সুতানুটি সমাচার
ভূমিকাংশ
প্রথম সংস্করণ
কলকাতা শহরের ইতিহাস নিয়ে অনেকদিন ধরে নানা রকমের দলিলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার সুযোগ হয়েছে। ১৯৪৯—৫০ সনে ‘কালপেঁচার নকশা’ থেকে শুরু। তারপর ‘কলকাতা কালচার’, ‘টাউন কলকাতার কড়চা’ ইত্যাদি বইতে কলকাতা শহরেরই নানা দিকের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। তবু মনে হয় যেন কলকাতার কথা কিছুই জানা হয়নি, কিছুই বলা হয়নি। একটা গ্রামকে যত সহজে বোঝা যায়, জানা যায়, একটা বড় শহরকে তত সহজে চেনাজানা যায় না। যত জানা যায় তত আরও জানবার কৌতূহল বাড়ে। বাংলা দেশের গ্রামে গ্রামে অনেক ঘুরেছি, এই ইতিহাসের নেশায়। কিন্তু গ্রামকে এত দুর্বল বলে মনে হয়নি। আর কলকাতা শহরে জন্মে এবং সারাজীবন এই শহরে কাটিয়ে আজও তার বাড়িঘর, পথঘাট সব চিনতে পারিনি। কলকাতার এক—একটা অঞ্চল ও পাড়ার ইতিহাস, এক—একটা রাস্তার ইতিহাস নিয়ে রোমান্টিক উপন্যাসের চেয়েও চিত্তাকর্ষক কাহিনি রচনা করা যায়। যেমন বড়বাজার লালবাজার কসাইতলা চাঁদনি চৌরঙ্গি ইত্যাদি অঞ্চল, অথবা পার্ক স্ট্রিট, সার্কুলার রোড, স্ট্র্যান্ড রোড, ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট, চিৎপুর রোড ইত্যাদি রাস্তার ইতিহাস যে কোনো কাহিনির নায়কের চরিত্রের তুলনায় কম জটিল ও আকর্ষণীয় নয়। কিন্তু সজাগ ইতিহাসবোধ ও তথ্যনিষ্ঠার সঙ্গে শিল্পবোধ ও রুচির সংমিশ্রণ না হলে এইসব ইতিবৃত্ত রচনা করা যায় না।
কিছুদিন আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রিসার্চ ফেলো’ হিসেবে কলকাতা শহরের একটা বিশেষ দিক নিয়ে ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের কাজে বছর তিনেক নিযুক্ত ছিলাম (১৯৫৮—৬০)। তখন অনেক সরকারি নথিপত্র ঘাঁটতে হয়েছে। ইতিহাসের বহু উপকরণ এইসব নথিপত্র থেকে বাছাই করা যায়, কিন্তু লক্ষ করে দেখেছি সামাজিক ইতিহাসের (Social History) উপকরণ তার মধ্যে খুব কম। একেবারে নেই যে তা নয়, যা আছে তা অর্থনীতি—ব্যবসাবাণিজ্য—নগরনির্মাণ ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সামাজিক জীবনযাত্রা বলতে যা বোঝায়, ইংরেজদের ও আমাদের, তার উপাদান সরকারি নথিপত্রে বিশেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ এই সামাজিক জীবনযাত্রার পরিচয় জানবার আগ্রহ আমার বেশি। কারণ তাতে যে কোনো দেশের, যে কোনো স্থানের ও কালের ইতিহাসের মর্মস্থল পর্যন্ত জানা যায়। কালের পটভূমিতে মানুষের জীবনের স্পন্দন পর্যন্ত অনুভব করা যায়। তা যতক্ষণ যা করা যায় ততক্ষণ ইতিহাসের অনেকখানিই অজানা থাকে। একদিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার কাজ করার সময় যেসব ভ্রমণবৃত্তান্ত স্মৃতিকথা—শ্রেণির বইপত্র দেখতে হয়েছিল, মনে হল সেগুলি সরকারি নথিপত্রের চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান, অন্তত সামাজিক ইতিহাসের দিক দিয়ে। এই শ্রেণির সমসাময়িক প্রত্যক্ষ বিবরণের মধ্যে কলকাতা শহর প্রসঙ্গে আমার কাছে অ্যাটর্নি উইলিয়াম হিকির স্মৃতিকথা, এলিজা ফে’র চিঠিপত্র এবং ফ্যানি পার্কসের ভ্রমণবৃত্তান্ত উপাদানের দিক দিয়ে মূল্যবান ও উপাদেয় মনে হয়েছে। অবশ্য এ ছাড়া আরও বিবরণ আছে যেমন বিশপ হেবারের, তদানীন্তন সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট জনসনের, এমমা রবার্টলের এবং আরও অনেকের। জনসন ও এমমার পর্যবেক্ষণশক্তি প্রশংসনীয়, উপাদানও তাঁদের বৃত্তান্তে যথেষ্ট আছে। কিন্তু একই কালের উপাদানের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে ভেবে এঁদের বাদ দিয়েছি।
