চম্পাঝরন – বুদ্ধদেব গুহ
তুই আমাকে বাঁচাবি তো পাগলি?
১
সন্ধে হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক হল। দু-পাশে লাল মাটির মধ্যে পিচ ঢালা কালো সরু পথটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে চম্পাঝরন গ্রামের দিকে। এখন শুক্লপক্ষ। চাঁদটা সেগুনজঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে পথের ডানদিকে সাতপুরা পর্বতমালার উঁচু পাহাড়ের পটভূমিতে। চাঁদটা উঠেছে বটে কিন্তু এখনো সেগুনের অগণ্য হাত ছাড়িয়ে নীলাকাশে মুক্তি পায়নি। তবে বিজলি আলোহীন পথের উপরে সপ্তমীর চাঁদের আলো পড়ে পথটিকে সাদা-কালো শতরঞ্চির মতো দেখাচ্ছে।
ধৃতির পায়ের তলাতে শুকনো পাতারা মচমচ শব্দ করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, তবে সেই মচমচানির মধ্যে একটু নেতানো ভাবও আছে। কারণ, এই আরণ্যক পরিবেশে বছরের এই সময়েও শিশির পড়ে। কালটা বসন্ত হলে কী হয় এখনো সন্ধের পর একটু শীত শীতও লাগে।
নির্জন জায়গা, তার উপরে দিনকাল আর কোথাওই ভালো নেই, তাই ধৃতিকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দেবার জন্যে বন-বাংলোর চৌকিদারকে সঙ্গে দিয়েছেন গৌতম নারায়ণ। অন্যদিন গৌতমনারায়ণের গাড়িই ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। আজ তাঁর ড্রাইভার কেরকেরেকে সীওনীতে পাঠিয়েছিলেন। অনেক কাজ দিয়ে। এবং কিছু কেনাকাটাও করার জন্যে। সীওনী এখান থেকে অনেকখানি পথ। আজ কেরকেরের ফিরতে ফিরতে রাত হবে।
আজই শেষ বিকেলে গৌতমনারায়ণ ধৃতির ডানদিকের স্তনটি ব্লাউজের মধ্যে দিয়ে মুঠি ভরে ধরেছিলেন। অল্পক্ষণের জন্যে। সেই পরশের সুখানুভূতির ওম এখনো ধৃতির বুকেই শুধু নয়, তার পুরো শরীরকেও কবোষ্ণ করে রেখেছে। কেন যে এরকম হয়, এইরকম শিরশিরানি! কে জানে। এমন তো নয় যে, ওর স্তন এর আগে আর কেউই স্পর্শ করেনি!
একটু আগেই ন্যারোগেজ রেললাইনটি জঙ্গলাবৃত পথটিকে কেটে গেছে। আন-ম্যানড লেভেল ক্রসিং। যেহেতু আন্ধারপানি থেকে চম্পাঝরনের এই মাইল পনেরো পথে ট্রাক ও গাড়ির চলাচল খুবই কম, দুর্ঘটনাও খুব কমই ঘটে তবে মাঝেমধ্যেই দিনের বেলায় গরু মোষ এবং ছাগল কাটা পড়ে ন-মাসে ছ-মাসে। সেটা কোনো ঘটনা নয়। চম্পাঝরনে কোনো স্টপেজও নেই। ট্রেন ঝমঝম করে বনে-পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে ধেয়ে যায় রাওলা-রাওলের দিকে।
ধৃতি শুনতে পেল বাঁ দিক থেকে একটি ট্রেন আসছে। শুক্লা সপ্তমীর রাতের সুগন্ধি অন্ধকারকে চিরে দিয়ে ট্রেনের আলোটি এগিয়ে আসছে মন্থর গতিতে রেলপথ এবং দু-পাশ আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে। দাঁড়িয়ে পড়ল ধৃতি লেভেল ক্রসিং-এর সামনে এসে। চিঞ্চিকেডেও। প্যাসেঞ্চার ট্রেনের আলোকিত খোলা জানালাতে স্ত্রী-পুরুষ ও শিশুদের মুখ—নানাবর্ণের শাড়ি, নানারঙা চুড়ি, পাগড়ি-মাথায় বুড়ো। চোখের সামনে ঝরঝর করে ঝরনার মতো বয়ে গেল আলোকিত ট্রেনটা। অনেকক্ষণ পর্যন্ত ট্রেনের পিছনের ক্রমশঃ ছোটো হতে থাকা লাল আলোটা দেখা যেতে লাগল যতক্ষণ না ট্রেনটা ডানদিকে বাঁক নিল।
ট্রেনটা চওড়ি-চাওড়ার দিকে চলে যাবার পরই হঠাৎই নিস্তব্ধতাটা জাঁকিয়ে বসল। শুধু দু-একটি পাতা ঝড়ে পড়ার শব্দ নিস্তব্ধতাকে থিতু করল। হঠাৎই একটা পিউ কাঁহা পাখি তীক্ষ্ণ তীব্র উদাত্ত চিৎকারে পিউ-কাঁহা, পিউ-কাঁহা চিৎকার তুলে সেগুন বনের বারণ না শুনে চাঁদটার মধ্যে ঢুকে গেল তার প্রিয়াকে খোঁজবার জন্য।
ধৃতির মনে পড়ল হঠাৎই যে, আজই বিকেলবেলা গৌতমনারায়ণ বলেছিলেন, নৈ:শব্দের মতো শব্দময়তা আর কিছুই নেই।
ধৃতি, ইজিচেয়ারে-বসা প্রায় বৃদ্ধ গৌতমনারায়ণের পায়ের কাছে বাংলোর সিঁড়িতে ওঁর দিকে মুখ করে বসেছিল।
ধৃতি চমকে উঠে বলল, এ কথার মানে?
—বুঝলে না তুমি?
না তো।
আপনি বলে দিন। মানে।
সব কথার মানে বলতে নেই। কিছু কথার মানে নিজেই বুঝে নিতে হয়।
কী করে?
কী করে নয়, নিজের থেকেই বুঝবে। সময়ে বুঝবে।
সময়ে?
হ্যাঁ রে পাগলি। সময়ে।
তারপর বললেন, সময়কে সময় দিতে হয়। সময়ের নিজের হাতে সময় সবচেয়ে কম। বুঝলে?
—কিছুই বুঝলাম না। আপনি কেমন হেঁয়ালি হেঁয়ালি কথা বলেন।
—আমি তো হেঁয়ালিই। আমি ভোরের কুয়াশা, আমি সন্ধ্যাতারার দ্যুতি, আমি ফুলের গন্ধ, চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতা।
—আপনি এমন কেন? আপনাকে পুরোপুরি বুঝি না।
গৌতমনারায়ণ একটু হেসে বললেন, কারণ যে আমি, আমিই! আমি যে অন্য কারো মতনই নই। শৈশব থেকে অনেক হেঁয়ালির সমুদ্রের মধ্যে সাঁতার কাটতে কাটতে নিজেই যে কখন এক হেঁয়ালি হয়ে উঠেছি তা নিজেই বুঝতে পারিনি। ভাগ্যিস কেউই আমাকে পুরো বোঝে না। পুরোই যদি বুঝবে তবে আমি আর আমি থাকব না। দুর্বোধ্য থাকাই যে আমার চিরদিনের সাধনা!
উত্তর না দিয়ে ধৃতি চুপ করেই বসেছিল।
গৌতমনারায়ণ বললেন, মহুয়ার গন্ধটা সন্ধ্যেবেলার হাওয়াটাকে যেন মাতাল করে দিয়েছে—গন্ধ পাচ্ছো না?
—পাচ্ছি। শুধু মহুয়াই বা কেন, এই গন্ধের মধ্যে আরো অনেক গন্ধ মিশে আছে।
—যেমন?
—জংলি আমের মুকুলের গন্ধ, জংলি কাঁটালের মুচীর গন্ধ, কৌরন্ধের গন্ধ…
—আর তোমার স্তন সন্ধির গন্ধ?
—আপনি বেশ অসভ্য।
—অসভ্য বলেই তো এই বয়সেও একজন তরতাজা যুবকের মতো বেঁচে আছি। বুঝলিরে পাগলি। নারী নইলে কি কোনো পুরুষ পূর্ণ হয়? পুরুষ আর প্রকৃতি নিয়েই তো সব। আর এই ‘প্রকৃতি’ পাগল এই সন্ধেবেলার গন্ধ, এই প্রকৃতি তুইও। তুই আমার সকালবেলার শিউলি।
—বুঝতে আর বাকি নেই। বুড়ো, তোমার মাথাটি একেবারেই গেছে। বসন্তকালে কি শিউলি ফোটে?
—গাছে না ফুটতে পারে, মনে তো ফোটে।
—শিউলির ভালো নাম কি জানিস মেয়ে?
—না। আমি অত জানতে চাই না।
—তবে তুই কী চাস?
—আমি বাঁচতে চাই।
—বা: এ তো বড়ো ভালো কথা।
—বাঁচার মানে কী জানিস তুই? বাঁচার মতো বাঁচতে জানে ক-জনায়?
—আমি জানি না। বুড়ো নারায়ণ, তুমি আমাকে বাঁচতে শেখাবে?
—শেখাব বইকি রে। তোকে বাঁচতে শেখাবার জন্যেই তো আমার সব কাজ ফেলে রেখে আমার ভেতরের কেজো মানুষটাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে আমি তোর টানে এখানে সাতদিন থাকব বলে পালিয়ে এলাম। তোকে যেদিন প্রথমে দেখলাম, শুধু সেদিনই বুঝতে পারলাম যে এতগুলো বছর মিছিমিছি ধুলোয় পড়ে মাটি হল। বাঁচা হল না এক মুহূর্তও। প্রায় মরেই তো বসেছিলাম। মরতে মরতে বেঁচে গেলাম জোর। শুধু তোরই জন্যে।
সীতা দরজা খুলল এক হাতে,অন্য হাতে লন্ঠন নিয়ে।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, তুই আমাকে বাঁচাবি তো পাগলি?
ধৃতি গৌতমনারায়ণের হাঁটু দুটোর ওপরে থুতনি রেখে বলেছিল, নিশ্চয়ই। তুমি দেখো।
তারপরই বলেছিল, তুমিও বাঁচাবে তো আমায়?
—চেষ্টা করব প্রাণপণ। দেখিস তুই।
এসব ভাবতে ভাবতেই ধৃতির বুকে যে কবুতরির মতো বুকটিকে গৌতম নারায়ণ বড়ো ভালোবাসায় মুঠি ভরে ধরেছিলেন, সেই থরথরানি ফিরে এল। সারা শরীরে এক রিকিঝিকি উঠল। এই নিজেকে ধৃতি কখনো জানেনি।
চাঁদের আলোর মধ্যে রাত পাখিদের ডাকের মধ্যে ভাসতে ভাসতে যেন জ্বরাক্রান্ত হয়ে ও চম্পাঝরনে পৌঁছে গেল; এই জ্বরের নামই কামজ্বর। গৌতমনারায়ণই শিখিয়েছিলেন।
চিঞ্চিকেডে বলল। আমি যাই এবারে?
সীতা দরজা খুলল এক হাতে, অন্য হাতে লন্ঠন নিয়ে।
ধৃতি হাত তুলে বলল, চিঞ্চিকেডে, যাও। সাবধানে যেও। ভাল্লুক-টাল্লুক সামলে।
আমি নিজেই তো এক ভাল্লুক।
চিঞ্চিকেডে বলল ভাল্লুক আমার কী করবে।
২
সপ্তমীর চাঁদ হলেও বনজঙ্গলের মধ্যে বলে চাঁদের জোর আছে। বন-বাংলোর পেছন থেকেই একটি পাহাড় উঠে গেছে। গভীর জঙ্গলাবৃত। সামনের দিকে চিঞ্চিকেডের কোয়ার্টারের পেছনে কিছুটা টাঁড় মতো জায়গা। একটি কুঁয়ো এবং কয়েকটি মহুয়া গাছ আছে। বেশ পুরোনো, প্রচুর মহুয়া ফলে এবং সেইজন্যেই জঙ্গলের হরিণ শম্বর এবং বিশেষ করে ভাল্লুকদের সমাগম হয় বছরের এই সময়ে। আশেপাশের ছোটো ছোটো গ্রামের শিশুরা ও বুড়িরা অন্ধকার থাকতেই ঝুড়ি নিয়ে চলে আসে মহুয়া কুড়োতে। যুবতীরা আসে না। কারণ, অন্ধকারে তাদের অনেক বিপদ। এই মহুয়াই ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত রাজ্যেই (পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্য ছাড়া) গরিবগুরবোদের বাঁচিয়ে রাখে। মহুয়া দিয়ে যেমন মদ হয় তেমনই শুখা মহুয়া বছরভর তাদের খাদ্যও হয়।
প্রাচীন মহুয়া গাছগুলোর ছায়া ফাঁকা বিস্তীর্ণ টাঁড়-এর ওপরে নবীন চাঁদের হালকা সাদা আলোর মধ্যে ঝুপড়ি ঝুপড়ি অন্ধকারের সৃষ্টি করেছে। বাংলোর ডান পাশের পাহাড়তলি দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে-যাওয়া চম্পাঝরন নালাটার ওপরে ওপরে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে ডাকতে ডাকতে একজোড়া টিটি পাখি তাদের লম্বা ঠ্যাং দুটি দোলাতে দোলাতে ডেকে ডেকে উড়ছে। ডাকছে টি-টি-ট্রি হুট—টি-টি-ট্রি-হুট করে। সাহেবরা এই পাখিকে বলে ডিড-ড্য-ড্যু-ইট। কাকে কী যে জিজ্ঞাসা করে ফেরে যুগযুগান্ত ধরে তা ওরাই জানে। কিন্তু এও ঠিক যে যখনই এর ডাকে, তখনই প্রত্যেক শ্রোতারই বুকের মধ্যে চমক জাগে। কী করেছি? কে করেছে? রাতভর এই পাখিরা এইরকমই চমকে চমকে ডেকে বেড়ায় বনের মধ্যে বা নদীরেখার উপরে উপরে কোনো নড়াচড়া বা আলোড়ন দেখতে পেলেই। গৌতমনারায়ণ এই পাখির জুওলজিক্যাল নামও জানেন। ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ। দু-রকম হয় পাখিগুলো। ইয়ালো ওয়াটেলড আর রেড ওয়াটেলড। এদিকে ইয়ালো ওয়াটেলডই বেশি দেখা যায়।
অনেকই জানেন গৌতমনারায়ণ। জীবনের শেষ প্রহরে এসে মনে হয় অনেকই বেশি জেনে ফেলেছেন। এত জানার প্রয়োজন ছিল না কোনো। এই জীবনের জ্ঞান তো পরজীবনে বয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তা ছাড়া আজকালকার ছেলে মেয়েরা সব ব্যাপারেই ওয়াকিবহাল। তারা অনেকই জানে। গৌতমনারায়ণদের অধীত বিদ্যা বা অর্জিত জ্ঞান তাদের কোনো কাজে লাগবে না। তারা ওয়েবসাইটের সামনে বসে থাকে, ইন্টারনেটে সার্চিং করে, চাবি টিপলেই সারা পৃথিবীর জ্ঞান তাদের সামনে হাজির। এইসব কারণেই উনি আধুনিকতাতে ক্লান্তবোধ করলেই চম্পাঝরনের মতো কোনো জায়গাতে আধুনিকতার সব কিছুকে বর্জন করবার জন্য পালিয়ে আসেন। টিভি দেখেন না, মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না, কম্পিউটার ব্যবহার করেন না, এমন-কী সঙ্গে ল্যাপটপও নিয়ে আসেন না। সর্বজ্ঞ মানুষমাত্রই বিভ্রান্ত মানুষ। ওঁর নিজেরই মতো। যেসব মানুষ অনেক জানেন তাঁদের উনি ঘৃণা করেন। তাই তিনি নিজেকেও ঘৃণা করেন। নিজেকে ভুলতে, নিজের পরিবেশ, প্রতিবেশ সব কিছুকে ভুলতে নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে আসেন বারে বারে, আধুনিকতা থেকে প্রাচীনতায়, ব্যাকগিয়ারে চলে আসেন অনেক দূর এই চম্পাঝরনের মতো কোনো জায়গাতে। যেখানে চিরন্তন পুরুষ আর চিরন্তন নারী আর অনাবিল প্রকৃতি, যেখানে কলকারখানা নেই, যন্ত্রচালিত যানবাহন নেই, দূষণ নেই, উচ্চাশা নেই, যশাকাঙ্ক্ষা নেই, যেখানে দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে, প্রিয় নারীর সঙ্গে দিনে অন্তত দু-বার সঙ্গম করে, দিবাযাপন এবং নিশিযাপন দুই-ই সমান সুখকর করে জীবন কাটানো যায়, যুবতীর সঙ্গতে এবং তার সঙ্গে সঙ্গমে পুরোনো শরীরের জীর্ণতাকে সাপের পুরোনো খোলসেরই মতো প্রাচীন কোনো জাম বা মহুয়া গাছের ছায়াতে অবহেলে ছেড়ে ফেলে চিকন নিক্কনিত নবকলেবরে নবজীবন শুরু করা যায়।
বয়স হলে কী হবে গৌতমনারায়ণের দুটি কান এখনো বাঘের কানের মতো সজাগ আছে। রাতে শুয়ে ঘুমের মধ্যেও বাইরের হাওয়াতে একটি পাতা পড়ার আওয়াজও স্পষ্ট শুনতে পান, দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ বা কুকুরের গা-চুলকানোর শব্দ। তাঁর ঘ্রাণশক্তিও আছে সমান সজাগ। বনের মধ্যে ফোটা দূরের কনকচাঁপার ঘ্রাণ বা ফেলে-আসা অপরাহ্ণের ধৃতির উরুসন্ধির ফিরদৌস আতরের গন্ধও তাঁর নাকে একেবারে টাটকা বলে মনে হয়।
গৌতমনারায়ণ তাঁর ডান হাতের পাতাটি বাঁ হাতের পাতা দিয়ে স্পর্শ করলেন। ধৃতির স্তনের কোমল উষ্ণতা এখনও হাতের পাতাতে মাখামাখি হয়ে আছে।
‘নিগাহ যায়ে কাঁহা সিনেসে উঠকর।
হুঁয়াতো হুসনকি দওলত গড়ি হ্যায়।’’
মনে পড়ল শায়রিটির কথা। আমার চোখদুটি তোমার বুক ছেড়ে আর কোথায় যাবে বলো? সুন্দরীদের সব সম্পদ তো খোদা এ বুক দুটিতেই গড়ে রেখেছেন।
৩
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের আলোও জোর হলো। ড্রাইভার কেরকেরে আর গৌতমনারায়ণের খিদমদগার ঝাণ্ডু ফিরে এসেছে সীওনি থেকে অনেকক্ষণ। তাঁকে খাইয়ে নিজেরাও খেয়ে শুয়ে পড়েছে। চিঞ্চিকেডের কোয়ার্টারে চিঞ্চিকেডে একাই থাকে। ওর বাড়ি খিন্দসিতে। সেখানে বউ-বাচ্চারা থাকে। তাই কোয়ার্টারে অনেকই জায়গা। উনি যতদিন থাকেন চিঞ্চিকেডেও চারবেলা গৌতমনারায়ণের লোকেদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করে।
ঝাণ্ডুটা খুব গুটখা খায়। ফলে কাশি হয় ভীষণ। রাতে শোওয়ার পরে বাড়ে। শহরে অতটা বোঝা যায় না, এই নির্জন নিস্তব্ধ জায়গাটাতে ফাটা কাঁসির শব্দের মতো শোনাচ্ছে কাশিটা। কেরকেরে পড়ে আর ঘুমোয়। বেঁচে আছে কী মরে গেছে তাই বোঝা যায় না। আর চিঞ্চিকেডে নাক ডাকে খুব। প্রথম প্রথম কেরকেরে আর ঝাণ্ডু গালাগালি করত। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
গৌতমনারায়ণ চওড়া বারান্দাতে হাতলঅলা ইজি চেয়ারে তখনো বসেছিলেন। চারিদিকের জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বন-পাহাড় আর বন বাংলোর নুড়ি- ফেলা, গাছে-ভরা হাতাটি ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। গাড়ি ফেরার পরে বাংলোর গেট বন্ধ করে দিয়েছে চিঞ্চিকেডে।
পাইপের পোড়া তামাকের ছাইটা ছাইদানিতে ফেলে ইজিচেয়ার থেকে উঠলেন উনি। তারপর চওড়া বারান্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে পায়চারি করতে লাগলেন ধীরে ধীরে। বাঁ-দিকের গেট অবধি গিয়ে ফিরে ডানদিকের গেট অবধি গেলেন। বাঁ-দিকে ঝাঁটি-জঙ্গল মিশেছে গিয়ে পাহাড়ে। পাহাড় থেকে হঠাৎ ব্বাক-ব্বাক-ব্বাক করে একটি কোটরা হরিণ ডেকে উঠল। তারপরই জোরে জোরে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে পাহাড় থেকে নেমে এল। কোনো শ্বাপদের তাড়া খেয়ে। বড়ো বাঘ এখানে নেই। একসময়ে ছিল। বাঘ এখন সারা দেশেই বা ক-টা আছে।
কোটরাটা পথ অবধি নেমে এল তারপর চম্পাঝরনের দিকে দৌড়ে গেল। কোন জানোয়ার তাড়া করল কে জানে। চম্পাঝরন নালার দিক থেকে একটি টিটি পাখি ডাকতে লাগল। অনেক জঙ্গলের মতোই এখানেও একজোড়া পাগলা কোকিল আছে। তারা কুহু-কহু-কহু করে শিহর তুলতে ডাকতে লাগল। এই ডাকে গৌতমনারায়ণের বুকের মধ্যেও শিহরণ উঠল। কিন্তু এসবে চিঞ্চিকেডের নাক ডাকা অথবা ঝাণ্ডুর কাশির কোনো বিরাম হল না। ওসব শব্দও যেন প্রাকৃতিক শব্দ।
কিছুক্ষণ পরে কোটরাটা বাংলোর নীচু বেড়া টপকে চম্পাঝরনের দিক থেকে ফিরে এসে বাংলোর হাতায় ঢুকল, মহুয়া গাছগুলোর নীচে নীচে সাবধানি পায়ে মহুয়ার ফুল খেতে লাগল ইতিউতি। গৌতমনারায়ণের ভরসাতেই। ও জানে, মানুষের কাছে আসবে না কোনো শ্বাপদ। অনেক সময়ে মানুষই তাদের যম আবার অনেক সময়ে মানুষই তাদের পরিত্রাতা। ওরা যদিও জানে না যে সারা দেশেই সবরকম বন্যপ্রাণী মারাই এখন বারণ তবে মানুষদের ব্যবহারে একটা পরিবর্তন যে এসেছে তা বুঝতে পারে। কোটরাটা এখন অনেকক্ষণ মহুয়া খাবে।
বন্য পশুপাখি উনি একসময়ে অনেকই শিকার করেছেন, কিন্তু বেআইনি হয়ে যাওয়ার পরে করেননি একটিও। করেন-তো-নিই কেউ করছে অথবা করার চেষ্টা করছে দেখলেও বাধা দিয়েছেন। তা ছাড়া, বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রকৃতি ও বনের পশুপাখিদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও মমত্ব যেন অনেকই বেড়ে গেছে। নিজের ভিতর থেকে নিজেকে বাইরে বের করে এনে সেই আমিকে দেখে বিস্ময়াভূত হন তিনি। বয়স মানুষকে যা দেয়, দিতে পারে, তা যৌবনের উন্মত্ততা কখনোই দিতে পারে না অথচ এ কথাটা নিজের বয়স হওয়ার আগে আদৌ বোঝা যায় না। নির্লিপ্তির মধ্যে দিয়ে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি আসে, সেই তৃপ্তি বড়ো আনন্দের। এই সুগন্ধি বাসন্তী, রুপোঝুরি রাতের রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শর মধ্যে যা আনন্দ তা কিন্তু সম্পূর্ণ হল না, প্রকৃতি অসম্পূর্ণ রইল একটি নারীর অভাবে। এখন যদি তাঁর পাশে ধৃতি থাকত তবে এই রাত সম্পূর্ণ হতো।
আজই গৌতমনারায়ণ ধৃতিকে বলেছিলেন ও চিঞ্চিকেডের সঙ্গে চম্পাঝরনের দিকে রওনা হয়ে যাওয়ার আগে।
‘‘আভি কামলিন হো, কাঁহি খো দেওগে দিল মেরা
তুমহারি লিয়েই রাখখা হ্যায়, লে লেনা জোঁয়া হোকর।’’
মানে, ওরে নবীন কিশোরী, এখন দিলে কোথায় হারিয়ে ফেলবে তুমি, আমার হৃদয়। তবে তোমারই থাকল, তোমার জন্যেই রাখা রইল এই হৃদয়। যখন যুবতী হবে এসে নিয়ে যেও।
ধৃতি ঘাড় ফিরিয়ে, চুল ঝাঁকিয়ে হেসে বলেছিল যুবতী তো সেই কবেই হয়েছি, এখন তো প্রায় বুড়ি হতে চললাম।
গৌতমনারায়ণ হেসে বলেছিলেন, কতরকমের যুবতী হয় তা কী জান?
কতরকমের?
সদ্যযুবতী, মধ্যযুবতী, আস্ত-যুবতী।
ধৃতি হেসে বলেছিল, আপনার মাথাতে আসেও বটে।
তারপরই পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গিয়ে বলেছিল আমাকে নায়িকা করে একটি উপন্যাস লিখবেন দাদা?
—সে উপন্যাস আরম্ভ করতে পারি কিন্তু সে-যে শেষ হবে না।
—কেন?
—তুমি যে অনন্ত।
আবারও হাসল ধৃতি।
—‘অনন্ত অপার তোমায় কে জানে’। একটি ব্রহ্মসংগীত আছে। শুনেছ কখনো?
—আমিও তো নাগপুরের বাঙালি। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ আর কতটুকু।
—আমিও তো নাগপুরের বাঙালি। ভৌগোলিক দূরত্ব কি কাব্য, সংগীত, সাহিত্যকে আটকে রাখতে পারে?
—পারে বই-কি সাধারণদের কাছে এ-এক বিরাট বাধা তবে আপনার মতো অসাধারণদের কাছে নয়।
সুন্দরী অনেকই দেখেছেন গৌতমনারায়ণ এ জীবনে। অনেক নারীর সংস্পর্শে এসেছেন। নারী সঙ্গও করেছেন অনেক। তাঁর মধ্যে বিধাতা এমন অনেক কিছু দিয়েছেন যে প্রথম যৌবন থেকে নারীরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। যত নারীর সঙ্গ করেছেন আজ অবধি তার পঁচানব্বই ভাগই তাঁদেরই গরজে। নিজে এগিয়ে গিয়ে যাঁদের চেয়েছেন আজ অবধি, তার মধ্যে ধৃতি অন্যতমা। গৌতমনারায়ণ তাঁর সব গুণ, সব রূপ নিয়ে ধৃতিকে চেয়েছেন এই অবেলাতে। বড়ো ভয় ছিল, যদি ধৃতি প্রত্যাখ্যান করে। তবে জীবনে এই প্রথম তাঁর হার তো। উনি কারোকে চেয়েছেন অথচ তিনি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এমনটি কখনো আসেনি ওঁর জীবনে। প্রত্যাখ্যান করলে কী হত উনি জানেন না। হয়তো উনি ভীরুর মতো আত্মহত্যা করতেন নয়তো একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখতেন, তা হত তাঁর জীবনের সেরা উপন্যাস। আজ অবধি তিনি এত লিখেছেন যে আজকে আর লিখতে ইচ্ছাই করে না। প্রত্যেক মানুষের জীবনই তো একটি উপন্যাস। এখন কথিত উপন্যাস নয়, লিখিত উপন্যাস নয়, একটি জীবন্ত উপন্যাস লিখতে ইচ্ছে করে, জীবনের শেষ উপন্যাস, যাতে কল্পনার কোনো ভূমিকাই থাকবে না, যা হবে সত্যি উপন্যাস। ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই ধৃতি তাঁকে অনুরোধ করল ‘আমাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখুন।’ ‘একটা গান লিখো আমার জন্যে।’ কার যেন গাওয়া? প্রতিমা ব্যানার্জি কি? বোধহয় ভালো ভালো গান, ভালো ভালো লেখা, ভালো ভালো ছবি, ভালো ভালো ফিল্ম সব যেন হারিয়ে যাচ্ছে একে একে। তবে ওঁর তো যাবার সময়ই হয়ে এসেছে। বেশি হারাবার ভয় আর নেই ওর।
ধৃতির অনুরোধ তো না রেখে উপায় নেই। ও যে ক্লিওপেট্রার মতো, রোম্যান হলিডের অড্রে হেপবার্ন-এর মতো, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র অরুন্ধতী মুখার্জির মতো, ও যে ক্যাটরিনা কাইফ-এর মতো, ওকে না করা যায় না। কিন্তু গৌতমনারায়ণ হলপ করে বলতে পারেন যে লেখালেখি আর করতে ইচ্ছে করে না।
ধৃতির হাসি, ওর চোখ, ওর দাঁত, ওর ভুঁরু, ওর সপ্রতিভতা সব কিছুই অনন্য। ওকে ফেরানো যায় না। কিছুতেই না। তবে ওর সাহসের কোনো অভাব নেই। সে তো হাভাতে নয়। তার বাপের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি সবাই মস্ত বড়োলোক। শুধু নাগপুর কেন, পুরো মহারাষ্ট্রেই তাদের লোকে এক নামে চেনে। তার বাপের বাড়ি ও শ্বশুড় বাড়ির মানুষেরা, গৌতমনারায়ণ যতই খ্যাতিমান, শক্তিমান এবং অর্থবান হন না কেন, তাঁকেও ইচ্ছে করলেই মেরে ফেলতে পারে। আজকাল ‘সুপারি’র দিন। টাকা থাকলে যাকে তাকে মেরে ফেলা যায়। কিছু আলোড়ন ওঠে কিছুক্ষণের জন্যে, সোডার বোতল খুললে যেমন হয়, তারপরই কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে থেমে যায়। কারোই কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। নিজে তো যৌবনে ডাকসাইটে অ্যাডভেঞ্চারাস মানুষই ছিলেন। পোলো খেলেছেন, র্যাফটিং করেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, শিকার করেছেন, ইয়াটিং করেছেন। করেন নি কী? কিন্তু সেসব যৌবনেই। ন্যাশনাল সুটিং এ রাজা মহারাজাদের সঙ্গে পার্টিসিপেট করেছেন। একবার অলিম্পিকেও নির্বাচিত হয়েছিলেন, বাবার অসুস্থতার কারণে যেতে পারেননি? তবু তাঁর সাহসের তারিফ করতে হয়। জীবনের এই শেষ বেলাতে এই নবতম অথবা শেষতম অ্যাডভেঞ্চারে ধৃতিকে নিয়ে এই জঙ্গলে আসাটা মানুষখেকো বাঘ শিকারের চেয়ে কম বিপজ্জনক ছিল না।
তবে ধৃতি খুবই উত্তেজিত। তার শরীরে এবং মনেও এই পরম বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চারের প্রতিটি মুহূর্তই সে উপভোগ করছে। তার সাহসেরও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
কিন্তু গৌতমনারায়ণ যেন স্থিতপ্রজ্ঞ। যেসব বড়ো বড়ো শিকারি অনেকেই বিপজ্জনক মানুষখেকো বাঘ মেরেছেন। তাঁরা উত্তেজিত হলেও বাইরে থেকে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না। তাঁরা একেবারে অবিচল থাকেন। নির্লিপ্ত। কোনোরকম বাহ্যিক উচ্ছ্বাস ছাড়াই তাঁরা সেই শিকারযাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত তিল তিল করে উপভোগ করেন। তাঁদের মধ্যে কোনোরকম ছটফটানি দেখা যায় না।
ওঁরা চম্পাঝরন বন বাংলোতে এসে পৌঁছেছেন মাত্র দু-দিন হল। তাও তো ধৃতি গ্রামে গিয়ে রয়েছে সীতার সঙ্গে। হাতে আছে আরো পাঁচদিন। ধৃতিই জেদ ধরেছিল যে ওর নিজের লালরঙা মার্সিডিজ নিজে চালিয়ে আসবে। মাথাতে লালরঙা রুমাল বেঁধে। পাশে গৌতমনারায়ণ বসে থাকবেন।
খুবই প্রয়োজন না পড়লে শহরে গাড়ি চালান না আজকাল। তবে বাইরে এসে চালান যদি অবশ্য ঝাণ্ডু তাঁকে চালাতে দেয়। বিয়ে না করলে কী হয়, তাঁর ভ্রাতৃবধূ বুলকু এবং ঝাণ্ডুরাই এখন তাঁর গার্জেন। দিনে দু-বার ফোন করে বুলকু ধানতোলি থেকে খবরাখবর নেবার জন্যে। তাঁর ভাইঝি পূর্ণাও ফোনে গল্প করে, তবে মোবাইল রেখে আসাতে তারা কেউই যোগাযোগ করতে পারছেন না। ঝাণ্ডু আর কেরকেরেকেও বলেছেন ওদের মোবাইল অফ করে রাখতে।
আজকাল গৌতমনারায়ণ সেমি-রিটায়ার্ড। ছোটো ভাই-ই কাজ কর্মসব দেখে। উনি তাঁদের ব্যবসার সঙ্গে আর জড়িয়ে-মড়িয়ে নেই। তবে ব্যবসা তাঁর বাবা অতীন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পরে গৌতমনারায়ণেরই অর্জিত সুনামে, সেই সুনাম শুধু ব্যবসাদার হিসেবেই নয়, তাঁর অন্যান্য গুণের সুবাদেও, কোম্পানির খ্যাতি অনেকই বেড়েছে।
বড়োদাদার মৃত্যুর পরে কাজের এগজিক্যুশনে একটু অসুবিধে যে হচ্ছে না তা নয় তবে অন্য ডিরেক্টরেরা খুব তাড়াতাড়ি সেই খামতি পূরণ করে নিয়েছেন। তবুও কর্মচারীরা এবং বিজনেস অ্যাসোসিয়েটররা বলেন গৌতমনারায়ণের এই ব্যাবসা পুরোপুরি না দেখায় খামতি থেকেই গেছে। কিন্তু যে যা-ই বলুক। অনেক করেছেন পরিবারের জন্যে এক জীবনে, এখন যে-কটা বছর হাতে আছে তা তিনি একেবারে নিজের খুশিমতোই ব্যয় করতে চান। বিয়ে-থা করলে জীবনের অনেকখানি সময়ই তাতে নষ্ট হত। তা যখন করেননি, তখন জীবনের এই ভগ্নাংশ তিনি নিজের খুশি ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারেই নষ্ট করতে চান না। তাঁর যে সব নিজস্ব কাজ, ছবি আঁকা, লেখা, পড়াশুনো, ঘুরে বেড়ানো এই সবের মধ্যেই তা শুধু ব্যয়িত করতে চান। তার মধ্যে প্রিয় নারীর সঙ্গও একটি।
৪
সকালে উঠে চা খেয়েই কেরকেরে চলে গেছে ধৃতিকে আনতে। ঝাণ্ডু এসে বলল, নাস্তাতে কী বানাব স্যার?
বহুদিন চিঁড়ের পোলাও খাই না। বানাতে পারবি ভালো করে। কাল সীওনী থেকে কী আনলি?
যা যা আসে সচরাচর। তবে খুব ভালো টাইট এঁচড় দেখলাম। এনেছি। ওলও এনেছি। দুপুরে সেদ্ধ করব। আর কচি পাঁঠার মাংস এনেছি।
মাংসা খারাপ হয়ে যাবে না? এখানে তো ফ্রিজ নেই।
না স্যার। রাতে তো ঠাণ্ডাই থাকে। শেষ রাতেও গায়ে কম্বল চাপাতে হয়। রাতে ঠিকই আছে। এখনই সাঁতলে রাখব। খারাপ হবে না।
টক দই আনিসনি?
এনেছি স্যার। টক এবং মিষ্টি দইও।
মিষ্টি দইও তো কেটে যাবে।
না স্যার। দড়ির থলেতে রান্নাঘরে টাঙিয়ে রেখেছিলাম। খারাপ হবে না।
তাহলে পেঁয়াজ, কাঁচালংকা গরমমশলা আলুকুচি বাদাম ও কিশমিশ দিয়ে নাস্তাতে চিঁড়ের পোলাও করছি। সঙ্গে স্ক্রাম্বলড এগস।
—আর মাংস কখন রাঁধবি?
—দুপুরে রাঁধব। টক দই দিয়ে।
—বেশি করে রাঁধিস। সকলের জন্যে হবে তো?
—হ্যাঁ স্যার। হয়ে, বেশি থাকবে। রাতে মুচমুচে পরোটা দিয়ে খাবেন খন।
এমন সময়ে কেরকেরের গাড়ি ঢুকল বাংলোর হাতায়।
ধৃতি নামল পেছনের দরজা খুলে। কেরকেরে পেছনের বুহুট খুলে ধৃতির নীলরঙা ছোটো স্যুটকেসটা নামাল আর একটা ঝোলা। ধৃতি ওর চামড়ার হালকা হলুদরঙা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নামল।
গৌতমনারায়ণ ঘর থেকে বারান্দাতে এসে বললে, একী! তুমি ওখানের ক্যাম্প স্ট্রাইক করে চলে এসেছ দেখছি। কী ব্যাপার?
—ব্যাপার একটা আছে। কাল রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে জন চার-পাঁচ লোক এসেছিল চম্পাঝরনে।
একটু অবাক হয়ে গৌতমনারায়ণ বললেন, কেন? কার কাছে? তোমার কাছে?
না। তাহলে তো আমিই কথা বলতাম। এসেছিল তোমার খোঁজে।
আমার খোঁজে কেন?
কেন? তা কী করে বলব। যে- গৌতমনারায়ণের খোঁজে ওরা এসেছিল তুমিই সেই গৌতমনারায়ণ কি না সে সম্বন্ধে নি:সন্দেহ হতে এসেছিল।
কী চায়? টাকা?
টাকা চাইলে তো আমার কাছেই চাইতে পারত। আমার কাছে হাজার দশেক তো ছিলই। এটিএম থেকে তুলেছিলাম আসার আগে। তোমার কাছে থাকাতে যে পাই-পয়সা খরচ হবে না আমার তা তো জানা ছিল না।
আমার কাছে আসবে বলেছে টাকার জন্যে?
না। সেরকম কিছু তো শুনলাম না শোওয়ার ঘর থেকে। সীতারও তেমন মনে হয়নি।
তবে? এসেছিল কেন?
কী করে বলব?
ওরা আর কী বলল?
তোমার খোঁজই করছিল। সীতা বলল, বুর্জোয়া গৌতমনারায়ণের খোঁজ করছিল ওরা।
ছেলেগুলো কি সবাই মারাঠি?
কথা শুনে তো সেরকম মনে হল না।
তবে?
একজন মারাঠি থাকলেও থাকতে পারে। একজন সম্ভবত বাঙালি। কথার টানে সেরকম মনে হল। সে হিন্দিতে কথা বলছিল। আর দু-তিনজন সম্ভবত ছত্তিশগড়িয়া। গ্রামাঞ্চলের লোক। কারণ ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরের লোক হলে মারাঠিও জানার কথা।
শেষ পর্যন্ত কী বলে গেল ওরা?
বলল, বুর্জোয়া গৌতমনারায়ণ সিংকে খুঁজতে এসেছে ওরা। সীতাটা এমনই বোকা, বলে দিয়েছে যে তুমি বনবাংলোতে আছ।
—ওরা বলল, বহত মেহেরবানি।
কাল ক-টা নাগাদ এসেছিল?
মনে হয় রাত সাড়ে ন-টা নাগাদ।
আমি তো তখন বাংলোর হাতাতে পায়চারি করছিলাম। ওরা তখনই এলে তো আমার দেখা পেতই। এসেও থাকতে পারে। কারণ চম্পাঝরন নালাটার উপরে ল্যাপউইঙ্গ পাখি দুটো ডিড-ড্যা-ড্যু ইট, ডিড-ড্যা-ড্যু ইট, করে খুব ডাকছিল।
তবে কী হবে? ভয় করছে আমার।
ভয়ের কী আছে। এইরকম ভয়ের মধ্যে তোমাকে আদর করতে কী মজাই না হবে বলো তো?
আমার ঠাট্টা ভালো লাগে না।
গৌতমনারায়ণ বললেন, ঝাণ্ডু, মেমসাহেবের মালগুলো নামিয়ে পাশের ঘরে রাখো আর মেমসাহেবকে জিজ্ঞেস করো আমি যা খাচ্ছি নাস্তা তিনি তাই খাবেন কি না?
ঝাণ্ডু, জি স্যার বলে, গাড়ির দিকে চলে গেল।
গৌতমনারায়ণ লক্ষ করলেন, ঝাণ্ডু, চিঞ্চিকেডে এবং কেরকেরে তিনজন ফিশফিশ করে কী আলোচনা করছে। তবে স্বল্পক্ষণের জন্যে।
মহারাষ্ট্রের সমস্ত অভয়ারণ্যের মধ্যে মাছ-মাংস খাওয়া বারণ।
তবে চম্পাঝরন অভয়ারণ্য নয়। তবু এই আইন সম্বন্ধে পুরো অবহিত নন বলে গৌতমনারায়ণ কেরকেরকে বললেন, মাংস কি এখানে খাওয়া যাবে রে? বন-মন্ত্রী যা কট্টর নিরামিষাশী।
না স্যার। সেই আইন শুধু অভয়ারণ্যের মধ্যে। চম্পাঝরনে সে আইন লাগু নেই। আমি সীওনীর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট-এর অফিসে গিয়ে যাচাই করে এসেছি।
বাবা:! তুই তো দেখছি পাকা লোক। এনেছিসই যখন তখন দিদিকে বল। আমি যেভাবে বলেছি রান্না সেইভাবেই কি করবি?
ধৃতি বলল, পাঁঠার মাংস? ঠিক কীভাবে রান্না করছে?
বলে দে ঝাণ্ডু মেমসাহেবকে।
সব শুনে ধৃতি বলল, মাংস আমি রান্না করব। বাসমতি চাল আছে তো?
বাসমতি তো নাগপুরে যথেষ্টই পাওয়া যায়। আমি তোমাকে যে চাল খাওয়াব তা কখনো খাওনি। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ থেকে আমার জন্যে একজন ‘তুলাইপাঞ্জী’ চাল পাঠিয়েছিলেন। আমি জমিয়ে রেখেছি চম্পাঝরনের মতো কোনো বন বাংলোতে তোমার মতো কারো সঙ্গে বসে দই-মাংস আর এই চালের ভাত খাব বলে।
বাসমতি কী একেবারেই নেই?
আছে গো আছে।
তাহলে আমি একদিন বিরিয়ানি রাঁধব। মাংস তাহলে আনতে হবে আবার। আর চাল কম পড়লে আবারও চাল আনাতে হবে। তারপরেই বলল, কী যেন নাম বললে চালের?
তুলাইপাঞ্জী।
বাসমতি চালের জন্য প্রয়োজন হলে দশবার সীওনীতে গাড়ি যাবে। তুমি বলে ব্যাপার। আর ঠিক করেছি, চিঞ্চিকেডেকে চম্পাঝরন গ্রামে পাঠিয়ে ছোটো পাঁঠা আনাবো একটা। তারপর তার বার-বি কিউ অথবা নলাপাড়া করাব কাল বা পরশু রাতে।
বার-বি-কিউ বুঝলাম, নলা-পোড়াটা কী জিনিস।
আছে, আছে, ও ওড়িষ্যার জঙ্গলের একরকম জংলি রান্না। ওড়িষ্যার জঙ্গলে শিকারে গিয়ে শিখেছি। খুব মোটা বাঁশের মধ্যে ডুমো ডুমো করে মাংস কেটে মশলা মাখিয়ে তার ভেতর দিয়ে দিতে হয়। গাঁটের একপাশে ফুটো করে মাংস ঢুকিয়ে দিতে হয়, তারপর সেই মুখটিকে কাদা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হয়। তারপরে সেই বাঁশটিকে ক্যাম্পফায়ারের মধ্যে ফেলে দিতে হয়। ফেলে দিয়ে ক্যাম্পফায়ারের চারদিকে গোল হয়ে বসে গল্পগুজব করো। একসময় কটাং শব্দ করে মোটা বাঁশের টুকরোগুলো ফেটে যাবে। তখন সেটাকে বের করে এনে, কাবাবের টুকরোগুলো একটি প্লেটে বের করে নিয়ে নুন ও গোলমরিচ ছিটিয়ে কাঁটা দিয়ে খেও, চমৎকার লাগবে। এ কাবাবের কথা কিন্তু সবাইকে বলে দিও না। তাহলে দেখবে লক্ষ্ণৌ-এর টুণ্ডের কাবাবের দোকানেও নলা-পোড়া কাবাব পাওয়া যাচ্ছে।
ঝাণ্ডু এসে বলল, নাস্তা হয়ে গেছে স্যার। খাবার ঘরেই দেব তো?
আরে, না, না। জঙ্গলে এসে কেউ ঘরে খায়? বাইরে টেবল লাগা।
কোন গাছের তলাতে লাগাব?
ওই চেরি গাছটার তলাতে লাগা। নানা পাখির মেলা বসবে গাছটাতে ফল খাবার জন্যে। অনেকরকম পাখিও দেখা যাবে।
কফি না চা?
আমি ড্রিঙ্কিং চকোলেট খাব। আমার সঙ্গেই আছে বের করে দিচ্ছি।
স্যার?
—আমি কফিই খাব। ভালো করে দুধ-চিনি দিয়ে।
—তোমার না ডায়াবেটিস?
তাতে কী? ডাক্তারদের সব অনুশাসন মানলে মানুষ এমনিতে যতদিন বাঁচত তার আগেই মারা যাবে নির্ঘাত। চিরদিন কি নীরোগ থাকা যায়? অথবা না মরেও? রোগ নিয়ে সর্বক্ষণ ভাবলে মানুষের মনের উপর এমন চাপ পড়ে যে তার বাঁচার আনন্দ একেবারেই মরে যায়। মতে তো একদিন হবেই রে বাবা। বেশি বাঁচলে জরার হাত থেকেও বা কে রক্ষা পাবে। এসব অমোঘ ব্যাপার। ডাক্তারদের হাতে না মরে স্বাভাবিকভাবে মরা অনেক ভালো। তাঁদের সব কথা মেনে পতুপতু করে দু-এক বছর বেশি বাঁচার চেয়ে না বাঁচাই ভালো। কোনো ডাক্তার কি মুচলেকা দিতে পারেন, না কখনোই দেন যে, ‘আমার কথা বেদবাক্যের মতো মানলে আপনি আপনার আয়ুর চেয়েও বেশি বাঁচবেন?’
আরে,না, না। জঙ্গলে এসে কেউ ঘরে খায়? বাইরে টেবল লাগা।
—না, তা হয়তো দেন না বা দেবেনও না। তবু ডাক্তারদের না মেনে কি পারা যায়। বিজিতেন জেঠু তো তোমার চেয়েও বড়ো বয়সে। তিনি তো ডাক্তারের কথাতে ওঠেন বসেন। তাইতো এমন দিব্যি বেঁচে আছে।
বিজিতেনদা তো ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মরা প্রত্যেকে নিজের স্ত্রী আর ডাক্তারদের সবচেয়ে বেশি ভয় পান পৃথিবীতে। তুমি হয়তো জান না যে সত্যজিৎ রায় কী অসম্ভব ভয় পেতেন তাঁর ডাক্তার এবং স্ত্রীকেও। ড: কান্তি বক্সী যদি মানিকদার মনে অমন ভয় ঢুকিয়ে না দিতেন তবে মানুষটা হয়তো আরও ক-বছর আমাদের কিছু দিয়ে যেতে পারতেন। আসলে, সাধারণ মানুষ আর অসাধারণ মানুষের চিকিৎসাতে তফাৎ থাকা উচিত। জীবনের দৈর্ঘ্য দিয়ে তো জীবনের পরিমাপ হয় না। জীবনের পরিমাপ হওয়া উচিত জীবনের কোয়ালিটি দিয়ে। পূর্ণভাবে বাঁচা উচিত। খাও দাও, ধৃতির মতো নারীসঙ্গ করো, প্রকৃতির মধ্যে বুঁদ হয়ে যাও, ভালো গান-বাজনা শোনো, ভালো ছবির তারিফ করো, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী অথবা আমার দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করো, দেখবে মৃত্যুচিন্তাই আসবে না মনে। তারপর বললেন, এই সব মানুষেরা কেরকেরে, ঝাণ্ডু, চিঞ্চিকেডে, সীতা এরা কি মানুষ নয়? এরা কত অল্পবয়স থেকে কাজ করছে, এদের না আছে প্রভিডেন্ট ফাণ্ড না গ্র্যাচুইটি, না কিছু সঞ্চয়। কাজ করতে করতে হঠাৎ একদিন মরে যাবে। ব্যাস। তার ছেলে যদি বড়ো হয়ে থাকে তবে তোমার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়াবে। তুমি হয়তো কিছু দয়ার দান একথোকে দিয়ে দেবে নয়তো ওকে বহাল করবে ওর বাবা-মায়ের জায়গাতে। এখনো কিছুমাত্র হল না ধৃতি—স্বাধীনতার এত বছর পরেও কিছু হল না। যদি বা কিছু হল তা হল শুধুমাত্র বড়ো বড়ো শহর আর সরকারি ক্ষেত্রেই। এই গ্রামে গঞ্জের, পাহাড় বনের মফস্বলের মানুষেরা যেন ভারতবর্ষের বাসিন্দাই নয়। ব্যাঙ্কের এবং বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মচারী ক্রমাগত মাইনে বাড়াবার জন্যে আন্দোলন করে যাচ্ছে এবং তাদের মাইনে বেড়েও যাচ্ছে। তারা যেন সব সরকারের জামাই। অথচ দেশের অধিকাংশ অসংগঠিত শ্রমিকদের বেলাতে, বাড়ির কাজের লোকেদের বেলাতে, চাষের কাজ যারা করে, যারা রিকশা চালায়—অতি অল্প আয়ে জীবন কাটায়—তাদের কর্মচারীরা—বেসরকারি অফিসের কোটি কোটি কর্মচারী—তারা সকলেই তো আর চেম্বার অফ কর্মাসের আওতায় আসে না, তাদের কথা কে ভেবেছে। এই ভারতবর্ষ শহরবাসীর, সচ্ছল মানুষদের ভারতবর্ষ। কাগজে ন্যাসড্যাক আর সেনসেক্স-এর উত্থান-পতনই এই দেশের আর্থিক অবস্থার নির্দেশক অথচ দেশবাসীর কত ভাগের কোম্পানি কাগজ আছে? খবরের কাগজে যখন দেখি যে মুদ্রাস্ফীতির হার নাকি বহু বছর এত কম ছিল না তখন নাগপুর বাজারে চাল, আটা, তেল, আলু, পেঁয়াজ, মাছ, মাংসের দাম এমনই আকাশছোঁয়া যে আমাদের মতো বড়োলোকদেরও প্রাণ ওষ্ঠাগত।
ধৃতি বলল, এইসব কাগজের অর্থনীতিক আর কাগুজে বয়ান চিবিয়ে আর সাধারণ মানুষে কত দিন বাঁচবে বলো? তুমি ঠিকই বলেছ।
ঝাণ্ডু আর চিঞ্চিকেডেরা চেরি গাছতলাতে টেবিল লাগিয়ে লাল সাদা খোপ খোপ টেবল ক্লথ পেতে, টেবলের মধ্যিখানে একটি পাথরের বাটিতে কয়েকটা কনক চাঁপা জলের মধ্যে রেখে টেবলে ক্রকারি কাটলারি সাজিয়ে গৌতমনারায়ণ আর ধৃতিকে ব্রেকফাস্ট খেতে ডাকল।
ধৃতি খুবই ইমপ্রেসড হল এমন পরিপাটি ব্যবস্থা দেখে। স্বগতোক্তি করল, বা: ঝাণ্ডু আর চিঞ্চিকেডে খুবই রুচিসম্পন্ন তো। আর্টিস্টিকও। আপনি চমৎকার ট্রেনিং দিয়েছেন ওঁদের।
কিন্তু আমি কিছুই শিখাইনি। কিছু মানুষ দেখে দেখে নিজে নিজেই শেখে। তবে ওরা আমাদের সেবা করার সময়ে খুবই আর্টিস্টিক এবং আর্টিকুলেট কিন্তু ওদের দেশে গিয়ে দ্যাখো কী দারিদ্র ও নোংরার মধ্যে ওরা থাকে। আর্টিস্টিক হবে কী করে। অত জনসংখ্যা, অত দারিদ্র, অত খাইখাই ওদের ভিতর যা কিছু ভালোত্ব, যা কিছু সৌন্দর্য সবই শুকিয়ে মরে যায়।
সে-কথা ঠিক।
ধৃতি বলল।
তারপর গৌতমনারায়ণ বললেন, রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘Art is born out of superfluity’ বিখ্যাত ওঁর রাধুমালি টিনের ক্যানেস্তারা করে জল বয়ে আনছিল বাগানে জল দেওয়ার জন্যে। চলার দুলকি চালে জল ছলকে ছলকে পড়ছিল ক্যানেস্তারা থেকে। তখন একজন বিদেশি অতিথি তাঁর কাছে বসেছিলেন। অতিথি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হোয়াট ইজ আর্ট?’
রবীন্দ্রনাথ রাধুমালির দিকে চেয়ে বলেছিলেন, ‘আর্ট ইজ বর্ন আউট অফ সুপারফ্লুইটি।’
অন্য কথাতে বলতে গেলে বলতে হয় জীবনের চাহিদার পাত্র কাণায় কাণায় পূর্ণ হবার পরেই যা উদবৃত্ত থাকে, উপচে পড়ে, তাই সুপারফ্লুইটি। আর্টের জন্ম সুপারফ্লুইটি থেকেই।
কথাটা হয়ত অত সহজ নয়। অত সহজে বোঝার নয় কিন্তু কথা সার কথা। যাদের ঘর করাই খিদের সঙ্গে তাদের পক্ষে সুপারফ্লুইটি সম্ভব নয়।
এ কথা বলছ বটে তুমি কিন্তু আমরা তো দেখি অধিকাংশ গুণী মানুষই তো গরিব ঘর থেকে আসেন। আমাদের অধিবাসীদের দেখে তো মনে হয় খিদে কাকে বলে তা তারা জানেই না। তাদের মাটির বাড়ির দেওয়ালে আঁকা ছবি থেকে, তাদের দেওয়া আলপনা দেখে তাদের অতি সাধারণ কিন্তু সুরুচিসম্পন্ন সাজপোশাক দেখে তো তোমার কথাটা সত্য বলে মানতে রাজি হয় না মন।
সে-কথাও ঠিক। তবে খিদের অনেক রকম থাকে। বাইরের খিদে ভিতরের খিদে। যে-খিদে তাদের এইরকম বড়ো করে সে খিদের ভিতরের খিদে। যে-খিদে নিয়ে জ্বলতে জ্বলতে তার আধারকেও জ্বালায়। এটা বোঝার কথা, বাইরে থেকে জ্ঞান দেবার কথা নয়। তুমি বুঝবার চেষ্টা করলে বুঝবে।
হঠাৎ উপরে চোখ তুলে ধৃতি বলল, এটা কী পাখি?
চেরি গাছটার দিকে চোখ তুলে গৌতমনারায়ণ বললেন এ পাখিও চিনিস না। চলো, আমি যদি বাঁচি আরো কিছুদিন তাহলে তোমাকে বিভিন্ন অভয়ারণ্যতে নিয়ে গিয়ে পক্ষী বিশারদ মানে Ornithologist করে দেব। নাগজিরাতে নিয়ে গিয়ে Lepidopterist করে দেব।
Lepidopterist মানে কী?
Lepidopterist মানে হচ্ছে প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ।
ঝাণ্ডু প্রায় দৌড়ে এল, বলল চিঁড়ের পোলাও যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল স্যার। ডিমের স্ক্রাম্বল কি এখনই করব?
করো-না। করতে করতে আমাদের চিঁড়ের পোলাও খাওয়া হয়ে যাবে।
পাখিটা কী বললে না। কী সুন্দর হলুদ রং।
এই পাখি তো শহরেও দেখা যায়। গোল্ডেন ওরিয়ল।
তাই?
আর ওই যে একঝাঁক পাখি এক্কাদোক্কা খেলার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে আর ছ্যা ছ্যা করছে সবসময়। ছাই রঙা গায়ের রং, ওগুলো কী পাখি।
আরে ও পাখি তো সব জায়গাতেই দেখা যায়। ওগুলো হল Babbler সবসময়ই কথা বলে। অনেকে ওদের বলেন সেভেন সিস্টারস।
তাই?
হ্যাঁ।
এবারে লক্ষ্মী মেয়ের মতো চিঁড়ের পোলাওটা খেয়ে ফেলো, এখুনি স্ক্র্যাম্বলড এগ নিয়ে চলে আসবে ঝাণ্ডু। সেটাও ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
ধৃতি বলল, খাওয়া-দাওয়ার পর কী হবে।
চলো, বনের মধ্যে ঘুরে আসি।
কোনো বিশেষ গন্তব্যে কি?
না, কোনো বিশেষ গন্তব্যে নয়। একই গন্তব্য।
যা বলো তুমি।
দুপুরে কী খাবে এখনি ওদের বলে দাও।
তোমার খালি খাওয়া আর খাওয়া।
তোমার না হয় দারুণ ভবিষ্যৎ। আমি আর এখন ফিগার দিয়ে কী করব। কেই বা আমায় দেখবে।
আপনাকে তো কেউ শুধু চেহারার জন্য দেখে না।
আজকে দেখে না। যখন আমার যৌবন ছিল তখন অবশ্যই দেখত।
আপনি কিছু জানেন না। যৌবনের সৌন্দর্য দেখে বোকা মেয়েরা, অগভীর মেয়েরা, আর বার্দ্ধক্য পুরুষকে যে-সৌন্দর্য দেয় তার কদর করে গভীর মেয়েরা। আপনার কত গুণ। আপনি তো শুধুমাত্র লেখক নন। আরো কত গুণ আছে।
গৌতমনারায়ণ বললেন, গুণ না ছাই। ঘাটের মড়ার আবার গুণ!
বড়ো বাজে কথা বলো তুমি। এবারে বলো, বনের মধ্যে কোন দিকে নিয়ে যাবে আমাকে?
তোমাকে পথ ভুলাবার জন্যে নিয়ে যাব। চম্পাঝরন নালা ধরে কিছুটা আন্ধারপাণির দিকে গিয়ে তারপরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাব ডান দিকে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে সেখানে একটা মানুষখেকো বাঘ মেরেছিলাম আমি। জঙ্গলও তখন ভীষণ ঘন ছিল। দিনমানেও মানুষ এ দিকে আসত না। সব জায়গার জঙ্গলই পাতলা হয়ে গেছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যাই প্রকৃতির সবচেয়ে বড়ো শত্রু। সর্বনাশ ঘটিয়েছি আমরা নিজেরাই, জনসংখ্যা বাড়িয়ে।
এই জায়গায় আন্ধারপাণি নাম কেন?
জায়গাটা খুব বড়ো বড়ো হরজাই গাছের নীচে ছিল। দিনের বেলাতেও আলো পৌঁছোতো না। আর সেখান দিয়ে তিরতির করে একটি ছোটো জলধারা বয়ে গেছে। সেখানটাতেই ছিল বাঘের জল খাবার জায়গা আর দিনের প্রিয় বিশ্রামস্থল। নির্জনে নিশ্চিন্তে দিবানিদ্রা লাগাত এখানে বাঘ।
‘হরজাই’ শব্দটার মানে কী? ধৃতি বলল।
হরজাই মানে, মিসেলিনিয়াস। যে-কোনো অ্যাকাউন্টেই একটি ‘মিসেলিনিয়াস’ শিরোনাম থাকে। তারই বাংলা হরজাই। বাংলা ভাষাতে যেসব অ্যাকাউন্ট রাখা হয় তার মধ্যে ‘হরজাই খাতে’ বলে একটি অ্যাকাউন্ট হেড থাকে।
তারপরে বলল, জানো এই একই নামের একটি জায়গা আছে নাগজিরা অভয়ারণ্যে। সেখানে বাঘ দেখার জন্যে একটি লোহার Hide আছে। নাগজিরাতে যাওনি কখনো বুঝি? সেখানে যাওয়া পথে হাইওয়ের ডানদিকে আছে নভেগাঁও বার্ডস স্যাংচুয়ারি। তবে মাইগ্রেটরি বার্ডস আসে শীতকালেই। একসময়ে সেখানের রাজার বার্ড শুটিং প্রিসার্ভ ছিল। এখন স্যাংচুয়ারি হয়ে গেছে। বছরের এই সময়ে গেলেও হয়তো সামান্য কিছু দেখা যেতে পারে। কিন্তু আর একটু গরম পড়লেই শুধু বক আর পানকৌড়ি।
তুমি কত জঙ্গলে গেছ না? আমাকে নিয়ে যাবে?
এনি—টাইম। তোমাকে নিয়ে জঙ্গলে যাওয়াও একটা গভীর আনন্দ। তোমার মতো পেলব কোমল সুন্টুনি মুন্টুনি হলুদ বসন্ত পাখিকে নিয়ে জঙ্গলে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। বছরের মধ্যে, ধরো, গড়ে চার মাস তো আমি জঙ্গলেই থাকি। সঙ্গে তুমি গেলে তো আমি বর্তে যাই।
বেশি বেশি।
তারপরে ধৃতি বলল। তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি কর।
যা করি তা যথেষ্ট নয়। জলীল মানীকুরীর একটি শায়রি আছে, জানো কী?
উর্দু শায়রি আমি খুব কমই জানি।
তবে শোনো :
‘ম্যায়নে তো তুমহে চাহা ক্যা ইসসে খতা হ্যায়।
এ তুম হো, এ আয়িনা, ইনসাফ জরা করনা।’
মানে কী হল?
মানে হল, আমি যে তোমাকে চেয়েছি সেটা কি খুব একটা অপরাধ হল? এই নাও আয়না। আয়নাতে তোমার নিজের মুখ দেখে বলো, আমি কি খুব অপরাধ করেছি?
বেশি বেশি।
ধৃতি বলল।
তোমার দিকে তাকালে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। এই গাছগাছালি ফুল পাখি সব কিছুর পটভূমিতে তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি নইলে মানাতোই না।
তারপরে বললেন, আমার বান্ধবীর সংখ্যা তো কম নয়। আজ না-হয় জীবনের শেষে এসে পৌঁছেছি যৌবন এমনকি প্রৌঢ়ত্বও পেরিয়ে এসে। কম নারী তো আমার জীবনে আসেনি। তারা কেউ ফ্যালনা নয়। একেকজন একেকরকম। তাদের মনে এবং শরীরে। কিন্তু তুমি একেবারে অন্য রকম। তুমি কারো মতোই নও। নাগপুরে কাটিয়ে দিলাম এতগুলো বছর কিন্তু তোমার খোঁজ পেতে পেতে জীবনই শেষ হতে বসল। এলেই যদি, তো এত দেরি করে এলে কেন?
যা কিছু ভালো তা হঠাৎ করেই ঘটে।
তোমার মতো সাহসী নারীও আমি কখনো দেখিনি। বিবাহিতা হয়েও তুমি এত দুঃসাহসী হতে পারলে কী করে তাই ভাবি।
সাহস সকলের বুকের মধ্যেই থাকে। কোনো অঘটন-পটিয়সী মুহূর্তে সে হঠাৎ করে বাইরে এসে তার ক্কচিৎ বিভাময় চেহারাটা স্পষ্ট করে আমাদের সামনে প্রকাশ করে মাত্র, আর তখনই সে সাহসী বলে চিহ্ণিত হয়ে যায়।
কখনো কখনো মুখে কোনো চমৎকার বাক্য এসে গেলেই যদি সকলেই লেখক হতে পারত তাহলে আর দুঃখ ছিল কী। শুধু বাংলা ভাষা জানলেই কি কেউ লেখক হতে পারে? না বৈয়াকরণ হলেই?
বৈয়াকরণ শব্দের মানে কী?
যারা ব্যাকরণে পন্ডিত তাঁদেরই বৈয়াকরণ বলে।
বুঝেছি। ওলচিকি ভাষায় ডক্টরেট ডঃ পবিত্র সরকারের মতো?
ইয়েস।
ওঁর ডাক্তারির নমুনা দেখার সুযোগ হয়নি তবে ছোটোদের পত্রিকাতে তাঁর কিছু ছড়া পড়েছি।
ছড়াও লেখেন নাকি? কেমন? ভালো?
অত বড়ো ডক্টরেট-এর লেখার সমালোচনা করার মতো সাহস বা যোগ্যতা কি আমার আছে?
সাহসের কথা বলেছিলে তুমি। আর একটু বলো।
ধরো, ফাইটার পাইলটদের কথা। তাদের মধ্যে সাহস অবশ্যই থাকার কথা কিন্তু কখনো কখনো তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অবিশ্বাস্য সাহস দেখান। যেমন ‘ব্যাটল অফ ব্রিটেন’-এর ফাইটার পাইলটরা দেখিয়েছিলেন। পরদিন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট-এ প্রাইম মিনিস্টার উইনস্টন চার্চিল তাঁর অননুকরণীয় ইংরেজিতে সেই পাইলটদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘নেভার ইন দ্যা হিস্ট্রি অফ ম্যানকাইণ্ড সো মেনি হ্যাভ ওওড সো মাচ, টু সো ফিউ’। সংখ্যাতে তো তারা সামান্যই ছিল।
আমি কিন্তু সাহসের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম তোমার ব্যক্তিজীবনের প্রেক্ষিতে। তুমি যে আমার সঙ্গে হুট করে এরকম সাতদিনের জন্যে জঙ্গলে চলে এলে তাতে তোমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা রাগ করবেন না বা আহত হবেন না? এই সবের তোয়াক্কা না করে তুমি চলে আসতে পারলে?
ধৃতি হেসে বলল, আমি তো বাড়ির ড্রাইভার বা ইলেকট্রিক মিস্ত্রির সঙ্গে লুকিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসিনি। ওঁরা তো জানেনই আমি কার সঙ্গে এসেছি।
তা জানেন। তবে ওঁরা তো এও জানেন যে নির্জন জঙ্গলে তোমার আমার শারীরিক সম্পর্ক তো হতে পারে। সেটাও কি তারা মেনে নেবেন?
খুব জোরে হেসে উঠল ধৃতি।
বলল, শারীরিক সম্পর্ক তো কেউ কারোকে দেখিয়ে দেখিয়ে করে না। আর কোনো শিক্ষিত মানুষ, সে পুরুষই হোক কী নারী, শারীরিক সম্পর্ক করবার জন্যেই এমন করে তেমন সঙ্গীর সঙ্গে বাইরে আসে না। মানসিক সম্পর্কের মধ্যে থেকে তা উজিয়ে গিয়ে যদি শারীরিক সম্পর্ক হয়েও যায় তার মধ্যে আকস্মিকতা থাকে না কোনো। প্রত্যাশার স্ফূরণ থাকে। সম্পর্কটি তাতে পরিপ্লুত হয়।
তারপর বলল, তুমি কি জানো যে, বিবাহ বা এক পুরুষ এক নারীর আজীবন সম্পর্ক, মানসিক সম্পর্ক, মানসিক এবং শারীরিক। বেশি পুরোনোও নয়। শ্বেতকেতু নামের এক ঋষিপুত্র প্রথমে এই প্রথার প্রবর্তন করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল ঋষি উদ্দালক। শ্বেতকেতু তখন বালক মাত্র, সে একদিন দেখল অন্য একজন ঋষি তাঁর মাকে নিয়ে চলে গেল। এ দৃশ্য দেখে উত্তেজিত হয়ে তিনি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী হল?
বাবা বললেন, নারী ও গাভীর উপরে সব পুরুষেরই সমান অধিকার। যে-কেউই যে-কারোর স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করতে পারে।
এই ঘটনাতে উত্তেজিত হয়ে শ্বেতকেতু এক-পুরুষ এক-নারীর চিরজীবনের মতো সহবাসের প্রথা বিধিবদ্ধ করেন। সেই থেকে বিবাহপ্রথা চালু হয়। অথচ মজাটা দ্যাখো, সেই উদ্দালকই পরে কামসূত্র লেখেন যাতে পরের স্ত্রীকে কী করে অধিকার করতে হয় তার নানা প্রক্রিয়া লিপিবদ্ধ করেন।
ধৃতি বলল, ভণ্ডামির চূড়ান্ত।
তাই যেসব নারী ও পুরুষ স্বাবলম্বী, কোনো ব্যাপারেই, শুধুমাত্র পারস্পরিক মন ও শরীরের অবিরাম আকর্ষণের বাঁধন ছাড়া অন্যের সঙ্গে প্রতিমুহূর্ত যুক্ত থাকবেনই যে, এমন কোনো মুচলেকা দেন না। অন্তত দেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। আমরা যেমন ক-দিনের জন্যে বাইরে এসেছি এই স্বাধীনতা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আলগা না করে বরং দৃঢ়ই করে। এতে কোনো পাপ নেই, ভ্রষ্টতাও নেই।
গৌতমনারায়ণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি যথার্থই আধুনিক ধৃতি। তোমার মতো মেয়ে আমি কখনো দেখিনি। তা ছাড়া তুমি যেমন সুন্দরী এবং কৃতি, তোমার প্রতি তো অনেক পুরুষই নিশ্চয়ই আকৃষ্ট হয়। তুমি তো তাহলে প্রায়ই এমন স্বৈরিণীর মতো ব্যবহার করতে পার। এমন করলে তোমার স্বামীর সঙ্গে তোমার সম্পর্কটাতে কি চিড় ধরবে না?
তুমি একেবারেই ভুল। আমার যে চাইয়ের অভাব নেই, সে-কথা আমি বলব না। কিন্তু আমার পাঁচ-বছরের বিবাহিত জীবনে আমি এই প্রথমবার এই স্বাধীনতা নিয়েছি। স্বাধীনতার অপব্যবহার করিনি। আর আমি ঘর ছেড়ে সাতদিনের জন্য বাইরে এসেছি গৌতমনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে—যাঁকে সকলেই চেনে, সম্মান এবং সম্ভ্রম করে। আমি জানি যে নাগপুরে ফেরার পরে আমার ধূর্জটি অধীর আগ্রহে আমার সাত দিনের অভিজ্ঞতা জানার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে। এই সাত দিন সেও যে নীল-এর উপোস করে ব্রহ্মচারী বৃত্তি পালন করবে এমন দিব্যি তো সে আমাকে দেয়নি।
সেটা তুমি ঠিকই বলেছ। প্রত্যেক সম্পর্কই মুক্তির উপরে নির্ভর করে, বাঁধনের মধ্যে সম্পর্ক কোনোদিনও মাটি পায় না।
গৌতমনারায়ণ বললেন।
একশোবার সত্যি কথা।
ধৃতি বলল।
তারপর বলল,
তুমি কি জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি পড়েছ?
পড়েছি। স্টেটস-এ একবার দেখাও হয়ে গেছিল। ওঁর এক আমেরিকান চেলা ছিল স্টুয়ার্ট গিল, আমার বিশেষ বন্ধু—ও নিয়ে গেছিল আমাকে।
তারপর বললেন, আমার না-হয় বয়স হয়েছে, তুমি এই বয়সেই জিড্ডু পড়েছ জেনে অবাক হচ্ছি।
পড়াশুনোর সঙ্গে বয়সের কী সম্পর্ক। আমাদের বাড়িতে যে লাইব্রেরিটি আছে তা হয়তো নাগপুর শহরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কোন বিষয়ের উপর বই যে নেই তা বলে শেষ করা যায় না।
—তা তো হল, কিন্তু হঠাৎ কৃষ্ণমূর্তির কথা তুললে কেন?
—এই জন্য তুললাম যে ওঁর একটি কথা মনে পড়ে গেল।
—কী কথা?
—উনি বলেছিলেন? ‘‘If you love something, or someone, set it free.
If he or she comes back to you, it is yours. If he or she does not, it was never meant to be.’’
বা: সুন্দর কথা তো!
হ্যাঁ।
—আর কতটা ভেতরে নিয়ে যাবে আমাকে?
যতখানি ভেতরে নিয়ে যেতে পারি। কী মন, কী শরীর ভেতরপানে যাওয়াই তো আমাদের উদ্দেশ্য। গভীরে না গেলে ধনরত্ন তুলবে কী করে।
তুমি দ্ব্যর্থক কথা বলতে খুব ভালোবাস তাই না?
হ্যাঁ।
ওইটা কী গাছ। পাতলা ফিনফিনে পেলব লালচে ফুল ফুটেছে গাছময়।
গৌতমনারায়ণ হেসে বললেন, যারা ও-গাছ চেনে না তারা সকলেই এই ভুল করে। তুমি ভাগ্যবতী যে বসন্তবনে এসেছ। এ গাছ কুসুম গাছ। আর ওগুলো ফুল নয়, পাতা, নতুন পাতা।
তারপর বললেন, শহুরে রবীন্দ্রসংগীত গাইয়েরা ‘কুসুমবনেতে’ শব্দটি উচ্চারণ করে বটে কিন্তু কুসুম গাছ না দেখলে সে, গানের ওই বাণীর তাৎপর্য কখনোই বোঝে না। আমাদের দেশের বসন্তের বনের মতো সুন্দর বন পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাবে না। এমন রং-এর বাহার এমন গন্ধের পিচকিরি এমন বনমর্মর সত্যিই কোথাও নেই। পশ্চিমী দেশের বন সুন্দর হয় হেমন্তে, অটাম এ, ওরা বলে ‘Fall’ কিন্তু সে শুধুই পাতার বাহার। আমাদের দেশের মতো বর্ণ গন্ধ শব্দ স্পর্শর বৈচিত্রের মতো বৈচিত্র আর কোথাও নেই। ভারতীয় নারীদেরই মতো।
তুমি যখন গাও ‘একলা বসে হেরো তোমার ছবি এঁকেছি আজ বসন্তি রং দিয়া, খোঁপার ফুলে একটি মধুলোভী গুঞ্জরে ওই গুঞ্জরে বন্দিয়া’ তখন কী তুমি বোঝো যে বাসন্তী আর বসন্তিতে তফাৎ আছে। ছেলেবেলাতে সরস্বতী পুজোর সকালে কী ছেলে কী মেয়ে সকলেই যখন আমরা ধুতি বা শাড়ি পরতাম হলুদরং-এ চুবোনো, তখন বলতাম ‘বাসন্তী’ রঙা। এই বাসন্তীর সঙ্গে বসন্তর যোগাযোগটা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে অধিকাংশরাই জানতাম না যে, শব্দটি বাসন্তী নয়, বসন্তি। গাছটার নাম বসন্তি। বেশ লম্বা দোহারা চেহারা তন্বী মেয়ের মতো। আর তাতে হালকা হলুদ ফুল ফোটে আর ঝরে পড়ে যায়। কোথাও দোলের আগে ফোটে, কোথাও পরে। শান্তিনিকেতনে অনেকের বাড়িতে ওই গাছ দেখতে পাবে। সে-গানের পরের পংক্তি, ‘কনকচাঁপা একটি দুটি করি, পড়ছে ঝরি ঝরি, তোমারে বন্দিয়া’। দোলনচাঁপা, কাঁঠালিচাঁপা শহরে দেখা যায় অনেকই। ‘দোলে প্রেমের দোলন চাঁপা হৃদয় আকাশে।’ কিন্তু কনকচাঁপা একটু ফাঁকা জায়গা ছাড়া বিশেষ দেখা যায় না। ভারতের বনাঞ্চলে কনকচাঁপার চেয়ে উঁচু আর কোনো গাছ নেই। আর সত্যিই এই গাছের ফুল অনবরত ঝরতে থাকে একটি দুটি করে, প্রায় নি:শব্দে।
তারপর বললেন, ‘এই চম্পাঝরন বনবাংলোতে একটি কনকচাঁপা গাছ আছে। ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।’ এই গানটির সঞ্চারী কিংবা আভোগে কনকচাঁপা শব্দটি আছে ‘চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে, তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে’।
বলেই গৌতমনারায়ণ বললেন, আমি বোধহয় একটু বেশি কথা বলছি। বনের মধ্যে এসে বনের কথা শুনতে হয়, নিজেরা কথা কইতে হয় না। চলো সামনের ওই ছোটো টিলাটার উপরে বসি। তুমি আগে বোসো না, আমি আগে ভালো করে দেখেইনি। ফাঁকফোকরে সাপ বা বিছে থাকে। বিছেই বেশি। আমাদের দেশেও টারান্টুলার মতো বিছের অভাব নেই। তবে ওদের ভয় বেশি গ্রীষ্মে ও বর্ষাতে।
টিলাটাতে আগে উঠে গৌতমনারায়ণ ভালো করে দেখে নিয়ে ধৃতিকে ডাকলেন।
বললেন, পূর্ব-আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি প্লেইনসে এই রকম বড়ো ছোটো টিলা এবং টিলার সমষ্টি দেখা যায়। তাদের বলে ‘Kopje’—উচ্চারণ ‘কোপি’। কোপিদের উপরে বিকেলের আলো মরে এলে সিংহ বা একাধিক সিংহ বসে চারধার নিরীক্ষণ করে কোথায় কী জানোয়ার চরছে। এই কোপিগুলো কিন্তু ন্যাড়া জায়গাতে থাকে। ধারে কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো গাছটাছ থাকে না। ওরা বড়ো বেআবরু জানোয়ার। আমাদের দেশের বাঘ বা লেপার্ড-এর মতো নয়। তারা সব সময় আবরু মানে। এমনকি শিকার ধরার সময়ে কখনও বেআবরু হয় না।
ধৃতি হেসে ফেলল। বলল, ভালোই বলেছ।
তারপরে বলল, তুমি? কবে গেছিলে আফ্রিকাতে?
—প্রায় তোমার জন্মের কাছাকাছি সময়ে। কতদিন হয়ে গেল। এখন নিশ্চয়ই অনেক বদলে গেছে। ফেরার সময়ে স্যেসেলস আইল্যাণ্ডসে গেছিলাম। দেখার মতো সুন্দর জায়গা।
—আর কখনো যাবে না?
গেলেই হয়। আফ্রিকা রি-ভিজিটেড। কিনিয়ার মাসাইমারা, নাইরোবি, তানজানিয়ার লেক মানিয়ারা, এন গোরোংগোরো পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো এবং গভীর মৃত আগ্নেয়গিরি, তারপরে সেরেঙ্গেটি প্লেইনস, মাঝে এনডুটু সাফারি লজ। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রিয় শিকারভূমি।
বলেই বললেন, তুমি কি ‘ব্লু হিলস অফ আফ্রিকা’ বইটি পড়েছ?
—না।
পড়ে ফেলো।
স্টুয়ার্ড গ্রাঞ্চার আর ভিভিয়ান লে ছিলেন ‘স্লো’জ অফ কিলিম্যানজারো ছবিতে। ভারী সুন্দর ছবি। দেখেছ ছবিটা?
না।
তুমি আর কোত্থেকে দেখবে? তুমি তো ভোরের শিউলি।
—তারপরেই বললেন, সমরেশ বসুর একটি উপন্যাস ছিল ‘বিকেলে ভোরের ফুল’। সেটির ছবিও হয়েছিল। উত্তমকুমার নায়ক ছিলেন। নায়িকা কে ছিলেন মনে নেই। সম্ভবত দিঘায় শুটিং হয়েছিল। বহুদিন আগের দিঘা। সত্যি! তখন পৃথিবীতে মানুষ কত কম ছিল। কত সুন্দর, কত বাসযোগ্য ছিল পৃথিবীটা।
—এবারে কিন্তু আমরা একেবারে চুপ করে বসে থাকব। পাখির ডাক বনমর্মরের শব্দ, বনের কথা সব শুনব চুপ করে।
তুমি আর কোত্থেকে দেখবে? তুমি তো ভোরের শিউলি।
—তার আগে আমার কাছে একবার এসো। খুব কাছে।
—খুব কাছে সরে এল ধৃতি। কাছে এলে, অনেকক্ষণ ধরে গভীর এক চুমু খেলেন তাকে গৌতমনারায়ণ।
—তোমার জামাটা খোলো।
—এখানে?
—এখানেই তো।
— ঘেমে-চুমে একাকার হয়ে গেছি।
—হলেই বা। আর শোনো, চম্পাঝরনে যে-কদিন আছো ভিতরের জামাটামা পোরো না। যাতে আমার পাখি দুটিকে যখন খুশি বিনা বাধায় ছুঁতে পারি, মুঠিভরে ধরতে পারি, ঠোঁট ছোঁয়াতে পারি শিশুর মতো। আর আজ জ্যোৎস্না রাতের বনের মধ্যে আমার কাঠবিড়ালিকে আদর করব।
—কাঠবিড়ালি কী?
—জান না?
—না তো।
—অনুক্ষণ বয়ে বেড়াচ্ছ, নিজে মালিক হয়ে তুমি নিজেই চেনো না? অমনই হয়। যার অসীম ধন থাকে সেই হিসেব রাখে না তার কী আছে আর কী নেই।
গৌতমনারায়ণ প্রথমে স্তন স্পর্শ করলেন, তারপর চুম্বন করলেন, তারও পরে মাতৃস্তনের মতো পান করতে লাগলেন।
আরামে, আবেশে স্তনবৃন্তটিকে গৌতমনারায়ণের মুখের অনেকখানি ভিতর পর্যন্ত ঠেলে দিল ধৃতি।
গৌতমনারায়ণের মনে পড়ে গেল, কোথায় যেন পড়েছিলেন, যে-পুরুষ যখন যে-নারীর স্তনে ঠোঁট রাখে সেই পুরুষ তখন সেই নারীরই।
ধৃতির সারা শরীরে রিকিঝিকি উঠল। এই রিকিঝিকির কথা শুধুমাত্র মেয়েরাই জানে। পৃথিবীর সব মেয়েরাই জানে।