গোল্ডেন ফক্স – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : জেসি মেরী কুইয়া
সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠল প্রজাপতির মেঘ; হালকা বাতাস পেয়ে ছড়িয়ে পড়ল গ্রীষ্মের আকাশে। হাজার হাজার বিস্মিত চোখ উপরের দিকে চেয়ে দেখল এগুলোর চলে যাওয়া।
বিশাল জমায়েতের একেবারে সামনের দিকে বসে আছে মেয়েটা, দশ দিন হতে চলল যাকে সে অনুসরণ করছে। শিকারকে পরখ করছে শিকারি, অদ্ভুত এক অন্তরঙ্গতার মাধ্যমে জেনে নিচ্ছে মেয়েটার প্রতিটি পদক্ষেপ আর আচরণ। কোনো কিছু তার মনোযোগ কেড়ে নিলে কেমন করে সে মুখ ঘুরিয়ে মাথা উঁচু করে তাকায়, কান পেতে কিছু শুনতে চায়, বিরক্তি কিংবা অধৈর্য হলে মাথা ঝাঁকিয়ে কিভাবে তা দূর করে দেয়। এবারে তো একেবারে নতুন এক ভঙ্গিমায় মুখ তুলে তাকালো পাখনাওয়ালা মেঘখানার দিকে। এতদূর থেকেও সে ঠিকই দেখতে পেল মেয়েটার উজ্জ্বল দাঁতের মারি আর বিস্ময়ে ‘ও’ হয়ে উঠা নরম ঠোঁটদুটো।
সামনের উঁচু মঞ্চে সাদা সাটিনের শার্ট পরা লোকটা হাতে আরেকটা বাক্স নিয়ে হেসে ফেলল। নাড়া দিতেই বের হয়ে উঠল আরো এক ঝাঁক রঙীন পাখা। হলুদ, সাদা আর অসংখ্য রঙ দেখে সকলের দমবন্ধ হয়ে উঠার যোগাড়। সমস্বরে শোনা গেল “উহুহু”।
গোত্তা খেয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে নিচে নেমে এলো একটা প্রজাপতি। শত শত হাত এগিয়ে এলো ছোঁয়ার জন্যে। কিন্তু কেন যেন এটি বেছে নিল মেয়েটার-ই মুখ। সকলের গুঞ্জন ছাপিয়েও কানে এলো মেয়েটার হাসি। আপন মনে সে। ও হেসে ফেলল।
কপালে হাত দিয়ে খুব সাবধানে দু’হাতের মাঝে প্রতাপতিটাকে নিয়ে নিল মেয়েটা। খানিক তাকিয়ে রইল মুগ্ধ হয়ে। নীলরঙা ওই জোড়া চোখ ভালোভাবেই চেনে সে। হঠাৎ করেই সতৃষ্ণভাবে নড়ে উঠল ঠোঁট দুটো। ফিসফিস করে কিছু বলে উঠল মেয়েটা, কিন্তু শব্দগুলো তার শোনা হল না।
মন খারাপ ভাব কেটে গিয়ে হাসি ফুটল ওই চমৎকার ঠোঁটে। বৃদ্ধাঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে মাথার উপর দুই হাত তুলে ধরল মেয়েটা।
দ্বিধায় পড়ে গেল প্রজাপতি। খানিক মেয়েটার আঙুলের ডগায় অপেক্ষা করে অবশেষে উড়ে গেল। শুনতে পেল মেয়েটার কণ্ঠ। “উড়ে যাও! আমার জন্য উড়ে যাও।” একইভাবে সকলেই চিৎকার করে উঠল, “উড়ে যাও! শান্তির জন্য উড়ে যাও!”
খানিকক্ষণের জন্য সকলের মনোযোগ কেড়ে নিল মেয়েটা। মঞ্চের মাঝখানে থাকা সুসজ্জিত লোকটাকে ছাপিয়ে সবার দৃষ্টি এখন ওর উপর।
লম্বা আর নমনীয় গড়নের নগ্ন পাগুলো রোদে পুড়ে, স্বাস্থ্যের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আধুনিককালের ফ্যাশন অনুযায়ী পরে আছে সাদা লেসঅলা খাটো স্কার্ট।
এটা এমন এক মুহূর্ত মনে হল যেন পুরো প্রজন্মের সামনে মহিমান্বিত হয়ে উঠল মেয়েটা। ও’র চারপাশে থাকা সকলের মাঝে এই বন্য আর মুক্ত উদ্দীপনার বোধটুকু অনুভব করল ছেলেটা। এমনকি মঞ্চের উপর থাকা লোকটা’ও সামনের দিকে ঝুঁকে এলো মেয়েটাকে আরো ভালোভাবে দেখার জন্য। মনে হল মৌমাছি কামড়ে দিয়েছে এমন মোটা কালশিরা পড়া ঠোঁটে হেসে, লোকটাও চিৎকার করে উঠল : “শান্তি!” মঞ্চের দু’পাশে উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা এম্পিফায়ারে ধাক্কা খেয়ে অসম্ভব জোরে শোনা গেল সেই শব্দ।
হাত থেকে উড়ে গেল প্রজাপতিটা আর সবকয়টি আঙুল ঠোঁটের উপর এনে কিস ছুঁড়ে দিল মেয়েটা। আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল রঙিন প্রজাপতি। মিশে গেল ভিড়ের মাঝে। মেয়েটা ঘাসের উপর বসে পড়ল আবারো। কাছাকাছি বসে থাকা অন্যেরা এগিয়ে এলো ওকে ছুঁয়ে দেখতে, জড়িয়ে ধরতে।
মঞ্চের উপর দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে সবাইকে নীরব হতে বলল মাইক জ্যাগার। এরপর কথা বলে উঠল মাইক্রোফোনে। কিন্তু ভালোভাবে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। উচ্চারণও এতটা মোটা আর দুর্বোধ্য যে দর্শকেরা বোধ হয় কিছুই বুঝলো না, উন্মত্ত এক সাপ্তাহিক পার্টির সময়ে মাত্র কয়েক দিন আগেই সুইমিং পুলে ডুবে মারা যাওয়া তার ব্যান্ডের সদস্যের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পড়া শোক গাথা।
সকলের ফিসফিসানি শুনে জানা গেল পানিতে নামার সময় নেশায় পুরো কুঁদ হয়েছিল মৃত লোকটা। তবে এটা ছিল বীরের ন্যায় মৃত্যু, কেননা এখন সময়ই হল মুক্তি, শান্তি, যৌবনের স্বাদ নেয়া আর নেশায় মত্ত হয়ে উঠা।
বক্তৃতা শেষ করল জ্যাগার। বেশ সংক্ষিপ্তই হল বলা চলে, তাই জমায়েতের উজ্জ্বল ভাবটুকু রয়েই গেল। ইলেকট্রিক গিটার বাজিয়ে নিজের সর্বস্ব দিয়ে “হঙ্কি টঙ্ক উইমেন” গেয়ে উঠল জ্যাগার। সেকেন্ডের মাঝে তার সাথে দৌড়াতে লাগল হাজার হাজার হৃদপিণ্ডের গতি, শত শত তরুণ দেহ নড়ে উঠল, আর এর দ্বিগুণ হাত উঠে গেল মাথার উপরে। ঠিক যেন বাতাসে দুলছে কোনো গমের ক্ষেত।
সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণের মতো তিক্ত হয়ে কানে বাজতে লাগল সেই সুর। মনে হল যেন খুলি ভেদ করে ঢুকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবে সবকিছু। খুব দ্রুত সকলেই হয়ে পড়ল এক বিশাল পোকার মত। এক সাথে দুলছে আর মাঝে থেকে উড়ছে ধুলা আর ঘামের গন্ধ। ক্যানাবিসের অসুস্থ করে দেয়া বোটকা ধোয়া।
এত সব কিছুর ভিড়েও বিচ্ছিন্ন হয়ে একাই দাঁড়িয়ে আছে সে। সমস্ত মনোযোগ দিয়ে দেখছে মেয়েটাকে, অপেক্ষা করছে কিভাবে তার মুহূর্তগুলো অতিক্রম করছে।
আদিম এক মূৰ্ছনায় আপ্লুত হয়ে নাচছে মেয়েটা। অন্যরকম এক সৌন্দর্য তাকে আলাদা করে রেখেছে চারপাশের অন্যদের কাছ থেকে। মাথার উপর চুড়া করে বেঁধে রাখা চুলগুলো রুবির মতো লাল আভা ছড়াচ্ছে সূর্যের আলো পেয়ে। কয়েক গোছা আবার পেচিয়ে নেমে এসেছে ঘাড়ের উপর, আর এর উপর বসানো মুখখানা ঠিক যেন বৃন্তে ফোঁটা টিউলিপ।
মঞ্চের ঠিক নিচেই খানিকাটা জায়গা ঘেরা দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ অতিথিদের জন্য। এখানেই অন্যান্য স্ত্রী আর ক্যাম্পের লোকদের সাথে ভোলা কাফতান গায়ে নগ্ন পায়ে বসে আছে মেরিয়ান ফেইথফুল। বহুদূরের এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে এই নারীকে। অন্ধ কারো মতই স্বপ্নীল আর দৃষ্টিহীন চোখ, স্থির-ধীর পদক্ষেপ। পায়ের কাছে বসে আছে। ছেলে-মেয়ের দল। আর সবাইকে পাহারা দিচ্ছে হেল’স এনজেলেস এর পদাতিক সৈন্যদল।
মাথায় কালো স্টিলের হেলমেট, ঝুলছে চেইন আর নাৎসি আয়রন ক্রস, রুপার পাতে মোড়া কালো চামড়ার দেহবর্মের নিচ দিয়েও দেখা যাচ্ছে বুকের কোকড়ানো পশম। পায়ে স্টিলের বুট, হাত জুড়ে আঁকি-ঝুঁকি আকা। অসংখ্য ট্যাটু। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর ফলে ভঙ্গিতে ফুটে রয়েছে যুদ্ধের ভাব। মুষ্টিবদ্ধ হাতের মুষ্টিতে ধারালো আর চোখা স্টিলের আংটি। উদ্ধত আক্রোশে সবার উপর নজর বুলিয়ে ঝামেলা খুঁজলো সৈন্যের দল। আসলে তা আশাও করল।
ঘণ্টা পার হয়ে গেল; তবুও থামল না গান। কেটে গেল আরো এক ঘণ্টা। গরম হয়ে উঠল চারপাশ। পশুর খাঁচার মতো গন্ধ বের হতে লাগল। দর্শকদের মাঝে কয়েকজন তো এই উন্মাদনার কোনো কিছুই মিস্ করতে চায় না। নারী আর পুরুষ সবাই আছে এ দলে। কেউ কেউ তাই নিজেদের জায়গাতেই মূত্র থলি খালি করে দিল।
অবশেষে বিরক্ত হয়ে উঠল সে। বন্য উন্মত্ততা আর এই সবকিছুতে আঘাত পেল তার বিশ্বাসের গোড়ায়। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল, মাথা ব্যথ্য শুরু হল। গিটারের তালে তালে দপদপ করে উঠতে চাইল মন। নাহ্ যাবার সময় হয়েছে। আরো একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। কখনোই আসেনি এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতে কেটে গেল আরেকটা দিন। যাই হোক, শিকারীর মতই ধৈর্যশীল সে। আরো দিন আসবে, কোনো তাড়াহুড়া নেই। তবে মুহূর্তটুকু হতে হবে তার উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
চলতে শুরু করল। এতক্ষণ সকলের ভিড়ে, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিচু টিবি পার হয়ে এলো। কিন্তু সকলে এতটাই সম্মোহিত হয়ে আছে যে কেউই তাকে খেয়াল করল না।
একবার পেছন ফিরে তাকাতেই সরু হয়ে উঠল চোখ জোড়া। দেখতে পেল পাশে বসে থাকা ছেলেটার সাথে হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে কথা বলছে মেয়েটা। একটু পরে আবার উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটাও হাঁটতে শুরু করল। ভিড়ের মাঝে দিয়ে সারি সারি আসন পার হয়ে কারো কাঁধে হাত রেখে দৃঢ় পদক্ষেপে এগোতে লাগল। কখনো কখনো হাসিমাখা মুখে ক্ষমাও চাইল।
পথ বদলে ফেলল সে। ঢালু পার হয়ে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। শিকারীর সহজাত বোধ মনে জানান দিয়ে গেল যে অপ্রত্যাশিতভাবেই এসে গেছে তার কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত।
মঞ্চের পেছনে দোতলা বাসের মতো সারির পর সারি কেবল টেলিভিশন ট্রাক। এত কাছাকাছি পার্ক করে রাখা হয়েছে যে ইঞ্চিখানেকের মতো ফাঁক একেকটার মাঝখানে।
পিছিয়ে এলো মেয়েটা। নিচু বেড়া ডিঙিয়ে মঞ্চের পাশ দিয়ে চেষ্টা করল ভিড় থেকে সরে যেতে। কিন্তু আবারো থেমে যেতে হল। চারপাশে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে উঠে পথ খুঁজতে লাগল।
হঠাৎ করেই সোজা বেড়ার দিকে এগিয়ে এসে অ্যাথলেটদের মতো করে লাফ দিল। পড়ল গিয়ে দুটো উঁচু টেলিভিশন ট্রাকের মাঝখানে। হেলস্ এনজেলস’দের একজন দেখল নিষিদ্ধ এলাকায় মেয়েটার চলে যাওয়া। চিৎকার করে দৌড়ে চাইল পিছু নিতে। কাঁধ বাঁকিয়ে চেষ্টা করল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মেয়েটার দিকে যেতে। লোকটা একবার ঘুরতেই মুখে হাসির ঝলক দেখতে পেল সে।
মেয়েটা যেদিক দিয়ে চলে গেছে বেড়ার সে অংশ দিয়ে যাবার জন্য প্রায় দুই মিনিট যুদ্ধ করতে হল। কে যেন দৌড়ে এলে তাকে থামাতে। কিন্তু লোকটার হাত ঝাটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে পার্ক করা উঁচু স্টিলের ট্রাকগুলোর মাঝখানে নেমে পড়ল।
একপাশে কাত হয়ে চলতে হচ্ছে। জায়গাটা এতটাই সংকীর্ণ যে কাঁধ ঠেকে যাচ্ছে। আর সামনেই চিৎকার আওয়াজ শুনতে পেল যখন, ততক্ষণে ডাইভারের ক্যাবের দরজা বরাবর চলে এসেছে। মরিয়া হয়ে দৌড় লাগালো সে। বনেটের পাশে এসে মুহূর্তখানেক দাঁড়িয়ে রইল সামনের দৃশ্য দেখে।
হেলস্ এনজেলস এর লোকটা ট্রাকের সামনের অংশে মেয়েটাকে চেপে ধরে রেখেছে। মেয়েটার এক হাত পিছমোড়া করে কাঁধের সাথে লেপ্টে আছে। দু’জনে মুখোমুখি, কিন্তু নিজের কোমর আর বিশাল পেট দিয়ে মেয়েটাকে স্টিলের গায়ে ঠেসে ধরেছে লোকটা। সে বুঝতে পারল কী ঘটতে যাচ্ছে। মেয়েটার পিঠ বেঁকে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে একপাশ থেকে অন্যপাশে মাথা নাড়াচ্ছে কেবল। হাসতে হাসতে খোলা মুখ নিয়ে লোকটা এগোতে চাইছে মেয়েটার মুখের কাছে।
ডান হাত দিয়ে মেয়েটার ছোট্ট স্কার্ট তুলে ফেলেছে কোমর অব্দি। মোটর সাইকেলের কালি লাগানো লোমশ হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটার কোমরের প্যান্টিতে। সন্ত্রস্ত মেয়েটা মুক্ত হাত দিয়ে লোকটাকে আঁচড় কাটতে চাইলেও কাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে বর্বরের মতো হাসছে লোকটা।
সামনে এগিয়ে এনজেলস সৈন্যটার কাঁধে হাত রাখল সে। সাথে সাথে যেন জমে গেল লোকটা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। জ্বলে উঠল চোখ জোড়া। মেয়েটাকে এত জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল যে ট্রাকের মাঝখানে ঘাসের উপর টলতে টলতে পড়ে গেল বেচারি। বেল্টের সাথে ঝুলতে থাকা লাঠির দিকে হাত বাড়াল এনজেলস্।
এগিয়ে এসে লোকটার স্টিলের হেলমেটের ঠিক নিচে কানের উপর হাত রাখল সে। দুই আঙুল দিয়ে চাপ দিতেই শক্ত হয়ে গেল এনজেল। সমস্ত পেশি অসাড় হয়ে গলা দিয়ে ঘরঘর শব্দ বের হতে লাগল। পুরো শরীর দুলতে দুলতে মাটির উপর পড়ে মৃগী রোগীর মতো খিচুনি শুরু হয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে নিজের বেশ-বাশ ঠিক করে নিল মেয়েটা। আর নগ্ন ভয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল সবকিছু। লোকটাকে ডিঙিয়ে মেয়েটার কাছে এসে ওকে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে।
“এসো” নরম সুরে জানালো,
নয়তো ওর বন্ধুরা এসে পড়বে।”
হাত ধরে দ্রুত মেয়েটাকে নিয়ে চলল সে আর শিশুর মতই ভরসায় এগোতে লাগল মেয়েটাও।
পার্ক করে রাখা ট্রাকগুলোর পেছনে রডোডেনড্রন ঝোঁপের মাঝ দিয়ে চলে গেছে সরু একটা গলি। এবারে পথে নেমে দমবন্ধের মতো করে মেয়েটা জানতে চাইল, “তুমি তাকে মেরে ফেলেছ?”
“না।” সে একবারের জন্য তাকালো না পর্যন্ত, “পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার সিধে হয়ে যাবে।
“তুমি তাকে একেবারে চ্যাপ্টা করে দিয়েছ। কিভাবে করলে? আঘাতও তো করোনি?”
উত্তর না দিয়ে মোড় ঘুরে থেমে দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“তুমি ঠিক আছে?” কোনো কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।
এখনো হাত ধরে আছে দু’জনে। মেয়েটাকে ভালোভাবে দেখে নিল সে। জানে চব্বিশ বছর বয়সী মেয়েটা এইমাত্র ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে এসেছে অথচ গাঢ় নীল চোখের দৃষ্টিতে তার কোনো ছায়াই নেই। নেই কোনো কান্না কিংবা যন্ত্রণা, এমনকি গোলাপি ঠোঁট জোড়া একটুও কাঁপছে না, হাত দু’টোও নরম আর উষ্ণ।
মেয়েটার উপর লেখা মনোবিজ্ঞানীর রিপোর্ট যেটা সে পড়ে এসেছে এ পর্যন্ত খাপে খাপে মিলে গেছে। এরই মাঝে নিজেকে সামলে নিয়েছে আত্মবিশ্বাসী মেয়েটা। এরপরই আস্তে আস্তে রং জমল মেয়েটার গালে। লম্বা গলার নিচে শ্বাস হয়ে উঠল সন্দিহান।
“তোমার নাম কি?” জানতে চাইল মেয়েটা; গভীরতা নিয়ে তাকাল তার দিকে যা অন্য নারীদের চোখেও দেখেছে।
“রামোন।” উত্তরে জানাল সে।
“রামোন” নরম সুরে মেয়েটা ওর নাম বলতেই মনে হল হা ঈশ্বর, ও কত সুন্দর!
“রামোন কে?”
“যদি বলি তুমি বিশ্বাস করবে না।” ছেলেটার ইংরেজি ওর মতই নিখুঁত। বিদেশি হলেও কণ্ঠস্বর সুন্দর, গভীর আর সাহসী মুখশ্রীর সাথে পুরোপুরি মানিয়ে গেছে।
“বলে দেখো একবার।” নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল মেয়েটা।
“রামোন ডি সান্তিয়াগো ই-মাচাদো।” গানের মতো করে বলে উঠল ছেলেটা। অসম্ভব রোমান্টিক লাগল পুরো ব্যাপারটা। এত সুন্দর নাম আর কণ্ঠ মনে হল আর কখনো শুনেনি সে।
“আমাদের যাওয়া উচিত।” এখনো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা।
“আমি দৌড়াতে পারি না।”
“তা না করলে একটু পরে দেখবে মোটর সাইকেলে ঝুলে যাবে মাসকটের মত।”
হাসতে হাসতেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে থামাল মেয়েটা। “এরকম করো না। আমাকে আর হাসিও না। আমার ব্লাডার খালি করতে হবে। সহ্য করতে পারছি না।”
“আহ তাহলে তুমি সেখানেই যাচ্ছিলে যখন প্রিন্স চার্মিং তোমার সাথে ভালোবাসার খেলা খেলতে এসেছিল।”
“দেখ, সাবধান করে দিচ্ছি।” বহুকষ্টে নিজের হাসি থামাল মেয়েটা।
“পার্কের গেইটের কাছে পাবলিক টয়লেট আছে। এতদূর যেতে পারবে?”
“জানি না।”
“তাহলে বাকি আছে রডোডেনড্রন।”
“না, ধন্যবাদ। আর কোনো শো হবে না আজ।”
“তাহলে চল।” মেয়েটার হাত ধরল রামোন।
আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে চলতে চলতে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “তোমার বয়ফ্রেন্ডের রাগ বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কোনো দেখা নেই।”
“হুম, সেটাই। আমি তো ভেবেছিলাম তোমার সেই কৌশলটা আবার দেখব। আর কতদূর বাকি?”
“এইতো এসে গেছে।” গেইটের কাছে পৌঁছাতেই রামোনের হাত ছেড়ে দিয়ে লাল ইটের ছোট্ট দালানটার দিকে দৌড় দিল মেয়েটা। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল।
“আমার নাম ইসাবেলা। ইসাবেলা কোর্টনি। কিন্তু বন্ধুরা ডাকে বেলা। কাঁধের উপর দিয়ে কথা কটা ছুঁড়ে দিয়ে ঢুকে গেল বেলা।
হ্যাঁ, আমি জানি। মৃদুস্বরে বিড়বিড় করে উঠল রামোন।
এতদূর থেকেও কানে আসছে গানের শব্দ; নিচু দিয়ে উড়ে গেল একটা হেলিকপ্টার। কিন্তু এসব কিছুই কোনো গুরুত্ব পেল না। রামোনের কথাই ভাবছে বেলা।
হাত ধুতে গিয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখল নিজেকে। সব চুল এলোমেলো; তাড়াতাড়ি ঠিক করে নিল। রামোনের চুলগুলো ঘন, কালো আর ঢেউ খেলানো। লম্বা, কিন্তু ততবেশি না। লেপ্টে যাওয়া গোলাপি লিপস্টিক মুছে নিয়ে মুখে আবারো হাত বুলালো। রামোনের মুখখানা বেশ পুরুষালি, নরম কিন্তু শক্তিশালী।
লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নার কাছে ঝুঁকে দেখল নিজের চোখ জোড়া। সাদা অংশটুকু এতটাই পরিষ্কার যে নীলচে দেখায়। জানে তার সৌন্দর্যের সেরা অংশ এটাই। কর্নফ্লাওয়ার আর স্যাপায়ারের মাঝামাঝি এই কোর্টনি র। রামোনের চোখ জোড়া সবুজ। প্রথম দেখাতে সেদিকেই চোখ যায়। এই অদ্ভুত সবুজ-সুন্দর কিন্তু; সঠিক উপমা খুঁজে পাচ্ছে না, সুন্দর কিন্তু ভয়ংকর। হেলস্ এনজেলস্ লোকটার কী হয়েছে সে বর্ণনা না জানতে চাইলেও ওই চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় যে রামোন অসম্ভব ভয়ংকর! ঘাড়ের পিছনে একই সাথে ভয় আর প্রত্যাশার এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করে গেল। হয়ত, এই-ই সেই-ই। ওর পাশে সবাইকেই নিষ্প্রাণ লাগছে। হয়তো এতদিন ধরে রামোনকেই খুঁজছিল সে।
‘রামোন ডি সান্তিয়াগো ই-মাচাদো।” নিজের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল বেলা। সোজা হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চেষ্টা করল তাড়াহুড়া না করতে। ধীরে ধীরে, লম্বা স্টিলেটো হিল পরা পায়ে কোমর দুলছে চলার ছন্দে।
ঘন পাপড়ি দিয়ে চোখ ঢেকে আস্তে করে বাইরে বের হয়েই জমে গেল
চলে গেছে রামোন। মনে হল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। পাকস্থলীতে যেন পাথর গিলে ফেলেছে ভুল করে। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল। দৌড় দিয়ে সামনে গিয়ে নাম ধরে ডাকল, “রামোন।” ওর দিকে আরো শত শত দেহ এগিয়ে আসছে গানের আসর ছেড়ে; কিন্তু কাক্ষিত সেই অবয়ব কোথায়ও নেই।
“রামোন” ডাকতে ডাকতে এস্তপায়ে গেইটের দিকে এগোল বেলা। বেইজওয়াটার রোড লোকে লোকারণ্য। হন্যে হয়ে ডানে বামে তাকাল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, চলে গেছে। এমনটা আর কখনো হয়নি। রামোনের প্রতি নিজের আগ্রহ দেখিয়েছে বেলা তারপরেও সে চলে গেছে।
ক্ষোভে ফেটে পড়ল মেয়েটা। ইসাবেলা কোর্টনির সাথে এমনটা আর কেউ কখনো করেনি। নিজেকে মনে হল অসম্ভব তুচ্ছ, অপমানে রাগ উঠে গেল।
“ধুত্তোরি, চুলোয় যাক রামোন।”
কিন্তু সেকেন্ড খানেকের মাঝেই রাগ পানি হয়ে গেল। মনে হলো চারপাশ খালি হয়ে গেছে। কেমন এক অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করে নিল সবকিছু।
চিৎকার করে বলে উঠল, “ও এমন করতে পারে না। তারপর আবারো। কিন্তু লাভ হল না।
পেছনে হৈ-হল্পা শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল তাড়াতাড়ি। একদল হেলস্ এনজেলস এর সৈন্য এগিয়ে আসছে। শ’খানেক গজ দূর থাকলেও সোজা এদিকেই আসছে। এখানে আর থাকা উচিত হবে না।
কনসার্ট শেষ, সবাই যে যার পথে চলে যাচ্ছে। যে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনেছিল সেটা নিশ্চয়ই জাগার আর তার রোলিং স্টোন’কে নিতে এসেছে। বন্ধুদের সাথে দেখা করার এখন আর সুযোগ নেই; এত মানুষের ভিড়ে সবাই হারিয়ে গেছে। নিজের চারপাশে দ্রুত আরেকবার চোখ বুলিয়ে খুঁজে দেখল ঘন ঢেউ খেলানো চুলের রাশি। মাথা ঝাঁকিয়ে চিবুক তুলে আপন মনে বলে উঠল, “কেইবা ওর পথ চেয়ে আছে?” নেমে গেল রাস্তায়।
পেছনে শোনা গেল হুইসেলের শব্দ। এনজেলস্ এর কেউ ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, লেফট, রাইট, লেফট-”
বেলা জানে যে হাইহিলের জন্য কোমর অসম্ভব জোরে দুলছে। জুতা খুলে তাই খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করে দিল। স্ট্যান্ডে অ্যামব্যাসি কার পার্কের কাছে গাড়ি রেখে এসেছে। তাই ল্যাঙ্কাস্টার গেইট স্টেশন থেকে টিউব ধরতে হবে।
ব্রান্ড নিউ মিনি কুপার চালায় বেলা, একেবারে লেটেস্ট ১৯৬৯ মডেল। জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছে। অ্যান্থনী আর্মস্ট্রং এর মিনি যেখানে থেকে সাজগোজ করে আনা হয়েছে সেই একই জায়গা থেকে তারটাও আনা হয়েছে।
ছোট্ট ব্যাকসিটে জুতা ছুঁড়ে ফেলে ইঞ্জিন চালু করল বেলা। টায়ারের ঘর্ষণ শোনা গেল-কারপার্কে। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলির দিকে তাকিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে পৈশাচিক উল্লাস ফুটে উঠল ওর চোখ মুখে। ইচ্ছে মতো গাড়ি চালাতে লাগল মেয়েটা। মেট্রোপলিটান পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গেল-ডিপ্লোমেটিক প্লেট নাম্বার থাকায়। ড্যাডিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
হাইভেল্ড পর্যন্ত আসতে নিজের পুরনো রেকর্ড ভেঙে ফেলল বেলা। পৌঁছালো চেলসি’তে অ্যাম্বাস্যাডরস রেসিডেন্সে প্রবেশ পথে পার্ক করে রাখা আছে ড্যাডির অফিসিয়াল বেন্টলি। শফার ক্লোনকি ওকে দেখে হেসে স্যালুট করল। কেপ টাউন থেকে নিজের বেশির ভাগ স্টাফ নিয়ে এসেছে ড্যাডি।
নিজেরে মুড সামলে নিয়ে ক্লোনকির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে চাবি ছুঁড়ে মারল বেলা। “আমার গাড়িকে সরিয়ে নিয়ে যাও ডিয়ার ক্লোনকি।” পরিচারকদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে ড্যাডি বেশ কড়া। অন্য যে কারো উপর মুড দেখাতে পারলেও ওদের উপর নয়। ড্যাডির মতে, “ওরা পরিবারেরই অংশ বেলা।” আর তাদের বেশির ভাগই আসলে উত্তমাশা অন্তরীপে পারিবারিক আবাস ওয়েন্টেড্রেডেনে ওর জন্মের আগে থেকেই আছে।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে বাগানের দিকে বানানো স্টাডির ডেস্কে বসে আছে ড্যাডি। কোট-টাই খুলে রেখেছে আর ডেস্কের উপর ছড়িয়ে আছে অফিসিয়াল ডকুমেন্টস্। তারপরেও মেয়েকে ঢুকতে দেখে কলম নামিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে তাকাল বেলার দিকে। খুশি হয়ে উঠলেন সন্তানের আগমনে।
বাবার কোলে ধপ করে বসে পড়ে কি করল বেলা। “ঈশ্বর, এ পৃথিবীতে তোমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই।” হেসে ফেললেন শাসা কোর্টনি। “কেন বল তো?”
“পুরুষেরা হয় বিরক্তিকর নয়তো শুয়োের। তবে তুমি ছাড়া। “আহ্! আর রজারই বা কী করল যে ক্ষেপে গেছ? আমার তো তাকে একেবারে খারাপ লাগে না।”
কনর্সাটে যাবার সময় ওকে পাহারা দিয়েছিল ব্লজার। তবে মঞ্চের সামনের ভিড়ের মাঝেই তাকে রেখে এসেছে বেলা। এতক্ষণে মাত্র মনে পড়ল ওর কথা। “জীবনেও আমি আর কোনো ব্যাটা ছেলের পাশে যাচ্ছি না।” ঘোষণা করল ইসাবেলা। “হয়ত কোনো সন্ন্যাসিনীদের আশ্রয়ে চলে যাব।”
“স্বর্গীয় এই আদেশ কি কাল পর্যন্ত বলবৎ করা যায়? আজ সন্ধ্যায় ডিনারে আমার এক অতিথি আসছেন অথচ এখন পর্যন্ত কিছুই ঠিক হয়নি।”
“হয়ে গেছে, বহু আগেই। আমি কনর্সাটে যাবার আগেই সব ঠিক করে গেছি।”
“মেনু?”
“আমি আর শেফ মিলে গত শুক্রবারেই তা ঠিক করে রেখেছি। ভয় পেও না পাপা। সব তোমার পছন্দের খাবার : কোকুইলিস সেইন্ট জ্যাকস আর ক্যামডি থেকে ল্যাম্ব।” কারু’তে নিজের ফামের ল্যাম্বই কেবল পরিবেশন করেন শাসা। মরুভূমির ঝোঁপ ঝাড়ে পালিত হওয়ায় অন্যরকম এক স্বাদ আসে ভেড়ার মাংসে। অ্যামব্যাসিতে গরুর মাংস আসে রোডেশিয়াতে তার র্যাঞ্চ থেকে। আর ওয়াইন আসে ওয়েন্টেড্রেডেনের আঙ্গুর ক্ষেত থেকে। সেখানে গত বিশ বছর ধরে তার জার্মান ওয়াইনমেকার অসম্ভব অধ্যবসায় আর নিখুঁত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাড়িয়ে চলেছে এর গুণ। তার উচ্চাকাঙ্খা হলো এমন এক ওয়াইন তৈরি যা কোতে ডি.আর.এর সাথে টেক্কা দিতে পারবে।
আর এসব কিছুর বহন কার্যে উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে লন্ডন পর্যন্ত কোর্টনি শিপিং লাইন চালু রেখেছে সাপ্তাহিক রেফ্রিজারেটেড নৌ-যান চলাচল করে আটলান্টিক রুটে।
.. আর আজ সকালেই ক্লিনারস এর কাছ থেকে তোমার ডিনার জ্যাকেট নিয়ে এসেছি। এছাড়াও পিকাডেলি আর্কেডে আরো তিনটা ড্রেস শার্টের অর্ডার দিয়েছি সাথে ডজনখানেক নতুন পট্টি।”
বাবার কোলে বসেই চোখের উপর পট্টিটা ঠিক করে দিল বেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইটালি’র বিপক্ষে আবিসিনিয়াতে হারিকেন চালানোর সময় বাম চোখ হারিয়েছেন শাসা। আর এখন তো চোখের উপর কালো সিল্কের পট্টিটা এক ধরনের জলদস্যুর ভাব এনে দিয়েছে চেহারাতে।
নিশ্চিন্ত হলেন শাসা। প্রথম বার বেলা’কে যেবার নিজের সাথে লন্ডনে আসার কথা জানিয়েছিলেন মেয়েটার বয়স তখন মাত্র একুশ। এত কম বয়সী কারো উপর অ্যামব্যাসি’র ঘরকন্নার ভার দেবার আগে বিস্তর ভেবেছেনও। তবে এখন আর চিন্তার কিছু নেই। মোটের উপর দাদীমা’র হাতে শিক্ষা পেয়েছে বেলা। এর সাথে আবার শেফু, বাটলারসহ স্টাফদের অর্ধেকই এসেছে কেপ থেকে। তাই সুপ্রশিক্ষিত দল নিয়েই জীবন শুরু হয়েছে এখানে।
“ডিনারের পর আধা ঘণ্টা ধরে যখন তোমার ইসরায়েলি বন্ধুকে নিয়ে অ্যাটম বোমা বানাবার প্ল্যান করবে, তখন থাকব তোমার সাথে?”
“বেলা!” তাড়াতাড়ি প্রাকটি করে উঠলেন শাসা, “তুমি জানো আমি এরকম মন্তব্য পছন্দ করি না।”
“মজা করেছি, ড্যাডি। কেউ তো আমাদের কথা শুনছে না।”
“যতই একা থাকো কিংবা মজা করো, বেলা।” জোরে জোরে মাথা নাড়লেন শাসা। সত্যির খুব কাছে চলে গেছে মেয়েটা। মনটা তাই খচখচ করছে। ইসরায়েলি মিলিটারি অ্যাটাশে আর শাসা প্রায় বছরখানেক ধরে এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। আর এখন তো একেবারে মজার ঊর্ধ্বে চলে গেছে এ সম্পর্ক।
গালে কিস্ করতেই নরম হয়ে গেলেন শাসা। “যাই, স্নান করে নেই।” কোল থেকে নেমে দাঁড়াল বেলা। “সাড়ে আটটায় তোমার নিমন্ত্রণ। আমি এসে তোমার টাই বেঁধে দিব।” ইসাবেলা’র ধারণা বাবা এই কাজটা পারে না, অথচ তার আগে চল্লিশ বছর ধরে নিজেই টাই বেঁধেছেন শাসা। এবারে মেয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “মাদমোয়াডেলে তোমার স্কার্ট যদি আরেকটু খাটো হয় তাহলে তো খবর হয়ে যাবে।”
“আহা। আঠারো শতকের বাবাদের মতো কথা বলো না তো পাপা।” দরজার দিকে এগিয়ে গেল বেলা। দরজা বন্ধ হতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন শাসা।
“ফিউজ বিহীন ডিনামাইট নিয়ে বাস করছি যেন।” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠলেন, “যাই হোক হয়তো ভালই হচ্ছে যে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”
সেপ্টেম্বর মাসে, শাসা’র তিন বছরে কূটনৈতিক দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে। আবারো দাদি সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম এর নিয়ম নীতির ঘেরাটোপে ফিরে যাবে বেলা। এ ব্যাপারে নিজের সফলতা যে বিফলে গিয়েছে তা ভালই বুঝতে পেরেছেন শাসা; তাই খুশি মনেই দায়িত্ব হস্তান্তরে কোন আপত্তি নেই।
কেপ টাউনে ফেরার কথা ভাবতে ভাবতেই ডেস্কের কাহজে চোখ ফেরালেন শাসা। লন্ডন অ্যামব্যাসিতে কাটানো বছরগুলো তার জন্য রাজনৈতিক প্রায়শ্চিত্তের মত। ১৯৬৬ সালে গুপ্তঘাতকের হাতে প্রধানমন্ত্রী হেনড্রিক ভারউড এর মৃত্যুর পর বেশ বড় একটা ভুল করে বসেন শাসা আর ভুল লোকটাকে সাহায্য করেছেন এই সর্বোচ্চ পদ পাবার জন্য। এই ভুলের মাশুলস্বরূপ জন ভর্সটার প্রধানমন্ত্রী হবার সাথে সাথে শাসা’কে ছুঁড়ে ফেলা হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থায়। কিন্তু অতীতের অনেক সময়ের মতো এবারেও বিপর্যয়কে বিজয়ে পরিণত করেছেন তিনি।
নিজের সমস্ত মেধা আর ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা, নিজের উপস্থিতি আর সৌন্দর্য, প্ররোচিত করার ক্ষমতা প্রভৃতির মাধ্যমে মাতৃভূমিকে পৃথিবীর রোষানল থেকে বাঁচাতে পেরেছেন। বিশেষ করে ব্রিটেনের লেবার গর্ভনমেন্ট আর তার কমনওয়েলথ এর হাত থেকে; যেটির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগেরই প্রধান কোনো কৃষাঙ্গ কিংবা এশীয়। এসব অর্জনকেই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন জন ভরসটার। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়ার আগে, আর্মসকোর এর সাথে বেশ জড়িয়ে পড়েছিলেন শাসা আর ভরসটার তাই গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর আর্মসকোরের চেয়ারম্যানের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন তাকে।
সহজভাবে বলতে গেলে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগ হলো আর্মসকোর। আর্মস বয়কটের বিরুদ্ধে দেশটির উত্তর হলো এ প্রতিষ্ঠান। যা শুরু করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডুওয়াইট আইজেনহাওয়ার আর এখন তা দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্য দেশগুলোর মাধ্যমেও যারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রতিরক্ষাহীন, নাজুক করে ফেলতে চায়। আমর্সকোর অস্ত্র উৎপাদন ও উন্নয়ন কোম্পানি একক ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা পুরো দেশের প্রতিরক্ষা শিল্প হিসেবে কাজ করছে।
যখন বিভিন্ন কোম্পানি মিলে সুদৃঢ় হয়ে গেছে কোর্টনি ফিনানসিয়াল আর বিজনেস এম্পায়ার, তখন এহেন সিদ্ধান্ত বেশ উত্তেজনাকর আর বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের এই কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে ম্যানেজমেন্টের অনেকটুকুই ধীরে ধীরে ছেলে গ্যারি কোর্টনির হাতে তুলে দিয়েছেন শাসা। একই সাথে কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান হবার সময়ে শাসার বয়সও বেশি ছিল না।
এছাড়া গ্যারি, তার দাদিমার প্রত্যক্ষ সমর্থনও পেয়েছে। কাজ করেছে শাসা আর সেনটেইন কোর্টনি এবং গত চল্লিশ বছরে জড়ো করা দক্ষ সব কর্মীর অধীনে।
তবে, এতে করে গ্যারি’র অর্জনকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। বিশেষ করে যেভাবে সে সম্প্রতি জোহানেসবার্গ স্টক একচেঞ্জের হ্যাপা সামলেছে। ষাট শতাংশ পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল শেয়ারের দাম। এই কৃতিত্ব শাসা কিংবা সেনটেইনের নয়, পুরোটাই গ্যারি’র। তাই ধ্বংস হওয়া তো দূরে থাক কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ এই ধাক্কা সামলে উঠে হয়ে উঠেছে আরো শক্তিশালী আর নগদ অর্থের ভাণ্ডার। একই সাথে মার্কেটে দর কষাকষির জন্য সুবিধাজনক অবস্থাতেও আছে।
নাহ হেসে ফেলে মাথা নাড়লেন শাসা-গ্যারি আসলেই কাজ করছে। তারপরেও এখনো শাসা বেশ তরুণই বলা চলে। বয়স পঞ্চাশের উপর যায়নি। তাই আমসকোর এর চাকরি পুরোপুরি যুৎসই হয়েছে তার জন্য।
কোর্টনি বোর্ডে থাকলেও নিজের বেশির ভাগ সময় আর শক্তি আমসকোর-কেই দেবেন। বেশির ভাগ সাব-কন্ট্রাক্ট কোর্টনি কোম্পানিকে দেয়ার ফলে উভয় এন্টারপ্রাইজেরই লাভ হবে। অন্যদিকে পুঁজিবাদের ফসল কাজে লাগিয়ে দেশপ্রেমকে চাঙ্গা করে তুলতে পারাটা হবে শাসার জন্য বাড়তি পাওনা।
একটু আগেই ইসাবেলা’র মন্তব্যের বিরোধিতা ছিল এই নতুন কাজের সাথে সম্পৃক্ত। নিজের কুটনৈতিক কানেকশন কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলি অ্যামব্যাসিকে প্ররোচিত করেছেন উভয় দেশের মাঝে যৌথ নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট প্রকল্পে। আজ রাতে তেল আভিভে পৌঁছে দেয়ার জন্য আরেক সেট ডকুমেন্টস্ তুলে দেবেন ইসরায়েলি অ্যাটাশের হাতে।
হাত ঘড়িতে চোখ, বোলালেন। ডিনারের জন্য তৈরি হবার আগে এখনো বিশ মিনিট সময় আছে হাতে। সমস্ত মনোযোগ তাই ঢেলে দিলেন সামনে পড়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে।
***
ইসাবেলা’কে গোসল করাতে ছুটে এলো ন্যানি।
“তুমি দেরি করে ফেলেছ, মিস বেলা। এখনো তোমার চুল ঠিক করাও বাকি।” কেপ রঙা ন্যানির রক্তে বইছে হটেনটট বীজ।
“বেশি বকো না তো, ন্যানি।” পাল্টা জবাব দিল ইসাবেলা। কিন্তু ন্যানি ঠিক যেভাবে তার পাঁচ বছর বয়সে করত তেমনিভাবে তাড়িয়ে নিয়ে গেল স্নান করাতে।
চিবুক পর্যন্ত বিলাস বহুল স্টিমিং ফোমে ডুবে গেল ইসাবেলা, ওর কাপড় জড়ো করে নিল ন্যানি। “তোমার পুরো পোশাকে ঘামের দাগ আর নতুন প্যান্টিও ছেঁড়া। কী করেছ?” নিজের হাতে ইসাবেলার সমস্ত অন্তর্বাস পরিষ্কার করে দিল ন্যানি, এক্ষেত্রে লন্দ্রিকে সে এতটুকুও বিশ্বাস করে না।
“আমি একটা হেলস এনজেলের সাথে রাগবি খেলেছি ন্যানি। আমাদের দল জিতে গেছে।”
“তুমি নির্ঘাত কোনো ঝামেলায় পড়বে। সবকটা কোর্টনিরই রক্ত গরম। “ ছেঁড়া প্যান্টি তুলে নিয়ে অসন্তোষে মাথা ঝাঁকাল ন্যানি। “নিরাপদে বিয়ে হবার এখনো বহু দেরি তার আগেই।”
“তোমার মাথা ভর্তি যত্তসব হাবিজাবি চিন্তা। এবার বলো আজ কী কী হলো। ক্লোনকি’র নতুন গার্লফ্রেন্ডের খবর কী?” ইসাবেলা ভালোভাবেই জানে তাকে কিভাবে ভোলাতে হয়।
কূটকচালিতে ওস্তাদ ন্যানি এ সময়টায় ইসাবেলার কাছে পুরো ঘরে কী হয়েছে না হয়েছে সবকিছু সবিস্তারে তুলে ধরে। ওর কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে আবার উৎসাহও দেয় বেলা, কিন্তু বলতে গেলে আজ কিছুই শুনছে না। সাবান লাগানোর জন্য উঠে দাঁড়াতেই নজর গেল রুমের ওপাশে রাখা ফুল নেংথ আয়নার দিকে।
“আমি কী মুটিয়ে যাচ্ছি ন্যানি।”
“তুমি এতটাই শুকনা যে কোনো ছেলে এখনো বিয়ে করছে না।” ঠোঁট বাঁকিয়ে বেড রুমের দিকে চলে গেল ন্যানি।
তারপরেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখল বেলা। শরীরের কোনো অংশে কী কিছু কমতি আছে, কিংবা কিছু কী করতে হবে? নাহ্, মাথা নেড়ে আপন মনেই ভাবলো, সবকিছুই নিখুঁত দেখাচ্ছে। “রোমোন ডি সান্তিয়াগো-ই মাচাদো” ফিসফিস করে উঠল বেলা, “তুমি জানতেও পারলে না যে কী হারালে।” কিন্তু মন খারাপ ভাবটা তবুও কেন কাটছে না।
“তুমি আবারো নিজের সাথে কথা বলছ, লক্ষ্মীটি।” বিছানার চাদরের সমান বাথ টাওয়েল নিয়ে ফিরে এলো ন্যানি। “এবার শেষ করো। সময় নষ্ট হচ্ছে।”
ইসাবেলাকে পুরো ভোয়ালে দিয়ে মুড়ে পেছনটা শক্ত করে ঘসে মুছে ফেলল ন্যানি। বেলা জানে ওকে বলে কোনো লাভ নেই যে এটুকু সে নিজেই পারবে।
“আহ, আস্তে। এত জোরে না।” গত বিশ বছর ধরে একই কথা বলে আসছে বেলা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। “তোমার কতবার বিয়ে হয়েছিল, ন্যানি?”
“তুমি তো জানোই আমি চারবার বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু গির্জাতে একবারই গিয়েছি।” বেলা’কে চেক্ করে মনোযোগ দিয়ে দেখল ন্যানি। “কিন্তু কেন বিয়ে নিয়ে কথা বলছ? মজার কিছু পেয়েছ নাকি? প্যান্টি যে ছিঁড়ে গেল?”
“ছিঃ তুমি এত বাজে কথা বলো না বুড়ি!” অন্যদিকে চোখ সরিয়ে থাই সিল্ক গাউন নিয়ে বেডরুমের দিকে চলে গেল বেলা।
হেয়ারব্রাশ নিয়ে মাথায় দিতেই ন্যানি এসে হাজির।
“এটা তো আমার কাজ, লক্ষ্মীটি। দৃঢ়স্বরে ন্যানি জানাতেই ইসাবেলা চুপ করে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলল আরামে।
“মাঝে মাঝে মনে হয় আমার একটা বাচচা হলে মন্দ হয় না, তুমি তাহলে আমাকে আর জ্বালাতে পারবে না, ওকে নিয়ে পড়ে থাকবে।”
হাত থেমে গেল ন্যানির। কী শুনছে খানিক ভেবে নিয়ে বলল, “বাচ্চার কথা বলার আগে তো বিয়ে করো।”
জান্দ্রা রোডস এর নকশা করা পোশাকটার রঙ এক অদ্ভুতি স্বর্গীয় মেঘ যেন; এর উপর সিকুইন আর মুক্তোদানার কাজ। এমনকি ন্যানিও মাথা নেড়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইল ওর সামনে ঘুরতে থাকা ইসাবেলার দিকে।
শেফ এর সাথে শেষ মিনিটের জরুরি কথা সারতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক নেমেও আরেকটা কথা মনে পড়ায় হঠাৎ করে থেমে গেল বেলা।
আজকের ডিনার গেস্টদের একজন তো আবার স্প্যানিশ চার্জ-ডি অ্যাফেয়ার্স। তাই সেকেন্ডের মাঝেই টেবিল সাজানোর পরিকল্পনা নতুন করে করে ফেলল।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।” নামটা শোনার সাথে সাথেই মাথা নাড়ল স্প্যানিশ চার্জ। “পুরনো আন্দা রুসিয়ান পরিবার। আমার যতটা মনে পড়ছে গৃহযুদ্ধের পরপরই মারকুইস ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো স্পেন ছেড়ে কিউবা চলে গেছেন। একটা সময়ে দ্বীপের চিনি আর তামাকের উপর বেশ বড় ব্যবসা থাকলেও আমার ধারণা ক্যাস্ট্রো সব পরিবর্তন করে দিয়েছেন।”
একজন মারকুইস-মুতখানেক চুপ করে কী যেন ভাবল। স্প্যানিশ অভিজাত সম্পদ্রায় সম্পর্কে ওর জ্ঞান যৎসামান্য হলেও মনে হল মারকুইস র্যাঙ্ক ডিউকের ঠিক নিচেই হবে।
“দ্য মারকুইসা ইসাবেলা ডি-সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো” ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাটা মাথায় আসতেই মনে পড়ে গেল ওই ভয়ংকর সবুজ চোখ জোড়া আর একটুক্ষণের জন্য মনে হলো দমবন্ধ হয়ে যাবে। কণ্ঠের উত্তেজনা চাপাতে না পেরেই জানতে চাইল, “মারকুইস এর বয়স কত?”
“ওহ, এতদিনে কিছুটা তো হয়েছেই। মানে যদি এখনো বেঁচে থাকেন। ষাটের শেষ কিংবা সত্তরে।”
“কোনো পুত্র সন্তান আছে নিশ্চয়ই?”
“আমি আসলে জানি না।” মাথা নাড়লেন চার্জ। “কিন্তু খুঁজে বের করা শক্ত কিছু না। আপনি চাইলে আমি অনুসন্ধান করে দেখব।”
“ওহ্, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” লোকটার বাহুতে হাত রেখে নিজের সবচেয়ে সুন্দর হাসি হাসল বেলা।
মারকুইস হও কিংবা না হও, এত সহজে ইসাবেলা কোর্টনির কাছ থেকে নিস্তার নেই তোমার। ধূর্তের মতো ভাবল মেয়েটা।
***
“প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে গেল তার কাছে যেতে আর যখন অবশেষে পারলে সাথে সাথে আবার চলে যেতে দিলে।” টেবিলের মাথায় বসে থাকা লোকটা হাতের সিগারেট ঘসে নিভিয়ে ফেলল সামনে রাখা উপচে পড়া অ্যাশট্রেতে। সাথে সাথে আকেরটা জ্বালালো। লোকটার ডান হাতের প্রথম দুটো আঙুলের ডগায় গাঢ় হলুদ দাগ। আর তার্কিশ সিগারেটের ধোয়ায় এরই মাঝে ছোট্ট রুমটাতে নীল রঙা মেঘ জমে গেছে।
“তোমাকে কী এই অর্ডার দেয়া হয়েছিল?” জানতে চাইল লোকটা।
হালকাভাবে কাঁধ ঝাঁকাল রামোন মাচাদো। মেয়েটার মনোযোগ পাবার জন্য এই একটাই উপায় ছিল। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ছেলেদের সঙ্গ পাওয়া এই মেয়ের কাছে পানি-ভাত। আঙুল তুললেই পুরুষেরা এসে হামলে পড়বে। মনে হয় এবার আমার ব্যাখ্যাটা বিশ্বাস করবেন।”
“তুমি তাকে চলে যেতে দিয়েছ।” বৃদ্ধ জানে তিনি বারবার একই কথা বলছেন তারপরেও এই ছেলেটা পাত্তা দিচ্ছে না।
এই তরুণকে সে পছন্দ করে না আর এতটা জানেও না যে বিশ্বাস করবে। এমন নয় যে কখনো তার অধীনস্থদের কাউকে বিশ্বাস করেনি। যাই হোক এই ছেলেটা একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী। অফিসারের চেয়ে নিজের মতই তার কাছে শ্রেয়।
চোখ বন্ধ করে ফেললেন জো সিসেরো। পুরনো ইঞ্জিনে অয়েলের মতই অস্বাচ্ছ আর কালো জোড়া চোখ, কান আর কপালের উপর পড়ে আছে রূপালি সাদা চুল।
“তোমার উপর আদেশ ছিল কনট্যাকট তৈরি করা।”
“উইদ রেসপেক্ট, কমরেড ডিরেকটু, আমার উপর, আদেশ ছিল মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন করা, পাগলা কুত্তার মতো ওর দিকে ছুটে যাওয়া নয়।
না, জো সিসেরো কিছুতেই তাকে পছন্দ করতে পারছে না। আচরণে ঔদ্ধত আছে; কিন্তু শুধু সেটাই কারণ না। ছেলেটা একটা বিদেশি। রাশান নয় এমন সবাইকেই বিদেশি ভাবেন সিসেরো। আন্তজার্তিক সমাজতন্ত্র যাই বলুক কেন পূর্ব জার্মান, যুগোশ্লাভ, হাঙ্গেরীয়রা, কিউবা আর পোলিশ সকলেই তাঁর কাছে বিদেশি।
মাচাদো শুধু যে বিদেশি তা নয়, ওর পুরো শেকড়ই হচ্ছে দুর্নীগ্রিস্ত। ছেলেটা না কোনো প্রোলাতারিয়েট বংশ থেকে এসেছে, না কোন হতাশাগ্রস্ত বুর্জোয়া পরিবার থেকে। বরঞ্চ ঘৃণ্য সেই সুবিধাভোগী অভিজাত পরিবারেরই সন্তান।
যদিও মাচাদো তার পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কিছু পেতে চায় না, তারপরেও সিসেরো তাকে বিশ্বাস করে না।
মোটের উপর আবার ছেলেটা স্পেনে জন্মগ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই ফ্যাসিস্ট দেশটা শাসন করেছিল ক্যাথলিক রাজাগণ, যারা ছিল জনগণের শত্রু। এখন তো আরো বেশি। একনায়ক ফ্রাঙ্কো গলা টিপে হত্যা করেছে কম্যুনিস্ট বিপ্লব। নিজেকে তাই ছেলেটা কিউবার সোশালিস্ট হিসেবে দাবি করলেও জো সিসেয়োর কাছে অভিজাততন্ত্রের দুর্গন্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়।
“তুমি তাকে যেতে দিয়েছ।” আবারো জোর দিয়ে একই কথা বললেন। “এই সময় আর অর্থ সবই নষ্ট হয়েছে।” সিসেরো উপলব্ধি করলেন যে, কী পরিমাণ গুরুভার চেপে বসেছে তার উপর। শক্তিও কমে আসছে। অসুস্থতা এরই মাঝে চিন্তা ভাবনাকে ধীর করে দিচ্ছে।
রামোন হেসে ফেলল। আর এই গা জ্বালানো হাসিটা সবচেয়ে অপছন্দ করেন সিসেরো। “মাছের মতই, বরশিতে গেঁথে গেছে মেয়েটা। যতক্ষণ না আমি তীরে তুলে আনছি শুধু সাঁতারই কাটতে থাকবে।”
আবারো নিজের সুপিরিয়রকে খাটো করল ছেলেটা। জো সিসেরো এবারে। সর্বশেষ কারণটা খুঁজে পেলেন তাকে অপছন্দ করার। ছেলেটার তারুণ্য, স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য। ব্যথার মতো মনে পড়ে গেল নিজের নশ্বরতার কথা। মারা যাচ্ছেন জো সিসেরো।
ছোট্ট বেলা থেকেই চেইন স্মোকার সিসেরো এই তার্কিশ সিগারেটগুলো। খেয়ে আসছেন আর অবশেষে শেষবার মস্কো ভ্রমণের সময় ফুসফুসে ক্যান্সার পেয়েছেন ডাক্তারেরা। নিরাময়ের জন্য স্বাস্থ্যসনে ভর্তি হবার কথা জানালেও জো সিসেরো কাজের মাঝে ডুবে থাকার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন। চেয়েছেন নিজের ডিপার্টমেন্ট যোগ্য কোনো উত্তরসূরির হাতে দিয়ে যাবেন। তখন তো জানতেন না যে এই স্প্যানিয়াডটার হাতে দিয়ে যেতে হবে; তাহলে হয়ত স্বাস্থ্য নিবাসকেই বেছে নিতেন।
এখন তো রীতিমতো ক্লান্ত আর নিরুৎসাহ লাগে সবকিছুতে। নিজের শক্তি আর উচ্চাকাক্ষার সব শেষ করে ফেলেছেন। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে চুলগুলো ছিল ঘন আর কালো। আর এখন অ্যাজমা রোগীর মতো কাশি আর হাঁপানি ছাড়া বারো কদমও চলতে পারেন না।
আজকাল তো প্রায়ই রাতে ঘুম ভেঙে গেলে, ঘামতে ঘামতে অন্ধকারে নিঃশ্বাসের কষ্টের সাথে মনে পড়ে ভয়ংকর সব চিন্তা। সারা জীবন ব্যয় করে দিয়ে কী করলেন তিনি? কী পেলেন? কতটা সফল হলেন?
কেজিবি’র চতুর্থ পরিচালকের দপ্তরে আফ্রিকান ডিপার্টমেন্টে আছেন প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল। গত দশ বছর ধরে দক্ষিণের হেড হিসেবে কাজ করছেন। আর স্বাভাবিক যে তাঁর এবং ডিপার্টমেন্টের পুরো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই অঞ্চলের দেশ, রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকা।
টেবিলে বসে থাকা অন্য লোকটা দক্ষিণ আফ্রিকার। এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে থাকলেও এবারে নরম স্বরে বলে উঠল, “আমি বুঝতে পারছি না যে মেয়েটাকে নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার কী। আমাকে বুঝিয়ে বলো।”
টেবিলে বসা শ্বেতাঙ্গ দু’জনেই তার দিকে তাকাল। রালেই তাবাকা যখন কথা বলেন অন্যরা সচরাচর শুধু শোনে। এমন এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য আছে লোকটার মাঝে যে আপনাতেই কৰ্তত্ব এসে যায়।
সারা জীবন ধরেই জো সিসেরো কালো আফ্রিকানদের সাথেই কাজ করে এসেছেন। লিবারেশন ফোর্সেসের নেতারা শুধু জীবন ভর সংগ্রাম করে গেছেন। লিবারেশন ফোর্সেসের সমস্ত ন্যাশনালিস্ট নেতাদেরকেই চেনেন। তারা হলো জোমো কেনিয়া, কেনেথ কুয়ান্তা, কৌমি নাকুমাহ এবং জুলিয়াস নাইরিরি প্রমুখ। কাউকে কাউকে তো বেশ ব্যাক্তিগতভাবে জানেন : শহীদের মৃত্যুবরণ করা মোজেস গামা আর হোয়াইট রেসিজম এর স্বীকার, কারাবাসরত নেলসন ম্যান্ডেলা।
এই কীতির্মান কোম্পানির একেবারে প্রথম স্থান রালেই তাবাকাকে দিয়েছেন সিসেরো। বস্তৃত মোজেস গামার ভাগনে এই রালেই আর দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ যে রাতে গামাকে খুন করেছিল, তখন সেও উপস্থিত ছিল। মোজেস গামা’র বিশাল ব্যক্তিত্ব আর চারিত্রিক শক্তির পুরোটাই পেয়েছে। তাবাকা। তাই গামার শূন্য স্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে। ত্রিশ বছর বয়সে স্পিয়ার আব দ্য নেশন এর ডেপুটি ডিরেকটর, দক্ষিণ আফ্রিকা ন্যাশনাল কংগ্রেসের সামরিক শাখাসহ সিসেরো জানেন যে এ এন সি’র কাউন্সিলেও নিজেকে বহুবার প্রমাণ করেছে তাবাকা।
শ্বেতাঙ্গ স্প্যানিশ ওই ছোঁকড়াটার চেয়েও তাবাকা’কে সিসেরো বেশি পছন্দ করলেও বুঝতে পারলেন যে বংশ আর রঙের পার্থক্য ছাড়া এরা দু’জনে হল একই ছাচে গড়া মানুষ। শক্ত আর বিপদজনক, মৃত্যু আর সহিংসতা ভালোই জানে, বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো কুশলী। এদের হাতেই নিজের লাগাম দিয়ে যেতে হবে সিসেরোকে আর এই কারণেই তাদেরকে তার এত অপছন্দ। “এই মেয়েটা” ভারী কণ্ঠে জানালেন তিনি, “হতে পারে তুরুপের তাস। যদি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু মারকুইস পুরোটা জানাবে। এটা তার কেস আর সাবজেক্ট নিয়ে সে ভালোই স্টাডি করেছে।
সাথে সাথে রামোন মাচাদো’র হাসি মুছে গিয়ে চোখ জোড়া হয়ে উঠল তীব্র। “আমি আশা করব কমরেড ডিরেকটর এই পদবী আর ব্যবহার করবেন না। এমনকি মজা করেও না।” ঠাণ্ডা স্বরে জানালো রামোন।
জো সিসেরো বুঝতে পারলেন যে একমাত্র এই পথেই সম্ভব স্প্যানিয়ার্ডটাকে কাবু করা। “মাফ চাইছি, কমরেড।” কপট প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন সিসেরো।” যাই হোক শুরু করে দাও।”
সামনে পড়ে থাকা হালকাভাবে বাঁধা কাগজের তোড়া খুলে ফেলল রামোন মাচাদো। কিন্তু একবারের জন্যও তাকালো না। ভালোভাবেই জানে কী লেখা আছে।
“মেয়েটার কেস নাম দিয়েছি “লাল গোলাপ।” আমাদের মনোবিজ্ঞানী ওর পুরো প্রোফাইল তৈরি করেছে। মূল্যায়নে জানা গেছে এই নারী যে কোন নিখুঁত কাজ পাবার জন্য অসম্ভবভাবে যোগ্য। কাজে লাগাতে পারলে মূল্যবান ফিল্ড অপারেটর হয়ে উঠতে পারবে।”
আরো মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য সাগ্রহে সামনে ঝুঁকে এলো রালেই তাবাকা। রামোন খেয়াল করে দেখল যে এ পর্যায়ে ও কোনো প্রশ্ন কিংবা মন্ত ব্য করল না লোকটা। ভালই হল। দুজনে এখন পর্যন্ত একসাথে তেমন কাজ করা হয়নি। এ নিয়ে তৃতীয়বার সাক্ষাৎ। পরস্পরকে এখনো ওজন করে দেখছে দু’জনেই। “লাল গোলাপকে অনেকভাবেই ব্যবহার করা যাবে। বাবার দিক থেকে মেয়েটা দক্ষিণ আফ্রিকার শেতাঙ্গ শাসক গোষ্ঠীর সদস্য। ব্রিটেনে দেশের অ্যাম্বাস্যাডর হয়ে মাত্রই নিজের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন ভদ্রলোক। ফিরে গিয়ে ন্যাশনাল আর্মামেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেবার কথা চলছে। ফিন্যান্স, ল্যান্ড আর মাইনের উপরও লোকটার বিশাল প্রভাব আছে। অপেনহেইমার’স আর তাদের অ্যাংলো আমেরিকান কোম্পানির পর দক্ষিণ আফ্রিকাতে সম্ভবত এই পরিবারটিই সবচেয়ে ধনী আর প্রভাবশালী। এর পাশাপাশি আবার শাসক গোষ্ঠীর একেবারে উচ্চ পর্যায়েও বেশ ভাল জানা শোনা আছে তার। যাই হোক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লাল গোলাপ বলতে অজ্ঞান মেয়েটার বাবা। তাই একটু চেষ্টা করলেই যে কোনো কিছু পেতে পারে এই নারী। এর মাঝে আছে সরকারের যে কোনো পর্যায়ে প্রবেশ থেকে শুরু করে অতি গোপনীয় সব তথ্য বের করে আনা, এমনকি যদি তা আর্মামেন্টস, করপোরেশনে তার নিয়োগ সম্পর্কিতও হয় না কেন।”
মাথা নাড়লেন রালেই তাবাকা। কোর্টনি পরিবারকে চেনেন, তাই এই মূল্যায়নের কোনো খুঁত চোখে পড়ল না। “লাল গোলাপের মায়ের সাথে একবার আমার দেখা হয়েছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা রাজনৈতিকভাবে আমাদের পক্ষেই ছিলেন।” বিড়বিড় করে জানাতেই মাথা নাড়ল রামোন।
“ঠিক তাই, সাত বছর আগে স্ত্রী তারা-র সাথে ডির্ভোস হয়ে গেছে শাসা কোর্টনি’র। ভদ্রমহিলা তো আপনার আংকেল মোজেস গামা’র সহযোগী ছিলেন; হোয়াইট রেসিস্ট পার্লামেন্টে বোমা হামলার সময়ে। যার কারণে শেষ পর্যন্ত কারাবাস আর হত্যার স্বীকার হলেন গামা। এছাড়াও তারা ছিলেন গামা’র মিসট্রেস আর তার বাস্টার্ড ছেলেটার মা। বোমা পরিকল্পনায় ব্যর্থতার পর গামার ছেলেকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে গেছেন তারা। লন্ডনে থেকে এখন তো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এ এন সি’র সদস্য হওয়া সত্ত্বেও জুনিয়র কোন ব্যাভক আর রুটিন অ্যাসাইনমেন্টের জন্য দক্ষ কিংবা মানসিকভাবে যোগ্য নন। লন্ডনে এ এন সি পার্সোনেলদের জন্য সেফ হাউজ, মাঝে মাঝে কুরিয়ার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানকে র্যালি আর প্রতিবাদ সভায় সাহায্য করা এই তাঁর কাজ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ হল লাল গোলাপের উপর তার প্রভাব।”
“হ্যাঁ।” অধৈর্যভাবে একমত হলেন রালেই। “আমি এসব কিছুই জানি। বিশেষ করে আমার আংকেলের সাথে তার সম্পর্ক। কিন্তু মেয়ের উপর ভদ্রমহিলার আদতেই কি প্রভাব আছে? মনে তো হয় বাবা কেই মেয়েটা বেশি ভালবাসে।”
আবারো মাথা নাড়ল রামোন। “অবস্থা এখন সেরকমই। কিন্তু মেয়েটার মা ছাড়াও পরিবারে আরো একজন আছেন যিনি প্রগতিবাদী নীতিতে বিশ্বাসী : ভাই মাইকেল, ওর উপর যার বেশ ভালো প্রভাব আছে। এছাড়া আরেকটা পথ আছে ওর মত ঘুরিয়ে নেবার।”
“কী সেটা?” জানতে চাইলেন তাবাকা।
“এগুলোর একটা হল হানি ট্র্যাপ মোহমোয়তার ফাঁদে ফেলা।” এবারে উত্তর দিলেন সিসেরো। “দ্য মারকুইস ক্ষমা চাইছি-এক্ষেত্রে কাজ শুরু করে দিয়েছে কমরেড মাচাদো। তার বহু গুণের একটি হল এই হানি ট্র্যাপ।”
“প্রগ্রেস সম্পর্কে নিয়মিত আমাকে জানাবেন।” নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন রালেই। বাকি দুজনের কেউ কোনো উত্তর দিল না। রালেই তাবাকা এ এন সি’র এক্সিকিউটিভ কিংবা কম্যুনিস্ট পাটির সদস্য হলেও বাকি দুজনের মতো রাশান কেজিবি’র অফিসার নয়।
অন্যদিকে জো সিসেরো কেজিবি’র একজন জ্যেষ্ঠ অফিসার। যদিও কর্নেল থেকে কর্নেল জেনারেল পদোন্নতি নিশ্চিত হয়েছে মাত্র মাসখানেক আগে। সিসেরো’র ধারণা সারা জীবন ব্যাপী ডিপটিমেন্টে বিশ্বস্তভাবে কাজ করার জন্য একেবারে শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এ পদোন্নতি। যেন অবসর জীবনে মোটা অংকের পেনশন ভোগ করতে পারেন।
রামোন মাচাদো’র বিশ্বস্ততার পথ আরো সোজা-সাপ্টা। তার জন্যে আর পারিবারিক পদবী স্প্যানিশ হলেও মা ছিলেন একজন কিউবান নারী। কিউবার হাভানার কাছে মাচাদো এস্টেটে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় রামোনের বাবার সাথে।
স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়ে মারকুইস জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর ন্যাশনালিস্টের বিরোধিতা করেছেন। পারিবারিক পটভূমি আর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ সত্ত্বেও রামোনের পিতা ছিলেন রিপাবলিকান সেনাবাহিনীতে। যোগ দিয়ে মাদ্রিদ অবরোধের সময়ে এক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেয়ার সময় ভদ্রলোক গুরুতরভাবে আহতও হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর ফ্রাঙ্কো শাসনামলের নিগ্রহ আর বঞ্চনা সইতে না পেরে ক্যারিবীয় দ্বীপে পুত্রসহ চলে যাবার মনস্থির করেন- রামোনের মা। কিন্তু ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো’র শাসনামলে অতিবাহিত জীবনের চেয়ে কোনো অংশে শান্তি ছিল না বাতিস্তার এক নায়কতন্ত্রে।
রামোনের মা ছিলেন তরুণ বামপন্থী ছাত্র নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর আন্টি ও তার সমর্থক। তাই তিনিও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন বাতিস্তা বিরোধী আন্দোলনে। ছোট্ট রামোনও নিজের রাজনৈতিক দীক্ষার পাঠ প্রথম পেয়েছে তার মা ও তার জননন্দিত বোন-পো থেকে।
১৯৫৩ সালের ছাব্বিশে জুলাই সান্তিয়াগো ব্যারাকে সেই দুঃসাহসিক কিন্তু ব্যর্থ আক্রমণের কারণে কারাবন্দি হন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। অন্যান্য বিদ্রোহীর সাথে রামোনের পিতা-মাতাকেও গ্রেফতার করা হয়।
হাভানা’তে পুলিশ সেলে ইন্টেরোগেশনের সময় মৃত্যুবরণ করেন রামোনের মা। একই কারাগারে কয়েক সপ্তাহ পরেই অযত্ন আর ভগ্ন হৃদয়ে মারা যান রামোনের বাবা। পারিবারিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে রামোন কেবল মারকুইস পদবীটাই পেল, ভাগ্য কিংবা সম্পত্তি নয়। এসব কিছুই ঘটে যখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ। এরপর ক্যাস্ট্রো পরিবারেই বেড়ে উঠে রামোন।
সাধারণ ক্ষমা পেয়ে জেল থেকে মুক্ত হয়ে রামোনকে নিয়ে মেক্সিকো চলে যান ফিদেল ক্যাস্ট্রো। ষোল বছর বয়সে বিদেশে কিউবার লিবারেশন আর্মির প্রথম দিককার কর্মী হিসেবে নিয়োগ পায় রামোন।
মেক্সিকোতে থাকতেই ছেলেটা প্রথম শেখে যে কিভাবে নিজের অসাধারণ সৌন্দর্যকে কাজে লাগাতে হয়। নারীদেরকে আকর্ষণ করার এক সহজাত ক্ষমতা আছে তার। সতের বছর বয়সে সঙ্গী-সাথীরা তার নাম রাখে এল জোরো ডোরাডো, “দ্য গোল্ডেন ফক্স।” বিশ্ব প্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তার খ্যাতি।
বাতিস্তা’র কারাগারে পিতার গ্রেফতার হওয়া আর মৃত্যুবরণের পূর্ব পর্যন্ত ধনী অভিজাত পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তানটির জন্য সর্বোচচ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই হারো’র ছাত্র হিসেবে মাতৃভাষা স্প্যানিসের মতই ইংরেজিও বলতে পারে। বিদ্যালয়ে থাকাকালীন পড়াশোনায় ভালো ফলাফলের পাশাপাশি তার মাঝে গড়ে উঠেছে ভদ্রলোকের সমস্ত আদব-কায়দা। গুলি ছোঁড়া, নাচ-গান, ঘোড়ায় চড়া, মাছ ধরা, সব কিছুতেই পারদর্শী রূপবান এই তরুণ ১৯৫৬ সালের দোসরা জিসেম্বর কিউবাতে ফিরে আসে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও অন্যান্য বিরাশি জন বীরের সাথে। আর তখনই প্রমাণ পেল যে মারামারিতেও সে সমানভাবে দক্ষ।
কাস্ট্রোর সাথে পর্বতের দিকে পালিয়ে যাওয়া অন্যান্যের সাথে রামোনও ছিল। পরবর্তীতে শুরু হওয়া গেরিলা যুদ্ধের সময়ে এল জোরো’কে শহরে আর গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয় নারীদের উপর তার ক্ষমতা অনুশীলনের জন্য। তরুণী কিংবা তরুণী নয়, সুন্দরী অথবা সাধারণ সব ধরনের নারীকুল রামোনের বাহুতে এসে হয়ে উঠে বিপ্লবী কন্যা। প্রতিটি বিজয়ের সাথে সাথে রামোন হয়ে উঠে আরো দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী। পরবর্তীতে দেখা যায় বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় আর বাতিস্তাকে উচ্ছেদ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার নারীবাহিনী।
এরই মাঝে নিজের এই তরুণ আত্মীয়ও সেনার সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে গেছেন ফিদেল কাস্ট্রো। তাই ক্ষমতায় এসে পুরস্কার হিসেবে। রামোন’কে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকাতে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক ইতিহাস ও সামাজিক নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি নিজের অমোঘ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশান্তরী কিউবানদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয় রামোন। যারা কিনা আমেরিকান সি আই এর সহাযযাগিতায় দ্বীপটিতে কাউন্টার রেভোলিউশন ও আক্রমণের গোপন পরিকল্পনা করছিল।
বিশেষভাবে রামোনের বুদ্ধিতেই বে অব পিগ’স ল্যান্ডিং এর সময় ও স্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে ঠিক করা হয়েছে। ফলাফলে নির্মূল হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের দল। এরই মাঝে মিত্রদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে তার মেধার সুখ্যাতি।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর কেজিবি’র কিউবা ডিরেক্টর ফিদেল কাস্ত্রো ও ডিজিএ’র ডিরেক্টরকে প্রভাবিত করেছেন রামোনকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য মস্কোতে পাঠানোর ব্যাপারে। আর রাশিয়াতে গিয়ে তার দক্ষতা সম্ভাবনা সম্পর্কে কেজিবি’র ধারণাকে ভালোভাবেই উৎরে গিয়েছে ছেলেটা। রামোন হচ্ছে সেসব দুর্লভ সৃষ্টিদের একজন যারা কিনা অনায়াসে সমাজের যে কোনো স্তরে প্রবেশ করতে পারে। জঙ্গলের নিষ্ঠুর গেরিলা ক্যাম্প থেকে শুরু করে ড্রয়িংরুম কিংবা ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রাইভেট ক্লাবগুলোসহ সব জায়গায়।
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর আশির্বাদ ধন্য হয়ে কেজিবি’তে নিয়োগ পেয়েছে রামোন। তাই স্বাভাবিক যে আফ্রিকাতে রাশান ও কিউবা’র স্বার্থ রক্ষায় তৈরি যৌথ কমিটির ডিরেকটর হিসেবেই কাজ করছে রামোন। একই সাথে এ এন সি’র সদস্য হিসেবে আফ্রিকান রেজিস্ট্যান্স দলকে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণও দিচ্ছে।
স্বল্প সময়ের মাঝে নিজের কর্মক্ষেত্রে থাকা সমস্ত আফ্রিকান দেশ চষে ফেলেছে রামোন। নিজের স্প্যানিশ পাসপোর্ট আর পদবী, চতুর্থ মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে সরবরাহ করা কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে পুজিবাদী ব্যবসায়ী হিসেবে ভ্রমণ করেছে সর্বত্র। সবাই সাদরে তাকে গ্রহণও করেছে। তাই আফ্রিকান ডিভিশনের অসুস্থ জেনারেল সিসেরো’র জায়গায় নতুন স্টেশন হেড হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য রামোন হয়ে উঠে এক নম্বর পছন্দ।
বেইজ ওয়াটার রোডের রাশান কনস্যুলেটের ব্যাক রুমে কৃষাঙ্গ আফ্রিকান গেরিলা নেতার সাথে বসে থাকা রামোনের বিশ্বস্ততা তাই তার উপর অলার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
রালেই তাবাকা’র ঘোষণা শুনে বিমূঢ় হয়ে গেছে রামোন। কেননা “যতটুকু প্রয়োজন” নীতিতেই কাজ করে সে। এছাড়া তার আর তার সরকার, উভয়েরই ধারণা, আফ্রিকা মহাদেশের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ জুড়ে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্য অর্জনে এই লোকটা কিংবা তার প্রতিষ্ঠান খুব নগণ্য ভূমিকাই পালন করবে।
“অবশ্যই, এ বিষয়টুকু ছাড়াও যৌথ স্বার্থ রক্ষায় জড়িত সমস্ত ব্যাপারে সবসময়ে আপনাকে জানানো হবে। এতটা আন্তরিকভাবে রামোন উত্তর দিল যে কৃষাঙ্গ লোকটা নিশ্চিত হয়ে চেয়ারে হেলান দিল; ফিরিয়ে দিল রামোনের হাসি। নারী কিংবা পুরুষ খুব কম লোকই তার মায়াজাল কাটাতে পারে। এহেন কঠিন কারো উপরেও নিজের যাদু দেখতে পেয়ে তৃপ্তি ফুটে উঠল রামোনের চোখে।
অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ লোকটার আত্ম-তুষ্টি ভালোভাবেই টের পেলেন রালেই তাবাকা। যদিও চেহারায় তেমন কোনো ভাব বোঝা গেল না। বহু বছর ধরেই রাশিয়া আর কিউবা থেকে আগত শ্বেতাঙ্গদের সাথে কাজ করে আসছেন। তাই ভালোভাবেই জানেন যে এদের ব্যাপারে একমাত্র নীতি হলো কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই না। যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন সে ব্যাপার।
এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যান না যে তারা শ্বেতাঙ্গ। অন্যান্য বেশিরভাগ আফ্রিকানের মতে, রালেই নিজেও গোত্র আর জাতির শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। শার্পভিলে গুলি ছোঁড়া সেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশগুলোকে যতটা ঘৃণা করে ততটাই করে কনফারেন্স টেবিলে বসে থাকা এসব শ্বেতাঙ্গকেও।
মুহূর্তখানেকের জন্যও ভুলতে পারে না ভয়ংকর সেই দিন, যেদিন নীল আফ্রিকান আকাশের নিচে তার হাতের মাঝেই মৃত্যুবরণ করেছে অনিন্দ সুন্দরী সে কৃষাঙ্গ দাসী। যার কথা ছিল তার স্ত্রী হবার। তাকিয়ে দেখেছে ভালোবাসার জনের মৃত্যু। এরপর দেহ ঠাণ্ডা হবার আগেই বুকের বুলেটের ক্ষতের মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করেছে। রালেই তাবাকা’র প্রাণশক্তিই আসে এ ঘৃণা থেকে।
টেবিলের ওপাশে থাকা সাদা মুখগুলোকে দেখে নিয়ে নিজের ঘৃণা থেকে শক্তি সঞ্চয় করলেন তাবাকা। “তো” আবারো শুরু করল, “ঠিক হল যে মেয়েটা আপনার দায়িত্ব। এখন চলুন বাকি…”
“এক মিনিট” রালেইকে থামিয়ে দিয়ে সিসেরোর দিকে তাকাল রামোন, “যদি আমি লাল গোলাপ’কে যদি এগোতে চাই তাহলে অপারেশনের বাজেটের প্রশ্নও এসে যায়।”
“এরই মাঝে দুই হাজার ব্রিটিশ স্টালিং দেয়া হয়েছে প্রতিবাদ জানালেন সিসেরো। “প্রাথমিকভাবে যথেষ্ট ছিল। তবে আরো বাড়াতে হবে। ধনী পুঁজিবাদের কন্যা এই মেয়ে, তাকে মুগ্ধ করার জন্য আমাকেও স্প্যানিশ যুবরাজের ভূমিকা পালন করতে হবে।
আরো কয়েক মিনিট ধরে দু’জনে কথা কাটাকাটিই করে চলল। টেবিলের উপর অধৈৰ্য্যভাবে পেন্সিলের টোকা দিয়ে চললেন তাবাকা। আফ্রিকান ডিভিশন হচ্ছে সিনডারেলার মতো, তাই প্রতিটি রুবল হিসাব করে খরচ করতে হবে।
রালেই’র মনে হলো এদের হাউকাউ শুনে যে কারো বোধ হবে যে ধূলিমাখা আফ্রিকান কোনো রাস্তার পাশে কুমড়া বিক্রি করছে এক জোড়া বৃদ্ধা। কিছুতেই মাথায় আসবে না যে শক্রর রাজত্ব ধ্বংস করে পনের মিলিয়ন নিগৃহীত আফ্রিকান আত্মাকে মুক্তি দিতে চাইছে দুই পুরুষ।
অবশেষে দুজনে একমত হলো। তাই আবারো যখন কথা বলে উঠলেন, কণ্ঠের উষ্মা লুকাতে পারলেন না তাবাকা, “আচ্ছা এবার কি আমরা আমার আফ্রিকা টুারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে কথা বলতে পারি?” তার ধারণা ছিল যে আজকের মিটিং এর মুখ্য উদ্দেশ্য এটাই। “মস্কো থেকে গ্রীন সিগন্যাল পাওয়া গেছে?”
আলোচনা শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেল। কাজ করতে করতে কনস্যুলেট ক্যান্টিন থেকে পাঠানো খাবার দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিল তিন জনে। আর অনেক উপরের একটা মাত্র জানালা দিয়ে হারিয়ে গেল জো সিসেয়োর সিগারেটের ধোঁয়ার মেঘ। একেবারে উপরের তলায় হাই সিকিউরিটিতে মোড়া রুমটাকে নিয়মিত পরিস্কার রাখা হয় ইলেকট্রনিক লিসনিং ডিভাইসের হাত থেকে বাঁচাতে। বাইরের কড়া নজরদারির বিপক্ষে সেফ হাউজের মতো কাজ করে এ কক্ষ।
অবশেষে সামনে রাখা ফাইলটাকে বন্ধ করে উপরের দিকে তাকাল জো সিসেরো। ধোয়ার জ্বালায় লাল টকটকে হয়ে গেছে কালো চোখ জোড়া। “আমার মনে হয় আর নতুন কিছু না থাকলে প্রতিটা পয়েন্ট নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। তাই না?”
মাথা নাড়ল বাকি দুজনে।
“সবসময়কার মতো কমরেড মাচাদো আগে যাবে। প্রাথমিকভাবে এ নিয়ম কঠোরভাবে পালন করা হয় যেন জনসমক্ষে তাদেরকে একসাথে না দেখা যায়।
বিল্ডিং এর সবচেয়ে ব্যস্ত অংশ ভিসা সেকশনের প্রবেশ পথ দিয়ে কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে এলো রামোন; সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নে বর্তমানে পড়তে যেতে আগ্রহী এমন হাজারো ছাত্র আর পর্যটকের ভিড়ের মাঝে তাকে কেউ খেয়ালই করবে না।
দেয়াল ঘেরা কনস্যুলেটের ঠিক বাইরেই আছে বাস স্টপ। ৮৮ নম্বর বাসে চড়েও পরের স্টপেজে নেমে গিয়ে দ্রুত পায়ে ল্যাঙ্কাস্টার গেইট দিয়ে কেনসিংটন গার্ডেনে চলে গেল। রোজ গার্ডেনে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হল যে তাকে কেউ অনুসরণ করছে না। তারপর পার্ক পার হয়ে চলে গেল।
কেনসিংটন হাই-স্ট্রিট থেকে বাইরে চিকন একটা গলির মাঝে রামোনের ফ্ল্যাট। লাল গোলাপ অভিযানের জন্যই বিশেষভাবে ভাড়া নেয়া হয়েছে। সিঙ্গল বেডরুম হলেও লিভিং রুমটা বেশ প্রশস্ত আর পাড়াটাও কেতাদুরস্ত।
মাত্র দুই সপ্তাহ হলেও ফ্ল্যাটটাকে এরই মাঝে বেশ সাজিয়ে নিয়েছে রামোন যেন বহুকাল ধরেই আছে এখানে। ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে করে কিউবা থেকে চলে এসেছে ওর ব্যক্তিগত সিন্দুক। এর মাঝে আছে বাবার রেখে যাওয়া কয়েকটা চমৎকার ছবি আর ছোট-খাট আসবাব : যেমন রুপার ফ্রেমে আটকানো পিতা-মাতাসহ ফ্যামিলি পিকচার, আন্দালুসিয়াতে কাটানো সুখের দিনগুলোতে পারিবারিক এস্টেট আর দুর্গের ছবি। কাঁচ আর পোর্সেলিনের সেটগুলো পুরোপুরি না থাকলেও মাচাদো পদবী আঁকা আছে এখনো। লাল গোলাপ সম্পর্কে যতটা জেনেছে, মেয়েটা এসব জিনিস বেশ খেয়াল করে।
যাই হোক তাড়াতাড়ি করতে হবে। ভারী আর ঘন দাড়ি বেশ দ্রুত গজায়। তাড়াতাড়ি কিন্তু সাবধানে শেভু করে চুল থেকে জো সিসেরো’র তার্কিশ সিগারেটের গন্ধ মুছে স্নান করে নিল রামোন।
বেডরুমে গিয়ে আপনাতেই চোখ চলে গেল আয়নাতে। তিন সপ্তাহ আগে রাশিয়া থেকে ফেরার পর স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত চমৎকার। কৃষ্ণ সাগরের তীরে কেজিবি ট্রেনিং কলেজের সিনিয়র অফিসারদের জন্য রিফ্রেশার কোর্সটা সুঠাম করে তৈরি করে দিয়েছে তার দেহ। তারপর থেকে তেমন একটা শারীরিক কসরৎ না করা হলেও অভাব এখনো চোখে পড়ছে না। শক্ত আর পাতলা গড়নে সমান পেট, কোকড়ানো কালো পশম। কোন রকম অহমিকা ছাড়াই নিজ প্রতিবিম্ব খুঁটিয়ে দেখে নিল রামোন। অনিন্দ সুন্দর দেহ আর মুখশ্রী একে অপরের সাথে চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে গেছে; কার্য উদ্ধারের জন্য এই অস্ত্রের জুড়ি নেই। যোদ্ধা যেমন তার অস্ত্র ভালোবাসে তেমনি ভাবেই নিজের এ অংশকে কাজে লাগায় সে।
“আগামীকাল জিমে। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করল রামোন। ব্লমসবেরি’তে এক হাঙ্গেরীয় শরণার্থী চালিত মার্শাল আর্ট স্টুডিওতে যায় রামোন। সপ্তাহে কয়েকবার দুই ঘন্টার কঠোর অভিযানের জন্যে ফিট হয়ে যাবে শরীর।
ঘোড়ওয়ারের উপযুক্ত পোশাক পরে নিল রামোন। জানে লাল গোলাপ নিজেও ঘোড়া চালায় মেয়েটার পৃথিবীতে ঘোড়াদের অস্তিত্ব বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে। তাই রামোনের জুতা জোড়া দেখে নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হবে তার আভিজাতত নিয়ে।
আবারো ঘড়ি দেখে নিল; নাহ, পুরোপুরি সময়মতোই তৈরি হয়েছে।
ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো রামোন। বিকেলের দিকে বৃষ্টির হুমকি দেয়া মেঘগুলো এখন উধাও হয়ে গেছে। চমৎকার এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা চারপাশে। তো প্রকৃতিও তাহলে তাকে সাহায্য করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে।
সৈন্যদের ব্যারাকের পেছনে ঘোড়ার আস্তাবল। তাকে দেখে চিনতে পারল ম্যানেজার। রেজিস্টারে সাইন করতে করতেই চোখ বোলালো নামের সারিতে। যাক ভাগ্যদেবী আজ তার সাথেই আছে। বিশ মিনিট আগে প্রবেশ করেছে লাল গোলাপ। সাইন তো তাই বলছে।
স্টলে গিয়ে দেখা গেল তার ঘোড়ায় জিন পরিয়ে রেখেছে সহিস। নিজের বাজেট থেকে মূল্যবান পাঁচশ পাউন্ড এই বাচ্চা ঘোটার জন্য ব্যয় করেছে রামোন। তারপর সবকিছু চেক্ করে গায়ে হাত বুলিয়ে নরম স্বরে ঘোড়ার সাথে কথা বলে নিয়ে সহিসকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিনের উপর চড়ে বসল।
রোটেন রো’তে প্রায় পঞ্চাশ বা তার চেয়েও বেশি ঘোড়সওয়ার চলে এসেছে এরই মাঝে। ওক গাছের নিচে ঘোটকীটাকে নিয়ে এলো রামোন। সামনে পিছনে চলে গেল অন্যরা। কিন্তু মেয়েটার দেখা নেই।
খানিকটা ওয়ার্ম-আপের পর বুড়ো আঙুল দিয়ে গায়ে তো দিতেই দুলকি চালে চলতে শুরু করল ঘোটকী। দুয়ে মিলে ভালই জুটি বানিয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন নারীই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রামোনের দিকে।
সারির শেষ মাথায় পার্ক লেনে, রামোন ঘুরে গেল আর খানিকটা জোরে ছোটাল ঘোড়া, টগবগ করে ঘোড়া ছোটানো এখানে নিষিদ্ধ। শখানেক গজ সামনে থেকে তার দিকেই এগিয়ে আসছে চারজনের এক দল। দুটো জোড়া। বেশ ভালোভাবেই এসেছে প্রত্যেকে কিন্তু তারপরেও সবার মাঝে মেয়েটাকে দেখাচ্ছে চড়ুই এর ঝাঁকের মাঝে রঙিন পাখির মত।
রাইডিং হ্যাটের নিচ দিয়ে বের হয়ে থাকা চুলগুলো দুলছে পাখির পাখার মতো; মাখনের মতো সূর্যালোকে চকচক করছে। হাসতেই দেখা গেল অসম্ভব সাদা দাঁত। বাতাস আর পরিশ্রমে গায়ের রং দেখাচ্ছে সজীব, প্রাণবন্ত।
মেয়েটার পাশে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা ছেলেটাকেও চিনতে পারল রামোন। গত দুই সপ্তাহ ধরে লাল গোলাপের পিছু নেয়ার সময় বেশির ভাগ জায়গায় দুজনকে একসাথে দেখেছে। রেকর্ড থেকে ছেলেটা সম্পর্কে জেনেও নিয়েছে। অত্যন্ত ধনী পরিবার থেকে আসা ছেলেটাকে লন্ডনে নাম দেয়া হয়েছে “ডেব’স ডিলাইট” কিংবা “হুররে হেনরী নামে; প্লেবয় সুলভ স্বভাবের জন্য। চারদিন আগে রোলিং স্টোনের কনর্সাটেও মেয়েটার সাথে ছিল। রামোন খেয়াল করে দেখেছে ছেলেটার সাথে মেয়েটার সম্পর্ক সেন্ট বানার্ড বাচ্চা কুকুরের মতো। আর নিজের এম জি তে করে মেয়েটাকে এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে পৌঁছে দেয়া ছাড়া দু’জনকে আলাদা একাকী কোথাও দেখেওনি রামোন। খানিকটা অবাক লাগলেও ১৯৬৯-এর এই উদ্দাম সময়েও একে অন্যের সাথে কখনোই বিছানায় যায়নি তারা, এ ব্যাপারেও সে প্রায় নিশ্চিতই বলা চলে।
যদিও জানে মেয়েটা কোনো বোকা-সোকা কুমারী নয়। হাইভেন্ডে থাকাকালীন গত তিন বছরে অন্তত তিনটা সম্পর্কে জড়িয়েছে এই মেয়ে, রিপোর্ট তো তাই বলে।
দুজনের দূরত্ব কমে আসতেই ঘোড়ার দিকে মনোযোগ দিল রামোন। ঝুঁকে আস্তে আস্তে হাত বুলাতে লাগল জম্ভটার গলাতে। “এসে গেছি, ডালিং।” চোখের কোণা দিয়ে মেয়েটাকে দেখতে দেখতে স্প্যানিশ ভাষায় ঘোড়ার সাথে কথা বলতে লাগল।
একে অন্যকে প্রায় পার হয়ে যাচ্ছে এমন সময় নড়ে উঠল মেয়েটার চিবুক। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। কিন্তু না দেখার ভান করল রামোন।
“রামোন!” উঁচু গলায় চিৎকার করে যেন প্রার্থনা জানাল বেলা। “দাঁড়াও।”
ঘোটকীকে দেখে নিয়ে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকাল মাচাদো। ঘোড়া ছুটিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে মিস কোর্টনি। মুখের ভাব একই রকম রেখে শীতল ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে রইল রামোন।
ও’র পাশে এসে ঘোড়াটাকে ধীর করে বলে উঠল, “আমাকে চিনতে পারোনি? ইসাবেলা কোর্টনি। তুমি তো আমার ত্রাণকর্তা!” অদ্ভুত অনিশ্চয়তা নিয়ে হাসছে মেয়েটা। পুরুষেরা সবসময় তাকে মনে রাখে, যতই অতীতে হোক না কেন সেই সাক্ষাৎ এমন ব্যবহার পেয়েই অভ্যস্ত সে। অবশেষে মৃদু স্বরে যোগ করল, “পার্কের কনর্সাটে।”
“আহ!” সহৃদয় হল রামোন। মোটর সাইকেল মাসকট। মাফ করো। তোমার পোশাক সে সময় বেশ আলাদা ছিল।”
“ধন্যবাদ জানাব সেটুকু সময়ও দাওনি আমাকে।” অনুযোগ করল বেলা। ইচ্ছে হলো জোরে হেসে উঠে যে, যাক অবশেষে তাকে চিনতে পেরেছে ছেলেটা।
“কোনো ধন্যবাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এছাড়া আমার যতদূর মনে পড়ে অন্য একটা জরুরি কাজও ছিল তোমার।”
“তুমি কি একা?” তাড়াতাড়ি বিষয়টাকে পরিবর্তন করে বেলা, জানালো “আমাদের সাথে জয়েন করো। আমার বন্ধুদের সাথে পরিচিত হবে এসো।”
“ওহু, না, না; আমি অযথা তোমাদেরকে বিরক্ত করতে চাই না।”
“প্লিজ।” অনুনয় করছে বেলা। তোমার ভালই লাগবে। ওরা বেশ মজার।” জিনের উপর বসে হালকাভাবে মাথা নাড়ল রামোন।
“এত সুন্দর একটা মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া নিমন্ত্রণ কিভাবে প্রত্যাখ্যান করি?” রামোন জানাতেই ধুপধুপ করে উঠল ইসাবেলার হৃদয়। স্বর্গদূতের মতো চেহারায় ওই সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো রীতিমতো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে।
বাকি তিনজন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কাছে না এসেও বেলা ঠিকই বুঝতে পারল যে রজার মুখে গোমড়া করে আছে। পুলকিত হয়ে তাই জানাল : রজার, ও হচ্ছে মারকুইস ডি সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো। রামোন, ও হচ্ছে রজার কোটস্ গ্রেইনার।”
পরিহাসের দৃষ্টিতে রামোন ওর দিকে তাকাতেই বেলা বুঝতে পারল ভুল করে ফেলেছে। কেননা প্রথমবার সাক্ষাতের সময় নিজের পদবী জানায়নি রামোন।
যাই হোক ক্ষণিকের অস্বস্তি কেটে গেল হারিয়েট কু-চ্যাম্পের সাথে রামোনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময়। মজা লাগল হ্যারিয়েটের প্রতিক্রিয়া দেখে। লন্ডনে ইসাবেলার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী হল এই হ্যারিয়েট। যদিও এর অন্য আরেকটা কারণই প্রধান। লন্ডন সোসাইটি’র ইনার সার্কেলে ইসাবেলাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে লেডি হ্যারিয়েট। হ্যারিয়েটও তাকে পছন্দ করে কেননা বেলা থাকলেই আশে পাশে ছেলেদের ভিড় জমে যাবে। তাই রামোনকে দেখে প্রায় সাথে সাথে ঠোঁট চাটতে থাকা হ্যারিয়েটকে ইসাবেলা নিঃশব্দে সতর্ক করে দিল দু’জনের মাঝখানে নিজের ঘোড় রেখে।
“মারকুইস?” ঘোড়া চালাতে চালাতে বিড়বিড় করে উঠল রামোন। “তুমি তো আমার সম্পর্কে ভালই জানো, কিন্তু তোমার সম্পর্কে আমি তো তেমন কিছু জানি না।”
“ওহ্ কোন পত্রিকার কলামে বোধ হয় তোমার ছবি দেখেছিলাম।” হাওয়া থেকে অযুহাত বানিয়ে ইসাবেলা ভাবতে লাগল : ঈশ্বর, ও যাতে বুঝতে না পারে যে আমি এতটা আগ্রহী।
‘আহ্, নিশ্চয়ই টাটলার…’
মাথা নাড়ল রামোন। কখনো কোথাও ওর ছবি ছাপা হয়নি, শুধু সি আই এ অথবা দুনিয়ার অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থাকলে থাকতেও পারে।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, টাটলারেই।” পালানোর পথ পেয়ে লুফে নিল নামটা বেলা। প্ল্যান কষতে লাগল কিভাবে নিজের আগ্রহ না দেখিয়ে বাগে আনা যায় এই রাজকুমারকে। তবে যতটা কঠিন হবে ভেবেছিল কাজটা, মনে হচ্ছে তা না। রামোন নিজেও খোলামেলাভাবে মিশে গেছে ওদের দলে। একটু পরেই সকলে বেশ মিশে গেল, একসাথে হাসছে। গল্প করছে, শুধু রজার বাদে। ওর গোসা মুখ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সবাই ফিরে চলল আস্তাবলের দিকে। হ্যারিয়েটের কাছাকাছি এসে হিসহিস করে ইসাবেলা বলে উঠল, “ওকে আজ রাতের পার্টিতে দাওয়াত করো।”
“কে?” যেন আকাশ থেকে পড়ল এমনভাবে তাকালো হ্যারিয়েট। “টং করবে না দস্যি মেয়ে। গত এক ঘণ্টা ধরে চোখ গোল গোল করে কাকে দেখছ আমি জানি না বুঝি?”
***
হ্যারিয়েটের দেয়া অন্যান্য স্মরণীয় পার্টিগুলোর চেয়ে ভালোই হলো আজকের আয়োজন। এতটাই ভিড় হলো যে মাথায় জরুরি কাজের তাড়া থাকা জুড়িগুলোর’ও বিশ মিনিট লেগে গেল বল রুম থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেডরুমে যেতে। সেখানে আবার অপেক্ষা করতে হল তাদের পালা আসার জন্য।
হ্যারিয়েটের পাপার জন্য করুণাই হলো ইসাবেলা’র। দশম আর্ল যদি জানাতেন যে তার বিছানার উপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে।
চারপাশের উদ্দাম হই-হল্লার মাঝেও একটাই চিন্তা ঘুরছে ওর মাথায়। মার্বেলের সিঁড়ির মাঝামাঝি একটুখানি জায়গা পাওয়া গেছে যেখানে দাঁড়িয়ে নজর রাখা যাবে সদর দরজা দিয়ে আগত প্রত্যেকের উপর। একই সাথে দেখা যাবে বল রুম আর নাচিয়েদের ভিড়ে ভারাক্রান্ত ড্রয়িং রুম।
একসাথে নাচার সব নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে যাচ্ছে বেলা। অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত জনের জন্য। আর রডার কোটস্ গ্রেইনজারের সাথে এতটাই ঠাণ্ডা আচরণ করেছে যে বেচারা ছাদের শ্যাম্পেন বারে চলে গেছে মন খারাপ করে। যাই হোক, ভালই হয়েছে।
টলতে টলতে, চিৎকার করতে করতে ভেতরে এলো আরো এক দল। তাদের মাঝে ঢেউ খেলানো কালো চুল দেখে ধড়াস ধড়াস করতে লাগল বেলা’র হৃদপিণ্ড। কিন্তু না, লোকটা বেশ খাটো। এদিকে ঘুরতেই চেহারা দেখে তো রীতিমতো রাগ হতে লাগল।
এক ধরনের বিকৃত যৌনানন্দের মর্মপীড়ায় আপ্লুত হয়ে পুরো সন্ধ্যায় মাত্র এক গ্লাস শ্যাম্পেন শেষ করল বেলা। এখন তো ওয়াইনও সাদা-মাটা আর গরম লাগছে। চারপাশে তাকিয়ে রজারকে খুঁজল, ভাবল আরেক গ্লাস আনিয়ে নেবে। দেখতে পেল, আলগা পাপড়ি লাগানো লম্বা আর কৃশকায় এক মেয়ের সাথে নাচে মত্ত সে।
ঈশ্বর, মেয়েটা কী ভয়ংকর ভাবতে ভাবতে তাকাল ড্রইং রুমের দরজার উপরে রাখা পোর্সেলিনের ফ্রেঞ্চ ঘড়ির দিকে। একটা বাজতে বিশ মিনিট বাকি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে করল বাবার কথা।
আজ দুপুর বেলায় পার্লামেন্টের প্রভাবশালী কনজারভেৰ্টিড মেম্বার আর তাদের স্ত্রীদের সাথে নিয়ে লাঞ্চ করবে ড্যাডি। বরাবরের মতো বেলাকেই সব ঠিকঠাক করতে হবে। তাই একটু ঘুমিয়ে নেয়া খুবই দরকার। তারপরেও ও এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কোথায় গেল ছেলেটা? তখনতো বলেছিল আসবে। “আসলে ও বলেছিল আসতে চেষ্টা করবো। কিন্তু সব কিছু এত হাসি-খুশি ছিল যে সেটাকে প্রমিজ হিসেবেই ধরে নেয়া যায়।
চেহারার দিকে না তাকিয়েই খারিজ করে দিল আরেকটা নাচের প্রস্তাব। ঢকঢক করে গলায় ঢালল শ্যাম্পেন। উফ! কী বাজে।
“একটা বাজার পর আর এক মিনিটও অপেক্ষা করব না।” নিজেকে শোনাল বেলা। আর এটাই শেষ কথা।”
আর তারপরেই বেড়ে গেল হার্টবিট। গানের শব্দ মনে হল কানে মধু বর্ষণ করছে। বিরক্তিকর ভিড় আর হট্টগোল সব ভুলে গেল। মন খারাপ ভাব কেটে গিয়ে বন্য এক উত্তেজনায় চাঙ্গা হয়ে উঠল।
ওই, সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে। এতটা লম্বা যে আশে পাশের সবার চেয়ে অন্তত আধা মাথা উঁচু। কপালের উপর প্রশ্ন চিহ্নের মতো পড়ে আছে একটা চুল। অভিব্যক্তিতে স্থির, অচঞ্চল সুদূরের অবয়ব।
ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে উঠে, “রামোন, আমি এখানে।” কিন্তু না নিজেকে থামাল। গ্লাস রেখে দিল একপাশে। গড়িয়ে যেতেই ঈষদুষ্ণ শ্যাম্পেন পড়ল নিচের সিঁড়িতে বসে থাকা মেয়েটার খোলা পিঠে। ইসাবেলা এমনকি মেয়েটার অভিযোগও শুনতে পেল না। হালকাভাবে উঠে দাঁড়াতেই রামোনের সবুজ দৃষ্টি এসে খুঁজে নিল ওকে।
চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকা অন্যদের মাথার উপর দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল দু’জনে। মনে হল যেন কেউ কোথাও নেই। কেউই হাসল না। ইসাবেলার কাছে মনে হলো এই সেই পবিত্ৰক্ষণ। ও এলো; আর অদ্ভুত কোন উপায়ে ইসাবেলা টের পেল কী হতে যাচ্ছে। নিশ্চিত যে এই মুহূর্ত থেকে বদলে গেল তার জীবন। কিছুই আর আগের মতো রইবে না।
সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়াজড়ি করে বসে থাকা কারো উপর ধাক্কা না খেয়েই নেমে আসতে লাগল বেলা। মনে হলো যেন ওরাই তাকে পথ করে দিল আর পা দুটোও খুঁজে নিল নিজেদের গন্তব্য।
রামোনকেই দেখছে শুধু। এগিয়ে এলো না। এত ভিড়ের মাঝে একেবারে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভঙ্গি দেখে মনে পড়ে গেল বিশাল শিকারি আফ্রিকান বিড়ালপুলোর কথা। ছেলেটার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বুকের মাঝে ছলাৎ করে উঠল ভয় মেশানো উত্তেজনা।
একে অন্যের সামনে দাঁড়িয়েও কেউই কথা বলল না। মুহূর্তখানেক পরে রোদে পোড়া শূন্য বাহু তুলে ধরতেই বুকের কাছে টেনে নিল রামোন। হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল বেলা। একসাথে নাচল দুজনে আর প্রতিটা পদক্ষেপে ঠিক যেন ওর শরীর থেকে বিদ্যুতের ঢেউ এসে আঘাত করতে লাগল বেলাকে।
চারপাশে ভিড়ে অতিরিক্ত গানের শব্দের মাঝেও নিজেদের রচিত সুরে মগ্ন হয়ে নেচে চলল রামোন আর ইসাবেলা। প্রচণ্ড শারীরিক আকর্ষণে যেন বেলাকে কোন বাদ্যযন্ত্রের মতই বাজিয়ে চলেছে ছেলেটা।
ইসাবেলার নিজেকে মনে হল আঙ্গুর লতা, যে কিনা জড়িয়ে রয়েছে রামোন বৃক্ষের গায়ে অথবা ঢেউ হয়ে আঁছড়ে পড়ছে রামোন পাথরের উপর। মনে হলো রামোন কোনো সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ আর নরম মেঘ হয়ে তাকে ঢেকে রেখেছে বেলা।
হালকা আর মুক্ত বিহঙ্গের মতো রামোনের বাহুডোরে নাচছে মেয়েটা। সময় আর স্থান-কালও যেন স্থির হয়ে গেছে। এমনকি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও খেই হারিয়ে ফেলেছে। জমিনে যেন পা-ই পড়ছে না আপ্লুত বেলার।
ওকে দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে রামন। দূর থেকে দেখল রজার কী যেন বলছে। লম্বা মেয়েটা চলে গেছে আর খেপে আগুন হয়ে আছে রজার; কিন্তু জালের মাঝে একসাথে তড়পাতে থাকা মাছেদের মতো মানুষের ভিড়ে ও’কে রেখে রামোনের সাথে চলে এলো বেলা।
সদর দরজায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে সিকুইনের কাজ করা ব্যাগ থেকে মিনি কুপারের চাবি বের করে রামোনের হাতে তুলে দিল।
শূন্য রাস্তা দিয়ে সাই সাই করে গাড়ি ছোটাল মোন। যতটা কাছে আসা সম্ভব ততটাই হেলান দিয়ে একমনে কেবল ছেলেটাকেই দেখছে বেলা, খেয়াল নেই তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রামোন। শুধু ভাবছে তৃষিত শরীরে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে।
হঠাৎ করেই থেমে গেল মিনি। লম্বা লম্বা পা ফেলে বেলার পাশে চলে এলো রামোন। বেলা বুঝতে পারল ছেলেটার আকুলতা। রামোনের হাত ধরে মনে হল শূন্যে চেপে রাস্তা ছেড়ে একই রকমের দেখতে লাল-রঙা দালানগুলোর একটার দ্বিতীয় ফ্লোরে উঠে এলো।
দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে উভয়ের বাঁধ ভেঙে গেল। সদ্য গজানো দাড়িঅলা হাঙ্গরের মতো শক্ত চামড়ামাখা মুখটা এসে স্বাদ নিল নরম উষ্ণ আর টসটসে মিষ্টি ঠোঁটের।
নিজের ভেতরে বিস্ফোরণের আওয়াজ পেল বেলা। ভেসে গেল সমস্ত বোধ-বুদ্ধি-বিবেক। কানের কাছে গজন করতে লাগল সামুদ্রিক ঝড়ো হাওয়া।
ছোট্ট হলওয়ের পলিশ করা কাঠের মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল পোশাক। বেলা’র দেখাদেখি একই রকম এস্ত ভঙ্গিতে নিজের পোশাকও দ্রুত খুলে ফেলল রামোন। ক্ষুধার্তের মতো তাকে দেখছে মেয়েটা।
কোন পুরুষের শরীর যে এতটা সুন্দর হতে পারে জানত না বেলা। মনে হলো অনন্তকাল ধরে কেবল তাকিয়েই থাকতে পারবে যদিও তর সইছে না আর।
মেয়েটাকে দুহাতের মাঝে তুলে নিল ছেলেটা। তারপর নিয়ে গেল ঝড়ের মুখে ভেসে যেতে।
***
জেগে উঠতেই, এক ধরনের ভালো লাগা এসে ছড়িয়ে গেল ইসাবেলা’র পুরো দেহে। মনে হল এই অনির্বচনীয় আনন্দ বুঝি কখনোই কাটবে না। শরীরের প্রতিটি রোমকূপ যেন নব জীবন লাভ করেছে।
বহুক্ষণ ধরে বুঝতেই পারল না যে কী হচ্ছে। তবু মুহূর্তটুকু উপভোগ করতে পড়ে রইল চোখ বন্ধ করে। জানে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে এই যাদুকরী অনুভূতি, তবু চায় না এটা ফুরিয়ে যাক। এখনো সারা দেহে ছড়িয়ে আছে মানুষটার গন্ধ, স্পর্শ আর সুখকর এক ব্যথার আবেশ।
আর তারপর হঠাৎ বিস্ময়ে ফিরে পেল চেতনা : আমি প্রেমে পড়ে গেছি। পুরোপুরি জেগে উঠতেই বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দে মনে হলো পাগল হয়ে যাবে।
তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই পায়ের কাছে পড়ে গেল চাদর। “রামোন” মাথার পাশের বালিশের উপর চোখ চলে যেতেই শিহরিত হয়ে উঠল শরীর। সাদা চাদরের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে গাঢ় রঙা চুল। হাত বাড়াতেই বুঝতে পারল ঠাণ্ডা হয়ে আছে বিছানার প্রান্ত। বহু আগেই উঠে গেছে ছেলেটা। আনন্দটুকু উবে গিয়ে হতাশায় ছেয়ে গেল মন।
“রামোন” বিছানা থেকে নেমে নিরাভরণ দেহেই বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল বেলা। খালি বাথরুমের দরজাটা কিঞ্চিৎ খোলা। আরো একবার উধাও হয়ে গেল ছেলেটা। মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হতাশা নিয়ে চারপাশে তাকাল মেয়েটা।
এরপরই চোখ পড়ল বেডসাইড টেবিলে। পারিবারিক পদবী খোদাই করা দামি ক্রীম রঙা কাগজের পাতা পড়ে আছে। মিনি কুপারের চাবি আর বেলা’র আংটি দিয়ে চাপা দেয়া হয়েছে কাগজটা। আগ্রহ নিয়ে ছোঁ মেরে কাগজটা তুলল হাতে। কোনো সম্বোধন ছাড়াই লেখা আছে,
অসাধারণ এক নারী হওয়া সত্ত্বেও ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে দেখায় শিশুর মত, সুন্দর সুবোধ একটা শিশু। তাই তোমাকে জাগালাম না। ছেড়ে যেতেও মন চায়নি, কিন্তু যেতে হবে।
সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে যদি আমার সাথে মালাগা যেতে পারো, তাহলে আগামীকাল সকাল নয়টায় এখানে চলে এসো। পাসপোর্ট নিয়ে এসো, কিন্তু পায়জামা না হলেও চলবে।
রামোন আবারো মন ভরে উঠল চাপা আনন্দে। আরেকবার পড়ে দেখল, লেখাটা। মসৃণ আর মার্বেলের মতো ঠাণ্ডা কাগজটা ছুঁয়ে আঙ্গুলের ডগাও যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ল। স্বপ্নাতুর চোখে ভেসে উঠল গত রাতের প্রতিচ্ছবি।
রামোনের সাথে শারীরিক মিলনের পর মনে হচ্ছে ওর শরীরের সাথে পুরো চেতনাও গ্রাস করে নিয়েছে ছেলেটা।
স্বর্গীয় কোনো স্পৃহাতে একে অন্যের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে দু’জনে। এক হয়ে উঠেছে দেহ আর মন।
গত রাতে বহুবার মনে হয়েছে এই বুঝি চূড়ায় পৌঁছে গেছে দু’জনে। কিন্তু না, তারপরেই আবিষ্কার করেছে তখনো সামনে থাকা বৃহৎ পর্বতের পাদদেশেই কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর আরেকটা, আরো একটা। প্রতিটাই আগেরটার চেয়ে আরো আরো উঁচু আর বিশাল। এর যেন কোনো শেষ নেই। অবশেষে গভীর ঘুমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ায় যেন সমাপ্ত হয়েছে সবকিছু। আর পুনরুষ্ণানের পর জেগে উঠেছে নব আনন্দ আর অস্তিত্ব নিয়ে।
“আমি প্রেমে পড়ে গেছি।” প্রায় প্রার্থনার মতো করে বিড়বিড় করে উঠল বেলা। চোখ নামিয়ে তাকাল নিজ শরীরের দিকে। সবিস্ময়ে ভাবল কেমন করে পলকা দেহ ভরে আছে এতটা আনন্দ আর অনুভূতিতে।
এরপরই চোখ পড়ল বেড সাইড টেবিলে গাড়ির চাবির সাথে পড়ে থাকা হাতঘড়ির উপর।
“ওহ ঈশ্বর! সাড়ে দশটা বাজে।” ড্যাডি’র লাঞ্চ! দৌড় দিয়ে বাথরুমে গেল। ওয়াশ-বেসিনের উপর মোড়ক লাগানো নতুন ব্রাশ রেখে গেছে রামোন। দেখে যারপরণাই কৃতজ্ঞ হলো বেলা।
মুখ ভর্তি টুথপেস্টের ফেনা দিয়ে গুণগুণ করে উঠল “ফার অ্যাওয়ে প্লেসেস।”
তাড়াতাড়ি গোসল করে নেবে কিনা ভাবতে ভাবতেই উষ্ণ পানিতে গা ডুবিয়ে মনে করল রামোনের কথা। শূন্যতায় ছেয়ে আছে শরীর, রামোন ছাড়া যা আর কেউ পূরণ করতে পারবে না।
তোয়ালে হাতে নিতেই দেখা গেল এখনো ভেজা। নিশ্চয়ই রামোন স্নান করে গেছে। নাক-মুখের উপর চেপে ধরে ঘ্রাণ নিল উদভ্রান্তের মত। উত্তেজিত হয়ে পড়তেই নিজেকে শুধালো, “থামো এবার!” ধোয়া ঢাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সাবধান করল। এক ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে ট্রাফালগার স্কোয়ারে পৌঁছাতে হবে।”
ফ্ল্যাট থেকে বের হতে যাবে এমন সময় আবারো কী মনে হতেই দৌড়ে গেল বাথরুমে। সিকুইনের হ্যান্ডব্যাগ হাতড়ে বের করে আনল ওভানন পিল।
জিভের উপর ছোট্ট সাদা ক্যাপসুলটা রেখে কল থেকে আধা মগ পানি নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে স্যালুট করল নিজেকে।
‘জীবন, ভালোবাসা আর স্বাধীনতার জন্য। আর মেনি হ্যাপি রিটার্নস।” গিলে ফেলল ওষুধটা।
***
রক্ত নিয়ে খেলা করতে কখনোই আপত্তি জানায় না ইসাবেলা কোর্টনি। ওর বাবা সবসময় শিকারিই ছিল। উত্তমাশা অন্তরীপের ওয়েল্টেভ্রেদেনে তাদের বাড়ি ভর্তি হয়ে আছে সেসব ট্রফিতে। পারিবারিক সম্পত্তি মাঝে, জাম্বেজি উপত্যকার শিকার অভিযানের আয়োজন করে এমন একটি সাফারী কোম্পানিও আছে। লাইসেন্সধারি শিকারি আর কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের নকশাকার বড় ভাই শন কোর্টনির সাথে মাত্র গত বছরেই শান্ত সমাহিত জঙ্গলের মাঝে রাত কাটিয়েছে বেলা। হ্যারিয়েট বু-চ্যাম্পের নিমন্ত্রণে বেশ কয়েকবার হাউন্ড নিয়েও শিকার করেছে। এক্ষেত্রে ইসাবেলার সঙ্গী সতের বছরের জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া স্বর্ণের খোদাই করা ছোট্ট সুন্দর হল্যান্ড এন্ড হল্যান্ড ২০ গজ শটগান।
আজ দ্বিতীয় দিন। প্রায় তিনশ প্রতিযোগীর সকলে ঝরে পড়ে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র দু’জনে। তাই অবস্থা হচ্ছে, “একটা মিস করলেই আউট।” কিংবা “যে জিতবে সে সব পেয়ে যাবে” টাইপ প্রতিযোগিতা। প্রবেশ মূল্য ছিল প্রতিজন এক হাজার ইউ এস ডলার; ফলে প্রায় মিলিয়নের চার ভাগের এক ভাগ অর্থ। চারপাশ টেনশনের উত্তাপে এতটা জমে উঠেছে যে ঠিক যেন আমেরিকানদের প্লেটে বিভিন্ন সবজি আর মাংস দিয়ে তৈরি স্যুপ।
এক আমেরিকান আর রামোন মাচাদো হচ্ছে টিকে যাওয়া দুই প্রতিযোগী। গত তেইশ রাউন্ড ধরে দু’জনে সমান সংখ্যক গুলি ছুঁড়েছে। তাই বিজয়ী নির্বাচনের জন্য স্প্যানিশ বিচারক আদেশ দিয়েছেন এখন থেকে জোড়া পাখি মারতে হবে।
আমেরিকানটি ফুল-টাইম প্রফেশন্যাল। স্পেন, পর্তুগাল, মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা আর গত বছর পর্যন্ত মোনাকো সহ ভ্রমণ করত এ ছেলে। কিন্তু ছোট্ট দেশটাতে এই খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে যখন গুরুতর আহত একটা কবুতর স্টেডিয়াম পার হয়ে রাজপ্রাসাদের দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেয়ে অবশেষে আছড়ে পড়েছে রাজকুমারী গ্রেস’র চায়ের টেবিলে। লেসের টেবিল ক্লথ আর লেডিসদের টি গাউনে ছিটিয়ে পড়েছে রক্ত। ক্ষুদ্র রাজ্যের পুরো অধের্ক জুড়ে শোনা গেছে চিৎকার। আর তারপর থেকেই মোনাকোতে জীবন্ত কবুতর খেলা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
আমেরিকানটার বয়স ইসাবেলারই মত। এখনো পঁচিশও হয়নি। কিন্তু এরই মাঝে বছরের কোটি ডলার আয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। গুলি ছুড়ছে “সাইড বাই সাইড” বারো গজ দিয়ে; যেটি প্রায় শতবর্ষ আগে তৈরি করে গেছেন কিংবদন্তী অস্ত্রনির্মাতা জেমস মার্টিন, তবে আধুনিক আমলের লম্বা কার্টিজ আর ধোঁয়াবিহীন পাউডার ব্যবহার করার মতো সংশোধন আনা হয়েছে এর নকশায়।
নিজের শ্যুটিঙের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল তরুণ আমেরিকান। বন্দুকের হ্যাঁমার টেনে, ডান হাতের তালুতে হাতল ধরে জোড়া মাজল তাক করল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে থেকে ত্রিশ গজ সামনে অর্ধ বৃত্তাকারে ঝোলানো পাঁচটা ঝুঁড়ির ঠিক মাঝখানে।
প্রতিটি ঝুড়িতে আছে একটা করে কবুতর। বেশির ভাগ বড় শহরের মাঝে ঝাঁক বেঁধে বাস করে এ জাতীয় বন্য পাখির দল।
পাখিদের মজুদ নিশ্চিত করার জন্য শু্যটিং ক্লাব ফিডিং শেড তৈরি করেছে। ট্রে অলা কাঠামোতে প্রতিদিন রাখা হয় গমের গুঁড়ো। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ফিডিং বার্ড এলেই আটকে দেয়া হয় ফাঁদের দরজা। প্রায়ই দেখা যায় যে কিলিং গ্রাউন্ড থেকে বেঁচে যাওয়া কবুতরগুলো উড়ে আবার ফিরে আসে এই ফিডিং শেডে। আগেও বহুবার মারা গেছে অসংখ্য পাখি। এই ছোট্ট প্রাণীগুলোও তাই বের করে ফেলেছে কিভাবে এড়িয়ে যেতে হয় গুলি, সেই কৌশল। এর উপর আবার পাখিগুলোকে যারা কুঁড়িতে রাখার দায়িত্ব পায়, তারা জানে কিভাবে পাখনা কিংবা লেজ থেকে একটা কি দুটো পালক খুলে নিলেই এলোমেলোভাবে অনিশ্চিৎ দিকে উড়ে যাবে প্রাণীগুলো।
শ্যুটার “পুল” বলার সাথে সাথে এক থেকে পাঁচ সেকেন্ডের মাঝে খুলে যায় কুঁড়ি। আর এই পাঁচ সেকেন্ড, দুরু দুরু বুকে ঘামতে থাকা, হাজার হাজার ডলারের টেনশন করা কারো জন্য ঠিক যেন অনন্তকালেরই সমান।
ঝুড়িগুলোর দূরত্ব ত্রিশ গজ আর ১২ গজ শটগানের রেঞ্জ সাধারণত চল্লিশ গজ ধরা হয়। আর ঘুরে আসার সার্কেলটাকে রাখা হয়েছে খুঁড়ির লাইনের দশ গজ পিছনে।
এটা মাত্র আট ইঞ্চি উঁচু একটা কাঠের দেয়াল। সাদা রং নির্দেশ করছে কিলিং গ্রাউন্ডের সীমানা। জিতলে হলে পাখির মরা দেহ কিংবা খণ্ডিত দেহের সবচেয়ে বড়অংশ কাঠের দেয়ালের ভেতর পড়তে হবে। তাই সীমানা পার হবার আগেই ছাড়া পাবার দশ গজের ভেতর পাখিটাকে মেরে ফেলতে হবে।
সামনে পয়তাল্লিশ ডিগ্রি অর্ধবৃত্তাকারে দুলছে ঝুঁড়িগুলো। জানার কোনো উপায় নেই যে “পুল” বলার সাথে সাথে কোন ঝুঁড়িটা খুলে যাবে কিংবা পাখিটা কোন দিকে উড়ে যাবে। ডানে-বামে; দূরে যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারে আর সবচেয়ে বাজে হলো কখনো কখনো সোজা শু্যটার এর দিকেই উড়ে আসে।
দ্রুত আর শব্দ করে উড়ে বেড়ানো কবুতরের ক্ষেত্রে এখন আবার নিয়ম করা হলো একসাথে দুটো করে পাখি ছাড়া হবে।
খানিকটা হামাগুড়ির ভঙ্গিতে নিজের জায়গা আঁকড়ে ধরল আমেরিকান ছেলেটা। বক্সারদের মতো করে বাম পাটা খানিক এগিয়ে রয়েছে। হালকাভাবে রামোনের হাতে চাপ দিল ইসাবেলা। দু’জনে বসে আছে প্রতিযোগী আর ক্লাব অফিসারদের জন্য সংরক্ষিত। সামনের দিকে নিচের সারির চামড়ায় সোজা চেয়ারে।
“পুল!” আমেরিকানটা চিৎকার করে উঠতেই মনে হল ওর টেক্সান গলার স্বর এমনভাবে নীরবতা ভেঙে ফেলেছে যেন কামারের নেহাই এর উপর হাতুড়ির বাড়ি পড়েছে।
“যাতে না লাগে!” ফিসফিস করে উঠল ইসাবেলা। “ফ্রিজ মিস্ হোক গুলি!”
প্রথম দুই সেকেন্ডে কিছুই ঘটল না। এরপরই শব্দ করে খুলে গেল দুটো ঝুডির ঢাকনা। আমেরিকানটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে খানিকটা বামে আর পুরোপুরি ডানে’র দুই আর পাঁচ নম্বর ঝুড়ি। ঝুড়ির তলা’র আটকে থাকা বাতাসে আঘাত পেয়ে আস্তে আস্তে উড়ে গেল পাখিগুলো।
দুই নম্বর পাখিটা নিচু দিয়ে দ্রুত উড়ে গেল। খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই কাঁধে শটগান তুলে গুলি ছুড়ল আমেরিকান ছেলেটা। ঝুড়ি থেকে বের হয়ে পাঁচ গজ যেতে না যেতেই ভবলীলা সাঙ্গ হল পাখিটার।
দ্বিতীয়টির দিকে নজর দিল ছেলেটা। বার্নিশ করা তামার মতো চকচকে শরীর নিয়ে ডানদিকে উড়তে থাকা পাখিটা গুলির শব্দে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ঘুরছে। ফলে নিশানা ঠিক করতে পারল না ছেলেটা। হার্ট, আর ব্রেইন ফুটো না করে পাখিটার ডান পাখা ভেঙে দিল গুলি। বাতাসে পালক ছড়িয়ে টলমল করে নামতে লাগল আহত পাখি।
নিচু সাদা কাঠের দেয়ালের মাত্র ফুটখানেক ভেতরে আছড়ে পড়ল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল দর্শকেরা। এরপরই অবিশ্বাস্যভাবে একটা পাখা বিহীন পাখিটা উন্মাদের মতো নাড়তে লাগল বাকি পাখনা। উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে এক সাথে দাঁড়িয়ে গেল সব দর্শক। অন্যদিকে একেবারে মাঝখানে কাঁধে শটগান নিয়ে বরফের মতো জমে গেল আমেরিকান ছেলেটা। মাত্র দুই কার্টিজ দেয়া হয়েছে ওকে। তাই তৃতীয় কার্টিজ লোড় করে পাখিটাকে মেরে ফেললে তৎক্ষণাৎ তাকে বাতিল ঘোষণা করে কেড়ে নেয়া হবে পুরস্কারের অর্থ।
ব্যারিকেডের কাছে গিয়ে দুর্বলভাবে লাফ দিল কবুতরটা। উপর থেকে ইঞ্চি খানেকের জন্য বুক বেঁচে গেল কাঠের দেয়ালে বাড়ি খাবার হাত থেকে। আর তারপরই পড়ে গেল। সাদা রঙের উপর উজ্জ্বল লাল রঙের ছিটে লাগল।
দর্শকদের অর্ধেক চিৎকার করে উঠল, “মরে গেছে!” অন্যদিকে আমেরিকান ছেলেটা’র বিরুদ্ধ সমর্থকেরা চিৎকার করে উঠল, “চলে যারে পাখি, যা!”
নিজের সর্বশক্তি এক করে আরো একবার লাফ দিল কবুতরটা। এবারে উপরে পৌঁছে অনিশ্চিতভাবে আগু-পিছ টলতে রইল আহত প্রাণীটা।
অন্যদের সাথে ইসাবেলা নিজেও বন্য উন্মাদে চিৎকার করছে, “লাফ দে।” অনুনয়ের সুরে বলে উঠল, “নাহ্-ওহ, মরিস না রে সোনা! উড়ে যা, প্লিজ।”
হঠাৎ করেই ঝাঁকি দিয়ে উঠে শক্ত হয়ে গেল পাখিটার দেহ। ঘাড় পেছনের দিকে বেঁকে পড়ে গেল দেয়াল থেকে, সবুজ লনের উপর পড়ে রইল নিথর হয়ে।
“থ্যাঙ্ক ইউ!” হাপ ছেড়ে নিজের আসনে এসে বসল ইসাবেলা।
সামনের দিকে পড়ে যাওয়ায় সার্কেলের বাইরে মারা গেছে কবুতরটা। মাথার উপরে থাকা লাউড স্পিকার গম গম করে শুনিয়ে দিল ফলাফল। স্প্যানিশ ভাষায় হলেও গত দুই দিনে তা ভালোভাবেই শিখে গেছে ইসাবেলা।
“ওয়ান কি। ওয়ান মিস্।”
“আমি আসলে এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।” নাটকীয় ভঙ্গিতে পেট চেপে ধরতেই শীতল সবুজ চোখ জোড়া তুলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল রামোন।
“নিজের দিকে তাকাও। একেবারে একটা বরফের মত। তুমি কি কোনো কিছুই অনুভব করো না?”
“তোমার বিছানার বাইরে কিছুই না আসলে।” বিড় বিড় করে জানাতেই লাউড স্পিকারে শোনা গেল, “নেক্সট গান আপ নাম্বার ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড টেন!”
যুৎসই কোন জবাব দেয়ার ফুরসৎ পেল না ইসাবেলা।
উঠে দাঁড়াল রামোন। একই রকম শীতলভাবে কানের উপর ঠিকঠাক করে বসিয়ে নিল প্রটেক্টর। ইসাবেলা’কে শিখিয়েছে যেন তাকে কখনো সৌভাগ্যের জন্য উইশ না করে। তাই মেয়েটাও কিছু বলল না। গেইটের কাছে লম্বা র্যাকে রাখা একমাত্র অস্ত্রটা নামিয়ে হাতে নিয়ে উজ্জ্বল আইবেরীয় সূর্যালোকে বেরিয়ে এলো রামোন।
মুগ্ধ হয়ে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। নিজ জায়গামতো এসে পেরাডিজ ১২ গজ লোড় করে ব্রিচ বন্ধ করে দিল রামোন। আর তারপরই কেবল কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল ইসাবেলার দিকে। গত দুদিন ধরেই গুলি ছোঁড়ার সময়ে এ কাজটা করে আসছে। বেলাও জানতো তাই দুই হাত বাড়িয়ে রামোন’কে দেখাল মুষ্টিবদ্ধ হাত।
ঘুরে দাঁড়িয়েই মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল রামোন। আরো একবার আফ্রিকান বিড়ালের কথা মনে পড়ে গেল বেলার। আমেরিকান ছেলেটার মতো হামাগুড়ি নয়, সটান দাঁড়িয়ে থেকে মোলায়েম স্বরে উচ্চারণ করল, “পুল!” মুক্তি পেয়েই বন্যভাবে পাখা ঝাঁপটাতে শুরু করে দিল দুটো পাখি। মনে হল কোনো তাড়াহুড়া নেই এমন অভিজাত ভঙ্গিতে অস্ত্র তুলে নিল রামোন।
মেক্সিকোতে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে থাকাকালীন লিবারেশন আমির ফান্ডের অনেকটুকুই খরচ হত গুয়াভালাজারা’তে শটগান দিয়ে জীবন্ত কবুতর মারা’য় রামোনের প্র্যাকটিসের পেছনে। তাই পেশাদারদের মতো তারও আছে এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ময়কর দৃষ্টি শক্তি আর প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতা।
প্রথম পাখিটা দ্রুত উজ্জ্বল সবুজ পাখা ছড়িয়ে উড়ে চলল দেয়ালের দিকে। নিচের ব্যারেল থেকে ছয় নম্বর শটে চমৎকারভাবে গুলি করল পাখিটাকে। ফেটে যাওয়া বালিশের মতো পালক ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হল অবোধ প্রাণীটা।
এবারে, নর্তকীর মতো ঘুরতে থাকা দ্বিতীয় পাখির দিকে নজর দিল রামোনএই কবুতরটা বেশ অভিজ্ঞ। এর আগেও কয়েকবার গুলি ছোড়া হয়েছে ওর দিকে। তাই ঝুঁড়ির কাছাকাছিই নিচেই রইল। দেয়ালের দিকে না গিয়ে সোজা নেমে আসতে লাগল রামোনের মাথা লক্ষ্য করে। রেঞ্জ দশ ফুট কমে যাওয়ায় গুলি লাগানো বেশির ভাগ সময়েই কষ্ট হয়ে পড়ে। চোখের সামনে ঝলকানি দেখে সেকেন্ডের শত ভাগের এক ভাগ মাত্র সময় পেল প্রতিক্রিয়া করার। রামোনের মনে হলো একটাই মাত্র গুলি ছোঁড়ার সুযোগে যদি ভুল হয়ে যায়, অথবা অ্যাংগেলে গণ্ডগোল হয় তাহলেই সর্বনাশ ঘটে যাবে।
পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে চৌকোণাভাবে কবুতরটার মাথায় সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করল রামোন। রক্তমাখা পাখা নিয়ে নিথর দেহ ছিটকে পড়ল দূরে। অক্ষত রইল কেবল দুটো পালক। গোত্তা খেয়ে এসে পড়ল রামোনের পায়ের কাছে।
পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলো ইসাবেলা। এক ঝটকা মেরে ভেঙে ফেলল ব্যারিয়ার। দুর্বোধ্য স্প্যানিশে রেঞ্জ মাস্টার কিছু বললেও কে শোনে কার কথা। লম্বা, ডেনিমে মোড়া পা দুটো দৌড়ে এলো রামোনের কাছে।
এতক্ষণ উত্তেজনা আর টেনশনে দর্শকেরাও কাহিল হয়ে পড়েছিল। রামোন আর ইসাবেলা এবারে স্টেডিয়ামের মাঝখানে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতে দেখে সবাই হাততালি দিল হাসতে হাসতে। সুদর্শন এই জুটির দু’জনেই অত্যন্ত লম্বা, অ্যাথলেটিক, স্বাস্থ্য আর তারুণ্যে ভরপুর। অন্যদিকে ভালোবাসার এই স্বচ্ছন্দ্য বহিঃপ্রকাশ ছুঁয়ে গেল দর্শকদের হৃদয়।
***
এয়ারপোর্টে ইসাবেলার ভাড়া করা মার্সিডিজে চড়ে শহরে এলো দু’জনে। মেইন স্কোয়ারের বাঙ্কো ডি এসপানাতে একটা একাউন্ট ওপেন করে বিজয়ীর চেক জমা দিল রামোন।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো অর্থের ব্যাপারে দুজনেরই মনোভাব এক। কোনো কিছুর দাম নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় না ইসাবেলা। রামোন খেয়াল করে দেখেছে, কোনো পোশাক কিংবা গয়না পছন্দ হলে দাম জিঙ্গেস না করেই নিজের ব্যাড় খুলে প্ল্যাস্টিক ক্রেডিট কার্ডের বিশাল কালেকশন থেকে একটা তুলে রেখে দেয় কাউন্টারে। স্লিপে সাইন করে একইভাবে না দেখেই কপি রেখে দেয় ব্যাগের ভেতর। হোটেল রুমে ব্যাগ উপুড় করে সব স্লিপ দিয়ে বল বানিয়ে অতঃপর ছুঁড়ে ফেলে দেয় ট্র্যাশবিনে।
এছাড়াও মেয়েটার সাথে থাকে এক তোড়া ব্যাংক নোট। যদিও স্টালিং আর স্প্যানিশ পেসেতাসের বিনিময় মূল্য নিয়ে ভাবিত নয় ইসাবেলা। প্রায়ই দেখা যায় এক কাপ কফি কিংবা এক গ্লাস ওয়াইনের বিল মেটাতে গিয়ে সাইজ আর রং দেখে যে কোনো একটা ব্যাংক নোট সিলেক্ট করে রেখে দেয় টেবিলে আর পেছনে নির্বাক বিস্ময় নিয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওয়েটার।
একই কথা খাটে রামোনের বেলাতেও। প্রথমতো পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার ভিত্তি আর নিদর্শন হিসেবে একে অবজ্ঞা করে ছেলেটা। অন্যদিকে দায়িত্ব পালন করার জন্য ক্যাশ চাইতে গিয়ে মস্কোর সাথে যে পরিমাণ দেনদরবার করতে হয় তাতেও অরুচি ধরে গেছে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই বুঝে গেছে উপর অলারা তাকে কতটা অর্থ অনুমোদন দেবে, তাই অনেক অপারেশনের খরচ সে নিজেই বহন করে।
মেক্সিকোতে এভাবেই জীবন্ত কবুতর গুলি করে মারত। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে মাদক এনে ক্যাম্পাসে বিক্রি করত। ফ্রান্সে থাকার সময় আলজেরীয়দের হয়ে অস্ত্র চালাত। ইটালীতে চোরাকারবারী ছাড়াও যুক্ত ছিল চারটা অপহরণ কার্য পরিচালনার সাথে।
আর এসব অপারেশনের অর্থই পৌঁছে গেছে হাভানা আর মস্কোতে। এর ফলেই দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে এ বয়সেই নির্বাচিত হয়েছে জেনারেল সিসেরোর স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য।
এবারেও প্রথম থেকেই লাল গোলাপের মতো অভিযানে সিসেরো যতটা অর্থ বরাদ্দ করেছেন তা অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে যতটা সম্ভব পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা ছাড়াও অপারেশনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্য স্পেনকে বেছে নিতে হয়েছে।
রোমোনের বিজয়কে উদযাপনের জন্য ছোট্ট একটা সী-ফুড রেস্টোরেন্টে এসে বসল দুজনে, ডিনার গেস্টদের মাঝে ইসাবেলাই একমাত্র বিদেশি।
ক্ল্যাসিক্যাল ট্রাডিশন অনুযায়ী তৈরি অসম্ভব সুস্বাদু খাবারের সাথে পরিবেশন করা হলো কোনো এক সময় রামোন’দের পরিবারিক সম্পত্তি ছিল এমন এক এস্টেট থেকে আসা ওয়াইন; স্পেনের বাইরের আর কোথাও বিক্রি হয় না এ উপাধেয় পানীয়।
ওয়াইনের স্বাদ নিয়ে মুগ্ধ ইসাবেলা জানতে চাইল, “তোমাদের পারিবারিক এস্টেটগুলো কী হয়েছে?”
“ফ্রাঙ্কো ক্ষমতায় আসার পর সব হারিয়ে ফেলেছে বাবা।” গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু রেখে রামোন জানাল, “প্রথম থেকেই তিনি অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ছিলেন।”
বুঝতে পেরে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল ইসাবেলা। তার বাবাও আজীবন ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছেন।
“তোমার বাবা আর পরিবার নিয়ে আমাকে কিছু জানাবে না?” রামোনকে নিমন্ত্রণ করল বেলা। উপলব্ধি করল প্রায় সপ্তাহখানেক একসাথে থাকলেও ডিনার টেবিলে স্প্যানিশ চার্জের দেয়া তথ্য ছাড়া ছেলেটা সম্পর্কে আর কিছুই জানে না সে।
হা হয়ে তাই শুনল রামোনের স্মৃতিচারণ। ১৪৯২ সালে কলম্বাসের সাথে আমেরিকা আর ক্যারিবীয়তে আসার পর পদবী লাভ করেছিল ওর পূর্বপুরুষ। এহেন পূর্ব ইতিহাস জানতে পেরে মুগ্ধ হয়ে গেল ইসাবেলা।
নিজের কথা জানাতে গিয়ে বলল, “প্রপিতামহ শন কোর্টনির বংশধর আমরা। উনিশ শতকের কোন এক সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর এসময় খেয়াল হল, যদি রামোন সন্তানের জনক হয় তাহলে কোন একদিন তার নিজের ছেলেও গর্ব ভরে উচ্চারণ করবে এই ইতিহাস। এর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শুধু রামোনের সাথে থাকতে পারাটাই আনন্দের ছিল; কিন্তু এখন মোমবাতির আলোয় সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে দিগন্তে ডানা মেলল স্বপ্নেরা।
“আর এতসব সত্ত্বেও, বেলা, বুঝতেই পারছ আমার কোনো টাকা-পয়সা নেই।”
“হ্যাঁ, সেটাই। আজ বিকেলেই তো দেখলাম ব্যাংকে দুই কোটি ডলার জমা দিয়েছ।” হালকাভাবে বলে উঠল, “অন্তত আরেক বোতল ওয়াইন তো কিনে দিতে পারবে।”
“যদি তোমাকে কাল সকালেই লন্ডন ফিরতে না হত, তাহলে এই অর্থের কিছুটা খরচ করে তোমাকে গ্রানাডা নিয়ে যেতাম। ষাড়ের লড়াইয়ে সঙ্গ দেয়াসহ দেখাতাম সিয়েরা নেভাডাতে আমাদের পারিবারিক
“কিন্তু তোমাকেও তো লন্ডন ফিরতে হবে, তাই না?”
“হুম কয়েকটা দিন ম্যানেজ করে নিতে পারব।”
“রামোন, তুমি যে কী করো, আমি তাও জানি না। উপার্জন করো কিভাবে?”
“মার্চেন্ট ব্যাংকিং।” অস্পষ্টভাবে মাথা ঝাঁকাল রামোন। “প্রাইভেট একটা ব্যাংকের হয়ে কাজ করি। দায়িত্ব হচ্ছে আফ্রিকান বিষয় সামলানো। মধ্য আর দক্ষিণ আফ্রিকার উন্ননশীল কোম্পানিগুলোর জন্য ঋণ সরবরাহ করি।”
চিন্তার ঝড় বইছে ইসাবেলার মাথায়। কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের টপ লেভেলে মার্চেন্ট ব্যাংকারের জন্য নিশ্চয়ই একটা জায়গা তৈরি হয়ে যাবে। সবকিছুই বেশ চমৎকারভাবে এগোচ্ছে।
“তোমার দুর্গটা দেখার চেয়ে দুনিয়াতে আর কোনো জরুরি কাজ নেই আমার, রামোন ডালিং।” ফিসফিস করে জানিয়েই মনে হলো : একটা দুর্গের কতটা দাম হতে পারে, গ্যারি’কে অনায়াসে এর কথা বলা যাবে। কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আর ফিনান্সিয়াল হেড হল গ্যারি। পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যদের চেয়ে ইসাবেলা’র সবচেয়ে কাছের এই ভাই।
“আর তোমার বাবা? আমি তো জানি যে তুমি সোমবারে ফেরার কথা প্রতিজ্ঞা করে এসেছ।” জানতে চাইল রামোন।
“বাবা’কে মানানোর ভার আমার উপর ছেড়ে দাও।” দৃঢ় স্বরে জানাল ইসাবেলা।
***
“বেলা, এটা কোনো সময় হলো কাউকে ঘুম থেকে জাগানোর?” টেলিফোনে বলে উঠলেন শাসা। “কয়টা বাজে বল তো?”
“ছয়টার বেশি বাজে, আমি এরই মাঝে সাঁতার কেটে এসেছি আর তুমি মোটেও বুড়ো হয়ে যাওনি, ড্যাডি। আমার দেখা সবচেয়ে তরুণ আর সুদর্শন পুরুষ হচ্ছ তুমি।” ইন্টারন্যাশনাল লাইনে বাবার সাথে আহলাদী করল বেলা।
“আমার তো ভয় হচ্ছে রে।” বিড়বিড় করে উঠলেন শাসা। “প্রশংসা যত বেশি আবদারও তত ভয়ংকর। কী চাস রে বেটি? এবারে কোন মতলব?”
“তুমি আসলেই খালি দোষ খুঁজে বেড়াও, বাবা।” রামোনের বুকের পশম নিয়ে খেলতে খেলতে উত্তর দিল বেলা। ডাবল বেডে ঘর্মাক্ত দেহে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা। “আমি তো শুধু এটুকু জানাতে চাইলাম যে আই লাভ ইউ পাপা।”
মুখ টিপে হাসছেন শাসা। “কতটা দায়িত্বশীল এই ছোট্ট ইন্দুরটা। ভালই শিক্ষা দিয়েছি।” বালিশে হেলান দিয়ে পাশে শুয়ে থাকা নারীর কাঁধে তুলে দিলেন মুক্ত হাতখানা। ঘুমের মাঝেই কাছে সরে এলো নারীদেহ। মুখ ঘসল শাসার বুকে।
“হ্যারিয়েট কেমন আছে?” স্পেনে ইসাবেলার অভিসারকে কাভার দিতে রাজি হয়েছে হ্যারিয়েট বু-চ্যাম্প।
“ও ভালো আছে।” আশ্বস্ত করল বেলা। “এই তো এখানেই আছে। চমৎকার সময় কাটছে আমাদের।”
“ওকে আমার ভালোবাসা দিও।” জানালেন শাসা।
“ওহ, ঠিক আছে।” মাউথপিসে হাত দিয়ে ঝুঁকে রামোনকে কিস করে বেলা জানাল, ‘আজ সকালের লন্ডনের প্লেন ধরতে চাইছে না ও।”
“আহ! তো এবারে এলো আসল কথা।”
“আমি না ড্যাডি, হ্যারিয়েট ও গ্রানাডাতে যেতে চায়। বুলফাইটে আমাকেও নিতে চাইছে।” আস্তে করে চুপ হয়ে গেল বেলা।
“বুধবারে তুমি আর আমি প্যারিস যাব, ভুলে গেছ? ক্লাব ডিমানছে’তে আমার বৃক্ততা আছে।”
“ড্যাডি, তুমি এত চমৎকারভাবে কথা বলো! ফ্রেঞ্চ লেডিসরা’ও যথেষ্ট সমাদর করে, আমি নিশ্চিত আমাকে তোমার দরকারই হবে না।”
খানিক কোনো কথা বললেন না শাসা। মাউথপিসে হাত রেখে বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকা নারীর কাছে জানতে চাইলেন,
“কিটি, বুধবারে প্যারিস যেতে পারবে।”
চোখ খুলে উত্তরে জানাল, “তুমি তো জানো আমি শনিবারেও এইউ কনফারেন্সের জন্য ইথিওপিয়া যাচ্ছি।”
“ততদিনে আমরা চলে আসব।”
কনুই এর উপর র দিয়ে উঠে চিন্তার ভঙ্গিতে শাসার দিকে তাকিয়ে সঙ্গিনী জানাল, “ঠিক আছে শয়তান, তাই হবে।”
“ড্যাডি, তুমি শুনছ?” দুজনের মাঝে ছেদ টানল বেলা।
“তো আমার নিজের দেহ আর মাংস আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে, তাই না?” আহত হয়েছেন এমন স্বরে জানালেন শাসা। “দুনিয়ার সবচেয়ে রোমান্টিক শহরে একাই যেতে হবে।”
“আমি তো হ্যারিয়েটকেও মানা করতে পারি না।” ব্যাখ্যা দিল বেলা। “তুমিই তাহলে বলল কী করব?”
“মনে রেখো। ইয়াং লেডি। ভবিষ্যতে এই অকৃতজ্ঞতা মনে রেখো।”
“মনে হচ্ছে গ্রানাডাটা ভয়ংকর বোরিং হবে। তোমাকে মিস্ করব পাপা।” রামোনের পেটে, বুকে, পেটের নিচে আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে বলে উঠল বেলা। যেন নিজের কাজ নিয়ে সে বেশ অনুতপ্ত।
“আর তোমাকে ছাড়া আমারও ভাল লাগবে না, বেলা।” একমত হলেন শাসা। ক্রেডলে টেলিফোন সেট রেখেই কিটিকে আলতো করে ঠেলে দিলেন বালিশের উপর। “এবারে উপরে উঠে এসো শয়তান।” ঘুম জড়ানো স্বরে জানাল শাসার সঙ্গিনী।
***
রামোনের পরিচিত যে কোনো পুরুষেরই ন্যায় দ্রুত আর দক্ষ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে ইসাবেলা। ভাড়া করা মার্সিডিজের চামড়ায় মোড়া বাঁকানো আসনে বসে খোলাখুলিভাবেই তাই পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে মেয়েটাকে।
বছরের পর বছর ধরে পূর্ণ করা অ্যাসাইনমেন্টগুলোর মতো করে এবারেও নিজের অংশ পালন করতে রামোন’কে খুব বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে না। এর পাশাপাশি আবার মেয়েটার ভেতরের শক্তি, অসম্ভব সাহস আর অখণ্ড প্রত্যয় দেখে উৎসাহ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।
বুঝতে পেরেছে অসন্তুষ্ট আর অপূর্ণতা বোধে ভুগতে থাকা চঞ্চল মেয়েটা খুঁজে ফিরছে এমন কোনো চ্যালেঞ্জ, এমন কিছু একটা যার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা যায়।
শারীরিকভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়াতে মেয়েটার প্রতি মিথ্যে আগ্রহ দেখাতে রামোন’কে কোনো বেগ পেতে হয়নি। তাই ইসাবেলার দিকে যখনই তাকায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ হয়ে যায়। তার দৃষ্টির আকুলতা বোঝে মেয়েটা। সাপের শীতল সবুজ দৃষ্টি দেখে যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে বন্য পাখি। এছাড়া ফাইলেও পড়েছে, অন্য পুরুষদের সাথে আগেও থেকেছে ইসাবেলা। কিন্তু গত কয়েকদিনে বুঝতে পেরেছে অন্তঃস্থলে মেয়েটার গভীর সত্তা এখনো অনাঘ্রাতা কুমারীরই ন্যায় আর অদ্ভুত এই সীমানায় পৌঁছাতে তাই ব্যাকুল রামোন।
কিংবদন্তীতুল্য অন্যান্য পুরুষ প্রেমিকদের মতো রামোন নিজেও স্বাদ পেয়েছে অসংযত যৌন-কামনার। শব্দটা এসেছে রোমান পৌরাণিক কাহিনীর সেসব অর্ধ-পুরুষ আর অর্ধ-পশু দেবতাদের কাছ থেকে যাদের যৌনাকাঙ্ক্ষা কখনো তৃপ্ত হত না। যে কোনো নারীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করা রামোন মাচাঁদের অবস্থাও ঠিক তাই। পাটনারকে নিঃশেষ করে দিতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না সঙ্গিনী নিজেই চিৎকার করে দয়াভিক্ষা চায়। কিন্তু অর্গাজম প্রাপ্তি বেশির ভাগ সময়েই দুরূহ হয়ে পড়ে।
যাই হোক, পাশের ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা এই নারী সেসব দুর্লভ প্রাণীদের একজন যারা তাকে এক্ষেত্রে হারিয়ে দিয়েছে। মেয়েটার সাথে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবারই সত্যিকারের রাগমোচনের স্বাদ নেয়া রামোন জানে ভবিষ্যতে আরও পাবে। তবে এটাও তার পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
গ্রীষ্মের গুমোট আবহাওয়াতেও উপকূল থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে যারপরনাই খুশি আর উত্তেজিত ইসাবেলা অনুভব করল যে সে প্রেমে পড়েছে। মনে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই যে আগে আর কখনো এমনভাবে কাউকে চায়নি। পাশে বসে থাকা ছেলেটা আর তার সবুজ দৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে সূর্যের তেজ হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল, সিয়েরার উষ্ণ বাতাস মনে হচ্ছে অত্যন্ত কোমল।
চারপাশের সমতল ভূমি আর পর্বতগুলো মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা। মনে পড়ে গেল বিশাল কারু’র খোলা দিগন্তের কথা। সেখানকার জমিনও একই রকম সিংহ রঙা আর পাথরগুলো গাঢ় বাদামি। উচ্ছল আনন্দে ভেসে যেতে যেতে মন চাইল চিৎকার করে বলে উঠে, “ওহ, রামোন, মাই ডালিং আই লাভ ইউ। আমার দেহ-মন শুধু তোমাকেই ভালবাসে।”
যদিও আপন মনে পণ করে রেখেছে যে রামোন’কেই প্রথম স্বীকার করতে হবে ভালোবাসার কথা। তাহলেই প্রমাণিত হবে তার সত্যিকার ভালোবাসার নিশ্চয়তা।
রামোন এ পার্বত্য অঞ্চল ভালোভাবেই চেনে। তাই গড়পরতা ট্যুারিস্ট রুটে না গিয়ে বিশালতা আর আপন সৌন্দর্য নিয়ে লুকিয়ে থাকা পেছনের রাস্তা দিয়ে নিয়ে এসেছে বেলা’কে। ছোট্ট গ্রামগুলোর একটায় থেমে নিয়ে এসেছে গোলাপি সেরানো হ্যাম কার্ডের টুকরা, চাষীদের বানানো শক্ত রুটি আর ছাগলের চামড়ায় করে মিষ্টি গাঢ় রঙের মালাগা ওয়াইন।
গ্রামের বাইরে প্রাচীন এক পাথরের সেতুর পাশে মার্সিডিজ পার্ক করে মিয়েরা নেভাডা’র পাদদেশ থেকে নদীটাকে অনুসরণ করে জলপাই বনের ভেতর দিয়ে পথ চলল দু’জনে। নদীর গোপন একটা অংশে এসে উলঙ্গ দেহে স্নান করার সময় উপরের চূড়া থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দাঁড়িঅলা পাহাড়ি ছাগল। একই অবস্থায় পিকনিক লাঞ্চ খেয়ে নিল মসৃণ কালো পাথরের উপর বসে।
রামোন দেখিয়ে দিল কেমন করে হাতের উপর রেখে চামড়ার থলে থেকে ওয়াইন খেতে হবে। অথচ চেষ্টা করতে গিয়ে ইসাবেলার গাল আর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ফোঁটা ফোঁটা ওয়াইন। ওর আবদার শুনে জিভ দিয়ে চেটে নিল রামোন। আর এতটাই মজা হলো যে লাঞ্চ ভুলে উদ্দাম ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে উঠল দু’জনে।
হাঁটু পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে ইসাবেলাকে দেখছে রামোন। এখনো পাথরের উপর পড়ে আছে মেয়েটা। ফিসফিস করে বলে উঠল, “আমার পা দুটো মনে হচ্ছে জেলী অসাড় হয়ে গেছে। গাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে চলো।”
বিকেলের বেশির ভাগটাই পানির কাছে কেটে গেল।
সূর্য উঠে এলো পাহাড়গুলোর মাথায়। চোখে পড়ল দুর্গ।
ইসাবেলা যতটা ভেবেছিল ততটা বিশাল কিংবা জমকালো নয় দুৰ্গটা। গ্রামের মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা গাঢ় রঙা সাদামাটা একটা দালান। কাছে যেতেই দেখা গেল সামনের দিকে অযত্ন অবহেলায় জন্মে গেছে ঝোঁপ-ঝাড়। সীমানা প্রাচীনের বেশ কিছু অংশই ভেঙে পড়েছে।
“এখন এ জায়গার মালিক কে?” জানতে চাইল ইসাবেলা?
“রাষ্ট্র।” কাধ বাঁকাল রামোন। কয়েক বছর আগে শোনা গিয়েছিল পর্যটকদের জন্য হোটেল বানানো হবে; কিন্তু আদতে কিছুই হয়নি।”
বৃদ্ধ কেয়ারটেকার মনে করতে পারল রামোনের পরিবারের কথা। গ্রাউন্ড ফ্লোরের রুমগুলোতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল দু’জনকে। শূন্য রুমগুলোর ঝাড়বাতিতে জমে আছে ফুল আর ধুলা পারিবারিক ঋণ মেটানোর জন্য আসবাবপত্র বহু আগেই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানির দাগ লেগে আছে হলের দেয়ালে।
“অযত্ন-অবহেলায় একদা খুব প্রিয় ছিল এমন কিছুর এহেন দুদর্শা দেখাটা খুব কষ্টের।” ফিসফিস করে জানাল ইসাবেলা। “তোমার খারাপ লাগছে না?”
“চলে যেতে চাও?” পাল্টা প্রশ্ন করল রামোন।
“হ্যাঁ, আজকের দিনে মন খারাপ করতে চাই না।”
চুলের কাটার মতো সরু পথ ধরে গ্রামের দিকে যেতে যেতে দেখা গেল পাহাড়ের উপর সূর্য ডোবার অসাধারণ দৃশ্য।
গ্রামের সরাইখানার মালিক চিনতে পারল রামোনের পদবী। সামনের রুমের বিছানার লিনেন চাদর বদলে দিতে বলল দুই মেয়েকে আর স্ত্রীকে রান্না ঘরে পাঠিয়ে দিল আন্দালুসিয়ার বিশেষ খাবার কসিদো মাদ্রিলেনো বানাবার জন্য। নুডলস এর উপর বসানো মসলাদার ছোট্ট চোরিজো সসেজ আর চিকেন স্ট্র দিয়ে তৈরি খাবারটা যুৎসই নাম পেয়েছে।
বেলা’র গ্লাস পূর্ণ করে দিতে দিতে রামোন জানালো, “স্পেনের লোকদের পানীয় হলো শেরী।” পাহাড়ি এলাকায় ঠাণ্ডা এত জেঁকে বসেছে যে পাথরের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাতে হলো। শিখার আভায় ছেলেটাকে মনে হল অসম্ভব রূপবান।
“মনে হচ্ছে আমরা কেবল এই তিনটা জিনিসই করব।”-গ্লাসের সোনালি ওয়াইনের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ বেলা বলে উঠল-”খাওয়া অথবা পান করা অথবা…ওয়াইনে চুমুক দিয়ে অসমাপ্ত রেখে দিল বাক্য।
“তোমার ভাল লাগছে না?” জানতে চাইল রামোন।
“অসম্ভব।” ক্ষুরধার দৃষ্টি হেনে বলে উঠল বেলা, “কসিদো আর শেরী শেষ করো, সিনর, অনেক শক্তি চাই তোমার।”
খোলা জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো পড়ে ঘুম ভেঙে গেল বেলার এবং যথারীতি রামোন নেই। কিন্তু না বড় সড় নরম বিছানাটায় পাশেই শুয়ে ঠাণ্ডা এক অভিব্যক্তি নিয়ে ওকে দেখছে ছেলেটা।
“ওহ, গড!” বুঝতে পারল ওকে পেতে অধীর হয়ে আছে রামোন। আনন্দের চোটে ফিসফিস করে বলে উঠল, “অসভ্য কোথাকার।” ওর মতো করে আর কেউ আগে চায়নি ইসাবেলাকে।
দেয়াল ঘেরা আঙ্গিনায় বেগুনি ফি আর গোর্ট চিজ দিয়ে ওদের জন্য নাশতা রেখে গেছে ইন কীপার। নেইল পলিশ লাগানো লম্বা নখ দিয়ে চামড়া খুলে অত্যন্ত সুস্বাদু ফিগ রামোনের ঠোঁটে গুঁজে দিল ইসাবেলা। এই কাজটা একমাত্র বাবার জন্যই করত এতদিন।
সরাইখানার মালিকের দুই মেয়ের একজন ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে আসতেই এক্সকিউজ মি বলে উঠে বেডরুমে চলে এলো রামোন। বাথরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে নিচের আঙ্গিনায় ইসাবেলা দেখা গেল হাসতে হাসতে নিজের সদ্য শেখা স্প্যানিশ জাহির করছে।
এর আগে ওয়াশবেসিনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে ওকে বার্থ কন্ট্রোল পিল খেতে দেখেছে রামোন। এক ধরনের হাস্যকর আনুষ্ঠানিকতাও করে এর সাথে, পানির গ্লাস নিয়ে টোস্ট করে বলে, “মেনি হ্যাপি রিটার্নস।” যাই হোক আপাতত টয়লেট ব্যাগে পাওয়া গেল না পিলগুলো।
বেডরুমে ফিরে এলো রামোন। মেঝের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই বিছানা রাখা।
দরজার পাশের পর্দা ঘেরা কুলুঙ্গির উপর জড়ো করে রাখা হয়েছে ওদের লাগেজ। স্যটকেসের উপর অনাদরে পড়ে আছে ইসাবেলা’র বড় সড় চামড়ার কাঁধের ব্যাগ।
একটু থেমে কান পাততেই ভোলা জানালা দিয়ে আবছাভাবে শোনা গেল মেয়েটার গলা। বিছানার উপর ব্যাগটা ফেলে তাড়াতাড়ি কিন্তু সাবধানে সব বের করে ফেলল। কেনসিংটন ফ্ল্যাটে সিকুইনের হ্যান্ড ব্যাগ খুলে বার্থ কন্ট্রোল পিলের ব্র্যান্ড চেক করে নিয়েছিল রামোন। পরে অ্যামব্যাসি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জেনেছে, যদি পিরিয়ডের দশম দিনের পূর্বে কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে অভ্যুলেশনের সময় গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেড়ে যায় সে নারীর।
অবশেষে ব্যাগের তলায় পড়ে থাকা কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি কালো পাসের ভেতর পাওয়া গেল ওষুধের চিকন প্যাকেট। আরো একবার ঘাড় সোজা করে কান পাতল রামোন। আঙ্গিনা থেকে কোনো শব্দ শুনতে না পেয়ে তাড়াহুড়া করে দৌড়ে এলো জানালার কাছে। দেখা গেল ইন কীপারের কালো বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছে বেলা।
আবারো তাই বেডরুমে ফিরে এলো নিজের কাজ শেষ করতে। প্যাকেট থেকে সাতটা ওষুধ মিসিং আছে। নিজের পকেট থেকে ওভাননের মতো হুবহু দেখতে আরেকটা প্যাকেট বের করল রামোন। এটা তাকে দিয়েছে অ্যামব্যাসির ডাক্তার। নিজের প্যাকেট থেকে সাতটা ওষুধ নিয়ে টয়লেট বোলে ফেলে দিয়ে ইসাবেলার পার্সে রেখে দিল বাকি ওষুধসহ প্যাকেটটা। আর অরিজিন্যাল ওষুধের প্যাকেট নিয়ে টয়লেটে ফ্লাশ করে দিল। মেয়েটা জানতেও পারবে না যে বার্থ কন্ট্রোল পিলের পরিবর্তে সাধারণ অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট যাচ্ছে পেটে। সবশেষে হাত ধুয়ে সুবোধ বালকের মতো সিঁড়ি বেয়ে আঙ্গিনাতে অপেক্ষারত ইসাবেলার কাছে নেমে এলো রামোন।
***
গ্রানাডাতে ইসাবেলাকে করিডা ডি টোরোসে নিয়ে গেল রামোন আর তাদের ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন যে এল কোরডোবেস্ এর কাজও দেখতে পেল।
সামান্য নভিলেরো, থাকা অবস্থাতেও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এই ম্যাটাডোরের পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন রামোনের বাবা। তাই তারা পৌঁছবার পরেই সকালবেলা হোটেলে রেখে যাওয়া হয়েছে দুটো টিকেট; নতুবা এতটা শর্ট নোটিশে টিকেট পাবার কথা নয়। রিং সাইডে প্রেসিডেন্টের বক্সের ঠিক ডানদিকে বসতে দেয়া ছাড়াও দর্শকদের সামনেই আমন্ত্রণ করা হয়েছে করিডা’র জন্য এল কোরডোবস এর ড্রেস দেখার জন্য।
হেমিংওয়ের ডেথ ইন দ্য আফটারনুন ইসাবেলাও পড়েছে। তাই সে বুঝতে পারল এহেন নিমন্ত্রণের মাহাত্ম। তারপরেও ম্যানুয়েল বেনিটেজ’র প্রতি রামোনের শ্রদ্ধা অথবা পোশাক পরিধানের এই প্রায়ই উপাসনার রীতির জন্য প্রস্তুত ছিল না মেয়েটা।
এনট্রি প্যারেডের ঢোলের আওয়াজ শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেছে উত্তেজনার ঢেউ। অত্যন্ত দর্শনীয় হল পুরো ব্যাপারটা : সোনা, রুপা আর মুক্তো দানা বসানো কস্টিউম পরানো ঘোড়াগুলো, অ্যামব্রয়ডারী করা খাটো জ্যাকেট আর স্কিন টাইট ট্রাউজার পরিহিত ম্যাটাডোর।
রিং এর মাঝে বের হয়ে এলো বঁড়। শিংঅলা মাথা উঁচু করতেই রাগে ফুলে উঠল কাঁধের বিশাল কুঁজ। পায়ের খুরের কাছ থেকে উড়তে লাগল সাদা ধুলা। ভিড়ের সাথে দাঁড়িয়ে ইসাবেলা নিজেও চিৎকার শুরু করে দিল।
এল কোরাডোবস এর প্রারম্ভিক আগমনের সাথে সাথে ইসাবেলার হাত ধরে ওর কাছে ঝুঁকে এলো রামোন। বর্ণনা করে বুঝিয়ে বলল বিভিন্ন অংশ। রামোনের চোখ দিয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের নিষ্ঠুরতা আর বিয়োগান্তক গল্পের স্বাদ পেল বেলা।
ষাঁড়ের সাথে লড়াইয়ে বল্লমধারী অশ্বারোহী যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে স্যালুট জানানোর জন্য তারা প্রবেশের সাথে সাথেই বেজে উঠল বাজনা। আর দাঁতে দাঁত ঠেকে গেল ইসাবেলা’র। পেট ফেটে পায়ের সাথে নাড়িভুড়ি বেঁধে যাওয়ার পরিণতির ভয়ংকর সব ঘোড়াদের কথা শুনেছে মেয়েটা। ওর ভয় কাটাতে তুলা। ক্যানভাস আর চামড়ার মোটা দেহবর্ম দেখাল রামোন, যাতে রক্ষা পাবে অবলা জীবগুলো। সবশেষে দেখা গেল একটাও ঘোড়া একটুও ব্যথা পায়নি।
ঘোড়ার জিনের উপর বসে ষাঁড়ের পিঠে স্টিলের গুঁতো দিল বল্লমধারী যোদ্ধা। ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত।
ভয়ংকর এক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন ইসাবেলা ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করল। রামোন বিড়বিড় করে জানাল : একেবারে সত্যিকারের রক্ত। এখানে যা দেখছ তার সবই সত্যি। জীবনেরই মতো সত্যি। এটাই জীবন, ডালিং জীবনের সমস্ত নিষ্ঠুরতা, সৌন্দর্য আর আবেগ এখানে পাবে।”
বুঝতে পেরে অবশেষে শান্ত হয়ে ঘটনার প্রবাহমানতায় নিজেকে সঁপে দিল বেলা।
নিজের ব্যান্ডেরিলাস তুলে নিল এল কোরডোবসস। রঙিন কাগজের ফিতে লাগানো লম্বা অস্ত্রটাকে মাথার উপর উঁচু করে সূর্যের আলোয় পোজ দিল লোকটা। এরপর ষাঁড়কে ডাকল। জম্ভটা কাছে আসতেই হালকা নাচের ছন্দে দৌড়ে গেল। একসাথে হতেই দমবন্ধ করে বসে রইল ইসাবেলা। কিন্তু ব্যান্ডে রিলাম মাটিতে গেঁথে ঘুরতে ঘুরতে দূরে চলে গেল মাস্টার। মাথা নামিয়ে রশিতে পুঁতো দিতে চাইল ষাঁড়টা।
ঢোলের আওয়াজে বোঝা গেল সর্বশেষ অঙ্ক, সত্যের ঘন্টার, সময় হয়ে গেছে। স্টেডিয়াম জুড়ে তৈরি হল নতুন এক পরিবেশ। ষাঁড় আর এলকোরডোবস নেচে একে অন্যকে সাথে নিয়ে মৃত্যু নৃত্যে মেতে উঠল। একে অন্যকে এত কাছ থেকে পাস করে যাচ্ছে যে প্রাণীটার কাঁধের রক্তের ছিটে এসে পড়ল ম্যাটাডোরের উরুতে।
অবশেষে প্রেসিডেন্ট বক্সের নিচে দাঁড়িয়ে কালো সিল্ক লাগানো নিজের মনতেরা টুপি খুলে বঁড়টাকে উৎসর্গ করার অনুমতি চাইল। ইসাবেলার আনন্দ বাঁধ ভেঙে গেল যখন লোকটা তার আসনের নিচে এসে ষড়টাকে উৎসর্গ করতে চাইল ওর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে। মনতেরা ইসাবেলার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ষড়টার কাছে ফিরে গেল লোকটা।
রিং-এর একেবারে মাঝখানে সর্বশেষ পাস্ খেলল এল কোরডোবস। একটার চেয়ে অন্যটা হল আরো বেশি দর্শনীয়। প্রতিবার সমস্বরে চিৎকার করে উঠল বিমুগ্ধ দর্শক। অবশেষে একেবারে ইসাবেলার সিটের নিচে এসে উদ্যত হল ষাঁড়টাকে মেরে ফেলার জন্য। লম্বা রূপার তরবারি বের করতেই ইসাবেলার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রামোন জানাল, “দেখো! সবচেয়ে। কঠিন কাজ, রেসিবিয়েন্দা। সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে যেতে চাইল ষড়টা। দৌড়ানোর পরিবর্তে চারকোণা করে দাঁড়িয়ে শিং এর গিয়ে পড়ল এল কোরডোবস। ছিঁড়ে গেল হৃদপিণ্ডের সবচেয়ে বড় ধমনী, ঝরনার মতো করে ছুটে এলো তাজা রক্ত।
যাঁড়ের লড়াই দেখে হোটেলে ফেরার পথে কেউই কোন কথা বলল না। রহস্যময় এক বোধে আপ্লুত হয়ে আছে দু’জনে। রক্ত আর পুরো ব্যাপারটার ট্র্যাজিক সৌন্দর্য এক ধরনের আত্মিক বেদনার সৃষ্টি করেছে যা কেবলই মুক্ত হবার পথ খুঁজছে। ইসাবেলা বুঝতে পারল তার চেয়েও বেশি অস্থির হয়ে পড়েছে রামোন।
জোড়া দরজা আর রট আয়রনের ব্যালকনি লাগানো তাদের বেডরুম মুখ করে আছে পুরাতন মুরিশ রাজপ্রাসাদের দিকে। মেঝের একেবারে মাঝখানে ও’কে দাঁড় করাল রামোন। মাথার উপরে কর্কশ শব্দে ঘুরছে প্রাচীন আমলের ফ্যানের ব্লেড। বেলা’র পোশাক খুলে নিল রামোন। মনে হচ্ছে যেন সে নিজেও করিড়া প্রথা পালন করছে। হাঁটু গেড়ে বেলা’র কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ ডুবিয়ে দিল পেটের নিচে। বেলা এতটা কোমলভাবে ওর মাথায় হাত রাখল যেন এই স্বর্গীয় ভালোবাসার যোগ্য নয় সে, নশ্বর মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এ বিশাল মহিমা বহন করা।
ছোট্ট শিশুর মতই কোলে তুলে ইসাবেলাকে বিছানায় নিয়ে গেল রামোন। মনে হচ্ছে যেন এর আগে কিছুই হয়নি অথবা অতল গহীনে লুকিয়ে রাখা শরীর আর আত্মার সেই গোপনীয়তায় প্রবেশ করেছে রামোন যার অস্তিত্ব বেলা নিজেও জানত না।
ছেলেটার বাহুতে এলেই স্থান-কাল-পাত্র বিস্মৃত হয়ে যায় বেলা। যেন ধূমকেতুর ন্যায় উঠে যায় ঊর্ধ্বাকাশে স্বর্গের দিকে। সবুজ চোখ জোড়া দেখে বুঝতে পেয়ে দেহের ন্যায় রামোনের আত্মাও বিলীন হয়ে গেছে ওর মাঝে। যখন মনে হয় যে আর পারবে না, তখনই টের পায় আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উষ্ণ তরল এসে ভরে যাচ্ছে শরীর।
দিনের শেষ আলো মরে যেতেই রুমের মাঝে দেখা গেল ছায়ার নৃত্য। নিঃশেষিত হয়ে কথা বলা কিংবা নড়া-চড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে বেলা; একটুকানি কাদার শক্তি আছে কেবল। অবশেষে নিদ্রা এসে সাঙ্গ করে দিল তাও।
***