হিকি, ফে ও ফ্যানি কলকাতা শহর ও প্রধানত বাংলা দেশ সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়েছেন, ‘সুতানুটি সমাচার’ বইতে কেবল সেইটুকুই সংকলিত হয়েছে। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার যে বাংলা দেশ ও কলকাতা শহরই তখন ইংরেজদের সর্বপ্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল, কাজেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশের কথা এইসব বিবরণের মধ্যে বিশেষ স্থান পায়নি। উইলিয়াম হিকির স্মৃতিকথা (Memoirs of William Hickey, 1749-1809) বড় বড় চারটি খণ্ডে সম্পূর্ণ—১৭৪৯ সন থেকে ১৮০৯ সন পর্যন্ত তার সময় বিস্তৃত। লন্ডন থেকে আরম্ভ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ফ্রান্স, পর্তুগাল, হল্যান্ড, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের বিবরণ ও অভিজ্ঞতার কথাও হিকি তাঁর স্মৃতিকথায় লিপিবদ্ধ করেছেন, কেবল ভারত বা বাংলা দেশের কথা বলেননি। মাদ্রাজে কিছুদিন অবস্থান করে, তদানীন্তন কলকাতার সুপ্রিমকোর্টে অ্যাটর্নি হিসেবে প্র্যাকটিস করার জন্য তিনি বাংলা দেশে আসেন। ১৭৭৭ সাল থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত, মধ্যে দু’একবার ইংলন্ডে যাওয়া ছাড়া, হিকি প্রায় একটানা কলকাতা শহরে বাস করেন। অ্যাটর্নির পেশার জন্য তো বটেই, তা ছাড়া উচ্চবংশজাত বলেও, সেকালের কলকাতার ইংরেজ—সমাজের সর্বোচ্চ স্তর শাসক—বণিকগোষ্ঠী থেকে আরম্ভ করে, সাধারণ স্তরের ইংরেজ ও এ দেশের লোকের সঙ্গে হিকির ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও সম্পর্ক ছিল। লোকচরিত্র বুঝবারও তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। সামাজিক মেলামেশার ব্যাপারে তাঁর মতো সুদক্ষ ব্যক্তি সেকালের সমাজে অল্পই ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস, ফিলিপ ফ্রান্সিস, কর্নওয়ালিস, ওয়েলেসলি, জাস্টিস ইম্পে, জাস্টিস হাউড, জাস্টিস চেম্বার্স, উইলিয়াম জোন্স থেকে আরম্ভ করে খিদিরপুরের ভূকৈলাস রাজবাড়ির গোকুল ঘোষাল, মল্লিক বংশের নিমাইচরণ মল্লিক পর্যন্ত সকলের সান্নিধ্যে তিনি আসবার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ দেশের বেনিয়ান কেরানি প্রভৃতি বাঙালি বাবুদের চরিত্র জানবার ও বুঝবার যে সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন তা তাঁর সমসাময়িক বহু ইংরেজের পক্ষেই পাওয়া সম্ভব হয়নি। বিখ্যাত হেয়ারড্রেসার থেকে আরম্ভ করে ড্যানিয়েলদের মতো শিল্পী, চাঁদ ও মন্নুর মতো এ দেশি ভৃত্য এবং জমাদারনির মতো হিন্দুস্থানি মেয়ে, বহু বিচিত্র লোকের সাহচর্য লাভ করেছিলেন হিকি। তার উপর হিকি জীবন উপভোগ বলতে জানতেন যে, ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’, এবং জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাকে তিনি উপেক্ষণীয় মনে করতেন না। লাটের বাড়ির ভোজসভা, জজের বাড়ির খানাপিনা থেকে শুরু করে ট্যাভার্নের হইহল্লা, বাগানবাড়ির সুরা—নারী—বিলাস, সব রকমের অভিজ্ঞতাকেই তিনি জীবনে উপভোগ্য ও অভিনন্দনীয় মনে করতেন। জীবন দিয়ে জীবন দেবার এই ইচ্ছা ও আগ্রহের জন্য তার জীবনস্মৃতির তথ্যগুলি আজও তপ্ত রয়েছে, কালের শীতল হাওয়ায় ঠান্ডা হয়ে যায়নি। তাঁর বিবৃত লোকচরিত্রগুলি আজও এত জীবন্ত যে তাদের চলাফেরা, কথাবার্তার পর্যন্ত প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তাই হিকির স্মৃতিকথা প্রসঙ্গে জনৈক সমালোচক বলেছেন : ‘Its characters might have stepped out Smollet and Fielding’—এবং ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ মন্তব্য করেছেন : ‘For colour and zest these memoirs would be hard to beat, were they fiction they would be called unmatchable pictures of the time.’
ফাল্গুন ১৩৬৮
It’s a good book indeed.