অচেনা অজানা বিবেকানন্দ – শংকর
সেই ১৮৯৩ সাল থেকে এদেশের চিত্তগগনে মধ্যাহ্নসূর্যের মতো উদ্ভাসিত হয়ে আছে স্বামী বিবেকানন্দ! উনিশ, বিশ এবং একুশ শতকের দেশী-বিদেশী গবেষকরা বিপুল নিষ্ঠায় নিরন্তর অনুসন্ধান চালিয়ে এখনও পরিপূর্ণ বিবেকানন্দকে এঁকে ফেলতে সক্ষম হননি। অজানা ও অচেনা বিবেকানন্দের অনুসন্ধান তাই চলছে এবং চলবে।
সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের সঙ্গে শংকর-এর প্রথম পরিচয় নিতান্ত বাল্যবয়সে ১৯৪২ সালে, যার চল্লিশ বছর আগে বেলুড়ে মহাসমাধি লাভ করেছেন বিদ্রোহী, বিপ্লবী ও জনগণমন বিবেকানন্দ। হাওড়ায় তারই নামাঙ্কিত বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে অতি অল্পবয়সে শংকর-এর বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানের শুরু।
কেমন ছিলেন মানুষটি? সন্ন্যাসীর কর্তব্য ও সন্তানের কর্তব্যের সমন্বয় ঘটাতে গিয়ে তিনি কি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন? তার বোন কোথায় আত্মঘাতিনী হলেন? বিলেত থেকে ফেরার পথে উদাসী মেজভাই কোন অভিমানে পাঁচবছর বাড়িতে একটা চিঠি লিখলেন না? কোথা থেকে যোগাড় হল দত্ত পরিবারের শরিকী মামলার টাকাকড়ি? সমস্ত পরিবার কীভাবে সর্বস্বান্ত হলেন?
সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কেমনভাবে বিদেশে বেদান্তের সঙ্গে বিরিয়ানি রান্নার প্রচার-অভিযানে নেমেছিলেন? কলকাতা শহর থেকে আরম্ভ করে কোথায়-কোথায় কতদিন তাকে অনাহারে থাকতে হয়েছিল? তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার কোনটি? কোন ফলটি তিনি একেবারেই অপছন্দ করতেন?
স্বামীজির দৈহিক উচ্চতা ও ওজন কত ছিল? তার প্রথম ও দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক কোথায় হয়েছিল? বিশ্ববিজয় করে ফেরবার পরেও কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তাররা তাদের চেম্বারে ভিক্ষুক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে নির্দ্বিধায় কত টাকা ফি গ্রহণ করেছিলেন? চিকিৎসার খরচ সামলাতে হিমশিম খেয়ে কাদের কাছে স্বামীজি হাত পেতেছিলেন? আসন্ন বিদায়ের কথা ভেবেই কি তিনি পারিবারিক বিবাদের ফয়সালা করার জন্য মহাপ্রয়াণের মাত্র কয়েকদিন আগে অমন তৎপর হয়ে উঠেছিলেন? এমনই সব হাজারো প্রশ্নের ছোট ছোট এবং বড় বড় উত্তর সংগ্রহ করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় লেগে গিয়েছে লেখকের।
শংকর-এর স্বপ্নময় রচনায় অচেনা অজানা বিবেকানন্দই জানিয়ে দেন, কেন তিনি পুরুষোত্তম? সমকালের সমস্ত তাচ্ছিল্য ও যন্ত্রণা অবহেলা করে কেমন করে তিনি মহত্ত্বের হিমালয়শিখরে আরোহণ করেছিলেন? কেন প্রতিটি বড় কাজ করার সময় তিনি মৃত্যুর উপত্যকা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছেন?
উৎসর্গ – শ্রীসত্যপ্রসাদ রায়বর্মণ শ্রদ্ধাস্পদেষু
যাঁর নিরন্তর উৎসাহ, অশেষ কৌতূহল, ধারাবাহিক অনুপ্রেরণা ও সহমর্মিতা ছাড়া এই বই লিখতে আমার আরও অনেক দেরি হয়ে যেতো।
শংকর
৩০ নভেম্বর ২০০৩
.
“কতবার আমি অনাহারে, বিক্ষতচরণে, ক্লান্তদেহে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি। কতবার দিনের পর দিন এক মুষ্টি অন্ন না পেয়ে পথচলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তখন অবসন্ন শরীর বৃক্ষচ্ছায়ায় লুটিয়ে পড়ত, তখন মনে হতো প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে পারতাম না, চিন্তাও অসম্ভব হয়ে পড়ত; আর অমনি মনে এই ভাব উঠত, আমার কোন ভয় নেই, মৃত্যুও নেই; আমার জন্ম কখনো হয়নি, মৃত্যুও হবে না; আমার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, সোহ হম, সোহ হম। সারা প্রকৃতির ক্ষমতা নেই যে আমায় পিষে মারে। প্রকৃতি তো আমার দাসী! হে দেবাদিদেব, হে পরমেশ্বর, নিজ মহিমা প্রকাশ কর, স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হও! উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত! বিরত হয়ো না। অমনি আমি পুনর্বল লাভ করে উঠে দাঁড়াতাম; তাই আমি আজও বেঁচে আছি।”
লস এঞ্জেলিসে বক্তৃতা
‘দ্য ওপেন সিক্রেট’
৫ জানুয়ারি ১৯০০
.
“না খেতে পেয়ে মরে গেলে দেশের লোক একমুঠো অন্ন দেয় না, ভিক্ষে-শিক্ষে করে বাইরে থেকে এনে দুর্ভিক্ষগ্রস্ত অনাথকে যদি খাওয়াই তো তার ভাগ নেবার জন্য দেশের লোকের বিশেষ চেষ্টা; যদি না পায় তো গালাগালির চোটে অস্থির!! হে স্বদেশীয় পণ্ডিতমণ্ডলী! এই আমাদের দেশের লোক, তাদের আবার কি খোসামোদ? তবে তারা উন্মাদ হয়েছে, উন্মাদকে যে ঔষধ খাওয়াতে থাকে, তার হাতে দু-দশটা কামড় অবশ্যই উন্মাদ দেবে; তা সয়ে যে ঔষধ খাওয়াতে যায়, সেই যথার্থ বন্ধু।”
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য
উদ্বোধন পত্রিকা
১৩০৬-০৮
.
“আমাদের এত বুদ্ধি মেধা কেন জানিস? আমরা যে সুইসাইডের বংশ, আমাদের বংশে অনেকগুলো আত্মহত্যা করেছে।…আমাদের পাগলাটে মাথা, হিসেব-ফিসেবের ধার ধারে না, যা করবার তা একটা করে দিলুম, লাগে তাক, না লাগে তুক।”
বলরাম বসুর বাড়িতে
যোগেন মহারাজকে
স্বামী বিবেকানন্দ
.
লেখকের নিবেদন
এতো চেনা-জানা হয়েও বিবেকানন্দকে অনেকসময় বড়ই অচেনা এবং অজানা মনে হয়েছে। প্রথমেই স্মরণ করি হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে আমার পূজ্যপাদ হেডমাস্টারমশাই সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্যের কথা। বয়সের এবং জ্ঞানের দুস্তর পার্থক্যের কথা মনে না রেখে তিনি কমবয়সী ছাত্রদেরও বিবেকানন্দ বিষয়ে নানা সংবাদ সরবরাহ করতেন। পরবর্তীকালে, ইস্কুলে সিনিয়র এবং আমার সাহিত্যগুরু শঙ্করীপ্রসাদ বসুর স্নেহপ্রশ্রয় ও নিবিড় সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য লাভ করি। তার কালজয়ী রচনা বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনেই মহীরুহের আকার ধারণ করে। শঙ্করীপ্রসাদের গবেষণা থেকে প্রত্যাশার বেশি লাভ করেও কিন্তু আমার কৌতূহলের অবসান হলো না। বরং পিপাসা আরও বেড়ে গেল।
এই পিপাসানিবৃত্তির প্রচেষ্টায় সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিবেকানন্দ সম্পর্কে কয়েকটা ছোট আকারের প্রবন্ধ লেখা হয়। সেই লেখাগুলি বেশ কয়েকজন পাঠকের নজরে আসে। প্রধানত তাদেরই প্ররোচনায় খোঁজ করতে হল কিছু পুরনো কাগজপত্রের। দেখলাম, দীর্ঘদিন ধরে আমার অজান্তেই কিছু কিছু উপাদান হাতের গোড়াতে সংগৃহীত হয়ে রয়েছে। অতএব সাহস করে আসরে নেমে পড়া গেল।
অচেনা অজানা বিবেকানন্দ সত্যিই বহুমুখীতার স্বল্পপরিসর বিচিত্র জীবনের কয়েকটা মাত্র দিক এবারের এই অনুসন্ধানের আওতায় আনা গেল।
যাঁদের জন্য এই লেখা, তারা চাইলে ভিক্ষালব্ধ সংগ্রহের ঝুলি থেকে আরও কিছু তথ্য আর একটি বইতে সাজিয়ে দেবার ইচ্ছা রইল।
শংকর
.
ত্রয়োদশ সংস্করণের নিবেদন
সুদূর সেন্ট লুইস, আমেরিকা থেকে সন্ন্যাসী, গবেষক ও লেখক স্বামী চেতনানন্দ সস্নেহে কিছু মন্তব্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আশীর্বাদে এই সংস্করণে নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু সংশোধন ও সম্পাদনা করা গেল! স্বামী চেতনানন্দকে জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
ভূতপূর্ব পাঠক এবং বর্তমানে বন্ধু শ্ৰীঅরুণকুমার দে এবারও সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। তাঁকেও নমস্কার।
শংকর
.
প্রচ্ছদচিত্র
স্বামীজির এই অবিস্মরণীয় ছবিটি কে তুলেছিলেন এবং কোথায় তুলেছিলেন তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এতোদিন বলা হয়েছে, এইটাই বেলগাঁও ছবি, তোলা আমেরিকযাত্রার আগে অক্টোবর ১৮৯২। কেউ কেউ বলেন, ছবিটি হায়দ্রাবাদে তোলা ১৮৯৩ সালের। গোড়ার দিকে। আবার একদলের দাবি, ছবি নেওয়া হয় চেন্নাইতে। নতুন মত, ১৮৯১ এপ্রিলের গোড়ায় জয়পুরে তোলা।
স্বামীজির ভক্ত ও শিষ্য হরিপদ মিত্র বেলগাঁওতে যে ছবি তুলিয়েছিলেন তা রক্ষা পেয়েছে। হরিপদ মিত্র নিজেই জানিয়েছেন, স্বামীজি ছবি তোলাতে খুব অনিচ্ছুক ছিলেন। সেক্ষেত্রে, এই ছবিটি বেলগাঁওয়ে তোলার সম্ভাবনা খুব কম। বেলগাঁওয়ের ছবিটি সম্ভবত তুলেছিলেন এস মহাদেব অ্যান্ড সন স্টুডিওতে গোবিন্দ শ্রীনিবাস ওয়েলিং।
ওপরের ছবিটি সম্পর্কে স্বামীজির সহাস্য মন্তব্য : ঠিক যেন। ডাকাতদলের সর্দার!
এই সময়ে তার সম্বলের মধ্যে একখানি গেরুয়া বস্ত্র, দণ্ড,কমণ্ডলু ও কম্বলে জড়ানো দু’চারখানি বই। এছাড়া সঙ্গে আর কিছুই থাকতো না। তার কাছে কোন পয়সাও থাকতো না।
রাজপুতানা ভ্রমণকালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “মহারাজ, আপনি কেন গেরুয়া পরেন?” স্বামীজির উত্তর, “কারণ এটাই ভিখিরির বেশ। শাদা কাপড়ে ঘুরলে লোকে আমার কাছে ভিক্ষে চাইবে। আমি নিজেই ভিখিরি, বেশীরভাগ সময়ে আমার নিজের কাছেই একটা পয়সা থাকে না। অথচ কেউ ভিক্ষে চাইলে না দিতে পারলে আমার বেজায় কষ্ট হয়। আমার এই গেরুয়া কাপড় দেখলে ওরা বুঝতে পারে আমিও ভিখিরি। কেউ ভিখিরির কাছে ভিক্ষে চায় না।”
.
০১. সন্ন্যাসী ও গর্ভধারিণী
“আমার ছেলে চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়েছিল,” এই কথা তার জীবনসায়াহ্নে বেশ গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন এক গর্ভধারিণী। যাঁদের কাছে তিনি একথা বলেছিলেন তাঁরা তরুণ সংসারত্যাগী, কিংবদন্তি সন্ন্যাসীর জননীকে দেখতে তারা এসেছিলেন উত্তর কলকাতার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে বিবেকানন্দর জন্মভিটায়। তখন অবশ্য তিনি ইহলোকে নেই।
বৈরাগ্যের এই দেশে স্মরণাতীত কাল থেকে মুক্তিসন্ধানী মানুষ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন, সংসারের মায়াবন্ধনকে তাঁরা ভাল চোখে দেখেননি, কিন্তু তবু প্রশ্ন জেগে থাকে, যার জঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া যায়, যার স্তন্যপানে অসহায় শিশু জীবনরক্ষা করে, তাকে কি কোনো অবস্থাতেই পরিপূর্ণ ত্যাগ করা সম্ভব? অভিজ্ঞরা জানেন, এইসব প্রশ্নকে চিরতরে ভস্মীভূত করার জন্যই সন্ন্যাসপথের পথিককে নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করতে হয়। পূর্বাশ্রমের সঙ্গে সকল সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করার জন্যই তো এই আত্মশ্রাদ্ধ।
কিন্তু সন্ন্যাসীও তো মানুষ। গর্ভধারিণী জননীর ঋণ এবং মোক্ষের আহ্বান যতই ভিন্নমুখী হোক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবসন্তানরাও কোনো যুগে এই দ্বন্দ্বের সম্পূর্ণ অবসান ঘটাতে সফল হননি। একালের সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন, “সন্ন্যাস অর্থ, সংক্ষেপে মৃত্যুকে ভালবাসা। আত্মহত্যা নয়–মরণ অবশ্যম্ভাবী জেনে নিজেকে সর্বতোভাবে তিলে তিলে অপরের মঙ্গলের জন্য উৎসর্গ করা।” এরই পাশাপাশি উত্তর কলকাতায় তারই প্রতিবেশী মহাকবির ঘোষণা, বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ গ্রহণের জন্য সত্যসন্ধানীর বার বার জীবনসমুদ্রে অবগাহন।
চব্বিশ বছর বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের যে প্রতিবেশী বৈরাগী হয়ে সব বন্ধন ছিন্ন করলেন, বিশ্ববাসীকে শোনালেন অনন্তকালের মুক্তিবাণী, তিনি বোধহয় উল্টোপথের যাত্রী। সমস্ত বন্ধন থেকে অনায়াসে মুক্ত হয়েও এবং অতীত বন্ধনকে অস্বীকার করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েও তা করতে রাজি হলেন না, যদিও সমকালের দৃষ্টিতে কারও কারও মনে হলো, তিনি ঘর ও ঘাটের বিচিত্র দোটানায় পড়ে থাকলেন।
আত্মশ্রাদ্ধের পর সর্ববন্ধন মুক্ত হয়েও যে মানবসন্তান অতীতবন্ধনকে অস্বীকার করে না, সে কি বিপথগামী? না নরোত্তম?
যেহেতু আমাদের সন্ধানের বিষয়বস্তু মহামানব বিবেকানন্দ, মানবতার সর্বোচ্চ শিখরে যাঁর রোমাঞ্চকর বিজয় অভিযান, সেহেতু আমরা অবাক বিস্ময়ে এমন এক মানুষের সন্ধান করি যিনি সংসারের কঠিনতম প্রশ্নকেও এড়িয়ে না গিয়ে বৈরাগ্য ও প্রেমকে আপন বিবেকের মধ্যে সহ-অবস্থানের অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। জনৈক প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে গাজীপুরে রোদন করতে দেখে একজন মন্তব্য করলেন, “সন্ন্যাসীর পক্ষে শোকপ্রকাশ অনুচিত।” বিবেকানন্দ উত্তর দিলেন, “বলেন কি, সন্ন্যাসী হইয়াছি বলিয়া হৃদয়টা বিসর্জন দিব? প্রকৃত সন্ন্যাসীর হৃদয় সাধারণ লোকের হৃদয় অপেক্ষা আরও অধিক কোমল হওয়া উচিত। হাজার হোক, আমরা মানুষ তো বটে।” তারপর সেই অচিন্তনীয় অগ্ন্যুৎপাত–”যে সন্ন্যাসে হৃদয় পাষাণ করতে উপদেশ দেয় আমি সে সন্ন্যাস গ্রাহ্য করি না।” এদেশের শতসহস্র বছরের ইতিহাসে মনুষ্যত্বের সারসত্যটুকু এমন অকুতোভয়ে আর কেউ ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।
কিন্তু সাধারণ মানুষ আমরা, যে কোনো কঠিন তত্ত্বকে গলাধঃকরণ করতে গেলে আমরা কিছু নজির খুঁজিনজির ছাড়া এই বিশ্বে সাধারণ মানুষের কাছে কিছুই গ্রহণীয় নয়। তাই বাধ্য হয়ে বিবেকানন্দও জনমতের আদালতে নজির উপস্থিত করেছেন অষ্টম শতকের শঙ্করাচার্যের–এই শঙ্করাচার্যও নিতান্ত তরুণবয়সে সংসার ত্যাগ করেছিলেন, বেঁচেছিলেনও অত্যন্ত কম সময় (বিবেকানন্দ ৩৯, শঙ্কর ৩২), কিন্তু গর্ভধারিণী জননীর প্রতি দু’জনেরই প্রবল আনুগত্য।
জগদ্গুরু শঙ্কর মাকে ভালবাসতেন ভীষণ, তার জন্য তাকে যে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, তার বিবরণ যথাসময়ে এই লেখায় এসে পড়বে। সেই সঙ্গে শ্রীচৈতন্যও। এখন শুধু আমরা স্মরণ করি, সত্যসন্ধানী বিবেকানন্দ দুর্জয় সাহস নিয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, “যে মাকে সত্য সত্য পূজা না করতে পারে, সে কখনও বড় হতে পারে না।” মাতৃপূজার এই দেশে নিতান্ত সাধারণ সত্যের প্রকাশ্য স্বীকৃতি, কিন্তু এযুগের সংসারে তার সরল পুনর্ঘোষণা তেমন মেলেনি। মাতৃপ্রেমী, মাতৃপূজারী, পূতচরিত্র বৈরাগীকে তাই শতাব্দীর দূরত্বে দাঁড়িয়েও প্রণাম জানাতে হয়।
বিবেকানন্দর এই দুঃসাহসিক উক্তি থেকেই আমার এবারের অনুসন্ধানের শুরু-সন্ন্যাসী ও গর্ভধারিণী। আত্মশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেও সন্ন্যাসী কেমনভাবে মাতৃপ্রেমকে অস্বীকার করতে রাজি হলেন না? মাতৃপ্রেমীদের ইতিহাসে এ বোধহয় দুর্গমতম তীর্থযাত্রা–সাধারণ মানুষের স্বপ্নেরও বাইরে। কিন্তু এ সংসারের বিবেকানন্দরা এখনও অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম হন এবং সেই জন্যেই তারা আমাদের হৃদয়-সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং হয়ে ওঠেন আমাদের পরম পূজনীয়।
.
সন্ন্যাসী হয়ে কেউ এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হন না। বিবেকানন্দ ২৪ বছর বয়সে এবং শঙ্করাচার্য ১৬ বছর বয়সে গৃহত্যাগী হয়েছিলেন, তার আগে সংসারেই তারা পরম আদরে লালিত পালিত হয়েছেন, সুতরাং আবহমান কাল থেকে সংসারই সমাজকে সন্ন্যাসী উপহার দেয় বলাটা অত্যুক্তি হবেনা।
বিবেকানন্দ যখন বিলু বা বীরেশ্বর বা নরেন্দ্রনাথ তখনকার ছবিটা একটু চেনা না থাকলে পরবর্তী জীবনে মায়ের প্রতি, ভাইদের প্রতি, বোনদের প্রতি তার প্রবল টান এবং কর্তব্য করতে না পারার জন্য বিবেকদংশনকে ঠিক বুঝতে পারা কঠিন হতে পারে। এই বিবেকদংশন আমৃত্যু কতখানি তীব্র হয়ে উঠেছিল এবং মাতৃসেবায় আপাত ব্যর্থতাকে হৃদয়বান বিবেকানন্দর কেন পাপ মনে হয়েছে তাও আমরা ভোলামনে অনুসন্ধান করবো।
যে সংসারে বিলে অথবা নরেন্দ্রনাথের জন্ম তাকে সোনার সংসার। বলাটা অত্যুক্তি হবে না। বিলে নামটায় আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, একবার বিবেকানন্দ-গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী দাসী বেলুড়মঠে এসে একতলা থেকে উঁচুগলায় বিশ্ববিজয়ী ছেলেকে ডাকলেন বিলু-উ-উ। মায়ের গলা শুনে ছেলে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন এবং নীচু গলায় মায়ের সঙ্গে কথাবার্তায় ডুবে গেলেন। এই সেই মা যিনি শৈশবে ছেলের দুরন্তপনায় অস্থির হয়ে বলেছিলেন, “চেয়েছিলাম শিবকে, পেলাম এক ভূতকে!” এসব কথা সব দেশের সব মায়েরাই তাদের ছেলেকে বলে থাকেন।
বিবেকানন্দর বিদেশি ভক্তদের মনে তাদের প্রিয় স্বামীজির গর্ভধারিণী জননী সম্বন্ধে প্রবল আগ্রহ ছিল। ইংরিজিতে আমরা বিভিন্ন রচনায় তার ইঙ্গিত পেয়েছি, তাদেরই একজন জননী ভুবনেশ্বরীর মুখে শুনেছিলেন, ছোটবেলায় এই বম্বেটে শিশুটিকে সামলানোর জন্যে একজন নয় দু’জন পরিচারিকা হিমশিম খেতো!
মায়ের কাছে চিরদিন বিলু থাকলেও, বিলে অথবা বীরেশ্বর ঠিক কবে থেকে নরেন হলেন তা আমাদের জানা নেই। তবে বীরেশ্বর নামটা যে অনেকদিন প্রচলিত ছিল তা পরবর্তীকালে সিস্টার নিবেদিতার চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি। একজন পশ্চিমী ভক্তিমতাঁকে নিবেদিতা কিছুটা উত্তেজনার সঙ্গে ‘গোপন’ খবর জানাচ্ছেন, “হৃদয়বান বিবেকানন্দর আসল নাম ‘বীরেশ্বর’ব্যাপারটা কিন্তু খুব কম লোকেই জানে।”
কথা যখন উঠলোই তখন বলে রাখা ভাল, বিলু ভুবনেশ্বরীর জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন না, যদিও পরবর্তীকালে তাকেই বড়ছেলের সমস্ত দায়িত্ব মাথায় পেতে নিতে হয়েছিল, সংসারত্যাগী হয়েও সেই বিরাট মানসিক দায়িত্বকে তিনি কোনোদিন স্বার্থপরের মতন দূরে সরিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেননি। এই পৃথিবীতে সন্ন্যাসী অনেকেই হয়েছেন, কিন্তু পরিবার ও বৈরাগ্যের উভয়-সঙ্কট এবং তার বিস্ময়কর সমাধানই বিবেকানন্দকে বিবেকানন্দ করে তুলেছে। বিলুর আরেকটি ডাক নাম ছিল। যে মানুষটি দীর্ঘদেহী এবং পৌনে ছ’ফুট লম্বা ছিলেন তাকে তাঁর ন’ঠাকুরদাদা গোপাল দত্ত ‘বেঁটে শালা’ বলে ডাকতেন। দত্তবাড়ির পূর্বপুরুষরা আয়তনে কেমন ছিলেন তার একটা আন্দাজ করা গেল!
সর্বসাকুল্যে বিবেকানন্দরা যে দশ ভাই-বোন সেকথা অনেকের খেয়াল থাকে না। আরেক মহামানব, জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথরাও পনেরো ভাই বোন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নটি পুত্র ও ছ’টি কন্যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর চতুর্দশ সন্তান। ভুবনেশ্বরীর প্রথম সন্তানটি পুত্র, অকালে মৃত্যু হওয়ায় তার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। যদিও বহুকাল পরেও জননী এই সন্তানটির অভাবনীয় সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেন–দেখতে ছিল পিতামহের মতন। দত্তবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন একজন অজ্ঞাতনামা লেখিকার মতে প্রথম সন্তানটি আটমাস বয়সে মারা যান। এবিষয়ে অবশ্য অন্য কোন প্রমাণ সংগ্রহ সম্ভব হয়নি।
ভুবনেশ্বরীর পরের সন্তানটি কন্যা, তারও শৈশবে মৃত্যু, নাম পর্যন্ত জানা যায় না। অজ্ঞাতনামা লেখিকার মতে, এই কন্যাটি আড়াই বছর বেঁচে ছিলেন। তৃতীয় সন্তান হারামণি মাত্র ২২ বছর বেঁচে ছিলেন, এঁর সম্বন্ধেও তেমন কিছু খবর পাওয়া যায় না। চতুর্থ সন্তান স্বর্ণময়ী দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন, এক সময় স্বামীজির ভিটেতেই বসবাস করতেন। তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছেন, স্বামীজির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর দিদি স্বর্ণময়ী বেলুড়মঠে দশটাকা পাঠিয়ে দিতেন। রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্যগণ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন এই চাঁদা দেওয়া হয়েছে। এই চাঁদা দেওয়া অবশ্য শুরু করেন বিবেকানন্দ-জননী ভুবনেশ্বরী। হয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ, না হয় স্বামী প্রেমানন্দ বাড়ি থেকে এই টাকা নিয়ে যেতেন। ভুবনেশ্বরীর পঞ্চম সন্তানটিও কন্যা–মৃত্যু ছ’বছর বয়সে। নরেন্দ্রনাথ তাঁর ষষ্ঠ সন্তান, বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৯ বছর (১৮৬৩ ১৯০২)। সপ্তম সন্তান কিরণবালা (আনুমানিক ১৮/১৯ বছর। বেঁচেছিলেন), অষ্টম যোগীন্দ্ৰবালা (বেঁচেছিলেন আনুমানিক ২৫ বছর), নবম মহেন্দ্র ও দশম ভূপেন্দ্রনাথ। শেষ দু’জন যথাক্রমে ৮৮ বছর (১৮৬৮ ১৯৫৬) এবং ৮১ বছর (১৮৮০-১৯৬১) জীবিত ছিলেন। মহেন্দ্রনাথের জন্ম-তারিখ নিয়ে অন্য মতও আছে। কর্পোরেশন জন্ম-রেজিস্টার অনুযায়ী তাঁর জন্ম ১ আগস্ট ১৮৬৯। রেজিস্টারির তারিখ ৭ আগস্ট।
ভুবনেশ্বরীর মেয়েদের পরিবারের কিছু কিছু সংবাদ বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া গেলেও, বিস্তারিত বিবরণ কোথাও নেই। বিবেকানন্দ ভিটার পুনরুদ্ধারের প্রাণান্তকর দায়িত্ব মঠ-মিশনের পক্ষ থেকে যিনি নিঃশব্দে গ্রহণ করেছেন সেই পার্থ মহারাজের (স্বামী বিশোকানন্দ) সূত্রে জানা যায়, যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটা অধিগ্রহণের সময় বেশ কয়েকজনকে পুনর্বাসিত করা হয়, তাদের দেওয়া হয় নতুন ফ্ল্যাট–এঁরা বিবেকানন্দের বোনের দিক থেকে বংশধর, কারণ ভুবনেশ্বরীর তিন পুত্রসন্তানের কেউই বিবাহ করেননি। বিশ্বস্ত সূত্রে আরও জানা যায়, যে বোন (যোগীন্দ্ৰবালা) বিবেকানন্দের পরিব্রাজককালে সিমলা পাহাড়ে শ্বশুরবাড়িতে আত্মহত্যা করে নিজের জ্বালা জুড়িয়েছিলেন, তার দুটি নাবালিকা কন্যার দায়িত্বও একসময়ে নিঃসম্বল ভুবনেশ্বরীকে ঘাড়ে নিতে হয়। অন্য আর এক সূত্রে জানা যায়, ভুবনেশ্বরীর এই জামাতা আবার বিবাহ করলে, শোকতপ্তা মাতা ভুবনেশ্বরী নতুন বউকে এবং জামাইকে নিজের বাড়িতে এনে আদরযত্ন করেছিলেন। বাঙালি সংসারে এই ধরনের ঘটনা বিরল না হলেও, বড়ই বেদনাদায়ক। এই অভাগা দেশের অভাগিনী মায়েরাই এমন কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করেও নিজের কর্তব্য পালন করতে পারেন।
স্বামীজির বোনদের কবে কীভাবে বিয়ে হলো, পিতৃদেব বিশ্বনাথ বেঁচে থাকতে থাকতে কতটুকু দায়িত্বপালন করতে পেরেছিলেন, তাঁর আকস্মিক অকালমৃত্যুর পরে বোনদের বিবাহব্যবস্থায় দাদা নরেন্দ্রনাথের কোনো ভূমিকা ছিল কি না, এইসব ব্যাপারে বিবেকানন্দ-বিষয়ক বিপুল তথ্যসমুদ্রে তেমন কিছু খুঁটিনাটি অভিজ্ঞমহলের নজরে পড়েনি। আমরা শুধু জানি, তার বড় দুই দিদি ইংরেজি শিক্ষার আলোকলাভ করে বেথুনে পড়াশোনা করেছিলেন এবং ছোটদুই বোনওমিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদুষীহয়েছিলেন। আমরা জানি, পিতৃদেবের মৃত্যুর সময়ে বিবেকানন্দর বয়স ছিল ২১ বছর, মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রর তখন ১৫ এবং ভূপেন্দ্রনাথ নিতান্তই নাবালক, বয়স তিন।
কিরণবালা ও যোগীন্দ্ৰবালার তেমন খোঁজখবর বিবেকানন্দর বিস্তারিত জীবনকাহিনীগুলিতে আজও নেই এবং পরিবার সম্বন্ধে সর্বপ্রকার সংবাদের তুলনাহীন রসার মহেন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় নব্বইখানি বইয়ের কোথাও এই বিষয়ে তেমনভাবে মুখ খোলেননি। কিন্তু স্বামীজির নিজের লেখা চিঠিতে মাঝে-মধ্যে কিছু উল্লেখ আছে। ১৯০০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লস্ এঞ্জেলিস থেকে মিসেস সারা বুলকে বিবেকানন্দ লিখছেন: “আমার বোনের একখানি পত্রে জানলাম যে, তার পালিতা কন্যাটি মারা গেছে। ভারতের ভাগ্যে যেন একমাত্র দুঃখই আছে। তাই হোক! সুখদুঃখে আমি যেন বোধশূন্য হয়ে গেছি!”
পরিবারের সভ্য এবং সভ্যাদের সম্পর্কে একটু বিবরণ এই জন্যে দেওয়া প্রয়োজন হলো যে মা, বোন, ভাইদের সম্পর্কে স্বামীজির কেন উদ্বেগ এবং পরিবারের পুত্র হিসেবে দায়িত্বপালনে ব্যর্থতা সম্পর্কে তাঁর মনে অন্যায়বোধ কেন তা চোখের সামনে থাকা প্রয়োজন। দশ সন্তানের জননী ভুবনেশ্বরী অকালবৈধব্যে জর্জরিত হয়েও কী বিপুল দুঃখের বোঝা আমৃত্যু নিঃশব্দে বহন করেছিলেন তা জেনে রাখাও মন্দ নয়।
সেই সঙ্গে মহাবৈরাগ্য অবস্থায় স্বামীজির চিঠি, “আমি অতি অকৃতী সন্তান, মাতার কিছু করিতে পারিলাম না, কোথায় তাদের ভাসিয়ে দিয়ে চলিয়া আসিলাম।” করুণ স্বরে তিনি যেন মায়ের কাছে ক্ষমা চাইছেন।
অবশ্য সবটাই অন্যায়বোধ নয়, অন্য এক জায়গায় সংসারত্যাগ সম্বন্ধে স্বামীজি বলছেন, যখন সংসার ছাড়লাম তখন আমার একচোখে শোকা, মা, দিদিমা, ভাই বোনদের ছেড়ে চলে যেতে ভীষণ খারাপ লাগছিল, কিন্তু দ্বিতীয় চোখে আমার আদর্শের জন্যে আনন্দাশ্রু।
.
সিমলার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তবাড়ি যাঁরা নিজের চোখে দেখেছেন তারা অবশ্যই জানেন দরিয়াটনার দত্তরা কলকাতা শহরে আদি যুগ থেকে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলেন। দক্ষিণরাঢ়ি কাশ্যপগোত্রীয় দত্তদের বিপুল বৈভবের পিছনে ছিল বংশানুক্রমে আইনব্যবসায় সাফল্য। কৌতূহলীরা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর পারিবারিক বর্ণনা পড়ে দেখতে পারেন এবং কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন কেন বিবেকানন্দ আইন পড়েছিলেন, কেন এটর্নি অফিসে শিক্ষানবিশী করেছিলেন, অথচ মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ বিলেতে আইন পড়তে হাজির হয়েছে শুনে কেন তিনি বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন।
উকিল ও এটর্নির গুষ্টি বলতে যা বোঝায় তা এই সিমলের দত্তরা। এই যৌথ পরিবারের সমৃদ্ধি অবশ্যই ওকালতি থেকে, আবার পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমায় সর্বস্ব হারানোর দুর্ভাগ্যও জুটেছে এঁদের। জ্ঞাতিদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমায় কলকাতার ধনবানরা একসময় কীভাবে নিঃস্ব হতেন তার অনেক ইতিহাস হাইকোর্টের এটর্নিপাড়ার কাগজপত্তরের মধ্যে চাপা পড়ে আছে। এক্ষেত্রে আমাদের দুঃখ এই কারণে যে অনাবশ্যক শরিকী লড়াই সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর স্বল্পপরিসর জীবনকে সবদিক থেকে বিষময় করে তুলেছিল। এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা না থাকলে হয়তো তিনি আরও কিছুদিন বাঁচতেন। এ-বিষয়ে যথাসময়ে একটা স্পষ্ট অথচ অস্বস্তিকর ছবি এই লেখায় হাজির করবার প্রয়োজন হবে।
দত্তদের আদি নিবাস বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত-দরিয়াটনা বা দেরেটনা গ্রাম। দক্ষিণরাঢ়ী কাশ্যপ গোত্রীয় রামনিধি দত্ত তার পুত্র রামজীবন এবং পৌত্র রামসুন্দরকে নিয়ে গড়-গোবিন্দপুরে (কলকাতা) চলে আসেন। দেওয়ান রামসুন্দরের পাঁচ ছেলে, জ্যেষ্ঠ রামমোহন। ইনিই নরেন্দ্রনাথের প্রপিতামহ। দেখা যাচ্ছে বিলুর প্রপিতামহ রামমোহন দত্ত সুপ্রীম কোর্টের ফার্সী আইনজীবী ছিলেন। অভিজাত জীবনযাপন করেও তিনি প্রভূত অর্থ ও সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন সালকিয়ায় তার দুটো বাগানবাড়ি এবং খিদিরপুরে প্রচুর জমিজমা ছিল। অতি অল্পবয়সে (৩৬) কলেরায় রামমোহনের মৃত্যু হয়। সে সময় গ্রীষ্মকালে কলেরা হতো এবং উত্তর কলকাতায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকে প্রত্যেক বছর এক-আধজন মারা যেতেন।
রামমোহন মৃত্যুর সময়ে বাড়িতে এক বিধবা কন্যা ও দুটি শিশুপুত্রসন্তান রেখে যান। রামমোহন দত্তর বড় ছেলে দুর্গাপ্রসাদ, বিবেকানন্দর পিতামহ। তিনিও এটর্নি অফিসে যুক্ত ছিলেন এবং কোনো এক দুর্ঘটনায় তার জীবনের গতি পরিবর্তনের কথা আমরা ভূপেন্দ্রনাথের তথ্যপূর্ণ রচনা থেকে সংগ্রহ করেছি।
শরিকী টেনশন তখনও ছিল, কারণ যৌথ পরিবারে তাঁর স্ত্রী অপমানিত হয়েছেন এই দুঃখে দুর্গাপ্রসাদ একবার বসতবাটি ত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি যে সন্ন্যাসী হয়ে যান তা অনেকেরই জানা। সন্ন্যাসী হয়ে যাবার পরও দুর্গাপ্রসাদ মাঝে মাঝে টার্টু ঘোড়ায় চড়ে উত্তর ভারত থেকে কলকাতায় আসতেন এবং তাঁর এক ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে বাস করতেন। একবার তাকে আটকাবার জন্যে দরজায় তালা লাগানো হয়, তিনদিন পরে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে দেখা যায়, তখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গৃহত্যাগী দুর্গাপ্রসাদ আর কখনও ফেরেননি।
নরেন্দ্রপিতাবিশ্বনাথদত্ততারকাকারকরুণায় প্রায় অনাথরূপেপ্রতিপালিত হন। স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কয়েকবার ব্যবসায় নামতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তেমন সফলনা হতে পেরে একসময় (১১ এপ্রিল ১৮৫৯)এটর্নি চার্লস এফ পিটারের অধীনে আর্টিকেল ক্লার্ক হন এবং পরে (২৯ জানুয়ারি ১৮৬১) এটর্নি হেনরি জর্জ টেম্পলের অফিসে আর্টিকেল ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন এবং সেখানে ১০ অক্টোবর ১৮৬৪ পর্যন্ত কাজ করেন। ১৪ মার্চ ১৮৬৬ প্রধান বিচারপতি স্যার বার্নের্স পিকক-এর এজলাসে ‘এটর্নি’ ও ‘প্রক্টর’ রূপে নাম লেখাবার জন্য বিশ্বনাথ দরখাস্ত করেন। আবেদনের সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্ত দুখানি সার্টিফিকেট দাখিল করেন–দুটি সার্টিফিকেটের তারিখ ৭ জানুয়ারি ১৮৬৫, দাতাদের নাম শ্রী গ্রীস’ চন্দ্র বনার্জি ও শ্রী ‘দিগাম্বের’ মিটার। একই দিনে এই আবেদনে সম্মতি দেন মিস্টার জাস্টিস ওয়ালটার মরগ্যান। বিচারপতি মরগ্যান পরে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রধান বিচারপতি হন। আইনপাড়ায় বিশ্বনাথের কোম্পানির নাম ছিল ধর অ্যান্ড দত্ত। তার পার্টনার আশুতোষ ধর।
ভূপেন দত্ত জানিয়েছেন, তাঁর সাহিত্যপ্রেমী পিতৃদেব একখানি উপন্যাস লিখেছিলেন এবং অর্থাভাব থাকায় বইটি পিতামহর খুড়তুতো ভাই, ডাকবিভাগের পদস্থ কর্মচারী গোপালচন্দ্র দত্তর নামে প্রকাশিত হয়। অপরের নামে নিজের রচিত গ্রন্থ প্রকাশের একই দুর্ভাগ্য পুত্র বিবেকানন্দর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। পূর্বাশ্রমে অপরের নামে এমনকি প্রকাশকের নামে তিনি বছর বেঁচেছিলেন, একমাত্র মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নিগ্রহ, যৌথপরিবার থেকে বিতাড়ন, অনেকগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে অকাল-বৈধব্য, অভাবনীয় ভাগ্যবিপর্যয়, এমনকি প্রাণাধিক নাতি বিলুর অকালমৃত্যুর অসহায় সাক্ষী এই রঘুমণি দেবী। বিডন স্ট্রিটের ঘোষপরিবারের মেয়ে, পিতা গোপালচন্দ্র ঘোষ, জন্ম ১৮২৫। রঘুমণি ছিলেন পরম বৈষ্ণব।
সুবিশাল যৌথপরিবারে বিবাহিতা হয়েও বিপদের সময় সহায়সম্বলহীন মেয়ের পাশে কেউ নেই, স্বামী প্রয়াত, উপার্জনের পথ নেই, জ্যেষ্ঠপুত্ৰ সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, মধ্যমটি নিজের খেয়ালে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায় এবং ছোটটি সাবালক হয়েই স্বদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে জড়িত হয়ে প্রথমে জেলে গিয়ে ঘানি টানা এবং মুক্তি পেয়ে আবার গ্রেপ্তার হবার আশঙ্কায় চুপিচুপি বেনামে দেশছেড়ে পালিয়ে দীর্ঘকাল স্বেচ্ছানির্বাসিত। এই কঠিনসময়ে আদরের ভুবনেশ্বরীর পাশে যিনি সবসময় ছিলেন এবং প্রয়োজনে কন্যাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। বিবেকানন্দ-মাতামহী রঘুমণি। পরম বৈষ্ণব এই মহিলা তার কন্যার দেহাবসান পর্যন্ত বেঁচেছিলেন এবং ১৯১১ সালে ভুবনেশ্বরীকে মরণসাগরের ওপারে পার করে দিয়ে, ঠিক একদিনের ব্যবধানে দেহরক্ষা করেন। মেনিনজাইটিস রোগে ভুবনেশ্বরীর মৃত্যু ২৫ জুলাই ১৯১১, আর রঘুমণির শেষ বিদায় ২৭ জুলাই। তার মৃত্যুকালীন বাসস্থান নিমতলা গঙ্গাযাত্রী নিবাস। আপনজন বলতে মহেন্দ্রনাথ, ঘাটের রেজিস্টারে নাতির সই আছে। ভূপেন্দ্রনাথের বইতে দিনগুলি সম্পর্কে একটু পার্থক্য আছে। আমরা কর্পোরেশন রেকর্ডের উল্লেখ করলাম।
মামা নেই, কিন্তু বিলুর মামাবাড়ি আছে। মাতৃ-আলয়েই অসহায়া ভুবনেশ্বরীকে সপরিবারে বারবার আশ্রয় নিতে হয়েছে। এই মামার বাড়িতেই ছিল ভুবনেশ্বরীর প্রাণবন্ত জ্যেষ্ঠপুত্রের নিত্য আনাগোনা। অনেক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার সাক্ষী রামতনু বসু লেনের এই মাতুলালয়। প্রথম পর্বে এই বাড়ির আরেকজন বসবাসকারিণী বিবেকানন্দর ঝিমা (প্রমাতামহী) রাইমণি দেবী, স্বামী মারা যাওয়ার পরে তিনি নিজ কন্যা রঘুমণির কাছেই বাস করতেন।
পিতৃদেব বিশ্বনাথের জীবনযাত্রার ওপর সামান্য আলোকপাত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিফল হয়ে তিনি আইনব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেন এবং সেই সঙ্গে নীলামে সম্পত্তি কিনে সময়মতো তা বেচে দিয়ে তিনি অর্থবান হতেন। এই কেনাবেচায় তিনি স্ত্রী ভুবনেশ্বরীর নাম ব্যবহার করতেন।
বিশ্বনাথের কাকা কালীপ্রসাদের দুই ছেলে–একজনের নাম কেদারনাথ এবং অপরজন তারকনাথ। তারকনাথ কলকাতা হাইকোর্টে নামী উকিল হয়েছিলেন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারী সেরেস্তার অনেক মামলা-মোকদ্দমা তিনি করতেন এবং সেই সুবাদে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় ছিল। তারকনাথের ছয় কন্যা এবং তাদেরই কারও বিয়েতে ঠাকুরপরিবারের বিশিষ্ট সদস্যরা (রবীন্দ্রনাথ সহ) গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলেন। বিশিষ্ট অতিথিদের বসাবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়েছিল। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের তখনও নাম হয়নি।
তারকনাথের বিধবা, অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী-পুত্রদের খুড়িমাকে কেন্দ্র করেই বিরাট মামলার সূত্রপাত। মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে খুড়িমা জ্ঞানদাসুন্দরী সর্বস্বহারা হয়ে শেষজীবনে বিবেকানন্দর সাহায্যপ্রার্থিনী হন। এমনই ভবিতব্যের রসিকতা, যাঁর খামখেয়ালিপনায় ভুবনেশ্বরীর সোনার সংসার দুঃস্থ হলো, তিনিই আবার আশ্রয় চাইলেন ভুবনেশ্বরীর সংসারত্যাগী সন্তানের কাছে। স্বামীজির দেহাবসানের পর খুড়িমা যে বেলুড়ে নরেনকে দেখতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তার বিবরণও আমাদের হস্তগত হয়েছে।
শরিকদের সঙ্গে মামলার সময় বিবেকানন্দর পিতার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে নানা ইঙ্গিত ওঠে। কারও অভিযোগ তিনি বিশাল দেনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং পাওনাদারদের এড়াবার জন্যে কিছুদিনের জন্য কলকাতা ছেড়ে রায়পুরে প্র্যাকটিস করেন। জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্রনাথের রায়পুরের পথে মাংস রান্না করা এবং বৈষ্ণবী দিদিমার প্রভাবে নিরামিষাশী মধ্যমভ্রাতাকে জোর করে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টার চমৎকার একটা দৃশ্য মহেন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন।
রায়পুর থেকে উত্তর ভারতের কয়েকটি জায়গায় বিভিন্ন সময়ে বিশ্বনাথের ওকালতির যে ছবি আমরা পাই তাতে তিনি যে ব্রীফলেস উকিল ছিলেন তা মোটেই মনে হয় না। নরেন্দ্রনাথের বয়স যখন চোদ্দ (১৮৭৭) তখন বিশ্বনাথ রায়পুরে ছিলেন এবং কয়েকমাস পরে নিজের পরিবারের সবাইকে তিনি রায়পুরে নিয়ে যান। মেট্রোপলিটান ইস্কুলে পড়াশোনা ছেড়ে দেড় বছর নরেন্দ্রনাথ রায়পুরে ছিলেন এবং ১৮৭৯ সালে কলকাতায় এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। পরের বছর ১৮৮০ সালের ২৭ জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথ দশ টাকা ভর্তি ফি দিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই বেতনের রসিদেরছবি ভূপেন্দ্রনাথের বইতে মুদ্রিত হয়েছে।
প্রচুর উপার্জনের সঙ্গে প্রচুর বেহিসেবী ব্যয়ের ব্যাপারে অনেক উকিল এবং ডাক্তার এদেশে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গিয়েছে। বিশ্বনাথ দত্ত বেশি রোজগার না কম রোজগার করেছেন তা নিয়ে মাথাব্যথার কোনো কারণ থাকতো না যদি না তার মৃত্যুর পরে শরিকী মামলায় তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের বউ আদালতে অভিযোগ করতেন যে ভুবনেশ্বরীর ভূসম্পত্তি সবই তার স্বামী তারকনাথের উপার্জিত অর্থে বেনামে যৌথপরিবারের ভ্রাতৃবধূ ভুবনেশ্বরীর নামে কেনা হয়েছিল। এসব সম্পত্তি কেনার কোনো আর্থিক সঙ্গতিইনাকি ছিল না ভুবনেশ্বরীর স্বামীর। এমনকি বিশ্বনাথের অনুপস্থিতিতে কলকাতায় স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের ভরণপোষণ হয়েছে খুডোর পয়সায়।
শরিকী মামলায় হাজার রকম অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ ওঠে, সে নিয়ে কেউ তেমন উদ্বিগ্নও হন না, কিন্তু এক্ষেত্রে এইসব অভিযোগের আইনী মোকাবিলার জন্যে বৈরাগী বিবেকানন্দকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।
কিন্তু বিশ্বনাথ পরিবার যে লক্ষ্মীর কৃপাধন্য ছিলেন তার অনেক নমুনা আমরা ভ্রাতৃস্মৃতি থেকে পাচ্ছি। যেমন ধরুন খাওয়া-দাওয়ার কথা। শুনুন বড় ও মেজ দুইভাইয়ের জলখাবারের কথা। তখন কলকাতার পাঁঠার দোকানে পাঁঠার মুড়ি বিক্রি হতো না। দুইভাই নরেন্দ্র ও মহেন্দ্র পাঠাওয়ালার সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। দুই চার আনায় দশ বারোটা পাঁঠার মাথা যোগাড় হতো। দশ বারোটা মুড়ি ও সের দুই আড়াই কড়াইশুটি–একসঙ্গে ফুটিয়ে তরকারি। মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিকেলে আমি ও স্বামীজি স্কুল থেকে এসে ওই তরকারি ও খান-ষোল করে রুটি জলখাবার খেতাম।”
আর একদিনের কথা। “বড়দা একবার নিলামে ফিরিঙ্গিপাড়া থেকে পাঁচ আনা দিয়ে কেটলি কিনে আনলো। ওপরটা কালিঝুলি মাখা–ওমা, ভুসোগুলো উঁচতে চাচতে দেখি, ভিতরটা খাঁটি রুপো!”
এইসব ঘটনা সংসারে অর্থকষ্টের ইঙ্গিত দেয় না, বরং প্রাচুর্যের কথাই বলে। ১৮৮০-৮৪ সাল সস্তাগণ্ডার সময়, তখন শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তদের অফিসে মাস মাইনে ছিল পনেরো টাকার মতন। সেই সময় ভুবনেশ্বরী দেবীর পারিবারিক সংসার খরচ ছিল মাসে হাজার টাকা!
.
মায়ের কথায় আবার আসা যাক। বিবেকানন্দ তাঁর বন্ধুদের বলতেন, “আমি কি অমনি হয়েছি, আমার জন্যে আমার মা কত তপস্যা করেছেন।” অন্যত্র তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেছেন, “আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি মায়ের কাছে ঋণী।”
ভুবনেশ্বরীর গায়ের রঙ ছিল ফর্সা, কণ্ঠ সুমধুর, প্রতি পদক্ষেপে আভিজাত্য, বুদ্ধিমতী, কার্যকুশলা, মিতভাষিণী, গম্ভীর প্রকৃতি, আলাপে মিষ্টস্বভাব, কিন্তু তেজস্বিনী। ছেলেকে তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন, “আজীবন পবিত্র থাকিও, নিজের মর্যাদা রক্ষা করিও, কখনও অপরের মর্যাদা লঙ্ঘন করিও না। খুব শান্ত হইবে, কিন্তু আবশ্যক হইলে হৃদয় দৃঢ় করিবে।”
এমন মায়ের ছেলে বলেই, জোরগলায় বিবেকানন্দ বলতে পেরেছেন, “যে মাকে সত্য সত্য পূজা করতে না পারে, সে কখনও বড় হতে পারে না।”
বড় কঠিন কথা, কিন্তু আমাদের এই দেশে নিতান্ত ফেলে দেবার মতন আদর্শ নয়। একজন বিদেশিনী অনুরাগিনী একবার রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখেছিলেন, এঁদের প্রায় সবার ওপর গর্ভধারিণী জননীর প্রভাব খুব বেশি, সে তুলনায় বাবার প্রভাব উল্লেখযোগ্য নয়।
নরেনের সমীক্ষা ভুবনেশ্বরী দেবী নিজেই ভালভাবে করেছে। তিনি বলতেন, “ছেলেবেলা থেকে নরেনের একটা মস্ত দোষ ছিল, কোন কারণে রাগ হলে আর জ্ঞান থাকতো না, বাড়ির আসবাবপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করতো।”
তার দুই দিদি (হারামণি ও স্বর্ণময়ী) ভাইয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হতেন। কখনও তাড়া করে তাকে ধরতে গেলে বিলু দৌড়ে গিয়ে আঁস্তাকুড়ে আশ্রয় নিতেন এবং সেখানে মনের সাধে ভেঙচাতে ভেঙচাতে মৃদুহাস্য সহকারে বলতেন, “ধর না, ধরনা।” শিষ্যদের কাছে পরবর্তীসময়ে স্বামীজির সপ্রসন্ন স্বীকারোক্তি, “ছেলেবেলায় আমি বড় ডানপিটে ছিলাম, তা না হলে কি আর একটা কানাকড়ি সঙ্গে না নিয়ে দুনিয়াটা ঘুরে আসতে পারতুম রে।”
মায়ের চরিত্রের আর একদিক বিবেকানন্দকে মুগ্ধ করেছিল। ভুবনেশ্বরীর। সংযমশক্তি। “মা একবার সুদীর্ঘ চোদ্দ দিন উপবাসে কাটিয়েছিলেন।” এই শক্তির প্রতিফলন আমরা বিবেকানন্দর জীবনের শেষপর্যন্ত দেখেছি, তিরোধানের কিছুদিন আগে কবিরাজের উপদেশ অনুযায়ী একুশ দিন তিনি জল না খেয়েই সবার বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিলেন।
সুখী সোনার সংসারের শত শত কাহিনী বিভিন্ন স্মৃতিকথায় ছড়িয়ে আছে। এই আনন্দময় বিবেকানন্দকে আমার ভীষণ ভাল লাগে। যেমন ধরুন, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয়ভক্ত গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র দত্তের কথা। এই আত্মীয়ের বিয়েতে নরেন মহানন্দে নিতবর হয়েছিলেন।
ছোটবেলায় দত্ত পরিবারের স্বর্ণযুগ প্রসঙ্গে প্রবীণ মহেন্দ্রনাথ একবার একটা দামী কথা বলেছিলেন, “মানুষের শেষজীবনে সমস্ত ছেলেবেলাকার ভাব, বংশের ধারা ফিরে আসে। এই দ্যাখ, ছেলেবেলায় যেসব খেতুম, যেসব শখ ছিল, এখন সেইসব মনে হচ্ছে–সেই কড়াইয়ের ডালের বড়া, ধোঁকা, এইসব। এইরকম হয়। স্বামীজি শেষটায় তখন মঠে আছেন। একদিন বললেন–”আমায় সব যোগাড় করে দে। আমি ফুলুরি করব। তেল, কড়া, বেসন সব দেওয়া হল, মায় খুরো দেওয়া সিঁড়ি পর্যন্ত স্বামীজি ঠিক ফুলুরিওয়ালার মতন করে বসলেন, হাঁটু থেকে কাপড় গুটোলেন, ফুলুরি ভাজতে ভাজতে ছেলে মানুষের মতো খদ্দের ডাকতে লাগলেন, আয় খদ্দের আয়।”
.
বিশ্বনাথ দত্তের শারীরিক অসুস্থতা এবং আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভুবনেশ্বরী ও তার জ্যেষ্ঠপুত্রের অন্তহীন অগ্নিপরীক্ষার শুরু। তবে তার কিছু আগেই শরিকী সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে। এই বিরোধ কী ধরনের তার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের হাতে নেই, কিন্তু আমরা জানি যৌথপরিবারের বিষাক্ত পরিবেশে তিতিবিরক্ত ভুবনেশ্বরী ও পুত্রকন্যাদের নিয়ে বিশ্বনাথ তাঁর মৃত্যুর আগের বছরে ছাতুবাবু বাজারের কাছে ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনে একটা বাড়িভাড়া করে উঠে যান। কিন্তু পরে তিনি সপরিবারে আবার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে আসেন। বিশ্বনাথ পরিবারের এই ফিরে আসায় উকিল খুড়ো তারকনাথ তেমন খুশি হননি বলে শোনা যায়।
বাবামায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে ভুবনেশ্বরী কিছু পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েছিলেন। পিতার বসতবাটি এবং চারকাঠা সম্পত্তি তার ছেলেরা ভোগদখলের অধিকারী। বিশ্বনাথ নিজেও তাঁর মাতামহের কাছ থেকে একটা বাগানবাড়ি উপহার পেয়েছিলেন।
এবার শুনুন বিবেকানন্দর ছোটভাইয়ের মুখে : “অকস্মাৎ আবির্ভূত হলেন বিশ্বনাথের মেজমামা। তিনি এসে ভাগ্নের কানে কি পরামর্শ দিলেন। বিশ্বনাথ সে সম্পত্তি মামার নামে লিখে দিলেন। আমার মায়ের কাছে এ কাহিনী শুনেছি। তিনি একার্যের সমর্থন করতেন। তিনি বলতেন, ঐ সম্পত্তি লিখে না দিলে মাতামহের কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি কাকাই আত্মসাৎ করে নিতেন। সে সময়ে পরিবারের সমস্ত অংশীদাররা মধু রায় লেনের বাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করছিলেন। বিশ্বনাথ তাঁর নিজের অংশ কাকার নামে লিখে দেন।”
বিশ্বনাথের মৃত্যু তারিখ কলকাতা কর্পোরেশনের খাতায় লেখা ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, কিন্তু হাইকোর্টে ভুবনেশ্বরীর আবেদনপত্র অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, তবে তাঁর মৃত্যুকালীন বাসস্থান যে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট তার প্রমাণ কর্পোরেশনের খাতায় রয়েছে। রাত্রে তার বুকে ব্যথা ও হার্ট অ্যাটাক হয়, যদিও ডেথ রেজিস্টারে কেবল ডায়াবিটিসের উল্লেখ আছে। শ্মশানে সংবাদদাতা হিসেবে ইংরিজিতে পুরো স্বাক্ষর করেছেন পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্ত। আকস্মিক মৃত্যুকালে নরেন্দ্রনাথ এক বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে গিয়েছিলেন, গভীর রাতে তিনি খবর পান এবং বোধহয় সোজা শ্মশানে চলে আসেন। ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “পরদিন সকালবেলায় তাঁর বড় ছেলের জন্যে কনে দেখতে যাবার কথা ছিল।”
নরেন্দ্রনাথের বিবাহ প্রস্তাব সম্পর্কে বেশ কিছু বিবরণ ভূপেন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায়। পিতার মৃত্যুর পরেও পিতৃবন্ধু কলকাতার হাইকোর্টের এক এটর্নি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যদি তার নাতনীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাহলে তিনি পারিবারিক মামলার সব ব্যয়ভার বহন করবেন।
পিতা-পুত্রের মৃত্যুর আকস্মিকতার মধ্যেও যথেষ্ট মিল আছে। সঙ্কট আসে রাত ন’টা নাগাদ। সন্ন্যাসী পুত্রের মৃত্যুসংবাদ বেলুড় থেকে এক সকালে কলকাতায় এল। মা জানতে চাইলেন হঠাৎকী হলো? ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, “বাবার যা হয়েছিল।” মা ও দিদিমা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন।
ভুবনেশ্বরীর জন্ম ১৮৪১ সালে, স্বামীর যখন ১৬ বছর বয়স তখন বিয়ে, পরের পর দশটি সন্তানকে গর্ভে ধারণ। একের পর এক সন্তানশোক পেয়েছেন। তেতাল্লিশ বছর বয়সে কপর্দকশূন্য অবস্থায় নাবালক ছেলেমেয়ে নিয়ে বৈধব্য, প্রায় একই সময় প্রাণান্তকর মামলায় ভিটেমাটি ছাড়া হওয়ার অবস্থা, যে ছেলে রোজগেরে হয়ে সংসারের হাল ধরতে পারতো তার সন্ন্যাস গ্রহণ, কন্যার আত্মহনন এবং একষট্টি বছর বয়সে সন্ন্যাসীপুত্রের মৃতদেহের সামনে বসে থাকা। সংসারে একজন মায়ের জন্য আর কত যন্ত্রণাই বা থাকতে পারে?
সময়সীমার অনেক আগেই মৃত্যু উপস্থিত হয়ে বিবেকবান সন্ন্যাসীর সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছিল কেমনভাবে তা কারও অজানা নয়। কিন্তু জীবনযাত্রার মধ্যপথে কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরে নগ্নপদে বিচরণ করতে গিয়ে তিনি কেমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন এবং রক্তমাখা চরণতলে পথের কাটাকে তিনি কেমন নির্ভীকভাবে দলনের চেষ্টা করেছিলেন তার সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা থাকলে, এদেশের সংখ্যাহীন হতদরিদ্র এবং ভাগ্যহত মানুষ জীবনসংগ্রামে জয়ী হবার ভরসা খুঁজে পাবেন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, জীবন কী তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তার অনুগত শিষ্য এবং দুঃখ দিনের পরম বন্ধু খেতড়ির রাজা অজিত সিংকে স্বামীজি বলেছিলেন, সতত প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ এবং আত্মবিকাশের চেষ্টার নামই জীবন।
*
সুখের সংসারে আগুন লেগে রাতারাতি বাঙালি পরিবার কীভাবে বিপর্যস্ত হয় তার ছবি আঁকার আগে সুখী গৃহকোণের আরও দু’একটা খবর সংগ্রহ করা যাক।
দাদা নরেন যে কমবয়স থেকে নস্যি নিতেন এবং মশারিতে তার গন্ধ পাওয়া যেতো একথা মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ সবিনয়ে আমাদের জানিয়েছেন। পায়রা ওড়াবার পারিবারিক শখ ছিল, আঙুলের কায়দায় দেওয়ালে ছায়াছবি দেখিয়ে নরেন্দ্রনাথ ভাইদের তাক লাগাতেন, খেলতেন একধরনের ক্রিকেট যার তদানীন্তন বাংলা নাম ব্যাটম্বল। এক মাস্টারমশাই তার মেজভাইয়ের মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন বলে স্কুল সুপার ব্রজেন্দ্রনাথ দে-কেনরেন্দ্রনাথ এমন চিঠি লিখেছিলেন যে মাস্টারমশায়ের যোগ্য শাস্তি হয়েছিল।
গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী একবার স্বামী অখণ্ডানন্দকে বলেছিলেন, বালককালে এবং বড় হয়েও আমার বড় ছেলে কখনও বেলা অবধি ঘুমোয়নি। যত দেরিতেই শোওয়া হোক, বিলু উঠতো খুব ভোরে।
সেকালে প্রতিষ্ঠিত পরিবারে নাপিতদের গৃহ আগমনে ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন হতো। বিবেকানন্দকে কিন্তু বেলুড়ে আমরা ঝটপট ক্ষুর চালাতে দেখেছি। আয়না সামনে না রেখেই এই কাজ তিনি নিপুণভাবে সম্পন্ন করতে পারতেন এবং রসিকতা করে বলতেন আমেরিকায় তার দুর্ভোগের কথা। এক সেলুনে তাঁর দাড়ি কামানো হলো না, কারণ একজন কালা আদমিকে কামালে সায়েবরা আর এই দোকানের দিকে পা বাড়াবেন না।
সোনার সংসার পর্বের আর একটি টিপিক্যাল বাংলা দৃশ্য: দুটো তক্তপোষ জুড়ে ঢালা বিছানা, সেখানে শুয়ে আছেন প্রথমে বিলু, পরে মহেন্দ্র, ছোটবোন, দিদিমা ও মা। এই সময়ে পিতৃদেব বিশ্বনাথ বিদেশে এবং ছোটভাইয়ের জন্ম হয়নি।
মাতৃকুল বৈষ্ণব আর পিতৃকুল শাক্ত, তাই দুটো ভাবই বিশ্বনাথ পরিবারে প্রবাহিত হত। দিদিমার মা রাইমণি যখন বেঁচেছিলেন তখন শেষরাতে ঘুম ভাঙিয়ে তিনি কৃষ্ণকথা শোনাতেন। এঁদের পাল্লায় পড়ে, তুলসীগাছে জল না দিয়ে মহেন্দ্রনাথ কিছু খেতেন না। মুগের ডাল, পুঁইশাক, পেঁয়াজ হাঁড়িতে ছোঁয়ানো যেতো না। গোবর পর্যন্ত খেতে হতো। ভুবনেশ্বরীর পরিবারে এসময় বিদেশি ফুলকপিও অচল ছিল। এহেন ভাই, দাদা ও মা সেবার বাবার সঙ্গে রায়পুরে যাচ্ছে। মহেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, “ঘোড়াতালাতে মাংস রান্না হল। আমি খাব না। দাদা মুখে মাংস গুঁজে দিয়ে পিঠে কিল মারতে লাগল, বলল খা। তারপর আর কি! বাঘ রক্তের আস্বাদ পেলে যা হয়।”– মায়ের দেওয়া শিক্ষাতেই বিবেকানন্দ চরিত্রের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল। একবার ভুবনেশ্বরী তার বড় ছেলেকে বলেছিলেন, “ফল যা হোক না কেন, সর্বদা যা সত্য বলে মনে করবে তাই করে যাবে। অনেক সময় হয়তো। এর জন্য অন্যায় অপ্রীতিকর ফল সহ্য করতে হবে, তবু সত্য কখনো ছাড়বে না।” জননী নিজেই দুঃসাহসের পথে নিজের ছেলেকে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন বলে আমরা যথাসময়ে বীরসন্ন্যাসীকে পেয়েছিলাম, সত্যের ব্যাপারে দর-কষাকষি করেননি বলেই যুগপুরুষের মর্যাদা লাভ করতে পেরেছিলেন ঘরছাড়া বিবেকানন্দ।
বিদেশে এক বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেন, “জননীর নিঃস্বার্থপ্রেম ও পূতচরিত্র উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হওয়াতেই তিনি জীবনে যা কিছু সৎকার্য করিয়াছেন, সমস্তই সেই জননীর কৃপাপ্রভাবে।” আর একবার মায়ের অদ্ভুত আত্মসংযমের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আর কোন রমণীকে তিনি কখনও তার মায়ের মতন দীর্ঘকাল উপবাস করতে দেখেননি। তিনি নাকি একবার উপর্যুপরি চোদ্দ দিন উপবাস করেছিলেন।
সুখী সংসারের সভ্য হিসেবেই বিলু বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটে পরীক্ষা দিয়েছিল–এনট্রান্স, এফ এ এবং বি এ। পরীক্ষায় ফলাফল কিন্তু তেমন চিত্তাকর্ষক হয়নি। ইংরিজি ভাষায় যিনি আমেরিকা এবং ইংলন্ড জয় করবেন, তার ইংরিজিতে নম্বর এন্ট্রান্সে ৪৭, এফ এ তে ৪৬ এবং বি এতে ৫৬। এফ এ এবং বি এ তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ। অনেক চেষ্টায় বিবেকানন্দর মার্কশিট যাঁরা উদ্ধার করেছেন তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কৌতূহলীদের জন্য সোনার সংসারের সোনার ছেলের নম্বরগুলো লিপিবদ্ধ করা হল :
এনট্রান্স
ইংরিজি – ৪৭
দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৭৬
ইতিহাস – ৪৫
অঙ্ক – ৩৮
মোট – ২০৬
.
এফ এ
ইংরিজি – ৪৬
দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৩৬
ইতিহাস – ৫৬
অঙ্ক – ৪০
লজিক (৫০ নম্বর) – ১৭
সাইকোলজি (৫০ নম্বর) – ৩৪
মোট – ২২৯
.
বি এ
ইংরিজি – ৫৬
দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৪৩
অঙ্ক – ৬১
ইতিহাস – ৫৬
ফিলসফি – ৪৫
মোট – ২৬১
একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং তুলনাহীন বাংলা ও ইংরিজির লেখকের নম্বরের হাল দেখে আশাকরি আজকের কম নম্বর-পাওয়া ছাত্ররা কিছুটা ভরসা পাবেন। যা মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভাল বা খারাপ নম্বরের সঙ্গে জীবনের পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের প্রায়ই কোনো সঙ্গতি থাকে না। আরও যা ভাববার বিষয়, আজও কেন আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতি মানুষের যথার্থ গুণাবলীর মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয় না?
*
সোনার সংসারের সোনার ছেলে নরেন্দ্রনাথ প্রায়ই একই সময়ে দুটি প্রবল ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়েছিলেন। এক, আধ্যাত্মিক জগতের বিপুল আলোড়ন–দক্ষিণেশ্বরের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, দ্বিতীয়, পিতা বিশ্বনাথের আকস্মিক মৃত্যুতে পারিবারিক বিপর্যয়, এমন এক পরিস্থিতিতে যখন একুশ বছর বয়সের ওকালতি-পড়া জ্যেষ্ঠপুত্র ছাড়া কাছাকাছি আর কেউ উপার্জনক্ষম নেই।
বিরাট সংসারের বিরাট খরচ, কিন্তু উপার্জনের কোনো রকম পথ নেই; এবং সুযোগ বুঝে শরিকদের মামলা-মোকদ্দমা, যাতে বিধবা ভুবনেশ্বরী অসহায় ছেলেমেয়েদের হাত ধরে ভিটেমাটি ছাড়া হন।
একান্নবর্তী পরিবারের অভিশাপ যে কত নিষ্করুণ তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামীজির ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ জীবনসায়াহ্নে দুঃখ করেছেন, যাঁরা এই একান্নবর্তী পরিবার-প্রথার পবিত্রতা সম্বন্ধে গলাবাজি করে থাকেন তারা বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত নন। পারিবারিক কলহবিবাদ ও বিয়োগান্ত ঘটনাবলী তারা উপেক্ষা করে থাকেন। ভূপেন্দ্রনাথের মতে, “বর্তমান সমাজে এই প্রথা চালু রাখার স্বপক্ষে কোনো কারণই থাকতে পারে না।”
বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর কেউ তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে একটি কপদক দিয়েও সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে আসেননি। এই অপ্রিয় সত্যটুকু ভুবনেশ্বরীর কনিষ্ঠ সন্তান লিখিতভাবে জানিয়েছেন। “অথচ কলকাতাতেই আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন। কিন্তু বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর সকলেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সমাজ, আত্মীয়-স্বজন আমাদের কথা বিস্মৃত হলো…জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম”, দুঃখ করেছেন ভূপেন্দ্রনাথ।
শেষ দিকে বিশ্বনাথবাবু তাঁর এটর্নি অফিসের ওপর তেমন নজর রাখতেন না। যে বন্ধুর ওপর তিনি কোম্পানির ভার অর্পণ করেন তিনি সুযোগ বুঝে বিশ্বনাথের নামে ঋণ করে সেইসব অর্থ আত্মসাৎ করতে থাকেন।
বাবার শ্রাদ্ধশান্তির পরেই দাদা নরেন্দ্রনাথ বুঝলেন, আর্থিক অবস্থা ভয়াবহ। তখন ছোটভাই নিতান্তই শিশু। জ্যেষ্ঠভ্রাতা স্বয়ং এসময়কার বৃত্তান্ত আমাদের জন্যে মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করে গিয়েছেন :
“মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল। অনাহারে ছিন্নবস্ত্রে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে অফিস হইতে অফিসান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম … কিন্তু সর্বত্রই বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। সংসারের সহিত সেই প্রথম পরিচয়েই বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল, স্বার্থশূন্য সহানুভূতি এখানে অতীব বিরল দুর্বলের, দরিদ্রের এখানে স্থান নাই। দেখিতাম, দুইদিন পূর্বে যাহারা আমাকে কোন বিষয়ে কিছুমাত্র সহায়তা করিবার অবসর পাইলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছে, সময় বুঝিয়া তাহারাই এখন আমাকে দেখিয়া মুখ বাঁকাইতেছে এবং ক্ষমতা থাকিলেও সাহায্য করিতে পশ্চাৎপদ হইতেছে। দেখিয়া শুনিয়া কখনো কখনো সংসারটা দানবের রচনা বলিয়া মনে হইত। মনে হয়, এই সময়ে একদিন রৌদ্রে ঘুরিতে ঘুরিতে পায়ের তলায় ফোস্কা হইয়াছিল এবং নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া গড়ের মাঠে মনুমেন্টের ছায়ায় বসিয়া পড়িয়াছিলাম। দুই একজন বন্ধু সেদিন সঙ্গে ছিল, অথবা ঘটনাক্রমে ঐস্থানে আমার সহিত মিলিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে একজন বোধ হয় আমাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য গাহিয়াছিল—’বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মনিঃশ্বাস পবনে।’
“শুনিয়া মনে হইয়াছিল মাথায় যেন কে গুরুতর আঘাত করিতেছে। মাতা ও ভ্রাতাগণের নিতান্ত অসহায় অবস্থার কথা মনে উদয় হওয়ায় ক্ষোভে নিরাশায় ও অভিমানে বলিয়া উঠিয়াছিলাম, ‘নে নে চুপ কর! ক্ষুধার তাড়নায় যাহাদিগের আত্মীয়বর্গকে কষ্ট পাইতে হয় না, গ্রাসাচ্ছাদনের তাড়া যাহাদিগকে কখনো সহ্য করতে হয় নাই, টানাপাখার হাওয়া খাইতে খাইতে তাহাদিগের নিকট ঐরূপ কল্পনা মধুর লাগিতে পারে; আমারও একদিন লাগিত। কঠোর সত্যের সম্মুখে উহা এখন বিষম ব্যঙ্গ বলিয়া বোধ হইতেছে।”
অন্য পরিস্থিতিতে নরেন্দ্রনাথ একদিন মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে যা বলেছিলেন তাও কথাসূত্রে লিপিবদ্ধ আছে : “অনেক দুঃখ কষ্ট পেয়ে তবে এই অবস্থা হয়েছে, মাস্টারমশাই, আপনি দুঃখকষ্ট পান নাই তাই; জানি দুঃখকষ্ট না পেলে ঈশ্বরের হস্তে সমর্পণ হয় না।”
পারিবারিক অবস্থা সম্বন্ধে বিলুর নিজের মুখেই আরও কথা : “প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম, গৃহে সকলের পর্যাপ্ত আহার্য নাই, সেদিন মাতাকে আমার নিমন্ত্রণ আছে, বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে ঘরে বাহিরে কাহারও নিকটে ঐকথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না।”
ধনী বন্ধু কিছু ছিল, কিন্তু তারাও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এবিষয়ে জানতে চেষ্টা করেনি। তাদের মধ্যে বিরল দুই-একজন কখনও কখনও বলতো, “তোকে আজ এত বিষণ্ণ ও দুর্বল দেখছি, কেন বল দেখি? একজন কেবল আমার অজ্ঞাতে অন্যের নিকট হইতে আমার অবস্থা জানিয়া লইয়া বেনামী পত্ৰমধ্যে মাতাকে সময়ে সময়ে টাকা পাঠাইয়া আমাকে চিরঋণে আবদ্ধ করিয়াছিল।”
তখনকার অবস্থা স্বামীজির মুখেই শুনুন। “যৌবনে পদার্পণপূর্বক যে সকল বাল্যবন্ধু চরিত্রহীন হইয়া অসদুপায়ে যৎসামান্য উপার্জন করিতেছিল, তাহাদিগের কেহ কেহ আমার দারিদ্র্যের কথা জানিতে পারিয়া সময় বুঝিয়া দলে টানিতে সচেষ্ট হইয়াছিল। তাহাদিগের মধ্যে যাহারা ইতঃপূর্বে অবস্থার পরিবর্তনে সহসা পতিত হইয়া একরূপ বাধ্য হইয়াই জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য হীনপথ অবলম্বন করিয়াছিল, দেখিতাম তাহারা সত্যসত্যই আমার জন্য ব্যথিত হইয়াছে। সময় বুঝিয়া অবিদ্যারূপিনী মহামায়াও এইকালে পশ্চাতে লাগিতে ছাড়েন নাই। এক সঙ্গতিসম্পন্না রমণীর পূর্ব হইতেই আমার উপর নজর পড়িয়াছিল। অবসর বুঝিয়া সে এখন প্রস্তাব করিয়া পাঠাইল, তাহার সহিত তাহার সম্পত্তি গ্রহণ করিয়া দারিদ্র-দুঃখের অবসান করিতে পারি! বিষম অবজ্ঞা ও কঠোরতা প্রদর্শনে তাহাকে নিবৃত্ত করিতে হইয়াছিল। অন্য এক রমণী ঐরূপ প্রলোভিত করিতে আসিলে তাহাকে বলিয়াছিলাম, বাছা এই ছাই-ভস্ম শরীরটার জন্যে এতদিন কত কি তো করিলে! মৃত্যু সম্মুখে–তখনকার সম্বল কিছু করিয়াছ কি? হীনবুদ্ধি ছাড়িয়া ভগবানকে ডাক।”
ঘটনাস্রোতে আর একবার কয়েকজন বন্ধু নরেন্দ্রনাথকে সুরাপানের পরামর্শ দেয় এবং সুচতুরভাবে এক বারাঙ্গনার কাছে জর্জরিত নরেনকে নিয়ে যায়। তাকে বিদায় করে দিয়ে নরেন্দ্রনাথ সবাইকে বলতে লাগলেন, “আমি আজ মদ ও মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ করেছি।” বাড়িতে গিয়ে নিজের মাকেও ওই কথা তিনি প্রকাশ করেন। খবরটা দিয়েছেন জীবনীকার প্রমথনাথ বসু।
“এক সন্ধ্যায় তাহার জনকয়েক বন্ধু তাহাকে গাড়ি করিয়া তাহাদের কলিকাতার উপকণ্ঠস্থিত এক উদ্যানবাটীতে লইয়া যাইতে চাহিলেন… গানবাজনা খুব হইল, নরেন্দ্রও যথারীতি যোগ দিলেন, কিছুপরে তিনি ক্লান্ত বোধ করিলে বন্ধুরা পার্শ্ববর্তী একখানি ঘর দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, তিনি সেখানে গিয়া বিশ্রাম করিতে পারেন। তিনি একাকী শুইয়া আছেন এমন সময় বন্ধুদের দ্বারা প্রেরিত একটি যুবতী সেই কক্ষে উপস্থিত হইল…সে ক্রমে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করিল এবং ঐ গৃহে আসার অভিপ্রায়ও খুলিয়া বলিল।…নরেন্দ্র বাহিরে যাইবার জন্য পা বাড়াইয়া বলিলেন, “মাপ করবেন; আমায় এখন যেতে হবে।…আপনার মঙ্গল হোক এই আমি চাই। আপনি যদি বুঝে থাকেন যে, এভাবে জীবনযাপন করা পাপ, তবে একদিন না একদিন আপনি এ থেকে উদ্ধার পাবেন নিশ্চয়।”
.
ঘটনাস্রোত থমকে দাঁড়ায়নি। নরেন্দ্রর আত্মজীবনবর্ণনা আমাদের কাছেই রয়েছে, “এত দুঃখ কষ্টেও এতোদিন আস্তিক্যবুদ্ধির বিলোপ কিংবা ঈশ্বর মঙ্গলময়–একথায় সন্দিহান হই নাই। প্রাতে নিদ্রাভঙ্গে তাহাকে স্মরণ-মনন পূর্বক তাহার নাম করিতে করিতে শয্যাত্যাগ করিতাম। একদিন ঐরূপ শয্যাত্যাগ করিতেছি, এমন সময় পার্শ্বের ঘর হইতে মাতা শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘চুপ কর ছোঁড়া! ছেলেবেলা থেকে কেবল ভগবান ভগবান। ভগবান সব তো কল্লেন!’ কথাগুলিতে মনে ভীষণ আঘাত পাইলাম। স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, ভগবান কি বাস্তবিক আছেন এবং থাকিলেও আমাদের সকরুণ প্রার্থনা কি শুনিয়া থাকেন? তবে এত যে প্রার্থনা করি, তাহার কোন উত্তর পাই না কেন? শিবের সংসারে এত অশিব কোথা হইতে আসিল? মঙ্গলময়ের রাজত্বে। এত প্রকার অমঙ্গল কেন?”
আরও বিস্ফোরণ আছে। “গোপনে কোন কার্যের অনুষ্ঠান করা আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল।…সুতরাং ঈশ্বর নাই। অথবা যদি থাকেন তো তাহাকে ডাকিবার জন্য কোন সফলতা বা প্রয়োজন নাই, একথা হাঁকিয়া ডাকিয়া লোকের নিকট সপ্রমাণ করিতে এখন অগ্রসর হইব, ইহাতে বিচিত্র কি? ফলে স্বল্পদিনেই রব উঠিল, আমি নাস্তিক হইয়াছি এবং দুশ্চরিত্র লোকের সহিত মিলিত হইয়া মদ্যপানে ও বেশ্যালয়ে গমনে পর্যন্ত কুণ্ঠিত নই।”
এই সময়ে পাড়ার রিপোর্টও ভাল নয়। এক প্রতিবেশী তার বন্ধু শরৎচন্দ্রকে (পরে স্বামী সারদানন্দ) বলেন, “এই বাটিতে একটা ছেলে আছে, তাহার মতো ত্রিপণ্ড ছেলে কখনও দেখিনি; বি এ পাশ করেছে বলে যেন ধরাকে সরা দেখে। বাপখুডোর সামনেই তবলায় চাটি দিয়ে গান ধরলে, পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে দিয়েই চুরুট খেতে খেতে চললো–এইরূপ সকল বিষয়ে।”
বি এ পাস করেও কলকাতার অফিসপাড়ায় মাসিক ১৫ টাকা মাইনের চাকরি জোগাড় করতে ভবিষ্যতের বিবেকানন্দ যে অসমর্থ হয়েছিলেন তা মার্কিন দেশের ভক্তদের তিনি সুযোগ পেলেই শুনিয়েছেন। এখনকার যুগে যাঁদের ধারণা সকালে কলকাতার চাকরিবাজার খুব লোভনীয় ছিল তারা আশা করি প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারছেন।
সম্বলহীন, অন্নহীন নরেন্দ্রনাথ দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কথামৃতের রচনাকার শ্রীমর স্নেহনজরে পড়লেন। তিনি তখন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক। তার চেষ্টায় নরেন্দ্রনাথ সুকিয়া স্ট্রিটে ইস্কুলের প্রধান শাখায় তিনমাস পড়ান। তারপর সিদ্ধেশ্বর লেন, চাপাতলায় মেট্রোপলিটানের একটা শাখা খোলা হল, ঐখানে হেডমাস্টারের কাজ পেলেন নরেন্দ্রনাথ।
ঐ স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন বিদ্যাসাগরের জামাই–তার বিষনজরে পড়ে গেলেন হতভাগ্য নরেন্দ্রনাথ। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা কলকাঠি এমনভাবে নাড়লেন যে ক্লাস নাইন ও টেনের ছেলেরা যৌথভাবে পিটিশন করলো, নতুন হেডমাস্টার পড়াতে পারে না। জগৎকে নতুন শিক্ষা দেবার জন্যে যাঁর আবির্ভাব, দলবাজির জোরে তার ছাত্ররাই কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করছে, লোকটা পড়াতে পারে না।
বিদ্যাসাগরমশায় পিটিশন দেখেই খোঁজখবর না নিয়েই নির্দেশ দিলেন, তা হলে নরেন্দ্রকে বলো–আর না আসে।নতমস্তকে এই নির্দেশ মেনে নেওয়া ছাড়া নরেন্দ্রর আর কোনো পথ ছিল না। আশ্চর্য এই,নরেন্দ্রনাথের মনে পরবর্তীকালেও কোনো তিক্ততা ছিল না। তাকে সবসময় বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করতে দেখেছি আমরা।
মেট্রোপলিটন ইস্কুলে প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের নমস্য সন্ন্যাসী স্বামী বোধানন্দ। পড়তেন নিচু ক্লাসে, কিন্তু তার বেশ মনে ছিল, আলখাল্লা, চাপকান ও ট্রাউজার পরে নরেন্দ্রনাথ ইস্কুলে আসতেন। সেইসঙ্গে গলায় থাকতো ৬ ফুট লম্বা চাদর, এক হাতে ছাতা এবং অন্যহাতে এনট্রান্স ক্লাসের পাঠ্যপুস্তক।
বিদ্যাসাগরের চাকরি হারিয়ে সিটি স্কুলে একটা মাস্টারির চাকরির জন্য শিবনাথ শাস্ত্রীমশাইকে ধরাধরি করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। বলাবাহুল্য, শাস্ত্রীমশায় দায়টা এড়িয়ে যান। আরও বলে রাখা ভাল, প্রায় এই পর্বে রামকৃষ্ণ ভক্ত শ্ৰীম নিজেই বিদ্যাসাগরের রোষানলে পড়েন। অসুস্থ রামকৃষ্ণের ওখানে ঘন ঘন যাতায়াতের জন্য ছেলেদের পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হয়নি, এমন ইঙ্গিত পাওয়ায় মানসম্মান রক্ষার জন্য ভবিষ্যতের কথা না ভেবেই মাস্টারমশাই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ঠাকুরকে যখন তিনি খবরটা দিলেন তখন অসুস্থ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ তিনবার বললেন, “ঠিক করেছ, ঠিক করেছ, ঠিক করেছ।” চাকরি-বাকরির ব্যাপারে ঠাকুরকে এতো সাফসুফ কথা বলতে আর কখনও শোনা যায়নি।
সৌভাগ্যবশত শ্ৰীমকে অন্নচিন্তায় কাতর হতে হয়নি, কারণ স্যর সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি মহাশয় তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত রিপন স্কুলে সাদরে ডেকে নিয়ে যান বহুগুণের অধিকারী মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে।
কিন্তু ভবিষ্যতের বিবেকানন্দ? শোনা যায়, তিনি গয়ার কাছে কোনো জমিদারি সেরেস্তায় সামান্য একটা কাজ জুটিয়েছিলেন, যদিও শেষপর্যন্ত সেখানে যাওয়া হয়নি। কারণ বাবার মৃত্যুর একবছর পরে ১৮৮৫ সালের মার্চ মাসে নরেন্দ্রনাথ গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বলে আমরা আন্দাজ করতে পারি। এইসব বর্ণনা পাঠ করেই নিন্দুকরা সময় বুঝে বাঁকা প্রশ্ন তুলেছেন, ইনি কি ‘অভাব-সন্ন্যাসী’ না ‘স্বভাব-সন্ন্যাসী’?
মেট্রোপলিটান স্কুল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নরেন্দ্রনাথ আরও কিছু করেছিলেন এমন ইঙ্গিত অন্য কোথাও না থাকলেও, উচ্চতম আদালতের নথিপত্রে তার একটি বক্তব্য ইদানীং আমাদের নজর পড়ে যায়। কলকাতা হাইকোর্টের একটি কাগজে লেখা : মেট্রোপলিটান ছাড়বার পরে “অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে ও তার অধীনে একটি কলেজে আমি কিছুদিন অধ্যাপনা করি।” তখন নরেন্দ্রনাথ আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। উকিলের প্রশ্নের মুখে তিনি স্বীকার করছেন : “আমি বেকার।”
.
পারিবারিক সংকটকালে অভাবের সংসারের কয়েকটি টুকরো টুকরো ছবি বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করে আমরা একটা বড় ছবি নিজেরাই সাজিয়ে নিতে পারি। দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের ইচ্ছা, প্রিয় শিষ্য শরৎ (পরে স্বামী সারদানন্দ) একবার নরেনের সঙ্গে দেখা করে।
“নরেন কায়েতের ছেলে, বাপ উকিল, বাড়ি সিমলে।” এইটুকু ইঙ্গিত পেয়ে ১৮৮৫ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসে কলেজফেরত শরৎ নরেনের গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে হাজির। “কেবল একখানি ভাঙ্গা তক্তপোষের ওপর তুলা বের করা একটা গদি, দু’একটা ছেঁড়া বালিশ আর পশ্চিমদিকে একটা কালো মশারি পেরেকের উপর গুটানো; কড়িকাঠ হইতে একটা টানা পাখার ছেঁড়া ঝালর ঝুলিতেছে।” নরেনের শিরঃপীড়া হয়েছে, নাকে কর্পূরের ন্যাস নিতে হতো। শরৎ তখন গুরুভ্রাতাকে ডাকতেন, নরেনবাবু বলে।
পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমা এই পর্বে ক্রমশই তাল পাকিয়ে উঠছে। পরমহংস মহাশয়ের কাছ থেকে উপদেশ এসেছিল, “মোকদ্দমা জোর চালাবে। ফোঁস করবে, কিন্তু কামড়াবে না।”
উকিলবাড়ির ছেলের মন কিন্তু তখন অন্যত্র। অসহায়া ভুবনেশ্বরী শেষ চেষ্টা করেছিলেন।
ছোটছেলেকে নিয়ে ভুবনেশ্বরী কাশীপুরের অন্তিমপর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথের বয়স তখন ছয়। “আমাকে মা নিয়ে গেলেন রামকৃষ্ণের ঘরে। দ্বিতলের একটি প্রশস্ত ঘরের মাঝখানে শয্যায় অর্ধ-শায়িত অবস্থায় রামকৃষ্ণ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে রয়েছেন। ঘরে ঢুকতে তিনি আমাদের উভয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাক্তার আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমাকে কথা বলতেই হবে। আপনি এসেছে ভালই হয়েছে। নরেনকে আপনার সঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যান। গিরিশ ওরা সকলে মিলে ওকে সন্ন্যাসীর পোশাক পরিয়েছিল, কিন্তু আমি তখনই বাধা দিয়ে বলেছিলাম–তা কেমন করে হয় নরেন, তোমার বিধবা মা এবং একটি শিশু ভাই রয়েছে দেখবার। তোমার তো সন্ন্যাসী হওয়া সাজে না।’ একথা বলার পরে নরেন্দ্রনাথ মা ও আমার সঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আসবার সময় ঘোড়ার গাড়িতে বসে মা নরেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণের কথাগুলো বললেন। নরেন্দ্রনাথ উত্তরে বললেন, ‘তিনি চোরকে বলেন চুরি করতে, আর গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে।”
*
বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর ভুবনেশ্বরী যে দশপ্রহরণধারিণী দুর্গতিনাশিনীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তা সংসারী বাঙালির মনে চিরদিন বিস্ময়ের সৃষ্টি করবে। আমার মতন ভুক্তভোগীরা বুঝবেন, তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। যে সংসারে প্রতি মাসে হাজার টাকা খরচ হতো তা নামিয়ে আনলেন তিরিশ টাকায়। শুরু করলেন গহনাপত্র বিক্রি করা।
এ বিষয়ে স্বামী সারদানন্দর সশ্রদ্ধ প্রতিবেদন : “স্বামীর মৃত্যুর পর দারিদ্র্যে পতিত হইয়া ভুবনেশ্বরীর ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও তেজস্বিতা প্রভৃতি গুণরাজী বিশেষ বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। …তাকে একদিনের জন্য বিষণ্ণ দেখা যাইত না।…তাহার অশেষ সদ্গুণসম্পন্ন জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্রনাথ নানা প্রকার চেষ্টা করিয়াও অর্থকর কোনরূপ কাজকর্মের সন্ধান পাইতেছেন না এবং সংসারের উপর বীতরাগ হইয়া চিরকালের নিমিত্ত উহা ত্যাগের দিকে অগ্রসর হইতেছেন–এইরূপ ভীষণ অবস্থায় পতিত হইয়াও শ্রীমতী ভুবনেশ্বরী যেরূপ ধীরস্থির ভাবে নিজ কর্তব্য পালন করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিয়া তাহার উপর ভক্তি-শ্রদ্ধার স্বতই উদয় হয়।”
বাবার মৃত্যুর পরে বিব্রত নরেনের প্রায়ই মাথার প্রবল যন্ত্রণা হতো। আমরা আগেই দেখেছি, মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য তিনি কর্পূরের ন্যাস নিতেন। মা একখানি চেলীর কাপড় পরতেন। কাপড়টা ছিঁড়ে যাওয়ায় নরেনকে বলেন, একখানা কাপড় হলে আহ্নিকের সুবিধে হয়। কাপড় দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নরেন মাথা হেঁট করে চলে গেল। এই সময় পরমহংসদেব এক ভক্তের কাছ থেকে একটা কাপড় পেয়ে নরেনকে বললেন, “তুই গরখানা নে, তোর মা পরে আহ্নিক করবেন।” নরেন নিল, কিন্তু পরমহংসদেব নিজেই অন্য লোকের মাধ্যমে কাপড়খানা শ্রীমতী ভুবনেশ্বরীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
পরমহংসদেবের অন্ত্যলীলা শুরু হওয়া থেকে পরিব্রাজক রূপে বিবেকানন্দর বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে কেউ কেউ দয়াপরবশ হয়ে নরেন্দ্রকে অর্থসাহায্য করেছিলেন। কথামৃতে আছে, কেউ তাকে একশ টাকা ধার দিয়েছিলেন, তার নাম বলা হয়নি, কিন্তু এখন আমরা ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের শেষ বয়সের উক্তি থেকে জানি, স্বয়ং মাস্টারমশায় টাকাটা দান করেছিলেন। তাতে নরেনের পরিবারের তিনমাসের সংসারখরচের ব্যবস্থা হয়েছিল।
কাশীপুরের প্রথম দিকের একটি বর্ণনা মনে দাগ কাটে। নরেন্দ্রনাথ শ্ৰীমকে বললেন, “আজ সকালে বাড়ি গেলাম। সকলে বকতে লাগল। আর বললেন–”কি হো হো করে বেড়াচ্ছিস? আইন এগজামিন এত নিকটে, পড়াশুনা নাই, হো হো করে বেড়াচ্ছিস!
মাস্টারমশায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা কিছু বললেন?” নরেন্দ্র উত্তর দিলেন, “না তিনি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত। হরিণের মাংস ছিল, খেলুম, কিন্তু খেতে ইচ্ছে ছিল না!”… “দিদিমার বাড়িতে সেই পড়বার ঘরে পড়তে গেলাম। পড়তে গিয়ে পড়াতে একটা ভয়ানক, আতঙ্ক এল–পড়াটা যেন কী ভয়ের জিনিস! বুক আটু বাটু করতে লাগল। অমন কান্না যা কখনো কাঁদি নাই। তারপর বই-টই ফেলে দিয়ে দৌড়। রাস্তা দিয়ে ছুট। জুতো-টুতো রাস্তায় কোথায় একদিকে পড়ে রইল।..আমি দৌড়াচ্ছি কাশীপুরের রাস্তায়! ‘বিবেক-চূড়ামণি’ শুনে আরও মন খারাপ হয়েছে। শঙ্করাচার্য বলেন, এই তিনটি জিনিস অনেক তপস্যায়, অনেক ভাগ্যে মেলে–”মনুষ্যত্বং, মুমুক্ষ্যত্বং, মহাপুরুষসংশয়ঃ।‘ ভাবলাম, আমার তিনটিই হয়েছে অনেক তপস্যার ফলে মানুষজন্ম হয়েছে, অনেক তপস্যার ফলে মুক্তির ইচ্ছা হয়েছে, আর অনেক তপস্যার ফলে এরূপ মহাপুরুষের সঙ্গলাভ হয়েছে।”
বরানগর পর্বে ঠাকুরের ত্যাগী-সন্তানদের কঠিন সাধনার কথা আমরা জানি। নরেন্দ্রর পক্ষে তখন উভয় সমস্যা। পারিবারিক মোকদ্দমা চালাতে হবে, আবার ঘোর বৈরাগ্যসাধন করতে হবে।” তেজস্বী বীরপুরুষ না হলে দুটি বিপরীতভাব একত্র রাখিয়া নিজেকে নিরাপদ রাখিতে পারে না। মোকদ্দমা চালাইবার টাকার এতো অনটন যে শশী (রামকৃষ্ণানন্দ) ও শরৎ (সারদানন্দ) নরেন্দ্রকে বলিলেন, “দেখ ভাই নরেন, তোমার টাকার অনটন। মকদ্দমার খরচ বেশি, আমরা বেশ দু’জনে গিয়ে বালির ইস্কুলে মাস্টারি করি না? কিছু কিছু রোজগার করি আর মঠে আসিয়া থাকি, তাহা হইলে সেই টাকা হইতে তোমার কিছু উপকার হইতে পারে।”
যাঁরা গুরুভাইয়ের পরিবারের দুঃখমোচনের জন্য এতো ভাবতে পারেন বরানগরে তাঁদের নিজেদের আর্থিক অবস্থা কত শোচনীয় ছিল তা শুনুন। রাত্রে শোবার কোনো বিছানা ছিল না। খান দুই তিন মোটা হোগলার চাটাই ঘরে পাতা ছিল, আর একখানা ছেঁড়া সতরঞ্চি ছিল। সকলে হাত মাথায় দিয়া রাত্রে নিদ্রা যাইত, বালিশের অভাব হইলে চাটাইয়ের নিচে একখানা ইট দিত তাহা হইতেই বালিশের অভাব পূরণ হইত..গেরুয়া কাপড় পরার প্রথা ছিল না…জুতাও ছিল না, জামাও ছিল না।”
কিন্তু তীব্র অভাবের মধ্যেও ভালবাসার তীব্র প্রকাশ। বরানগরপর্বে নরেনের মোকদ্দমা চলাকালীন সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কেদারনাথ দাস। বাগবাজারের খড়ের ব্যবসা করতেন বলে এঁর নাম হয়েছিল খড়ো কেদার। তিনি স্বেচ্ছায় নরেনকে একশ টাকা দিয়েছিলেন।
এই সময়েই নরেনকে টাকা ধার নিতে হয় বলরামবাবুর কাছ থেকে। এই ৫০০ টাকা ঠাকুরের গৃহী ভক্ত সুরেশবাবু মঠ স্থাপনের জন্য বলরামবাবুর কাছে রেখে যান। মোকদ্দমা যখন তুমুলভাবে চলছে তখন নরেন্দ্রনাথ এই টাকা ধার করেন। দেড় বছর পরে টাকা পাওয়া গেলে এই টাকা শোধ করে দেওয়া হয়। টাকাটা কোম্পানির কাগজে ছিল এবং উকিল অতুল ঘোষের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে মহিমবাবু ও শরৎ মহারাজ বড়বাজারে প্রসাদদাস বড়ালের অফিসে গিয়ে, কাগজ ভাঙিয়ে টাকা শোধ করেন। শোনা যায়, পরে এই টাকায় বেলুড় মঠে ঠাকুরঘরের মার্বেল পাথর কেনা হয়।
*
স্বামীজীর পারিবারিক বিপর্যয়কালে তার দু’জন গুরুভাইয়ের নিঃশব্দ সেবা ও সমর্থন অবিস্মরণীয় রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) ও শরৎ মহারাজ (সারদানন্দ)। স্বামীজীর পিতৃবিয়োগের পর আত্মীয়রা এই পরিবারকে ভিটেমাটিছাড়া করার চেষ্টা চালিয়েছিল, সেই দুর্দিনে জমিদার-পরিবারের সন্তান রাখাল লোকজন সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দখল রক্ষা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই পর্বের অনেক বর্ণনা শোনা যেত অনঙ্গ মহারাজ ওরফে স্বামী ওঙ্কারানন্দের মুখে। অনঙ্গ মহারাজের প্রিয়পাত্র ছিলেন গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু।
স্বামীজির দেহত্যাগের পর জননী ও ভ্রাতাদের অভিভাবকের দায়িত্বও রাখাল মহারাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
জীবনের শেষপর্বেও স্বামীজি তার গুরুভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, “রাখাল, আমার শরীর ভাল নয়। আমি শীগগির দেহত্যাগ করবো, তুই আমার মার ও বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিস, তাকে তীর্থ দর্শন করাস, তোর ওপর এইটি ভার রইল।”
পারিবারিক বিরোধ একবার শুরু হলে শেষ হতে চায় না, আমাদের অষ্টাদশ পর্ব মহাভারতই তার প্রমাণ। এই বিরোধ যেমন মৃতদেরও ছাড়তে চায় না, তেমন সন্ন্যাসীকেও তার মুক্তিপথ থেকে হিড়হিড় করে আদালতে টেনে আনতে দ্বিধা করে না।
পারিবারিক দ্বন্দ্ব একবার আদালতে গেলে যে দুটো খরচের কোনো নাগাল পাওয়া যায় না তা হলো সময় ও অর্থ। ভুবনেশ্বরী দেবীর ক্ষেত্রেও আমরা দেখবো, এই মামলা শাখাপ্রশাখা বিস্তারিত করে স্বামীজির ৩৯ বছর জীবনকালের দ্বিতীয়ার্ধটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবার প্রবল চেষ্টা করেছিল।
স্বামীজির কনিষ্ঠভ্রাতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, জ্যেষ্ঠভ্রাতা সংসার ত্যাগ করায়, এই সংকটকালে ভুবনেশ্বরীর পাশে কেউ ছিল না। কথাটা কতটুকু সত্য তা পরিমাপ করতে হলে দত্তদের পারিবারিক মামলার বিস্তৃত বিবরণ ইতিহাসের অবগুণ্ঠন সরিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা প্রয়োজন।
স্বামীজির সব জীবনীগ্রন্থে এই মামলার উল্লেখ থাকলেও সব তথ্য এখনও যাচাই করা হয়নি। কিন্তু ভূপেন্দ্রনাথ স্বামীজির জীবনীকারদের কিছু মন্তব্যকে ভালভাবে নিতে পারেননি। এইসময় স্বদেশ এবং বিদেশ থেকে মেমসায়েবদের এবং অবাঙালিদের কাছে লেখা বিবেকানন্দর কিছু চিঠির পূর্ণবয়ান তখন ভূপেন্দ্রনাথের হাতে ছিল না। গত কয়েকবছরে পরিস্থিতির অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। মেরি লুইস বার্ক তার অতুলনীয় গবেষণাগ্রন্থে কিছু চিঠির পূর্ণ বয়ান সংগ্রহ করে অনেক বিক্ষিপ্ত অংশ এমনভাবে জুড়ে দিয়েছেন যে তাঁর ছয়খণ্ডের বইটার কয়েক হাজার পাতা মন দিয়ে না পড়লে নানা সমস্যায় জর্জরিত এবং অকারণে বারংবার বিপন্ন বিবেকানন্দকে পুরো জানা যায় না।
এই বিড়ম্বনার হিসেবখাতা দেখলে বোঝা যায়, বিবেকানন্দ একই সঙ্গে দেবী দুর্গার মতন দশ হাতে যুদ্ধ করছেন। রণক্ষেত্রে দেবী চণ্ডীকার যত অসুবিধাই থাক তার স্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা ছিল না, বিবেকানন্দ সেই সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। এক একবার মনে হয় আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে জন্মগ্রহণ করে বড় কোনো স্বপ্ন দেখলে তার জন্যে মানুষকে অনেক বাড়তি মাশুল দিতে হয়। সংগ্রামী বিবেকানন্দকে ভালভাবে জানলেই এখন যাঁরা দারিদ্রের বিরুদ্ধে পারিবারিক সংগ্রাম করছেন এবং অনাগতকালে যাঁরা সংগ্রাম করবেন তাদের একাকিত্বের কিছুটা অবসান ঘটবে, তাদের মনে বিশেষ কোনো দুঃখ থাকবে না।
*
একজন প্রবীণ আইনজ্ঞ (চিত্রগুপ্ত) ছদ্মনামের আড়ালে থেকে কিছুদিন আগে দত্তপরিবারের কিছু আইনি তথ্য আমাদের উপহার দিয়েছেন, যার থেকে আমরা জানতে পারি ভিটেমাটি নিয়ে কবে কোন মামলা হয়েছিল এবং কোন আদালতে নরেন্দ্রনাথ কী সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
মামলার সময় ভুবনেশ্বরী পালকি করে কলকাতার হাইকোর্ট পাড়ায় আসতেন। বিলু যেতেন পায়ে হেঁটে, কিন্তু তিনি মায়ের আগেই পৌঁছে যেতেন। মামলার কাগজপত্র থেকে আমাদের সব চেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি ভুবনেশ্বরী দেবীর বাংলা স্বাক্ষর–এমন সুন্দর হস্তলিপি কদাচ দেখা যায়।
বিবেকানন্দের পিতা বিশ্বনাথের ওকালতি তথ্য সম্বন্ধে একসময় হাইকোর্টে খোঁজখবর করেন ব্যারিস্টার সুধীরচন্দ্র মিত্র। তার অনুরোধে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন চিফ জাস্টিস ফণিভূষণ চক্রবর্তী ১৯৫২ সালে সুধীরচন্দ্রকে কিছু বিবরণ পাঠিয়ে দেন।
ভিটেবাড়ি নিয়ে বিড়ম্বনা যখন সারাজীবনই ঘটেছে, তখন জেনে রাখা ভাল যে আমরা একনজরে একটা নয়, একগুচ্ছ মামলার উপস্থিতি লক্ষ্য করছি। এই মামলার বিবরণ মাথায় নিতে হলে যেসব বংশলিপি সেই সময় আদালতে পেশ করা হয়েছিল তাও পড়ে নেওয়া দরকার–কোন্ প্রজন্মে কার কতখানি অংশ, কোন শরিক বিবাহ করেননি, কে নিঃসন্তান, কে অপুত্রক, বা কে ছয় বা সাত কন্যার জনক তা জানা প্রয়োজন।
সিমলাপর্বের শুরুতে রামসুন্দর দত্ত, যাঁর পাঁচটি সন্তানের নাম আমাদের জানা।
জ্যেষ্ঠপুত্র রামমোহনের দুইপুত্র ও সাত কন্যা। এঁরই জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্গাপ্রসাদ সন্ন্যাসী হয়েছিলেন এবং তিনিই বিবেকানন্দর পিতামহ। রামমোহনের দ্বিতীয় পুত্রের পুত্র তারকনাথ ছিলেন বিবেকানন্দর খুড়ো, তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদাসুন্দরীর সঙ্গেই আদালতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যা সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর জীবনকে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
বলে রাখা ভাল এই খুড়ির ছয় কন্যা এবং পরবর্তীকালে যথাসর্বস্ব হারিয়ে তিনি ভুবনেশ্বরী-পুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেন!
ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মোকদ্দমা বিশ্বনাথ দত্তের স্ত্রী বনাম তারকনাথ দত্তের স্ত্রীর মোকদ্দমা, তখন স্বামী বিবেকানন্দ বলে কেহ ছিলেন না।” মোকদ্দমার দায়ে খুড়ি জ্ঞানদাসুন্দরীর বাস্তুভিটা নিলাম হয়। “পরে স্বামীজির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে, তিনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা এককালীন দান করেন।”
আমরা দেখবো, উদার হস্তে দান করেও সমস্যা মেটেনি, বরং স্বামীজি কিছুটা ঠকেছিলেন। ফলে মামলা আরও শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে, যদিও শেষ বয়সে এই খুড়ি নাকি দুঃখ করতেন, কয়েকজনের প্ররোচনায় তিনি এই মামলা করেন। বাড়ির সরকারও সুযোগ বুঝে হাজার পাঁচেক টাকা বাড়তি উপার্জন করেন। কিন্তু আমরা জানি, যৌথপরিবারে খুড়োখুড়ির অত্যাচার ছিল তুঙ্গে এবং এমন সময় গেছে যখন ভুবনেশ্বরীকে ‘একটি শাড়ি পরে কাটাতে হয়েছে।‘ বিশ্বনাথ দত্ত নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেটভরে খেতে পায় না।”
আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছে যৌথপরিবারের লাইফস্টাইলটা অবোধ্য এবং রহস্যময় মনে হওয়া আশ্চর্য নয়। আমি রোজগার করছি, আর আমার বউ এক কাপড়ে প্রায় না খেয়ে কী করে থাকবে? বাড়ি যখন আমার তখন আদালতে ছোটাছুটি কেন?
উনিশ ও বিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের এ এক দুঃখময় দিক। ব্যাপারটা এই রকম : সম্পন্নলোকরা সেকালে যৌথ পরিবারে থাকতেন। রোজগারের পরিমাণ যার যতই হোক, হেঁসেল অথবা হাঁড়ি এক। দুই, আইনের চোখে সভ্যদের মালিকানার অংশ থাকলেও সম্পত্তিটা অবিভক্ত। একসময় এই অবিভক্ত সম্পত্তি ভাগ করে দেবার জন্যে পার্টিশন স্যুট চলতো চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে কলকাতার ধনপতি আইনজ্ঞদের বিশাল উপার্জনের একটা বড় অংশ আসতো এই ধরনের মামলা থেকে। এক প্রস্থে এইসব মামলার শেষ হতো না। একবার হারলে উচ্চ আদালতে আপিল হতো। বলে রাখা ভাল, দুর্বল নিঃসন্তান বিধবারা অনেক সময় টাকার প্রয়োজন হলে অবিভক্ত ভিটের নিজের অংশ আর একজন শরিককে বেচে দিতেন।
ভুবনেশ্বরী মামলার একটি সংক্ষিপ্তসার ভূপেন্দ্রনাথ দিয়েছেন, সেটি প্রথমে দিই। তারপর একটু-আধটু বাড়তি আলোকপাত করা যাবে। “আমরা যখন কালিপ্রসাদের বংশের সঙ্গে এজমালিতে থাকতাম সেসময়ে আমার মাতাঠাকুরানী দত্তদের অবিভক্ত পৈতৃক বাড়ির একাংশ, যা এক বালবিধবার বখরায় পড়ে, ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু আমাদের খুল্লতাতের মৃত্যুর পর খুড়ি তা দখল করে আমাদের ভিটাচ্যুত করেন। তারপরে আদালতে মকদ্দমা রুজু করেন।”
অতিসুন্দর সংক্ষিপ্তসার, কিন্তু বিবেকানন্দের বিড়ম্বনা বুঝতে গেলে আর একটু খবর সংগ্রহের প্রয়োজন। প্রথমেই বলে রাখা যাক, আমরা একাধিক মামলায় দত্তপরিবারকে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখছি। সময় অনুযায়ী সাজালে ব্যাপারটা সহজ হয়। যার শুরু নরেন্দ্রনাথের চোদ্দবছর বয়স থেকে।
১লা সেপ্টেম্বর ১৮৭৭ : মাধব দত্তর স্ত্রী বিন্দুবাসিনীর ভাগ কিনলেন ভুবনেশ্বরী। এই সম্পত্তি স্বামীর টাকায় কিনলেন, না খুড়ো তারকনাথ বেনামে ভাইপোর স্ত্রীর নামে কিনলেন, এই নিয়ে আদালতে মহারণ হয়েছিল পরে।
১৮৮০: আর এক শরিক শচীমণি দাসী (গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী) সম্পত্তি বিভাজনের মামলা আনলেন, যাতে বিবেকানন্দ জননীও ছিলেন প্রতিপক্ষ। এই মামলায় বিখ্যাত এটর্নি রবার্ট বেচেম্বার্স সম্পত্তি বিভাজনের কমিশনার নিযুক্ত হলেন। যথাসময়ে তিনি ভাগ ঠিক করে দেন, কিন্তু তাতে এই মামলার শেষ হয় না।
আগস্ট ১৮৮৫ : পিতা বিশ্বনাথের মৃত্যু ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪ সালে, তারপরেই উকিল তারকনাথ ভুবনেশ্বরীর নামে কেনা সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করতে লাগলেন।
বড়দিন ১৮৮৫ : যৌথসম্পত্তির একটা অংশে শৌচাগার মেরামতের জন্য পুরনো দেওয়াল ভাঙা নিয়ে ভুবনেশ্বরী পরিবারের সঙ্গে তারকনাথ কথাকাটাকাটিতে পড়লেন। এই কথাকাটাকাটিতে মাতৃনির্দেশে নরেন্দ্রনাথকে অংশ নিতে হয়েছিল।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : তারকনাথ দেহ রক্ষা করলেন।
জুলাই ১৮৮৬ : তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী হাইকোর্টে মামলা করলেন ভুবনেশ্বরী দেবীর বিরুদ্ধে।
১১ই আগস্ট ১৮৮৬ : শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পাঁচদিন আগে ভুবনেশ্বরী দাসী স্বামীর সম্পত্তির জন্য হাইকোর্টে লেটার অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের আবেদন করলেন কারণ বিশ্বনাথের কোনো উইল ছিল না। তখনকার উচ্চ আদালত কীরকম দ্রুত কাজ করতে পারতেন তার প্রমাণ, পরের দিনই (১২ আগস্ট) ছাড়পত্র পাওয়া গেল। সমস্ত কাগজপত্রে মায়ের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের সই আছে।
১৬ আগস্ট ১৮৮৬ : শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধি।
১৮৮৭ গোড়ার দিক : খুড়ি জ্ঞানদাসুন্দরীর মামলা আদালতে শুরু হলো। তার পক্ষে বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টার পিউ।
৮ মার্চ ১৮৮৭ : নরেন্দ্রনাথ তখন বরাহনগর মঠ নিবাসী। সাক্ষ্য দিতে এসে অপরপক্ষের ব্যারিস্টারের জেরার মুখে পড়লেন, বললেন আমি বেকার।
১৪ মার্চ ১৮৮৭ : হাইকোর্টের রায়–হেরে গেলেন খুড়ি, কিন্তু আবার হাইকোর্টে আপিল।
১০নভেম্বর ১৮৮৭ : তিন বিচারকের আপিল আদালতের রায়। খুড়ির আবার পরাজয়।
১৮৮৮ : শচীমণি দাসী ১৮৮০ সালে যে পার্টিশন চেয়েছিলেন এবং রবার্ট বেলচেম্বার্স যে বাঁটোয়ারা করেছিলেন সেই অনুযায়ী সম্পত্তি বিভাজন চাইলেন শ্রীমতী ভুবনেশ্বরী।
২৩ নভেম্বর ১৮৮৮ : ভুবনেশ্বরী তার আইনগত অধিকার পেলেন।
২৮ জুন ১৯০২: প্রায় চোদ্দ বছর অতিক্রান্ত। তবু মামলার শেষ নেই।
৪ঠা জুলাই স্বামীজির দেহত্যাগ। তার কয়েকদিন আগে তার জীবনের শেষ শনিবারে (২৮ জুন) কলকাতায় এসে অনেক চেষ্টা করে স্বামীজি মামলার অবসান ঘটালেন, শান্তি ফেরাবার জন্য শরিকদের বেশ কিছু টাকা দিতে হল।
৪ জুলাই ১৮৮৯ বাগবাজার থেকে স্বামীজি বারাণসীতে প্রমাদাস মিত্রকে যে চিঠি লেখেন তাতে মামলার কিছু আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। “আমার মাতা ও দুই ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জ্যেষ্ঠ, মধ্যমটি এইবার ফার্স্ট আর্টস পড়িতেছে, আর একটি ছোট। ইহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমনকি কখন কখন উপবাসে দিন যায়। তাহার উপর জ্ঞাতিরা দুর্বল দেখিয়া পৈতৃক বাসভূমি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিল; হাইকোর্টে মকদ্দমা করিয়া যদিও সেই পৈতৃক বাটীর অংশ পাইয়াছেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হইয়াছেন–যে প্রকার মকদ্দমার দস্তুর।…এবার তাহাদের মকদ্দমা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলকাতায় থাকিয়া, তাহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মত বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্বাদ করুন।”
দশদিন পরে প্রমদাবাবুকে স্বামীজির আর একটি চিঠি। “…আমার এস্থানের গোযোগ প্রায় সমস্ত মিটিয়াছে, কেবল একটি জমি বিক্রয় করিবার জন্য দালাল লাগাইয়াছি, অতি শীঘ্রই বিক্রয় হইবার আশা আছে। তাহা হইলেই নিশ্চিন্ত হইয়া একেবারে কাশীধামে মহাশয়ের সন্নিকট যাইতেছি।”
জটিল পারিবারিক মামলা সম্পর্কে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথের বক্তব্য: “স্বামীজীর জীবন বলে যেসব পুস্তক বাজারে চলছে তাতে একটা মিথ্যা সংবাদ আছে। এই মোকদ্দমায় ব্যারিস্টার ও উকিল পাই-পয়সাটি পর্যন্ত আদায় করেছিল, ব্যারিস্টারদের নগদ বিদায় দিতে হয়, আর উকিলের পাওনা, তা শেষ দেবার সময় লেখক হাজির ছিলেন এবং তার রসিদ আছে।”
*
মায়ের প্রতি দায়িত্বপালন করতে গিয়ে নিঃসম্বল সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে কি কঠিন সমস্যামালার মধ্যে পড়তে হয়েছিল এবং আমৃত্যু তিনি কীভাবে একের পর এক সেইসব আর্থিক বাধার মোকাবিলা করেছেন, এমনকি অপরের কাছে তার চিরউন্নত শির নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন তার ইতিহাস অপ্রকাশিত না হলেও তেমন প্রচারিত নয়।
এই অংশটুকু না জানলে বোঝা শক্ত কত বড় হৃদয় ছিল তার, দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ গ্রহণ করতে সারাজীবন ধরে তার কেন আপত্তি। মোক্ষসন্ধানী বিবেকানন্দই আমাদের মতন সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে গিয়েছেন ভবিতব্যের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ না করেও কী করে মানবত্বের হিমালয়শিখরে আরোহণ করা যায়। দরিদ্র বিশ্ববাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, দরিদ্র বাঙালির পূজ্য দেবতা হবার জন্য যা যা অবশ্য প্রয়োজন তার সব কিছুই আমরা স্বামীজির অবিশ্বাস্য জীবনসংগ্রাম থেকে খুঁজে পেতে পারি।
শচীমণির মামলার সময় ভুবনেশ্বরী তার স্বামীর সঙ্গে আদালতে গিয়েছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার সময় তিনি নরেনকে সঙ্গে যেতে বলেছিলেন, সে রাজি হয়নি। ভুবনেশ্বরী আদালতকে বলেন, রামসুন্দরের দ্বিতীয় ছেলের বংশধর ভোলানাথ ও মাধবচন্দ্রের প্রত্যেকের অংশ ওঁদের বিধবা বামাসুন্দরী ও বিন্দুবাসিনীর কাছ থেকে প্রত্যেককে ৫০০ টাকার বিনিময়ে তিনি কিনে নেন। বিক্রি কোবলার তারিখ ১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৭।
বাঁটোয়ারা কমিশনার রবার্ট বেল চেম্বার্সের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচারপতি আর্থার উইলসন রায় দিলেন, যৌথসম্পত্তিতে শচীমণির অংশ চার আনা। এই মামলায় সমস্ত পরিবারদের অংশ এবং বাসগৃহের সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল। চিত্রগুপ্ত’ আমাদের জানিয়েছেন, দেওয়াল তুলে ভাগাভাগি না হলেও, বাঁটোয়ারার ব্যাপারে খরচ হয়েছিল ২৮৯২ টাকা, এবং নিজ নিজ অংশের আনুপাতিক হারে শরিকরা সেই অর্থ মিটিয়ে দেন। পরবর্তী মামলায় প্রমাণিত হয়, এই টাকা দেওয়ার কথা ওঠে বিশ্বনাথের মৃত্যুর পরে এবং ভুবনেশ্বরীর দেওয়ার একটা অংশ মিটিয়েছিলেন খুড়ো তারকনাথ।
তখনকার ভুবনেশ্বরী সংসারজ্বালায় বড়ই জর্জরিত। একই সময়ে চলেছে ঠাকুরের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের লীলাখেলা। বিরক্ত ভুবনেশ্বরী নাকি একদিন বলেছিলেন, “এসব কি হচ্ছে বিলু? সংসারটা কি করে চলবে সেদিকে হুঁশ নেই, দিনরাত টোটো করে ঘুরছিস।”
নরেন নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, “সংসার চালাবার আমি কে মা? যিনি চালাবার তিনি চালিয়ে দেবেন।”
ঠাকুরের পরম ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত ভুবনেশ্বরীর নিকট-আত্মীয়, শিশুকালে মাতৃহারা হওয়ায় তিনি ভুবনেশ্বরীর স্তন্যদুগ্ধে লালিত হয়েছিলেন। তাকে ভুবনেশ্বরী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বিলু কি আর সংসারে ফিরে আসবে না?” গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র ভরসা দিয়েছিলেন, “আপনাকে ছেড়ে ও যাবে কোথায়?”
খুড়ির সুবৃহৎ মামলার খবর নরেন্দ্রনাথ পান বরানগর মঠে থাকার সময়, যদিও মামলা দায়ের হয়েছে ঠাকুরের মহাসমাধির একমাস আগে। খুড়ির আর্জিতে আছে, ভুবনেশ্বরী যে সম্পত্তি কিনেছিলেন তা তার স্বামীর অর্থে বেনামীতে নেওয়া। সেইসময় খুড়ির প্রধান পরামর্শদাতা তার এক জামাই।
এটর্নি নিমাই বসু ভুবনেশ্বরীর জবাব দাখিল করলেন যথাসময় আমার স্বামী তার পোষ্যদের যাবতীয় খরচ প্রবাস থেকে নিয়মিত পাঠাতেন। এই সম্পত্তি আমার স্ত্রীধন। এই মামলায় মায়ের দেওয়া বাংলা স্বাক্ষর নরেন্দ্রনাথ শনাক্ত করেন।
.
