

ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরটাকে দেখে নিয়ে রুকস্যাক এক কোনায় নিয়ে গেল লোকটা তারপর প্যান্টের বোতামে হাত রেখে বলল, তুমি আমার ওপর খুব রেগে গেছ, তাই না?

কথাটার জবাব দিল না পার্থ। লোকটার যা চেহারা তাতে বেশিক্ষণ ওর সামনে দাঁড়ানো মোটেই সুবিধের নয়। সে হ্যান্ডেল আর টর্চ নিয়ে ভেতরের ঘরের দরজা আস্তে আস্তে খুলল। সঙ্গে সঙ্গে চার্লি বলে উঠল, বাঃ, ওখানে একটা ঘর আছে নাকি?

হ্যাঁ এটা রিজার্ভ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *