০১.
খলিফা হারুনর রশীদের প্রাসাদের এক অংশে সহধর্মিণী বেগম জুবায়দা ও বাঁদী মেহেরজান কথোপকথন-রত।
বেগম : মেহের।
মেহেরজান : বেগম সাহেবা।
বেগম : যা, এবার যা।
মেহের : আগে ওরা তন্দ্রায় ঝিমোক। মহলের প্রহরীরা এখনও জেগে আছে।
বেগম : আর তাতারী জেগে আছে তোর জেন্য।
মেহের : কিন্তু বেগম সাহেবা, ধরা পড়লে খলিফা আমাকে কতল করে ছাড়বেন।
বেগম : সে আমি দেখে নেব। আর এই নে। যদি বিপদে পড়ি আমার অঙ্গুরী রেখে দে। পাহারাদারদের দেখালে ছেড়ে দেবে।
মেহের : তবু ভয় লাগে, বেগম সাহেবা।
বেগম : আজ হঠাৎ ভয় লাগছে কেন?
মেহের : এম্নি। খলিফা ত আমাকে দেখেন নি। দেখলে মেহেরবানী করতেন। প্রহরীদের হাতে ধরা পড়লে আর রক্ষা থাকবে না।
বেগম : যা। এই সুসাম রাত। এখন জওয়ানের বুকের মধ্যে বাঁধা পড়তে কি যে সুখ—
মেহের : আপনি আমাকে ঈর্ষা করছেন, বেগম সাহেবা?
“মেহেরজান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বেগম সাহেবা বললেন, “দুই সীনা একত্র দেখলে আমার কি যে খুশী লাগে!”
“বেগম সাহেবা”, মেহেরজান জবাব দিলে, “এইজন্যে আমি কেয়ামত তক আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আপনার বাঁদী ত আছি-ই। বেহেশতেও যেন আল্লা আমাকে আপনার। বাঁদী বানিয়ে রাখেন।”
–তুই যা। বড় বাজে কথা বলি। যা, আর দেরী করিস্ না। একটু দাঁড়া–তোর চোখের সুর্মা কোণের দিকে একটু মুছে গেছে।
বেগম সাহেবা নিজেই আয়নার সামনে মেহেরজানকে দাঁড় করানোর পর সুর্মার রেখা স্থান-শোভায় ভরিয়ে তুললেন।
–আহ্, তোকে যা মানিয়েছে। এই ঘাঘরা সদ্রিয়া, ওড়না নেকাব। ফেরেস্তারা তোকে না তুলে নিয়ে যায়।
–বড় লজ্জা দেন, বেগম সাহেবা।
–যা, তাতারী না পাগল হোয়ে যায় আজ তোকে দেখে।
–বেয়াদবী মাফ করবেন, বেগম সাহেবা। সে ত পাগল আছেই। বুকে জড়িয়ে না ছাতু করে ফেলে।
সে ত ভালই। তুই তার বদনে বদনে লেপটে যাবি, আর কাছছাড়া হোতে হবে না।
–কি যে বলেন, বেগম সাহেবা। ঘোড়ার সহিস, শুধু আপনার মেহেরবানীতে–
–ওকে দেখে ভেবেছিলাম, তোর সঙ্গে ভাল মানাবে। হাব্সী গোলাম। কিন্তু সুন্দর সুঠাম দেহ নওজোয়ান।
–মানুষ হিসেবে ও আরো সুন্দর।
–যা, যা। বড় কথা বাড়াস্। আঙুর নিয়েছিস্ ত?
মেহেরজান ওড়নার আড়াল থেকে বেগম সাহেবাকে এক গোছা আঙুর দেখাল।
–তুই নিজেই আজ আঙুর। এর চেয়ে আর বড় মেওয়া তাতারীর কাছে কিছুই হোতে পারে না। (বুকে টোকা দিয়া) এখানেও ত বোটায় ভাল ফল ধরেছে।
বেগম সাহেবা হাতে লাগলেন। সরমে মেহেরজান মুখ নীচু করে আর কুঁচকানো গালের পাশ দিয়ে চোখের দৃষ্টি ছড়িয়ে বেগম সাহেবাকে দেখে।
–এবার যা।
–আর থোড়া–একটা কথা, বেগম সাহেবা। আপনি কেন আমাকে এত পেয়ার করেন?
–তুই এলি। তাই আমি খুশি। তুই আছিস্, তাই এই প্রাসাদে আমার আনন্দ আছে। নচেৎ এই বিরাট মহলে কে কার? বেগম, বাঁদী ত শত শত। কিন্তু কাছের মানুষ মেলা দায়।
–খলিফা ত আপনাকেই…
–সে কথা রাখ।
–আমার আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। আমিরুল মুমেনীন ত আজ আপনার মহলে আসবেন না। কাছে থাকতে দিন।
–না। আর এ-কি বছিস্, মেহেরজান? যা, যা। আর একজনের বুক খাঁ খাঁ করছে। গোনাগার হোতে পারব না। ভোর হওয়ার আগে ঠিক ফিরে আসি।
–আমি ত ভয় পাই! দু-জনে কখন ঘুমিয়ে পড়ি জানি না। যদি রাত্রে ঘুম আর না ভাঙে…
–না, এ ভুল কোনদিন করিস্ নে। যদিও খলিফা আমার কথা রাখেন–কিন্তু কখন কি হয়, কে জানে। মরজী যেখানে ইনসাফ সেখানে কোন কিছুর উপর বিশ্বাস রাখতে নেই।
–আপনি ভয় পান, আর আমি ভয় পাব না, বেগম সাহেবা?
–না। তবু সাবধান থাকা ভাল।
–তবে খলিফা আমাকে কখনও দেখেন নি। সেই যা ভরসা। হঠাৎ পথে ধরা পড়লে বলব, বেগম সাহেবা বাগানে ফুল আনতে পাঠিয়েছিলেন।
–খলিফা দেখেন নি। সে ভাল-ই। কখন কি ঘটে এই মহলে, কেউ বলতে পারে না।
–আমার তাই ত রোজ যেতে ইচ্ছে করে না, বেগম সাহেবা।
–না, যা। তাতারী জেগে আছে মহলের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।
–আচ্ছা, বেগম সাহেবা।
–খোদা হাফেজ। ফি আমানীল্লাহ।
নীচে তরুলতা শোভিত প্রাঙ্গণ চত্বর। তারপর বাগানের সীমানা শুরু। বাতাবী লেবুর সারি, দ্রাক্ষাকুঞ্জ–অন্যান্য গাছের ঘন সন্নিবেশে রাত্রি অন্ধকার-জমাট। পথের হদিস পাওয়া কষ্টকর। বেগম জুবায়দা অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। বাঁদী মেহেরজান কি কালো অন্ধকার, না হাব্সী গোলামের কালো বুকে এতক্ষণে হারিয়ে গেল?
আখরোট-খুবানী ডাল ঝুলে আছে ওইখানে পুব দরওয়াজার দু’পাশের দেওয়ালের পাথর ঘিরে। তারই নীচে তো তাতারী প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। ডালের ঝোঁপ ছেড়ে মেহেরজান কখন তার হাতে হাতে দিয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
হাব্সী গোলাম আজ অপেক্ষা করবে ত? দাঁড়িয়ে থাকবে না স্পন্দিত বুকে, সারাদিনের কঠোর ক্লান্তির পর?
বেগম জুবায়দার মনে সেই প্রশ্ন, মেহেরজানের মনে সেই প্রশ্ন।