পুরোনো ঢাকার নন্দলাল দত্ত লেনের তিন বাই দুই নম্বর বাড়ির সবচেয়ে নিরীহ আর সুন্দর ছেলে সুজনের দিন শুরু হয় গালমন্দ শুনে। পাড়ার মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে ঢুকেই বড় চাচা শুরু করেন–হতভাগা এখনো ঘুমোচ্ছে দেখ! আল্লা খোদার নাম তো মুখে নেবে না কখনো, গাছে পানি দেয়ার জন্যেও রোজ বলতে হবে!
এইটুকু বলার ভেতরও যদি সুজনের ঘুম না ভাঙে বড় চাচা হুঙ্কার ছাড়বেন–এখনো উঠলি না হারামজাদা!
চোখে রাজ্যের ঘুম জড়িয়ে থাকলেও সুজনকে উঠতে হয়। কলতলায় গিয়ে কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়েই কোদাল আর বালতি ভরা পানি নিয়ে ছুটতে হয় বড় চাচার সবজি বাগানে।
বাড়ির পেছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি, বড় চাচা সারা বছর সেখানে সবজির চাষ করেন। সারা বছর সেখানে কাজ থাকে সুজনের। সকাল বিকেল মিলিয়ে দিনে তিন চার ঘন্টা এর পেছনে চলে যায়। পানি দেয়াই তো একমাত্র কাজ নয়। মাটি কোপাতে হয়, গাছের গোড়া নিড়িয়ে দিতে হয়, সার দিতে হয়, আগাছা বাছতে হয়, গাছের ফলনের সময় বীজতলা তৈরি করে নতুন চারা জন্মাতে হয়, সবজি বাগানের কাজ শেষ করার পর চাচাঁদের ছোট ছোট চারটা ছেলেমেয়েকে সকালে স্কুলে দিয়ে আসতে হয়, রাতে এক ঘন্টা পড়াতে হয়। তারপর বাজার করা, রেশন ভোলা, লণ্ডিতে যাওয়া থেকে শুরু করে সারা দিনে আরো অনেক কাজ থাকে সৃজনের। এর ফাঁকে স্কুলের পাট চুকিয়ে সে গত বছর কলেজে ঢুকেছে। এক বছর ধরে রোজ বিকেলে একটা টিউশনিও করে।
পাড়ার মহিলারা কখনো চাচিদের আড়ালে ওর মাকে বলেন, যে ছেলের বাপ মরেছে জন্মের আগে, ওর যদি এত ভোগান্তি না হবে তাহলে আর ভুগবে কে?
মা কি বলবেন! লুকিয়ে শুধু চোখ মোছেন আর ভাবেন কবে সুজন বড় হবে; ওঁকে এই রাক্ষসপুরি থেকে মুক্তি দেবে। ছোটবেলায় চিলেকোঠার ঘরে রাতে ঘুমোনোর সময় মার মুখে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শুনে সুজন বলতো, বড় হলে এই রাক্ষসপুরিটা ভেঙে তোমাকে আমি নিয়ে যাবো। সারাদিন বাড়ির সব কাজ করার পরও সবার গালমন্দ শুনে চোখের পানি মুছতে মুছতে মুক্তির স্বপ্ন দেখেন সুজনের মা।
সুজনের বাবা মারা গেছেন একাত্তর সালের আঠার নবেম্বরে। সবাই বলে দারুণ সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি, একা পাকিস্তানী সৈন্যদের একটা বাঙ্কার গ্রেনেড ছুঁড়ে উড়িয়ে দিতে গিয়ে বুকে শত্রুর গুলি লেগে শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধে যাবার আগে ছিলেন নামকরা সাংবাদিক। নাম বললে সবাই চেনে। সুজনের জন্ম হয়েছে বাহাত্তরের জানুয়ারিতে। তখন সবাই ছোট্ট সুজন আর ওর মাকে নিয়ে কত মাতামাতি করতো! চাচারা পর্যন্ত ওর মাকে সমীহ করে কথা বলতেন। বড় চাচা ছিলেন শান্তি কমিটির মেম্বার, করতেন মুসলিম লীগ। যুদ্ধের সময় পাড়ার দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে নাকি গোপনে ধরিয়েও দিয়েছিলেন। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা ওঁকে ঠিকই গুলি করে মারতো-বেঁচে গেছেন শহীদ সাংবাদিক জাফর চৌধুরীর বড় ভাই বলে।
শহীদদের জন্য দুঃখ করার দিন দ্রুতই ফুরিয়ে গেলো। সরকারি ভাতা অনিয়মিত হতে হতে একদিন বন্ধ হয়ে গেলো, সুজনরা নিজেদের বাড়িতে থাকে বলে। ওর বাবার সঙ্গে যারা যুদ্ধ করেছিলেন, ওঁদের কেউ কেউ ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে সুজনদের ভুলে গেলেন। অন্যরাও এড়িয়ে চলা শুরু করলেন, পাছে কোনো দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। আটাত্তর সালে দাদি মারা যাওয়ার পর বড় চাচাও স্বমূর্তি ধরলেন। ততদিনে একাত্তরের রাজাকারগুলো সবখানে বেশ জাকিয়ে বসেছে। বড় চাচা বললেন এ বাড়িতে শুধু ওদের দুই ভায়েরই হক আছে। দাদি মারা যাওয়ার সময় নাকি সুজনদের কিছু দিয়ে যান নি। এখানে থাকতে হলে তাঁর কথামতো চলতে হবে। সুজনের নানা নানি ছিলেন না। এক মামা আছেন, তাঁর অবস্থাও ভালো নয়। যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকায় চাচা চাচিদের গালমন্দ খেয়েও এ বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলো ওরা।
মার কাছে শুনে শুনে বাবার একটা পরিষ্কার ছবি সুজনের মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিলো। আমেরিকায় থাকেন ওর একমাত্র ফুপু। একসময় তিনি নিয়মিত চিঠি লিখে ওদের খোঁজ খবর নিতেন, টাকা পয়সাও পাঠাতেন। ফুপু সুজনকে লিখতেন–আমার বড় আশা, তুই তোর বাবার মতো নামকরা একজন হবি। বাবার বইগুলো যত্ন করে রাখিস। মেজদার খুব প্রিয় ছিলো বইগুলো। ফুপু আরো লিখতেন মার দিকে খেয়াল রাখিস। কয়েক বছর আগে টাকা পয়সা নিয়ে বড় চাচার সঙ্গে ফুপুর কিসব গণ্ডগোল হয়েছে। সেই থেকে তিনি বাড়িতে চিঠি লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। গত বছর এসএসসি পরীক্ষার পর সুজন লিখেছিলো ও আমেরিকা যেতে চায়। চিঠির কোনো উত্তর পায় নি।
চিলেকোঠার ঘরে দুটো বড় সিন্দুকে সুজনের মা ওর বাবার বইগুলো তালাবন্ধ করে রেখেছেন। মাঝে মাঝে খুলে দেখেন, বেছে একটা দুটো সুজনকে পড়তে দেন, আবার সিন্দুকে তালা দিয়ে রাখেন। ক্লাস এইটে থাকতেই সুজন গোর্কির মা, অস্ত্রয়ভস্কির ইস্পাত, জ্যাক লন্ডনের হোয়াইট ফ্যাং আর শেক্সপীয়ারের কয়েকটা নাটকের অনুবাদ পড়েছিলো। নাইনে ওঠার পর মা ওকে রবীন্দ্র রচনাবলীর কয়েক খণ্ড পড়তে দিয়েছিলেন। গল্পগুচ্ছের কয়েকটা গল্প আর কিছু নাটক পড়ে সুজন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। নিজেকে কখনো মনে হয়েছে অমল, কখনো মনে হয়েছে ফটিক, কখনো মনে হয়েছে বলাই। গোর্কির ছেলেবেলা পড়ে মনে হয়েছে ও আলিশা। সারাদিন বাড়ির হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে চাচাতো ভাইবোনদের পড়িয়ে নিজের পড়া শেষ করে সুজন বাবার বই নিয়ে বসে। মা বলেন স্কুল কলেজের পড়ার বইয়ের চেয়ে এসব বই কম দরকারি নয়।
অনেক রাত জেগে বই পড়ে বলে ভোরে সহজে ঘুম ভাঙতে চায় না সুজনের। বড়চাচা প্রায় সকালে ওঠার জন্য বকুনি দেন। রোজ অন্তত এক ঘন্টা বাগানে কাজ করা চাই। ক্লাস ফোরে থাকতে বড় চাচা ওকে এ কাজে লাগিয়েছেন। দুই চাচার ছেলেমেয়েরা কুটোটিও নাড়ে না। তবে এতে সুজনের অন্যরকম একটা উপকার হয়েছে। ভোরবেলা কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ঘাম ঝরিয়ে যে ব্যায়াম হয় তাতে করে ওর শরীরের গড়নটি হয়েছে ভারি সুন্দর। মার মতো ফর্শা হয়েছে। সবাই বলে ওর চোহারা নাকি খুব মিষ্টি। আজকাল পাড়ার মহিলারা মার কাছে ওর চমৎকার স্বাস্থ্যেরও প্রশংসা করেন। তবু সুজনের সবচেয়ে খারাপ লাগে সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতে হয় বলে।
বাবার কারণে সুজনের যেমন বই পড়ার নেশা জন্মেছিলো, মার কাছ থেকে ও পেয়েছিলো চমৎকার গানের গলা। বিয়ের পরও মা রেডিওতে নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাইরে গান গাওয়া ছেড়ে দিলেও নিজের ছেলেকে তিনি ঠিকই গান শিখিয়েছিলেন। ছোট থাকতেই সুজনের প্রচন্ড আগ্রহ ছিলো গান শেখার। মা যতটুকু জানতেন সবই শিখিয়েছেন, যার ফল পাওয়া গেছে গত বছরই। আন্তঃস্কুল সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্র সঙ্গীত আর গণসঙ্গীতে প্রথম হয়ে সোনার মেডেল পেয়েছিলো সুজন। গণসঙ্গীত অবশ্য মার কাছে শেখে নি। গত বছর ওদের স্কুলের পাশের কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে সুধীনদা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, এতো চমৎকার গলা তোমরা, ভাল গণসঙ্গীত গাইতে পারবে। সময় করে এসো আমার কাছে, কয়েকটা গান তুলে দেবো তোমাকে। সেই সুধীনদার শেখানো হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসঙ্গীত গেয়ে সুজন প্রতিযোগিতায় সোনা জিতেছিলো।
ওদের স্কুলের কোনো ছেলে ছাত্র সংগঠন করতো না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো সুজন। বাবার পরিচয়ের কারণে বছর দুয়েক আগে একদিন ওদের কলেজের আসিফ ভাই ওকে নিয়ে গিয়েছিলো ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো শহীদ জাফর চৌধুরীর ছেলে হিসেবে। সেই থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ওর যোগাযোগ। ও স্কুলে থাকতেই কলেজের কোনো অনুষ্ঠান হলে আসিফ ওকে নিয়ে যেতো গান গাইবার জন্য। ফুটফুটে এক কিশোরের গলায়-ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা, যদি তোর ডাক শুনে, কিংবা বাঁধ ভেঙ্গে দাও শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেতো। বাবার পরিচয় পেলে বড়দের কেউ কেউ এখনো এসে বলেন, জাফর ভাইর মতো চমৎকার মানুষ হয় না। যে কোনো মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। আদর্শের জন্য শহীদ হয়েছেন। এসব কথা শুনলে বাবার জন্য গর্বে বুকটা ভরে ওঠে ওর। তখন মনে হয় পৃথিবীটা অনেক বড়, অনেক সুন্দর। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায় বাড়ির লোকজনদের দুর্ব্যবহারের কথা। ভুলে যায় সকল লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। ভাবে এই পৃথিবীকে যারা আরো সুন্দর করার জন্য লড়ছে সে তাদেরই একজন। ছাত্র ইউনিয়নের কাজে নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলো–বছর না ঘুরতেই নগর কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হলো ওকে। সুজন জানে এবার ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ওকেই সাধারণ সম্পাদকের পদের জন্য দাঁড় করানো হবে। কলেজের ছেলেরা সবাই ওকে এক ডাকে চেনে।
সেদিন কলেজের কি একটা গণ্ডগোল হওয়ায় বিকেলে সুজনদের কেমিস্ট্রি ক্লাশটা হল না। বাসায় না গিয়ে ও সোজা চলে গেলো ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে। ওকে দেখে আসিফ হইচই করে উঠলো–তোর জন্য একটা দারুণ খবর আছে সুজন। আগে বল কি খাওয়াবি?
সুজনের পকেট তখন একেবারে ফাঁকা। টিউশনির বেতন পেতে আরো তিন দিন। শুকনো হেসে বললো, কি খাওয়াবো সেটা নির্ভর করছে খবরটা কি তার ওপর।
গলা খুলে হাসলো আসিফ–খবর হচ্ছে আটদিন পর তুই বুখারেস্ট যাচ্ছিস।
তার মানে? আসিফের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো সুজন।
মানে খুব সোজা। সাদামাটা গলায় আসিফ বললো, ওখানকার ইয়ং পাইওনিয়ারদের একটা কংগ্রেস হচ্ছে। আমাদের দুজন প্রতিনিধি চেয়েছে ওরা। আমরা ঠিক করেছি তোকে আর খুলনার বরুণকে পাঠাবো।
আমি যাবো মানে আমি কি ইয়ং পাইওনিয়ার?
আমাদের ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আগেও ইয়ং পাইওনিয়ারদের কনফারেন্সে ডেলিগেট পাঠানো হয়েছে।
এত সব বড় বড় নেতা থাকতে আমাকে কেন?
আসিফ গম্ভীর হয়ে বললো, আগামী দিনের নেতাদের আমরা এভাবেই তৈরি করি, যাতে তারা যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারে।
কোনো কথা না বলে সুজন হা করে তাকিয়ে রইলো আসিফের দিকে। আসিফ নিরীহ গলায় বললো, মুখ বন্ধ কর, পেটে মাছি ঢুকবে। কাল তুই ছয় কপি পাসপোর্ট ছবি তুলে রাখবি। পরশু তোকে নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে যাবো। টাকা বেশি দিয়ে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পাসপোর্ট করিয়ে নিতে হবে। তারপর যেতে হবে ভিসার জন্য। গরম কাপড়ের জন্য ভাবিস না। গত বছর মস্কো থেকে আমি দারুণ একটা ওভারকোট আর টুপি এনেছিলাম। ওগুলো নিতে পারবি।
এতক্ষণ পর সুজনের বিশ্বাস হল ও সত্যি সত্যি রুমানিয়া যাচ্ছে। বললো, কতদিন থাকতে হবে?
রুমানিয়াতে দু সপ্তাহ। আমরা চেষ্টা করছি ফেরার পথে সোভিয়েত ইউনিয়নের দু একটা পাইওনিয়ার ক্যাম্প দেখে আসতে পারি কিনা। ওটার ব্যবস্থা করা গেলে ধর আরো দিন দশেক।
সুজনের মুখে ততক্ষণে হাসি ফুটলো–সত্যিই দারুণ খবর দিয়েছেন আসিফ ভাই। মিষ্টি পাওনা থাকলো। আমি জানি আপনিই আমার কথা বলেছেন।
বলেছি। গম্ভীর হওয়ার ভান করে আসিফ বললো, তবে সেটা মিষ্টি খাওয়ার লোভে নয়। তোকে আমি ভালবাসি বলেই।
লাজুক হেসে সুজন শুধু বললো, জানি।
তাহলে বল বুখারেস্ট থেকে আমার জন্য কী আনবি?
আপনি যা বলবেন।
কিছুক্ষণ সুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মিষ্টি হেসে আসিফ বললো, কার্পেথিয়ানের তুশনাদ হ্রদের তীরে চমৎকার ক্যাম্পিং শেষ করে তুই ভালোয় ভালোয় ফিরে আসবি–এর চেয়ে বেশি কিছু আমি চাই না।
পাঁচ বছরের বড় আসিফের জন্য গভীর ভালবাসায় সুজনের বুকটা ভরে গেলো। বললো, রুমানিয়ায় আমার যা সবচেয়ে ভালো লাগবে সেটাই আনবো আপনার জন্য।
গম্ভীর হওয়ার ভান করে আসিফ মাথা নাড়লো–না, সেটা তোর পক্ষে সম্ভব হবে না।
কেন? অবাক হয়ে জানতে চাইলে সুজন।
গতবার আমি যখন রুমানিয়া গিয়েছিলাম তখন সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো সেখানকার মেয়েদের। বাইরে থেকে যারা যায় সবাই বলে ইউরোপের অন্য কোনো দেশের মেয়েরা এতো সুন্দর হয় না। তোরও নিশ্চয় ভাল লাগবে।
ধেৎ, কি যে বলেন! লজ্জায় লাল হল সুজন-সুভেনিরের দোকানে কি মেয়ে কেনা যায়?
সুভেনিরের লোভ দেখবি না সুজন। আমার কাছে যা আছে সেগুলো রাখার জায়গা না পেয়ে এমনিতেই বড় বিপদে আছি আমি। তুই আর বিপদ বাড়াস নি।
আসিফের কথার ধরনে গলা খুলে হাসলো সুজন। সঙ্গে গলা মেলালো আসিফ।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সবার আগে রুমানিয়া যাওয়ার কথাটা মাকে জানালো সুজন। মা তখন রান্নাঘরে তরকারি কুটছিলেন। সুজনের কথা শুনে বটিখানা একপাশে সরিয়ে, ওর কপালে চুমু খেয়ে বললেন, আমি জানি তুই অনেক বড় হবি। তোর বাবার চেয়েও অনেক বড়। অনেক দেশের মানুষ তোকে চিনবে।
বাবার কথা উঠতেই সুজনের বুকটা ভারি হয়ে এলো। ধরা গলায় বললো, যত বড় হই না কেন তোমার কাছে ছোট্ট সুজনই থাকতে চাই মা।
গভীর মমতায় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মা। সুজন বললো, চাচাঁদের তুমিই খবরটা দিও মা। আমার ভয় হচ্ছে যদি যেতে না দেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বললেন, যেতে দেবেন না কেন? তুই বেড়াতে ভালবাসিস। এরকম সুযোগ কি বার বার আসে?
তুমি তো বলো বাবা অনেক দেশ ঘুরেছেন। তিনি কি রুমানিয়া গিয়েছিলেন?
ছেলের প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলেন মা-তোর বাবা চীন আর আলবেনিয়া ছাড়া সবগুলো কমিউনিস্ট দেশই ঘুরেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন তিনবার।
তুমি কখনো যাও নি বাবার সঙ্গে?
একবার মস্কো গিয়েছিলাম। তবে ঘুরেছি ইণ্ডিয়াতে। দিল্লী, আগ্রা থেকে শুরু করে পণ্ডিচেরী পর্যন্ত কিছু বাদ রাখি নি।
কবে গিয়েছিলেন ইন্ডিয়া?
যে বছর আমাদের বিয়ে হল–সেই তেষট্টি সালে। দুবছর পরে গিয়েছিলাম মস্কো।
তোমাকে এখন দেখলে কেউ বলবে না চব্বিশ বছর আগে তুমি মস্কো গিয়েছিলে।
ম্লান হেসে মা বললেন, এখন কি আমাকে ঠিকে ঝি মনে হয়?
মাকে জড়িয়ে ধরে সুজন বললো, তুমি আমার মা। চিরকাল তোমাকে আমার মা ই মনে হবে।
সুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা বললেন, এখন তো ইউরোপে অনেক শীত। তোর যে গরম কাপড় কিছুই নেই!
ওসব নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না মা। আসিফ ভাই সব ব্যবস্থা করে দেবেন।
দরকারের চেয়ে বেশি করেছিলো আসিফ। অনেক আগে ওর ছোট ভাই পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিলো। পুতুলের মতো ফুটফুটে ভাইটাকে পাগলের মতো ভালবাসতো আসিফ। সুজনের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হয়েছে ওর ছোট ভাইটা বেঁচে থাকলে ওর মতোই সুন্দর হতো দেখতে। সুজন নিজেও জানে না আসিফের বুকের ভেতর ওর ছোট ভাইর জায়গাটুকু কখন সে দখল করে নিয়েছে।
বড় চাচা শুনে প্রথমে একটু গাঁইগুই করেছিলেন। আসিফ তাঁকে বুঝিয়েছে। পাসপোর্ট ভিসা, টিকেটের জন্য যাবতীয় ছুটোছুটি সেই করেছে। সেদিনের পর থেকে প্লেনে ওঠা পর্যন্ত আটটা দিন একরকম ঘোরের ভেতর কেটেছে সুজনের। তবে মাঝখানে একটু দমে গিয়েছিলো বরুণ যাবে না শুনে। যাওয়ার তিন দিন আগে বরুণ জানিয়েছে ওর বাবার খুব অসুখ। এ অবস্থায় রুমানিয়া যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
বরুণকে সান্ত্বনা দিয়ে আসিফ বলেছে, তুই কিস্যু ভাবিস না বরুণ। তার বাবা ভালো হয়ে যাবেন। তোকে আগামী বছর পাঠাবো। আর সুজনকে বলেছে, একা যেতে হবে বলে মন খারাপ করছিস কেন? আমি যখন প্রথমবার সোফিয়া গেলাম তখন একাই গিয়েছিলাম, তোর চেয়ে বেশি বড় ছিলাম না। তুই তো মিশনারি স্কুলে পড়ে ভালো ইংরেজি বলতে পারিস। আমি তাও পারতাম না।
গরম জামা কাপড় সুজনের বলতে গেলে কিছুই ছিলো না। এমন কি একটা সুটকেস পর্যন্ত নয়। আসিফ নিজের সুটকেসে দরকার মতো সব কিছু গুছিয়ে দিয়েছে। সব শেষে নিজের অটোমেটিক ক্যামেরাটাও ওর কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এয়ারপোর্টে আসিফের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে কিছুতেই কান্না সামলাতে পারলো না সুজন।