দিন যায় – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
০১.
সীতাকে বহুকাল বাদে দেখল মনোরম।
দেখল, কিন্তু দেখা-হওয়া একে বলে না। দুপুরে উপঝরণ বৃষ্টি গেছে। তারপর মেঘভাঙা রোদ উঠেছে। সমস্ত কলকাতা জলের আয়না হয়ে বেলা চারটের রোদকে ফেরত দিচ্ছে। ভবানীপুরের ট্রাম বন্ধ, চৌরঙ্গির মুখে জ্যাম। সবকিছু থেমে আছে, রোদ ঝলসাচ্ছে, ভ্যাপসা গরম। মনোরমের পেটে ঠাণ্ডা বিয়ার এখন দুর্গন্ধ ঘাম হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে। লক্ষৌয়ের কাজ করা মোটা পাঞ্জাবি আর বিনির টেরিকটন স্ট্রাইপ বেলবটম প্যান্টের ভিতর মনোরম নিজের শরীরে কয়েকটা জলধারা টের পাচ্ছে। গরম, পচা, লালচে ঘাম তার। সীতা রাগ করত।
বিয়ারটা খাওয়াল বিশ্বাস। নতুন কারবার খুলেছে বিশ্বাস। ভারী নিরাপদে কারবার, ক্যাপিট্যাল প্রায় নিল। কলকাতার বড় কোম্পানিগুলোর ক্যাশমেমো ব্লকসুদু ছাপিয়েছে, সিরিয়াল নম্বর-টম্বর সহ। ব্যবসাদার বা কন্ট্রাক্টররা আয়কর ফাঁকি দিতে বিস্তর পারচেজ দেখায়। সেইসব ভুয়ো পারচেজের জন্য এইসব ভুয়ো রসিদ। মাল যদি না কিনে থাক তবে কন্ট্যাক্ট বিশ্বাস। হি উইল ফিক্স এভরিথিং ফর ইউ। যত টাকার পারচেজই হোক রসিদ পাবে, এন্ট্রি দেখাতে পারবে। সব বড় বড় কোম্পানির পারচেজ ভাউচার। বিশ্বাস এক পারসেন্ট কি দু পারসেন্ট নেবে। তাতেই অঢেল, যদি ক্লায়েন্ট আসে ঠিকমতো।
কিন্তু কারবারটার অসুবিধে এই যে, বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় না। হাশ পাবলিসিটি। লোকে জানবে কী করে যে কলকাতার কোন গাড্ডায় বিশ্বাস বরাভয় উঁচিয়ে বসে আছে উদ্বিগ্ন আয়করদাতাদের জন্য? যে সব চেনা লোক কলকাতার বাজারে চালু আছে, তাদেরই বলে রাখছে সে। কমিশন দেবে।
–দিস ইজ দি জিস্ট ব্যানার্জি। বিশ্বাস বলল–এবার ইন্টারেস্টেড মক্কেলদের টিপসটা দেবেন।
মনোরম কলকাতার ঘুঘু। শুনে-টুনে মৃদু একটু হাসল, বলল–বিশ্বাস, এর চেয়ে চিট ফান্ডের ব্যবসা করুন। এটা পুরনো হয়ে গেছে। কলকাতায় অন্তত ত্রিশটা রসিদ কোম্পানিকে আমি চিনি।
বহুকাল আগে একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছিল মনোরম। শরীরে কাটাছেঁড়াগুলো মিলিয়ে গেছে, ভাঙা হাড় জুড়ে গেছে। কেবল জিভটাই এখনও ঠিক হয়নি। দাঁত বসে গিয়ে জিভটা অর্ধেক নেমে গিয়েছিল। জোড়া লেগেছে বটে, কিন্তু কথা বলার সময়ে থরথর করে কাঁপে। কথাগুলো একটু এড়িয়ে এড়িয়ে যায়। কিন্তু তাতে আত্মবিশ্বাস এতটুকু কমেনি মনোরমের।
বিশাল থলথলে চেহারার বিশ্বাস উত্তেজনায় চেয়ারে নড়ে বসল। মোকাঘোর মজবুত চেয়ার তাতে একটু নড়বড় করে। প্রকাণ্ড গরম শ্বাস ফেলে বিশ্বাস বুকে মুগুরের মতো দুখানা হাতের কনুই দিয়ে ভর রাখল টেবিলের ওপর। বলল ব্যানার্জি, আমার তিন মাসের ব্যবসাতে কত লাভ হয়েছে জানেন?
কত?
বিশ্বাস শুধু মুখটা গম্ভীরতর করে অবহেলায় বলে–হু।
মনোরম বলল কিন্তু কম্পিটিশন তো বাড়ছে এ কারবারেও!
ট্যাক্স পেয়ার কি কমে যাচ্ছে? জোরি কমেছে? যতদিন এদেশে প্রাইভেট সেক্টরে ব্যবসা থাকবে, ততদিন আমারও ব্যবসা থাকবে। এর মধ্যেই আমার ক্লায়েন্ট তিনশো ছাড়িয়ে গেছে, দু-আড়াই লাখ টাকার রসিদ ইস্যু হয়েছে। অ্যান্ড উইদাউট মাচ পাবলিসিটি। আপনার স্বভাব হচ্ছে সব ব্যাপারের নৈরাশ্যের দিকটা দেখা। ভেরি ব্যাড।
বিশ্বাস ঠিক বলেনি। মনোরমের এটা স্বভাব নয়। নৈরাশ্যের দিকটা সে কখনও দেখে না।
বিশ্বাস বিয়ার খায় সরাসরি বোতল থেকে। বোতলের শেষ কয়েকটা ফোঁটা গলায় ঢেলে আবার নতুন বোতলের অর্ডার দিল। তারপর তেমনি মনোরমের মুখে ঝোড়ো লুবাতাসের মতো খাস ফেলে বলল-দেন?
মনোরম কিছুক্ষণ এক ঢোঁক বিয়ার মুখে নিয়ে তিতকুটে স্বাদটায় জখম জিভটা ডুবিয়ে রাখল। মুখের ভিতরে ঠিক যেন একটা জিওল মাছ নড়ছে। গিলে ফেলল বিয়ারটা। আস্তে করে বলল–কত কমিশন?
–আমার কমিশন থেকে টুয়েন্টিফাইভ পারসেন্ট দেব।
–আর একটু উঠুন।
–কত?
ফিফটি।
বিশ্বাস ভ্রূ তুলল না, বিস্ময় বা বিরক্তি দেখাল না। একটু হাসল কেবল। বিশ্বাস পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে। তবু ওর দাঁতগুলো এখনও ঝকঝকে। নতুন বোতলটা তুলে নীরবে অর্ধেক শেষ করল। তারপর নিরাসক্ত গলায় বলল-ফিফটি! অ্যাঁ?
-ফিফটি।
ব্যানার্জি, আমি যেমন প্রফিট করি তেমন রিস্কটা আমারই। ইনকাম ট্যাক্স নিয়ে গভর্নমেন্ট কী রকম হুজ্জত করে আজকাল জানেন না? যদি ধরা পড়ি তো মোটা হাতে খাওয়াতে হবে নয়তো শ্বশুরাল ঘুরিয়ে আনবে। আমার প্রফিটের পারসেন্টেজ সবাই চায়, রিস্কের পারসেন্টেজ কেউ নেয় না। এটাই মুশকিল।
বিশ্বাস তেমন ঝোড়ো বাস ছাড়ে। ওর নাকের বড় বড় লোমের গুছি বের হয়ে আসে। গালের দাড়ি অসম্ভব কড়া, তাই রোজ কামালেও গালে দাড়ির গোড়া সব গোটার মতো ফুটে আছে। ঘন জ্ব। আকাশি রঙের বুশ শার্টের বুকের কাছ দিয়ে কালো রোমশ শরীর দেখা যায়। গলায় সোনার চেন-এ সাঁইবাবার ছবিওলা ছোট্ট লকেট।
মনোরম মুখে বিয়ার নিয়ে নড়ন্ত জিভটাকে ডুবিয়ে রাখে বিয়ারে। মুখের ভিতরে একটা চুকচুক শব্দ হতে থাকে। শালার জিভটা নড়ছে অবিকল ছোট্ট মাছের মতন।
রসিদের কারবারটা মনোরমের কাছে ছেলেমানুষির মতো লাগে। সে আস্তে করে বলল আজকাল ফলস রসিদ টিকছে না। স্পটে গিয়ে এনকোয়ারি হয়, কোম্পানি নিজেদের সিরিয়াল নম্বর দেখে বলে দেয় যে, রিয়্যাল পারচেজ হয়নি। তখন মর্কেলরা ঝোলে।
বিশ্বাস উত্তেজিত হয়ে বলে-ঝুলবে কেন? আজকাল কেউ ঝোলে না। ধরা পড়লে খাওয়াবে কিছু।
মনোরম শ্বাস ছেড়ে বলে–খাওয়াবে আর খাওয়াবে। কত খাওয়াবে মশাই? এত খাওয়ালে নিজে খাবে কী? তার ওপর ফলস রসিদ ধরা পড়লে ক্রিমিনাল কেস হয়ে যায়।
বিশ্বাস ঝুঁকে বলল–আপনি আমার ইয়ে বোঝেন। আমি আরও তিনটে কোম্পানি চালাই ব্যানার্জি। সেগুলো অনেক বেশি রিস্কি। বলে উত্তেজিত বিশ্বাস ধবধবে সাদা রুমালে ঘেমো কপালটা মুছল। তারপর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে বলল–আপনার ওই একটা বড় বদ স্বভাব। পেসিমিস্টিক অ্যাটিচুড। ভেরি ব্যাড।
মনোরম নিরুৎসাহের হাসি হাসে।
বিশ্বাস বলল–একটা কথা মনে রাখবেন। না সুন্দরী বউ যার, হয় না যার শালা, তার ঘরে অলক্ষ্মী অচলা।
-মানে?
