১. লাশগুলোকে নামানো হচ্ছিল

ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস – উপন্যাস – মলয় রায়চৌধুরী

উৎসর্গ : বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায়

এক       

         লাশগুলোকে নামানো হচ্ছিল হোসপাইপ কেটে থামানো পাটনামুখো দরোজা-জানলাহীন, টয়লেটের পাল্লাহীন গয়া প্যাসেঞ্জারের অন্ধকার লাগেজ ভ্যান থেকে, একের পর এক আদুল-গা তামাটে পুরুষের পেশিদার শরীর, মহিলাদের ঘোমটামোড়া দেহ, ঠাণ্ডা কাঠ, পূণ্যলাভের জন্য পুড়তে যাবে গঙ্গায়, আর এই লেভেল ক্রসিং থেকে একটু দূরত্বে, রাস্তার ধারে ফোলডিং চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে, ল্যাম্পপোস্টের তলায় বসে স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমাণপত্র দিয়ে চলেছে পাটনা মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের পাকাচুল কদমছাঁট চশমাচোখ ডাক্তার সুনীলরঞ্জন নাহাবিশ্বাস ওরফে বিসওয়াসজি, শ্মশানঘাট কাছেই বলে, প্রতিদিন সন্ধ্যার টিমটিমে বিজলি আর কেরোসিন লন্ঠনের আলোয় ফুলকো মেলার জমজমাট ভিড়, আগেভাগে তৈরি তাদের বাঁশের মাচান, ফুল, শাদা আর গোলাপি থানকাপড়, ঠ্যালা, রিকশা, ট্যাকসি, ধুপ, সিঁদুর, খুচরো টাকা পয়সা, খই-বাতাসা, কাতাদড়ি, নাইলন দড়ি, মাটির কলসি । ফিক্সড প্রাইস । কাউকে দরদস্তুর করতে হয় না । বিহারি সংস্কৃতির মড়া পোড়ার যাকিছু।

         পাটনা-গয়া লাইনে দাঙ্গা বা জাতপাত-মারকাট হলে, যখন লাশের সংখ্যা বেড়ে যায়, লেভেল ক্রসিং পেরোতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায় । ট্রেনটার কোনো বরাদ্দ সময় নেই থামার । যতক্ষণ লাশ ততক্ষণ আশ । লেভেল ক্রসিং ছেড়ে প্রচুর সময় লেগে যায় ট্রেনটার, স্টিম এনজিনের ভোপ্পোর ভোঁ কয়লাচুরো উড়িয়ে, কিংবা ডিজেল এনজিনের গরম হলকার ধোঁয়া ভাসিয়ে । বর্ষাকালে জলে ডোবা রাস্তা, গ্রীষ্মে জ্যাম, শীতে শবযাত্রীর শিকারে সস্তার রাঁঢ় ।

         মোটর সাইকেলে বসে যখন বিরক্তি উথলে উঠছিল, ট্রেনটার যাবার অপেক্ষায়, পাশেই এক যুবক হাতি, পেছনের বাঁ পা জিরেন দিচ্ছিল শ্রীকৃষ্ণের কায়দায়, নীহারিকার বর্ণালী থেকে তখন সবে হেমন্ত নামছে স্হানীয় পৃথিবীতে, অদৃশ্য কানামাছি-ওড়ানো শুঁড়ের ধাক্কায়, যেন বিদ্যুৎ দিয়ে গড়ে নরম মাংস, ঘুরে যায় মুণ্ডু, চকিতে হাজার সর্ষেফুল ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়, তারপর গলায় চোঙবাঁধা অবস্হায় নিজেকে খুঁজে পায় সুশান্ত, হাসপাতালে, সরকারি রাজেন্দ্র ব্লকের শতচ্ছিন্ন গয়ের রক্ত পুঁজ মাখা বিছানায়, মাছির দল তার ঠোঁটে বসে ঘুমজাগানিয়া চালিশা শোনাচ্ছিল । হাসপাতাল, তায় সরকারি, পটল অবধারিত জেনে, একহাতে নলসুদ্দু স্যালাইনের বোতল ঝুলিয়ে বাড়ি কেটে পড়েছিল ও, সুশান্ত, রিকশায় চেপে । বাড়িতে ধুদ্ধুমার । অনেককাল লেগে গিয়েছিল সারতে । থানায় গিয়ে মোটর সাইকেলটা নিয়ে এসেছিলেন সুশান্তর বড়োজ্যাঠা, হাতে-টানা ঠ্যালায় চাপিয়ে ।

         বিছানায় শুয়ে, গলায় চোঙবাঁধা, কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে, কাকার কাছ থেকে জানতে পেরেছিল সুশান্ত, ওই পালোয়ান হাতিটায় চেপে ইন্দিরা গান্ধি গিয়েছিলেন আক্রান্ত গ্রামের মানুষদের সান্ত্বনা দিতে । এগারোজন তফশিলি মানুষের সাফায়া করে দিয়েছিল পিছড়াবর্গের কুরমি জাতের মহাবীর আর পরশুরাম মাহাতো, যাদের পরে ফাঁসি হয়েছিল । সীতারাম মাহাতো, সিরি মাহাতো, রামকিশুন মাহাতো, রাজেন্দর মোচি, নেপালি, সিমন, বলদেও আর কেশব মাহাতোর কুড়ি বছরের জেল । কিন্তু কালীচরণ, দাসো পাসোয়ান, রামচন্দর মোচি, মহাবীর মাঝি, শ্রবণ পাসওয়ান, রাজো পাসওয়ানদের  প্রতি একজন মৃত প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসভঙ্গের আক্রোশ হাতিটা চাপিয়ে দিলে ওর, সুশান্তর, ঘাড়ে !

         মুচি মাল্লা শুঁড়িদের হাতে যে-সব দেড়-দু একর জমির কাগজ ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল, তার মালিক ওই কুরমিরা জেল থেকে তেল, কাপড়, চিনি, টাকা ফি মাসে পাঠাচ্ছে নিজের নিজের বাড়ি ; জমি কেনাকাটা চলছে, অথচ মুসহর দুসাধ চামার আর তেলিরা সুযোগ পেলেই গ্রাম ছেড়ে পাটনা, জ্ঞাতি খুঁজেপেতে কলকাতা । গ্রামে একটা পুলিশ ফাঁড়ি বসিয়ে কর্তাবাবারা নিশ্চিন্ত ।

         বেলছির পর যখন পারসবিঘায় গোলমাল হল, লাগেজ ভ্যান থেকে লাশ নামাতে সময় লেগেছিল বেশ, মনে আছে সুশান্তর । রামাশিষ, হরিভগত, শ্যামনারায়ণ প্রসাদ, রামস্বরূপ, সিয়ারাম, কিসমিসিয়া দেবী, হরমণিকুয়ারি, গুলাবিয়া দেবী, পতিয়া দেবী, আর শ্যামপেয়ারিদের জলজ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল নিরঞ্জন শর্মার ছোটো ভাই মদন শর্মা । তারপর থেকে ভূমিহার আর নিচুজাতের খুনোখুনি । খুনোখুনিতে ঝামরে নষ্ট হয়ে গেছে সবুজ গ্রামের পর সবুজ গ্রাম । এই সব গ্রামে রোদ্দুরেরও শীত করে । কনসারা, দরমিয়া, নোনহি-নগওঁয়া, মলবরিয়া, দনওয়র-বিহটা, মিনবরসিমা, বারা– উড়ন্ত ধুলোয় মানুষহীন প্রান্তর, সাপের পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে সন্দেহময় শুকনো পাতায় পদক্ষেপ । লেঠেল-ঘেরা পাকা ধানের খেত । পাড়ভাঙা যেমন নদীর মুদ্রাদোষ, তেমন সুশান্তর এই লাশ-নামানো-মেলা দেখা, মাঝে-মধ্যে সান্ধ্যকালীন নেশা ।

         সুশান্তর চেহারা অবাঙালি । পাঁচফুটের ফর্সা গালফোলা ঘাড়েগর্দান কোঁকড়াচুল চনমনে । গলায় চোঙ বেঁধে হালকা কাজের বিভাগে কিছুকাল কাটাবার পর পৌঁছেছিল অতনুদের ত্যাঁদড়া-কর্মী বিভাগে । ঘোষ বলে অফিসে জাতপাতের বিভাজনে ও দুধিয়া ঘোষ, মানে গয়লা, যাদব, বিহারি যাদব কর্মীরা নিজেরাই ওকে কৃষ্ণায়ত যাদব বানিয়ে দিয়েছে, কংসায়ত যাদবে ফ্যালেনি । অথচ মুঙ্গেরের পিপারিয়ে গ্রামে, যেখানে ওদের প্রচুর জমিজমা, ঘোষ হবার দরুণ সেখানে যাওয়া, ফসল তোলানো, এতোয়ারি হাটের খাজনা তোলা সব বন্ধ । বাবার ঠাকুর্দা, মানে ঠাকুর্দার বাবা, হাইকোর্টে, তখন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা লড়তে যেতে হতো, ভূমিহার রাজনাথ সিংকে ফৌজদারি মামলায় জিতিয়ে দেয়ায়, মুঙ্গেরের রোমহর্ষক দিয়ারায় দুশো একর জমি, আর সাত একর আনাজ-বাগান, আর এতোয়ারি হাট ওর ঠাকুর্দার নামে করে দিয়েছিল । সুশান্ত যায়নি কখনও পিপারিয়ে । ছোটোবেলায় চাল মুসুর অড়র ভুট্টা সর্ষে পটল কচি তরমুজ আম আর হাটের টাকা আসত । তারপর ওখানে  কৈলু যাদব, কজ্জল ধানুকদের অপহরণের দল এমন জ্বালাতন আরম্ভ করলে যে সেসব জমিজমা এখন কাদের হাতে তা শুধু কানাঘুষায়, কোনো যাদব ছিটকে পাটনায় এলে, তার মুখে ভাসাভাসা জানা যায় । বাংগালি-তাংগালি বলে, সুশান্তরা আর সেখানে পাত্তা পায় না । লোকমুখে প্রচারও করে দেয়া হয়েছে যে কোনো বাংগালি ঘোষবাবু এলে তার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়া হবে।

         দিয়ারা, দ্বীপের মতন গঙ্গার চর, জেগে ওঠে, থাকে বছরের পর বছর, বেগুসরায় মুঙ্গের থেকে নদীর কিনারে-কিনারে ভাগলপুর কাটিহার ওব্দি । এক জায়গায় ডুবে আরেক জায়গায় কুমিরের পিঠের মতন ভেসে ওঠে অনেক সময়ে, খেলা করা অজস্র মানুষের সুখশান্তি নিয়ে, তাদের দুর্ধর্ষ ক্রুর মমতাহীন আতঙ্কিত করে রাখে আজীবন, ভালা বরছি গঁড়াসা ভোজালি পাইপগান কট্টা তমঞ্চা দিয়ে । ঢেউরা দিনেরাতে হাসি বিলোয় ।

মেদিনি পুলিশফাঁড়ির সুরজগড়হার কাছে হুসেনা গ্রামের পালোয়ান, কোমরে ঘুনসি, গলায় তাবিজ, থলথলে বুক আর উরধ, কদমছাঁট অধিক যাদব, দুধ বিক্রির ফাঁকে, কিষান-কামিলের নূনতম মজুরির মজুরি আন্দোলন পিষে ফেলার লেঠেল হিসেবে জোতদারেরদের স্যাঙাত থাকতে-থাকতে নিজেরাই আরম্ভ করে দিলে জোরজবরদস্তি জমিজমার দখল নেয়া, কানপুর থেকে চটের থলেতে আসত পিস্তল কারতুজ হাতবোমা দোনল্লা একনল্লা, খড়ের গাদায় লুকোনো, পালতোলা নৌকোয় । সামহো-সোনবরসা কুরহা দিয়ারায় গোটাকতক চাষি ট্যাঁফোঁ করলে, তাদের ডান হাত কেটে গঙ্গায় । নিজেদের হুসেনা গ্রামে পুলিশের ওপর কয়েক ঝাঁক গুলি চালিয়ে ভাগাল । তারা আর ওমুখো হয়নি । মেদিনি ফাঁড়ির পুলিশ ইন্সপেক্টর যতীন্দ্রনাথ সিং ছ’জন কন্সটেবলের শং্গে যখন ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, অধিক যাদব গঁড়াসা দিয়ে চারজনের ভুঁড়ি ফাঁসায় । লাশ নদীতে আর বন্দুকগুলো নিজেদের কব্জায় । পেট চিরে মারাকে শিল্পের পর্যায়ে তুলেছিল । পেট চিরে পূণ্যসলিলা গঙ্গায় ফেলেছিল আরও অনেককে, টুকরো-টুকরো, যেমন পাঁঠার দোকানের মাংস, বেশিরভাগ সীমান্ত চাষি, যেমন অঙ্গদ যাদব, এতোয়ারি মাহাতো, ডুকো মাহাতো, দেবেন মাহাতো, সুধীর মাহাতো । অধিক যাদব মরলে, ওর রাজ্যপাট যায় কৈলু যাদবের হাতে, সে পিপারিয়ে গ্রামের অমৃত যাদবের ছেলে । সুশান্তদের গরদানিবাগের বাড়িতে অমৃত যাদব একবার এসেছিল, চার বছরের খালি-গা ধুলোমাখা কৈলুকে নিয়ে ।

         লখন তাঁতিকে, পুলিশের মুখবির, মানে চর সন্দেহে, কেন তাড়িয়ে-তাড়িয়ে গ্রামবাসীদের চোখের সামনে থেঁতো করে মেরেছিল কৈলু, অফিসের একজন পিওনের কাছে, যে অবসর পাবের পর প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের কিছু টাকায় কিনে, কোনও এক কমবয়সী তরুণীকে বিয়ে করেছিল, তার কাছ থেকে জানতে পেরেছিল সুশান্ত । পরে, মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যস্হতায়, কৈলু যাদব আর ওর প্রতিবেশী দুলারচন্দ্র যাদবের সন্ধি হলে, অপহরণের ব্যবসা আরমভ করে কৈলু । দিয়ারা থেকে দূরে-দূরে ছড়িয়ে পড়ে ব্যবসার আওতা, পাটনা রাঁচি মজফফরপুর লখনউ কানপুর এমনকি দিল্লির রাস্তা থেকেও তুলে আনতে পেরেছিল রওনক আগরওয়ালকে । কৈলুকে সাফায়া করার জন্যে সরকার ‘অপারেশান কোবরা’ চালু করলে, সেই যে ও গা ঢাকা দিয়েছে, খুঁজে পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত ।

কৈলুর জায়গা দখল করেছে কজ্জল ধানুক, আর ধানুকদের নরকে যাওয়া উচিত হবে না ভেবে সুশান্তর বাবা কাকা জ্যাঠারা আর নিজেদের জমিজমা খেতখামার চাষবাস হাটের আয় ইত্যাদির কথা ভুলে গিয়ে ও-মুখো হননি । পিপারিয়াতে ওরা বাংগালি যাদব । বারোটা যাদব বাচ্চাকে একদিন দুপুরে বরছি-ভালা দিয়ে ছিন্নভিন্ন করেছে কজ্জল ধানুক, শুনেছেন ওনারা লোকমুখে । ধানুক বিন্দ আর ভূমিহার এখন একদিকে, যাদবরা অন্যদিকে । লছমিপুর-তৌফির দিয়ারায়, বদলা নেবার জন্যে, গঙ্গার ওপর থেকে ভেসে গিয়ে শীতের কুয়াশা যখন ঘিরে ধরেছে কুঁড়েঘরগুলোকে, যাদবরা দল বেঁধে হামলা করে বিন্দ বাচ্চা বউ বুড়োদের আস্ত রাখা অনুচিত ভেবেছিল ; বিন্দ জোয়ানরা বেঁচে গিয়েছিল কেউ কেউ, অন্ধকারে পিটটান দিয়ে ।

         ঘন সবুজ কচি আমের থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করছিল একটা প্রৌঢ় আমপাতা । গাছের প্রায়ান্ধকার গোড়ায়, আধভিজে উইপোকার মেটেরঙা দেউড়ি । মিহিন আবেগপ্রবণ বিকেল-বাতাস বেড়াতে বেরিয়েছে গোধুলী-বাতাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে । আকাশে দীঘল ফোলাফোলা মেঘ । অনেক দূরে, ওই দিকে, একাধটা ঠুনকো বিদ্যুতের অদৃশ্য আওয়াজ । এখন রূপসী মর্জির বিকেল । অল্পবয়সী খেটে-খাওয়া কয়েকটা কাক চলে গেল দক্ষিণ থেকে উত্তরে । একটু আগে সামনের ছাতিম গাছে যে-চড়াই পাখিগুলো স্হূল রঙ্গরসিকতায় মশগুল রেখেছিল নিজেদের, তারাও এখন ডানা গুটিয়া ঠোঁট গুঁজে চুপচাপ । রাস্তার ওপারে ধনী আর উদার কাঁঠালগাছ । রোদ্দুর বোধহয় গাছের ছায়া মাড়ায় না এ অঞ্চলে । চারিদিকের এমন অতীন্দ্রিয় জগতের আভাস পেয়ে ছোটোখাটো গোলগাল নুড়ির দল উদাসীন শুয়ে আছে কালভার্টের তলাকার ছিপছিপে নালার কিনার বরাবর ।

কালভার্টের ওপর বসে, ধূসরিত কাহিল পা ঝুলিয়ে, আনমনে এইসব দেখছিল অতনু । যে লজঝড়ে বাসটা পাটনা থেকে ভোর পাঁচটায় ছেড়েছিল, তা থেকে এই অজ দিগন্তে নেমে পড়েছে ও । সৌন্দর্য সৃষ্টির আকুতিতে মগ্ন  আসন্ন বিকেল-গোধূলির স্নেহময় আকাশ, বাসের জানালায় থতমত বাতাস, বাধ্য করেছিল ওকে এইখানে নেমে পড়তে । সেই তখনই জড়সড়ভাব এসে গিয়েছিল স্হানীয় রোদ্দুরের । একটু পরেই কেয়ারি-করা অন্ধকার গজিয়ে উঠবে ওর চারপাশে, তখন পথ, চলার পথ, দেখা যাবে না বলে হাঁটতে আরম্ভ করবে ও, অতনু । জঙ্গলের কালচে সবুজ মহাফেজখানা পেরিয়ে, গ্রামটা ওইদিকেই ।

         ময়লা বলতে যা বোঝায়, অতনুর গায়ের রঙ তার থেকে এক পোঁচ ফর্সা । দু-চোখ প্রায় সব সময় বরফের বুদবুদ, ভেতরে ভেতরে উসখুসে নদীর মুখচোরা স্রোত । গত অঘ্রাণে তেইশে পড়েছে । নোংরা জামা-কাপড় । টো-টো বেড়ানো চটজলদি পিচপথের ধূসর গন্ধমাখা কোলহাপুরি । হাতঘড়ি পরার অভ্যাস, চুড়ি-চুড়ি মনে হয় বলে, আর সময়ের বাদবিচার না-থাকায়, নেই ওর । এই বয়সেই চুলের কিছুটা চিলতে, ডান ঘেঁষে, পেকে গেছে, দুশ্চিন্তায় নয়, চিন্তাহীনতায় । কখনও যেচে আলাপ করে না, কারোর সঙ্গে অতনু । কম কথা বলে । অনেকক্ষণ টানা কথা বলতে পারে না । খেই হারিয়ে যায় । কথা বলতে-বলতে ওর মনে হয়, এঁর সঙ্গে এসব আলোচনা করার মানে হয় না । তরুণীদের এড়িয়ে চলে । কেউ ওর সঙ্গে কথা বললে, ওর তার সংক্ষিপ্ততম জবাব দ্যায়, হ্যাঁ, না, ও, আচ্ছা, তাই বুঝি, ঠিক আছে, চলি ।

         অতনুর হাতে মানসী বর্মণের গচ্ছিত রাখা বাদামি নরম ফোম রেকসিনের ব্যাগ । কয়েক লক্ষ টাকার নোংরা-হাফনোংরা নোট, আর অসীম পোদ্দারের ডায়েরি আছে তাতে । টাকাগুলো তেকচিটে আধমরা অসুখী । ডায়েরিতে স্বীকৃতি আছে যৌন যথেচ্ছাচার থেকে কুড়োনো রোগের । ব্যাগে টাকার ডাঁই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে , রাত্তিরেই, খাটের তলা থেকে টেনে স্তম্ভিত, এই বেরিয়ে পড়ার নির্ণয় নিয়ে ফেলেছিল ।

দূরের ক্ষণজন্মা বিদ্যুৎগুলো এবার ফুরিয়ে গেছে । মেঘের হাত ধরে ছোটো-ছোটো তারারা গুটিগুটি পায়ে আসছে ওই সংসারে । আলুথালু পোশাক সামলে ঘরে ফিরছে বকযুবতী । একটা লরি চলে গেল হেডলাইটের শানবাঁধানো আলো জ্বেলে । গলা শুকিয়ে ধু-ধু করছিল বলে, এবার উঠে দাঁড়াল অতনু । আনমনা হয়ে উঠেছে চারপাশের বর্তমান । বহুক্ষণ বসে থাকার দরুণ ঠ্যাং দুটি ভঙ্গিসর্বস্ব । আড়মোড়া ভেঙে কিছু-ভারি ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো । উদ্দেশ্যহীন জীবন হয়তো এবার প্রহেলিকাময় হবে । জীবনের মোড় পালটাবার জন্যে তার সামনে বেশ কয়েকটা বিকল্প থেকে যে-কোনো একটা বেছে নিতে হবে ওকে । ক্ষুধা আর স্বার্থের বাইরে জীবনযাপন আছে কি, যেখানে বেঁচে থাকার জন্যে কোনো চাবিকেন্দ্র চাই না !

         যদিও ওরা দেশভাগের উদ্বাস্তু নয়, অতনু কোনো রাজ্যের ভূমিপুত্র হতে পারেনি, তার জন্য দরকার কোনো জায়গায় ন্যুনতম থাকার প্রমাণপত্র ্র বাবার ছিল না স্হির সাকিন আর ঠাকুর্দার ছিল না স্হাবর ধানপাটের তৌজি-মৌজা । কেউই কোথাও থাকেননি বেশিদিন । শেকড় গজিয়ে ফেলতে ভালো লাগত না ওনাদের । সত্যি, একই বাড়িতে, একই পাড়ায়, একই শহরে, একই লোকজনের মাঝে, মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু, বছরের পর বছর, কাটিয়ে দিতে পারে কেউ-কেউ, গর্ব করে অমন মরচেপড়া জীবনযাপন নিয়ে । ভস্মপূঞ্জ জমে যায় না কি তাদের চোখের পাতায় আর ভুরুর চুলে, ভেবেছে অতনু ।

         আচমকা খেয়াল করল অতনু,  অন্ধকারে, যুঁই ফুল তার সুগন্ধ দিয়ে ছড়াচ্ছে আন্তরিকতা । এক হাজার বছর পরেও এই সুগন্ধ থেকে যাবে । কোনো রেশ থাকবে না অতনুর । বাবাও তো থিতু হবার আগেই ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করা নিজের ছেলেকে চাকরিটা পাইয়ে দিয়ে গেলেন । জানতেন ছেলেটা নিজে কিছুই করে উঠতে পারবে না । প্রাতিষ্ঠানিক সমবেদনা । গোড্ডা বিহটা লাহেরিয়াসরায় জপলা বা বকসরের কোনো ছাদহীন মাটির দেয়ালের স্যাঁতসেতে স্কুলে, এই চাকরিটা নে পেলে, অর্ধেক মাইনেতে, চরবাহাদের পড়াতে হতো হিন্দির মাধ্যমে ইংরেজি, ওই ভাষায় স্নতকোত্তর হবার মাশুল । মাইনের আর্ধেক দিয়ে দিতে হতো শিক্ষা বিভাগের সরকারি পেয়াদাদের ।

         বাবা কেন আত্মহত্যা করেছিলেন ? মাও বলতে পারেননি । অতনু তাই দায়টা নিজের চাকরির ওপর চাপিয়ে নিয়েছে ।

         চাকরিটা আসলে কেরানি আর মজুরের দোআঁশলা, শুনতে জমজমাট, ব্যাংকনোট এগজামিনার, টাকাকড়ি পরীক্ষক, অথচ যারা চা কিংবা মদ পরীক্ষা করে, তাদের কতো র‌্যালা । অতনুর কাজ  টাটকা নোট আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি, দশটা প্যাকেটের বাণ্ডিল, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, ঋতুর পর ঋতু, গ্রীষ্মের পর বর্ষা, বর্ষার পর শরৎ, শরতের পর হেমন্ত, হেমন্তের পর শীত, শীতের পর বসন্ত, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর, বাছাই ছাঁটাই, গোনার পর ভালো নোটগুলো চলে যায়  ব্যাংকে আর ট্রেজারিতে । পচা নোটগুলোয় গোল-গোল চাকতির মতন গোটাকতক ছ্যাঁদা, ঝপাং ঝপাং ডাইস দিয়ে করার পর, নোটগুলো মরে গিয়ে অচল হয়ে গেছে ভেবে, যাতে আবার না বেঁচে উঠে ব্যবহৃত হয়, ছ্যাঁদা-ছ্যাঁদা নোটের প্যাকেট আর ঝরে পড়া গোল চাকতি, বস্তাবন্দি সিলমারা চটের থলেতে চলে যায় অন্য বিভাগে পুড়ে ছাই হবার জন্যে ।

         প্রথম দিকে অতনু, তেএঁটে ফাঁকিবাজ হবার আগে, এদেশের ভার্জিন কর্মচারীদের যেমন হয়, মন আর সততা খরচ করে, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করত, গুনত, পচা নোটগুলোই কেবল নষ্ট করাত গোল-চাকতি ছ্যাঁদা করিয়ে । সহকর্মীরা ধমকাতে আরম্ভ করেছিল ; আর হুমকি দিয়েছিল ভাজপা, জদ, ইনকা, সপা ইউনিয়ানের কত্তারা । কে আর সৎ হয়ে প্যাঁদানি খায় ! ভালো নোট হোক খারাপ নোট ওক, পচা হোক বা আনকোরা, প্যাকেটের সবকটা টাকাকে, প্রতিটি, অতনু পচা ছাপ মেরে নষ্ট করিয়েছে । কমিয়ে ফেলেছিল কাজের চাপ । সৎ হবার ফালতু বোঝা, নোয়ম মেনে চলার লাফড়া, প্যাকেট খোলার আর ঝঞ্ঝাট নেই । দরকার নেই গোনার । এহাতে প্যাকেট নাও, ছ্যাঁদা করাও, নিজের কোড চিহ্ণ দাও শেষ নোটে, এবার তুলে দাও সহকারি খাজাঞ্চির হাতে, যে নিজের টেবিলে বসে জনর রাখে কেউ গ্যাঁড়াবার তাল করছে কিনা, যদিও দরোজায় চেকিং হয় বেরোবার সময় । অতনুর তাড়াতাড়ি কাজ শেষ, ছুটি, বাড়ি যাও, বা বাইরে বেরিয়ে যা ইচ্ছে করে বেড়াও, সহকারি খাজাঞ্চি খুশি, খাজাঞ্চি খুশি, খুশি সব্বাই, স্মুথ সেইলিং । দশটা-পাঁচটার টুঁটি টেপা চাকরি হয়ে গেল এগারোটা-একটা । না-গোনার মধ্যে ঝুঁকির তড়াস । সে ঝুঁকি সবাই নিচ্ছে । অতনু কেন মাঝখান থেকে সৎ হতে যাবে ! চাকরির জন্যে তো আর কারোর প্রতি দায়বদ্ধতা গজায় না । তাই চাকরিকে চাকরি বলে মনে হচ্ছিল না অতনুর । ভেতো জীবন হয়ে উঠেছিল নিরলস কুঁড়েমিতে মুখর । সেকশানের লোহার জাল দেয়া জানলার বাইরে শিমুল গাছটায়, আহ্লাদে ফেটে পড়া লাল ফুলগুলোয় লুকিয়ে বউ কথা কও পাখি নির্দেশ দিয়েছে অতনুকে, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও, নোট গুনে নাও ।

         অতনুর সহকর্মীরা বসন্তঋতুকে বলে ফগুয়া । গাঁও চলে যায় অনেকে, বউয়ের কাছে । বসন্তঋতু তো বউদেরও ডাক দেয় । কোথায়-কোথায় সেসব গ্রাম । বাসে-ট্রেনে-নৌকোয়-পায়ে হেঁটে কোশের পর কোশ । রোহতাসের কারমু পাহাড় এলাকায়, ভাগলপুরের কহলগাঁও সুলতানগঞ্জ বহিপুরে, সীতামড়হির মানেচওকে, অওরংগাবাদের মদনপুরায়, দলেলচৌক বধৌরায়, চাতরার প্রতাপপুর হাণ্টারগঞ্জ ইটখোরিতে যেখানে খয়েরের চোলাই হয়, জাহানাবাদের আরওয়ালে, বিষ্ণুগঞ্জে, মখদুমপুরে, পোরমগাঁও আর হিঁডিয়ার নকসল্লি মাওওয়াদি জামাতে, নওয়াদা জেলার হিঁসুয়ায়, মুঙ্গেরের শেখপুরায়, কুঁওর সেনা সানলাইট সেনা ব্রহ্মর্ষিসেনা আজাদ সেনা শ্রীকৃষ্ণ সেনাদের বাভন বনিয়া রাজপুত কোইরি কাহার কুরমি আহির গাঁওয়ে, সোনাপাস রুগড়ি সুপাইসায়, কোতওয়ালসায়, তেলাইডি বড়াউরমা সিংগাড়ি লোসোদিকি পিতকলাঁ মাদেউবটা গ্রামে, যেখানে ধুলোবালি ছাড়া আর কিছুই নিজের মনে ঘোরাঘুরি করে না । কোথাও যায়নি অতনু । সহকর্মীরা বলেছে, আবে চল, তনিক হিলাকে-ডোলাকে মৌজমস্তি কর ফগুয়ামেঁ । সেসব গ্রাম দেখতে ইচ্ছে করেছে কিন্তু যেতে ইচ্ছে করেনি অতনুর । পাটনার কাছে-পিঠের বাইরে যায়নি কোথাও ।

         সময় কাটাবার জন্যে একজোড়া কাকাতুয়া কিনেছিল ; আর কিনেছিল শাদাঝুঁটিটার জন্য বাংলা ছড়ার সিডি, আমি হব সকালবেলার পাখি, সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি ।  হলুদঝুঁটির জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের, আমি হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় । ছড়ার বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্যে কেনেনি, কিনেছিল কাকাতুয়া দুটোর জন্য । এত মিঠে গলা পাখিদুটোর, সত্যি । অডিওগুলো না বাজালে, সকাল থেকে গলিতে গালমন্দের যে তারস্বর আদানপ্রদান হয়, তা শিখে ফেলত পাখি দুটো ।

চাপচাপ অসন্তোষ মাখানো, নোংরা তেলচিটে আধমরা পচা টাকার দু-চোখ জুড়োনো রূপে, চাকরির বছর দেড়েকের মাথায়, নিষ্পৃহ হয়েছিল অতনু । অতিশয়োক্তির মতন কোটি-কোটি কেগজের স্যাঁতসেতে ছাতাপড়া নীলসবজে টাকার টিলা । একশো টাকার, পাঁচশো টাকার, হাজার টাকার, পঞ্চাশ কুড়ি দশ পাঁচ টাকা থেকে সারাবছর শুকনোপচা পাতার বুনো জঙ্গুলে গন্ধ । সেসব আদুলগা টাকার সঙ্গে কথা বলা এদানতি বন্ধ করে দিয়েছিল অতনু । মূল্যহীন অঢেল ।

         গলায় চোঙবাঁধা সুশান্ত অতনুর বিভাগে এলে আলাপ । সুশান্তই প্রথম দিন বলেছিল, ‘তোর নাম তো অতনু চক্রবর্তী ? আমি সুশান্ত ঘোষ । দেখেছি তোকে, অমন একা ম্যাদামারা হয়ে পড়ে থাকিস কেন ? চলিস আমাদের বাড়ি, তোর ভাল্লাগবে ।’

         বেলা একটার পর, শেষশীতের দুপুরে, কাজ শেষ হলেই, অফিস ছুটি, সুশান্তর মোটর সাইকেলে । চালাতে শিখে গেল অতনু, ধুতি পরেই, চটি পায়ে । নাটুকে নষ্টকুমার-কুমারীদের মতন, শীতের বসন্তঋতু মেজাজি পাগলাটে ছায়া-চেহারাগুলোর নিঝুম দাপাদাপি, দৃষ্টিতে রক্তমাখা ছুরি নিয়ে তাপটগবগে হলকার পিচগলা গ্রষ্ম, দিলখোলা বর্ষার প্যাচপেছে হাঁটু-কাদা রাস্তা, ছুটেছে দিশেহারা মোটর সাইকেল । কখনও পেছনে সুশান্ত, কখনওবা পেছনে অতনু । পাটনা সাহেব থেকে দানাপুর-খগোল, এরাস্তা-সেগলি-রাজপথ । কিন্তু ধুতি-পাঞ্জাবি থেকে শার্ট-প্যান্টে যেতে পারেনি অতনু । শীতে আলোয়ান । এদিকে সুশান্ত, বিহারি জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভূমিহার কুরমি যারা, কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্হ বিহারি আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান এনেছে । জ্যাকেট জিনস টিশার্ট উইন্ডচিটার, ব্রাণ্ডেড । দপতরের গৃহবধু কর্মীদের নজরে সুশান্ত অবিনশ্বর জাদুখোকন, লিচুকুসুম, মাগ-ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ । গেঁজিয়ে যেতে পারে, চোখে চোখ রেখে, ননস্টপ, যান বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছে হিজড়েতে, সবায়ের অজান্তে ।

         কী হয় অমন কথা-বলাবলিতে, এক্সচেঞ্জ হলে সুশান্তর পাশে চুপচাপ, বাচাল গৃহবধুদের মাঝে ঠায় অপ্রস্তুত, আধ থেকে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, ঠোঁট বন্ধ রেখে হাইতোলা চেপেছে অতনু । মহিলাকর্মীদের বিভাগ আলাদা । তিনটে-চারটে বেজে যাবার ভয়ে, যখন কিনা কাজ সেরে একটায় বাড়ি কেটে পড়া নৈতিক । মহিলাকর্মীরা নাকি সৎভাবে কাজ করে, ইউনিয়ানগুলো ওনাদের টলাতে পারেনি । লম্বা টিকোলো আঙুলে টরটরিয়ে দরকচা নোট গোনে, পচা নোট বাতিল করে, সেগুলোতে ছ্যাঁদা করায়, প্যাকেটের পেছনে যে যার নিজের কোডের ছাপ মারে, কেবল হাফকাটা নোট বাছাই করে ফেরত পাঠায় । মহিলাদের সততার চাবিকেন্দ্র, শরীরের তুলতুলে জায়গাগুলোয় লুকোনো থাকে বলে, এও মনে হয়েছে অতনুর, সৎপুরুষ আর সতীনারীর কী অবাঞ্ছনীয় তফাত । ওনাদের সুখপাঠ্য মুখশ্রী, অম্লমধুর স্তন, দুষ্প্রাপ্য নিতম্বের আদেখলাপনায়, শ্রাবণের বিকৃত-মস্তিষ্ক বুড়িগণ্ডক বা পুনপুন নদীগুলোর মতন, নিজেকে মশগুল আর অনিশ্চিত রেখেছে ভারজিন অতনু ।

গায়কের ইশারায় যেভাবে ধ্বনিপরম্পরা টের পায় তবলাবাদক, তেমনই, নৈশভোজে বেরোনো টিকটিকি যুবকের মতন, মহিলা সহকর্মীদের অবান্তর কথাবার্তা, ভোজপুরি হোক হিন্দি-বাংলায়, বলার জন্যেই বলা, একপলক দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিলেছে সুশান্ত । কোনো যুবতী মুখে রুমাল চেপে থাকলে অতনুর সন্দেহ হয়েছে যে এবার নির্ঘাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরবে সুশান্তকে, এত কাছে কী করে দাঁড়ায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের দূরত্বে !

         –অররে সুশান্তজি, একদম টইয়র লগ রহেঁ হ্যাঁয় আজ !

         –বাঃ, বেশ মানিয়েছে তো লাল সোয়েটারটা হলদে স্কার্ফের সঙ্গে । শিমলা থেকে বুঝি ?

         কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত, আরও স্বচ্ছলতার আপ্রাণে, ট্রাকে করে শীতে দাক্ষিণাত্য থেকে আম, কোংকন থেকে এঁচোড়-কাঁঠাল, গ্রীষ্মে শিমলা থেকে টোম্যাটো কড়াইশুঁটি ফুলকপি, পুণা হায়দ্রাবাদ থেকে ব্রয়লার, রায়গড় থেকে সফেদা, ভুসাওয়াল থেকে কলা এনে ছেড়েছে পাটনা শহরের বাজারে, ওর কাকার সঙ্গে ব্যবসায় । পিপারিয়ার জমিদারি হাতছাড়া হলেও বর্ধমানের মেমারিতে আছে এখনও বসতবাড়ি আর কিছু তৌজি-মৌজা খামার-খতিয়ান । ওদের পারিবারিক কিংবদন্তি অনুযায়ী, ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিলেন নামকরা ঠগি । বাড়ির সবাই এখনও রঙিন রুমাল রাখে । ঠগিদের বংশধর হবার গোপন গর্ব আছে সুশান্তর ।

কৃষিবিজ্ঞান পড়ে নোটপরীক্ষক । এনজিনিয়ার, জীববিজ্ঞানে ডক্টরেট, উচ্চ গণিতে স্নাতকোত্তর, জেনেটিকসে বিশারদ, সংস্কৃতে সান্মানিক স্নাতক, হরেক রকম শিক্ষিতের ছড়াছড়ি এই চাকরিতে, মজুর আর কেরানির এই দোআঁশলা কাজে ; একবার এই এগারোটা-একটার আরামে ঢুকে গেলে বড় একটা বেরিয়ে যায় না কেউ । দশ-বারো বছরের মাথায় কেরানিগিরির সাধারণ বিভাগে পদোন্নতি হলে কাজের ধারা পালটায়, কাজের সময়ও দশটা-পাঁচটায় আটকে পড়ে ।

         অতনুকে ছাড়ে না পচা নোটের জীর্ণ গন্ধ, যে গন্ধে ওর চারিপাশে ঘনিয়েছে দুর্বহ স্বচ্ছ অন্ধকার । পোড়াবার সময়, চুল্লি থেকে ভেসে আসে মড়া পোড়াবার হুবহু, অথচ ছাইয়ের রং সোনালি ! চুল্লিতে নোট ফেলার সময় ননীদা হরিবোল দ্যান, রাণা রামদেও সিং আওয়াজ দিয়ে ওঠে রামনাম সৎ হ্যায় । চাকরির দোটানায় বেশির ভাগ স্বপ্নই স্বল্পপরিসর ।

         উচ্চাকাঙ্খী মহিলাদের তিনজন, যারা পদোন্নতি পেয়ে ইউডি কাউন্টার আলোকিত করে, যদিও জোচ্চুরির ওই ঘেমো অঞ্চলে পুরুষদের  একচ্ছত্র, কেননা জনগণের বেহুদা কিচাইন, টু-পাইস অফুরন্ত, খুল্লম খুল্লা । একটাকা দুটাকা পাঁচটাকার তরতাজা করকরে নোটের আনকোরা প্যাকেট, দশ-কুড়ি টাকা বেশিতে ঝাড়া যায়, বিয়ের মরশুমে প্রায় দ্বিগুণ, হাতজোড় কন্যাদায়গ্রস্তের কাতার । জোড়াতালি, তাপ্পি, ছেঁড়া, উইচাটা, ঝুরঝুরে, তেলচিটে, ছাতাপড়া, কাহিল, ভ্যাপসা নোট, যেগুলো কেউ নিতে চায় না, ছুঁতে চায় না, কুষ্ঠরোগাক্রান্ত, সেগুলো নিয়ে হাজিরা দ্যায় মুচকিমুখ দালালরা, আবডাল হলেই যারা মনে-মনে আর ফিসফিসিয়ে মাদারচোদ গধে-কা-লণ্ড রণ্ডি-কে-অওলাদ ভোঁসড়ি-কে-জনা কুত্তে-কা-চুত আওড়ায়, অতনুর সুশান্তর মানসী বর্মণের অসীম পোদ্দারের দপতরের উদ্দেশে, কাউন্টারের টেলরদের উদ্দেশে । দালালরা বাঁধা কমিশন হাতপাচার করে । দালালগুলো, কাউন্টারে কিউ দেবার জন্যে অফিসের সিকিউরিটির পালোয়ানদের টাকা খাওয়ায়, কেননা কিউতে প্রতিদিনের বরাদ্দ কেবল চল্লিশজন । ভিজিল্যান্স ধরেছিল সিকিউরিটে অফিসারকে, শর্ট সারভিস কমিশনের সেনাক্যাপ্টেন, সে ব্যাটা এখন ট্রান্সফার হয়ে ত্রিভান্দ্রম না নাগপুরে ।

         কতরকমের নোট যোগাড় করে আনে দালাল নোট-বদলকারীরা । এত সূক্ষ্ম জোড়াতালি, শাদা চোখে টের পাওয়া যায় না কিচ্ছু । অফিসাররা পরখ করার জন্যে টেবিলের ওপর এনামেলের গামলায় ছাড়লে, কিছুক্ষণে আলাদা হয়ে ছিতরে যায় তাপ্পি দেয়া জোড়াতালি নোট । হয়তো দুকোণের সংখ্যাগুলো আলাদা, আদ্দেক আসলের সঙ্গে জোড়া আদ্দেক নকল, কিংবা কুড়ি টাকায় দুটাকার তাপ্পি, পাঁচশো টাকায় পাঁচ টাকা, সাতটা একশো টাকার নানা টুকরো জুড়ে একটা আস্ত । চিনে ছাপিয়ে এনে পাকিস্তানিরা নকল নোট ভারতের বাজারে ছাড়ার পর কিচাইন বেড়েছে । দালালগুলো আলট্রাভায়োলেট আলোর যন্ত্র কিনে যাচাই করে নেয় নোটগুলো নকল পাকিস্তানি না আসল ভারতীয় । পাকিস্তানি নোট হলে পুলিশের প্যাঁদানি, জেলহাজত, হুজ্জোতের শেষ নেই ।

আসল নোট যত বেশি পচা, যত বেশি নষ্ট, আবদার তত বেশি, পরিবর্তে অনুমোদিত টাটকা নোট পাবার নিয়ম তত খুঁতখুঁতে, পাশ করার অফিসারের পাদানি তত উঁচু ।

         জুড়ে-জুড়ে কাঠ হয়ে গেছে যেসব নোটের প্যাকেট-বাণ্ডিল, গায়ে গা সেঁটে আলাদা হতে চায় না, উইচাটা থিকথিকে, গ্রামীণ আটচালায় ছিল সোঁদা দেয়ালবন্দি, খামার বাড়ির মাটির অযাচিত গভীরে কলসিবদ্ধ, গাছতলায় পোঁতা গোমোট কাঠের বাক্সে, আত্মহত্যাকারিনীর সঙ্গে জ্বলে আধখাক বা আধসেঁকা ঝুরঝুরে, চেহারা পালটে কাগজ না নোট বোঝার উপায় নেই, এসেছে হয়তো জেলা মুজফফরপুরের মিঠুনপুরা মোহোল্লার রমইরাম বিধায়কের রক্ষিতার বাড়ি থেকে ঘুষের ফাউ, ধানবাদের এ এস পি রেজি ডুংডুঙের ধরা ব্যংক ডাকাতের বস্তা থেকে, সন্ত কানেশ্বরের অমরপুরী আশ্রমের তহখানায় বহুকাল লুকোনো, সে-সব বহুরূপী নোট পাস করেন আরও বড়ো সায়েব । দালালদের বরাদ্দ খাতিরে হাফসায়েব ছোটোসায়েব বড়োসায়েবরা দিনকানা । কোন অফিসের কোন বড়ো সায়েবের দুর্বলতা ঠিক কী আর কতটা নামতে পারেন, দালালরা, ভারত দেশে ছড়ানো অদৃশ্য নাইলনজালের বুনোটে, জানে, না-জানলে চলে না, আর বদলি হলে কাঁড়ির তাড়া বেঁধে ধাওয়া মারে সে-শহরে । দেখতে ভিকিরি সে-সব দাঁত-ফাঁক দালালরা, দাঁতের ফাঁক থেকে টুথপিক দিয়ে মোরগের ডানা বের করতে-করতে, হাওয়াই জাহাজে পাড়ি দ্যায় এক রাজধানি থেকে আরেকে, তোবড়ানো তোরঙ্গে নোটের পচা লাশ নিয়ে । কারোর বা অজানা শহরে বেনামা ব্যাংক খাতায় আড়মোড়া ভাঙে বখশিশ । দেওয়ালি দশেরায় পেস্তা কাজু খোবানি মুনাক্কা আনজির কাগজিবাদামের রঙিন ডিবে । স্টেনলেস স্টিলের, লা ওপালা চিনামাটির ডিনার সেট । শিভাস রিগ্যাল, ব্ল্যাক ডগ, কিং অফ কিংস, আবসোল্যুট ।

         গত বছর গরমকালে সুশান্ত, এক শনিবার মহঙ্গুর দোকানে বিকেল ছটায় অপেক্ষা করতে বলেছিল, বগেড়ির মাংস খেয়ে জীবনের অ্যাকশান রিপ্লে দেখাতে নিয়ে যাবে । অতনুর বাসা মহেন্দ্রুতে । সব রকম মাংস পাওয়া যায় মহঙ্গুর দোকানে । ওর নোলানির্ভর রান্না আরম্ভ হয়নি তখনও । কড়াই ডেকচি ঘুমোচ্ছে পোঁদ উল্টে, কোনে ঠেশান দিয়ে জিরোচ্ছে খুন্তি হাতা সানচা । বুকের বসনখোলা তনদুরি চিকেনগুলো গায়েহলুদের মশলা মেখে দোল খাচ্ছে দড়িতে, শিকে গেঁথা খরগোশ, পাঁঠার ঠ্যাঙের ডাঁই অ্যালুমিনিয়াম পাতে ঢাকা টেবিলে, পায়রার গোলাপি মাংস,  বারকোশে পোস্ত আর সাদাতিল মাখা কিমার কাঁচাগোল্লা, ভগ্নস্বাস্হ্য ছাগলের হাড় থেকে চলছে কাবাবের মাংসের চাঁছাই ।

         মোটর সাইকেলের পিলিয়নে হেলমেট পরে বসতেই, সুশান্ত বললে, চল, অকুস্হল কাছেই । বুঝলি তো, বিগ বস খান্না সায়েব রিটায়ার করার আগে সিক লিভ খরচের জন্যে একমাসের ছুটিতে । তাঁর কাজ সামলাতে হেড অফিস থেকে এসেছেন ডেলিওয়েজ কড়ারে মুখার্জিসায়েব । চল্লিশোর্ধ টাকমাথা, কড়া লোক হিসেবে কর্মীমহলে পছারিত, দু-বার ঘেরাও আর সাতবার ধর্নার খেতাব আছে ।

ফ্রেজার রোডে, সম্রাট হোটেলের পার্কিং লটে, দোচাকে দাঁড় করাতে, অতনু বললে, ‘, এসব তেলফেল দেয়া আমার দ্বারা হবে না ।’

         ‘ধারণা করতে পারবি না, এমন ব্যাপার,’ বাঁ চোখের বাঁ কোণ সামান্য কুঁচকে জানিয়েছিল সুশান্ত ।

রিশেপশানে খোঁজ করে সাততলার সাতশো বত্রিশ নম্বর ঘরে কোকিল-ডাক কলিং বেলে টোকা দিতে, দরোজা সামান্য ফাঁক, ভুরু কোঁচকানো চাউনি চারিয়ে এক ঝটকায় মেপে নিলেন দুই কুতূহলী খোট্টাকে । সিঁথে উল্টে চুল বাড়িয়ে টাক-ঢাকা মাঝবয়সী দোহারা । ফরসা । পাজামা ধবধবে । মেরুন সিল্কের ড্রেসিং গাউন । উড়ছে আড়িপাতা বিলিতি পারফিউম আবছা অন্ধকার শীতাতপে । বিছানায় গোলাপি মখমলের চাদর দেখা গেল ফাঁ দিয়ে । মুখার্জি মশায় একটু পেছোতেই, ঘরের ভেতর ফুলদানি রাখা টেবিল-থামের পাশে দাঁড়িয়ে সুশান্ত ভদ্রতার অভিনয় করল, ‘আমার নাম সুশান্ত ঘোষ, আপনার আনডারে কাজ করি, ডি সেকশানে ।’

         ‘ও, আমি এক্ষুনি বেরোবো, আপনারা যদি রবিবার সকালের দিকে আসেন ।’ ভেসে এলো হুইস্কি-প্লাবিত চেতনা ।

         ‘ঠিক আছে স্যার, রবিবার সকালেই আসব, এর নাম অতনু চক্রবর্তী, একই সেকশানে ।’

         ‘ওওওও, বারিন্দির বামুন ।’ হাসলে কপালের শিরা ফোলে । ‘সাতটা শকুন মরলে একটা বদ্যি, আর সাতটা বদ্যি মরলে একটা বারিন্দির ।’ কাঁধের ওপর ঘাড়-বেঁকানো, মুচকি দিয়ে দরোজা ভেজিয়ে দিলেন ।

‘জিরিয়ে নেয়া যাক ।’ জাজিমে ঢাকা সিএফএল প্রায়ান্ধকার করিডরের শেষ প্রান্তে রাখা উনিশ শতকী ঢাউস অ্যান্টিক সোফার কালো ফোমনরম কোলে বসে, কাচের টেবিল থেকে চকচকে বিদেশি পত্রিকা হাতে নিয়ে জানালো সুশান্ত, বলল, ‘তুইও একটা পত্রিকা তুলে মুখ ঢেকে ওই দিকে উঁকি দে ।’ সবুজ কার্পেট পাতা নিঝুম ছমছমে, পেতলের ঝকমকে গামলায় ঘরকুনো  গাছালির ফিকে সবুজ পাতায় ঘন সবুজের ফোঁটা । বাস্তবকে রহস্যখুশি দিয়ে যতটা অবাস্তব করা যায় । কারই বা বাস্তব ভাল্লাগে ।

         চিকন রঙিন পত্রিকার বিদেশিনী মাই খোলার এক ফাঁকে, দেয়াল ঘড়িতে সাতটা বাজার কুহু শেষ হয়নি, লিফ্ট থেকে একজন চৌখশ নীল-পাগড়ি আধবুড়ো শিখ দালাকে দেখা গেল খুঁড়িয়ে বের হতে, পেছন-পেছন হলুদ শালোয়ার লাল কামিজ হলুদ ওড়না মাথায়, প্রায় ফর্সা স্বাস্হ্যবতী, যাকে মুখার্জির শীতল ঘরে টোকা দিয়ে ঢুকিয়ে, লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে ফেরত গেল লিফটে । করিডর আবার ফাঁকা নিস্তব্ধ ।

         ‘দেখলি তো ? তার মানে রোজ সন্ধে সাতটায় ।’

         ‘রোজই হয় বুঝি ? কে খবর দিলে তোকে ?’

         ‘এ ব্যাটার রোজ নতুন মডেল চাই । এর বড়ো ছেলে কানপুরে না খড়গপুরে আইআইটিতে পড়ে । শালা বাঙালির নাম ডোবালো ।’

         ‘লিঙ্গের কোনো জাত ধর্ম ভাষা দেশ হয় না ।’

         কথাটা বলে ফেলে অতনু টের পেল, অজান্তে অদ্ভুত সত্যি কথা বেফাঁস উগরে ফেলেছে । লিঙ্গ এক উপহাসাস্পদ আবরদক । বেশিটা জীবন কেটে যায় এর ওপর ভর দিয়ে অথচ জিনিশটা কত অনুর্ভরযোগ্য । কত তাড়াতাড়ি একে জ্বালাতন করা যায়, ধোঁকা দেয়া যায়, হাল ছেড়ে দেয়া যায় এর । কিন্তু এমন ভান করে যেন অজাতশত্রু, মালিককে জাদুক্ষমতা দিয়ে দিতে পারে এমন অস্ত্র যেন, পেশীহীন আঙুল-পোকাটাকে তাই সদম্ভে চেষ্টা করে যেতে হয় সর্বনাশের বিরুদ্ধে লড়তে । কিছুই করার নেই মুখার্জির ।

         ‘তাই তোকে বলেছিলুম, গেলবার হরিহর ছত্তরের মেলার সময় নাংগা ক্যাবারে দেখে আসি শোনপুরে ; গেলি না । দেখলে তো আর চরিত্র তোর নষ্ট হবে না।’

          সুশান্ত নিজে গিয়েছিল যদিও, মোটর সাইকেলে । তখন গঙ্গার ওপর পাটনা সিটির কাছে এপার-ওপার পোলটা হয়নি, এপারে মহেন্দ্রুঘাট থেকে ওপারে পহলেজা ঘাট বাচ্চাবাবুর স্টিমার যেত দিনে চার খেপ, ঢাউস ঢেউ তোলে, নামে স্টিমার হলেও মাপে বিরাট । সে-বছর বৈশালীর বিধায়ক বীর মহোবিয়া মেলা থেকে একটা পাগলা হাতি কিনে নিয়ে গিয়েছিল, একশো লেঠেলের পাহারায় । মহোবিয়ার কাছ থেকে হাতিটা কিনেছিল পালামৌ জেলার বিশ্রামপুর বিধানসভা এলাকার বিধায়ক বিনোদ সিং, সি সেকশানের কয়েননোট এগজামিনার দেবেন্দর পরসাদ সিংএর ফুফেরা কাকা, যে কিনা দিনদুপুরে পুলিশ খুন করে যশশ্বী হয়েছিল, খ্যাতি পেয়েছিল নিজের বিরাদরিতে । মালহানের ফজল মিয়াঁ, কমরুদ্দিন, সহজ গঞ্জুকে পিটিয়ে করেছিল আধমরা, চিত্তবিনোদনের জন্যে । চিত্ত সেরকম হলে শির উচ্চ হয় । পাগলা হাতি কিনে জোতদাররা শির উচ্চ করার উপায় খুঁজে পেয়েছিল । হাতিটাকে মাঝরাতে শেকল খুলে এমন খেপিয়ে দিত বিনোদ সিং যে জেগে থাকতে বাধ্য হতো গ্রামবাসী । ব্যাটাকে অবশ্য খুন করতে বাধ্য হয় সহানুভূতিশীল লোকেরা, যারা রাতে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায় । উচ্চ শিরকে মাঝরাতেই নামিয়ে দিয়েছিল কেউ ; নামিয়ে পাগলা হাতির পায়ের তলায় ।

         ‘বিম্বিসার অশোক জরাসন্ধ অজাতশত্রু এদের থেকে খুব একটা তফাত নেই, না ?’

         ‘আচ্ছা, কার কাছ থেকে জানলি মুখার্জির ফাইভস্টার অভিসারের কথা ?’

         ‘মোটা টাকার পচা বাণ্ডিল পাশ করার এই একটাই আবদার লোকটার । মাগি খায় । ভিজিল্যান্স বোধহয় আদিরসের স্টক নিয়ে ঘাঁটায় না কাউকে । আমরা প্রোমোশান পেয়ে ওই পোস্টে উঠতে-উঠতে বুড়িয়ে যাব ।’ সত্যিকার আফশোয সুশান্তর গলায় ।

         কুড়ি মিনিট পড় মাথায় হলুদ ওড়না দাঁত চেপে ঢালু কাঁধ ত্রস্ত মেয়েটা লেফটের বদলে পাকানো সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য হতেই, সুশান্ত সোফা থেকে তড়াক, অতনুর হাত ধরে হালকা পায়ে, তারপর সাতশো বত্রিশে কলিং ঘণ্টি বাজায় আর দরোজা খুলতেই, ‘স্যার, আমার গগলসটা ফেলে গেছি ।’ সায়েবের কোমরে গোলাপি তোয়ালে, সাজানো টাকের চুল উস্কোখুস্কো, ধামসানো বিছানার চাদর চেয়ারে দলা । দরোজার পাশে উঁচু পাতলা স্ট্যাণ্ডে রাখা গ্ল্যাডিওলির গামলার পাশ থেকে চশমাটা তুলে, ‘সরি স্যার, ডিস্টার্ব করলুম ।’

         মুখময় কুয়াশামাখা মুখার্জির সামনে, স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার, দু-চোখ জুড়ে অগাধ দূরত্ব । লোকটা আবিষ্কার করছিল ওরা দুজন তার দিকে প্রখর চাউনি মেলে তাকিয়ে ।

         লিফটের দরোজা বন্ধ হতেই, ‘হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ, পেট ফেটে গেল ।’

         সুশান্ত : না, বালিশের পাশে কনডোমের প্যাকেট ছিল ।

         সুশান্ত : রেকর্ডারে মোৎসার্টের বাইশ নম্বর কনচের্টো লাগিয়ে রেখেছেন ভদ্দরলোক ; পিয়ানো আর অর্কেস্ট্রা ।

         সুশান্ত : টাক থেকে ভুরুর কাজল মোছার সময় হয়নি !

         সুশান্ত : ভাবতেই পারেনি, ঢুঁ মারব ।

         সুশান্ত : দেখে নিস, নির্ঘাৎ হোটেল পালটাবে কাল ।

         সুশান্ত : একেলে ? সেকেলে ? আধুনিক ? উত্তরাধুনিক ? কী বলা হবে লোকটাকে ?

         পরের দিন, বুধবার সন্ধেবেলা, বধিরদের মধ্যে কেচ্ছা যেভাবে একান-সেকান হয়, একই শিখ নোট এক্সচেঞ্জার দালালের সঙ্গে ময়লাপানা ডাগরচোখ শাদা টিপ শাদা অরগ্যাণ্ডি শাড়ি, পীনোন্নত ব্লাউজে, গলায় নকল মুক্তোর মালা, ঢ্যাঙা ছিপছিপে । পাটলিপুত্রা হোটেলে, কেননা গোপন রাখতে ঠাঁই পালটেছেন সম্রাট থেকে এই হোটেলে । দরোজায় কান রেখে সুশান্ত বলেছিল, ‘হিউগো মনটেনেগরোর ফিস্টফুল অফ ডলার্স ।’

         পঁয়তাল্লিশ দিন জুড়ে হরেকরকম নারীর আনাগোনার মাঝে ওরা শুনল, হোয়াম-এর দ্য এজ অফ হেভেন, মাইকেল জ্যাকসনের ‘আই অ্যাম ব্যাড’, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু উউ উউ উউ উউ’, ফিল কলিনসের ‘অনাদার ডে ইন প্যারাডাইস,’ বনি এম-এর ‘ব্রাউন গার্ল ইন দ্য রিং,’ মোৎসার্টের সোনাটা পনেরো, সোনাটা ষোলো, এলভিস প্রেসলির ‘বোসসা নোভা বেবি, বড়ে গুলাম আলি খাঁ-এর ‘কা করুঁ সজনী আয়ে না বালম,’  দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘আজি এই গন্ধবিধুর সমীরণে,’ বাখ-এর চার নম্বর কনচের্টো, লোপামুদ্রার ‘ছাতা ধরো হে দেওরা এইসান সুন্দর খোঁপা হামার ভিঁজ গেলাই না ।’ শুনলো নজরুল, অতুলপ্রসাদ, আব্বাসউদ্দীন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, পূর্ণদাস বাউল, কিশোর কুমার, মোহম্মদ রফি, কুমার শানু, শ্রেয়া ঘোষাল, লতা মঙ্গেরশকর, আশা ভোঁসলে । জানে না বলে কারা গেয়েছে, কী গান, হদিশ করতে পারল না সুশান্ত, তা কিশোরী আমনকর-এর বসন্তবাহার, পণ্ডিত যশরাজের রাগ ভবানীবাহার, ভীমসেন যোশীর হিন্দোল বাহার, মল্লিকার্জুন মনসুরের বসন্তি কেদার ।

         –লোকটা তো হরফনমওলা । এমন বাঁধাধরা সময় করে ফেলেছে । ও তো পাভলভের কুকুর । গড়িতে সাতটার ঢং ঢং হলেই, দুপায়ের মাঝখানে চিতচোর কেলেঙ্কারি । একেবারে ঠাপ্পু ওস্তাদ !

         –সেই জন্যে রোজ আলাদা-আলাদা গান বাজায় । বউয়ের সঙ্গে শোবার সময়েও নিশ্চই বাজায় । বাড়িতে প্রচুর গানের স্টক করে ফেলে থাকবে । ঘোড়ার ডাক্তারি, বি ভি এস পড়ে আমাদের পরের ব্যাচে চাকরিতে ঢুকেছে জীবন দে সরকার আর অখিলেশ শ্রীবাস্তব, ওদের জিগ্যেস করেছিলুম ।

         –আমার মধ্যে দুটো সুড়সুড়ি চালু হয়েছে । গানবাজনা বুঝতে আরম্ভ করেছি ।

         –অন্যটা ? ভুরু কোঁচকায় সুশান্ত । আঁচ করে ফেলেছে । হোসটেলে পুসায় পড়ার সময়ে, অনেক কাল আগে ওর মধ্যেও খেলেছিল । দুটো ব্লক ছিল ছাত্রাবাসের, হোমো ব্লক আর হেটেরো ব্লক । জবাবদিহি চাইবার মতন গলার আওয়াজ টাকরায় ঠেকিয়ে, তাই :’বল ? অন্যটা ?’

         –কিছু কিছু ব্যাপার আগে কুকাজ ভাবতুম, এখন আর সেসব তেমন খারাপ মনে হচ্ছে না । কেমন যেন লিবারেটেড ফিল করছি । বোধহয় গানের প্রভাব।

         বুদ্ধ মার্গের পাশের রাস্তায়, ধোঁয়া-ডিজেলের ছিন্নাংশে মোড়া ব্যস্ত শহর পাড়ার ভিড়ের মাঝে, লাল মোটর সাইকেলের থ্রটলের গলাখাঁকারি তুলে, জড়োয়া ঝিকমিকে বাজারের সামনে, ছুটন্ত মোটরগাড়িগুলোর শ্যেনদৃষ্টি আলোয়, ফ্যাস করে এক মুহূর্তের জন্যে ফোঁপানির ঝলক তুলে নিজেকে সামলায় সুশান্ত ।

         অতনু : আজ ওব্দি তুই বললি না, কার কাছ থেকে জেনেছিলি !

         সুশান্ত : রমা বউদির কাছ থেকে ।

         অফিসের কেয়ারটেকারের বউ রমা, টেলিফোন অপারেটার । সকলের কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনে মশলাদার গল্প চেপে রাখেন আর হাসেন নিজের মনে গিগ গিগ । ওনার বিয়ের আগে কেয়ারটেকার রাঘব সান্যালকে লেখা রমা ব্যানার্জির আট পাতার চিঠি, কাগজের এদিক-ওদিক খুদে-খুদে হাতের লেখায়, পড়েছিল অতনু-সুশান্ত ।  আত্মহত্যার চিরকুটে প্রেমপত্রের মিশেল । রাঘবের জাঁতাকাল অনুনয়, ‘একটা খসড়া লিখে দাও না অতনু । ওর সবকিছু এতো ছোটোছোটো কচিকচি , রুখতে পারলুম না । ‘অতনু উপদেশ দিয়েছিল, চোখমুখ থেকে অভিনয় এক্কেবারে বাদ দিয়ে, ‘বিয়ে করে ফেলুন না, ওসব ফালতু লেখালিখে দিয়ে কী করবেন !’

         অফিস বিলডিঙেই সাজানো-গোছানো কোয়ার্টার পেয়েছিল রাঘব । বোতামখোলা একাকীত্বে অকালমৃত স্তনেরা জীবন ফিরে পায় । প্লাসটিকের তৈরি বাঁশপাতার সবুজ খড়খড়ি তুলে ঢুকে পড়ে হাসিমুখ রোদ্দুরের আবালবৃদ্ধবনিতারা । সৈন্য বাহিনীর শর্ট সারভিস কমিশন থেকে ফিরে আসা রাঘব কী একখানা ছিল । অফিস এলাকাকে যুদ্ধক্ষেত্র আর যগ্যিবাড়ির চনমনে চেহারা দিয়েছিল, এ সে-ই । জিপের ট্রেলারে, তাঁবুর তলায়, তুষারের মেঝেতে, গান ক্যারেজে, ট্যাংকের মধ্যে বসে, উটের ছায়ায় মরুভূমির বালিতে, হোমো করার ফিরিস্তি । মেয়েমানুষের অনুপস্হতি দিয়ে ঘেরা দুর্ভেদ্য যৌনতার নড়বড়ে আর নাছোড় স্ট্যাগ কিংবদন্তি । সৈন্য জওয়ানদের জন্যে মুখস্হ হিন্দি হুকুমগুলো চারিয়ে যায় কামিন কামিলা মজুর দারোয়ান ঝি চাকর আরদালি পিওন চাপরাসি খানসামা ঝাড়ুদারদের দুনিয়ায় । আর্মি ক্যানটিনের ঘোড়াছাপ রাম । আফরিকানিবাসীদের মতন ঠাশবুনোট চুল ওর, আঁচড়াতে হয় না, তেল দিতে হয় না । রনা বউদির দেওয়া কোনও খবর গোপন রাখতে পারে না রাঘব ।

         রাঘবের দেয়া মুখার্জি মশায়ের বিদেয় পার্টির শেষে, পটলের দোরমা চিংড়ির মালাইকারি গোবিন্দভোগের পায়েস হয়েছিল । অতনু সুশান্ত আনন্দ বোস অরুণ মুখার্জি মণিমোহন মুখার্জি মলয় রায়চৌধুরী প্রদীপ দাশগুপ্ত বাইরে পোর্টিকোয় বেরিয়ে দ্যাখে গেটের কাছে হকিস্টিক সাইকেল চেন লাঠি নিয়ে মারপিট চলছে দু-দল কর্মীর । চন্দ্রকেতু সিং-এর রাজপুত-ভূমিহার গ্যাঙের সঙ্গে তফসিলি গ্যাঙের । ইউনিয়ান নেতা ছিল চন্দ্রকেতু সিং, বছর চারেক, কলকাতা থেকে বদলি নিয়ে আসার পর, কলকেতিয়া স্লোগানবাজি দলাদলি ল্যাং-মারামারি চুকলি শিখে কুরমি কায়স্হ আর গোয়ালারা ওকে ঠেলে ওরই চেলা বেচয়েন লালকে ইউনিয়ান নেতা বানিয়ে ফেলেছিল । মারপিটটা এইজন্যে যে একজন দুসাধ কেরানি নিজেকে রাজপুত হিসেবে পরিচয় দিয়ে চন্দ্রকেতুর গোপন মিটিঙে যোগ দিত, তা ফাঁস হয়ে গেছে । রামচিজ সিং, দুসাধকে, ধোলাই দেয়া আরম্ভ হতে, লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে সবাই, দু-দলের পালোয়ানরা ।

         –ওঃ, কী করে এমন একটা অসভ্য দেশে থাকেন । মুখার্জি সায়েব কোঁৎ পাড়েন । চলন্ত মারপিটের মাঝ দিয়েই ওনার গাড়ি বিমানবন্দর যাবে ।

         –গেটের বাইরে ওসব, চিন্তার কিছু নেই স্যার ।

         –অনেক বাঙালি পরিবার নাকি বিহার ছেড়ে চলে যাচ্ছে ।

         –হ্যাঁ, দিল্লি লখনউ মুম্বাই আর তা না হলে পশ্চিমবঙ্গ ।

         কথাটা সত্যি, অতনুর মনে হল । গঙ্গাভিলার ছেলেরা চলে গেছে । লঙ্গরটুলির রায়রা । নাগ ডাক্তার । রেডিও টিউটোরিয়ালের বাঁড়ুজ্জে । সমরেণ চক্রবর্তী আর ওর ভাইরা । জীবনময় দত্ত আর ওর বউ, কলকাতায় সাহিত্য করবে বলে । গরদানিবাগ, চাঁইটোলা, লোদিপুর, কংকরবাগ থেকে, পরিবারের পর পরিবার । বাঙালির প্রিয় মাছগুলোই আর আসছেনা পাটনার বাজারে । এখানের জাতপাতের লড়াইতে বাঙালিরা কোন দিকে, নাকি যে যেমন জাতের সেই দিকে যাবে কিনা নির্ণয় নিতে পারছে না বলে পালাচ্ছে । ইসকুলগুলোয় আর বাংলা পড়ানো হয় না । সরকার বাংলা টেকস্টবুক ছাপায় না । বাংলা শিক্ষক নিয়োগ করে না । হিন্দিতেই বাড়িতে কথা বলা আরম্ভ করে দিয়েছে বহু বাঙালি পরিবার । বাংলা অ্যাকাডেমির সভা হলে বাইরে পানের দোকানে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে কথা বলেন কোনো-কোনো সদস্য । বিহার ছেড়ে পালাচ্ছে বাঙালিরা । যাদের জো নেই তারা ভাগলপুরের বাঙালিদের মতন স্হানীয় সংস্কৃতিতে মিশে যেতে বাধ্য । সাংস্কৃতিক চাপ থেকে চাগিয়ে ওঠা দুঃখের খতিয়ান রাখে না কোনো ভূভাগের ইতিহাস । মিলিয়ে যায় হরপ্পাবাসী বা মিশরীয়দের মতন।

মারামারির মধ্যে দিয়েই এগোলো অফিসের গাড়ি, মুখার্জি আর রাঘবকে নিয়ে । একাধজনের মাথা ফেটে গেছে, জামায় রক্ত, তেড়ে হিন্দি গালাগাল চলছে । গাড়ির কাঁচ তুলে না দিলে পটল চিংড়ি গোবিন্দভোগ উগরে দিতেন মুখার্জি ।

         ‘জায়গাটা বড্ড ড্রাই’, সুটকেসে কেবিন ব্যাগেজের টভাগ বাঁধতে-বাঁধতে বিমানবন্দরে বললেন মুখার্জি । বখশি৯শের নিয়মমাফিক লোভে ড্রাইভার রমাকান্ত দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, পেল না । মুখার্জি সিকিউরিটি চেকে সেঁদিয়ে গেলে, রাঘব বেরিয়ে আসছে, রমাকান্ত’র উষ্মা, ‘স্যার, লোকটা লুচ্চা, পর-পর তিনটে রবিবার নৌকোয় মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছে গঙ্গায় ।’

         ‘তুই কী করে জানলি ?

         ‘আমার ট্যাকসি করে ঘাটে গিসলো ।’

         গাড়লের মতন কাশতে পারে এমন একটা সাত গ্যারেজের তেল খাওয়া ট্যাকসি কিনেছিল রমাকান্ত । অফিসের নতুন গাড়ি থেকে কলকব্জা মায় টায়ার চালান হয়ে গেছে তাতে । ঘাঁটালে, রমাকান্ত মুরমু ওর ঝাড়খণ্ডি বেরাদর দিয়ে চটিয়ে দেবে মজদুর ইউনিয়ানকে, আর অফিসের মারাঠি ম্যানেজার রাঘবকে বলবে তুমি ট্যাক্ট জানো না । ট্যাকসিটা রমাকান্ত’র ছেলে ছিরিকান্ত চালায়, এটা-সেটায় লাগে । রাঘব সত্যিই অবাক পেল নিজেকে, ওর ছেঁদো খুচরোর লোভ দেখে, বলে ফেলল, ‘কেন, ভদ্দরলোকদের নুনু হয় না বুঝি ? যতো নুনু বাঞ্চোৎ ফুটপাতিয়াদের । জিভের আড় থেকে সৈন্যজওয়ানদের বিটিং দি রিট্রিট হয়নি আজও । সুবেশ মধ্যবিত্ত বাঙালি চোস্ত হিন্দি গালাগাল আরম্ভ করলে থম মেরে যায় বাতাস ।

         বিমানবন্দর থেকে ফেরার সময়ে অফিসবাড়ির পেছনের গলিতে ঢোকার মুখে চায়ের দোকানে স্যাঙাতদের সঙ্গে চন্দ্রকেতু সিং, মাথায় ব্যাণ্ডেজ । ‘সব মিটমাট হয়ে গেছে তো ?’ গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বের করে রাঘব জিগ্যেস করায়, চন্দ্রকেতু জবাব দ্যায়, ‘আরে গান্ধিজি বেঁচে থাকলে এসব আম্বেদকরাইটদের রাস্তা মাপিয়ে দিতুম ।’

         ভেতর, চটের পর্দার আড়ালে, তিন পাত্তির জুয়া খেলছে কয়েকজন কেরানি নোট-পরীক্ষক আর চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ; জুয়া খেলায় শ্রেণি বিভাজনের পাঁচিল হয় না । বোর্ড মানি নেবে বলে, বাঁশের বেঞ্চের ওপরে ঠ্যাঙে ঠ্যাং তুলে বসে আছে চন্দ্রকেতু ; বালিয়া জেলায় ওর বাপের দোশো একর ধানজমি আর পঞ্চাশ একর গ্যয়েরমজরুয়া জমি রেখেছে দখলে । পাটনায় রাজেন্দ্রনগরের একতলা  ফ্ল্যাটের চারপাশে বেড়া তুলে সরকারি জমিতে মোষ পুষেছে । দুধ আর ঘুঁটে বেচে । অফিসে কাজটাজ ছোঁয় না । বললে, ‘হেঃ হেঃ, ইউনিয়ান কা কাম, জানতে হি হ্যাঁয় ।’

         ফ্ল্যাটে ফিরে রাঘব জানতে পারল, ঝিয়ের চোদ্দ বছরের মেয়েটা, যাকে ওর বাপ পরশু শশুরবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল, আজ সকালে তার লাশ পাওয়া গেছে, কোইলওয়র নদীর বালিতে পোঁতা । পুলিশ তার শশুর আর খুড়শশুরকে গ্রেপ্তার করেছে, বলাৎকার, খুন আর লাশ লোপাটের চেষ্টার দায়ে । মেয়েটার বাপ-মায়ের আছাড়ি-পিছাড়ি কান্নাকাটি চলছে রাঘবের কোয়ার্টারের দোরগোড়ায় ।

         রাঘব : ছোটোবেলায় কতবার গেছি কোইলওয়র চড়ায় পিকনিক করতে ।

         রমা : কই, আমায় নিয়ে যাওনি তো কখনও !

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *