পাওয়ার অফ দ্য সোর্ড – উইলবার স্মিথ / অনুবাদ : মাসুম আহমেদ আদি
শান্ত আর বর্ণহীন মহাসমুদ্রের চারপাশে কেবল কুয়াশা আর কুয়াশা। কিন্তু সকালের প্রথম মৃদু বাতাসের ঘূর্ণি এসে ধাক্কা দিতেই ফুলে ফেঁপে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এই কুয়াশাকুণ্ডুলি। মাটি খুঁজে নিল বাতাসের গতি। সমুদ্রতট থেকে তিন মাইল দূরে কুয়াশাবেষ্টিত ঢেউয়ের মাথায় দুলছে ট্রলার; যেখানে সমুদ্রের গভীরে গাঢ় সবুজ রেখা হয়ে শান্ত উপকূলীয় জলের সাথে মিশে গেছে জীবনদায়ী প্লাঙ্কটন।
হুইল হাউজে খাঁজকাটা কাঠের হুইলের ওপর ঝুঁকে উঁকি দিয়ে বাইরের কুয়াশা দেখছেন লোথার ডি লা রে। উপভোগ করেন এই চনমনে উত্তেজনাময় অপেক্ষার মুহূর্তটা। অনুভব করলেন পরিচিত সেই শিকারের নেশাটা। বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলল শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা। এ এমনই এক নেশা যা হার মানায় মাদকের নেশাকেও।
মনে পড়ে গেল ম্যাগারস্ ফন্টেইন পাহাড়ের ওপর লুকিয়ে থাকার সময় দেখা সেই তুলতুলে গোলাপি ভোরের কথা। ট্রেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কখন অন্ধকার কুঁড়ে এগিয়ে আসবে হাইল্যান্ড পদাতিক বাহিনি। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই আজ এতদিন পরেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
তারপর তো এরকম আরো কতশত ভোর কেটে গেছে যখন খেলেছেন ভয়ংকর সব খেলা; প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ঝাঁকড়া কেশরঅলা কালাহারি সিংহ, মাথায় মস্ত শিংআলা যোদ্ধা ষাঁড়, লম্বা আর মূল্যবান দাঁতের হাতি। এখন খেলাটা সে তুলনায় ছোট হয়ে গেলেও রোমাঞ্চটা ঠিক এই সমুদ্রের মতই বিশাল।
হঠাৎ করে ছেলেটা গ্যালি থেকে খোলা ডেকে বেরিয়ে আসতেই চিন্তার গতি বাধা পেল। বাদামিরঙা, শক্তিশালী লম্বা পা দুটো পুরোপুরি খালি। উচ্চতাতেও পরিণত বয়স্ক পুরুষের সমান হওয়ায় দু’হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে খানিকটা ঝুঁকে হুইল হাউজে ঢুকতে হল।
“চিনি দিয়েছ?” জানতে চাইলেন লোথার।
“চার চামচ পা।” হেসে ফেলল ছেলেটা।
“আজ যেন জাল ভরে মাছ ওঠে।” দুর্ভাগ্যের দেবী তাড়াতে ডান হাতের অঙল ভাজ করে ট্রাউজারের পকেটে ঢোকালেন লোথার। “আসলেই খুব দরকার।” মনে মনে ভাবলেন, “বাঁচতে হলে বেশ ভালো পরিমাণ মাছ পেতে হবে।”
এই বন্য খেলায় আরো একবার মত্ত হয়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে। বিক্রি করে দিয়েছিলেন বহু কষ্টে গড়ে তোলা রোড অ্যান্ড রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। বাজির খাতায় বিকিয়ে দিয়েছেন সর্বস্ব।
তবে ভালোভাবেই জানতেন এই বেনগুয়েলা স্রোতের সবুজ শীতল জলের নিচে লুকিয়ে থাকা সীমাহীন সম্পদের কথা। যার নজির প্রথমবার দেখেছিলেন ঘূণ্য ইংরেজ আর তাদের হাতের পুতুল ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকাতে তার নিজ সেনাবাহিনি প্রধান জ্যান স্মুটের সাথে লড়াইয়ের সেসব ভয়ংকর দিনগুলোতে। পরবর্তীতে ভার্সেইলেসে থাকার সময় প্রচণ্ড পরিশ্রম আর জমানো পুঁজি ও পরিকল্পনার ফসল আজকের এই দিন।
পর্তুগালে খুঁজে পাওয়া সার্ডিন ট্রলারগুলোর গায়ে অযত্ন ও অবহেলার মরচে লেগে ছিল। এখানেই পেয়েছেন দা সিলভাকে। মাঝখানে অবশ্য আরো চারটি পুরনো ট্রলারকে মেরামত করে যন্ত্রপাতি আর হাড়জিরজিরে নাবিকের দলসহ ঘুরে এসেছেন আফ্রিকা মহাদেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চল।
ক্যালিফোর্নিয়াতে খুঁজে পাওয়া ক্যানিং ফ্যাক্টরিটা চালাত এমন এক কোম্পানি, যারা টুনার ঝক দেখে খুশিতে দিশেহারা হয়ে ভুলেই গিয়েছিল যে, সমুদ্রের এই মুরগির বাচ্চাগুলোকে ধরার খরচ কতটা অবিশ্বাস্য হতে পারে। তাই প্রকৃত মূল্যের সামান্য এক ভগ্নাংশ খরচ করে পুরো ফ্যাক্টরিটাকে কিনে নিয়ে জাহাজে করে আফ্রিকাতে তুলে আনতে লোথারকে কোনো কষ্টই করতে হয়নি। পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত তিমি কারখানার পাশের মরুভূমিতে ঠিক-ঠাক করে গড়ে তোলেন পুরো ফ্যাক্টরি। যা আজ ওয়ালবিস বে’ নামে পরিচিত।
প্রথম তিন সিজনে তিনি আর অভিজ্ঞ বুড়ো দা সিলভা মিলে খুঁজে পেয়েছেন মাছের অভয়ারণ্য। অগুণতি সেসব মাছের ঝাঁকের মাধ্যমে শোধ করেছেন সমস্ত দেনা। আর তার প্রায় সাথে সাথেই ভাঙাচোরা পর্তুগিজ ট্রলারগুলোকে বদলে ফেলার জন্য নতুন সব নৌকার অর্ডার দিয়েছেন। ফলে যা হবার তাই হল। শুরুতে যতটুকু ঝুঁকি নিয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লেন লোথার।
আর তার পরে বিদায় নিল মাছের ঝাঁকও। উধাও হয়ে গেল হেরিংয়ের দল। শত শত মাইল সমুদ্র চষে বেড়িয়েও বৃথা গেল সমস্ত চেষ্টা। ক্যানিং ফ্যাক্টরির আর্থিক মূল্য ছাপিয়ে, মরুভূমির দীর্ঘ উপকূল অঞ্চল দিয়ে বেড়াতে গিয়ে নির্মমভাবে কেটে গেল মাসের পর মাস। কেবল জমতে লাগল সুদের বোঝ। ফ্যাক্টরি আর নৌকাগুলোকে বাঁচানোর জন্য তাই অবশেষে পুনরায় ঋণের আবেদন করলেন লোথার।
এভাবেই কেটে গেল আরো দু’বছর। তারপর বলা যায় একরকম নাটকীয়ভাবেই; লোথার নিজেও যখন পরাজয় মেনে নিয়েছেন; সামুদ্রিক জলস্রোত পরিবর্তিত হয়ে গেল। অথবা বাতাসের সাতের দিক বদল হয়, যার ফলে ফিরে এল সব মাছ। সংখ্যায় এত বেশি যেন প্রতিটি ভোরেই গজিয়ে উঠছে নতুন ঘাস।
“আজও যেন তাই হয়।” কুয়াশার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নিঃশব্দে প্রার্থনা করলেন লোথার। আমার প্রার্থনা শোনো, ঈশ্বর! প্লিজ।” আর মাত্র তিনটা মাস প্রয়োজন, তাহলেই সমস্ত ঋণ শোধ করে তিনি আবার মুক্ত হতে পারবেন।
“ওই তো, কেটে যাচ্ছে।” ছেলেটার কথা কানে যেতেই চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়লেন লোথার।
থিয়েটারের পর্দার মত ঘন কুয়াশা সরে যেতেই দেখা গেল অত্যন্ত নাটকীয় আর শ্বাসরুদ্ধকর এক দৃশ্য। সকালের উজ্জ্বলতা আর ধোঁয়া মিলেমিশে শুরু হল আতশবাজির খেলা। একসঙ্গে এত রঙের সম্মিলন যেন কিছুতেই প্রাকৃতিক বলে মনে হচ্ছে না। সমুদ্রের পানি থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠছে কমলা, সোনালি আর সবুজ বর্ণচ্ছটা। রক্তলাল আর গোলাপি আভায় ভরে উঠেছে কুয়াশা। স্রোতের গায়ে শুরু হয়েছে আগুনের নাচন। জাদুকরী এই দৃশ্য দেখে ভারি হয়ে উঠেছে চারপাশের নীরবতা। অসাড় হয়ে গেছে যেন শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয় আর অনুভূতি। চোখ মেলে দুজনেই সবিস্ময়ে দেখল এই অপার্থিব দৃশ্য।
আর ঠিক তখনই উদয় হল সূর্য দেবতা। অত্যন্ত উজ্জ্বল সোনালি আলোয় ধসে পড়ল কুয়াশার ছাদ। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্রোতের রেখা। মেঘরঙা নীল মিশে উপকূলীয় পানি একেবারে তেলের মতই মসৃণ আর শান্তভাবে টলটল করছে। যেখানটাতে সত্যিকারের সামুদ্রিক স্রোতের সাথে মিশে গেছে সেই রেখাটা যা ঠিক একটা ছুরির ফলার মতই সোজা আর তীক্ষ্ণ। এর ওপারে আছে সীমাহীন অন্ধকার, যেন সবুজ এক ভেলভেট।
ফোরডেক থেকে শোনা গেল দা সিলভা’র গলা। দূরের কৃষ্ণকালো পানির দিকে চেয়ে নাচছে, “ওই তো লাফ দিয়েছে।”
পানির মধ্যে লাফিয়ে উঠল একটা মাছ। লম্বায় একটা মানুষের হাতের চেয়ে খানিকটা বড় হবে; চকচকে রূপার ছোট্ট একটা টুকরা। “ইঞ্জিন চালু করো।” উত্তেজনায় কাঁপছে লোথারের গলা। ছেলেটা হাতের কফি মগটাকে ঠাস করে চার্ট-টেবিলের ওপর রেখেই মই বেয়ে নিচের ইঞ্জিনরুমে দৌড় লাগাল। চারপাশে ছিটিয়ে পড়ল শেষ কয়েক ফোঁটা কফি।
একের পর এক সুইচ চালু করে থ্রটল ঠিক করে নিলেন লোথার। নিচে ক্রাংক হ্যাঁন্ডেলের ওপর ঝুঁকে আছে ছেলেটা।
“ঘোরাও।” লোথারের চিৎকার শুনেই চারটা সিলিন্ডারের বিরুদ্ধে সবলে যুদ্ধ করল ছেলেটা। ওর বয়স এখনো তেরো না হলেও ঠিক একজন পুরুষের মতই শক্তিশালী, আর কাজ করার সময় পেছনে ফুলে উঠেছে পেশি।
হালের পাশের এগজস্ট পাইপ দিয়ে প্রথমে খানিকটা তেল চিটচিটে কালো ধোঁয়া বেরোলেও একটু পরেই নিয়মিত ছন্দে চলতে শুরু করল ইঞ্জিন।
পড়িমরি করে মই বেয়ে ডেকে উঠে এল ছেলেটা। দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো দা সিলভার পাশে।
স্রোতের মধ্য দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলল লোথারের ট্রলার। কুয়াশা পুরোপুরি কেটে যাওয়ায় আশপাশের অন্যান্য ট্রলারগুলোকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ সবাই কুয়াশার আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল সূর্যের আশায়। প্রতিটি ট্রলারের রেইলের ধারে দাঁড়িয়ে বকের মত গলা বাড়িয়ে সামনের জল দেখছে নাবিকদের দল। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে তাদের উত্তেজিত গলা।
কাঁচে মোড়া হুইল হাউজে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশ ফুট ট্রলারের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পারছেন লোথার। সম্পন্ন হয়েছে সমস্ত প্রস্তুতি। স্টারবোর্ড রেইলের নিচে পড়ে আছে লম্বা জাল। শুকনো অবস্থাতেই এর ওজন সাড়ে সাত টন। ভিজে গেলে তো আরো কয়েকগুণ ভারি হয়ে যায়। পাঁচশ ফুট লম্বা জালটা পানিতে সত্তর ফুট গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়; ঠিক যেন মিহি তার দিয়ে তৈরি একটা পর্দা। এর পেছনে লোথার পাঁচ হাজার পাউন্ডেরও বেশি খরচ করেছেন, যা সাধারণ একজন জেলের প্রায় বিশ বছরের আয়ের সমান। তার বাকি তিনটি ট্রলারও একই রকম স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতিটি ট্রলারের পেছনে ঝুলছে আঠারো ফুট লম্বা ডিগ্রি, আর বাইরের তক্তা বা ধাতব পাতের একটির অংশ অপর একটির নিচে বিস্তৃত হয়ে থাকে এমনভাবে প্রস্তুত ডিঙ্গি নৌকা।
তীক্ষ্ণ চোখে আরো একবার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে সন্তুষ্ট হলেন লোথার। এরপর সামনে তাকাতেই দেখলেন লাফিয়ে উঠল আরেকটা মাছ। এবার এত কাছে যে মাছটার শরীরের রঙও স্পষ্ট ধরা পড়ল চোখে। তারপর আবার পানিতে আন্দোলন তুলে টুপ করে গভীরে চলে গেল ছোট্ট মাছটা।
যেন এটাই ছিল সেই কাঙিক্ষত সিগন্যাল। সাথে সাথে জীবন্ত হয়ে উঠল পুরো মহাসমুদ্র। গাঢ় হয়ে উঠল পানির রঙ; যেন ভারি মেঘ এসে ঢেকে দিল চারপাশ। তবে এবার মেঘটা এল একেবারে অতল গভীর থেকে। স্রোতের নিচে নড়ে উঠল যেন এক জলদানব।
“এত্ত এত্ত মাছ!” বিবর্ণ আর ভঁজের দাগঅলা বাদামি মুখখানা ঘুরিয়ে লোথারের দিকে তাকাল দা সিলভা। একই সাথে হাত ছড়িয়ে বোঝাতে চাইল মাছের পরিমাণ।
এক মাইল সামনে একেবারে গভীর জল অব্দি থেকে বেরিয়ে এল বিশাল বড় একঝাক। শিকারি হিসেবে এত বছর পেরিয়ে এলেও জীবনে এরকম প্রদর্শনী লোথার আর দেখেননি। এর কাছে আফ্রিকান সূর্যকে গাঢ় পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়া পঙ্গপাল কিংবা কোয়েল পাখির ঝাঁকও কিছুই নয়। মাছের ঝকটা পানির উপরে উঠে আসতেই চারপাশ এতটা সাদা আর তুষারের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে, তীরবেগে ছুটে চলা ট্রলারগুলোর নাবিকেরা পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মত নিশ্চুপ হয়ে গেল।
সবার আগে নড়ে উঠল দা সিলভা। ঠিক একজন তরুণের মতই ঘুরে দাঁড়িয়ে ডেকের ওপর দিয়ে দৌড় দিল। হুইল হাউজের দরজায় দাঁড়িয়ে কেবল বলল, “মারীয়া, ঈশ্বরের মাতাকে ধন্যবাদ দাও যে তারপরেও দিনশেষে আমাদের একটা জাল অবশিষ্ট থাকবে।”
তীক্ষকণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী করেই বুড়ো স্টানের দিকে দৌড় দিল। তারপর গানওয়েলের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ডিঙ্গির ওপর চড়ে বসল। তার দেখাদেখি চঞ্চল হয়ে উঠল বাকি। সবাই যে যার স্থানের উদ্দেশে দৌড় লাগাল।
“ম্যানফ্রেড!” ছেলের উদ্দেশে হাঁক ছাড়লেন লোথার। পিতার ডাক কানে যেতেই পোর কিনার থেকে বাধ্যের মত চলে এল মোহাবিষ্ট ছেলেটা।
“হুইল ধরো।” কম বয়স্ক কারো জন্য এ দায়িত্ব অত্যন্ত বিশাল হলেও ম্যানফ্রেড এর আগেও বহুবার নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করাতে লোথার নিশ্চিন্তে হুইল হাউজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে একের পর এক সিগন্যাল দিয়ে চললেন লোথার। বাবার ইশারা মতই ঝাকের চারপাশে চক্রাকারে ট্রলার নিয়ে ঘুরতে শুরু করল ম্যানফ্রেড।
“বড় বেশি মাছ।” আপন মনে ফিসফিসিয়ে উঠলেন লোথার। দূরত্ব, বাতাস ও স্রোতের গতি আর বুড়ো দা সিলভার সতর্কবার্তাকে মাথায় রেখে দক্ষ চোখে হিসাব কষে বের করলেন : বড়জোর ১৫০ টন আর ভাগ্য ভালো হলে ট্রলার আর জালের ধারণক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ২০০ টন পর্যন্ত মাছ ভোলা যাবে।
অথচ চোখের সামনে পানিতে নাচছে মিলিয়ন মিলিয়ন টন মাছের ঝাঁক। অবিবেচকের মত একটু ভুলচুক হলেই দশ থেকে বিশ হাজার টন মাছের ভারে ছিঁড়ে পড়বে জাল; এমনকি হ্যাঁচকা টানে পুরো ট্রলার উল্টে পড়াও বিচিত্র নয়। আর তাহলে যে শুধু দামি একটা জাল আর ট্রলার হারাবেন তা-ই নয়; ক্রু আর ছেলেকেও হারাবেন।
অবচেতনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখলেন দাঁত বের করে হাসছে ম্যানফ্রেড। উত্তেজনায় চকচক করছে ছেলেটার চেহারা। গাঢ় হলুদাভ বাদামি রঙা চোখ আর উজ্জ্বল দাঁতের সারি দেখে মনে পড়ে গেল ওর মায়ের মুখ। মা ছেলে অবিকল একে অন্যের প্রতিচ্ছবি। কথাটা মনে হতেই তিক্ত মনে কাজে চলে গেলেন লোথার।
তবে খানিকক্ষণের এই অন্যমনস্কতার জন্য আরেকটু হলেই সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল। দ্রুতবেগে ধাবমান ট্রলার যেকোনো মুহূর্তে মাছের ঝাঁকের গায়ে ধাক্কা দেবে। আর ছোট্ট প্রাণীগুলোও এমন অদ্ভুতভাবে জোট বেঁধে আছে যেন একক সত্তা। ট্রলারের শব্দে একবার যদি গভীর সমুদ্রে উধাও হয়ে যায় তাহলেই কাজ সারা। তাড়াতাড়ি মোড় ঘোরানোর জন্য তীব্রভাবে ইশারা দিতেই দায়িত্ব পালন করল ম্যানফ্রেড। প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরত্বে সরে এসে সুযোগের অপেক্ষায় স্থির হল নৌকা।
চারপাশে দ্রুত একবার নজর বোলাতেই বুঝতে পারলেন বাকি ট্রলারগুলোর ক্যাপ্টেনদেরও একই অবস্থা। সোয়ার্ট হেনড্রিকের সাথে চোখাচোখি হল। বিশাল আর কালো মদ্দা ষাড়ের মত মানুষটার টাক মাথায় সূর্যের আলো পড়ে কামানের গোলার মত চকচক করছে। যুদ্ধ আর শত শত বেপরোয়া অভিযানের সঙ্গী সোয়ার্ট, লোথারের মতই স্থল থেকে জলে স্থানান্তরিত হয়ে দক্ষ এক জেলেতে পরিণত হয়েছেন। হাত দিয়ে ইশারা করে “সাবধান” আর “বিপদ” শব্দ দুটো দেখিয়ে দিলেন লোথার। নিঃশব্দে হাসি দিয়ে সম্মতিসূচকভাবে হাত নাড়লেন সোয়াট।
নর্তকীদের মতই সাবলীল তালে ঋকের চারপাশে ঘুরছে চারটা নৌকা। কুয়াশার শেষ আঁচড়টুকুও মিলিয়ে দিয়ে দিগন্তে উঠে গেল সূর্য।
কিন্তু এখনো একটুও আলগা হয়নি মাছের ঝাঁক। আস্তে আস্তে অধৈর্য হয়ে উঠছেন লোথার। সচরাচর যেটুকু থাকেন তার চেয়েও প্রায় এক ঘণ্টা বেশি সময় ধরে চক্কর কাটছেন। যেকোনো মুহূর্তে হয়ত মাছগুলো আবার হাওয়া হয়ে যাবে। অথচ একটা নৌকা থেকেও জাল ছোঁড়া হয়নি। সম্পদের খনি পেয়েও যেন কিছুতেই ছুঁতে পারছেন না। মরিয়া হয়ে উঠলেন লোথার, এমনিতে বহুক্ষণ কেটে গেছে।
“ধুত্তোরি, যা হবার হবে।” ম্যানফ্রেডকে আরো কাছে যাবার ইশারা দিলেন। কিন্তু বোকামিটা করার সাথে সাথে কানে এল দা সিলভার হুইসেল। বুড়ো পর্তুগিজের দিকে তাকাতেই দেখা গেল উন্মাদের মত হাত নাড়ছে। তাদের পেছনে ফুলে উঠেছে মাছের ঝাঁক। গোলাকার ঝকটা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। এতক্ষণ এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল সকলে।
“ম্যানফ্রেড!” তীব্র গর্জন করেই ডান হাতটাকে উইন্ডমিলের মত ঘোরাতে লাগলেন লোথার। ছেলেটাও হুইল ঘুরিয়ে দিতেই তরতর করে এগিয়ে চলল নৌকা। জল্লাদের তলোয়ারের ফলার মত ঝাঁকের মধ্যে ঢুকে গেল ট্রলারের মাথা।
“গতি কমাও!” লোথার হাতের ঝাঁপটা দিতেই থেমে গেল নৌকা। নিচের পানি এত স্বচ্ছ যে প্রায় প্রতিটি মাছকে আলাদাভাবে দেখা যাচ্ছে।
লোথার আর ম্যানফ্রেড মিলে ট্রলারের বো’ এত সাবধানে ঝাঁকের মাঝে নিয়ে গেলেন যেন প্রপেলারও তেমন না নড়ে। নচেৎ আতঙ্কিত হয়ে ফিরে যাবে মাছের ঝক। বাবার ইশারামত কাজ করল ম্যানফ্রেড। ঝাঁকের ছোট একটা অংশ আলাদাও হয়ে গেল।
“কিন্তু এখনো বেশি!” বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই শোনালেন লোথার। ঝাঁকের যে অংশটা আলাদা করা গেছে সেটা আকারে ক্ষুদ্র হলেও প্রায় হাজার টন মাছ আছে, অথবা এর চেয়েও বেশি। কারণ গভীরে কতটা আছে তা তো বোঝা যাচ্ছে না।
ঝুঁকিটা তাই একটু বেশিই হয়ে যাবে। চোখের কোনা দিয়ে দা সিলভার বিক্ষুব্ধ ইশারা দেখল, আর এবার তো উদ্বেগে হুইসেল দিয়ে ফেলল। এত মাছ দেখে ভড়কে গেছে বুড়োটা। হেসে ফেললেন লোথার। হলুদ চোখ দুটোকে সরু করে ম্যানফ্রেডকে জাল ছোঁড়ার স্পিড দিতে ইশারা করেই, ইচ্ছে করে বুড়োর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন লোথার।
গতি পাঁচ নটে উঠতেই ম্যানফ্রেডকে দিয়ে সজোরে নৌকাটা ঘুরিয়ে আনলেন। ঝাঁকের মাছগুলোকে চক্রের মধ্যেই থাকতে বাধ্য করলেন। তারপর দ্বিতীয়বার চক্কর দেয়ার সময় ট্রলারের স্টার্নের কাছে গিয়ে হাত গোল করে মুখের উপর রেখে চিৎকার করে বললেন, “লুস! জাল ছুঁড়ে মারো!”
স্টার্নে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ হেরেরো নাবিক ডিঙ্গির দড়ি আটকে রাখা পিচ্ছিল গিঁটের গায়ে কয়েকবার আঘাত করেই নৌকার কিনার দিয়ে ছুঁড়ে মারল। ছোট্ট কাঠের ডিঙ্গি ক্যাচকোচ করে সশব্দে পেছন দিকে আছড়ে পড়ে স্রোতের ফেনায় আগু-পিছু দুলতে লাগল। সাথে করে টেনে নিয়ে গেল ভারি বাদামি রঙা জাল।
ঝাঁকের চারপাশে ঘুরছে ট্রলার। আর কাঠের রেইলের উপর দিয়ে ঘষা খেয়ে হিসহিস শব্দে পানিতে নেমে যাচ্ছে মোটা ফাঁকলা জাল। পাইথনের মতই কুপুলি খুলে তরতর করে নেমে যাচ্ছে কর্ক লাইন, যা কিনা ডিঙ্গি আর ট্রলারকে মায়ের গর্ভে থাকা প্রাণের নালীর মত জুড়ে রেখেছে। পুরো ঝাকটার চারপাশে সমানভাবে বিছিয়ে গেছে জাল। এখন কেবল দা সিলভা আর তার ডিঙ্গি নিয়ে যত চিন্তা।
বিশাল জালটার ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য হুইল নিয়ে কাজ করছে ম্যানফ্রেড। একটু পরে থ্রটল বন্ধ করে দিল। কাঁধে তিন ইঞ্চি ভারি ম্যানিলা লাইনের শেষপ্রান্ত নিয়ে ট্রলারের সাইড বেয়ে উপরে উঠে এল দা সিলভা।
লোথারকে দেখেই গর্জন করে জানাল, “জালটাকে হারাবে, আর কিছু না। কেবল কোনো পাগলই পারে এমন মাছের ভেতর জাল ফেলতে। সাধু আন্তনী আর সাধু মার্কের সাক্ষী মেনে বলছি, হতচ্ছাড়াগুলো জাল নিয়ে ভাগবে, দেখো।” কিন্তু লোথারের নির্দেশ পেয়ে ততক্ষণে জাল উপরে তোলার কাজ শুরু করে দিয়েছে হেরেরো নাবিকের দল।
“জালও আমার আর মাছও আমার।” বিকট শব্দে কপিকল চালু করে দিলেন লোথার, “বুকি হুকে লাগাও!”
পরিষ্কার সবুজাভ পানির সত্তর ফুট গভীরে ঝুলে আছে জাল। কিন্তু তলদেশ এখনো ভোলা। তাই সবচেয়ে প্রথম আর জরুরি কাজটা হল মাছের ঝাঁক পালাবার পথ পাবার আগেই জালটাকে বন্ধ করে ফেলতে হবে। কপিকল ঘুরিয়ে একের পর এক পার্স লাইন টেনে আনতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রমে ফুলে উঠেছে লোথারের নগ্ন বাহুর পেশি আর প্রতিটি গিট। জালের তলদেশের স্টিল রিংয়ের ভেতরে থাকা পার্স লাইন আস্তে আস্তে মুখটাকে বন্ধ করে ফেলছে। ঠিক যেন চোয়াল দুটো এক করে ফেলছে কোনো দানবের মুখ।
অন্যদিকে হুইল হাউজে খুব সাবধানে ফরোয়ার্ড আর রিভার্সের মাধ্যমে ট্রলারের স্টার্নকে জালের পাশ থেকে সরিয়ে আনছে ম্যানফ্রেড। অবশেষে সবটুকু পার্স লাইন কপিকলে জড়িয়ে ফেললেন লোথার। নৌকার পাশ দিয়ে উঠে এল চকচকে স্টিল রিংয়ের গোছা। জালের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাগে উঠে এসেছে পুরো ঝাঁক।
গাল বেয়ে দরদর করে ঝরে পড়ছে ঘাম; ভিজে গেছে গায়ের শার্ট। গানওয়েলের পাশে হেলান দিয়ে বসলেন ক্লান্ত লোথার। এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন যে কথা বলার শক্তিও পাচ্ছেন না। কপাল আর চোখের ওপর লেপ্টে আছে ঘামে ভেজা রুপালি-সাদা চুল। হঠাৎ করে দা সিলভার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন।
শীতল সবুজ বেনশুয়েলা স্রোতের ওপর পরিষ্কার একটা গোলাকার চক্র হয়ে ঘুরছে কর্ক লাইন। কিন্তু একটু জিরোবার আশায় বসতেই লোখারের চোখে পড়ল-নড়ে উঠেছে কর্ক লাইন। আকারেরও পরিবর্তন হচ্ছে। তার মানে এতক্ষণে জালের অস্তিত্ব টের পেয়েছে মাছের ঝাঁক। তাই ছাড়া পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভাসমান আগাছার মত দুলে উঠল পুরো জাল আর সাথে থাকা ডিঙ্গি।
ঠিক যেন লেভিয়াথানের শক্তি এসে ভর করেছে পুরো ঋকের ওপর।
“ওহ, খোদা, যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি মাছ উঠেছে।” হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালেন লোথার। চোখের ওপর থেকে ঘামে ভেজা চুল সরিয়েই দৌড় দিলেন দা সিলভার কাছে।
জালের ভেতর ছোটাছুটি করে পুরো ঝাঁক। পানির ঘূর্ণির ভেতর মোচার মত দুলছে ডিঙ্গি। ভারি লাইনে হ্যাঁচকা টান লাগাতে লোখারের পায়ের নিচে কেঁপে উঠল ট্রলারের ডেক।
“দা সিলভা ঠিকই বলেছিল। মাছগুলো উন্মাদ হয়ে গেছে।” ফিসফিসিয়ে নিজেকে শুনিয়েই ফ্যাহর্নের হ্যাঁন্ডেল ধরতে ছুটলেন লোথার। তীক্ষ্ণ সরে তিনবার বেল বাজালের সাহায্যের আশায়। তারপর আবার ডেকে দৌড়ে আসতে আসতে দেখলেন যে এরই মাঝে নাক ঘুরিয়ে এদিকে ছুটে আসছে। বাকি তিনটা নৌকা। এত বিশাল বড় ঝাক দেখে কেউই এখনো নিজেদের জাল ফেলতে সাহস করেনি।
“তাড়াতাড়ি! আরো জোরে আয় বাবারা!” অনর্থক ঘোঁতঘোঁত করে উঠলেন লোথার। তারপর নিজের ক্রুদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, “যে যেখানে আছো, দৌড়ে আসো, জাল ধরতে হবে।”
কিন্তু নাবিকদের চেহারা দেখে বোঝা গেল যে সবাই দ্বিধা করছে। জালে কেউ হাত লাগাতে চায় না।
“হা করে কী দেখছো, হাত লাগাও পাজির দল!” সবাইকে চিৎকার করে লোথার নিজে গানওয়েলের উদ্দেশে লাফ দিলেন। সবাই মিলে ঝাঁকটাকে চেপে ধরতে হবে। যেন ছোট্ট মাছগুলো নড়াচড়া করার শক্তি না পায়।
জালটা কাঁটাতারের মত ধারালো হলেও নাবিকেরা এক সারিতে বসে হালের সাথে আস্তে আস্তে পেঁচাতে লাগল। তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কয়েক ফুট গুটিয়ে এল।
কিন্তু মাছের ঝাঁক আবার ঢেউয়ের মত দুলে উঠতেই পিছলে গেল সবটুকু জাল। হেরেরো নাবিকদের একজন আবার চট করে ছেড়ে না দেয়ায় জালের ফাঁকে ডান হাত আটকে গেল। সাথে সাথে আঙুল থেকে মাংস খসে বেরিয়ে পড়ল কাঁচা মাংস আর সাদা হাড়। চিৎকার করে অসাড় হাতটাকে বুকের কাছে চেপে ধরল হতভাগা নাবিক। ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছে তাজা রক্ত।
“ম্যানফ্রেড!” চিৎকার করে উঠলেন লোথার, “ওকে সাহায্য করো!” তারপর আবার জালের দিকে মনোযোগ দিলেন। বাকের ছোট্ট একটা অংশ জালের ওপর দিয়ে লাফিয়ে গাঢ় সবুজ ধোয়ার মত পড়ল স্বচ্ছ পানির ভেতর।
“যাক, খানিকটা কমল!” বিড়বিড় করে উঠলেন লোথার। কিন্তু এর প্রায় সাথে সাথে জালে বন্দি পুরো ঝাক নিচের দিকে গোত্তা খাওয়াতে ভয়ংকরভাবে নড়ে উঠল ভারি পঞ্চাশ ফুট ট্রলার। নাবিকেরা হ্যান্ডহোল্ড আঁকড়ে ধরলেও ভয়ে সাদা হয়ে গেল সবার কালো মুখ।
গানওয়েল দিয়ে উপরে উঠে এল সবুজ পানি। ভেসে গেল ডেক।
“লাফ দাও!” বুড়ো সিলভার দিকে তাকিয়ে কিড়মিড় করে চিৎকার করে উঠলেন লোথার। “জালের কাছ থেকে সরো!” দুজনেই বিপদ টের পেয়েছেন।
আগের সিজনে নাবিকদের একজন জালের ভেতরে পড়ে গিয়েছিল। মাছের ঝাঁক সাথে সাথে লোকটাকে টেনে একেবারে নিচে নিয়ে যায়। তারপর অবশেষে যখন কয়েক ঘণ্টা পরে জালের তলা থেকে মৃতদেহটাকে উদ্ধার করা হয়, দেখা গেল যে পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে লোকটার শরীরের প্রত্যেকটা খোলা অংশ দিয়ে ঢুকে পড়েছে মাছ। মুখ দিয়ে পেটে; রুপালি ছোরা হয়ে চোখের ভেতরের বল ছিঁড়ে সিধে মগজে। এমনকি মলদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় পেট ভর্তি মরা মাছ নিয়ে ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল বেচারা। দৃশ্যটা এতটাই নির্মম আর করুণ যে কেউ কখনোই ভুলতে পারবে না।
“জলদি সরে এসো জাল থেকে।” লোথারের চিৎকার শুনেই ডুবন্ত ডিঙ্গির একেবারে এক কিনারে চলে গেল দা সিলভা; তার প্রায় সাথে সাথে পানিতে ডুবে গেল কাঠের ডিঙি। ভারি সি-বুট নিচের দিকে টেনে ধরায় উন্মাদের মত হাত-পা নাড়ছে দা সিলভা।
ঠিক এমন সময় ত্রাণকর্তার মত এগিয়ে এলেন সোয়ার্ট হেনড্রিক। কর্ক লাইনের পাশে নিজের ট্রলার নিয়ে আসায় তার দু’জন ক্রু মিলে বুড়ো সিলভাকে টেনে তুলল। আর বাকি নাবিকরা সোয়ার্টের নির্দেশমত রেইলের কাছে জড়ো হয়ে জালের বাকি অংশকে হুকে আটকে ফেলল।
“ওহ, জালটা যেন টিকে থাকে।” লোথার আকুতি জানাতেই ততক্ষণে বাকি দুটো নৌকাও চলে এল। বন্দি ঝাকের চারপাশে ঘুরছে চারটি নৌকা। নাবিকদের সবাই মিলে এবার জাল টানার কাজে হাত লাগাল।
এক ফুট এক ফুট করে উঠে এল জাল। প্রতিটি ট্রলারে বারো জন করে ক্রু; এমনকি পিতার জায়গায় এসে ম্যানফ্রেডও দাঁড়িয়ে গেল। পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত নাবিকদের হাত কেটে বেরিয়ে গেল তাজা রক্ত; কিন্তু ধীরে ধীরে প্রতিবারে এক ইঞ্চি করে করে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল পুরো ঝাক।
“ভেতরে নেয়ার জাল নিয়ে এসো!” লোথার চিৎকার করে উঠতেই প্রতিটি ট্রলারে তিনজন করে নাবিক হুইল হাউজের ওপর থেকে লম্বা হাতলঅলা ডিপ নেট নিয়ে নিচের ডেকে চলে এল।
ডিপ নেট দেখতে পুরোপুরি বাটারফ্লাই নেট কিংবা সেসব ছোট ছোট হাত জালের মত; যেগুলো দিয়ে সমুদ্রের পাশের পাথুরে পুল থেকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা চিংড়ি কিংবা কাঁকড়া ধরে। যাই হোক, নাবিকদের জালগুলোর হ্যাঁন্ডেল ত্রিশ ফুট লম্বা। আর প্রতিবারে একটন পর্যন্ত জীবন্ত মাছ তুলে নিতে পারে। জালের মুখের স্টিলের রিংয়ের তিনপাশে ম্যানিলা লাইন লাগানো আছে। কপিকলের সাহায্যে উঠা-নামা করা যায়।
ডিপ নেটগুলো জায়গামত বসানোর পরপরই লোথার আর ম্যানফ্রেড মিলে কার্গো হোন্ডের হ্যাঁচ কিংবা ঢাকনা খুলে দিল। তারপর আবার যার যার জায়গায় ফিরে গেল। লোথার গেলেন কপিকলের কাছে আর ম্যানফ্রেড পার্স লাইনের কাছে।
লোথার কপিকলের সাহায্যে ডিপ নেটকে উপরে তুলে রুপালি মাছের ঝকে ছুঁড়ে মারলেন। তিনজন নাবিক মিলে নিজেদের সমস্ত ওজন দিয়ে চেপে ধরল জালের হ্যাঁন্ডেল। “উঠে আয়!” দাঁত কিড়মিড় করে কপিকলের ফরোয়ার্ড গিয়ার টানলেন লোথার। ঝাঁকের মাছ তুলে উপরে উঠে এল ডিপ-নেট। সাথে নিয়ে এল এক টন জীবন্ত মাছ। পাসলাইন ধরে হোন্ডের হাঁ করা মুখের উপর জালটাকে নিয়ে এল ম্যানফ্রেড।
“ঢেলে দাও!” ছেলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন লোথার। পার্স লাইন ছেড়ে দিল ম্যানফ্রেড। জালের তলদেশ খুলে যেতেই ভোলা হোন্ডে ঝরে পড়ল সবটুকু মাছ। ঘষা খাওয়ায় মাছের গা থেকে খসে পড়ল ছোট ছোট আঁশ। ডেকে থাকা নাবিকদের ওপর যেন গোলাপি আর সোনালি তুষার কনা ঝরে পড়ল।
জাল খালি হয়ে যেতেই ম্যানফ্রেড পার্স লাইন বন্ধ করে দিল। কপিকল রিভার্স করে পুরো প্রক্রিয়াটা আবার শুরু হল দ্বিতীয় স্তূপ মাছ টেনে আনার জন্য। বাকি তিনটি ট্রলারেও কপিকল আর ডিপ-নেট নিয়ে নাবিকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রতি কয়েক সেকেন্ডে টন ওজনের মাছ হোল্ডে ঢোকানো হল। আর এর পাশাপাশি সৃষ্টি হল স্বচ্ছ আঁশের বৃষ্টি।
একঘেয়ে কাজটা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য আর প্রতিবার মাথার ওপর জাল উঠলেই সমুদ্রের ঠাণ্ডা জলে ভিজে নেয়ে উঠছে নাবিকের দল। তাই মাঝে মাঝেই ক্রুদের স্থান পরিবর্তন করাচ্ছেন নৌকার ক্যাপ্টেনগণ। যদিও লোথার নিজে এখনো কপিকল থেকে এক চুলও নড়েননি। লম্বা, ক্লান্তিহীন আর সদা সতর্ক লোথারের সাদা সোনালি চুলে আটকে গেছে মাছের আঁশ; সূর্যের আলোয় ঠিক আগুনের মতই চকচক করছে।
“সিলভার থ্রি পেনিস।” নিজের চারটি ট্রলারের হোল্ড ভর্তি মৎসবৃষ্টি দেখে আপন মনেই হাসলেন। “আজ ডেক ভর্তি টিকি (Tickey) নিয়ে যাবো।” টিকি হল নাবিকদের মাঝে প্রচলিত থ্রি পেনির পরিবর্তিত স্ল্যাং।
“ডেকলোড।” খালি হয়ে আসা মেইন জালের কাছে কপিকল নিয়ে ব্যস্ত সোয়ার্ট হেনড্রিকের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন লোথার। পালিশ করা আবলুস কাঠের মতই চকচক করছে সোয়াটের কোমর পর্যন্ত উদোম শরীর।
“ডেকলোড!” পাল্টা চিৎকার করে নিজ আনন্দ প্রকাশ করলেন সোয়ার্ট। প্রতিটি ট্রলারের হোন্ডে দেড়শ’ টন করে মাছ তোলা হয়েছে। এখন তারা ডেকলোড করবেন।
আবারো একটা বড় ঝুঁকি নিতে চলেছেন লোথার, একবার লোড করা হয়ে গেলে বন্দরে ফিরে ফ্যাক্টরিতে মাছ পাম্প করে বের না করা পর্যন্ত নৌকা আর খালি হবার উপায় নেই। কিন্তু ডেকলোডিং করা হলে আরো একশ’ টন ওজনের মাছ ভোলা হবে। যা নিরাপদে বহনযোগ্য ওজনের সীমা ছাড়িয়ে যাবে। আর যদি এর ভেতরে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়, তাহলে এক ধাক্কায় অতিরিক্ত ভার বহনকারী ট্রলারকে শীতল সবুজ গহীনে নিয়ে যাবে সমুদ্রের দৈত্য।
“আবহাওয়া নিশ্চয় এরকমই ভালো থাকবে।” কপিকল নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে নিজেকেই যেন আশ্বস্ত করলেন লোথার। অসম্ভব ভয়ংকর এক ঝুঁকি নিয়ে এক হাজার টন মাছ তুলেছেন। একবার জাল ছুঁড়েই পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড লাভ। জীবনে এতটা সৌভাগ্যের দেখা কখনো পাননি। জাল-নৌকা কিংবা নিজের জীবনও হারাতে পারতেন, কিন্তু না; এবারে সব দেনা শোধ করতে পারবেন।
“ঈশ্বরের দিব্যি, এখন আমার সাথে আর খারাপ কিছু ঘটবে না। এবারে পুরো মুক্ত হয়ে যাবো।”
চারটি ট্রলারের উপরেই চক্কর কাটছে সাদা মেঘের মত একঝাক সী বার্ডস। পার্স লাইন দিয়ে জালের ভেতর ঢুকে রাক্ষসের মত মাছ খেতে শুরু করল পাখির দল। শেষে এমন অবস্থা যে উড়ে যাবারও সাধ্য নেই। ফোলা পেট নিয়ে কোনোমতে স্রোতের তোড়ে ভেসে গেল। অন্যদিকে হাতে ধারালো লোথার আংটাযুক্ত দণ্ড নিয়ে প্রতিটি ট্রলারের বো আর স্টার্নে দাঁড়িয়ে আছে একজন করে নাবিক। কারণ একটু পরপর আঘাত করে বড় বড় সব হাঙর তাড়াতে হচ্ছে। জালে আটকা পড়া মাছের ঝাক খাবার নেশায় আগত হাঙরগুলোর ত্রি-কোণাকার ছুরির মত তীক্ষ্ণ লম্বা দাঁতগুলো শক্ত জালও কেটে ফেলতে ওস্তাদ।
অন্যদিকে মাছের ভারে আস্তে আস্তে পানিতে ডুবে যাচ্ছে প্রতিটি ট্রলারের শরীর। অবশেষে দুপুরের একটু পরে লোথার নিজেই থামার নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন। আর একটা মাছও তোলার জায়গা নেই। বরঞ্চ নৌকার পাশ দিয়ে পড়ে হাঙরের পেটে যাচ্ছে।
কপিকলের সুইচ বন্ধ করে দিলেন লোথার। মেইন জালে এখনো না হলেও আরো একশ’ টন মাছ ঝুলছে। “জাল খালি করে ফেলল।” আদেশ দিলেন লোথার। “মাছ ফেলে জাল নৌকায় তুলে আনো।”
অতিরিক্ত ভারে পানিতে প্রায় ডুবুডুবু হয়ে এক সারিতে বাড়ির পথ ধরল চারটা ট্রলার। সবার আগে পথ দেখাচ্ছে লোখারের নৌকা।
পেছনে প্রায় এক মাইল পর্যন্ত সমুদ্রে কার্পেটের মত বিছিয়ে রইল মরা মাছ। রুপালি পেট উপরে দিয়ে এমনভাবে ভাসছে যেন অরণ্যের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বসন্তের ঝরা পাতা। ঠিক তার উপরেই হাজার হাজার পরিতৃপ্ত সি-গাল আর মহা ভোজে ব্যস্ত বড় বড় হাঙর।
পরিশ্রমে নিঃশেষিত নাবিকের দল ডেকের ওপর এখনো তড়পাতে থাকা মাছের ঝাঁকের ওপর দিয়ে কোনোমতে নিজেদেরকে টানতে টানতে নিচের ডেকে নিয়ে গেল। মাছের আঁশ আর সমুদ্রের জলে স্নাত শরীর নিয়েই ছোট্ট বাঙ্কের ওপর গড়িয়ে পড়ল সবাই।
অন্যদিকে হুইল হাউজে পরপর দু’মগ গরম কফি খেয়ে মাথার উপরের ক্রনোমিটার চেক করলেন লোথার।
“ফ্যাক্টরিতে ফিরতে আরো চার ঘন্টা লাগবে। আমাদের পড়ার সময় হয়েছে এখন।”
“ওহ, পা!” আকুতি জানাল ছেলেটা, “আজ নয়। আজ একটা বিশেষ দিন। না পড়লে হয় না?”
ওয়ালবিস বে’তে কোনো বিদ্যালয় নেই। সবচেয়ে কাছের সোয়াকোপমুণ্ডের জার্মান স্কুলটাও ত্রিশ কি.মি. দূরে। জন্মের পর থেকে লোথারই ছেলেটার বাবা আর মা। রক্ত আর জলে ভেজা ছোট্ট শরীরটার দিকে মা তাকিয়ে দেখেনি। নার্সের দুধ ব্যতীত একা হাতেই ছেলেটাকে লালন-পালন করেছেন লোথার। তাই দুজনের আত্মিক বন্ধন এতটাই বেশি যে, একদিনের জন্য ওকে ছাড়া থাকতে পারবেন না। দূরে না পাঠিয়ে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থাও তাই তাকেই করতে হয়েছে।
“কোনোদিনই এতটা বিশেষ নয়।” ম্যানফ্রেডকে বললেন “প্রতিটি দিনই আমাদেরকে কিছু না কিছু শিখতে হবে। কেবলমাত্র পেশি থাকলেই কেউ শক্তিশালী হয় না। নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, “এটাই একজন মানুষকে শক্তিশালী করে তোলে। যাও, বই নিয়ে এসো!”
সাহায্যের আশায় দা সিলভার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকাল ম্যানফ্রেড, কিন্তু জানে তর্ক করে লাভ নেই।
“হুইল ধরো” বুড়ো মাঝিকে হুইল ধরিয়ে দিয়ে ছোট্ট চার্ট টেবিলে ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন লোথার। “আজ গণিত নয়; ইংরেজি পড়ব।”
“আমার ইংরেজি একটুও ভালো লাগে না!” বিতৃষ্ণা নিয়ে ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড, “ইংরেজি আর ইংরেজ দু’টোকেই ঘৃণা করি।”
মাথা নাড়লেন লোথার। “হ্যা” একমত হয়ে বললেন, “ইংরেজরা আমাদের শত্রু। সবসময় তাই ছিল আর ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এই কারণেই তাদের অস্ত্র দিয়ে নিজেদেরকে বলীয়ান করতে হবে। এ কারণেই ভাষাটা শিখতে হবে, যখন সময় আসবে তখন যেন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এর সদ্ব্যবহার করা যায়।”
সারা দিনের মাঝে এই প্রথমবার ইংরেজিতে কথা বললেন লোথার। ম্যানফ্রেড আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিতে গেলেও হাত তুলে থামালেন লোথার।
“ইংরেজি।” তিরস্কারের সুরে ছেলেকে বললেন, “শুধু ইংরেজি বলো।”
পরবর্তী চার ঘণ্টায় পিতা-পুত্র মিলে শেষ করল বাইবেলের কিং জেমস অংশ আর কেপ টাইমস পত্রিকার দু’মাসের পুরনো একটা কপি। এরপর এক পাতা শ্রুতিলিপি লিখতে দিলেন লোথার। অপরিচিত এই ভাষা নিয়ে খাটতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়ল অস্থির ম্যানফ্রেড। শেষপর্যন্ত অধৈর্য হয়ে বলে উঠল,
“আমাকে দাদা আর শপথ সম্পর্কে বলো পা!” আহ্লাদী সুরে বাবার কাছে জানতে চাইল ছেলেটা।
হেসে ফেললেন লোথার, “দিনে দিনে তুই একটা বান্দর হচ্ছিস, তাই না? মাথায় শুধু কাজ ফাঁকি দেয়ার চিন্তা।”
“প্লিজ, পা”
“এ গল্প তো আগেও করেছি।”
“আবার বলো! আজ তো একটা বিশেষ দিন।”
হুইল হাউজের জানালা দিয়ে বহু মূল্যবান রুপালি কার্গোর দিকে তাকালেন লোথার। ছেলেটা ঠিকই বলেছে। আজ সত্যিই একটা বিশেষ দিন। গত পাঁচ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি মিলবে অবশেষে।
“ঠিক আছে” মাথা নেড়ে বললেন, “আবারো বলব ঠিকই, কিন্তু ইংরেজিতে।” ঠাস করে এক্সারসাইজ কপি বন্ধ করে টেবিলের ওপাশ থেকে ঝুঁকে এল ম্যানফ্রেড। আগ্রহে চকচক করছে স্বচ্ছ হলুদাভ বাদামি দু’খানা চোখ।
“তো শোন” শুরু করলেন লোথার, “বিশ্বাসঘাতক ইংরেজ রাজা পঞ্চম জর্জ যখন ১৯১৪ সালে জার্মানির কাইজার উইলহেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল তখন তোমার দাদু আর আমি নিজেদের দায়িত্ব ঠিকই বুঝতে পারলাম। তারপর তোমার দাদিমাকে চুমু খেয়ে বিদায় জানিয়ে-”।
“দাদিমার চুলের রঙ কী ছিল?” জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“তোমার দাদিমা ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী একজন অভিজাত জার্মান নারী আর সূর্যের আলোয় তার চুল দেখাত ঠিক পাকা গমেরই মতন।
“ঠিক আমার মতন।” বাবাকে শুধরে দিল ম্যানফ্রেড।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তোমার মতন” হেসে ফেললেন লোথার। “তারপর তোমার দাদু আর আমি মিলে ঘোড়ায় চেপে বসলাম অরেঞ্জ নদী তীরের উদ্দেশে; যেখানে বুড়ো জেনারেল মারিটজ আর তার ছয়শ’ বীরের সাথে যোগ দিয়ে ছুটলাম বিশ্বাসঘাতক জ্যানি মুটের খবর নেয়ার জন্য।”
“বলো পা, তাড়াতাড়ি বলো।” তাগাদা দিল ম্যানফ্রেড।
এরপর কামানের গোলা আর মেশিনগানের গুলিতে বিদ্রোহীদেরকে ঝাঁঝরা করে দেয় জ্যানি স্মুটের বাহিনি। লোথারের মুখে প্রথম যুদ্ধের সেই কাহিনি শুনে বেদনার মেঘ এসে ভর করল ম্যানফ্রেডের জোড়া চোখে।
“কিন্তু তোমরাও খুব লড়েছিলে তাইনা, পা?”
“পাগলের মত যুদ্ধ করেছি। কিন্তু ওরা সংখ্যায় বেশি ছিল আর ওদের কাছে বড় বড় কামান, মেশিনগান এসবও ছিল। তারপর তোমার দাদু পাকস্থলীতে গুলি খাওয়ার সাথে সাথে আমার ঘোড়ায় চড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উনাকে সরিয়ে নিয়ে গেছি।” সে কথা শুনে কান্নায় চকচক করে উঠল ছেলেটার চোখ।
“তারপর যখন মৃত্যু কাছে চলে এল, তোমার দাদু বালিশ হিসেবে ব্যবহার করা চামড়ার ব্যাগ থেকে পুরনো কালো বাইবেলটা বের করে আমাকে দিয়ে শপথ করালেন।”
“আমি জানি এই শপথ।” বাবাকে বাধা দিল ম্যানফ্রেড। “দাঁড়াও বলছি।”
“হুম, বলো তো দেখি?” লোথারও মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
“দাদু বলেছে : “এই বইয়ের উপর হাত রেখে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করো মাই সান, প্রতিজ্ঞা করো যে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ কখনো শেষ হবে না।”
“হ্যাঁ।” মাথা নেড়ে লোথার জানালেন, “ঠিক তাই। মৃত্যুশয্যায় বাবার কাছে আমি এই শপথ করেছি।” হাত বাড়িয়ে ছেলেকে ধরলেন।
পিতা-পুত্রের আবেগঘন এই মুহূর্তে হানা দিল বুড়ো দা সিলভা। কাশি দিয়ে গলা বাড়িয়ে হুইল হাউজের জানালা দিয়ে বাইরে থুথু ফেলল।
“তোমার লজ্জা হওয়া উচিত ছেলেটার মাথায় মৃত্যু আর ঘৃণার কথা ঢোকাচ্ছো।” দা সিলভার কথা শুনেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন লোথার।
“তোমার মুখ বন্ধ করো বুড়ো” সিলভাকে শাসালেন। এতে তোমার নাক না গলালেও চলবে।”
“কুমারী মারীয়াকে ধন্যবাদ যে এসব শয়তানেরই কাজ।” বিড়বিড় করে নিজের অসন্তুষ্টি জানাল দা সিলভা।
ঘোঁত ঘোঁত করে সরে এলেন লোথার। “ম্যানফ্রেড, আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে। বই রেখে এসো।”
হনহন করে হুইল হাউজ থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলেন লোথার। পানি ঠেকানোর জন্য জাহাজের ডেকের উঁচু প্রান্তদেশে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে পকেট থেকে লম্বা কালো চুরুট বের করে মাথার খানিকটা কামড়ে থু করে ফেলে দিলেন। এমন সময় মাথা উঁচু করে উঁকি দিল ম্যানফ্রেড; যখন দেখল বাবা কিছু বলেনি, লাজুক ভঙ্গিতে উঠে এসে বাবার পাশে বসল।
হাত গোল করে দিয়াশলাই দিয়ে চুরুটে আগুন ধরিয়ে গভীর টান দিলেন লোথার। তারপর হাত খুলে দিতেই দমকা বাতাস নিভিয়ে দিল আগুন। আস্তে করে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন লোথার।
আনন্দে কেঁপে উঠল ম্যানফ্রেড। সচরাচর এমনভাবে বাবার আদর পাওয়া যায় না। পিতার কাছ ঘেঁষে বসে বলতে গেলে প্রায় দম বন্ধ করে রইল ছেলেটা। পাছে নষ্ট হয় এ দুর্লভ মুহূর্ত।
“আশা করি উইলেমের মাথায় বয়লারগুলো জ্বালিয়ে রাখার বুদ্ধি ঠিকই এসেছে।” আপন মনে বিড়বিড় করলেন লোথার “হাতে এত কাজ জমে গেছে যে আজ সারারাত আর আগামীকাল সারাদিন ফ্যাক্টরিতে ব্যস্ত থাকতে হবে।”
“এত মাছের সবটুকু কি কাজে লাগানো যাবে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ম্যানফ্রেড।
“না, এগুলোর বেশিরভাগ দিয়ে মাছের তেল আর মাছের খাবার-” হঠাৎ করেই কথা বন্ধ করে উপসাগরের ওপাড়ে একদৃষ্টে তাকালেন লোথার। ম্যানফ্রেড টের পেল শক্ত হয়ে গেছে বাবার শরীর। ছেলেটাকে আরো হতাশায় ডুবিয়ে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে চোখের উপর রাখলেন লোথার।
“বেকুব কোথাকার।” দক্ষ শিকারির চোখে ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন দূরে ফ্যাক্টরির বয়লার হাউজ। ধোয়ার কোনো চিহ্নও নেই। “না জানি গাধাটা কোন নরকে পচছে?” লাফ দিয়ে দাঁড়িয়েও চলন্ত ট্রলারে ঠিকই ভারসাম্য রাখলেন লোথার। “বয়লারগুলোকে ঠাণ্ডা করে রেখে দিয়েছে। আবার আগুন জ্বালাতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লেগে যাবে। ততক্ষণে সব মাছ পচে যাবে। গোল্লায় যাক শয়তানটা; রাগে কাঁপতে কাঁপতে হুইল হাউজে নেমে এলেন লোথার। ফগহর্ন হাতে নিয়ে ফ্যাক্টরিকে সতর্ক করে দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। “কী, হচ্ছেটা কি সেখানে!” কন্ট্রোল প্যানেলের কাছ থেকে দূরবিন টেনে নিয়ে চোখের ওপর ধরলেন। এত দূর থেকেও ফ্যাক্টরির মেইন গেটের জটলাটা দেখা যাচ্ছে।
“ওই তো উইলেম।” ভারি গুঁড়ির পাইলিং দিয়ে বানানো উপসাগরের শান্ত জলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের লম্বা আনলোডিং জেটির শেষ মাথায় ফ্যাক্টরি ম্যানেজারকে দেখা যাচ্ছে। সে এখানে কী করছে, বয়লারগুলো ঠাণ্ডা অথচ সবাই বাইরে হল্লা করছে। কিন্তু উইলেমের দু’পাশে দু’জন অপরিচিত লোককেও দেখা যাচ্ছে। পোশাক দেখেই লোক দুজনের পেশা আন্দাজ করে নিলেন লোথার।
“ট্যাক্স কালেক্টর কিংবা অন্য কোনো সরকারি কর্মচারী।” রাগ কমে গিয়ে তার বদলে অস্বস্তি বোধ করলেন।
“ঝামেলা।” অনুমান করলেন লোথার। “এখন আমাকে হাজার টন মাছ রান্না করতে হবে অথচ কিনা-”।
এর পরপরই চোখে পড়ল দুটো মোটরগাড়ি। একটা ভাঙাচোরা পুরনো টি মডেলের ফোর্ড হলেও অন্যটা দেখে লাফিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ড।
পুরো আফ্রিকাতে এমন আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ড্যাফোডিল হলুদ রঙা হাতির মত ভারি ডেইমলার। শেষবার এটাকে উইন্ডহকের প্রধান রাস্তায় কোর্টনি মাইনিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানির অফিসের বাইরে পার্ক করা দেখেছিলেন।
কোম্পানিতে তার ঋণের মেয়াদ বাড়াবার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন লোথার। ধূলিমাখা চওড়া রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন গাঢ় রঙা সুট পরিহিত দুই কর্মচারী সাথে নিয়ে মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে সে। লোথারের দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। তারপরে কেটে গেছে প্রায় এক বছর।
দা সিলভা ভারি বোঝায় প্রায় ডুবুডুবু ট্রলারটাকে জেটির পাশে রাখতেই উঠে দাঁড়ালেন লোথার। নৌকা পানিতে এতটাই নিচু হয়ে আছে যে, জেটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা কু’র দিকে মুরিং লাইন ছুঁড়ে মারল ম্যানফ্রেড।
“লোথার, এই লোকগুলো আপনার সাথে কথা বলতে চায়।” গলা বাড়িয়ে বলে উঠল উইলেম। বুড়ো আঙুল নাচিয়ে লোকগুলোকে দেখাবার সময় নার্ভাস হয়ে ঘামতে শুরু করল ম্যানেজার।
“আপনিই কি মিঃ লোথার ডি লা রে?” ধূলিমলিন ফেডোরা টুপিটাকে মাথার পেছনে টেনে দিয়ে জানতে চাইলেন আগন্তুকদ্বয়ের অপেক্ষাকৃত খাটো জন।
“ঠিক তাই।” মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত কোমরে রেখে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন লোথার। “আর আপনি?”
“আপনিই কি সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকান ক্যানিং অ্যান্ড ফিশিং কোম্পানির মালিক?”
“জ্যা!” আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিলেন লোথার। “আমিই মালিক, কিন্তু হয়েছেটা কী?”
“আমি উইন্ডহক কোর্টের শেরিফ। এখানে কোম্পানির সমস্ত সম্পদের একটা রিট নিয়ে এসেছি।” হাতের দলিলগুলো বাতাসে ঘোরালেন শেরিফ।
“ওরা ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে।” করুণ কণ্ঠে জানাল উইলেম। “আমাকে বয়লার বন্ধ করতে বাধ্য করেছে।”
“না! এটা হতে পারে না!!” ফোঁস ফোঁস করে উঠলেন লোথার। ক্ষ্যাপা চিতার মতই হলুদ হয়ে ধকধক করে জ্বলতে লাগল চোখ। “আমাকে এক হাজার টন মাছ প্রক্রিয়াজাত করতে হবে।”
“কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রিকৃত চারটি ট্রলার কি এগুলোই?” লোথারের প্রতিক্রিয়া দেখেও কোনো রকম নরম না হয়ে বলে উঠলেন শেরিফ। তবে জ্যাকেটের বোতাম খুলে দুটো হাতই কোমরে রেখে দাঁড়ালেন। বেল্টের চামড়ার হোলস্টারে ঝুলছে ভারি ওয়েবলি সার্ভিস রিভলবার। তারপর মাথা ঘুরিয়ে জেটির দুপাশে নোঙর করা চারটি ট্রলার দেখিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, “আমার সহকারী, নৌকা আর কার্গোগুলোর উপর কোর্টের সিল লাগিয়ে দেবে। তাই সাবধান করে দিচ্ছি, এগুলোতে হাত দেবার কিংবা সরাবার যে কোনো ধরনের প্রচেষ্টাই অপরাধ বলে গণ্য হবে।”
“না, এটা হতে পারে না!” তাড়াতাড়ি মই বেয়ে জেটিতে উঠে এলেন লোথার। কমে গেছে কণ্ঠের তেজ। “আমাকে আমার মাছগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। বুঝতে পারছেন না? নতুবা কাল সকাল অব্দি এভাবে থাকলে পচে গন্ধ বেরোবে
“এগুলো আর আপনার মাছ নয়।” মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ। “এগুলো এখন কোর্টনি মাইনিং ও ফিন্যান্স কোম্পানির সম্পত্তি।” তারপর অধৈর্য হয়ে সহকারীর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন, “যাও কাজে হাত দাও।” তারপর যেই না অন্যদিকে ঘুরতে যাবেন, পেছন থেকে লোথার ডেকে বললেন, “উনি এখানে এসেছেন।” শেরিফ ঘুরে তাকাতেই লোথার আবারো বললেন, “উনি এসেছেন। এটা তো উনার গাড়ি। তাই না?”
চোখ নামিয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন শেরিফ। কিন্তু উইলেম বলে উঠল, “হ্যাঁ এসেছেন, আমার অফিসে অপেক্ষা করছেন।”
দলটার কাছ থেকে সরে লম্বা লম্বা পা ফেলে জেটি থেকে নেমে এলেন লোথার। মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটো দেখে মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধে চলেছেন। এদিকে জেটির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ফ্যাক্টরির উত্তেজিত কর্মচারীর দল।
“এসব কী হচ্ছে বস?” সবাই মিলে আকুতি জানালো লোথারের কাছে, “আমাদেরকে আর কাজ করতে দেবে না? আমরা তাহলে করব কি?”
“দাঁড়াও!” খসখস কণ্ঠে উত্তর দিলেন লোথার। “আমি সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছি।”
“আমরা বেতন পাবো বস? আমাদের ছেলেমেয়েরা-”
“অবশ্যই পাবে।” তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলেন লোথার, “আমি নিজে প্রতিজ্ঞা করছি।” কিন্তু মাছ বিক্রি না করতে পারলে তো এ প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবেন না। ধাক্কা দিয়ে সবাইকে সরিয়ে ফ্যাক্টরির কোনায় ম্যানেজারের অফিসে চলে এলেন।
দরজার বাইরে পার্ককৃত ডেইমলারের সামনের মাডগার্ডের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানফ্রেডের চেয়ে বছরখানেকের বড় একটা ছেলে। কিন্তু ম্যানফ্রেডের চেয়েও ইঞ্চিখানেক খাটো আর পরিচ্ছন্ন শরীরটা কৃশকায়। মেয়েদের মত রূপবান ছেলেটার চামড়া একেবারে নিখুঁত আর চোখ দুটো গাঢ় নীল।
ছেলেটাকে দেখেই লোথার বলে উঠলেন “শাসা!”
দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কপালের উপর থেকে এক গোছা কালো চুল সরিয়ে দিল ছেলেটা।
“আপনি কীভাবে আমার নাম জানেন?” কণ্ঠের রুক্ষতা সত্ত্বেও গাঢ় নীল চোখ দুটিতে দেখা গেল আগ্রহ।
শত শত উত্তর ভিড় করে এল লোথারের ঠোঁটে : “অনেক বছর আগে একবার আমি তোমাকে আর তোমার মাকে মরুভূমিতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছি… যখন তুমি মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতে চাইতে না, সেই শিশু অবস্থায় আমার ঘোড়ার জিনের সামনের বাঁকা অংশে তোমাকে নিয়ে ঘুরেছি… তোমাকে ততটাই ভালবাসি একদা তোমার মাকে যতটা বেসেছিলাম… তুমি ম্যানফ্রেডের ভাই, আমার নিজের ছেলের সৎভাই। এত বছর পরেও তোমাকে যেখানেই দেখি না কেন আমি ঠিক চিনে যাবো।”
কিন্তু এসবের কিছুই বললেন না লোথার পরিবর্তে জানালেন, “গুড ওয়াটার” এর বুশম্যান শব্দ হল শাসা, যা বুশম্যানদের দুনিয়ায় সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু।”
“ঠিক তাই।” মাথা নেড়ে সম্মত হল শাসা কোর্টনি। লোকটা তাকে বেশ আগ্রহী করে তুলেছে। আবদ্ধ এক উন্মাদনা, নিষ্ঠুরতা আর নিখাদ শক্তি সত্ত্বেও লোকটার চোখগুলো অদ্ভুত স্বচ্ছ। প্রায় একটা বিড়ালের মতই হলুদ। “আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার খ্রিস্টান নাম হল মাইকেল। এটা ফ্রেঞ্চ শব্দ। আমার মা’ও ফরাসি কিনা তাই।”
“তিনি কোথায়?” লোথারের প্রশ্নের উত্তরে অফিসের দরজার দিকে তাকালো শাসা।
“উনি বলেছেন কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে।” শাসার কথায় কর্ণপাত না করে এগিয়ে গেলেন লোথার ডি লা রে। এত কাছ দিয়ে গেলেন যে লোকটার তেলতেলে চামড়ায় মাছের নোংরা কাদা আর রোদে পোড়া দেহতুকে আটকে থাকা আঁশও দেখতে পেল শাসা।
“আপনি দরজায় নক করলে-” গলার স্বর নামিয়ে নিল শাসা; কিন্তু লোথার তোয়াক্কা না করে ঠাস করে খুলে ফেললেন অফিসের দরজা। শাসা দেখল জানালার কাছের চেয়ারটা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকালো মা।
ছোট্ট মেয়েদের মতন পাতলা দেহাবয়বের অধিকারী এই নারীকে এতটাই তরুণ দেখাচ্ছে যে বয়স নিজ ছেলের চেয়ে খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে না। কেবল চিবুক ভোলার সাথে সাথে চোখের কোণ নেচে ওঠা, চোয়ালের দৃঢ়চেতা ভাব আর মধুরঙা গভীর চোখ জোড়া দেখে যে কোনো তেজস্বী পুরুষের কথাই মনে পড়ে যেতে বাধ্য।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে শেষবার সাক্ষাতের পর থেকে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন পরিমাপের চেষ্টা করল দুজনে।
“কত হবে ওর বয়স?” আপন মনে ভাবতে গিয়েই লোথারের মনে পড়ে গেল যে, “এ শতাব্দীর একেবারে প্রথম দিনে মধ্যরাতের কিছু পরেই ওর জন্ম। তার মানে বিংশ শতকের মতই বয়স্ক, এ কারণেই নাম রাখা হয়েছে সেনটেইন। তার মানে একত্রিশ হলেও দেখায় উনিশ বছর বয়সীরই মতন। এখনো ঠিক সেদিনকারই মতন তরুণ যেদিন মরুভূমিতে সিংহের নখের আঘাতে জর্জরিত রক্তমাখা মৃত্যুপথযাত্রী তন্বী শরীরটাকে খুঁজে পেয়েছিলাম।”
“ওর বয়স বেড়ে গেছে।” আপন মনে ভাবলেন সেনটেইন। চুলে রুপালি রেখা; মুখে আর চোখের কিনারে ভাজ। বয়স চল্লিশের উপরে আর অনেক যন্ত্রণাও সয়েছে। কিন্তু না, এখনো যথেষ্ট হয়নি। ভাবতে ভালোই লাগছে যে আমার বুলেট ওর হার্ট মিস্ করে গেছে। যাই হোক, এখন তাকে বাগে পেয়েছি। এবার আসল সত্যিটা ঠিকই টের পাবে”।
কিন্তু হঠাৎ করেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনে পড়ে গেল নিজ দেহের উপরে লোখারের নগ্ন, মসৃণ আর শক্তিশালী সোনালি শরীরের অনুভূতি। একই সাথে নিজের উপরেই রাগ হল আবেগের এ অংশটাকে কাবু করতে না পারার অক্ষমতার জন্য। অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে অ্যাথলেটের মতই গড়ে তুলেছেন সেনটেইন; কেবল লাগামহীন এই সুখানুভূতির আকাক্ষা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে ছাড়িয়েও চোখ গেল রৌদ্রে স্নাত শাসার দিকে। তার অনিন্দ্যসুন্দর ছেলেটা কৌতূহলী হয়ে মাকে দেখছে। লজ্জা পেয়ে গেলেন সেনটেইন। নিশ্চিত যে মনের ভাব চেহারায় লুকোতে ব্যর্থ হয়েছেন।
“দরজা বন্ধ করে দাও।” খসখসে কণ্ঠে আদেশ দিলেন পুরোপুরি শান্ত সেনটেইন, “ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করো।” এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে খানিক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। যে মানুষটাকে ধ্বংস করতে চান তার মুখোমুখি হবার আগে আবারো নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন সেনটেইন কোর্টনি।
***
দরজাটা বন্ধ হতে দেখে অসন্তুষ্ট হল শাসা। বুঝতে পারল গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটতে চলেছে। বিড়াল চোখঅলা বিপজ্জনক ধরনের লোকটা ওর নাম জানে। তার ওপর আবার মায়ের গাল জুড়ে রঙের এরকম পরিবর্তন আর চোখের দৃষ্টি আগে কখনোই দেখেনি, অপরাধবোধ যে নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তাছাড়া শাসা যতটুকু জানে মায়ের দুনিয়াতে অস্থিরতা বলতে কিছু নেই। তাই বন্ধ দরজার ওপাশে যে কী ঘটছে জানতে খুব ইচ্ছে করছে।
“যদি তুমি কিছু জানতে চাও তাহলে নিজেই খুঁজে বের করা।” মায়ের উক্তিগুলোর একটা যদি প্রয়োগ করতে যায় তাহলে ধরা খাবার সম্ভাবনা আছে জেনেও শাসা ঘুরে অফিসের অন্য পাশের দেয়ালের কাছে চলে এল।
কিন্তু কান পেতেও বিড়বিড় শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।
“জানালা।” চিন্তাটা মাথায় আসতেই তাড়াতাড়ি কোনার দিকে সরে এল শাসা। কিন্তু খোলা জানালার নিচে দাঁড়ানোর আগেই পঞ্চাশ জোড়া চোখের দৃষ্টির সামনে ধরা খেতে হল। মেইন গেইটের কাছে এখনো জটলা পাকিয়ে আছে ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আর তার কর্মচারীর দল। কোনার দিক থেকে শাসাকে এগিয়ে আসতে দেখেই চুপচাপ সবাই এদিকে তাকাল।
মাথা ঝাঁকিয়ে দিক পরিবর্তন করে জানালার কাছ থেকে সরে এল শাসা। তারপর সবাই তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে নিজের অক্সফোর্ড ব্যাগের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অলসের মত ঘুরতে ঘুরতে জেটিতে চলে এল; যেন লম্বা জেটিতে বেড়ানোটাই ওর উদ্দেশ্য ছিল। হঠাৎ করে চোখে পড়ল নোঙর করা চারটা ডুবুডুবু ট্রলার। নৌকা দেখলে সব সময়েই খুশি হয়ে ওঠে শাসা। তাই উত্তপ্ত মরুভূমির এই একঘেয়ে বিকেলের বিতৃষ্ণা কাটাতে জেটির কাঠের ওপর দ্রুত হয়ে উঠল তার পা-জোড়া।
পুরো ব্যাপারটা সত্যিই বেশ নতুন আর উত্তেজনাময়। এত মাছ আগে কখনো একসাথে দেখেনি। না হলেও হাজার টন হবে। প্রথম নৌকার সমান্তরালে চলে এল শাসা। নাকে আসছে ফুয়েল অয়েল আর মানুষের মলের দুর্গন্ধ। নৌকাটার এমনকি কোনো নামও নেই : সমুদ্রের নোনা জলে ক্ষয়ে যাওয়া বো’র উপরে কেবল রেজিস্ট্রেশন আর লাইসেন্স নাম্বার রঙ করা।
“একটা নৌকার অবশ্যই একটা নাম থাকা উচিত।” মনে মনে ভাবল শাসা। তার নিজের তেরোতম জন্মদিনে উপহার হিসেবে মায়ের দেয়া পাঁচশ ফুট লম্বা ইয়টের নাম দ্য মিডাস টাচ।
কটু গন্ধে নাক কুঁচকে ফেলল শাসা। একই সাথে নৌকাটার প্রতি অবহেলা আর এর বেহাল দশা দেখে মন খারাপ করে ফেলল।
“মা বুঝি উইন্ডহক থেকে এত দূরে কষ্ট করে এটার জন্যই এসেছে” শাসার চিন্তায় বাধা দিয়ে লম্বা আর কোনাকৃতি হুইল হাউজের দিক থেকে বেরিয়ে এল একটা ছেলে।
পরনে তালিঅলা ক্যানভাস শর্টস, পা দুটো বাদামি আর পেশিবহুল। কিন্তু খালি অবস্থাতেও ভাসমান হ্যাঁচের উপর চমৎকারভাবে ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
হঠাৎ করেই পরস্পরকে দেখতে পেয়ে শক্ত হয়ে গেল দুজনে। নিঃশব্দে পরস্পরকে মেপে দেখল।
“খাসা একটা ফুলবাবু” আপনমনে ভাবল ম্যানফ্রেড। উপকূলের উপরে সোয়াকোপমুন্ড শহরে এরকম দুএকজনকে আগেও দেখেছে। বড়লোকের ছেলেমেয়েগুলো এরকম হাস্যকর আটোসোটো পোশাক পরে মুখে আলগা ভাব নিয়ে বাবা-মায়ের পেছনে ঘুরে বেড়ায়।
অন্যদিকে শাসা ভাবল, “গরিব সাদা-আফ্রিকানগুলোর একজন।” মা ওকে এদের সাথে খেলতে মানা করলেও এদের কয়েকজন কিন্তু বেশ মজার। তাদের খনিতে মেশিন শপের ফোরম্যানের ছেলে এত সুন্দর করে পাখিদের ডাক নকল করতে পারে যে শুনলে মনে হবে সত্যিকারের পাখির আওয়াজ। এছাড়াও ছেলেটা শাসাকে পুরনো ফোর্ড গাড়ির ইগনিশন আর কার্বোরেটর অ্যাডজাস্ট করা শিখিয়েছে। আবার এই ছেলেটারই বড় বোন, শাসার চেয়েও বছরখানেকের বড় হবে; মেয়েটা খনির পাম্প হাউজের পেছনে তাকে আরেকটা গূঢ় জ্ঞান দান করেছে। পরবর্তী সুযোগেও আবার এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে অধীর হয়ে আছে শাসা।
এখন ট্রলারের উপরের ছেলেটাকে দেখেও আগ্রহ হচ্ছে। চোখ ঘুরিয়ে ফ্যাক্টরির দিকে তাকাল; নাহ, মা কিছু দেখছে না।
“হ্যালো” অভিজাত আচরণের সাথে সাবধানে হাসল শাসা। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ পুরুষ নানা স্যার গ্যারিক কোর্টনি শিখিয়েছেন, “তুমি জন্মসূত্রেই সমাজের একটা বিশেষ অবস্থান পেয়ে গেছে। এই সুবিধার সাথে দায়িত্বও আছে। একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক তার অধীনস্থ সকলের সাথেই সদয় আচরণ করে।”
“আমার নাম কোর্টনি” ছেলেটাকে নিজের পরিচয় দিল শাসা কোর্টনি। “আমার মায়ের নাম মিসেস সেনটেইন ডি থাইরী কোর্টনি।” নামগুলো উচ্চারণের সাথে সাথে সচরাচর যেমন অভিব্যক্তির দেখা পায় এবারে তা অনুপস্থিত থাকায় আস্তে করে জানতে চাইল, “তোমার নাম?”
“আমার নাম ম্যানফ্রেড।” ঘন কালো চোখের ভ্রু বাঁকা করে আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিল ম্যানফ্রেড, “ম্যানফ্রেড ডি লা রে। আমার দাদা, বাবা আর পুরো বংশই ডি লা রে। তারা যতবার ইংরেজদের মুখোমুখি হয়েছেন ততবারই গুলি ছুঁড়েছেন।”
অপ্রত্যাশিত এই আঘাতে শাসার গালে রঙ জমলেও ফিরে যেতে পারল না। হুইল হাউজের জানালায় হেলান দিয়ে এদিকে দেখছে এক বুড়ো। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকও এগিয়ে এল।
“আমরা, ইংরেজরা বিদ্রোহীদেরকে হারিয়ে ১৯১৪ সালে যুদ্ধে জিতেছি।”
“আমরা!” বাকিদের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। “চুলে সুগন্ধি লাগানো এই ছোট্ট ভদ্রলোক নাকি যুদ্ধে জিতেছেন।” মিটিমিটি হেসে উৎসাহ দিল নাবিকেরা। “গন্ধে মনে হয় নাম হবে লিলি, দ্য পার্ফিউম সোলজার। অন্যদিকে ঘুরতেই শাসা প্রথমবারের মত উপলব্ধি করল যে ছেলেটা ওর চেয়ে ইঞ্চিখানেক লম্বা হবে। তার মানে তুমি ইংরেজ, তাই না লিলি?”
একটা গরিব শ্বেতাঙ্গ ছেলের বুদ্ধি যে এত সুরসিক হতে পারে ভাবতে পারেনি শাসা।
“অবশ্যই, আমি ইংরেজ। মনেপ্রাণে চাইছে এই পরিস্থিতি থেকে সরে পড়তে। কারণ ঘটনার উপর থেকে ওর নিয়ন্ত্রণ সরে যাচ্ছে।
“তাহলে তো নিশ্চয় লন্ডনে থাকো, তাই না?” এখনো জেদ করছে ম্যানফ্রেড।
“আমি কেপটাউনে থাকি।…
“হাহ!” ম্যানফ্রেডের দর্শক এখন বেড়ে যাচ্ছে। নিজের ট্রলার থেকে চলে এলেন সোয়ার্ট হেনড্রিক। নাবিকেরাও ভিড় করেছে।
“এ কারণেই এদেরকে সোতপিয়েল বলে।” ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড।
খোঁচা খেয়ে জ্বলে উঠল শাসা। “সোতপিয়েলের এক পা লন্ডনে আর আরেক পা কেপটাউনে।” নাবিকেরা সমস্বরে হাততালি দিয়ে উঠতেই মরিয়া হয়ে উঠল শাসা। জেটিতে ছেলেটার ঠিক নিচে চলে এল।
তারপর আচমকা লাফ দিল। এত জলদি আক্রমণ! ম্যানফ্রেড ভেবেছিল কথার মাধ্যমে আরো খানিকক্ষণ শাসাকে অপমান করবে।
নিজের শরীরের সমস্ত ভার আর ক্ষোভ নিয়ে ছয় ফুট উপর থেকে ম্যানফ্রেডের ওপর পড়ল শাসা। হুশ করে বেরিয়ে গেল ম্যানফ্রেডের বুকের বাতাস। একসাথে জড়াজড়ি করে দুজনে মিলে গড়িয়ে পড়ল মরা মাছের জমির উপর।
ম্যানফ্রেডের শক্তি দেখেও চমকে গেল শাসা। ছেলেটার হাত কাঠের গুঁড়ির মত শক্ত আর আঙুল যেন কসাইয়ের হুক। কেবল বুকের বাতাস বেরিয়ে হতভম্ব থাকায় বেইজ্জতির হাত থেকে বেঁচে গেল শাসা। তার বক্সিং ইনস্ট্রাকটর জক মারফির নির্দেশনাও দেরিতে মনে পড়ল;
“তোমার চেয়ে বড় কাউকে কাছে থেকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করার সুযোগ দেবে না। মাঝখানে অন্তত এক হাতের দূরত্ব রাখবে।”
ম্যানফ্রেড খুব চাইছে ওর মুখে নখ ঢোকাতে আর হাফ নেলসন ভঙ্গিতে পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরতে। ডান হাঁটুর ওপর উঠে বসল শাসা; তারপর ম্যানফ্রেডও উঁচু হতেই বুকের উপর লাথি কষাল। হাঁফ ছেড়ে পিছনে গড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেড। কিন্তু এবার শাসাও গড়ানোর চেষ্টা করতেই ডেড লকের উদ্দেশে সামনে ঝাঁপ দিল। মাথা নিচু করে ডান হাত দিয়ে ম্যানফ্রেডের হাতের বাঁধন আলগা করতে চাইল শাসা। তারপর মুক্ত হবার সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে ঘুষি মারল।
কাছে থেকে সোজা বাম দিকে ঘুসি চালাতে বহুবার শিখিয়েছে জক।
শাসা এটা তেমন ভালো না পারলেও ছেলেটার চোখে লাগতেই মাথা পিছনে হেলিয়ে খানিকক্ষণের জন্য অন্যমনষ্ক করা গেল। ফলে নিজ পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সরে আসার সময় পেল শাসা।
ততক্ষণে পুরো জেটি ভর্তি হয়ে গেল। রাবার বুট আর গোলগলা জার্সি পরে দলে দলে ট্রলারের কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকেরা এসে জড়ো হল। আনন্দ উত্তেজনায় যেন মোরগ লড়াই দেখছে এমনভাবে ছেলে দু’জনকে উৎসাহ দিতে লাগল।
ফোলা চোখ থেকে জল সরিয়ে ম্যানফ্রেড এগিয়ে এলেও পায়ের নিচের মাছে বাধা পেল। ফলে কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই আরেকটা ঘুসি হজম করতে হল। আহত চোখ এত ভীষণ জ্বালা করছে যে ক্রোধে চিৎকার করে হন্যে হয়ে শাসাকে খুঁজল।
মাথা নিচু করে ম্যানফ্রেডের হাতের নিচে ঢুকে আবারো বাম দিকে আঘাত করল শাসা।
এবার ম্যানফ্রেডের মুখে লাগায় ঠোঁট কেটে সাথে সাথে রক্ত ঝরতে লাগল। প্রতিদ্বন্দ্বীর রক্ত আর দর্শকদের চিৎকার শুনে নিজের ভেতরে আদিম এক সত্তার অস্তিত্ব টের পেল যেন শাসা; ম্যানফ্রেডের ফোলা গোলাপি চোখে আবার লাগাল ঘুসি।
মাথায় ঘুরছে জ’কের কথা, “মার্ক করে বারবারই একই জায়গায় মারবে।” এবার ম্যানফ্রেডের চিৎকারে আক্রোশের পাশাপাশি ব্যথার বোধও ছিল।
“সত্যিই কাজ হয়েছে” আনন্দিত শাসা হুইল হাউজের দিকে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করতেই দু’হাত দুপাশে ছড়িয়ে হাসতে হাসতে তেড়ে এল ম্যানফ্রেড।
এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত শাসা হুইল হাউজের কাঠ ধরে সামনে আঘাত হানল। তার মাথা গিয়ে সোজা ম্যানফ্রেডের পাকস্থলীতে লেগেছে।
আরো একবার দম বন্ধের মত দিশেহারা হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। হামাগুড়ি আর সাঁতার দেয়ার ভঙ্গিতে আস্তে করে জেটির কাঠের মইয়ের গোড়ায় চলে এল শাসা।
হাসছে পুরো জেটি ভর্তি দর্শক। থু করে মুখ থেকে রক্ত আর মাছের আঁশ ফেলল ম্যানফ্রেড। নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টায় ভয়ংকরভাবে ওঠানামা করছে ওর বুক।
শাসা মইয়ের মাঝ বরাবর আসতেই গোড়ালি ধরে টান দিল ম্যানফ্রেড। মরিয়া হয়ে মই আঁকড়ে ধরতে চাইল শাসা। নাবিকদের মুখগুলো আর বেশি হলে ইঞ্চিখানেক দূরে। জেটির উপর ঝুঁকে সবাই যেন ওর রক্ত দেখার অপেক্ষা করছে।
পা দুটো মুক্ত হতেই ম্যানফ্রেডের ফোলা চোখে লাথি কষাল শাসা। ছেলেটা পিছিয়ে যেতেই হাঁচড়ে-পাঁচড়ে জেটিতে উঠে অগ্নিদৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল শাসা। এতক্ষণে যুদ্ধ করার নেশা কেটে গেছে। এখন কাঁপছে।
জেটি ধরে পালিয়ে যাবার পথ খোলা থাকলেও চারপাশের লোকগুলোর হাসি আর উদ্ধত ভাব দেখে ওর পা দুটো যেন জমে গেল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই হতাশ হয়ে দেখল ম্যানফেডও উঠে এসেছে।
কেমন করে যে এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল শাসা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। আবারো ম্যানফ্রেডের মুখোমুখি হবার আগে চেষ্টা করল নিজের কাপুনি থামাতে।
বড়সড় ছেলেটাও কাঁপছে। কিন্তু ভয়ে নয়। খুনির মত ক্রোধে জ্বলছে ওর চেহারা। রক্তাক্ত ঠোঁট থেকেও কেমন যেন হিসহিস আওয়াজ বের হচ্ছে।
“ওকে খুন করে ফেলো ছোট্ট মনিব।” কৃষ্ণাঙ্গ ট্রলার নাবিকদের চিৎকার শুনে নিজেকে ধাতস্থ করল শাসা। গভীরভাবে বুকভর্তি দম নিয়ে ক্ল্যাসিক বক্সারদের ভঙ্গিতে হাত মুঠি পাকিয়ে দাঁড়াল।
“সারাক্ষণ নড়বে।” মনে পড়ল জকের পরামর্শ। বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে পাক দিল শাসা।
“দেখো কী করছে!” চিৎকার করে উঠল ভিড়ের দর্শক। “নিজেকে জ্যাক ডেমসে ভাবছে। ওকে ওয়ালবিস বে ওয়ালট্জ দেখিয়ে দাও ম্যানি!”
সংকল্পবদ্ধ গাঢ় নীল দু’খানা চোখ নিয়ে শাসার চারপাশে চক্কর কাটছে ম্যানফ্রেড।
নিজের সাবধানতা বজায় রেখে আস্তে আস্তে ম্যানফ্রেডের সাথে ঘুরছে। শাসা। দু’জনেরই সারা গায়ে, মাথায় থকথকে মাছের কাদা আর আঁশ। কিন্তু কাউকে দেখেই শিশুসুলভ বলে মনে হচ্ছে না। ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। নিশ্চুপ হয়ে গেল উপস্থিত দর্শকের দল। নেকড়ের পালের মত ধকধক করছে তাদের চোখ। হাঁসের মত গলা বাড়িয়ে সাগ্রহে দেখছে সামঞ্জস্যহীন এই জুটির লড়াই।
খানিকটা বামদিক ঘেঁষে পাশ থেকে আঘাত করল ম্যানফ্রেড। দৈহিক আকার, ভারি পা আর কাধ সত্ত্বেও গতি বেশ দ্রুত। উজ্জ্বল সোনালি চুলঅলা নিচু মাথা আর বাঁকানো জোড়া প্রমাণ করছে আক্রমণের ভয়াবহতা।
কিন্তু সে তুলনায় শাসাকে মেয়েদের মতই কমনীয় দেখাচ্ছে। কিন্তু তারপরেও ম্যানফ্রেডের আঘাতের উত্তরে সরে গিয়ে নিজের বাম হাত চালাল। পাঞ্চ খেয়ে সশব্দে ক্লিক করে উঠল ম্যানফ্রেডের দাঁত। একই সাথে মাথা পেছনে হেলে গেল।
গর্জন করে উঠল সকলে, “ওকে ধরো ম্যানি!” আবারো তেড়ে এসে শাসা’র কোমল মসৃণ চেহারায় শক্তিশালী এক ঘুসি লাগাল ম্যানফ্রেড।
মাথা নিচু করে ঘুসিটাকে এড়িয়ে গেল শাসা। আর এর প্রায় সাথে সাথে ভারসাম্যহীন ম্যানফ্রেডের বেগুনি ফোলা চোখে বাম হাত দিয়ে আঘাত করল। চোখের উপর দু’হাত রেখে গর্জন করে উঠল ম্যানফ্রেড।
“ঠিকভাবে লড়ো। দুই নম্বরী করছ কেন?”
“জা!” ভিড়ের মধ্য থেকে একজন আবার ম্যানফ্রেডকে সমর্থন দিল। “ভেগে যাওয়া বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পুরুষের মত লড়াই করো।”
পাশাপাশি নিজের কৌশলও বদলে ফেলল ম্যানফ্রেড। চরকাটা বন্ধ করে সোজাসুজি এগিয়ে এল। সাথে ভয়ংকরভাবে বাতাসে ঘোরাচ্ছে দুই হাত। উন্মাদের মত কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে, মাথা নিচু করে পিছু হটছে শাসা। ম্যানফ্রেডের মুখে একের পর এক আঘাত করেও ছেলেটাকে থামাতে পারছে না। চোখের নিচে কেটে চামড়া ফুলে ঢোল হয়ে গেছে : কিন্তু মনে হচ্ছে এসব আঘাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।
ম্যানফ্রেডের বাদামি রঙা হাতের মুঠি কপিকল আর জাল নিয়ে কাজ করতে করতে শক্ত হয়ে গেছে। কয়েকটা ঘুসি শাসার চুলে লাগলেও একটা এসে সোজা মাথার তালুতে লাগল। নিজে আঘাত করা বাদ দিয়ে এসব ঘুসির হাত থেকে বাঁচতেই যুদ্ধ শুরু করল শাসা। কোমরের নিচে পা দুটোও ক্রমশ অসাড় আর ভারি হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে ক্লান্তিহীনভাবে আঘাত করছে ম্যানফ্রেড। হতাশা আর পরিশ্রম মিলে ধীর হয়ে যাচ্ছে শাসার গতি। প্রচণ্ড জোরে পাজরের উপর ঘুসির আঘাত সহ্য করতে না করতেই দেখে মুখের উপর আরেকটা এগিয়ে আসছে। এড়াতে না পেরে ম্যানফ্রেডের হাত আঁকড়ে ধরল শাসা। এ সুযোগেরই অপেক্ষাতে ছিল ম্যানফ্রেড। অন্যহাতে শাসার গলা জড়িয়ে ধরল।
“এবারে বাগে পেয়েছি।” জোর করে নুইয়ে ফেলে বাম হাতের নিচে নিল শাসার মাথা। তারপর ডান হাত তুলে নির্মম এক আপার কাট চালাল।
শাসা বুঝতে পারল কী ঘটতে চলেছে। এত জোরে নড়ে উঠল যে, মনে হল ঘাড় ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু তারপরেও কোনোমতে মুখ বাঁচিয়ে কপাল দিয়ে ঠেকালো আঘাত। তারপরেও কপালের খুলি ভেঙে যেন মগজে ঢুকে গেল লোথার পেরেক। বুঝতে পারল এরকম আরেকটা আঘাত আর সহ্য করতে পারবে না।
চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেল দৃষ্টিশক্তি। বুঝতে পারল দু’জনে জেটির কিনারে চলে এসেছে। সর্বশক্তি দিয়ে চাইল কিনার দিয়ে পড়ে যেতে। কিন্তু ম্যানফ্রেন্ড বুঝতে না পেরে ভুল দিকে গড়িয়ে যাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়ল ছয় ফুট নিচে ট্রলারের মাছভর্তি ডেকে।
ম্যানফ্রেডের শরীরের নিচে চাপা পড়ল শাসা। তাই সাথে সাথে রুপালি মাছের চোরাবালিতে ডুবতে শুরু করল ওর দেহ। ম্যানফ্রেড আরেকটা ঘুসি মারতে চাইলেও শাসার মাথার চারপাশে নরম মাছ লেগে তা ভেস্তে গেল। পুনরায় আঘাতের চেষ্টা বাদ দিয়ে শাসার ঘাড়ের উপর নিজের সবটুকু ভার দিয়ে ছেলেটার মাথা চেপে ধরতে চাইল ম্যানফ্রেড।
ডুবে যাচ্ছে শাসা। চিৎকার করার চেষ্টা করতেই একটা মরা মাছ ওর খোলা মুখে ঢুকে গলায় গিয়ে আটকে গেল। অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে সমানে হাত পা ছুড়ছে; কিন্তু ছাড়ছে না ম্যানফ্রেড। গলায় মাছের মাথা আটকে থাকায় মনে হল দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। মাথার ভেতরে বাতাসের মত শো শো শব্দ হচ্ছে; অন্ধকার হয়ে এল দৃষ্টিশক্তি। এমন সময় উপরের জেটি থেকে শোনা গেল খুনে উল্লাস।
“আমি মারা যাচ্ছি” কেমন যেন বিস্ময় বোধ করল শাসা। “আমি ডুবে যাচ্ছি-” অচেতন হয়ে পড়ায় বাধা পেল চিন্তা।
***
“তুমি এখানে আমাকে ধ্বংস করতে এসেছে,” বন্ধ দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলেন লোথার ডি লা রে। “এতদূর কষ্ট করে এসেছে স্বচক্ষে দেখে আনন্দ লুটতে।”
“নিজেকে এত বেশি গুরুত্ব দিও না।” নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন সেনটেইন। “তোমার উপরে আমার এতটুকুও আগ্রহ নেই। আমি কেবল আমার বিনিয়োগের নিরাপত্তা দিতে এসেছি। পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড, সাথে সুদ।”।
“তাহলে আমাকে কাজ করতে বাধা দিতে না। এক হাজার টন মাছ। পেয়েছি, যা আগামীকাল সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডে পরিণত হবে।”
অধৈর্য হয়ে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন সেনটেইন। “তুমি আসলে কল্পনার দেশে বাস করছে। তোমার এই মাছের কোনো নেই। এসব কেউ চায় না। পঞ্চাশ হাজার তো বহু দূরের কথা।”
“অবশ্যই এর মূল্য আছে, মাছের খাবার, ক্যান তৈরি
আবারো লোথারকে চুপ করতে ইশারা করলেন সেনটেইন।
“তুমি সংবাদপত্র পড়ো না? এই মরুভূমিতে কোনো খবরই রাখো না, নাকি? জানো না যে দুনিয়ার ভাড়ারগুলো সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ভরে উঠেছে?”
“না, এটা সম্ভব না।” জেদের সুরে বলে উঠলেন লোথার। “স্টক মার্কেটের কথা অবশ্যই শুনেছি, কিন্তু মানুষকে খেতেও তো হবে।”
“তোমাকে নিয়ে আমি অনেক কিছুই ভেবেছি, কিন্তু এতটা নির্বোধ হবে বলে কখনো ভাবিনি।” মনে হল কোনো শিশুর সাথে কথা বলছেন সেনটেইন। “দুনিয়াতে কী ঘটছে বুঝতে চেষ্টা করো। সবরকম বাণিজ্য বন্ধ। ফ্যাক্টরিগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। বড় শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বেকার।”
“এসব তুমি তোমার কাজের অজুহাত হিসেবে বলছো। আমার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছো।” সেনটেইনের দিকে এগিয়ে এলেন লোথার। “বহু আগে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার জন্য আমাকে শাস্তি দিতে তাড়া করছে।”
“ঠিক তাই।” খানিকটা পিছিয়ে এলেও লোথারের চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। “ক্ষমার অযোগ্য, ভয়ংকর এই নিষ্ঠুর অপরাধের জন্য তোমাকে আমি যে শাস্তিই দিই না কেন যথেষ্ট হবে না। ঈশ্বর জানেন সে
“আর সন্তান?” শুরু করলেন লোথার, “যে সন্তানকে তুমি আমার কাছে ফেলে-” এই প্রথমবারের মত সেনটেইনের শান্ত অভিব্যক্তির মাঝে করাঘাত করলেন লোথার।
“তোমার ওই বেজন্মার কথা আমার সামনে তুলবে না।” এক হাত দিয়ে আরেক হাত ধরে নিজের কাঁপুনি থামালেন সেনটেইন।
“ও আমাদের ছেলে। এটা তো তুমিও অস্বীকার করতে পারবে না। তুমি কি ওকেও ধ্বংস করতে চাও?” লোথারের দাবি।
“ও তোমার ছেলে।” অস্বীকার করলেন সেনটেইন। “ও তো আমার অংশই নয়। তাই এতে আমার সিদ্ধান্তেরও নড়চড় হবে না। তোমার ফ্যাক্টরি পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাই আমার বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের আশা তো বাদই দিলাম, একটা অংশ ফেরত পেলেই বাঁচি।”
এমন সময় খোলা জানালা দিয়ে ভেসে এল বহু মানুষের কণ্ঠস্বর। এতদুর থেকেও সকলের উত্তেজিত গলা পাওয়া যাচ্ছে। যেন রক্তের নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছে একপাল হাউন্ড। কিন্তু লোথার কিংবা সেনটেইন কেউই সেদিকে খেয়াল করলেন না।
“আমাকে একটা সুযোগ দাও সেনটেইন।” নিজের কণ্ঠের আকুতির সুরে নিজেই বিরক্ত হলেন লোথার। জীবনে কখনো কারো কাছে হাত পাতেননিঃ কিন্তু সবকিছু নতুন করে শুরু করার সম্ভাবনাও দেখছেন না। এর আগেও দুবার সর্বস্ব হারিয়েছেন। কেবল সাহস আর দৃঢ় সংকল্প টিকে ছিল। প্রতিবারই শত্রু ছিল ইংরেজ এবং শূন্য থেকে নিজ ভাগ্য গড়ে তুলেছেন লোথার।
কিন্তু এবার আর পারছেন না। তাঁর সন্তানের জননী, সেই ভালোবাসার নারী, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন এখনো ওকে ওরকমই ভালোবাসেন। ছেচল্লিশ বছর বয়সে শরীরে এখন আর তরুণদের মত উদ্দাম নেই। সেনটেইনের চোখেও যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল অনুকম্পা।
“আমাকে একটা সপ্তাহ কেবল একটা সপ্তাহ সময় দাও সেনটেইন।” বললেও সাথে সাথে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন লোথার।
বাইরে প্রকাশ না পেলেও সেনটেইনের চোখ দেখে ঠিকই বুঝতে পারলেন যে এই মুহূর্তের জন্য, লোথারের হেনস্থা দেখার প্রতীক্ষাতেই বসেছিলেন সেনটেইন।
“আমার খ্রিস্টান নাম ধরে না ডাকতে তোমাকে মানা করেছিলাম। যখন জানতে পেরেছি যে তুমি আমার সবচেয়ে ভালোবাসার দু’জন মানুষকে হত্যা করেছে তখনই বারণ করেছি। এখন আবারো বলছি।”
“এক সপ্তাহ। কেবল এক সপ্তাহ।”
“আমি ইতিমধ্যেই তোমাকে দুই বছর দিয়েছি।”
এইবার মাথা ঘুরিয়ে খোলা দরজার দিকে তাকালেন সেনটেইন। মনে হচ্ছে যেন ষাড়ের লড়াইয়ের রক্তাক্ত গর্জন।
“আরেকটা সপ্তাহ দেয়া মানে বেড়ে যাবে তোমার ঋণের বোঝা আর আমার লোকসানের পরিমাণ।” মাথা ঝাঁকালেন সেনটেইন; কিন্তু দেখলেন লোথার একদৃষ্টে জানালা দিয়ে বাইরে কী যেন দেখছেন, “নিচের জেটিতে কী হচ্ছে?” জানালার শার্সিতে হাত রেখে সৈকতে তাকালেন সেনটেইন।
পাশে চলে এলেন লোথার। জেটির মাঝ বরাবর মানুষের একটা জটলা।
“শাসা!” মাতৃসুলভ উদ্বেগে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। “শাসা কোথায়?” হঠাৎ জানালার ভেতর দিয়ে লাফ দিয়ে জেটির দিকে ছুটলেন লোথার। চিৎকাররত নাবিকদেরকে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সোজা এগিয়ে গেলেন জেটির কিনারে।
“ম্যানফ্রেড!” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গর্জন করে বললেন, “থামো! ওকে ছাড়ো!”।
হেডলক দিয়ে পেঁচিয়ে হাত ঘুরিয়ে রোগা-পটকা ছেলেটার মাথায় মারল তার নিজের ছেলে। শাসার খুলি ফাটার আওয়াজ পেলেন লোথার।
“বেকুব কোথাকার!” এগিয়ে গেলেন লোথার। কিন্তু ভিড়ের শব্দে কিছুই শুনল না দুই ছেলে। শাসার জন্য সত্যিই ভয় পেলেন লোথার, এও ভালোভাবেই বুঝলেন যে, ছেলেটা আহত হলে সেনটেইনের প্রতিক্রিয়া কী হবে।”ওকে ছাড়ো!” কিন্তু লোথার পৌঁছাবার আগেই জেটির কিনার বেয়ে পড়ে গেল যুদ্ধরত জুটি। “ওহ, ঈশ্বর।” তাড়াতাড়ি কিনারে গিয়ে দেখলেন যে চকচকে মাছের মধ্যে প্রায় ডুবে গেছে দুজন।
মইয়ের মাথায় পৌঁছাতে চাইলেও লড়াইয়ের এক মুহূর্তও মিস করতে নারাজ কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকদের ভিড় ঠেলে কিছুতেই পৌঁছাতে পারছেন না লোথার। অতঃপর দুই হাতে ঘুসি মেরে নিজের লোকদেরকে সরিয়ে ট্রলারের ডেকে নিচে এলেন লোথার।
অন্য ছেলেটার ওপর বসে তার মাথা আর কাঁধ মাছের স্তূপের নিচে ঠেসে ধরেছে ম্যানফ্রেড।
তার নিজের মুখে অসংখ্য ক্ষতের আঁকিবুকি আর ক্রোধ। রক্তমাখা ফোলা ঠোঁটে অনবরত বিভিন্ন ধমক দিয়ে চলেছে ম্যানফ্রেড। শাসার মাথা আর কাঁধ দেখা না গেলেও মাথায় গুলি খেয়ে আহত লোকের স্নায়ুবিহীন পদক্ষেপের মত নড়ছে দুটো পা।
ছেলের কাধ ধরে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাইলেন লোথার। মনে হল এক জোড়া ম্যাস্টিফকে আলাদা করতে চাইছেন। প্রচণ্ড শক্তি খাটাতে হল। ম্যানফ্রেডকে তুলে হুইল হাউজের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। একই সাথে শাসার পা ধরে মরা মাছের চোরাবালি থেকে টেনে তুললেন।
“তুমি ওকে মেরে ফেলেছে, নিজ পুত্রের দিকে তাকিয়ে ঘোঁত ঘোত করে উঠলেন লোথার। চেহারা থেকে রক্ত সরে গিয়ে ছাই রঙা হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের মুখ। কাঁপতে শুরু করল।
“আমি তো তা চাইনি, পা। আমি চাইনি-”।
শাসার নিথর মুখের ভেতরে মরা মাছ ঢুকে দম বন্ধ করে দিয়েছে। নাকের ফুটো দিয়ে বের হল মাছের কাদার বুদবুদ।
“বেকুব কোথাকার! হাঁদারাম একটা!” আঙুল ঢুকিয়ে শাসার মুখ থেকে মাছ বের করে আনলেন লোথার।
“আমি দুঃখিত, পা। আমি সত্যিই এটা চাইনি।” ফিসফিস করে উঠল ম্যানফ্রেড।
“যদি তুমি ওকে মেরে ফেলতে তাহলে বুঝতেও পারছে না যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তা কত বড় অপরাধ হত।” শাসাকে কোলে তুলে নিলেন লোথার।
“তুমি তোমার নিজের নির্মম সেই সত্যটা উচ্চারণ না করে কেবলমাত্র খানিক জোর দিয়েই মইয়ের দিকে ঘুরলেন লোথার।
“আমি ওকে হত্যা করিনি।” ভয় পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড, “ও তো মারা যায়নি। ঠিক হয়ে যাবে, তাই না পা?” …
“না।” গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন লোথার। “আর কখনো ঠিক হবে না।” অচেতন শরীরটাকে বইয়ে নিয়ে জেটিতে উঠে গেলেন লোথার।
নিঃশব্দে সরে জায়গা করে দিল সকলে, ম্যানফ্রেডের মত তারাও অপরাধবোধে ভুগছে।
“সোয়ার্ট হেনড্রিক,” গলা চড়িয়ে ডাকলেন লোথার, “তুমি তো সবকিছু জানো। কেন থামালে না?”
সৈকত থেকে ফ্যাক্টরি যাবার পথে অপেক্ষা করছিলেন সেনটেইন। শাসার অসার দেহ নিয়ে তার সামনে থেমে গেলেন লোথার।
“ও মারা গেছে” অসহায়ের মত বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন।
“না।” মন থেকেই কথাটা বললেন লোথার। আর এর সত্যতা প্রমাণের জন্যই যেন গুঙ্গিয়ে উঠে বমি করল শাসা।
“তাড়াতাড়ি।” কাছে এগিয়ে এলেন সেনটেইন। “তোমার কাঁধে উল্টো করে ফেলে নাও। নতুবা নিজের বমিতেই দম বন্ধ করে ফেলবে।”
শাসার ঝুলন্ত দেহকে ব্যাগের মত কাঁধের উপর ফেলে শেষ কয়েক গজ দৌড়ে অফিসে চলে এলেন লোথার। টেবিল খালি করে দিলেন সেনটেইন।
“ওকে এখানে শোয়াও।” দুর্বলভাবে উঠে বসার চেষ্টা করল শাসা। নিজের ড্রেসের হাতা দিয়ে ছেলের নাক-মুখ মুছিয়ে দিলেন সেনটেইন।
“এটা তোমার বেজন্মাটার কাজ।” ডেস্কের ওপাশ থেকে অগ্নিদৃষ্টিতে লোথারের দিকে তাকালেন সেনটেইন। “ও আমার ছেলের সাথে এমন করেছে তাই না?”
চোখ সরিয়ে নেবার আগে লোথারের মুখে উত্তরও পেয়ে গেলেন।
“এখান থেকে যাও।”
শাসার ওপর ঝুঁকে এলেন সেনটেইন। “তুমি আর তোমার বেজন্মাটা তোমাদের দুজনকেই আমি দেখে নেবো। এখন আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও।”
***
ওয়ালবিস বে’ থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা বিশাল সব কমলা রঙের বালিয়ারির জট পাকানো উপত্যকার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে।
শক্ত হাতে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন সেনটেইন। ইঞ্জিনকে এতটুকুও থামতে দিচ্ছেন না। এমনকি গোলকধাঁধার মত অঞ্চলে যেখানে অন্যান্য যানবাহনও গর্তে ডুবে যায় বড়সড় হলুদ গাড়িটাকেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ঠিকই সোজা রেখেছেন।
রেসিং ড্রাইভারদের মত বত্র মুষ্ঠিতে ধরে রেখেছেন হুইল। চামড়ায় মোড়ানো সিটে সোজা বসে একেবারে পুরোটা বাঁক দেখতে পাচ্ছেন। এমনকি বালির ফাঁদে আটকে গেলে ডেইমলারকে ধাক্কা দেবার জন্য ব্যাক সিটে দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারককে নিয়ে ভ্রমণের নীতিরও তোয়াক্কা করেননি সেনটেইন। খনির বাইরে রাস্তা যত খারাপই হোক না কেন, মাকে কখনো পাঁকে আটকে যেতে দেখেনি শাসা।
ক্যানিং ফ্যাক্টরির স্টোর থেকে আনা পুরনো স্যুট গায়ে পরে সিটে উঠে বসল। ডেইমলারের বুটে তুলে নেয়া হয়েছে ওর মাছের গন্ধঅলা আর বমিতে মাখামাখি পোশাক।
ফ্যাক্টরি ছাড়ার পর এখনো একটাও কথা বলেনি মা। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারছে না শাসা।
“কে শুরু করেছিল?” রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই জানতে চাইলেন সেনটেইন।
খানিক ভেবে শাসা উত্তর দিল, “আমি নিশ্চিত নই। প্রথম আঘাত আমিই করেছি, কিন্তু গলাটা এখনো ব্যথা করছে।
“বলো?”
“মনে হচ্ছে যেন সব সাজানোই ছিল। আমরা পরস্পরের দিকে তাকাবার সাথে সাথে মনে হল যে লড়তে হবে।” মা কিছু বলছে না দেখে শাসা কাচুমাচু করে শেষ করল, “ও আমাকে গালি দিয়েছে।”
“কী বলেছে?”
“বলতে পারব না। শব্দটা অনেক খারাপ।”
“আমি জানতে চাইছি কী বলেছে?” মায়ের গলা একটু না কাঁপলেও বিপদ সংকেত টের পেল শাসা।
“সোয়েতপিয়েল বলেছে।” তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়েই অপমান বোধে অন্য দিকে তাকালো শাসা। তাই মায়ের হাসি চাপার চেষ্টা আর চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠা কৌতুকের ছটা দেখতে পেল না।
“আমি বলেছি না যে খুব খারাপ।” ক্ষমা চাইল শাসা।
“তাই তুমি তাকে মারলে, ও তো তোমার চেয়েও ছোট।”
শাসা নিজে এ তথ্য না জানলেও মা জানে দেখে একটুও অবাক হল না। মা সব জানে আসলে।
“হতে পারে ছোট; কিন্তু আমার চেয়েও দুইঞ্চি লম্বা একটা বড়সড় আফ্রিকান ষড়।” তাড়াতাড়ি আত্মরক্ষায় বলে উঠল শাসা।
সেনটেইনের মন চাইল শাসার কাছে তার অন্য ছেলের খবর নেন। দেখতে কি ওর বাবা একদা যেমন ছিল তেমন সুদর্শন হয়েছে? কিন্তু এর বদলে জানতে চাইলেন, “আর তারপর ও তোমাকে ঠেসে ধরল?”
“আমি প্রায় জিতেই যাচ্ছিলাম।” দৃঢ়কণ্ঠে আত্মপক্ষ সমর্থন করল শাসা, “রক্ত বের করে ওর চোখটাকে সুন্দর করে বুজে দিয়েছি। প্রায় জিতেই গিয়েছিলাম।”
“প্ৰায় কথাটা ততটা ভালো নয়। আমাদের পরিবারে আমরা প্রায় জিতেই ক্ষান্ত হই না, একেবারে জিতে যাই।”
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল শাসা। “নিজের চেয়ে বড় আর শক্তিশালী কারো সাথে জেতা যায় না।”
“তাহলে হাত মুঠি পাকিয়ে লড়তে যাবে না।” ছেলেকে শেখালেন সেনটেইন, “দৌড়ে গিয়ে ওকে সুযোগ দিলে যেন তোমার মুখে একটা মরা মাছ ঢুকিয়ে দিতে পারে।” অপমানে লাল হয়ে উঠল শাসার গাল। “নিজের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর তোমার অস্ত্র আর শর্ত দিয়েই লড়াই করবে। তখনই লড়বে যখন জানবে যে তোমার জয় সুনিশ্চিত।”
মায়ের কথাকে খুব সাবধানে বিভিন্ন দিক থেকে ভেবে দেখল শাসা। “ওর বাবার সাথেও তুমি তাই করেছে, না?” নরম স্বরে জানতে চাইল মায়ের কাছে, ছেলের কথা শুনে চমকে গেলেন সেনটেইন। শাসার দিকে তাকাতেই ঝাঁকুনি খেল ডেইমলার।
দ্রুতহাতে আবার গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনলেন সেনটেইন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। আমি তাই করেছি। আমরা কোর্টনি বুঝেছো? হাত দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে না। আমরা অর্থ, ক্ষমতা আর প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে লড়াই করি। আমাদেরকে তাই কেউ হারাতে পারবে না।”
চুপচাপ খানিক ভাবল শাসা। তারপর আবার হেসে ফেলল। বলল, “ঠিক আছে আমি মনে রাখব। পরেরবার ওর সাথে দেখা হলে তোমার কথা অবশ্যই মনে রাখব।”
কিন্তু মা-ছেলে কেউই জানোনা যে, এই দুই ছেলের আবার দেখা হবে আর তখনো আজ শুরু হওয়া এ দ্বন্দ্বের জের চলতেই থাকবে।
***
সমুদ্রের দিক থেকে আসা বাতাসে পচা মাছের গন্ধ এত তীব্র হয়ে নাকে লাগছে যে লোথার ডি লা রের গলায় ঢুকে যেন অসুস্থ বানিয়ে ফেলল।
চারটি ট্রলার এখনো তাদের জায়গামত থাকলেও কার্গোগুলো আর রূপার মত চকচক করছে না। সারাদিন ফ্যাক্টরি অফিসের জানালার কাছে বসেই কাটিয়ে দিলেন লোথার। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ ট্রলার নাবিক আর প্যাকারদের বেতন তো দিতেই হবে। তাই পুরনো প্যাকার্ড ট্রাক আর সবশেষ অবলম্বন কয়েকটা ফার্নিচার বিক্রি করে দিতে হল। এগুলোই একমাত্র সম্পত্তি যেগুলোর উপর কোর্টনি কোম্পানির কোনো এক্তিয়ার নেই। সোয়াকোপমুন্ড থেকে আসা সেকেন্ড হ্যান্ড ডিলারও কেমন করে যেন দুরাবস্থার গন্ধ পেয়ে গেল; ঠিক শকুনদের মত। ব্যাটা আসবাবগুলোর প্রকৃত মূল্যের অনেক কম লোথারকে গছিয়ে দিয়ে চলে গেল।
নিজের কুটিরের বালির মেঝেতে লুকিয়ে রাখা অর্থ সহযোগে কোনমতে নাবিকদের পারিশ্রমিক শোধ করলেন লোথার। যদিও এখন আর এটা তার দায়িত্ব নয়, কিন্তু এরা তার আপনার জন; ওদের সাথে তো তিনি আর অন্যায় করতে পারেন না!,
“আমি দুঃখিত! জানালা দিয়ে প্রত্যেককে একই কথা বললেন লোথার; কিন্তু কারো চোখের দিকে তাকাতে পারলেন না।
তারপর সবাই চলে যাবার পর অফিসের দরজায় তালা দিয়ে ডেপুটি শেরিফের হাতে চাবি তুলে দিলেন।
এরপর পিতা-পুত্র দুজনে মিলে শেষবারের মত জেটিতে এসে পা ঝুলিয়ে বসে রইলেন। চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে মরা মাছের গন্ধে।
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, পা।” উপরের ঠোঁটে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত নিয়ে বলে উঠল ম্যানফ্রেড, “আমরা এত মাছ ধরেছি, তাহলে তো বড়লোক হয়ে যাবার কথা। কিন্তু এসব কী হয়েছে পা?”
“আমাদেরকে ধোকা দেয়া হয়েছে।” আস্তে করে জানালেন লোথার। এই মুহূর্তটার আগপর্যন্ত মনে কোন রাগ কিংবা তিক্ততা ছিল না, ছিল কেবল অসার এক অনুভূতি। আগেও দুবার গুলি খেয়েছেন। একবার ওমারুরুর রাস্তায় আরেকবার নিজ পুত্রের মায়ের হাতে।
সেবারও এরকমই হয়েছিল। প্রথমে স্থবিরতা; তারপর বহু পরে রাগ আর ব্যথা, এবার কালো ঢেউয়ের মত ধেয়ে এল রাগ। তাতে খানিকটা উপশম হল সেনটেইনের গাঢ় চোখে অপমানের হাসি দেখার জ্বালা।
“আমরা ওদেরকে থামাতে পারি না, পা? জানতে চাইল ম্যানফ্রেড। কিন্তু কেউই বলল না “ওরা” কারা। নিজেদের শত্রুকে দুজনেই চেনে।
প্রচণ্ড রাগের তোড়ে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন লোথার। মাথা নাড়লেন কেবল।
“একটা না একটা পথ নিশ্চয় আছে।” আবারো বলে উঠল ম্যানফ্রেড। “আমাদের শক্তি আছে।” মনে পড়ল হাতের নিচে দুর্বল হয়ে পড়া শাসার কথা। আনমনেই হাত ভাজ করল ছেলেটা, “এটা তো আমাদের, পা। এই জমি আমাদের। ঈশ্বর আমাদেরকে দিয়েছেন। বাইবেলেও তো সে কথাই লেখা আছে।” তার পূর্বসূরিদের মত ম্যানফ্রেডও বাইবেলকে নিজের মত করেই ব্যাখ্যা করেছে।
বাবাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শার্টের হাতা ধরে নাড়া দিল ম্যানফ্রেড, “ঈশ্বর তো এটা আমাদেরকে দিয়েছেন। তাইনা পা?”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন লোথার।
“আর তারপর ওরা আমাদের কাছ থেকে এটা চুরি করে নিয়ে গেছে, পুরো জমি। হীরে, সোনা সবকিছু। এবারে আমাদের নৌকা আর মাছগুলোও নিল। ওদেরকে থামাবার নিশ্চয়ই কোনো পথ আছে।”
“ব্যাপারটা আসলে এত সহজ নয়।” ছেলের কাছে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলেন লোথার। উনি নিজেই তো পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই বললেন, “তুমি যখন বড় হবে নিজেই সবকিছু বুঝতে পারবে ম্যানি।”
বড় হলে ওদেরকে হারাবার পথ ঠিকই বের করে ফেলব।” ম্যানফ্রেড এত জোর দিয়ে কথাটা বলল যে শুকনো ঠোঁট ফেটে রুবির মত লাল ফোঁটা বের হল।
“ওয়েল, বাছা, হয়ত তুমি ঠিকই পারবে।” ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন লোথার।
“দাদার শপথ মনে নেই পা? আমার মনে থাকবে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কখনো শেষ হবে না।”
সূর্য উপসাগরের পানি স্পর্শ না করা পর্যন্ত দু’জনে একসাথে বসে রইলেন। তারপর অন্ধকার নেমে এলে চলে এলেন কুটিরের কাছে। এগোতেই দেখা গেল চিমনির ধোয়া। হেলে পড়া রান্নাঘরে ঢুকতেই চুলার উপর থেকে চোখ তুলে তাকালেন সোয়ার্ট হেনড্রিক।
“ইহুদিটা টেবিল-চেয়ার নিয়ে গেলেও আমি মগ আর পাতিলগুলো সরিয়ে রেখেছি।”
মেঝেতে বসে সকলে মিলে সোজা পাতিল থেকেই খেয়ে নিলেন গমের পরিজ আর শুকনো নোনা মাছ। শেষ না করা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না।
অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন লোথার, “তোমার রয়ে যাবার তো দরকার ছিল না।”
কাঁধ ঝাঁকালেন সোয়ার্ট। “দোকান থেকে কফি আর ডোবাকো কিনে এনেছি। তুমি যে টাকা দিয়েছ তা একেবারে কাটায় কাটায় যথেষ্ট ছিল।”
“আর কিছু নেই। সব শেষ।”
“আগেও তো হয়েছে এমন।” আগুনের লাকড়ি থেকে পাইপ ধরালেন সোয়ার্ট।
এবারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবার আর কোনো আইভরি নেই, শিকারের জন্য কিংবা-” অন্ধ রাগে আবারো দিশেহারা বোধ করলেন লোথার। টিনের মগে কফি ভরে দিলেন সোয়ার্ট।
“বেশ অদ্ভুত লাগছে।” বলে উঠলেন হেনড্রিক, “আমরা যখন ওকে খুঁজে পেয়েছিলাম পরনে ছিল চামড়ার পোশাক আর এখন দেখো বড়সড় হলুদ গাড়ি নিয়ে এসেছে।” মাথা নেড়ে মিটিমিটি হাসলেন, “অথচ দেখো এখন আমাদেরই পরনে ছেঁড়া ত্যানা।”
“তুমি আর আমি মিলেই তো ওকে বাঁচালাম।” বলে উঠলেন লোথার, “তার চেয়েও বড় কথা, ওর জন্য হিরে খুঁজে দিলাম, মাটি খুঁড়ে এত কষ্ট করে খুঁজে বের করলাম।”
“এখন তো সে ধনী হয়ে গেছে। এবারে বললেন হেনড্রিক, “অথচ আমাদের যা আছে তাও নিতে এসেছে। এটা করা উচিত হয়নি। বিশাল কালো মাথাটা নেড়ে বললেন, “নাহ, এটা একেবারেই ঠিক হয়নি।”
আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসলেন লোথার। সাগ্রহে সামনে ঝুঁকলেন হেনড্রিক। অতঃপর প্রথম বারের মত হাসল ম্যানফ্রেন্ড।
“ইয়েস।” হাসতে শুরু করলেন হেনড্রিক। “এবারে কী তাহলে?”
“না, আইভরি নয়। এবার হবে হিরে।” উত্তর দিলেন লোথার।
“হিরে?” হেনড্রিক আরেকটু হলে হোঁচট খাচ্ছিলেন। “কোন হিরে?”
“কোন হিরে?” হেসে ফেললেন লোথার। জ্বলে উঠল তার হলুদ চোখ জোড়া, “কেন ওর জন্য যে খুঁজে পেয়েছি সেসব হিরে।”
“ওর হিরে?” একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন হেনড্রিক, “হানি খনির হিরে?”
“তোমার কাছে কত টাকা আছে?”
লোথারের কথা শুনে চোখ সরু করে ফেললেন হেনড্রিক। “আমি তোমাকে ভালোভাবেই চিনি।” অধৈর্য ভঙ্গিতে হেনড্রিকের কাঁধে চাপ দিলেন লোথার, “তুমি সব সময় খানিকটা সরিয়ে রাখো। কত আছে?”
“বেশি নয়।” হেনড়িক উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই চেপে বসিয়ে দিলেন লোথার।
“শেষ সিজনে তুমি ভালোই কামাই করেছে। আমি তোমাকে কত দিয়েছি তার পাই পয়সা পর্যন্ত আমার হিসাব আছে।”
“পঞ্চাশ পাউন্ড।” স্বীকার করলেন হেনড্রিক।
“না।” মাথা নাড়লেন লোথার, “তার চেয়েও বেশি আছে।”
“হ্যাঁ, হয়ত আরেকটু বেশি। আবার মেনে নিলেন হেনড্রিক।
“তোমার কাছে একশ’ পাউন্ড আছে।” যেন পুরোপুরি নিশ্চিত এমনভাবে জানালেন লোথার, “এইটুকুই আমাদের দরকার। আমাকে দাও। তুমি জানো এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ফেরত পাবে। আগেও তাই পেয়েছো ভবিষতেও পাবে।
***
প্রভাতের প্রমম আলোয় খাড়া পাথুরে পথটা বেয়ে বহুকষ্টে উপরে উঠে এল পুরো দল। লিসবিক নদীর তীরে, পর্বতের একেবারে তলদেশে ইয়েলো ডেইমলারকে রেখে প্রভাতের এই ভূতের মত ধূসর আলোয় পেরিয়ে এসেছে পাহাড়।
দলের একেবারে প্রথমে দু’জন বুড়োকে দেখলে মনে হবে অর্থনৈতিক মহামন্দার দিনে আজকাল এরকম হরহামেশাই রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায়, কমদামি পোশাক পরনে, অর্ধাহারে বেরিয়ে গেছে শরীরের হাড়।
কিন্তু না, বুড়ো দু’জনের সবচেয়ে লম্বাজন ব্রিটিশ রাজত্বের নাইট কম্যান্ডার অব দ্য অর্ডার। সেই সাথে প্রখ্যাত সামরিক ইতিহাসবিদও বটে।
“বুড়ো গ্যারি” স্যার গ্যারিক কোর্টনির বদলে সংক্ষিপ্ত স্বরেই ডাকলেন তার সঙ্গী। “আমাদের মানুষগুলো মাটি ছেড়ে শহরে ভিড় করছে।” টেবিল মাউন্টেনের উপর প্রায় ২০০০ ফুট পার হয়ে এলেও বাতাসের তোড়ে ভেসে গেল না কথা।
“এটাই হল বিপর্যয়ের রেসিপি।” সম্মত হলেন স্যার গ্যারিক। “খামারে থাকাকালীন দরিদ্র থাকলেও শহরে উপোস করে মরবে। আর জানোই তো অনাহারী মানুষ কতটা ভয়ংকর হয়। ইতিহাস তো তাই বলে।”
স্যার গ্যারিকের সঙ্গী আকারেই ছোটখাটো। তবে তার মত ধনবান নন। ট্রান্সভ্যালে ছোট্ট একটা খামার আছে আর গ্যারি নিজের ভাগ্য সম্পর্কে যতটা উদাসীন এ লোকটা নিজের দেনা সম্পর্কেও ততটাই উদাসীন। যদিও পৃথিবীর প্রথম সারির পনেরটা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে জাত সবচেয়ে বুদ্ধিমান, জ্ঞানী আর প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। পূর্বে প্রধানমন্ত্রী থাকলেও বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা। নিজেকে তিনি প্রয়োজনের খাতিরে সৈন্য আর রাজনীতিবিদের বদলে বৃক্ষপ্রেমী হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশি।
“অন্যদের জন্য অপেক্ষা করা উচিত।” পাথুরে একখানা প্লাটফর্মের উপর হেলান দিলেন, জেনারেল জ্যান সুটস্।
তাদের একশ কদম নিচে পথ বেয়ে উঠছে, এক রমণী।
“আমার ছোট্ট সোনাপাখি” প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেখে বলে উঠলেন স্যার গ্যারি। চৌদ্দ বছর সম্পর্ক শেষে মাত্র ছয়মাস হল তার বেডরুমে ঠাই পেয়েছে এই নারী।
“তাড়াতাড়ি করো অ্যানা।” তাগাদা দিল পেছনের ছেলেটা। “উপরে যেতে যেতে দুপুর হয়ে যাবে, আমি ক্ষিধেয় মরছি।” শাসা অ্যানার সমান লম্বা হলেও তার মত মোটা গড়ন নয়।
“যাও, তুমিই তাহলে আগে যাও।” ঘোঁত ঘোত করে উঠল অ্যানা। “কেন যে মানুষ এত বড় পাহাড়ে উঠতে চায়”।
“দাঁড়াও আমি সাহায্য করছি” বলেই লেডি কোর্টনির বিশালাকার পশ্চাদ্দেশে ধাক্কা দিল শাসা, “আরো জোরে হেইয়ো”।
“থামো তো দুষ্ট ছেলে।” হঠাৎ গতি বাড়ায় হাঁপাচ্ছে অ্যানা।
লেডি কোর্টনি হবার আগে অ্যানা ছিল শাসার নার্স আর ওর মায়ের সবচেয়ে পছন্দের পরিচারিকা। কিন্তু হঠাৎ করেই সামাজিক পদমর্যাদার মত করেই বদলে গেছে তাদের সম্পর্ক।
“এই যে তোমার বিশেষ ডেলিভারি নিয়ে এসেছি!” নানার দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দিল শাসা। এই সুদর্শন ছেলেটা আর লাল-মুখো নারীই গ্যারির সবচেয়ে বড় সম্পদ।
“এই পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে আমি লাঞ্চের তদারক করলেই ভালো হয়।” জেনারেল সুটের দিকে তাকিয়ে আফ্রিকান ভাষায় জানতে চাইল অ্যানা, “আর কতদূর?”
“আর বেশি দেরি নেই লেডি কোর্টনি। আহ! ওই তো বাকিরাও এসে পড়েছে। আমি শুধু শুধু চিন্তা করছিলাম।”
বহু নিচের ঢালের জঙ্গলের কিনার দিয়ে উদয় হলেন সেনটেইন আর তার দল।
স্যার গ্যারিক কোর্টনির জন্মদিনে টেবিল মাউন্টেনের এই বাৎসরিক পিকনিক মোটামুটি পারিবারিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। আর তার পুরনো বন্ধু জেনারেল স্যুটও কখনো মিস্ করেন না এই উপলক্ষ।
চূড়ায় পৌঁছে ঘাসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে দম নিল সবাই। অন্যদের কাছ থেকে খানিকটা পৃথকে বসেছেন সেনটেইন আর বুড়ো জেনারেল। তিনিই আগে কথা বললেন, “তো সেনটেইন মাই ডিয়ার, তুমি যেন কী নিয়ে কথা বলতে চাইছিলে?”
আপনি সত্যিই মনের কথা পড়তে পারেন ওড বাস।” বিষণ্ণভাবে হাসলেন সেনটেইন, কীভাবে পারেন বলুন তো?”
“আজকাল তরুণী কেউ পাশে এসে বসলেই বুঝতে পারি যে কোনো কাজ আছে; আনন্দের মতলবে নিশ্চয়ই আসেনি।” পিটপিট করে তাকালেন মুট।
“আমার দেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষদের একজন হলেন আপনি”।
“আহ, আহ, কী বলো! যাই হোক শুনে ভালোই লাগল। কিন্তু নিশ্চয়ই জরুরি কিছু।”
বদলে গেল সেনটেইনের অভিব্যক্তি। সহজভাবে জানালেন, “ব্যাপারটা শাসাকে নিয়ে।”
“কোনো সমস্যা তো দেখছি না, নাকি আমার ভুল হচ্ছে?”
স্কার্ট পকেটের ভেতর থেকে একপাতা একটা কাগজ বের করে জেনারেলের হাতে দিলেন সেনটেইন। অ্যামবোস করা সিলমোহর দেখে বোঝা যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের রিপোর্ট।
সেনটেইন জানেন জেনারেল কত দ্রুত যে কোনো কাগজ পড়ে ফেলতে পারেন। এমনকি শেষ লাইনটাও পড়ে ফেললেন : “মাইকেল শাসা তার নিজের এবং বিশপদের জন্য অত্যন্ত গর্ব বয়ে এনেছে।”
সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন জেনারেল, “তুমি নিশ্চয়ই ছেলেকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করছে।”
“ওই আমার সবকিছু।”
“আমি জানি। আর এটা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। তোমার সন্তান কয়েক দিন পরেই পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়ে নিজের জীবন গুছাতে চাইবে। যাই হোক, এখন বলল আমি কীভাবে সাহায্য করবো?”
“ও অনেক মেধাবী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন; সবার সাথে চমৎকারভাবে মিশতে পারে। তাই আমি ওকে সংসদে দেখতে চাই।”
মাথা থেকে পানামা টুপি নামিয়ে হাতের তালু দিয়ে রুপালি চুলগুলোকে আঁচড়ালেন জেনারেল, “আমার তো মনে হয় সংসদে যাবার আগে ওর পড়াশোনা শেষ করা উচিত, তাই না ডিয়ার?”
“হুম তাই। আমিও এটাই জানতে চাইছি। ওকে কি অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজে পাঠাবো? নাকি তাহলে পরবর্তীতে নির্বাচনে দাঁড়াতে সমস্যা হবে? নাকি স্থানীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবো?”
“ঠিক আছে। এ ব্যাপারে ভেবে তোমাকে পরে জানাবো সেনটেইন। কিন্তু তার আগে তোমাকে মানসিকভাবে দৃঢ় হবার জন্য পরামর্শ দিতে চাই।”
“প্লিজ, ওড বাস” অনুনয়ের ভঙ্গিতে জানালেন সেনটেইন, “আপনার পরামর্শের মূল্য-” শেষ হবার আগেই জেনারেল বললেন,
“শাসাকে ঠিক করতে হবে ওর সত্যিকারের গৃহ কোনটা। যদি সমুদ্রের ওপার হয় তাহলে আমার সহায়তার তো কোনো দরকার নেই।”
“আমি কী বোকা” জেনারেলের চোখে পড়ল সেনটেইনের আত্মধিক্কার। সোয়েতপিয়েল। ব্যাপারটা আর কৌতুকের পর্যায়ে নেই।
“এরকম আর কখনো হবে না।” জেনারেলের হাতে হাত রাখলেন সেনটেইন, “আপনি ওকে সাহায্য করবেন না?”
এমন সময় দূর থেকে শাসা ডেকে বলল, “নাশতা করব না মা?”
“ঠিক আছে, ঝুড়ি নিয়ে এসো।” সেনটেইন, “আপনার উপর ভরসা করতে পারি তো?”
“আমি তো বিরোধী দলে আছি সেনটেইন”
“খুব বেশিদিন তো থাকবেন না। পরবর্তী নির্বাচনেই দেশ এ ভুল শুধরেদেবে।”
“বুঝতেই পারছো আমি এখনই কিছু প্রমিজ করতে পারছি না। সাবধানে শব্দ বাছাই করলেন জেনারেল, “তবে ওর প্রতি আমার নজর থাকবে। যদি দেখি ও সবগুলো শর্ত পূরণ করছে তাহলে আমার সমর্থন অবশ্যই পাবে।”
আনন্দ আর স্বস্তিতে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন সেনটেইন। জেনারেল সহজভাবে জানালেন, “আমার সরকারের আমলে শন কোর্টনি অত্যন্ত দক্ষ মন্ত্রী ছিল।”
নামটা শোনার সাথে সাথে বহু গোপন আনন্দ আর বিষাদের স্মৃতি স্মরণ করলেন সেনটেইন। যাই হোক জেনারেল এসবের কিছুই খেয়াল করলেন না। বললেন, “তাই কখনো আরেকজন কোর্টনি পেলেও মন্দ হবে না।”
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সেনটেইনকেও উঠতে সাহায্য করলেন। একটু পরে সবার ভোজনে সন্তুষ্ট হয়ে সেনটেইনের জেনারেল ম্যানেজারদের একজন সিরিল স্লেইন ঘোষণা করলেন, “যাক! নামার সময় ঝুড়ির ওজন কম হবে।”
“এখন সবাইকে ওঠার আদেশ দিলেন জেনারেল, “আজ দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করা হবে।
“সবাই তৈরি হও।” বালিকার মতই চপল হয়ে উঠলেন সেনটেইন।
একেবারে প্রথমেই হাঁটতে লাগলেন জেনারেল। কেবলমাত্র শাসাই তার সাথে তালে তাল মিলিয়ে এগোতে পারল। নিচে পড়ে রইল পুরো পৃথিবী। ধূসর চূড়ার একেবারে কিনার বেয়ে উঠে গেল সবাই। এমন জায়গায় এসে থামল যেখানে পাথুরে সংকীর্ণ উপত্যকার ঠোঁটের কাছে মাটিতে আকর্ণ হয়ে আছে উজ্জ্বল সবুজ ঘাস।
“এই তো আমরা চলে এসেছি। প্রথম যে ডিসা খুঁজে পাবে তাকে ছয় পেন্স দেয়া হবে।”
জেনারেলের ঘোষণা শুনেই উপত্যকার খাড়া কিনার দিয়ে ছুটে গেল শাসা। একটু পরেই উত্তেজিত হয়ে চিৎকার শুরু করল,
“পেয়েছি! সিক্স পেন্স এখন আমার!”
সবাই মিলে ওর কাছে এগিয়ে গেল।
অত্যন্ত ভঙ্গি সহকারে এক হাঁটু গেড়ে বসলেন জেনারেল।
“এটা সত্যিই একটা নীল ডিসা। দুনিয়ার সবচেয়ে রেয়ার ফুলগুলোর একটা; যা কেবলমাত্র টেবিল মাউন্টেনেই পাওয়া যায়।”
চোখ তুলে শাসার দিকে তাকালেন, “এই বছর নানার প্রতি সম্মান জানাবার দায়িত্বটা কি তুমি নেবে ইয়াং ম্যান?”
গাম্ভীর্য নিয়ে এগিয়ে এল শাসা। তারপর বুনো অর্কিডটা তুলে স্যার গ্যারিকে দিল। নীল ডিসা প্রদানের এ ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতাও জন্মদিনের উৎসবের অনুষঙ্গ। আনন্দের সাথে হাততালি দিল সবাই।
পুত্রগর্বে গর্বিত সেনটেইনের মনে পড়ে গেল ছেলেটার পৃথিবীতে আসার ঘটনা। বুড়ো বুশম্যান ওর নাম রেখেছেন শাসা। কালাহারির গভীরে পবিত্র উপত্যকায় শাসার জন্য নিজে রচিত গীত গেয়ে নৃত্যও করেছেন। কথাগুলো এখনো কানে বাজে :
তার তীর উঠে যাবে তারার পানে
যখন লোকে তার কথা বলবে
তা ততদূরেও শোনা যাবে,
আর একদিন ওই খুঁজে পাবে সুমিষ্ট জল।
সেনটেইনের চোখের সামনে ভেসে উঠল বহুদিন আগেই পরলোকগত বুশম্যানের চেহারা। বুকের গভীর থেকে ফিসফিস করে বলে উঠল, “তাই যেন হয়, তাই যেন হয়।”
***
ফিরে আসার সময় সবাই মিলে ডেইমলারেই চড়ে বসল।
বনের আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাবার সময় পেছনের সিট থেকে মাকে উৎসাহ দিল শাসা, “কামঅন মম। তুমি আরো স্পিড় তুলতে পারবে।”
সেনটেইনের পাশেই টুপি আকড়ে বসে আছেন জেনারেল।
এস্টেটের বিশাল ত্রিকোণাকার মেইন গেইট দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন সেনটেইন। বিখ্যাত ভাস্করের হাতে গড়া আঙুর হাতে নৃত্যরত বনপরীদের ভাস্কর্যের সাথে এস্টেটের নামও লেখা আছে উজ্জ্বল অক্ষরে :
ওয়েল্টেভেদেন-১৭৯০
আস্তে করে ডেইমলারের গতি কমিয়ে আনলেন সেনটেইন। অজুহাত হিসেবে জেনারেলকে শোনালেন, “আঙুরগুলোর উপর ধুলা পড়তে দিতে চাই না।” চোখের সামনে সারি সারি আঙুর ফলের বাগান দেখে বাড়ির নামের সার্থকতা উপলব্ধি করলেন জেনারেল।
দুইশ একর আঙুর ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা মূল দুর্গের দিকে চলে গেছে।
বিশাল বাড়িটার চারপাশে উজ্জ্বল কিকুড ঘাসের লন। এর মাঝখানে কর্মচারীদের বেল টাওয়ার। এর পেছনেই মূল দালান।
গাড়ি দেখে ইতিমধ্যেই চলে এসেছে সব পরিচারক।
“দেড়টা বাজে লাঞ্চ হবে।” সংক্ষিপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন সেনটেইন। ওড় বাস, স্যার গ্যারি আপনাকে তার লেটেস্ট চ্যাপটার পড়ে শোনাবে। শাসা তুমি কি করবে?”
পালানোর চেষ্টা করতেই মায়ের হাতে ধরা খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাসা। কোনোমতে বলল, “জ্যাক আর আমি নতুন টাট্ট ঘোড়াটাকে নিয়ে সময় কাটাবো।”
“ম্যাডাম ক্লেয়ার তোমার জন্য অপেক্ষা করবেন। গণিতে তো আরেকটু মন দেয়া উচিত তাই না?”
“ওহ, মা, এখন তো ছুটি।”
“তুমি যখন অলস সময় কাটাবে তখন কেউ হয়ত কঠোর পরিশ্রম করবে আর যখন সময় আসবে তখন তোমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে।”
“ইয়েস।” সাহায্যের আশায় নানার দিকে তাকাল শাসা।
“আরে, নানুভাই, গণিতের ম্যাডাম চলে গেলেই মা তোমাকে কয়েকঘণ্টা ছুটি দেবে। কারণ এখন তো সত্যিই ছুটি।”
মেয়ের দিকে আশা নিয়ে তাকালেন স্যার গ্যারি।
“আমিও আমার ইয়াং ক্লায়েন্টের হয়ে আর্জি জানাতে চাই।” জেনারেলের কথা শুনে হেসে ফেললেন সেনটেইন।
“ঠিক আছে। কিন্তু আগে টিচার।”
পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিরস বদনে ম্যাডামের কাছে ছুটল শাসা।
“তো চলো” সিরিলের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন সেনটেইন, “কাজ করা যাক।”
জোড়া কাঠের সদর দরজা ঠেলে শেষ মাথার স্টাডিতে চলে এলেন সেনটেইন। পুরুষ সেক্রেটারির দল এখানেই অপেক্ষা করছে। সবাই বেশ তরুণ আর সুদর্শন। ফুলে ফুলে ভরে আছে স্টাডি। রোজ নতুন ফুল তুলে ফ্লাওয়ার ভাসে রাখাটাই তার রীতি।
চতুর্দশ লুইসের লম্বা টেবিলটাকে ডেস্ক হিসেবে ব্যবহার করেন সেনটেইন। চারপাশে পৃথক পৃথক রূপার ফ্রেমে ঝুলছে শাসার পিতার ডজন ডজন ছবি। একেবারে শেষের ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে সিঙ্গেল সিটার স্কাউট প্লেটের সামনে নিজ স্কোয়াড্রনের পাইলটদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মাইকেল কোটান। চামড়ার চেয়ারে বসে খানিকটা হেলে পড়া ছবিটাকে ঠিক করে দিলেন সেনটেইন।
“আমি পুরো কনট্রাকটটা পড়ে দেখেছি।” মুখোমুখি চেয়ারে বসল সিরিল। কিন্তু দুটি অনুচ্ছেদ মনঃপূত হয়নি। প্রথমটা হল ছাব্বিশ।” বাধ্য ছেলের মত পাতা উল্টালো সিরিল। দু’পাশে দাঁড়ানো মনোযোগী সেক্রেটারির দল নিয়ে দিনের কাজ শুরু করলেন সেনটেইন।
সব সময় হানি খনি দিয়েই কাজ শুরু হয়। এ সময় মনে হয় যেন কালাহারির বিশালতায় আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন সেনটেইন। আনন্দচিত্তে ভাবলেন, “কাল আমি আর শাসা আবার সেখানে যাবো।” এরপর একেবারে শেষ ডকুমেন্টে সাইন করে দিয়ে এগিয়ে গেলেন খোলা ফ্রেঞ্চ দরজার দিকে।
নিচে পরিচারকদের কোয়ার্টারের পেছনে জক মারফি’র সাথে টাটু ঘোড়া নিয়ে খেলছে শাসা।
ঘোড়াটা বেশ বড়সড়। মাত্র কয়েকদিন আগেই ঘোড়ার আকার থেকে সীমারেখার নীতি তুলে নিয়েছে আন্তর্জাতিক পোলো অ্যাসোসিয়েশন। বয়স কম হলেও এখনই শক্ত হয়ে বসে দৃঢ়তার সাথে পোলো অনুশীলনে দক্ষ হয়ে উঠেছে শাসা।
জক মারফিকেও সেনটেইনই খুঁজে এনেছেন। এর আগে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছে জক: রয়্যাল মেরিন, পেশাদার কুস্তিগির, মাদক বহনকারী আরো কত কী। এখন সেই শাসার শারীরিক প্রশিক্ষক। শাসাকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসে জক।
কেবল প্রতি তিন মাসে একবার হুইস্কি খেলে হয়ে উঠে আস্ত একটা শয়তান। ফলে সেনটেইনকে পুলিশ স্টেশনে লোক পাঠিয়ে জককে ছাড়িয়ে আনাতে হয়। প্রতিবার একই ঘটনা। বুকের উপর ঝুলতে থাকে ডার্বি হ্যাট, লজ্জায় চকচক করে ওঠে টাক মাথা আর আকুতি জানিয়ে বলে,
“আর কখনো এমন হবে না। আমাকে আরেকটা সুযোগ দিন, কথা দিচ্ছি আর এরকম করব না।”
***
একজন মানুষের দুর্বল দিক সম্পর্কে জেনে রাখা খুবই প্রয়োজন। লাগাম টেনে তাকে রুখে দেয়া যাবে আবার ইচ্ছেমত চালানোও যাবে।
উইন্ডহকেও কোনো কাজ পাওয়া গেল না। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো ট্রাক আর ওয়াগনে লিফট প্রার্থনা করে অবশেষে শহরতলীতে পৌঁছালো তিনজনে।
এখানকার তাবুর মাঝে ভালো জায়গাগুলো আগেই দখল হয়ে গেছে। কোনোরকমে একটা গাছের নিচে ঠাই মিলল। আগুনের পাশে বসে গরম পানিতে গম ঠেলে যৎসামান্য খাবার বানাবার চেষ্টা করছেন সোয়ার্ট হেনড্রিক। শহরে কাজ খুঁজতে গিয়েও হতাশ হয়ে ফিরে এসেছেন লোথার।
“ম্যানফ্রেড কোথায়?”
চিবুক উঁচিয়ে কাছের একটা চালাঘরের দিকে নির্দেশ করলেন হেনড্রিক। মন্ত্রমুগ্ধের মতন লম্বা দাঁড়িঅলা এক লোকের কথা শুনছে ডজনখানেক ভবঘুরে।
“ম্যাল উইলেম” বিড়বিড় করলেন হেনড্রিক, “পাগল উইলিয়াম” ছেলেকে খুঁজলেন লোথার। অন্যদের মাঝে দেখা গেল ম্যানফ্রেডের উজ্জ্বল সোনালি চুল।
এরপর নিজে পাইপ ধরিয়ে হেনড্রিকের দিকে ছুঁড়ে দিলেন তামাক পাতা।
“তুমি কী পেলে?” দিন আর রাতের বেশিরভাগ সময় উইন্ডহকের ওপাশে কৃষ্ণাঙ্গদের বস্তিতেই কাটান হেনড্রিক। কেননা কারো গোপন কথা জানলে, তার পরিচারকেরাই হতে পারে শ্রেষ্ঠ উৎস।
“কী খুঁজে পেয়েছি জানো, কেউ তোমাকে ফ্রি ড্রিংক দেবে না আর উইন্ডহকের পরিচারিকাদেরকে তো কেবল ভালোবাসার কথা বলে কিছুতেই কাবু করা যাবে না।” দাঁত বের করে হাসলেন হেনড্রিক।
থু, মুখ থেকে তামাকের পিক ফেলে ছেলের দিকে তাকালেন লোথার। ক্যাম্পে নিজ বয়সীদের ছেড়ে বয়স্ক পুরুষদের সাথে ওর মেশার আগ্রহ দেখে খানিকটা চিন্তা হচ্ছে।
“আর কী?” হেনড্রিকের কাছে জানতে চাইলেন লোথার। “লোকটার নাম ফুরি। গত দশ বছর ধরে খনিতে কাজ করছে। প্রতি সপ্তাহে চার-পাঁচটা ট্রাক নিয়ে আসে আর তারপর মাল বোঝাই করে চলে যায়।”
“বলে যাও।”
“আরো আছে। প্রতি মাসের প্রথম সোমবার পেছনে চারজন ড্রাইভার নিয়ে ছোট্ট একটা ট্রাকে চড়ে যায়। সবার কাছেই শটগান আর পিস্তল থাকে। সোজা মেইন স্ট্রিটের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে যায়। ফুরি আর আরেকজন ড্রাইভার ট্রাক থেকে ছোট্ট একটা লোথার বক্স নিয়ে ম্যানেজারের হাতে দেয়। এরপর ফুরি আর তার সঙ্গী মিলে বারে গিয়ে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পান করে। সকালে আবার খনিতে ফিরে যায়।”
“মাসে একবার।” আপন মনেই ফিসফিস করলেন লোথার।
“পুরো মাসের উৎপাদন একবারেই পাওয়া যাবে।” তিক্ত কণ্ঠে হেসে ছেলেকে ডাকলেন, “ম্যানফ্রেড!”
বাবা এসেছে এতক্ষণ টের পায়নি ম্যানফ্রেড। তাই এবার অপরাধীর ভঙ্গিতে উঠে এল। বাবার পাশে এসে পা ভাজ করে বসতেই ঘন দুধ দিয়ে পরিজ দিলেন সোয়ার্ট।
“পাপা তুমি জানো জোহানেসবার্গের সোনার খনিতে যে ইহুদি মালিকেরা একটা নাটক রচনা করেছে?” চকচকে চোখে জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“কী?” জানতে চাইলেন লোথার।
“অর্থনৈতিক মন্দা।” মাত্রই শেখা শব্দটাকে বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করল ম্যানফ্রেড। “ইহুদি আর ইংরেজরা মিলে এমনটা করেছে যেন বিনামূল্যে তাদের খনি আর ফ্যাক্টরিতে কাজ করার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায়।”
“তাই নাকি?” পরিজ খেতে গিয়ে হেসে ফেললেন লোথার। “খরাটাও কি তাদের তৈরি নাকি?” ইংরেজবিরোধী হলেও তার বিদ্বেষ কখনো যুক্তির সীমানা পার হয় না।
“হ্যাঁ সেটাও, পাপা!” তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ম্যানফ্রেড। “ওম উইলেম আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। পেছনের পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ বের করে কোলের ওপর বিছিয়ে বসল। বলল, “এই দেখো”।
তারপর আফ্রিকান ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের পিতৃভূমি’, কাটুনটার ওপর বুড়ো আঙুল রেখে বলল, “দেখো ইহুদিরা আমাদের সাথে কী করছে!”
কার্টুনের প্রধান চরিত্রটার নাম “হগেনহেইমার” পকেটভর্তি পাঁচ পাউন্ডের নোট নিয়ে মাল বোঝাই ওয়াগনে চাবুক চালিয়ে দূরের সোনার খনি’ লেখা টাওয়ারের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ওয়াগনে আঁড়ের বদলে মানুষ জুড়ে দিয়েছে টানার জন্য। হগেনহেইমারের চাবুকের নিচে নিষ্পেষিত হচ্ছে সারি সারি হাড় সর্ব, অনাহারী নারী-পুরুষের দল।
মিটিমিটি হেসে কাগজটাকে ছেলের হাতে ফিরিয়ে দিলেন লোথার। তিনি কয়েকজন ইহুদিকে জানেন যারা সকলেই বেশ পরিশ্রমী আর সাধারণ মানুষ; দরিদ্র আর উপোস করেই দিন কাটায়।
“জীবন যদি এত সহজ হত…” মাথা নাড়লেন লোথার।
“সত্যিই তাই, পাপা! আমাদেরকে কেবল ইহুদিদেরকে তাড়িয়ে দিতে হবে, ব্যস। ওম উইলেম সব বুঝিয়ে দিয়েছেন।”
লোথার উত্তর দেবার জন্য মুখ খুলতেই বুঝতে পারলেন যে তাদের খাবারের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ক্যাম্পের জনাতিনেক ছেলে-মেয়ে এসে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। তাই ভুলে গেলেন কার্টুনের কথা।
তিনজনের মধ্যে বারো বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে। শীতকালের কালাহারির ঘাসের মত দুলছে ওর লম্বা বিনুনি। কিন্তু রোগা হওয়ায় হাড় আর চোখ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।
মেয়েটার স্কার্ট ধরে রেখেছে আরো দু’জন ছোট্ট বাচ্চা। একটা ছেলে একটা মেয়ে।
চোখ সরিয়ে নিলেন লোথার। হঠাৎ করেই খাবারের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে গেছে। তাকিয়ে দেখলেন হেনড্রিকের এদিকে নজর নেই আর ম্যানফ্রেড এখনো একমনে কাগজটা দেখছে।
“ওদেরকে খাবার দিলে দেখা যাবে ক্যাম্পের সব বাচ্চা চলে এসেছে এখানে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে জনসমক্ষে আর না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন লোথার।
“কেবল রাতে খাবার জন্য আরেকটু অবশিষ্ট আছে। তাই ওদেরকে ভাগ দেয়া যাবে না।”
কিন্তু মুখের কাছে চামচ তুলতে গিয়েও থেমে গেলেন লোথার। মেয়েটার দিকে তাকাতেই লাজুক ভঙ্গিতে এগিয়ে এল কাছে।
“নিয়ে যাও। কর্কশ কণ্ঠে আদেশ দিলেন লোথার।
“ধন্যবাদ, আংকেল” ফিসফিস করে উঠল মেয়েটা, “ডানকি ওম।”
তারপর প্লেটটাকে স্কার্টের নিচে লুকিয়ে ঘোট দুই ভাইবোনকে টানতে টানতে চালাঘরগুলোর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।
আবার একঘন্টা পরে ফিরে এল। প্লেট আর চামচ সুন্দর করে ধুয়েও এনেছে। “ওমের কোনো শার্ট বা কিছু ধুয়ে দিতে হবে?” জানতে চাইল মেয়েটা।
লোথার ব্যাগ খুলে নিজের আর ম্যানফ্রেডের মাটি মাখানো কাপড় বের করে দিলেন। সূর্যাস্তের সময় ফেরত দিয়ে গেল মেয়েটা। কার্বোলিক সাবানের খানিকটা গন্ধ থাকলেও পরিচ্ছন্নভাবে ভাজ করে নিয়ে এসেছে সবগুলো কাপড়।
“সরি, ওম, আমার কাছে ইস্ত্রি নেই।”
“তোমার নাম কী?” হঠাৎ করেই জানতে চাইল ম্যানফ্রেড। চারপাশে তাকিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটা। তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সারাহ।”
***
পরিষ্কার শার্ট গায়ে দিয়ে বোম আটকালেন লোথার। তারপর আদেশ দিলেন, “আমাকে দশ শিলিং দাও।”
“কেউ যদি শুনতে পায় যে আমার কাছে এত টাকা আছে তাহলে নির্ঘাত এসে গলা কাটবে।” ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠলেন হেনড্রিক।
“তুমি খালি খালি আমার সময় নষ্ট করছে।”
“একমাত্র এই জিনিসটাই তো আমাদের কাছে অফুরন্ত আছে।”
সুইং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন লোথার। কোনার দিকে বারম্যানসহ মাত্র তিনজন লোক দেখা যাচ্ছে।
“আজ রাত তো দেখি বেশ নিশ্চুপ।” বিয়ারের অর্ডার দিলেন লোথার। ছোট-খাটো বারম্যানের মাথায় সাদা চুল আর চোখে স্টিলের ফ্রেমের চশমা।
“তোমার জন্যও একটা নাও।” লোথারের প্রস্তাব শুনে বদলে গেল বারম্যানের অভিব্যক্তি।
“আমি জিন নিচ্ছি, ধন্যবাদ।” কাউন্টারের নিচ থেকে স্পেশ্যাল একটা বোতল বের করল লোকটা। দুজনেই জানে যে বর্ণহীন পানিটা আসলে সাদা পানি আর এই শিলিংয়ের পুরোটাই বারম্যানের পকেটে যাবে।
তারপর দুজনেই সুস্বাস্থ্যের কামনায় মদ গিলে অলসের মত বসে বসে খানিক গল্পও করল। বারম্যান হঠাৎ করে জানতে চাইল, “কতদিন হল শহরে এসেছেন? আগে দেখিনি তো।”
“এসেছি আর কি একদিন, বহু আগে।” হেসে ফেললেন লোথার, “আচ্ছা তোমার নামটা যেন কী?” এইবার লোথারের নাম শুনে বারম্যান সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠল।
“এই যে শুনছো” বারের অন্য কাস্টমারদের উদ্দেশে গলা চড়ালো বারম্যান, “জানো এ কে? লোথার ডি লা রে! মনে নেই সেই যে যুদ্ধের সময়ে পুরস্কারের ঘোষণা? সেই তো রুনিকিদের কলজে ভেঙে দিয়েছিল।” রুনিকি কিংবা “লাল গলা” বলতে রোদে পোড়া নতুন আগত ইংরেজদেরকে বোঝানো হত। “খোদা, ওই তো জেমস-কফনটেইনে ট্রেন উড়িয়ে দিয়েছিল।”
সবাই এতটা উদ্বেলিত হয়ে উঠল যে, একজন তো লোথারকে আরেকটা বিয়ারই কিনে দিল।
“আমি আসলে কাজের সন্ধান করছি।” খানিকের মাঝেই বন্ধু হয়ে যাওয়া বাকিদেরকে জানালেন লোথার।
“শুনেছি হানি’র খনিতে নাকি কাজ পাওয়া যাবে। বাকিরা হেসে ফেলল।
“তাহলে আমি ঠিকই জানতে পারব। প্রতি সপ্তাহে সেখানকার ড্রাইভারেরা এখানে আসে।” আশ্বস্ত করল বারম্যান।
“আমার সম্পর্কে বলবে তাহলে?” জানতে চাইলেন লোথার।
“নিশ্চয়ই। সোমবারে এসো। চিপ ড্রাইভার গার্যাড ফুরি’র সাথে মোলাকাত করিয়ে দেব। আমার বন্ধুও হয়। ওখানকার সবকিছু জানে।”
সম্পর্ক ভালো হয়ে যাওয়ায় চার রাত পরে লোথার আবার বারে যাওয়ার সাথে সাথেই আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাল বারম্যান। “বারের একেবারে শেষ মাথায় ফুরি বসে আছে। অন্যদেরকে সার্ভ করা শেষ করেই আমি তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেব।”
পুরো বার ভিড়ে লোকারণ্য থাকায় বসে বসে ড্রাইভারকে স্টাডি করলেন লোথার। মধ্যবয়স্ক আর শক্তিশালী লোকটাকে মনে হচ্ছে খুব সহজে ভয় দেখানো যাবে না। তবে কোন পথে এগোবেন তা এখনো ঠিক করেননি লোথার।
ফুরির কাছে নিয়ে গেল বারম্যান। “আমার বন্ধুর সাথে পরিচিত হও।” লোথার আর ফুরি করমর্দন করলেন। প্রথমেই শক্তি প্রয়োগ করতে চাইল ফুরি। একে অন্যের চোখের দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর লোথারের হাত থেকে নিজের হাত বের করার জন্য কুঁকড়ে উঠল। লোথারও আর ঝামেলা করলেন না। ছেড়ে দিলেন।
“তোমার জন্য ড্রিংক আনতে বলেছি।” এখন বেশ সহজ বোধ করছেন লোথার। তাছাড়া একটু পরে বারম্যানের মুখে যুদ্ধের সময়ে লোথারের কীর্তি শুনে ফুরির আচরণও পুরোপুরি নরম হয়ে গেল।
একটু পরে লোথারকে একপাশে টেনে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “এরিক বলেছে তুমি নাকি হানির খনিতে কাজ খুঁজছ? তাহলে সবকিছু ভুলে যাও। বছরখানেকের মধ্যে তারা আর কোনো নতুন লোক নেবে না।”
“হ্যা” মনমরা হয়ে মাথা নাড়লেন লোথার, “এরিককে জিজ্ঞেস করার পর খনি সম্পর্কে সত্য কথাটা জানতে পেরেছি। পরে তোমাদের সবার জন্যও ব্যাপারটা খারাপ হবে।”
অস্বস্তিতে পড়ে গেল ড্রাইভার, “কী বলছ তুমি? কোন সত্য?”
“কেন আমি তো ভেবেছি তুমি জানো।” লোথার যেন লোকটার অজ্ঞতায় বেশ মজা পেলেন।
“ওরা আগস্টের মধ্যেই খনি বন্ধ করে সবাইকে তাড়িয়ে দেবে।”
“কী বলো, ওহ ঈশ্বর, না!” ফুরির চোখে ভয় দেখা গেল, “এটা সত্যি হতে পারে না।” ওমা লোকটাকে তো দেখি সহজেই প্রভাবিত করা গেল। মনে মনে সন্তুষ্ট হলেন লোথার।
“আমি দুঃখিত কিন্তু সত্যটা জানা থাকা ভালো। তাই না?”
“তোমাকে কে বলেছে?” প্রতি সপ্তাহে শহরে আসার সময় রেলওয়ের তাবুতে বেকার লোকদের দুর্দশা দেখেছে ফুরি। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তাই।
“আব্রাহামের কাজ করে এমন এক নারীকে চিনি। কেপটাউনে মিসেস কোর্টনির কাছে আসা চিঠি দেখেই জেনেছে যে আর কোনো ভুল নেই। খনিটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা আর ডায়মন্ড, বেচতে পারছে না। লন্ডন, নিউইয়র্কের কেউও আর হীরে কিনছে না।” আব্রাহাম হল খনির অ্যাটর্নি।
“ওহ, ঈশ্বর! ঈশ্বর!” ফিসফিসিয়ে উঠল ফুরি, “আমাদের কী হবে তাহলে? আমার স্ত্রীর শরীরও ভালো না। আমার ছয় বাচ্চা তো তাহলে উপোস করে থাকবে।”
“তোমার নিশ্চয় কয়েকশ’ জমানো আছে। তাই না?”
মাথা নাড়ল ফুরি।
“যদি না থাকে তাহলে আগস্ট আসার আগেই কিছু জমাও।”
“বাচ্চা নিয়ে কীভাবে জমাবো?” অসহায়ের মত জানতে চাইল ফুরি।
“তাহলে চলো, বলছি কীভাবে পারবে। এক বোতল ব্র্যান্ডিও কিনে নিচ্ছি।” বন্ধুর মত ফুরির হাত ধরলেন লোথার।
পরের দিন সূর্যোদয়েরও পরে ক্যাম্পের নিজ ঘরে ফিরে এলেন। ড্রাইভার লোখারের প্রস্তাব মেনে নিলেও খানিকটা ভয় আর দ্বিধায় ভুগছে।
প্রতিটি পয়েন্ট ধরে ধরে বুঝিয়ে আশ্বাস দিলেন লোথার। “আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি যে কেউ তোমার কথা জানতেই পারবে না।”
হেনড্রিকের পাশে ধপ করে বসে পড়লেন ক্লান্ত লোথার।
“কফি?”
“শেষ হয়ে গেছে।” জানালেন হেনড্রিক।
“ম্যানফ্রেড কোথায়?”
চিবুক উঁচু করে দেখালেন হেনড্রিক। ক্যাম্পের শেষ মাথায় একটা কাটা ঝোঁপের পাশে বসে আছে ছেলেটা। পাশে সারাহ। দুজনে দুই মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে কোনো একটা কাগজ দেখছে। ক্যাম্প ফায়ারের কয়লা দিয়ে পেন্সিল বানিয়ে কী যেন লিখছে ম্যানফ্রেড।
“ও মেয়েটাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে।”
নির্ঘুম লাল চোখ জোড়া ঘসলেন লোথার। জানালেন, “কাজ হয়ে গেছে।”
“আহ!” অট্টহাসি দিলেন হেনড্রিক।
“এখন তাহলে ঘোড়ার জোগাড় করতে হবে।”
.
একদা সিসিল রোডস্ আর দি বিয়ারস ডায়মন্ড কোম্পানির প্রাইভেট রেলওয়ে কোচকে একবারে স্বল্পমূল্যে কিনে নিয়েছেন সেনটেইন। তারপর প্যারিস থেকে নিয়ে আসা ডিজাইনার দিয়ে ডেকোরেশন করিয়েছেন। দেখে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে একমত হবে যে ডিজাইনারকে দেয়া প্রতিটি পয়সা উশুল হয়েছে।
কোচের মেইন বেডরুম স্যুইটের গোলাকার বেড দেখে আপন মনে হেসে ফেললেন সেনটেইন। সচকিত হয়ে দেখলেন যে শাসা তাকিয়ে আছে।
“জানো মা, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তোমার চোখ দেখলে কী ভাবছ তা আমি বুঝতে পারি।” আগেও কয়েকবার এ কথাটা বলেছে শাসা।
“আর আমি আশা করছি যেন না পারো।” কেঁপে উঠলেন সেনটেইন। “বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।” ডিজাইনার যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করে স্যালুনের বাতাস ঠাণ্ডা রাখার জন্য মেশিন বসিয়েছেন। “এটা বন্ধ করে দাও তো।”
ডেস্ক থেকে দাঁড়িয়ে দরজা ঠেলে কোচের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন সেনটেইন। মুখ উপরে তুলতেই মরুভূমির উষ্ণ বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেল খাটো করে কাটা চুল।
“কয়টা বাজে?” চোখ বন্ধ রেখে জানতে চাইলেন সেনটেইন। মায়ের পিছু পিছু এসে ব্যালকনির রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল শাসা। এবার জানাল, ইঞ্জিন ডাইভার শিডিউলমত এগুলে দশ মিনিটের মধ্যে অরেঞ্জ নদী পার হব।”
“অরেঞ্জ পার হলেই মনে হয় যেন ঘরে পৌঁছে গেছি।” ছেলের কাছে এসে গায়ের উপর হাত রাখলেন সেনটেইন। উত্তমাশা অন্তরীপ জার্মান কলনীর সীমানা এই নদীকে কেউ কেউ আবার দক্ষিণের নীল নামে ডাকে।
কয়েকবার কেঁপে উঠে ট্রেনের গতি ধীর করে ফেলল ড্রাইভার।
“ব্রিজের জন্য গতি কমানো হয়েছে।” শাসা ব্যালকনি দিয়ে নিচে ঝুঁকতেই ধক করে উঠল সেনটেইনের বুক। সাথে সাথে বাধা দিতে গিয়েও মনে পড়ে গেল জক মারফি’র পরামর্শ, “ওকে তো আপনি চিরকাল শিশু করে রাখতে পারবেন না। আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে আর এখন পুরুষকে অনেক ধরনের ঝুঁকিই নিতে হয়।”
নদীর দিকে চলে গেছে আঁকাবাঁকা রাস্তা। লোকোমোটিভের পেছনের সমতল রাস্তায় ডেইমলারটাও দেখা যাচ্ছে। এটা একেবারে নতুন। সেনটেইন প্রতি বছর গাড়ি বদল করেন। ট্রেনে আসায় মরুভূমির ঝাঁকুনির হাত থেকে বাঁচা গেছে; কিন্তু মাইনে কোনো রেলপথ নেই।
“ওই তো ব্রিজ চলে এসেছে!” চিৎকার দিয়ে উঠল শাসা।
“হিরের নদী শাসার সমান্তরালে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন।
“হিরে কোথা থেকে আসে?” উত্তরটা শাসা জানলেও মায়ের মুখ থেকে শুনতেই বেশি ভালোবাসে।
“নদী তার পথিমধ্যে প্রাপ্ত সবগুলোকে একসাথে জড়ো করে। এমনকি মহাদেশের জন্মমুহূর্তে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বাতাসে ভেসে বেড়ানো কণাগুলো পর্যন্ত। তারপর উপকূলে বয়ে নিয়ে আসে।” চোখের কোনা দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন সেনটেইন। “বলো তো এগুলো অন্য পাথরের মত ক্ষয়ে যায় না কেন?”
“কারণ হিরে প্রকৃতির সবচেয়ে কঠিন পদার্থ। কোনোকিছুই হিরের গায়ে দাগ কাটতে পারে না।” দ্রুতকণ্ঠে উত্তর দিল শাসা।
“এতটা শক্ত কিংবা এতটা সুন্দর আর কিছুই নেই।” ডান হাত তুলে আঙুলের বিশাল মারকুইস হিরেটা ছেলেকে দেখালেন সেনটেইন, “তুমি এগুলোকে অবশ্যই ভালোবেসে ফেলবে। যেই এগুলোকে নিয়ে কাজ করবে, ভালোবাসতে বাধ্য।”
“নদী” মাকে মনে করিয়ে দিল শাসা। “নদীটা সম্পর্কে বলো।” মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতেই অসম্ভব ভালোবাসে।
“সমুদ্রের দিকে যাবার সময় সৈকতে নিজের হিরেগুলোকে রেখে যায় নদী। তাই হিরেভর্তি সৈকত নিষিদ্ধ এলাকা হয়।”
“ফলের বাগান থেকে পকেটে ফল নেয়ার মত করে হিরে কুড়ানো যায়?”
“ব্যাপারটা এত সহজ নয়।” হেসে ফেললেন সেনটেইন। “তুমি বিশ বছর ধরে খুঁজে একটাও পাথর পাবে না, যদি না জানো যে কোথায় খুঁজতে হবে। সাথে ভাগ্যও থাকা চাই।”
“তাহলে আমরা যেতে পারি না কেন মা?”
“কারণ সবই স্যার আর্নেস্ট ওপেনহেইমার নামে একজনের কোম্পানির সম্পত্তি।”
“একটা কোম্পানি সবকিছুর মালিক। এটা মোটেই ঠিক নয়।” প্রথমবারের মত ছেলের চোখে আকাক্ষার ঝিলিক দেখে খুশি হয়ে উঠলেন সেনটেইন। তিনি ছেলেকে অর্থ আর ক্ষমতার জন্য লোভী হিসেবেই গড়ে তুলতে চান।
“বেশিরভাগ বড় বড় উৎপাদনশীল খনি ছাড়াও উনি প্রতিটি পাথরের বিক্রিও নিয়ন্ত্রণ করেন, এমনকি আমাদের উৎপাদনও।”
“সে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে?, হানি?” লাল হয়ে উঠল শাসার মসৃণ গাল।
মাথা নাড়লেন সেনটেইন। “আমাদের সমস্ত হিরে তার সেন্ট্রাল সেলিং অর্গানাইজেশনের হাতে দিতে হয়। উনি তারপর মূল্য নির্ধারণ করেন।”
“আর আমাদেরকে সেটা মেনে নিতে হয়?”
“না তা একেবারেই নয়। কিন্তু বিপক্ষে যাওয়াটাও বোকামি হবে।”
“তাহলে উনি আমাদের সাথে কী করবেন?”
“শাসা, তোমাকে আগেও কতবার বলেছি যে নিজের চেয়ে শক্তিশালী কারো সাথে লড়াই করবে না। যদিও আমাদের চেয়ে শক্তিশালী খুব কম লোকই আছে; কিন্তু আর্নেস্ট ওপেনহেইমার তাদেরই একজন।”
“বলো না কী করবেন? জেদের স্বরে জানতে চাইল শাসা।
“খেয়ে ফেলবেন বুঝলে। কারণ প্রতি বছর আমরা আরো বেশি ধনী হয়ে উঠছি। তাই যদি আমরা তার এই নদীর কাছে আসতে চাই তাহলে তাকে ভয় তো পেতেই হবে।” হাত নেড়ে নদীটাকে দেখালেন সেনটেইন।
এটার ডাচ আবিষ্কারক নদীটার নাম অরেঞ্জ রাখলেও কমলারঙা বালু তীরের উজ্জ্বলতা দেখলে মনে হয় নামটা পুরোপুরি সার্থক হয়েছে।
“উনি এই নদীর মালিক?”
বিস্মিত হয়ে গেল শাসা।
“আইনত নয়। কিন্তু সাবধানে না থাকলে এই হিরের জন্য উনার ক্রোধের আগুনে তুমি নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবে।”
“তার মানে এখানে হিরে আছে?”
আগ্রহ নিয়ে নদী তীরে চোখ বোলালো শাসা।
“ডং টুয়েন্টিম্যান জোনস আর আমার তো তাই ধারণা। দুইশ মাইল গেলেই একটা ঝরনা আছে যেটাকে বুশম্যানেরা দ্য প্লেস অব গ্রেট নয়েজ বলে ডাকে। এখান থেকে সংকীর্ণ পাথুরে পথ দিয়ে নিচের খাদে বয়ে চলেছে অরেঞ্জ নদী। তাই এই খাদে নিশ্চয়ই হিরে আছে।”
খুব সাবধানে শাসাকে সবকিছু বর্ণনা করছেন সেনটেইন। যে মুহূর্তে ছেলে বিরক্ত হয়ে পড়বে তিনি কথা থামিয়ে দেবেন। শাসাকে কিছুতেই চাপ দিতে চান না। ছেলে যেন নিজের আগ্রহেই মনোযোগ দেয়। খানিক বাদে বললেন,
“চলো স্যালুনের ভেতরটা নিশ্চয় গরম হয়ে গেছে।” শাসাকে ডেস্কের কাছে নিয়ে গেলেন। “আমি তোমাকে কয়েকটা জিনিস দেখাতে চাই।” কোর্টনি মাইনিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল কোম্পানির বাৎসরিক রিপোর্ট খুলে বসলেন সেনটেইন।
এটাই হবে সত্যিকারের কঠিন অংশ। পেপারওয়ার্ক তার নিজেরও ভালো লাগে না আর গণিতে শাসাও একটু কাঁচা।
“তুমি দাবা খেলা পছন্দ করো, তাই না?”
“হ্যাঁ।” খুব সাবধানে সম্মত হল শাসা।
“এটাও তেমনই একটা খেলা। কিন্তু একবার যদি নিয়ম বুঝে ফেলতে পারো তাহলে হাজার গুণ বেশি আনন্দ আর পুরস্কার পাবে।” সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠল শাসা।
“আমাকে নিয়মগুলো বলল তাহলে।”
“একেবারে সবগুলো নয়। অল্প অল্প করে শুরু করা শিখতে হবে।”
এরপর কেটে গেল বহুক্ষণ। সন্ধে নাগাদ ছেলের মুখে ক্লান্তির ছোঁয়া দেখলেও একাগ্রতার কমতি খুঁজে পেলেন না সেনটেইন।
“আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। মোটা ফোল্ডারটাকে বন্ধ করে বললেন, “গোল্ডেন রুলস্ তাহলে কী বলতো?”
বিক্রি করার সময় খরচের চেয়ে বেশি আদায় করতে হবে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি আর উৎসাহ দিলেন সেনটেইন।
“আর অন্যেরা যখন বিক্রি করবে তখন তুমি কিনবে; অন্যেরা যখন কিনবে তখন তুমি বিক্রি করবে।”
“গুড” এবারে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চলো ডিনারের আগে খানিক খোলা বাতাসে দাঁড়ানো যাক।”
কোচের ব্যালকনিতে ছেলের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে জানালেন, “খনিতে যাবার পর ড, টুয়েন্টিম্যান জোনসের সঙ্গে তুমি কাজ করবে। বিকেলবেলা ফ্রি পাবে। আমি চাই তুমি খনি আর এর কাজ সম্পর্কে জানো। তোমাকে পারিশ্রমিক দেব।”
“লাগবে না, মা।”
“আরেকটা গোল্ডেন রুল শোনো মাই ডার্লিং, কখনো কোনো ভালো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে না।”
পুরো রাত আর পরের দিন সারাদিন উত্তরে ছুটে চলল ট্রেন।
“সূর্যাস্তের খানিক পরেই উইন্ডহকে পৌঁছে যাবো।” শাসাকে জানালেন সেনটেইন। “কিন্তু সন্ধ্যায় না নেমে একেবারে সকাল বেলায় খনিতে যাবো। ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস আর আব্রাহাম আমাদের সাথে ডিনার করবেন। চলো তৈরি হয়ে নাও।”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাটারফ্লাই টাই বাঁধতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেল শাসা। এখনো ব্যাপারটা আয়ত্তে আনতে পারেনি। হঠাৎ করেই হুইসেলের আওয়াজ শুনে খোলা জানালার দিকে এগোল।
শহরতলীতে পৌঁছে ট্রেনের গতি ধীর হয়ে গেছে। নাকে আসছে কাঠের ধোয়ার গন্ধ। রেললাইনের ধারের তাবুগুলোও চোখে পড়ছে। চলন্ত ট্রেনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন ছেলে-মেয়ে।
খাটোজন মেয়ে আর তার দিকে শাসা তেমন নজরও দিল না। চমকে উঠল পাশে দাঁড়ানো লম্বা ছেলেটাকে দেখে। আধো অন্ধকারেও একে অপরকে ঠিকই চিনতে পেরেছে। অভিব্যক্তিহীন চোখে পরস্পরকে দেখল সাদা শার্ট, কালো টাই আর নোংরা খাকি পোশাক পরিহিত দু’জন ছেলে।
“ডার্লিং” স্যাপায়ারস পরিহিত মাকে দেখে জানালা থেকে মুখ সরালো শাসা।
ছেলের টাই ঠিক করে দিলেন সেনটেইন। অন্যদিকে নিজের ভেতরের রাগ দমন করতে গিয়ে হিমশিম খেলো শাসা।
***