১. রামলালের চাকরিটা গেল

রামলালের চাকরিটা গেল।

এমন কিছু নয়, সামান্য ত্রিশ টাকা মাইনের গ্রাম্য বালিকা বিদ্যালয়ের হেড পণ্ডিতের পদ। কিন্তু আজকাল নতুন কি সব নিয়ম হয়েচে গবর্ণমেন্টের, ষাট বছর বয়েস হলে স্কুলের চাকরিতে আর নাকি রাখা চলবে না। এ সব নতুন ফ্যাঁসাদ, এতকাল মাস্টারি করে আসচে রামলাল, কখনো শোনেনি বয়েসের সঙ্গে এর আবার সম্পর্ক আছে। যাই হোক, রামলাল গিয়ে ধরবে ভাবলে সাব ইনসপেক্টর বাবুকে মহকুমার টাউনে।

রামলাল রুগ্ন স্ত্রীকে বললে—সকাল সকাল দুটো ভাত দিতে পারবে হ্যাঁগা? একবার গিয়ে ধরি ইনসপেক্টর বাবুকে। দেখি কি হয়।

বড় ছেলে শ্যামলাল হল এই অঞ্চলের স্থানীয় কবি। ছোটখাটো সাহিত্যসভা থেকে নিমন্ত্রণ আসে, শ্যামলাল সভার মাঝে দাঁড়িয়ে উঠে কবিতা পড়ে, সবাই হাততালি দেয়, গ্রামের লোকে সুখ্যাতি করে। সে দু’বছর কলেজে পড়েছিল, অর্থাভাবে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি, আর পড়াও হয়নি। সে কিন্তু ছেলে ভালো, পড়াশুনোর দিকে খুব ঝোঁক এবং সত্যিই কবি-প্রকৃতির। সকলে তাকে ভালোবাসে, বলাবলি করে পিতার দারিদ্র্যের জন্যে এমন ছেলেটার কিছু হল না। শ্যামলালের ঝোঁক পরোপকার করা—লোকের বাড়ির ক্রিয়াকর্মে সে আগে থেকে গিয়ে কাঁধ দেবে, খাটা-খাটুনি করবে, পরিবেশন করবে, গরীব পরিবারের জন্যে মুষ্টিভিক্ষা তুলে বেড়াবে—কিন্তু নিজের সংসারে বিশেষ কোনো কাজে লাগে না সে। অনেক সময় বসে আকাশপাতাল ভাবে, কি করলে বাবার অবস্থা ভালো করা যায়, অবিশ্যি তার বাবা ভালো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন এবং বাবার চিকিৎসায় তার খুব বিশ্বাস—কিন্তু এসব অঞ্চলে কেশব ডাক্তারেরই পসার। তার বাবাকে কেউ ডাকে না, রাত-দুপুরে হাতের কাছে অন্য ডাক্তার না পেয়ে তাকে যারা ডাকে, তারা পয়সা দেয় না।

বেলা দু’টোর সময় রামলাল সাব-ইনসপেক্টর বাবুর বাসায় গিয়ে হাজির হল। বাইরের ঘরে দু’তিনজন লোক বসে আছে, তাদের একজনকে রামলাম চেনে, ঘাটবাঁওড় পাঠশালার সেকেন পণ্ডিত রিদয় ভট্টাচার্যি।

রামলাল ওর পাশে বেঞ্চিতে বসে বললে, ও রিদয়, ভালো আছ?

রিদয়ের বয়েস ষাটের কাছাকাছি, মাথার চুল সব সাদা, রোগা লম্বাটে চেহারা, সামনের দুটো দাঁত বেজায় উঁচু—নস্যি নেবার অভ্যেস থাকায় নাসিকা-গহ্বরে নস্যির গুঁড়ো লেগে আছে। রামলালের দিকে চেয়ে নীরস মুখে বললে—মন্দ না।

—এখানে কি মনে করে?

—তুমি কি মনে করে?

—দরকার।

—আমারও তাই।

—আমার না হয় চাকরি নেই, তোমার তো তা নয়।

—এ কোয়াটারের মাইনের বিল পাঠিয়ে দিইচি মাসখানেক আগে, এখনো টাকা পাইনি—কি খাই বলো দিকি?

এ পাশের ছোকরা-গোছের লোকটা বললে—আমারও তো তাই।

.

রামলাল তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে—তোমাকে তুমিই বলি, আমার ছেলের বয়িসী তুমি। কোন ইস্কুলে চাকরি কর?

—লালমোহন একাডেমি, সুন্দরপুর।

—কি, পণ্ডিত?

—আজ্ঞে আমি হেডমাস্টার।

রিদয় ভট্টাচার্যি বললে—ওঁকে চেন না, ওঁর নাম সুধাংশুবাবু, উনি বি. এ. পাশ।

রামলাল অবাক হয়ে বললে—তবে তো বড্ড অন্যাই হয়ে গিয়েচে আপনাকে তুমি বলে? কিছু মনে করবেন না সুধাংশুবাবু।

সুধাংশুবাবু বললেন—না না, আমাকে তুমিই বলুন না। সত্যিই তো আপনি আমাদের বাপের বয়িসী।

—এই বয়েসে হেডমাস্টার? বাঃ বাঃ, সোনার টুকরো ছেলে। আমার বড় ছেলের বয়িসী বলেই তুমি বললাম। তা আপনারও কি বিল-পাশের হাঙ্গামা?

—তা ছাড়া আর কি বলুন! আপনি কোন ইস্কুলের?

—মেটেরা ফ্রি বালিকা বিদ্যালয়।

এমন সময় সাব-ইনসপেক্টর বাবু নিজে এসে ঘরে ঢোকাতে এদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। সাব-ইনসপেক্টর বাবুর বয়েস চল্লিশের বেশি নয়, বেশ ফরসা, সুন্দর চেহারা, চোখে সোনার চশমা। তিনি এসে সকলকে হাতজোড় করে নমস্কার করে প্রথমেই সুধাংশুবাবুকে সম্বোধন করে বললেন—আপনার কি খবর?

সকলেই বেঞ্চি থেকে দাঁড়িয়ে উঠেছিল, সুধাংশুবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মিনিট পাঁচ ছয় কথা বললেন ইনসপেক্টর বাবুর সঙ্গে। আর কারো দিকে কিন্তু তিনি তাকালেন না বা অন্য কারো সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। সুধাংশুবাবুর কাজ বোধ হয় মিটে গিয়েছিল, তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবার আগে রামলালের দিকে চেয়ে নমস্কার করে বললেন—আচ্ছা পণ্ডিতমশায়, চলি তবে—

—আসুন, নমস্কার। নমস্কার।

এই সময় সাব-ইনসপেক্টর বাবু সুধাংশুবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন—আপনি চেনেন এ পণ্ডিতমশায়কে?

—এই মাত্র আলাপ হল।

—আচ্ছা, আপনি যান। তারপর পণ্ডিতমশায়, আপনি কি মনে করে?

রামলালের মন প্রসন্ন হল সুধাংশুবাবুর ওপর। উনি না এখানে থাকলে ইনসপেক্টরবাবু পুঁছতেনই না আজ। সে বিনীতভাবে বললে—আজ্ঞে, আমার একটা দরকার আছে।

—কি বলুন না।

রামলালের লজ্জা করতে লাগলো, এতগুলি বাইরের লোক, বিশেষতঃ রিদয়ের সামনে চাকরি বজায় রাখার জন্যে কাকুতিমিনতি করতে, তার ওপর আবার বয়েস উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে যাওয়া চাকরি। এখুনি তো এতগুলি লোক জেনে যাবে যে তার বয়েস ষাট উত্তীর্ণ হয়েছে।

সে বললে—আজ্ঞে, বলবো এখন।

—আমার সময় খুব কম, একটা মিটিং আছে এস. ডি. ও’র বাসায়। বলুন না—

—আমার বিষয় একটু বিবেচনা করে দেখুন, হুজুর—

রামলাল সেকেলে লোক, ওপরওয়ালাকে ‘সার’ বলতে শেখেনি।

—কি বিবেচনা করবো?

—অন্ততঃ আর দু’বছর আমায় একসটেনশ্যন দিন দয়া করে, হুজুর।

—এই দেখুন, আমার কি স্বার্থ আছে আপনার চাকরি খেয়ে! ডিপার্টমেন্টের নিয়ম অনুসারে তো আমাকে চলতে হবে, না হবে না?

—আজ্ঞে আপনি সব পারেন।

—কি পারি?

—দুটো বছর আমাকে আরও রেখে দিন হুজুর, বড্ড বিপদে পড়ে যাবো এ সময় অবলম্বনটা গেলে।

—কত বছরের সার্ভিস হল?

—ছত্রিশ বছরের ওপর।

—উঃ বাবাঃ, প্রায় আমার বয়েস। আর কি পণ্ডিতমশাই, চিরজীবন চাকরি করবার ইচ্ছে আছে? আর হয় না। ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন। ভেবে দেখুন, যারা ইয়ঙ্গার মেন, তারা কি করবে? তাদের জন্যে জায়গা খালি করে দিন। কতকাল আর জায়গা জুড়ে রাখবেন? অবকাশ নিন, বিশ্রাম করুন।

—খাবো কি?

—এতদিন কি করলেন তবে?

—ছত্রিশ টাকার চাকরি করে কি করতে পারতাম বলুন, হুজুর। একটা মেয়ের বিয়ে দিয়েচি, ছেলে পড়িয়েচি—

—ছেলে কি করে?

—বাড়ি থাকে।

—কি পড়াশুনো করেচে?

—আই-এ পর্যন্ত পড়েছিল, পরীক্ষা দেয়নি।

—বলেন কি? আপনার ছেলে তো রত্ন মশাই এ সব অজ পাড়াগাঁয়ে। তবে আর আপনার ভাবনা কি?

—না, তবে—ইয়ে—

—কি ব্যাপার?

—সে হল একটু কবি-প্রকৃতির ছেলে। কাজকর্মের দিকে ততটা নেই। ভারি ভাবুক।

—হ্যাঁ। লেখে-টেখে নাকি?

—আজ্ঞে আপনাদের বাপমায়ের আশীর্বাদে চমৎকার পদ্য লেখে—

পুত্র-গর্বে রামলালের কণ্ঠস্বর ভরে গেল।

—বাঃ, বাঃ—খুব ভালো। তা আমাকে শোনাবেন একদিন কবিতা?

—নিশ্চয় শোনাবো। আপনি হলেন অন্নদাতা, আপনাকে শোনাবো না হুজুর?

সাব-ইনসপেক্টর বাবু এবার ঘরের বাইরে চলে গেলেন। বললেন—আমি চলি, আমার মিটিং-এর সময় হয়ে গেল—

রামলাল তাঁর সঙ্গে পথে নেমে বললে—হুজুর তা হলে আমার বিষয়টা—

দু’জনেই পথচলা অবস্থায় কথাবার্তা হতে পারতো, কিন্তু রামলালের সাহসে কুলোলো না অত বড় একজন পদস্থ লোকের সঙ্গে হেঁটে বেশিদূর যেতে। চটে যেতে পারেন। চটলে কাজ পাওয়া যাবে না। রামলাল মোড়ের অশথতলাটা পর্যন্ত গিয়ে বললে—তা হলে যান হুজুর।

—আপনি অন্য সময় আসবেন—

—কোন সময় হুজুর?

এই ধরুন—বেলা একটা—আচ্ছা, এক কাজ করুন। আপনি এখুনি গিয়ে বসে থাকুন আমার বাড়ি। আমি চল্লাম—

রামলাল হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল। সে যখন সাব-ইনসপেক্টর বাবুর বাসায় এসে উঠলো, তখন আর সব দরবারীরা চলে গিয়েচে, রিদয় ভট্টাচার্যি নামচে বারান্দা থেকে। ওকে দেখে রিদয় বল্লে—কাজ মিটলো?

—কোথায়? কিছুই না। তোমার?

—আমারও তথৈবচ। কেরানীর সঙ্গে দেখা করতে বল্লেন। সে তো রোজই করচি রে ভাই। কেরানী বলে আমি কি করবো? ওপর থেকে বিল আজও পাশ হয়ে না এলি কি করবে সে লোক? যাই ফিরে, আবার সোমবারে হেঁটে কোপাতি হবে তিন-তিনটি কোশ। কম গেরো! তুমি কি বসবে নাকি?

—আমায় বসতে বললেন।

—তোমার তবে পোয়াবারো। বোসো। এক যাত্রায় পৃথক ফল হল বোধ হয়। চাকরিটা তাহলে থেকে গেল।

—রও ভাই, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।

—খুচরো পয়সা আছে ভাই, দু আনা দিতি পারো? খুকিটার জন্যে মুড়কি কিনে নিয়ে যাবো।

—দাঁড়াও, দেখি আছে কিনা—

রামলাল ছেঁড়া জামার পকেট থেকে একটা দুয়ানি বার করে রিদয়ের হাতে দিলে। রিদয় ভটচার্যি বললে—চলি তবে ভাই, তোমার কাজ বোধ হয় হয়ে যাবে’খন—

.

ঘণ্টা দুই পরে রামলাল দেখা পেল ইনসপেক্টর বাবুর। তিনি বাড়ি এসে চা খেয়ে এলেন বাইরের ঘরে। রামলালকে বললেন—এখনো বসে আছেন?

—আজ্ঞে হুজুর।

—ধৈর্য আছে আপনার।

—না থেকে উপায় কি? পেট তো বোঝে না।

—আপনার ষাট বছর বয়েস হল, একসটেনশ্যন আর কি সম্ভব?

—আপনার দয়া হলি সবই সম্ভব, হুজুর।

—তার চেয়ে একটা কথা শুনুন—

—কি বলুন—

—আপনার ছেলেকে ওই চাকরিতে বাহাল করে দিতে বলেন তো দিতে পারি।

—সে করবে না হুজুর। সে হল আধুনিক ছেলে, কবিতা-টবিতা লেখে, পণ্ডিতি সে করবে না বোধহয়।

—পণ্ডিতি না, আপনার ছেলে তো আই. এ. পাশ?

—পাশ নয়, পড়েছিল। পয়সার অভাবে আর পড়াতে পারিনি হুজুর।

—বেশ। তাকে যদি সেকেন মাস্টার করে দিই মাইনর ইস্কুলের? তবে একটা কথা—

—কি?

—জি. টি. অথবা বেসিক ট্রেনিং যা হয় একটা কিছু পড়তে হবে বছরখানেক।

—হুজুর, খুব ভাল কথা। আমি তাকে বলে দেখি। সে যদি রাজী হয়, আপনার কাছে ওকে নিয়ে আসবো।

—সামনের বুধবারে আপনি নিয়ে আসবেন।

—যদি সে না করতে চায়, তবে আমার চাকরি থাকবে?

—আমি সুপারিশ করে দিতে পারি কিন্তু ওপরওয়ালা শুনবে না পণ্ডিতমশায়।

—আপনার কলম দিয়ে যা বেরুবে তা কেউ কাটতি পারবেন না—এ বিশ্বাস আমার আছে—

—আপনার সঙ্গে তর্ক করে কোনো লাভ নেই। আপনার ছেলেকে আনবেন বুধবার?

—হুজুরের হুকুম তামিল করবো না? নিশ্চয় আনবো।

—আপনি তাকে আনবেন, সে চাকরি করে না করে, সে ভার আমার ওপর রইল।

—তাহলে আজ চলি হুজুর। বেলা গিয়েচে, পথে বড্ড বাঘের ভয় হয়েচে। বাঘটা রজনীপুরের পথে কাল একটা গরু মেরেচে।

—গো-বাঘা?

—সময় পেলে অনেক সময় মানুষকে আঁচড়ে কামড়ে দেয় হুজুর।

—যদি ভয় হয়, আজ রাত্রে এখানে না হয় থেকেই যান। কাল সকালে উঠে যাবেন।

—না হুজুর, কাল এখান থেকে গিয়ে ইস্কুল করতি পারবো না। জোর পায়ে হেঁটে বদ্দিপুর পর্যন্ত গেলি আর ভয় নেই। আজ বদ্দিপুরির হাট। হাটে অনেক লোকজন, গাড়ি যাতায়াত করবে সন্দের পর। নমস্কার, হুজুর। দৃষ্টি রাখবেন একটু গরীবির দিকে।

—আসুন, নমস্কার। সাবধানে যাবেন।

—যে আজ্ঞে।

রামলাল সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ি রওনা হ’ল।

.

পথে বাজার পড়লো। ছোট ছেলেটার জন্যে একপোয়া মুড়কি নিয়ে যেতে পারলে ভাল হয়, কিন্তু হাতে পয়সা কম। দোকানে ঢুকে দোকানীকে জিজ্ঞেস করলে—কুঁচো গজা আছে?

—আছে।

—কত করে সের?

—দু’টাকা।

—মুড়কি কত করে?

—পাঁচ সিকে।

—দাও আধপোয়া।

নিজের খিদে খুবই পেয়েছিল কিন্তু ছেলেটার জন্যে না নিয়ে গেলে মন মানে কি?

পথে অন্ধকার নেমে এল। বড় বড় মাঠের ওপর দিয়ে রাস্তা। আজকাল চারিদিকে ভয়ভিত, একা অন্ধকারে পথে যেতে ভয় করে। আগে আগে একজন বৃদ্ধ লোক যাচ্ছে দেখে রামলাল তাকে ধরবার জন্যে লম্বা লম্বা পা বাড়িয়ে চললো। কাছে এসে দেখলে সে লোকটা জানিপুরের রব্বানি মোড়ল, সাদা লম্বা দাড়িওয়ালা সত্তর-বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ ব্যক্তি, দিব্যি জোরে জোরে পা ফেলে চলেচে। ওকে দেখে বললে—বাঁড়ুজ্যে মশাই কোত্থেকে আলেন?

—একটু গিইছিলাম ইনসপেক্টর আপিসে। তুমি?

—বাজারে থেকে আসচি। একটা গরু দর করতি গিইছিলাম।

—কি দর হল?

—দেড়শো টাকা। বড্ড দর।

—তোমাকে পেয়ে ভাল হল।

—আমারও।

—দু’জনে চলো আস্তে আস্তে হাঁটা যাক।

—আপনি একটু বসুন। আমি নমাজটা চট করে পড়ে নি।

বৃদ্ধ মাঠের মধ্যে একটা গাছের তলায় নমাজ পড়তে বসলো। তারপর আবার দুজনে পথ চলতে লাগলো। রব্বানি মোড়লও খুব খুশী হয়েছে নির্জন মাঠের মধ্যে একজন সঙ্গী পেয়ে। রামলাল বললে—কি গরু কেনবা?

—গাই গরু।

—তোমার আছে তো?

—আমার এক গোয়াল গরু ছেল। আপনার বাপ-মার আশীর্বাদে এখনো সাতটা গরুতে দুধ দ্যায় সাড়ে তেরো সের।

—বল কি?

—তা বাঁড়ুয্যে মশাই, একটু দুধ না হলি মোরা খাবো কি বলুন। ঘি তা বাজারে নেই, সর্ষের তেল তা বাজারে নেই, চিনি তা নেই, মাছ মাংস যা দর, তাতে মোদের মত নোক কিনি খেতি পারে রোজ রোজ? মানুষের খাদ্য-খাদক তো উঠেই গেল—

—যা বলেছ।

—আমরা যা খেয়ে গ্যালাম, এর পর যারা আসবে, তারা আর কি খাবে বলুন! এই দেশে আগে ষোল-আঠারো সের করে দুধ দেখিছি টাকায়। ঘি ছেল চোদ্দ আনা এক টাকা সের। তিন আনা করে খাঁটি সর্ষের তেল দেখেছি। এখন তার কি আছে বলুন? ক্ষেতে সর্ষে হয়, তাই এখনো খাঁটি সর্ষের তেলির মুখ একটু-আধটু দেখতে পাই—

—তোমরা আমাদের চেয়ে সুখে আছ—

—তার মানে আমাদের বাজার থেকি জিনিস কিনতি হয় না। অনেক জিনিস বাড়তি হয়—নইলি আমাদের দশাও আপনাদের মতো হ’ত—তাই ভাবলাম দুধ বড় জিনিস। গাইগরু আরও বাড়াতি হবে, নইলে কি খেয়ে বাঁচবে ছেলেপিলে?

সামনেই জানিপুর গ্রাম দেখা যাচ্ছিল মাঠের মধ্যে। রব্বানি বললে—এইবার বাঁড়ুয্যে মশাই মোর গেরাম তো এসে গেল। আপনারে একলা মাঠের মধ্যি ছেড়ে দিতি মন সরচে না—মোদের বাড়ি আজ রাতে থাকবেন?

—না মোড়ল, বাড়িতে যেতেই হবে, বাড়ির লোকে ভাববে। ভয় কি? আমার একা যাওয়া অভ্যেস আছে—

—সে কথা না বাবু, দিনকাল পড়েচে খারাপ। হিঁদু মোছলমান মানবে না, এ সব অঞ্চলে খুব ভয় হয়েছে জানেন তো? মারবে মাথায় লাঠি, তারপর আপনার কাছে যা পায় আর না পায়—

—তা বটে—তবে আমার কাছে কিছু নেই তো! এই আধ পোয়া মুড়কি ছাড়া।

—ঐ যে বললাম। তারা আগে দেখবে না আপনার কাছে কি আছে না আছে। আগেই মেরে বসবে। এক কাজ করুন, কালিচরণ মুচিকে চেনেন?

—না।

—রেলের গেটম্যান ছেল, লোকটা ডাকাত, চোর সব রকম। বিলির ধারে ডান হাতে তার বাড়ি। তার কাছে গিয়ে মোর নাম করে বলুন, আপনাকে সবাইপুরের পুল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতি। সেখান থেকে দুধারে গাঁয়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা। তাহলি চললাম বাঁড়ুয্যে মশাই, কিছু মনে করবেন না। একটু এগিয়ে গেলেই বিল দেখতি পাবেন।

রামলালের মনে ভয় যে একেবারে না হয়েছিল এমন নয়। সে আরও কিছু এগিয়ে গেল। মস্ত মাঠে অন্ধকার ঘন হয়ে নেমেচে, মাথার ওপর আকাশে অগণ্য নক্ষত্র ফুটে উঠেচে, ফাল্গুন মাসের প্রথম—এখনো শীত আছে। খোলা মাঠের হাওয়ায় রামলালের শীত করতে লাগলো—ভুল হয়েচে একখানা গায়ের কাপড় না নিয়ে বেরুনো। শ্যামলালের গর্ভধারিণী বলেছিল চাদর নিয়ে আসতে, সে কথা শোনা উচিত ছিল। ওটা কি?

রামলালের ভূতের ভয় আছে। সে দাঁড়িয়ে গেল। ভালো করে চেয়ে চেয়ে দেখলে অন্ধকারের মধ্যে। না, ওটা একটা কি গাছ, অন্ধকারে এ রকম দেখাচ্চে। বোধহয় কুল গাছ। সে আবার পথ চলতে শুরু করলে। রশি দুই পথ বেশ একটু ভয়ে-ভয়েই গেল। বিলের ধারে এক জায়গায় আলো জ্বলচে। নিশ্চয়ই সেই কালিচরণের বাড়ি। রামলালের মনে অনেকটা সাহস হল আলোটা দেখে। চেঁচিয়ে ডাকলেও তো মানুষের সাড়া মিলবে!

বিলটা খুব বড়, অনেক পদ্মফুল ফুটে থাকে গরমকালে। এখনো ফুল ফুটতে শুরু করেনি। একটা খড়ের ছোট্ট দো-চালা ঘর থেকে আলো বেরুচ্ছিল, রামলাল গিয়ে ডাকলে—ও কালিচরণ—কালিচরণ আছ?

ভেতর থেকে গম্ভীর, মোটা গলায় কে বলে উঠলো—কিডা আছে?

—আরে আমি, কালিচরণ। বাজার থেকে জানিপুরের রব্বানি আর আমি গল্প করতি করতি এলাম। তা সেই বললে, কালিচরণকে একটু বলুন গিয়ে যান, সবাইপুরের পুল পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসবে। তা আমিও বললাম কালিচরণ তো আমার চেনা লোক। খুব চিনি ওকে।

কালিচরণ বাইরে এসে দাঁড়লো, লম্বা কালো চেহারা। দেখলে মনে হয় এ লোক ডাকাতি করতে পারে বটে। রামলাল বললে—কালিচরণ, তোমার চেহারা দেখচি খারাপ হয়ে গিয়েচে—

—হ্যাঁ বাবু, জ্বর হইছিলো আষাঢ় মাসে। সেই থেকেই ভুগছিলাম।

—তুমি আমাকে একটু এগিয়ে দাও দিকি!

—হ্যাঁ চলুন, যাইগে বাবু। লাঠিটা নিয়ে আসি দাঁড়ান—

কালিচরণ লম্বা একটা লাঠি ঘাড়ে নিয়ে আগে আগে চললো। রামলাল কখনো কালিচরণকে দেখেনি, তার নামও শোনেনি। অথচ তার সঙ্গে এমন ধরনের কথা বলতে হচ্ছিল তখন, যেন সে কতদিনের পরিচিত।

কালিচরণ বললে—হামার বাবাকে আপনি জানতেন তো? বড় ভাল লোক ছিলো—উ রেলগাড়িতে কেটে মরলো মাদলার পুল বানানোর সময়—

—খুব জানি। অমন লোক আর হয় না। কি নাম ছিল যেন—

—গঙ্গারাম—

—গঙ্গারাম, গঙ্গারাম।

—এখনো গঙ্গারামের নাম শুনলে লোকের চোখের পানি গিরে—

—এই তো সেদিনও ফণীকাকার সঙ্গে গঙ্গারামের কথা হচ্ছিল—

—আচ্ছা বাবু, হামাকে ডাকাত বলে চালান দিয়ে দিল শালার লোগ! হামি ডাকাত আছে বাবু?

—আরে রাম রাম—তোমার নাম শুনলে সবাই এদেশে খুশী হয়। এখনো বাড়ির মেয়েরা তোমার কথা বলে।

—তা বলবে না? হামি ছেলের মতো আছে সোকলের।

—আমরা তো তাই জানি।

কালিচরণ খুব খুশী হয়ে সবাইপুরের পুল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল রামলালকে। বাকি পথটুকু সন্ধ্যার অন্ধকারে অতিক্রম করে রামলাল নিজের বাড়ি পৌঁছে গেল আধঘণ্টার মধ্যে। রামলালের স্ত্রী অন্নপূর্ণা উঠোনের শিউলিতলায় বসে হারিকেন লণ্ঠনের আলোতে কি করছিল, পায়ের শব্দ শুনে বললে—কে? কে?

—আমি। তুমি ওখানে কি করচো?

—মাছ দিয়ে গেল বিধুর মা। তাই বসে বসে বাছচি—

—কি মাছ?

—পুঁটি। তোমার কাজের কি হল?

—কিছুই না। বললে, শ্যামকে নিয়ে যেতে। তাকে চাকরি দেবার ইচ্ছে আছে।

—শ্যাম তোমার মত পণ্ডিতি করবে? তাই আর করেচে! সে মিথ্যে নিয়ে যাবে কেন? ওর মত হবে না।

—একবার বলে দেখি! কোথায় গিয়েচে?

—পতিতপাবনদের বাড়ি সত্যনারাণের পুঁথি পড়বার জন্যে ডেকে নিয়ে গিয়েচে—

.

স্বামী-স্ত্রীতে মিলে পরামর্শ হল এর পরে। রামলালেরও ইচ্ছে নয় ছেলেটা চিরজীবন ইস্কুলে মাস্টারি করবে এই পাড়াগাঁয়ে। ওরা জানে তাদের ছেলে গ্রামের সেরা ছেলে। অমন পদ্য লিখবার ক্ষমতা এ গাঁয়ের কোন ছেলের আছে? সবাই ওকে ডেকে নিয়ে যায় বিয়ের সভায়, সত্যনারাণের পুঁথি পড়তে। এমন সুন্দর পুঁথি পড়তে পারে, দু’দণ্ড বসে শুনবার মতো। নিজেদের ছেলে বলে বলচে না রামলাল, যেমন চেহারা, তেমনি গুণ। শ্যামলালের বাবা বলে সত্যি মনে মনে এক এক সময় গর্ব হয় রামলালের।

অনেক রাত্রে পুঁথি পড়ে শ্যামলাল বাড়ি ফিরলো। হাতে তার বড় কাঁসার জামবাটিতে সত্যনারাণের কাঁচা প্রসাদ, অন্য হাতে কলা-মুলো পাটালি। এসেই বললে—বাবা এয়েচ?

রামলাল তামাক খেতে খেতে বাইরে এসে বললে—এসেচি অনেকক্ষণ। তুই কোথায় ছিলি?

—দেখতেই পাচ্চ। সত্যনারাণের সিন্নি ছিল গুরুদাসদের বাড়ি।

—খাওয়ালে তোকে?

—হ্যাঁ, গুরুদাস আবার খাওয়াবে। জানো না কেমন ওরা? ওই যেমন সবাইকে প্রসাদ খাওয়ায়, তেমনি আমাকেও খাওয়ালে।

—সারা দিন উপোস করে ছিলি?

—নাঃ—পুঁথি পড়বো তার আবার উপোস কি? ভারি বিয়ে তার দু’পায়ে আলতা ।

—যা হাত-পা ধুয়ে খেয়ে নিগে যা।

—তোমার কাজের কি হল বাবা?

—তুই খেয়ে আয়, বলচি।

শ্যামলাল আহারাদির পরে বাবার কাছে এসে বসলো। রামলাল আজকের দিনের সব খুঁটিনাটি ঘটনা বললে। শ্যামলাল শুনে বললে—আমায় কবে দেখা করতে বলচেন ইনসপেক্টর বাবু?

—তুই কি মাস্টারি করবি?

—তুমি বললে করবো না কেন? তোমার কি মত?

—আমার মত তা নয়। আমি আমার নিজের জীবনটা নষ্ট করেছি, আবার তোকে তা করতে দেবো না।

—তুমি তো বলে খালাস। সংসার চলবে কি করে?

—সে আমি বুঝবো।

—তোমার কথা শুনলে আমার রাগে গা জ্বলে যায় বাবা। তোমার বয়েস হল বাষট্টি বছর। তুমি এখন আর কি করবে? আমার ওপর সব ছেড়ে দাও। আমি বুঝে নিচ্চি—

—না। যা বলচি, তাই শোন। আমার মতে তুই চলবি না তোর মতে আমি চলবো?

—তবে ইনসপেক্টর বাবুর কাছে বলে এলে কেন যে আমাকে নিয়ে তুমি সেখানে যাবে?

—অত বড় লোক একজন, মুখের ওপর না বলতি পারি?

—যখন বলেচ তখন নিয়ে যেতে হবে, সে আমি শুনবো না। তুমিই বাবা আমায় এমন করে রেখেচ। আমায় কোথাও যেতে দেবে না, কোনো কাজ করতে দেবে না—তবে আমি কি করে মানুষ হবো বলো! আমায় যেতে দাও বাইরে।

—আমি এক মতলব ঠাউরেছি। চল, পশ্চিমে তোর সেজমামা ডাক্তারি করে যেখানে, পাহাড়-জঙ্গলের জায়গা, সেখানে তুই আর আমি চলে যাই। সে দেশ ভারি ভালো। তোর বড্ড ভাল লাগবে। আমি সেখানে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করবো। দুজনে মিলে যা হয় কিছু করা যাবে। তাই চল। আজ পথে আসতে আসতে ওই কথাই ভাবছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *