১. শুনতা ক্যা সিং-এর আমদানি

এক

শুনতা ক্যা সিং-এর আমদানি

বছর তিনেক আগে আমার দোস্ত মিটমিটে শয়তান শুনতা ক্যা নিজেই ছিল নোকরির উমেদার। এখন সে ধরাকরা করে বনে গেছে ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুরের খাস আর্দালি। দিনভর নোকরির তল্লাশে এধার ওধার ঘুরে ঘরে ফিরলাম। আচমকাই খেয়াল হল আমার সেই দোস্তের কথা। ভাবলাম তার সঙ্গে মোলাকাত করলে কেমন হয়। শহরে গিয়ে যা নজরে এল তা দেখে তো আমি বেকুব। কোথায় মাটির দালান, খাপরার চাল! বদলে দেখনসই পাকা কোঠা বাড়ি। আর শুনতা ক্যা এখন— উলুঝুলু, আধপেটা আদমি নয় একজন নুর সমেত ইজ্জতদার মুসলমান। আমি যাকে চিনতাম তার সঙ্গে এই আদমির কিছু মিল থাকলেও একে দোস্ত বলতে হলে আমাকে দু’বার ভাবতে হবে। কিছুটা নারাজির সঙ্গে একটা সেলাম ঠুকলাম কিন্তু লাভ হল না। বুঝতেই পারছিলাম না লোকটা শুনতা ক্যা কিনা। একজন আমার ভুল ভাঙিয়ে দিল। আমার এই গোস্তাখির জন্য নিজের কাছেই নিজে মাফ চেয়ে নিয়ে চেষ্টা করলাম যতদূর খাতির দেখানো যায়। জমায়েত হালকা হলে, দোস্তের নজর পড়ল আমার দিকে। এবার সে জানতে চাইল কী হাল আমার। দোস্তের ফুরফুরে মেজাজের হদিশ পেয়ে আমি পালটা জানতে চাইলাম, হা-ঘরে কুনবির ব্যাটা এত দৌলতমন্দ কেমন করে হল? জবাব মিলল, “দোস্ত তুমি তাজ্জব বনে গেছ তাই না! ভাবছ এসব হয়েছে আমার মাহিয়ানা থেকে। আরে! আর্দালির মাসোহারা তো কেবল চার টাকা। নোকরির শর্ত হল হামেহাল ফিটফাট হয়ে হুজুরের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরা। দিনের খোরাকি আছে, বিবির পাকানো রোটি খাওয়ার ফুরসত মেলে না। তা হলে বোঝো চার টাকায় ফিটফাট থেকে, বিবি-বাচ্চাদের দেখভাল করে নিজে খেয়ে কেমন করে চলে?” তার কথা শুনে তো আমি আরও তাজ্জব। যারা ফরিয়াদ চাইতে এসেছে তাদের জন্য কিছু করার এলেম শুনতা-র নেই। আদালতে হুজুরকে মদত করবে সে সওয়ালই ওঠে না। তা হলে আমদানি হচ্ছে কেমন করে?

শুনতা ক্যা ফের বলতে বসল, “বেয়াকুব! তুই এখনও সেয়ানা হলি না। আমদানির হাজারো তরিকা। যত হুঁশিয়ারই মালিক হোক না কেন এসব ঠেকানোর কোনও রাস্তা নেই। আমাদের ঠেকাতে হলে খোদ মালিককেই এই কাজগুলো করতে হয় আর তার ওয়াস্তে কেউ তাকে কোনও অজুরা কবুল করবে না। তার চেয়ে আমরা যে সব কায়দা ইস্তেমাল করি তেমন দু’-চারটে কিস্‌সা শোনাই।”

কোনও হোমরাচোমরা মাতব্বর হয়তো পাঠাল তার কারিন্দা বা মোক্তারকে হুজুরের সঙ্গে মোলাকাতের জন্য। আমরা তাকে ঢুকতে দেব বৈঠকখানা অবধি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে বসেই থাকবে। কেউ তাকে নজরই করবে না। এবার শুরু হবে হুজুরের সঙ্গে মোলাকাতের জন্য তার ঝোলাঝুলি। আমরা আমলই দেব না। আখেরে বেচৈন হয়ে সে কবুল করবে এক টাকা। আমরা ভান করব তেড়িয়া হওয়ার। মুখের উপর বলে দেব— এক টাকায় আবার কিছু হয় নাকি? শেষে বেচারাকে কবুল করতে হবে পাঁচ টাকা। সেটা জেবে পুরে আমি যে হাসিটা হাসব সেটার দামই হবে কয়েকশো রুপিয়া। এবার আমি তাকে বলব, তুমি হলে একজন সাচ্চা অশরফ (ushraf)। মালিকের দর্শনের লায়েক। এবার তুমি বলতেই পার, পাঁচ টাকা আর এমন কী বড় আমদানি। কিন্তু ইয়াদ রেখো এই রকম ছোটখাটো আমদানি চলতেই থাকে।

যে সব দৌলতমন্দ আহেলা মাতব্বরেরা সাহেবান আলিশানের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করতে চায় তারা আমাদের মতো আর্দালিদের সব পরবে বখশিশ কবুল করে। ধরা যাক কোনও এক মাতব্বর বখশিশের মামলায় খুব হুঁশিয়ার হয়ে উঠল অথবা শুরু করল বেয়াদবি করতে। হুজুরের সঙ্গে ফের মোলাকাত করতে এলে তখন সে দেখবে তার সওয়ারি চৌহদ্দির ভিতর এতিমের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৈঠকখানায় ঢোকার পর কেউ তাকে কুর্শিটাও এগিয়ে দেবে না। বেশি ছটফট করলে শুনতে হবে হুজুর ব্যস্ত, মোলাকাতের ফুরসত নেই। মাতব্বর বুঝে যাবে এখন সে নেহাতই হেঁজিপেঁজি। সে দুগুণা বখশিশ কবুল করে রফা করবে। আল্লার কসম খেয়ে বলবে, এইরকম গোস্তাখি তার কখনও আর হবে না।

আমি জানতে চাইলাম, শুনতা ক্যা সিং, ধর এদের মধ্যে কেউ গিয়ে তোমাদের খিলাফ চুকলি কাটল, তখন কী হবে? “কী আবার হবে,” সে জবাব দিল, “চুকলি কাটা এত সস্তা নাকি? কার হিম্মত আছে যে গিয়ে বলবে, হুজুরের নোকরদের বখশিশ দিয়েছে, তা হলে তো সে নিজেও গুনাহগার। বড় জোর সে বলতে পারে, অনেকটা ওয়াক্ত তাকে ইন্তেজার করতে হয়েছে। সে কথা শুনে যদি হুজুরের ইচ্ছে হয় তা হলে তিনি আমাদের তলব করে বলবেন, দেখ লোকেদের যেন বেশি ইন্তেজার করতে না হয়, তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেবে। বহুত খুব, এরপর যে মোলাকাতের জন্য আসবে তাকেই সটান হুজুরের কামরায় দাখিল করে দেওয়া হবে। তা তিনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন। একটা সময়ের পর তিনিও বেদম হয়ে পড়বেন। আমাদের বকাঝকা করবেন, কেন এত বেশি লোক ঢুকে পড়ছে। আমাদের জবাবটা হবে মোলায়েম। সবই তো হুজুরের হুকুম মোতাবেক হচ্ছে। তিনি সমঝে যাবেন আমাদের ঢিট করা এত সহজ নয়। ফলে আমরা আমাদের রাস্তা ধরেই চলতে থাকব।

আবার ধর কোনও থানেদার আমাদের সঙ্গে বেচাল করল; তাকে শায়েস্তা করা খুব সোজা নয়। আমরাও সরাসরি তার পিছনে লাগতে যাব না। ইন্তেজার করব কখন সুযোগ আসে। কোনও একদিন সাহেব হয়তো বিশ্রাম করছেন, শুরু হবে আমাদের নাটক। নিজেদের মধ্যে চলতে থাকবে ফিসফিস, গুজগুজ— থানেদারকে নিয়ে বানিয়ে তোলা নানা কেচ্ছা। কেউ বলবে, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি এসব কথা সঙ্গে জুড়বে আরও নতুন কিছু। আর একজন বলতে বসবে, থানেদারটা মহা নিমকহারাম, ব্যাটার এত হিম্মত যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বাহাদুরকেও কেয়ার করে না। বলে কিনা, আমি যতক্ষণ কাজ করি ততক্ষণ কাউকে পরোয়া করি না। আমাদের এই বাতচিত হুজুর ঠিক শুনবেন আর সময়মতো মিলবে তার ফল। কোনও গোলমেলে মামলায় হুজুরের মনে পড়ে যাবে আমাদের সেই গুলতানি আর বেচারা থানেদার বরখাস্ত— এককথায় ব্যাটার নোকরি গয়া।

দোস্ত কে আদাব জানিয়ে আমি উঠে পড়লাম। ভুললাম না তার কেরামতির জন্য সাবাস জানাতে। ইন্তেজার করতে লাগলাম কবে আমিও হব বড় সাহেবের আর্দালি। তখন না হয় আরও অনেক গায়েবি কথা খোলসা করা যাবে।

১. ওয়াস্তে: জন্য

২. লায়েক: যোগ্য, সাবালক, কৃতবিদ্য

৩. আহেলা: অধিবাসী, নেটিভ অর্থে

৪. আলিশান: খুব বড়ো

১. গায়েবি: অদৃশ্য, রহস্যময়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *