শ্রীমতি কাফে (১৯৫৩) – উপন্যাস – সমরেশ বসু
প্রথম কথা, শ্রীমতী কাফে কোনও একটা রেস্তোরাঁ নয়। ও একাধিক মিলে শ্রীমতী কাফের একটা বিশেষত্ব আছে। অর্থাৎ শ্রীমতী একটা ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। সে ঐতিহ্য আমাদের জাতীয় জীবনেরই আলো-আঁধারির খেলা।
শ্রীমতী কাফে উপন্যাস। কাহিনী ও চরিত্রই এর প্রধান উপজীব্য এবং তা বাস্তবধর্মী হলেই এর উৎস-সন্ধানে যে ইতিহাস আপনা হতেই এসে পড়ে, উপন্যাসে সেটা অপ্রধান নয়।
শ্রীমতী কাফে যেন রঙ্গমঞ্চ, যে হিসাবে আমরা সমগ্র বিশ্বকেই রঙ্গমঞ্চ বলে থাকি। সুতরাং ক্ষেত্র বড় বিস্তৃত নয়। অথচ অনেক ঘটনা। তাই কাহিনীর গতি চলতি নিয়ম থেকে একটু অন্য পথ ধরেছে। পথটা সমাদৃত হলেই সার্থক।
আবার বলছি শ্রীমতী কাফে কোনও বিশেষ রেস্তোরাঁ নয় এবং শ্রীমতী কাফের আয়নায় যদি কেউ নিজের প্রতিবিম্ব দেখেন, সে দায়িত্ব লেখকের নয়। চরিত্রগুলি লেখকের সৃষ্টি।
আর এক কথা, তেরোশো ঊনষাটের শারদীয় চতুষ্কোণে শ্রীমতী কাফে যেটুকু প্রকাশিত হয়েছিল, সেটুকু প্রকৃতপক্ষে বর্তমান উপন্যাসের কিঞ্চিৎ গল্পাংশ। বাংলাদেশের চলতি-প্রথানুযায়ী ওটা একটা শারদীয়কীর্তি হিসাবে গণ্য করলে ত্রুটি হবে না আশা করি।
বইটি প্রকাশে বিলম্বের দরুন বন্ধুমহলে অনেক কৈফিয়ত দিয়েছি, এবার তার নিরসন হল।
লেখক
অগ্রহায়ণ, ১৩৬০
.
শ্রীমতী কাফে
০১.
সময়টা উনিশশো বাইশ সালের বসন্তকালের শেষ দিক। সারা দেশটা যেন একটা বিরাট বইয়ের ভস্মস্তূপ হয়ে আছে। ছাইয়ের স্তূপটা বিলিতি কাপড়ের। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, জাতীয় আন্দোলনের নিভানো চিতার ছাই প্রদেশ জেলায় ছড়িয়ে যেন একটা ধূসর আবছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। বোঝা যায় না সেই ভস্মভূপের তলায় আগুন চাপা পড়ে আছে কি না। আর জায়গায় জায়গায় লেগে আছে রক্তের দাগ। নতুন যুগের সূচনায় যে সমস্ত বিচিত্র ও অসব ঘটনা গত কয়েক বছর দেশে ঘটে গিয়েছে, বুঝি সেটা একটা স্বপ্ন মাত্র। অবুঝ কাঁচা মেয়েটাকে কে যেন তেপান্তরের মাঝে ফেলে পালিয়েছে। স্তব্ধ হয়েছেনপুর ও বাঁশির সুর শব্দ। চৈত্রের পাগল হওয়ায় এক অসহ্য গোমরানি ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে।
নতুন রাগিণী ও তান ধরে দিয়ে গিয়েছে বদৌলিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। একমাত্র ব্যক্তির নেতৃত্বে সারা দেশ আচ্ছন্ন। তিনি গান্ধীজি, যাঁর অঙ্গুলি সংকেতের জন্য সমস্ত দেশ প্রতীক্ষা করে আছে। তিনি আইন অমান্য আন্দোলন তুলে নিলেন। দেখলেন, যাকে তিনি জাগাতে যাচ্ছেন সে একট সুপ্ত হিংস্র সিংহ। অহিংসা বোঝে না সে।
কিন্তু বদৌলির রাগিণী যেন বিয়েবাসরের হাসি কলরবে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের বিষাদ নিয়ে চেপে বসল। তার সঙ্গে ওই অসহ্য গোমরানিটা একটা বেসুরো শব্দে ভরে রাখল আকাশটা।
.
বারাসত মহকুমা কোর্ট। কোর্ট মহকুমা হাকিমের। তিন মহলা কোর্ট। অর্থাৎ তিন টুকরো একতলা বাড়ি। বিচার চলে তিন ঘরে। এক নম্বরে স্বয়ং ম্যাজিটে, দু নম্বরে এক অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, তিন নম্বরটা উভয়ের। একদিকে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পুলিশ বিভাগ, মহকুমা হাজত। কোট প্রাঙ্গণের এক পাশে বার লাইব্রেরি। সেখানে চোগা চাপকান পরা উকিল মোক্তারবাবুর দল ঝিমুচ্ছেন, দু-একজন কথাবার্তায় ব্যস্ত নয় তো নথি ঘটছেন চোখে চশমা এটে। ডাকসাইটে মোক্তার নলিনীবাবু যথাপূর্বং তাঁর চোপসানো গালে থোলোহঁকোয় সশব্দে চুমু খাচ্ছেন আর নড়বড়ে দাঁতে চিবুচ্ছেন পান।
হাকিমের লাঞ্চটাইম প্রায় উয়োয়। তবু কোর্ট প্রাঙ্গণটা যেন ঝিমুচ্ছে এখনও।
কোর্টের একপাশ দিয়ে গুম গুম করে বেরিয়ে গেল আপ-এর বনগাঁ লোকাল ট্রেন। আর একদিকে সুদূর নির্জন যশোর রোডটা গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে। চৈত্রের এলোমেলো হাওয়ায় দুলছে শাল শিমুল ও কৃষ্ণচূড়ার মাথা। ডালে ডালে থোকা থোকা লাল ফুল বাতাসের ঘায়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে আগুনের শিখার মতো। তারই নিখুঁত ছায়া মাটির বুকে নাচছে যেন দল বাঁধা বুনন মেয়েরা। আচমকা নোনা হাওয়ার ঝোড়ো শব্দ বেদনার্ত পৃথিবীর দমকা নিশ্বাস। তার সঙ্গে রাশি রাশি ধুলো উড়ে বিব্রত করে দিচ্ছে মানুষকে। হঠাৎ শুকনো পাতা উড়ে গিয়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, বুঝি সে বাতাসের ব্যাকুল চিঠি। কয়েদি ঠাসা হাজত ঘরটার পাশে একটা গাছে পাখি ডাকছে কুহু কুহু!
কোর্ট ঝিমুচ্ছে। আছে গুল্তানি, কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, বাদী আসামি সাক্ষীর ভিড়। তবু যেন ঝিমুচ্ছে। বহুরিদের কলম ধরা হাতে আঁটন নেই। তেলে ভাজা, খাবারের দোকান ও হোটেলগুলোর টুলে খদ্দেরেরা খেয়ে নিয়ে জিরুচ্ছে। রাস্তার একপাশে কয়েকটা গরুর গাড়ি, আর একপাশে ঘোড়া-গাড়ি কাতার দেওয়া রয়েছে ডজনখানেক। ঝিমুচ্ছে জানোয়ারগুলো এবং তাদের প্রভুরা। গরুর গাড়ির ছইয়ের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়েছে নথ নোলক পরা সম্পন্ন গেরস্ত বউ। হয় তো বাদী নয় তো আসামি। কৌতূহল ভরে দেখছে বিচারালয়, নিজের অজান্তে হাসি নিয়ে দেখছে হাজতের বারান্দায় দড়িবাঁধা আসামিদের। সেদিকে তাকিয়ে পরস্পর হাসাহাসি করছে গেঁয়ো, আধা গেঁয়ো লোকগুলো।
হোটেলের পেছন দ্বার দিয়ে বেরিয়ে একটা বেড়াল অসঙ্কোচে ঘুমন্ত পেয়াদার নাকের উপর দিয়ে এক নম্বর আদালতের হাকিমের চেয়ারে গিয়ে গুটিসুটি বসল। এই কোর্টের, ওই চেয়ারের এক কালের হাকিমের তেলরং ছবি টাঙানো দেওয়ালে, বঙ্কিম চাটুজ্যের মুখে বুঝি চকিতে ঝিলিক দিয়ে গেল হাসি। মনে পড়ে গেল নাকি কমালকান্তের মাজার প্রসঙ্গ।
ঝিমুনি কাটছে না। আমের বোলের সঙ্গে বেআইনি চোলাই করা মদের গুদাম থেকে একটা তীব্র মদিরা-গন্ধ যেন মানুষ ও জানোয়ার সবাইকে নেশাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। যশোর রোডের দূর দূরান্ত থেকে ভেসে আসছে গরুর গাড়ির গাড়োয়ানের গানের স্তিমিত সুর।
ঝিমুনি সর্বত্র। সারা দেশে। গত সালে মামলার সংখ্যা আশাতীত কম। অনেকগুলো মামলা বাদী আসামির অনুপস্থিতি বা ইচ্ছানুক্রমে কোর্ট খারিজ করে দিয়েছেন। লোকে বিবাদ বিসম্বাদ একটা বছরের জন্য যেন প্রায় ভুলতে বসেছিল। অবশ্য দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার কথা বলছি। তবুও সরকারের আইন শৃঙ্খলা বিভাগ গত বছরে নিশ্বাস নেওয়ার সময় পায়নি।
তারই একটা রেশ এখনও রয়েছে যেন সুরের মাঝে ছেড়া তারের গোঙানির মতো। এ চৈত্র আকাশটার মতো উদাস অথচ নীল, বেদনার বিলম্বিত সুরের মাঝে দমকা হাওয়ার বেতাল লয়।
ঢং করে বেলা একটার ঘণ্টা পড়ল। গোক গড়াক করে এল হাকিমের গাড়ি। আড়মোড়া ভাঙল কোর্ট। হুজুরে সেলাম পড়ল এদিকে সেদিকে, প্রত্যুত্তর চোখের ইশারায়। সময় বুঝে উকিলবাবুরা পেছন দিক দিয়ে হাত পাতলেন মক্কেলের কাছে, মুহুরি কলম চালাতে চালাতে সেদিকে নজর রাখল কড়া। গাছে গাছে পাখিগুলো তাড়া খায় লোকের মাথা নষ্ট হওয়ার ভয়ে। গরুর গাড়ির ছইয়ের বাইরে দুই চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠেছে। এই হাকিম, মানে ম্যাজিস্টর অর্থাৎ কাজি!
বেড়ালটা পালাল নিঃশব্দে কাঠগড়ার তলা দিয়ে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে কোর্ট বসতেই নাজিরের নির্দেশে পেয়াদা বাইরে এসে হাঁকল, মাদেব হালদার হাজির! একবার দুবার নয় চার পাঁচবার গলা ফাটিয়ে ডাকা হল।
নলিনী মোক্তার লাফ দিয়ে উঠে হুঁকো হাতে ছুটে এলেন মুহুরির কাছে। দেখলেন মহাদেব হালদার পাঁশুটে রং-এর সুতার গলাবন্ধ কোটটা গায়ে দিয়ে, মোটা ছড়িগাছটি মাথার কাছে রেখে তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন। নলিনী প্রথমে খেকোলেন মুহুরিকে, কী রকম বে-আক্কেল হ্যাঁ তুমি, ভলোককে ডাক দিতে পর্যন্ত পারোনি?
মুহুরি বলল, এঁজ্ঞে ডেকেছিলুম, উনি বিরক্ত হলেন।
নলিনী বললেন, তোমার মাতা। তাড়াতাড়ি ডাকলেন, কই হত্যা মাদেব ভায়া, ও-দিকে ডাক পড়ছে য্যা।
মহাদেব হালদার উঠলেন। গায়ে মাথায় দু এক জায়গায় পাখির বিষ্ঠা পড়েছে। সে সব দিকে কোনও খেয়াল না করে বললেন, কোনও লাভ আছে নলিনীদা? জানার কি কিছু বাকি আছে? তবে?
নলিনী বললেন, কী যে বলল আজকে মামলার রায় আর তুমি সুস্থ শরীরে কোর্টের উঠোনে বসে থাকবে?
কী হবে আর! মহাদেব বললেন, বিশ্বেস করো, তোমার মোক্তারিতে আমার একটুও সন্দেহ নেই। তবে ভাবছি, মামলাবাজ নামটা এবার ঘোচাব। এক ছিটে জমি নিয়ে অনেকদিন কাটল, আর নয়। এই মামলা করে করে কবে বউ মল, ছেলে দুটো কতখানি হল কোনও খোঁজ খবরই নিইনি। আজ থেকে–
পেয়াদা আবার হাঁকল, মাদেব হালদার হাজি–র।
হালদার মরেছে।বলে হেসে উঠলেন মহাদেব।
নলিনী বললেন, না ভায়া, যেতে তোমাকে হবেই।
মহাদেব ছড়িতে ভর দিয়ে উঠে ভ্রূ কুঁচকে খানিকক্ষণ হাকিমের এজলাসের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, চলো যাই। বীরপুরুষ তার পরাজয়ের সংবাদ নিজের কানেই শোনে। শুনেই আসি হাকিমের বক্তিমেটা।
আধঘণ্টা বাদে হাকিম রায় দিচ্ছেন। মহাদেব তখন পকেট থেকে একটা আধুলি বার করে পেয়াদার হাতে লুকিয়ে দিলেন। কাজটা অবশ্য কোর্ট অবমাননা করা। কিন্তু কোর্টেরও চোখ সময়ে সময়ে বুজে যায়। বললেন, ধরো হে তাড়াতাড়ি। আমাকে আবার যেতে হবে।
এঁজ্ঞে আপনার রায় হচ্ছে যে।
আমার রায়? হালদার নিঃশব্দে হেসে হেসে বললেন, এ সংসারে কার রায় কে দেয় হে।
কথাটা এমনভাবে বললেন যে, হাকিমের বক্র বিরক্তিব্যঞ্জক দৃষ্টিও চকিতে একবার হালদারকে খোঁচা মেরে গেল। জনকয়েক বাইরের লোক ছিল। তারা হাসল মুখ টিপে টিপে।
হালদারের এ মামলার আসামি হল এক সাহেব কোম্পানি। তাদের একজন আইরিশম্যান ইঞ্জিনিয়ারও হাজির ছিল কোর্টে। সে খানিকটা বিস্মিত হয়েই তাকিয়েছিল কোম্পানির এ জন্মশত্ৰুটির দিকে। তার সঙ্গে ছিল তাদের কেরানি কান্ত চক্রবর্তী। সে স্পার্টা দেখছিল হালদারের।
নাজির বলল গম্ভীর গলায়, আপনারা চুপ করুন।
হাকিমের রায় পাঠ শেষ হল। রায়ে আদালতি ইংরেজি কথায় এ যাত্রা তার পরাজয় ঘোষণা হল। মহাদেব হালদার বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
হালদার সুপুরুষ। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। গায়ের রংটা উজ্জ্বল শ্যাম। টানা টানা দুটো। চোখে কিছুটা লালের আভাস। চাউনিটা তীব্র কিন্তু উদাস। পাঁশুটে বর্ণের বিশাল গোঁফের পাশে এমনি একটা বক্রতা ছিল যে, সাধারণের দ্বারা তাকে হঠাৎ ঘাঁটানো সম্ভব ছিল না। প্রশস্ত কপাল। মাথার চুল কাঁচায় পাকায় মিলে একটা মসৃণ ধূসরতা দেখা দিয়েছে কিন্তু চুলের গোড়া যে শক্ত তা দেখলেই বোঝা যায়। এত থাকতে যেটা নিয়ে হালদারের চেহারার খ্যাতি, তা হল তাঁর খাঁড়ার মতো বিরাট নাক। লোকে বলে, তার একপাশে দাঁড়ালে আর একপাশের সবটা ওই নাক আড়াল করে রাখে। যেন একটা পাঁচিল। তাই পড়শিরা বলে, নেকো হালদার।
জয়ী পক্ষকে ঘিরে ধরেছে তাদের পাওনাদারের। পাওনা বখশিশ ইনাম অনেক কিছু। হালদার দেখছিলেন নলিনী মোক্তার কোথায়। নলিনী মোক্তার হালদারের উনিশটি মামলার পরাজয়ের গ্লানি বহন করছেন, কোনওদিন তিনি জেতাতে পারেননি। তাই আজ তিনি হুঁকোসহ অন্তর্ধান করেছেন।
সে চক্ষুলজ্জা যার বিন্দুমাত্র ছিল না সে হল মুহুরি। সে বলল, চললেন হালদারমশাই?
হালদার বললেন চলব তো, তোমার বাবু কোথায়?
মাথা চুলকে বলল মুহুরি, এঁজ্ঞে তিনি বোধ করি পাইখানায় গেছেন।
এমন অসময়ে? বলে হালদার তাঁর সেই চোখে সঙ্কুচিত মুহুরির দিকে তাকিয়ে বললেন, সেই হুঁকো নিয়েই গেছে বুঝি। তোমার বাবুকে ওটা একটু গঙ্গাজলের ছিটা দিয়ে নিতে বলল। আর এই নেও, তোমার আর তোমার বাবুর পাওনাটা।
বলে কোটের পকেট থেকে টাকা বের করে মুহুরির হাতে দিয়ে হালদার ঘোড়ার গাড়ির লাইনের কাছে এসে দাঁড়ালেন।
ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানরা চেঁচাচ্ছে, আইয়ে বাবু নীলগঞ্জ, বারিকপুর, টিটাগড়, খড়দা। কেউ বা চেঁচাচ্ছে, ইছাপুর, শ্যামনগর, ভাটপাড়া। বলদ ও ঘোড়া-গাড়ি ছাড়া এখান থেকে যাওয়ার আর কোনও যানবাহন নেই। ট্রেনে দমদম জংশন হয়ে যদি উজান আবার উত্তরদিকে পিছু হটতে হয়, সে বড় ঘুরপথ সেইজন্য বিশেষ করে উত্তরদিকের লোকেরা সাধারণত চারজন করে শেয়ারে ঘোড়া-গাড়ি ভাড়া করে বারাকপুর স্টেশন হয়ে যায়। চারজন অবশ্য আইনত, বেআইনে জনা বারোও হয়।
হালদার সাধারণত শেয়ারে গিয়ে থাকেন আর গাড়োয়ানরাও তাঁকে বিলক্ষণ চেনে। কিন্তু হালদার আজ স্থির করলেন, ভাগাভাগি থাক, এ দিনটাতে একলা যাওয়াই ভাল। কেন না, শেয়ারে যারা যায়, তারা সকলেই জানে উনি একজন মামলাবাজ শুধু নন, ফেরেববাজও বটেন। শলাপরামর্শ ও উপদেশ দিতে যেমনি ওস্তাদ, তেমনি সেটা কার্যকরী। অনেকে তাঁর পরামর্শে ও উপদেশে বিলক্ষণ লাভবান হয়েছে। কেবল নিজের জীবনে এ মামলা সংগ্রামে কোনওদিন জয়তিলক পাননি। আজ আর ওইসব পরামর্শ প্রার্থীদের বাহবা, গুলতানি কিছুতেই ভাল লাগছে না।
এই কোর্টের পানবিড়িওয়ালা থেকে শুরু করে সবাই হালদারকে চেনে। কিন্তু হালদার আজ আর কারও সঙ্গে কথাবার্তা বললেন না। বাড়ি ফিরে যাওয়ার একটা তাগিদ তাঁকে ভিতরে ভিতরে ব্যস্ত করে তুলছে।
কোর্টের কাজ যেমন তেমনি চলতে লাগল। সারা মহকুমা থেকে এখানে নিত্য নতুন লোকের আনাগোনা। একদিন ছিল প্রায় সারা জেলার তীর্থক্ষেত্র। বারাকপুর কোর্ট হয়ে এখানকার তেজ সম্প্রতি কিছু কম হয়েছে। এখানে লোক ও রকমের ভাবনা নেই। তাই হালদারের বিদায়ে এখানে কারও কিছু যায় আসে না।
তবু হালদার একবার ফিরে তাকালেন। কিছুই নতুন নয়। তবু হাইকোর্টের চেয়ে মফস্বলের এসব কোর্টের প্রতি তাঁর একটা মমতা ছিল। তাকে ঘুরতে হয়েছে নগর ও উপকণ্ঠের সব বিচারালয়েই। কিন্তু এ-সব জায়গায় তার একটা ঘরোয়া মজলিশি ভাব ছিল।
ফটকের মাথায় সিংহ ওত পেতে রয়েছে। তার মাথায় টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে, যেন বিক্ষুব্ধ অগ্নিশিখার মতো সিংহকে পুড়িয়ে দিতে চাইছে। চালচুলোহীন বাউলটার মতো কাঁটা ভরা ন্যাড়া শিমুলের সর্বাঙ্গে আল-সাজ।
কিন্তু বিশ্বসংসারটা ঝিমুচ্ছে। মাতালের মত। ঘুঘু ডাকছে কোনও নির্জন ঝোপে। সব অলস, মন্থর। তার মাঝে টুনটুনির চিড়িক পিড়িক যেন ছেলেমানুষের লুকোচুরি খেলা।
হালদার গাড়িতে উঠলেন।
গাড়ি পশ্চিমের খোয়া বাঁধানো রাস্তা ধরে চলল ঘ্যাগর-ঘ্যাগ করে। হালদার ঘোড়া দুটোর দিকে তাকিয়েছিলেন বাইরের দিকে মাথা হেলিয়ে। ঘোড়া দুটোর পরস্পরের বনিবনা নেই বোঝা গেল। এ ওকে খোঁকাচ্ছে, ও একে। হালদার ভাবলেন, কী বা ওদের বিবাদ, কে বা করবে বিচার। মামলা হাজির করা তো ওদের দ্বারা সম্ভব নয়। জানোয়ারে আর মোকদ্দমার কী বোঝে। ওরা যেটা বোঝে, সেটা গাড়োয়ান হাকিমের চাবুক।
জানোয়ারের মামলাতত্ত্ব থেকে কখন তাঁর মনে ভর করেছে তাঁর স্ত্রী-হীন সংসার ও ছেলেদের কথা তা বোধকরি নিজেরও খেয়াল নেই। সে চিন্তাও আজ এসেছে নিজের দারুণ অসহায়তার কথা ভেবেই। উপরের হাজারো নির্লিপ্ততার মধ্যে বুকের ভেতরে যেন একটা চাকা ঘুরছে লক্ষ মাইল বেগে। সেই চাকাটাকে যেমন বোঝা যায় না সেটা ঘুরছে কিনা, তার উপরের শান্তভাব খানিকটা তাই।
বসতবাড়িটি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। আজ যে জমির মামলায় তাঁর পরাজয় হল, সে জমিটুকুর দাম তিনি পাবেন। গঙ্গার ধারে যে জমির উপর সাহেবরা কারখানা করেছে, সেখানেই অনেকের সঙ্গে তাঁরও খানিকটা জমি ছিল। কিন্তু, গোঁ ধরে বসেছিলেন, সে জমি তিনি ছাড়বেন না। কোম্পানিকে কম বেগ পেতে হয়নি। তাদের অনেকখানি কাজ বাকি পড়েছিল। প্রতিশোধ নিতে তারাও ছাড়বে না। আগে যে দামে তারা সেধেছিল, আজ তার থেকে কম দেবে। বিশেষ ওই কান্ত চক্রবর্তীর মতো লোক যখন কোম্পানির সহায়। লোকটা বোধকরি নেকো হালদারের নাকেও দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারে। তা ছাড়া কানাই মুখুজ্যের মতো জমিদার কোম্পানির বন্ধু।
কিন্তু কথা সেখানে নয়। যে টাকা তিনি পাবেন কোম্পানির কাছ থেকে সে টাকাও মামলার দেনা শোধ করতেই যাবে। যে পকেট থেকে তিনি আজ নলিনী মোক্তারকে টাকা দিয়ে এসেছেন, সে পকেট শেষবারের মতো শূন্য হতে বসেছে। কী ভাগ্য মেয়েটার বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন, স্ত্রীর শ্রাদ্ধটাও করেছেন নিজে। যারা বাকি আছে, তারা দুই ছেলে। বড় নারায়ণ, ছোট ভজন। দুজনেই শিক্ষিত। কিন্তু নারায়ণ একরকমভাবে সংসারের মায়া ছড়িয়েছে। এ দুর্ভাগা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়েছে সে। মাসখানেক হল সে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। এক মাত্র ভরসা ছিল ভজন। কিন্তু ভজন অত্যন্ত উন্নাসিক, দুর্বিনীত। বিশেষ, বাপের সঙ্গে তার একটা ঘোরতর বিরোধ। সে বিরোধ মহাদেব হালদারের সংসারের বিমুখতা। তা ছাড়া অত্যধিক সরাসক্তিতে তিনি নিমজ্জমান। অর্থাৎ, এ সংসারের দিকে তিনি কোনওদিন ফিরে তাকাননি উপরন্তু যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছেন, সেটা একটা অন্ধকার অতল গর্ভের খাদের ধারে। অথচ ভজন চাকরি করবে না।
তবু হালদারের অন্ধকার চোখে শেষ পর্যন্ত ভেসে উঠল ভজনের দোকান। বাড়ির সামনেই সামান্য জায়গায় ছিটেবেড়ার ঘরে ভজনের চায়ের দোকান। আজ ডোববার মুহূর্তে সেটা যেন মুমূর তৃণকূটার মতো মনে হল। শেষ হবার আগে এক বার বুঝি পা ঠেকাবার এক চিমটি মাটির আবাস রয়েছে জলে।
গাড়ি বারাকপুরের রেল ক্রশিং পেরিয়ে বাঁয়ে স্টেশনের দিকে মোড় নিল। অস্তমিত সূর্যের আভা পড়েছে হালদারের চিন্তাক্লান্ত মুখে। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে তাঁর কপালে। গাড়োয়ানকে বললেন, নন্দীর দোকানে চল।
গাড়ি আবার বাঁক নিল পশ্চিমে চার্নক ফাঁড়ির পাশ দিয়ে।
চকিতে একবার মনে উদয় হল হালদারের, ভজনকে কোনওরকমে যদি একবার মামলা মোকদ্দমার দিকে ঝোঁকাতে পারেন, তা হলে এখনও গোটা তিনেক মামলা হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ পাওয়া যাবে। তা ছাড়া এমন কতকগুলো জমি তাঁর সন্ধানে আশেপাশে ছিল, যেগুলো একটু চড়ুকো হলেই ভজন নিজের কুক্ষিগত করতে পারে।
কিন্তু বড় শক্ত ঘাঁটি। দুপয়সা কাপ চা বিক্রি করবে সে তবু এসব দিকে ভিড়বে না। এক কথা, তাকে বিয়ে দিয়ে যদি তার বউয়ের মারফত তাকে ঘোরানো যায়। ওই শ্রীপাদপদ্মে অনেক বীরপুরুষ তাঁদের উঁচু মাথা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েন।
রাস্তার দুপাশে ঝাউ ও দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে থেকে থেকে হঠাৎ অস্তোন্মুখ সূর্যের লাল আলো এসে পড়েছে হালদারের উত্তেজিত মুখে। সে উত্তেজনা যেন অসহ্য যন্ত্রণায় ফেটে পড়বার পূর্ব মুহূর্ত।
আচমকা হালদারের স্ত্রীর মুখ মনে পড়ে গেল। সেই অসহ্য রূপ ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব কোনওদিন তো তাঁকে বাঁধতে পারেনি। তিনি নিজের বেগে দুর্বার আর সে রূপসী কস্তা পেড়ে শাড়ি পরে পায়ে আলতা দিয়ে রক্ত-রেখায়িত ঠোঁট টিপে টিপে হেসেছে ঘরের কোণে বসে। কেন? হয়তো নিজের কাছে সে ছিল অপরাজিতা। সেই হাসির মতোই ডঙ্কা মেরে সে পরম ঔদাস্যে বিদায় নিয়েছে।
হালদারের প্রৌঢ় বুকের মধ্যে হঠাৎ কীসের বান ডেকে উঠল, নড়ে উঠল ঠোঁট। আমি কার কাছে থাকব, কে আমাকে দেখবে? কোনওদিন যাদের মুখ চাইনি, আজ তাদেরই কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে দাঁড়াতে হবে। আমি করুণার পাত্র হতে চলেছি এক মুঠো ভাত আর এক ঘটি জলের জন্য। তোমার সেই দুর্জয় হাসিই যে অক্ষয় হয়ে রইল আমার জীবনে!
হু হু করে দুরন্ত বেগে ছুটে এল দক্ষিণ হাওয়া। যেন ভেঙে পড়ল বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ, নোনা জল। তপ্ত।
গাড়ি এসে দাঁড়াল নন্দীর ফরেন লিকার সপের সামনে।
গোধুলির ঝিকিমিকি বেলা। চিকচিক করে উঠল আকাশে দুটো তারা। হালদার বেরিয়ে এলেন নন্দীর দোকান থেকে। গাড়ি চলল স্টেশনের দিকে। তারপর উত্তরে।
তবু অবসাদ কাটতে চায় না। ঝিমুনি যেন বসেছে মৌরসী পাট্টা নিয়ে।
বড় রাস্তার পশ্চিম ধারে কেরোসিন টিন পাতের মরচে পড়া চালা আর পোকা ধরা ছিটেবেড়ার হেলে পড়া ঘর। তাকে আবার দুভাগে ভাগ করা। সামনের দিকে কেরোসিন কাঠের টেবিল, আর উনুন। উনুনে চায়ের কেটলি। টেবিলে কাপ আর গেলাস। বাইরে খান দুয়েক বেঞ্চি পাতা। সেখানে বসে চা খাচ্ছে কয়েকজন মিস্তিরি শ্রেণীর লোক।
টেবিলের উপরে একটা সাবেক কালের দেওয়ালবাতি। মসজিদের লম্বা গম্বুজের মতো তার চিমনিটা কালি পড়ে পড়ে কালো হয়ে উঠেছে। ঘরে কেউ নেই। পার্টিসনের আড়ালে কেউ আছে কি না কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
ঘরের বাইরে দরজার পাশে একটা ব্ল্যাকবোর্ডে মস্ত বড় করে খড়ি দিয়ে লেখা রয়েছে চা। ছোট অক্ষরে, এক কাপ দুই পয়সা। দু পয়সা আবার দুটো গোল বৃত্ত এঁকে বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। রসুন পেঁয়াজের একটা হালকা গন্ধ বোঝা যাচ্ছে, ওই জাতীয় খাবারও এখানে কিছু বিক্রি হয়। তার আর একটা নিদর্শন, দোকানটার সামনে অনেকগুলো শালপাতা ছড়িয়ে রয়েছে। সেগুলো চেটে চেটে বেড়াচ্ছে একটা কুকুর।
রাস্তাটা খোয়া বাঁধানো, কাঁকর বিছানো। দক্ষিণদিক থেকে সোজা এসে হঠাৎ বাঁক নিয়ে উত্তরে চলে গিয়েছে। একচখো ভূতের মতো দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে কেরোসিন ল্যাম্প-পোস্ট। রাত্রি প্রায় আটটা, কিন্তু রাস্তাটা এর মধ্যেই খালি হয়ে এসেছে।
একটা মস্ত ছায়া ফেলে এসে দাঁড়ালেন সেখানে হালদার। বেঞ্চির লোকগুলোকে একবার দেখলেন ঘোলাটে চোখে। দুলে উঠলেন বারকয়েক। লোকগুলো এক মুহূর্ত অবাক হয়ে পরস্পর মুখ চাওয়াচায়ি করে হাসল। মাদেব হালদার মদ খেয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন এটাই তাদের হাসির কারণ।
হালদার ঘরে ঢুকে টেবিলের সামনে লোহার চেয়ারটায় বসে কোটের ঝোলা পকেট থেকে বার করলেন বাইশ আউন্স বোতলের প্রায় খালি করা স্কচ্ হুইস্কির বোতলটা। তারপর এ তা হাঁটকে বের করলেন ঘুগনি ও চপের ভাণ্ড। বোতল থেকে গেলাসে মদ ঢেলে কোনওদিকে দৃকপাত না করে সেই খাবার খেতে আরম্ভ করলেন।
সেই মুহূর্তে আবিভাব ভজনের। হালদার মশায়ের ছোট ছেলে। ছেলে নয়, যেন একটা জীবন্ত শাণিত ইস্পাতের তলোয়ার। গায়ের রংটা উৎকট ফরসা, ধবধবে। ঠোঁট দুটো রক্তাক্ত। খাড়া নাকটা তার উন্নাসিক চরিত্রের সাক্ষীর মতন, চোখ দুটো টানা টানা কিন্তু কটা মণি দুটোতে একটা অদ্ভুত ধকধকানি। একহারা লম্বা, সটান একটু বেশি। সামনে পেছনে কোথাও সামান্য ঝোঁকতা নেই। আর মাজা ঘষা ফিটফাটভাব তার সর্বাঙ্গে বিরাজ করেছে। দুএক বছর হল বি.এ. পাশ করে বেরিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম যুগের ছেলে। এ যুগে এতখানি লেখাপড়া শিখে সরকারি দপ্তরে একটা সদ্গতি হতে পারত তার। কিন্তু সেদিক থেকে তার নিজের প্রচণ্ড আপত্তি। তা ছাড়া, তাদের পরিবারে একটা সরকার-বিরোধী ছাপ একা নারায়ণ হালদারের জন্যই যেন গভীর ভাবে এঁকে রেখে গিয়েছে! সেসবে ভজন বিচলিত নয়। এখানকার কোনও চটকল বা অন্য কোনও বেসরকারি কারবারে তার চাকরি হতে পারত। কিন্তু জবাব তার একটাই ছিল, ও-সব ছাঁচড়া কাজের জন্য ভজন জন্মায়নি, কিন্তু টাকাও নেই যে, কোনও একটা কারবার ফেঁদে বসবে। অতএব এই চায়ের দোকান।
ঘরে ঢুকে সামনেই বাবার কীর্তি দেখে ভজুর মুখটা যেন আগুনের মতো দপ দপ করে জ্বলে উঠল। সে কিছু একটা বলবার উদ্যোগ করতেই হালদার প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভজুর উপর। তার হাত ধরে বলে উঠলেন, রাগ করিসনে ভজু। আমার ছেলে তুই তোর চাটের দোকান। আর কোথায় যাব আমি?
তাতে ভজুর রাগের চেয়ে লজ্জার মাত্রা বেড়ে গেল। বাবার গলা শুনে থমকে গেল সে। ঠিক বুঝতে পারল না, মমলাবাজ উদ্ধত লোকটা সত্যি আজ এতখানি নেমে এসেছে কি না। জীবনে এই প্রথম যে তার ছেলের কাছে এসে কোথাও না কোথাও যেতে পারার অক্ষমাত স্বীকার করছে, সে দম্ভী, বক্রভাষী নেকো হালদার।
আমি হয়তো মরে যাব। হালদারের মোটা গলায় কথাটা শোনাল যেন কান্নার মতো। অন্তত ভজুর তাই মনে হল। তিনি জড়ানো গলায় টেনে টেনে বলে চললেন, তবু তোদের আমি মানুষ করেছি, তোদের বাবা আমি। যতদিন বেঁচে থাকব
ভজুর একটু মায়া হল। সে বলল, তুমি বাড়ি যাও। তোমাকে কিছু বলতে হবে না।
হবে। হালদার দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন সোজা হয়ে। বললেন, শুনেছি নারান বে করবে না। কিন্তু তোকে করতে হবে, তোকে সংসার করতে হবে। আমি তোর বড়লোক শ্বশুর করে দেব, তুই কারবার করবি। বল, অমত করবিনে?
ভজু অবাক হয়ে তার বাবার মুখের দিকে তাকাল। হালদারের রক্তবর্ণ চোখে আশা নিরাশার দোলা। সারা মুখটা যেন তার মত্ততায় আরও বড় হয়ে উঠেছে। গোঁফের পাশে সকলের হৃদয়বিদ্ধকারী রেখাটা যে ক্রন্দনোম্মুখ হৃদয়ের ঢেউমাত্র। উকণ্ঠা, দীনতা, করুণা ভরা মুখ।
ঘটনাটা শুধু অভাবিত এবং চমকপ্রদই নয়, ভজুর বুকের কোনখানটায় যেন বারে বারে মোচড় দিয়ে উঠল। বাবার প্রতি যে তার মমতা খানিকটা আছে, তা এমন করে আর কোনওদিন সে বুঝতে পারেনি। বলল,সেসব কথা তো পরেও হতে পারবে। মামলা মোকদ্দমার ব্যাপারে তোমার মনটা হয়তো খারাপ আছে। তুমি এখন ঘরে যাও।
হালদার আর কোনও কথা না বলে ভজুর হাত ছেড়ে দিলেন। গোড়াহীন গাছের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আরও কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু না পারার যন্ত্রণাটা যেন চেপে বসেছে তার মুখে। তারপরে হঠাৎ বললেন, তোর গায়ের রংটা তোর মায়ের মত, কিন্তু চেহারাটা আমার মতোই। তুই একরোখা। তুই বুঝবি ঠিক আমার কথা। জানিস-
বলে আবার তিনি ভজুর কাছে এলেন, এ সংসারে কাউকে বিশ্বেস করবিনে, তার জায়গা এটা নয়। দেখ, আমাদের এ গাঁয়ে কোন্ লোকটাকে তুই ভাল বলবি? কালো চাটুজ্যের দিদি কালোকে খুন করতে চেয়েছিল লুকিয়ে। পয়সার জন্যে। আমাদের নারানই তোকে কোনওদিন ফাঁকি দিতে চাইবে।
বলে গলার স্বর নামিয়ে বললেন ফিসফিস করে, খুব হুঁশিয়ার।” তারপর টলায়মান পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ভজু সেই পথের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ভাবল, কীসের ফাঁকি আর কেনই বা ফাঁকি। আমার কী আছে যে আমি হুঁশিয়ার হব। আবার তা-ও হুঁশিয়ার হতে হবে কি না দাদার জন্য! মনটা তার লজ্জায় সংকোচে ছিঃ ছিঃ করে চুপসে গিয়ে চকিতে আবার রাগে স্ফীত হয়ে উঠল। ঘৃণা জাগল বাবার প্রতি। লোকটা জীবনে কোনওদিন কাউকে বিশ্বাস করেননি। শুধু তাই নয়, চুপিসারে কেউ-ই বলতে ছাড়ে না যে, তার বাবা জমিদারের নায়েবগিরি করে এ বিশ্বসংসারে অনেককে অনাথ করেছেন। কিন্তু সে বঞ্চনার মুঠিভরা পয়সা তিনি কোনওদিন রাখতে পারেননি। এক হাতে এনেছেন, অন্য হাতে তা বেরিয়ে গিয়েছে। ভজনের বিশ্বাস, দশজনের অভিশাপই তার কারণ। তবে একথাও সত্যি, চব্বিশ পরগনার উত্তর সীমান্তে তাদের এ ব্রাহ্মণ অধুষিত অঞ্চলে পাড়ায় ঘরে নীচতা ও হীনতা যেন সীমাহীন। অর্থ ও যৌবনের লালসার নোংরা দাগ অনেক ঘরে গুপ্ত ছাপ রেখে গিয়েছে। হাজার বছর পূর্বে এরা স্বৈরতন্ত্রের রাজা ও পুরোহিত, সেকথা বাহ্যত ভুলে গেলেও নীল রক্তধারা তার কাজ এখনও স্তিমিত ধারায় তলে তলে চালিয়ে যাচ্ছে। তবু এখানেই যত সমাজ সামাজিকতার বন্ধন, এখানেই যত হাঁকাহাঁকি ও গলাবাজি।…এ সত্যের মতো আর একটা সত্য, সুযোগের সদ্ব্যবহারও এরাই করেছে। আধুনিক শিক্ষাকে গ্রহণ করেছে এরাই সকলের আগে। এ যুগে এদের বংশধরেরাই আবার প্রতিবাদ করেছে অন্ধকারে গোপন পাপের। অবশ্য এ সমাজের পরিত্যক্ত স্তরগুলোতেও এ সময়ে পম্পিয়াই নগরীর পশ্চাদপট সর্বনেশে বিসুবিয়াসের মতো তলে তলে গোমরাচ্ছে।
ভজনের জন্ম এ সমাজে। এখানে ঘরে বাইরে তার শ্রদ্ধা নেই কোথাও, বলা চলে একটা চির-অবিশ্বাসী। ওমর খৈয়ামের সেই উক্তিটা ভজনের তাই খুব প্রিয়, সে কোন্ এক মরুর বুকে, অবিশ্বাসী থাকত সুখে। এই নিরালার সুখই ভজনের কাম্য। তাই তার সমস্ত কিছুতেই এখানেঅবজ্ঞা আর অশ্রদ্ধা। তাই ব্যক্তি হিসাবে একমাত্র নারায়ণের প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা, বুঝি নিজের প্রাণটাও তুচ্ছ কিন্তু নারায়ণের পথকে সে গ্রহণ করেনি। ওটা একটা বৃথা কাজ, পাথরের দেওয়ালে অকারণ মাথা ঠোকা। যে কারণে সে সাধু হবে না সে কারণেই সে হবে না বিপ্লবী। তাঁদের জন্য তোলা রইল নমস্কার।
এ সমাজের বুকে তাই সে ব্যতিক্রম নয়, একটা বিভ্রাট। যত অশ্রদ্ধা, তত তার দম্ভ। বিনয় হল ধাষ্টামো। ঘরে বাইরের দুর্বুদ্ধিতা তাকে যেন নিয়ত পোড়াচ্ছে। চরিত্রে যে তার প্রচণ্ড বেগ, তাতে সেই পোড়ানো যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও ঠাঁই নেই তার, নেই জীবনের নিরাপত্তা। তবে কাকে মানবে সে। তাই বুঝি আর সবকিছু ছেড়ে এ চায়ের দোকান। তাই সে ভজু নয়, লোকে বলে ভজুলাট।
তবু জীবনাকাশে ছিল একটি সূর্য, সে নারায়ণ। অনেক নক্ষত্র। সে তাঁর সঙ্গীরা। ওরা আর যা-ই হোক এ সমাজের নোংরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নয়। জীবনটাকে পুতুপুতু করে রাখার জন্য মিথ্যা মায়াজাল ওরা রাখেনি ছড়িয়ে।
কিন্তু এ সমস্ত চিন্তা ছাড়িয়ে ভজুর মনে গুন গুন করে উঠল নহবতের অনুরাগ ধ্বনি। আচমকাই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি মুখ। কিন্তু কী বিচিত্র, ক্ষণে ক্ষণে সে মুখ কত রূপে ভেসে উঠতে লাগল। এক দেহে সহস্র মুখ, একটা ছেড়ে আর একটা যেন হঠাৎ অস্থির করে তুলল তাকে। বাবার একটা কথায় মনের সুরটা বদলে দিয়ে গেল তার। বারবার মন বলল, সে কে, সে কে। বোঝা গেল, এমন চরিত্রের ভজুর মনটাও একটা খুব সাধারণ তারে বাঁধা রয়েছে, তাই বিয়ের কথায় মনের তালে এত উচ্ছ্বাস।
ভজু বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাল। সে কবিতা লেখে। বলা চলে লিখত। নিয়মিত পাঠাত ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকায়। কিন্তু ছাপানো অক্ষরের জগৎটা ধরা দেয়নি কোনদিন। সেজন্য তার বিক্ষোভের অন্ত ছিল না। এখন সে কবিতা বলে মুখে মুখে। আজ তার মনে গুনগুনিয়ে উঠল কবিতা।
কিন্তু বাধা পড়ল। বাইরের থেকে একটা গলা ভেসে এল, একটু চা দিয়ো গো বাবু।
ভজু দেখল কয়েকজন এসেছে। সে তাড়াতাড়ি চা তৈরি করতে আরম্ভ করে জিজ্ঞেস করল, কে, বাঙালি না কি রে? কজন আছিস?
লোকটার নাম বাঙালি। কাজ করে রেলওয়ে ইয়ার্ডে। ভজুর নিয়মিত খদ্দের। বলল, খান চারেক সাজো। আর ঘুগনি দিয়ো এক পসার করে।
ঘুগনি নেই। জবাব দিল ভজু। ছিল, তার বাবা সমস্তটাই প্রায় নষ্ট করে গিয়েছেন।
বাইরেও সেই আলোচনাই চলছিল। হালদার মশাইকে যারা দেখেছিল, তারাই বলাবলি করছিল, কিন্তু সন্তর্পণে। যেন ভজু শুনতে না পায়।
কেবল বাঙালির কেশোমোটা গলায় শোনা গল, কপালে নেইকো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী। খেটে খুটে এলুম, এটু ঠাউরের ঘুগনি খাব বলে। তা আর—
বলে সে চুপ করে গেল। বাঙালি না হলে এমন করে কথা বলা মুশকিল ছিল। কারণ ভজু যে শ্রেণীর গুণের কদর করত, সেরকম গুণের অধিকারী বটে বাঙালি। বাঙালি একরকমের উন্নাসিক। ছোট জাতের বড় চোপা। অর্থাৎ বাঙালি জাতের সীমায় নিজেকে বাঁধতে রাজি নয়। এ পাড়ার তিলক ঠাকুর একদিন কী কারণে রাগ করে তাকে বলেছিল, এ ছোট জাতের মানুষগুলোকে উঠতে বসতে খড়মপেটা করতে হয়। যেমনি বলা, তেমনি বাঙালি তিলক ঠাকুরকে পাঁজাকোলা করে তুলে প্রথমে ছাড়িয়ে নিয়েছিল তার পায়ের খড়ম। হয়তো আছাড় মারত। কিন্তু তা না করে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে বলেছিল, বলল বাউন ঠাকুর, এবার তোমার খড়ম তোমার পিঠে ভাঙলে কোন্ বেহ্মা এসে রক্ষে করবে।
বোধ করি তিলক ঠাকুরের বেহ্মার ক্ষমতা ছিল না সেকথার জবাব দেওয়া। ঘটনাটার সাক্ষী ছিল ভজু। সেইদিন থেকে বাঙালির সঙ্গে তার একরকম বন্ধুত্বই গড়ে উঠেছিল।
বাঙালি আবার বলল, ঠাকুর ছিটেফোঁটা পেসাদও কি নেই?
ভজু তাকিয়ে দেখল, ঘুগনি খানিক পড়ে আছে তখনও। বলল, ওই পেসাদের মতো একটুখানি পড়ে আছে। বেচা যাবে না। খাস তো এমনি খা।
বাঙালি বলল, বাঁচালে ঠাকুর। খিদেয় পেট য্যানো হেদিয়ে পড়েছে।
আর একজন বলে উউঠল, পসাটা আজ রইল গো বাবু।
এক মুহূর্তের জন্য জোড়া কুঁচকে উঠল ভজুর। বলল, হিসেবের বেলায় তো বলবি, এত খেলাম কবে? হিসেব করে খাস।
এমন সময় ঢং ঢং করে সামনের কারখানার পেটা ঘড়িতে নটা বাজল। চমকে উঠল ভজু। সবাইকে চা দিয়ে সে বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। এদিকে ওদিকে দেখল। শুন্য রাস্তা। ভেসে আসছে একটা রেল ইঞ্জিনের ঝকঝক শব্দ সেই থেকে থেকে হেইয়ো ধ্বনি। অন্ধকার। দমকা হাওয়া। গাছ গাছালির ফাঁকে পুবে দেখা যায় একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। আবছায়াতে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে যেন একটা কিম্ভুতাকৃতি মস্ত জানোয়ার।
দোকানের পরে এক ফালি জমি, তারপরেই ভজুদের বাড়ি। রেলিং দেওয়া বারান্দা। কে যেন বারান্দায় রয়েছে দাঁড়িয়ে, রেলিং-এ ভর দিয়ে। রাস্তার স্তিমিত আলোর এক কণা বারান্দার এক কোণে এসে পড়েছে। সে আলোয় লক্ষ করা যায় একখানি ফরসা হত, নিখুঁত চিবুকের একটি পাশ। বাদ বাকি সবটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
দাঁড়িয়ে আছেন বকুলমা। ভজুর বকুলমা। তার মায়ের বকুলফুল ছিলেন তিনি। ভজু নারায়ণের পালিকা মা। এ গাঁয়েরই বউ, অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে। ভজুর মায়ের সঙ্গে শুধু তো সই পাতানো নয়, দুজনের জন্য দুজনের প্রাণ দুটো যেন হাওয়া-দোলা পদ্মপাতায় দু ফোঁটা জল। এর জন্য ওর নিয়ত প্রাণ যায় যায়, গেল গেল। এ দুই রূপসীকে নিয়ে গায়ে কথার অন্ত ছিল না। সেকথা ভাল মন্দ দুই-ই। সুন্দরী বলেই বুঝি ছিল লোকের অত ফিসফিস গুনগুনানি।
একজন আজ স্বামীহারা, আর একজনের স্বামী ছেড়ে গিয়েছেন। বকুলমার ছেলেমেয়ে হয়নি। সইয়ের মরণের পর তার নাবালক অপোগণ্ডদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন বকুল মা। সেজন্য কথা। গাঁয়ে ঘরে, পথে ঘাটে কান পাতা দায়। কিন্তু হার মানবার পাত্রী ছিলেন না বকুলমা। লোকে তাকে মহাদেব হালদার নামের সঙ্গে যুক্ত করে কুৎসা রটিয়েছে। টাক, কিন্তু সইয়ের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠল তো তাঁরই হাতে। আজও সংসারের হেঁসেল থেকে শুরু করে সবই তাঁর হাতে। তাঁর উপরে, ভজুর দোকানের ঘুগনি চপ তিনিই তৈরি করে দেন। আর আছেই বা কে, কাকে নিয়ে বা তাঁর থাকা।
একদিন সহস্র লজ্জায় ওই সুন্দর মুখ মহাদেব হালদারের সামনে খুলতে পারতেন না। সইয়ের বর যে! তা ছাড়া ভয়ও ছিল। হালদার মামলাবাজ, উদ্ধত। তা ছাড়া অতবড় নাকটা যাঁর, তাঁর সঙ্গে মেয়েমানুষ কথা বলবে কী? সইকে বলতেন ঠাট্টা করে, অতবড় নাকটাকে তুই সামলাস কী করে? সইও ঠাট্টা করে জবাব দিতেন, সব পুরুষের ভোলা নাকই তো আমাদের কাছে ভোঁতা লো।
আজ আর নেই সে ঘোমটার লজ্জা, নেই ভয়। হালদার নিয়মিত ঘরে এসেছেন, খেয়েছেন, বকুলফুলকে দেখেছেন যেন সংসারেই আর কেউ। টেরও পাননি ভাল করে, কী হারিয়েছে এ সংসারের।
বকুল মায়ের সম্পর্ক শুধু ছেলেদের সঙ্গে।
ভজু দেখল, বকুলমা দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো ভাবছেন, কখন খেতে আসবে ছেলে দুটো। খাওয়া হলে তিনি আবার বাড়ি যাবেন।
কে যেন আসছে উত্তর দিক থেকে। পেছনে আর একজন। আর একজন আসছে দক্ষিণ থেকে, কারখানা পাঁচিলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে। সকলেই এসে উঠল ভজুর চায়ের দোকানে।
ভজু আবার দোকানে এসে ঢুকল। কৃপাল আর হীরেন, এসেছে। কৃপাল দত্ত আর হীরেন নিয়োগী। ভজুর বয়সী সকলে। আর এসেছে রথীন। সে সকলের চেয়ে বছর দুই তিনেকের ছোট। তার আজ অবধি ম্যাট্রিক পাশ করা আর হয়ে উঠল না। স্বদেশী নিয়ে মাতামাতি চলেছে তার গত দুতিন বছর ধরে। সেইজন্য তাকে সবসময় বাড়ি থেকে লুকিয়ে বেরুতে হয়। কারও সঙ্গে তার মেশামেশি সম্পূর্ণ বন্ধ। বিশেষ ভজুর চায়ের দোকান তো তার অভিভাবকেরা নিষিদ্ধ এলাকা বলে একটা লাইনে টেনে দিয়েছেন এবং তারপরেও যখন তাকে এখানে দেখা গিয়েছে, তখন বাড়িতে বেশ ভালরকম উত্তম নারায়ণের ব্যবস্থা হয়েছে। সেদিক থেকে কৃপাল হীরেন, এরা এখন অ্যাডাল্ট। আধপোয়া নস্য ভরা কৌটো আর ন্যাকড়া পকেটে পুরে এরা সব সময়েই প্রায় বাইরে ঘুরে বেড়ায়। কলেজের ক্লাশের দুর্ভেদ্য বেড়া থেকে ওদের সরস্বতী ভারতমাতার দুর্জয় মূর্তি ধরে বার করে নিয়ে এসেছে। গত বছর ওরা নারায়ণের সঙ্গে জেল খেটেছে। এরা সকলেই নারায়ণের বন্ধু ও শিষ্যস্থানীয়। তা ছাড়া ভজুর যাকে বলে রেগুলার খদ্দের। তবে ভজুর বক্তব্য অনুযায়ী, হিসেব না জানা লোকের চেয়েও এদের হিসেবের গণ্ডগোল অনেক বেশি, ভজু বলে, শুরুতেই গণ্ডগোল, ভবিষ্যতে যে কানা হয়ে যাবি তোরা।
কৃপাল তার নাকের ছোট ছোট ফুটো দিয়ে অবিশ্বাস্য রকমের একদলা নস্য পুরে দিয়ে বলল, কই হে ভজু, একটু দাও। চা না হলে অর জছে লা।
নস্য নিলে কৃপাল ন, ম ইত্যাদি শব্দগুলো কিছুতেই উচ্চারণ করতে পারে না।
ভজু ভাবছিল তার দাদার কথা। এতক্ষণে তো দাদার এসে পৌঁছুনো উচিত ছিল। সে চা তৈরি করতে গেল।
রথীন চঞ্চল, অস্থির। শুধু বয়স নয়, ওটা তার স্বভাব। চোখ দুটো যেন কীসের উন্মাদনায় প্রতি মুহূর্তে জ্বলছে। কৃপাল আর হীরেন যেন অনেকখানি নিশ্চিন্ত। কিছুটা নির্বিকার, শান্ত। তাদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে যেটা ফুটে উঠেছে সেটা একটা স্বভাবসুলভ সদার পড়োভাব। এ অঞ্চলের জনসাধারণের শ্রদ্ধামাখা বিস্মিত চোখে নিজেদের তারা নিয়ত দেখে দেখে এমন একটা পর্যায়ে পৌছেছে, যেখানে তাদের হৃদয় বারবার স্ফীত হয়ে ওঠে, উন্নত মাথাটা আরও যেন উন্নত হয়ে ওঠে। সেজন্য একটা সঙ্কোচ ছিল, বোধ করি কৃতজ্ঞতা বোধও ছিল একটা। সেটা সচেতন মনের কি না, বোঝা যায় না। কিন্তু তারা অনেক কিছু করবে, এমনি একটা আকাঙ্ক্ষা তাদের হৃদয়ে যেন ঠাসা রয়েছে।
বাঙালি চা খেয়ে বিড়ি ধরিয়ে বলল, নেও বাবু, এটু দেশের কথা টথা শোনাও। তা পরে বাড়ি যাই।
এমন ভাবে কথাটা বাঙালি বলল যেন দেশি প্রথাতে কেউ রামায়ণ মহাভারত শোনবার জন্য তৈরি হয়ে বসেছে। হীরের নিয়োগী কিছুক্ষণ আগে থেকেই বাঙালির উপর খানিকটা রুষ্ট হয়ে উঠেছিল। বাঙালি যে মদ খেয়ে এসেছে, তা সে আগেই টের পেয়েছে। সে বলল, দেখো বাঙালি, দেশের কথা যদি শুনতে হয়, তবে তোমাকে পবিত্র হয়ে আসতে হবে। স্বরাজ তো তোমার আমার হাতে। শোনননি সেই গল্প, শিকার করতে গিয়ে রাজা কাপালিকদের পাল্লায় পড়ে বলি হওয়ার জন্য যখন প্রাণের ভয়ে মুচ্ছো গেছেন, তখন দেখা গেল রাজার একটা আঙুল নেই। অঙ্গহীনকে দিয়ে তো আর দেবতার পুজো হয় না। তেমনি আমাদের নিষ্কলঙ্ক চরিত্র করতে হবে। গান্ধীজি তাদেরই পথ চেয়ে আছেন। আমাদের অঙ্গ আমাদের চরিত্র, তাতে খুঁত থাকলে আর ভারতমাতার পুজো হবে না।
এ পর্যন্ত বলে হীরেন থামল। অন্ধকারে চৈত্র রাত যেন মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কৃপাল চমৎকৃত, রথীনও প্রায় তাই। বাঙালির সঙ্গীরা নির্বোধের মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইল হীরেনের দিকে। ভজু একটু অবাকই হয়েছে হীরেনের বক্তৃতায়।
বাঙালি বোকাটে মুখে বলল, চরিত্তি টরিত্তি কী বলছ বুঝলুমনি বাবু। মুখ মানুষের অনেক দোষ। একটু বুঝেসুঝে বলল।
হীরেন তীব্র চাপা গলায় বলে উঠল, তুমি মদ খেয়ে এসেছ বাঙালি, তুমি পাপ করেছ। মদ খাওয়া তোমাকে ছাড়তে হবে।
বাঙালি আর তার সঙ্গীরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল এমনভাবে যেন, হঠাৎ এ আবার কোন দেশি কথা! বাঙালি বলল, এই মেরেছে। শেষটায় সব ছেড়ে ছুড়ে তোমরা আমাদের পেছুতে লাগলে?
অমনি কৃপাল কিছু একটা বলবার উদ্যোগ করতেই হীরেন বলে উঠল, তোমার লজ্জা করে না বাঙালি একথা বলতে? ভেবেছ, মদ খেয়ে বদমাইশি করে এ দেশ স্বাধীন করা যাবে। এই অনাচারের জন্যেই আজ আমরা পরাধীন–
বদমাশি কেন বলছ গো বাবু, বাঙালি বাধা দিয়ে বলে উঠল। আমরা কি বদমাইশ? তত পসাও নেই, সময়ও নেই। বাঙালির মদ খাওয়া অনাচার, তার চে কত বড় অনাচার যে সংসারে নিত্যি ঘটছে! আর আমাদের শালা পেটে নেই দানা, মাগের ঝ্যাটা খেয়ে দু ফোঁটা মদ, তাও বলছ ছেড়ে দিতে? তালে আর হলনি বাপু।
বলে বাঙালি ও তার সঙ্গীরা উঠে দাঁড়াল। ঘৃণা ও করুণায় ভরে উঠল হীরেনের মন। সে বাঙালিদের দিকে তাকিয়ে দেখলল, আবছা অন্ধকারে একদল নিশাচর প্রেত যেন। যারা স্বাধীনতার মর্ম বোঝে না, ভাল বোঝে না, জীবনকে চেনে না, এমন কী ধর্ম জানে না, এরা সেই দেশবাসী। বুঝল, এদের দিয়ে কোনওদিন কিছু হবে না, এদের পৈশাচিক প্রবৃত্তির ভয়েই গান্ধীজি বারবার পেছিয়ে আসছেন। এরা নিজেরা কোনদিন কিছু করবে না, আমাদের সংযত আন্দোলনেরও অন্তরায়। হ্যাঁ, এই বিষকে আমাদেরই গ্রাস করতে হবে, এই জঞ্জালকে সরিয়ে আমাদেরই প্রতিষ্ঠা করতে হবে স্বরাজ। এমন কী, আর কথা বলতে পর্যন্ত তার দ্বিধা হল বাঙালির সঙ্গে, নিজের অপমানের ভয়ে।
এত কথা ভাববার অবকাশ ছিল না বাঙালির। সে পকেট থেকে পয়সা বের করে গুনে দেখে ভজুর হাতে দিল। চলে যাবার মুখে হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, চললুম গো লেইগি বাবু, মনে কিছু করোনি। আমাদের কথা মনে নিয়োনি।
বলে তারা সকলে চলে গেল।
কৃপাল বলল, নারায়ণদের সঙ্গে বসে এ রোববারেই মদের দোকানে পিকিটিং-এর প্রস্তাবটা নিয়ে ফেলো হীরেন।
হীরেন যেন আশার আলো দেখতে পেল। বলল, ঠিক বলেছ। রথীন, কাল থেকেই তুমি স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করো।
তাদের এই কথার মাঝেই এলেন নারায়ণ হালদার। ভজুর দাদা। প্রায় ভজুর মতোই তাঁকে দেখতে, তবে ভজুর মতো তীব্রতা তাঁর নেই। যে অস্থিরবেগে ভজু চঞ্চল, তাকে যেন তিনি গ্রাস করে আত্মস্থ হয়েছেন। ধীর ও স্থির। চোখের মণি তাঁর কটা নয়, কালো চোখে স্নিগ্ধতা। হৃদয়ের একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস যেন চাপা বেদনার মতো লুকিয়ে আছে তার চোখে। তবুও সে চোখে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা, দৃঢ়তা এবং বিক্ষুব্ধতা। ঠোঁটের কোণে একটা বিষণ্ণ হাসির আভাস সব সময় লেগেই আছে।
তিনি একলা আসেননি, সঙ্গে আর একটি লোক ছিল। লোকটার পরনে সাহেবি পোশাক, মাথার টুপিটা কপাল অবধি টেনে নেওয়া। তার তলায় দুটো চোখে আধো অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে, তাতে একটা মাঝারি সুটকেশ। লোকটি এক লহমায় দেখে নিল সবাইকে। নারায়ণ বললেন, চাপা গলায়, ভেতরে চলে যান। ভজুকে বললেন একটু উঁচু গলায়, কই রে ভজু, আমাদের একটু চা টা দে।
সবাই তাকিয়েছিল সেই আগন্তুকের দিকে। এই তা হলে সেই লোক। যেন চকিতে এখানকার আবহাওয়া থমথমিয়ে উঠল, একটা বিভীষিকার ছায়া ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। সকলেই সচকিত হয়ে উঠল, যেন মনে পড়ে গেল, তাদের সকলের আশেপাশে ছায়ার মতো গুপ্ত শত্রুরা ওত পেতে আছে। সাবধান!
এ সময়টাতে এমনিতেই সারা দেশময় সরকারের দমন নীতির তাণ্ডব চলছে। স্বরাজ স্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দগুলো যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। ওই কথাগুলোই যেন একটা মূর্তিমান বিদ্রোহের মতো ব্রিটিশ সিংহকে ভীত ও সংক্ষিপ্ত করে তুলছে। তার উপরে এই ঘটনা তো আরও সাংঘাতিক।
আগন্তুক ঘরের ভিতরে যেতে ভজু তাকে পার্টিশনের আড়ালে ভাঙা চৌকিটা দেখিয়ে দিল বসবার জন্য। তারপর চা তৈরি করতে লেগে গেল এমনভাবে, যেন কিছুই হয়নি।
নীরব উত্তেজনায় রথীনের চোখ মুখ জ্বলে উঠেছে। কৃপাল হীরেনের উত্তেজনা ছিল কিন্তু তাদের নীরবতা যেন অস্বস্তিক্র।
নারায়ণ বললেন, রথীন, স্টেশনের পাশ দিয়ে এক চক্কর ঘুরে এসো! সন্দেহজনক কিছু মনে হলে, এসে সংবাদ দেবে।
বোঝা গেল, এ নির্দেশ হতাশ করেছে রথীনকে। সে এখান থেকে যেতে চায়নি। এই মুহূর্তে যে রহস্যের ঢাকনা এখানে ভোলা হবে, তা সে দেখতে পাবে না। কিন্তু নারায়ণদার নির্দেশ। এ বিশ্বকে অবজ্ঞা করা যায়, কিন্তু ওঁর কাছে তো কোনও কথা চলে না।
বাধ্য সৈনিকের মতো উঠে একবার সেই পার্টিশনের দিকে তাকিয়ে সে বেরিয়ে গেল।
বাইরে অন্ধকার। নিস্তব্ধ। কিন্তু একটা অশরীরী জীবন্ত সত্তা যেন ভর করেছে সর্বত্র। কেবল বকুলমা দাঁড়িয়ে আছেন তেমনি। যেন প্রস্তরমূর্তি, নিশ্চল।
নারায়ণ সেদিকে এগিয়ে গেল নিঃশব্দে। যেন আপন মনেই বললেন, চাপা গলায়, এসে পড়েছে।
বকুল মায়ের শরীরটা একটুও নড়ল না। কেবল উৎকণ্ঠিত মিহি গেলা ভেসে এল, একটু সাবধানে থাকিস বাবা।
তারপর নারায়ণ ফিরে হীরেন ও কৃপালকে নিয়ে ঢুকলেন পার্টিশনের আড়ালে।
ভজু যেন এক বিচিত্র বিপজ্জনক খেলার দর্শক। উত্তেজনার ঢেউ লেগেছে তারও বুকে। সে যে অনর্গল চা তৈরি করেই চলেছে তা যে কে খাবে কেউ জানে না। হয়তো ফেলে দেবে। কিন্তু একটা ঘোর লেগেছে তার। টেবিলের উপর বাতিটা একটু তেরছা করে দিতেই পার্টিশনের আড়ালে ছুটে গেল একটা রেশ। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, আমি একটা গান গাইতে থাকব দাদা?
অন্য সময় হলে নারায়ণ হাসতেন। এখন বললেন, তাতে শ্রোতার দল জুটতে পারে তো।
তা বটে। ভজু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সে কুঁচকে অন্ধকারে তাকিয়ে রইল। বোধ হয়, চিন্তায় পড়ল, এ সময়ে কী করা যায়।
আগন্তুক এবার তার সুটকেশের ঢাকনা খুলতেই একটা চাপা আফিমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরটার মধ্যে। বোঝা গেল বেআইনি আফিম রয়েছে তার মধ্যে। সুটকেশের উপরের প্যাকেটটা সরিয়ে আর একটা বের করে সে দিল নারায়ণের হাতে।
নারায়ণ সেই প্যাকেটটা খুলতে তার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল বিষধর কাল কেউটের মতো চকচকে দুটো রিভলবার। ছঘরা রিভলবার। একবার ঘোড়া টিপলে আর একটা গুলি মুখের কাছে এসে তৈরি হয়ে থাকে। চকিতে নারায়ণের শান্ত চোখজোড়া যেন দুখণ্ড অঙ্গারের মতো জ্বলে উঠল। ঠোঁটের বিষণ্ণ হাসি বেঁকে উঠল নিষ্ঠুর হাসিতে। বুঝি শত্রুকে তিনি দেখতে পেয়েছেন।
কিন্তু কৃপাল বা হীরেন কেমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। বাংলায় যাকে বলে ভড়কানো। এ ব্যাপারটাতে তাদের একটা ভয় ও অস্বস্তির ভাব ঘিরে ধরেছে। জেল থেকে আসার পর অবশ্য তারা একটা নতুন আন্দোলনের কথা চিন্তা করছিল। ভেবেছিল নারায়ণই তাদের পথ দেখাবেন। কিন্তু নারায়ণ যে এ ভয়াবহ পথে মোড় নেবেন, এটা তারা ভাবতেই পারেনি। এই প্রথম হীরেন ও কৃপাল চোখের এত সামনে রিভলভার দেখছে। কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক জীবনে এ পথে আসার কথা তারা কোনওদিন চিন্তাও করেনি।
আগন্তুক আর একটি প্যাকেট নারায়ণের হাতে দিল। সেটাতে ছিল কার্তুজ। তারপর দিল একখানা চিঠি। চিঠিটা সাদা কাগজের। আগুনের তাপে ধরলে কথাগুলি আপনিই ফুটে উঠবে।
আগন্তুক এবার তার টুপি খুলল। দেখা গেল লোকটার চেহারা মোটেই এ দেশিয় নয়। চ্যাপ্টা নাক, ছোট ছোট চোখ। পলকহীন সাপের মতো চোখ। ভাঙা বাংলায় বলল, আমি কলকাতা যাব। মাল খালাস করবে।
লোকটা আফিমের স্মাগলার। তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই একমাত্র পয়সা রোজগার করা ছাড়া। সন্ত্রাসবাদীরা খুব সহজেই এদের পাল্লায় এসে পড়েছে অন্ত্রের জন্য। কারণ, পৃথিবীর সমস্ত সীমান্তে এদের আনাগোনা। সীমান্ত থেকে সীমান্তে টপকে গিয়েই এদের কাজ চালাতে হয়। অনবরত খুন জখমের রক্তাক্ত বীভৎস পথে এরা কারবার করে ফেরে। আফিম বহনের মতোই অস্ত্রটাও বহন করে, লাভের অংশটা এতেও কিছু কম হয় না।
ভজু তাড়াতাড়ি আগন্তুককে এক গেলাস চা এগিয়ে দিল। আগন্তুক ইংরাজিতে বলল, ধন্যবাদ।
নারায়ণ বললেন, আপনি আবার কবে আসবেন?
সে জবাব দিল তার অদ্ভুত চাপা ও মোটা গলায়, অপটের টিরি মন্টস।
অর্থাৎ তিনমাস বাদে।
এই সময়ে রথীন ফিরে এসে জানাল, কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই।
আগন্তুক চা খেতে খেতে হঠাৎ জানাল, একটা আমানি পিস্টল, পিপটেন রূপি বেরি চিপ। অপটের টিরি মন্ট।
অর্থাৎ তিনমাস বাদে সে একটা আমানি পিস্তল মাত্র পনেরো টাকায় দিয়ে যাবে। তারপর বলল, বোট রেডি?
নারায়ণ বললেন ইংরাজিতে, হ্যাঁ। যে পথে এসেছেন, সেই পথেই যাবেন এখন জোয়ার লেগেছে, আপনি দু ঘণ্টায় কলকাতা পৌঁছতে পারবেন।
লোকটা হাসল। তাতে নাক কুঁচকে চোখ জোড়া ঢেকে গেল। টুপি মাথায় দিয়ে বেরুবার মুখে ভজু হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, সাহেব, তোমার এ কাজে আমাকে নিয়ে নাও।
সাহেব আবার হাসল। নাক চোখ কিছুই নেই, খালি এক পাটি দাঁতের একটা অদ্ভুত বুনো হাসি। তারপর যেমন এসেছিল, তেমনি বেরিয়ে গেল। মুহূর্তে কোথায় হারিয়ে গেল দমকা হওয়ার মতো।
ভজু বলল, এবার তোমরা কাটো দাদা, দোকান বন্ধ করব। নারায়ণ বললেন, আর একটু ভাই, আমাদের কয়েকটা কথা আছে।
এটা মাত্র শুধু ভজুর তাড়া দেওয়া। সে এ দলের কেউ নয়, আপত্তি করলে নারায়ণকে হয়তো সত্যি অন্য কোথাও আস্তানা গাড়তে হবে। কিন্তু ভজুর একটা অদ্ভুত কৌতূহলও ছিল সব কথা জানার ও শোনার। তা ছাড়া, এই সব বিপজ্জনক কাজে দাদাকে সে আর কোথায় যেতে বলবে?
নারায়ণের সারা মুখে তখনও উত্তেজনার ছাপ। জীবনে তার নতুন সুর্যোদয় ঘটেছে, এক নতুন জগতে আজ তার প্রবেশ। বললেন, তোমাদের তিনজনকেই আজ ডেকেছি, তার কারণ এ ব্যাপারে সবাইকে এখুনি টেনে আনা ঠিক হবে না। তার আগে দাঁড়াও, চিঠিটা পড়ি। ভজু বাতিটা দে, একটু বাইরে লক্ষ রাখিস।
তারপর আলোর গায়ে চিঠিটা ধরতেই, ছোট ছোট পাঁশুটে বর্ণের কতগুলো অক্ষর যেন কথা বলে উঠল।
বীর বিপ্লবী!
আপনাকে দুইটি রিভলভার পাঠাইলাম, সঙ্গে একশত কার্তুজ। ভবিষ্যতে আরও পাঠাইব, অস্ত্র সংগ্রহ চলিতেছে। ইতিপূর্বে আপনাকে দলের সব কথাই জানানো হইয়াছে। যাহা পাঠাইলাম, তাহা দিয়া বিপ্লবীদের অস্ত্রবিদ্যায় শিক্ষিত করিবেন। তৎপূর্বে অবশ্যই বিপ্লবী হইতে ইচ্ছুকদের দীক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। নিয়মাবলী আপনি জানেন। মনে রাখিবেন, আমাদের সর্বাপেক্ষা বড় ও একমাত্র ব্রত হইল, এ দেশের প্রতিটি ইংরাজের রক্তে এ-দেশের মাটি আমরা লাল করিয়া দিব। এ দেশে যত দিন পর্যন্ত একটি ইংরাজও জীবিত থাকিবে, ততদিন আমাদের পিতা মাতা ভাই ভগ্নী গৃহ কিছুই নাই। আমরা মরিব, তবু দেশ শত্রুমুক্ত করিব। ভবিষ্যৎ নির্দেশের জন্য প্রতীক্ষা করুন।
বন্দেমাতরম্। ইতি
দলের কেন্দ্রীয় কমিটি।
চিঠি পড়া শেষ হল কিন্তু নারায়ণের গভীর গলার রেশ তখনও প্রতিধ্বনির মতো গুনগুন করছে। রথীন একটা লেলিহান আগুনের শিখার মতো জ্বলছে। হীরেনও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে।
সে উদ্দীপনা ফার্নেসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন তাত লাগে তেমনি। কৃপাল বিমুঢ় চোখে তাকিয়ে আছে চিঠির দিকে।
ভজু এক কেটলি তৈরি ঠাণ্ডা চা হড়হড় করে নর্দমায় ফেলে দিয়ে বলল, লোকসানের বরাত। পয়সাটা তোমরা দিয়ে দিয়ো দাদা।
কিন্তু সে কথায় নারায়ণ কান দিলেন না। বললেন, তোমাদের সকলেরই দীক্ষা প্রায় শেষ। কিন্তু একটা বাকি আছে। ভয় কাটাতে হবে তোমাদের।
সকলেই নারায়ণের দিকে ফিরে তাকাল। নারায়ণ হীরেন ও কৃপালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে একবার হাসলেন। বুঝলেন, ওরা একটু ভয় পেয়েছে। ওদের সাহস জোগাবার জন্যই তিনি রথীনকে ডাকলেন, রথী।
রথীন সামনে এসে দাঁড়াল। বলিষ্ঠ মূর্তি, নিষ্পলক দৃঢ় চাউনি, টেপা ঠোঁট। সামান্য গোঁফ দেখা দিয়েছে তার ঠোঁটের উপরে
নারায়ণ বললেন, তোমাকে আজ রাত্রি বারোটার পর একলা শ্মশানে যেতে হবে। যে চিতায় হরিবুড়োকে পোড়ানো হয়েছিল, তার পাশে তোমার নামের প্রথম অক্ষর লিখে রেখে আসবে। পারবে?
রথীনের টেপা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে খালি বেরিয়ে এল, পারব দাদা।
বলে সে নারায়ণকে প্রণাম করল। নারায়ণ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দুটি হৃদয়ের ধুক ধুক শব্দ যেন তাদের গোপন কথা বিনিময় করল। নারায়ণের বিশাল কালো চোখ জোড়া কীসের আলোয় চকচক করে উঠল। মনে মনে কাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমারই হাতে রথীকে ছেড়ে দিলুম, ওকে তুমি রক্ষা করো।
ভজু মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার বুকটার মধ্যে কেন যেন বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে। অকারণ বেদনায় বুকটা ভরে উঠছে তার। কেবলি কেন মনটা তার বারবার বলে উঠল, আমি একাকী, নিঃস্ব। স্নেহ, ভালবাসা আমার জন্য নেই এ সংসারে।
তারপরে অস্বাভাবিক তাড়াতাড়ি সে উনুনের আগুন খুঁচিয়ে দিতে লাগল, ধুতে লাগল কাপ গেলাস।
নারায়ণ বললেন, হীরেন কৃপাল, তোমরাও প্রস্তুত থাকো এ পরীক্ষার জন্য। তুমি যাও রথী। আমি গিয়ে ভেরবেলা দেখে আসব শ্মশানের চিহ্ন।
হীরেনের আর মদের দোকানে পিকেটিং-এর কথা বলা হল না। সেটা মুলতবি রয়ে গেল কালকের জন্য।
বাইরে অন্ধকার। অন্ধকার আরও ভারী হয়েছে। পথের কেরোসিনের বাতি কোনটা নিভে গিয়েছে, কোনটা নিভু নিভু! তেল নেই। সারাদিন গিয়ে চৈত্র বাতাস এখন আরও মত্ত হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত চেপে আসা এ অন্ধকারকে ঝেটিয়ে উড়িয়ে নিতে চাইছে তার পাগলা প্রাণ।
স্তিমিত শব্দ আসছে রেলওয়ে ইয়ার্ড থেকে শোঁ শোঁ করে। সেখানে ইঞ্জিনের এ শব্দ সারারাত্রি। শেয়ালের পাল ডাকছে গঙ্গার ধার থেকে। পাড়ার ভেতর থেকে ডেকে ডেকে উঠছে। কুকুরেরা।
কোথা থেকে ডেকে উঠল আৰ্তরে প্রাণভীত চৈত্র পাখি। হয় তো তাড়া করছে কোনও খাবার সন্ধানী বিষধর সাপ।
সমস্ত চরাচর ঘুমন্ত কিন্তু তবু যেন জাগ্রত। আকাশে বাতাসে যেন কীসের কোলাহল। ঘুম যেন ছলনা। এ রাত্রি যেন কোন সর্বনাশের ষড়যন্ত্রে মত্ত।–হুতোম প্যাঁচাটা ডাকছে কোথায় হু হু করে যেন সে এ রাত্রির হার সাক্ষী। গাছগুলো মাথা
হেলিয়ে দুলিয়ে বুঝি কথা বলছে পরস্পরে।
বকুল মা খেতে দিয়েছেন দুই ভাইকে। নারায়ণ আর ভজু। নারায়ণ খাচ্ছেন ধীরে। খাওয়ায় মন নেই, চিন্তাচ্ছন্ন। সমাহিত। শূন্যদৃষ্টি। বোঝা যায়, জীবনের গতিতে তাঁর হৃদয়ের তাল মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। সুরে লয়ে বাজছে ঐক্যতান। আশপাশ নেই, পেছন নেই। সামনরে অন্ধকার কাঁটা ভরা পথটাকে কেবল অতিক্রম করা।
আর একজন বেতাল। তারও ঠিক খাওয়ায় মন নেই। দিশেহারা। ব্যস্ত। তার পাছ নেই আগও নেই। তার সুর নেই, লয় নেই। জীবনের পথে কেবলি কোলাহল। অস্থির। কী যেন চাই, কী যেন নেই। এ জীবনে কেবলই ছুটে চলেছি, যেন হাজার বছর ধরে। পাঠশালা, স্কুল, কলেজ, কাব্য দর্শন, রাজনীতি তারপর চায়ের দোকান। কিন্তু বৃত্তহীন। কী যেন ফেলে এসেছি। কী চায় এ মন। মনের সঙ্গে মনান্তর। কোথাও মাথা নত করতে পারিনে, বুক ভরে পারিনে কাউকে আলিঙ্গন করতে। তবুও শুনি নহবতের সুর, বেতালের তালে দেখি গজলের তাল ফেরতার মোহিনী কটাক্ষ।
আর একজন, বকুলমা। খাওয়া দেখছিলেন ছেলেদের। কিন্তু আর বোধহয় দেখছেন না। হঠাৎ মন হারিয়ে গিয়েছে। বসে আছেন বকুলমা নয়, এক কিশোরী বালিকা। বয়স চল্লিশ পার হয়ে গিয়েছে। সে যেন পাথরের বুকে মাথা ঠুকে গিয়েছে হাওয়া। পাথর তেমনি রয়েছে, শক্ত মজবুত। মাথার চুল কুচকুচে কালো, কালো। ফরসা রং। বললেন, খা তোরা, হালদার মশাই খাবেন কি না, জিজ্ঞেস করে আসি।
ঘরে ঢুকে দেখলেন হালদার আরাম কেদারাটায় গা হাত পা এলিয়ে পড়ে আছেন। সারা মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ। নাকের পাশের কোঁচ দুটো আরও গভীর হয়েছে। গায়ের জামা রয়েছে গায়ে। দেখলেন পড়ে রয়েছে মদের বোতল আর মোটা ছড়িগাছটি। চোখের পাতা বন্ধ। সইয়ের বর, নেকো হালদার। হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখছেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। থাক, ডেকে কাজ নেই। মায়া লাগে বকুলমায়ের। ঘুমুক। ঘুম তো কোনওদিন ছিল না ওই চোখে।
হঠাৎ হালদার চোখ খুললেন। রক্তজবার মতো চোখের চাউনি আচ্ছন্ন। বকুলমায়ের দিকে তাকিয়ে মাথাটা তুলতে চেষ্টা করলেন। ডাকলেন, কে স্বর্ণ। বড় বউ।
হালদার তাঁর স্ত্রীর নাম ধরে ডাকছেন।
বকুলমার বুকের মধ্যে চমকে উঠল। তাঁর সুন্দর ঠোঁট নড়ে উঠল, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না।
হালদার ফিসফিস করে বললেন, শোনো বড় বউ, আমি ভজুর বে দেব। নারায়ণটা জোচ্চুরির পথ ধরেছে, ও লোক ঠকিয়ে খাবে। কিন্তু ভজু তা নয়, ও সংসার চায়। মোটা পণ নে ওকে আমি বে দেব বুঝলে? তারপর, ওকে আমি ঠিক আমার রাস্তায় এনে ভেড়াব, তুমি দেখো।
বকুলমা নীরব। বুঝি স্পন্দনহীন! জোর করে তাকিয়ে আছেন হালদারের মাথার উপর দিয়ে দেওয়ালের দিকে।
হালদার বললেন, হাসছ বোধ হয়? কোথা পেয়েছিলে অমন হাসি। শোনো কাছে এসে বড় বউ।
বকুলমা দেখতে পেলেন, ওই যে তার সই এসে দাঁড়িয়েছে। হাসছে নিঃশব্দে। যেন বলছে, জবাব দে না লো পোড়ারমুখী, আমার ভাতার কি তোর ভাসুর।
কীসের ধাক্কায় কেঁপে উঠলেন বকুলমা। তাড়াতাড়ি বললেন, হালদারমশাই, আমি এসেছি।
হালদার ভ্রূ টান করে বললেন, কে?
আমি, সুখদা।
বকুলফুল।
হালদার একটু বিস্মিত হলেন। তারপর তার সেই মত্ত চোখে বকুলফুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জীবনে যেন এই প্রথম দেখলেন বকুলফুলকে। স্বর্ণের মতোই সুন্দরী। কেবল ঠোঁট দুখানি তেমন বাঁকা হাসিতে বাঁকা নয়। চোখে নেই তেমন ঔদাস্য। কী রয়েছে তার সারা চোখে মুখে, সব ঘুলিয়ে গেল হালদারের দৃষ্টির সামনে। মাথার মধ্যে অনেকগুলো কথা এলোমেলো হয়ে গোলমাল পাকিয়ে গেল সব। বকুলফুলের মূর্তিটা তাঁর চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো। কী যেন বলতে চাইলেন। পারলেন না। খালি অস্ফুট গলা দিয়ে বেরিয়ে এল বকুলফুল।
খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে ছুটে এল হাওয়া। যেন স্বর্ণর আচমকা নিশ্বাস! হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস পড়ল বকুলমায়ের। সই এসে দাঁড়িয়েছে মুখোমুখি। একজন এ সংসার ছেড়ে গিয়েও যেতে পারেনি, আর একজন থেকেও সেখানেই গিয়েছেন। তাদের জীবনে পাওয়া না পাওয়ার যোগ বিয়োগ আজও এক তালেই চলছে।
জীবনের সমস্ত ব্যর্থতা নিয়ে বকুলমা অবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। লাঞ্ছনা অপমান সব সয়েও দিন রাতের মতো নিয়মে চলা জীবনে একটা কথাই বারবার মনে হয়, আর কিছু বাকি আছে। স্বামীর কথা স্মরণ করার চেষ্টা করেন। ভাল মনে পড়ে না। যাকে মনে পড়ে সে সই। এ গাঁয়ে ঘরে তার প্রতি কত ডাকাডাকি কত হাসাহাসি। অরক্ষণীয়ার সে চির অপমান। আছে শুধু ভজু আর নারায়ণ। তবু বুকের কোনখানটাতে যেন একেবারে ফাঁকা। সে ফাঁকাতে নেই একটু বনপালা, শুধু বালিয়াড়ির স্তূপ।
বকুলমা।ভজুর গলা ভেসে এল।
এই যে বাবা। সাড়া দিলেন বকুলমা। তিনি কিছু কথা বলতে চাইছিলেন হালদারের সঙ্গে, বিশেষ ওঁর মুখে ভজুর বিয়ের কথা শুনে। নারায়ণের জন্য ভয় পেয়েছেন তিনি। এ সংসারের একটা হিল্লে হওয়া দরকার। বকুলমার নিজেরও ছুটি চাই এবার।
কিন্তু তাকিয়ে দেখলেন, হালদার একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আশ্চর্য! এই তো কথা বলছিলেন, এর মধ্যেই ঘুমোলেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগের তন্দ্রা তলিয়ে হঠাৎ অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। যেন দুধের শিশু হালদার। গভীর ঘুমের মধ্যে শিশুর দেয়ালের মতো হল ব্যাপারটা। হালদার সুখী। এ-সব মানুষেরাই তো প্রকৃত সুখী।
অথচ বকুলমায়ের কাছে রাত্রি আসে জাগার যন্ত্রণা নিয়ে। এ জীবনে কিছুই হয়তো ভাববার ছিল। তবু সম্ভব অসম্ভব সব বিচিত্র ভাবনায় তাঁর রাত কাবার হয়। তাঁর অন্ধকার ঘরে একলা বিছানায় ওই চোখজোড়া যেন জ্বলতে থাকে, কখনও ভিজে ওঠে কখনও দিশেহারার মতো এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে। যেন অনেক অপরিচিত আত্মার সঙ্গে তিনি মিশে যান। তাঁর সারা গায়ের মধ্যে ছুঁচ ফুটতে থাকে, মাথার মধ্যে দপদপ করে। ইচ্ছে হয়, কোথাও ছুটে যান। কোথা গেলে যে একটু প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়।
ভজু এল ঘরের মধ্যে। বলল, চলো বকুলমা, অনেক রাত হল।
বকুলমা তাড়াতাড়ি ফিরে বললেন, হ্যাঁ, চল বাবা, তোর বাবার দেখছি আজকে রাতটা কেদারাতেই কেটে যাবে। ডাকাডাকি করলে কি উঠবেন।
ভজুর মুখ দেখে বোঝা গেল, সে এখন এসব কিছুই ভাবছে না। বলল, ছেড়ে দাও না। ওঁর তো এসব নতুন নয়! তুমি তাড়াতাড়ি চলো। ঘরে গিয়ে তো আবার যা হোক কিছু মুখে দিতে হবে।
সত্যি। না জানি রাত কত হল। এখন গিয়ে আবার বকুলমাকে যা তোক কিছু খেতে হবে। তারপর সেই ঘরটাতেও কাজকর্ম কিছু আছে।
খিড়কির দোর দিয়ে ভজুর সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলেন বকুলমা। ভজু শিকল তুলে দিল দ্বারে।
রাত নিশুতি। নিঝুম। অন্ধকার। আকাশে অগণিত নক্ষত্র। যেন অনেক অশরীরীরা প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। কীসের প্রতীক্ষায় সে চাউনি উৎসুক।
পাড়ার দুপাশে বাড়িগুলো ছদ্মবেশি আততায়ীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় কোন ছোটখাটো বনবেড়াল গোছের জন্তুরা হঠাৎ দৌড়ে পালাচ্ছে, সড়সড় করে শুকনো পাতার উপর দিয়ে। টিকটিকি ডাকছে ঠিকঠিক। বাড়িগুলির গায়ে হাওয়া ধাক্কা খেয়ে অনেকের ফিসফিসানির মতো শোনাচ্ছে।
বকুলমা একটু অবাক হলেন ভজুর কথা ভেবে। ও তো এরকম থম মেরে থাকে না। রোজ পৌছে দেওয়ার পথে কত বকবক করে ভজু। সংসার, ব্যবসা, আশা আর ভবিষ্যৎ। তারপর আড় আনতে কুড়, বলে একে মারব, তাকে হাঁকব। তারও পরে বলব, যত নষ্টের গোড়া আমার বাবা। তোমাদের এ নেকো হালদারটিকে কম ভেবো না বকুলমা। বকুলমাও হাসেন বকবক করেন।
বকুলমা বললেন, ভজন, বাপের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস বুঝি আজ?
চমকে উঠল ভজু, ভাবনার ঘোরে ধাক্কা খেয়ে বলে উঠল, কেন?
কথা বলছিস না যে?
এমনি।
খটকা লাগল বকুল মায়ের। এমনি কেন। এমনি তো ভজুর হয় না। কী হল ওর প্রাণে, ওর হেঁকো ডেকো প্রাণে।
হ্যাঁ, কিছু হয়েছে তার প্রাণে। তাকে দুটো ভাবনা দুদিক থেকে চেপে ধরেছে। দুটো ভাবনা নয়, দুটো মুখ। একটি হল রথীনের সেই বীরত্বব্যঞ্জক দৃঢ় মুখ। যে মুখোনি বুকে নিয়ে নারায়ণ আদর করেছেন। দাদার দুই হাতের মধ্যে সেই মুখ। ভজুর নয় রথীনের। আর একটি এক রহস্যময়ীর। পলে পলে যে মুখের পরিবর্তন। মুখ হাসি হাসি, তবু হাসি নয়, ও চোখে হাসির ধার না অশ্রু ঝিকিমিকি। বকুনি না সোহাগ।
বকুলমা দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ওমা! আর চলছিস কোথা! এসে পড়লুম যে।
অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ভজু। আবার বাধা পড়ল, বলল, তাই তো।
বকুলমায়ের মনটা দমে যেতে লাগল বারেবারে। কী হয়েছে ছেলেটার, কী হয়েছে ওর মনে। নারায়ণ কিছু বলেনি তো। না, সে ছেলে তো কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলবার নয়। সে বরং ভজন। বাছাবাছি নেই, মানামানি নেই। গড়গড় করে যা মুখে এল তাই বলে দিল। তবে কী হল ছেলেটার। ওর বকুলমাকে তো ও কোনও কথা লুকায় না।
বললেন, আসবি আমার ঘরে, বসবি একটু।
ভজু বলল, না বকুলমা, আমি যাব। তোমার কিছু করতে হবে কিনা বল।
না, আমার কিছু করতে হবে না। তোর মনটা খারাপ দেখছি, তাই বললুম। বকুলমায়ের গলা একটু ধরেই এল। অভিমান হল তাঁর মনে। জল এসে পড়ল চোখের কোলে। কিছু না করলে বুঝি আসতে নেই। কত অগুনতি রাত যে আমার এই বুকে শুয়ে কাটিয়েছিস। যে বুকে আমার বিধাতা আজও কুমারীর বেদনার কাঁটা ফুটিয়ে রেখেছেন, যে বুকে তুই মাকে খুঁজেছিস আর আমি খুঁজেছি মাতৃত্বকে। আসলে ভজু তার মনের কথা বলতে চায় না। বললেন, এত রাতে যেন আর কোথাও যাসনি। গিয়ে শুয়ে পড়।
বকুলমা বাড়িতে ঢুকে গেলেন। অভিমান শুধু নয়, উৎকণ্ঠাও চেপেছে তাঁর মনে। মরণের সময় সইয়ের কথাগুলো মনে পড় গেল, সই, ওদের বাপের অনেক ছেলে মরেছে। সে সব ছেলের নাম মামলা। এগুলোকে তুই দেখিস আমার মুখ চেয়ে। ওদের কেউ নেই।
বকুলমায়ের বুকটা মুচড়ে উঠল। নারায়ণ ধরেছে এক মহাসর্বনাশের পথ। ভজনও আজ কেমন করে চলে গেল। কী হয়েছে ওর মনে।