মামলার শুনানির দেরি হতে পারে জেনে নরেন্দ্রনাথ তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। শুনানি শুরু হবার আগেই তিনি ফিরে আসেন। এই মামলায় সাক্ষীসাবুদ অনেক। নরেন্দ্রনাথ নিজেই সাক্ষ্য দিলেন ৮ মার্চ ১৮৮৭।
স্বামী গম্ভীরানন্দের মতে এই মামলায় ব্যারিস্টার ডবলু সি বনার্জি ভুবনেশ্বরীকে সাহায্য করেন। ব্যারিস্টার পিউ সায়েব নরেন্দ্রনাথকে বেকায়দায় ফেলবার জন্য আদালতে নানাভাবে জেরা করেন।
তোমার বয়স কত?
–তেইশ-চব্বিশ হবে।
তোমার পেশা কী?
–আমি বেকার। বর্তমানে আমি কিছুই করছি না। প্রায় দু’বছর আগে ১৮৮৫ সালে মেট্রোপলিটান ইনটিটিউশনে হেডমাস্টার পদে নিযুক্ত হই। কিন্তু মাসতিনেক পরে আমি সে কাজ ছেড়ে দিই। তারপর ডঃ আঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে ও তার অধীনে একটি কলেজে আমি কিছুদিন অধ্যাপনা করি।
পৈত্রিক বাড়িতে তিনি বহুদিন বসবাস করেন না, একথা ঠিক কিনা জানতে চাইলেন পিউ সায়েব।
–বাবা মারা যাওয়ার পর আমি মায়ের কাছেই থাকতাম। সব সময় যে থাকতাম একথা বলতে পারি না। আমার কাকা তারকনাথের মৃত্যুর সময়ে আমি বাড়িতে ছিলাম।
মিস্টার পিউ–তুমি কি কারও চেলা হয়েছ?
–চেলা কাকে বলে তা আমি জানি, কিন্তু আপনার ইঙ্গিতটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমি কখনও কোনো ভিক্ষাজীবী সাধুর চেলাগিরি করিনি।
মিস্টার পিউ জানতে চাইলেন, ধর্মীয় ব্যাপারে কোনোরকম চাঁদা তোলায় যুক্ত ছিলে?
–নরেন উত্তর দিলেন, রামকৃষ্ণদেবের জন্য তিনি কোনো চাদা গ্রহণ করেননি।
মিস্টার পিউকে প্রত্যাঘাত করার জন্য নরেন জিজ্ঞেস করলেন, মহাশয় আপনি চেলা শব্দটির অর্থ জানেন কি? ব্যারিস্টার সায়েব এবার একটু বেকায়দায় পড়ে গেলেন।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্রনাথ জানালেন, কাকা তারকবাবুর সঙ্গে তাঁর দু’বার বচসা হয়। কথাকাটাকাটির পরে তারকবাবুর সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হয়নি। কাকার মৃত্যুর আগে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। মাও ফিরে বাড়িতে এসেছিলেন। মায়ের ঘরটি অক্ষত ছিল। নরেন ও পরের ভাই অন্য একটি ঘরে ছিলেন। অপর একটি ঘর তারকনাথ ভেঙে দিয়েছিলেন।
স্বামী গম্ভীরানন্দর অনবদ্য জীবনকথায় আমরা জানতে পারি, ইংরেজ জজ বলেন, “যুবক তুমি একজন ভাল উকিল হইবে।” বিপক্ষের এটর্নিও তাঁর হাত ধরে বলেন, “আমি জজসায়েবের সঙ্গে সহমত।”
দীর্ঘ শুনানির পরে হাইকোর্টের বিচারপতি ম্যাকফারসনের রায় প্রকাশিত হলো : বিশ্বনাথ প্রবাস থেকে স্ত্রীকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। সুতরাং তারকনাথ বেনামীতে সম্পত্তি কিনেছিলেন তা প্রমাণ করবার পূর্ণ দায়িত্ব তার স্ত্রীর। জ্ঞানদাসুন্দরী তার স্বামীর কোন হিসেব খাতা আদালতে দাখিল করেননি। বিপদ সাধলো তারকনাথের একটি পুরনো চিঠি, যেখানে এক আত্মীয়কে তিনি লিখছেন, সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভুবনেশ্বরী। এছাড়া এই সম্পত্তি কলকাতা কালেকটরেটে নথিভুক্ত করার জন্য ভুবনেশ্বরী একবার দেবর তারকনাথকে ওকালতনামা দিয়েছিলেন এবং সে দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন।
আপিল মামলার রায়ও যথাসময়ে বেরিয়েছিল ১৮৮৭ সালে চীফ জাস্টিস, জাস্টিস আর্থার উইলসন এবং জাস্টিস রিচার্ড টটেনহ্যাম-এর আপীল কোর্ট ভুবনেশ্বরীর পক্ষে রায় দিলেন। খুড়ির শোচনীয় পরাজয় ১০ নভেম্বর ১৮৮৭।
কিন্তু মামলা কি আর অত সহজে শেষ হয়! আমরা দেখবো এর রেশ গড়ায় বিবেকানন্দর দেহাবসানের মুহূর্ত পর্যন্ত।
*
এর পরের রিপোর্ট স্পষ্টভাবে আঁকার জন্য শঙ্করীপ্রসাদ বসুর রচনা থেকে কিছু ভিক্ষা নেওয়া যাক। স্বামীজি ৬ হাজার টাকা দিয়ে নিজের খুড়ির কাছ থেকে পৈতৃক বাড়ির একটা অংশ কিনে নেন। মঠ-তহবিল থেকে এর জন্য তাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করতে হয়।
কিন্তু স্বামীজি এই ব্যাপারে দারুণভাবে ঠকেন, জানাচ্ছেন শ্রদ্ধেয় গবেষক। ৬ই আগস্ট ১৮৯৯, মিসেস ওলি বুলকে স্বামীজি লেখেন, “দুশ্চিন্তা? সম্প্রতি তা যথেষ্ট। আমার খুড়িকে আপনি দেখেছেন তিনি আমাকে ঠকাবার জন্য তলেতলে চক্রান্ত করেন। তিনি ও তাঁর পক্ষের লাকজন আমাকে বলেন, ৬০০০ টাকায় বাড়ির অংশ বিক্রি করবেন–সেটা আমি সরল বিশ্বাসে ৬০০০ টাকা দিয়ে কিনি। তারপর তারা বাড়ির অধিকার দেবেন না–এই বিশ্বাসে যে আমি সন্ন্যাসী হয়ে, জোর করে বাড়ি দখল নেবার জন্য আদালতে যাব না।”
“এর ফলে মামলা হয়। এবং কয়েক বছর গড়ায়। মামলাতে যথেষ্ট খরচ হয়। স্বামীজির সে খরচের টাকাও মঠ তহবিল থেকে নিতে হয়। পূর্বোক্ত পাঁচ হাজার টাকা এবং এই মামলা খরচের টাকার দুশ্চিন্তা স্বামীজিকে একেবারে অস্থির করে ফেলেছিল। তাঁর ব্যক্তিগত টাকা বলতে সেইসব টাকা, যা তাঁর অনুরাগীরা তাঁর নিজস্ব খরচের জন্য দিতেন, কাজের জন্য নয়; এই সঙ্গে ছিল বই বা প্রবন্ধসূত্রে, কিছুটা লেকচার সূত্রে উপার্জিত অর্থ।” শঙ্করীপ্রসাদ সবাইকে নিশ্চিন্ত করেছেন, “স্বামীজি শেষ পর্যন্ত ধার নেওয়া সব টাকা শোধ করতে পেরেছিলেন।”
বিবেকানন্দ পরিবারের কেউ কেউ লেখার সময় স্মরণে রাখেননি যে বিদেশ থেকে ফেরবার পরে স্বামীজি তার মাকে পৈতৃকবাড়ির অংশ কিনে দিয়েছিলেন। শঙ্করীপ্রসাদ সঙ্গত কারণেই অস্বস্তি বোধ করেছেন। “আমার মনে হয়। স্বামীজি তারকনাথ দত্তর বিধবা বধূকে অর্থসাহায্য করেছিলেন। (যা ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন)–তার শর্ত ছিল, তিনি ভুবনেশ্বরীর প্রাপ্য যে অংশ অন্যায়ভাবে অধিকার করে আছেন, সেটি ফিরিয়ে দেবেন।” সেখানেও তাকে চক্রান্তের শিকার হতে হয়।
সন্ন্যাসীর সাধনা ও যন্ত্রণাকে এক্স-রে করতে গিয়ে মামলা-মোকদ্দমার সাতকাহন গাইতে হলো। কিন্তু এই যন্ত্রণা মানুষের চোখের সামনে থেকে লুকিয়ে রাখলে বিবেকানন্দের বিবেক পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হয় না।
এর আগে শঙ্করীপ্রসাদ যে সম্পত্তি কেনাবেচার কথা উল্লেখ করেছেন তার বিবরণ স্বামী গম্ভীরানন্দ বিরচিত যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থের ছোট্ট ফুটনোটে ধরা আছে। “অন্য সূত্রে জানা যায়, স্বামীজি ২/১২/১৮৯৮ তারিখে অমৃতলাল দত্ত প্রভৃতির নিকট হইতে ২ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের এক-চতুর্থাংশ এবং ২৯/১/১৮৯৯ তারিখে গৃহাদি সহ ৩নং-এর জমি বাড়ি বিশ্বেশ্বরী দেবীর নিকট ক্রয় করেন। ২৭/৫/১৮৯৯ তারিখে তিনি উভয় সম্পত্তি স্বীয় জননীকে দান করেন।”
মামলার ছায়া প্রলম্বিত হয়েছে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে (মার্চ ১৯০২) বেনারস থেকে সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখছেন, “ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের দেনা শোধ এবং সংসার খরচে লেগে গেল। সামান্য যা রয়ে গিয়েছে তাতেও হাত দেবার উপায় নেই, ঝুলে-থাকা মামলার জন্য লাগবে।”
বিরোধের শেষ মীমাংসার একটা সুন্দর ছবি স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপিতে আছে।
স্বামীজি ২৮শে জুন শনিবার ১৯০২ (তাঁর তিরোধানের এক সপ্তাহ বাকি নেই) পারিবারিক মামলাস্থান কলকাতায় গিয়েছিলেন। কয়েকজনকে নিয়ে বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণও খেয়েছিলেন। দেখা করতে শরিক হাবুল (দত্ত) এলো। স্বেচ্ছায় মিটিয়ে নেবার কথা বলল। যদি মীমাংসা হয় তা হলে স্বামীজি আরও হাজার টাকা দেবেন বললেন। তারা রাজি হলো। হাবুলের সঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ পন্টুবাবুর (এটর্নি) অফিসে গেলেন। শর্তাদি জানিয়ে ওঁদের এটর্নি এন সি বসুর কাছে চিঠি পাঠানো হলো। তারা উত্তরে ওঁদের শর্ত স্বীকার করে চিঠি দিলেন।
এতো তীব্রগতিতে একদিনে এইভাবে আইনপাড়ার সাধারণত কাজ হয় না। স্পষ্টই মনে হয়, স্বামীজি আন্দাজ করেছিলেন, অপেক্ষা করবার মতন সময় তার হাতে আর নেই।
মৃত্যুর দুদিন আগে (২রা জুলাই) পন্টুকে শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে চারশো টাকা দেওয়া হলো–হাবুল দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী। সবই পারিবারিক চুক্তি অনুযায়ী করা হয়।
শুধু অর্থ নিয়েই মাতাপুত্রের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। আমরা শেষ দেখেছি কাশীপুর থেকে মায়ের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ গাড়িতে ফিরছেন, পাশে ছোটভাই এবং মা কাশীপুরে ঠাকুরের কাছে যা শুনেছেন তা বলছেন।
আরও একটি দৃশ্য আছে, ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ ঠাকুরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে কাশীপুর শ্মশান থেকে নরেন বাড়ি ফিরে এলেন এবং জামাকাপড় ধুতে দিলেন। কাপড়ের খুঁটে ঠাকুরের অস্থি বাঁধা ছিল। পরের দিন তিনি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, চাঁদরে অস্থি পেয়েছেন কি না। মা বললেন, চাঁদরের কোণে কতকগুলো কয়লার ছাই দেখে ফেলে দিয়েছি। ছেলে বললেন, “হায়! হায়! ওগুলোই তো রামকৃষ্ণের অস্থি।”
মামলা-মোকদ্দমার প্রথম ধাক্কা সামলে দিয়েই নরেন বিরলদৃশ্য হয়েছিলেন এবং সন্ন্যাসী হয়ে ভারত পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বাড়ির সঙ্গে বিশেষ কোন সম্পর্ক রইলো না, যদিও কলকাতায় থাকলে মাঝে-মাঝে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ১৮৯৭ সালে ইউরোপ থেকে ফেরবার আগে পর্যন্ত বাড়িতে কেউ তাকে গেরুয়া বসনে দেখেন নি।”
*
সত্যিই দুর্ভাগা জননী। তিন পুত্রই ভুবনেশ্বরীকে আমৃত্যু অশেষ বেদনা দিয়েছেন।
বরানগর মঠে ১৮৮৭ সালের গ্রীষ্মের প্রারম্ভে জ্যেষ্ঠ পুত্র গুরুতর অসুস্থ বলে অসহায় বিধবা সেখানে ছুটেছিলেন দ্বিতীয় পুত্রকে নিয়ে, কিন্তু নরেনই তখন নিয়ম করে দিয়েছে মঠে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। মাকে আচমকা ঢুকতে দেখে তার কথা, “আমিই নিয়ম করলুম, আর আমার বেলায়ই নিয়ম রদ হল?”
পরিব্রাজক বিবেকানন্দের কোনো খবরাখবর প্রায়ই থাকত না। মাকে লেখা স্বামীজির কোন চিঠি কারও সংগ্রহে নেই।
১৮৯১ সালে বৈশাখ মাসে রবিবারের এক সকালে ভুবনেশ্বরীর কাছে চিঠি এলো যে কন্যা যোগীন্দ্ৰবালা সিমলা পাহাড়ে আত্মহত্যা করেছে। তখন তার বয়স পঁচিশ। শোকাৰ্তমনে ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ চললেন বরানগর মঠে খবর দিতে।
যোগেন মহারাজ, বাবুরাম মহারাজ ও গিরিশচন্দ্র ঘোষ সিদ্ধান্ত করলেন স্বামী সারদানন্দের কাছে টেলিগ্রাম করবেন তিনি যাতে নরেনকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারেন, কারণ ভুবনেশ্বরী তখন অত্যন্ত শোকার্ত। হাওড়া স্টেশনে গিয়ে শরৎ মহারাজের নামে টেলিগ্রাম করা হল।
রামতনু বসু লেনে ভুবনেশ্বরী তখন অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে কাঁদছেন। বাবুরাম মহারাজ নিজেও শোকার্ত হয়ে বসে রইলেন, আর যোগেন মহারাজ জননীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। রাত ৯টায় সময় সন্ন্যাসীরা বাগবাজারে ফিরে গেলেন। যোগীন্দ্রবালার আত্মহত্যা সংবাদ সারদানন্দ মারফত বিবেকানন্দর কাছে আলমোড়ায় পৌঁছেছিল, তিনি প্রবল দুঃখও পেয়েছিলেন।
কিন্তু সংসারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর সে কী বেদনাময় সংগ্রাম।
মহেন্দ্রনাথের বর্ণনায় : টেলিগ্রামের মর্মার্থ শুনে শুরু হলো বুকের মধ্যে দড়ি টানাটানি। শেষে সন্ন্যাসীর জয় হলো। সারদানন্দকে ক্রন্দনরত সন্ন্যাসী বললেন, “তোরাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে, চিঠি দিয়ে এত গোলমাল বাধাস।.. আমাকে সব সময় তুই বিরক্ত করিস। আমি জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না, তুই কেবল সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবি।”
আত্মহত্যার বংশ? বলরামবাবুর বাড়িতে যোগেন মহারাজকে স্বামীজি একবার বলেছিলেন, “আমাদের এত বুদ্ধি মেধা কেন জানিস? আমরা যে সুইসাইডের বংশ। আমাদের বংশে অনেকগুলো আত্মহত্যা করেছে… আমাদের পাগলাটে ধাত, হিসেব-নিকেশের ধার ধারে না। যা করবার তা একটা করে দিলুম, লাগে তাক, না লাগে তুক।”
দত্তদের মেধা প্রসঙ্গে আরও একটি সরস ব্যাখ্যা আছে। মেজভাই মহেন্দ্রনাথকে নিরঞ্জন মহারাজ একবার বলেন, “নরেনের এতো বুদ্ধি কেন জানিস?নরেন খুব গুড়ুক যুঁকতে পারে। আরে গুড়ুক না টানলে কি বুদ্ধি বেরোয়…তামাক খেতে শেখ। নরেনের মতন মাথা খুলে যাবে।”
বোনের আত্মহননের শোক সামলে নিয়ে, আবার সব যোগাযোগ ছিন্ন করে অধিকতর দুর্গম গিরিগহ্বরে আশ্রয় নেবার জন্যে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ আচমকা পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
বরানগরে মাঝে মাঝে নরেন্দ্রনাথ ফিরতেন, কিন্তু বলে যেতেন, এই শেষ, আর ফিরছি না। ১৮৯১ থেকে তার একাকী ভ্রমণ। গুরুভ্রাতাদের সঙ্গেও তিনি সম্পর্ক ত্যাগ করেন।
কিন্তু বিবেকবান বিবেকানন্দ কি সত্যই গর্ভধারিণীকে নিষ্ঠুরভাবে মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন? না পেরেছিলেন?
সব চেয়ে আশ্চর্য, বিবেকানন্দর সাড়ে পাঁচশোর বেশি চিঠি আমাদের সামনে রয়েছে, কিন্তু একখানা চিঠিও নেই মাকে লেখা। মাও কি কোনোদিন বিলুকে একখানা চিঠি লেখেননি? বিশ্বাস হয় না, ভাবতেও ইচ্ছা করে না। সেসব চিঠি যদি লেখা হয়ে থাকে এবং সেইসব চিঠি খুঁটিয়ে দেখার সৌভাগ্য হলে গর্ভধারিণী ও সন্ন্যাসী সম্বন্ধে গবেষকরা নিশ্চয় আরও অনেক কিছু জানতে পারতেন।
কিন্তু বিবেকানন্দর মানসিকতার নিদর্শন তার অন্য কয়েকটি চিঠিতে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। দেওয়ান হরিদাস দেশাইকে তিনি লিখেছিলেন, “আপনি আমার দুঃখিনী মা ও ছোটভাইদের দেখিতে গিয়াছিলেন জানিয়া সুখী হইয়াছি, কিন্তু আপনি আমার অন্তরের একমাত্র কোমলস্থানটি স্পর্শ করিয়াছেন। আপনার জানা উচিত যে আমি নিষ্ঠুর পশু নই। এই বিপুল সংসারে আমার ভালবাসার পাত্র যদি কেহ থাকেন তবে তিনি আমার মা।.. একদিকে ভারতবর্ষ… লক্ষ লক্ষ নরনারীর দুঃখ.. আর অন্যদিকে আমার যত নিকট আত্মীয়-স্বজন আছে তাহাদিগের দুঃখ দুর্দশার হেতু হওয়া–এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমটিকেই আমি ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছি, বাকি যাহা কিছু প্রভুই সম্পন্ন করিবেন।”
আরেক জায়গায় সন্ন্যাসীর স্বীকারোক্তি : “জননীর নিঃস্বার্থ স্নেহ ও পূতচরিত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হওয়াতেই তিনি সন্ন্যাসজীবনের অধিকারী হইয়াছেন এবং তিনি জীবনে যা কিছু সকার্য করিয়াছেন, সমস্তই সেই জননীর কৃপাপ্রভাবে।”
আমরা আরও দেখেছি, ভুবনেশ্বরী শুধু ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক ইংরিজি শিক্ষা দেননি–কেবল লৌকিক শিক্ষা নয়, নৈতিক শিক্ষাও দিয়েছেন। গর্ভধারিণীর মতে, “সংসার সমুদ্রের নানা আবর্তে পড়ে নৈতিক জীবনকে অবহেলা করা অত্যন্ত দূষণীয়।”
পরিব্রাজক জীবনে মায়ের চিন্তা থেকে কখনও মুক্ত হতে পারেননি স্বামীজি। “মাদ্রাজে যখন মন্মথবাবুর বাড়িতে ছিলুম, তখন একদিন স্বপ্ন দেখলুম, মা মারা গেছেন! মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। তখন মঠেও বড় একটা চিঠিপত্র লিখতুম না–তা বাড়িতে লেখা তো দূরের কথা। মন্মথবাবুকে স্বপ্নের কথা বলায় তিনি তখনই ঐ বিষয়ের সংবাদের জন্য কলকাতায় তার করলেন।…মাদ্রাজের বন্ধুগণ তখন আমার আমেরিকায় যাবার যোগাড় করে তাড়া লাগাচ্ছিল; কিন্তু মায়ের কুশল সংবাদটা না পেয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। আমার ভাব বুঝে মন্মথবাবু বললেন, শহরের কিছু দূরে একজন পিশাচসিদ্ধ লোক বসবাস করে, সে জীবের শুভাশুভ ভূত-ভবিষ্যৎ সব খবর দিতে পারে…’পিশাচসিদ্ধ’ মায়ের মঙ্গল সমাচার বললে। ধর্মপ্রচার করতে আমাকে যে বহুদূরে অতি শীঘ্র যেতে হবে তাও বলে দিলে!”
পরিব্রাজকপর্বে স্বামীজি একবার সকলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেছিলেন। মীরাট থেকে গুরুভাইদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পরে অনেকদিন তার খবর নেই।
শেষে একখানা চিঠি এল বরানগরে, কিন্তু নাম লেখা নেই। বরানগরের হাতকাটা হাবুর বাড়িতে একটা ওষুধ পাওয়া যেত–ওইটা পাঠাতে অনুরোধ করেছেন। ওই চিঠি মধ্যমভ্রাতা মহিমকে দেখানো হলো। তিনি বললেন, নাম না থাকলেও দাদার চিঠি সন্দেহ নেই।
কয়েক বছর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের কোনো খবরই ছিল না। কেবলমাত্র জয়পুর থেকে একখানা চিঠি এসেছিল–তাতেও নাম লেখা নেই। পরে খেতড়ির রাজা অজিত সিং চিঠি দিতে লাগলেন। চিঠি বন্ধের আগে যে কয়েকখানি চিঠি এসেছিল তাতে স্বামীজির মনের ভাব যে অতি বিষণ্ণ তার প্রকাশ ছিল।
মহিমবাবু উল্লিখিত স্বামীজির একটি চিঠি বড়ই হৃদয়গ্রাহী : “ভগবান তো পেলাম না, অনেক চেষ্টা করলাম, তাতেও কিছু বুঝতে পারলাম না, এতে বুকের ভালবাসাটা বেড়ে গেছে, সকলের উপর একটা ভালবাসা এসেছে।”
*
মায়ের প্রতি, সংসারের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে স্বামীজি তার কর্তব্য পালন কীভাবে করেছিলেন, অথবা আদৌ করতে সক্ষম হননি তা এখনও ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গিয়েছে।
নতুন অধ্যায়ের শুরু হলো ১৮৯১ সালে। ওই বছর ৪ জুন বৃহস্পতিবার খেতড়ি নরেশ অজিত সিংজী ৬-৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠলেন, সন্ধ্যায় যোধপুরের মহারাজ প্রতাপ সিং-এর সঙ্গে আধঘণ্টা কাটালেন, তারপর এক সন্ন্যাসী এলেন তিনি বাংলা, ইংরিজি ও সংস্কৃত : ভাষায় পারঙ্গম।নানা বিষয়ে আলাপ করে রাত এগারোটায় স্বামীজি বিদায় নিলেন। সন্ন্যাসীকে আহারও দেওয়া হয়েছিল।…
এই হচ্ছে পরিচয়ের প্রথম পর্ব। বলাবাহুল্য স্বামীজি খেতড়ি মহারাজের হৃদয় জয় করলেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, মহারাজও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর হৃদয়স্পর্শ করলেন। স্বামীজি প্রথমবারে খেতড়িতে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ছিলেন–পরিব্রাজক জীবনের দীর্ঘতম অবস্থান–প্রায় পাঁচ মাস। মনে রাখা প্রয়োজন, স্বামী প্রভানন্দের হিসাব অনুযায়ী স্বামীজি তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠে মাত্র ১৭৮ দিন অবস্থান করেছিলেন।
এরপরেও তিনি দুবার খেতড়িতে এসেছেন, একবার আমেরিকা যাবার আগে এবং আরেকবার পাশ্চাত্যদেশ থেকে ফিরে।
খেতড়িতে থাকার কোনো একসময়ে মহারাজ অজিত সিং শ্রদ্ধেয় স্বামীজির পারিবারিক দায়িত্বর কথা শুনে তাঁকে চিন্তামুক্ত করতে মনস্থ করেন।
মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন : “খেতড়ির মহারাজা, শরৎ মহারাজের, যোগেন মহারাজের, সান্ডেলমশায়ের মারফৎ স্বামীজির মাতাঠাকুরাণীকে মাসে একশত টাকা পাঠাইয়া দিতেন এবং বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছিলেন যে, এসকল কথা যেন অপরে না জানিতে পারে।”
খেতড়ির মহাফেজখানায় ইদানীং যেসব চিঠির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, অন্তত ১৮৯২ থেকে স্বামীজির পরিবারের সঙ্গে মহারাজের পত্রালাপ চলছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ তারিখে ৭ রামতনু বোস লেন থেকে মহেন্দ্রনাথের চিঠি : “বহুদিন পত্র না পাইয়া বিশেষ চিন্তিত আছি।… প্রায় পনেরো দিন পূর্বে দাদার খবর পাইয়াছি। তিনি এখন মাদ্রাজে।”
২২ মার্চ ১৮৯৩-এর চিঠিতে মহেন্দ্রনাথ খেতড়ি মহারাজকে তার সম্প্রতিপঠিত পুস্তকের তালিকা দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে কনিষ্ঠ ভ্রাতা সম্বন্ধে জানাচ্ছেন, “কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে শহরের অন্যতম বিদ্যালয় মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে পাঠাইয়াছি। সে ভালই লেখাপড়া করিতেছে।…দাদার খবর পাইলাম। তিনি এখন মাদ্রাজে এসিসট্যান্ট কট্রোলার অফ মাদরাজ শ্ৰীমন্মথনাথ ভট্টাচার্যের গৃহে আছে।”
যাঁদের ধারণা, স্বামীজির দ্বিতীয়বার খেতড়ি ভ্রমণের সময় (এপ্রিল ১৮৯৩) পারিবারিক সাহায্যের কথা হয়, তা ঠিক নাও হতে পারে। ২১শে এপ্রিল থেকে ১০ মে স্বামীজি তিন সপ্তাহকাল খেতড়িতে ছিলেন।
বিদেশযাত্রার ব্যাপারে খেতড়ির অসামান্য অবদানের কথা এখন আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমরা কেবল সন্ধান করছি মায়ের দুঃখ অপনোদনে স্বামীজির প্রচেষ্টার বিবরণ।
বেণীশঙ্কর শর্মা এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “যাহা কিছু পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাহাই নিন্দনীয় বা বর্জনীয় এমন মনোভাব তাঁহার ছিল না। মাতৃভক্তিকে তিনি সন্ন্যাসের বেদীমূলে বলি দেন নাই। বরং দেখি, মাতার জন্য তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নেতৃত্ব, যশ, সব কিছুই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।”
বেণীশঙ্কর শর্মার মতে, “স্বামীজিকে আমেরিকা পাঠাইবার যে ব্যয়বহুল সংকল্প মহারাজা গ্রহণ করেন, তাহার মধ্যে স্বামীজির মাতা ও ভ্রাতাদের জন্য মাসিক একশত টাকা ব্যয় বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত ছিল বলিয়া মনে হয়। মহারাজ মনে ভাবিয়া থাকিতে পারেন, স্বামীজিকে মাতা ও ভ্রাতা সম্পর্কিত দুশ্চিন্তা হইতে মুক্ত রাখিয়া বিদেশে পাঠানোই তাহার কর্তব্য।”
আমেরিকা যাত্রার দুদিন পর, ২ জুন ১৮৯৩, মহেন্দ্রনাথ মাতুলালয় থেকে লেখেন : “গত ৩১ মে তারিখে আপনার অনুগ্রহপত্র ও পঞ্চাশ টাকা পাইয়া কৃতার্থ হইয়াছি। আপনার পত্রের মর্ম স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে, আমার মাতা ও মাতামহীকে পাঠ করিয়া শুনাইয়াছি..আমার মাতা ও মাতামহী দাদার পৃথিবী পরিভ্রমণে সম্মতি জানাইতেছেন।…”
১৩ জুন ১৮৯৩ খেতড়িনরেশকে মহেন্দ্রনাথের আবার পত্রাঘাত। “অবগত হইলাম যে দাদা বর্মা গিয়াছেন। তথা হইতে চীন বা অন্যত্র কোথাও যাইবেন।…আমার মাতা ও মাতামহী আপনার ন্যায় মহানুভবের পরিবারবর্গকে আন্তরিক আশীর্বাদ জানাইতেছেন।”
একই দিনে খেতড়ির মহারাজাকে রামকৃষ্ণানন্দের চিঠি–”মহেন্দ্রনাথ আপনার প্রেরিত একশত টাকা পাইয়াছে।”
২০শে জুলাই ১৮৯৩ স্বামী শিবানন্দ এক চিঠিতে স্বামীজির পরিবারকে সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে মহারাজকে প্রশ্ন করেছেন, “কানাঘুষা শুনিতেছি, বিবেকানন্দ ইংলন্ড অভিমুখে যাত্রা করিয়াছে। যদি তাই হয়, আপনি কি তাহার ইংলন্ডের ঠিকানা জানেন?”
পারিবারিক সাহায্যের ব্যাপারটা এতই গোপন রাখা হয়েছিল যে প্রথম পর্বে মুন্সী জগমোহনলালও ব্যাপারটা জানতেন না। তখনকার দিনে রাজস্থান থেকে বাংলায় টাকা পাঠাবার পদ্ধতি সম্বন্ধে একটা মজার ধারণা পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথকে লেখা জগমোহনলালের ৬ জুলাই ১৮৯৩-এর চিঠি থেকে। “আমি মহামহিমান্বিত খেতড়ি মহারাজের অধীনস্থ কর্মচারি এবং আপনাদের পরিবারের যাবতীয় বিষয় তিনি বিশ্বাসযোগ্য বিবেচনায় আমাকে গোপনে জানাইয়াছেন..মহারাজের ইচ্ছানুযায়ী v/41 62743 নম্বর সম্বলিত একশত টাকার কারেন্সি নোটের অর্ধাংশ আপনাদের সংসার খরচের জন্য পাঠাইলাম। আপনার প্রাপ্তিপত্র পাইলে দ্বিতীয়াংশ পাঠাইব।”
৩১শে জুলাই ১৮৯৩ কলকাতা থেকে জগমোহনলালজীকে মহেন্দ্রনাথের উত্তর : “প্রীত হইলাম যে আপনি দাদাকে খেতড়ি হইতে মাদ্রাজ এবং তথা হইতে বোম্বাইয়ে স্টীমার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। কলিকাতায় তাঁহার সম্বন্ধে কোন সংবাদ পাওয়া যাইতেছেনা।…গত তিন মাস দাদা বাংলাদেশের কোন বন্ধুকেই কোন পত্ৰই দেন নাই।…আপনি আমার পাঠসংক্রান্ত খবর লইয়াছেন। আমি আপনাকে সানন্দে জানাইতেছি যে এযাবৎ আমি ভালভাবে লেখাপড়া করিয়াছি, ক্লাসের সহিত সমান তালে চলিতেছি এবং আমার অধ্যাপকগণ প্রীত আছেন।..”
“পুনশ্চ : একশত টাকার কারেন্সি নোটের অর্ধাংশ পাইয়াছি। ভবিষ্যতে এইরূপ কারেন্সি নোট পাঠাইলে দয়া করিয়া রেজেস্ট্রি যোগে পাঠাইবেন। কেননা পোস্টাপিসের লোকেরা সন্দেহক্ৰমে চোখ রাখিয়াছে এবং হয়তো খাম খুলিয়া নিজেরাই আত্মসাৎ করিবে, এইরূপ ইঙ্গিতও তাহারা দিয়াছে।”
স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ খেতড়িকে চিঠি লিখতেন বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের সরকারি অফিসের ঠিকানা থেকে। ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯৪ তিনি খেতড়ির জগমোহনলালজীকে জানাচ্ছেন, “অনেকদিন পর আমাদের শ্রদ্ধেয় ভাই বিবেকানন্দর পত্র পাইয়াছি। তিনি এখন চিকাগোয় আছেন এবং ভাল আছেন।… কয়েকদিন পূর্বে মহেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিয়াছি। সে, তাহার মাতা, ছোট ভাই সকলে কুশলে আছে। সে এখন লেখাপড়া লইয়া বিশেষ ব্যস্ত, প্রতিদিন একটি করিয়া পাঠ্য পুনর্পাঠ করিতেছে। আগামী মাসের ২৬ তারিখে তাহার পরীক্ষা। স্বামীজির আত্মীয়বর্গের অভাব মোচনের ভার যখন মহারাজ লইয়াছেন তখন আমার আর উক্ত বিষয়ে কোনরূপ চিন্তা করা সাজে না; কি কর্তব্য তিনিই ভাল জানেন।”
সম্প্রতি বিভিন্ন পরীক্ষায় মহেন্দ্রনাথের ফলাফল ও সার্টিফিকেট দেখার সৌভাগ্য হয়। এনট্রান্সে (১৮৮৮-৮৯) প্রথম শ্রেণী পেলেও, এফ এ এবং বি এতে তিনি থার্ড ডিভিশন। বি এতে তৃতীয় শ্রেণী পেয়ে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যেতে সেযুগেও দুঃসাহসের প্রয়োজন হতো।
উনিশ শতকের শেষ দশকে মাসিক একশ টাকার নিয়মিত ব্যবস্থা নিতান্ত ছোট ব্যাপার নয়। তখন কলকাতায় শিক্ষিত কেরানির মাইনে তো ১৫ টাকা। যাঁরা মাসে পঞ্চাশ টাকা পান তারা দোলদুর্গোৎসব করতেন। কেউ কেউ বলেন, এই একশ টাকা আজকের দশহাজার টাকা, কেউ বলেন কুড়ি হাজার টাকা। গুরুর পরিবারের প্রতি একজন ভক্তের এই বদান্যতা সত্যিই স্মরণে রাখার মতন। কারণ বাঙালিরা পরবর্তীকালেও রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের ভক্ত হলেও কখনও তারা উদারহস্ত হননি। মনে রাখা প্রয়োজন, টাইটেল মহারাজা হলেও, খেতড়ি এমন কিছু বড় আকারের রাজ্য ছিল না। আরও মনে রাখা দরকার, মামলামোকদ্দমার রাহু সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকলে সেই সন্তাগণ্ডার যুগেও একশ টাকার মাসিক ব্যবস্থা কোনো সমস্যার অবসান ঘটায় না।
আরও একটি লক্ষ্য করবার বিষয় রয়েছে–দানের গোপনীয়তা। মহারাজ অজিত সিং চাননি তাঁর সাহায্যর কথা প্রকাশিত হোক। এই সাহায্যপর্বের শুরু ১৮৯১ সালে, কিন্তু খবরটা প্রকাশিত হল আরও আটদশক পরে যখন দত্ত পরিবারের নায়ক-নায়িকাদের কেউ ইহজগতে নেই। ভুবনেশ্বরীর জীবনাবসান ১৯১১, দিদি স্বর্ণবালার ১৯৩২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, মহেন্দ্রনাথের ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ এবং কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথের ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১। যদিও স্বামীজি প্রকাশ্যে খেতড়ির ঋণ স্বীকার করে বিদেশ থেকে ফিরে (১৭ ডিসেম্বর ১৮৯৭) বলেছিলেন, “ভারতের উন্নতির জন্য সামান্য যা কিছু আমি করতে পেরেছি খেতড়ি রাজের সঙ্গে পরিচয় না হলে তা আমার পক্ষে সম্ভব হত না।”
খেতড়ি রাজের ওপর স্বামীজির নির্ভরতার আরও কিছু কথা এখনও বাকি আছে। স্বামীজির জীবনসায়াহ্নের সেই মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলি গর্ভধারিণী প্রসঙ্গে যথা সময়ে এসে পড়বে।
কিন্তু তার আগে আমেরিকা ও ইউরোপে গিয়েও স্বামীজির মাতৃচিন্তার কিছু খবর নেওয়া মন্দ হবে না।
*
মার্কিনমুলুকের প্রথম পর্বে মাতৃপ্রেমী বিবেকানন্দ অবাক হলেন, ছেলেরা তাদের মাকে নাম ধরে ডাকছে। আরও অবাক হলেন যখন দেখলেন, মা সম্বোধন করলে মার্কিন মহিলারা আঁতকে ওঠেন। প্রথমে না বুঝতে পারলেও পরে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো, মা ডাকটা মেনে নেওয়া মানেই তো স্বীকার করে নেওয়া যে যথেষ্ট বয়স হয়েছে!
আমেরিকায় সুযোগ পেলেই পরিচিত মহলে তিনি গর্ভধারিণী মায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন। ছোটবেলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে মায়ের কাছে যেসব গল্প-কবিতা শুনেছেন তা হড়হড় করে বলে যেতেন। তাঁর স্মৃতিশক্তির উল্লেখ হলেই বলতেন, “হ্যাঁ, আমার মায়েরও ঐ ধরনের স্মৃতিশক্তি আছে। একবার রামায়ণ শুনলে তিনি গড়গড় করে বলে যেতে পারেন।”
স্বামীজির স্মরণে ছিল, তার মায়ের কণ্ঠস্বর খুব মিষ্টি। কৃষ্ণযাত্রার গান তিনি আপনমনে গাইতেন। দুপুরে কয়েক ঘণ্টা এবং রাত্রে কয়েক ঘণ্টা সেই বিদ্যুৎবিহীন যুগে নিত্যপাঠ করতেন।
আর জননীর শেষবয়সের দেহবর্ণনাও তত রয়েছে। তার শরীরের গঠন ছিল বলিষ্ঠ, চোখ দুটি বৃহৎ ও আয়ত–চলতিভাষায় পটলচেরা চোখ। তার মধ্যে সবল, দৃঢ়চিত্ত ও তেজস্বিতার ভাব যেন ঠিকরে বের হতো।” দেখে মনে হতো এমন মায়েরই স্বামীজির মত ছেলে হওয়া সম্ভব। তিনভায়েই কতকটা মায়ের মুখাকৃতি পেয়েছিলেন।
মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “স্বামীজির চোখদুটি মায়েরই অনুরূপ–তবে তার চোখে যে কি ছিল তা মুখে বলা যায় না।”
মায়ের ছিল আত্মশক্তি। চরম বিপদেও এই আত্মশক্তির আগুন তিনি নিভতে দেননি। এবিষয়ে বিবেকানন্দর উক্তি অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখা ভাল। “জগতের ইতিহাস হচ্ছে কতকগুলি আত্মশক্তিতে বিশ্বাসবান লোকের ইতিহাস।… যে মুহূর্তে একটা মানুষ বা একটা জাত নিজের উপর বিশ্বাস হারায় সেই মুহূর্তে সে মরে।”
ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কারাবাসের সময় (স্বামীজির মৃত্যুর পরে) কলকাতার কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা স্যর নীলরতন সরকারের বাড়িতে বীরজননীকে ডেকে একটি মানপত্র দেন। স্থান ৬১ হ্যারিসন রোড, তারিখ ২৪ শ্রাবণ ১৩১৪।
মুক্তিলাভের পর ভূপেন্দ্র মাকে বলেছিলেন, “বিবেকানন্দর মা হয়ে তুমি কোন স্বীকৃতি পেলে না, কিন্তু আমার মা হয়ে তুমি জন-সম্বর্ধনা লাভ করেছ।”
ভূপেন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করছেন, হাসতে হাসতে বলেছিলাম। কারণ বিদেশে স্বামীজির মুখে মুখে মায়ের কথা প্রচারিত হয়েছিল। ১৮৯৪ খ্রষ্টাব্দে বোস্টনে স্বামীজি ‘মাই মাদার’ নামে এক উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা দেন। ডিভাইন মাদার। হিউম্যান মাদার কি করে আসছে, সেটি তিনি সেদিন বলছিলেন। বক্তৃতা শুনে বিদুষী শ্রোতৃবৃন্দ এতদূর মোহিত হয়েছিলেন যে বড়দিনের সময় তারা স্বামীজির অজ্ঞাতসারে মেরী-অঙ্ক সুশোভিত বালক খ্রীস্টের একটি সুন্দর চিত্রের সহিত একখানি পত্র দিয়া স্বামীজির জননীর নিকট প্রেরণ করেন। সেই পত্রে স্বামীজি ভগবান যীশুখ্রীস্টের সদৃশ এই ভাবটি প্রকাশিত হইয়াছিল।”
“আজ মেরীপুত্র ভগবান যীশুর জন্মদিন।…এই শুভক্ষণে আমরা আপনাকে অভিনন্দিত করিতেছি, কারণ আপনার পুত্র এক্ষণে আমাদিগের মধ্যে অবস্থান করিতেছেন। কয়েকদিন পূর্বে তিনি বলেন যে ওখানকার আবালবৃদ্ধবনিতার কল্যাণার্থ তিনি যাহা কিছু করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাহা কেবল আপনার শ্রীচরণাশীর্বাদে।…হে পুণ্যচরিতে, আপনার জীবনের কার্যসমূহ আপনার সন্তানের চরিত্রে প্রতিফলিত। সেই মহৎ কার্যের মাহাত্ম্য সম্যক উপলব্ধি করিয়া আমরা আপনার প্রতি আমাদের হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতেছি।”
কিন্তু শুধু মাতৃস্তুতি নয়, মায়ের মতামতের ওপর স্বামীজির কতখানি নির্ভরতা ছিল তা স্পষ্ট হয় যখন প্রতাপ মজুমদার মার্কিন দেশে তার চারিত্রিক নিন্দে শুরু করেন–”ও কেউ নয়, ঠগ, জোচ্চোর, ও তোমাদের দেশে এসে বলে–আমি ফকীর।”
এই সময়ে স্বামীজির একটি করুণ চিঠি: “আমার বুড়ী-মা এখনও বেঁচে আছেন, সারাজীবন তিনি অসীম কষ্ট পেয়েছেন, সেসব সত্ত্বেও মানুষ আর ভগবানের সেবায় আমাকে উৎসর্গ করার বেদনা তিনি সহ্য করেছেন। কিন্তু তার সবচেয়ে ভালবাসা যে ছেলেটিকে তিনি দান করেছে, সে দূরদেশে গিয়ে কলকাতার মজুমদার যেমন রটাচ্ছে–জঘন্য নোংরা জীবনযাপন করছে, এ সংবাদ তাকে একেবারে শেষ করে দেবে।”
সৌভাগ্যের বিষয় একই সময়ে মার্কিনী মহিলারা আমেরিকা থেকে ভুবনেশ্বরী দেবীকে স্বামীজির অজান্তে জানান : “এখানকার আবাল-বৃদ্ধ বনিতার কল্যাণার্থে তিনি যাহা কিছু করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাহা কেবল আপনার শ্রীচরণাশীর্বাদে”।
আরও কয়েকবছর পরে বিদেশের মাটিতে স্বামীজি সমস্ত হৃদয় ঢেলে দিয়ে অপূর্ব ও স্বার্থশূন্য, সর্বংসহা, নিত্য ক্ষমাশীলা জননী’র প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।”ধন্য আমাদের জননী! যদি মায়ের পূর্বে আমাদের মৃত্যু হয়, তাহা হইলে মায়ের কোলেই মাথা রাখিয়া আমরা মরিতে চাই।..আমাকে পৃথিবীতে আনিবার জন্য তিনি তপস্বিনী হইয়াছিলেন। আমি জন্মাইব বলিয়া তিনি বৎসরের পর বৎসর তাহার শরীর-মন, আহার পরিচ্ছদ, চিন্তা কল্পনা পবিত্র রাখিয়াছিলেন। এই জন্যই তিনি পূজনীয়া।”
মার্কিন দেশে প্রথম পর্বে মায়ের সঙ্গে স্বামীজির কী ধরনের ভাবের আদান-প্রদান ছিল তা আজও খুব স্পষ্ট নয়।
ইংলন্ডে ১৮৯৬ সালে আমরা আবার স্বামীজির অনেক পারিবারিক সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। পূর্বপর্বে আমরা জানি, তার প্রাণাধিক প্রিয় গুরুভাইরা স্বামীজির অনুরোধের ওপর গভীর গুরুত্ব দিয়ে তার পরিবারের সবরকম সমস্যা সামলাচ্ছেন। একমাত্র বিবেকানন্দর মতন মহামানবের পক্ষেই পূর্বাশ্রম ও সন্ন্যাসপর্বের দায়দায়িত্ব এমনভাবে পালন করা সম্ভব।
*
এবার কেন্দ্র লন্ডন। লন্ডন থেকে মিসেস ওলি বুলকে স্বামী বিবেকানন্দ ৫ জুন ১৮৯৬ জানাচ্ছেন, “আমার ভাই মহিন গত দু’মাস ধরে লন্ডনে রয়েছে, সে ব্যারিস্টার হতে চায়।”
মহেন্দ্রনাথের রচনা থেকে আমরা জানি, “শরত্মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) ১৮৯৬ সালের মার্চ মাসে কলকাতা থেকে জাহাজে লন্ডনে যান। শরৎ মহারাজ কলিকাতা পরিত্যাগ করিবার এক সপ্তাহ পরে বর্তমান লেখক আইন অধ্যয়ন করবার জন্য লন্ডনে গমন করেন।”
এই বিলেত যাওয়ার ব্যাপারে স্বামীজির সাহায্য বা সমর্থন কতখানি ছিল তা আজও অস্পষ্ট। যদিও মহিমবাবু লিখেছেন, “স্বামীজি বাচস্পত্য অভিধান চাহিয়া পাঠাইয়াছিলেন, সেইজন্য সকলে মিলিয়া ১০০ টাকা দিয়া অভিধানটি ক্রয় করিয়া বর্তমান লেখকের সহিত পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।”
লন্ডনে স্বামীজি তখন নিজের জীবনযুদ্ধ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তার ওপর বিদেশে পদে পদে ভাইয়ের উপস্থিতি যে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছিল তা এখন আমাদের জানা হয়ে গিয়েছে। আমাদের একমাত্র আনন্দ, মহেন্দ্রনাথ এইভাবে লন্ডনে হাজির হয়ে বিবেকানন্দর সমস্যা বাড়ালেও, তিনি না গেলে আমরা ‘লন্ডনে বিবেকানন্দ’ নামে তিন খণ্ডের অসামান্য গ্রন্থ থেকে বঞ্চিত হতাম।
আমরা জানি, বহুবৎসর পরে স্বামীজিকে দেখে মেজভাই মহিমের ভাইকে চিনতে একটু বিলম্ব হয়েছিল।
‘বিবেকানন্দ ইন দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থের নমস্যা লেখিকা মেরি লুইস বার্ক স্বামীজির কয়েকটি চিঠির সবকটি লাইন পুনরুদ্ধার করে প্রবাসী সন্ন্যাসীর তখনকার ছবিটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এর আগে আমেরিকা থেকে স্বামীজি একবার ইংলন্ডে গিয়েছিলেন। এটি দ্বিতীয়বার। স্বামীজি তাঁর ভাইকে দেখে আহ্লাদ করে একটি সোনার কলম দিয়েছিলেন। এই কলম মহেন্দ্রনাথ আবার ছোটভাইকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ডাকওয়ালাদের হাত থেকে তা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছয়নি। প্রথম সাক্ষাতের পর, পকেট থেকে পাঁচপাউন্ড দিয়ে ভক্ত কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে নিজের ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন।
আরেকদিন দুপুরবেলায় ভাইয়ের ঘরে ঢুকে স্বামীজি পরামর্শ দিলেন, আঙুলগুলো সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখবে, নখে যেন ময়লা না থাকে। বড় নখ হলে কেটে ফেলবে। আমার জামার পকেটে নখ কাটবার অনেকরকম যন্ত্র আছে। সর্বদা ফিটফাট থাকবে, নইলে লোকে ঘৃণা করবে।
মিসেস বুলকে স্বামীজি তার ভাই সম্বন্ধে লিখলেন, “আমি চাই সে ইলেকট্রিসিয়ান হোক। আমার ইচ্ছে সে আমেরিকায় গিয়ে কোনো ভাল ইলেকট্রিসিয়ানের অধীনে কাজ করে। খেতড়ির রাজা তাকে কিছু টাকা পাঠাবেন। আমার কাছে যে ৩০০ পাউন্ড আছে তার পুরোটাই আমি তাকে দিতে পারি। আপনি আমাকে বছরে যে ১০০ ডলার দিতে চেয়েছেন সেটা আমি নেব না।” এরপরেই ভাইয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন!”প্রত্যেক পনেরোদিন অন্তর তার জঙ্গল জ্বর’ হচ্ছে। ছেলেটি খুব ভাল।”
খ্যাতনামা শিল্পী নন্দলাল বসুর সঙ্গে পরবর্তীকালে মহিমবাবুর আন্তরিক যোগাযোগ হয়েছিল। তার স্মৃতিচারণ : “মহিমের বিলেত যাওয়ায় স্বামীজি খুশি হননি। সম্ভবত পয়সাকড়ির অভাবের জন্য। মহিমবাবু লন্ডনে বছর দেড়-দুই ছিলেন…খানিকটা অভিমান করে আর হাতে বেশি পয়সা না থাকার জন্যে মহিমবাবু বিলেত থেকে সোজা হেঁটে এদেশে ফিরে আসার মনস্থ করলেন।..সব রাস্তাটাই পায়ে হেঁটে হেঁটে…য়ুরোপের নানান দেশের ভেতর দিয়ে গিয়ে উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া, গ্রীস, ইরান, সিরিয়া, রাশিয়া, বুলগেরিয়া হয়ে…পাঁচ বছর ধরে দেশ পর্যটন করে ১৯০২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরলেন।” . মনে রাখা প্রয়োজন, বিলেতে যখন দুই ভাইয়ের দেখা হয় তখন স্বামীজির বয়স ৩৩, মহিমের ২৬, সারদানন্দের ৩০, দ্রুতলেখক গুডইনের ২৫ এবং অপর সঙ্গী জন ফক্সের ২৩। মহিম অকস্মাৎ উধাও হয়ে বিশ্বপরিভ্রমণে বেরুবার পরেও এই ফক্সের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। জেনে রাখা ভাল, উদাসী পথিক হয়ে বেরিয়ে পড়বার পরে প্রায় ছ’বছর মহিম তার মাকে একখানাও চিঠি লেখেননি।
পরের বছর মিস্ ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে বিবেকানন্দ অনুরাগী মিস্টার স্টার্ডি জানাচ্ছেন, “মহিমের ব্যাপার জানি না, সে একেবারে উধাও হয়েছে, কোনো ঠিকানা রেখে যায়নি। আমি তার চিঠিপত্তর পোস্টাপিসে ফেরত দিয়েছি।”
শোনা যায় লন্ডনে ভাইকে নিয়ে স্বামীজির বেশ কিছু অসুবিধা হয়েছিল। মহিম ইলেকট্রিসিয়ান হতে আগ্রহী নন। বিবেকানন্দর খুবই ক্ষোভ মিস মুলার তার ভাইকে জ্বর অবস্থায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ১৮৯৬ সালের শরৎকালে লন্ডনে মহিম একের পর এক লজিং হাউস পাল্টাচ্ছেন এবং তেমন কিছুই করছে না।
স্বামীজির ক্ষিপ্রলিপিকার জে জে গুডউইন সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মহেন্দ্রনাথ নিজেই পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, সারদানন্দ ও গুডউইনের সঙ্গে ভাইকেও স্বামীজি একই সঙ্গে আমেরিকায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। “লন্ডন অপেক্ষা নিউ ইয়র্কে অনেক কিছু শিক্ষা করিবার বিষয় আছে।” আমেরিকাতে ইলেকট্রিসিটির কলকজা ও নানা প্রক্রিয়া লক্ষ্য করিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন।মহেন্দ্রনাথের ভাষায় “গুডউইনবর্তমান লেখককে আমেরিকাতে সাথী করিবার জন্য কয়েকদিন বিস্তর চেষ্টা করিয়াছিলেন। কখনও মিষ্টি কথায়, কখনও গালাগালি দিয়ে, কখনও বা হাস্যকৌতুকে নানাভাব উহার মত বদল করাইতে চেষ্টা করিলেন। স্বামীজির বাচনভঙ্গী অনুকরণ করে গুডউইন কথা বলেছিলেন।”গুডউইন তখন সিংহের সরব গর্জন করিয়া, ঘুসি পাকাইয়া বর্তমান লেখককে বলিতে লাগিলেন, মারব ঘুসি, দাঁত ভেঙে দেব, নাক ভেঙে দেব, চ আমেরিকায়।” অভিমানী মহিম দাদার কাছ থেকে কলকাতায় ফেরত আসবার জাহাজভাড়া না চেয়ে পরিব্রাজক হিসেবে বেরিয়ে পড়েন এবং বহু দেশ ঘুরতে ঘুরতে দেশে ফেরেন।
খেতড়ির কাছে লন্ডন থেকে লেখা চিঠিতে (১৩.১.১৮৯৯) এক সাহায্যপ্রার্থী বাঙালি (অক্ষয়কুমার ঘোষ) জানান, “আপনি মহিনের জন্য যে ত্রিশ পাউন্ড পাঠাইয়াছিলেন তাহা মিঃ স্টার্ডির কাছে রাখা আছে। গত উনিশ মাস মহিনের কোন খবর নাই।”
কলকাতা থেকে ৭ই জুলাই ১৮৯৮ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত খেতড়ির জগমোহনলালকে জানাচ্ছেন, “বহুদিন আপনার সহিত পত্রালাপ করি নাই। আমি সংবাদ পাইয়াছি আমাদের অগ্রজ এখন তুর্কীতে, তথা হইতে তিনি পারস্য, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া হইয়া চীনের প্রাচীর পর্যন্ত যাবেন। এই খবর তিনি মিঃ ট নামক এক আমেরিকানকে এবং তাহার মারফত আমরা পাই।”
সন্ন্যাসী হয়েও সংসারের নানাবিধ সমস্যা থেকে মুক্তি ছিল না বিবেকানন্দর। কিছুদিন পরে ফক্সকে স্বামীজি জানাচ্ছেন: “দয়া করে মহিনকে লিখবেন, সে যা করছে তাতে আমার আশীর্বাদ থাকবে। আমি অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসি। একমাত্র কথা, আমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, বেশিদিন বাঁচবো বলে আশা করি না, মহিনকে যে করেই হোক মায়ের এবং পরিবারের হাল ধরতে হবে। আমার যে কোন সময়ে মৃত্যু হতে পারে। আমি এখন তাকে খুব পছন্দ করি।”
এই চিঠিতে লন্ডনপর্বের কিছু অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত আছে, যদিও মহেন্দ্রনাথের সারাজীবনের সমস্ত রচনায় দাদার প্রতি গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রবাসে অপরের দয়ার ওপর নির্ভরশীল বিবেকানন্দ তার ভাইকে স্নেহপ্রশ্রয় দিয়েছিলেন তা, ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
পরবর্তী একসময়ে বিরক্তিতে ফেটে পড়ে বিবেকানন্দ ইংলন্ডের স্টার্ডিকে তীব্র পত্রাঘাত করেছিলেন। মিস মুলারের অভিযোগ ছিল, সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ পারিবারিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েন। স্টার্ডিকে বিবেকানন্দ লেখেন : “সেন্ট জর্জেস রোডের বাড়ির দায়িত্বে ছিলে তুমি এবং মিস মুলার। আমার ভাই অসুস্থ মিস্ মুলার তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন।…তুমি আমাকে কাজের জন্যে যে পয়সা দিয়েছে তার প্রতিটি কড়ি ঠিক জায়গায় রয়েছে। তোমাদের চোখের সামনে আমি আমার ভাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি–বোধহয় তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি, আমি তাকে একটা আধলা দিইনি যা আমার নিজের সম্পত্তি নয়।”
*
১৬ ডিসেম্বর ১৮৯৬ ইংলন্ড ত্যাগ করে ভারতের পথে যাত্রা শুরু করেন। বিবেকানন্দ। কলম্বো ঘুরে কলকাতায় ফেরেন ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭।
তারপর বেশ কিছুদিন ঝড়ের বেগে মঠ মিশন প্রতিষ্ঠা এবং আসমুদ্র ভারত ঘুরে বেড়ানো।
নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই স্বামীজির। পরের বছর সেপ্টেম্বরে তিনি কাশ্মীরে, ঠিকানা কেয়ার অব ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, প্রধান জজ। সেখানে দু’সপ্তাহ অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে আবার খেতড়ির মহারাজকে চিঠি (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮): “আমার অর্থের প্রয়োজন। যদিও আমার আমেরিকান বন্ধুগণ আমায় যথাসাধ্য সাহায্য করছেন তবু সব সময় হাত পাততে লজ্জা হয়, বিশেষত এই কারণে যে রোগ হওয়া মানেই একটানা অর্থব্যয়। পৃথিবীতে একটিমাত্র লোকের কাছে ভিক্ষা চাইতে আমার লজ্জা বা সংকোচ হয় না, সে লোক আপনি! আপনি দেন বা না দেন, আমার কাছে দুই-ই সমান। যদি সম্ভব হয়, দয়া করে আমাকে কিছু টাকা পাঠাবেন।”
মহারাজ তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেন। কৃতজ্ঞ স্বামীজির উত্তর আসে বেলুড় থেকে। কলকাতার পোদ্দার শেঠ দুলিচাঁদ কাকরাণির কাছে ৫০০ টাকার যে অর্ডার কেটে পাঠিয়েছেন তার প্রাপ্তিস্বীকার এবং সেই সঙ্গে, “আমি এখন একটু ভাল আছি। জানিনা এই উন্নতি চলতে থাকবে কিনা।”
শরীর খারাপ থাকায় সংসার-সমস্যা মেটাবার জন্যে স্বামীজি ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। নভেম্বর মাসে তিনি খেতড়িকে লেখেন, “বংশলোপ নিবারণের জন্য কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিবাহ দিতে চাই।”
এব্যাপারে মায়ের ইচ্ছা যে প্রবলভাবে উপস্থিত তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। স্বামীজি নিজে কিন্তু একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, যদি মহেন্দ্রনাথ বিয়ে করতে চান, তাঁকে দূর করে দেবেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সিদ্ধান্ত, মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথের মধ্যে ছোটকেই তিনি অধিক বিবাহযোগ্য মনে করেছিলেন। কিন্তু মনে রাখা ভাল, এই চিঠি লেখার সময় ভূপর্যটক মহেন্দ্রনাথের কোনো পাত্তা নেই।
পরের সপ্তাহে ২২ নভেম্বর ১৮৯৮ বেলুড় থেকে স্বামীজি খেতড়িকে সেই দুঃখময় গোপন চিঠি লেখেন যা পড়লে শতবর্ষ পরেও হৃদয়বান পাঠকের চোখ সজল হয়ে ওঠে। “মাননীয় মহারাজা,…আপনি জানেন বিদেশ থেকে ফেরার পর থেকেই আমি ভুগছি।… এই অসুস্থতা সারবার নয়।… এই দুবছর বিভিন্ন জায়গায় বায়ু পরিবর্তন করেও প্রতিদিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে, আমি এখন প্রায় মৃত্যুর দ্বারে। আজ আমি মহারাজের প্রদত্ত আশ্বাস, মহানুভবতা ও বন্ধুত্বের কাছে একটা আবেদন জানাচ্ছি। আমার বুকের মধ্যে একটা পাপ সারাক্ষণ পীড়া দেয়–আমার মায়ের প্রতি বড় অবিচার করেছি। আমার মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ বাইরে চলে যাওয়ায় মা শোকে একেবারে মুহ্যমান, এখন আমার শেষ ইচ্ছা, অন্তত কিছুকালের জন্য মায়ের সেবা করে পাপস্খলন করি। এখন আমি মায়ের কাছে থাকতে চাই, আমাদের বংশটি যাতে লোপ না পায় সেজন্য ছোটভাইয়ের বিয়ে দিতে চাই। এতে আমার ও আমার মায়ের শেষ কটা দিন যে শান্তিতে কাটবেতাতে সন্দেহ নেই। মা এখন এক জঘন্য বাসায় থাকেন। তার জন্যে ছোট একটা ভাল বাড়ি করে দিতে চাই। ছোটভাইটির উপার্জন ক্ষমতা সম্পর্কে আশা কম, তার জন্যেও কিছু করে যাওয়া দরকার। আপনি রামচন্দ্রের বংশোদ্ভব, যাকে ভালবাসেন, যাঁকে বন্ধু মনে করেন তার জন্য এই সাহায্য আপনার পক্ষে কি খুব কষ্টকর হবে? আমি জানিনা, আর কার কাছে এই আবেদন পেশ করতে পারি। ইউরোপ থেকে যে টাকা পেয়েছি তার সবই কাজ’ এর জন্যে–এবং তার শেষ পাইপয়সা পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হয়েছে।…”
“পুনশ্চ :–এই চিঠি নিতান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয়।”
এই চিঠির প্রথম উত্তর আসে টেলিগ্রামে। ১লা ডিসেম্বর ১৮৯৮ বেলুড়ে বসে মহানুভব খেতড়িকে উত্তর দিতে বসেন রোগাক্রান্ত বিবেকানন্দ।
“আমি কি চাই তা বিশদভাবে লিখলাম। কলকাতায় একটা ছোট বাড়ি তৈরির খরচ দশহাজার টাকা। ঐ টাকায় চারপাঁচজনের বাসযোগ্য একটা ছোট বাড়ি কোনমতে কেনা বা তৈরি করা যায়। সংসার খরচের জন্য যে মাসিক একশ টাকা আপনি আমার মাকে পাঠিয়ে থাকেন তা তার পক্ষে যথেষ্ট। যদি আমার জীবদ্দশা পর্যন্ত আমার খরচ নির্বাহের জন্য আরও মাসিক একশ টাকা পাঠাতে পারেন তাহলে বড়ই খুশি হব। অসুস্থতার জন্য আমার খরচ ভয়ানক বেড়েছে; কিন্তু এই বাড়তি বোঝা আপনাকে খুব বেশিদিন বইতে হবে বলে মনে হয় না, কেননা আমি বড়জোর আর দু’এক বছর বাঁচবো। আমি আর একটি ভিক্ষা চাইব–মায়ের জন্য একশত টাকার সাহায্যটি সম্ভব হলে আপনি স্থায়ী রাখবেন। আমার মৃত্যুর পরেও যেন সে সাহায্য নিয়মিত পৌঁছয়। যদি কোন কারণে আমার প্রতি ভালবাসায় ও দাক্ষিণ্যে ছেদ টানতে হয়, এক তুচ্ছ সাধুর প্রতি একদা যে প্রেম-ভালবাসা ছিল তারই কথা স্মরণ করে মহারাজ যেন সাধুর দুঃখীমাতার প্রতি এই করুণা বর্ষণ করেন।”
যতদুর মনে হয়, বাড়ির জন্য ১০,০০০ টাকা দেওয়া খেতড়ির পক্ষে সম্ভব হয়নি। স্বামীজিও আলাদা বাড়ির পরিবর্তে ৬,০০০ টাকা দিয়ে খুড়ির কাছ থেকে পৈতৃক বাড়ির একটা অংশ কেনেন। শঙ্করীপ্রসাদ জানিয়েছেন মঠ-তহবিল থেকে এর জন্য স্বামীজিকে ৫,০০০ টাকা ধার করতে হয়।
*
এবার আমাদের নজর পরিব্রাজক বিবেকানন্দর ওপর–২০ জুন ১৮৯৯ কলকাতা থেকে জাহাজে চড়ে তিনি দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো চলেছেন পশ্চিমে। তার যাত্রাসঙ্গী স্বামী তূরীয়ানন্দ ও মানসকন্যা নিবেদিতা। বিদেশে যাত্রার আগের দিন (১৯ জুন ১৮৯৯) গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী ও পূর্বাশ্রমের কয়েকজন আত্মীয়কে স্বামীজি বেলুড় মঠে আনিয়েছিলেন। একসময় সকলে স্বামীজির গান শোনার জন্য ঠাকুরঘরের বারান্দায় গিয়ে বসেন। মায়ের অনুরোধে তাঁর প্রিয়পুত্র শিব ও কালী বিষয়ক বেশ কয়েকটি গান গাইলেন। সন্ধ্যার সময় ঘোড়ার গাড়িতে মাকে সিমলায় পৌঁছে দিয়ে স্বামীজি বাগবাজারে বলরাম বসুর ভবনে চলে যান।
জাহাজ থেকে নিবেদিতা নিয়মিত চিঠি লিখতেন মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস বুলকে।
কলকাতা ছেড়ে জাহাজ যখন সিংহলদ্বীপের কূলে উপস্থিত হচ্ছে তখন নিবেদিতা চিঠি লিখছেন…। মঙ্গলবার সকাল, ২৮ জুন। “তিনি কীভাবে নিজের গর্ভধারিণীর কথা বললেন; মাকে কত কষ্ট দিয়েছেন তিনি, সেই সঙ্গে তাঁর প্রবল ইচ্ছা ফিরে এসে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি মায়ের কাছে নিবেদন করার।দেখছো না, এবার মধ্যে রয়েছে প্রকৃত বৈরাগ্য। সম্ভব হলে অতীতকে আমি খণ্ডন করতাম-দশ বছর কম বয়সী হলে আমি বিয়ে করতাম, কেবল আমার মাকে খুশি করবার জন্য, আর কোনো কারণে নয়। আহা! কীসের ঘোরে এই ক’বছর আচ্ছন্ন ছিলাম? উচ্চাশার পাগলামি–এরপর হঠাৎ যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বললেন–আমি কখনই উচ্চাভিলাষী ছিলাম না। খ্যাতির বোঝা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”
নিবেদিতা বললেন, “খ্যাতির ক্ষুদ্রতা আপনার মধ্যে কখনও ছিল না। তবে আমি ভীষণ খুশি যে আপনার বয়স দশ বছর কম নয়!”
মানসকন্যা নিবেদিতার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীজি খুব জোরে হাসতে লাগলেন।
.
১৬ আগস্ট ১৮৯৯ স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছলেন। ডিসেম্বরে তিনি প্রবল উদ্দীপনায় লস এঞ্জেলিসে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন।
বড়দিনের দুদিন পরে আমরা দেখছি বিদেশের মাটিতেও মামলা মোকদ্দমার চিন্তা থেকে স্বামীজির মুক্তি মেলেনি। শ্রীমতী সারা বুলকে তিনি লিখছেন, “আমার শরীর এখন অনেক ভাল। আমি কাজ শুরু করেছি। মামলার খরচের জন্য ইতিমধ্যেই ১,৩০০ টাকা পাঠিয়েছি, যদি ওদের প্রয়োজন হয় তাহলে আরও পাঠাব।”
আরও খবর : “রাজযোগ-এর গ্রন্থস্বত্ব থেকে এবং খেতড়ির পাঠানো মোট ৫০০ পাউন্ড মিস্টার লেগেটের কাছে আছে, ওঁর কাছে আমার মোট গচ্ছিত একহাজার পাউন্ড। যদি আমি মরে যাই তাহলে দয়া করে ওই টাকা আমার মাকে পাঠিয়ে দিও।”
মায়ের জন্যে প্রবাসে রোগজর্জরিত সন্তানের চিন্তার শেষ নেই।কয়েকদিন পরেইনতুন বছরের নতুন মাসে (১৭ জানুয়ারি ১৯০০) লস এঞ্জেলিস থেকে মিসেসবুলকেবিবেকানন্দ জানাচ্ছেন: ”মিসম্যাকলাউডওমিসেস লেগেটের দাক্ষিণ্যে আমি সারদানন্দকে ২,০০০ টাকা পাঠাতে পেরেছি। ওঁরাই বেশি দিয়েছেন, বাকিটা আমার লেকচার থেকে।… আমি স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে এখানে এসেছিলাম। সেটা তো হয়েছেই, বাড়তি প্রাপ্তি মামলা-মোকদ্দমার জন্যে এই ২,০০০ টাকা।… এটা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে, মঠের চিন্তা ঘাড় থেকে নামিয়ে, কিছুসময়ের জন্যে আমি মায়ের কাছে ফিরে যাই। আমার জন্যে তিনি বড্ড কষ্ট পেয়েছে। ওঁর শেষ দিনগুলো মসৃণ রাখতে হবে। আপনি কি জানেন, অমন যে অমন শঙ্করাচার্য তাকেও এই একই পথ বেছে নিতে হয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাকে মায়ের কাছে ফেরত যেতে হয়েছিল।… ১৮৮৪ সালে মাকে ছেড়ে আসা মস্ত ত্যাগের ব্যাপার ছিল, এখন তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া আরও বড় ত্যাগের ব্যাপার। ‘মা’ বোধ হয় চাইছেন শঙ্করাচার্য যা করেছিলেন আমাকে দিয়েও তাই করাবেন।”
আচার্য শঙ্করের জীবন ও শিক্ষা সম্বন্ধে এই বাংলায় তেমন আগ্রহ ইদানীং দেখা যায় না। অতি অল্পবয়সে তিনি সংসারত্যাগী হয়েছিলেন, মৃত্যুও হয়েছিল নিতান্ত কম বয়সে, অনেকের মতে মাত্র ৩২ বছরে। তার জননীর নাম বিশিষ্টা।
শঙ্কর যখন সন্ন্যাসের জন্য মাতৃ-অনুমতি চাইলেন, তখন জননী বললেন, “বাবা তুমি চলে গেলে কে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবে? তুমি থাকতে আমার সৎকার কি জ্ঞাতিরা করবে?” জননীর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছিল।
শঙ্কর : “আপনি প্রসন্নমনে আমার গৃহত্যাগের অনুমতি দিন…আপনার সৎকার আমি যেখানেই থাকি, যথাসময়ে এসে আমিই করব। সন্ন্যাসীর এই কাজ নিষিদ্ধ, তবু আপনার জন্য আমি এই কাজ করব।”
অনেকদিন পরের কথা, জগদগুরু শঙ্কর তখন শৃঙ্গেরীতে অধ্যাপনা করছেন, এমন সময় তিনি জিভে মাতৃস্তনদুগ্ধের আস্বাদ অনুভব করলেন। তিনি বুঝলেন, মায়ের অন্তিমসময় উপস্থিত। তিনি দ্রুত জন্মস্থান কালাডি গ্রামে ফিরে এলেন।
রোগশয্যায় শায়িতা জননী বিশিষ্টা তার পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা এতে বিলম্ব কেন?”
আচার্য শঙ্কর নিঃশব্দে জননীসেবায় মনোনিবেশ করলেন। স্নেহময়ী জননী জানতে চাইলেন, “বৎস যে জন্য গৃহত্যাগী হয়েছ তাহা সিদ্ধ হয়েছে তো?”
শঙ্কর নীরবে মাতৃসেবায় ব্যস্ত রইলেন, পুত্রমুখ দর্শনে জননী সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে গেলেন।
জননীর দেহাবসানের পর স্বার্থপর আত্মীয়রা বেশ হাঙ্গামা বাধালেন। তারা শঙ্করকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেন শবপার্শ্বে বসে আছেন? সন্ন্যাসীর তো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অধিকার নেই।..বুঝেছি, সন্ন্যাসী হবার কষ্ট দেখে গৃহী হতে ইচ্ছা হয়েছে! মুখাগ্নি করে সম্পত্তির মালিক হবার ইচ্ছা রয়েছে। তুমি সন্ন্যাস নিয়ে বেদমার্গ থেকে বহির্ভূত হয়েছ, অন্যদেশে গিয়ে ম্লেচ্ছত্ব প্রাপ্ত হয়েছ, নষুদিরী ব্রাহ্মণ হয়ে কেরল ত্যাগ করে তুমি জাতিভ্রষ্ট হয়েছ–তোমাকে আমরা কিছুতেই মুখাগ্নি করতে দেব না।”
শঙ্কর : আপনারা তো আমার জননীর কোন যত্নই করেননি।.আমিই শেষকার্য সম্পন্ন করব।
চিতা সজ্জিত হল। কিন্তু অগ্নি কোথায়? কেউ অগ্নি দেবে না, তখন প্রয়াতা মায়ের দক্ষিণ হাতে অরণি কাঠ রেখে শঙ্কর অগ্নিমন্থন করলেন এবং সেই আগুনেই মাতৃদেহের সৎকার হলো।
শঙ্করের প্রতি নির্মম দুর্ব্যবহারের খবর পেয়ে স্থানীয় নরেশ রাজশেখর পরে শঙ্করদর্শনে এসেছিলেন এবং দুষ্ট আত্মীয়দের যথাবিহিত শাস্তিবিধান করেছিলেন। শঙ্করের জন্ম ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে এবং দেহাবসান বোধ হয় ৮১২ খ্রিষ্টাব্দে।
.
এক, এমনকি দুই কোকিলেও বসন্ত আসে না। মাতৃপ্রেমে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সন্ন্যাসী শঙ্করকে আমরা তো দেখলাম। আরও কে কে আছে তা একবার খোঁজ নিলে একালের বিবেকানন্দকে বোঝা বোধহয় সহজ হয়ে ওঠে।
বেশিদূর যাবার প্রয়োজন নেই, ঘরের কাছেই রয়েছেন শ্রীচৈতন্য। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত চৈতন্যচরিতামৃত অবশ্যই সন্ধানী পাঠকের চোখ খুলে দেয়। মহাপ্রভুর জীবনের কয়েকটি মুহূর্ত পাঠককে একবার মনে করিয়ে দিতে চাই।
“নবদ্বীপে শচীমাতাকে দেখে প্রভু দণ্ডবৎ করলেন। পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে শচীদেবী কাঁদতে লাগলেন। দুজন দুজনকে দেখে আকুল হয়ে পড়লেন। পুত্রের মাথায় চুল নেই দেখে শচীমাতা মনে বড় ব্যথা পেলেন। শচীদেবী পুত্রের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, তাকিয়ে থাকেন, চুম্বন করেন। চোখে জল এসে ঝাঁপসা করে দিচ্ছে, ভাল দেখতে পাচ্ছেন না, কেঁদে কেঁদে বললেন,বাছা নিমাই, বিশ্বরূপের মত নিষ্ঠুর হবে না। সেও সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেল। আমি একটু দেখতে পেলাম না। তুমি সেরকম কোরো না, তাহলে আমি আর বাঁচবো না।
“প্রভু কেঁদে কেঁদে বললেন–শোনো মা, এই শরীর তো তোমারই দেওয়া, আমার কিছুই নয়। তোমার থেকেই জন্ম, তুমিই লালনপালন করে এত বড় করেছ, কোটি জন্মেও তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না। যদিও সন্ন্যাস নিয়েছি, তা বলে তোমাকে কখনও ভুলতে পারব না।…প্রভু শচীমাতাকে সান্ত্বনা দিয়ে তার চরণবন্দনা করলেন। পরে তাকে প্রদক্ষিণ করে নীলাচলে যাত্রা করলেন।…
“পুরীতে শ্রীবাস পণ্ডিতকে আলিঙ্গন করে মহাপ্রভু বললেন, এই কাপড় এবং এই প্রসাদ মাকে দেবে, মায়ের সেবা ছেড়ে আমি যে সন্ন্যাস নিয়েছি এই অপরাধ ক্ষমা করার জন্য মাকে তুমি আমার হয়ে বলবে, মাকে সেবা করাই পুত্রের কাজ, আমি তা ছেড়ে পাগলের মত কাজ করেছি। মা পাগল ছেলের দোষ নেবে না, আমার কথা বলবে মাকে, মা খুশি হবে।… মায়ের আজ্ঞাতেই নীলাচলে রয়েছি, মধ্যে মধ্যে মায়ের চরণদর্শন করার জন্য যাব।”
আরও আছে। তার অত্যন্ত প্রিয় জগদানন্দকে চৈতন্যদেব প্রতি বছর। নবদ্বীপে পাঠাতেন, তিনি পুত্রবিচ্ছেদে দুঃখিতা জননী শচীদেবীকে প্রভুর সব সংবাদ জানিয়ে আশ্বস্ত করতেন। চৈতন্যচরিতামৃতের লেখকের প্রশ্ন : “মহাপ্রভুর মতন মাতৃভক্ত কতজন আছে?তিনি মাতৃভক্তের শিরোমণিতুল্য, সন্ন্যাস নিয়েও মাকে সেবা করে যাচ্ছেন।”
স্বামী বিবেকানন্দও বলতেন, “যে মাকে পুজো করেনি সে কখনও বড় হতে পারে না।”
ব্রহ্মবাদিন পত্রিকায় ভুবনেশ্বরী দেবীর মহাপ্রয়াণ বর্ষে (১৯১১)নামহীন এক লেখক অথবা লেখিকার তিনটি প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। সেখানে বিশ্ববিজয় করে কলকাতায় ফিরে এসে (১৮৯৭) স্বামীজির মাকে দেখতে যাওয়ার একটি দৃশ্য আছে। “পেট্রিয়ট, অরেটর, সেন্ট কোথায় হারিয়ে গেল! তিনি আবার যেন মায়ের কোলের খোকাটি। মায়ের কোলে মাথা রেখে, অসহায় দুষ্ট শিশুর মতন তিনি কাঁদতে লাগলেন, মা, মা, নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে আমাকে মানুষ করো।”
স্বামী বিবেকানন্দ কি তখনই মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন? ৭ মার্চ ১৯০০ আমেরিকা থেকে তিনি মিসেস বুলকে লিখলে, শঙ্কর প্রদর্শিত পথেই তিনি ফিরে যাচ্ছেন মায়ের কাছে। সেই সঙ্গে কেমনভাবে ফেরবার খরচ তুলবেন তার হিসেব।
“নিউইয়র্কে আমার যে হাজার ডলার আছে তার থেকে মাসে ৯ টাকা আসবে। আমি যে জমি মাকে কিনে দিয়েছি তার থেকে আসবে ৬ টাকা। যে পুরনো বাড়িটা রয়েছে তার থেকে পাওয়া যাবে মাসে ৬ টাকা। যা নিয়ে মামলা চলছে সেটা আমাদের অধিকারে নেই। মা, দিদিমা, ভাই ও আমি মাসে কুড়ি টাকায় চালিয়ে নেবো। আমি এখনই ভারতে ফিরে যেতে রাজি যদি হাজার ডলারে হাত না দিয়ে জাহাজ ভাড়াটা যোগাড় করতে পারি।”
এর পরে আবার মায়ের কথা : “সমস্ত জীবন ধরে মায়ের ওপর বিরামহীন অত্যাচার করেছি। মায়ের পুরো জীবনটাই সীমাহীন এবং বিরতিহীন দুঃখ। যদি সম্ভব হয়, শেষ চেষ্টায় আমি মাকে একটু সুখী করতে চাই। আমি পরিকল্পনাটা ছকে নিয়েছি।…”।
পাঁচদিন পরে ব্রহ্মানন্দের কাছে স্বামীজি খোঁজখবর নিচ্ছেন–দেওয়াল তুলে ছোট্ট বাড়িটাকে আলাদা করে দেওয়া খুব শক্ত কাজ নয়। যদি পারা যায় একটা ছোট্ট বাড়িতে মা ও বৃদ্ধা দিদিমার সেবা করা।
মে মাসে স্বামীজির আর একটা চিঠি থেকে দেখছি, গঙ্গার ধারে ছোট্ট মাতৃনিবাসের পরিকল্পনা স্বামীজি ত্যাগ করেছেন, পয়সা নেই বলে। টাকাকড়ির আরও হিসেব রয়েছে : “মিসেস সেভিয়ার আমাকে যে ৬০০০ টাকা দিয়েছিলেন তা আমার খুড়ি এবং খুড়তুতো বোনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি কেনবার ৫০০০ টাকা মঠ-ফান্ড থেকে ধার করেছি। আমার খুড়তুতো বোনের কাছে আপনি যে টাকা পাঠান তা সারদানন্দ যাই বলুক বন্ধ করবেন না। এরপর স্বামীজি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন যে মঠের টাকা তার নিজের অথবা মায়ের খরচের জন্যে কখনও নেওয়া হয়নি।
বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজার সময় সঙ্ঘজননী সারদামণি স্বামীজিকে প্রধান ভূমিকা দিয়েছিলেন। গর্ভধারিণী জননীকেও স্বামীজি যে আনন্দোৎসবের সময় ভোলেননি তার প্রমাণ রয়েছে শ্রীশ্রীমায়ের স্মৃতিচিত্রে। আনন্দময়ীর আবাহনের সময় আনন্দময়ী জননীর একটা ছবি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেলুড় মঠে ভুবনেশ্বরী বেগুন তোলেন, লঙ্কা তোলেন আর এ বাগান ও বাগান ঘুরে বেড়ান। “আমার নরেন এসব করেছে”, মনের আনন্দ তিনি চেপে রাখতে পারছেন না। বিব্রত বিবেকানন্দ মাকে সামলে বললেন, “মনে করছ বুঝি তোমার নরু এসব করেছে! নয়, যিনি করবার তিনিই করেছেন, নরেন কিছু নয়।”
*
১৯০০ সালেই স্বামীজির শেষ পাশ্চাত্যলীলা। বছরের শেষপ্রান্তে আমরা তাকে দেখি অনুরাগিণী পরিবৃত হয়ে প্যারিস থেকে কনস্ট্যানটিনোপলের পথে।
মাদাম কালভে ও মিস ম্যাকলাউড সহ তিনি যখন এথেন্স হয়ে কায়রোর পথে তখন পরমবিশ্বস্ত স্বামী সারদানন্দ চিঠি লিখছেন মিসেস বুলকে–”মঠ ফান্ড থেকে স্বামীজি যা টাকা ধার নিয়েছিলেন তা শোধ করে দিয়েছেন। মামলার জন্যও তিনি বাড়তি টাকা পাঠিয়েছে।”
এই মামলা নিশ্চয় খুড়ির বিরুদ্ধে, যিনি পয়সা নিয়ে, প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিবেকানন্দ-জননীকে সম্পত্তির দখল দেননি। মঠের জন্যও তিনি কিছু টাকা নিশ্চিত করেছেন।
কায়রোতে আকস্মিক যা ঘটে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে। এখন আমাদের আলোচনার বিষয় ৯ই ডিসেম্বর ১৯০০ সালের সেই সন্ধ্যা, যখন স্বামীজি বিনা নোটিসে বেলুড়ে ফিরে এসেছিলেন এবং মঠের দেওয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে তিনি সকলের সঙ্গে খিচুড়ি খেতে বসে গিয়েছিলেন। যারা তাঁকে সেদিন দেখেছিল তারা জানতো না কোন শারীরিক দুর্যোগের তোয়াক্কা না করে বিশ্বপরিভ্রমণ বন্ধ রেখে ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে এসেছে।
ফেরার পরেই স্বামীজি যে মায়ের সংসারের খবরাখবর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে। পাঁচ দিন পরে তিনি মিসেস ওলি বুলকে অনুরোধ করলেন, “যে টাকাটা আপনি আমার খুড়তুতো বোনের কাছে সোজাসুজি পাঠাতেন এবার সেটা আমার কাছে পাঠাবেন। আমি চেক ভাঙিয়ে, টাকা দেবার ব্যবস্থা করবো।” এই গুড়তুতো বোনকে (কাজিন) নিয়মিত টাকা দেবার ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত খুড়ির মেয়েদের কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই বিমলহৃদয় সন্ন্যাসী।
জীবনের শেষপর্বে মা ও দিদিমার কাছে স্বামীজির যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। স্বামীজি যেমন যেতেন মা-দিদিমার কাছে, তেমন মাঝে মাঝে মা চলে আসতেন বেলুড়ে, ডাক দিতেন বিলু-উ-উ বলে।
তাছাড়া ছেলের কাছ থেকে মাঝে মাঝে বিধবা মা-দিদিমার কাছে ফলমূল, শাকশজি উপহার যেতো।
ফিরে এসে যেবার প্রথম মামাবিহীন মামাবাড়িতে গেলেন সেবার আলোড়ন পড়ে গেল। দিদিমার বাড়িতে সবাইকে সীমাহীন আনন্দ দিতেন স্বামীজি। পাঠদ্দশায় দিদিমার বড় ন্যাওটা ছিলেন স্বামীজি। মাকে ছাড়িয়েও দিদিমা অপার্থিব সুন্দরী ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও তার রূপ ফেটে পড়তো। প্রিয় নাতির জন্য নানা ব্যঞ্জন প্রস্তুত হতো। দলবল নিয়ে গিয়ে স্বামীজি খেয়ে আসতেন। এঁদের রান্না শুকতো ও মোচার ঘণ্টর কি রকম তারিফ করতেন স্বামীজি তা পরের অধ্যায়েই স্পষ্ট হবে।
ভুবনেশ্বরী জননীর সঙ্গে তার নাতি-দিদিমার সম্পর্ক। ভুবনবিজয়ী নাতিকে তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “আর কেন, তোর তো সব হলো। এবার বিয়েটা বাকি আছে! বিয়েটা করে ফেল।” দিদিমার কথা শুনে স্বামীজি হাসির হররা তুললেন।
একদিন ওঁদের আহারের অল্প পরে স্বামীজি হঠাৎ গিয়ে হাজির। বিশেষ ইচ্ছা মায়ের পাতের একটু প্রসাদ খান। তখন মায়ের থালায় সজনে খাড়াটুকু মাত্র অবশিষ্ট ছিল। কোনো কথায় কান না দিয়ে তাই অত্যন্ত পরিতৃপ্তি সহকারে খেলেন স্বামীজি।
*
অন্ত্যলীলা পর্বে স্বামীজির শরীরের অবস্থা যে ক্রমশই খারাপ হচ্ছে তা অনুগামীরা ভালভাবেই জানতেন।
সামান্য যেটুকু সময় অবশিষ্ট রয়েছে তার পূর্ণ ব্যবহারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। একদিকে চলেছে মঠ-মিশনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার দুর্জয় সাধনা, অন্যদিকে রামকৃষ্ণ ভাবধারাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবার নিরন্তর প্রচেষ্টা। সেই সঙ্গে চলেছে নতুন প্রজন্মের সাধকদলকে নবযুগের প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ। এইসব কাজ সহজ নয়, বাধাহীনও নয়। স্বামীজির সন্ন্যাসী-ভ্রাতারাও ভালবাসায় এবং আনুগত্যে তুলনাহীন। এদেশের অধ্যাত্মজীবনে বিবেকানন্দর গুরুভ্রাতারা যে নিঃশব্দ ইতিহাস রচনা করে গিয়েছেন তার প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হয়নি।
সন্ন্যাসী-বিবেকানন্দের এক তীর্থ থেকে অন্য তীর্থে যাত্রার বিরতি নেই। এইসব তীর্থযাত্রা নিতান্ত সুগম নয়। কোথাও কোথাও দুর্গম পথের যাত্রী পথের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তবু নেই চলার বিরতি।
মায়াবতী ত্যাগ করছেন বিবেকানন্দ ১৮ই জানুয়ারি ১৯০১ এবং সেই দিনই খেতড়িরাজ অজিত সিং-এর বেদনাদায়ক এবং কিছুটা রহস্যজনক অকালমৃত্যুর সংবাদ নতুন অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত এঁকে দিল। যাঁর ওপর তিনি সবচেয়ে নির্ভরশীল ছিলেন তিনিই আর পিছনে রইলেন না। কিন্তু সন্ন্যাসীর নাইকো চলার শেষ।
বিবেকানন্দ এবার চললেন পূর্বভারতের তীর্থযাত্রায়। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের তীর্থপরিক্রমা তো নতুন কথা নয়, কিন্তু নতুন কথাটা হলো জননীর ইচ্ছাপূরণ। গুণের ছেলেরাই তো সাগ্রহে মাকে তীর্থে নিয়ে যায়।
বছরের গোড়াতেই (২৬শে জানুয়ারি) এক চিঠিতে স্বামীজি লিখছেন, “বাংলাদেশে, বিশেষত মঠে যে মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনি আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এস্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ।”
স্বামীজির সানন্দ ঘোষণা: “আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে তীর্থে যাচ্ছি। তীর্থযাত্রা সম্পূর্ণ করতে কয়েক মাস লাগবে। তীর্থদর্শন হলো হিন্দু বিধবার প্রাণের সাধ। সারাজীবন আত্মীয়-স্বজনদের কেবল দুঃখ দিয়েছি। তাদের এই একটি ইচ্ছা অন্তত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছি।”
নিজের মাকে নিয়ে দাক্ষিণাত্যে যাবার পরিকল্পনাও হয়েছিল, কিন্তু স্বামীজির রোগজীর্ণ শরীরই বাদ সেধেছিল।
এক সপ্তাহ নয়, মার্চের ১৮ তারিখের আগে পূর্ববঙ্গের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া সম্ভব হল না। স্বামী ব্রহ্মানন্দের ওই তারিখের দিনলিপিটি আকর্ষক। ‘আজ সন্ধ্যায় স্বামীজি, নিত্যানন্দ ও আরও পাঁচজন ঢাকায় যাত্রা করলেন।
স্বামীজির মা মঠে এসেছিলেন, বললেন ব্রহ্মপুত্রে স্নান করাতে। স্বামীজির কাছ থেকে রিপ্লাই টেলিগ্রাম এল, মাকে পাঠাতে বলেছেন।
ঢাকায় স্বামীজির ভগ্ন শরীর দেখে একজন ভক্ত জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনার শরীর এত তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল, আগে থেকে যত্ন নেননি কেন?”
স্বামীজির স্পষ্ট উত্তর : “আমেরিকায় আমার শরীরবোধই ছিল না।”
চিঠিতে স্বামীজি লিখছেন, “আমার মা ও তার সঙ্গিনীরা পাঁচদিন আগে ঢাকায় এসেছেন, ব্রহ্মপুত্রে পবিত্র স্নানের যোগে।” একই চিঠিতে স্বামীজি জননীসমা মিসেস বুলকে আমেরিকায় জানাচ্ছেন, “আমার মা ও আর সব মেয়েদের নিয়ে চন্দ্রনাথ যাচ্ছি, সেটা পূর্ব বাংলার শেষপ্রান্তে একটি তীর্থস্থান।”
ঢাকায় থাকার সময় স্বামীজি যে স্পষ্টভাবেই আসন্ন বিদায়কালের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তা এখন আমরা জানি। যখন ঢাকায় জনসভায় গম্ভীর গলায় স্বামীজি বলেছিলেন তখন ব্যাপারটার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। স্বামীজি বলেছিলেন, “আমি বড়জোর একবছর আছি। এখন শুধু মাকে গোটাকতক তীর্থ দর্শন করিয়ে আনতে পারলেই আমার কর্তব্য শেষ হয়। তাই চন্দ্রনাথ আর কামাখ্যা যাচ্ছি। তোরা কে কে আমার সঙ্গে যাবি বল? স্ত্রীলোকের উপর যাদের খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, শুধু তারাই সঙ্গে যাবে।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে সমর্থন পাওয়া যায়, স্বামীজির মা ও বোন কামাখ্যাদর্শনেও গিয়েছিলেন। ঢাকা ও শিলং-এ স্বামীজির স্বাস্থ্যের ঘোরতর অবনতি ঘটেছিল।
১২ই মে ১৯০১ স্বামী ব্রহ্মানন্দের ডায়রি : “রবিবার : স্বামীজি, গুপ্ত, স্বামীজির মা, বোন, খুড়ি, রামদাদার বিধবা স্ত্রী কৃষ্ণপ্রেয়সী দত্ত সকালে শিলং থেকে ফিরলেন।” গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র দত্তের স্ত্রী কৃষ্ণপ্রেয়সীর মৃত্যু পরের বছর ১লা এপ্রিল- ক্ষয়রোগে। তার শেষ ঠিকানা ১১ মধু রায় লেন। এঁর বিয়েতেই বিলু নিতবর হয়েছিলেন। কৃষ্ণপ্রেয়সী সম্পর্কে মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার মাকে তিনি বিশেষ করিয়া সম্ভম করিতেন। এইরূপ ধীরা, নম্রা ও মিষ্টভাষিণী স্ত্রী জগতে খুব কম দেখিতে পাওয়া যায়।”
ব্রহ্মানন্দের ডায়রিতে উল্লিখিত খুড়িটিই কি আমাদের আদালতী খুড়ি? মনে হয় ইনিই জ্ঞানদাসুন্দরী দত্ত কারণ স্বামীজির দয়ার শরীর। তার শত্রু-মিত্র জ্ঞান থাকতো না। ক’দিন আগেই তিনি প্রিয় ব্রহ্মানন্দকে বলেছিলেন, “যদি একজনের মনে–এ সংসার নরককুণ্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেইটুকুই সত্য, এই তো আজন্ম ভুগে দেখছি।”
আসামের সৌন্দর্য যে স্বামীজিকে মুগ্ধ করেছিল তার প্রমাণ, অবিশ্বাস্য প্রশস্তি গেয়ে তিনি বলেছিলেন–”কাশ্মীরের পরেই আসাম ভারতের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা।” মহামূল্যবান এই উদ্ধৃতিটুকু বোধ হয় আজও আসাম পর্যটন বিভাগের নজরে পড়েনি!
.
শরীর ভাঙছে, কিন্তু তা বলে তো সন্ন্যাসীর চলার পথ রুদ্ধ হতে পারে না। এক বোন এবং মিসেস ব্যানার্জিকে নিয়ে আগস্ট মাসে স্বামীজি দার্জিলিং গিয়েছিলেন।
এই বোনটি কে? নাম পাওয়া যাচ্ছে প্রিয়ম্বদা দাসী। তাঁর পরিবারে দু’জন প্রিয়ম্বদাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর বইতে যে কবি। প্রিয়ম্বদার উল্লেখ করেছেন তিনি প্রিয়ম্বদা বসু। সেকালে দাসী লেখাটাই রেওয়াজ ছিল, স্বামীজির মাও লিখতেন ভুবনেশ্বরী দাসী।
মনে হয় দার্জিলিং-যাত্রী স্বামীজির সম্পর্কিত বোন ১২৩ মানিকতলা স্ট্রিটের প্রিয়ম্বদা ঘোষ। স্বামীজির অশেষ অনুগ্রহভাজনীয়া এবং সম্ভবত স্নেহের শিষ্যা। এই প্রিয়ম্বদা প্রায়ই বেলুড়ে আসতেন এবং স্বামীজির জন্য নানারকম খাবার তৈরি করতেন যা প্রায় সবই সেবকদের পেটে যেত!
আরও একজন বোনের সন্ধান এখনই সেরে ফেলা যাক। ইনি বড় জাগুলিয়ার দূরসম্পর্কের বোন মৃণালিনী বসু। দেহান্তের ঠিক আগে এঁর কাছেই স্বামীজি শেষ বেড়াতে গিয়েছিলেন (৬-১২ জুন ১৯০২)। গ্রামের জমিদার সর্বেশ্বর সিংহের কন্যা মৃণালিনী। তাঁর স্বামী সন্ন্যাসী হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান, ফলে তিনি সপুত্র পিত্রালয়ে বসবাস করতেন। ইনিই বেলুড়ে ফিরবার সময় ডায়াবিটিস রুগী দাদাকে এক ঝুড়ি কালজাম দিয়েছিলেন। এই জাম মঠে এনে মৃত্যুর ক’দিন আগে স্বামীজি বিপুল উৎসাহে ফারমেন্ট করে ‘সিরকা বানিয়েছিলেন।
সংসার সম্বন্ধে জীবনের শেষপ্রান্তে স্বামীজির যে বেশকিছু হতাশা ছিল তাও এখন অনুসন্ধানীদের কাছে স্পষ্ট। ভক্ত শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী একবার ঠাকুরের ভক্ত সুরেশ মিত্তিরের কথা তুলেছিলেন স্বামীজির কাছে। মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য এঁর রেখে যাওয়া ৫০০ টাকাই একবার স্বামীজিকে ধার করতে হয়েছিল পারিবারিক মামলার জন্য। শিষ্য জিজ্ঞেস করলেন, “মহাশয়, শুনিয়াছি মৃত্যুকালে আপনারা তাহার সহিত বড় একটা দেখা করিতে যাইতেন না।”
স্বামীজির উত্তর : “যেতে দিলে তো যাব। যাক, সে অনেক কথা, তবে এইটা জেনে রাখবি, সংসারে তুই বাঁচিস কি মরিস, তাতে তোর আত্মীয়পরিজনদের বড় একটা কিছু এসে যায় না।”
“তুই যদি কিছু বিষয়-আশয় রেখে যেতে পারিস তা তোর মরার আগেই দেখতে পাবি, তা নিয়ে ঘরে লাঠালাঠি শুরু হয়েছে। তোর মৃত্যুশয্যায় আগুন দেবার কেউ নেই–স্ত্রী-পুত্র পর্যন্ত নয়। এরই নাম সংসার।”
শতসহস্র সমস্যায় জড়িত, মৃত্যুপথযাত্রী সন্ন্যাসীর বিবেকে গর্ভধারিণী জননীর প্রতি কর্তব্যবোধের অগ্নি দিবারাত্র ধিকিধিকি জ্বলছে। তার চিন্তা, দেহাবসানের পর এই স্বার্থপর সংসারে তার মাকে কে দেখবে?
২০ মার্চ ১৯০১ তারিখের একটি চিঠি নজরে পড়ে। আমাদের হিসেব অনুযায়ী স্বামীজি তখন ঢাকায়। মায়ের সঙ্গে মিলন হয় ২৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জে।
২০ মার্চ ১৯০১-এর চিঠিতে স্বামীজির উদ্বেগ : “আমার ভাই মহিন এখন ইন্ডিয়ায়, বম্বের কাছে করাচিতে। সারদানন্দের সঙ্গে তার পত্রযোগাযোগ আছে। শুনছি সে এবার বর্মা এবং চিনে যাবে। যেসব লোক তাকে লোভ দেখাচ্ছে তাদের ঐসব জায়গায় দোকানপাট আছে। আমি ওর সম্বন্ধে মোটেই উদ্বিগ্ন নই।” এরপরেই সেই নির্মম উক্তি : “সে ভীষণ স্বার্থপর–হি ইজ এ ভেরি সেলফিশ ম্যান।”
এর আগে আমরা দেখেছি, আমেরিকান মিস্টার ফক্সের কাছে চিঠিতে স্বামীজি তাঁর ভূপর্যটক ভাইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর স্বামীজি বোধ হয় তাঁর মৃত্যুর পরে মায়ের দেখাশোনার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন, হয়তো তিনি মানসচক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন তার দেহাবসানের পরেই ভূপেন রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে দেশছাড়া হবে, তখন কে দেখবে মাকে?
সম্প্রতি শ্রীনগর পোস্টাপিস থেকে লেখা মহিমবাবুর একটা চিঠি (২৪ এপ্রিল ১৯০২) আমাদের নজরে এসেছে। চিঠির প্রাপক স্বামী সদানন্দ, গুপ্তমহারাজ বলে যিনি পরিচিত। মহেন্দ্রনাথ লিখছেন, “যা খবর পাচ্ছি তাতে আমাকে মায়ের যত্ন নিতে হবে, তার অবস্থা মোটেই ভাল নয়। এবার আমাকে কাজ করতে হবে, রোজগার করতে হবে, যাতে তাকে ভালভাবে রাখা যায়।”
আমরা জানি ১৯০৩ থেকে ভূপেন্দ্রনাথ গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। এমনও কি হতে পারে, পরিবারের মধ্যে আরও আগে থেকে আগুন না হলেও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল?
মহিমকে হাতের গোড়ায় পাওয়া যাবে না বলেই কি স্বামীজি তাঁর পারিবারিক মামলার আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলবার জন্যে এমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন?
মায়ের কথা তিনি যে কখনই ভুলছেন না তার আরও প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব। কাশী থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখছেন (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯০২)–”মা দিদিমা যদি আসতে চান পাঠিয়ে দিও। এই প্লেগ আসবার সময়টা কলকাতা থেকে সরে এলেই ভাল।”
শেষ পর্বে স্বামীজির শরীরের অবস্থা আমাদের মনকে ব্যথিত করে তোলে। পা ফুলে নানা রোগের লক্ষণ, হাঁটতে কষ্ট হয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এত শিথিল ও কোমল যে টিপলেই ব্যথা লাগে। দারুণ গ্রীষ্মে কবিরাজমশাই নির্দেশ দিলেন একুশ দিন জল খাওয়া বা নুন খাওয়া চলবে না। স্বামীজি প্রবল মনোবল নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। শরীরের ঐ অবস্থায় আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে সানন্দে বিলিতি কায়দায় তিনি রান্নাবান্না করলেন।
তার কয়েকজন বাল্যবন্ধু একদিন স্বামীজিকে বলেছিলেন, “তুমি যে ছেলেবেলায় বে করতে বললে বলতে ‘বে করব না, আমি কি হব, দেখবি, তা যা বলেছিলে তাই করলে।” স্বামীজি : “হ্যাঁ ভাই করেছি বটে। তোরা তো দেখেছিস-খেতে পাইনি, তার উপর খাটুনি। বাপ, কতই না খেটেছি।… কিন্তু ভাই ভোগ আমার অদৃষ্টে নেই। গদিতে শুলেই রোগ বাড়ে, হাঁপিয়ে মরি। আবার মেঝেয় এসে পড়ি, তবে বাঁচি।”
শেষের দিকে স্বামীজির একটি চোখ ডায়াবিটিসের প্রকোপে নষ্ট হয়েছিল।
সপ্তরথী রোগ একটি শরীরকে কেমনভাবে নানা দিক থেকে আক্রমণ করছে তার ধারাবিবরণী এই বইয়ের অন্য অধ্যায়ে পাঠক-পাঠিকাকে উপহার দেওয়া যাবে। এখন আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের শেষপর্বে উপস্থিত হওয়া যাক।
আমরা জানি, ২২ মার্চ ১৯০২ সালে সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, স্বামীজির মা, দিদিমা গাড়ি করে বেলুড়ে এসেছিলেন। ১৯ জুন স্বামীজি কলকাতায় গেলেন মা এবং অপর আত্মীয়দের দেখতে। আন্দাজ করা যায়, পরের সপ্তাহে বোনের বাড়িতে মায়ের সম্পত্তি সংক্রান্ত যে ম্যারাথন আলোচনার ব্যবস্থা হয়েছিল তার প্রস্তুতিপর্ব এইদিন শেষ হয়েছিল। মিটমাটের এই আয়োজন হয়েছিল স্বামীজির জীবনের শেষ শনিবার ২৮ জুন ১৯০২।
তার আগে আর একটি মর্মস্পর্শী দৃশ্যের বর্ণনা নতুন প্রজন্মের পাঠকদের অবগতির জন্য লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
মিস ম্যাকলাউডের মুখেই শোনা যাক, “এপ্রিল মাসের একদিন তিনি বললেন, ‘জগতে আমার কিছুই নেই; নিজের বলতে আমার এক কানাকড়িও নেই। আমাকে যখন যা কেউ দিয়েছে তা সবই আমি বিলিয়ে দিয়েছি। আমি বললাম, স্বামীজি, যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন আমি আপনাকে প্রতিমাসে পঞ্চাশ ডলার দেব। তিনি মিনিটখানেক ভেবে বললেন, তাতে কুলিয়ে নিতে পারব তো? হ্যাঁ নিশ্চয় পারবেন। অবশ্য তাতে হয়তো আপনার ক্রীম-এর ব্যবস্থা হবে না’–আমি তখনই তাকে দুশ ডলার দিয়েছিলাম, কিন্তু চার মাস যেতে না যেতেই তিনি চলে গেলেন।”
*
স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে আমরা আরও কিছু একান্ত ব্যক্তিগত খবরাখবর পাই। জানা যায় মিস ম্যাকলাউড পরে স্বামীজিকে আরও টাকা পাঠিয়েছিলেন, ঐ টাকা থেকে এবং অপরের দান থেকে স্বামীজি নিজের মাকে মাসে ১০০ টাকা এবং ভগ্নীকে ৫০ টাকা দিতেন। তখন সম্ভবত খেতড়ির দান বন্ধ ছিল।
স্বামীজির মহাপ্রয়াণের পরবর্তী দিনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ছবি রয়েছে নিবেদিতার লেখা চিঠিতে। এমন কাব্যময় হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যের অক্ষয় অঙ্গ হিসাবে বহুদিন বেঁচে থাকবে। আর বর্ণনা আছে ভূপেন্দ্রনাথের রচনায়।
ভূপেন্দ্রনাথের বাংলা বই ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ এবং ইংরিজি সংস্করণ ‘পেট্রিয়ট প্রফেট’ এক নয়। দুটির মধ্যেই কিছু কিছু বাড়তি খবর এখানে ওখানে লুকিয়ে আছে। ইংরিজি সংস্করণে ভূপেন্দ্রনাথ মোকদ্দমায় মা দিদিমাকে প্রধান ভূমিকা দিয়েছেন। লিখেছেন, মেয়ের মামলা চালাবার জন্যে দিদিমাকে বলরাম দে স্ট্রিটের চার কাঠা জমি বিক্রি করতে হয়। তার দুঃখ, মা তার ত্যাগের স্বীকৃতি কখনও পাননি। তিনি কেবল বিবেকানন্দ অনুরাগীদের কৌতূহলের পাত্রী ছিলেন।
শেষ সংবাদের বিবরণটুকু ইংরিজি বাংলা উভয় বই থেকে নিলে এইরকম দাঁড়ায় : এক সকালে স্বামীজির সেবক নাদু (হরেন) স্বামীজির মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে আসে। মা ও দিদিমাকে আমি খবরটা দিলাম। মা জানতে চাইলেন, হঠাৎ কী হলো? আমি বললাম, বাবার যা হয়েছিল। শোকে ভেঙে পড়ে ওঁরা কাঁদতে লাগলেন, পাড়ার একজন মহিলা এসে তাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। নাদু আমাকে বললো সিমলা স্ট্রিটের মিত্রদের খবর দিতে। বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম আমার ভগ্নিপতি ইতিমধ্যেই খবরটা পেয়েছেন। নাদু এবং আমি বেলুড়ে রওনা দিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি স্বামীজি অন্তিম শয্যায় শয়ান। ওঁকে ঘিরে রয়েছেন মঠের সাধুরা, অতুলচন্দ্র ঘোষ এবং সিস্টার নিবেদিতা। এবার দেখলাম নাতি ব্রজমোহন ঘোষকে নিয়ে মা এলেন এবং বিলাপ করতে লাগলেন। ভূপেন্দ্রনাথের ইংরিজি বইতে আছে, সাধুরা ভূপেনকে বললেন, মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। অশ্রুসজল চোখে নিবেদিতা আমার মাকে বিদায় দিলেন। অপরাহে যখন চিতায় আগুন দেওয়া হচ্ছে তখন গিরিশচন্দ্র ঘোষ এলেন। নিবেদিতা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মাকে কেন বিদায় করা হল?” বাংলা বইতে আছে, “তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া হল।” আর ইংরিজি বইতে : “সন্ন্যাসীদের নিয়মকানুনের কিছু অংশ ওঁর কাছে ব্যাখ্যা করা হলো।”
আমরা জানি, জীবনের শেষ শনিবার, স্বামীজি বাগবাজারে তার মানসকন্যা নিবেদিতার বাড়ি গিয়েছিলেন, বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন এবং তারপর উদগ্রীব হয়ে পারিবারিক বিবাদের সমাধানসূত্র খুঁজতে বসেছিলেন। জীবনের শেষ শনিবার, স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে এলেন শরিক হাবুল দত্ত। স্বেচ্ছায় বিবাদ মিটিয়ে নেবার কথা বললেন হাবুল দত্ত। স্বামীজি সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন। বললেন, যদি মীমাংসা হয় তাহলে তিনি আরও হাজার টাকা দেবেন। দুই শরিক হাবুল ও তমু দত্ত রাজি। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন হাবুলের সঙ্গে পন্টুবাবু এটর্নির অফিসে গেলেন। শর্তাদি জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এটর্নি এন সি বসুর কাছে চিঠি পাঠানো হলো। উত্তরে ওঁদের এটর্নি এন সি বসু শর্তস্বীকার করে চিঠি দিলেন। ২ জুলাই (মৃত্যুর দুদিন আগে) শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে পন্টুকে (হাবুল দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী) চারশ টাকা দেওয়া হলো। অর্থাৎ শেষ হলো স্বামীজির জীবনব্যাপী আইনী সংঘাতপর্ব।
স্বামীজির মৃত্যুর পরে এক চিঠিতে নিবেদিতা তার বিস্ময় প্রকাশ করে লিখলেন, তিনি সবকিছু গুছিয়েটুছিয়ে রেখে গেলেন। শেষ দেখার সময় আমাকে বললেন, মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে আপসে–এবিষয়ে তার কোনো খেদ নেই।
অর্থাৎ মায়ের সব সমস্যার সমাধানের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেলেন তার সংসারবিরাগী জ্যেষ্ঠপুত্র। যাবার আগে মাতৃইচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি-পূরণের জন্য তিনি শুধু তীর্থভ্রমণ নয়, কালিঘাটে হত্যে পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তাঁর দেহাবসানের পরেও মায়ের যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গিয়েছিলেন সন্ন্যাসীভ্রাতাদের।
ভুবনেশ্বরীর কাছে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ছিলেন সন্তানতুল্য। জ্যেষ্ঠপুত্রের অকালমৃত্যুর পরে শোকাহত জননীকে সান্ত্বনা দেবার প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ।
প্রথমদিকে রোজ এবং কিছুদিন পরে মাঝে মাঝে ভুবনেশ্বরীর কাছে। গিয়ে তার শোকের বোঝা কমাবার চেষ্টা করতেন। “কোনোদিন তার রান্না খেতেন, জননীর সাংসারিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতেন। পরিবারের অর্থ সংস্থানের সমস্যা ছাড়াও পৈতৃক ভিটা সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমার তখনও পূর্ণ মীমাংসা না হওয়াতে ঐ সব বিষয়ের দায়িত্বও স্বামী ব্রহ্মানন্দকে গ্রহণ করতে হয়।”
বিবেকানন্দজননীর শোক কিছুটা কমলে রাজা মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) ভুবনেশ্বরী দাসীকে তীর্থদর্শনে পুরী পাঠিয়ে দেন। বিবেকানন্দ জননী যতদিন বেঁচেছিলেন (১৯১১) ততদিন স্বামী ব্রহ্মানন্দ নিজের ছেলের মতন সংসারের সব ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতেন। এসব খবর স্বামী ব্রহ্মানন্দর দিনলিপিতে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ আছে।
স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশিনী অনুরাগিণীরাও নিঃশব্দে কীভাবে চরম বিপদের দিনে তাদের প্রিয় স্বামীজির পরিবারের সভ্যদের রক্ষা করেছিলেন সেও এক দীর্ঘগল্প।
*
ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে ইংরেজের রোষানল থেকে বাঁচাবার জন্য ভগ্নী নিবেদিতা নিজে সহায়সম্বলহীনা হয়েও ২০,০০০ টাকার জামিন দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও ভূপেন্দ্রনাথ বলেছেন তার প্রয়োজন হয়নি, মাসতুতো ভাই চারুচন্দ্র মিত্র ও ডা. প্রাণকৃষ্ণ আচার্য প্রত্যেকে পাঁচহাজার টাকা করে জামিনে প্রতিভূ হয়েছিলেন।
জেল থেকে মুক্তি পাবার পরে সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে না পালালে অন্য মামলায় ভূপেন্দ্রনাথ আবার জড়িয়ে পড়তে পারেন এই গোপন খবরও সিস্টার নিবেদিতারই সংগ্রহ বলে মনে হয়।
ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, তাঁর মাতার অর্থানুকূল্যে আত্ম-পরিচয় গোপন করে তিনি বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিজ্ঞমহলের ধারণা, জাহাজের টিকিটের দায়িত্ব নিবেদিতার পরম অনুগত একজন মানুষ নিয়েছিলেন। ভাগ্যে স্বামী সারদানন্দের অনুরোধে স্বামীজির তিরোধানের পনেরো দিন পরেই মহেন্দ্রনাথ দত্ত কাশ্মীর থেকে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসেছিলেন।
বিবেকানন্দের জীবনকালেও গর্ভধারিণী জননীর দায়দায়িত্ব তার পরমপ্রিয় গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ কেমন ভাবে পালন করতেন তার কিছু নমুনা সেকালের সন্ন্যাসীরা রেখে গিয়েছেন।
স্বামী রমানন্দ ও খ্যাতনামা ডাক্তার তাপস বসু একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্বামী হরিহরানন্দ একবার ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্যকে বলেছিলেন : আমেরিকা থেকে ফিরেই কিছু টাকা (১০ হাজার) স্বামী ব্রহ্মানন্দর হাতে দিয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, রাখাল, এই টাকাটা তুই মাকে দিয়ে আয়।
ব্রহ্মানন্দ বললেন, মাকে তোমার নিজের হাতে দেওয়া উচিত। স্বামীজি উত্তর দিলেন, না, তুই-ই দিয়ে আয়, আমি দিলে লোকে মনে করবে মা ভাইদের না-জানি কত টাকাই দিয়েছে, মঠকে আর কী দিয়েছে।
সুদূর মার্কিনী প্রবাসে ভূপেন্দ্রনাথের আশ্রয় ও লেখাপড়ার আর্থিক ব্যবস্থা কে করেছিলেন এবং কীভাবে করেছিলেন তা জানার জন্যে নিবেদিতা, সারা বুল ও মিস ম্যাকলাউডের পবিত্র জীবনকথা ধৈর্যের সঙ্গে পাঠ করা প্রয়োজন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গুরুভ্রাতা বিবেকানন্দর জননী ও তার মাকে সবসময় রক্ষা করে এসেছেন পূজনীয় সন্ন্যাসীবৃন্দ। তারা মাকে সঙ্গে নিয়ে তীর্থযাত্রাতেও বেরিয়েছে। শেষ তীর্থযাত্রা পুরীতে, ১৯১১ খ্রীস্টাব্দে।
কলকাতায় ফিরে এসে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হলেন বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী। তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন ডাক্তার জে কাঞ্জিলাল। দেহাবসান মঙ্গলবার ২৫ জুলাই ১৯১১। তাঁর প্রিয় পুত্র স্বর্গলোকে কী সংবাদ পেয়েছিলেন তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমরা জানি নিউইয়র্কে নির্বাসিত পুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ সেদিন বিস্ময়কভাবে মায়ের মৃত্যুস্বপ্ন দেখেছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথের নিজের রচনাতেই এর স্বীকৃতি আছে।
শ্মশানে অবশ্যই উপস্থিত ছিলেন মহেন্দ্রনাথ। আর উপস্থিত ছিলেন বিবেকানন্দর মানসকন্যা নিবেদিতা। শেষ নিশ্বাস ত্যাগের কিছু আগে তিনিও বিবেকানন্দজননীর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে থেকে এই চিরদুঃখিনী রত্নগর্ভাকে স্বস্তি দিয়েছিলেন।
২৮ জুলাই ১৯১১ নিবেদিতা তার ইংরেজ বন্ধু দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক র্যাডক্লিফকে লেখেন : “দুদিন আগে স্বামীজির গর্ভধারিণী দেহরক্ষা করলেন। তাঁর ইনকারনেশন’ অবতারপর্ব শেষ হলো এক অদ্ভুত পথে। শেষনিশ্বাসের কয়েকঘন্টা আগে মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আবার তাঁকে দেখলাম শ্মশানে।”
স্বামীজির মহাসমাধির পরে পুত্রশোকাতুরা জননীর ৯ বছর বেঁচে থাকা। এই পর্বে তার আর্থিক দায়দায়িত্ব কীভাবে মেটে?
বেণীশঙ্কর শর্মার ধারণা, খেতড়ি মহারাজের প্রতিশ্রুত মাসিক একশ টাকা অব্যাহত ছিল মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত। হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। সুদূর প্রবাসে ভূপেন্দ্রনাথের দায়িত্ব যে বিবেকানন্দর বিদেশি অনুরাগিণীরা গ্রহণ করেছিলেন তা স্পষ্ট। মায়ের মৃত্যুর পরও দেখছি, তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছেন মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড। এমনকি স্বদেশে ভূপেন্দ্রনাথের একটা কাজের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। ইলিনয় থেকে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, একজন ভূতপূর্ব স্বাধীনতাসংগ্রামীকে তার ইস্কুলে চাকরি দিয়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল। স্বামীজির ভাইকে চাকরি দিয়ে সাহায্য করতে পারেননি অসহায় রবীন্দ্রনাথ। তার পরামর্শ ছিল, শাসক ইংরেজের মতিগতি যতক্ষণ না পাল্টাচ্ছে ততক্ষণ আমেরিকায় শিক্ষকতা করাটাই ভূপেন্দ্রনাথের পক্ষে শ্রেয়।
নিবেদিতা চিঠি লিখেছিলেন মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউডকে। স্বামীজির অসমাপ্ত দায়দায়িত্ব গভীর ভালবাসায় নিঃশব্দে কারা নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন তার হৃদয়গ্রাহী দৃষ্টান্ত। ১৬ আগস্ট ১৯১১ : “.তোমার পাঠানো ১০ পাউন্ড এসেছে, কিন্তু এতোদিনে নিশ্চয় জেনে গিয়েছ স্বামীজির মা ইহলোকে নেই। …টাকাটা আমি ব্যাঙ্কে রেখেছি, তোমার পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। বোন এখনও ওখানে রয়েছে–অসুখের চিকিৎসা এবং দাহ খরচ ইত্যাদি যথেষ্ট, আমার আন্দাজ তুমি চাইবে এইটা শেষ অর্থ হোক। …দুদিন পরে সূর্যাস্তের সময় দিদিমাও চলে গিয়েছেন। সুতরাং ওপারে স্বামীজি তার আপনজনদের জড়ো করে নিয়েছেন।”
ওপারে আবার নিজের জনদের প্রসঙ্গ কেন? ভগিনী নিবেদিতা বোধ হয় ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। একালের বিবেকময় সন্ন্যাসী কামিনীকাঞ্চন অতি সহজে ত্যাগ করলেও, ভালবাসাকে এবং কর্তব্যকর্মকে বিসর্জন দিতে রাজি হননি। এর জন্যে বিশ্বসংসারকে তিনি তোয়াক্কা করেননি, বহুকাল আগেকার শঙ্করাচার্য ও শ্রীচৈতন্যের মতন।
গর্ভধারিণীকে আজীবন এই সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বলেই স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের বিবেকানন্দ হতে পেরেছেন। এবং হয়তো এই জন্যেই তিনি বহুদিন ধরে বহুমানুষের, বহু জননীর, বহু সন্তানের, বহু ভ্রাতার ও বহু ভগ্নীর হৃদিপদ্মাসনে নিত্য পূজিত হবেন।
স্বামীজির জীবনের কিছু বৃত্তান্ত এই লেখায় সংগ্রহ করে রাখা গেল এই বিশ্বাসে যে গর্ভধারিণী জননীকে না জানলে কোনও মানুষকে পুরো জানা যায় না।