-মানে হচ্ছে ‘না’ কথাটা যার সুন্দরী বউয়ের মতো প্রিয়, ‘হয় না’ কথাটাকে যে নিজের শালার মতো খাতির-যত্ন করে, সে কখনও সাকসেসফুল হতে পারে না।
মনোরম বালকের মতো হাসে। এমন সে অনেকদিন হাসেনি।
বিশ্বাস স্মিতমুখে বলে–এক মহাপুরুষের কথা। আমি অবশ্য বাজে ব্যাপারে প্রয়োগ করলাম।
-ঠিক আছে। মনোরম বলল–আমি দেখব।
–টুয়েন্টি ফাইভ?
–টুয়েন্টি ফাইভ।
বিশ্বাস আত্মতৃপ্তিতে হাসল। বলল-এটা আমার সাইড বিজনেস। না টিকলেও ক্ষতি নেই। বন্ধুবান্ধবদের বলছি, যদি কাউকে কিছু টাকা পাইয়ে দিতে পারি। আপনার অবস্থা তো ভাল যাচ্ছে না ব্যানার্জি।
মনোরম মাথা নেড়ে বলল–না।
বিশ্বাস দুঃখিত গলায় বললস্যাট উওম্যান?
মনোরম শ্বাস ছেড়ে বলে–দ্যাট উওম্যান।
বিশ্বাস গম্ভীর চিন্তিত মুখে বলে–ব্যানার্জি, বউ বিশ্বাসী না হলে ভারী মুশকিল। আমাদের মতো বয়সে পুরুষ মানুষের বউ ছাড়া আর বিশ্বস্ত কেউ তেমন থাকে না। আমার সব কিছু বউয়ের নামে। বাড়ি, গাড়ি এভরিথিং। বউটা দজ্জালও বটে, কিন্তু ফেইথফুল।
মনোরম টাকরা দিয়ে নড়ন্ত জিভটাকে চেপে ধরে থাকে। রক্তের ঝাপটা তার মুখে লাগে। কান দুটো গরম হয়ে ওঠে।
বিশ্বাস সেটা খেয়াল করল না। বলল-দুপুরে বিজনেস পিক আওয়ার্স বলে বিয়ার বেশি খাই না। তারপর সন্ধে হলে স্কচ থেকে শুরু করে দেশি কত কী গিলব তার ঠিক নেই। রাত দশটায় যখন ফিরব বউ ফারনেস হয়ে আছে। কলিং বেল টিপে আধতলা সিঁড়ি নেমে রেলিংয়ের পাশে লুকিয়ে বসে থাকি। বউ দরজা হাট করে খুলে দেয়, তারপর উঁকিঝুঁকি না দিয়ে ভিতরে অপেক্ষা করে। আমি তখন আবার উঠে আসি। ভিতরে ঢুকি না। বাইরে থেকে এক পাটি জুতো পা থেকে খুলে ভিতরে ছুঁড়ে দিয়ে অপেক্ষা করি। যদি জুতোটা খুব জোরে ঘর থেকে ব্যাক করে আসে তবে বুঝি বউ আজ আপসে আসবে না, জোর খিচান হবে। যদি জুতো ব্যাক না করে তবে বুঝি বউ খুব খিচান করবে না, বউ বড় জোর বাপ-মা তুলে দু-একটা গালাগাল দেবে।
মনোরম এক নাগাড়ে হাসছে। গাল ব্যথা হয়ে গেল। বলল–থামুন মশাই, বিষম খাব।
ব্যাপারটা কিন্তু একজ্যাক্টলি এরকম। বাড়িয়ে বলছিনা। যেদিন খিচান হয় সেদিন বউ মারধোরও করে। চুল ধরে টানতে টানতে বাথরুমে নিয়ে যায়, তারপর দরজা বন্ধ করে…
বাথরুমে কেন?
–বাঃ, ছেলেমেয়েরা রয়েছে না! বলে বিশ্বাস সুখী গৃহস্থের মতো হাসে। বিশ্বাসের চেহারাটা যদিও মা দুর্গার পায়ের তলাকার অসুরটার মতোইকালো, প্রকাণ্ড রোমশ এবং বিপজ্জনক, তবু এখন তার মুখখানা একটা গার্হস্থ্য সুখের লাবণ্যে ভরে গেল। বলল–কিন্তু তবু আমার বউ ফেইথফুল। লাইক এ বিচ। নানারকম মেয়েলি রোগে ভুগে শরীরটা শেষ করেছে। আমি আবার একটু বেশি সেক্সি, তাই আমাকে ঠিক এন্টারটেন করতে পারে না, অ্যান্ড আই গো টু আদার গার্লস।
বউ জানে?
বিশ্বাস মৃদুস্বরে বলে–জানে মানে আন্দাজ করে। তবে চুপচাপ থাকে। ভেরি কনসিডারেট। এটা তো ঠিক যে সে শরীরটা দিতে পারে না। তাই শরীর আমি বাইরে থেকে কিনি। কিন্তু তা ছাড়া আমিও ফেইথফুল।
বিশ্বাস মৃদুস্বরে বললেও ওর ফিসফাস কথা দশ হাত দূর থেকে শোনা যায়। মনোরম আশপাশের টেবিলে একটু চেয়ে দেখে নিল। তারপর বলল–আপনি সুখী?
-খুব। আপনার কেসটা কী?
বনত না।
–কেন?
বুঝতে পারতাম না। তবে আমাদের দুজনেরই ছিল পরস্পরের প্রতি এক রকমের রিপালশান। সেটা বেঙেবেড়ে একসময়ে কানেকশন কেটে গেল।
-স্যাড।
মনোরম মৃদু একটু হাসল। বলল–আরও স্যাড যে, আমিও অন্য সকলের মতো বউয়ের নামে টাকা রাখতাম, জমি কিনেছিলাম, লকারেও কিছু ছিল। সেগুলো হাতছাড়া হয়ে গেল।
-কিছু রিয়ালাইজ করতে পারেননি?
–না। আমি প্রায় ব্যাঙ্করাপ্ট। আমার সম্বন্ধী দুদে অ্যাডভোকেট। ডিভোর্সের সময়ে মাসোহারা ও বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। বিশ্বাস, আমার একটা ওপেনিং দরকার। যে কোনও একটা কাজ। আমি আবার দাঁড়াতে চাই।
বিশ্বাস গম্ভীর এবং সমবেদনার মুখ করে বলল–দেখব ব্যানার্জি, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব।
-দেখবেন।
বিয়ার শেষ করে দুজনেই উঠেছিল। বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। ভেজা পার্ক স্ট্রিটটাকে কুচকুচে কালো দেখাচ্ছিল। জলে ছায়া ফেলে নিথর দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্বাসের গাড়িখানা। পুরনো মরিস। তার সাদা রংটা থেকে মেঘভাঙা বোদ পিছলে আসছে।
বিশ্বাসের গাড়িতে একটা লিফট পেতে পারত মনোরম। কিন্তু রেস্তরাঁর দরজায় বিশ্বাস তার একজন চেনা লোক পেয়ে গেল হঠাৎ।
অবিকল টেলিফোনে কথা বলার মতো বিশ্বাস চেঁচিয়ে বলল–হ্যালো! অরোরা, ইজনট ইট? বিসোয়াস হিয়ার।
দুজনে আবার ঢুকে যাচ্ছিল রেস্তরাঁয়। বিশ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–আচ্ছা ব্যানার্জি, বাই।
মনোরম হাতটা তুলল। তারপর পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে লাগল পশ্চিমমুখো।
ময়দানের ধার ঘেঁষে দক্ষিণমুখো ট্রামগুলো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি। এতক্ষণ লোকজন বৃষ্টির জন্য আটকে ছিল গাড়িবারান্দায়, দোকানঘরে, বাসস্টপের শেড-এ এখন সব সরষেদানার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারধারে। ট্রাম বন্ধ, বাসে তাই লাদাই ভিড়। হাতে পায়ে চুম্বকওয়ালা কলকাত্তাই লোকেরা বাসের গায়ে সেঁটে আছে অবলীলায়। বাসের গা থেকে অন্তত তিন হাত বেরিয়ে আছে মানুষের নশ্বর শরীর।
মনোরমের ঠিক এক্ষুনি কোথাও যাওয়ার নেই। যতক্ষণ বিয়ারের গন্ধ শরীরে আছে ততক্ষণ গড়িয়াহাটার কাছে মামার কাঠগোলায় ফেরা যাবে না। বৃষ্টির পর এসপ্লানেড এখন ভারী ঝলমলে, রঙিন শো-উইনডোতে দোকানের হাজার জিনিস, রঙিন পোশাকের মানুষ, রঙিন বিজ্ঞাপন। টেকনিকালার ছবির মতো চারদিকের চেহারা এখন ধুলোটে ভাবটা ধুয়ে যাওয়ার পর। কাজ না থাকলেও এসপ্লানেডে ঘুরলে সময় কেটে যায়।
রাস্তা পার হয়ে মেট্রোর উল্টোদিকে ট্যাক্সির চাতালে তখন উঠে-যাওয়া পসাবিরা দ্রুত ফুচকার ঝুড়ি, ভেলপুরির বাক্স, ছুরি কাঁচি কিংবা মনোহারি জিনিস সাজাচ্ছে। ট্রাম টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁকা ট্রাম। তারই একটাতে উঠে একটুক্ষণ ঝুম হয়ে বসে থাকবে ভেবেছিল মনোরম। ফুটপাথ ছেড়ে ইট বাঁধানো চাতালটায় নামতে গিয়েও সে বাড়ানো পা টেনে নিল। সীতা না?
সীতাই। সোনা রঙের মুর্শিদাবাদি শাড়ি পরনে, ডান হাতে ধরা দু-একটা কাগজের প্যাকেট বুকে। চেপে সাবধানে হাঁটছে। বাঁ হাতে শাড়িটা একটু তুলে পা ফেলছে। মাথা নোয়ানো। পাতলা গড়ন, ছিপছিপে ছোট্ট সীতা। নরম মুখশ্রী, কাগজের মতো পাতলা ধারালো ছোট্ট নাক, লম্বাটে মুখখানা, ছোট্ট কপাল, চোখের তারা দুটি ঈষৎ তাম্ৰাভ, মাথার চুল বব করা। বেশ একটু দূরে সীতা, ওর মুখখানা সঠিক দেখতে পেল না মনোরম। কিন্তু দূর থেকে দেখেই সবটুকু সীতাকে মনে পড়ে গেল। ছয় সাত বছর ধরে সীতার সবটুকু দেখার কিছুই তো বাকি ছিল না। আশ্চর্য কার্যকারণ! একটু আগে বিয়ারের বোতল সামনে নিয়ে সে হোঁতকা বিশ্বাসটার কাছে সীতার কথা বলছিল।
একটা রগ মাথার মধ্যে ঝিনন করে চিড়িক দেয়। মনোমে গাছের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, কী সুন্দর অপরূপ রোদে সীতা একটু ভেঙে নয়ে মহার্ঘ মানুষের মতো হেঁটে চলেছে। সব জায়গা থেকে হঠাৎ সূর্যরশ্মিগুলি থিয়েটারের আলোর মতো এসে ওকে উদ্ভাসিত করে। পিছনে মরা গাছ, মেঘলা আকাশ, এসপ্লানেড ইস্টের বাড়ির আকাশরেখা, চার দিকে ফড়ে, দালাল, দোকানির আনাগোনা। কিন্তু আবহের আলো এই ভিড়ে কেবলমাত্র সীতাকেই উদ্ভাসিত করে। সোনালি শাড়িটা আগাগোড়া সোনালি, কোথাও কোনও কাজ নেই, আঁচল নেই, সোনালি ব্লাউজ, পায়ে কালো সরু স্ট্রাপের চপ্পল সবটুকু ঝলসায় এই রোদে, কিংবা বোদই ঝলসে ওঠে ওকে পেয়ে? পেটে অঢেল বিয়ার, তাই ঠিক বুঝতে পারে না মনোরম। তলপেটটা জলে ভারী হয়ে টনটন করছে, একটা কেমন গরমি ভাপ বেরোচ্ছে শরীর থেকে, আকণ্ঠ তেষ্টা। ভিখিরি যেমন ঐশ্বর্যের দিকে তাকায়, তেমনি অপলক তাকিয়ে থাকে মনোরম। মনে হয় এই সীতাকে সে কখনও স্পর্শ করেনি।
কোথায় যাচ্ছে সীতা? কোথায় এসেছিল? বোধহয় বেহালার ট্রাম ধরতেই যাচ্ছে। ওদিকের ট্রাম চালু আছে কি? চালু থাকলেও এই ভিড়ে উঠতে পারবে তো সীতা? ভাবল একটু মনোরম।
সীতা ট্রাম লাইন বরাবর হেঁটে গেল। একটু দাঁড়াল, চেয়ে দেখল দু’ধারে। তারপর দুটো থেমে থাকা ট্রামের মাঝ দিয়ে সুন্দর পদক্ষেপের বিভঙ্গ তুলে ওপাশে চলে গেল। দৃশ্যের শেষে যেমন মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়, নেমে আসে পর্দা, তেমনই হয়ে গেল চারধার। কিছু আর দেখার রইল না।
মনোরম চলল চাতালটা পেরিয়ে গোলঘরের দিকে। তীব্র অ্যামোনিয়ার গন্ধের ভিতরে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করল। এবং বেরিয়ে আসার পর টের পেল, ভীষণ একা আর ক্লান্ত লাগছে। কোথাও একটু যাওয়া দরকার এক্ষুনি। কারও সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থাকা দরকার। সীতাকে দেখার ধাক্কাটা সে ঠিক সামলাতে পারছে না। সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে, সে সত্যিই সীতাকে দেখেছে। এমন আচমকা হঠাৎ কেন যে দেখল। দেখল, কিন্তু দেখা হওয়া একে বলে না।
আকাশ আজ খেলছে। দ্রুত গুটিয়ে নিল রোদের চাদর। বৃষ্টিটা চেপে আসবে। দু-চারটে চড়বড়ে ফোঁটা মনোরমের আশেপাশে যেন হেঁটে গেল। ততক্ষণে অবশ্য মনোরম লম্বা পা ফেলে জোহানসন অ্যান্ড রোর অফিস বাড়িটায় পৌঁছে গেছে।
পুরনো সাহেবি অফিস। বাড়িখানা সেই সাহেব আমলের গথিক ধরনের। শ্বেতপাথরের মতো সাদা রং, বৃষ্টিতে ভিজেও শুভ্রতা হারায়নি। সামনে খানিকটা সবুজ সযত্নরচিত জমি, শেকল দিয়ে ঘেরা। বাঁকা হয়ে ড্রাইভওয়ে ঢুকে গেছে। সার সার গাড়ি দাঁড়ানো। তার মধ্যে সমীরের সাদা গাড়িটা দেখল মনোরম। অফিসেই আছে।
চমৎকার কয়েকটা থামে ঘেরা পোর্টিকো পেরিয়ে রিসেপশনের মুখোমুখি হওয়ার আগে মনোরম আকাশটা দেখল। গির্জার ওপর ক্রশচিহ্ন, তার ওপাশে আকাশটা সাদা বৃষ্টির চাদরে ঢাকা। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। সীতা ট্রামে উঠেছে? না হলে ভিজবে। খুব ভিজবে।
রিসেপশনের বাঙালি ছেলেটা চমৎকার ইংরেজিতে বলে–সমীর রয়? অ্যাকাউন্টস আপ ফার্স্ট ফ্লোর।
মনোরম মাথা নেড়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। শ্বেতপাথরের প্রাচীন এবং রাজসিক সিঁড়ি। বহুকাল ধরে পায়ে পায়ে ক্ষয়ে গিয়ে ধাপগুলো নৌকোর খোলের মতে দেবে গেছে একটু। তবু সুন্দর দোতলার মেঝেতে পা দিলে মেজেতে পারসিক কার্পেটের সূক্ষ্ম এবং রঙিন সুতোর মতো কারুকাজ দেখা যায়। কোথাও কোথাও গট (রেছে, তবু তেলতেল করছে পরিষ্কার। মেটা দেওয়ালের মাঝখানে নিঃশব্দ করিডোর, তাতে বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। অফিসবাড়িটায় পা দিলেই একটা ওডউইলের অলক্ষ্য অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। গুডউইল। বিশ্বস্ততা এবং সুনাম।
একটা বড় হলঘরের একধারে টিকপ্লাইয়ে ঘেরা চেম্বার। সেখানে সমীর রায় বসে। সামনে প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিল, তার ওধারে সমীর। মনোরমের ভায়রা ভাই। কিংবা ভূতপুর্ব ভায়রাভাই। লম্বা চেহারায় এখন একটু মেদ জমেছে, রংটা কালোই ছিল, এখন ইটচাপা ঘাসের মতো ফরসা হয়েছে। ভাল খায়-দাম, গাড়ি চড়ে বেড়ায়, গায়ে গলায় রোদ লাগে না। সরু টাই, চেয়ারের পিছনে কোট ঝুলছে। ঝুঁকে একটা কাগজ দেখছিল সমীর। চমৎকার একজোড়া মদরঙের ফ্রেমের চশমার ওপর ওর বড় কপাল, লালচে চুল, টিকোলো নাক, এবং গভীর খাঁজওলা থুতনিতে আভিজাত্য ফুটে আছে। সেই মুখশ্রীতে ওর চুয়াল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সটা ধরা যায় না। অনেক কম বলে মনে হয়।
মনোরমের কোনও কাজ নেই। ব্যস্ত সমীরের কাছে দু’দণ্ড বসা কি সম্ভব হবে! দু-চারটে কথা কি ও বলবে মনোরমের সাথে! একটু দ্বিধা ও অনিশ্চয়তায় ও টেবিলটার কাছাকাছি এল।
সমীর মুখ তুলে বলল-আরে, মনোরম! কী খবর?
তীক্ষ্ণ চোখে মনোরম সমীরের মুখখানা দেখে নিল। না, খুশি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। চোখ দুটি সামান্য বিস্ফারিত হয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। যারা অভিজাত তাদের একটা সুশিক্ষা আছেই, মনোভাব তারা ঢেকে রাখতে পারে। বিস্ময় এবং বিরক্তিকে অনায়াসে চাপা দিয়ে সমীর হাসল।
-একটু এলাম। খুব ব্যস্ত নাকি? মনোরম বলে।
-একটু, বলে সমীর চেয়ারে হেলান দিয়ে আঙুলে মাথার চুল পাট করতে করতে বললসাড়ে চারটেয় কিক অফ। ভাবছিলাম তাড়াতাড়ি কাজটাজ চুকিয়ে একটু মাঠে যাব। বলে ঘড়ি দেখে সমীর বলে–ঠিক আছে, তুমি বোসো। খানিকক্ষণ সময় আছে।
বিয়ারটা এখনও পেটে, ঘাম বা পেচ্ছাপের সঙ্গে এখনও পুরোটা বেরিয়ে যায়নি। মনোরম চেয়ার টেনে বসে হিসেব করে নিচ্ছিল, এতবড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলটা পার হয়ে সমীরের নাকে অ্যালকোহলের গন্ধটা যাচ্ছে কিনা। টেবিলের ওপর হেলাভরে পড়ে আছে এক প্যাকেট বেনসন আর হেজেস, ছোট্ট দেশলাই। মনোরম প্যাকেটটা টেনে সিগারেট ধরাল। সমীর লক্ষ না করার ভান করে নিচু হয়ে একটা ড্রয়ার টেনে কী একটু দেখতে লাগল কাগজপত্র।
দামি সিগারেট, কিন্তু বিয়ারের পেটে কোনও ভাল গন্ধ পাওয়া মুশকিল। মনোরম যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল-গীতাদি ভাল?
-ভালই। একটা বাচ্চা হয়েছে জানো তো! ছেলে।
না।
–সাড়ে তিন কেজি। রুমি ভাই পেয়ে খুব খুশি। দিনরাত বেড়ালের মতো থাবা গেড়ে ভাইয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে বসে আছে।
বলে এবার সত্যিকারের খুশির হাসি হাসল সমীর। মেয়ে রুমির পর দশ বছর বাদে ওদের ছেলে হল। খুশি হওয়ারই কথা।
মনোরম যান্ত্রিক এবং অন্যমনস্ক গলায় বলে-কংগ্রাচুলেশনস।
সমীর মাথার চুলে মুদ্রাদোষবশত আঙুল চালাতে চালাতে বলে একটু বেশি বয়সে হল, ঠিকমতো মানুষ করে যেতে পারব কি না কে জানে!
সমীরের গলার স্বরটা ভারী এবং পরিষ্কার। একেই কি বা ভয়েস বলে? এত ভদ্র এবং মাজা গলা যেন মনে হয় খুব উঁচু থেকে আসছে। এত শিক্ষিত ও ভদ্র গলায় কখনও কোনও অশ্লীল কথা বলা যায় না। সমীর বোধহয় তার বউকেও কখনও কোনও অশ্লীল কথা বলেনি, যা সবাই বলে! সীতাকে অনেক অশ্লীল কথা শিখিয়েছিল মনোরম, সীতা শুনে দুহাতে মুখ ঢেকে হাসতে হাসতে বলত–মাগো! পরে দু’-একটা ওইসব খারাপ কথা সীতাও বলত। ঠিক সুরে বা উচ্চারণে বলতে পারত না। তখন মনোরম হাসত। এবং ঠিক উচ্চারণটা আর সুরটা শেখাত। সীতা শিখতে চাইত না। সমীর আর গীতা কি অন্তরঙ্গ প্রবল সব মুহূর্তে ওরকম কিছু বলে? বোধহয় না। ওদের রক্ত অনেক উঁচু জাতের।
মনোরম সমীরের নম্র এবং সুন্দর কমনীয় মুখটির দিকে চেয়ে থেকে বলল–মানুষ করবার ভার আপনার ওপর নয়। টাকার ওপর। একটা হেভি ইন্সিওরেন্স করিয়ে রাখুন।
সামান্য একটু গম্ভীর হয়ে গেল সমীর। কিন্তু কথাটা গায়ে মাখল না। ডজ করে বেরিয়ে গেল। বলল–তার অবশ্য দরকার হবে না। যা আছে…বলে একটু দ্বিধাভরে থেমে থাকল। এত ভদ্র সমীর যে, টাকার কথাটা মুখে আনতে পারল না। মনোরমেরই ভুল। সমীররা তিন পুরুষের বড়লোক। ওর এক ভাই আমেরিকার হিউসটনে আছে, বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা মাইনে পায়, অন্য ভাই ফিলম প্রোডিউসার। সমীর নিজে বিলেতফেরত অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সীতাদের পরিবারের উপযুক্ত জামাই। এ সব প্রায় ভুলেই গিয়েছিল মনোরম। প্রায় একবছর সীতাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তেমনি চুলে আঙুল চালিয়ে সমীর বলে-তবে ছেলেকে মানুষ হতে দেখে যাওয়াটা বাপের একটা স্যাটিসফ্যাকশন।
মুখে কোনও বিরক্তির চিহ্ন নেই, তবু সমীরের বিরক্তিটা টের পাচ্ছিল মনোরম। ওর চোখ মনোরমের লম্বা চুল, বড় জুলপি আর কাজ করা পাঞ্জাবির ওপর থেমে থেমে সরে গেল। বোধহয় মনে মনে পোশাকটাকে সমীর পছন্দ করল না। কিন্তু কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলা সমীরের স্বভাব নয়। অভিজাতদের এইসব সুশিক্ষা থাকেই।
সমীর চোরাচোখে ঘড়িটা একবার দেখে নিল, বলল–তোমার কি কিছু বলার ছিল?
মনোরম মাথা নেড়ে বলল–না। একটু বসব বলে এসেছিলাম। বাইরে যা বৃষ্টি।
-বৃষ্টি! চোখ বড় করে বলে সমীর, তারপর একটু লাজুক হাসি হেসে বলে–বাইরের রোদ বা বৃষ্টি এখানে বসে কিচ্ছু বোঝা যায় না। তারপর একটু চিন্তিতভাবে বলে–খুব বৃষ্টি?
থেমেছিল। আবার বোধহয় শুরু হয়েছে।
অন্যমনস্কভাবে সমীর বলে–খেলাটা না ওয়াশড আউট হয়ে যায়।
কার খেলা?
ছোটবাঙাল আর বড়বাঙাল। উয়াড়ি ভারসাস ইস্টবেঙ্গল। সমীর তার সরু কিন্তু সুবিন্যস্ত দাঁত আর কোমল ঠোঁট দিয়ে আকর্ষক হাসিটা হাসে, তারপর ফোনটা তুলে নিতে নিতে বলোঁড়াও, জেনে নিই।
ফোন করল। বোধহয় ক্লাবে। সমীর অনেক ক্লাবের মেম্বার। আই এফ-এ, সি-এ-বি, ওয়াই-এম-সি-এ এবং আরও কয়েকটার। বোধহয় রোটারিয়ানও। বহুকাল ধরে মেম্বার। এতদিনে দুচারটে ক্লাবের কর্মকর্তাও হয়েছে বোধহয়।
ফোনটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে বললনা, খেলা হচ্ছে। বৃষ্টিটা বোধহয় থেমে গেল। লিগের যা অবস্থা আজকের খেলাটা খুব ইম্পট্যান্ট।
থুতনিই বোধহয় মানুষের মুখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। অনেকক্ষণ সমীরকে লক্ষ করে এই সত্যটা উপলব্ধি করে মনোরম। থুতনির চমৎকার খাঁজটি সমীরের বংশগত, ওই খাঁজটিই ওর মুখটাকে এত উঁচুদরের মানুষের মুখের মতো করেছে। অনেক মানুষের মুখই সুন্দর কিন্তু সেই সৌন্দর্যে সব সময়ে ব্যক্তিত্ব থাকে না। সমীরকে দেখলেই যে সম্ভ্রান্ত এবং উঁচুদরের লোক বলে মনে হয় তা কি ওর চমৎকার খাঁজওলা ওই থুতনিটার জন্যই? মনোরম ভাবে। সমীর ঘড়ি দেখছে। বোধহয় প্রায় চারটে বাজে। ওর ওঠা দরকার। কিন্তু সে কথাটা ভদ্রতাবশত মনোরমকে বলতে পারছে না।
মনোরম সংকোচটা ঝেড়ে ফেলে বলে-সীতার কোনও খবর জানেন?
আবার মদরঙের চশমার ভিতরে চোখটা সামান্য বিস্ফারিত হল। বিস্ময়ে। একটু অস্বস্তির সঙ্গে সমীর বলে-সীতা! ভালই আছে। একদিন কি দু’দিন নার্সিং হোম-এ গিয়েছিল ওর দিদিকে দেখতে।
সে খবর নয়, অন্য কোনও খবর?
–আর কী? ওদের বাড়িতে বহুদিন যাই না, ঠিক কিছু বলতে পারব না। কীসের খবর চাও?
মনোরম টেবিলের ওপর কাঁচের ভিতরে চাপা একটা ছবি দেখল। রঙিন ফটোগ্রাফ বলে মনে হয়েছিল প্রথমে। তা নয়, হাতে আঁকা রঙিন প্রিন্ট। বনভূমিতে বেলাশেষের সিঁদুরে আলো, কয়েকটা গোরুর গাড়ি কুঁকে আছে, মাঝখানে আদিবাসী কয়েকজন নারী ও পুরুষ রান্নাবান্না করছে। পথের ওপর গেরস্থালি। ছবিটার মধ্যে একটা গল্প আছে।
সে মুখ তুলে বলল–একটু আগে আমি সীতাকে দেখলাম।
সমীর অস্বস্তিতে চেয়ারের একদিক থেকে আর একদিকে শরীরে ভর দিল। বলল–ও! কোথায়?
–এসপ্লানেডে। বোধহয় মার্কেটিংয়ে এসেছিল। ফিরে যাচ্ছিল তখন।
চুলে তেমনি আঙুল চালায় সমীর। চোখ সরিয়ে নেয় মনোরমের চোখ থেকে, তারপর একটু হালকা গলায় বলে কথাটথা বললে নাকি?
না। আমি কথা বললেও ও পাত্তা দিত না।
মনোরম ক্ষীণ একটু হাসে। সমীর চিন্তিতমুখে পার্টিশনটার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলে লে–আর কিছু বলবে? হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে–এখনও একটু সময় আছে।
কটা বাজে?
চারটে প্রায়।
–আমার কিছু বলার ছিল।
-খুব কি জরুরি কথা?
–খুব। অন্তত আমার কাছে।
–খুব জরুরি হলে না হয় আজকের প্রোগ্রামটা…
না না। আমি…আমার খুর অল্প কথা।
সমীর একটু ঝুঁকে মুখখানা তুলে চেয়ে রইল।
মনোরম বলার আগে আর একবার বনভূমির ছবিটা দেখে নিল। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোরুর গাড়ি। গাছের ছায়ায় গোধূলি, আদিবাসী নারী ও পুরুষ উনুন জ্বেলেছে।
–আমি আজ সীতাকে দেখলাম।
বলেছ তো।
বলেছি। তবু বলতে ইচ্ছে করছে।
কী?
–সীতা এরপর কী করবে কিছু জানেন?
–ফ্রাঙ্কলি জানি না।
সমীর দুঃখিতভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে। মুখে সত্যিকারের সমবেদনা। রক্তাভ সুন্দর আঙুল দিয়ে থুতনির খাঁজটা মুছে নিল অকারণ। একটা পোখরাজ একটু ঝলসে যায়। মনোরম বুঝতে পারে, সমীরের কিছু বলার নেই।
কিন্তু তবু মনোরমের ইচ্ছে হয়, আরও একটুক্ষণ এই সফল সুপুরুষ ও উঁচু ধরনের লোকটির সঙ্গে কাটায়। আর একটু দেখতে ইচ্ছে করে, কী আছে লোকটার। সীতার কথা একটু শুনতে ইচ্ছে করছিল তার।
সে একটা মিছে কথা বলল। চেয়ারটা ঠেলে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে–আমিও মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম।
যাবে? বলে একটু বিস্মিতভাবে তাকিয়েই সেই ভদ্র আন্তরিক হাসিটি হেসে বলে–ইউ আর ওয়েলকাম। আমার সঙ্গে চলো।
টেবিলের ওপর ঝুঁকে মনোরম বলে–যাব?
যাবে না কেন?
মনোরম একটু বোকা-হাসি হেসে বলে–আমি কিন্তু একটু মদ্যপান করেছি। অবশ্য তেমন কিছু না, একটু বিয়ার…
তেমন ভদ্র হাসি হেসে সমীর উঠতে উঠতে বলে–গন্ধ পাচ্ছিলাম। তাতে কী? আমিও তো মাঝে মাঝে খাই। ইটস অল ইন দ্য গেম।
টেবিল থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগে শেষবারের মতো মনোরম ছবিটা দেখছিল। রাঙা আলোর বনভূমিতে গো-গাড়ি থামিয়ে গেরস্থালি পেতেছে কয়েকজন আদিবাসী পুরুষ ও রমণী। কী চমৎকার বিষয়, যেন ঠিক একটা গল্প বলা আছে ছবির ভিতরে। ছবিটা দেখতে দেখতেই সমীরের শেষ বাক্যটির চমৎকার ইংরিজি কটা শব্দ শুনে সে চমকে গেল। এখনও ভাল ইংরিজি বলা লোককে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হয়। আদিবাসীদের ছবি থেকে সে চোখ সরিয়ে কলকাতায় চলে এল এক পলকে। কিছুক্ষণের জন্য যেন বা সে ওই ছবির বনভূমিতে চলে গিয়েছিল।
–আমার কার্ড নেই, লাইন দিয়ে টিকিট কাটতে হবে।
টিকিট? লোকটা পরতে পরতে আবার সেই ভদ্র হাসি, কোমল লাবণ্য, ক্ষমা, সব বিকিরণ করে সমীর বলে–আরে কার্ডফার্ড লাগবে না। আমি…বলে আবার সেই ভদ্রতাসূচক স্তব্ধতা, থেমে বলল–গভর্নিং বডির মেম্বার।
আন্দাজ করেছিল। তাই হাসল মনোরম, মনে মনে বলল–জানতাম। ঘাড় দুটো উঁচু করে স্বাগ করল। বললনা। আমি সবুজ গ্যালারিতেই যাব।
চলো তো।
নিঃশব্দ গাড়ি। ছুটল, শব্দ হল না। কথা না বলে গাড়িটার জোরালো ইঞ্জিনের টান ও গতিটুকু উপভোগ করে মনোরম। কনভার্টিবল বুইক। একটু পুরনো। তবু ভাল। যে কোনও ভাল জিনিস এমনকী একটা গাড়ির চলাও নিবিড়ভাবে উপভোগ করার আছে। মনোরম করে। মামার গাড়িটা ভাল নয়, সেই গাড়িতে সে আজকাল প্রায়ই বীরুর পিছু নেয়।
ইডেন গার্ডেনের উল্টো দিকে গাড়িটা দাঁড় করায় সমীর। বৃষ্টিটা থেমেছে। পিঁপড়ের মতো ময়দান ভেদ করে তোক চলেছে। দূরে উড়ছে একটা লাল সোনালি পতাকা। মাঠে সমীর গাড়ির কাচ বন্ধ করে দরজা লক করে বলল–এখানেই থাক। দূরে থাকাই সেফ।
হাঁটতে হাঁটতে মনোরম বলে আপনি রোজ খেলা দেখেন?
–আরে না, না। মাঝে-মধ্যে। তবে গভর্নিং বডিতে যাওয়ার পর প্রায়ই আসতে হচ্ছে। ওটা এটিকেট।
কখনও টিকিটের গ্যালারি থেকে খেলা দেখেননি?
একটু অস্বস্তি বোধ করে সমীর, দ্বিধাভরে বলে–সেই ছেলেবেলায়, দু-একবার, ঠিক মনে নেই।
-কেন যান না?
–এমনিই! যেতে তো হয় না, তা ছাড়া ওদিকের ওরা একটু হস্টাইল।
সাধারণ দর্শকের গ্যালারি থেকে যখন মানুষ জামা প্যান্ট খুলে বাতাসে ওড়ায়, চেঁচিয়ে বাপ-মা তুলে গাল দেয় খেলোয়াড়কে, যখন ঘাড়ে লাফিয়ে ওঠে, মস্তিষ্কশূন্য খ্যা-খ্যা হাসে, কনুয়ের বা হাঁটুর গুতো দেয়, তখন তার মাঝখানে এই অতি সুকুমার ও ভদ্র মানুষটিকে কেমন দেখাবে? যখন ইট ছুঁড়ে মারবে, রেফারি, লাইনসম্যান আর ক্লাবের কর্মকর্তাদের পিতৃপুরুষ উদ্ধার করবে তখন কেমন হবে ওই মুখখানার ভাব!
–ওরা হস্টাইল কেন, তা কিন্তু একবার আপনার নিজের দেখে আসা উচিত। গভর্নিং বডির মেম্বারদের দর্শক সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকা ভাল।
সমীর দ্বিধাভরে বলে–মন্দ বলোনি। কিন্তু এ বয়সে একটা মোটামুটি ভদ্র জীবন যাপন করে, ওই ইট-ছোঁড়া আর খারাপ কথা ভাল লাগে না। হার্শনেসটা ঠিক সহ্য হয় না আমার।
মাঠের কাছাকাছি এসে মনোরম হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সমীরের কোমল, পরিষ্কার এবং রক্তাভ একখানা হাত ধরল–আসুন।
সমীর অবাক হয়ে বলে-কোথায়?
সবুজ গ্যালারিতে।
–আরে পাগল, টিম মাঠে নামবে, মেম্বাররা খোঁজাখুঁজি করবে।
মনোরম মিনতি করে–আসুন না। একদিন আমার সঙ্গে দেখুন। ওদের বলবেন শরীর খারাপ ছিল।
সমীর হাত টানাটানি করল না, বিরক্তি দেখাল না। কেবল সহৃদয়ভাবে হেসে বলল–আরে, আজ তুমি আমার গেস্ট। এসো এসো
লড়াইটা মর্যাদার ছিল! সবুজ গ্যালারিতে লম্বা লাইনে সমীরকে দাঁড় করাবে, গ্যালারিতে খিস্তির সমুদ্রে দাঁড় করিয়ে পাশাপাশি খেলা দেখবে–এতটা আশা করেনি মনোরম। বড়লোকেরা যে কী জিনিস দিয়ে তৈরি! টপ করে হারিয়ে দেয়। মনোরম ওই মহার্ঘ গলার স্বরের প্রভুত্বের কাছে হেরে গেল। খুবই বোকা-বোকা লাগছিল নিজেকে।
সমীর তার কাঁধটা বন্ধুর মতো ধরে বলল-চলো।
মনোরম চলল। সসম্ৰমে গেট-এর পাহারাদাররা রাস্তা ছেড়ে দেয়। মনোরম কে সে প্রশ্নই ওঠে না।
ভিতরে দু-চারজন কর্তাব্যক্তি গোছের লোক সমীরকে ঘিরে ধরে। সমীর যে বড় ‘ডোনার’ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, নইলে মনোরমের সন্দেহ ও কোনওকালে ফুটবলে লাথিই দেয়নি।
কথা বলতে বলতেই সমীর ব্যস্তভাবে চলে গেল টেন্ট-এর দিকে, মনোরম যে সঙ্গে আছে, খেয়ালই করল না। একা দাঁড়িয়ে থেকে মনোরম তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠে। একা সে দাঁড়িয়ে, চারদিকে ব্যস্ত সমস্ত লোকজন চলে যাচ্ছে। এখন কেউ তাকে সে কে জিজ্ঞেস করলে তার তেমন কিছু বলার নেই। চলাচলের রাস্তাটা ছেড়ে সে গ্যালারির তলদেশে আবছায়ায় এসে দাঁড়ায়। টেস্ট-এর খোলা জানালা দিয়ে ভিতরের অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। সমীর যে কোথায় গেল। বড় একা লাগে মনোরমের। আর সেই নিঃসঙ্গতায় কেবল টুক টুক করে মুখের ভিতরে নড়ে তার অসহায় জখমি জিভখানা।
ঝলসানো রঙের জার্সিপরা খেলোয়াড়রা সারিবদ্ধভাবে টেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছে। কী চমৎকার তাদের সতেজ উরু, নোয়ানো কিন্তু গর্বিত মাথা, চারদিককে অবহেলা করে তারা পলকে গ্যালারির ভিতরকার রাস্তা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় মাঠের দিকে। সামনে পেছনে পাশে কয়েকজন ভাল চেহারার লোকজন তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল। মনোরম ঈর্ষার চোখে এই তাজা বয়সি খেলোয়াড়দের চলে যাওয়া দেখছিল। সে যদি খেলোয়াড় হত!
আলো থেকে চোখ সরিয়ে গ্যালারির তর আবছায়ার দিকে তাকিয়ে মনোরম নিজেকে দেখতে পাচ্ছিল। পায়ে বুট, হোস আর রনি জার্সি নোয়ানো মাথা, আত্মবিশ্বাসী সতেজ উরুদ্বয়ে মাংসল শক্তির পিচ্ছিলতা। হেঁটে যাচ্ছে মনোরম খেলার মাঠের দিকে। সেখানে হাড়ভাঙা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গ্যালারিতে সীতা বসে আছে, উদগ্রীব তার শুষ্ক উজ্জ্বল মুখখানা। মাঠে বাইশজনের একজন হয়ে মনোরম প্রচণ্ড শক্তিতে ফেটে পড়ে। কী খেলাই খেলছে মনোরম, কী খেলাই যে খেলছে! বাইশজনের মধ্যে ঠিক একজনকেই দেখছে সীত। মনোরমকে।
হঠাৎ মাঠে চিৎকার ফেটে পড়ে। টিম মাঠে নামছে। কল্পনাটা ভেঙে যায়।
মাঠ থেকে চিৎকার আসছে। বলে বুটে লাগাবার শব্দ। দৌড় পায়ের আওয়াজ। একজন চেঁচিয়ে উঠল-হেগো…হলদে চিনি দিয়ে খা। একা বিষয় এবং চুপচাপ দাঁড়িয়ে শোনে মনোরম। আজ বিকেলে সে সীতাকে দেখেছিল। ভুলতে পারছে না।
শেষ পর্যন্ত স্মৃতি ছাড়া মানুষের কিছুই থাকে না বুঝি! গ্যালারিতে ঝুঁকে মানুষ খেলা দেখছে, মাঠে রগ-ছেঁড়া লড়াই কত উত্তেজক, বলে পা লাগার শব্দ কী মাদকতাময় কত মানুষের কাছে। একাকী মনোরম দাঁড়িয়ে আছে গ্যালারির ছায়ায়, বিষণ্ণ, স্মৃতিতাড়িত, উদাসীন। এখনও, মানুষ পৃথিবীতে খেলা করে। ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার সেটা। চারদিকে বৃষ্টিবিন্দুর মুক্তো আর মেঘভাঙা রোদের ভিতর দিয়ে পৃথিবীর মাটিতেই হেঁটে গেছে সীতা। কোথা থেকে এসেছিল, কোথায় চলে গেল কে জানে! প্রায় এক বছরে সীতা কত দূরের হয়ে গেছে। সীতাকে চেনার চিহ্নগুলি কি শেষ পর্যন্ত মনোরমের থাকবে। ভুলে যাবে না তো! স্মৃতি ছাড়া তার আর কিছুই নেই। প্রবল বৃষ্টিতে যেমন গাছপালার ধুলোময়লা ধুয়ে যায়। তেমনই কি সীতা মনোরমের সব স্মৃতি ধুয়ে-মুছে ফেলেছে? কিছু কি নেই?
মুখের ভিতরে জিভটা নড়ছে টুক টুক করে। চামচের মতো নড়ন্ত জিভটাই যেন তার স্মৃতিকে ঘুলিয়ে তোলে। সীতা তীব্র আশ্লেষের সময়ে কতবার তার সুন্দর দাঁতে মুখের ভিতরে মনোরমের জিভটাকে নরম করে চেপে ধরে রেখেছে। খাসবায়ুর স্বরে বলেছে ‘নোড়ো না জিভ, চুপ করো’। সীতার সুগন্ধী সুস্বাদু মুখের ভিতরে জিভটা নিথর হয়ে থাকত। এমন প্রবলভাবে সেই অনুভূতিটা আক্রমণ করে মনোরমকে যে তার চোখ বুজে আসে, মুখটা আস্তে একটু ফাঁক হয়, জিভটা। লোভে-প্রত্যাশায় বেরিয়ে আসে। মুখে স্বেদবিন্দু ফুটে ওঠে মনোরমের, গায়ে কাঁটা দেয়, খাস গাঢ় হয়ে আসে। সমস্ত শরীরটা এক অদৃশ্য সীতার বুকে-পড়া, কাছে আসা, আলিঙ্গন-আশ্লেষে বদ্ধ অস্তিত্বের স্বাদ নিতে থাকে। ইডিও-মোটর অ্যাকশন।
ঠিক এই অবস্থায় তাকে দেখল সমীর। টেন্ট-এর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবার মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে সে অবাক হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল। কাছে এসে বলল–তোমার শরীর কি খারাপ মনোরম?
না, না। লজ্জা পেয়ে মনোরম বলে।
সমীরের অবাক ভাবটা কাটেনি, বলল–চোখ বুজে, জিভ বের করে এমনভাবে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে যে আমি চমকে উঠেছিলাম।
কী করবে মনোরম! মনে পড়ে, বড্ড যে মনে পড়ে! কিছু একটা প্রবলভাবে মনে পড়লেই তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। এই ইংরিজি শব্দটা সীই শিখিয়েছিল তাকে। ছুঁচে সুতো পরাচ্ছে সীতা, অখণ্ড মনোযোগে, খুব ধীর হাতে, চোখ ছোট, ঠোঁট দুটো পাখির ঠোঁটের মতো ছুঁচোলো। দেখতে দেখতে মনোরমেরও চোখ ছোট হয়ে যেত, ঠোঁট ছুঁচোলো হয়ে আসত, দুটো হাত আপনা থেকেই শুন্যে উঠে ছুঁচে সুতো পরানোর ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকত, হঠাৎ চোখ তুলে দৃশ্যটা দেখেই হেসে ফেলে সীতা একদিন বলেছিল–তোমার ইডিও-মোটর অ্যাকশন আছে। না বুঝে মনোরম বলেছিল-মানে? সীতা উত্তর দিয়েছিল–ওটা সাইকোলজিকাল একটা ব্যাপার। কখনও কখনও সেই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে মনোরমের। কোনও কারণ থাকে না, হঠাৎ মনে পড়ে। সেই ভয়ঙ্কর শব্দ, অন্ধকার রাত, হঠাৎ ঘুম-ভাঙা আঘো-চেতনায় টের পেত, চারদিকে ট্রেনের কামরা ভাঙার শব্দ, কে যেন তাকে বাতাসে ছুঁড়ে দিচ্ছে। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল মনোরম। মনে পড়লেই তার হাত মুঠো পাকায়, শরীর কুঁকড়ে আসে, চোখ বুজে সে কাল্পনিক আঘাতে বিকট মুখভঙ্গি করতে থাকে। এ দৃশ্য দেখেও সীতা ওই ইংরিজি শব্দটা বলেছিল। ইডিও-মোটর অ্যাকশন। বলত– তোমার যখন ছেলে হবে, আর ছেলেকে যখন আমি ঝিনুকে দুধ খাওয়াব তখন তা দেখে ঠিক তুমিও হাঁ করবে, ঢোক গিলবে, দেখো। ইডিও-মোটর অ্যাকশন থাকলে ওরকম হয়।
দুর্ঘটনাটা এড়ানো গেছে। তাদের ছেলেপুলে হয়নি। সীতা তাই বিবাহ-বিচ্ছেদের পর অবিকল বিয়ের আগের মতো কুমারী হয়ে গেছে। কিন্তু তা কি হয়? হতে পারে? স্মৃতি থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত স্মৃতিই থাকে। কুমারী সীতার বুকভরা বিবাহের স্মৃতি, মনোরম জানে।
এসো, বলে সমীর হাঁটতে থাকে। এবং মনোরম কেন সমীরের সঙ্গে এতক্ষণ লেগে আছে তা না-বুঝেই পিছু নেয়। গ্যালারির ফাঁক দিয়ে মাঠে রঙিন জার্সির ছোটাছুটি দেখা যায়। একটু এগোতেই মস্ত আকাশের নীচে সতেজ সবুজ মাঠ, গ্যালারিতে আনন্দিত ভিড়, সাদা উড়ন্ত বলখানা–সব মিলিয়ে সুন্দর দৃশ্যটা দেখে মনোরম। দেখে, কিন্তু তাকে কিছুই স্পর্শ করে না। বরং একটা ভোলা বাতাস এসে ঝাপটা দিতেই তার গা শিরশির করে, একটু শীত করে। সে এই খেলার কিছুই মানে বুঝতে পারে না। তবু সমীরের পিছু পিছু সে যায়। লোহার ঘেরা-বেড়ার গেট দিয়ে মাঠের সাইড লাইনের ধারে গিয়ে বসে। একটা প্রবল চিৎকার উঠতে উঠতে হঠাৎ ফেটে পড়ে উল্লাসে। গোল। দুহাতে কান ঢেকে মনোরম চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। এত কোলাহল তার সীতার হেঁটে-যাওয়ার ছবিটা ছিঁড়ে দেয় বুঝি!
সমীর গাঢ় একটা শ্বাস ফেলে সিগারেট ধরাল। মুখে হাসি। একটু ঝুঁকে বলল–বি পাল খেলছে না, আমাদের রেগুলার স্ট্রাইকার। খুব চিন্তা ছিল।
না বুঝে মনোরম হাসল, যেন বা গোলটা হওয়ায় সেও নিশ্চিন্ত। খানিকটা অসহায়ভাবেই সে মাঠের দিকে চেয়ে খেলাটা বুঝবার চেষ্টা করে। সারা মাঠ জুড়ে রঙিন জার্সির ছোটাছুটি। মাঠে চোরা জল লাথি খেয়ে হঠাৎ ছিটকে ওঠে ফোয়ারার মতো। পিছলে পড়ে বহু দূর মাটিতে ঘষটে যায় চতুর খেলোয়াড়েরা। কী সুন্দর ভঙ্গিতে হরিণের মতো লাফিয়ে ওঠে শূন্যে গোলমুখে কয়েকজন হালকা শরীরের মানুষ। বলটা বাতাসে কেমন ধনুকের মতো বাঁক নেয়। দেখতে দেখতে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। পা শূন্যে ওঠে, মাথাটা হঠাৎ নড়ে, দুহাত মুঠো পাকায়।
দুটো গোলের পর সমীর হাসল–গেম ইজ ইন দি পকেট। তুমি কী বলবে বলেছিলে মনোরম!
মনোরম একটু ইতস্তত করে। তারপর বলে–মানস লাহিড়িকে আপনি চেনেন?
সমীর একটু থমকায়। তারপর চিন্তা করে বলে–কোন মানস বলো তো!
-জিমন্যাস্ট ছিল। রিং থেকে পড়ে গিয়ে যার কলারবোন ভেঙেছিল এখন রেলের অফিসার, দু-চারটে ক্লাবের কোচ। চেনেন না?
সমীর মাথা নাড়ল, বলল–হ্যাঁ, চিনি।
–আমি খবর রাখি, সীতা ওকে বিয়ে করবে।
সমীর নীরবে কিছুক্ষণ খেলাটা দেখে যেতে থাকল। ভ্রু কোঁচকাল। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল মনোরম, ফ্রাঙ্কলি আমি কিছুই জানি না। কিন্তু যদি সীতা আবার বিয়ে করেই তাতেই বা কী?
মনোরম সহজ উত্তর দিল না। বলল–ডিভোর্সের পর এক বছর পূর্ণ হতে আর মাস তিনেক বাকি। তারপর আইনত সীতা বিয়ে করতে পারে। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমার কয়েকটা কথা ছিল।
সমীরের ভ্রূ কোঁচকানোই ছিল, একটু অধৈর্যের গলায় বলে–আমাকে এ সব ব্যাপারের মধ্যে টেনো না মনোরম। আমি ইনভলভড হতে চাই না। তা ছাড়া সীতার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তো চুকেই গেছে। আবার কেন? লিভ হার অ্যালোন।
মনোরম মাথা নাড়ল। বলল–তা হয় না। সীতা এখনও আমার কাছ থেকে মাসোহারা পায়।
–তাতে কী?
–তাতে এটুকু প্রমাণ হয় যে, সে আমার ওপর এখনও কিছুটা নির্ভরশীল। নীতিগতভাবে তার সম্বন্ধে দু-চারটে কথা আমি বললে দোষ হয় না। ২৩৪
-কিন্তু আমাকে কেন জড়াচ্ছ?
আপনাকে জড়াচ্ছি না। সীতার কোনও খবর পাওয়ার উপায় আমার নেই। আপনি ও বাড়ির জামাই, আপনি খবর পান। তাই আপনাকে ছাড়া আর উপায় কী?
তুমি বরং সীতাকে চিঠি লেখো, কিংবা টেলিফোন করো।
–টেলিফোন করলে ও ফোন রেখে দেবে। চিঠি ছিঁড়ে ফেলবে।
সমীরের ভদ্র ও সুকুমার মুখে ইতিমধ্যে অধৈর্যের ভাব ফুটে উঠেছে। মনোরম সেটা লক্ষ করে। তবু সমীর বলেকী বলতে চাও?
গোলের সামনে একজন ফরোয়ার্ড ল্যাং খেয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে। চারদিক থেকে প্রবল একটা চিৎকার ওঠে। রেফারির বাঁশি বাজে। সমীর হঠাৎ দুহাতে মাথাটা ধরে ধরা গলায় চেঁচিয়ে বলে–গড! পেনাল্টি!
স্পটে বল বসানো হয়েছে। কিন্তু কে কিক নেবে তা নিয়ে একটু ঠেলাঠেলি হতে থাকে। কেউ এগোয় না। মাঠসুদ্ধ লোক ঝুঁকে আছে ব্যাপারটার দিকে। সমীর নিথর। কথাগুলো আটকে আছে মনোরমের গলায়। পেনাল্টি শটটা নিতে ওরা বড় দেরি করতে থাকে। মনোরমের ইচ্ছে করে, উঠে গিয়ে শটটা দিয়ে ফিরে এসে সমীরকে কথাগুলো বলে।
কালো লম্বা একটা ছেলে অবশেষে এগিয়ে যায়। কোমরে হাত দিয়ে হাত দশেক দূর থেকে বলটাকে দেখে। দৌড়োয়। ডান পায়ে কিকটা নেয়। কোমর সমান উঁচু হয়ে ভীমরুলের ডাক ডেকে বলটা গোলে ঢুকে যায়। মাঠ স্তব্ধ।
সেই স্তব্ধতার মধ্যেই মাঠের মাঝখানে বলটা চলে আসে। দুপাশে খেলোয়াড়রা দাঁড়ায় যথাযথ। সমীর অস্ফুট গলায় বলে–গড।
তারপর সিগারেট ধরায়।
মোটে আর একটা গোলের লিড থাকছে। হাফটাইম পর্যন্ত ব্যাপারটা যথেষ্ট নিরাপদ নয়। মনোরম সমীরের মুখ দেখে ব্যাপারটা আঁচ করে নিল।
চিন্তিত সমীর মনোরমের দিকে মুখ ফেরায় এবং স্বয়ংক্রিয় হাতে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই এগিয়ে দেয়।
কী বলছিলে যেন।
মনোরম একটা শ্বাস ফেলে বলে সীতার কথা।
–ও। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো।
–আসলে সীতার কথাও আমি বলতে চাইছি না।
তবে কী বলতে চাইছ?
–স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা।
বলো।
-মানস লাহিড়ি আমার বন্ধু ছিল, আমাদের বাসায় আসত-টাসত। এবং নামকরা জিমন্যাস্ট বলে আমি তাকে যথেষ্ট খাতির করতাম। সে সীতার খুব প্রশংসা করত। ক্রমে সীতার ভাল লাগতে থাকে। মানস লাহিড়িকে তো আপনি জানেন, কী রকম পেটা প্রকাণ্ড শরীর, কাঁধের হাড় ভাঙা বলে বাঁ দিকটা একটু বেঁকে থাকে, তবু খুবই পুরুষালি চেহারা। অন্য দিকে সীতা একটা চড়াই পাখির মতো ছোট্ট আর নরম আর সুন্দর।
-গুডনেস। সমীর আচমকা চেঁচিয়ে ওঠে।
ও বিরক্ত হয়েছে মনে করে মনোরম থেমে যায়। কিন্তু তারপরই দেখে কর্নার ফ্লাগের কাছ পর্যন্ত গিয়ে সমীরের টিমের রাইট-আউট বলটা সেন্টার করতে পারেনি। বল লাইন পার হয়ে গেছে। গোল কিক।
কী বলছিলে যেন?
–স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা।
বলো।
–কোনও অন্য পুরুষ যখন কোনও বিবাহিতা মহিলার প্রশংসা শুরু করে এবং সেই মহিলা যখন সেই প্রশংসা গ্রহণ করে খুশি হতে থাকে তখন তাদের মধ্যে একটা যৌন শ গড়ে ওঠে।
কীসের ঋণ।
–যৌন ঋণ।
–ওঃ গড!
পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকে একজন খেলোয়াড় বলটা বাইরে মেরেছে। মনোরম গভীরভাবে সিগারেটে টান দেয়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে।
কী বলছিলে মনোরম? কীসের ঋণ?
–যৌন ঋণ।
–সেটা কী ব্যাপার?
পরস্পরের কাছে তখন একটা না বলা দাবি-দাওয়া তৈরি হতে থাকে। অপরিশোধ্য একটা ঋণ গড়ে ওঠে। ঠিক ভালবাসা এ নয়, এটুকুর জন্য কেউ ঘরসংসার ভাঙে না, তবু এও এক ধরনের স্খলন বা পতন। পরস্পরকে যখনই ভাল লাগতে থাকে, তখনই ভিতরে ভিতরে একটা বাঁধ ভাঙার ইচ্ছে উঁকি দিতে থাকে। যেহেতু সেটা অবৈধ সেই জন্যই সেটা আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে।
-ডিসগাস্টিং। বি পাল খেললে এরকমটা হত না।
কার কথা বলছেন?
–বি পাল। আমাদের স্ট্রাইকার। গোললাইন থেকে বলটা ব্যাক করতে পারা ছেলেখেলা ছিল, মজুমদার পারল না দেখলে?
–আমি মানস লাহিড়ির কথা বলছিলাম।
–ওঃ হ্যাঁ, বলো।
—আসলে মানস লাহিড়ির কথাও নয়।
তবে কার কথা।
—স্বামী-স্ত্রীর কথা।
বলো।
–বিয়ের ছয়-সাত বছর পর আর পরস্পরকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর তে উত্তেজনা থাকে না।
—বটেই তো।
-সীতার আর আমারও ছিল না।
–হুঁ, হুঁ।
–আর তখন মানস লাহিড়ি আসত।
–ঠিক।
–আর তখন আমরা যখন, অর্থাৎ আমি আর সীতা যখন শারীরিক দিক দিয়ে মিলিত হতাম, মানে বুঝতেই পারছেন
–ও-গুডনেস—
সমীরের টিম অন্য টিমের গোলপোস্ট ঘেঁকে ধরেছে। পর পর চারজন গোলে মাল। পোস্ট, বার খেলোয়াড়ের গা থেকে ফিরে এল। শেষ শটটা গোলকিপার উড়িয়ে দিল বারের ওপর দিয়ে। কর্নার।
কর্নার কিকটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মনোরম।
কিক থেকে একটা নিষ্ফলা হেড। তারপর গোল-কিক আবার।
শ্বাস ফেলে সমীর বলল-বলো।
—যখন আমরা মিলিত হতাম–মানে শারীরিকভাবে, বুঝলেন?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো।
—তখন আমার প্রায়ই মনে হত সীতা আমার কথা ভাবছেন না।
–তবে কার কথা?
-মনে হত, সীতা চোখ বুজে আমার জায়গায় আর একজনকে ভেবে নিচ্ছে এবং তাতে তার সমস্ত শরীরে একটা বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। মনে মনে সে তখন সেই ঋণ শোধ দিচ্ছে।
-মাই গুডনেস! সমীর চাপ তীব্র গলায় বলে।
মনোরম চমকে মাঠের দিকে তাকাল। না, মাঠে কোনও ঘটনা ঘটেনি। মাঝ-মাঠে একজন বল নিয়ে দুর্বল পায়ে দৌড়োচ্ছে। বেরোতে পারবে না।
সমীর তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনোরম লজ্জা পায়।
কী বলছ মনোরম।
আমার ওরকম মনে হত।
–কেন?
মনে হওয়াকে কেউ ঠকতে পারেনা।
সমীর দ্রুত সিগারেটে টান দেয়। বলে তারপর?
মনোরম দুঃখিত গলায় বলে আমার একটা দোষ, আমি বড্ড বেশি কৌতূহলী। সব ব্যাপারটা আমি জানতে চাই। তাই সীতাকে আমি জিজ্ঞেস করি। মানস লাহিড়িকেও।
-বলো কী?
মনোরম ম্লান একটু হাসল। বললদুজনেই অস্বীকার করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম ওরা মিছে কথা বলছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার পক্ষে কী রকম কঠিন হয়ে দাঁড়াল ভেবে দেখুন। আমি সীতার স্বামী, তার সঙ্গে মিলিত হচ্ছি, সম্পূর্ণ বৈধ ভাবে। অথচ জানছি, আমি নই, তার বুক জুড়ে আর একজনের কাছে ঋণ। আমি সেই আর একজনের প্রতিনিধি হয়ে সেই ঋণ শোধ নিচ্ছি মাত্র। এভাবেই আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ক্রমে অবৈধ হয়ে ওঠে।
সমীরের মুখের সুকুমার ভাবটুকু ভেদ করে একটা ঘেন্নার ভাব ফুটে ওঠে। সে বলল–ডিসগাস্টিং। এ সব কী বলছ মনোরম!
–আমি সীতা বা মানসের কথা বলতে চাইছি না। আমি আসলে জানতে চাইছি সব স্বামী-স্ত্রীরই কি এরকম হয়? এরকম হওয়াটাই কি স্বাভাবিক?
নিশ্চয়ই নয়।
–আপনি কখনও গীতাদিকে জিজ্ঞেস করেছেন?
কী?
–তিনি কখনও আর কাউকে…
পলকে ফণা তোলে সমীর। দুখানা চোখ ধ্বক ধ্বক করে ওঠে। মনোরম মুখ আড়াল করে উদ্যত হাতে, যেন বা মার ঠেকাবে।
রিডিকুলাস মনোরম। ভেরি রিডিকুলাস! তুমি কি পাগল?
মনোরম অবাক হয়ে টের পায়, সমীরের টিম একটা গোল দিয়েছে। ৩-১। সমস্ত মাঠ ফেটে পড়ছে উল্লাসে। সবুজ গ্যালারির ওপর শূন্যে ভাসছে ছাতা, উড়ছে জুতো, জামা। সমীর এক পলক তাকিয়ে দেখল মত্র। উত্তেজিত হল না।
মনোরম আস্তে আস্তে আমার যন্ত্রণাটা ঠিক এইভাবে শুরু হয়। অথচ কখনও সীতা বা মানস লাহিড়ি পরস্পরের দিকে এক পাও এগোয়নি। বৈঠকখানা ঘরে তারা বরাবরের মতো দুটো দূরের চেয়ারে বসে থেকেছে, হেসেছে, স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছে। কিন্তু আমি কেন–আমারই কেন যে শান্তি ছিল না।
সমীর হঠাৎ উঠতে উঠতে বলে-মনোরম, তুমি কি খেলাটা আর দেখবে? দেখলে দেখো৷ আমি যাচ্ছি।
না। বলে মনোরম উঠে সরে পিছু নেয়।
গ্যালারির কলরোল তখনও থামেনি। উদ্দণ্ড নাচ নাচছে লোকজন। একজন বুড়ো মোটা মানুষ একসঙ্গে তিনটে সিগারেট ধরিয়ে টানহে, তাকে ঘিরে ভিড়। গ্যালারির সরু রাস্তাটা দিয়ে তারা বেরিয়ে আসে। আগে সমীর, পিছনে মনোরম। স পার হয়ে তারা বড় রাস্তায় এসে পড়ে।
সমীর দ্রুত লম্বা পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছিল, যেন বা মনোরম তার সঙ্গে নেই। হঠাৎ থমকে সমীর মুখ ফিরিয়ে বলল–পুরুষমানুষের অনেক কাজ থাকে মনোরম। শুধু বউয়ের চিন্তা নিয়ে থাকলেই তার চলে না।
মনোরম দাঁড়িয়ে গেল। সমীর পিছন ফিরে আর তাকাল না, নিজের গাড়ির দিকে চলে গেল।
বিষণ্ণ মনোরম বড় রাস্তা ছেড়ে একা মাঠের মধ্যে নামল। তারপর প্রকাণ্ড মাঠ খানা-জলকাদা ভেঙে পার হতে থাকল। প্রকাণ্ড আকাশের নীচে মাঠখানা বড় অফুরান, ক্লান্তিকর লাগছিল তার।