১. রান্না হল

হাজারদুয়ারি – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

০১.

রান্না হল?

প্রায়।

ভরত কোথায়? ওর ভাষা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না?

না। সারল্য ভাষার বাধা ভেঙে দেয় যে! ভারি সরল ছেলেটি!

কোথায় সে?

 বাগানে আছে বোধহয়।

আমাকে একটা জলচৌকি আর হামনদিস্তা এনে দিতে হবে কিন্তু কাল।

দেব, দেব। এত দূর নিয়ে এলাম তোমাকে আর এসব তো…

বেশিদূর আর কোথায়? মাত্র শচারেক মাইল তো!

 শ্ৰী ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ওই মোড়াটা টেনে নিয়ে বোসো না যদি কাজ না থাকে।

অন্য কাজ আর কী থাকবে? বাইরের দরজাটাতে ভেতর থেকে আরেকটা খিল লাগাবার বন্দোবস্ত করতে হবে শুধু। তা বিকেলেও করা যাবে। বাজারে কাঠের মিস্ত্রির দোকানও দেখে এসেছি গিয়ে। দোতলা থেকে পাহাড় জঙ্গল বেশ দেখায়, না?

সত্যি।

খুব সংসারী হয়ে উঠেছ দেখছি। এবং প্রকৃতি-প্রেমিক।

 জবাব এড়িয়ে গিয়ে গোপেন বলল, রান্নার কত দেরি?

প্রথম দিন আমার হাতে খাবে। নার্ভাস লাগছে তো! কাল কিন্তু নীপাদি দারুণ খাওয়ালেন দু-বেলা। তাই না?

তুমি কী কী করলে? সকালে বাজারটা কেমন করলাম সেটাও এল!

খুউব ভালো। ডাল করেছি।

 কী? কী ডাল?

 ছোলার। নারকোল দিয়ে।

আর?

কুমড়ো ভাজা।

আর?

লাউয়ের তরকারি।

ধনেপাতা দিয়েছ? কালোজিরে?

নিশ্চয়ই।

আর?

আর খাওয়ার সময় দেখতেই পাবে।

 বাঃ। আর?

আরও? টোপা কুলের টক।

বা: বা :

ছেলেরা মেয়েদের মতো রান্নার ইনস অ্যাণ্ড আউট-এর সব জানুক তা আমার পছন্দ নয়। এটা আমাদের নিজস্ব জগৎ। মেয়েদের জগৎ।

তা হলে কী হয়! পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো রাঁধুনিরা সবাই তো পুরুষ।

সে তারা মাইনের জন্যে রাঁধে। আনন্দের জন্যে তো রাঁধে না।

আর তুমি?

 আমি রাঁধি ভালোবাসার জন্যে। ভালোবাসার সঙ্গে। তাই তো রোজ রাঁধতে ভালোই লাগে না আমার।

এখন আসল মতলবখানা এল তো কী? এককাপ চা চাই বুঝি?

দেখেছ! তোমার বুদ্ধিই আলাদা।

 এতক্ষণ আমড়াগাছি না করে তো বললেই হতো। তোমার সঙ্গে আমিও খেতাম। নতুন জায়গা, নতুন বাড়ি, ধকল তো সকাল থেকে কারোই কম গেল না। পরশু রাতের অন্ধকারে এসে ওঠা। তার ওপরে আবার ঠিক কালই অতক্ষণ লোডশেডিং। গতকাল তো সারাটা দিনই প্রায় কাটল নীপাদির বাড়িতেই।

যা বলেছ! ভাগ্যিস নীপাদি ছিল। ভাড়ার ফার্নিচার থেকে কাজের লোক সবকিছুই ঠিক করে রেখেছেন। সত্যি। শালি হোতি তো অ্যায়সি!

বোসো না। কড়াইটা নামিয়ে চায়ের জলটা চাপাই।

 তোমাকে রান্না করতে দেখাটা তো একটা নতুন এক্সপিরিয়েন্স। সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু। মুখটি কেমন তেতে লাল হয়ে গেছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে নাকে, কপালে। বগলতলি..

থামো তো এবার। কীসের সঙ্গে কী। লেখাপড়া করেছ বটে কিন্তু রুচি জিনিসটাই গড়ে ওঠেনি তোমার।

সে জন্যেই তো আমার ছেলেবেলার পাড়াছাড়া করিয়ে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে আনলে এত দূরে আমাকে। তবে, রুচি ব্যাপারটা কিন্তু রিলেটিভ। আমাদের বাড়িতে যা সুরুচি, তোমাদের বাড়িতে সেটাই কু।

ওসব কথা থাক। তা ছাড়া তাড়া কীসের? এখন তো রোজই ওই নিয়ে লেগে থাকবে ঠোকাঠুকি।

চা আমি করছি, তুমি ভরতকে দেখে এসো। কোথায় গেল ছেলেটা! বাগানে সাপ-টাপ নেই তো?

পাহাড়ি জায়গা। বাগান থাকবে আর সাপ থাকবে না?

ওর মন ভালো না।

কার?

ভরতের। নীপাদি ওর মা-বাবা ছাড়া করে নিয়ে এসেছেন এত দূরে! ওদের বাড়ি নাকি কেন্দ্রাপাড়া না কোথায়। অনেক দূর।

তাই?

গোপেন বলল।

মন কি তোমারই ভালো?

মা, বাবা, দাদা, কাকা, কাকিমা ছেড়ে নিজের সংসার পাতলে আলাদা হয়ে। মনে তো দুঃখ হবেই। কিন্তু আমরা মেয়েরা যে সকলকে ছেড়ে এসে হঠাৎ একদিন তোমাদের বাড়ির একজন হয়ে যাই! সেই হয়ে-যাওয়াটার পেছনে কতখানি কষ্ট থাকে তা কি তোমরা কোনোদিনও বোঝো?

বাজে কথা বোলো না। ওসব কষ্ট হত আগেকার দিনে। যখন মেয়েরা কম বয়েসে শ্বশুরবাড়ি আসত। আজকাল সব এম এ, পি এইচ ডি করে, চাকরি করে, স্বামীর ঘরে আসে মেয়েরা। শ্বশুরবাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে থাকে কী করে বউয়ের মন জোগাবে তার আবার…

থাক। আজকে আর এসব আলোচনা করব না।

না করাই তো ভালো। আলাদা তো হয়েই এসেছে। এখন আলোচনা করা তো উচিতও নয়।

শ্রী আরেকবার গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকাল গোপেনের দিকে।

গোপেন, ভরত! ভরত! বলতে বলতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

০২.

এখানে অফিসে আজই প্রথম জয়েন করছে গোপেন। সবাই অচেনা। স্টোরস-এ বোসদা আছেন শুধু। কলকাতায় ছিলেন। অবশ্য জি এম-ও চেনা কারণ কলকাতায় এ জি এম ছিলেন কিছুদিন। তবে তার সবচেয়ে বড়ো ভরসা এই যে সকলেই নিশ্চয়ই জেনে গেছেন যে গোপেনের স্ত্রী শ্রীর বড়োমামা আর এই কোম্পানির এম ডি একগেলাসের বন্ধু, ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বার, একসঙ্গে বিলেতে পড়াশুনো করেছিলেন।

অবশ্য এইটে সকলে জানবে বলেই গোপেনের লজ্জা করছে। কারো মাধ্যমে যদি এখানে ট্রান্সফারের মূল কারণটাও ফাঁস হয়ে যায় তবে আর বাড়িতে কারো কাছেই মুখ দেখাতে পারবে না।

শ্রী দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিল। মুখে বিজয়িনীর হাসি।

গোপেন কথা না বাড়িয়ে বড়োরাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।

শ্রী বলল, অফিস থেকে ফিরলে আমরা বেড়াতে যাব। তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু।

 ভরতও বলল, চঞ্চল ফিরিবা বাবু।

 ভারি হাসিখুশি ছেলেটি।

 যেমন কারখানা তেমনই অফিস। কলকাতার হাওড়ার অফিসের সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না। সেখানের এ জি এম-এর যা ঠাটবাট এখানের একজন ফোরম্যানেরই তার চেয়ে ঢের বেশি। গোপেনের নিজস্ব বিরাট অফিস, ব্যক্তিগত পিওন, গাড়িও স্যাংশন হয়ে গেছিল নিজস্ব। তবে নতুন সরকার আসাতে আটকে গেছে। গোপেন মনে মনে বলল, ভালোই হয়েছে। জীবনে যেমন পঞ্চাশের আগে একরকম আর পঞ্চাশের পরে আরেকরকম, আর্থিক অবস্থার জীবনেও গাড়ি থাকার আগের স্তর পর্যন্ত একরকম আর পরের স্তরে একেবারে অন্যরকম। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এবং অপরিচিত মানুষদের কাছে তো অবশ্যই, একেবারে কাছের মানুষদের সঙ্গেও নতুন করে সম্পর্ক পাতাতে হয়। গাড়ি থাকলেই মানুষকে অন্যে দূরের মানুষ বলে ভেবে নেয়। স্কুটার, মোটরসাইকেল আর পদাতিকরা একদলের আর গাড়িওয়ালারা অন্য দলের। গাড়ি চড়ার আনন্দ ম্লান হয়ে যায় অন্যদের নানারকম মানসিক প্রতিক্রিয়ায়। তা ছাড়া, গাড়ি কিনলেই স্ট্যাটাস বেড়ে যায়। ছেলে-মেয়েরা নিজেদের বড়োলোকের ছেলে-মেয়ে ভাবে। একের পর এক সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। গাড়ি পেলেও নেবে না ঠিক করেছে। এম ডি সেনসাহেব গোপেনকে ডেকে পাঠালেন।

চমৎকার মানুষ। তবে এত যে কম বয়েস তা বুঝতেই পারেনি গোপেন। এই মানুষ কী করে শ্রীর টাকমাথা প্রৌঢ় বড়োমামার সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশুনো করতে পারেন তা মাথায় এল না গোপেনের। একে কলকাতাতে দেখেওনি কখনো।

ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে সুমন সেন বললেন, আপনার আত্মীয় ঘোষসাহেব ইংল্যাণ্ডে আমাদেরই ইউনিভার্সিটিতে একটি কোর্স করতে গেছিলেন ছ-মাসের। সরকার থেকেই পাঠিয়েছিল। উনি যখন কোর্স শেষ করেন তখনই আমার শেষ সেমেস্টার শেষ হয়। বুঝতেই পারছেন। আমি হয়তো আপনার চেয়েও বয়েসে ছোটো হব। আপনার কোন ইয়ারের গ্রাজুয়েশন?

আমি গ্রাজুয়েশন করিনি। ইন্টারমিডিয়েট করেই যাদবপুরে ঢুকেছিলাম।

একই কথা। একট যোগ-বিয়োগ করলেই হবে। আমি প্রেসিডেন্সি থেকে বি এসসি করি সেভেনটিতে।

গোপেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

তাহলে তো আপনি ছোটোই আমার চেয়ে। তবে বিদ্যাবুদ্ধিতে অবশ্য আপনি অনেকই..

শীট।

বলে দু-হাত শ্রাগ করল সুমন। দারুণ সপ্রতিভ, সুদর্শন, ব্যক্তিসম্পন্ন মানুষ।

খেলাধুলো করতেন, মানে করেন?

 এম ডি জিজ্ঞেস করলেন গোপেনকে।

 সে, ইউনিভার্সিটিতে।

কী?

ফুটবল, ক্রিকেট, টেবল-টেনিস।

এখানে একটা স্কোয়াশ-কোর্ট করছি। ক্লাবের পেছনটাতে। আসুন স্কোয়াশ খেলা যাবে। নাথিং লাইক ইট। টেনিস এমনিতেই আছে।

ম্যারেড তো নিশ্চয়ই! নইলে মামাশ্বশুর আসবেন কোত্থেকে।

এম ডি বললেন।

হ্যাঁ। তাড়াতাড়িই বিয়ে করতে হয়েছিল। বোঝেনই তো! জয়েন্ট ফ্যামিলি আমাদের। নিজের ইচ্ছেতে তো সব কিছু হয় না।

আহা। বেশ করেছেন। বঙ্গভূমে বিয়ে করার মতো অবশ্যকর্তব্য আর কী আছে! তা ছাড়া আপনার যোগ্যতা, বয়েস সবই যখন…।

কথাটাতে কোনো খোঁচা ছিল কি না ঠিক বুঝতে পারল না গোপেন।

সুমন, গোপেনের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে টেবলের কোনাতে পেছন ঠেকিয়ে বসেছিল। দু-দিকে দু-হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে কথা বলছিল। ভারি সপ্রতিভ, সুন্দর, সুগন্ধি মানুষ। গায়ে অথবা চুলে কী মেখেছেন তা জানে না গোপেন কিন্তু সুগন্ধও মেয়েদেরই মতো পুরুষের সঙ্গী হলে তার ব্যক্তিত্ব যে অন্য মাত্রা পায় তা এই প্রথম উপলব্ধি করল গোপেন। এমন সুগন্ধি, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ আগে কখনো দেখেনি ও।

 সুমন বলল, চলুন, আপনার সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দিই। এই হুরহুলাগড় ইণ্ডাস্ট্রিজ-এর আণ্ডারে কুড়িটি কোম্পানি আছে। এরকম কম্পোজিট প্রজেক্ট ভারতবর্ষের আর কোথাও নেই। একই ক্যানোপির আণ্ডারে এতরকম ডাইভার্সিফায়েড ইউনিটসও কোথাও নেই। শুধু ভারতবর্ষই নয়, হয়তো পৃথিবীর কোথাও নেই। ওড়িশার এই অঞ্চলের মতো অঞ্চল সত্যিই কম আছে। হুরহুলাগড় ইণ্ডাষ্ট্রিজ হোল্ডিং কোম্পানি।

দেখুন মিস্টার ব্যানার্জি আপনাকে বলে রাখা ভালো প্রথমে যে, অফিসের আর কারখানার বাইরে আমরা বন্ধু। দুজনে দুজনকে ফাস্ট নামে ডাকব। আপনি আমাকে সুমন বলবেন আর আমি আপনাকে গোপেন। প্রকৃত বন্ধুর মতোই মিশব আমি। কিন্তু অফিসের আর কারখানার মধ্যে আমি বস। আপনি সাবর্ডিনেট। আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করবেন। আমি মি : ব্যানার্জি বলে ডাকব আপনাকে।

গোপেনের মাথাটা বুকের কাছে নুয়ে ছিল।

বলল, নিশ্চয়ই স্যার।

ফাইন।

 আরও একটা কথা মি: ব্যানার্জি। আমার সঙ্গে আমার অফিসার এবং শ্রমিকদের ভালোবাসা কিন্তু কাজের ভালোবাসা। যে যেমন কাজ করবেন আমার ভালোবাসা এবং অবভিয়াসলি আমার দেয় সি সি আর ঠিক সেইরকমই হবে। এই হুরহুলাগড় ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড পাবলিক সেক্টর কোম্পানি হলেও এ একেবারেই এক অন্যরকম পাবলিক সেক্টর কোম্পানি। যে-কোনো প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানিকে, আমাদের সমান স্ট্যাচারের; আমরা হারাতে পারি, ইন এনি ফিল্ড, এনি মোমেন্ট। হ্যাঁণ্ডস ডাউন। আপনি নতুন আসছেন তাই এত কথা বলা দরকার। হোল্ডিং কোম্পানি অথবা তার আণ্ডারে যে কুড়িটি কোম্পানি আছে তাদের প্রত্যেকের আলাদা সেটআপ। প্রত্যেকের আলাদা জি এম এবং একজন করে এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর। কিন্তু ইন ম্যাটারস অফ ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন, ইট ইজ মাই ওপিনিয়ন হুইচ প্রিভেইলস, আদারওয়াইস আই টুইট। দে ওল নো ইট। দে ক্যানট অ্যাফর্ড টু লুজ মি।

ইয়েস স্যার। আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড।

ডু উ্য? ওয়াণ্ডারফুল! আমি একা নই, আপনি এবং আমরা সকলে মিলে এই হুরহুলাগড় ইণ্ডাষ্ট্রিজকে ভারতীয় পাবলিক সেক্টর আণ্ডারটেকিং-এর এক মডেল করে তুলব।

বলেই, ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন এম ডি গোপেনের দিকে।

গোপেন যেন বশীকৃত হয়ে গেছিল। সেও ডান হাত বাড়াল। সুমনের হাতে হাত রাখতেই সে এমন এক উষ্ণ চাপ বোধ করল যে তার সারাশরীর যেন এক নতুন কর্মোদ্দীপনাতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। শরীরের সমস্ত শিরা-ধমনীতে রক্ত ছোটাছুটি শুরু করল দারুণ বেগে। এক নতুন মানুষকে সে অনুভব করল, উপলব্ধি করল নিজের মধ্যে; যে মানুষ নিজে অথবা অন্যকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে বা করাতে সক্ষম, যার ক্ষমতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

একটি সাদা মারুতি জিপসি চালাচ্ছিল সুমন নিজেই। শেডের পর শেড পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। বাঁ-হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান-হাত জানালা দিয়ে বাইরে ছড়িয়ে দিয়ে দেখাতে দেখাতে চলেছিল সুমন। ব্লকের পর ব্লক।

একটু পর স্পিড কমিয়ে আনল সুমন। তারপর পারচেজ অফিসের সামনে দাঁড় করাল জিপসিকে।

নেমে, দারোয়ান তাকে স্যালুট করার আগেই, নিজেই মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করল দারোয়ানকে। দারোয়ানের মুখে এক অদ্ভুত সম্ভ্রম লক্ষ করল এম ডির প্রতি গোপেন, যা কোনো অফিসের কোনো দারোয়ানের মুখেই সেদিন অবধি দেখেনি। দারোয়ানেরা সেলাম করেই। কিন্তু ভালোবাসা বা ভক্তির সঙ্গে কাউকেই করে না। সুমনকে করল। গোপেন দেখল।

গটগট করে হেঁটে একের পর এক করিডর পেরিয়ে পারচেজ ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে দরজা খুলে ঢুকল সুমন গোপেনকে নিয়ে।

 মস্ত বড় ঘরের মধ্যে মস্ত বড়ো টেবল। তার সামনে বিরাট রিভলভিং চেয়ারে ছোটোখাটো এক ভদ্রলোক আদ্দির আধময়লা পাঞ্জাবি ও ধুতি পরে জোড়াসনে বসেছিলেন।

এম ডি-কে ঢুকতে দেখেই তাড়াতাড়ি উঠতে গেলেন। চেয়ার ছেড়ে।

 সুমন বলল, ক্যারি অন সুরেশবাবু ক্যারি অন। পাঞ্জাবি আর ধুতিটা আর একটু পরিষ্কার কি হতে পারত না? আপনার সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এলাম। টুল শপ-এর নতুন ম্যানেজার গোপেন ব্যানার্জি। আজই জয়েন করেছেন।

তারপর গোপেনকে বললেন, মি: ব্যানার্জি রিকুইজিশন আপনি সুরেশবাবুকেই পাঠাবেন। থ্র প্রপার চ্যানেল। সুরেশ মহাপাত্র। ইনিই আমাদের প্রত্যেকটি ইউনিট-এর লাইফ-ব্লাড সাপ্লাই করেন। আ ভেরি ডেডিকেটেড অফিসার। অ্যাণ্ড ভেরি অনেস্ট।

সুরেশবাবু ততক্ষণে দু-হাতের পাতা দিয়ে ইঙ্গিতে ওদের বসতে বলে সামনে যে ভদ্রলোক বসেছিল তাকে বললেন ওড়িয়াতে, এই যে মি: আগরওয়ালা। ভালোই হল এম ডি নিজেও উপস্থিত আছেন। এখন বলুন আপনাকে আর অর্ডার দেব কেন? গতবারের লট-এ আপনি যে কাগজ দিয়েছিলেন তা বস্তাপচা। কাগজের রং বিভিন্ন বেরিয়েছে। অথচ আপনারা নাকি ম্যানুফাঁকচারারের পুরো ওড়িশার হোলসেল ডিস্ট্রিবিউটর? এই দামে আমরা তো টিটাগড়ের চৌদুয়ার ফ্যাক্টরি থেকে বন্দোবস্ত করে নিয়ে বণ্ড কিনতে পারি মশাই।

সে ওন্যায় হয়ে গেছে মহাপাত্রসাহেব। একবার হোল বোলে কি বারবার হোবে? বলুন সাহেব?

আরে ছাড়ান দ্যান মশাই। আমি আবার সাহেব হইল্যাম কবে? না, না। ডিসঅনেস্ট সাপ্লায়ার আমরা রাখি না।

এম ডি কানে কানে বললেন গোপেনকে, মহাপাত্রসাহেবরা ঢাকায় ছিলেন বহুকাল।

আপনি একটু বলুন এম ডি সাহেব। লাইফে আর এরকম ভুল কোখনো হোবে না।

 আমার কিছুই বলার নেই। পারচেজ-এর ব্যাপারে সুরেশবাবুর কথাই শেষকথা। এমনকী আমার কথাও উনি ফেলতে পারেন। সে অধিকার আমিই ওঁকে দিয়েছি। এবার আপনি একটু বাইরে যান। আমাদের কথা আছে।

মহাপাত্রবাবু বললেন, একটু কেন? কাজের কথা তো শেষই হয়ে গেছে আপনার সঙ্গে। আপনাকে আর স্টেশনারির অর্ডার দেব না। আমাদের কোনো টেণ্ডারে আপনি অ্যাপ্লাইও করবেন না। আমি যতদিন এই চেয়ারে আছি ততদিন আপনার নাম দেখলেই ঘ্যাচাং করে কেটে দেব। কোনটা ভুল আর কোনটা চুরি, তা বোঝার মতো বুদ্ধি আমি রাখি আগরওয়ালা। অন্য অনেক পাবলিক সেক্টর কোম্পানি আছে, প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানিও আছে যেখানে পারচেজ ম্যানেজারেরা তোমার ভাষায় রিজনেবল, তুমি তাদেরই সাপ্লাই দাও। তোমারও ভাল, তাদেরও ভালো। এখানে এসে আর সময় নষ্ট কোরো না। তোমাদের সময় মানেই পয়সা। সেটুকু তো বুঝি, না কি? যাও।

আগরওয়ালা চলে গেলেই সুমন বলল, মহাপাত্রসাহেব।

 আঃ। আপনেও। সাহেব?

 এম ডি বললেন হ্যাঁ। অফিসটা অফিস।

এই গোপেনবাবু আপনার বাড়ির কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। গোপেন ব্যানার্জি।

কেন? কোয়ার্টার অ্যালট করা হয়নি?

না। হঠাৎ এলেন তো। কোয়ার্টারের জন্যে এখুনি ওকে নিয়ে যাচ্ছি এস্টেট ম্যানেজার ত্রিপাঠীজির কাছে। কিন্তু যতদিন না বি টাইপ কোয়ার্টার খালি হচ্ছে ততদিন এঁদের একটু দেখাশোনা করবেন। সেটল করতে সময় লাগবে তো একটু।

নিশ্চয়। নিশ্চয়। দাঁড়ান একটু নস্যি নিই। নিবেন নাকি একটিপ?

গোপেন নাক সিঁটকালো। সুমন বলল, কবে যে এই প্রি-হিস্টরিক ঘাস্টলি হ্যাঁবিবটা ছাড়বেন। মহাপাত্রসাহেব।

ছাড়ুম। ছাড়ুম। কইছি না আগে। কবে ছাড়ম? যেদিন বিয়া করুম।

সুমন হাসল।

বলল, তবে আর ছাড়া হল না। নেত্রনালিতে ঘা হয়ে যাবে। সাইনাসে অক্কা পাবেন।

ইউ!

মহাপাত্রসাহেব বললেন।

আচ্ছা। এবারে চলুন মি: ব্যানার্জি। এস্টেট ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যাই।

এস্টেট ম্যানেজার ত্রিপাঠীজি নিজে সিভিল এঞ্জিনীয়ার। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির। খদ্দরের ট্রাউজার আর হাফ-হাতা হাওয়াইন শার্ট পরা। পান খান। বেনারস থেকে এই সুদূরে পান আনান। বাড়িতে নরম ন্যাকড়াতে ভিজিয়ে সেই মঘাই পান পরমযত্নে রাখেন। জর্দাও আনান ডালকা মণ্ডির এক পুরনো দোকান থেকে। পান-জর্দা ইস্তেমাল করে ত্রিপাঠীজি খাতির করে ওঁদের বসিয়ে একটু কেশে বললেন, প্রবলেম অ্যায়সি হু চুকে হেঁ যো কা কঁহু। পরিস্থিতি বহুতই গম্ভীর হ্যায়। নয়া ফ্ল্যাট বনতা হ্যায়। পুরে মোজাইককি। পহিলেওয়ালাই আপহিকি দুংগা বনার্জি সাব।

কব তক বন যায়েগা ত্রিপাঠীজি?

সামনের পেতলের রেকাবী থেকে একটু চুন তর্জনী দিয়ে উঠিয়ে মুখে দিতে দিতে বললেন, লগভগ ইক সাল লাগেগী স্যার। মগর থ্রি-বেডরুম কোয়ার্টার। রিভার ফেসিং। দোনো সাইডমে বারান্দা। পিছ সাইডমে হুরহুলা পাহাড়ভি দিখ পড়েগা। ছোটাসা বাগিচাভি লগেগি। বীচমে ঝুলা। ইকদম বনার্জি সাহেবকি লায়েক হুজৌর।

জেরা জলদি নেহি হোনে শকতা?

গোপেন একটু বাহাদুরি করে বলল।

 ত্রিপাঠীজি বললেন, দেখিয়ে সাহাব, মকান তো জিন্দগীমে ইকইবার না বনতা। উসমে জলদিবাজি নেহি করনা চাহিয়ে। যো টাইম লাগতি হ্যায় মকান বননেমে ঔর জোড়ি বননেমে উহ টাইম লেড়কি আর মকানোঁকো তো জরুরই দেনা হ্যায়। নেহিতো সবকুছ বরবাদ হো যাতা।

সুমন উঠে পড়ে বলল, আচ্ছা। নমস্তে ত্রিপাঠীজি। আপকি কোই প্রবলেম? হামারা লায়েক কোঈ সিওয়া?

 ফিনান্সকি জাদা প্রবলেম হো রাহা হুজৌর। ফ্যাকাও নে কুছ বিল জলদি পাস করেঙ্গে তো কাম ওরভি তেজীসে আগে বড়নে শকতা থা।

ঠিক হ্যায়। ম্যায় বাত করুঙ্গা।

 গোপেন বলল, ম্যাকাও কি স্যার?

ম্যাকাও?

ম্যাকাও, ফ্যাকাও।

ওঃ।

হেসে ফেলল সুমন।

 বলল, আমিও আগে জানতাম না। আমরা তো অ্যাকাউন্টস-এর লোক নই। ফ্যাকাও মানে হচ্ছে ফিনানশিয়াল অ্যাডভাইসার অ্যাণ্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার। এসব নামাবলি পাবেন পাবলিক সেক্টর কোম্পানিগুলোতে। ডেপুটি অ্যাকাউন্টেন্ট, জয়েন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, অ্যাডিশনাল অ্যাকাউন্টেন্ট, সিনিয়র অ্যাকাউন্টেন্ট, চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট। চিফ অ্যাকাউন্টেন্টও পাবেন একাধিক। তাঁদের ওপরে সিনিয়র চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট। তারও ওপরে ফ্যাকাও।

আর ম্যাকাও?

আরে মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি কলকাতার বনেদি বাড়ির ছেলে, ম্যাকাও-এর নাম শোনেননি?

ওহো। ম্যাকাও। সে তো পাখি। মামাবাড়িতেই আছে। অ্যাকাউন্ট্যান্টদের মধ্যে বলে, মানে; ঠিক…

সুমন হেসে উঠল।

 জিপসিতে উঠে সুমন বলল, এবারে চলুন আপনার নিজের ইউনিটে। টুল শপ কিন্তু আমাদের সবচেয়ে ক্রুশাল ইউনিট। অনেকদিন ধরে ম্যনেজার না থাকায় একটু ডিস অ্যারেঞ্জড আছে। আপনি নিজে দেখে আমাকে একটি রিপোর্ট দেবেন। যা সাজেশান থাকবে তাও দেবেন। এগজিস্টিং সিস্টেমে, মানে আমার ম্যানেজমেন্টে যদি ঠিকমতো রেজাল্টস আসার অসুবিধা হবে বলে আপনি মনে করেন তবে তাও নিঃসংকোচে লিখে জানাবেন। আমি সুপারম্যান নই। আমাদের সকলের মাথা একসঙ্গে লাগিয়ে যাতে এই ইণ্ডাস্ট্রি আমরা প্রফিটে রান করাত পারি– শ্রমিকদের এবং আমদেরও বিন্দুমাত্র না ঠকিয়ে– সেটাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আমাদের অফিসারদের কোনো সুপিরিয়রিটি বা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সও নেই। কোম্পানির পক্ষে যেটা ভালো সেটাই প্রত্যেকের কাম্য। কোনোরকম হ্যাঙ্গ-আপস বটলনেক-এর সম্মুখীন হলেই আমাকে সোজা জানাবেন। এই কার্ডটি রাখুন। আনলিস্টেড নাম্বার আমার। বাড়ি ও অফিসের। কিন্তু লেসার দ্য কমপ্লেইন, দ্য মেরিয়ার। মনে রাখবেন। আই ওয়ান্ট ওল মাই ম্যানেজারস টু ইণ্ডিপেণ্ডেটলি হ্যাঁণ্ডল দেয়ার অ্যাফেয়ার্স। যে ম্যানেজার যত কম সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসবেন তাকেই আমি তত ভালো ম্যানেজার বলব। উ হ্যাভ আ ফ্রি হ্যাঁণ্ড। ওয়ার্ক অনেস্টলি অ্যাণ্ড এফিশিয়েন্টলি দেন এভরিথিং ইজ দেয়ার ফর ইওর আস্কিং। দ্যাটস মাই প্রবলেম। আই গিভ উ্য মাই ওয়ার্ড।

 টুল শপ–এর দরজাতে এম ডি যখন জিপসিটাকে দাঁড় করালেন, দারোয়ানেরা ঠিক সেইভাবেই স্যালুট করল। বাঁ-হাত দিয়ে বাঁ-দিকের দরজা খুলে দিলেন এম ডি। কিন্তু নিজে নামলেন না।

আপনি?

 গোপেন একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল। অবাকও হল।

 সুমন হেসে বলল, ইটস ইওর হাউস মি: ব্যানার্জি। দে আর ইওর বয়েজ। গো অ্যাণ্ড ইন্ট্রোস ইওরসেল্ফ।

গোপেন কিছু বলার আগেই সাদা মারুতি জিপসিটা লাল ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। পথের দু-পাশের গাছে লাল ধুলোর আস্তরণ গাঢ় হল। গোপেন লক্ষ করল সাদা জিপসির পেছনে লেখা আছে লালে, My Heart bleeds… but it bleeds for myself.

লোকটা গোলমেলে আছে।

মনে মনে বলল গোপেন। ভগবান বলে মনে হচ্ছে বলেই ভূত হওয়ার সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিতে পারল না। আফটার ওল, শিশুকাল থেকে কলকাতায় থাকা সন্ধিগ্ধ মানুষ।

.

০৩.

বসবার ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়েছিল শ্রী। জায়গাটা জঙ্গল পাহাড় ঘেরা। গা-ছমছম করে। নামটাই লক্ষ্মীছাড়া। হুরহুলাগড়। সন্ধে অনেকক্ষণই হয়ে গেছে। নতুন জায়গা। তারপর কলকাতা নয়। রাস্তায় আলো নেই। লোকজন, গাড়িঘোড়া কিছুই নেই। তবে শুক্লপক্ষ। তাই বাঁচোয়া। চাঁদের আলোয় চারধার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কাছিমপেঠা পাহাড়টাও। ভুতুড়ে ভূতুড়ে। কীসব জঙ্গুলে ফুলের গন্ধ আসছে বাইরে থেকে। ঝিঁঝি এখন ডাকছে না তবে দুটো পেঁচা ক্রমাগত ঝগড়া করছে সূর্য ডোবার পর থেকেই। ভরত রান্নাঘরে আটা মেখে রাখছিল। যাতে খাওয়ার সময় গরম গরম রুটি সেঁকে দিতে পারে। ভরত কাছে থাকলে তাও একটু সাহস পায়। ছোটো হলেও সে এই বনজঙ্গলেরই মানুষ।

শ্রী মাঝে মাঝে ভরতের কাছে গিয়ে কথা বলে সাহস সঞ্চয় করে ফিরে আসছে। তাকে অবশ্য বলছে না যে, সে ভয় পেয়েছে।

ভরত বলছে, এসে যাবে দাদা। কারখানা তো অনেক দূর আছে এখান থেকে। টাউনশিপের বাস যাবে আধমাইল দূর দিয়ে। তা ছাড়া টাউনশিপের বাসের ভরসা কী? এখানে নিজের একখানা বাহন না থাকলে কোনো উপায়ই নেই। সে সাইকেলই হোক কি ইসকুটার কি মোটর সাইকেল। থাকতেই হবে। ট্যাক্সি ও ভটভটিয়া ভাড়া পাওয়া যায় বটে কিন্তু কোনদিকে যাবে সে তা তাদেরই মর্জি। তা ছাড়া মিটার মানে না কেউই। পিসেঞ্জারদের কাছ থেকে ছিনতাইও করে মাঝেমধ্যে। টাউনশিপের মধ্যে হলে অন্য কথা। চওড়া চওড়া পিচের রাস্তা, সাজানা-গোজানো বাগান, লাল নীল সব বড়ো বড়ো আলো। টাউনশিপের নিজের বাস রাত এগারোটা অবধি চলে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। আপনারা বউদি এতদূরে বাড়ি ভাড়া কেন নিলেন? দাদার তো যেতে আসতেই দুঘণ্টা কাবার হয়ে যাবে। তাও এখন তো গরম পড়ে এল। বোঝা যাবে না। কিন্তু শীতকালে কী হবে? অন্ধকার থাকতে বেরোতে হবে আবার গভীর অন্ধকারে ফিরে আসতে হবে।

 কী আর বলবে শ্রী!

বলল, তাই তো। বাড়ি তো নীপাদিরাই ঠিক করেছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, কাছে থাকলে দেখাশোনার সুবিধে হবে। তা তুই তো কেন্দ্রাপাড়ার ছেলে। তুই হুরহুলাগড়ের এত কিছু জানলি কী করে?

বাঃ রে! আমার বাবা প্লান্টে কাজ করত না? বাবা মরে যেতেই তো মা আমাদের নিয়ে কেন্দ্রাপাড়াতে ফিরে গেল। এখন আমি আবার রোজগার করতে এলাম। আমি তো বড়োছেলে!

রাত প্রায় ন-টার সময়ে দরজার বেল বাজল।

কে?

আমি।

গোপেনের গলা পেয়েই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল শ্ৰী। দরজা খুলেই চমকে গেল। ভেবেছিল ক্লান্তিতে বিরক্তিতে বেঁকে থাকবে গোপেন কিন্তু এই গোপনকে যেন চেনেই না শ্রী। তার মুখচোখ ঝকঝক করছে। কে বলবে যে, সকাল আটটাতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল!

শ্রী অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার?

দেরি হয়ে গেল অনেক। ইনস্টলমেন্টে একটা স্কুটার কিনতে হবে কালই।

কালই?

হ্যাঁ কালই। নইলে হবে না।

 চালাতে পারবে?

সাইকেল চালাতে জানলেই ওই সব চালানো যায়। একটু দেখে নিলেই হল।

চা খাবে? ভরত।

ভরত পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বলল, ইদরখ উদরখ ডালকে বানা?

বিকেলে বানানো ওর আদা-দেওয়া চাকে শ্ৰী ভালো বলাতেই এই বিপত্তি।

কিন্তু শ্রী উত্তর দেবার আগেই গোপেন বললো, না না। চা-টা খাব না। একটু গরম জল পেলে চানটা করে নিতাম। নতুন জায়গা তো! হবে?

হবে না কেন? গরম জলের অসুবিধে কী?

 রান্নাঘরের লাগোয়া বাগানের এককোনাতে জ্বালানি কাঠ জড়ো করা আছে।

বলার আগেই ভরত দৌড়ে চলে গেল। বলল, আভভি লায়া।

ও চলে যেতেই শ্রী বলল, ভারি উৎসাহী আর চটপটে ছেলেটা। আনন্দ করে কাজ করে। কলকাতাতে এমন কাজের লোক পাওয়া যায় না কেন এল তো? কাজ করতে বললেই সকলের মুখ ব্যাজার।

সে তো আমারও হতো। কলকাতায় তো পাঁচটাতে বাড়ি ফিরে আসতাম। এ জায়গার জাদু আছে।

জাদু?

 শ্রী বলল, অবাক গলায়।

গোপেন হাসল।

 বলল, হ্যাঁ জাদু।

কীসের জাদু?

জাদুকরের জাদু। এখানে এক জাদুকর থাকে। হুরহুলাগড়-এর জাদুকর।

সে আবার কে?

সে আছে। বলব পরে। এখানের সবকিছু চলে তারই অঙ্গুলিহেলনে। সে-ই এখানকার প্রাণপুরুষ।

রাতে টিভিতে সাড়ে নটার নিউজ শোনার পর খেয়ে-দেয়ে যখন শুল ঘরের বাতি নিবিয়ে তখনই প্রথম গভীরভাবে অনুভব করল শ্রী জায়গাটার নির্জনতা। গতরাতে, আগের দিনের জার্নির ক্লান্তি, নতুন জায়গাতে পোঁছোনোর উত্তেজনা, ইত্যদিতে ভালো করে ঠাহর করেনি। চাঁদের আলো এসে পড়েছে দোতলার খোলা জানালা দিয়ে। ধবধবে সাদা মেঝেতে কালো গরাদের ছায়া পড়েছে। জানালার পাশেই একটি বাঁদর-লাঠি গাছ। তার আন্দোলিত পাতাদের কালো ছায়া নড়ছে মেঝেতে। চিরিপ, চিরিপ, চিরিপ করে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে একটি পাখি ডাকছে সুনির্মল কলুষহীন চন্দ্রালোকিত আকাশে। রেল স্টেশনটা কাছেই, কিন্তু কোনো শোরগোলই নেই। দিনে-রাতে সকাল-বিকেল চারখানি গাড়ি চলাচল করে, যাত্রীবাহী। আপ ডাউনে। তা ছাড়া, মালগাড়ি যায়। থামেও কিছু। ট্রেন-আসা ও ট্রেন-যাওয়ার ঘণ্টিগুলি পরিষ্কার শোনা যায় ওদের বাড়ি থেকে। ইয়ার্ডে মাল খালাস হয়, মাল লোডিং হয়। এখানে নিয়ারে বন্দর পারাদ্বীপ। সেখান থেকে হুরহুলাগড়-এর মাল বিদেশে চালানও যায়।

শ্রী পাশ ফিরে গোপেনের বুকে ডান হাতটি রাখল। বলল, কী সুন্দর ফুলের গন্ধ। পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

শ্ৰী আবার বলল, এখনও কি আমার ওপর রাগ যায়নি?

 কীসের রাগ?

তোমাকে কলকাতা থেকে নিয়ে আসার রাগ।

রাগ তো করিনি।

করেছ।

 তবে তো জানোই, মিছে বিরক্ত করছ কেন!

এখনও আমাদের ছেলে-মেয়ে হয়নি। হলে কি পারতাম এমন জায়গায় আসতে? তার স্কুল; কত্বরকম চিন্তা। বদলিটদলি হতে হয় ঝাড়া-হাত-পা থাকার সময়ই। বেড়ানো টেরানো, হই হই করা সেসব এখুনি। তার পরই তো দায়িত্ব আর দায়িত্ব।

হুঁ।

 গোপেনকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে বলল, শ্রী, এখানে যেন বেশ হানিমুন হচ্ছে। আমাদের। কী এল? কলকাতার বাড়িতে তোমাদের ল্যাজারাস কোম্পানির খাটে একটু পাশ ফিরলেই যা শব্দ হত! আর পাশের ঘরেই দাদা। দরজার পাশ দিয়ে, তলা দিয়ে আওয়াজ আর আলো আসত। এবং ভয়ও। ছোটকুনটা আবার মাঝে মাঝেই দরজার ফুটোতে চোখ লাগিয়ে… অ্যাডোলেসেন্ট তো! এত লজ্জা করত আমার। সবসময়ই উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকতাম। লজ্জা করত। ভয়ও।

ছোটকুন-এর কথা তো এলনি আমায়।

আমরাও তো অ্যাডোলেসেন্ট ছিলাম একসময়। কিন্তু এ কী! এ যে পারভার্শন! বলা উচিত ছিল।

গোপেন বলল।

 তারপর বলল, লজ্জা ব্যাপারটাও ল্যাজারাস কোম্পানির ফার্নিচারেরই মতো আউট ডেটেড, অ্যান্টিক হয়ে গেছে আজকাল। কলকাতা ছেড়ে তো এসেইছ। এখন ওসব আলোচনা কেন? কলকাতার ভালোটুকুই শুধু মনে রেখো। যতটুকু খারাপ তার সবটুকুকেই ভুলে যেয়ো।

 শ্রী বুঝল, আজকে কিছু ঘটেছে গোপেনের জীবনে যা ওকে অনেকখানি বদলে দিয়েছে। এই স্বল্পবাক, অফিসের কাজে ফাঁকিবাজ অন্যমনস্ক গোপেনকে সে কখনোই এমনভাবে লক্ষ করেনি। একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল শ্রীর। গোপেনকে সে কখনোই বলেনি তার বড়ড়া জা, তার অবিবাহিত দুই ননদ, তার শাশুড়ি তার সঙ্গে কীরকম চক্রান্তময় খারাপ ব্যবহার করেছেন। দিনের পর দিন। সে সুন্দরী বলে, সে বিদুষী বলে, সে মা হতে পারেনি বলে। অথচ গোপেনকে বহুবার বলা সত্ত্বেও সে নিজেকে পরীক্ষা করায়নি। অথচ গোপেনদের পরিবার বনেদি, সম্ভ্রান্ত এবং উচ্চশিক্ষিত। শ্রীদের পরিবারের সঙ্গে কোনোদিক দিয়েই গোপেনদের তুলনা চলে না। কিন্তু এ পরিবারে আট বছর ঘর করার পর শ্রী নিঃসংশয়ে জেনেছে যে গোপেনরা ভীষণ গোঁড়া ও প্রাচীনপন্থী। তাদের পরিবারের সকলের ডিগ্রিগুলোইপাকানো কাগজ হয়ে আলমারির দেরাজেই রয়ে গেছে, আশীর্বাদ হয়ে পৌঁছোয়নি জীবনে। গোপেন বেচারা ভালোমানুষ। নিজের ফাঁকির এবং স্বল্প মাইনের চাকরি, বউকে আদর করা, দাবা খেলা এবং গরমের আর বর্ষার দিনে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানো এই নিয়েই ওর জীবন। শ্রীকে আদর করাটাও গোপেনের কাছে একটি কর্তব্য বিশেষ ছিল। স্কুলের রুটিনের মতো। সপ্তাহের দিন ভাগ করা আছে। কোনো বৈচিত্র্য নেই, উচ্ছ্বাস নেই; সমারোহ নেই। বিয়ের মাত্র আট বছর পরেই শ্ৰী জীবনানন্দের শুকরী হয়ে গেছে যেন। অথচ একটা এবং একটামাত্র জীবন নিয়ে কত কীই না করার ছিল। আশা এখনও ছাড়েনি শ্ৰী। তার মতো আশাবাদী মেয়ে খুব কমই আছে। সব কিছুর মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেওয়ার এক দৈবী ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে ও। কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর সব সহপাঠীই বলত, শ্রী না থাকলে কোনো কিছুই জমে না। না পড়াশুনো, না পিকনিক, না কমনরুম, না কফিহাউসের আড্ডা। কোথায় গেল সেই সব দিনগুলো। বন্ধুরা সব কোথায় কোথায় বিয়ে করে, চাকরি জুটিয়ে ছড়িয়েছিটিয়ে গেছে। জনাদশেক চলে গেছে দেশ ছেড়ে। কতবার বেড়াতে যেতে বলেছে। কিন্তু যাবে কী করে? গেপেনকে নিয়ে ভবানীপুর থেকে বালিগঞ্জ যাওয়া যতখানি কঠিন তার চেয়ে ভারতবর্ষকে ঠেলে কানাডাতে নিয়ে যাওয়াও অনেক সোজা ছিল। মনের কোণে এক ধরনের বিদ্রোহ অনেক দিন ধরেই জমে উঠছিল শ্রীর কিন্তু সে অনেকই বুদ্ধিমতী বলে সেই চাপা আগুনে পাখা করেনি। যে-কোনো সম্পর্কই ছেঁড়া খুব সহজ। কিন্তু একটি ছেঁড়া সম্পর্কর মধ্যেই অগণ্য ছেঁড়া সম্পর্কর বীজ সুপ্ত থাকেই। অনেকই দেখেছে শ্ৰী, এমন। কোনো সম্পর্কই নিটোল নয়, সর্বাঙ্গসুন্দর নয় একথাও ও জানে বলেই গোপেনের অনেক অপূর্ণতা মানিয়ে নিয়েই একসঙ্গে সুখীমনে থেকেছে। এবং থাকছে।

কিন্তু এই হুরহুলাগড়-এ গোপেনকে নিয়ে একা আসাতে ও ঠিক করল না ভুল, তা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। জায়গাটা যে এত দূরে এবং এমন পান্ডব-বর্জিত সে বিষয়ে ওর কোনো ধারণাই ছিল না।

গোপেন উঠে একটা সিগারেট ধরাল তারপর মোড়াটাকে জানলার পাশে নিয়ে গিয়ে বসল।

শ্রী বলল, একটা চাদর-টাদর গায়ে দিয়ে বোসো। এখনও বেশ ঠাণ্ডা আছে।

হুঁ।

দুপুরে কী খেলে?

অফিসারস ক্যান্টিন আছে।

ভালো খাবার?

কলকাতার থেকে ভালো।

কী খেলে?

স্যুপ। মাছের একটা প্রিপারেশন। চিকেন। লেমন টার্ট। কফি।

বাবাঃ। এ তো জব্বর খাওয়া। রান্না কেমন?

খুব ভালো। এই কুক আগে গভর্নর হাউসের কুক ছিল।

কোথাকার?

ওড়িশার।

তাই?

যাক বাবা। আমি ভেবেছিলাম তুমি যদি খুশি না হও।

খুশি না হয়ে উপায় নেই। সে ভারও জাদুকরের।

 কী যে হেঁয়ালির-হেঁয়ালি কথা এল বুঝি না। খুলে এল না।

বলব। আমার নিজের কাছেও ব্যাপারটা হেঁয়ালি।

তাই?…

বলেই, শ্রী চুপ করে গেল।

একটু পর বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমোচ্ছি। সারাদিন গোছগাছ করে বড়ো পরিশ্রম গেছে। আরও তিনচার দিন লাগবে। তোমার বইগুলো কিন্তু তুমি একটু দেখে গুছিয়ে। দুটি টেবলের ওপর ডাঁই করে রাখা আছে।

ঠিক আছে।

ওপাশ ফিরে পায়ের কাছে রাখা চাদরটা গায়ে টেনে নিয়ে শ্রী বলল, তুমি শোবে না?

হুঁ।

গোপেন আজ গল্প করার মুডে নেই বুঝেই শ্রী চুপ করে রইল।

 নীপারা ওড়িশাতেই সেটলড। ওড়িয়াদের মতোই ওড়িয়া বলতে পারে। নীপার স্বামীর পদবি চ্যাটার্জি। অনেক পুরুষ আগে কলকাতার বাস উঠিয়ে ওরা ওড়িশার সম্বলপুরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসে। অশেষদার ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিলেন ডাক্তার। খুব ভালো পসার ছিলো তাঁর। তার পর থেকেই সবই ওখানে।

ওড়িশি সংস্কৃতি বলতে যে নিজস্ব একটি ব্যাপার আছে তা হুরহুলাগড়-এ না এলে বুঝতে পর্যন্ত পারত না শ্ৰী। কলকাতায় বসে সহজ ও লজ্জাকর উচ্চমন্যতায় কলকাতার বাসিন্দা বাঙালিরা হয়তো হুরহুলাগড় নামটি নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাও করতে পারেন। কিন্তু যাঁদের অজ্ঞতা এবং কূপমন্ডুকতা যত বেশি, অন্যকে বা অন্যদের নিয়ে সহজে ঠাট্টা তামাশা করা তাঁদেরই তত বেশি আসে।

নীপাদির ছেলে-মেয়েরা প্রণাম করার সময় দু-হাত দিয়ে প্রণম্যর দুটি পায়ে হাত রেখে প্রণাম করে। একগ্লাস জল দিতে হলে ডানহাতখানিতে গেলাসটি ধরে তা এগিয়ে বাঁ-হাতের আঙুল দিয়ে ডানহাতের কনুই ছুঁয়ে থেকে তবে তা দেয়। এমনি ছোটোখাটো অনেক কিছু শেখার আছে এঁদের কাছে। খুব ভালো লাগে শ্রীর এই সব ব্যপারগুলো। বারো-তেরো বছরের ভরত, বহুদূরে নিজের গাঁ ও মা-বাবাকে ছেড়ে শ্রীদের কাছে কাজ করতে এসেছে। যে, তার কাছে বসে নানা গল্প শোনে ও অবসর সময়ে। নীপাদি বলেছেন তুমি ভরতের সঙ্গে ওড়িয়াতে কথা বলার চেষ্টা করবে দেখবে, অল্পদিনেই ওড়িয়া বলা শিখে যাবে। মুখে বলতে পারলে তারপর এককপি করে সমাজ দৈনিক কাগজ রাখবে, দেখবে ওড়িয়া পড়তেও শিখে গেছ। স্ক্রিপটা অবশ্য গোল গোল। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলি মতো, কিন্তু চেষ্টা করলেই শিখে নিতে পারবে। মাঝে মাঝে ম্যাটিনি শো-তে তোমাকে ওড়িয়া ছবি দেখাতে নিয় যাব। দেখবে তিন মাসে শিখে গেছ ওড়িয়া!

নীপাদির সঙ্গে শ্রীদের কোনো আত্মীয়তা নেই। অশেষদার বাবা বড়োমামার সঙ্গে কলকাতায় একই কোম্পানিতে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। সেই সুবাদে ওরা হুরহলাগড়ে আসার আগে চিঠি দিয়ে দিয়েছিলেন নীপাদিদের। ওই একটি চিঠি পেয়েই বাড়ি ঠিক করে ফেলেছিলেন নীপাদিরা। বাড়ি, মোটামুটি সাজিয়েও ফেলেছিলেন। ভাঁড়ার ঘরে সাত দিনের রসদ, গ্যাস সিলিণ্ডার; কাজের লোক ভরত। যেদিন ওরা রাতের বেলা এই পাহাড়ের দিগন্তরেখা-ঘেরা জঙ্গলে জায়গাতে এসে গা-ছমছম করা হুরহুলাগড় নামের এই নির্জন স্টেশনে এসে নামল সেদিনও সব উষ্ণতা নিয়ে সপরিবারে স্টেশানে এসে ওদের রিসিভ করেছিলেন। রাতে নিজেদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে খাইয়ে-দাইয়ে তার পর আগে থেকে ঠিক করে রাখা ট্যাক্সি করে ওদের ভাড়া-বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছিলেন ভরতকে সুষ্ঠু। পরদিন শনিবার সকালে এসে নিয়ে গেছিলেন নিজেদের বাড়ি। সারাদিন খাইয়ে-দাইয়ে টাউনশিপ ঘুরিয়ে সব দ্রষ্টব্য স্থান দেখিয়ে রাতের বেলা আবার পোঁছে দিয়ে গেছিলেন।

 টাউনশিপের মধ্যে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের আর ডিরেক্টরদের বাংলো, গেস্ট হাউস, ম্যানেজারদের বাংলো দেখে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছিল শ্রীর। নিজের মনেই অস্ফুটে বলেছিল, এত বড়ো বাড়িতে মানুষ থাকে কী করে?

অশেষ হেসে বলেছিল, ওই দেখো শ্ৰী। ওগুলো বি-টাইপ বাংলো। ম্যানেজারদের। গোপেনবাবু এইরকম বাংলো পাবেন।

নইলে ফ্ল্যাট।

কবে?

উত্তেজিত হয়ে বলেছিল শ্রী।

খালি হলেই পাবেন। বি-টাইপের একটু টান আছে। ম্যানেজার তো এখানে প্রায় কুড়ি একুশ জন। ডি জি তিনজন। জি এম একজন। ডিরেক্টরও অনেক। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছাড়া। অনেকগুলি ইউনিট তো। পারাদীপ হবার পর হুরহুলাগড়-এর ইম্পর্টেন্সই বেড়ে গেছে বহুগুণ। আরও বেড়েছে সেনসাহেব ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে আসার পর।

কেন?

কেন, তা বলতে পারব না। এ মানুষটা একেবারে অন্য জাতের মানুষ। প্রত্যেকেই একে ভালোবাসে।

প্রত্যেকে যাকে ভালোবাসে তিনি কাজের মানুষ হতেই পারেন না। তাঁর অনুরাগীর চেয়ে শত্রু বেশি থাকবেই।

শত্রু নেই যে তা নয়। উনি যে-কোনো সময় খুনও হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ওঁর শত্রুরা জানে যে যেখানে ওঁর রক্ত পড়বে সেখান থেকেই তাদের সর্বনাশ নিশ্চিত হবে।

দেখতে হয় তো মানুষটাকে!

অন্যমনস্ক হয়ে গোপেন বলেছিল।

তোমাকে তো ওঁর কাছেই রিপোর্ট করতে হবে প্রথম দিন। তুমি তো দেখতে পাবেই।

আমি?

শ্রী বলেছিল।

 তুমিও দেখবে। অফিসার্স পার্টি-টার্টিতে। ক্লাবে গেলে। ওই দেখো হুরহুলাগড় ক্লাব, ওই যে উঁচু টিলাটার ওপরে শাল আর শিমুল বনের মধ্যে মধ্যে। ওখানে থাকার বন্দোবস্তও আছে। অল্পদিনের জন্যে যাঁরা আসেন অথবা ব্যাচেলার তাঁরা তো ক্লাবেই থাকেন। সুইমিং পুল আছে, টেনিস আছে, শীতকালে ব্যডমিন্টন, ভেতরে টেবল টেনিস।

তাস-দাবা নেই?

হ্যাঁ, তাও আছে। তবে তাস-দাবা লোকে তো বাড়িতে বসেই আরাম করে খেলে কে আর সে জন্যে ক্লাবে আসে।

তা বটে!

অন্যমনস্ক গলায় আবারও বলেছিল গোপেন।

.

০৪.

টুল শপ ঘুরে সবে অফিসে এসে বসেছে গোপেন এমন সময় ইন্টারকমটা বাজল। এম ডি-র ব্লিংকারটা ক্লিপ ব্লিপ করতে লাগল।

ইয়েস, স্যার।

 গুড মর্নিং ব্যানার্জি। তোমার পি এ কি আজ আসেননি?

এখনও তো দেখছি না।

পুল হার আপ। উই আর নট আ প্রাইভেট কনসার্ন। দ্য ট্যাক্সপেয়ার্স পে আওয়ার স্যালারিজ। টেল হার টু বি অ্যাট হার সীট টেন মিনিটস বিফোর টাইম।

রাইট স্যার।

আমার ঘরে একটু চলে আসুন। অন্যদেরও ডেকেছি। আপনার সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দেব।

আসছি স্যার।

ডু উ হ্যাভ আ ট্রান্সপোর্ট?

নো স্যার।

আই উইল অ্যারেঞ্জ।

 থ্যাঙ্ক ঊ্য।

আলোটা নিভে গেল।

পরমুহূর্তেই ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজার ফোন করলেন, স্যার দ্য জিপ ইজ অন দ্য ওয়ে। প্লিজ কিপ দ্যাট ভেহিকল উইথ স্ট্য। প্লিজ গেট ড্রপড অ্যাট ইওর হোম এভরি ডে অ্যাণ্ড টেল দ্য ড্রাইভার হোয়েন ডু উ্য ওয়ান্ট টু বি পিকড আপ দ্য নেক্সট মর্নিং।

থ্যাঙ্ক ঊ্য পানিগ্রাহী।

এম ডি বহত গালি দেল্লে স্যার। হউ। দোষটা তো মোর। আউ কঁড় করিবি? কেমতি যে এ ম্যাটারটা মিস হই গন্থা বুঝি পারলু না। ভেরি সরি স্যার।

ঠিক আছে পানিগ্রাহী। এত কাজের মধ্যে ভুল তো হতেই পারে। ডোন্ট ওয়ারি। থ্যাঙ্ক ট্য এগেইন।

নো মেনশন স্যার।

জিপ আসতেই জিপে গিয়ে বসল গোপেন।

তম নামক?

 বাইধর আইজ্ঞা।

ঘর কউটি?

ভবানী পটনা আইজ্ঞ। কালাহাভী।

 মু জানিচি।

আজটু মু আপনংকু ডিউটি করিবি।

মু জানিচি। বাহার হেল্বা কি?

 হেল্লা আইজ্ঞা।

কেত্বে পুও? কেত্বে ঝিও?

 গুট্টে পুও গুট্টে ঝিও।

 তম্বে তো ফ্যামিলি-প্ল্যানিং কম্লিট করি সারিলা।

বাইধর হাসল। বলল, হ আইজ্ঞাঁ।

এম ডি-র অফিসের সামনে প্রায় পনেরো কুড়িটা গাড়ি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। কী ব্যাপার কে জানে?

কে মানে আসিলা বাইধর?

আপুনি জানিনান্তি কি?

নাহি, তো!

আল্লো স্যর। বিজ্ঞ পট্টনায়েক বাবু আসিলানি যে।

সত্য?

সত্য।

গত তিন মাসে এম ডি-এর মুখে এই ভদ্রলোকের নাম অনেকবারই শুনেছে গোপেন। কলকাতার মানুষ বিজু পট্টনায়েক সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানেন না। শুধু এই জানেন যে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকানোকে প্লেন চালিয়ে নিয়ে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন। দুর্ধর্ষ পাইলট, ওড়িশার মাটিতে শিল্পর প্রথম পত্তনকারী হিসেবেও অনেকে জানেন। কিন্তু এম ডি-র কাছে যা শুনেছে গোপেন তা একেবারে অন্য ধরনের কথা।

 গোপেন যখন গিয়ে পৌঁছোলো তখন উনি উঠছেন। চা খেয়ে এম ডি-র অনুরোধে দুটো পানও মুখে দিলেন। ধুতি পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘাঙ্গ সুপুরুষ। এণ্ডির পাঞ্জাবির নীচ থেকে শক্ত বলিষ্ঠ হাত বের করে গোপেনের সঙ্গে করমর্দন যখন করলেন তখন গোপেনের মনে হল যেন কোনো সুদেহী যুবকের সঙ্গেই করমর্দন করল।

উনি বললেন, ইটস আ নাইস টিম অব বয়েজ। কিপ ইট আপ। দ্য কান্ট্রি ডিসার্ভস ইট ফ্রম উ্য ওল অ্যাণ্ড উ্য ডিসার্ভ ইট ফ্রম দ্য কান্ট্রি। ইট ইজ ঊ্য পিপল দ্য ফিউ পিপল হু রিয়্যালি আর দ্য কান্ট্রি। কিপ দ্য ফ্ল্যাগ ফ্লাইং অ্যাণ্ড দ্য কান্ট্রি উইল রিমেম্বার ঊ্য।

 ওঁকে গাড়িতে তুলে দিতে ওঁরা প্রত্যেকেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে পর্চ অবধি এলেন। প্রত্যেকের সঙ্গেই হাসিমুখে হ্যাঁণ্ডশেক করে গাড়িতে ওঠার আগে এম পি-র পিঠে একটি চাপড় মেরে ওড়িয়াতে বললেন, এব্বে চালিলিরে পিলা। আই অ্যাম প্রাউড অফ ঊ্য। মু পুন আসিবি।

ওঁর গাড়িটি চলে গেলে সকলেই যার যার কাজে ফিরে গেলেন। এম ডি গোপেনকে থাকতে বললেন।

ঘরে এসে বসতে বসতে বললেন, আপনার চা-টা তো খেয়ে যাবেন।

 কোথায় এসেছিলেন উনি?

ঠিক কোথায় এসেছিলেন তা বললেন না। তবে যেখানে এসেছিলেন সেখানেই শুনেছেন। যে আমি এখানে আছি। দেখুন কত্ব ভালোবাসেন আমাকে। সেই কত্ব বছর আগে ইংল্যাণ্ডে একবার আলাপ হয়েছিল শ্যামলকাকার মাধ্যমে। দেখুন! মনে করে রেখেছেন। মানুষ কখনো গুণ না থাকলে বড়ো হয় জীবনে? ওঁর কথা তো আপনাকে আগেও বলেছি।

হ্যাঁ স্যার। বলেছেন।

দুঃখ হয় কী জানেন, আমাদের পশ্চিম বাংলাতে যদি বিধানবাবুর পর এই বিজুবাবুর মতো একজন মানুষও থাকতেন তাহলে কী ভালোই না হত। এই মানুষটি ওড়িশার জন্যে যে কী কী করে গেছেন তা মানুষ বুঝতে পারবে তাঁর মৃত্যুর পর। নিজের রাজ্যও তাঁকে ন্যায্য সম্মান দিল না।

আপনার শ্যামলকাকা কে?

আরে শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ। বার্ড হাইলজার্স-এর মাইনিং এক্সপার্ট ছিলেন। পরে ডিরেক্টরও হয়েছিলেন। তারপর রিটায়ার করে নিজের কোম্পানিও করেছিলেন। টালাক কোম্পানি। কিন্তু ১৯৬২-তে বিজুবাবু যখন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী তখন শ্যামলকাকার সঙ্গে হঠাৎ ভুবনেশ্বরের গভর্নমেন্ট গেস্ট হাউসে দেখা। বিজুবাবু বলেছিলেন, একটা চ্যালেঞ্জ আছে, সাহস থাকে তো এগিয়ে এসো। শ্যামলকাকাও অমনি দশ মিনিটের মধ্যে ওড়িশা মাইনিং করপোরেশানের পুরো দায়িত্ব মাথায় নিয়ে নিলেন। ওড়িশার মতো ধাতুসম্পদ ভারতে আর কোথায় আছে বলুন? কিন্তু শ্যামলকাকার কাছেই শুনেছি যে সামান্য কেরানি থেকে চিফ-সেক্রেটারি পর্যন্ত, আমলাতন্ত্রের সকলকে, রেড-টেপিজিয়মকে পুরোপুরি কবর দিয়ে তিনি এমনভাবে ওই মহান পরিকল্পনার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। যেমন কর্মশক্তি, তেমন উদ্যম, তেমন প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর তেমনই সাহস। শ্যামলাকাকা ওঁর কথা বলতে বলতে আবেগাভিভূত, উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন একেবারে। তা ছাড়া দেখুন আমার সঙ্গে তো আধঘণ্টার আলাপ হয়েছিল ইংল্যাণ্ডে। আমি বলেছিলাম, ভুবনেশ্বরে গেলে কি আমায় চিনতে পারবেন?

হেসে বলেছিলেন, টেলিফোন অপারেটরকে আমার নাম বলবে। আমার সঙ্গে কানেক্ট করিয়ে দেবেন এক্সচেঞ্জ। তার পর আমি চিনতে পারি কি পারি না সেটা আমার ওপরই ছেড়ে দিয়ো।

দেখুন কারো কাছে আমার কথা শুনে আমি ওড়িশারই হুরহলাগড়ে আছি জেনে আমাকে কত বাহবা দিয়ে গেলেন। বলে গেলেন গত তিন বছর ধরে তোমার সব খবর আমার কানে আসছে। আই অ্যাম প্রাউড অফ ঊ্য ইয়াং বয়।

বলেই, এম ডি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ইয়াং না থোরী!

তার পর গলাটা একটু খাঁকড়ে নিয়ে বললেন, তা ছাড়া কৃতিত্ব যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা তো আমার একার নয়। আপনাদের প্রত্যেকের সহযোগিতা ছাড়া কিছুই করা যেত না।

অনেকে কিন্তু ওঁর নিন্দাও করেন স্যার। নানা কথা বলেন।

তা তো বলবেনই। আমাদের দেশে যাঁরাই কাজ করেন তাঁদেরই নিন্দাটাই বেশি হয়। এমন নিষ্কর্মা লোকের দেশ তো আর হয় না! নিন্দা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আর যাঁরা আপনার সঙ্গে অসহযোগিতা করে স্যার?

গোপেন হেসে বলল।

তাঁদেরও প্রয়োজন আছে। তারা না থাকলে সকলেরই গায়ে মরচে ধরে যেত। অ্যাডভার্সীদের চেয়ে বড়ো বন্ধু কিন্তু আসলে আর নেই ব্যানার্জিসাহেব। দে আর আওয়ার ব্লেসিংস ইন ডিসগাইজ।

আপনার শ্যামলকাকা কি বেঁচে আছেন স্যার?

না। ওঁর পুরো নাম শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ। শান্তিনিকেতনে শেষবয়েসে সেটল করেছিলেন। গত হয়েছেন কয়েক বছর হলো। উনি আমার আপন কাকাও নন। বাবার বন্ধু। ওঁর একটি চমৎকার বই আছে। ওঁর এই জঙ্গুলে পেশার জগৎ নিয়েই লেখা। বইটির নাম জঙ্গলে জঙ্গলে। আমাদের লাইব্রেরিতেও আছে। বইটি নিয়ে পড়বেন। লেখক হিসেবেও চমৎকার ছিলেন উনি। মানুষ হিসেবে তো ছিলেনই!

যাঁরা চমৎকার হন তাঁরা সব হিসেবেই চমৎকার হন। যেমন আপনি।

 ডোন্ট পুল মাই লেগস। আই নো মাই লিমিটস। বাই দ্য ওয়ে, আপনি আসার পর কিন্তু টুল শপ আমাদের গ্রেট হেল্প হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া আপনি কতক্ষণ থাকেন এবং কী করেন তাও আমার চোখ এড়াচ্ছে না। উ্য আর অ্যান অ্যাসেট টু আস মি: ব্যানার্জি।

বাই দি ওয়ে, আপনি যে এত রাত করে বাড়ি ফেরেন আপনার স্ত্রী রাগ করেন না? ছেলে-মেয়েরা?

 গোপেন মুখ নীচু করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, রাগ করেন না। তবে বোরড ফীল করেন নিশ্চয়ই। শিক্ষিত মহিলাদের নিয়ে এই বিপদ।

কোন ডিসিপ্লিনের? উনি?

উনি ইংরিজিতে এম এ। এবং ডক্টরেটও করেছিলেন।

মাই গড। আর এখানে একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে হুরহুলাগড়-এর স্টেশানের কাছেই বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে বিশ্বজয় করে আসা স্বামীর পথ চেয়ে তাঁর দিন কাটছে। হোয়াট আ শেম। আপনি কীরকম লোক মশায়! আগে একথা বলবেন তো! আমাদের স্কুল এবং কলেজের হেডদের সঙ্গে আমি আজই কথা বলব। ছিঃ ছিঃ। অবশ্য দোষটা আমারই। প্রথম দিনেই আমার এ সম্বন্ধে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। দ্য ফল্ট ইজ এন্টায়ারলি মাইন।

গোপেন চুপ করে রইল।

আমার প্রশ্নের একটি উইং-এর জবাব কিন্তু আপনি দিলেন না।

এমন সময় ফোনটা বাজল।

 ইয়েস। দিল্লি? কে? সুমিতা প্লিজ টেল দিল্লি টু গেট ব্যাক আফটার ফিফটিন মিনিটস। আর বিশ্বল সাহেবকে প্রোডাকশন চার্ট নিয়ে আমার কাছে আসতে এল এক্ষুনি। চ্যাটার্জি আর গুণ্ডাপ্পাকে এল বাজেট নিয়ে আসতে। ওঁরা এলে তারপরই কথা বলব দিল্লির সঙ্গে।

হ্যাঁ। যা বলছিলাম।

আমার ছেলে-মেয়ে নেই স্যার।

নেই? ওঃ। আই অ্যাম সরি। কিন্তু এমনভাবে আপনি কথাটা বললেন যেন একটা ফাইন্যাল ডিক্লারেশন দিচ্ছেন। ফানি! ভেরি ফানি ইনডিড। ক-দিন বিয়ে করেছেন আপনি?

আট বছর।

ফু: আট বছরেই হাল ছেড়ে দিলেন। আমি ডঃ ঘনশ্যাম কুণ্ডুর কাছে পাঠিয়ে দেব আপনাদের এই উইক এণ্ডেই। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেব। দু-এক দিন ছুটিও নেবেন প্রয়োজন হলে। ঊ্য মাস্ট গো অ্যাণ্ড কনসাল্ট হিম। নইলে ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেব। কোম্পানির খরচায়।

কোম্পানি দেবে কেন?

সে জবাবদিহি আমি করব। যতক্ষণ আমি নিজে না নিচ্ছি আমাকে প্রশ্নটা করবে কে?

অডিটার নেই স্যার?

আছেন মিস্টার ব্যানার্জি। তবে আমি অ্যাকাউন্টসও একটু একটু জানি। এক নাম্বার হতে হলে জ্যাক হতে হয়। জ্যাক অফ ওল ট্রেডস। বলেই, হাসলেন।

তারপর বললেন, ছি : পুওর লেডি। শি ইজ এলোন ওল ডে অ্যাণ্ড হাফওয়ে গ্রু দ্য নাইট। টাউনশিপে এলে কোনো কলিগ-এর স্ত্রীর কাছে জিম্মা দিয়ে দেন না কেন?

আমার কোনো কলিগ-এর স্ত্রীর সঙ্গে আজ অবধি আলাপ হয়নি। মানে, সময় হয়নি আলাপ করার।

ওও–ও। শেম শেম। সেটাও আমারই দোষ। মাথাই তুলতে পারেন না কাজ ছেড়ে। তার ওপর শনিবারেও তো আমার সঙ্গে মিটিং থাকে আপনাদের। নাঃ। আমি বোধ হয়…। মে বি আই অ্যাম মেকিং টু মাচ ডিম্যাণ্ডস অন ড্য।

কিছু মনে করবেন না স্যার। আপনার মিসেস রাগ করেন না? কখনো?

আমার মিসেস? হাঃ হাঃ। ইটস দ্য জোক অফ দ্য ইয়ার। মিস্টার ব্যানার্জি। আমার মিসেস থাকলে তো রাগ করবেন? বিয়েই কেউ করল না এই হতভাগাকে।

 তা বলবেন না স্যার। কী-ই-বা বয়েস আপনার! আমারই তো বয়েসি হবেন। আমাদের প্রাচীনপন্থী বাড়ি তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে দিলেন সকলে মিলে। মা, বাবা,কাকা, মায় ঠাকুরদা-ঠাকুমা পর্যন্ত আছেন তো!

আরে সে তো সৌভাগ্যের কথা মশায়। আজকাল এত সব কার থাকে? আর জয়েন্ট ফ্যামিলিই বা ক-টা আছে এখন! তা আপনি কোন আক্কেলে কলকাতা থেকে এখানে ট্রান্সফার নিয়ে এলেন? অমন সুখ কি আর কোথাও আছে? জয়েন্ট ফ্যামিলির সুখ?

আমার স্ত্রী ঠিক..

তাই?

বলেই এম ডি অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

 বললেন, হ্যাঁ সেটা বুঝি। আসলে কী জানেন, প্রত্যেক মেয়েই তার পুতুলখেলার দিন থেকে একটি নিজস্ব ঘর চায়, যেখানে সে-ই সম্রাজ্ঞী। এবং সেই সাম্রাজ্যটুকুর জন্যে তারা জীবনের অন্য অনেক প্রাপ্তিও ছেড়ে দিতে রাজি থাকে। অনেক কিছুই।

আপনি কী করে এত জানলেন স্যার?

আমি? আমি মানে…। মানে আমিও তো মানুষ। না কি? চারদিক দেখেশুনে জানলাম। নিজে বিয়ে না করলে কি অনুভব করা যায় না? তবে আমার কথা এখন থাক। নিন্দুকেরা কী বলে জানেন তো? বলে, আ ব্যাচেলর ইজ আ স্যুভেনির অফ আ উত্তম্যান হু হ্যাড ফাউণ্ড আ বেটার ওয়ান অ্যাট দ্য লাস্ট মোমেন্ট।

বলে, নিজেই নিজের রসিকতায় হেসে উঠলেন হো: হো: করে।

 গোপেনের গত তিন মাসের মধ্যে এই প্রথমবার মনে হল যে সুমন সেন একটা বোকার মতো রসিকতা করলেন। কথাটা মনে হওয়াতে গোপেন বেশ সুখী হল। মানুষটাকে এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে মনে হত। এম ডি-ও যে একজন সাধারণ মানুষ, অতিমানব-টানব কিছু নন একথা বুঝে আশ্বস্ত হল গোপেন।

বলল, এবার আমি আসি স্যার?

ও ইয়েস। ইয়েস।

 কোনো কারণে এম ডি অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন। কিন্তু কেন যে, তা গোপেন বুঝে উঠতে পারল না। বোঝার প্রয়োজনও অবশ্য বোধ করল না।

নিজের শপ-এ ফিরে গিয়েই লক্ষ করল কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। স্টোরকিপার একটি ছেলে তিন চার দিন হল বেশ নিজস্ব মর্জিতে কাজ করছে এবং মেজাজও করছে যার তার ওপর। এও লক্ষ করেছে গোপেন যে তাকে সকলে সমীহ করে চলছে। ছেলেটি বাঙালি কিন্তু বহুপুরুষ হল ওড়িশাতে সেটলড। ওড়িয়া যে নয় তা বোঝা যায় না।

গোপেন বলল এ কী রমেন! বিন-র্যাকে স্টোরসগুলো সব সাজিয়ে রাখলে না আজও? তা ছাড়া আমরা ফলো করি লিফো সিসটেম আর তুমি কার্ড-এ যে সিসটেম ফলো করছ তা তো ফিফো।

আমার দ্বারা হবে না স্যার। এই সব ম্যানুয়াল লেবারের কাজ বি কম পাস করে আমি এখানে করতে আসিনি। স্টোরস-এ আমার আরও জনা চারেক ম্যানুয়াল লেবারার দরকার।

তোমাকে সাহায্য করার জন্যে তো আটজন আছেন। তার ওপরে চাঁদসাহেব আছেন তোমাকে অ্যাসিস্ট করবার জন্যে। বলতে গেলে সব কাজ তো চাঁদসাহেবই করেন, মানে হাতের কাজ, তোমার তো ওভারঅল রেসপনসিবিলিটি।

তাহলে আমাকে সুপারফ্লয়াস বলছেন? পার্সোনেল ম্যানেজারকে লিখে দিন যে আমাকে অন্যত্র ট্রান্সফার করে দেবেন। আমার দ্বারা এত কাজ হবে না। ওভারটাইম দিলে হতে পারে।

ওভারটাইম তো এম ডি কোনো ডিভিশানেই অ্যালাউ করেন না জানো। হুরহুলাগড় ইণ্ডাস্ট্রিজ অন্য দশটা পাবলিক সেক্টর কোম্পানির মতো নয় রমেন। ঊ্য শুড নো হোয়াট আর উ্য টকিং অ্যাবাউট।

ওসব বড়ো বড়ো কথা শুনে আমাদের কী লাভ স্যার? নাম তো কিনছেন সুমন সেন। শুনতে পাচ্ছি এ বছর পদ্মশ্রীও পাবেন। তাতে আমাদের লাভ কী? আমরা নিজেদের আখের আগে দেখব। বণ্ডেড লেবার নাকি আমরা যে, যা খুশি তাই করাবেন আমাদের দিয়ে?

গোপেন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ওই সেকশনের অন্যদের মুখে একবার আস্তে করে চোখ ঘোরাল। তাদের মুখের ওপরে তার মুখটি ঘুরে যেতেই সে বুঝতে পেল রমেনের পেছনে অন্যদের কারোরই সাপোর্ট নেই। সম্ভবত বাইরের কোনো এলিমেন্ট রমেনকে প্রভাবিত করছে. হুরহুলাগড়ের সুনাম যাতে নষ্ট হয়, তার পরমবিস্ময়ের শ্রমিক-শান্তি যাতে বিঘ্নিত হয়; তারই কোনো গোপন চক্রান্ত্রর শিকার হয়েছে রমেন।

গোপেন বলল, আমার ঘরে গিয়ে আমি রিটন অর্ডার ইস্যু করছি তোমাকে রমেন। আজকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে এই লটগুলো প্রপারলি প্যাক করে রাখতে হবে। কোল ওয়াশারি থেকে রিকুইজিশান পাঠাবেন ওঁরা। পরশু থেকে দশ ট্রাক নতুন মাল কাল আসবে। এখন এমন রয়ে-সয়ে কাজ করার সময় আমাদের কারোরই নেই।

কবেই বা ছিল।

তাচ্ছিল্যের গলায় বলল রমেন।

 গোপেন নিজের ঘরে গিয়ে অর্ডার ডিকটেট করে সই করে রমেনকে ডেকে পাঠাল বেয়ারা দন্ডধরকে দিয়ে। দন্ডধর যেতে যেতে বলল রমেনবাবুকে ভবানী-পাটনার ইউনিয়নের লোকেরা এসে বদবুদ্ধি দিয়ে গেছে। আপনি সাবধানে থাকবেন স্যার। ওদের চক্ৰ বড়ো চক্র। সেমানে সব্বে তম্পসাদগ্ধ, অছি। বড়জামদা, নুয়ামুন্ডি, রাউরকেল্লা, টেনসা সব জায়গায় ওদের লোক আছে। আমাদের এখানে ইউনিয়ন করার জন্যে ওরা উসকানি দিচ্ছে। আপনাকে কী বলব স্যার এম ডি কে বে-ইজ্জত করার জন্যে অন্য অনেক গভর্নমেন্ট কোম্পানির এম ডি-দেরও মদত আছে এই রমেনদের পেছনে। এই চক্র বড়ো চক্র স্যার। সহজ ভাববেন না।

গোপেন নিজের চিন্তার কথা মুখে প্রকাশ না করে বলল, রমেনকে ডাকো।

রমেন এলে ননাটিশটি তার হাতে ধরিয়ে দিল গোপেন। যখন দিল তখন ঘরের মধ্যে টুল শপ-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মিশ্র সাহেব, গোপেনের পি এ এবং স্টেনোগ্রাফারও ছিলেন। এত লোকের সামনে রমেন নোটিশটি নিয়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দিল।

গোপেন এবং ঘরসুদ্ধ লোক রমেনের এই স্পর্ধাতে হতবাক হয়ে গেল।

রমেন ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে কিছু বলতে যেতেই গোপেন বলল, উ্য আর সাসপেণ্ডেড উইথ ইমিডিয়েট এফেক্ট। ফর ইনসাবর্ডিনেশান। নোটিশ, সিকিউরিটির লোকে আজই একটু পরে তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবে। আমি চার্জ শিট ড্র করব তাতে যা সময় লাগার লাগবে।

বলেই, ঘণ্টা বাজিয়ে দুজন সিকিউরিটির লোককে ডাকল গোপেন এবং বলল, রমেনবাবুকে কারখানার গেটের বাইরে পৌঁছে দিয়ে এসো আমার জিপে করে।

আমার সাইকেল আছে। স্ট্যাণ্ডে।

স্ট্যাণ্ডে গিয়ে সাইকেলটাও জিপের পেছন উঠিয়ে নিয়ো। সাইকেল-সমেত গেট পার করে দিয়ে এসো। রমেনবাবু, আপনাকে আমি তিন মাসের জন্যে সাসপেণ্ড করলাম। ফ্যাক্টরি এরিয়াতেও আপনি আসবেন না তিন মাস। অ্যাপিল করলে এম ডি-র কাছে করবেন।

রমেন হিন্দি সিনেমার হিরোর মতো কোমরে হাত দিয়ে বেঁকে দাঁড়িয়ে বলল, এর নতীজা ভালো নিকলাবে না স্যার।

সে দেখা যাবে। আপনার মতো একজন, এমন সুন্দর কাজের পরিবেশকে নষ্ট করবেন আর সেটা আমরা চুপ করে মেনে নেব তা মনে করবেন না। একজন মানুষের খামখেয়ালিপনার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দামি এখানের কাজ। আর্ক ফারনেস, ম্যাঙ্গানিজ ওর, কপার, অ্যালমনিয়ম, স্মেলটিং কলিয়ারি, কোল-ওয়াশারি ইত্যাদি সব কিছুতেই আপনার মতো ইনডিসিপ্লিনড ওয়ার্কারের প্রভাব পড়লে সবই নষ্ট হয়ে যাবে। আপনার মতো মানুষের জায়গা হুরহুলাগড় ইণ্ডাস্ট্রিজ-এ নেই।

 দেখা যাবে স্যার। আপনাদের মতো চামচে নিয়ে এম ডি সুমন সেন কতদিন ইউনিয়নকে ঠেকিয়ে রাখে এখানে। আমি চলে যাচ্ছি বটে কিন্তু এম ডিকে বলে দেবেন যে আমি একা নই। এত বড়ো এবং এতরকমের ইণ্ডাষ্ট্রিজ চলবে অথচ ইউনিয়ন করতে দেবে না তা হচ্ছে না।

হবে। ইউনিয়নের যদি কোনো প্রয়োজন থাকত এখানে তাহলে প্রথম দিন থেকেই ইউনিয়ন থাকত। এখানে আমরা সকলে মিলে খুশি হয়ে কাজ করি। ইউনিয়নের জন্যেই ইউনিয়ন, গলাবাজি আর কাজ নষ্টর জন্যে ইউনিয়ন এখানে সেনসাহেব করতে দেবেন না। আমাদের শ্রমিক এবং সব ক্যাডারের শ্রমিকরা যা সুযোগ-সুবিধা পান তা যদি অন্য কোনো কারখানার শ্রমিকরা, সে সরকারি বা বেসরকারিই হোক না কেন, পান বলে দেখাতে পারেন তবে সেনসাহেব দাবি মেনে নেবেন। কাজ নষ্ট করার জন্যে, ইউনিয়নের জন্যে ইউনয়ন সেনসাহেব করতে দেননি, দেবেনও না কোনোদিন।

দেখবেন স্যার।

সিকিউরিটি গার্ডেরা বলল, চালন্তু।

বাইধর জিপের স্টিয়ারিং-এ বসল। তারপর রমেনকে নিয়ে সিকিউরিটির লোকেরা পেছনে বসল। জিপটা চলে গেল। এবং চলে যেতেই গোপেন বাইরে এসে নিজে হাত লাগাল মালগুলোতে।

অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার মিশ্র বললেন, স্যার। দ্য লেসসন হ্যাজ বিন টট। ইউ হ্যাভ ডান দ্য রাইট থিং। আপনার হাত লাগাতে হবে না। দ্যাট ডাজ নট স্পিক অফ গুড ম্যানেজমেন্ট। যাঁরা করবার তাঁরাই করবেন। উ্য লিভ দ্য ম্যাটার টু মি।

 সমস্ত টুল শপ-এ একটি গুঞ্জন উঠল, যা হেম্বা সে ভাল হে! সে বারুঙ্গাটা এটি রহিলে সব্বে কাম ধান্দা চৌপট হইথান্তি।

একজন বলল, তাংকু সাঙ্গেরে গুণ্ডামানে অচ্ছি বাবু। আপুনি টিকে সাবধান হইকি রহিবে।

আ মু:। আম্মেমানে কঁড় হেব্বনি। এটি রহিচি? রমেন পান্থ বাবুকু কিছি করিলে আম্মেমানে কি রম্ভা চুষিবি? সেমতি দুঃসাহস তাংকু কেব্বেভি হেল্বে, ই মানিবাংকু হেব্ব যে সে ষড়া মরি সারিলা। আপনংকু কিছি, ভয় নাহি বাবু।

ঘটনাটি আধঘণ্টার মধ্যে পুরো হুরহুলাগড়ে চাউর হয়ে গেল। পার্সোনাল ম্যানেজার, সিকিউরিটি ম্যনেজার সকলে এম ডির অফিসে দৌড়ে গেলেন। সিকিউরিটি অফিসার ডি এম এবং এস পিকে খবর দেবার পক্ষপাতি ছিলেন। লেবার ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট, ভুবনেশ্বরে সি এম কে এমনকী দিল্লিতে ইণ্ডাস্ট্রিজ মিনিস্টারকে জানানোর কথাও কেউ কেউ বললেন। সুমন সেন কিছুই করলেন না। সিকিউরিটি অফিসার একটি মেজর ল অ্যাণ্ড অর্ডার ক্রাইসিস হবে বলে ভয় করছিলেন। এম ডি বললেন, কিছুই হবে না। ডোন্ট ওয়ারি। ইফ এনিথিং হ্যাঁপেনস দ্যা রেসপনসিবিলিটি উইল বি এন্টায়ারলি মাইন।

এস পি কেও জানাব না?

না। প্লিজ গেট ব্যাক টু ইওর ওয়ার্ক। এই নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা হোক এটা আমি চাই না। যা ঘটেছে তা ঘটবার ছিল। নাউ লেটস ফরগেট বাউট ইট।

সকলে চলে গেলে সেনসাহেব গোপেনকে ডেকে পাঠালেন।

গোপেনের জিপ ছিল না। দন্ডধরের সাইকেলে চেপে এসে পৌঁছে ঘরে ঢুকতেই এম ডি উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাঁণ্ডশেক করলেন। বললেন কনগ্রাচুলেশনস মি: ব্যানার্জি। আপনি যা করেছেন তা না করলে সিচুয়েশান পরে কন্ট্রোল করা যেত না। আমি নিজে কিন্তু প্রচন্ড লেবার মাইণ্ডেড। কাঁধ শ্রাগ করে বললেন, ইন ফ্যাক্ট আই অ্যাম ওলওয়েজ ফর দ্য লেবার অ্যাণ্ড এগেইনস্ট দ্য ম্যানেজমেন্ট। যদিও আমিই এই ক্লাসটার অফ ইণ্ডাস্ট্রিজের এম ডি। লেবারেরা যাতে বেস্ট অফ ট্রিট পায় তা প্রথম দিন থেকে আমি দেখে এসেছি। কিন্তু যদি কেউ কোনো আলটিরিয়ার মোটিভ নিয়ে আমাদের ডি-স্টেবিলাইজ করতে চায় তাকে তো প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। যায়? বলুন? এত লোকের পরিশ্রম, স্বপ্ন; নো। নেভার।

রমেনের পেছনে তো লোক আছে।

অবশ্যই আছে।

তবে?

আমাদের খুঁজে বের করতে হবে সে কে বা তারা কারা।

 সমস্যার গোড়া ধরে টান দিয়ে একে উপড়াতে হবে।

বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পি এ-কে বললেন, কলকাতার সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ কোম্পানিটার কী যেন নাম?

দ্য প্রাইভেট আই।

 ও দেবব্রত ধরের? পুলিশের ডি আই জি ছিলেন?

রাইট। আপনি জানলেন কী করে?

আমার স্ত্রীর মামার সঙ্গে ক্যালকাটা ক্লাবে একদিন দেখেছিলাম। কিন্তু উনি তো এখন বিদেশে।

তাই?

তবে ভুবনেশ্বরে রাউতকে ফোন করো।

রাউত কে স্যার?

আমার কলেজের বন্ধু। ইন ফ্যাক্ট র‍্যাভেনশ কলেজে দু-বছর করে ও কলকাতায় প্রেসিডেন্সিতে একবছর পড়েছিল। ওর বাবা ট্রান্সফারড হয়ে ওখানে চলে যাওয়াতে। তারপর আই এ এস-এ বসেছিল। পেয়েছিল, ফরেন সার্ভিস। কিন্তু নিল পুলিশের চাকরি। এখন ডি আই জি হেডকোয়াটার্স। ভুবনেশ্বরে। বাঘের বাচ্চা। দাও, লাইন দাও।

ইয়েস। কঁড়রে? রাউত সাহেব্ব? সেঠি বসিকি কঁড় করিছন্তি?

কঁড় করিবি আউ? তম ভেলিয়া এম ডি তো হেম্বা পারিনানি। কিচ্ছিতো করিবাকু হেব্ব।

হঃ! মু জানিছি। মাছু খাইবো ইলিসি, ইতা কইবো পুলিসি। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ হল। এম ডিও হাসলেন।

তারপর ভুবনেশ্বরে প্রাইভেট ডিকেটটিভ কে ভালো আছেন তাঁর খোঁজ করলেন রাউতসাহেবের কাছে।

রাউতসাহেব বললেন, তোর বউ ভেগেছে বুঝি কারো সঙ্গে?

না। তোর বউকে ভাগিয়ে আনব এবারে।

তোর অফিশিয়াল ব্যাপারে দরকার?

 হ্যাঁ।

আমিই করে দেব। ডি আই জি ইন্টেলিজেন্স এখন রথো আছে। আমারই ব্যাচমেট। কী প্রবলেম?

ফোনে বলব না।

কাল রথোর একজন লোক তোর কাছে যাবে।

প্লেন-ড্রেসে পাঠাতে বলবি।

হ্যাঁরে গাধা। ইন্টেলিজেন্স-এর লোকেরা প্লেইন ড্রেসেই যায়। গিয়ে তোর পি এ-কে বলবে পিসিকালচারের লোক। ফিশারিজ মিনিস্ট্রি থেকে যাচ্ছে। তোদের কারখানার ভেতরে পুকুর কেটে কার্প মাছের চাষ করা যায় কি না দেখতে এসেছে।

বাড়িতেই পাঠাস।

অফিসেই পাঠাব। তুই না হয় বাড়িতে নিয়ে যাস।

থ্যাঙ্ক উ্য।

তুই একদিন আয়। রথোসাহেবকেও নিয়ে আসিস। চম্পা কেমন আছে?

শি ইজ ইন দ্য ফ্যামিলি ওয়ে।

কনগ্রাচুলেশনস।

 হলে কী হয়। ছেলে কি মেয়ে যাই হোক তোর মতো দেখতে হবে।

কেন?

 সবসময়ই চম্পা তোর ছবিরই দিকে চেয়ে বসে থাকে। বলে, স্বামী করতে হলে সুমন সেনকেই করতে হত।

ষড়া! তু আজটু সে বদমাস ছুয়াটা রহিলি।

আউ কড় করিবি?

কিন্তু নিশ্চয় আসিব্বি চম্পাকু নেইকি? রথোসাহেবকু ফ্যামিলিকু নেইকি। গুট্টে উইক-এণ্ড এটিচ কাটাইকি জীবী। খরাপ লাগিবনি। আসিসকিতো দেখিকি যা।

হউ। আসিবি।

প্রমিস?

 প্রমিস।

 ফোনটা নামিয়ে রেখে সুমন বলল, যাক একটা প্রবলেম সলভড।

রমেন কাদের হয়ে এই ডিসরাপশান শুরু করেছে সেটা জানা গেলেই প্রবলেম আর্ধেক সলভড হয়ে যাবে। আচ্ছা! এবারে আপনি আসুন মিস্টার ব্যানার্জি। বাট কিপ দিস কনভার্সেশান আ সিক্রেট। ডোন্ট ডিসককাস উইথ এনি ওয়ান। নট ইভিন উইথ ইওর ওয়াইফ।

.

০৫.

ভরত আর শ্রী প্ল্যাটফর্ম থেকে হেঁটে ফিরে আসছিল বাড়িতে। সন্ধে সবে হয়েছে। তবে শুক্লপক্ষ। করলকাতার দিনগুলোতে কৃষ্ণপক্ষ-শুক্লপক্ষর কোনো তফাত বুঝতে পারা যেত না। এমনকী পূর্ণিমা-অমাবস্যারও নয়। হুরহুলাগড়ে যেমন কলকাতার অনেক কিছুই নেই, নেই বইমেলা, নেই ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল : নেই নিত্যনতুন হুজুগ তেমন আবার অনেক কিছু আছেও যা কলকাতার নেই।

সবচেয়ে বেশি করে যা বোঝা যায়, এই তফাত-এর মধ্যে, তা হচ্ছে এখানে প্রচুর শান্তি ও অবকাশ আছে। জীবিকার পেছন দৌড়েই জীবন এখানে শেষ হয়ে যায় না। মানসিক দিক দিয়ে তো নয়ই! অফিস যাওয়া-আসার কথা ভাবলেই মানুষ আতঙ্কিত বোধ করে না এখানে। গোপেন একথা সবসময়ই বলে। তা ছাড়া শ্ৰীর মনে হয় যে, গোপেন মানুষটার মধ্যে প্রায় মরচেই পড়ে আসছিল। ওই সরকারি সংস্থাতে থেকে থেকে কাজ ব্যাপারটা যে পুরোপুরিই রুজি-নির্ভর নয়, কাজের নিজের মধ্যেই যে প্রচন্ড এক ধরনের আনন্দ আছে এবং পরের কাজও ভালো করে করলে তাতে সবচেয়ে বেশি লাভ যে হয় নিজেরই; এমন কথা বিশ্বাস করতে পর্যন্ত ভুলে গেছিল গোপেন। এই হুরহুলাগড়-এর মতো বিচ্ছিরি নামের একটি সুন্দর জায়গাতে এসে গোপেন একেবারেই বদলে গেছে। এমনকী এতখানিই বদলেছে যে, শ্রীর রীতিমতো ভয় করছে যে নিঃসন্তান গোপেন বুঝি কাজকেই তার স্ত্রী এবং সন্তান দুই-ই করে ফেলবে। তাহলে শ্ৰী কী নিয়ে, কাকে নিয়ে বাঁচবে শেষপর্যন্ত?

স্টেশনে এলেই মন ভালো হয়ে যায় শ্রীর। এখানের পার্মানেন্ট স্টাফ এবং কুলিরা ছাড়া অন্য যাঁরা ট্রেনে করে আসেন যান তাঁরা কিছুক্ষণের জন্যে এখানের হয়ে উঠলেও এখানের আসলে কেউই নন। থেমে-থাকা ট্রেনের কামরায়, জানালার পাশে বসে এই চা। এই পান! এই শিঙাড়া। বলে হাঁক দেন। তারপর চা শিঙাড়া পান খেতে খেতে গার্ড সাহেবের হুইসেল বাজে, গাড়ি ছেড়ে দেয়। ডিসট্যান্ট সিগন্যালে আলো সবুজ থেকে লাল হয়ে যায় আবার। হঠাৎ নিস্তবদ্ধতা নেমে আসে।

 কেউ কেউ প্ল্যাটফর্মে নেমে কল থেকে জল ভরে নেন। চকিতে। আজই যেমন দেখা হল জয়িতার সঙ্গে। এরকম কত দিনের পুরোনো বন্ধু, দূরের আত্মীয়, মুখ-চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কলকাতায় যাদের সঙ্গে ফুটপাথে বা মিনির লাইনে দেখা হলেও কথা বলার উৎসাহ থাকত না আদৌ, তাদেরই এখানে কত কাছের মানুষ বলে মনে হয়।

আসলে জয়িতাই ওকে প্রথম দেখেছিল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের ভেতরটাকে দিনের বেলা অন্ধকার দেখায়। কিন্তু চেঁচিয়ে ডাকেনি ও অসভ্যতা হবে বলে। বাদামি, বড়ো বড়ো চেক-চেক লুঙ্গি পরা এক ভদ্রলোক, গায়ে সবুজ-রঙা খদ্দরের পাঞ্জাবি, হাতে বাদামি-রঙা পেট-মোটা জলের বোতল এবং প্রায় এককাঁদি মর্তমান কলা নিয়ে জল ভরতে যাচ্ছিলেন। তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে শ্রীকে বললেন, কিছু মনে করবেন না; আপনার নাম কি শ্রীপর্ণা? প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন আপনি?

শ্রীর পোশাকি নামটা যে শ্রীপর্ণা সেকথা সে প্রায় ভুলেই গেছিল। তাই চমকে উঠে বলল, হ্যাঁ।

ভদ্রলোক গম্ভীর উত্তেজনাহীন গলায় বাঁ-হাত উঠিয়ে মর্তমান-কলাক্রান্ত তর্জনীটি তুলে বললেন, আপনার মামাতো বোন মুনমুন-এর বান্ধবী জয়িতা, লেডি ব্রেবোর্ন-এর মনে আছে কি?

হ্যাঁ। হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।

 তিনি আপনাকে ডাকছেন। লাল সিল্কের শাড়ি পরে; ওই যে! জানালার ধারে।

 বলেই, ভদ্রলোক জলে চলে গেলেন আর শ্রী প্রায় দৌড়ে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল। উত্তেজিত হয়ে বলল, কী রে! তুই!

এখানে? কত্বদিন পর! শ্রীপর্ণা!

আর তুই?

বা :! আমার স্বামী যে ধড়কামডা রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার

। তা যাচ্ছিস, না আসছিস?

 আমার মেজো-জা-এর সেজো ছেলের ভাত ছিল। তাই গেছিলাম চেনকানল-এ।

একটি রাগী এবং অসভ্য শিশু ক্রমাগত জয়িতার গালে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে যাচ্ছিল। জয়িতা কিছু বলছিল না। অন্যজন সিটের তলায় রাখা একটি টিফিন ক্যারিয়ার খোলার অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছিল। অন্য কোনোদিকেই তার হৃক্ষেপ ছিল না। জয়িতার শাড়ির ক্যাটক্যাঁটে লাল রঙে এবং শিশুদের পোশাকেও সুরুচির বিন্দুমাত্র ছাপ ছিল না। যে জয়িতাকে কলেজে পড়ার সময় শ্রী চিনত তার সঙ্গে একে মেলাতে বড়ো কষ্ট হল ওর।

তোর ছেলে-মেয়ে?

হ্যাঁ। অশনি আর সংকেত।

বা :

মনে মনে ভাবল, সত্যজিৎবাবুর কতরকম মুগ্ধ ভক্তই না আছে। উনি নিজে যদি তা জানতেন। গণশত্রু নাম দিলেও ভালো করত। অথবা ভূমিকম্প এবং বহ্নিকন্যা। মনে মনে খুবই আশ্চর্য হল রোমান্টিক জীবন সম্বন্ধে স্বপ্নে ভরপুর জয়িতার এমন ল্যাজে-গোবরে অবস্থা দেখে। আশ্চর্য আরও বেশি হল একথা বুঝতে পেরে যে, জয়িতা নিজে জানে না যে সে কেমন ল্যাজে-গোবরে হয়ে গেছে।

ভালো আছিস?

 ভালোই। রোজগারপাতি ভালোই। বুঝলি না, বড়ো স্টেশান। লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, ভোলোমাইট, আরও কত কী সব চলাচল করে। সারাণ্ডার সাত-শো পাহাড়ের বনের কাঠ। উপরি খুব ভালো। চলে যাচ্ছে। ধড়কামড়া রড়বিলে বেশ কিছু বাঙালিও বাস করেন।

উনি কি তোর স্বামী?

প্রথমে অবাক হল শ্ৰী। এমনভাবে জয়িতা কথা বলছে যেন নিজের চাকরির কথাই বলছে ও। তারপর ভালো ভূগোলের ছাত্রী ছিল তাই বোধ হয়…

উনি কি তোর স্বামী?

হ্যাঁ। জয়িতা হেসে বলল, লুঙ্গি-পরা চেহারা দেখে ওকে ঠিক বোঝা যায় না। যখন রেলের ইউনিফর্ম পরে প্ল্যাটফর্মে ঘোরে তখন বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়।

পুরুষদের দেখতে হয় তাদের কাজের জায়গাতে, আর মেয়েদেরও তাই; তাদের বাড়িতে। কী বল?

শ্রী হাসল।

প্রায় বলেই ফেলেছিল, শ্রী! কথাটা ওকে। নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল এই জয়িতা। নিজে কত্ব বদলে গেছে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। বদলে যে যায়, সে জানতেই পারে না যে সে বদলে গেছে। কেউ সেকথা বললে হয়ত সে বিশ্বাস করে না, নইলে আহত হয়। নির্লজ্জর মতো তর্ক করে নিজেকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে।

কিছু বল?

কী বলব।

 আরে তুই এই হুরহুলাগড়-এর প্ল্যাটফর্ম-এ কী করছিস? এখানে কোথায় এসেছিস বেড়াতে? চামুন্ডির মন্দিরে মানত করতে এসেছিস বুঝি? ছেলে-মেয়ের জন্যে অনেকে মানত করে। খুব জাগ্রত দেবী! মুনমুন-এর কাছে গতবছর শুনেছিলাম যে তোর ছেলে-মেয়ে হয়নি। না কি বেড়াতে এসেছিস?

না। না। বেড়াতেও নয়।

 তাহলে? চাকরি করিস এখানে? কোনো স্কুলে?

 না।

তবে?

আমার স্বামী কারখানায় কাজ করেন।

ছিঃ ছি। এত লেখাপড়া শিখে প্রেসিডেন্সিতে পড়ে শেষে একজন কারখানার লেবারকে বিয়ে করলি! কী রুচি হল রে তোর?

আসল কথাটা না ভেঙে শ্রী বলল, কেন? শ্রমিক খারাপ কীসে? তা ছাড়া যে শ্রম করে, সে-ই তো শ্রমিক।

সে তুই যা বলিস।

মুনমুন কেমন আছে? মামারা টাটায় চলে যাওয়ার পর তো আর আমাদের সঙ্গেও দেখা হল না। কত্ব বছর হয়ে গেল। গত বছর তোর মতোই খড়গপুর স্টেশানে দেখা হয়েছিল।

 মুনমুন দিল্লি আছে। হ্যাঁ ভীষণ মোটা হয়ে গেছে। একটি মারুতি গাড়ি কিনেছে বলছিল। তাতেও আঁটে না। নিজেই বলে, হেসে গড়াচ্ছিল।

ওর স্বামী কী করেন?

ও বাবা : পারচেজ ম্যানেজার। তার হাতে বছরে সত্তর কোটি টাকার অর্ডার। হ্যারাসমেন্ট করবেন না এই জন্যেই শুধু একপার্সেন্ট পায়। আর খুব খেলে তো পাঁচ সাত দশ পার্সেন্টও পেতে পারত। তা সত্তর কোটির একপার্সেন্ট কত হয়?

শ্ৰী বোকার মতো বলল, কত?

সত্তর লাখ টাকা রে বোকা!

গাড়ির ঘণ্টা বাজল। আজকাল রেলের একটি টুকরো ঝুলিয়ে তাতে লোহা পিটে ঢং ঢং শব্দ করে না। ইলেকট্রিক বেল বাজে।

এমন সময় জয়িতার স্বামী ফিরে এলেন। পুরি তরকারি, কলা ও জল নিয়ে।

ওমা। আমার চা? বন্ধুকেও খাওয়াতে পারতাম।

 এখানে চা পাউডার মিল্কের। সব দুধ চলে যায় টাউনশিপ-এ। পরের স্টেশনে খাওয়াব।

এই যে আমার স্বামী, হরনাথ। আমার বন্ধু শ্রীপর্ণা।

শ্ৰী মনে মনে বলল, নাম যিনি দিয়েছিলেন তাঁর বাহাদুরি আছে। হর হর মহাদেব দিলে আরও ভালো হত।

 জয়িতা বলল, মুনমুন, তোদের এই হুরহুলাগড়ের যে বড়োসাহেব, তাকে খুব ভালো করে চেনে। একবার তো বেড়াতে এসেছিল ওর স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে, এখানে।

কে বড়োসাহেব? এখানে গন্ডা গন্ডা বড়োসাহেব আছেন।

 সে কী রে! তোর স্বামী এখানে চাকরি করেন আর বড়োসাহেবেরই নাম জানিস না?

চাকরি তো স্বামীই করেন। আমি তো করি না!

অ। বড়োসাহেবের নাম সুমন সেন। দারুণ নাম করেছে রে। পুরো ইণ্ডিয়াতে। এমন অনেস্ট অফিসার নেই। আসলে ইডিয়ট। পরে পস্তাবে।

গোড়ায় গোড়ায় কতজনকে দেখলাম অমন অনেস্টি করতে। পু!

 মুনমুন চিনল কী করে, সুমন সেনকে?

আরে মুনমুন-এর স্বামীর ব্যাচের। প্রেসিডেন্সির। একসঙ্গে পড়ত দুজন।

তা মুনমুন তো তোর সঙ্গে লেডি ব্রেবোর্ন-এ পড়ত, তাই না?

আহা! বললামই তো মুনমুনের স্বামী।

শ্রীর খুব ইচ্ছা করল যে জিজ্ঞেস করে জয়িতাকে, মুনমুনের স্বামী কোন ব্যাচের? তারপরে ভাবল, বেশি ইনকুইজিটিভনেস দেখানো হবে। থাক। নিজের মামাতো বোনের খবর অন্যর কাছ থেকে নিতে…

আরেকটা ঘণ্টা দিল।

হরনাথবাবু কলা খেতে খেতে বললেন, একবার আসবেন ধড়কামড়ায়, ঠাকুরানি পাহাড়, জোড্ডা, গুয়া, নুয়ামুন্ডি সব দেখিয়ে দেব। লৌহ আকরের লাল দগদগে পাহাড়, ম্যাঙ্গানিজের নীল পাহাড়। আসবেন কিন…

এইটুকু বলা হতেই অশনি অথবা সংকেত কেউ গণশত্রুর মতো একথাবড়া দিয়ে হরনাথবাবুর মুখের কলাটি নিয়ে নিল। হরনাথবাবু বললেন, এত্বে অঝভ্য।

জয়িতা বলল, ভারি দুষ্টুমি করছ কিন্তু তোমরা। এবারে কিন্তু সত্যিই বকে দেব।

 ট্রেনটা ছেড়ে গেল। শ্ৰী হাত নাড়ল। নিজের হাতটাকে অন্যর হাত বলে মনে হচ্ছিল। সাড় নেই। জয়িতা কনুই অবধি সোনার চুড়ি পরা ডানহাতটি নেড়ে যেতে লাগল সমানে।

ট্রেনটা চলে যাবার পরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শ্রী প্ল্যাটফর্মে।

জয়িতার এই আমূল পরিবর্তন ওকে বড়ো ধাক্কা দিয়ে গেল। জয়িতা আর জয়িতা নেই। পুরোপুরিই হরনাথের স্ত্রী হয়ে গেছে। অথবা গণশত্রু। ইচ্ছে করলে জয়িতা তার জীবনকে এবং নিজের জীবনকেও অন্যরকম করতে পারত। পুরুষেরা যে খারাপ কি ভালো হয় তার পেছনে তাদের স্ত্রীদের এক বিশেষ ভূমিকা থাকেই! এই কথাটা মনে করে, ওর শিরদাঁড়ায় শিহরন খেলে গেল হঠাৎ। শ্রী নিজেও কি আর শ্রী আছে? সেও কি গোপেন ব্যানার্জির স্ত্রী নয় শুধুই? যে-শ্রীকে সুমন বলে একটি ছেলে ভালোবাসত সে তো আর বেঁচে নেই। ইচ্ছে করলেও তাকে আর বাঁচাতে পারবে না শ্রী নিজে। অন্য কেউ এসে যদি কোনোদিন বাঁচায় তো অন্য কথা!

ভরত বলল, মা, এখানে দাঁড়িয়েই থাকবে বাড়ি যাবে না?

স্টেশান থেকে ওদের বাড়ি আসতে একটি দোমোহানা পড়ে। তার ওপর কজওয়ে আছে। বর্ষাকালে এই দুই নদীতে নিশ্চয়ই বান আসে। তখন বানের জল এই কজওয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। একটি নদীর রং লাল আর অন্যটির নীল। মনে হয় স্বপ্নের নদী। বড়ো বড়ো কতগুলো মহুয়াগাছ আছে লাল নদীটির পাশে। আর কতগুলো চাঁর গাছ। নীল নদীটির পাশে। প্রতিদিন বিকেলে স্টেশন যাওয়া-আসার পথে এখানে কিছুক্ষণ চুপটি করে দাঁড়ায় শ্রী। এদিকে গাড়িঘোড়া নেই-ই বলতে গেলে। এই পথটি ওদের বাড়ি হয়ে জুরাণ্ডি হয়ে ঘন নীল পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। সেখানে নাকি খুব জাগ্রত দেবীর মন্দির আছে বলে শুনেছে শ্রী। একদিন যাবে ভেবেছে। কিন্তু কে নিয়ে যাবে? ওই বোধ হয় চামুন্ডি মন্দির। যার কথা বলছিল জয়িতা।

কজওয়েটির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল শ্ৰী। জঙ্গলের দিক থেকে তিতির আর বনমুরগি ডাকছিল। দিনের আলো মরে গেছে অথচ চাঁদের আলোও পুরো ফোটেনি। অপরূপ এক বিভাতে ছেয়ে রয়েছে পাহাড়তলি, স্টেশান, লাল রং করা স্টেশানের ওভারব্রিজ, বহুদূরের হুরহুলাগড়ের বিভিন্ন কারখানার মস্ত মস্ত শেড। অতিকায় সব বুক-চেতানো বা কাছিমপেঠা প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের মতো।

ভরত আবারও, বলল, ঘরকু জীব্বেনি? মা?

জীব্বীরে জীবী পিলা। টিকে থই ধরতো তু!

ঠি আছি।

 সুমন সেন। মুনমুনের স্বামীদের সঙ্গে পড়ত, একব্যাচে? প্রেসিডেন্সিতে…মুনমুন-এর স্বামী প্রণয় তো শ্রীদেরই ব্যাচমেট ছিল। সুমু।

না:। নাঃ। তা হতেই পারে না।

বহুদিন পর শ্রীর অন্ধকার, নোংরা, ধুলোবালি-ভরা বুকের ভেতরটার মধ্যে যেন দু-শো হর্সপাওয়ার-এর কোনো মরচে-পড়া জেনারেটর হঠাৎই চলতে শুরু করল। বাতি জ্বলতে লাগল এক এক করে। কিন্তু আওয়াজ? বড্ড আওয়াজ আর ধুলো। ভীষণই কষ্ট হতে লাগল শ্রীর বুকের মধ্যে। অনেক অনেক পুরোনো কথা ফিরে আসতে লাগল মাথার মধ্যে। এই সুমন তার সুমন হতেই পারে না। অসম্ভব!

ভরত বলল আবার, জীব্বে, কি জীব্বে না?

 চাল। ছিলো!

বলে, অস্ফুটে জিভ-এ একটি আওয়াজ করে শ্রী ভরতের সঙ্গে ধীর পায়ে হেঁটে এগোতে লাগল।

একটু পরই স্টেশানের সামান্য শোরগোল পেছনে পড়ে রইল। এখন চারপাশ শান্ত। ঝিঁঝির ডাক। কোনো বাড়িতে শাঁখ বাজল। দূরের প্রায়ান্ধকার পাহাড়তলিতে হট্টিটি পাখি ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে ডাকতে লাগলো হট্টিটি হুট, হট্টিটি হুট।

শ্ৰী সারাপথ কোনো কথা বলল না।

বুদ্ধিমান ভরত একবার অবাক হয়ে তাকাল শ্রীর মুখের দিকে। তারপর চুপ করে মুখ নামিয়ে পাশে পাশে হাঁটতে লাগল।

বাড়ি ফিরে ভরত বলল, পারিবা কঁড় করিবি? সকালের পনস থিলা। বিরি ডাল্ব। আউ কঁড় করিবি?

আমি জানি না। তোর যা খুশি কর। দাদাবাবু এলেই না হয় জিজ্ঞেস করিস।

 বলেই, শ্ৰী শোবার ঘরে চলে গেল।

 কলকাতা থেকে আসার সময় ব্যক্তিগত জিনিস প্রায় কিছুই আনতে পারেনি। তবে একটি চামড়ার ব্যাগ এনেছিল। চিঠিপত্রে-ভরা। আলমারি খুলে, ওই ব্যাগটি বের করে পাগলের মতো হাতড়াতে লাগল শ্ৰী। হাতড়াতে হাতড়াতে বেরুল একটি বড়ো খাম। তার মধ্যেই সব ক-টি চিঠি একসঙ্গে করা ছিল। এবং খামটি বাঁধা ছিল রাবার ব্যাণ্ড দিয়ে।

 খামটি খুলে চিঠিগুলো বের করল। খুব বেশি চিঠি নেই। গোটা দশের কলকাতা থেকে লেখা আর গোটা দশের ইংল্যাণ্ড থেকে। শ্ৰী, সুমনের প্রতি অন্যায় করেছিল। সুমনের মতো ছেলে যেখানেই যাক বা থাকুক না কেন, ওর প্রতি মেয়েরা যে আকৃষ্ট হবেই, কথাটা শ্রীর জানা উচিত ছিল। তবে শ্রী যে শ্রীই সেকথাও সুমনের জানা উচিত ছিল। সেইটে সুমন ভুলে গেছিল বলে এবং সুমন যে সুমনই এ কথাও শ্রী ভুলে গেছিল বলেই এই বিপত্তি। এখন আর কিছুই করার নেই। শিক্ষিত মানুষের জীবনে যেমন অনেক আশীর্বাদ থাকে তেমন অভিশাপও নেহাত কম থাকে না। প্রথম অভিশাপ এই অহং। একটি ভুল করে ফেলে বাকি জীবন সেই ভুলকেই দাঁতে দাঁত চেপে আঁকড়ে ধরে থাকার মূখামি শিক্ষিত মানুষকে এই অহংই জোগায়। প্রকৃত শিক্ষিতদের অহং থাকে না। থাকা উচিত নয়। কিন্তু শ্রীদের মতো শিক্ষিতদের। শিক্ষার গুমোরসর্বস্বতাই হয়তো শিক্ষাকে মাটি করে দেয়।

সুমনের যে অনেক বান্ধবী, তাদের মধ্যে কারো কারো সঙ্গে যে সে স্টেডি যাচ্ছে এ খবর সুমনই দিত তার উচ্ছ্বাসমসয় চিঠির মাধ্যমে, শ্রীকে। সুমনের চরিত্র ছিল হাজারদুয়ারি। তাতে আলো হাওয়ার প্রবেশধিকার যেমন ছিল অবাধ তাতে একটু ধুলোময়লাও জমত না। শ্রীর রক্ষণশীল মনে অতখানি আলো হাওয়া কখনও সইবার মতো যথেষ্ট শক্ত-পোক্ত বাতাবরণ ছিল না। ফলে সুমন তাকে যতই চিঠির পর চিঠি লিখত বিদেশ থেকে, শ্ৰী ততই গুটিয়ে যেত ক্রমাগত।

একটা চিঠি বেরুল। চিঠিটি পড়বার আগে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে এল শ্ৰী। যদি হঠাৎ গোপেন ফিরে আসে। গোপেনদের পরিবার শ্রীদের পরিবারের চেয়ে আরও অনেকই বেশি রক্ষণশীল।

স্ট্যাটফোর্ড অন অ্যাভন।
রবিবার

 শ্রী, শ্রীময়ী আমার,

তোমার কি হাঁদাকে মনে আছে? লাস্ট বেঞ্চে বসে থাকত। অফ পীরিয়ডে পুঁটিরামে গিয়ে লুচি আর ছোলার ডাল খেত এবং আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলত যে, চারু মজুমদার মানুষটি অত্যন্ত কনফিউজড? বলত, মজুমদার মশায় নিজের কনফিউশন বাচ্চা ছেলেদের মধ্যে ইনফিউস করে দিয়ে কতগুলো ব্রিলিয়ান্ট ছেলের ফিউচার ফর্সা করছেন বলেই ওঁকে মেরে দেওয়া উচিত।

একথা শুনেও সেইসব দিনে হাঁদাকে আমরা যে সত্যিই মেরে দিইনি তা আমাদের মহত্ত্বই বলতে হবে।

সেই হাঁদা এখন লানডান স্কুল অফ ইকনমিক্স-এর একজন নামি ছাত্র। এবং এখন সে-ই এখানে নকশাল আন্দোলনকে নতুন করে আরম্ভ করার চেষ্টা করছে। আয়ারল্যাণ্ডে ঘুরে এসেছে ইতিমধ্যে দু-দুবার। আণ্ডারগ্রাউণ্ড কনটাক্টও এস্টাব্লিশ করেছে বলে শুনেছি। ওর নিজের উদ্ভাবিত ইকনমিক সিসটেম অফ দ্য ফিউচার ওয়ার্ল্ড দারুণ নাম করেছে। লোকে বলছে, অমর্ত্য সেনের পর এত বড়ো মেধাবী ছাত্র নাকি আর হয়নি। বাঙালি। এবং ভারতীয়।

তোমাকে চুপি চুপি বলি যে লানডান স্কুল অফ ইকনমিক্স-এ অথবা আমাদের দেশের ডুন স্কুলে পড়লেই যে সকলেই কিছু ক্ষণজন্মা পুরুষ বা নারী হবেন এমন কোনো কথা নেই। আমার স্বচক্ষে দেখা প্রচুর স্যাম্পল আছে এই দুই স্কুলেরই, যা ওই দুই স্কুলেরই লজ্জার। সেকথা থাক। হাঁদাদের চালাক হওয়ার কোনো ইতিহাস যদি কখনো লেখা হত তবে আমাদের হাঁদার নাম তাতে জ্বলজ্বল করত। এইটেই তোমার এবং আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের কথা।

 হাঁদার এক কাজিন এসেছে কলকাতা থেকে। তার নাম, উজ্জ্বল। অথচ এমন প্রকৃত নিষ্প্রভ ছেলে আমি খুবই কম দেখেছি। এই মুহূর্তে সে আমাকে ও হাঁদাকে অ্যাভন নদীর পাশে ঘাসের মধ্যে থেবড়ে বসিয়ে রেখে শেক্সপিয়র সাহেবের (ছেলেবেলায় যাঁকে আমরা শেক্ষপিয়র বলে জানতাম, যেমন ম্যাক্সমুলারকে মোক্ষমূলার। কতরকম বিপদ কাটিয়েই না আমরা বড়ো হয়ে উঠেছিলাম। এল) বাড়ি দেখতে গেছে। তিনি কোন চেয়ারে বসে লিখতেন, কোন কমোড-এ বসে ইয়ে করতেন ইত্যাদি ইত্যাদি। শেক্সপিয়র সাহেবের লেখা পড়লে তাঁকে যতটা সম্মান করা হয় তার ছিটেফোঁটাও যে তাঁর কমোডের প্রতি অনিমেষে চেয়ে থাকলে করা হয় না, এই কথাটা উজ্জ্বল অথবা নিষ্প্রভ কোনো ছেলেকেই যে বোঝাতে পারিনি এটা আমারই দুর্ভাগ্য বলতে হবে।

প্রায় প্রতি শনি-রবিবারেই, বিশেষ করে সামার-এ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবন্ধবদের বিলেত দর্শনের সাধ জাগে। আজকালকার নচ্ছার এয়ারলাইন্সগুলো যে ভাড়াতে গোটা-গোটা রোগা মোটা যাত্রীদের উগরে দিয়ে যায় এখানে সে ভাড়ায় হয়তো কলকাতা থেকে ভাগলপুর কিংবা সমস্তিপুরেও যাওয়া যায় না। অতএব অনেকই আদেখলা প্রতিবছর ফোরেন বেড়ানোর জন্যে দুগগা বলে ঝুলে পড়ে। বর্ষে বর্ষে দলে দলে তাঁরা আসেন। এদের সামলে তারও পর বাসন মেজে, কুলি খেটে পড়াশুনো করা যে কী চিত্তির তা আমরাই জানি।

তুমি তো এলে না আমার সঙ্গে।

এলে, এই সাদা চামড়ার মেয়েগুলো আমার সুন্দর উজ্জ্বল চামড়া নিয়ে এমন আদিখ্যেতা করতে পারত না।

তুমিই একদিন বলেছিলে যে, যাদের কনসার্ভ করার মতো কিছু থাকে তারাই কনসার্ভেটিভ হয়। বাক্যটির মধ্যে চমক নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আজকের প্রেক্ষিতে, তেমন ভার নেই। আধুনিক বিশ্বে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই কিছুই কনসার্ভ করার নেই। কারণ এই বিশ্বের নিজের আয়ুরই কোনো স্থিরতা নেই। তা ছাড়া প্রতিটি রক্ষিত বস্তুই প্রতিমুহূর্তে ভেতরে বাইরে বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তার আধার এবং আবরণ। তার আভরণও। এবং নিজের অজান্তে সে নিজেও যাচ্ছে বদলে। সেই জন্যই বলি যে, রক্ষণশীলতা আজ আর কোনো গুণ নয়, আজ তা দোষ; প্রতিবন্ধকতা। পারিবারিক বাধা কোনো বাধাই নয়। যারা পারিবারিক বা দেশজ বা পরিবেশগত বাধাকে বাধা বলে মেনে নেয় আজকেও, তারা তাদের নিজের মনের ভেতরকার বাধা ভাঙবে কী করে? সেই বাধাই তো আসল বাধা। যে নিজের অন্তর্জগৎকে প্রসারিত প্রতিসরিত করে অন্যকে প্রভাবিত করতে না পারল তার লেখাপড়া শেখাই যে বৃথা হল। আদর্শ স্ত্রী হয়ে, স্বামীর অনুষঙ্গ হয়ে, তার সন্তান গর্ভে ধারণ করেই যদি নারীজন্ম সার্থক করতে চাইতে হত তবে তো আঠারোতে বিয়ে করে এতদিনে সে ধর্ম অর্ধেক সার্থক করা যেত। তাও করলে না তুমি অথচ আধুনিকা নারী যে অর্থে আধুনিক সঙ্গিনী, সেই নারীও হয়ে উঠতে পারলে না।

এখনও এল তো আমি তোমাকে স্পনসরশিপ পাঠাচ্ছি। অক্সফোর্ড ছেড়ে দিয়ে লানডান-এ চলে যাব। বেইজওয়াটার স্ট্রিটে বেড-সিটার এরিয়াতে একটি ঘর নিয়ে দুজনে থাকব। লিভটুগেদার করব।

তোমার আপত্তি?

পড়াশুনোর মনে পড়াশুনো হবে, শরীর-মন চেনাও হবে তার সঙ্গে। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা মিছিমিছি নষ্ট করে কী হবে? সব কিছুই একই সঙ্গে করা উচিত। অন্তত এই যুগে। পায়ে দাঁড়াতে পুরুষ অথবা নারীর দুজনেরই যদি এত সময় লাগে আজকাল তবে জীবনযাপন আর কবে করা হবে?

 রোদে শুয়ে, এলমেলো কথা লিখতে ভারি ভালো লাগে। মনে মনে তোমাকে এলমেলো করে নিতেও ভালো লাগে। রেবেকা আর পামেলা বলে দুটি মেয়ে আমার জীবনের খুব কাছাকাছি এসে গেছে। শরীরেরও। শরীরটা কোনো ব্যাপারই নয় এদের কাছে। মানুষের শরীরচর্চার চেয়ে যে তার মনের চর্চা অনেকই বেশি দামি একথাটা শরীরকে অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত মর্যাদা দিতে দিতেই তোমরা ভুলতে বসেছ। শরীরের কাছে আসতে দিতে তোমরা এমনই বায়নাক্কা করো, এতখানিই সময় নাও; কাছে আসতে আসতেই যৌবন শেষ হয়ে যায়। যৌবনের বাগানে ফুল ফোঁটাবে আর কখন?

নিজেকে ভালোবেসো। আমাকে ভালোবেসো। এবং আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো। শুধু পড়াশুনোই নয়, এদেশ থেকে এমন বিদ্যা শিখে যাচ্ছি যা তোমার ওপর প্রয়োগ করে রীতিমতো চমকে দেব। তুমিই হবে আমার ক্রসিবল। আমার সব রঙিন পরিকল্পনার আধার।

ভালো থেকো।

ইতি তোমার সুমু।
ইয়েস! ইওরস ওনলি।

 চিঠিটি পড়তে পড়তে শ্রীর দুচোখ ঝাঁপসা হয়ে এল। শ্রীর বিয়ের চিঠি পর্যন্ত পাঠায়নি সে সুমনকে। বিয়ের কথা শুরু হবার পর থেকেই তাকে চিঠি লেখা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। বাধাটা সত্যিই যতখানি না বাইরের ছিল তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল ভেতরের। তার নিজের বাড়ি, মামাবাড়ি, তার ভাবী শ্বশুরবাড়ি আজকেও এতখানি রক্ষণশীল যে তাদের সকলের সঙ্গে ঝগড়া করার মতো জোর শ্রীর একার ছিল না। তার ওপরে সুমনের ওপর ওর যে অভিমান জমেছিল, সেই অভিমানের কথাও ও কখনো খুলে বা গুছিয়ে সুমনকে বলতে পারেনি। সুমন যেমন অবলীলায় নিজেকে খুলতে-মেলতে পারে তার চিঠিতে কিছুমাত্রই বাকি না রেখে, শ্ৰী তা কখনোই পারেনি। ভাষার ওপর এমন জোর কখনোই শ্ৰীর ছিল না যে সুমনের মতো নিজেকে সুব্যক্ত করতে পারে। হয়তো কম মানুষেরই থাকে।

সুমন যে সুমনই!

কিন্তু গোপেনের এম ডি, হুরহুলাগড়ের সুমনই যে শ্রীর সুমন একথা তো ঠিক নাও হতে পারে! ঠিক হতেই পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *